এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • রাগ দরবারীঃ ১১শ পর্ব

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৩ মে ২০২১ | ২০১৬ বার পঠিত
  • এই গাঁয়ে ‘কানা’ বোলে তো পন্ডিত রাধেলাল। ওর একটা চোখ অন্যটির চেয়ে ছোট, তাই ‘গঁজহা’র দল ওকে কানা বলে ডাকে।

    আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য হল- এক হিসেবে আমাদের সবকিছুই প্রাচীন ঐতিহ্য — কেউ বাইরে, মানে অন্য রাজ্যে, যাবে তো কথায় কথায় বিয়ে করে নেবে। অর্জুনের সঙ্গে চিত্রাংগদা আদি উপাখ্যানে তাই হয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রবর্তক রাজা ভরতের পিতা দুষ্যন্তের সঙ্গেও তাই। যারা আজকাল ত্রিনিদাদ কি টোবাগো, বর্মা কি ব্যাংকক যাচ্ছে তাদের সঙ্গেও ঠিক ওইসব হচ্ছিল। এমনকি আমেরিকা বা ইউরোপে গেলেও একই হাল। সেই হাল হল পন্ডিত রাধেলালের। অর্থাৎ যে ব্যাটা নিজের পাড়ায় থাকতে নিজেদের সমাজের এক ইঞ্চি বাইরে বিয়ে করার কথায় ভির্মি খায়, যেই সে দেশের বাইরে পা রাখে অমনই বিয়ের ব্যাপারে কেশর ফোলানো সিংহ হয়ে ওঠে। দেবদাস নিজের পাড়ার মেয়ে পার্বতীকে বিয়ে করার হিম্মত জোটাতে পারল না, উলটে একটা গোটা প্রজন্মের জন্যে কান্নাকাটির মশলা ছেড়ে গেল। ওকে যদি একবার বিলেত পাঠিয়ে দেয়া যেত, তাহলে ও নি;সংকোচে কোন ফর্সা মেম বিয়ে করে ফেলত। দেশের বাইরে গেলে আমরা হরদম যা করি সেটা হল প্রথমেই কাউকে বিয়ে করে ফেলা এবং তারপর ভাবতে বসা যে এই বিদেশ- বিভুঁইয়ে কী করতে এসেছি যেন? লোকে বলে যে পন্ডিত রাধেলালও একবার পূবদেশে গিয়ে কিছু করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু একটা মাসও কাটল না— উনি ওই ‘কুত্তি’কে বিয়ে করে শিবপালগঞ্জে ফিরে এলেন।

    একবার পূর্বাঞ্চলের কোন জেলায় একটা চিনির কলে পন্ডিত রাধেলালের চাকরি পাওয়ার জোগাড় দেখা যাচ্ছিল। চৌকিদারের চাকরি। উনি গিয়ে আরেকজন চৌকিদারের ঘরে থাকতে লাগলেন। তখন পন্ডিত রাধেলালের বিয়ে হয়নি। এদিকে ওঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল মেয়েছেলের হাতের রান্না খেতে না পাওয়া। সাথী চৌকিদারের স্ত্রী কিছুদিনের জন্যে এই সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়েছিলেন। রাধেলাল ওদের বাড়িতে শুতে এবং দু’বেলা খেতে লাগলেন। একটি বিশ্বপ্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে যে নারী উদরের গলিপথ ধরে পুরুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে। ওই নারীও রাধেলালের পেটে সিঁধ কেটে শনৈঃ শনৈঃ ওর হৃদয়ের দিকে গুটি গুটি এগোতে লাগলেন। ওই মহিলার হাতের রান্না রাধেলালের এত ভাল লাগল এবং মহিলাটি নিজের হাতে ওর পেটের মধ্যে খোঁড়া সিঁধে এমন ফেঁসে গেলেন যে একমাসের মধ্যে মহিলাটিকে রাধেলাল নিজের খাবার বানাতে শিবপালগঞ্জে নিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। চলে আসার সময় আগের বাড়ি থেকে বছর-দু’বছরের ঘরে বসে খাওয়ার মত রসদও সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর চিনি মিলের এলাকার লোকজন ভাবল— রাধেলালের বন্ধু চৌকিদারটি এক্কেবারে ভোঁদাই। এদিকে শিবপালগঞ্জের লোকজন বলল — রাধেলাল হল মরদ কা বেটা! তার আগে ওই এলাকার লোকজন রাধেলালকে চিনত ‘কখনও জব্দ না হওয়া সাক্ষী’ হিসেবে, এখন চিনল ‘কখনও সুযোগ ফস্কাতে না দেওয়া মরদ’ হিসেবে। রাধেলাল এভাবে বিখ্যাত হয়ে গেল।

    অবশ্যি, ওই ‘কখনও জব্দ না হওয়া সাক্ষী’ খ্যাতিটিই রাধেলালের জীবিকার পুঁজি। ও নিরক্ষর এবং সাক্ষরের আলোআঁধারিতে আদালতে দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে “আমি লেখাপড়া শিখিনি” অথবা ‘খালি দস্তখত করতে পারি’ গোছের কোন একটা দরকারমত বলতে পারে। কিন্তু দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনকানুনের এমন প্রখর জ্ঞান যে ও যেকোন মামলার সাক্ষী হয়ে যেকোন পক্ষের হয়ে বয়ান দিতে পারে। কোন উকিল আজ অব্দি ওকে জেরা করে জব্দ করতে পারে নি। যেভাবে যেকোন জজ তার এজলাসের যেকোন মামলার রায় দিতে পারে, যে কোন উকিল যেকোন মামলার ওকালত করতে পারে ঠিক তেমনই পন্ডিত রাধেলাল যেকোন মামলার ‘আই-উইটনেস’ হতে পারে। সংক্ষেপে, মোকদ্দমাবাজির শৃংখলে জজ, উকিল, পেশকার, মুহুরির মত রাধেলালও একটি অনিবার্য গাঁট। আর যে ইংরেজি আইনের মোটরগাড়িতে চড়ে আমরা বড় গর্বের সঙ্গে ‘রুল অফ ল’ বলে চেঁচাই, তার চাকার ‘টাইরড’ হল রাধেলাল এবং সেই সুযোগে ও আইনের শাসনের গতিকে ইচ্ছেমত এদিক-সেদিক করে। একবার যখন এজলাসে দাঁড়িয়ে ও ‘মা গঙ্গার দিব্যি, ঈশ্বরের দিব্যি-যাহা বলিব, সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না’ বলে শপথ নেয়, তখন বিরোধী পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট অব্দি বুঝে যায় যে আর যাই হোক, ও সত্যি বলতে আসেনি। কিন্তু বুঝে হবেটা কি কচুপোড়া, ফয়সালা তো বুঝদারিতে হবেনা, আইন মোতাবেক হবে। অথচ পন্ডিত রাধেলালের জবানবন্দী শুনতে যাই মনে হোক, আইনের বিচারে একদম নিখাদ।

    রাধেলালের সম্মান যেমনই হোক, ওনার প্রেয়সীর ব্যাপারে গাঁয়ের হিসেব একদম স্পষ্ট। ও স্বামীকে ছেড়ে পালিয়ে এসেছে, অতএব ‘কুত্তি’। লোকেরা ওকে আওয়াজ দিতে পারে, কারণ সবার বিশ্বাস ওর আওয়াজ খেতে ভাল লাগে। শিবপালগঞ্জের ছোঁড়াদের কপাল ভাল যে কুত্তিটাও ওদের নিরাশ করেনি। সত্যিই ওর লাইন মারা বা আওয়াজ খাওয়া খুব ভাল লাগত, তাই আওয়াজের পালা চুকলে ওর গালির ফোয়ারা ছুটত। আর গালাগাল তো ‘গঞ্জহা’দের অভিব্যক্তির সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈলী।

    শনিচর এবার রঙ্গনাথকে রাধেলালের কিসসাটা বেশ নাটকীয়ভাবে শোনাচ্ছিল। তখনই ওই তিনটে ছোঁড়ার একজন এসে বৈঠকখানার দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল। খালি গা’, শরীরময় আখাড়ার মাটি, ল্যাঙ্গোটের পট্টি কোমর থেকে পা’ পর্য্যন্ত হাতির শুঁড়ের মত দোলা খাচ্ছে। এদানীং শিবপালগঞ্জে যেসব ছোকরা ল্যাঙোট পরে চলাফেরা করে তাদের মধ্যে এই স্টাইলটাই বেশ জনপ্রিয়। শনিচর প্রশ্ন করল, ‘কী ব্যাপার ছোটে পালোয়ান’?

    পালোয়ান শরীরের জোড়গুলিতে দাদ চুলকোতে চুলকোতে বলল, ‘আজ বদ্রীভাইয়াকে আখাড়ায় দেখলাম না যে? কোথায় টপকেছে’?

    - ‘টপকাবে কেন, এদিক সেদিক কোথাও হবে’।
    - ‘গেছে কোথায়’?

    ‘ইউনিয়নের সুপারভাইজার ট্রাকে গমের বস্তা ভরে গায়েব হয়ে গেছে। সেই নিয়ে ইউনিয়নের মিটিং চলছে। বদ্রীও ওখানেই হবে’।

    পালোয়ান নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চাতালে পিচ করে থুতু ফেলল। ‘বদ্রীভাইয়া মিটিংযে বসে কি ডিম পাড়বে? সুপারভাইজার ব্যাটাকে পাকড়ে এক ধোবিপাট আছাড় দিত, তাতেই শালার দম বেরিয়ে যেত। মিটিং শিটিং করে হবেটা কী’?

    রঙ্গনাথের কথাটা মনে ধরল। বলল, ‘তোমাদের এখানে মিটিংযে বুঝি ডিম পাড়ে’?

    পালোয়ান এপাশ থেকে কোন প্রশ্ন আসবে ভাবে নি। জবাবে বলল, ‘ডিম পাড়বে নাতো কি বাল ছিঁড়বে? সবাই মিটিংযে বসে রাঁড়ের মত কাঁও কাঁও করবে আর আসল কামকাজের বেলায় খুঁটি জাপ্টে ধরবে’।

    হিন্দিভাষার বাগধারার এই রূপের সঙ্গে রঙ্গনাথের বিশেষ পরিচয় ছিলনা। ও ভাবল, লোকজন খামোকাই আফশোস করে যে আমাদের ভাষায় মজবুত শক্তিশালী শব্দের নিতান্ত অভাব। যদি হিন্দি সাহিত্যের ছাত্রদের চারমাসের জন্যে ছোটে পালোয়ানের মত আখাড়ায় পাঠানো হয়, তাহলে কিছু ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ওরা ওখানকার মাটির ছোঁয়ায় এ’ধরণের শব্দকোষ গড়ে তুলবে। শনিচর এবার ছোটে পালোয়ানের দিকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে ভাল করে আড্ডা দেয়ার মতলবে ভেতরে ডেকে নিল — ‘ভেতরে এস পালোয়ান’।

    ‘বাইরে কি মাথায় বাজ পড়ছে? আমি এখানেই ফিট’। তারপর ছোটে পালোয়ান একটু আত্মীয়তা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার কেমন চলছে রঙ্গনাথ গুরু’?

    রঙ্গনাথ নিজের ব্যাপারে ছোটে পালোয়ানের সঙ্গে বেশি কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। দু’বেলা দুধ-বাদামে সাঁটিয়ে আখড়ায় কুস্তির গল্প কফি হাউসে খুব একটা পাত্তা পায়না। কিন্তু ছোটে পালোয়ান এই নিয়ে একটা গোটা রাত কাবার করে দিতে পারে। রঙ্গনাথ বলল, ‘আমি তো একদম ফিট, এবার তোমার হালচাল শোনাও। সুপারভাইজার ব্যাটার হঠাৎ গম বেচে দেয়ার কি দরকার পড়ল’?

    ছোটে পালোয়ান ফের তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চাতালের উপর থুতু ফেলল, ল্যাঙোটের ঝুলন্ত পট্টি কষে বাঁধল এবং এইসব ব্যর্থ চেষ্টার মাধ্যমে এটা বোঝাতে চাইল যে ও ন্যাংটো নয়। এভাবে ও রঙ্গনাথের সমপর্যা্য়ে এসে বলল - আরে গুরু, ওর হাল হল ‘পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি’। লক্ষনৌ শহরে দিনরাত ফুট্টূফৈরি করে বেড়াত; বিনা মশলা কিসের ফুট্টূফৈরি, কিসের ইন্টূমিন্টু? গম বেচবে না তো কী?

    -- এই ফুট্টূফৈরি কী জিনিস?

    পালোয়ান হেসে ফেলল। ‘ফুট্টূফৈরি শোননি? ওই শালার শালা বড় মাগীবাজ। তা ‘মাগীবাজি কি ছেলের হাতের মোয়া? বড় বড় মানুষের পেছন ফেটে যায়। জমুনাপুরের জমিদারী এতেই ছারখার হয়ে গেছল’।

    দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা যায় ইংরেজি ফিলিম দেখতে। ইংরেজি ডায়লগ বুঝতে পারেনা তবু মুচকি মুচকি হেসে দেখাতে চায় খুব বুঝেছে আর সিনেমাটা বেশ হাসির। অজ্ঞতা ঢাকতে রঙ্গনাথও তাই করছিল। পালোয়ান বলে চলেছে, ‘আমি এই রামস্বরূপ সুপারভাইজারের নকশাবাজি গোড়া থেকেই বুঝে গেছলাম। বদ্রী পালোয়ানকে তখনই বলেছিলাম, ওস্তাদ, এ ব্যাটা লক্ষনৌ যায় মাগীবাজি করতে। তখন তো বদ্রী ওস্তাদেরও বিশ্বাস হয়নি। বলেছিল - বেশি টিক টিক করিস না ছোটু। শালা কাঠ খাবে তো আঙরা হাগবে’।

    এখন দেখ, কাঠও খাওয়া হল, আবার ট্রাকভর্তি গম উড়িয়ে নিয়ে গেল। গোড়াতে তো বৈদজী মহারাজও ধামাচাপা দিচ্ছিলেন।এখন জোয়ারের গু’ ভেসে উঠেছে তো সবাই ইউনিয়ন অফিসে বসে ফুসুর ফুসুর করছে। শুনছি, প্রস্তাব পাশ করবে। প্রস্তাব না ঘোড়ার ডিম! ফসল-গুদামের সারা ফসল তো রামস্বরূপ ফাঁক করে দিয়েছে। এখন প্রস্তাব পাশ করে ওর কি ছেঁড়া যাবে?

    রঙ্গনাথ — বদ্রীকে খামোখা বলেছিলে। তখন যদি বৈদ্যজীকে গিয়ে খুলে বলতে তাহলে উনি সেদিনই সুপারভাইজারকে ওখান থেকে সরিয়ে দিতেন।

    ‘আরে গুরু, আমার মুখ খুলিও না। বৈদ্যজী তোমার মামা, আমার কী? আমার বাপ তো নয়। সত্যিটা যদি ঠূঁসে দিই তো তোমার কলজেতে গিয়ে চোট লাগবে’।

    শনিচর বাধ দিল, ‘ছোটু পালোয়ান, খুব যে রঙবাজি ঝাড়ছ, ভালকরে ভাঙ চড়িয়ে এসেছ মনে হচ্ছে’?

    ‘বেটা, রঙবাজির কথা নয়, আমার তো একেকটা রোঁয়া জ্বলছে। সব্বার লেজ তুলে দেখ, খালি মাদী আর মাদী। বৈদ্য মহারাজের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস না করলেই ভাল। ওর হিসেবের খাতা খুলে বসলে সমানে গরম ভাপ বে্রোতে থাকবে। সামলানো মুশকিল হবে। এই রামস্বরূপ এতদিন বৈদ্যজীর মুখে মুখ, তিনরকমের কথাবার্তা। আজ যখন দু’গাড়ি গমের বস্তা ভরে গায়েব হয়ে যেতেই দু’দিন ধরে টিলটিল করছেন! আমিও ইউনিয়নের সদস্য, বলেছিলেন মিটিনে এসে প্রস্তাবের পক্ষে হাত তুলে দিও। বললাম-আমাকে হাত-টাত তুলতে বোল না মহারাজ।একবার যদি হাত তুলি তো লোকজনের পিলে চমকে যাবে। হাঁ, ওই ব্যাটা রামস্বরূপ রোজ শহরে চসর-পসর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় ওকে ধরে এনে লালবাড়িতে আটকে রাখার ব্যবস্থা হবে, তা না, প্রস্তাব পাশ কর। বদ্রী উস্তাদ রেগে কাঁই, কিন্তু করবেটা কি, নিজেরই বাপ। যদি কাপড় খুলে উরুত দেখাও তো লাজ, আবার ওটা খুলে দেখাও তো লাজ’।

    এবার বৈঠকখানার সামনের দিকে লোকজনের আগমনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। চাতালে খদ্দরের ধুতিপাঞ্জাবি ও তিরছে টুপি পরা সৌম্যদর্শন বৈদ্যজী মহারাজের আবির্ভাব হল। পেছন পেছন কয়েকজন ভক্তবৃন্দ, সবার পেছনে বদ্রী পালোয়ান। দেখামাত্র ছোটে এগিয়ে এল, ‘ওস্তাদ, একটা জবরদস্ত ফান্টুশ মামলা।বলব বলে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি’।

    ‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোগা হয়ে গেলে নাকি? মামলাটা কী ঝেড়ে কাশো’।

    এভাবে শিষ্যের অভর্থনা করে গুরুশিষ্য চাতালের আরেক কোণে গিয়ে নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় ডুবে গেল।

    বৈদ্যজী জনাচার-পাঁচ চ্যালাকে নিয়ে বৈঠকখানার ভেতরে গেলেন। একজন আরাম করে এমন এক লম্বা শ্বাস টানল যা ফোঁপানিতে শেষ হল। আরেকজন তক্তপোষে গুছিয়ে বসে এক লম্বা হাই তুলল যে ওটা ধীরে ধীরে বদলে গেল তীব্র সিটির আওয়াজে। বৈদ্যজীও কম যান না। উনি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে টুপি আর কুর্তা খুলে এমন কায়দায় তক্তপোষের অন্য মাথায় ছুঁড়ে ফেললেন যেন কোন বড় গায়ক লম্বা তানের শেষে সমে ফিরল। বোঝা গেল যে সবাই কোন বড় কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে গা’ এলিয়ে দিয়েছেন। শনিচর বলল, ‘মহারাজ কি খুব ক্লান্ত? তাহলে আর একবার (ভাঙের) শরবত ছেঁকে দিই’?

    বৈদ্যজী কিছু বলেননি, কিন্তু ইউনিয়নের এক ডায়রেক্টর বললেন - দ্বিতীয় নম্বর তো মিটিংয়ের মাঝখানেই হয়ে গেছ। এবার বাড়ি যাওয়ার নম্বর।

    এতক্ষণ বৈদ্যজী চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শুনছিলেন। এই ওনার অনেক পুরনো অভ্যেস। কারণ উনি অনেক আগে শিখেছিলেন — যে ব্যক্তি নিজে কম খেয়ে অন্যদের বেশি করে খাওয়ায়, নিজে কম বলে অন্যদের বেশি বলতে দেয়, সেই কম বোকা বনে অন্যদের বেশি করে বোকা বানায়। হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠলেন — রঙ্গনাথ, তুমি কী বল?

    যেভাবে বৈদ্যজী ব্যাপারটা কী সেটা খোলসা না করে রঙ্গনাথের অভিমত জানতে চাইলেন, সেও সেই ভাবে ব্যাপারটা কী সেটা না বুঝে ও বলে উঠল — আজ্ঞে যা হয়, সেটা ভালর জন্যেই হয়।

    বৈদ্যজী গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে বললেন - তুমি ঠিকই বলেছ। বদ্রী গোড়ায় প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল, শেষে ও চুপ মেরে গেল। প্রস্তাব সবার সমর্থনে পাশ হয়ে গেল। যা হল তা’ ভালর জন্যেই হল।

    রঙ্গনাথের খেয়াল হল যে খামোকা নিজের রায় জাহির করে ফেলেছে। এবার ও একটু উৎসুক হয়ে জানতে চাইল — আপনারা কোন প্রস্তাব পেশ করেছিলেন?

    ‘আমরা প্রস্তাব - সুপারভাইজার আমাদের যে আটহাজার টাকার ক্ষতি করেছে তার ভরপাই করতে সরকার আমাদের অনুদান দিক’।

    এমন যুক্তি শুনে রঙ্গনাথের মাথা ঘুরে গেল।

    --‘সরকারের কী মাথাব্যথা? তছরূপ করবে আপনার সুপারভাইজার আর খেসারত দেবে সরকার’?

    - ‘নইলে কে দেবে? সুপারভাইজার তো গা’ঢাকা দিয়েছে। আমরা পুলিশে খবর দিয়েছি। এখন সরকারের দায়িত্ব। আমাদের হাতে কিস্যু নেই। যদি থাকত, তাহলে সুপারভাইজারকে ধরে এনে ওর থেকে গমের দাম পাইপয়সা আদায় করে ছাড়তাম। এখন যা করার সরকার করুক। হয় ওকে বন্দী করে আমাদের সামনে পেশ করুক, নয় অন্যকিছু করুক। যাই হোক, যদি সরকার চায় যে আমাদের ইউনিয়ন বেঁচে থাকুক এবং জনগণের কল্যাণ করুক তাহলে আমাদের অনুদান দিক। নইলে ইউনিয়ন পথে বসবে। আমরা আমাদের যা করবার করে দিয়েছি, এবার সরকারের পালা। ওরা কত অপদার্থ, তাও আমার ভালই জানা আছে’।

    বৈদ্যজী এমন নিখুঁত যুক্তি সাজাচ্ছিলেন যে রঙ্গনাথের মাথার ঘিলু নড়ে গেল। উনি বারবার কিছু শব্দ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আওড়াচ্ছলেন, যেমন ‘সরকারের অকর্মণ্যতা’, ‘জনগণের কল্যাণ’, ‘দায়িত্ব’ ইত্যাদি। রঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে ওর মামা পুরনো প্রজন্মের বটে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের পছন্দের ভাষা ভালই রপ্ত করেছেন।

    বদ্রী পালোয়ান ছোটে পালোয়ানের সঙ্গে পরামর্শ সেরে ফিরে এসেছে।বলল, ‘রামাধীনের বাড়িতে ডাকাতি হয়নি, তবে এদিক ওদিক কিছু ছিঁচকে চুরির খবর আসছে’।

    পালোয়ান বাবার সামনে একটু সামলে সুমলে কথা বলে। এই কথাগুলো ও এমনভাবে বলল যেন ছোটের সঙ্গে এতক্ষণ এই আলোচনাই হচ্ছিল যা বাবাকে জানিয়ে দেওয়া ওর পরম কর্তব্য।

    বৈদ্যজী বললেন, ‘চুরি! ডাকাতি! সর্বত্র এই খবর। দেশ রসাতলে যাচ্ছে’।

    বদ্রী পালোয়ানের যেন এসব কথা কানে যায় নি। একজন হেলথ ইন্সপেক্টর যেভাবে জনসাধারণকে কলেরা নিবারণের উপায় বোঝায় তেমনই ভাবে বলল, ‘গোটা গাঁয়ে এখন খালি চুরির চর্চা। আমাদের জেগে ঘুমোতে হবে’।

    শনিচর লাফিয়ে উঠে নিজের জায়গা বদলে বদ্রীকে জিজ্ঞেস করল, ‘জেগে আবার ঘুমোয় কী করে পালোয়ান’?

    বদ্রী কড়াস্বরে বলল, ‘টিকির টিকির করবে না তো! আজকে ইয়ার্কি-ফাজলামি ভালো লাগছে না’।

    তারপর ও অন্ধকারে চাতালের কোণায় গিয়ে ছোটে পালোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১৩ মে ২০২১ | ২০১৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন