এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • রাগ দরবারী (৭ম পর্ব)

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১০ এপ্রিল ২০২১ | ২২২৬ বার পঠিত


  • ছাতের কামরাটি সংযুক্ত পরিবারের পাঠ্যপুস্তকের মত সবসময় খোলা পড়ে থাকে। ঘরের কো্নে একজোড়া মুগুর, মানে সরকারিভাবে ঘরটার মালিক বড়ছেলে বদ্রী পালোয়ান। তবে পরিবারের অন্য সদস্যরাও নিজেদের ইচ্ছেমত ঘরটার ব্যবহার করে থাকে। মহিলারা নানান কিসিমের কাঁচের বয়াম ও মাটির পাত্রে নানাধরণের আচার ভরে ছাতে রোদ খাইয়ে বিকেল হবার মুখে ঘরটার মধ্যে ভরে দেন। ছাতে শুকুতে দেয়া কাপড়চোপড়েরও একই হাল। কামরার ভেতরে এ’মুড়ো থেকে ও’মুড়ো অব্দি একটা দড়ি টাঙানো। তাতে সন্ধ্যের পর ল্যাংগোট ও চোলি, বক্ষবন্ধনী ও সায়া একসাথে দোলা খায়। বৈদ্যজীর ফার্মেসি থেকে একগাদা ফালতু শিশি একটা আলমারি ভরে রাখা। অধিকাংশই খালি। কিন্তু তাতে দু’রকম লেবেল সাঁটা—‘ওষুধ খাওয়ার আগে’ আর ‘ওষুধ খাওয়ার পর’। প্রথমটায় একটা অর্ধমানবের ছবি, পরেরটায় এমন চেহারা যার গোঁফে তা’, ল্যাঙ্গোট কষে বাঁধা। অর্থাৎ, বোঝা যায় যে এই সেই শিশি যা হাজার নবযুবকদের সিংহ বানিয়ে দিয়েছে। তবে কথা হল, এরা সব স্নানের ঘর এবং শোবার ঘরের মধ্যেই সিংহবিক্রমে চলা ফেরা করে, কিন্তু বাইরে বেরোলে নিরীহ ছাগলছানা হয়ে যায়।

    একধরণের সাহিত্য আছে যার বিষয় ‘গুপ্ত’ এবং ‘ভারতে ইংরেজ রাজত্ব’ গোছের বইয়ের চেয়েও ভয়ংকর। কারণ এই ধরনের বই ছাপিয়ে ফেলা ১৯৪৭ সালের আগে তো নিষিদ্ধ ছিলই, এখনও অপরাধের আওতায় পড়ে। এই ধরণের সাহিত্য অফিসের গোপন ফাইলের মত গোপন হয়েও গোপন নয়, এবং এরা আহার-নিদ্রা ও ভয়ে ভয়ে কাটানো মানবজীবনে নিঃসন্দেহে এক আনন্দময় লিটারারি সাপ্লিমেন্টের কাজ করে। এছাড়া এরা সাহিত্যের কুলীন এবং জনপ্রিয় সাহিত্যের কৃত্রিম শ্রেণীবিভাগের বেড়া টপকে ব্যাপকহারে জনগণেশের হৃদয়ে আসন পাকা করে নেয়। এতে এমনকিছু রহস্য নেই। খালি বর্ণনা করা হয় যে কোন পুরুষ অন্য পুরুষ বা নারীর সঙ্গে কেমন করে কী কী করেছিল। অর্থাৎ কবি সুমিত্রানন্দন পন্থের দার্শনিক ভাষায় বললে ‘মানব মানবীর চিরন্তন সম্পর্কে’র বর্ণনা।

    এই ঘরটা এমন সব সাহিত্য পড়ার জন্যেও কাজে আসে, আর বোঝা যায় যে পরিবারের একমাত্র ছাত্র হওয়ার ফলে এই সব অধ্যয়ন একমাত্র রূপ্পনবাবুই করে থাকেন। এটুকুই নয়, ঘরটা রূপ্পনবাবুর অন্য কাজেও লাগে। যে সুখ পেতে অন্যদের চাই রুটির টুকরো, গাছের ছায়া, পানপাত্র ও প্রেমিকা, তা’ উনি এই কামরাতেই পুরোপুরি আদায় করে নিতেন।

    এই কামরায় পরিবারের সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পতাকা ওড়া দেখে লোকজন স্থানীয় সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারে। এই ঘরটা একবার দেখলে নিঃসন্দেহ হবেন যে পূর্ব গোলার্ধে সংযুক্ত পরিবারে কোন দিক থেকেই কোন বিপদের আশংকা নেই।

    রঙ্গনাথের এই কামরায় ঠাঁই হল। এখানে ও চার-পাঁচ মাস থাকবে। বৈদ্যজী ঠিক বলেছেন। এম এ পড়তে পড়তে রঙ্গনাথও অন্য সব ছাত্রের মত দুর্বল হয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই জ্বর হত। সমস্ত গড়পড়তা হিন্দুস্থানী নাগরিকের মত রঙ্গনাথেরও আধুনিক ডাক্তারিতে বিশ্বাস নেই, তবু ওষুধ খাচ্ছিল, এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। সব শহুরেদের মত ওরও বিশ্বাস যে শহরের ওষুধ আর গ্রামের হাওয়া্য কোন তফাৎ নেই। তাই ও এখানে মামাবাড়িতে কয়েকমাস থাকতে এসেছে। এম এ করার পর চাকরি না পেয়ে ও অন্য গড়পড়তা মূর্খদের মত পিএইচডি করতে নাম লেখাল। আবার সাধারণ বুদ্ধিমানদের মত ওর এটাও জানা ছিল যে রিসার্চ করতে হলে রোজ ইউনিভার্সিটিতে হাজিরা দেয়া এবং লাইব্রেরিতে বসে থাকার কোন মানে নেই। তাই ও ভাবল যে কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে আরাম করি, শরীর ভাল করি, পড়াশুনো করি, দরকার পড়লে মাঝে মাঝে শহরে গিয়ে বই পালটে নিয়ে আসি। আর মাঝে মাঝে মামাবাবু মানে বৈদ্যজীকে শিষ্ট ভাষায় এটা বলার সুযোগ করে দিই—হায়, আমাদের নবযুবকেরা অকর্মার ধাড়ি! নইলে আজ আমাদের মত বুড়োদের ঘাড়ে এতসব দায়িত্বের বোঝা চাপে !

    উপরের কামরাটি বেশ বড়সড়। রঙ্গনাথ এসেইই ওর এক কোনায় নিজের রাজ্য আলাদা করে নিল। ঘরটা সাফসুতরো করিয়ে তাতে একটা চারপাই আর একটা বিছানা পাকাপাকি ভাবে পাতা হল। পাশের আলমারিটিতে ওর বইপত্তর ভরে তাতে গোয়েন্দা সিরিজ বা ‘গুপ্তজ্ঞান’ গোছের বই রাখা নিষিদ্ধ হল। কলেজ থেকে এসে গেল একটা ছোটখাট টেবিল আর চেয়ার। খাটিয়ার পাশে একটা জানলা যা খুললে বাগান এবং চাষের ক্ষেত চোখে পড়ে। এই দৃশ্য রঙ্গনাথের জীবনকে কবিত্বময় করে তুলল। কখনও কখনও ওর সত্যি সত্যি মনে হত ওর সামনে কত ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কত রবার্ট ফ্রস্ট, কত গুরুভক্ত সিং মিলে একটা অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছে।ওদের পেছনে রয়েছে অনেক স্থানীয় লেখক তুরী আর শিঙে ফুঁকতে ফুঁকতে যাদের বুক হাপরের মত উঠছে আর নামছে।

    রূপ্পনবাবু কোত্থেকে কিছু ইঁটের টুকরো এনে জুড়ে টুরে একটা রেডিওর আকার বানিয়েছিলেন। কামরার ছাদের বাঁশ আর আশেপাশের গাছগাছালির সাহায্যে লম্বা লম্বা তার এমন ভাবে টাঙানো হয়েছিল যেন এই কামরাটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় ট্রান্সমিশন সেন্টার। কিন্তু সেন্টারের ভেতরের রেডিওটি শুনতে কানে একটা হেডফোন লাগানো জরুরি। রঙ্গনাথ কখনও সখনও ওটা কানে লাগিয়ে স্থানীয় সংবাদ ও বৈষ্ণব সন্তদের কান্নাকাটিমার্কা ভজন শুনতে পেত। ও বুঝে যেত যে অল ইন্ডিয়া রেডিও দশবছর আগে যা ছিল এখনও তাই। এত গাল খেয়েছে তবু বেহায়ার মত জিদ ধরেছে যে - পরিবত্তোন চাইনে।

    রঙ্গনাথের দৈনিক রুটিন বৈদ্যজীর পরামর্শে তৈরি হয়েছে।

    সাতসকালে উঠতে হবে, উঠে ভাবতে হবে যে কালকের খাবার ঠিকমত হজম হয়েছে।

    ব্রাহ্মে মূহুর্তে উত্তিষ্ঠেৎ জীর্ণাজীর্ণং নিরুপয়েৎ।

    তারপর তামার লোটায় রাত্তিরে রাখা জল খাও, বেশ খানিকটা বেড়িয়ে নিত্যকর্ম ষেরে এস।কারণ সংসারে ওই একটা কাজই নিত্য, বাকি সব অনিত্য। তারপর রয়েছে হাত-মুখ ধুয়ে নিমের বা বাবুলের দাঁতন চিবোনো, হাত এবং দাঁত পরিষ্কার করা।

    নিম্বস্য তিক্তকে শ্রেষ্ঠঃ কষায়ে বব্বুলস্তয়া।

    এরপর একের পর এক-- কুসুম গরম জলে কুলকুচি করা, ব্যায়াম করা, দুধ খেয়ে পড়তে বসা, দুপুরের খাবার, বিশ্রাম, আবার পড়াশুনো, সন্ধ্যের মুখে একটু বেড়িয়ে আসা, ফিরে এসে সাধারণ ব্যায়াম, বাদাম-মুনক্কার শরবত, আবার পড়া, রাতের খাবার, পড়া এবং নিদ্রা।

    রঙ্গনাথ এই রূটিন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে মেনে চলল। তবে তাতে সামান্য পরিবর্তন। পড়ার বেশিরভাগ সময় বৈদ্যজীর বৈঠকখানার দরবারে ‘গঞ্জহা’দের সঙ্গে খোশগল্পে কাটতে লাগল। বৈদ্যজী এই পরিবর্তনে অখুশি নন, কারণ এতে রঙ্গনাথের বীর্যরক্ষায় কোন ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বাকি সব মেনে চললেই হল। একদিকে এই দরবারে ভাগ্নের নিয়মিত হাজিরায় উনি খুশি, কারণ একজন লেখাপড়া জানা লোক তাঁর দরবারে রয়েছে এবং বাইরের লোকজনের কাছে গর্বের সঙ্গে পরিচয় করানো যাচ্ছে।

    কিছুদিনের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হল যে যা কোথাও নেই তাও শিবপালগঞ্জে আছে, আর যা শিবপালগঞ্জে নেই তা কোথাও নেই; ঠিক মহাভারতের মত। এটাও বিশ্বাস হল যে ভারতবাসী সর্বত্র এক, আমাদের বুদ্ধিটুদ্ধি সবজায়গায় একই রকম। যেসব পাঁয়তারা প্যাঁচ-পয়জারের প্রশংসায় নামজাদা খবরের কাগজগুলো প্রথম পাতায় বড় বড় হেডলাইনে মোটা মোটা অক্ষরে রোজ চেঁচায়, যার ধাক্কায় বড় বড় নিগম, কমিশন এবং প্রশাসন ডিগবাজি খায়, ওসবের একগাদা অখিল ভারতীয় প্রতিভা শিবপালগঞ্জে কাঁচামালের মত এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে। ভেবে ভেবে ভারতের সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতি ওর আস্থা আরও মজবুত হল।

    কিন্তু একটা জিনিস এখানে নেই।ও দেখেছিল যে শহরে পুরনো ও নতুন প্রজন্মের মধ্যে এক বিতর্ক শুরু হয়েছে। পুরনো প্রজন্মের বিশ্বাস আমরা অনেক বুঝদার, অনেক বুদ্ধিমান। আমাদের পরে গোটা দুনিয়ায় বুদ্ধি ব্যাপারটাই গায়েব হয়ে গেছে, নতুনের জন্যে ছিটেফোঁটাও বাঁচেনি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের দৃঢ় বিশ্বাস যে পুরনোর দল হল অল্পে খুশি হওয়া স্থবির, সমাজের প্রতি দায়িত্বহীন। আর আমরা? আমরা সচেতন, কোন কিছুতেই সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার বান্দা নই, নিজের স্বার্থের প্রতি নিষ্ঠাবান, এবং সমাজের প্রতি আস্থাহীন, কারণ সমাজ বলে আজ আর কিছু নেই।

    এই সব তর্ক-বিতর্ক বিশেষ করে সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রে বেড়ে উঠছিল, কারণ অন্য সব বিষয়ের জায়গায় সাহিত্য ও শিল্পের ক্ষেত্রের জাল অনেক বেশি ছড়ানো, কিন্তু সবচেয়ে কম লোকসানদায়ক। পুরানো দের চোখে নতুনরা মূর্খ আর নতুনদের চোখে প্রাচীনেরা সব ভাঁড়—ব্যাপারটা এদ্দুর গড়িয়েছে যে সাহিত্য-শিল্পকলা না হয়ে অন্য কিছু হলে এতদিনে গৃহযুদ্ধ বেঁধে যেত। রঙ্গনাথ প্রথমে ভেবেছিল নতুন-পুরনোর এই লড়াইয়ের শহুরে ব্যামো শিবপালগঞ্জে ছড়ায়নি। একদিন ওর ভুল ভেঙে গেল। দেখল এখানেও ওই নতুন-পুরনোর লড়াই। এখানকার রাজনীতি এব্যাপারেও কিছু কম নয়।

    শুরু হয়েছিল একটি চোদ্দ বছরের ছেলেকে নিয়ে। এক সন্ধ্যার বৈঠকে একজন শিবপালগঞ্জের ওই ছেলেটির জীবন-চরিত ব্যাখ্যা করা শুরু করল।বোঝা গেল যে ছোঁড়াটার মধ্যে বদমাশ হওয়ার ক্ষমতা এতটাই প্রবল হয়ে উঠল যে বড় বড় মনোবৈজ্ঞানিক ও সমাজবিজ্ঞানী একে প্রভূর মায়া বলে মানতে বাধ্য হন। শোনা যায় যে আমেরিকায় পড়ে দেশে ফেরত আসা কিছু বিদ্বান ছেলেটার বিষয়ে রিসার্চ করেছিলেন। ওঁরা চাইছিলেন ওঁদের বইয়ের বাঁধা থিওরির —ভেঙে যাওয়া পরিবার, অসৎসঙ্গ, খারাপ পরিবেশ, বাপ-পিতামো’র ক্রিমিনাল রেকর্ড ইত্যাদি- ফ্রেমে ছেলেটাকে ফিট করাতে, কিন্তু সে ছেলে কোনমতেই ওই ফেমে বাঁধা পড়তে রাজি নয়।

    এতে ওই পন্ডিতদের ব্যর্থতা নয়, বরং আমাদের দেশের যোগ্যতা প্রমাণিত হয়।আমরা আজকাল ধনবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি-বিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞান আদির ক্ষেত্রে এমন সব প্র্যাক্টিক্যাল সমস্যা এক তুড়িতে তৈরি করে দিই যে আমেরিকায় দামি কাগজে ছাপা মোটা মোটা বইয়ের দামি থিওরিগুলো হার মেনে যায় এবং ভারতীয় পন্ডিতেরা ঘাবড়ে গিয়ে ফের আমেরিকায় দৌড়তে বাধ্য হয়। এই ছোঁড়াটার কেস-হিস্ট্রিটা এমন হাঙ্গামা খাড়া করল যে এক নামকরা পন্ডিত ওঁর আগামী আমেরিকা প্রবাসের সময় এর সমাধান খুঁজে বের করার প্রতিজ্ঞা করলেন।

    শিবপালগঞ্জের ইতিহাসের পাতায় ছেলেটা দু’তিন বছরের জন্যে হঠাৎ উদয় হয়ে সবার চোখ ধাঁধিয়ে দিল, তারপর পুলিশের মার, উকিলের যুক্তিতর্ক এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়া শাস্তি নির্বিকার ভাবে স্বীকার করে নাবালক অপরাধীদের জেলখানার ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেল। পরের খবর হল ছেলেটার ব্যক্তিগত চরিত্র দেশের পন্ডিতদের জন্যে এক প্রহেলিকা মনে হওয়ায় সে রহস্যভেদ করতে ভারত ও আমেরিকার মৈত্রীর দোহাই দিয়ে সাহায্য চাওয়া হচ্ছে। খবরটা শিবপালগঞ্জে পৌঁছতে পৌঁছতে মিথ বা লোককথার চেহারা পেয়ে গেল। তখন থেকে ছেলেটার লীলা-প্রসংগ বড় গর্বের সঙ্গে বর্ণনা করা হয়।

    রঙ্গনাথকে বলা হল যে ছোঁড়াটা দশবছর বয়সেই এমন জোরে দৌড়ুত যে পনের বছরের ছেলেছোকরারা ওর নাগাল পেত না। এগার বছরের মাথায় ও রেলে বিনা টিকিটে চড়ায় এবং টিকিট চেকারদের বোকা বানানোর খেলায় পাকা খেলুড়ে হয়ে উঠল। আরো এক বছর যেতে না যেতে ও যাত্রীদের মালপত্তর গায়েব করায় এমন হাত পাকালো যেন দক্ষ সার্জন লোক্যাল অ্যনাস্থেশিয়া দিয়ে কারও অপারেশন করছে এবং টেবিলে শোয়া রোগী টের পাচ্ছে না যে ওর একটি অঙ্গ শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এই ধরণের চুরিতে ওর এত নাম হওয়ার বিশেষ কারণ হল একবারও ধরা না পরা। শেষে চোদ্দ বছর বয়েসে যখন প্রথম ধরা পড়ল ততদিনে ও দরজার ওপরের কাঁচ ভেঙে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খোলায় পারঙ্গম হয়েছে। বাংলোবাড়িতে চুরি করতে স্কাইলাইট দিয়ে না ঢুকে নিজস্ব কায়দায় দরজা খুলে ঢোকে এবং কাজটি সেরে ভালোমানুষের মত সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসে।

    এই ছেলেটির গুণগান চলছিল, এমন সময় কেউ তুলে দিল ‘বহরাম চোট্টা’র প্রসংগ।ও নাকি একসময় এই এলাকার ইতিহাস অনুযায়ী বেশ নামকরা চোর ছিল। কিন্তু নামটা শোনামাত্র এক ছোকরা চেঁচিয়ে আপত্তি করল। ঠিক যেমন বিধানসভায় কোন যুক্তি ছাড়াই সির্ফ চিৎকার করে ‘স্পীচ’এর বিরোধ করা হয়। ওর কথা হচ্ছে-বহরাম চোট্টা আবার কোন চোর নাকি? রামস্বরূপ চোর বারো বছর বয়সেই যা মাল সরিয়েছিল বহরাম ব্যাটা জনম ভর চেষ্টা করেও সেটা গুণে শেষ করতে পারবে না।

    রঙ্গনাথ এই বিতর্কে যেন দুই প্রজন্মের লড়াইয়ের আঁচ পেল।শনিচরকে বলল, ‘কী ব্যাপার? আজকালকার চোরেরা কি সবাই ভারি সেয়ানা? আগেকার দিনেও তো একের পর এক ভয়ংকর সব চোট্টা জন্মেছিল’।

    শনিচরের বয়েসটা এমন যে ওকে নতুনেরা ভাবে বুড়োদের দলে আর বুড়োরা ভাবে ছোঁড়াদের দলে। এবং প্রজন্মের ভাগাভাগি তো বয়সের মাপকাঠি দিয়ে কোন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে হয়নি, ফলে দুটো দলই ওকে দুধভাত করে রেখেছে। তাই ওকে কেউ কোন দলকে সমর্থন করতে মাথার দিব্যি দেয়নি। শিল্প-সাহিত্যের দুনিয়ায় যেমন কয়েক’শ আধবুড়ো সমালোচক এমনভাবে মাথা নাড়ে যাতে তার স্পষ্ট কোন মত বোঝা যায়না, শনিচরও ঠিক সেই ভাবে এড়িয়ে গিয়ে বলল, ‘ভাই রঙ্গনাথ, পুরনো দিনের ওস্তাদদের কথা আর বোল না। ছিলেন বটে ঠাকুর দূরবীন সিং। আমি সেসব দিনও দেখেছি। কিন্তু আজকালকার চ্যাংড়াদের কথা না বলাই ভাল।

    ‘আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে, যখন আজকের ছেলেছোকরারা জন্মায়নি, বা জন্মে কিছু বৃন্দগান গাইতঃ

    “হে গোবিন্দ, হে গোপাল!
    আমার রাজা-রানীকে দেখো ঠাকুর, হে দীনদয়াল”।

    অথবা,

    “হে আমার রাজরাজেশ্বর,
    জর্জ পঞ্চমকে রক্ষা কর গো, রক্ষা কর”!

    সেই সময় শিবপালগঞ্জের সবচেয়ে বড় ‘গঞ্জহা’ ছিলেন ঠাকুর দূরবীণ সিং। বাপ-মা হয়ত ভেবেছিলেন যে নাম যখন দূরবীন রেখেছি, ছেলে সব কাজ বৈজ্ঞানিক ঢংয়ে করবে।বড় হয়ে উনি তাই করলেন। যে জিনিসে একবার হাত দিয়েছেন, তো সোজা তার বুনিয়াদে গিয়ে ঘা’ দিয়েছেন।ইংরেজের আইন-কানুন ওনার ভালো লাগেনি।তাই মহাত্মা গান্ধী যখন শুধু লবণ আইন অমান্য করতে ডান্ডি গেলেন, দূরবীন সিং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের সমস্ত ধারা ভাঙতে উঠে পড়ে লাগলেন।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১০ এপ্রিল ২০২১ | ২২২৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • guruhelp | 99.0.80.158 | ১৪ এপ্রিল ২০২১ ১২:০২104748
  • আপনি আপনার ধারাবাহিক লেখাগুলোয়, "ধারাবাহিক: প্রথম আর্টিকল#" এর বাক্সে প্রথম এপিসোডের আর্টিকল নম্বরটি ভরে দেবেন। যেমন ধরুন, এই "রাগ দরবারী" সিরিজের প্রথম পর্বের আর্টিকল নম্বর হল 20544, যখনই এই ধারাবাহিকের নতুন পর্ব লিখবেন তখন ঐ "ধারাবাহিক: প্রথম আর্টিকল#" বাক্সে এই প্রথম পর্বের নম্বরটি ভরে দেবেন। তাহলেই পর্বগুলো কানেক্টেড হয়ে যাবে।

  • Ranjan Roy | ১৫ এপ্রিল ২০২১ ১০:৪২104774
  • অবশ্যই খেয়াল রাখব।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন