মেয়েদের উৎবৃত্ত শ্রমের সেই ট্রাডিশন
গৌতম রায়
আমাদের মেয়েদের পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ জীবনে উজার করে দেওয়া উদ্বৃত্ত শ্রম ,যাকে মহামতি কার্ল মার্কস 'সারপ্লাস ভ্যালু ' বলে অভিহিত করেছেন, তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা অনেক জ্ঞানগর্ভ রচনা প্রস্তুত করেছেন। রাজনীতিবিদদের নানান ধারা-উপধারায় তা নিয়ে বহু আলাপ-আলোচনা হয়েছে। যারা নিজেদের প্রগতিশীল রাজনীতিক বলে দাবি করেন ,তারাও আমাদের এই সামাজিক উদ্বৃত্ত কে ঘিরে অনেক রকম চিন্তাভাবনা করছেন ।আবার যাদের আমরা সামাজিক তকমা দিয়ে থাকি বুর্জোয়া রাজনীতিক বলে, তারাও কিন্তু নারীর সামাজিক উদ্বৃত্ত প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনা- চিন্তাভাবনা অন্তত কেতাদুরস্ত ভাবে কম করেননি ।
গান্ধীবাদী ভাবধারার মানুষজন আমাদের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে মেয়েদের সামাজিক উদ্বৃত্ত কতখানি ক্রিয়াশীল , তার চিন্তাভাবনায় মশগুল থেকেছেন। এই চিন্তার অসামান্য সাহিত্যিক দৃষ্টান্ত রেখে গিয়েছেন সতীনাথ ভাদুড়ীর' জাগরী ' উপন্যাসের ভেতর দিয়ে। সেই সময় কালে আজকের দিনের মতো হয়তো মেয়েরা প্রত্যক্ষ রাজনীতির বৃত্তে এতোখানি সক্রিয় ছিল না ।তখন যেটুকু সক্রিয় মেয়েদের দেখতে পাওয়া যেত ,তার বেশিরভাগই ছিল উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের ,উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের ভিতরে সীমাবদ্ধ ।
আর কিছুটা পতির পুণ্যে সতীর পুণ্যের মত গান্ধী মহাত্মার চেলা বাবাজীদের উদ্দেশ্যে তাদের ঘরওয়ালীদের একটু একটু ভাবনা চিন্তা ছিল।' জাগরী' তে জেলবন্দি নর্মদা বেনের কথা আজকের নারী সমাজের কজনের মনে আছে, তা ঘিরে অবশ্য সংশয় জাগে।
সামাজিক উদ্বৃত্তের সঠিক মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে সংসার থেকে বাইরের পরিমণ্ডল ,অর্থাৎ ;ঘর এবং বাইরে ,নারীর কখনো নীরব -নিভৃত, কখনো সরব -চিৎকৃত ভূমিকা, একটি সুনির্দিষ্ট পরিমাপের ভিত্তিতে পরিলক্ষিত হোক, নারী হোক বৈকুন্ঠের নয় ,এই মর্ত্য ভূমের লক্ষ্মী, সেই চেতনার কথা অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ,' রত্ন ও শ্রীমতি' উপন্যাসে ব্যক্ত করে গিয়েছিলেন গত শতাব্দীর মধ্যভাগে শেষ যামে।
এই ভাবনাটাই আক্ষরিক অর্থে পরিস্ফুট হতে আমরা দেখি শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব যখন গ্রহণ করেন শ্রীমতী সিরিমাভো বন্দরনায়েক, ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব যখন গ্রহণ করেন ইন্দিরা গান্ধী, ইংল্যান্ডে মার্গারেট থ্যাচার,বাংলাদেশে শেখ হাসিনা অথবা পাকিস্তানে বেনজির ভুট্টো। তখনকার পরিবেশ-পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে কিন্তু যে প্রশ্ন উঠে এল, তা হল; এইসব ব্যক্তিত্বরা ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হয়েছিলেন এ কথা ঠিকই। কিন্তু এঁরা কখনো কিন্তু অতি সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসেন নি ।
সিরিমাভো বন্দরনায়েকের স্বামীর একটি রাজনৈতিক পরিচয় ও প্রেক্ষাপট ছিল। আততায়ীর হাতে স্বামীর মৃত্যু জনিত সহানুভূতির জেরে তাঁকে তাঁর দেশ শ্রীলংকার রাজনীতির শীর্ষবিন্দুতে উপনীত করেছিল ।মোতিলাল ,জহরলালের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ধারা প্রবাহিত ইন্দিরা গান্ধীর শীর্ষ বিন্দুতে উপনীত হওয়া প্রেক্ষিতে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বা বেনজির ভুট্টোর ক্ষেত্রে তাঁর পিতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথা এই ধরনের আলোচনার ক্ষেত্রে এসে যায়। তবে মার্গারেট থ্যাচার তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক পরিক্রমার ভেতর দিয়েই নিজের রাজনৈতিক ভিত্তি কে তৈরি করেছিলেন।
দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে এই ধরনের শীর্ষবিন্দুতে যাঁরা উপনীত হতে পেরেছিলেন, তার বাইরে যে একটা বড় অংশের নারীসমাজ, সামাজিক ক্ষেত্রে নিজেদের মেলে ধরতে চান, তাহলে কি তাঁদের এই নিজেদের মেলে ধরবার ক্ষেত্রে তাঁরা পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পান? পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কি তাদের কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রকে আতস কাচের মধ্যে রেখে মাপজোক করে না ?বাড়িতে তার উদ্বৃত্ত যেমন নারী হয়েও তার শাশুড়ি, ননদ ইত্যাদিরা সব সময় খুব সঠিকভাবে পরিমাপ করে উঠতে পারেন তা নয় ।
একই কথা সেই নারীটির স্বামী , সন্তান-- ছেলে হোক বা মেয়ে হোক, তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সেই নারীটি যখন সামাজিক জীবনে প্রবেশ করছেন ,সেটা পেশাগত জীবনে হোক বা সামাজিক জীবনে হোক বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল, তখন তিনি কতটা মুক্ত বিহঙ্গের মতো নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন, তাঁকে তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নিতে নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষশাসিত সমাজ যে ভয়ঙ্কর বেড়াজালের মধ্যে তাঁকে বেঁধে রাখতে চায়, সেই বেড়াজাল কেটে বেরিয়ে এসে, তার আপন সত্তায় নিজেকে প্রকাশ করবার এতোটুকু ক্ষমতা কি তার থাকে?
ভারতের রাজনীতির ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধী এক ব্যতিক্রমী চরিত্র, যাঁকে কখনই কোনোভাবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দ্বারা নিজের ভাবনা চিন্তার পরিমণ্ডলকে পরিব্যাপ্ত করতে হয়নি। এমনকি নারী হিসেবে গার্হস্থ্য জীবন যাপনের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর স্বামী ফিরোজ গান্ধীর সঙ্গে কতখানি মানবিক আচার-আচরণ করেছিলেন, তা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর জীবনী কার এবং অনুরাগী- অনুগামীদের ভেতরে যথেষ্ট বাকবিতণ্ডা আছে। বরংচ বলা যায়; পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থা টাই ইন্দিরা গান্ধীর নামক এক নারীর পদতলে সমবেত হয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক সৌভাগ্যের বৃহস্পতি তুঙ্গে থাকার সময় কালে ,তাঁর সহযোদ্ধারা, পুরুষ সমাজ, যেভাবে ইন্দিরার পায়ের কাছে এসে ভিড় করেছিল, তা কি একজন নারীর কাছে পুরুষ সমাজের অবনমিত হওয়ার উদাহরণ ছিল ?তা কিন্তু নয় ।দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ইন্দিরা, একজন শাসক হিসেবে কিন্তু তাঁর দলীয় সতীর্থদের, তাবড় তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের ,নিজের পায়ের কাছে এনে ফেলতে পেরেছিলেন ।
এটি কিন্তু নারী হিসেবে ইন্দিরার কোনো বিশেষ কৃতিত্ব নয় ।বরং বলা যায় সমাজ বিকাশের ধারা পুরুষের সঙ্গে সমান অধিকারের দাবিতে লড়াইরত নারীর আপন মাধুর্যের জোরে, ব্যক্তিত্বের জোরে, ধৈর্য, স্থৈর্য ,সততা ,মানবিকতার জোরে পুরুষের সঙ্গে যে একটি সম মর্যাদাপূর্ণ আসন তৈরি করার সংগ্রাম এবং প্রবণতা ,যে প্রবণতা ইন্দিরা গান্ধী একজন নারী হিসেবে অর্জন করতে পারতেন ,সেটিকে তিনি একজন শাসক হিসেবে কিন্তু হারিয়েছিলেন।
শাসক হিসেবে তিনি পুরুষকে জয় করেছিলেন ।নারী হিসেবে বা একজন মানবিক চরিত্রের ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি কিন্তু পুরুষকে তাঁর আপন মাধুর্যের বশীভূত করতে পারেননি। এই যে প্রবণতা ,সেই প্রবণতাটা কিন্তু আমাদের মত উলুখাগড়া দের জীবনের খুব ভয়ঙ্কর ভাবে এসে পড়েছে ।পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকার সময় স্থানীয় প্রশাসন ,অর্থাৎ ;পৌরসভা -পঞ্চায়েত গুলিতে মেয়েদের জন্য আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা তাঁরা করেছেন।
এই ব্যবস্থায় মোটের উপর কি নারীর ক্ষমতায়নের দিগন্ত প্রসারিত হয়েছে ?নাকি, পুরুষের পরিত্যক্ত আসনে সেই পুরুষের স্ত্রী , পুরুষের কার্যত দাসী হিসেবে কাজ করে যেতে বাধ্য হয়েছেন? কি বামপন্থী ,কি দক্ষিণপন্থী ,কি বুর্জোয়া রাজনীতিক, প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলেরই যে সমস্ত মহিলা জনপ্রতিনিধি আমাদের রাজ্যের স্থানীয় প্রশাসন গুলিতে, কি বামপন্থী শাসনকালে, কি আজকে তৃণমূলের শাসনকালে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদের কজন ,নিজেদের ইচ্ছেমত ,নিজেদের স্বাধীন চিন্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে ,গণতান্ত্রিক পরিবেশে কাজ করতে পারেন ?
বামপন্থী আমলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে; স্থানীয় প্রশাসনের যেসব মহিলারা সংরক্ষিত আসনে নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা আসলে পুরুষের ' পরিবর্ত' হিসেবে ই শেষ পর্যন্ত থেকে গেছেন। তাঁদের নির্বাচন ক্ষেত্রে প্রতিটি কাজই কার্যত পরিচালনা করেছেন ,হয় তাঁর স্বামী ।নয় তাঁর পিতা। নয় তাঁর পুত্র। অর্থাৎ পুরুষ সমাজে র কোনো না কোনো প্রতিনিধি ,দলীয় ক্ষেত্রে ও যাঁরা এগুলি পরিচালনা করেছেন, তাঁরাও কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই লিঙ্গ সাম্যের দিকে কোনরকম নজর লক্ষ্য দেননি।
অভিজাত পরিবারের উচ্চশিক্ষিত রমনী সরোজিনী নাইডু থেকে শুরু করে সুচেতা কৃপালনি কিংবা বামপন্থী পরিমণ্ডলে অরুনা আসফ আলি, এঁরা প্রত্যেকে কিন্তু তাঁদের পারিবারিক পরিমণ্ডলে পুরুষশাসিত সমাজের, পুরুষশাসিত পরিকাঠামো একটা সুযোগ কিছু না কিছু হলেও পেয়েছেন। একই কথা প্রযোজ্য বাংলার বামপন্থী রাজনীতির বিশিষ্ট নারী চরিত্র গুলি সম্পর্কে ও।ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের ভাইঝি রেণু চক্রবর্তী, প্রতিনিধি কিংবদন্তি ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখার্জির পত্নী হিসেবে গীতা মুখোপাধ্যায়ের খ্যাতি, সরোজ মুখোপাধ্যায়ের পত্নী হিসেবে কনক মুখোপাধ্যায়ের খ্যাতি , নিকুঞ্জ বিহারী মাইতি কন্যা হিসেবে আভা মাইতির রাজনৈতিক পরিব্যক্তি, বিজ্ঞানী বীরেশ গুহের পত্নী হিসেবে ফুলরেণু গুহের পরিব্যক্তি কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ রায়ের পত্নী হিসেবে রেনুকা রায়ের পরিব্যাপ্তি --এগুলি তাঁদের ,অর্থাৎ; সেইসব নারীদের নিজস্ব ব্যক্তি সংগ্রাম, লড়াই ,আত্মত্যাগ -সবকিছুর উপস্থিতি সত্বেও বলতে হয়, পারিবারিক পরিমণ্ডলে পুরুষশাসিত প্রেক্ষিতে ,তাঁদের রাজনৈতিক জীবনের ব্যপ্তিকে গগনচুম্বী করে তুলতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
প্রথম সারির নেতৃত্বে র এই প্রেক্ষিতে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে স্থানীয় প্রশাসন গুলিতে মেয়েদের জন্য আসন সংরক্ষণ স্বীকৃত হওয়ার পর ,একটি পরিবর্তিত- পরিমার্জিত আকার নিয়ে আমাদের সামনে উঠে আসে।শাসক- বিরোধী, সব কটি রাজনৈতাক দল ই ,বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ভিতর দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ণের বিষয়টিকে নির্বাচন ক্ষেত্রে নিজের দলের শক্তিশালী, জনপ্রিয় পুরুষ নেতাটির স্ত্রী, কন্যা, বধুমাতার উপরে ছেড়ে দিয়ে, রথের রশির মুড়োটা রেখে দেয় পুরুষের ই হাতে।মার্কস সাহেব হয়তো এসব দেখে , তাঁর সারপ্লাস ভ্যালুর কথা চিন্তা করে কবরে পাশ ফিরে শোন।