মিশন পৃথিবী একেবরে প্রথম প্রকাশিত হবার পরে এক বন্ধুর অনুরোধে কিনে পাঠাতে গিয়ে প্রায় রাত জেগে শেষ করেছিলাম। তখন প্রাথমিকভাবে অস্বস্তি হয়েছিল যে প্রবলেম স্টেটমেন্টটা আসলে কী? যে কোন ফ্যান্টসি বা থ্রিলার বা কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর একটা প্রবলেম স্টেটমেন্ট তো লাগবে, এখানে সেটা কী? তা বাদে বাকীটা 'আমেরিকান গডস' এর ছায়ায় টানটান মুচমুচে ফ্যান্টাসি। তো সে বই তো সেই বন্ধুকে পাঠিয়ে দিলাম, কিন্তু অস্বস্তিটার কারণে কিছু আর লিখি টিখি নি। তাই এবারে যখন দেখলাম আগের পর্বের একটা প্রিক্যুয়েলও যোগ হয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবেই কৌতুহলী হলাম যে তাহলে কি এবারে প্রবলেম স্টেটমেন্টটা তৈরী হল?
তো নতুন মিশন শুরু হচ্ছে সেই গুহামানবের সময় থেকে। ভাল আর মন্দের দ্বন্দ্ব, ঈশ্বর অর শয়তানের দ্বন্দ্ব রয়েছে মানুষের 'মানুষ' হয়ে ওঠার সময় থেকেই। হোমো স্যাপিয়েন্সের উত্থান সম্ভব হয়েছে তার বুদ্ধি হৃদয় এই দুইয়ের ব্যবহারে। এসব কথা আমরা এমনিতে জানিই স্কুলপাঠ্য বইতে পড়েওছি। মিশন পৃথিবী প্রথম পর্বের প্রিক্যুয়েল এই মানুষ হয়ে ওঠার ধাপগুলো ধরেছে খানিকটা। সেখানেই বুনে দিয়েছে সমস্যার বীজ। আসলে কারা , কেন আসছে পৃথিবীর দখল নিতে? ভাল আর মন্দের দ্বন্দ্ব, কে জেতে শেষ পর্যন্ত কৌতুহল ধরে রাখে আগাগোড়া। পরবর্তী অংশ মোটামুটি আগের বইয়ের মতই, স্মৃতি বলছে সামান্য কিছু পরিবর্তন বোধহয় হয়েছে এই অংশেও, তবে সে আর ক্রসচেক করার উপায় নেই।
তবে সামান্য পরিবর্তনের ফলেই হোক বা আগেরটুকু বুনে দেবার জন্যই হোক এইবার এই অংশটুকু পড়তে চমৎকার লাগল। বইদুটোকে 'প্রাপ্তবয়স্ক ফ্যান্টাসি' বলে বিজ্ঞাপিত হতে দেখেছি। সে সম্ভবত কিছু হিংস্র ধর্ষণের বর্ণনার কারণে। হিংস্র যৌনতা থাকলে ব্যক্তিগতভাবে আমার একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু এ বইয়ের হিংস্রতা কোথাও কোথাও সামান্য অস্বস্তিকর লাগলেও যৌনতাটুকু একেবারেই অস্বস্তিকর লাগে নি। প্রথম পর্ব শেষ হয় মানুষের হেরে যাওয়ায়। এত হিংস্রতা, এত ক্ষয়ক্ষতি পরাজয়ের মধ্যেও আগাগোড়া অন্তর্লীন বয়ে চলে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার, সহমর্মিতার চোরাটান। ভালোবাসো, জোট বাঁধো, প্রস্তুত হও
এই বার্তা বয়ে নিয়ে লুকিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পরাজিত মানুষ বা সাবস্পিসিস।
যদি কাহিনীর উপর থেকে ফ্যান্টাসির মোড়কটা খুলে নিই তাহলে এই পৃথিবীর কোন কোনও ঘটে যাওয়া কিংবা ঘটতে থাকা অনেক ঘটনার সাথেই আবছা মিল চোখে পড়ে। দ্বিতীয় পর্বে এসে সেই আবছা মিলগুলো আস্তে আস্তে স্কেচপেনের সরু মোটা লাইনে স্পষ্ট আঁকা হয়ে উঠতে থাকে। সুপারস্পিসিসের কোনও কোনও চরিত্রকে প্রায় লর্ড ভোল্ডেমর্টের মত লাগে, সেই নির্মম হিংস্রতা, সেই মিনিস্ট্রি অব ম্যাজিক দখল করে নেওয়া। পরক্ষণেই মনে হয় কল্পকাহিনী কেন একেবারে আজকের বা গত কয়েক বছরের খবরের কাগজের পাতা খুললেও কি এই সব ঘটনারই রকম বেরকম দেখি না? ভালো বনাম মন্দ, আলো বনাম কালোর এই দ্বন্দ্ব তো বারেবারে এসেছে মানুষের ইতিহাসে।
ওই যে বলে না নিষ্প্রভাত রাত্রি হয় না, যত কালোই হোক, একদিন তার পরে ঝলমলে সূর্য ওঠেই, সেই আশাবাদ, মানুষকে ভালবাসার, অপরিচিতের বিপদে প্রাণ তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানবিক গুণগুলো গোটা বইয়ের প্রাণবাহী ধমনী ও শিরা। কিছু কিছু লাইন একেবারে আমূল গেঁথে যায় মনে। 'গল্পকথাই তো আসল কথা। বেঁচে থাকা মানে গল্পকথা বই কিছু নয়।' এরকম একটা লাইন সঙ্গে থাকবে অনেককাল। কল্পবিজ্ঞানে বিজ্ঞানের বেসিক সুত্রগুলো উপেক্ষা করা চলে না। সেই হিসেবে এই বইয়ে অধিকাংশ ঘটনাই বিজ্ঞানের বেসিক সূত্র মেনে, বিজ্ঞান অনুসারী হয়ে চলেছে সেটা আরেক প্রাপ্তি। কিছু ঘটনা অবশ্যই অনেকটাই বিজ্ঞানের আওতার বাইরে, সেটা অনেকটা ফ্যান্টাসির স্বার্থে গল্পের স্বার্থেই।
ব্যক্তিগতভাবে ফ্যান্টাসি আমার খুব যে সাংঘাতিক পছন্দের জঁর এমন না। হ্যারী পটার জাতীয় কিছু খুব ভালোলাগার কারণ যেগুলো সেগুলো অনেকটাই এই বইয়েও উপস্থিত। গল্পের টান এমন মোক্ষম যে একেবারে উর্দ্ধশ্বাসে পড়ে শেষ করতে বাধ্যই করেছে বলা যায়। অল্প যে দু একটা ছোটখাট অস্বস্তি সেগুলোও লিখে রাখি। বেশ কিছু টাইপো আছে, বিশেষত দ্বিতীয় পর্বে। এগুলো আশা করি পরের সংস্করণে বদলে দেবেন লেখিকা। সুশান্থের চরিত্রগঠন একটু দুর্বল লেগেছে। অনেকটা স্নেপের আদলে তৈরী সুশান্থ। এছাড়া প্রিক্যুয়েল পর্বেও কিছু ঘটনা ও চরিত্র আরেকটু সময় ও স্থান দাবী করে বলে মনে হয়েছে আমার।
তো মোদ্দা কথা হল বাংলায় জমজমাট ফ্যান্টাসি পড়তে চাইলে ঝটপট পড়ে ফেলুন অনুষ্টুপ শেঠের লেখা মিশন পৃথিবী
বই - মিশন পৃথিবী ১, ২
লেখক - অনুষ্টুপ শেঠ
প্রকাশক - বসাক বুক স্টোর
দাম -
১ম খন্ড - ৩৭৫/- টাকা
২য় খন্ড - ২৪৯/- টাকা

পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।