লীসা গাজীর 'হেলফায়ার বইটি সম্প্রতি বেশ নাম করেছে, সপ্রশংস রিভিউ বেরিয়েছে কাগজে পত্রে। বইটার খবর দেয় স্বাতী। খোঁজাখুজি করে জানতে পারি লীসার 'রৌরব' উপন্যাস অনুবাদ করেছেন শবনম নাদিয়া। বিডিনিউজ২৪ থেকে ধারাবাহিক বাংলা উপন্যাসটি খুঁজেও দেন শবনম। অতএব পড়েও ফেললাম। রাত জেগে প্রায় একবসায় শেষ করে মনে হল দু'কথা লিখি।
লাভলি, বিউটি তাদের মা ফরিদা খানম, তাদের ছোট পরিবার আর গৃহকর্মীদের ঘিরেই উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে। একটি মাতৃতান্ত্রিক পরিবার, তার অবরোধ, চাপা হিংস্রতা, অবদমন আমরা দেখি লাভলির আপাত শান্ত ভীতু মাটির দিকে নামানো দুইচোখ দিয়ে। লাভলি তার চল্লিশ বছরের জন্মদিনে জীবনে প্রথমবারের মত বাড়ি থেকে একলা বেরোবার অনুমতি পায়। খাঁচাবন্দী পাখি যেমন খাঁচার দরজা খোলা পেলেও চট করে উড়ে যেতে পারে না, এদিক ওদিক তাকায়, ডানা ঝাপটে কাছাকাছি কোথাও বসে, লাভলিও তেমনি বাড়ি থেকে বেরোয় কিছুটা অনিশ্চিতভাবে। লাভলির এলোমেলো চলা, গাউছিয়ায় গিয়ে কেনাকাটা, রমনাপার্কে অনিশ্চিত বসে থাকার ফাঁকে পাঠক দেখতে পান লাভলি , বিউটির শৈশব কৈশোর যৌবনের দমবন্ধকরা দিনযাপন। দুইবোনের একলা বেরোবার অনুমতি নেই, ছাদে ওঠার অনুমতি নেই, স্কুলে কলেজে পড়াও ফরিদা খানমের চোখের সামনে, তাতে স্কুল কলেজ আপত্তি করলে বরং পড়া ছড়িয়ে বাড়িতে বসিয়ে রাখা হয়।
পিতৃতন্ত্র মেয়েদের এরকম কঠিন্ভাবে পর্দানশীন করে রাখে তাকে বিয়ে এবং শুধুই বিয়ে ও সংসারের জন্য তৈরী করতে। এই উপন্যাসে কিন্তু মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় না। তাদের বিয়ের কোনও চেষ্টা করা হয় না, এরকম কোনও সম্ভাবনা দেখা দিলেও সেটি নির্মমভাবে ধ্বংস করেন তাদের মা। আমার পারিবারিক বৃত্তে একটা কথা মাঝে মাঝে শুনতাম 'সাত পাকে বাঁধার মা' অর্থাৎ 'সাত পাকে বাঁধা' সিনেমার মা চরিত্রটির মত মা। অন্তর্নিহিত অর্থ যে মা মেয়ের বিবাহিত জীবন, যৌনসুখ চান না। তো সেটি খুবই নিন্দার্হ বিষয় ছিল। ফরিদা খানমের চরিত্রটি একেবারে ঐ সংজ্ঞার সাথে খাপে খাপ বসে যায়। সামান্য অপরাধেও মেয়েদের শাস্তি দিতে হলে তিনি তাদের শোবার ঘরে চাবি দিয়ে আটকে রাখেন দিনের পর দিন, একজনের অপরাধে শাস্তি পায় দুই বোনই। বাইরের জগৎ দেখে তারা এক অনচ্ছ পর্দার ওপাশ থেকে। বাবা চরিত্রটি এক অতি দুর্বল মানসিকতার পুরুষ, সংসারে তাঁর ভূমিকা একটি আদরের বিড়ালের মত।
আমরা বিভিন্ন উপন্যাসে প্যাট্রিয়ার্কের গড়ে ওঠা দেখেছি। লীসা এই উপন্যাসে এঁকেছেন এক ম্যাট্রিয়ার্ককে। একা কুর্নিআওয়ানের 'বিউটি ইজ আ উন্ড' এ এক ম্যাট্রিয়ার্কের গড়ে ওঠা দেখেছিলাম আর দেখলাম 'রৌরব' এ। ফরিদা খানমের চরিত্রটি, তাঁর ক্রমশঃ এক ম্যাট্রিয়ার্ক হয়ে ওঠা, অতি যত্নে তৈরী। পুরো উপাখ্যানে চাপা গৃহহিংসা, মেয়েদের প্রতি, গৃহকর্মীদের প্রতি অশ্রাব্য বাক্যবর্ষণ দেখে মনে হয় এত অন্ধকারও হতে পারে কোনও বাড়ির, পরিবারের পরিবেশ!! উপন্যাসটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টেনে রাখে। তবু দুই একটা ছোটখাট অপ্রাপ্তিও থাকে। মেয়েদের এই সম্পূর্ণ বন্দী করে রাখার পেছনে ফরিদা খানমের আপাত কারণটি খুব বিশ্বাসযোগ্য লাগে নি। শ্বাসরোধকারী ঘটনাক্রম এক একসময় মার্গারেট অ্যাটউডের হ্যান্ডমেড্স টেল মনে করিয়েছে কিন্তু ডিস্টোপিয়া আর সাররিয়ালিজমে অ্যাটউডের মত সফল হয় নি। কোথাও যেন একটু আটকে গেছেন লীসা। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে আমি চরম হতাশার মধ্যেও একটু আধটু আশার আলো খোঁজার চেষ্টা করি। সেদিক থেকে এই উপন্যাসটি খুবই ডার্ক। বোকা ভীতু লাভলির আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাওয়াও বড় বেশী মূল্য দিয়ে হয়। তবে এটুকু উপেক্ষা করাই যায়।
থিয়েটারকর্মী লীসা বিখ্যাত তাঁর তথ্যচিত্র 'রাইজিং সায়লেন্স'এর জন্য। এটি তাঁর প্রথম উপন্যাস। সেই হিসেবে যথেষ্ট ভাল। উপমহাদেশের এক পরিবারের মধ্যে দিয়ে পাঠককে রৌরব নরকই দেখায়।
#মাসকাবারি_বইপত্তর
উপন্যাসটি পড়া যাবে এখান থেকে
পড়বো. কটা কিস্তি আছে গো?
১২টা কিস্তি । শবনম যিনি অনুবাদ করেছেন বলেছেন লেখক নিজে সামান্য কিছু বদলেছেন অনুবাদের সময়। তাছাড়আপুরোটাই মূলানুগ।
ডকুটাও দেখো। যদিও সেটা এর সাথেযুক্ত নয় তাবু লীসার কাজ হিসেবে দেখো। ভাল কাজ।
ওকে, দেখ্বো।
উপন্যাসটি পড়তে আগ্রহ বোধ করছি। সাত পাকে বাঁধার মা, ব্যাপিকা বিদায়ের মা, নারায়ণীর মা দিগম্বরী- নানা ধরনের মায়ের কর্তৃত্বপ্রবণতা আর অনধিকার চর্চা- খুব অপিরিচিত নয় আমাদের কাছে।
আরে হ্যাঁ দিগম্বরীর কথা ভাল মনে করিয়েছেন। মনেই ছিল না। পড়ে ফেলুন।
(অন্য লেখাটায় শাখাওয়াতের ড্রেসের রং ভুল হয়েছে লিখেছেন দেখেছি। ধন্যবাদ। )
পড়ে ফেললাম।