এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • পরস্পরকে ভালোবাসো

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ | ২০৫ বার পঠিত


  • “Love One Another”

    এই একটি কথাই হয়তো আজ গোটা বিশ্ব-বিভীষিকার মোড় ফেরাতে পারে। এই একটি কথার নীল-প্রয়োজনীয়তা এখন ভেসে বেড়াচ্ছে প্যালেস্তাইনের অলিতে গলিতে। এই একটি বাক্যের বাকরুদ্ধ ধুসর জীবন আলেখ্য ইউক্রেনের রাস্তায় রাস্তায়। এই তিনটি শব্দের যথাযথ মর্মার্থবোধ মণিপুরের ঘরে ঘরে কালো বিষাদে ঢেকে আছে। এই একটি কথার মর্মার্থ পাশ্চাত্য বুঝেছিল ১৯৪৫-এর পর। তারও প্রায় উনিশশো বছর আগে, চুনাপাথরের তৈরী চার দেওয়ালের ঘরে জনা কয়েক আকাট গন্ডমুর্খকে বলেছিলেন যিনি, তিনি রক্তাক্ত হয়েছিলেন কাঠের ক্রুশে।

    একটানা সাত বছর ধরে চলা বিশ্বযুদ্ধে তখন গোটা ইউরোপ ধুঁকছে। ১৯৫০ সালে, যুদ্ধ পরবর্তী বিদ্ধস্ত এবং লোভাতুর দেশগুলোর মধ্যে যখন এক ঠান্ডা যুদ্ধের অশনি সংকেত প্রোথিত হচ্ছে, তখনি একটা উপন্যাস, বারাব্বাস, জনচেতনার মাঝে স্থান করে নিতে চাইল। পরের বছরেই, বিশেষত, উক্ত উপন্যাসের জন্য, সুইডিশ এই লেখক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। লেখকের নাম Pär Lagerkvist, রোমান হরফেই লিখলাম, কারন, ইদানীং, বানান পুলিশের দৌরাত্ম্যে ভাববস্তু নির্মমভাবে ঢেকে যাচ্ছে।

    আমরা কি বারাব্বাসকে চিনি? যীশুখ্রীষ্টকে যার বদলে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, সেই খুনে ডাকাতের নাম বারাব্বাস? বাইবেলে, ম্যাথুর গসপেলে পাই, “সেই সময় বারাব্বানামে এক কুখ্যাত (notorious prisoner) আসামী কারাগারে ছিল।”(২৭/১৬) মার্কের মতে, “সেই সময় বারাব্বা নামে একটি লোক বিদ্রোহীদের সাথে কারাগারে ছিল, যাঁরা বিদ্রোহের সময় অনেক খুন জখম করেছিল।” (১৫/৭) লুকের বক্তব্য, “শহরের মধ্যে গণ্ডগোল বানানো ও হত্যার অপরাধে বারাব্বাকে কারাবন্দী করা হয়েছিল।” (২৩/১৯) আর জন লিখেছেন, “তারা আবার চিত্কার করে বলল, ‘একে নয়! বারাব্বাকে!’ এই বারাব্বা ছিল একজন বিদ্রোহী।” (১৮/৪০)

    মোট কথা, Pär Lagerkvist-এর কাছে বারাব্বাস কি হয়ে দাঁড়াল অবশেষে? সভ্যতার সংকট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সত্যিই কি আর কোন বিশ্বাস অবশিষ্ট ছিল? আইনস্টাইন পর্যন্ত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কায় বলেছিলেন, “I know not with what weapons World War III will be fought, but World War IV will be fought with sticks and stones.” সেই আশঙ্কার অমোঘ প্রতিরূপ বারাব্বাস। বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের পাতা থেকে উঠে আসা বারাব্বাস মানুষের ধ্বংসলীলার ওপর বিশ্বাসের এক দুর্বিষহ প্রতিরপ। 

    এই প্রতিরূপের একটাই অস্ত্র। বারাব্বাসরূপী মনটাকে আমরা যদি যীশুরূপী মনের দিকে ফিরিয়ে আনতে পারি। বাইবেলের পাতা থেকে, শুধু বাইবেল কেন, সমস্ত ধর্মগ্রন্থের পাতা থেকে বোধহয় একটাই বাণী উঠে আসে, Do unto others as you would have them do unto you. – অপরের সাথে তেমন ব্যবহারই করো, অপরের কাছে যেমন ব্যবহার আশা করো। Pär Lagerkvist তাকেই রূপ দিলেন তিনটি শব্দবন্ধনের বাক্যে - Love One Another.

    এই উপন্যাসটার কাঠামো বাইবেল থেকে উঠে আসা বারাব্বাস চরিত্রটাকে নিয়ে, উপন্যাসের শুরুতেই যে যীশুখ্রীষ্টের মৃত্যু প্রত্যক্ষ করছে। এবং তার পর থেকেই শুরু হচ্ছে তার অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব তাকে আস্তে আস্তে খোকলা করে ফেলছে। তাকে অস্তিত্ববাদ আর নাস্তিত্ববাদের মাঝে পিষে ফেলছে। জীবনের এক-একটা পর্বে সে কখনও ভালো, কখনও মন্দের মধ্যে দিয়ে একটাই বোধকে উপলব্ধি করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, Love One Another

    তা সত্ত্বেও, যদি এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস না থাকে, তাহলে? ধর্মের নামে পড়ে থাকা মোহ অবশেষে হন্তার কারণ হয়। নিজেকে, অপরকেও। এই বইয়ের শেষ পর্বে দেখি, যে বিশ্বাস করার জন্য সে প্রাণপনে সারা জীবন ধরে লড়ল, সেই বিশ্বাসে অটল না থাকার কারণেই সেই বিশ্বাস তার বুদ্ধিভ্রংশের কারণ হল। বারাব্বাস তার শেষ মুহূর্তে একা। নরকের অতল গুহায় কোটি কোটি কালো কালো অন্ধকারের মতো সে একা। মোহান্ধ ধর্মবিশ্বাস অবশেষে সমাপ্তি টেনে দেয় – “স্বার্থের সমাপ্তি অপঘাতে। অকস্মাৎ / পরিপূর্ণ স্ফীতি-মাঝে দারুণ আঘাত / বিদীর্ণ বিকীর্ণ করি চূর্ণ করে তারে / কালঝঞ্ঝাঝংকারিত দুর্যোগ-আঁধারে।”

    এই উপন্যাসের অনুবাদ করেছেন Alan Blair, সহজ সরল ঝরঝরে অনুবাদ। ততোধিক সুন্দর অনুবাদ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর। আমি ওনার অনুবাদটা যখন পড়ছি, মনেই হচ্ছে না অনুবাদ পড়ছি। একটা সার্থক অনুবাদ কি হতে পারে, তার যথার্থ উদাহরণ নীরেন্দ্রনাথের ‘বারাব্বাস’। বুলবুল সারওয়ারের অনুবাদও মন্দ নয়। যদিও তিনি স্বীকার করেছেন, “শ্রী নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বারাব্বাস অনুবাদ করেছিলেন বহু আগে। তার সুকর্ম থেকে সাহায্য না নিয়ে পারিনি।” তিনটের মধ্যে তুলনা করলে নীরেন্দ্রনাথের অনুবাদ আমার সবচেয়ে বেশি কাছের মনে হয়েছে।

    তবে এই উপন্যাস প্রসঙ্গে André Gide-এর একটা চিঠি পড়লাম। সেখানে তিলি লিখছেন, “It is the measure of Lagerkvist’s success that he has managed to admirably to maintain his balance on a tightrope which stretches across the dark abyss that lies between the world of reality and the world of faith.” 

    তিনি যথার্থই লিখেছেন। 

    ======================

    Barabbas
    Pär Lagerkvist
    Translated By: Alan Blair
    Vintage International
    Price: 850/-

    অনুবাদকঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
    পরম্পরা প্রকাশন
    মুদ্রিত মূল্যঃ ১৫০ টাকা

    অনুবাদকঃ বুলবুল সারওয়ার
    ঐতিহ্য প্রকাশন
    মুদ্রিত মূল্যঃ ১৮০ টাকা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মত | 173.49.254.96 | ২৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ২০:৫১527168
  • বেশ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন