এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • মাই ইয়ার্স ইন অ্যান ইন্ডিয়ান প্রিজনঃ মেরি টাইলার। অনুবাদ

    বর্গীয় জ লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৩১৮ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • টাটা
    ~~~~

    সেই রাতে সেলে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম - এই কথার কী মানে হতে পারে। কল্পনা, অমলেন্দু সহ আরও একান্নজনের সঙ্গে পুলিশ আমাকে আভিযুক্ত করেছে। সবাই এখনো বিচারের অপেক্ষায়, জেলে। আমার ব্যাপারে যা তদ্বির হয়েছে তাতে সাড়া দিয়ে সরকার আমার মামলাটি বাকিদের থেকে আলাদা করেছে। এখন আমার দেশে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন, আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে একটা স্বীকারোক্তি আদায় করার চেষ্টা করছে। এতে হয়তো আমার নিজের স্বাধীনতা কিছুটা ক্ষুন্ন হবে, কিন্তু আমার সম্ভাব্য স্বীকারোক্তি যে ঐ এলাকা থেকে আটক হওয়া অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে এতে কোন সন্দেহই নেই। তাই, ওরা আমার থেকে ঠিক কোন 'অপরাধ'এর স্বীকারোক্তি চাইছে তা নিয়ে নিশ্চিত না হলেও, প্রস্তাবটা বিবেচনা করার প্রশ্ন নেই। আমার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারলে অন্যদের জন্য বাধা কোথায়? অভিযুক্তদের মধ্যে কেউ কেউ কল্পনার মত এক সময়েই কলকাতা বদলি হয়েছে। বাংলার পুলিশও ওদের হাতে পেতে চাইছিল। কিন্তু তখনও পঁয়ত্রিশজন কয়েদী হাজারিবাগ জেলে। ওদের পরিস্থিতিও অনেকটা আমারই মত, কিন্তু আমাকে নিয়ে এখন শাস্তির থেকে বেশি ছেড়ে দেওয়া নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে, আর ওদের কপালে এখনও গারদের পেছনে ডাণ্ডা বেড়ি - আরও কত বছরের জন্য তা কেউ জানে না। 

    এইসব ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম আদালতে হাজিরার দিন হাকিমের কাছে হাজারিবাগে কয়েদ থাকা সহঅভিযুক্তদের জামশেদপুরে বদলি করার আবেদন করবো।
    পরদিন ভোরে গরাদে খোলাবন্ধ, বড় বড় গোছায় বাঁধা চাবির হুড়োহুড়ি, চকচকে বেয়নেটের ঠোকাঠুকি - এইসব আওয়াজের মধ্যে আমাকে একটা পুলিশ ট্রাকে তুলে আদালতে হাজির করা হলো। আমি কাঠগড়ায় দাঁড়ালাম, ম্যাজিস্ট্রেট কী লিখতে লিখতে আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো, আমার সঙ্গে আসা পুলিশের দিকে কিছু ইশারা করলো - দশ মিনিটের মধ্যে আমি আমার সেলে ফেরত গেলাম। প্রায় তিন বছর পর এই আমার আদলতে হাজিরা। পরের হাজিরার জন্য কোন দিন ঠিক হয়েছে কিনা আমি সেটা পর্যন্ত জানতে পারলাম না। জেলার সমন দেখে বললো, ১৭ই এপ্রিল। ঐ হাজিরার দিনের আগে অমলেন্দুর বোন আর ওংদের ঠিক করা উকিলের সঙ্গে দেখা হলো একবার। অমলেন্দু আমার বদলির কথা শুনেছে; ওর স্থির বিশ্বাস হয়েছে এবার ওরা আমাকে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠাবে, তাই বোনকে শেষবারের মত আমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছে। আমি ওকে বললাম অত তাড়াতাড়ি কিছু হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। 

    প্রেসিডেন্সি জেল থেকে অমলেন্দুর একটা পোস্টকার্ড পেলাম। তবে একটা চিঠি পাওয়া মানে বুঝে নিতে হবে তার আগে অন্তত পাঁচ ছটা পাঠানো চিঠি পাওয়া যায়নি। এই সেন্সরশিপের কোন যুক্তি বুঝতে না পেরে আমি একটা দরখাস্ত লিখেছিলাম - চিঠিতে কী লেখা যাবে আর কী লেখা যাবে না তার একটা নির্দেশিকা চেয়ে।
    কয়েদীদের লেখা দরখাস্তের যেমন দস্তুর, তার কোন উত্তর আসেনি। হাজারিবাগ জেলের সেন্ট্রাল ওয়াচ টাওয়ারের নিচের ঘরের বাতিল চিঠিপত্রের স্তূপে তার ঠাঁই হয়েছে ধরে নেওয়া যায়। একবার ওখানকার চিফ হেড ওয়ার্ডার একটা কাগজে মুড়িয়ে আমার জন্য এক আঁটি পালং শাক এনেছিল। কী মনে হতে কাগজটা খুলে দেখলাম এই দরখাস্তটা আমি সপ্তাহখানেক আগে ফাটকের অন্য একজনের জন্যে লিখে দিয়েছিলাম। 

    ১৭ই এপ্রিল আমাকে আদালতে ঢুকতেও হলো না। পুলিশ ট্রাকে বসে থাকলাম, ম্যাজিস্ট্রেট বেরিয়ে এসে দেখলো আমি আছি, দেখে আবার আদালতে ঢুকে পড়লো। কপাল ভালো, আমার উকিল সেখানে ছিল। তাকে বললাম হাজারিবাগের কয়েদীদের জন্য দর্খাস্তটা জমা দিতে। ম্যাজিস্ট্রেট বললো পনেরো দিনের মধ্যে রায় দিয়ে দেবে। এর মধ্যে জেলের ভেতরের একটা অস্থায়ী আদালত মত - শুনানির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছিল। জেলের মধ্যেই শুনানির সরকারী আবেদন আদালতে গ্রাহ্য হওয়াতে এই ব্যবস্থা। শুনানির জায়গা তৈরি, হাজারিবাগ থেকে অন্যদের আনা - সেসবে আরও তিন মাস কেটে গেল। 

    জামশেদপুরের প্রথম সকালেই বীনা এসে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিল, মেটিনের নজর বাঁচিয়ে। বীনার কাছেই ভারতের সাধারন গ্রামীণ মানুষ, কৃষকদের জীবন নিয়ে অনেক কিছু জানতে পারি। কাছাকাছি বয়সী এই মেয়েটির ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার জায়গা নিয়ে নিয়েছিল আমার কাছে খুব সহজেই। বীনার জন্ম ভূমিহীন চাষীর ঘরে - শৈশব থেকে অন্যের ক্ষেতে মজুর খেটেছে। ছোটবেলায় বিয়ে হয়েছে, কিন্তু গরীব বাবা ঠিকমত পণ দিতে পারেনি বলে বর আর শাশুড়ির অত্যাচার শুরু হয়েছে বিয়ের পর থেকেই। দৃঢ়চেতা বীনা এসব মেনে নিতে পারেনি - শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে স্বামীর ঘর ছেড়ে ১৯৭০ সালে ফিরে এসেছিল বাবার বাড়ি মেদিনীপুর।
    সেখানে তখন নকশালরা তাদের দ্বিতীয় মুক্তাঞ্চল দখল করার পথে।

    ১৯৭১ সালে পুলিশ বীনাকে গ্রেপ্তার করে নক্শাল সন্দেহে। সপ্তাহখানেক হাজতে রাখে, জেরার নামে প্রতিদিন, ক্রমাগত মারধোর করে, তারপর রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত, অর্ধচেতন অবস্থায় জেলে পাঠায়। কোনরকম একটু সুস্থ হওয়ার পর আবার হাজতে, আবার এক সপ্তাহ জেরা ও নৃশংস মার। আমার সঙ্গে যখন দেখা তখনও বীনার সর্বাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন, কানে চোট লেগে মাথা ঘোরে, যন্ত্রনা আর থেকে থেকে জ্বর। কিন্তু বীনা শক্ত মেয়ে। বীনার সব থেকে বড় রাগ ছিল, পুলিশ ওর ঋতুশ্রাবের সময় কোন কাপড় পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেয়নি। জেলেও অবস্থা তেমন কিছু আলাদা ছিল না। হাজারিবাগে কখনো কখনো নোংরা, উকুনে ভরা কাপড়ের বান্ডিল গরাদের ফাঁক দিয়ে ছুঁড়ে দেওয়া হত- বেচেবুছে পরিস্কার করে ঋতুশ্রাবের সময় ব্যবহার করার জন্য। জামশেদপুরে ওসবের আলাদ কোন ব্যবস্থাই ছিল না। মেয়েরা তাদের শাড়ি থেকে, কখনো কম্বল থেকে কাপড় ছিঁড়ে ধুয়ে শুকিয়ে ব্যবহার করতো।

    বীনার সঙ্গে আমার য্খন দেখা তখন সদ্য ওর বাবা মারা গেছে। বাড়ির কাউকে ও অনেকদিন দেখেনি - কারন জামশেদপুর আসতে দশ টাকা গাড়ি ভাড়া লাগে, আর জেলের দরজায় ঘুষ দিতে হয় - ঐ টাকা জোটানো বীনার বাড়ির লোকের পক্ষে সম্ভব না। ওকে দেখে বুঝতে পারতাম বীনা কখন ওর বাড়ির মানুষের কথা ভাবছে। আবহাওয়ার সামান্য বদলে বীনা বিষন্ন হয়ে পড়তো - ফসলের কী হবে, ফসলের ক্ষতি হলে বাড়ির মানুষের কী হবে। ফসল ভালো না হলে স্থানীয় মহাজনের থেকে ১০০% সুদে ধান কর্জ নেওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই।
    বীনার সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে কোন অপ্রত্যাশিত আবহাওয়ার বদল ছিল জেলের গুমোট ঘেমো কুঠুরির একঘেয়ে দিন রাতের মধ্যে এক ঝলক হঠাৎ খুশির চোদ্দ আনা। এর আগে আমি কখনো ভাবতেই পারিনি হঠাৎ না বলে কয়ে আসা এক দিনের বৃষ্টিতে একটি পরিবার চিরকালের মত অনিশ্চিতের চক্রে ডুবে যেতে পারে। 

    আমার সঙ্গে কথা বলার সময় মেটিনের থেকে সাবধান থাকার ব্যাপারে বীনার আন্দাজ ঠিক ছিল। এর মত এত বিতৃষ্ণা বোধহয় আমার আর কোন সহবন্দীর প্রতি কখনো হয়নি।  এক কালে রঙচঙে, এখন নোংরা ও মলিন সিল্কের শাড়ি, হাতে সোনার চুড়ি, নাভির নীচে বাঁধা শাড়ির ঘের উপচে চর্বির থাক - এই মহিলাকে দেখে মনে হয় যেন বেশ্যাখানার বাড়িওয়ালি। মনে হওয়াটা খুব ভুলও না। অন্যদের কাছে শুনলাম ও ঘাঘু মেয়ে পাচারকারী - অনেক মেয়েকে দেশের নানান প্রান্তে ও বিক্রী করেছে। ও আর ওর জামিনে থাকা চার মেয়ে এক বড় পাচারচক্রের ছোট অংশ। ওদের ভূমিকা ছিল গরীব বাড়ির মেয়েদের খাবার, জিনিসপত্র দিয়ে, স্বচ্ছল ভবিষ্যতের লোভ দেখিয়ে বাড়ি থেকে ফুসলে বের করে আনা।

    তিনজন মেয়েকে বেচে দেওয়ার আগে উদ্ধার করে চাইবাসা জেলে রাখা হয়েছিল - কোর্টে কেস উঠবে, জবানবন্দি নেওয়া হবে - এইসবের জন্য। দু'বছর পর আমি যখন দেশে ফিরে যা, তখন এই মেটিন জামিন পেয়ে গেছে, কিন্তু ঐ তিন মেয়ে তখনও চাইবাসা জেলে। একজন কয়েদী জামশেদপুর থেকে চাইবাসা বদলী হয়েছিল - মেটিন ওকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিল ঐ তিনজনকে - ওর বিরুদ্ধে বয়ান দিলে বিপদ হবে।

    যত দিন যাচ্ছিল এই মেটিনের প্রতি আমার বিরাগ বেড়ে চলেছিল। হাজারিবাগেও চল ছিল নতুন কয়েদী এলে মেটিন তল্লাশি করে জিনিসপত্র কয়েদীকে ফিরিয়ে দেবে, দামী কিছু থাকলে জ্ল অফিসে জমা হবে। এই মেটিন নতুন কয়েদীদের থেকে তল্লাশির সময় যাই কিছু আদায় করা যায়, যেটাই অন্য কোথাও বিক্রি করে দিতে পারার সম্ভাবনা আছে - পয়সা, তামাক, রুমাল, দেশলাই - সব কেড়ে নিতো। পরে জেনেছিলাম ও যা কিছু পরে - গয়নাগাঁটি সমেত - সবই অন্যদের থেকে কেড়ে, হুমকি দিয়ে, না হয় ভুলিয়ে নেওয়া। এ একটা লোহার রড নিয়ে সবাইকে শাসন করে বেড়াতো - মারধোর, অকথ্য গালাগাল, জিনিস কেড়ে নেওয়া - আর সবার ওপর, ওয়ার্ডারের কাছে কয়েদীদের নামে লাগিয়ে। একাধিকবার দেখেছি মেটিনের বানানো গল্প শুনে ওয়ার্ডারদের হাতে কয়েদীদের মার খেতে।
    পরে অবশ্য আমার প্রতিবাদের পর সুপারের আদেশে ওয়ার্ডারদের মহিলা বন্দীদের গায়ে হাত তোলা বারন হয়েছিল। 

    শুরু থেকেই আমার আর বীনার মেলামেশা ওর চক্ষুশূল হয়ে গিয়েছিল। বীনাকে তার জন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হত; একদিন আমি ওকে বীনা আর আমার ব্যপারে নাক গলাতে নিষেধ করলাম। সেই সন্ধ্যায় ও ওয়ার্ডারকে নালিশ করলো আমি নাকি ওকে মেরেছি। কথাটা মিথ্যে তো ছিল, কিন্তু মেটিনের ব্যবসায় ওয়ার্ডারের বখরা ছিল, তো ওয়ার্ডার এই নিয়ে সুপারের কাছে নালিশ করলো। আমার সেল আর অন্যদের সেলের মাঝের গরাদ- যেটা আমার অনুরোধে খোলা হয়েছিল - সেটা আবার বন্ধ হল। 

    জেলের হাল হকিকৎ দেখে এইটা বুঝলাম যে বীনার আমার সঙ্গে থাকুক - এমন আবেদনে কোন কাজ হবে না। আমি সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে গিয়ে বললাম আমার এই অংশের ঝাঁটপাট, সেল পরিস্কার, সব সাফ সুতরো রাখা - এসব আমার একার পক্ষে সম্ভব না। আমি জানতাম জেলারের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য জুক্তি হবে - যে একজন 'শিক্ষিত' মানুষের পক্ষে এসব কাজ করা সম্ভব না। সুতরাং বীনাকে আমি আমার 'অ্যাটেন্ডেন্ট' হিসেবে পেলাম। 

    এইসব ছোটখাটো ধূর্ততার সঙ্গে জেলে আসার আগে আমার কোন পরিচয়ই ছিল না - কিন্তু বুঝলাম জেলের ভেতর টিঁকে থাকার এইসব কায়দা মানুষ এমনি শিখে যায়।
    এই নতুন ব্যবস্থায় আমাদের হাতে কিছু নিরিবিলি ও শান্ত সময় এল। আমার সামান্য বাংলা জ্ঞানে ভর করে বীনাকে লিখতে পড়তে শেখাতে শুরু করলাম। বীনা খুব তাড়াতাড়ি শিখছিল। আমরা কিছু চকখড়ির ব্যবস্থা করলাম - তা দিয়ে পাথরের মেঝেতে লিখতাম। সব কটা বাংলা অক্ষর আমি জানতাম না, তবে ধ্বনির জন্য কোন অক্ষর তা মোটামুটি জানা ছিল। আমার শেখানোর পদ্ধতিও খুবই অভিনব মত ছিল, কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই বীনা এতটা শিখে গেল যে মায়ের কাছে এক পোস্টকার্ড চিঠি লিখে ফেলা যায়! 
    সেই পোস্টকার্ড অবশ্য পৌঁছবে না কোথাও - চিঠি পত্রের লোক দেখানো ব্যবস্থা শুধু জেলের দপ্তরীদের পকেট ভরানোর ফন্দী। 

    গ্রামের জীবনের পাশাপাশি কর্মঠ আর দক্ষ বীনা আমাকে শেখালো শুধু বালি দিয়ে ঘষে ঘষে কী করে অ্যালুমিনিয়ামের বাসন রুপোর মত ঝকঝকে করে মাজা যায়, তেলের বাতির কাচ কী করে চকচকে করে পরিস্কার করা যায়, বিনা সাবানেও কেমন ধবধবে করে কাপড় কাচা যায়। রাতে বীনা অনয়্দের সঙ্গে অন্যদিকের সেলেই থাকতো, কিন্তু এই ব্যবস্থাটা সব মিলিয়ে ভালৈ চলছিল - বীনার অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, আমিও রাতে নিজের পাড়াশুনো করে ফেলতাম।

    হাজারিবাগের জেলে আমরা জামশেদপুর জেলের দাঙ্গার কথা শুনেছিলাম। ১৯৭০ সালের শরৎকালে জামশেদপুর জেলের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল বন্দীদের প্রতিবাদ। মূল প্রতিবাদ ছিল মাত্রাতিরিক্ত ভিড়, জল, আর চিকিৎসার অভাব নিয়ে। শুরুতে সমস্যা মেটানোর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছিল। তারপর দেখা গেল প্রতিবাদের নেতৃস্থানীয়দের ধরে অন্যত্র বদলি করে দেওয়া হয়েছে, বাকি সব যে কে সেই। পুরুষদের একটা সেলে একশোর ওপর কয়েদী, নানান রকম ছোঁয়াচে রোগ, দেখা গেল রোজই সেল থেকে একটা করে মৃতদেহ বেরোয়। অন্যদিকে ঘুষ দিতে পারলে একটু ভালো শোয়ার জায়গা, বেশি খাবারের অভাব নেই - এই বেশি খাবারটা আসে যে ঘুষ দিতে বা মারপিট করে কেড়ে নিতে পারে না তার ভাগের থেকে। ঠিকাদাররাও জেলের কর্মীদের ঘুষ দিয়ে ওজনে কম, মানে খারাপ জিনিস আপসে সরবরাহ করে চলে। হাজারিবাগ বা জামশেদপুর জেলে পুরুষ কয়েদীদের প্রতিবাদ আমি দেখেছি এসব নিয়ে কয়েকবার। সাধারনত কেউ কোন উঁচু ছাদের ওপর বা গাছের ডালে চেপে বসে, সমস্যার সমাধান করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের নামানো হয়। কিন্তু কোন স্থায়ী সমাধান কখনোই হয় না।
    জামশেদপুর জেলে নিজের খাবার রান্না করার কোন ব্যবস্থা সাধারনভাবে ছিল না। আলাদ কোন ব্যবস্থা না করে আমিও অন্যদের যা দেওয়া হত তাই খেতাম। শুধু কেরোসিন স্টোভে চা বানিয়ে খাওয়ার একটা ব্যবস্থা রেখেছিলাম। জেলের রান্নাঘর আমার কুঠুরির দরজার বাইরে দেওয়ালের ঠিক পেছনে। ভোর তিনটেয় আমার ঘুম ভাঙে রান্নাঘরের হাঁকডাক, ভাত রান্নার বিশাল লোহার ডেকচি কলের তলা দিয়ে গড়িয়ে আনার আওয়াজে। রাঁধুনীরা সকাল সকাল শুরু করে কারন রান্নাঘরে কয়েদীদের এক চতুর্থংশের রান্নাই শুধু একবারে করা যায়। তাই পুরো জেলের খাবার তৈরি করতে চারবার রান্না চাপাতে হয়। ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ আধোয়া চাল ফোটার অদ্ভুত একটা গন্ধে বাতাস ভরে ওঠে। ফুটে ওঠা ভাত দাওয়ায় পেতে রাখা বস্তার ওপর ছড়িয়ে রাখা হয় - পোকা, মাছি, পাখি, ধুলোর মধ্যে - যতক্ষন না বেলা দশটা এগারোটায় কয়েদীদের খাওয়ার সময় হয়। ঐ পিচ্ছিল ভাত আর আধকাঁচা চাপাটি অচিরেই আমার হজমশক্তিকে ভয়নক রকম কাবু করে ফেললো। তারমধ্যে জামশেদপুরের গ্রীষ্ম তখন তুঙ্গে। আমার শুরু হল আমাশা আর জ্বর। মে মাসে চূড়ান্ত গরম -  আমি অষ্টপ্রহর ঘেমে নেয়ে থাকি - তার মধ্যে স্নান করতে পারি না- স্নান করলে চুল শুকোয় না - ভেজা চুল ঘাড়ের ওপর পড়ে থেকে ঘা হয়ে যায়। আমরা সবাই ঘামাচিতে কাহিল - আমি সারাক্ষন বিরক্ত, ক্লান্ত, অশান্ত হয়ে থাকি। ঘন্টাখানেক একটানা বসে পড়া মনে হয় কী সুবিশাল কাজ- ভারী মাথা কেবলই মাটির দিকে ঝুঁকে নুয়ে পড়ে। একবার শুলে উঠে দাঁড়ানো মনে হয় প্রাণান্ত পরিশ্রম। গরমে যেন ধমনী শিরা ফুলে উঠে রক্ত চলাচলও কষ্টকর করে তুলেছে।  

    প্রতিটি গাঁটে এমন যন্ত্রনা যে দু'ধাপ সিড়ি বেয়ে ওঠা যেন পাহাড়ে চড়ার মত। রাতে শোয়ার সময় জামা কাপড় গায়ে রাখতে পারি না - পাথরের মেঝেতে শুয়ে মনে হয় নক্শাল সেলে ডান্ডাবেড়িতে থাকা কয়েদী, বা জেনানা ফাটকের মেয়েরা - শিশুসন্তান সহ নারকীয় গরমে অসহ্য ভিড়ের ঘুমনোর চেষ্টা করছে। সেই তুলনায় তো আমি অনেক আরামে আছি।
    দুজন পুরুষ বন্দী - মেদিনীপুরের- ওদের হল গুটিবসন্ত। পুরুষ বন্দীদের মধ্যে বসন্ত ছড়িয়ে পড়লো, কিন্তু আশ্চর্য, মেয়েদের দিকে কারো কিছু হলো না। আমাদের সবাইকে - প্রতিটি মেয়েকে ধরলো খোস - অষ্টপ্রহর অসহ্য চুলকুনী। রাতে চুলকুনীতে ঘুম ভেঙে যায় - উন্মাদের মত চিরুনী ঘষে ঘষে চুলকোতে থাকি সর্বাঙ্গ। ডাক্তার কী যেন একটা সাদা বড়ি দেয় সবাইকে - তাতে আদৌ কোন কাজ হয় না। শীতে হাজারিবাগ ফিরে একটা মলম পাওয়ার আগে পর্যন্ত খোস আমার কমেইনি। অন্যদের ভাগ্য এত ভালো ছিল না। চুলকোতে চুলকোতে একেকজনের শরীর ঘায়ে ভরে গিয়েছিল। জেল অফিসে এক পুরুষ বন্দীকে দেখেছিলাম - তার পা বিষক্ত ক্ষতে ভরে ফুলে গিয়েছে - সে হাঁটতেই পারছে না। জেলার বললো "ওদের" চিকিৎসার চেষ্টা করে লাভ নেই, "ওরা" পরিচ্ছন্ন থাকতে জানে না। এই ভীড়াক্রান্ত কুঠুরিতে কেউ নিজেদের পর্যাপ্ত জল বা সাবান ছাড়া কী করে পরিচ্ছন্ন রাখতে পারে তা আমার বোধগম্য হলো না। 

    জুনের মাঝামাঝি, আমার সহ-অভিযুক্তরা হাজারিবাগ থেকে জামশেদপুরে বদলি হয়ে এল। এর কদিন পর, ১৯৭৩, ১৯শে জুন, আমাদের সকালের ধোয়া কাচা স্নানের রুটিন থেমে গেল ডান্ডাবেড়ি আর চিৎকারের আওয়াজে - "মার, মেরে ফ্যাল"। আমরা কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে স্থির হয়ে গেলাম - কোথা থেকে আসছে - কে কাকে মারছে - আমরা কী করবো - বুঝতে না পেরে। আওয়াজটা এগিয়ে আসতে লাগলো - আমার ফাটকের বাইরে দেওয়ালের ঠিক উল্টোদিকেই  - চিৎকার, আওয়াজ, প্রচন্ড মারের শব্দ; আমরা শুনলা একটি ছেলে চিৎকার করছে জল দাও, একটু জল দাও বলে, আরেকজন মা গো বলে চিৎকার করে থেমে গেল। আমি আর বীনা একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছিলাম - কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে। অন্য মেয়েরা দৌড়ে গেল দুই ফাটকের গেটের দিকে।

    একটা জিনিস বোঝার জন্যে আমাদের চিন্তাও করতে হয়নি - ডান্ডাবেড়ি, মারের আওয়াজ, চিৎকার - মানে নক্শালরাই শিকার হয়েছে।
    মার শেষ হওয়ার পর জেলের পাগলা ঘন্টি বাজলো। ঘন্টি না বাজলে পরে কর্তৃপক্ষের কাছে কাগুজে প্রমাণ দিতে অসুবিধে হবে যে বন্দীরা দাঙ্গা করায় বল প্রয়োগ করা হয়েছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৩১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৩:২৭528271
  • অনেকদিন বাদে আবার শুরু হল। চলুক চলুক।
    বেশ কিছু টাইপো আছে। 
  • বর্গীয় জ | ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৮:৪৮528273
  • হ্যাঁ, অনেক টাইপো, বানান ভুল আছে, দেখে শুনে এডিট করতে হবে।
    লিখে ফেলবো বাকিটা, শুরুতে যেমন প্রায় রোজ লিখছিলাম সেটা হবে না কিন্তু সপ্তাহে একটা দুটো লিখতে হবে।

    ডিসেম্বর মাস থেকে বইমেলার কাজকর্মে অন্য কিছুতে মন দেওয়া দুঃসাধ্য হয়, মেলা মিটে গেলে হাতে বেশ অনেকটা সময় - এমন একটা মনে হওয়ার ব্যাপার আসে - ওটা থাকতে থাকতে লিখে ফেলতে পারলে ভালো!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন