এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • মাই ইয়ার্স ইন অ্যান ইন্ডিয়ান প্রিজনঃ মেরি টাইলার। অনুবাদ

    বর্গীয় জ লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ০১ আগস্ট ২০২৩ | ৩৬৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • সঙ্গীসাথী
    ~~~~~~

    এখন আমার পাশের সেল ফাঁকা, নিঃস্তব্ধ রাত। লেওনি নামে একজন অল্প বয়সী ওয়ার্ড্রেস ছিল - ওর খারাপ লাগতো আমাকে দেখে। সপ্তাহখানেক পর থেকে লেওনি এসে আমার সেলের কাছে বসতে লাগলো মাঝে মাঝে। ওর বয়েস খুব বেশি হলে কুড়ি একুশ হবে - এত অল্প বয়সে জেলের চাকরী পেল কী করে তাই ভেবে আমি অবাক হতাম। লেওনির সৎ বাবা মারা যাওয়ার পর সৎ ভাইরা ওকে আর ওর মা-কে, পাঁচজন ছোট ভাইবোন সহ বাড়ি থেকে বের করে দেয় - জমির ভাগ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য। মা সহ বাচ্চারা এক পরিচিতের বাড়ির দাওয়ায় শুতো, কোন থালা বাটি ছিল না - খাবার খেত বড় বড় গাছের পাতায়। খাবারের মধ্যে একমাত্র বৈচিত্র ছিল ঐ উঠোনের কী একটা গাছের পাতা সেদ্ধ। আস্তে আস্তে লেওনি আর ওর মা দালান তৈরীর ইট বালি সিমেন্ট বইবার মজুরের কাজ জোটায়। এখন জেলখানার সরকারী চাকরি করে ওর মাথার ওপর ছাত, দুবেলা নিশ্চিত খাবার জুটছে, ছোট ভাইদের স্কুলের খরচ দিতে পারছে।  
    মিশনারী ধর্ম প্রচারকদের প্রভাবে এখানে অনেক জনজাতির মেয়েই খ্রীস্টান। যারা পুরনো ধর্মে থেকে গেছে তাদের অনেক সময়ই নতুন হওয়া খ্রীস্টানরা অসভ্য, জংলী বলে ঠাট্টা করতো, ইওরোপিয়ান আদব কায়দা নকল করার চেষ্টা করতো। লেওনিও খ্রীস্টান, কিন্ত ও এমন করতো না - লেওনির প্রকৃতিটাই ছিল দৃঢ় কিন্তু সহমর্মী। ওর অকপট স্বভাব, চিন্তার সততার জন্য আমি ওকে সম্মান করতাম, বন্ধু বলে মনে করতাম। জেলের অন্য সব কর্মীদের সঙ্গে ওর একটা খুব বড় তফাত ছিল - কয়েদীদের লেওনি নির্বিচারের অপরাধী বলে মনে করতো না - সরকার খেতে থাকতে দিয়ে ওদের ধন্য করছে মনে করতো না। লেওনি জানতো জেলের কয়েদী  মাত্রেই অপরাধী, আদৌ ব্যাপারটা সেরকম না। ওর নিজের অবর্ণনীয় দারিদ্রের দিনগুলি ও ভোলেনি - মাঝে মাঝে হতদরিদ্র কয়েদীদের দরকার বুঝে ওদের জন্য ও নিজের পুরনো কাপড় নিয়ে আসতো। 

    ঐ বছর হিন্দুদের সব থেকে বড় উৎসব দুর্গা পুজোর সময় একটা বিশেষ ছাড় পেলাম। জেল খানার মূল চত্ত্বরে একটা জায়গা ছিল যাকে স্কুল আর লাইব্রেরি বলে উল্লেখ করা হত - ওখানে কয়েদীরা দুর্গার প্রতিকৃতি তৈরী করে পুজো করছিল। ঠিক হলো পুরুষ বন্দীরা সব ফাটকে বন্দী থাকাকালীন মেয়েরা ওখানে পুজো দেখতে যাবে - তাদের সঙ্গে আমিও যেতে পারবো। স্কুল লাইব্রেরি জায়গাটা আসলে মেয়েদের ফাটকের থেকে একটু ছোট একটা দালান, বই খাতার কোন চিহ্নই নেই - পুরুষ বন্দীদের রাখার জন্য ব্যবহার হয়। পুজো দেখতে গিয়ে দেখা গেল ভাঁজ করা কম্বলের ওপর শূন্য দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে ছায়া ছায়া ভূতের মত কয়েদীরা বসে আছে - ওদের পেছনে, গারদের ভেতরেই ঠাকুর। আমরা গরাদের বাইরে ভিড় করে দাঁড়ালাম "দুর্গা মা"কে দেখতে। পেছনে পুজো উপলক্ষে সেজেগুজে জেলের রক্ষীরা সব, আমাদের ওপর নজর রেখে। সবাই নীরবে ঠাকুর দেখছে, হটাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে শোনা গেল প্রকাশের পঙ্গু মা-র কাতর আবেদন- "মা দুর্গা, আমার ছেলেটার বিচি ফুলে গেছে, একটু দেখো মা"। পেছনে একটা চাপা হাসির রোল উঠলো। "কে রে ওটা? বিসনি? আমি ঠিক জানতাম" - সহকারী জেলার চাপা গলায় বললো।
    সত্যিই প্রকাশের অন্ডকোষ ফুলে গিয়ে কষ্ট পাচ্ছিল - জেলের ডাক্তার কিছু করতে পারেনি, ও বাইরে থেকে কীসব জড়িবুটি আনিয়েছিল, সেসবেও কাজে হয়নি। তখনই ও ঠিক করেছিল পুজোর সময় দুর্গা মা-র কাছে বলবে।
    আর মজার ব্যাপার হল, সত্যিই কদিন পর প্রকাশ সুস্থও হয়ে গেল!
    পরে আমরা যখনই ওকে এটা নিয়ে আওয়াজ দিতাম, বিসনি বলতো, "কাজ তো হল, নাকি বল"?

    পুজোর পরপর তদারকি আর পাহারার ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন হলো। একজন নতুন ওয়ার্ড্রেস বহাল হল - তার মানে এখন থেকে দিনে দু'জন, রাতে তিনজন। ওয়াচটাওয়ারে সার্চলাইট লাগানো হল। অবশ্য আমার সবচে কাছের টাওয়ারের সার্চলাইট প্রথম এক বছর কাজ করেনি। আর রাতে আমার সেলে অন্য কয়েদী দেওয়া হল - এই সেলে রাতে এখন আরও তিনজন শোবে। এটা অবশ্য আমার একাকীত্ব দেখে দয়া করে না, পঁচিশে জুলাইয়ের গোলমালের ফলে।

    চারজন আনকা মানুষ ছোট একটা কুঠুরীতে। নভেম্বর মাস, বর্ষার স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা এখনো শুকোয়নি, ভোরে গরাদের ভেতর দিয়ে কুয়াশা আসে। আমরা রাতে ঠান্ডা থেকে বাঁচার জন্য কাছাকাছি বিছানা করে শুই, সারা সন্ধ্যে নিজেদেরে মধ্যে গল্প করে, ধাঁধাঁ বলে সময় কাটাই। আমি অবশ্য খুব একটা যোগ দিতে পারতাম না - স্থানীয় ঠেঁট হিন্দি এখনো বলতে পারি না। কিন্তু অনুবাদ করে দেওয়ার জন্য কল্পনা ছিল না, দ্রুত শিখে নিচ্ছিলাম।

    গরাদের কাছে শোয় বুলকানি। হাঁপানীর রোগ, বয়স হয়ে গেছে, কাছেই কয়লাখনিতে মজুরের কাজ করতো। ছোটখাটো চুরির দায়ে বিনা বিচারে তিন বছর ধরে জেলে আছে। ওর সবসময় হাল্কা জ্বর জ্বর থাকে, কিন্তু শীত করে না - তাই বাইরের দিকে শুতে পেরে খুশি - তাতে আবার আমাদের দিকে ঠান্ডা হাওয়াটা আড়াল হয়। তারপর মোহিনী - বর আর ছেলের সঙ্গে আটক - জমির বিবাদের বৌদি খুন হয়েছে। ছোট ছোট চারটি ছেলেমেয়ে আছে ঘরে - সামান্য চাষবাষ কী করে ওরা চালাবে সেই ওর সারাক্ষনের দুশ্চিন্তা। পালা পার্বনে যখনই বিশেষ কিছু খাবার দিত জেল থেকে, মোহিনী খেতে পারতো না, ছোট বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে কাঁদতো। মাঝে মাঝে এক ছেলে দেখা করতে আসতো - প্রতি বার দেখা হওয়ার পর ও ঘন্টার পর ঘন্টা বসে কাঁদতো - বাইরে ঋণের বোঝা কেবল বেড়েই চলেছে। একবার ছেলে এসে বললো দুটো বলদ মরে গেছে। চাষবাস চালানোর আর কোন উপায় নেই - তাই জমি বন্ধক দিয়ে মোহিনীর জামিনের চেষ্টা করবে এবার।

    আমার পাশে শুতো পান্নো। ও সাঁওতাল। সাঁওতালরা ওদের সাহস আর বীরত্বের জন্য বিখ্যাত- আঠারোশো পঞ্চান্ন সালে হুল বিদ্রোহে বৃটিশদের বিরুদ্ধে লড়েছে। পান্নো রাতে স্বপ্ন দেখে কেঁপে কেঁপে ওঠে, কাঁদে। পাথর মাথায় মেরে মেয়েকে মেরে ফেলেছে - ঐ মেয়ে স্বপ্নে আসে। মাঝে মাঝে সকালে বিরবিড় করে বলতো - "ওকে মারতেই হত। হারামজাদী আমার জন্যে কলংক নিয়ে এসেছিল। মারতেই হতো"। মেয়ের সঙ্গে গ্রাম প্রধানের ছেলের ভাব ছিল। মেয়ে গর্ভবতী হয়ে যায়, প্রধান বিয়ে দিতে রাজি হয় না। গ্রামের মানুষের টিটকিরি শুনে পান্নো মেয়েকে একপ্রস্থ মারধোর করে। তাতেও শান্তি না হওয়ায়, একদিন কাঠ কুড়নোর নাম করে মেয়েকে জঙ্গলে নিয়ে যায়। মেয়ে কাঠ কুড়োচ্ছিল, পান্নো  পেছনে থেকে পাথর দিয়ে মাথায় মারে। মেরেই ফেলে।
    তারপর নিজেই পুলিশের কাছে ধরা দেয়। কুড়ি বছরের সাজা হয়েছে - চার বছর কেটেছে।
    পান্নোকে দেখে মনেই হতো না ও রাগ করতে পারে। নম্র, শান্ত, প্রায় নিরীহ বয়স্ক মহিলা - কেউ কড়া করে কিছু বললে কেঁদে ফেলে - কাউকে মুখের ওপর কিছু বলতে পারে না। মাঝে মাঝে আমার কাছে আসতো - উপোস করে কত পয়সা হল, বা কোন ওয়ার্ড্রেস কত দিয়েছে গুণে দিতে। মাঝেমাঝেই রোব্বার জমানো গুড় আর ময়দা দিয়ে বলতো - "আমাকে দুটো পিঠা বানিয়ে দে না, মেয়ে"।

    পরিবারের সম্মান রক্ষায় খুন আমি আরো কয়েকটা দেখেছি জেল জীবনে - পান্নো তাদের মধ্যে প্রথম। আইনকে ফাঁকি দেওয়ার কোন ইচ্ছে বা উদ্দেশ্য ওদের কারোর দেখিনি। সবাই জেল খাটার, শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রস্তুত হয়েই যা করার করেছে - সবার কাছে এটা কর্তব্য পালন, আর শাস্তিটা কর্তব্যের দাম। ওদের কাছে মূল্যবোধ বা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আইন কানুনের আদৌ তেমন কোন প্রাসঙ্গিকতা ছিল না। আর আমার জেল জীবনে সম্মান রক্ষার খুন ছাড়া পরিকল্পিত খুনের আসামী প্রায় দেখিইনি।

    বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন একেকটা গ্রাম যেন একেকটা আলাদা দেশ - গ্রামের সীমানার মধ্যেই তাদের জীবনের যত অভিজ্ঞতা। এইসব সরল গ্রামীন মানুষের জীবনে ভূত পেত্নী দানো ডাকিনী রাজা রানী, হাজারো সংস্কারের ভীড়। এরা খবরের কাগজ চোখে দেখেনি - প্রতিদিন আমার কাগজে কী লেখা শুনতে এসে গোল করে বসে। কখনো কখনো কেউ জিজ্ঞেস করে ওর কেস নিয়ে বা ওদের গ্রামের কথা কাগজে কিছু লিখেছে কিনা। "সরকার" শব্দটা সবাই শুনেছে, কিন্তু দেশটা ঠিক চলে কীভাবে কেউ ওদের কোনদিন বলে দেয়নি। 
    কিন্তু সবাই খুব আগ্রহী - জানতে, শিখতে। একেকজনের একেকেরকম প্রশ্ন - কেরোসিন তেল কোথা থেকে আসে, কাগজ কী করে তৈরি হয়, খবরের কাগজ কেমন করে ছাপা হয়। অনেক উত্তর জানা থাকলেও আমার ভাঙাচোরা হিন্দিতে সেসব বোঝাতে বেগে পেতে হয় - তাও যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

    একবার ফুলকপির ক্ষেতে শুঁয়োপোকার উপদ্রব শুরু হল - মোহিনী বললো নিশ্চয় কেউ মাসিকের সময় ক্ষেতে ঢুকেছে। কেউ ঘনঘন অসুস্থ হলে সবাই বিশ্বাস করে কারো নজর লেগেছে। বাচ্চাদের কপালে কালো টিকা আর কোমরে তাগা - অশুভ আত্মা থেকে বাঁচানোর জন্য। একবার একজন বয়স্কা কয়েদীর ফিট হচ্ছিল - ফিটের সময় ওর চোখ গোলগোল করে ঘোরে আর সারা শরীর কাঁপে - সেই নিয়ে বিশাল গোলমাল শুরু হলো। মেয়েরা বললো ওর ওপর ডাইনীর ভর হয়েছে - বাচ্চাদের খেয়ে ফেলবে। ওর কাছাকাছি কে শোবে সেই নিয়ে রোজ রাতে ঝগড়া। ওয়ার্ড্রেসকে বলেকয়ে কদিন আমার সেলে শোয়ানোর ব্যবস্থা করলাম। আমার কোন বিপদ হলো না দেখে অবশেষে অশান্তি মিটলো।

    একেকদিন ছেঁড়া জামাকাপড় সেলাই করতে করতে, বা সেঁকা ছোলা বেটে ছাতু তৈরি করতে করতে গ্রামের গল্প শুনতাম। এই গল্পগুলি আমার জন্য একেবারে অশ্রুতপূর্ব বিস্ময়ের আকর ছিল। প্রায় প্রতিটি মেয়ে দারিদ্রসীমার একেবারে শেষ প্রান্ত থেকে এসেছে - নিজেরা কাদা মাটি কাঠ খড় দিয়ে ঘর বেঁধেছে নিজেদের হাতে। বাল্যবিবাহ আইনে নিষেধ, কিন্তু প্রায় সবারই বিয়ে "দেওয়া" হয়েছে অতি শৈশবে। প্রথম ঋতুশ্রাবের পর সবাই শ্বশুরবাড়ি গেছে। যার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে তাকে বিয়ের রাতেই দেখেছে প্রথমবার। যারা শহরের কাছাকাছি থেকেছে, সিনেমা দেখেছে, তারা পাশ্চাত্য পদ্ধতির বিয়ের ব্যাপারে জানে, সেটাকে ওরা "লাভ ম্যারেজ" বলে। কিন্তু ওদের কাছে এসব চিত্রতারকা বা বড়লোকদের ব্যাপার - যাদের সমাজের অনুশাসন না মানলেও চলে। সবারই নানান ভয়ের গল্প জানা আছে - নিজের পছন্দের মানুষের সঙ্গে ঘর বাঁধতে গেলে কী হতে পারে। অবাধ্য মেয়েদের কাউকে ভেড়ার রক্ত খাইয়ে, কাউকে গাধায় চড়িয়ে, কাউকে একঘরে করে, মাথা মুড়িয়ে সমাজ শাস্তি দিয়েছে। কোন মেয়ে এরকম ভাবে পরিবারের মুখে চুনকালি দিলে তার পরিবারকে নিজেদের জাত বাঁচাতে পঞ্চায়েতকে জরিমানা দিতে হয়, গ্রামের মানুষকে খাইয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। এই জাত বাঁচানোর খাওয়ানোকে বলে "জাতভাত"।

    স্বামী একটা বিরাট সম্মানের পদ। মেয়েরা স্বামীর নাম মুখে আনে না। এই করে নানান প্রাশাসনিক ঝামেলাও হয় - জেল অফিসের দপ্তরী মেয়েদের বরের নাম খুঁজে পায় না - এরা বলতে রাজি নয়। কেউ কেউ ফিসফিস করে কোন বয়োজ্যেষ্ঠাকে বলে, সে বয়োজ্যষ্ঠা দপ্তরীকে বলে - তখন গিয়ে সমস্যা মেটে। এছাড়াও পুরুষদের সামনে ঘোমটা না টানা, শ্বশুর বা ভাশুরের সঙ্গে কথা বলা - এসব গুরুতর পাপ।
    এদের বেশিরভাগই বাড়িতে স্বামীর হাতে নিয়মিত মার খেত - ব্যাপারটা অপছন্দ হলেও এটাই নিয়ম, এই সবার মত। নানান গল্প শুনতাম - একজনের বর খাবারে নুন কম বলে ঠেঙিয়েছিল, আরেকজনের ভাত ঠান্ডা ছিল বলে। যতই খিদে পাক, বাড়ির পুরুষদের আগে খাওয়ার নিয়ম নেই। একজনকে ওর পিরিয়ডের দিনগুলিতে বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হতো না। যারা একটু অবস্থাপন্ন, তারা সারাজীবন বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্য বন্দী। যারা বেশি গরীব তাদের বরং একটু স্বাধীনতা - কাজে যেতে হয় ক্ষেতমজুরী, বা নির্মান শ্রমিক। অনেকেরই সতীন আছে, অনেকে আবার ওদের আগের বর মারা যাওয়ার পর দেওরকে বিয়ে করেছে।

    পাশ্চাত্য কায়দা কানুন নিয়ে তো আর কেউ কিছু জানতো না, তাই দেখলাম আমিই আস্তে আস্তে আমার সঙ্গী সাথীদের আদব কায়দা, নীতি নৈতিকতা রপ্ত করে নিচ্ছি! অন্য পুরুষ বন্দী বা ওয়ার্ডারদের সামনে জোরে কথা বলা বা হাসা নিয়ে খুব সচেতন থাকতাম - পাছে কেউ "বেহায়া" ভাবে! পিরিয়ডের সময় বাগানে যাওয়া বন্ধ করলাম, যেন সব্জীতে পোকা ধরা নিয়ে কেউ কিছু না বলে আমাকে। সিঁথিতে সিঁদুর দিতেও শুরু করলাম - যেন কেউ না ভাবে যে আমি অন্য কোন বরের সন্ধানে আছি!

    ডিসেম্বরের শুরুতে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ আর এড়ানো গেল না। মাথার ওপর দিয়ে মুহুর্মুহু উড়োজাহাজ উড়ে যায় - মেয়েরা আর বাচ্চারা হইহই করে বেরিয়ে আসে। লোকজন এসে বিজলি বাতির ওপর টিনের ঠুলি পরিয়ে দিয়ে গেল। রাতে শোনা যেত ভারী ভারী ট্রাক যাচ্ছে বাইরে। সতেরো দিন পর ভারত যুদ্ধে জিতলো - তীব্র জাতীয়তাবাদে ভরপুর খবরের কাগজে শুধু শত্রুদের হারের খবর। ভারতীয় সেনা কিছুদিন পূর্ববঙ্গে থাকল, আর পাকিস্তানী যুদ্ধবন্দীরা বছর দুয়েক ভারতে। 

    যুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর সাইবুন্নিসা, পান্নো আর রোহিনীকে ভাগলপুরে বদলী করা হল। তখন ভাগলপুর বিহারে শুধু মহিলা আসামীদের জন্য তৈরি একমাত্র জেল। আরেকজনেরও যাওয়ার কথা ছিল, ওর পাঁচ বছরের সাজা হয়েছিল - বাড়ি হাজারিবাগ জেলের কাছে। ওর বর সহকারী জেলারকে পয়ঁষট্টি টাকা ঘুষ দিয়ে এখানেই রেখে দেওয়ার ব্যবস্থা করলো। এখানে থাকতে চাওয়ার আরেকটা কারন ছিল - আর এক সহবন্দীর ছেলের সঙ্গে ওর ছ'বছরের মেয়ের বিয়ের আলাপ চলছে।

    শুনলাম রোহিনীর বদলীর দিন, কয়েদের সময় জমা নেওয়ার রুপোর বালা আর হাঁসুলী ফেরত চেয়েছিল অফিসে। সেগুলো পাওয়া যায়নি, অশ্বাস দিয়েছে, ওসব "পরে পাঠানো হবে"। এরকম অনেকগুলি ঘটনা শুনেছি, যখন বন্দীরা বদলী বা ছাড়া পাওয়ার সময় জমা রাখা গয়না, জিনিস বা টাকা চেয়ে ফেরত পায়নি।

    রোহিনীর বদলীর সপ্তাহেই অপ্রত্যাশিতভাবে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে অমলেন্দুর পোস্টকার্ড পেলাম। আমি অমলেন্দুকে কোন চিঠি লিখিনি এতদিন - আমার চিঠি ওর কাছে পোঁছবে এমন আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই যে প্রথমদিনের কেরাণী - যে  আমাকে পুরুষ বন্দীদের লাইনে বসতে বলেছিল - ও-ই চিঠিটা হাতে দিয়েছিল। আমার ওপর ওর খুব সহানুভূতি হয়ে গেছে ততদিনে - মনে হলো ওরও আমার মতই আনন্দ হচ্ছে অমলেন্দুর চিঠি আসায়। অমলেন্দুর বাবা লিখেছিলেন কলকতার জেলগুলোর অবস্থা এখান থেকে অনেক বেশি ভয়ানক। উনি অমলেন্দুকে জানিয়েছিলেন আমি চিন্তা করছি। অমলেন্দুর সংক্ষিপ্ত চিঠিতে বিরাট স্বস্তি পেলাম। সেন্সর পেরিয়ে আসা এই কাটা কাটা শুকনো চিঠিতে লুকনো দুকূলপ্লাবী ভালোবাসা আমি শুষে নিচ্ছিলাম আমার পুরো চেতনা দিয়ে যেন। 

    পরের সাড়ে তিন বছরে ওর লেখা অনেকগুলি চিঠির মধ্যে তিনটে আমার হাতে এসেছিল।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ০১ আগস্ট ২০২৩ | ৩৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:15fc:ebb:aecc:df40 | ০১ আগস্ট ২০২৩ ০৯:০৫521981
  • বেশ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন