এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  বইপত্তর

  • মাই ইয়ার্স ইন অ্যান ইন্ডিয়ান প্রিজনঃ মেরি টাইলার। অনুবাদ

    বর্গীয় জ লেখকের গ্রাহক হোন
    বইপত্তর | ৩১ জুলাই ২০২৩ | ৫১৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • গুলি! 
    ~~~~


    শুরু হল জেল সুপারের কড়া তদারকি। ওয়াচটাওয়ার, রাত পাহারার জায়গাগুলিতে টহল - শুধু কয়েদী না, নজরদারদের ওপরেও নজরদারী। তিনজন কম বয়সী প্রহরী ঘুমিয়ে পড়ে সাময়িক বরখাস্ত হল। সারা রাত শুনতে পাই সান্ত্রী, ওয়াচটাওয়ারের পাহারাদারদের হাঁক, লোহার লাঠি গরাদে হেঁচড়ে ঠনঠন আওয়াজ, ভারী শিকলের ধাতব আওয়াজ, জেলের ঘন্টা। আর দিনের বেলার তদারকি তো আছেই - কোথাও সামান্য সন্দেহজনকও যদি কিছু দেখা যায়। একবার ফাটকে ঢুকে, ডিউটি ওয়ার্ড্রেসকে বললো আমাদের সেল তল্লাশি করতে - আমরা নাকি পিস্তল লুকিয়ে রেখেছি। আরেকদিন খাবারের স্তুপের ওপর থেকে বস্তার ঢাকা সরিয়ে দুটো লেবু পাওয়া গেল - জেলের ডাক্তার আমাকে দিয়েছিল। সেগুলোকে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে, পেয়ারা কোথা থেকে পেলাম সেই নিয়ে একপ্রস্থ জিজ্ঞাসাবাদ, শেষে গন্ধ শুঁকে নিশ্চিত হওয়ার পর নিস্তার।

    সে বছর এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় রোজ বৃষ্টি হলো। আমাদের জামাকাপড়, বইপত্র সব স্যাঁতস্যাঁতে, ছাতা পড়া, চাল, ময়দায় তেতো স্বাদ। দেওয়াল চুঁইয়ে বর্ষার জল ঢোকে, কম্বল, কয়লা, উনুনের লাকড়ি ভিজিয়ে রাখে। বিহারে নানান জায়গায় বন্যা, সপ্তাহের পর সপ্তাহ জলের তলায় জনবসতি, ফসল ডুবে গেছে। খাবার সব্জি, আলু ছাতা পড়া, কালো, খেলে মুখ চুলকোয়। আকাশ যেন চিরকালের জন্য অন্ধকার হয়ে গেছে, বাইরের বাগানের ধ্বংসাবশেষে এঁদো ডোবা।

    এক রোব্বার বিকেলে ভেজা লাকড়ি জ্বালানোর চেষ্টা করছি রাতের খাবার বানানোর জন্য, এমন সময় হঠাত পাগলাঘন্টি, ওয়ার্ডেনদের বাঁশিতে জেল কেঁপে উঠলো। ওয়ার্ড্রেসরা হুড়োহুড়ি করে আমাদের সেলে ঢুকিয়ে তালা দিতে লাগলো। সব গারদের তালা লাগাতে না লাগাতেই শুরু হলো গোলাগুলি। টানা দুঘন্টা অসহায় ভাবে গরাদ ধরে সেলের ভেতর থেকে শুনতে লাগলাম অবিশ্রান্ত গুলির আওয়াজ। ওয়ার্ড্রেসরাও বন্দুকের গুলির থেকে বাঁচার জন্য এদিক ওদিক মাথা গুঁজে লুকিয়ে পড়লো। উদ্বেগে, দুশ্চিন্তায় কাঁপছিলাম থরথর করে, - কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে - মনে হচ্ছিল হৃৎপিন্ড যেন ফেটে যাবে আমার। পাঁচটা নাগাদ চিফ হেড ওয়ার্ডার জেনানা ফাটক তদারকি করতে এল - মাথায় টুপি নেই, উস্কোখুস্কো চুল, খালি পা, উদভ্রান্ত অবস্থা। বিহার মিলিটারি পুলিশ জেল ঘিরে রেখেছিল - ওরা আমাদের তল্লাশি করতে এল রাত নটা নাগাদ। ওদের অফিসার খুব উল্লাসের সঙ্গে বললো বেশ কয়েকজন নকশাল গুলি খেয়ে মরেছে।

    পরদিন বেলা করে আমাদের সেলের তালা খুলললো। ওয়ার্ড্রেসকে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে, কিছুই জানা গেল না - চিফ হেড ওয়ার্ডারের হুকুম। আমাদের উদ্বেগ দেখে একজন বললো বিড়ি আর খৈনি নিয়ে নাকি কয়েকজন রক্ষী আর কয়েদীর মধ্যে মারপিট হয়েছে, আকাশে ফাঁকা গুলি করা হয়েছে নাকি। আমাদের বিশ্বাস হলো না।

    পরদিন, খাবার দিতে যে আসতো, ও গলার কাছে হাত দিয়ে আর আঙুল তুলে ইশারায় বলও, দশজন মারা গেছে।
    ওদের মধ্যে অমলেন্দু নেই তো?
    কখনো কখনো মনে হত অমলেন্দু বোধহয় আর নেই, আবার কখনো নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করতাম - সব ঠিকই আছে।  এর বেশ কয়েক সপ্তাহ পর অমলেন্দুর বোনেরা দেখা করতে এল - বললো অমলেন্দুর সঙ্গে ওদের দেখা, কথা হয়েছে। পরে জেনেছিলাম আমাদের সঙ্গে যারা আটক হয়েছিল তারা কেউই এতে ছিল না। এই ঘটনা ২৫শে জুলাই, ১৯৭১এর। ডেপুটি হাই কমিশনার আমাকে লন্ডন টাইমস পাঠাতে শুরু করেছিল, জেল কর্তৃপক্ষ আবার সেটা সেন্সর করতো না। অগাস্টের শেষে লন্ডন টাইমসে পড়লাম, সেদিন ষোলজন নক্শাল বন্দী মারা গিয়েছিল। পরে জেনেছিলাম, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার খবরে ছিল, এদের মধ্যে বারোজনকে বন্দুকের গুলিতে না, পিটিয়ে খুন করা হয়েছে। 

    কয়েক মাস পর একজন ওয়ার্ড্রেস আমাকে পুরো গল্পটা বলেছিল। নক্শাল বন্দীদের একটা দল নাকি, সেলের দরজা ভেঙে জেলের প্রধান ফটকের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। জেল সুপার তখন গুলি চালানোর আদেশ দেয়। ঐ কয়েকজন গুলিতে নিহত হওয়ার পর, কিছু 'বিশ্বস্ত' কয়েদীদের সঙ্গে নিয়ে রক্ষীরা অন্য নক্শাল ফাটকগুলিতে হামলা করে, কিছু বন্দীকে কাছে থেকে গুলি করে, আর বাকিদের পিটিয়ে মারে। জনা ছয়েক কয়েদীকে নিয়ে যা শুরু হয়েছিল, সেটা মোটামুটি একটা খোলামেলা হত্যালীলায় বদলে যায় সেই সন্ধ্যায়। ষোলজন নিহত ছাড়া, আরও একমাস পরেও, একত্রিশজন গুরুতর আহত বন্দী তখনও জেল হাসপাতালে। কয়েকবছর পর চিফ হেড ওয়ার্ডার বলেছিল সেদিন ও ডিউটিতে থাকলে হয়তো পুরো ঘটনাটা এড়ানো যেত - সম্ভবত ঐ জনা ছয়েক বন্দীর পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ আগেই জানতো, এই হত্যালীলা চালানোর জন্য ইচ্ছে করেই ওদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

    জেল সেন্সরের ভুলে একটা খবর আমাদের চোখে পড়ে গেল। উত্তর কলকাতার কাছে বারাসাতে রাস্তার ধারে এগারোজন "সন্দেহভাজন নক্শাল" তরুণের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেছে। গুজবে প্রকাশ, পুলিশই এই খুনগুলি করেছে। একই রকম ভাবে দমদম আর শহরতলীর ডায়মন্ড হারবারেও তরুণদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ পাওয়া গেল। কাগজে বেরোচ্ছিল থানায় নক্শাল সন্দেহে তরুণদের স্রেফ পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। একবার কাগজে এক পাঠকের চিঠি বেরুলো - বাড়ির কাছের থানা থেকে ভেসে আসা আর্তনাদে পাড়ার মানুষ ঘুমোতে পারছে না। কল্পনার বাড়ি থেকে বেশ কদিন কোন খবর আসছিল না - একদিন জানা গেল ওর এক ভাই আর ভাইপো নকশাল সহযোগী সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়েছে। 
    তিন মাস ওরা আটক ছিল।

    জেল জীবনের পরের দিকে, কারা বিভাগের এক কর্মচারীর আত্মীয়ার সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। ও বলছিল, কীরকম ভয়ানক অন্ধকার সময় ছিল সেটা - বীরভূম জেলায়, ওর বাড়ির কাছে - যুবক ছেলেদের পুলিশ বাড়ি থেকে ডেকে বের করে ওখানেই গুলি করে মেরে দিত। মনে হচ্ছিল সরকার, প্রশাসন, নক্শাল দমনের জন্য পুরোপুরি আতঙ্কের রাজত্ব কায়েম করে দিয়েছে - মানুষ যেন নক্শাল সংশ্রবের কথা ভাবতেই ভয় পায়।

    জুলাই মাসের সেই সন্ধ্যার পর জেলখানা পুরোপুরি পাল্টে গেল। হাজারিবাগের জেলখানা গাছপালা, বাগান, দালান - নিয়ে একটা আদর্শ কারাগার হিসেবে পরিচিত ছিল। এবার অসংখ্য আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, কতবেলের গাছে কেটে ফেলা হলো - ওয়াচ টাওয়ার থেকে জেল চত্বরের প্রতিটি কোন যেন পরিস্কার দেখা যায়। দিনগুলি শুধু এইসব প্রাচীন গাছের পতনের শব্দে ভরে গেল। গাছগুলি আমাদের বড় অবলম্বন ছিল - মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ার আগে শেষ অবলম্বন ছিল এইসব প্রাচীন বৃক্ষ - এবার যেন আমরা শিকার, আর আমাদের শিকারীদের মধ্যে আর কোন আড়াল থাকলো না। দুটো বড় বড় আমগাছ পড়ে গেল - আমাদের মুখোমুখি, ষাট গজ দূরে পরিস্কার দেখতে পেতাম রোদ ঝড় জলে ওয়াচ টাওয়ারে সদা সতর্ক রক্ষী, রাইফেল তাক করে। গুলি চালানোর পথে আর কোন বাধা নেই। রাতে ঘুমোতে গেলেও মাথা থেকে যেত না, আমরা ওয়াচটাওয়ারের প্রহরীর নজরে, ওর বন্দুকের গুলির আওতায়।

    মনে হতো আমি যেন এক যুদ্ধবন্দী। বাইরের কাউকে এখানে কী চলছে কিছু জানানোর কোন উপায় নেই। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে সেদিনের গুলির খবর পেয়ে মা বাবার উদ্বেগ অনুমান করতে পারতাম। চিঠিতে লিখতাম, আমি এখানে খুব ভালো আছি, শান্তিতে আছি, সুস্থ আছে। অর্ধসত্য লিখতে মন সায় দিত না, কিন্তু সত্যি কথা লিখতে গেলে সেন্সরের কালি পেরিয়ে চিঠি পোঁছবে না।

    কয়েদীরা এখন দিন শুরু করে ভীত, সন্ত্রস্ত। আমাদের এদিকে কেউ এলে বা গেলে তাদের ভালোমত তল্লাশি হয়। একে অন্যকে সাবধান করে দেয় - খাবার দাবার সুযোগ সুবিধে নিয়ে কোনরকম আপত্তি অভিযোগ জানাতে গেলে কিন্তু নক্শাল বলে সলিটারিতে পুরে দেবে। এতকিছুর পরেও, সাইবুন্নিসার বর একদিন ঝুঁকি নিয়ে অমলেন্দুর খোঁজ নিতে যাওয়ার চেষ্টা করলো। নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে নকশাল ওয়ার্ডে পৌঁছতেও পারেনি, নক্শাল সহযোগী অভিযোগে আলাদা সেলে আটক হয়ে গেল। ওদের ছেলে দশ টাকা ঘুষ দিয়ে বাবাকে উদ্ধার করলো।
    আমি খুব অপরাধবোধে ভুগছিলাম - কিন্তু ওর দেখলাম ভ্রূক্ষেপ নেই - খবর পাঠালো ক'দিন পর আবার চেষ্টা করবে।

    এইসব কিছু, তুমুল বর্ষা - এসবের মধ্য সংবাদ মাধ্যম ভারত পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। জাতীয়তাবাদী চেতনা তৈরীতে সব কটা খবরের কাগজ সচেতন। পূর্ব পাকিস্তানে মার্চ মাস থেকেই গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি। অতি করুণ অবস্থায় দুর্দশাগ্রস্ত উদ্বাস্তুরা দলে দলে ভারতে ঢুকছিল; হয়তো ভারত এবার হস্তক্ষেপ করবে। অগাস্ট মাসে ভারত-রুশ মোত্রী চুক্তি সাক্ষরিত হল। মনে হচ্ছিল ভারতের সামরিক আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পথে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, এবার হয়তো ভারত পূর্ববঙ্গে সেনা পাঠাবে।

    অগাস্টের শেষে আবার একটা অঘোষিত পরিদর্শন - সুপার এক পুলিশ অফিসারকে নিয়ে এল - সে কে, কোথা থেকে এসেছে কিছুই জানাতে রাজি হল না। ও আমাকে আমার নাম, নগরিকত্ব, পাসপোর্ট নাম্বার এসব নিয়ে জেরা শুরু করলো, যেসব কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকদিন থেকেই আছে। কল্পনা বিড়বিড় করে বললো এসব আবার বলার কোন মানেই হয় না- কল্পনার এই মন্তব্য শুনে সুপার একবারে ভয়ানক রেগে আগুন হয়ে গেল। লাঠি তুলে কল্পনাকে তক্ষুনি পাশের সেলে যাওয়ার হুকুম দিল। আমিও পেছন পেছন যাচ্ছিলাম, আমার পথ আটকে বিশাল ধমক দিয়ে বললো এখানেই থাকতে আর যা জানতে চাওয়া হচ্ছে তার জবাব দিতে। পনেরো মাস জেলে ছিলাম, আমি জানতাম জেলের ভেতর জিজ্ঞাসাবাদ করার অধিকার পুলিশের নেই। ঠিক করলাম কোন কথার জবাব দেবো না।

    চুপ করে বসে রইলাম, কথা বলা বা জবানবন্দীতে সই করা - কোনটাতেই রাজি হলাম না। সুপার তখন কল্পনাকে অন্য সেলে ঢুকিয়ে তালা দিতে ব্যস্ত ছিল, জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যে মুখ খোলার বেয়াদবীর শাস্তি। ফিরে এসে বললো সই আমাকে করতেই হবে। চুপ করে থাকলাম - আদেশ হল, বইপত্র সব বাজেয়াপ্ত, আর কখনোই লেখাপড়ার জিনিস দেওয়া হবে না, আগের মত দিনরাত সেলে তালাবন্ধ করে রাখা হবে। 
    আমি জানালাম জেলের আইন অনুসারে চুপ থাকার অধিকার আমার আছে। আমি কোন নিয়মভঙ্গ করিনি, যদি তাতেও শাস্তি পেতে হয় তাহলে আমি ভুখ হরতাল করবো।
    "কথা বলার জন্য মুখ খুলতে না পারলে খাওয়ার জন্যও মুখ খুলতে হবে না" - এই বলে সুপার চলে গেল।

    সেই রাতে আমাদের খাওয়ার জল বা তেলের বাতি কিছুই দেওয়া হল না। আশ্চর্যজনকভাবে, পরদিন সকালে সেলের দরজা কিন্তু খুলে দিল। আমরা ঠিক করলাম বই আর খবরের কাগজ ফিরে পাওয়ার জন্য ভুখ হরতাল তাও চালিয়ে যাবো। সেলের তালা খুলে দেওয়াতেই আমরা খুব অবাক হয়েছিলাম, দুপুরের মধ্যে দেখলাম বই খাতা কাগজও চলে এলো বিনাবাক্যব্যয়ে।

    পরদিন সকালে বুঝলাম এরা কেন ঝামেলা বাড়ায়নি। ভোরের আলো ফোটার আগেই ফটকের ঘন্টা বাজলো - একজন ওয়ার্ড্রেস এসে বলললো কল্পনাকে তৈরি হয়ে নিতে - ওকে কলকাতায় বদলি করা হবে। পরের একঘন্টা তাড়াহুড়োয় কেটে গেল। আমাদের এতদিনের সব সম্পত্তি সমান দু'ভাগে ভাগ করলাম। শেষবারের মত কল্পনার ঘন কালো চুল আচড়ে বেঁধে দিচ্ছিলাম আমি। কীভাবে আমরা নিজেদের মধ্যে ভবিষ্যতে যোগাযোগ রাখতে পারি সেসব নিয়ে কথা বলছিলাম। আমার মাথায় এল - অমলেন্দুও তো এমন ভাবে অন্য জেলে বদলী হয়ে যেতে পারে! যদি অমলেন্দুর সঙ্গে দেখা হয় তাহলে কী বলবে আমি বলে দিলাম কল্পনাকে। 
    সত্যিই সেদিন অমলেন্দুকেও কলকাতায় বদলী করা হয়েছিল, তবে আমি সেটা আরও দু'মাস পর জানতে পেরেছিলাম। 

    অন্যদের ফাটকের তালা খুলতে না খুলতেই কল্পনার ডাক পড়লো। আমরা দুজনেই জানতাম আগে পরে কখনো আমাদের চলে যেতেই হবে। কিন্তু তাও এই যাওয়াটা একেবারে অপ্রত্যাশিত মনে হচ্ছিল। আমি কোন রকমে কান্না গিলে নিজের সেলে ফিরলাম। 

    সাইবুন্নিসা আর রোহিনী এসে আমার সঙ্গে বসলো। ওরা আমাকে স্বান্তনা দিচ্ছিল। আমি মিষ্টি খেতে ভালো বাসতাম, সাইবুন্নিসা জমানো চিনি দিয়ে চালের পিঠে বানিয়ে এনেছিল। আমি ভেসে যাচ্ছিলাম ওদের যত্নে, ভালোবাসায়, কিন্তু কল্পনা চলে যাওয়ায় আমার কেমন লাগছে সেটা বোঝানো সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। এই দেড় বছরে আমরা খুবই কাছাকাছি চলে এসেছিলাম।
    সচ্ছল মধ্যবিত্ত বাড়ির মেয়ে কল্পনা বিবাহিত সংসারজীবন, ভালো চাকরি এইসব নিশ্চয়তার  হাতছানি উপেক্ষা করে নিজের দেশের মানুষকে ভালোবেসে বস্তিতে বস্তিতে কাজ করতে গেছে। দুঃখ, দারিদ্র, রোগ, হিংস্রতা খুব কাছে থেকে দেখে কল্পনা পরিনত আর দৃঢ় একজন মহিলা হয়ে উঠেছে। কিন্তু দৃঢ়তার পাশাপাশি, কোন সহবন্দীনির দুঃখের জীবনকথা শুনে ওর চোখে জলও আমি দেখেছি। অসুস্থ কয়েদীর সেবা করার জন্য কল্পনা ওর নাওয়া খাওয়া চুল আঁচড়ানো ভুলে যেত।
    সেই তুলনায় আমি নিরাপদ আশ্রয়ে আরামের জীবন কাটিয়েছি। কল্পনা চলে যাওয়ায় নিজেকে ভীষন অসহায়, বিপন্ন মনে হচ্ছিল। 

    কল্পনা যেকোন পরিস্থিতিতে হাসতে পারে, উৎপীড়নকারীকে তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিতে পারে, যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে রুখে উঠতে পারে। আমি এর কোনটাই পারি না। 
    যত বছর জেলে কাটিয়েছি, বারবার, প্রতিটি কঠিন সময়ে ভেবেছি এইসবের মোকাবিলা করতে কতখানি শক্তি পাওয়া যেত, কল্পনা সঙ্গে থাকলে।

    প্রকাশ বলে একটি বাচ্চা কল্পনার খুব ন্যাওটা ছিল। প্রকাশকে কোলে নিয়ে সন্ধ্যেবেলা পায়চারী করছিলা। বাইরে ওয়াচটাওয়ারের দিকে আঙুল তুলে প্রকাশ বললো - কল্পনা মাসি কি ওখানে? কল্পনামাসি কোথায়?

    আমার কাছে কোন উত্তর তো ছিল না। শুধু জানতাম কল্পনাকে কলকাতা নিয়ে গেছে। কলকাতা, কুখ্যাত লালবাজারে। ওখানে কল্পনার সঙ্গে কী করবে ওরা তা ভাবতে পারছিলাম না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • বইপত্তর | ৩১ জুলাই ২০২৩ | ৫১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ৩১ জুলাই ২০২৩ ০৫:১৯521945
  • পড়তেই ভয় লাগে আর তারা এদিনগুলো কাটিয়েছে; কেউ কেউ ফিরতে পেরেছে, অনেকেই পারেনি। এবং এসব দিন কত কত কারাগারে এই মুহুর্তেই বাস্তব।
  • aranya | 2601:84:4600:5410:e9b6:7f1e:e3b0:7efd | ৩১ জুলাই ২০২৩ ২৩:২৩521974
  • পড়ছি 
  • Dolon | 2a00:23c5:7701:c501:2541:6b8c:e424:d89a | ০১ আগস্ট ২০২৩ ০০:৪১521977
  • খুব ভালো অনুবাদ ,ভাবার্থ অতি সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে .
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন