আলু ব্রিগাডা – আলু তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে আয়। ভাবছেন ইয়ারকি মারছি? মোটেই না। হেমন্তকালে ফসল তোলার সময় যখন অতিরিক্ত আলুর ফলনে উপছে যায় মাঠ ক্ষেত, তখন দেশবাসীকে ডাক দেয় সরকার। এসো সবাই হাতে হাতে তুলে ফেলি পাকা ফসল, নাহলে যে মাঠে পচে নষ্ট হবে। শীতের আগেই তুলে প্রক্রিয়াকরণ করে উপযুক্ত উপায়ে গুদামজাত করে ফেলতে হবে। ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা, দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর সমাজতান্ত্রিক চেকোশ্লোভাকিয়ায় দেশভরা কৃষি সমবায়, বড় বড় জমি বড় বড় ট্রাক্টরে চাষ হচ্ছে, চাষ করা, সার জল দেওয়া সবকিছুরই নানারকম কল আছে। উৎকৃষ্ট সার ও নানা কলের ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বেড়ে গেছে অনেক। ফসলে মাঠ এক্কেরে ভরে উপছে যায়। ফসল কাটারও কল আছে নানারকম, কিন্তু তাতেও গ্রামের লোক সামাল দিয়ে উঠতে পারে না। তাই ফসল তোলার সময় ডাক পড়ে সমগ্র দেশবাসীর। দেশের লোকও সানন্দে স্কুল কলেজ অফিসের কাজ স্থগিত রেখে চলে যায় ব্রিগাডায় অর্থাৎ স্বয়ং সেবার কাজে। আলুর ব্রিগাডা, বিটের ব্রিগাডা।
পড়ছিলাম মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পুনর্দর্শনায় চ’। মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখনীর সাথে আমার প্রথম পরিচয় 'অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'এর বাংলা অনুবাদ পড়ার সময়। কোন্নগর পাবলিক লাইব্রেরী থেকে আনা সেই বই দেখে মা একটু অবাক হয়ে বলেছিল ইনি কি সেই দক্ষিণের বারান্দার মোহনলাল নাকি? আর ট্যালা আমি ভেবেছিলাম দাদুর দক্ষিণেরে বারান্দায় যাঁরা আসেন টাসেন তাঁদেরই কেউ বুঝি। তারপর ঐ বড়রা যেমন হয় ‘হ্যা হ্যা এমা তুই কি হাঁদু রে!' ইত্যাদি। তো,অবন ঠাকুরের এই নাতিটিকে অধিকাংশ বাঙালি 'দক্ষিণের বারান্দা'র লেখক বলেই চেনেন।
মোহনলাল বেশ কিছু ভ্রমণকাহিনীও লিখেছিলেন। সেই কাহিনীগুলির একত্র সংকলন, ভ্রমণসমগ্র সম্প্রতি যোগাড় করলাম। মূলতঃ ইউরোপে তাঁর ছাত্রজীবনে পদব্রজে ও লাফা যাত্রায় ঘোরা জায়গাসমূহ। এর সাথে পরবর্তীকালে চেকোশ্লোভাকিয়ায় পুনরায় কর্মসূত্রে এক বছর কাটানোর অভিজ্ঞতা। পরিশিষ্ট অংশে দক্ষিণের বারান্দা থেকে রাঁচি ও দার্জিলিঙ ভ্রমণ এবং জাহাজে যুদ্ধোত্তর ইউরোপ গমনের বিবরণও যুক্ত করা হয়েছে। ১৯৩৭-৩৮ এ চেকোশ্লোভাকিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াবার চমৎকার ঝরঝরে বর্ণনা যেন বরফগলা জলে পুষ্ট তরতরে নদীটি, আপনমনে বয়ে চলেছে। কোনও ছবি ছাড়াই চোখের সামনে ভেসে ওঠে উচ্চ ও নিম্ন তাতরা, মোরাভিয়ার পর্বতশ্রেণী, চের্ভেনা সেডলোর জঙ্গল।
মোহনলালের গদ্য যেমন নির্ভার, তেমনই উল্লেখযোগ্য ভাষায় বাঙলা শব্দের ব্যবহার। একটা ৩৭২ পাতার বইতে প্রায় কোন ইংরাজী শব্দ নেই। পায়ে হেঁটে ঘোরা পর্যটককে লিখেছেন চরণিক, হিচ-হাইকিঙ হল লাফা যাত্রা, সেলফ হেল্প শপের বাঙলা আত্ম সেব দোকান, রুকস্যাক পিঠঝুলি। চরণিক হয়ে পিঠঝুলি নিয়ে ঘুরেছেন চেকোশ্লোভাকিয়া। পরের বছর গ্রীস্মের ছুটিতে লাফা যাত্রায় ঘুরেছেন সুইডেন, ডেনমার্ক নরওয়ে। রসালো বুনোবেরি আর সুগন্ধি হ্রিবি ছত্রাক চিনতে শিখেছেন, নদীর জলে রান্না করে খেয়ে, ইয়ুথ হোস্টেলের কুটিরে কখনো সামান্য বিছানায় কখনো খামারবাড়ির বিছানো বিচালি বা খড়ের উপর রাত কাটিয়েছেন।
এই যে সময়টা, ১৯৩৭-৩৮, ইউরোপে তখন দ্বিতীয় যুদ্ধের দামামা প্রায় বেজেই গেছে, আর মাত্র বছরখানেকের মধ্যেই ইউরোপ ছিন্নভিন্ন হতে শুরু করবে। সাধারণ মানুষ তখনো আপনমনে নিজ নিজ জীবনপথে ঘুরে চলেছে, ছাত্ররা ছুটিতে বেরিয়ে পড়ছে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে গায়ে রোদ্দুর মেখে দেশ দেখতে। একের পর এক জনপদ, ব্যক্তিমানুষ আর আর সমষ্টিগত স্মৃতিভান্ডারের স্পর্শ পেতে পেতে এগোতে হয় মোহনলালের ভ্রমণকাহিনীর পাতায়। তাঁর লেখায় ইউরোপের সেই সময়টা, সাধারণ মানুষদের কথা পড়তে পড়তে কেমন একটা মন খারাপ লাগে, কে জানে এরা কজন বেঁচে ছিল কেমন ছিল তারা যুদ্ধের পরে! লেখকের সঙ্গী চেক যুবক মিরেক, তার সাথে লেখকের আর কখনো যোগাযোগ হয়েছিল কিনা? নাৎসীদের ভয়াবহ অত্যাচার সম্ভবত জার্মানীর বাইরে আসে নি তখনো।
তবে ১৯৬১ -৬২তে আবারো চেকোশ্লোভাকিয়ায় কর্মসূত্রে একবছর থাকার সময় লেখক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণনা করেছেন চেক জনজাতির জাতীয় জীবন, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। সে সময়ের চেকোশ্লোভাকিয়া তাঁর মন কেড়ে নিয়েছিল। সে দেশের মানুষের প্রাথমিক চাহিদাগুলি মেটানোর দায়িত্ব সরকার নিয়ে নেওয়ায় তাদের সরল জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক জীবনে সমাজের সব অংশের সক্রিয় অংশগ্রহণ, সর্বোপরি দেশ গঠনের বিপুল কর্মযজ্ঞে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। এই অংশে নাৎসী জার্মানির পৈশাচিক আচরণের কথা এসেছে, এসেছে স্রেফ সন্দেহের বশে সমস্ত মানুষসহ একটি গ্রাম মুছে দেবার বীভৎস কাহিনী। এসেছে লেখকের স্বাধীনতার প্রসঙ্গও।
সব মিলিয়ে মোহনলালের কাহিনীগুলি অতুলনীয়, বারেবারে পড়ার মত। এই গ্রুপেই কেউ একজন এই সমগ্রটির সন্ধান দিয়েছিলেন। তাঁকে অজস্র ধন্যবাদ।
বই - ভ্রমণসমগ্র
লেখক - মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশক – দে’জ পাবলিশিং
মূল্য – ৪০০/-
বিমল মুখার্জির "দু-চাকার দুনিয়া" আর "লাফা যাত্রার" লেখক দুজন কে প্রায় আল্লারাখা-জাকির হোসেন বলা যায়। বিমল মুখার্জি সাইকেলে লন্ডন পৌঁছেছিলেন ১৯২৮ সালে ।তারপর ২০২১-এর মার্চ মাসে বন্ধুর আই টি বিশেষজ্ঞ ছেলের বিয়েতে দে'স প্রকাশনীর প্যাকেটে মুড়ে উপহার দিয়েছি ঐ আল্লারাখা ও জাকির হোসেন। মুখোশে মুখ ঢেকে।
শ্যামলেন্দু,
আরো একজন ভূ পর্যটক বিমল আছেন বিমল দে নাম। ওঁর মহাতীর্থের শেষ যাত্রীও ইন্টারেস্টিং বই।