(৫) লক্ষ লক্ষ বছর আগেই প্রকৃতি নিজেই সৃষ্টি করে রেখেছিল আশ্চর্য রকমের ধাপ বা স্টেপ যা দৃশ্যতই মুগ্ধ করেছে আমাদের। ইউরোপের উত্তর আয়ার্ল্যাণ্ডে দেখা যায় এমন এক অলৌকিক পাথরের দৃশ্য। পঞ্চাশ লক্ষ বছর আগে এখানে এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুপাতের পরে প্রায় চল্লিশ হাজারের মতো এই আগ্নেয়গিরিজাত পাথর বা শিলা তৈরি হয়েছিল যা এখন দেখলে মনে হয় এক বিস্তৃত দুর্গম প্রাকৃতিক সিঁড়ির সমাবেশ যেন।

এই জায়ান্টস কজওয়ে হল প্রায় চল্লিশ হাজার ইন্টারলকিং বেসল্ট কলামের একটি জায়গা, যা নাকি এক প্রাচীন আগ্নেয়গিরির ফাটল বিস্ফোরণের ফলে তৈরি। উত্তর আয়ারল্যান্ডের উত্তর উপকূলে কাউন্টি অ্যানট্রিমে অবস্থিত এই জায়ান্টস কজওয়ে, বুশমিলস শহরের প্রায় তিন মাইল উত্তর-পূর্বে। ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৮৬ সালে ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান। আর ১৯৮৭ তে উত্তর আয়ারল্যান্ডের পরিবেশ বিভাগ দ্বারা একটি জাতীয় প্রকৃতি সংরক্ষণাগার হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। স্তম্ভ বা কলামগুলি পাহাড়ের তলা থেকেই উঠেছে খাড়া হয়েই। বেশিরভাগ কলামই ষড়ভুজাকার, যদিও কিছু আছে চার, পাঁচ, সাত বা আট বাহু বিশিষ্ট। সবচেয়ে লম্বাগুলি প্রায় ১২ মিটার (৩৯ ফুট) উঁচু এবং ক্লিফগুলির লাভার স্তরটি ২৮ মিটার (৯২ ফুট) পুরু।
প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লক্ষ বছর আগে, প্যালিওসিন যুগের সময়, আগ্নেয়গিরি অ্যানট্রিম এর তরল গলিত লাভা একটি বিস্তৃত আগ্নেয় মালভূমি গঠনের জন্য চক বেডের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে। এই লাভা ঠান্ডা হলে সংকোচন ঘটে, ফাটল ধরে ছড়িয়ে পরে অনেকটা জায়গা জুড়ে। কিংবদন্তি বলে, কলামগুলি একটি দৈত্য দ্বারা নির্মিত একটি কজওয়ের অবশেষ।
গল্পটি বলে যে গেলিক পুরাণের আইরিশ জায়ান্ট ফিওন ম্যাক কামহেল (ফিন ম্যাককুল), স্কটিশ জায়ান্ট বেনান্ডোনার সাথে লড়াই করার জন্য চ্যালেঞ্জ হয়। ফিওন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন এবং উত্তর চ্যানেল জুড়ে কজওয়ে তৈরি করেন যাতে দুটি দৈত্য মিলিত হতে পারে। এক গল্প অনুসারে ফিওন এই লড়াই জেতে। অন্য গল্পটিতে ফিওন নাকি লুকিয়ে পড়ে যখন সে বুঝতে পারে যে তার শত্রু বেনান্ডোনার দৈহিক শক্তি তার চাইতে অনেকগুণ বেশি। ফিওনের স্ত্রী সাধভ, ফিওনকে একটি হৃষ্টপুষ্ট শিশুর ছদ্মবেশ ধারণ করায় এবং তাকে একটি দোলনায় জড়িয়ে নেয়। বেনান্ডোনা শিশুটির চেহারা দেখে ভাবে যে শিশুটির পিতা ফিওন না জানি আরো কতো শক্তিশালী। ভয়ে বেনান্ডোনা স্কটল্যান্ডে ফিরে যায় আর তার সাথে পেছনের রাস্তাটি ধ্বংস করে দেয় যাতে ফিওন তাকে তাড়া করতে না পারে। ঐ জায়গার সাগর জুড়ে ওই লাভা প্রবাহের ফলে বিভিন্ন এমন ব্যাসল্ট কলাম তৈরি হয় এবং স্কটিশ আইল অফ স্টাফাতে ফিঙ্গাল'স গুহায় এমন অনেক বেসাল্ট কলাম ও রয়েছে যা দেখে মনে হয় যে এই গল্পটি এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।
সামগ্রিকভাবে আইরিশ পুরাণের কাহিনীতে, ফিওন ম্যাক কামহেল দৈত্য নন কিন্তু অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাসম্পন্ন একজন নায়ক। আইরিশ কৃষকদের রূপকথা ও লোককাহিনীতে এটি উল্লেখ করা হয়েছে যে, সময়ের সাথে সাথে, "আয়ারল্যান্ডের পৌত্তলিক দেবতারা জনপ্রিয় কল্পনায় ছোট থেকে ছোট হতে থাকে যতক্ষণ না তারা পরীতে রূপান্তরিত হয় আর পৌত্তলিক নায়করা বড় এবং বড় হতে থাকে। যতক্ষণ না তারা দৈত্যে পরিণত হয়।"
“ফোমহোরাই” নামে আইরিশ পুরাণে অতিপ্রাকৃত প্রাণীদের একটি জাতির কথা শোনা যায় যাদেরকে কখনও কখনও দৈত্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছিল এবং যারা মূলত প্রাক-খ্রিস্টান প্যান্থিয়নের অংশ ছিল।

এই ধরণের আরেকটি দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায় ইতালির রিয়েলমন্তিতে যার নাম স্কালা দেল তুর্চি (Scala dei Turchi)।

স্কালা দেল তুর্চি (Scala dei Turchi)।

স্কালা দেই তুর্চি (ইতালীয়: "তুর্কিদের সিঁড়ি" বা "তুর্কি ধাপ") হল ইতালির দক্ষিণ সিসিলির পোর্টো এম্পেডোকলের কাছে রিয়েলমন্টের উপকূলে একটি পাথুরে পাহাড়। এটি একটি পর্যটক আকর্ষণে পরিণত হয়েছে, আংশিকভাবে কমিসারিও মন্টালবানো সম্পর্কে আন্দ্রেয়া ক্যামিলেরির গোয়েন্দা গল্পের সিরিজে উল্লেখ করার কারণে।
স্কালা (Scala) মার্ল (সাদা রঙের একটি পাললিক শিলা) দ্বারা গঠিত, যা প্লাঙ্কটোনিক ফোরামিনিফেরার পরীক্ষা থেকে গঠিত। এগুলো ট্রুবি ফর্মেশনের (Trubi Formation) অন্তর্গত, নিম্ন প্লিওসিন (জ্যানক্লিয়ান) যুগের একটি সামুদ্রিক পাললিক একক, যা জ্যানক্লিয়ান বন্যার পরে জমা হয়েছিল। একটা সময়ে ভূমধ্যসাগর পুরো শুকিয়ে গেলে এই মার্ল এর সাহায্যেই ভূমধ্যসাগরের লবনাক্ততা পুনরায় পূরণ করা হয়েছিল।
স্কালা দেই তুর্চি’র পাহাড় দুটি বালুকাময় সমুদ্র সৈকতের মাঝখানে অবস্থিত এবং একটি সিঁড়ির আকারে চুনাপাথর পাথরের গঠন, তাই নাম "তুর্কিদের সিঁড়ি" বা "তুর্কি ধাপ"।
“Scala dei Turchi” নামের শেষ অংশটি মধ্যযুগের। ‘সারাসেন’দের দ্বারা ঘন ঘন জলদস্যু অভিযান এবং বার্বারি জলদস্যুদের এবং আধুনিক যুগে তুর্কিদের দ্বারা নামাঙ্কিত। প্রকৃতপক্ষে, তুর্কি জলদস্যুরা এই এলাকায় আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল যেখানে নিরাপদে আরোহণ অবরোহণের খুবই সুবিধে ছিল হাওয়া কম থাকায়। ২০০৭ এর আগষ্টে এটি ইউনেস্কো’র হেরিটেজ তকমা পায়। ২০২০-র পর্যটকদের দ্বারা ভাঙচুরের কারণে প্রচুর ক্ষতি হবার জন্য ইতালি সাময়িকভাবে এটা ট্যুরিস্টদের কাছে বন্ধ রাখার কথা ঘোষণা করে। ২০২২ থেকে এটি আবার দর্শনীয় হয়ে ওঠে।
প্রকৃতির হাতে গড়া এই সব সিঁড়ির আবছা ধারণা নিয়ে মানুষের হাতে সিঁড়ি তৈরি হতে লেগেছে অনেকটাই সময়।