(৭)আবার ফিরি সিঁড়ির ইতিহাসে।
আগেই বলেছি সিঁড়ি শব্দের শুরুয়াৎ। কিন্তু এর ব্যবহার শুরু হ’ল কিভাবে ?

প্রাচীন মই, নিউ মেক্সিকোয়ের লস আলামোসের কাছে আনাসাজীর ধ্বংসাবশেষে।
আজকের ‘মই’-ই ছিল সিঁড়ির শুরু। মানুষ প্রথম যখন বাড়ি বানাতে শিখল তখন থেকেই সেই বাড়ি বা কুটিরগুলো মাটি থেকে একটু উঁচু করেই বানাতো যাতে জন্তুজানোয়ার সহজে না ঘরে ঢুকে পড়ে। এবং সেই বাড়িতে ওঠানামার জন্য মানুষের মাথায় এসেছিল এই মই এর ভাবনা। হয়তো আজ আমরা যে শেপে মই দেখে থাকি তা হয়তো ছিল না। কিন্তু একটা পাদানি তো ছিলই যার ওপরে পা রেখে ওঠা নামা করা হ’ত। এখনো বিশ্বের বিভিন্ন উপজাতিরা এই ভাবেই মই ব্যবহার করে থাকে জন্তুজানোয়ার থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্যেই।
পশ্চিম আফ্রিকা এবং পানামার উপজাতিরা এখনও সবচেয়ে সহজ এবং প্রথম দিকের সিঁড়িগুলির মধ্যে একটি ব্যবহার করে। এখনো তারা বন্যার হাত থেকে তাদের ঘরবাড়িগুলো বাঁচাতে একটু উঁচু জায়গায় ঝুপড়ি বানায়। আর মাটি থেকে ঘরে যাওয়ার জন্য সেই মই ব্যবহার করে থাকে। মেসোপটেমিয়া এবং মিশরে সেই কালে একেবারে খাড়াই সোজা সিঁড়ি ব্যবহার করা হতো অনেক উঁচু তলায় যাওয়ার জন্য।
এটা একটা ৬ থেকে ১২ইঞ্চি ব্যাসযুক্ত গাছের কাণ্ড থাকে যার ওপরের দিকে কাঁটাচামচের (forks) মতো কাঁটা করা থাকে। এই কাঁটার দিকটা বাড়ির পাঁচিলের দিকে আটকে থাকে। এর ফলে গাছের গুঁড়িগুলো হড়কে যায় না। এই ধরণের সিঁড়ি একেবারে প্রায় সিঁড়ির আদিযুগ থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। সাইপ্রাসের খিরোকিটিয়ার (Khirokitia) নিওলিথিক ঘরের মেজেনাইন ফ্লোরে পৌঁছতেও একই ধরণের সিঁড়ির ব্যবহার ছিল। আজও নিউ মেক্সিকোর তাওস (Taos) আর একোমা প্লুবস-এও (Acoma Pueblos) এই মই এখনও ব্যবহার করা হয়। ফিলিপাইন্স এর তারঙ (Tarong) এর বাড়িগুলোর ওপরের তলায় একটা বারান্দা করা থাকে। বাইরে থেকে একটা মই দিয়ে ওরা বাড়িতে ঢোকে। আর রাতের বেলায় ওই মইগুলো ওপরে তুলে নেয়। মানে সেই অপারেশন থিয়েটারের লাল আলো জ্বলার মতো এই মই না দেখতে পেলে বুঝতে পারে যে গৃহস্বামী আর কারো আগমন চাইছেন না। কি দারুণ ব্যাপার, তাই না !

মরক্কোর বাইরের পাঁচিলে ওঠার জন্য পাঁচিলের গায়ে চৌকো চৌকো গর্ত করা আছে যাতে এক হাত দিয়ে ওপরের গর্তখানা ধরে নিচে পায়ের কাছ বরাবর যে গর্ত থাকে তার ওপর পা রেখে ধাপে ধাপে এই পাঁচিলের ওপরে চড়া যায়।
এবারে বলি আমাদের দেশের এক প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। তার নাম নালন্দা।
খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দী থেকে আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নালন্দা মহাবিহার ছিল ভারতের তথা সারা বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের মধ্যে ( রাজধানী পাটনা থেকে পঁচানব্বই কিলোমিটার) নালন্দার এই বৌদ্ধ মহাবিহার প্রায় ছ’শ বছর ধরে মাথা উঁচু করে আলো দিত হাজার হাজার ছাত্রদের।
এই নালন্দা মহাবিহারে পড়াশুনো ছিল সম্পূর্ণ অবৈতনিক।
মনে মনে কল্পনা করুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে দশ হাজার শিক্ষার্থী্র কলরোলে গ ক্যাম্পাস,আর দু হাজার শিক্ষক শেখানে শ্রেষ্ঠ পাঠ দান করছেন। বিভিন্ন গাছের ছায়ায় আচ্ছাদিত নালন্দার আঙিনা। সরোবরের জলে ফুটে আছে পদ্ম। এই বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। একে বলা হয় বিশ্বের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়।
আধুনিক কালের যে সমস্ত প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় এখনো বর্তমান সে সবের অনেক আগেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় মৃত।
নালন্দার সুশিক্ষার খ্যাতির সুবাতাস এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে অনুন্নত প্রতিকুল এবরো থেবরো যোগাযোগ ব্যবস্থাও বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনি সুদূর তিব্বত, চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, গ্রীস তুরষ্ক থেকে ছুটে আসা বিদ্যা অনুরাগীদের।
এই নালন্দা চত্বরের মধ্যেই ছিল একটি ন-তলা লাইব্রেরী যা পরবর্তীকালে সম্পূর্ণ ধ্বংস এবং নষ্ট হয়ে যায়।
নালন্দার ধ্বংশাবশেষ বর্তমানে এটি একটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।

ধ্বংসপ্রাপ্ত নালন্দার যেটুকু উদ্ধার করা গেছে তা উত্তর-দক্ষিণে ১৬০০ ফুট (৪৮৮ মিঃ) আর পূব-পশ্চিমে ৮০০ ফুট (২৪৪ মিঃ)। এগারোটা মঠ আর ছ’খানা মন্দির। একখানা ১০০ ফুটের চওড়া রাস্তা চলে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে যার পূব-দিকে মঠগুলোর অবস্থান আর ওই রাস্তার পশ্চিমে রয়েছে মন্দিরগুলো। সমস্ত মঠগুলোর স্থাপত্য বা ডিজাইন কিন্তু প্রায় একই ধরণের। সবগুলোই পশ্চিমমুখী। পুব-দিকগুলোয় নর্দ্দমার অবস্থান। আর সমস্ত সিঁড়ির অবস্থান প্রতি মঠ বা গৃহের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকেই।


৩ নং মঠ ছিল নালন্দার এক বিখ্যাত সৃষ্টি। অনেকগুলো সিঁড়ি ছিল এই মঠের ওপরে যাওয়ার জন্যে। পুরাতত্ব গবেষণায় জানা গেছে যে অনেক পুরুষ ধরে তৈরি হয়েছিল এই মঠ। এই মঠখানার সিঁড়ির ধারে ধারে গুপ্তযুগের সময়কার বুদ্ধের বিভিন্ন ছবি খোদাই করে আঁকা হয়েছিল।
চলবে.........
#