
(১১)মায়া সভ্যতা। নামটা শুনলেই যেন মন চলে যায় প্রাচীন ইতিহাসের পাতায়। উত্তর-মধ্যে আমেরিকা থেকে গুয়াতেমালা, এল সালভাদোর, মেক্সিকো এবং হন্ডুরাস পর্যন্ত বিস্তৃত এই সভ্যকা বহু অসাধারণ স্থাপত্যের নিদর্শন রেখে গিয়েছে।
Copán Hieroglyphic Staircaseহন্ডুরাস-গুয়েতেমালান সীমান্তের কোপানে (Copán) পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে মায়া সভ্যতার বিস্তার। এটি পশ্চিম হন্ডুরাসের একটি উর্বর, জলযুক্ত পর্বত উপত্যকা যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ছ’শ মিটার (২৪০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এটি পঞ্চম থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত একটি প্রধান ক্লাসিক যুগের রাজ্যের রাজধানী ছিল। শহরটি মেসোআমেরিকান সাংস্কৃতিক অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বে, ইস্তমো-কলম্বিয়ান সাংস্কৃতিক অঞ্চলের সীমান্তে ছিল এবং প্রায় অ-মায়া লোকেদের দ্বারা ঘেরা ছিল।
আর এই কোপানে-ই রয়েছে - মায়া যুগের দীর্ঘতম হায়ারোগ্লিফিক শিলালিপি। ২৬ নং মন্দিরের পশ্চিম দিকে যে শিলালিপি রয়েছে তাতে কোপানের শাসক রাজবংশের ইতিহাস হায়ারোগ্লিফিকে খোদাই করা আছে। রাজবংশের বিভিন্ন জনের জন্মতারিখ, রাজা বা রানিদের সাম্রাজ্যে যোগদানের কথা, তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠান, তাঁদের কৃতিত্ব, মৃত্যু ইত্যাদি সব কিছুই ওই শিলালিপিগুলোয় উল্লিখিত আছে।
এই সিঁড়ি তৈরির সময় না জানা গেলেও ওই শিলালিপি থেকে এটা জানা যায় যে কোপানের তেরো-তম রাজা তার পূর্বসূরী স্টেলা (৬৩) কে সম্মান এবং শ্রদ্ধা জানাতে এই সিঁড়ি নির্মাণ করেছিলেন। হায়ারোগ্লিফিক সিঁড়িটি একুশ মিটার (৬৯ ফুট) দীর্ঘ, দশ মিটার (৩৩ ফুট) চওড়া এবং এতে মোট বাষট্টিটি ধাপ রয়েছে আর প্রতি ১২তম ধাপের কেন্দ্রে একটি বড় ভাস্কর্যযুক্ত চিত্র রয়েছে।
আরেকজন প্রধান মায়া দেবতার নাম কুকুলকান। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সর্পদেবী মনসার সঙ্গে এই দেবতার বেশ মিল রয়েছে। কুকুলকান হলো মায়ানদের সর্পদেবতা, তার বাবা হলেন সর্পদের রাজা। কুকুলকান মূলত ডানাওয়ালা এক সরীসৃপ, যাকে মায়ারা শ্রদ্ধাভরে পূজা করতো। এই পূজার জন্য নবম ও দশম শতকের মাঝামাঝিতে তারা তৈরি করেছিল ১০০ ফুট উচ্চতার একটি পিরামিডসদৃশ উপাসনালয়। চারদিকে ৯১টি করে সিঁড়ির ধাপ, আর একেবারে ওপরে উঠার জন্যে একটি ধাপ, সব মিলিয়ে ৩৬৫টি ধাপ ছিল এই উপাসনালয়ে।

চিচেন ইটজা
মায়া সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য হল এই চিচেন ইটজা। স্থানীয় ভাষায় একে এল কাস্টিলো-ও বলে অনেকে। এই মন্দিরের অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল গুরুত্বও বিশেষ তাত্পর্যপূর্ণ। পিরামিডের আকারে নির্মিত এই উপাসনাস্থলের প্রতিটি দিকে ৯১টি করে সিঁড়ি রয়েছে। এখানে মোট সিঁড়ির সংখ্যা ৩৬৫। অর্থাত্ বছরের প্রতিটি দিন সিঁড়ির এক একটি ধাপের সঙ্গে সমার্থক। ২০০৬-এ এখান থেকে পড়ে এক মহিলার মৃত্যু হওয়ার পর এল কাস্টিলো-তে ওঠা নিষেধ।
পালেংক
পালেংক
মায়া সভ্যতার পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত আর্কিওলজিক্যাল সাইট পালেংক। বর্তমান কালে এই অঞ্চলে মেক্সিকোর শিয়াপাস অবস্থিত। পালংক আয়তনে মায়া সভ্যতার অন্য স্থাপত্যের তুলনায় ছোট হলেও এর সৌন্দর্য অপরিসীম। এর বেশিরভাগ নির্মাণই ৬০০ এডি থেকে ৮০০ এডির মধ্যে তৈরি। বিশেষ করে এই স্থাপত্যের টেম্পল অফ ইন্সক্রিপশন-এর কথা উল্লেখ করতেই হয়।
উক্সমাল

উক্সমাল
উক্সমাল শব্দের অর্থ 'তিন সময়ে নির্মিত'। মায়া সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত ও দীর্ঘতম স্থাপত্য এটি। পিরামিড অফ ম্যাজিসিয়ান ১১৫ ফুট লম্বা। ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে দশম শতাব্দীর মধ্যে পাঁচ দফায় এই মন্দিরটি নির্মিত হয়।
খুব গম্ভীর হয়ে পড়ছে আলোচনা। সত্যিই তাই! সিঁড়ি নিয়ে এমন একটা লেখার কথা যখন মাথায় চাপল তখন ভেবেই পাচ্ছিলাম না যে, কি ভাবে শুরু করবো বা কি কি লিখবো। কিন্তু তথ্য খুঁজতে গিয়ে আমি তো দিশেহারা হয়ে পড়ছি। সত্যিই, কতো কিছুই না জানার আছে আমাদের আর সেই জানাকে ঘরের মধ্যে এনে দিয়েছে এই যুগান্তকারী ইন্টারনেট ব্যবস্থা এবং তার সাথে অবশ্যই গুগুল বাবাজীবন। সারা পৃথিবীর অজস্র লাইব্রেরীর তাকগুলো এখন আমার আঙুলের ডগায়। যদিও আমাদের দেশজ লাইব্রেরী এখনো সেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগে।
রবীন্দ্রনাথের গল্প বা উপন্যাসে ‘সিঁড়ি যে কতো ভাবে এসেছে তা বলাই বাহুল্য …

“বরীচ জায়গাটি বড়ো রমণীয়। নির্জন পাহাড়ের নীচে বড়ো বড়ো বনের ভিতর দিয়া শুস্তা নদীটি (সংস্কৃত স্বচ্ছতোয়ার অপভ্রংশ) উপলমুখরিত পথে নিপুণা নর্তকীর মতো পদে পদে বাঁকিয়া বাঁকিয়া দ্রুত নৃত্যে চলিয়া গিয়াছে। ঠিক সেই নদীর ধারেই পাথর-বাঁধানো দেড়-শত-সোপান-ময় অত্যুচ্চ ঘাটের উপরে একটি শ্বেতপ্রস্তরের প্রাসাদ শৈলপদমূলে একাকী দাঁড়াইয়া আছে— নিকটে কোথাও লোকালয় নাই।
তখন গ্রীষ্মকালের আরম্ভে বাজার নরম; আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না। সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আমি সেই নদীতীরে ঘাটের নিম্নতলে একটা আরাম-কেদারা লইয়া বসিয়াছি। তখন শুস্তানদী শীর্ণ হইয়া আসিয়াছে; ও পারে অনেকখানি বালুতট অপরাহ্নের আভায় রঙিন হইয়া উঠিয়াছে; এ পারে ঘাটের সোপানমূলে স্বচ্ছ অগভীর জলের তলে নুড়িগুলি ঝিক ঝিক করিতেছে। সেদিন কোথাও বাতাস ছিল না। নিকটের পাহাড়ে বনতুলসী পুদিনা ও মৌরির জঙ্গল হইতে একটা ঘন সুগন্ধ উঠিয়া স্থির আকাশকে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল”।
“সূর্য যখন গিরিশিখরের অন্তরালে অবতীর্ণ হইল তৎক্ষণাৎ দিবসের নাট্যশালার একটা দীর্ঘ ছায়াযবনিকা পড়িয়া গেল-- এখানে পর্বতের ব্যবধান থাকাতে সূর্যাস্তের সময় আলো আঁধারের সম্মিলন অধিকক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঘোড়ায় চড়িয়া একবার ছুটিয়া বেড়াইয়া আসিব মনে করিয়া উঠিব-উঠিব করিতেছি, এমন সময়ে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম, কেহ নাই”।
রবীন্দ্রনাথে’র ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পে শুস্তা নদীর তীরে সিঁড়ি আর প্রাসাদে ওঠবার সিঁড়ি, এই দু’য়ে মিলে এক ভৌতিক অনুভূতির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছেন। নদীর ধারে পাথর বাঁধানো দেড়শ খানা সিঁড়ি যখন কল্পনা করতে থাকি তখনই মনের মধ্যে এক অকারণ অনুভব। সেই সিঁড়ি দিয়ে একঝাঁক নারী মল ঝমঝমিয়ে স্নানে যায় শুস্তা’য়। আবার স্নান সমাপনে উঠতে থাকে তখন এক মায়াময় জগৎ তৈরি হয় এই সিঁড়িকে ঘিরেই।
“ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মনে করিয়া পুনরায় ফিরিয়া বসিতেই একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল, যেন অনেকে মিলিয়া ছুটাছুটি করিয়া নামিয়া আসিতেছে। ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরূপ পুলক মিশ্রিত হইয়া আমার সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। যদিও আমার সম্মুখে কোনো মূর্তি ছিল না তথাপি স্পষ্ট প্রত্যক্ষবৎ মনে হইল যে, এই গ্রীষ্মের সায়াহ্নে একদল প্রমোদচঞ্চল নারী শুস্তার জলের মধ্যে স্নান করিতে নামিয়াছে। যদিও সেই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ গিরিতটে, নদীতীরে নির্জন প্রাসাদে কোথাও কিছুমাত্র শব্দ ছিল না, তথাপি আমি যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম নির্ঝরের শতধারার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া আমার পার্শ্ব দিয়া স্নানার্থিনীরা চলিয়া গেল। আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না। তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেইরূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য। নদী পূর্ববৎ স্থির ছিল, কিন্তু আমার নিকট স্পষ্ট বোধ হইল, স্বচ্ছতোয়ার অগভীর স্রোত অনেকগুলি বলয়শিঞ্জিত বাহুবিক্ষেপে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে; হাসিয়া হাসিয়া সখীগণ পরস্পরের গায়ে জল ছুঁড়িয়া মারিতেছে, এবং সন্তরণকারিণীদের পদাঘাতে জলবিন্দুরাশি মুক্তামুষ্টির মতো আকাশে ছিটিয়া পড়িতেছে।
আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল; সে উত্তেজনা ভয়ের কি আনন্দের কি কৌতুহলের, ঠিক বলিতে পারি না। বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছু ছিল না; মনে হইল ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে, কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল অরণ্যের ঝিল্লিরব শোনা যায়। মনে হইল, আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে দুলিতেছে………”
কিরকম করে একটার পর একটা দৃশ্য চোখের সামনে খুলে দিচ্ছেন।
আমাদের ছোটোবেলায় এই বরানগরে কত যে পুকুর ছিল, আর ছিল প্রচুর জমিদার বাড়ির বাগান। পাড়ার পুকুরগুলোয় ছোটো ছোটো সিঁড়ি থাকতো। ইঁট বাঁশ এসব দিয়ে। কিন্তু ওই বড় বড় বাগানবাড়ি’র পুকুরগুলোয় শ্বেতপাথরের সিঁড়ি থাকতোই। এখনো একটা দুটো তার স্মৃতি বহন করে আছে এই অঞ্চলে। বাকিগুলো ‘প্রমোটার’ নামক এক সুনিপুণ জাতিদের কবলে পড়ে সিঁড়ির শ্বেতপাথরগুলো বিক্রিত হয়ে তাদের সিন্দুকে কাঁচা টাকায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সাথে সাথে চলে গেছে ছায়াসুনিবিড় প্রাচীন বৃক্ষগুলিও।
“একটি অমেয় সিঁড়ি মাটির উপর থেকে নক্ষত্রের
আকাশে উঠেছে;
উঠে ভেঙে গেছে।
কোথাও মহান কিছু নেই আর তারপর।
ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র প্রাণের প্রয়াস র'য়ে গেছে;
তুচ্ছ নদী-সমুদ্রের চোরাগলি ঘিরে
র'য়ে গেছে মাইন, ম্যাগ্নেটিক মাইন, অনন্ত কনভয়,-
মানবিকদের ক্লান্ত সাঁকো
এর চেয়ে মহীয়ান আজ কিছু নেই জেনে নিয়ে
আমাদের প্রাণের উত্তরণ আসেনাকো।
সূর্য অনেক দিন জ্বলে গেছে মিশরের মতো নীলিমায়।…” — (রাত্রির কোরাস - সাতটি তারার তিমির)
##
চলবে..................।
©গৌতমদত্ত।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।