এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • সিঁড়ির সাতকাহন   (৬)

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১১ নভেম্বর ২০২২ | ২১৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)

  •  
    (৬)



    স্পেনের বারমিও পৌরসভার অন্তর্গত বিস্কে উপকূলে একটি দ্বীপ “গজৎলুকাৎসেতে” (Gaztelugatxe)। দ্বীপখানি একটা ব্রিজের সাথে মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত। দ্বীপের উপরে একটি আশ্রম রয়েছে। সেই আশ্রমের নাম “গজৎলুকাৎসেতে ডোনিন” (স্প্যানিশ ভাষায় San Juan de Gaztelugatxe)।

    ছোট গির্জা, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮০ মিটার উপরে, দশম শতাব্দীর। নবম এবং দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যযুগীয় সমাধিগুলি এই আশ্রমে পাওয়া গেছে। এই জায়গায় সমুদ্র খুবই সংকূল। এই যে সেতু, সেটা শক্ত পাথরে তৈরি আর এখানেই রয়েছে ২৩১ খানি সিঁড়ির ধাপ। লোককথা বলে যে এই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে প্রত্যেককে তিনবার ঘন্টা বাজানো উচিৎ আর মনে মনে একটা ইচ্ছে করাই দস্তুর।
     
    *
    “পাষাণে ঘটনা যদি অঙ্কিত হইত তবে কতদিনকার কত কথা আমার সোপানে সোপানে পাঠ করিতে পারিতে। পুরাতন কথা যদি শুনিতে চাও, তবে আমার এই ধাপে বইস; মনোযোগ দিয়া জলকল্লোলে কান পাতিয়া থাকো, বহুদিনকার কত বিস্মৃত কথা শুনিতে পাইবে।

    আমার আর-একদিনের কথা মনে পড়িতেছে। সেও ঠিক এইরূপ দিন। আশ্বিন মাস পড়িতে আর দুই-চারি দিন বাকি আছে। ভোরের বেলায় অতি ঈষৎ মধুর নবীন শীতের বাতাস। নিদ্রোখিতের দেহে নূতন প্রাণ আনিয়া দিতেছে। তরু-পল্লব অমনি একটু একটু শিহরিয়া উঠিতেছে।

    ভরা গঙ্গা। আমার চারিটিমাত্র ধাপ জলের উপরে জাগিয়া আছে। জলের সঙ্গে স্থলের সঙ্গে যেন গলাগলি। তীরে আম্রকাননের নীচে যেখানে কচুবন জন্মিয়াছে, যেখান পর্যন্ত গঙ্গার জল গিয়াছে। নদীর ঐ বাঁকের কাছে তিনটে পুরাতন ইঁটের পাঁজা চারি দিকে জলের মধ্যে জাগিয়া রহিয়াছে। জেলেদের যে নৌকাগুলি ডাঙার বাবলাগাছের গুড়ির সঙ্গে বাঁধা ছিল সেগুলি প্রভাতে জোয়ারের জলে ভাসিয়া উঠিয়া টলমল করিতেছে — দুরন্তযৌবন জোয়ারের জল রঙ্গ করিয়া তাহাদের দুই পাশে ছল ছল আঘাত করিতেছে, তাহাদের কর্ণ ধরিয়া মধুর পরিহাসে নাড়া দিয়া যাইতেছে”।

    চেনা যাচ্ছে ? সিঁড়ির ধাপ নিয়ে কি অসাধারণ বর্ণনা। গল্পগুচ্ছে’র প্রথম গল্প। ঘাটের কথা’। এটি প্রকাশিত হয় ভারতী পত্রিকার কার্তিক ১২৯১ সংখ্যায়। পল্লীগ্রামের একটি সাধারণ মেয়ের সারাটা জীবনকে রবীন্দ্রনাথ কি অসম্ভব নিপুনতায় ফুটিয়ে তুলেছিলেন।

    “যে মেয়েটির কথা বলিতেছি ঘাটের অন্যান্য মেয়েরা তাহাকে কুসুম বলিয়া ডাকিত। বোধ করি কুসুমই তাহার নাম হইবে। জলের উপরে যখন কুসুমের ছোটো ছায়াটি পড়িত, তখন আমার সাধ হইত সে ছায়াটি যদি ধরিয়া রাখিতে পারি, সে ছায়াটি যদি আমার পাষাণে বাঁধিয়া রাখিতে পারি; এমনি তাহার একটি মাধুরী ছিল। সে যখন আমার পাষাণের উপর পা ফেলিত ও তাহার চারিগাছি মল বাজিতে থাকিত, তখন আমার শৈবালগুল্মগুলি যেন পুলকিত হইয়া উঠে......”

    “কিছুদিন পরে কুসুমকে আর দেখিতে পাই না। ভুবন আর স্বর্ণ ঘাটে আসিয়া কাঁদিত। শুনিলাম তাহাদের কুসি-খুশি-রাক্কুসিকে শ্বশুরবাড়ি লইয়া গিয়াছে। শুনিলাম, যেখানে তাহাকে লইয়া গেছে, সেখানে নাকি গঙ্গা নাই। সেখানে আবার কারা সব নূতন লোক, নূতন ঘরবাড়ি, নূতন পথঘাট। জলের পদ্মটিকে কে যেন ডাঙায় রোপণ করিতে লইয়া গেল”।

    “ক্রমে কুসুমের কথা একরকম ভুলিয়া গেছি। এক বৎসর হইয়া গেছে। ঘাটের মেয়েরা কুসুমের গল্পও বড়ো করে না। একদিন সন্ধ্যার সময়ে বহুকালের পরিচিত পায়ের স্পর্শে সহসা যেন চমক লাগিল। মনে হইল যেন কুসুমের পা। তাহাই বটে, কিন্তু সে পায়ে আর মল বাজিতেছে না। সে পায়ের সে সংগীত নাই। কুসুমের পায়ের স্পর্শ ও মলের শব্দ চিরকাল একত্র অনুভব করিয়া আসিতেছি — আজ সহসা সেই মলের শব্দটি না শুনিতে পাইয়া সন্ধ্যাবেলাকার জলের কল্লোল কেমন বিষন্ন শুনাইতে লাগিল, আম্রবনের মধ্যে পাতা ঝরঝর করিয়া বাতাস কেমন হা হা করিয়া উঠিল।

    কুসুম বিধবা হইয়াছে”।

    ‘কুসুম বিধবা হইয়াছে’ এ যেন সেই বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘শোলে’র সেই কার্ট-শর্ট। যেখানে সঞ্জীবকুমার এর মৃতদেহ তার গ্রামের শুন্য বাড়িতে ফিরে আসছে। একটা খণ্ড দৃশ্য। অথচ কি বেদনাময়! তেমন করেই রবীন্দ্রনাথ ছবিখানা এঁকে দিলেন তাঁর ছোটোগল্পের প্রথম গল্পে।

    এর পরে গল্পে এক সন্ন্যাসীর আগমন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন...

    “......কোথা হইতে গৌরতনু সৌম্যোজ্জ্বলমুখচ্ছবি দীর্ঘকায় এক নবীন সন্ন্যাসী আসিয়া আমার সম্মুখস্থ ঐ শিবমন্দিরে আশ্রয় লইলেন। সন্ন্যাসীর আগমনবার্তা গ্রামে রাষ্ট্র হইয়া পড়িল। মেয়েরা কলসী রাখিয়া বাবাঠাকুরকে প্রণাম করিবার জন্য মন্দিরে গিয়া ভিড় করিল।”

    “ক্রমে একদিন কুসুমও আসিয়া সন্ন্যাসীর পা ছুঁলো। তারপর…”

    “......সন্ন্যাসী তাহাকে যেমন উপদেশ করিতেন সে অবিকল তাহাই পালন করিত। প্রত্যহ সে মন্দিরের কাজ করিত — দেবসেবায় আলস্য করিত না — পূজার ফুল তুলিত — গঙ্গা হইতে জল তুলিয়া মন্দির ধৌত করিত।  

    সন্ন্যাসী তাহাকে যে-সকল কথা বলিয়া দিতেন, আমার সোপানে বসিয়া সে তাহাই ভাবিত। ধীরে ধীরে তাহার যেন দৃষ্টি প্রসারিত হইয়া গেল, হৃদয় উদ্ঘাটিত হইয়া গেল। সে যাহা দেখে নাই তাহা দেখিতে লাগিল, যাহা শোনে নাই তাহা শুনিতে লাগিল। তাহার প্রশান্ত মুখে যে একটি ম্লান ছায়া ছিল, তাহা দূর হইয়া গেল। সে যখন ভক্তিভরে প্রভাতে সন্ন্যাসীর পায়ের কাছে লুটাইয়া পড়িত, তখন তাহাকে দেবতার নিকটে উৎসর্গীকৃত শিশিরধৌত পূজার ফুলের মতো দেখাইত। একটি সুবিমল প্রফুল্লতা তাহার সর্বশরীর আলো করিয়া তুলিল।”

    ক্রমে বসন্তকাল এল। কুসুমের মন চঞ্চল। হৃদয়ে মৌমাছির গুঞ্জরন। সন্ন্যাসী অবশেষে প্রশ্নের জবাবদিহিতে জানতে পারলেন যে কুসুম তাঁহাকেই স্বপ্নে দেখেছে।

    এ কথা শোনার পর সন্ন্যাসী কুসুম’কে বলেন...
    "তবে আমি চলিলাম।"
    “কুসুম আর কিছু না বলিয়া তাঁহাকে প্রণাম করিল, তাঁহার পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল। সন্ন্যাসী চলিয়া গেলেন।
    কুসুম কহিল, "তিনি আদেশ করিয়া গিয়াছেন তাঁহাকে ভুলিতে হইবে।" বলিয়া ধীরে ধীরে গঙ্গার জলে নামিল”।

    “...... চাঁদ অস্ত গেল, রাত্রি ঘোর অন্ধকার হইল। জলের শব্দ শুনিতে পাইলাম, আর কিছু বুঝিতে পারিলাম না। অন্ধকারে বাতাস হুহু করিতে লাগিল; পাছে তিলমাত্র কিছু দেখা যায় বলিয়া সে যেন ফু দিয়া আকাশের তারাগুলিকে নিবাইয়া দিতে চায়।

    আমার কোলে যে খেলা করিত সে আজ তাহার খেলা সমাপন করিয়া আমার কোল হইতে কোথায় সরিয়া গেল, জানিতে পারিলাম না”।

    গল্প শেষ হয়। গঙ্গার ধারে সেই সিঁড়ি অপেক্ষা করতেই থাকে আরো নতুন কোনো গল্পের।

    “বিফল প্রেমিকা একা নেমে যায় অবতরণের শেষ ধাপে ;
    বড় অবসন্ন এই চলে যাওয়া,
    রেলিংয়ে হাতের মুঠি খুলে—
    যেন ভেসে যায় কোনো জলমগ্ন মানব-শরীর, জলাশয়ে
    নীল ঝাঁঝি জলজ গুল্মের নীচে অন্ধকার শীতল শয়নে…
             প্রথম দিনের মতো উজ্জ্বল মুখের কোনো প্রিয়-সম্ভাষণ,
    মিষ্ট কলস্বর আর থাকে না সিঁড়িতে ;
    বিপরীতে শব্দহীন হাওয়া ঘুরে যায়...

    ঘরের ভিতরে আছে অদৃশ্য এমন সরোবর ;
    জলের কিনার ছুঁয়ে আঁকাবাঁকা হলুদ সাপের মতো একা
    ডুবে যায় বিষন্ন প্রেমিক”।                   (কবিতা – ‘সিঁড়ি থেকে দূরে’ - কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়)
     
     
    আগামী পর্বে......
    #
     
    ©গৌতমদত্ত।
  • ধারাবাহিক | ১১ নভেম্বর ২০২২ | ২১৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বানী - Ashiq Rahman
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন