(৯)এরপরে এগিয়ে এলেন গণিতবিদরাও। তাঁরাও সিঁড়ির আকারে আগ্রহী হতে শুরু করলেন !
মোটামুটি বারোশ’ সালের ভেতরেই গণিতবিদ লিওনার্দো ফিবোনাচি (Leonardo Fibonacci) আবিষ্কার করলেন ‘ফিবোনাচি পরম্পরা’ বা ‘ফিবোনাচি’র সোনার অনুপাত’। তার আবিষ্কৃত সংখ্যার পরম্পরা বা ক্রম অর্থাৎ ( ০, ১, ১, ২, ৩, ৫, ৮, ১৩, ২১, ৩৪) এই সংখ্যাগুলোকে যদি দৃশ্যমানতায় আনা যায় তাহলে এটা একটা সর্পিল আকার নেয়। এই গাণিতিক সূত্রটি সে সময় এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে সে সময় মানে ঐ রেনেসাঁ পিরিয়ডের স্থাপত্য আর ছবি আঁকাতেও ব্যবহার করেছিলেন প্রচুর তথাকথিত শিল্পীরা মায় লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি অব্দি। স্পাইরাল বা পেঁচালো বা সর্পিল যে কোনো সিঁড়িকে এমন একটা কৌণিক জায়গা থেকে যদি দেখা হয় তাহলে মনে হবে যে স্বর্গের সিঁড়ি বা যে সিঁড়ির শেষ নেই আর কি ! অথচ ব্যাপারটাই দৃষ্টির মায়া।

Bramante Staircase, Vatican (1505)

"আপেক্ষিকতা", M.C Escher (1953) এবং Penrose Steps (1958) দ্বারা।
প্রকৃতিই বিশ্বজুড়ে স্থপতিদেরকে আশ্চর্যজনক কাঠামো তৈরি করতে অনুপ্রাণিত করেছে, তবে এমন কাঠামোও রয়েছে যা প্রকৃতির নিয়মের সাথে খাপ খায় না। অতএব, গণিতবিদরা অসম্ভব কাঠামোর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন এই নিয়মরক্ষার খাতিরে যা চিত্রকর্ম বা স্বপ্নের মতো। এর একটি উদাহরণ হল ১৯৫৩-য় তৈরি M.C. Escher এর লিথোগ্রাফিক প্রিন্ট। একে বলা হয় "আপেক্ষিকতা" কারণ প্রতিটি সিঁড়ির কোণ, স্থানটির বিষয়ের অবস্থানের উপর নির্ভর করে। এটি আপেক্ষিক কারণ এ সিঁড়ির বিভিন্ন কোণ একটি অসম্ভব সিঁড়ি রচনার ধারণা করেছিল।
কিছুদিন পরে, এই "আপেক্ষিকতা" দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, একজন গণিতবিদ, লিওনেল (Lionel) এবং রজার পেনরোজ (Roger Penrose), ১৯৫৮ সালে "অসম্ভব বস্তু" নামে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন যা "দ্য পেনরোজ স্টেপস" নামেও পরিচিত। ১৯৬০ সালে, আবার ওই গবেষণাপত্রের প্রতিক্রিয়া হিসাবে, এসার (Escher) পুনরায় এই পেনরোজ সিঁড়িতে ‘আরোহণ’ এবং ‘অবরোহণ’ এর নতুন ফর্মুলা আনেন।

“Ascending and Descending”, by M.C Escher (1960).
এই ছবি যেন পৌনঃপুনিক আর একটানা বলে মনে হয়, যার কোনো কার্যকারী উদ্দেশ্য পাওয়াই যায় না। এক চিঠিতে এসার তাঁর বন্ধুকে জানান এই ছবি সম্পর্কে তাঁর অস্তিত্ববাদী ধারণার কথা। “সিঁড়িটি যখন একটি দুঃখজনক, হতাশাবাদী বিষয়, সেইসাথে খুব গভীর এবং অযৌক্তিক। (...) হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা উপরে উঠি এবং উপরে উঠিই, আমরা কল্পনা করি যে আমরা আরোহণ করছি যেটির প্রতিটি ধাপ প্রায় দশ ইঞ্চি উচ্চ, যা ভয়ঙ্করভাবে ক্লান্তিকর। এটি আমাদের কোথায় নিয়ে যায়? কোথাও নয়।"

The ancient podium found in the City of David. Photo by Shai Halevy/Israel Antiquities Authority
প্রত্নতাত্ত্বিকরা প্রাচীন জেরুজালেমের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ডেভিড শহরের একটি প্রাচীন রাস্তায় একটি রহস্যময় পোডিয়ামের মতো সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছেন। ধ্বংস হওয়া দ্বিতীয় মন্দিরের সংলগ্ন ধাপগুলির ক্ষুদ্র পিরামিডটি প্রায় দু হাজার বছর পুরানো বলে অনুমান করা হয়।
ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে অবশেষে, ইতালিতে একটি প্রধান স্থাপত্য কৌশল বলে সিঁড়ি স্বীকৃত হয়েছিল। ভাসারি তাঁর ‘লাইভ অফ আর্টিস্ট’ (১৫৬৮ সালের সংস্করণ) বইতে নিজে সিঁড়ির জন্য অনুপ্রাণিত হয়ে একটি বাড়ির শরীর হিসেবে সিঁড়িকে "বাহু ও পা" হিসাবে বর্ণনা করেছেন। এবং ভিনসেঞ্জো স্কামোজি (Vincenzo Scamozzi) (১৫৫২-১৬১৬) লিখেছেন ‘মানুষের শরীরে যেমন শিরা, রক্তনালী, ধমনী প্রভৃতি রক্ত জোগান দেয় ঠিক তেমনি একটা সম্পূর্ণ বাড়ির যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য সিঁড়ি একটা প্রয়োজনীয় স্থাপত্য।’

বিখ্যাত স্থপতি এবং শিল্পীদের দ্বারাও এই সিঁড়ির নতুনতর বিন্যাস ইতিহাসে দেখা গেছে। মাইকেলেঞ্জেলোর কথা বলি। ইতালিতে রোমে “পিয়াজা দেল ক্যাম্পিডোগ্লিও”র মধ্যে অবস্থিত পালাজ্জো সেনাটোরিও (Palazzo Senatorio), যা সেনেটোরিয়াল প্যালেস নামেও পরিচিত তা নির্মিত হয়েছিল দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যে। ১৫৩৮ সালে শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো ও গিয়াকোমো ডেলা পোর্টা (Giacomo Della Porta) দ্বারা এটিকে আমূল পুনর্বিন্যাস করা হয়েছিল। মাইকেলেঞ্জেলো যখন কাঠামোটিকে নতুনভাবে ডিজাইন করেছিলেন তখন তিনি তার নকশাটি রেনেসাঁ থিম এবং বিল্ডিংয়ের শৈলীর উপর ভিত্তি করে করেছিলেন। আসলে তিনি একটা একক অথচ রাজসিক সিঁড়ি নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অবশ্যই কাজের সাথে সাথে এক বিশেষ অলংকরণের কারণে। মাইকেলএঞ্জেলো এর একক সিঁড়িটিকে একটি ডাবল সিঁড়ি দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে বেছে নিয়েছিলেন। ধাপগুলিকে আরও প্রশস্ত এবং আরও ব্যবহারিক করে তুলতেও চেয়েছিলেন যাতে ধাপগুলি পুরো প্রাসাদের চেহারা এবং প্রাসাদের সম্পূর্ণ শৈলীর সাথে সিঁড়িখানা এক দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে।

দুদিক খোলা সিঁড়ির ধারণা কিন্তু খুব পুরোনো নয়। ইতালির ফ্লোরেন্স বা নেপোলি’তে এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বিখ্যাত স্থপতি বা শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলো ফ্লোরেন্সের লরেন্টিয়ান লাইব্রেরি-র (Laurentian Library) (১৫৫৭ খ্রীঃ) জন্য, এক নতুন ডিজাইনের সিঁড়ি-র বিন্যাসের পরিকল্পনা করলেন। সিঁড়িটি দুদিকে খোলা হবে এবং একটা লেফাফার মধ্যে যেমন কাগজপত্তর থাকে তেমন হবে সিঁড়ির দুদিক।

Lauretian Library Staircase.
গতিবিদ্যার উন্মাদনায় মধ্যযুগীয় স্থপতিরা আনন্দিত হতেন এবং তাঁরা সিঁড়িকে লুকিয়ে রাখতে চাইতেন শুধুমাত্র যেখানে প্রতিরক্ষার ব্যাপার থাকতো। সাধারণভাবে সে সময়ে সিঁড়িগুলো বাড়ি বা প্রাসাদের বাইরের দিকেই থাকতো এবং যে কেউই বাইরে থেকেই দেখতে পারতো। তবে রেনেসাঁসের প্রথম দিকের স্থাপত্য বা প্রকৌশলী তত্ত্বগুলো সিঁড়িকে স্বাভাবিক চলাচলের স্বাধীনতা কে রুপ দেওয়ার চেষ্টায় সচেষ্টই থাকত।
সিঁড়ির যে কৌণিক অবস্থান তা কিন্তু খোলা সিঁড়ির এক ত্রিমাত্রিক ছবি যেন। তার সমাধান মেটাতে সিঁড়িকে ঘিরে দেওয়ার প্রয়াস শুরু হল। এই প্রযুক্তিকেই জার্মান এবং ভিয়েনিজ বারোক মাস্টাররা ট্রেপেনহাউস (Treppenhaus) বলে থাকেন। রেনেশাঁসের সময়কার স্থপতিরা তখন স্থাপত্য হিসেবে সিঁড়ির আকার এবং আয়তন বাড়াতে সচেষ্ট হন। এই প্রবণতার চূড়ান্ত পরিণতি দেখা যায় ইতালি, অস্ট্রিয়া এবং জার্মানির দুর্দান্ত বারোক সিঁড়িগুলিতে।
লরেন্টিয়ান লাইব্রেরির সিঁড়িতে, মাইকেলেঞ্জেলো সিঁড়িটিকে একটি ফ্রিস্ট্যান্ডিং বস্তুতে পরিণত করেছিলেন শুধুমাত্র একপাশে দেয়ালের সাথে সংযুক্ত করেই। ফ্রিস্ট্যাণ্ডিং শব্দটার অর্থ হলো সিঁড়ি নিজেই নিজে দাঁড়িয়ে থাকবে অর্থাৎ সিঁড়ি নিজেই যেন এক স্থাপত্য। সিঁড়ির মূল পইঠা (flight) সংযুক্ত থাকবে দুপাশেই। গোদা বাংলায় যাকে বলা হয় সিঁড়ির দুধারের রেলিং আর কি !
একটা সিঁড়িও আমাদের দিতে পারে এক আপেক্ষিক পরিমাপের ধারণা। আগেই বলেছি যে ল্যাটিন ভাষায় সিঁড়ি শব্দের ব্যুৎপত্তিগত পরিভাষা হল “scala”। আমরা এই ল্যাটিন শব্দটিকে আমাদের ‘স্কেল’ এর সাথে এক গোত্রেই ফেলতে পারি। আমাদের পরিচিত স্কেল-এ দেখতে পাই ইঞ্চি, মিলিমিটার আর সেন্টিমিটারের বিভিন্ন মাপ যা প্রতি একককে নির্দিষ্ট এবং সুন্দরভাবে প্রকাশ করে। ঠিক তেমনি এই সিঁড়িও তার প্রতি পইঠা বা ধাপের উচ্চতা আর বেধ একটা নির্দিষ্টমাপেই ধরে রাখে। ফ্রাঁসোয়া ব্লন্ডেল (François Blondel) এর বিখ্যাত সূত্র অনুযায়ী “twice the riser plus the tread equals a constant” ফর্মূলাকেই মান্যতা দেওয়া হয়ে থাকে। ১৬৭২ সাল নাগাদ তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার সুত্র মেনে বলছেন যে সাড়ে আট ইঞ্চির (২২ সে.মি) বেশি উঁচু ধাপ (সিঁড়ির) আর ন’ ইঞ্চির কম চওড়া সিঁড়ি আমাদের জন্য একেবারেই উপযুক্ত বা আরামদায়ক হয় না।