এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • সিঁড়ির সাতকাহন  (১০)

    Goutam Dutt লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ০১ জানুয়ারি ২০২৩ | ২১৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  •  
    (১০)
     
    বললে পেত্যয় যাবেন না এই সূত্রের প্রভাব সাহিত্যেও এসে পড়েছিল। যে কোনো সিঁড়ির কাজ কি ? সিঁড়ি দিয়ে ওঠা বা নামা। এই তো ? সে ব্যাপারটাকে প্রতীক করে সাহিত্যে, সিনেমায় আর ছবিতেও ব্যাপক ব্যবহার শুরু হ’ল। মনে করুন এমন একটা সিঁড়ি যা মাঝখানটা চারকোনা ফাঁকা। চারধার দিয়ে উঠে গেছে সিঁড়ি। এবারে কুড়ি তলায় সিঁড়ির ধাপ থেকে যদি আপনি নিচে তাকান তাহলে একটু প্যালপিটিশন যে হবে না, সে কে বলতে পারে ? পারেন হিচ্‌ককের মতো সিনেমার পরিচালকেরা। ঐ সিচুয়েশনটা দিয়েই সৃষ্টি করতে পারেন এক ভয়ার্ত পরিবেশ যা হিচ্‌কক করেছিলেন ১৯৫৮ তে বিখ্যাত ‘ভার্টিগো’ সিনেমায়। এই সিনেমার প্রধান চরিত্রের একটা বিরল রোগ ছিল। উচ্চতাজনিত রোগ। পরিভাষায় যার নাম এক্রোফোবিয়া। সেই সিনেমাতেও এই সিঁড়ির দৃশ্য অসাধারন সব এঙ্গেলে তোলা হয়েছিল।


    “ভার্টিগো” সিনেমার সেই সিঁড়ি।

    “অক্ষরে অক্ষরে বোঝে মেয়ে,  তার আপেল জীবন,
    আকাশ চুমো পাহাড় বরফ আর গ্লেসিয়ার ঢাকা,
    কুম্ভীরাশ্রু পড়ে ভারাক্রান্ত নিস্তরঙ্গ ফল্গু শিরে,
    দয়ামায়া নিশ্চিহ্ন সবার মুখে, দেবতারাও বাইপাশে ছোটে,
    প্রেমের চেয়ে প্রেমিক বড়, বিছানায় মার্জিত অশ্লীল ভাষা,
    বাচক্লব শ্রেষ্ঠত্ব উপলব্ধ তর্কবিতর্কে, আপোষ না হলে জবর দখল,
    ডোরবেল বাজলেই সেবন্তী দরজা খুলবে অকুতো খুঁৎ খুঁৎ,
    তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে যুত্সই চুমো,
    আর ঘরে কাপড় খুলতে খুলতে উলঙ্গ সমাধি।”  ( - সিঁড়ি। কৃষ্ণকুসুম পাল)


    কতই না গল্প উপন্যাস। কবিতা বেশ কম যদিও। তবে, যে কোনো গোয়েন্দা উপন্যাসে সিঁড়ি অবধারিত।
    “......আগেই বলা হয়েছে জমিদার-বাটী ‘মধু নিবাস’ প্রাসাদতুল্য। চারতলা। গ্রামের বহু দূর থেকেও লাল রঙের জমিদার বাড়ী পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

    চারতলার উপরে অবিশ্যি একখানি মাত্রই ঘর : ঠাকুর-ঘর বা গৃহদেবতা লক্ষ্মী-নারায়ণের পূজা-ঘর। ত্রিতলে ও দ্বিতলে আটটি ঘর। অন্যান্য ঘরগুলি মাঝারী গোছের। বাড়ীর সামনে প্রকাণ্ড দেশী-বিলাতী ফুলের এখখানি বাগান। বাগানের মধ্যখানে লাল সুরকীঢালা পায়ে-চলার পথ। বাড়ীর পিছন দিকে প্রায় ১০/১১ কাঠা জমির পরে আম-জাম প্রভৃতি ফলের বাগান, বাগানের সীমানা পেরিয়ে নজরে পড়ে সবুজ মাঠ ও চষা জমি।

    বাড়ীর দুই দিক দিয়ে দুটি সিঁড়ি। একটি সিঁড়ি বরাবর চারতলা পর্যন্ত গেছে, অন্যটি তিনতলায় গিয়ে শেষ হয়েছে।

    মোট কথা, চারতলার 'পরে ঠাকুর-ঘরে যাবার একটিই মাত্র সিঁড়ি। কিরীটি খুব ভাল করে ঘুরে ঘুরে দেখলে: চারতলার 'পরে ঠাকুর-ঘরে যাবার ঐ সিঁড়ি ভিন্ন আর কোন উপায়ই নেই। ঐটিই একমাত্র পথ।

    ঠাকুর-ঘরে যাওয়ার মধ্যে শিবশংকরের বৃদ্ধা জননী ও পূজারী ব্রাহ্মণ রামকুমার সান্যাল, মাঝে মাঝে শিবশংকর যান বটে তবে গত ৭/৮ দিন ওদিকে মোটে যানই নি। আর কারও পূজা-ঘরে প্রবেশাধিকার নেই। শিবশংকরের হুকুম।......”

    এ গল্প তো ডিটেকটিভ কিরীটি রায় এর। গল্পের নাম ‘স্বর্ণ-মূর্তি। মূর্তি চুরি হয়েছিল। চারতলার ওই ঠাকুরঘর থেকেই।

    “কত রকম সিঁড়ি আছে ওঠার এবং নামার
    চলতে চলতে থামার।
    সরল সিঁড়ি শীতল সিঁড়ি
    পদোন্নতির পিছল সিঁড়ি
    অন্ধ এবং বন্ধ সিঁড়ি
    কদম ফুলের গন্ধা-সিঁড়ি
    ওঠার এবং নামার
    চলতে চলতে থামার।
    কত রকম সিঁড়ির ধাপে কত রকম জল
    পা পিছলোলে অধঃপতন
    ভাসতে পারো মাছের মতন
    ডুব সাঁতারে মুঠোয় পেলে সঠিক ফলাফল।
    কত রকম জলের ভিতর কত রকম মাছ।
    চুনো পুঁটি রাঘব বোয়াল যার যে রকম নাচ।
    পেট চিরলে আংটি কারো।
    কারো শুধুই আঁশ।
    দীর্ঘতর ফুসফুসে কার ভরাট দীর্ঘশ্বাস।
    সিঁড়ির নীচ জল এবং সিঁড়ির উপর ছাদ
    মেঘও পাবে মানিক পাবে
    বজ্রধ্বনির খানিক পাবে
    পুড়তে চাইলে রোদ।
    জ্যোৎস্না থেকে চাইতে পার সার্থকতাবোধ।

    অনেকরকম সিঁড়ি আছে ওঠা নামা হাঁটার
    ঊর্ধ্বে অভিষেকের তোরণ।
    নিচের ঝোপটি কাঁটার”।          — (কবিতা ‘সিঁড়ি’ - কবি পূর্ণেন্দু পত্রী)


    কিংবা আরো পরে যখন হাতে পেলাম…

    “...আপনার ঘরটা একবার দেখতে পারি কি?’ ফেলুদা প্রশ্ন করল। ভদ্রলাকে চৌকাঠের মুখে থেমে গিয়ে বললেন, দেখবেন বইকী। সুবীর দেখিয়ে দেবে। আমি ছাতে সান্ধ্যভ্রমণটা সেরে আসি।'

    করিডরে বেরিয়ে এলাম চারজনে। অন্ধকার আরও ঘনিয়ে এসেছে। করিডরের ডাইনে বাঁয়ে ঘরগুলোর ভিতর থেকে মোমবাতির ক্ষীণ আলো বাইরে এসে পড়েছে। নীহারবাবু লাঠি ঠক ঠক করে ছাতের সিড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। শুনলাম তিনি বলছেন, স্টেপ গোনা আছে। সতেরো স্টেপ গিয়ে বাঁয়ে ঘুরে সিঁড়ি। সেভেন প্লাস এইট-পনেরো ধাপ উঠে ছাত। প্রয়োজন হলে খবর দেবেন...?”
    —  (উপন্যাস – গোলকধাম রহস্য - সত্যজিৎ রায়)।

    রহস্য, গোয়েন্দা আর ভূতের গল্পে সিঁড়ি যেন মাস্ট মাস্ট মাস্ট।

    জয়বাবা ফেলুনাথ সিনেমাটির সেই অংশটা যেখানে ফেলুদা একা বেরিয়েছে একদিন সকালবেলায়। কাশী’র মুন্সীঘাটে একটা বুরুজের ওপরে বসে চা খেতে খেতে হঠাৎ ফেলুদার চোখে পড়ে মছলীবাবা’র মতো একটা লোক গঙ্গাস্নান সেরে মুন্সীঘাটের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত উঠে আসছে সেই প্রাচীন বাড়িটায়। ফেলুদা ফলো করতে থাকে। প্রথমে একটা বাড়িতে ঢোকে লোকটা। তারপরে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত ঢুকে পড়ে আরেকটা বিশাল বাড়ির অভ্যন্তরে। সে বাড়িটা একেবারে গঙ্গার পাশেই। পিছু নিতে নিতে ফেলুদা পৌঁছে যায় সেই বিশাল বাড়ির দুতলায়। এর পরে খাবার আনতে আবার নেমে আসে লোকটা। সেই সুযোগে ফেলুদা তার ঘরে ঢুকে প্রথমেই সন্ধান পায় সেই মাছের আঁশের। তারপরে সেই পুরোনো দিনের ফুল আঁকা টিনের স্যুটকেশ খুলে ফেলুদা খুঁজে পায় নকল কালো দাড়ি আর রিভলভার। এর মধ্যেই। খাবার হাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে লোকটা। ফেলুদা সরে যায়। ভিজে জামা কাপড় মেলতে থাকে লোকটা। ফেলুদা লুকিয়ে লক্ষ্য করতে থাকে। ঘরে ঢুকে লোকটা এরপরে দরজার দিকে পিছন ফিরে উবু হয়ে খেতে বসে। সেই সুযোগে ফেলুদা বেরিয়ে আসে। দমবন্ধ করা এই দৃশ্যাংশটুকু। এর পরেই মূর্তিশিল্পী শশীবাবু খুন আর সেই আখতারী’র গান......

    এই দৃশ্যগুলোয় সিঁড়ি’র ব্যবহার কি অসামান্য দক্ষতায় করেছিলেন আমাদের সেই লম্বা ছফুটিয়া পরিচালক মশাই। উপন্যাসে কিন্তু এই ডিটেলস্ নেই।

    সাহিত্য, সিনেমা এবং চিত্রকলা সম্পর্কিত চিত্রগুলিতে এক প্রতীকী ব্যঞ্জনা প্রকাশ করতে প্রায়শই সিঁড়ির ব্যবহার হয়ে থাকে। কিছু বিখ্যাত চলচিত্রের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যেও সিঁড়ির ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।



    চলবে.....................
     
    ©গৌতমদত্ত।
     
     
  • ধারাবাহিক | ০১ জানুয়ারি ২০২৩ | ২১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন