এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - তৃতীয় পর্ব - চতুর্থ ভাগ  

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ২২ জুন ২০২২ | ১১০৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • তৃতীয় পর্ব - ৬০০ বিসিই থেকে ০ বিসিই - চতুর্থ ভাগ 

    ৩.৪.১ বৌদ্ধধর্মের রাজস্বীকৃতি
    শেষ অপরাহ্নে তালবন আশ্রমের ভিক্ষুরা তখন বুদ্ধদেব এবং উরুবিল্ব কশ্যপকে ঘিরে সবে মাটিতে আসন নিয়েছে ধর্মকথা শুনবে বলে। সেই সময় গৌতমবুদ্ধের কানে সংবাদ পৌঁছল - রাজা আসছেন। তিনি উরুবিল্ব কশ্যপকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে গেলেন রাজপরিবারকে অভ্যর্থনা করতে। রাজা বিম্বিসার দেখলেন তাঁর অনুমান নির্ভুল, তাঁর বন্ধু সন্ন্যাসী সিদ্ধার্থই এই গৌতমবুদ্ধ। তিনি বুদ্ধদেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন তাঁর রাণি এবং পুত্রের। তারপর বিখ্যাত আচার্য এবং অভিজাত কয়েকজনের সঙ্গেও পরিচয় করালেন। বুদ্ধ এবং অর্হৎ কশ্যপ সকলের বসার ব্যবস্থা করলেন, রাজপরিবারের জন্যে কাঠের পীঠিকা আর অন্যদের জন্য মাটিতেই আসন বিছিয়ে দেওয়া হল।

    রাজার অনুগামীদের মধ্যেই অনেকেই ছিলেন প্রখ্যাত বেদজ্ঞ আচার্য, দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত। তাঁদের অনেকেই উরুবিল্ব কশ্যপকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনেন, জানেন অথবা নাম শুনেছেন, কিন্তু তাঁদের কেউই গৌতমবুদ্ধের নাম কখনো শোনেননি। তাছাড়া কশ্যপের তুলনায় বয়সেও গৌতমবুদ্ধ অনেকটাই ছোট। তাঁরা সকলেই আশ্চর্য হলেন, উরুবিল্ব কশ্যপের মতো পণ্ডিত কী ভাবে অচেনা-অজানা এই গৌতমবুদ্ধর শিষ্য হয়ে গেলেন? নাকি তাঁরা ভুল বুঝছেন, আসলে গৌতমবুদ্ধই উরুবিল্ব কশ্যপের শিষ্য? কিন্তু তিনি যখনই কথা বলছেন, গৌতমবুদ্ধের প্রতি তাঁর বিনম্র শ্রদ্ধা দেখে উপস্থিত বিদ্দ্বজ্জনেরা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উঠছিলেন। তাঁদের মনের এই দ্বিধা বুঝতে ভুল করলেন না উরুবিল্ব কশ্যপ। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, “হে গৌতমবুদ্ধ, হে বোধিসত্ত্ব, আপনিই আমার জীবনের সর্বোত্তম আচার্য। আপনাকে নতমস্তকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে অনুরোধ করি উপস্থিত সকলকে এবং আমাকেও আপনি আত্ম-জাগরণের পথ নির্দেশ দিন”। এই বলে তিনি গৌতমবুদ্ধকে তিনবার প্রদক্ষিণ করলেন।
     
    গৌতমবুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়ে কশ্যপকে নিজের পাশে বসালেন, তারপর সকলের উদ্দেশে শুরু করলেন তাঁর ধর্ম কথা। ভোরের রৌদ্রের মতো উজ্জ্বল অথচ জ্যোস্নার মতো স্নিগ্ধ তাঁর শরীর। উদাত্ত অথচ শান্ত, প্রত্যয়ী স্বরে তিনি যখন তাঁর উপলব্ধির কথা শুরু করলেন, উপস্থিত মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইল তাঁর মুখের দিকে। ন’শো ভিক্ষুসহ, সমবেত প্রায় এক হাজারের ওপর মানুষ সকলেই নিঃশব্দ, নিস্পন্দ। কেউ উচ্ছ্বসিত নিশ্বাস ফেলল না, সকলেই নিবাত-নিষ্কম্প দীপশিখার মতোই অচঞ্চল, নড়াচড়ায় যদি বস্ত্রের খস্‌খস্‌ আওয়াজ ওঠে!

    গৌতমবুদ্ধের ধর্মকথা সমাপ্তির পর রাজা বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন, করজোড়ে নতমস্তকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে বললেন, “হে প্রভু, ছোটবেলা থেকেই আমার পাঁচটি সঙ্কল্প ছিল। আজ এই মাত্র, আমার সব সঙ্কল্পই সম্পূর্ণ হল। প্রথম সঙ্কল্প ছিল রাজ্যাভিষেক এবং রাজা হওয়া। রাজা আমি হয়েছি। দ্বিতীয় সঙ্কল্প ছিল এই জীবনে একজন পরমপ্রজ্ঞাবান আচার্যের সাক্ষাৎ। সাক্ষাৎ আমি পেয়েছি। তৃতীয় সঙ্কল্প ছিল সেই প্রজ্ঞাবান আচার্যকে আমি বন্দনা করবো। সে সুযোগ আমি পেয়ে গেছি। চতুর্থ সঙ্কল্প ছিল সেই আচার্য আমাকে সত্যের পথ দেখাবেন। আপনিই আমাকে সে পথ দেখিয়েছেন। পঞ্চম সঙ্কল্প ছিল আমার অন্তরে, আমার চেতনায় সেই সত্য যেন উপলব্ধি করতে পারি। আমার অন্তরে সেই আলোক আমি দেখতে পেয়েছি। হে আচার্য, আমাকে অনুগ্রহ করে, আপনার গৃহী-শিষ্য হবার অনুমতি দিন”।
     
    গৌতমবুদ্ধ স্মিতমুখে সম্মতি দিলেন। আনন্দিত বিম্বিসার তাঁকে, উরুবিল্ব কশ্যপকে এবং তাঁদের ন’শ ভিক্ষু সন্ন্যাসীকে আগামী পূর্ণিমায়, তাঁর প্রাসাদে ভিক্ষা গ্রহণের অনুরোধ করলেন। গৌতমবুদ্ধ রাজার সে প্রার্থনাও আনন্দের সঙ্গে মঞ্জুর করলেন। তারপর রাজা বিম্বিসার সপরিবার এবং সপারিষদ নগরে ফেরার জন্যে প্রস্তুত হলেন। গৌতমবুদ্ধ এবং উরুবিল্ব কশ্যপ তাঁদের এগিয়ে দিলেন তালবনের সীমানা ছাড়িয়ে রাজপথ পর্যন্ত।
     
    এখন প্রতিদিনই সঙ্ঘে ভিক্ষুর সংখ্যা বাড়ছে, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ আসছে তাঁর জ্ঞানের আলোকে মনের তমসা দূর করার প্রার্থনা নিয়ে। পূর্ণিমার দিন গৌতমবুদ্ধ হাতে ভিক্ষাপাত্র নিয়ে রাজগৃহ নগরে যখন ঢুকলেন, ন’শোর জায়গায় তাঁকে অনুসরণ করছিল বারোশ পঞ্চাশজন ভিক্ষু। তাদের প্রত্যেকের হাঁটার গতি ধীর কিন্তু প্রত্যয়ী, সকলের দৃষ্টি পথের দিকে, পথ চলাতেও তারা যেন ধ্যাননিবিষ্ট। তাদের সকলেই মুণ্ডিত মস্তক, পরনে গৈরিক বসন এবং হাতে ভিক্ষাপাত্র। রাজগৃহের নাগরিক পথের দুপাশে দাঁড়িয়ে রইল সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে, নিজেদের অজ্ঞাতেই তাদের জোড়হাত উঠে এল বুকের কাছে।
     
    রাজা বিম্বিসার তাঁর প্রাসাদের সিংহদ্বারে অপেক্ষা করছিলেন প্রায় সহস্র অনুচর ও অতিথিদের সঙ্গে। বুদ্ধদেব এসে পৌঁছতেই তিনি সসম্মানে তাঁকে এবং সকল ভিক্ষুদের নিয়ে গেলেন প্রাসাদের প্রাঙ্গণে। অজস্র পুষ্পমাল্যে সাজানো, সুগন্ধী ধূপ ও গুগ্‌গুলের সৌরভে সুরভিত সেই প্রাঙ্গণের মাঝখানে রাজা বিম্বিসার বুদ্ধদেবকে বসালেন। রাজকুমার অজাতশত্রু নিজের হাতে জল এনে ভগবান বুদ্ধের হাত ও পা ধুয়ে দিলেন। অন্যান্য অনুচরেরা জল এনে অন্যান্য অর্হৎ এবং ভিক্ষুদের হাত-পা ধুয়ে দিলেন। তারপর নিরামিষ খাদ্যসম্ভার এনে সাজিয়ে রাখা হল। রাজা জানতেন অহিংস বুদ্ধদেব নিরামিষ খাদ্যই পছন্দ করেন। তিনি এবং মহারাণি নিজের হাতে খাবার তুলে দিলেন বুদ্ধদেবের ভিক্ষাপাত্রে। রাজ পরিবারের অন্য মহিলারা খাবার পরিবেশন করলেন ভিক্ষুদের। পরিবেশন শেষ হতে, বুদ্ধদেব এবং অন্য সকলে একসঙ্গে আহারে মন দিলেন। তাঁদের নিঃশব্দ, শান্ত এবং নিবিষ্ট আহার গ্রহণ দেখে উপস্থিত সকলেই অভিভূত হয়ে গেলেন। প্রতিটি খাদ্যের স্বাদ ও গন্ধ সম্যক অনুভব করতে করতে, এভাবেও আহার করা যায়! আহার শেষে বুদ্ধদেব এবং সকল ভিক্ষুদের ভিক্ষাপাত্র ধুয়ে ফেরৎ দেওয়া হল, সকলেই হাতমুখ ধুয়ে এসে আবার নিজ নিজ আসনে বসলেন।

    রাজা বিম্বিসার করজোড়ে একটি নিচু আসনে বসলেন ভগবান বুদ্ধের সামনে। গৌতমবুদ্ধ রাজার ইচ্ছা বুঝে ধর্ম কথা বলতে শুরু করলেন, “প্রথম ধর্ম সর্বদা অহিংস থাকা। এই ধর্ম থেকে আসে সহমর্মীতা। সকল জীবই মৃত্যুকে ভয় পায়। আমরা যেমন নিজেদের জীবন পোষণ করি, সকল প্রাণীও তাই করে থাকে। আমরা যে শুধু মানুষ হত্যা থেকেই বিরত থাকব তা নয়, আমরা অন্য সকল প্রাণী হত্যা থেকেও বিরত থাকার চেষ্টা করব। আমরা সকল মানুষ, প্রাণী এমনকি উদ্ভিদের সঙ্গেও মিলেমিশে থাকব। আমরা যখন প্রত্যেকটি প্রাণের মূল্য বুঝতে শিখব, দেশে অশান্তি থাকবে না। অন্য রাজ্য জয়ের জন্য শক্তির বৃথা অপচয় নয়, বরং আমাদের সেনাবাহিনী ব্যস্ত থাকুক রাজ্যের রাস্তাঘাট, সেচব্যবস্থা, চিকিৎসালয় গড়ে তুলতে।

    দ্বিতীয় ধর্ম হল অচৌর্য বৃত্তি। পরিশ্রমে সঞ্চয় করা একজনের সম্পদের ওপর অন্য মানুষের কোন অধিকার থাকতে পারে না। নিজের ক্ষমতা এবং প্রভাব খাটিয়ে সেই সম্পদ থেকে তাকে বঞ্চিত করা আরো বেশি অপরাধ। শ্রমিকের শ্রম ও স্বেদের বিনিময়ে প্রভূত সম্পদ অর্জন করাও এক ধরনের চুরিই। দেশের সকলেই যখন এই ধর্ম পালন করবে, দেশ থেকে হিংসা দূর হয়ে যাবে। সকল মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হবে সামাজিক সাম্যতা।

    তৃতীয় ধর্ম হল কখনো যৌন দুরাচার না করা। বিবাহিত দাম্পত্য ছাড়া কখনো যৌনাচার করো না। এই ধর্মাচরণে সমাজে আসবে বিশ্বাস এবং সুখ, দূর হবে ভুল বোঝাবুঝি এবং পারিবারিক দুঃখ। উপপত্নীদের থেকে নিজেকে দূরে রাখলে, পরিবার ও সমাজের মানুষকে সুখী এবং সাহায্য করার অনেক বেশি সময় মিলবে।

    চতুর্থ ধর্ম হল কখনও মিথ্যা না বলা। এমন কথা কখনও না বলা, যার থেকে হিংসা এবং বিভেদ সৃষ্টি হয়। তোমাদের বক্তব্য যেন সত্য অনুসারী হয়। কথার মধ্যে বিশ্বাস এবং সুখ সৃষ্টি করার শক্তি থাকতে হবে। এমন কোন কথাই বলবে না যা থেকে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে বিদ্বেষ বা ঘৃণা, কলহ-বিবাদ এমনকি যুদ্ধের সৃষ্টি হয়। প্রতিটি কথা বলার আগে বক্তব্য বিষয় নিয়ে বারবার চিন্তা করবে – তোমার বক্তব্য যে শুনছে তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

    পঞ্চম ধর্ম কোন নেশাতেই আকৃষ্ট না হওয়া, সে মদই হোক বা অন্য কিছু। নেশার জিনিষ মনকে আচ্ছন্ন করে। নেশাগ্রস্ত মানুষ তার পরিবার, সমাজ এবং নিজের অবর্ণনীয় দুঃখের কারণ হয়ে ওঠে। এই ধর্ম প্রত্যেকের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে সর্বদা পালনীয়।

    দেশের রাজা এবং রাজ্যের সমস্ত আধিকারিক যদি এই পাঁচটি ধর্ম নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে, তাহলে রাজ্যের সমৃদ্ধি অবধারিত। হে রাজন্‌, রাজা রাজ্যের কর্ণধার। রাজ্যের কোথায় কী ঘটছে এবং কেন ঘটছে সে সম্বন্ধে সর্বদাই অবহিত এবং সচেতন থাকাটা রাজার কাছে জরুরি। আপনি এবং রাজকার্যের নানান দায়িত্বে থাকা সকলেই এই পাঁচটি ধর্ম যদি সম্যক পালন করেন, আমি বলছি, মগধ রাজ্যে খুব দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে”।

    প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য গৌতমবুদ্ধের এই ধর্ম-পরামর্শগুলি সাধারণের জন্যে হলেও বিশেষতঃ রাজা বিম্বিসারকেই উদ্দেশ  করেই যেন বললেন। রাজা বিম্বিসারের উপপত্নী সম্ভোগ। রাজা বিম্বিসারের বিলাস, ব্যসন ও ভোগবাসনা। সিদ্ধার্থের মতো স্বল্প পরিচিত তরুণ এক সন্ন্যাসীকে হঠাৎ অর্ধেক রাজত্ব দানের প্রস্তাব দিয়ে, নিজেকে অসহায় ধর্মপ্রাণ প্রমাণের চেষ্টা। এই সবকিছুই গৌতমবুদ্ধের কাছে তাঁর অব্যবস্থিত মানসিকতাকেই প্রকট করেছিল।        

    রাজা বিম্বিসার শ্রদ্ধায় নতমস্তকে প্রণাম করলেন ভগবান বুদ্ধকে। মহারাণি বিদেহী পুত্র অজাতশত্রুর হাত ধরে সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি জোড়হাতে শ্রদ্ধা জানালেন, বালক পুত্রকেও শেখালেন কীভাবে জোড়হাতে পদ্মমুদ্রায় শ্রদ্ধা জানাতে হয়। তারপর মহারাণি বললেন, “হে প্রভু, আজ এখানে অজাতশত্রুর মতোই প্রায় চারশ বালক-বালিকা উপস্থিত রয়েছে। আপনি তাদের শিক্ষণীয় কিছু উপদেশ দিন”।

    ভগবান বুদ্ধ বালক অজাতশত্রুকে কাছে টেনে নিলেন, তার একটি হাত নিজের হাতে ধরে রেখে তিনি সকল বালকদের উদ্দেশ্যে স্মিতমুখে বললেন, “ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের কোন উপদেশ দেব না বরং একটি গল্প শোনাবো। এই মানব জন্মের আগে, আমি এই পৃথিবীতে পাথর, মাটি, গাছপালা, পাখি বা অন্য নানান প্রাণী হয়ে বহুবার জন্ম নিয়েছিলাম। তোমরাও, আগের আগের জন্মে তেমনই ছিলে! তোমাদের সঙ্গে আমার আগের কোন না কোন জন্মে, হয়তো কোন সম্পর্ক ছিল, যার জন্যেই আমরা এই জন্মে আবার একত্র হয়েছি। কে জানে, হয়তো বিগত জন্মগুলিতে আমরা বারবার পরষ্পরের সুখ-দুঃখের কারণ হয়েছিলাম।

    আজ যে ঘটনার কথা তোমাদের বলব, আমার কয়েক হাজার জন্ম আগে সে ঘটনা ঘটেছিল। এক কাঁক, এক কাঁকড়া, একটি চাঁপাগাছ, আর অনেক চিংড়ি এবং মাছদের নিয়ে এই কাহিনী। এই গল্পে আমি ছিলাম চাঁপাগাছ, আর তোমাদের মধ্যে কেউ হয়তো ছিলে সেই কাঁক[1], কাঁকড়া, চিংড়ি কিংবা মাছ। এই কাহিনীতে কাঁকই ছিল ভয়ংকর এক চরিত্র, যে অন্য সকলের অশেষ দুঃখের কারণ হয়েছিল, এমনকি আমার মতো গাছেরও।

    সে জন্মে সুন্দর স্বচ্ছ এক পদ্মদীঘির পাড়ে আমি চাঁপা গাছ হয়ে বেড়ে উঠেছিলাম। আর সেই সরোবরের কিছুটা দূরেই ছিল ছোট্ট একটি ডোবা। সেই ডোবার অগভীর জলে বাস করত অনেক চিংড়ি, মাছ এবং কাঁকড়া। একদিন এক কাঁক উড়তে উড়তে তাদের সকলকে দেখে ফেলল। ছোট্ট ডোবার সীমিত জলে এতগুলি লোভনীয় শিকারকে একসঙ্গে দেখে, সে তখনই সেই ডোবার পাড়ে নামল। তারপর একপায়ে দাঁড়িয়ে শিকারের মতলব আঁটতে গভীর চিন্তায় ডুব দিল।

    মাছ এবং চিংড়ির দল পাড়ের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “হে কঙ্ক, আপনি এত গভীর ভাবে কী চিন্তা করছেন?” গভীর শ্বাস ছেড়ে কাঁক উত্তর দিল, “আমি তোদের কথাই চিন্তা করছি, রে। এই ঘোলা কাদামাখা জলে তোরা এতজন রয়েছিস কী করে? তোদের শ্বাস নিতে কিংবা সকলের খাবার পেতে অসুবিধে হচ্ছে না? তোদের কষ্টের কথা চিন্তা করে, আমার খুবই দুঃখ হচ্ছে, রে!”
    “কথাটা ঠিকই, কিন্তু আপনি কী আমাদের কোনভাবে সাহায্য করতে পারেন?”
    “পারি না আবার? একশবার পারি। এই কাছেই একটা পদ্মদীঘি আছে। আমি তোদের প্রত্যেককে সেই দীঘির স্বচ্ছ শীতল জলে ছেড়ে দিতে পারি। সেখানে প্রচুর জল, প্রচুর খাবার পেয়ে যাবি”।
    “আমরা কোনদিন শুনিনি, কাঁক পাখি কোন মাছ বা চিংড়িকে সাহায্য করেছে। আপনাকে ভরসা করতে ভয় লাগে।  আমাদের শিকার করে খাবার, এ হয়তো আপনার নতুন কোন চাল”।
    “য্যাঃ, তোরা বড্ডো সন্দেহবাতিক। আমি তোদের বড়ো কাকার মতো। আমি তোদের ঠকাতে যাবো কী করতে? এই কাছেই সত্যিই খুব সুন্দর বড়ো একটা পদ্মদীঘি আছে, তার জল যেমন স্বচ্ছ তেমনি ঠাণ্ডা। বিশ্বাস না হলে, তোদের একজন কেউ আমার সঙ্গে চল, আমি দেখিয়ে নিয়ে আসছি। তারপর না হয় তোরা সবাই মিলে, কী করবি, ঠিক করিস!”

    মাছ এবং চিংড়ির ঝাঁক নিজেদের মধ্যে বেশ খানিকক্ষণ শলাপরামর্শ করল, তারপর তারা ঠিক করল একজন বয়স্ক মাছ যাবে, কাঁকের কথা সত্যি কিনা, পরখ করতে। বয়স্ক সেই মাছটি বেশ বড়সড়ো, শক্তপোক্ত, তার গায়ের আঁশগুলোও খুব মোটা আর শক্ত। কাঁক তাকে মুখে করে নিয়ে গেল সেই সরোবরে, তারপর তাকে ছেড়ে দিল সরোবরের জলে। বয়স্ক সেই মাছ সরোবরের জলে অনেকক্ষণ ঘুরল, ফিরল, দেখল। সত্যিই, সরোবরের জল স্বচ্ছ, শীতল। অনেক মাছ এবং চিংড়ি থাকার পক্ষে বিস্তর জায়গা এবং খাবারেরও কোন অভাব নেই। সে কাঁকের মুখেই আবার ফিরে এল সেই ডোবায়। সে যা দেখেছে, মাছ এবং চিংড়িদের কাছে সব খুলে বলল।
    কাঁকের সদিচ্ছায় মাছ এবং চিংড়িদের এবার ভরসা হল। এক এক করে তাদের ওই পদ্মদীঘিতে ছেড়ে আসতে, তারা কাঁককে অনুরোধ করল। ধূর্ত কাঁক এক কথাতেই রাজি হয়ে গেল। সে একটি মাছকে জল থেকে তুলে, ঠোঁটে করে নিয়ে, উড়ে এসে বসল সরোবরের পাড়ের সেই চাঁপাগাছের ডালে। গাছের শাখার খাঁজে মাছটিকে রেখে, কাঁকটা ঠুকরে ঠুকরে খেয়ে ফেলল মাছের মাস। মাছের কাঁটাগুলো ফেলে দিল গাছের গোড়ায়। তারপর আবার উড়ে গেল আরেকটি মাছ তুলে আনতে।

    আমিই সেই চাঁপাগাছ, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম এই সব ঘটনা। আমার কষ্ট হচ্ছিল, রাগ হচ্ছিল খুব। কিন্তু আমি যে গাছ, কিছুই করতে পারছিলাম না, কাঁককে আটকানোর কোন ক্ষমতা তো আমার ছিল না। একটা চাঁপাগাছ, ডালপালা ছড়াতে পারে, ফুল ফোটাতে পারে। কিন্তু সে তো দৌড়ে কোথাও যেতে পারে না। সে চিৎকার করে মাছ এবং চিংড়িদের সাবধান করতে পারে না। দিনের পর দিন সেই কাঁক অজস্র মাছ এবং চিংড়িদের ধরে এনে, আমারই ডালে বসে খেতে লাগল। আর তাদের কাঁটা আর শল্ক ফেলে ফেলে ছোটখাটো পাহাড় বানিয়ে তুলল আমার গোড়ায়। আমিই শুধু সেই ভয়ংকর দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে রইলাম। আতঙ্ক, ভয় এবং দুঃখে আমি দিনের পর দিন শুকিয়ে উঠতে লাগলাম।
     
    সেই ডোবার মাছ এবং চিংড়িরা এক দিন শেষ হয়ে এল। কিন্তু কাঁকের লোভ তখনও মেটেনি। ডোবার জলে থাকা কাঁকড়াদের বলল, “ভাইপোরা, সেই পদ্মদীঘির জলে মাছ আর চিংড়ির ঝাঁক তো দিব্যি আরামে আছে, এখন তোদের কী ইচ্ছে? তোরা কী এখানেই থাকবি, নাকি পদ্মদীঘিতে যাবি?”
    কাঁকড়ার দল জিজ্ঞাসা করল, “আমাদের কীভাবে নিয়ে যাবেন?”
    “কেন? ঠোঁটে করে? যেভাবে এতগুলো মাছ আর চিংড়িদের এতদিন ধরে নিয়ে গেলাম?”
    “ওরে বাবা, না না। আপনার ঠোঁট ফস্কে একবার মাটিতে পড়লে আর দেখতে হবে না, খোলস ফেটে আমরা অক্কা পাবো”।
    “আরে ধূর, ঘাবড়াস না, আমি বেশ যত্ন করেই তোদের নিয়ে যাবো”।
     
    কাঁকড়ার দল নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলোচনা করল। হতে পারে কাঁক হয়তো সব মাছ এবং চিংড়িদের সত্যিই পদ্মদীঘিতে নিয়ে গেছে। কিন্তু তা যদি না হয়? কাঁকটা যদি তাদের সবাইকে খেয়ে ফেলে থাকে? কাঁকড়ার দল পরামর্শ করে, একটা নিরাপদ উপায় চিন্তা করল। তারপর কাঁককে বলল, “কাকা কঙ্ক, আমাদের ভয় হচ্ছে, আপনি আপনার ঠোঁটে আমাদের নিরাপদে ধরে রাখতে পারবেন না। তার থেকে আমরা যদি আপনার গলাটি দাঁড়া দিয়ে জড়িয়ে ধরি? আমাদের মনে হয় সেটা অনেক নিরাপদ।”

    কাঁক রাজি হয়ে গেল, সে গলা বাড়িয়ে দিল এবং তার গলা আঁকড়ে ঝুলে পড়ল বড়ো একটি কাঁকড়া। কাঁকড়াকে গলায় নিয়ে কাঁক উড়ে এসে বসল আমারই গাছের ডালে। কাঁকড়া বলল, “কাকা কঙ্ক, আপনি নিচেয় পদ্মদীঘির কাছে না গিয়ে, আমাকে এখানে কেন নিয়ে এলেন?”

    কাঁক ক্রূর হেসে বলল, “আমি কি এতই মূর্খ? যে অকারণে মাছ আর চিংড়িদের পদ্মদীঘিতে বয়ে বয়ে আনব? কাঁক এত পরোপকারী নয়, ভাইপো! গাছের নিচে তাকিয়ে দেখ, মাছের কাঁটা আর শল্কর কেমন স্তূপ জমে উঠেছে। সব কটাকে খেয়েছি, এখন তোকেও খাবো। তোর খোলাও পড়ে থাকবে ওই স্তূপের মধ্যে”।
    “কাকা, মাছ এবং চিংড়িদের সহজেই ঠকাতে পেরেছ বলে, আমাদেরও ঠকাতে পারবে ভেবেছ? আমাকে এখনই ওই পদ্মদীঘির ধারে নিয়ে চল, তা না হলে আমার দুই দাঁড়ায় তোমার গলা আমি ছিঁড়ে ফেলব”।
     
    কাঁকড়া তার দুই দাঁড়া দিয়ে কাঁকের গলা চেপে ধরতেই, কাঁক তার বিপদ বুঝতে পারল, যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বলল, “ঠিক আছে ঠিক আছে, ছেড়ে দে। আমি তোকে এখনই নিচেয় নিয়ে যাচ্ছি। তোকে আমি খাবো না”। কাঁক তাকে নিয়ে পদ্মদীঘির জলের ধারে নিয়ে গেল, কিন্তু কাঁকড়া তাকে ছাড়ল না। মাছ এবং চিংড়িদের সঙ্গে ওই কাঁকের নিষ্ঠুর বঞ্চনার কথা মনে করে, সে তার দুই দাঁড়ার প্রচণ্ড চাপে ছিঁড়ে ফেলল কাঁকের গলা। কাঁক মারা গেল, আর কাঁকড়া হেঁটে গিয়ে নেমে পড়ল জলে।
     
    ছেলেমেয়েরা, আমিই ওই চাঁপাগাছ ছিলাম বলে, সমস্ত ঘটনা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম। তখনই আমি শিখেছিলাম, আমরা যদি কারও সঙ্গে সহৃদয় আচরণ করি, সেও আমার সঙ্গে তাই করবে। আর যদি নিষ্ঠুর হিংস্র আচরণ করি, আমাদের ভাগ্যেও তাই জুটবে। সে সময় আমার কিছু করার সাধ্য না থাকলেও, আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আমি যদি পরের জন্মে কোন প্রাণী হয়ে জন্মাই, তাহলে আমি অবশ্যই দুর্বল এবং অসহায় প্রাণীদের রক্ষা করার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করব। হয়তো তোমাদের মধ্যে অনেকেই সেই জন্মে ছিলে, চিংড়ি, মাছ অথবা কাঁকড়া।”

    ছেলেমেয়েরা খুব মন দিয়ে এই কাহিনী শুনছিল। তারা সকলেই অনুভব করল চাঁপাগাছের অসহায় দুঃখ। অসহায় মাছ এবং চিংড়িদের কথা ভেবেও তারা ভীষণ কষ্ট পেল। কাঁকের প্রতি বিতৃষ্ণায় তাদের মনে ভরে উঠল। আর স্বস্তি পেল কাঁকড়ার উপস্থিত বুদ্ধি আর বীরত্বে।
     
    রাজা বিম্বিসার উঠে দাঁড়ালেন। জোড়হাতে নতমস্তকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তিনি ভগবান বুদ্ধকে বললেন, “হে আচার্য, আপনার এই কাহিনী শুধু ছোটদের নয়, আমাদের মতো বড়দের কাছেও সমান শিক্ষণীয়। আমি নিশ্চিত, পুত্র অজাতশত্রু এবং অন্য সব ছেলেমেয়েরা, এই শিক্ষা সারাজীবন মনে রাখবে। আমাদের রাজ্য আজ আপনার উপস্থিতিতে অলংকৃত হয়ে উঠল। এবার অনুগ্রহ করে আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে খুব সামান্য কিছু উপহার দেওয়ার অনুমতি দিন”।
     
    গৌতমবুদ্ধ কোন উত্তর দিলেন না, স্মিতমুখে তাকিয়ে রইলেন রাজা বিম্বিসারের মুখের দিকে। রাজা বিম্বিসার বললেন, “রাজগৃহের উত্তরে অর্ধক্রোশ দূরে খুব সুন্দর একটি বড়ো উপবন আছে। সেখানে আছে স্বচ্ছ জলের সরোবর। হিংস্র-শ্বাপদহীন সে বনে শুধু হরিণ আর কাঠবেড়ালি ঘুরে বেড়ায়। ওই উপবনের নাম বেণুবন। আমি ওই বেণুবন আপনাকে এবং আপনার সঙ্ঘকে দান করতে চাই। সেই সঙ্গে বানিয়ে দিতে চাই আপনাদের সবার বাসযোগ্য অনেক কুটির। সহস্রাধিক ভিক্ষু এবং আমাদের মতো গৃহীশিষ্যদের বসার জন্যে বানিয়ে দিতে চাই স্থায়ী বাঁধানো মণ্ডপ। যেখানে স্বয়ং আপনি এবং অহর্ৎগণ আমাদের প্রত্যহ ধর্মশিক্ষা দিতে পারবেন। হে প্রজ্ঞাবান, আপনি অনুগ্রহ করে আমার অন্তরের এই বিনীত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করুন”।

    ভগবান বুদ্ধ কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর স্মিতমুখে সম্মতি দিলেন রাজাকে। রাজা বিম্বিসার তখনই সোনার কলসে পবিত্র জল আনালেন, তারপর সেই কলসের জল ভগবান বুদ্ধের করকমলে ঢালতে ঢালতে বললেন, “হে প্রভু, যেভাবে এই কলসের জল আপনার করপদ্মে নিবেদন করলাম, সেইভাবেই বেণুবন সমর্পণ করলাম আপনাকে এবং আপনার সঙ্ঘকে”।

    বুদ্ধদেব এবং তাঁর সঙ্ঘ সেই প্রথম নিজস্ব একটি জমির অধিকার লাভ করলেন। যেখানে ভিক্ষুরা নিশ্চিন্তে বাস করবেন এবং ধর্মচর্চা করবেন। প্রতিকূল বর্ষার সময়েও তাঁরা পেয়ে যাবেন নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়। রাজগৃহের বেণুবন বৌদ্ধধর্মে নিয়ে এল বৌদ্ধবিহারের প্রথম ধারণা। গড়ে উঠতে লাগল বৌদ্ধবিহার কেন্দ্রিক সুশৃঙ্খল এক ধর্মীয় সংগঠন।

    সেদিন রাজা বিম্বিসারের অতিথিদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের রক্ষক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। তাঁরা প্রকাশ না করলেও, মনে মনে তীব্র ঈর্ষায় বিরূপ হলেন রাজার ওপর এবং গৌতমবুদ্ধ নামের ওই ছোকরা লোকটির ওপর।

    এরপর গৌতমবুদ্ধ আমৃত্যু (৪৮৩ বি.সি.ই) সর্বদাই পরিব্রাজক হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন, প্রধানতঃ এখনকার উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের বিভিন্ন নগরে, জনপদে এবং গ্রামে। তাঁর শিষ্য এবং অনুগামীদের মধ্যে ছিলেন, রাজা থেকে ক্রীতদাস, বণিক থেকে বারাঙ্গনা। বয়োবৃদ্ধ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ থেকে নিজের পুত্র বালক রাহুল। বিভিন্ন বৌদ্ধগ্রন্থে বিখ্যাত যত অর্হৎ ও সন্ন্যাসীদের নাম পাওয়া যায়, তাঁদের কয়েকজনের কথা সংক্ষেপে উল্লেখ করলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে।
     
    অহর্ৎ কঙ্খা রেবত – শ্রাবস্তীর অতি ধনী পরিবারে পুত্র। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের অন্যতম স্তম্ভ।  
    অনাথপিণ্ডিক (অনাথপিণ্ডদ নামেও পরিচিত) – অন্যতম বিখ্যাত গৃহীশিষ্য। শ্রাবস্তীর সফলতম বণিক। তাঁর সম্বন্ধে আশ্চর্য এক কাহিনী শোনা যায়। গৌতমবুদ্ধকে একটি বিহার নির্মাণ করে দেবেন মনস্থ করে, অনাথপিণ্ডিক বেশ বড়ো একটি ভূখণ্ড পছন্দ করেছিলেন। সেই ভূমির অধিকারী ছিলেন কোশলরাজ প্রসেনজিতের পুত্র রাজকুমার জেত। তিনি কিছুতেই জমিটি হাতছাড়া করতে চাইছিলেন না। অনেক অনুরোধে তিনি নাকি অসম্ভব এক প্রস্তাব দিয়েছিলেন - সম্পূর্ণ জমিটি ঢাকতে যতগুলি স্বর্ণমুদ্রা প্রয়োজন, তার বিনিময়েই তিনি জমিটি হস্তান্তর করতে পারেন। অনাথপিণ্ডিক নির্দ্বিধায় রাজি হয়ে গেলেন এবং গোশকটে কার্ষাপণ বা নিষ্ক (স্বর্ণমুদ্রা) বহন করে এনে জমিতে বিছোতে শুরু করলেন।
     
     
    অনাথপিণ্ডিকের এই আশ্চর্য সংকল্পে মুগ্ধ হয়ে শেষ অব্দি রাজকুমার জেত জমিটি দান করে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর শর্ত ছিল এই বিহারের নাম তাঁর নামেই রাখতে হবে। সেই কারণেই এই বিহারের নাম জেতবন বিহার। শিল্পীরা এই কাহিনীকে অমর করে রেখে গেছেন সাঁচী এবং ভারহুত স্তূপের প্রাচীরের গায়ে (ওপরের চিত্র)। জমিটি বিনামূল্যে পেয়ে গেলেও, জেতবন বিহারের সমস্ত নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় অনাথপিণ্ডিক আজীবন বহন করেছিলেন।  
    অর্হৎ সুভূতি – অনাথপিণ্ডিকের আত্মীয় – ভাইপো, মতান্তরে শালা।
    ভিক্ষু পুন্নমন্তালিপুত্ত – বিখ্যাত ব্রাহ্মণ পণ্ডিত।
    অর্হৎ দাসক – অনাথপিণ্ডিকের ক্রীতদাস।
    গৃহীশিষ্য রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রু – মগধের রাজা। 
    গৃহীশিষ্য রাজা প্রসেনজিৎ - কোশলের রাজা।
    গৃহীশিষ্য রাজা চণ্ডপ্রদ্যোত – উজ্জয়িনীর রাজা।
    গৃহীশিষ্য রাজা উদয়ন – বৎসদেশের রাজা।
    অর্হৎ অভয় -  রাজা বিম্বিসারের পুত্র।
    অহর্ৎ সুপ্রিয় – শূদ্র কুলে জন্ম।
    অর্হৎ বিমল কোণ্ড – রাজা বিম্বিসারের রক্ষিতা অম্বাপালীর পুত্র।
    অহর্ৎ ছন্ন – রাজা শুদ্ধোদনের ক্রীতদাস।
    অর্হৎ তিস্র – রাজা বিম্বিসারের মিত্র।
    ভিক্ষু বৎসগোত্র -  ধনী ব্রাহ্মণ পুত্র।
    অহর্ৎ যশ – বারাণসীর বণিক পুত্র।
    অর্হৎ পিণ্ডোল ভারদ্বাজ – কৌশাম্বীর রাজপুরোহিত।
    অর্হৎ সারিপুত্র – অহর্ৎ তিস্রর পুত্র। তিনি প্রায় দ্বিতীয় বুদ্ধের মতো সম্মানীয় ছিলেন।
    অহর্ৎ মৌদ্গলায়ন - অর্হৎ সারিপুত্রর আবাল্য বন্ধু। তিনিও সারিপুত্রের মতোই সম্মানীয় ছিলেন।
    অহর্ৎ ধনিয় – কুম্ভকার ছিলেন।
    অহর্ৎ উপালি – নাপিত – ত্রিপিটক গ্রন্থের অন্যতম সংকলক।
    অর্হৎ উরুবিল্ব কশ্যপ – বেদজ্ঞ প্রখ্যাত পণ্ডিত ব্রাহ্মণ। এঁর কথা আগেই বলেছি।
    অর্হৎ কৌণ্ডিল্য, বপ্র, ভদ্রিক, অশ্বজিৎ এবং মহানামা – এঁদের কথা আগেই বলেছি।
    অহর্ৎ মহাকাত্যায়ন – উজ্জয়িনীর রাজা চণ্ডপ্রদ্যোতের পুরোহিত।
    অর্হৎ আনন্দ -  গৌতমবুদ্ধের খুড়তুতো ভাই, ত্রিপিটক গ্রন্থের অন্যতম সংকলক।
    অহর্ৎ অনুরুদ্ধ – গৌতমবুদ্ধের খুড়তুতো ভাই।
    অহর্ৎ রাহুল – গৌতমবুদ্ধের পুত্র।

    গৌতমবুদ্ধের বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে জীবক কুমারভৃত্যও একটি উজ্জ্বল নাম। ভারতীয় চিকিৎসাচর্চায় তিনিই যে পথিকৃৎ সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। জীবকের মা ছিলেন রাজগৃহের বিখ্যাত বারবনিতা শাল্বতী বা শালবতী। শোনা যায় পরিত্যক্ত শিশু জীবককে আবর্জনার স্তূপ থেকে উদ্ধার করেছিলেন রাজা বিম্বিসারের পুত্র কুমার অভয়, তারপর রাজা বিম্বিসারই তাঁকে প্রতিপালন করেন। ছোটবেলা থেকেই  মেধাবী জীবক উদ্ভিদ ও ভেষজ চর্চায় অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি তক্ষশীলা[2] মহাবিদ্যালয়ে সাত বছর আয়ুর্বেদ এবং ভেষজশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন। তক্ষশিলায় তাঁর গুরু ছিলেন বিখ্যাত ঋষি আত্রেয় পুর্ণবসু।

    শোনা যায়, জীবকের পাঠ সমাপ্তির দিন গুরু আত্রেয় শিষ্যের পরীক্ষা নিতে বলেছিলেন, “বৎস এই মহাবিদ্যালয়ের পিছনে যে বনভূমি রয়েছে, সেখানে সারাদিন সন্ধান করে আমার জন্যে ওষধিগুণহীন অন্ততঃ তিনটি গাছ, তৃণ, গুল্ম বা উদ্ভিদ এনে দাও”। সারাদিন নিবিড় সন্ধানে নিরত জীবক এমন উদ্ভিদ একটিও যোগাড় করতে পারলেন না। সন্ধ্যায় বিষণ্ণ মুখে এসে দাঁড়ালেন গুরু আত্রেয়র সামনে এবং নিজের ব্যর্থতার কথা নিজমুখে স্বীকার করলেন। গুরু আত্রেয় উজ্জ্বল সহাস্য মুখে শিষ্যকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, “কোন না কোন ওষধিগুণ ছাড়া জগতে একটিও উদ্ভিদ নেই, বৎস। তোমার শিক্ষা সম্পূর্ণ ও সার্থক”।             

    তক্ষশিলার পাঠ শেষে তিনি রাজগৃহে ফিরে আসেন। শোনা যায় তিনি রাজা বিম্বিসারের দুরারোগ্য ব্যাধি সারিয়েছিলেন, উজ্জয়িনীর রাজা প্রদ্যোত এবং বেশ কয়েকবার ভগবান বুদ্ধেরও চিকিৎসা করেছিলেন।

    তিনি সরাসরি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা নিয়ে সংঘে যোগ দিয়েছিলেন, এমন তথ্য পাওয়া না গেলেও, গৌতমবুদ্ধ ও বৌদ্ধ সংঘের সঙ্গে তাঁর আজীবন ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। শোনা যায়, পিতৃহত্যার পর অজাতশত্রু যখন অনুতাপে দগ্ধ হচ্ছিলেন, এবং গৌতমবুদ্ধের সামনে যেতে ভয় করছিলেন, তখন জীবকের মধ্যস্থতায় তিনি বিরক্ত বুদ্ধদেবের ক্ষমা লাভ করেছিলেন।

    জীবকের এবং ভারতীয় আয়ুর্বেদ ও চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পরবর্তী পর্বে আলোচনা করব, তবে এখানে এটুকু বলে রাখি, গৌতমবুদ্ধের নির্দেশে এবং জীবকের প্রভাবেই বৌদ্ধ বিহারগুলিতে অর্হৎ এবং ভিক্ষুদের মধ্যে চিকিৎসাবিদ্যা চর্চার ব্যাপক প্রচলন হয়েছিল। যার ফলে পরবর্তীকালে, সাধারণ মানুষের শুধুমাত্র চৈতন্য বোধনের জন্যেই নয়, শারীরিক চিকিৎসার জন্যেও, বৌদ্ধ অর্হৎ ও ভিক্ষুরা দেশে-বিদেশে সর্বত্র সম্মানীয় এবং জনপ্রিয় হয়েছিলেন।            
           
    গৌতমবুদ্ধের বিখ্যাত মহিলা ভক্তের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। প্রথমদিকের আশ্রম এবং বিহারগুলিতে মহিলাদের থাকার উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় তিনি ভিক্ষু হতে ইচ্ছুক মহিলাদের অনুমতি দিতেন না। মহিলাদের গৃহীশিষ্যা হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হত। এরকমই কিছু নাম পাওয়া যায়, রাজগৃহের বিখ্যাত বারাঙ্গনা অম্বাপালী, সিরিমা এবং বারাণসীর অড্‌ঢকাশী। তাছাড়া আরও ছিলেন, কৌশাম্বীর মহারাণী শ্যামাবতীর ক্রীতদাসী খুজ্জুত্তরা। এছাড়াও (কোশলরাজার বোন) সুমনা, ভদ্রা, সুপ্রিয়া, ক্ষেমা, সুজাতা (উরুবিল্বের সেই বালিকা), মুত্তা এবং বড্ঢ মাতার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। বুদ্ধদেবের বিমাতা ও মাসি, কপিলাবস্তুর রাণি গৌতমী, তাঁর শিষ্যা হয়েছিলেন এবং প্রধানতঃ তাঁর উদ্যোগেই বৌদ্ধবিহারে ভিক্ষুণীদেরও থাকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। অতঃপর বিখ্যাত তিয়াত্তর জন ভিক্ষুণীর নাম পাওয়া যায়, “থেরীগাথা” নামের বৌদ্ধদের এক ধর্মগ্রন্থে। গ্রন্থটির সমস্ত শ্লোকই থেরী অর্থাৎ সন্ন্যাসিনীদের রচিত। “থের” শব্দের উৎপত্তি “স্থবির” থেকে, বয়স্ক প্রাজ্ঞ সন্ন্যাসীদের থের বলা হত, সন্ন্যাসিনীদের থেরী। পরবর্তী কালে বৌদ্ধ ধর্মের একটি শাখার নাম হয়ে উঠেছিল “থেরবাদ” অর্থাৎ প্রাচীনপন্থী মত। সে প্রসঙ্গ আসবে পরে।

    শেষ পর্যটনে গৌতমবুদ্ধ রাজগৃহ থেকে মল্লরাজ্যের কুশীনারায় গিয়েছিলেন। সেখানে এক কর্মকারের গৃহে নিমন্ত্রণ রক্ষা করার পরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন অহর্ৎ আনন্দ, তিনি মল্লরাজের সহায়তায় গৌতমবুদ্ধের অন্ত্যেষ্টি সৎকার করেছিলেন। গৌতমবুদ্ধের পুণ্য অস্থি ও ভস্ম ভাগ করে নিয়েছিলেন তখনকার অনেক রাজা এবং গণরাজ্যগুলি, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কুশীনারার মল্লরাজ, মগধ রাজ্যের অজাতশত্রু, বৈশালীর লিচ্ছবি, কপিলাবস্তুর শাক্য, কোলিয় রাজ্য এবং পিপ্পলি গণরাজ্যের মোরিয়রা। এঁরা সকলেই নিজ নিজ রাজধানীতে গৌতমবুদ্ধের অস্থি-অবশেষের ওপর স্তূপ নির্মাণ করিয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন।
     
    গৌতমবুদ্ধের মহানির্বার্ণের একবছর পর রাজগৃহে প্রথম ধর্ম সম্মেলন হয়েছিল, সেখানেই “ত্রিপিটক” গ্রন্থ সংকলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বোধিলাভের পর প্রায় চুয়াল্লিশ বছর ধরে গৌতমবুদ্ধ যত ধর্মকথা এবং উপদেশ দিয়েছিলেন, সেগুলি তিনটি প্রধান বিভাগে সংকলিত হয়েছিল - বিনয়, সূত্র এবং অভিধর্ম। এই ত্রিপিটক বৌদ্ধধর্মের প্রধানতম এবং প্রথম ধর্মগ্রন্থ। একই সঙ্গে সঙ্কলিত হয়েছিল, গৌতমবুদ্ধের নিজের মুখে বলা পূর্বজন্মের কাহিনীগুলি – যার নাম ছিল “জাতক”।  

    ৩.৪.২ প্রাক-মৌর্য ভারত
    কথিত আছে রাজা বিম্বিসারের দীর্ঘ আয়ুতে বিরক্ত হয়ে, যুবরাজ অজাতশত্রু পিতাকে হত্যা করে মোটামুটি ৪৯৩ বি.সি.ই-তে মগধের রাজা হয়েছিলেন। উচ্চাভিলাষী অজাতশত্রু রাজা হয়েই রাজধানী রাজগৃহকে আরও সুরক্ষিত করেছিলেন এবং গঙ্গার ধারে পাতলিগ্রামে একটি দুর্গ বানিয়েছিলেন। রাজা বিম্বিসার পূর্বে অঙ্গ জয় করেছিলেন, এখন অজাতশত্রু রাজা হয়ে উত্তর ও পশ্চিমদিকে মন দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কোশল, কাশী এবং বৃজি গণসঙ্ঘ জয় করে, গাঙ্গেয় উপত্যকায় পূর্ণ আধিপত্য স্থাপন করলেন। নদীপথের যাবতীয় বাণিজ্য এবং বিস্তীর্ণ উর্বর জমির কৃষিজ সম্পদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ মগধরাজ্যের শক্তি ও সমৃদ্ধি বাড়িয়ে তুলল। তাছাড়াও মগধের নিয়ন্ত্রণে ছিল লোহা এবং তামার আকরগুলি। সব মিলিয়ে সে সময় মগধ উত্তরভারতে সব থেকে শক্তিশালী রাজ্য হয়ে উঠেছিল। শোনা যায়, মোটামুটি ৪৬১ বি.সি.ই-তে রাজা অজাতশত্রুরও মৃত্যু হয় তাঁর পুত্রের হাতে। এবং তাঁর বংশের পরবর্তী পাঁচজন রাজাই নাকি পিতৃহন্তারক[3] এবং রাজ্য পরিচালনায় অদক্ষ ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রাজগৃহের অভিজাত নাগরিকেরা বিরক্ত হয়ে বিদ্রোহ করে এবং শেষ রাজাকে সিংহাসনচ্যুত করে, শিশুনাগ নামে এক রাজকর্মচারীকে সিংহাসনে বসায়। শিশুনাগের বংশ সম্ভবতঃ পঞ্চাশ বছরের বেশি রাজত্ব করতে পারেননি, তাঁকে সরিয়ে মগধের রাজা হয়েছিলেন মহাপদ্ম নন্দ। নন্দরা বর্ণে শূদ্র ছিলেন। অতএব ভারতের ইতিহাসে তাঁরাই ছিলেন প্রথম অক্ষত্রিয় রাজা।
     
    নন্দ রাজারা বিশাল মগধরাজ্যের সীমানা আরও বাড়িয়ে তুললেন তাঁদের শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী দিয়ে। উত্তরভারতের যতগুলি গণসঙ্ঘী রাজ্য ছিল, সবগুলিকেই পরাস্ত করে নিজের অধিকারে নিয়ে এসেছিলেন। অজাতশত্রু গঙ্গার ধারে পাতলিগ্রামে যে দুর্গ বানিয়েছিলেন, সেখানেই নন্দ রাজারা রাজধানী প্রতিষ্ঠা করলেন। সে শহরের নাম হল পাটলিপুত্র। নন্দরাজারা খুব বেশি দিন রাজত্ব করতে না পারলেও, ভারতে তাঁরাই প্রথম বিশাল এক সাম্রাজ্য পরিচালনার প্রশাসনিক ধারণা ও দক্ষতার সূচনা করতে পেরেছিলেন। সমস্ত সাম্রাজ্য জুড়ে কর ব্যবস্থা এবং কর আদায়ের নির্দিষ্ট প্রশাসনিক পদ্ধতির প্রচলন করেছিলেন। সুষ্ঠু কর আদায় নন্দবংশের বৈভবকে সে সময় প্রবাদে পরিণত করেছিল। সেই সম্পদ দিয়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। আলেকজাণ্ডার যখন ভারত জয়ে এসেছিলেন, সে সময় মগধের সেনাবাহিনীতে ছিল কুড়ি হাজার অশ্বারোহী, দুই লক্ষ পদাতিক, দু’হাজার রথ এবং তিন হাজার হাতি। এই বর্ণনা পাওয়া যায় আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে আসা গ্রীক ঐতিহাসিকদের লেখায়। শোনা যায় এই বিপুল সৈন্য বাহিনীর সংবাদ পেয়েই, দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকা ক্লান্ত গ্রীক সৈন্যদল ভারতবিজয়ের আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল। শুধু প্রতিরক্ষাই নয়, নন্দরাজারা সেচ ব্যবস্থার জন্যেও বহু ক্যানাল এবং জলাধার নির্মাণ করিয়েছিলেন। রাজ্যের সমস্ত ভূমি এবং ভূসম্পদ ও জলসম্পদের অধিকারী যে রাষ্ট্র এবং সেই যাবতীয় সম্পদই যে করযোগ্য ভারতবর্ষে সে ধারণারও প্রথম প্রবর্তন করেছিলেন নন্দরাজারাই।  

    ৩২১ বি.সি.ই-তে ধননন্দকে পরাস্ত করে নন্দ-রাজত্বের হঠাৎই সমাপ্তি ঘটালেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

    ৩.৪.৩  মৌর্য সাম্রাজ্য - চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য (রাজত্বকাল ৩২১-৩০০ বি.সি.ই)
    মৌর্যদের সঠিক বংশ পরিচয় বেশ অস্পষ্ট এবং বিতর্কিত। কেউ কেউ বলেন, তাঁরা ছিলেন আদতে ময়ূর-পোষমানানো জনগোষ্ঠী। ময়ুরকে চলতি ভাষায় মোর বলা হয়, সেখান থেকে এসেছে মৌর্য। সেক্ষেত্রে মৌর্যরা অনার্য এবং শূদ্র। অনেকে বলেন চন্দ্রগুপ্তের মায়ের নাম মুরা, তিনি নন্দবংশের শেষ রাজা ধননন্দের প্রাসাদে ক্রীতদাসী ছিলেন। মাতা মুরার সম্মানেই মাতৃভক্ত চন্দ্রগুপ্ত তাঁর বংশের নাম রেখেছিলেন মৌর্য। এই মত মেনে নিলেও মৌর্যরা ছিলেন অনার্য এবং শূদ্র। ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থে মৌর্যদের “পাষণ্ড” বলেই উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ তাঁরা ছিলেন প্রচলিত ব্রাহ্মণ্যধর্মের বিরোধী।
     
    কিন্তু বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র মতে, কয়েকশ’ বছর আগে থেকেই পিপ্পলিবনে ছোট একটি গণসঙ্ঘী রাজ্য ছিল, সে রাজ্যের এক গোষ্ঠীর নাম ছিল মোরিয়। এই গণরাজ্যের গোষ্ঠী প্রধানরাও, মহানির্বাণের পর বুদ্ধদেবের অস্থি নিয়ে, তাঁদের রাজ্যে স্তূপ নির্মাণ করিয়েছিলেন, সে কথা আগেই বলেছি। অজাতশত্রু রাজা হয়ে মগধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময়, যে গণরাজ্যগুলিকে অধিকার করেছিলেন, তার মধ্যে পিপ্পলি গণরাজ্যও নিশ্চয়ই ছিল। অতএব সে সময় মোরিয়রা রাজ্যচ্যুত হন। বৌদ্ধমতে মৌর্য নামকরণ সেই মোরিয়া থেকেই। এক্ষেত্রে তাঁরা ক্ষত্রিয় কিনা স্পষ্ট নয়, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যধর্ম বিরোধী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। কারণ আমরা আগেই দেখেছি আর্যাবর্তের গণরাজ্যগুলি সাধারণতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্ম এড়িয়ে চলত। তাছাড়া তাঁরা যে বৌদ্ধধর্মের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন, তার প্রমাণ, প্রবল শক্তিশালী রাজ্য মগধের পাশাপাশি, তাঁরাও ভগবান বুদ্ধের অস্থি-অবশেষের অংশ পেয়েছিলেন।

    মৌর্যরা ব্রাহ্মণ্য বিরোধী হলেও একজন ব্রাহ্মণ নন্দরাজাকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে মগধের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, এমনই শোনা যায়। সেই ব্রাহ্মণের নাম কৌটিল্য বা চাণক্য এবং তিনিই “অর্থশাস্ত্র” নামক জটিল এক রাষ্ট্রনীতির অনন্য গ্রন্থ প্রণেতা। শোনা যায় তিনি তক্ষশিলায় অধ্যয়ন করেছিলেন।

    আধুনিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দুটো প্রবাদই আংশিক সত্য হতে পারে কিন্তু সম্পূর্ণ সত্য নয়। প্রথমতঃ মগধের মতো শক্তিশালী এক বিশাল রাজ্য কৌটিল্য শুধুমাত্র কূটনীতি করে চন্দ্রগুপ্তকে পাইয়ে দিলেন এ কথা অবিশ্বাস্য। যদি তিনি তেমন কিছু করেও থাকেন, কেন করলেন? কারণ চন্দ্রগুপ্ত উচ্চাভিলাষী এবং রাজ্যকামী, হয়তো এক শূদ্রজাত কিংবা শূদ্র না হলেও মোরিয় গোষ্ঠীর ক্ষত্রিয় যুবক। যাদের ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী হিসেবে বহুদিনের দুর্নাম। এমন একজন মানুষকে কৌটিল্য এতটা সাহায্য করলেন কেন? শোনা যায় রাজা ধননন্দর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল। গভীর ষড়যন্ত্রে তিনি তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলেছিলেন?

    দ্বিতীয়তঃ অর্থশাস্ত্র যে একজনের লেখা কোন শাস্ত্র নয়, সে কথাও এখন প্রমাণিত এবং এটাও প্রমাণিত যে বহু বছরের প্রচলিত তত্ত্বসমূহ একত্র করে, “অর্থশাস্ত্র” সংকলন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বিষ্ণুগুপ্ত। অর্থশাস্ত্রের প্রথম অধ্যায়ে রাজবৃত্তির বিনয়াধিকারিকের প্রথম অধিকরণে বিষ্ণুগুপ্ত বলছেন, “ওঁ। শুক্র ও বৃহষ্পতিকে প্রণাম। ভূমি অধিগ্রহণ এবং তার সংস্কার সম্পর্কে পূর্ববর্তী আচার্যগণ যত অর্থশাস্ত্র রচনা করে গেছেন, তার প্রায় সবগুলিই এই গ্রন্থে সংকলিত হল”[4] । অতএব এমন অনুমান করা যায়, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধান মন্ত্রণাদাতা ছিলেন আচার্য কৌটিল্য, এবং তাঁদের মধ্যে নিবিড় নির্ভরতা ছিল। উচ্চাভিলাষী চন্দ্রগুপ্ত যেমন যেমন সাম্রাজ্যের পরিসীমা বাড়িয়েছেন, সেই অনুযায়ী জটিল থেকে জটিলতর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক প্রকরণে তাঁরা অভিজ্ঞ হয়েছেন। সেই অভিজ্ঞতার কথাই কৌটিল্য লিখে গিয়েছিলেন “অর্থশাস্ত্রে”। যার ফলে, অর্থশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ নীতিই কৌটিল্যরই রচনা, কারণ তার আগে এত বড়ো সাম্রাজ্য এবং এমন জটিল প্রশাসনের অভিজ্ঞতা কারও ছিল না। যদিও আগের অধ্যায়েই আমরা দেখেছি, ভারতবর্ষে ভূমি এবং ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন নন্দরাজারা।

    অতএব কৌটিল্য তাঁর লেখা শুধুমাত্র অর্থশাস্ত্র বইখানি হাতে নিয়ে, সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় চন্দ্রগুপ্তকে পুতুলের মত ব্যবহার করে, এত বড়ো সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন। কিংবা তিনি পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই সেই সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক যাবতীয় কাজ, চন্দ্রগুপ্তকে দিয়ে সুষ্ঠুভাবে করিয়ে নিয়েছিলেন। বিশেষজ্ঞদের বিবিধ বিতর্কের মধ্যে না জড়িয়েও এমন অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত অবশ্যই গ্রহণযোগ্য নয়।
     
    চন্দ্রগুপ্ত মগধের সিংহাসনে বসেছিলেন ৩২১ বি.সি.ই-তে। তার মাত্র ছ’বছর আগে ৩২৭ বি.সিই-তে  ম্যাসিডোনিয়ার (গ্রীসের ছোট একটি রাজ্য) দিগ্বিজয়ী রাজা আলেকজাণ্ডার পারস্যের শক্তিশালী আকিমিনিড সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়ে এগিয়ে আসছিলেন ভারত বিজয়ের লক্ষ্যে। আসার পথে তিনি জয় করলেন, আকিমিনিড সাম্রাজ্যেরই আরেকটি প্রদেশ গান্ধার এবং তার রাজধানী তক্ষশিলা। তারপর তিনি সিন্ধু উপত্যকার ছোটখাটো রাজ্যগুলি জয় করে পৌঁছে গেলেন পাঞ্জাবে (অধুনা পাকিস্তানে অবস্থিত)। সেখানে ঝিলাম নদীর ধারে রাজা পুরুর সঙ্গে আলেকজাণ্ডারের তুমুল যুদ্ধ হয়েছিল। গ্রীক ঐতিহাসিকরা এই যুদ্ধকে “হাইডেসপাস নদীর যুদ্ধ” (৩২৬ বি.সি.ই) বলে উল্লেখ করেছেন। সেই যুদ্ধে আলেকজাণ্ডারের জয় হয়েছিল ঠিকই, তবে ক্ষতিও হয়েছিল বিস্তর। রাজা পুরুর রাজ্য জয় করে, আরও পূর্বদিকে আলেকজাণ্ডারের সৈন্য বাহিনী এসে পৌঁছল বিপাশা নদীর তীরে। সেখানেই তারা শুনল নন্দরাজার সাম্রাজ্য এবং তাদের বিপুল সৈন্যবাহিনীর কথা। ছোট্ট এক রাজ্যের রাজা পুরুর সঙ্গে লড়াইতে তারা যে বেগ পেয়েছিল, সে কথা চিন্তা করে, আলেকজাণ্ডারের সৈন্যরা এবার বেঁকে বসল। অনেক দিগ্বিজয় হয়েছে এবার তারা দেশে ফিরতে চায়। অতএব ৩২৫ বি.সি.ই-র কোন এক সময়ে, ভারত জয়ের স্বপ্ন ছেড়ে আলেকজাণ্ডার বাধ্য হলেন দেশে ফিরে যেতে। শোনা যায় চন্দ্রগুপ্ত কোন এক সময়ে নাকি আলেকজাণ্ডারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং তাঁর সৈন্য শিবিরে বেশ কিছুদিন ছিলেন।

    হয়তো আলেকজাণ্ডারের রণকুশলতার শিক্ষা নিয়েই, চন্দ্রগুপ্ত নন্দসাম্রাজ্য জয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। নন্দ সাম্রাজ্যের রণসজ্জার তুলনায় চন্দ্রগুপ্তের ক্ষমতা নগণ্য বলেই, তিনি সরাসরি যুদ্ধের পথে হাঁটেননি। প্রথমে ছোট ছোট আক্রমণে নন্দসাম্রাজ্যের সীমানাগুলিকে তিনি ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন এবং ধীরে ধীরে তাকে দুর্বল করে তুলছিলেন। তাঁর এই কৌশলের পিছনেও একটি কাহিনী শোনা যায়। গরম ভাতের থালায় মাঝখানের ভাতের চূড়া গরম থাকে অনেক বেশি। কাজেই মাঝখান থেকে না খেয়ে, থালার ধার থেকে ভাত খেতে শুরু করা অনেক সুবিধেজনক। বালকপুত্রকে বলা কোন এক মহিলার এই উপদেশ নন্দসাম্রাজ্য জয় করার পথে চন্দ্রগুপ্ত মনে রেখেছিলেন। এরপর কোন একসময় কৌটিল্যের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয় এবং হয়তো তাঁর তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং ষড়যন্ত্রের সাহায্যে তিনি সহজেই মগধের সিংহাসন অধিকার করতে পেরেছিলেন।

    মগধের সিংহাসনে বসে প্রথমেই তিনি সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দিলেন। আলেকজাণ্ডার ও তাঁর সৈন্যদল দিগ্বিজয় করে দেশে ফিরে যাওয়ায়, উত্তর-পশ্চিম ভারতের পরাজিত রাজ্যগুলি তখনও বেশ দুর্বল ছিল।  অন্যদিকে তাঁর নিজের এবং নন্দরাজাদের সেনাবাহিনী মিলিত হয়ে, তাঁর রণশক্তি তখন প্রবল। অতএব উত্তর-পশ্চিমে সিন্ধু নদ পর্যন্ত রাজ্যগুলি জয় করতে তাঁকে বেগ পেতে হল না। সে সময় তিনি সিন্ধু নদ পার হয়ে আর এগোলেন না। কারণ সে পারে ছিল আলেকজাণ্ডারের রাজত্বের সীমানা এবং তার দায়িত্বে ছিলেন তাঁর গ্রীক সেনাপতি সেলুকস নিকেটর। উত্তর-পশ্চিমের পর, তিনি মধ্যভারত জয়ে মন দিলেন এবং নর্মদার তীর অব্দি সাম্রাজ্য বিস্তার করলেন। এরপর দীর্ঘ কয়েক বছর তিনি নতুন রাজ্য জয়ের থেকে, সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক কাজেই হয়তো বেশি মনোযোগ দিয়েছিলেন। তারপর তিনি আবার রাজ্য জয়ে বের হলেন ৩০৫ বি.সি.ই-তে, হানা দিলেন সেলুকাসের সীমানায়। ৩০৩ বি.সি.ই-র এক চুক্তিতে সেলুকীয় (Seleucid) সাম্রাজ্যের বেশ কিছু অঞ্চল - এখনকার বালুচিস্তান, আফগানিস্তান (কপিশা) এবং মাকরান – চন্দ্রগুপ্তের হাতে সমর্পণ করা হয়েছিল। তার পরিবর্তে সেলুকাস পেয়েছিলেন পাঁচশ হাতি, হেলেনিয় (Hellenistic) যুদ্ধবাহিনীতে তখনও হাতি ছিল এক আশ্চর্য রণসম্ভার। এ ছাড়াও তাঁদের মধ্যে একটি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। সেলুকাস তাঁর এক কন্যাকে মৌর্যবংশে সম্প্রদান করেছিলেন।

    অতএব পশ্চিমে সেলুকীয় সাম্রাজ্যের সীমানা থেকে পূর্বের গাঙ্গেয় উপত্যকার অধিকাংশ অঞ্চল নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত শুধু বিশাল এক সাম্রাজ্যই প্রতিষ্ঠা করলেন না, প্রতিষ্ঠা করলেন অভূতপূর্ব এক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। গান্ধার এবং তক্ষশিলা তাঁর আয়ত্ত্বে এসে যাওয়াতে সুদূর পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ এখন তাঁর হাতে এসে গেল। তার ওপর হেলেনীয় কন্যা এদেশের বধূ হয়ে যখন পাটলিপুত্রে এসে বসবাস করতে লাগলেন, প্রাচীন দুই সভ্যতা এবং সংস্কৃতির নিবিড় আদানপ্রদানও শুরু হয়ে গেল।

    চন্দ্রগুপ্তর বিশাল এই সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে এবং প্রদেশগুলি বিষয়ে (জেলা) বিভক্ত ছিল। এই প্রদেশগুলির মধ্যে প্রধান ছিল উত্তরাপথ (রাজধানী তক্ষশিলা), অবন্তী (রাজধানী উজ্জয়িনি), দাক্ষিণাত্য (রাজধানী সুবর্ণগিরি) এবং মগধ (রাজধানী পাটলিপুত্র)।
     
    মোটামুটি ৩০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি কোন এক সময়ে চন্দ্রগুপ্ত পুরোপুরি জৈনধর্মী হয়ে উঠেছিলেন এবং পুত্র বিন্দুসারের হাতে সাম্রাজ্যভার ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। এরপর তিনি বিখ্যাত জৈন আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে পাটলিপুত্র ছেড়ে কর্ণাটকের শ্রবণ বেলগোলায় চলে যান। সেখানেই কট্টর জৈনধর্মীয় প্রথা অনুযায়ী উপবাস করে দেহত্যাগ করেন।
     
    সম্রাট বিন্দুসার ২৯৭ বি.সি.ই-তে ক্ষমতায় এসে মৌর্য সাম্রাজ্যকে আরও দক্ষিণে কর্ণাটক পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পেরেছিলেন এবং আরও দক্ষিণে যুদ্ধ ছাড়াই মৈত্রী বন্ধনে সাম্রাজ্যের সীমানা বাড়াতে পেরেছিলেন। রাজা বিন্দুসার আজীবিক ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। ২৭২ বি.সি.ই-তে বিন্দুসার যখন মারা গেলেন, একমাত্র কলিঙ্গ এবং দক্ষিণভারতের শেষ প্রান্তটুকু ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের পুরোটাই ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে। কলিঙ্গ রাজ্য জয়ের দায়িত্বটুকু রইল সম্রাট অশোকের জন্যে। বিন্দুসার তাঁর পিতা চন্দ্রগুপ্তের মতোই বৈদেশিক সম্পর্ক অটুট রাখতে পেরেছিলেন। শোনা যায়, বিন্দুসার গ্রীক রাজা অ্যান্টিওকাসকে একটি চিঠি দিয়ে মূল্যের বিনিময়ে কিছু গ্রীক সুরা, আঞ্জির (figs) এবং একজন দার্শনিককে ভারতে পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। রাজা অ্যান্টিওকাস সুরা ও আঞ্জির পাঠিয়েছিলেন এবং চিঠির উত্তরে লিখেছিলেন গ্রীকরাজা পণ্য বিক্রয় করে থাকেন ঠিকই, কিন্তু দার্শনিক বিক্রয় করেন না।  
         
    চলবে...
    (২৮/০৬/২২ তারিখে আসবে তৃতীয় পর্বের পঞ্চম ভাগ।)

    চিত্র ঋণঃ '

    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১) Old path white clouds: Mr Thich Nhat Hanh
    ২) বুদ্ধচরিত – অশ্বঘোষঃ ভাষান্তর শ্রী সাধনকমল চৌধুরী
    ৩) বৌদ্ধ দর্শন – রাহুল সাংকৃত্যায়নঃ অনুবাদ শ্রীধর্মাধার মহাস্থবির
    ৪) গৌতম বুদ্ধ – ডঃ বিমলাচরণ লাহা
    ৫) Mauryan Empire – Mr Ranabir Chakravarti, Jawaharlal Nehru University, India –    The Encyclopedia of Empire, First Edition. Edited by Mr John M. MacKenzie.
    ৬) Candragupta Maurya and his importance for Indian history – Mr Johannes Bronkhorst, University of Lausanne, Switzerland– publication at: https://www.researchgate.net, uploaded on 15 November 2015.
    ৭) The Oxford History of India – Late Vincent Smith; Revised by Sir Mortimer Wheeler and Mr A. L. Basham (1981)
    ৮) The wonder that was India – A. L. Basham
    ৯) The Penguin History of Early India: Dr Romila Thapar 
     

    [1] কাঁক বা কঙ্ক -একধরনের বড়ো পাখি, সম্ভবতঃ হাড়গিলে [শব্দকোষ]।

    [2] তক্ষশিলা – গান্ধার রাজ্যের রাজধানী – এই সময় পারস্য অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্যের একটি অঙ্গ রাজ্য ছিল। এই তক্ষশিলা মহাবিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন ঋষি আত্রেয় পূর্ণবসু – অতএব ভারতীয় বিদ্দ্বজ্জনের সঙ্গে অ্যাকিমিনিড সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠতা ছিল – একথা নিঃসন্দেহে অনুমান করা যায়।    

    [3] চতুরাশ্রম ছিল ব্রাহ্মণ্য সামিজিক রীতি – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। তবে বাস্তবে খুব কম লোকই এই রীতি অনুসরণ করত। কোন রাজা দীর্ঘায়ু হলেই পারিবারিক ষড়যন্ত্র প্রবল হয়ে উঠত। সে কালের স্বচ্ছল মানুষরা অল্পবয়সেই, মোটামুটি ১৬-১৮ বছরেই সন্তানের পিতা হত। অতএব পিতা সত্তর-আশি বছর জীবিত থেকে সিংহাসন আগলে বসে থাকলে, সিংহাসনের মুখ্য দাবিদার জ্যেষ্ঠপুত্রের বয়স দাঁড়াত ৫২-৬২ বছর! যুবরাজ অথবা আঞ্চলিক প্রধান হয়ে, জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র কতদিন আর ধৈর্য ধরবে সিংহাসনের আশায়! শুরু হত অন্তঃপুরে অঘটন।         
    [4] “Óm. Salutation to Sukra and Brihaspati. This Arthasástra is made as a compendium of almost all the Arthasástras, which, in view of acquisition and maintenance of the earth, have been composed by ancient teachers”. - From Kautilya’s Arthashastra – Translated in English by Shrijukta R. Shamasastry. বাংলা অনুবাদ- লেখক।  

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২২ জুন ২০২২ | ১১০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ২৩ জুন ২০২২ ০০:১৬509279
  • কিশোর 
     
    অসামান্য লিখছেন । অসম্ভব ঝরঝরে ইতিহাস - স্কুলে পড়ার সময় যদি পেতাম, হায় ! 
    বই হয়ে বেরুলে মাথার পাশের টেবিলে রাখব ! 
     
    টাইমলাইন অনুযায়ী হাম্মুরাবির শিলালিপি এবং  টেন কমান্ডমেনটস বুদ্ধ দেবের পাঁচ আদেশের আগেই লিখিত । প্রথম চারটি মোজেসের আদেশের সঙ্গে একাত্মক আবার হাম্মুরাবির কয়েকটি নির্দেশ মোজেসের দশ আদেশের সঙ্গে মেলে। তা দিয়ে অবিশ্যি কিছুই প্রমাণ হয় না। সকলেই মানুষের মঙ্গল চেয়েছেন  ।
    নন্দ রাজ বংশের ট্যাক্স সিস্টেম একটি অসাধারণ চিন্তা - যেটি পরে অনেকে অনুসরণ করেছেন পি ডাবলু ডি বা জন উন্নয়ন প্রকল্পের পথ প্রদর্শক ছিলেন তাঁরা । 
     
    আপনার লেখা পড়ে  ইতিহাসের একটা আশ্চর্য পার্সপেকটিভ ( দৃষ্টিকোণ ?) পাচ্ছি । কেন যে এতদিন শুধু সন তারিখ মুখস্থ করেছিলাম 
  • Kishore Ghosal | ২৩ জুন ২০২২ ০৯:০০509292
  • অজস্র ধন্যবাদ স্যার, আপনার মন্তব্যে ভীষণ উৎসাহিত হচ্ছি।
     
    হামুরাবির শিলালিপি বিশ্বের প্রথম লিপি - সম্ভবতঃ কিউনিফর্ম বলা হত। নরম মাটিতে সরু কলম দিয়ে লেখা হত এবং লেখা হয়ে গেলে রোদে বা আগুনে সেঁকে স্থায়ী রূপ দেওয়া হত। 
     
    নন্দরাজাদের ভূমিনীতি প্রজা নিয়ন্ত্রণের অদ্ভূত আয়োজন। ভূমি বলতে কৃষি, বাস্তু, পতিত, অরণ্য সব জমিই রাষ্ট্রের অধীন। যার খুশি জঙ্গল জ্বালিয়ে কৃষিজমি বা বাস্তুজমি হাসিল করা বন্ধ হয়ে গেল। রাষ্ট্র বিবেচনা ও অনুমতি দিয়ে কর নির্ধারণ করলে, তবেই প্রজারা জমির উপসত্ত্ব ভোগ করতে পারত।
  • Madhuri Hazra | ২৩ জুন ২০২২ ১০:৪৪509297
  • অসম্ভব ভাল লাগছে। জীবনে প্রথম ইতিহাস পড়ে আনন্দ পাচ্ছি। সত্যিই নতুন কিছু শিখছি, মনে রাখছি, এমন কিছু জানছি যা খুবই মূল্যবান আমার কাছে। 
     
    আপনার উপস্থাপনা খুব মনকাড়া। লেখার গতি সাবলীল। আপনার জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত এবং বিবিধ। বৌদ্ধ ধর্ম সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। অনেক কিছুই শিখলাম। 
     
    বলা বাহুল্য পড়ে খুবই আনন্দ আর তৃপ্তি পাচ্ছি। 
     
    সাগ্রহে অপেক্ষা করছি পরের পর্বের জন্যে। পরিশেষে বলি, এত বৃহৎ সৃষ্টির মধ্যে বানান ভুল, ব্যাকরণ ভুল ইত্যাদি প্রায় চোখেই পড়ে নি। আপনার ধৈর্য্য এবং নিষ্ঠা সত্যিই প্রশংসনীয়। 
     
    নমস্কার জানবেন। ভাল থাকবেন ভাই। আপনার কলম চলতে থাক। 
  • Kishore Ghosal | ২৩ জুন ২০২২ ১২:৫৩509300
  • মাধুরী ম্যাডাম, 
     
    আপনার প্রশংসায় আমি অভিভূত, আমার প্রচেষ্টা সার্থক হয়ে উঠছে। 
     
    চেষ্টা করি নির্ভুল লেখার - তবে কিছু কিছু ভুল থেকেই যায় বারবার সংশোধনের পরেও! সে জন্যে আমি সর্বদাই ক্ষমাপ্রার্থী।  
  • হীরেন সিংহরায় | ২৪ জুন ২০২২ ১১:১১509325
  • কিশোর 
     
    পড়লাম.  অনেক কিছু জানা গেল , যেমন হাম্মুরাবির লিপির সূত্র।
     খরোষ্ঠী নাম কেন? তখনও কি শূন্যের আবির্ভাব হয় নি ? খরোষ্ঠী ডান থেকে বাঁ দিকে লেখা হত জেনে খুব অবাক হলাম।  সিন্ধু নদের পুব দিকে যে তার প্রচলন ছিল জানতাম না । ইউরোপে প্রাচীনতম লিখিত যে শিলা পাওয়া গেছে সেটি গ্রীকে,  বয়েস ১৪০০ বি সি  । 
  • Kishore Ghosal | ২৪ জুন ২০২২ ১১:৫৫509328
  • স্যার, 
    খরোষ্ঠী লিপি নিয়ে পরের অধ্যায়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা আসবে। তবে সিন্ধুর পূর্বদিকে খরোষ্ঠীর প্রচলন ছিল কম, বহুল প্রচলন ছিল পশ্চিমদিকে, আজকের পশ্চিম পাকিস্তান, আফগানিস্তান অঞ্চলে।  '০' আবিষ্কার - খ্রীষ্টাব্দ দ্বিতীয় শতাব্দীতে, সে আলোচনাও আসবে - চতুর্থ পর্বে। 
  • Sara Man | ২৪ জুন ২০২২ ১৭:০৫509342
  • আমি ঐ বেণুবন আর জেতবনেই ঘুরে বেড়াচ্ছি। 
  • Kishore Ghosal | ২৫ জুন ২০২২ ২০:৩২509395
  • আমরা সবাই পাটলিপুত্র পৌঁছে গিয়েছি, ম্যাম। আপনি বেণু বন আর  জেতবনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেন?  
  • হীরেন সিংহরায় | ২৫ জুন ২০২২ ২০:৩৭509396
  • কিশোর 
     
    যে বন্ধনে আমাদের বেঁধেছেন! কোথায় কোন যুগে কার আখডায় বা বনে আছি বুঝবার উপায় নেই ! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন