এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম – পঞ্চম পর্ব  - পঞ্চম ভাগ 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১০৭৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ৫.৫.১ সমুদ্র মন্থন
    ভগবান শিবের এই দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করার রুদ্র রূপই একমাত্র রূপ নয়। তাঁর অন্য আরেকটি রূপ ভীষণ সহজ, সরল, অনাড়ম্বর এবং উদাসীন তপস্বীর মঙ্গলময় রূপ। অমৃত লাভের জন্যে দেবতা ও অসুররা সম্মিলিত হয়ে, সমুদ্রমন্থন শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই সমুদ্রের থেকে অতি উৎকট হলাহল উঠে এল। সেই হলাহলের তীব্র তেজে দেবতা, অসুর এবং লোকপালেরা সকলেই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁদের রক্ষার জন্যে সকলেই দেবাদিদেব মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন। মহেশ্বর তখন কৈলাসে দেবীর সঙ্গে তপস্যা করছিলেন। দেবতাদের প্রার্থনা শুনে তিনি পত্নী ভবানীকে বললেন, “কী দুশ্চিন্তার বিষয়, সমুদ্র মন্থনে উদ্ভূত কালকূট প্রজাদের ঘোর দুঃখের কারণ হয়ে উঠেছে। প্রজাগণ নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এদের অভয় দেওয়াই আমার বিধেয়, যেহেতু যিনি সমর্থ, দীনজনকে রক্ষা করাই তাঁর একান্ত কর্তব্য। অতএব এই বিষ আমিই পান করব”। দেবী ভবানী পতি মহেশ্বরের সাধ্যের কথা জানতেন, তাই আপত্তি করলেন না। তখন দেবাদিদেব সমস্ত হলাহল পান করলেন এবং বিষের তীব্র তেজে তাঁর কণ্ঠ নীল হয়ে গেল। যদিও সেই বিষ তাঁর আর কোনও ক্ষতি করতে পারল না। সেই থেকেই তাঁর আরেক নাম হল নীলকণ্ঠ। পান করার সময়, তাঁর আঙুলের ফাঁক দিয়ে কিছু বিষ মাটিতে পড়েছিল, সেই ছিটেফোঁটা বিষ পান করেই, সাপ, বৃশ্চিক, শৃগাল, কুকুর এবং কিছু লতা-গুল্ম বিষধর হয়ে উঠেছিল।

    এরপর সমুদ্রমন্থন থেকে একে একে নানান ঐশ্বর্যের উদ্ভব হতে লাগল। যেমন, সুরভি নামের কামধেনু, ব্রহ্মবাদী ঋষিরা তাঁকে গ্রহণ করে তাঁদের গোয়ালে বেঁধে ফেললেন। শ্বেতবর্ণ এক ঘোড়া উচ্চৈঃশ্রবা, দেবরাজ ইন্দ্র গ্রহণ করে স্বর্গের ঘোড়াশালে পাঠাবার ব্যবস্থা করলেন। ঐরাবত নামের হাতি, সঙ্গে আটটি হস্তিনী- কেউ গ্রহণ করলেন কিনা, মহাভারত থেকে জানা যায় না। কিন্তু অন্য পুরাণ মতে ঐরাবত দেবরাজ ইন্দ্রই কুক্ষিগত করে নিজের পিলখানায় বেঁধে ফেলেছিলেন। কৌস্তুভ নামের পদ্মরাগ রত্ন, ভগবান বিষ্ণু গ্রহণ করলেন। পারিজাত বৃক্ষ, ইন্দ্র গ্রহণ করে স্বর্গের বাগানে রোপণ করলেন। সোনার অলংকারে ভূষিতা অপ্সরাগণ, তাঁদেরও ইন্দ্র স্বর্গে নিয়ে গেলেন। এরপর আবির্ভূতা হলেন লক্ষ্মীদেবী, তিনি নিজেই ভগবান বিষ্ণুকে আশ্রয় করলেন। এরপর সুরার দেবী বারুণী আবির্ভূতা হলেন, ভগবান বিষ্ণুর অনুমতি নিয়ে অসুররা তাঁকে গ্রহণ করলেন। এরপরেই অমৃতপূর্ণ কলস হাতে আবির্ভূত হলেন, আয়ুর্বেদ পারদর্শী ধন্বন্তরি। অতএব সমুদ্রমন্থনে লব্ধ এত ঐশ্বর্যের মধ্যে ভগবান শিবের ভাগে জুটেছিল তীব্র বিষ, কারণ অমৃতের ভাগ তো, পৌরাণিক মতে, দেবতাদের সকলেই পেয়েছিলেন। এমন উদাসীনতা আর কোন হিন্দু দেবতার মধ্যে আছে বলে আমার মনে হয় না।  

    ৫.৫.২ শিবের পূজা
    মহাভারতে শিবের রূপ নিয়ে বেশ কয়েকটি উল্লেখ আছে। ব্যাসদেব যুধিষ্ঠিরকে, দেবাদিদেব শিবের বর্ণনায় বলেছেন, “ত্রিপুরারি মহাদেব - বৃষ তাঁর বাহন, তিনি নীলকণ্ঠ, শূল ও পিনাকধারী এবং কৃত্তিবাস” (সভা/৪৫)। মহারাজ সগর পুত্রকামনায় কৈলাস পর্বতে গিয়ে তপসা করেছিলেন এবং সেখানে ভবানীপতি শূলপাণীর থেকে পুত্রলাভের বর লাভ করেছিলেন (বন/১০৬)। মহাদেবের থেকে পাশুপত অস্ত্র লাভের জন্যে অর্জুন হিমাচলের দুর্গম এক পাহাড়ে দীর্ঘ তপস্যা করেছিলেন। অর্জুনের তপস্যায় সন্তুষ্ট মহাদেব কিরাতের বেশে অর্জুনের সঙ্গে প্রথমে অস্ত্রযুদ্ধ পরে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হন। সে যুদ্ধে যদিও অর্জুনের পরাজয় হয়েছিল, কিন্তু তাঁর পরাক্রমে মহাদেব সন্তুষ্ট হয়ে, নিজের পরিচয় জানালেন এবং পাশুপত অস্ত্র দান করলেন। তারপর এই অস্ত্রের প্রয়োগ ও নিরোধের বিধি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ অর্জুন মহাদেবের স্তবে বলেছিলেন, “হে মহাদেব, হে নীলকণ্ঠ, হে জটাধর, হে ত্র্যম্বক (ত্রিলোচন), হে বিষ্ণুরূপ শিব, হে শিবরূপ বিষ্ণো, হে শূলপাণে, হে পিনাকধারিণ, হে মার্জ্জালীয়[1], আপনাকে প্রণাম” (বন/১৩৯)। মহাভারতে ব্যাসদেব অর্জুনের কাছে মহাদেবের মহিমা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, “তিনি রুদ্র, নীলকণ্ঠ, করাল, পিঙ্গলাক্ষ, কপর্দ্দী (জটাধারী), উগ্র। তিনি দিক্‌পতি, পর্জন্যপতি, ভূতপতি, বৃক্ষপতি, গোপতি, বিশ্বপতি। তিনি ধর্মাত্মা, মহেশ্বর, মহোদর, দ্বীপীচর্মবাসা (বাঘছাল বসন), ত্রিশূলপাণি, পিনাকী, খড়্গ-চর্মধারী। তিনি ত্রিপুরঘ্ন, ভগনেত্রঘ্ন, বনষ্পতির পতি, নরগণের পতি, মাতৃগণের পতি, গণপতি, গোপতি, যজ্ঞপতি, দেবপতি। তাঁকে বিনীত নমস্কার কর। তাঁর অনেক পার্ষদ আছেন, তাঁরা বামন, জটিল (জটাধারী), মুণ্ডী (নরমুণ্ডধারী), হ্রস্বগ্রীব, মহোদর, মহাকায় প্রভৃতি বিকৃত বেশধারী, বিকৃত মুখ, বিকৃত পা প্রাণী” (দ্রোণ/ ২০৩)।
    মহাভারতের প্রধান চরিত্রদের অনেকেই শিবভক্ত এবং মহাদেব শঙ্করের আরাধনা করতেন, যেমন দ্রৌপদী, অর্জুন, জরাসন্ধ প্রমুখ। জরাসন্ধ যখন নরবলি দিয়ে রুদ্রযজ্ঞের আয়োজন করছিলেন, সেই সময়েই কৃষ্ণের নির্দেশে ভীম তাঁকে হত্যা করেন। কৌরব প্রাসাদের দেবমন্দিরে মহাদেবের উপাসনা কে করবেন, সে নিয়ে রাণি গান্ধারী ও রাণি কুন্তীর মধ্যে নাকি বিবাদ হয়েছিল। রাজা সগর, জয়দ্রথ, অম্বা, দ্রুপদরাজা, সোমদত্ত, অশ্বত্থামা এবং স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণও শাল্ব রাজার রাজধানী সৌভনগর ধ্বংস করতে যাওয়ার আগে শিবের উপাসনা করেছিলেন। 

    ৫.৫.৩ শিবমূর্তি
    শিবের বহু মূর্তিপূজার প্রচলন থাকলেও, সব থেকে প্রাচীন এবং আজও সব থেকে পূজিত হয়, তাঁর প্রতীক “লিঙ্গ”। যতদূর প্রমাণ পাওয়া যায় এই লিঙ্গপূজা, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল। এই লিঙ্গের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে সিন্ধুসভ্যতার শহরগুলির প্রত্নখননে। লিঙ্গ প্রজননের প্রতীক। প্রচুর শস্য, সন্তান, পশু এবং সমৃদ্ধির আশায় ভারতীয় সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই লিঙ্গ পূজার বহুল প্রচলন। এবং প্রকৃতপক্ষে প্রাচীনকাল থেকে লিঙ্গপূজার মতো সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তা হিন্দুধর্মের আর কোন দেবতার ভাগ্যে জোটেনি।

    বিবিধ লিঙ্গ এবং তার মহিমার কথা সবিস্তারে জানা যায়, “তপোভূমি নর্মদা” গ্রন্থে,
    যেমন – “সাধারণতঃ আমরা শিবলিঙ্গ দেখলেই তাঁকে বাণলিঙ্গ আখ্যা দিই। কিন্তু বাণলিঙ্গের অনেক প্রকারভেদ আছে। যেমন, রৌদ্রলিঙ্গ, শিবনাভিলিঙ্গ, দেবলিঙ্গ, আর্ষলিঙ্গ, আগ্নেয়লিঙ্গ, নৈঋতলিঙ্গ, বারুণলিঙ্গ, বায়ুলিঙ্গ, কুবেরলিঙ্গ, বৈষ্ণব লিঙ্গ, ইত্যাদি। এছাড়া যে কোন শিবলিঙ্গের মধ্যে জ্যোতির প্রকাশ থাকলে তাকে জ্যোতির্লিঙ্গ বলা হয়”। (প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৮২)।

    এই বাণলিঙ্গের সৃষ্টি সম্পর্কে যাজ্ঞবল্ক্য-সংহিতায়, স্বয়ং মহেশ্বর দেবী পার্বতীকে বলছেন, “বাণাসুরের কঠোর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে বর দিয়েছিলাম যে (ধাবড়ি কুণ্ডে) পর্বত ও নর্মদার জলস্রোতে বিঘূর্ণন ও বিঘর্ষণে আমি লিঙ্গরূপে সতত নর্মদার জলে বিরাজমান থাকব। শত সহস্র লিঙ্গের মধ্যে যেগুলির আকৃতি পাকা জাম বা হংস ডিম্বের মতো হবে, বর্ণ হবে পাকা জামের মতো কিংবা মধুবর্ণ, শ্বেত, নীল ও মরকতের মত দ্যুতিসম্পন্ন সেইগুলিকেই বাণলিঙ্গ বলে জানবে”। পুরাণের কাহিনী থেকে জানা যায়, নর্মদার তীরেই ছিল বলিরাজার পুত্র বাণাসুরের সাম্রাজ্য। সাতপুরা পর্বতের শিখরদেশে ছিল তাঁর রাজধানী”। (প্রথম খণ্ড, পৃঃ ৯১)।   

    পরবর্তী কালে এই লিঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল যোনি, যাকে গৌরীপাট বা গৌরীপট্ট বলে। উদ্দেশ্য একই ভগবান শিব ও ভগবতী গৌরীর ঐশী মিলনে ভক্তদের গোলা ভরে উঠুক শস্যে, ঘরের উঠোনে খেলে বেড়াক সুস্থ সন্তানেরা। গোয়ালে বেড়ে উঠুক সবৎসা গাভী। প্রজনন মানেই সুখ, সম্পদ ও সমৃদ্ধি। ভগবান শিবের মন্দিরের মধ্যে সব থেকে পবিত্র মনে করা হয় দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির। আজও হিন্দুদের মধ্যে এই দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের তীর্থদর্শন খুবই পুণ্যকর্ম বলে মনে করা হয়। এই বারোটি মন্দিরের অবস্থান, সোমনাথ (গুজরাট), মল্লিকার্জুন (অন্ধ্র), মহাকালেশ্বর (উজ্জয়নী), ওঙ্কারেশ্বর (মধ্যপ্রদেশ), কেদারনাথ (উত্তরাখণ্ড), ত্র্যম্বকেশ্বর (মহারাষ্ট্র), রামনাথস্বামী (তামিলনাড়ু), কাশী বিশ্বনাথ (উত্তরপ্রদেশ), ইলোরার ঘুস্মেশ্বর (মহারাষ্ট্র), বৈদ্যনাথ (ঝাড়খণ্ড), দ্বারকার নাগেশ্বর (গুজরাট), ভীমশংকর (মহারাষ্ট্র)।

    দক্ষিণ ভারতে শিবের নটরাজ মূর্তি পূজার বহুল প্রচলন আছে। দক্ষিণ ভারতীয় শিবভক্তদের বিশ্বাস, মহাদেবের হিমালয়ে কৈলাস পর্বতের আবাস ছাড়াও দক্ষিণ ভারতেও তাঁর আবাস আছে। সেটি হল চিদম্বরম মন্দির বা তিল্লই মন্দির – পুদিচ্চেরি থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দক্ষিণে, সমুদ্র উপকূলের কাছে। চিদম্বরম (চিৎ+অম্বরম) শব্দের অর্থ মনের আকাশ বা চেতনার আকাশ, দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলির মধ্যে স্থাপত্য সৌন্দর্যে এই মন্দির অন্যতম প্রধান। এখানে মহাদেবের নটরাজ মূর্তি পূজিত হয়। এই মন্দিরের দেওয়ালে নটরাজের যে ১০৮টি নৃত্যভঙ্গি খোদিত আছে, সেগুলির বর্ণনা ভরতমুনির নাট্যশাস্ত্রে পাওয়া যায়। এই ভঙ্গীগুলি থেকেই বিখ্যাত ভারতনাট্যম নৃত্যের সৃষ্টি।  

    প্রাচীন অনার্য ভারতীয়দের পূজিত আরেকটি দেবমূর্তির নিদর্শন পাওয়া গেছে, সিন্ধুসভ্যতার প্রত্নখননে। শিং-ওয়ালা মুকুট মাথায় এক দেবমূর্তি, যাঁর আশেপাশে বেশ কয়েকটি সজীব প্রাণীর মোটিফ। অনুমান করা হয় ইনি ভগবান শিবের আদিম সংস্করণ, পশুপতিদেব। একটু অন্যরকম পশুপতির মূর্তি পাওয়া গেছে প্রাচীন দক্ষিণ ভারতেও। সে মূর্তি চতুর্ভুজ, একহাতে বরাভয় বা আশীর্বাদ, অন্য হাত মুক্ত যেন বরদানে উদ্যত, তৃতীয় হাতে একটি কুঠার আর চতুর্থ হাত থেকে লাফিয়ে উঠছে ছোট্ট একটি হরিণশাবক।

    ৫.৫.৪ শিবের অসুর বা দৈত্য নিধন
    বিষ্ণুর মতো তাঁরও বেশ কিছু অবতারের কথা শোনা যায়, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক, সেগুলির জনপ্রিয়তা নেই। বিষ্ণু এবং কৃষ্ণ যেমন দলে দলে অসুর দলন করেছেন, মহাদেব সে তুলনায় বেশ কম। যে কয়েকজন বিখ্যাত অসুরকে তিনি বধ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রধান হলেন ত্রিপুরাসুর।

    ত্রিপুরাসুর - মহাভারতে ঋষি বেদব্যাস অর্জুনকে ত্রিপুরাসুর-সংহার-সংবাদ বর্ণনা করেছেন। প্রাচীনকালে[2] অসুরদের তিনটি পুর বা দুর্গ ছিল, এই তিনটি পুর যথাক্রমে সোনা, রূপো ও লোহা দিয়ে নির্মিত হয়েছিল। স্বর্ণময় পুরের অধিকারী ছিল কমলাক্ষ, রৌপ্যময়ের তারকাক্ষ এবং লৌহময়ের বিদ্যুন্মালী। দেবরাজ ইন্দ্র এই তিনটি পুরের বিনাশ না করতে পেরে মহেশ্বরের শরণাপন্ন হলেন এবং বললেন “ব্রহ্মার বরে ওই তিন অসুর সবার উপরে অত্যাচার করছে, আপনি ছাড়া কেউ ওদের বিনাশ করতে পারবে না। অতএব আপনিই ওদের বিনাশ করুন”। ভগবান ভূতভাবন, তিনটি পুরকে ঘিরে দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহ নিমার্ণ করে সহস্র বছর ধরে অবরোধ করে রইলেন। তারপর তিনটি পর্বযুক্ত শল্যের আঘাতে তিনটি পুর দগ্ধ করলেন।

    দৈত্য অন্ধক - এই অন্ধকের জন্ম কাহিনী খুবই অদ্ভূত। একবার কৈলাসে মহেশ্বর যখন তপস্যায় মগ্ন, পত্নী দেবী পার্বতী খেলাচ্ছলে পিছন থেকে দুই হাতে তাঁর চোখ বন্ধ করে দেন। এর ফলে বিশ্বচরাচর অন্ধকার হয়ে যায় এবং মহেশ্বর ও পার্বতীর স্বেদ থেকে এক অন্ধ শিশুর জন্ম হয়। দেবীপার্বতী এই অদ্ভূত ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠায়, মহেশ্বর তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যেহেতু এই পুত্র তাঁদের অঙ্গস্পর্শ থেকেই জাত, অতএব এই পুত্র তাঁদেরই। এরপর নিঃসন্তান হিরণ্যাক্ষ পুত্র কামনায় মহেশ্বরের তপস্যা করলে, মহাদেব তাঁর হাতে অন্ধককে তুলে দেন। ভগবান বিষ্ণুর হাতে হিরণ্যাক্ষের মৃত্যুর পর, অন্ধক রাজা হলেন, কিন্তু তাঁর গোষ্ঠীর দৈত্যরা তাঁকে মেনে নিল না, কারণ তিনি দৈত্যপুত্র নন, দেবপুত্র এবং অন্ধ। তখন অন্ধক ঘোর তপস্যা করে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করলেন এবং ভগবান ব্রহ্মার বরে তাঁর অন্ধত্ব দূর হল এবং একমাত্র মহাদেব ছাড়া তিনি সকলের অবধ্য হয়ে গেলেন। এরপর বিপুল পরাক্রম অর্জন করে, তিনি স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে দেবরাজ ইন্দ্র ও দেবতাদের উপর খুবই অত্যাচার শুরু করেছিলেন। যথারীতি অন্ধকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হওয়াতে, তিনি মহাদেবকে এর প্রতিকারের অনুরোধ করলেন। মহাদেব অনায়াসেই অন্ধকের “কোটি-কোটি (!)” অসুর-সৈন্যদের বিনাশ করে, অন্ধককে তাঁর ত্রিশূলে গেঁথে ফেললেন। অন্ধকের পতনে ত্রিলোকের দেবতা, মুনি-ঋষি, নর আনন্দে মহাদেবের জয়ধ্বনি করতে লাগল। এদিকে মহাদেবের শূলে বিদ্ধ অন্ধকের মনে তখন সাত্ত্বিক ভাবের উদয় হল, তিনি বহু স্তব ও স্তুতিতে মহাদেবকে সন্তুষ্ট করলেন। মহাদেব তাঁকে শূল থেকে নামিয়ে মুক্তি দিলেন এবং “প্রমথাধিপত্য[3]” দান করলেন। সেই থেকে অন্ধক গাণপত্যে প্রতিষ্ঠিত হলেন, এবং ইন্দ্রাদি দেবতারা তাঁকে প্রণাম করলেন। (লিঙ্গপুরাণ/৯৩)

    জলন্ধর – পুরাকালে জলন্ধর এক প্রবল পরাক্রমী অসুর ছিলেন। সেই অসুর দেব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস, পন্নগ এমনকি স্বয়ং ব্রহ্মাকেও পরাজিত করেছিলেন। এরপর তিনি বিশ্বহর বিষ্ণুকে আক্রমণ করে, অবিরত যুদ্ধের পর বিষ্ণুকেও পরাজিত করলেন। বিষ্ণুকে পরাজিত করে তিনি ভগবান পিনাকীকে জয় করার ইচ্ছা নিয়ে মহাদেবের কাছে গিয়ে বললেন, “হে দেবদেব, আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করার ইচ্ছাতেই এখানে এসেছি”। অসুরের কথা শুনে ভগবান মহেশ্বর সমুদ্রের মধ্যে পায়ের আঙুল ডুবিয়ে ভীষণ সুদর্শন চক্র উৎপন্ন করলেন। কিন্তু পাছে এই চক্রে ত্রিজগৎ ও দেবতারা নিহত হয় ভেবে, তিনি সমুদ্রের জলেই চক্রটি রেখে দিলেন। এখন অসুরের কথায় হাসতে হাসতে বললেন, “ওহে অসুরেন্দ্র জলন্ধর, তুমি যদি সমুদ্র থেকে ওই চক্র তুলে আনতে পারো, তবেই আমি তোমার সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হব, নচেৎ হব না”। ভগবান মহাদেবের কথায় জলন্ধর রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে বললেন, “হে শঙ্কর, গরুড় যেমন নির্বিষ ডুণ্ডুভ (ঢোঁড়া) সাপকে অবলীলায় বিনাশ করে, সেভাবে আজ আমিও তোমাকে, নন্দীকে এবং তোমার সব পারিষদদের সংহার করব।  আমি ভগবান বিষ্ণু, ইন্দ্র, অগ্নি, যম, কুবের, বায়ু, বরুণ সকল দেবতাকেই পরাজিত করেছি। স্বর্গে-মর্তে যুদ্ধ করার মতো কোন প্রতিপক্ষ না থাকায় একবার আমার হাত সুড়সুড় করছিল বলে, পাহাড়ের গায়ে হাত ঘষেছিলাম। তাতে মন্দর, শ্রীমান, নীল, সুশোভন সুমেরু পাহাড় পড়ে গিয়েছিল। মজা দেখার জন্যে আমি হিমালয়ে একবার গঙ্গার গতিরোধ করে দিয়েছিলাম। আমার পত্নীর ভৃত্যেরা পর্যন্ত দেবতাদের বজ্র আটকে দিয়েছে। আমি গরুড় ও বিষ্ণুকে একসঙ্গে নাগপাশে বদ্ধ রেখেছিলাম। ইন্দ্রের পত্নী শচী এবং উর্বশী সহ সকল অপ্সরাকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছিলাম। ইন্দ্র আমার কাছে এসে অনেক অনুনয়-বিনয় করাতে, শচীকে ছেড়ে দিয়েছি। এ হেন মহাবীর জলন্ধরকে তুমি চেন না?”

    জলন্ধরের এই রকম আস্ফালন শুনে মহাদেব বেশ বিরক্ত হলেন। তাঁর তৃতীয় নয়নের প্রান্ত থেকে অগ্নিকণা বের হয়ে অসুরের রথ, অশ্ব, হাতি এবং অজস্র দৈত্য দগ্ধ হয়ে মারা গেল। জলন্ধর তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে উন্মত্ত ক্রোধে সমুদ্র থেকে সেই চক্র তুলতে প্রবৃত্ত হল। অতি কষ্টে সেই চক্র সে যেমনি কাঁধে তুলল, তখনি তার দেহ দু’টুকরো হয়ে, কাটা গাছের মতো, আছড়ে পড়ল মাটিতে। জলন্ধর নিহত হওয়াতে ত্রিজগতের দেব, গন্ধর্ব, দানব এবং নর - সকলেই আনন্দে “সাধু সাধু” বলতে লাগল। এই জলন্ধর-বিমর্দন উপাখ্যান যিনি পাঠ করবেন বা শুনবেন বা শোনাবেন, তিনি গাণপত্য লাভ করে অপার আনন্দ ভোগ করতে পারবেন। (লিঙ্গপুরাণ/ ৯৭)

    ৫.৫.৪.১ তারকাসুর বধ ও শিব-পার্বতী সংবাদ
    দক্ষের যজ্ঞে সতীদেবীর দেহত্যাগের পর, মহাদেব সুদীর্ঘ তপস্যায় মগ্ন রয়েছেন, পুনর্বিবাহের কথা তাঁর মনেও আসেনি। অন্য দিকে সতীদেবী মহাদেবকেই আবার পতিরূপে লাভ করতে নিজের ইচ্ছেয় জন্ম নিলেন, হিমালয়-পত্নী মেনকা দেবীর গর্ভে। এই জন্মে তাঁর নাম হল হিমালয়-দুহিতা পার্বতী। দেবী পার্বতীর যখন বারো বছর বয়স হল, তিনি তপস্যায় প্রবৃত্তা হলেন।

    এদিকে দুর্দান্ত অসুরদের প্রথা অনুযায়ী প্রাচীনকালে তারকাসুরও দেবতাদের পরাজিত করে তাঁদের ওপর ভীষণ অত্যাচার করছেন। কিন্তু কোন দেবতাই তাঁর পরাক্রম সহ্য করতে পারছিলেন না, এমনকি ভগবান বিষ্ণুও নাকি তাঁর সঙ্গে “কুড়ি হাজার বছর” ধরে, যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছেন। দেবাদিদেব কঠোর তপস্যায় মগ্ন, তাঁর কাছে যাওয়া যাচ্ছে না। উদ্বিগ্ন দেবতারা তারকাসুরের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় জানতে ভগবান ব্রহ্মার কাছে গেলেন। ভগবান ব্রহ্মা সব শুনে বললেন, “দেবতাদের এই দুর্গতির কথা আমি সবই জানি। কিন্তু তাও কেন নিশ্চিন্তে আছি তোমাদের বলি। সতীদেবী এই জন্মে গিরিরাজ হিমালয়ের কন্যা হয়ে জন্ম নিয়েছেন। তোমরা সকলে হিমালয় কন্যা পার্বতীদেবীর সঙ্গে রুদ্র মহাদেবের বিবাহে সচেষ্ট হও। তাঁদের মিলনে বীর্যবান এক পুত্রের জন্ম হবে, তাঁর নাম কার্তিকেয়। তিনি ষড়ানন (ছটি মুখ) এবং দ্বাদশ বাহু নিয়ে মহা শক্তিধর বীর হবেন। একমাত্র তাঁর হাতেই তারকাসুরের সংহার সম্ভব। তিনিই দেবতাদের সেনাপতি হয়ে দেবসেনাপতি নাম গ্রহণ করবেন। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য নাম হবে স্কন্দ, শাল্য, বিশাল্য, নৈগমেয় ইত্যদি”।

    দেবতারা খুশি হয়ে প্রথমেই সুমেরু পর্বতের শিখরে কামদেবতার উদ্যানে গেলেন। সেখানে কামনার দেবতা কন্দর্প ও তাঁর পত্নী রতিকে দেবরাজ ইন্দ্র সব কথা বলতে, কন্দর্প ও রতি তখনই মহাদেবের তপস্যা স্থলে উপস্থিত হলেন। মদনদেব ও রতি সেখানে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, কঠোর তপস্যার রুক্ষ পরিবেশ সরে গিয়ে, প্রকৃতিতে বসন্তের স্পর্শ লাগল। হঠাৎ এই ঋতু পরিবর্তনে ভগবান ত্র্যম্বক বিস্মিত হলেন, তিনি তৃতীয় নয়ন মেলে তপস্যারতা সুন্দরী কন্যা পার্বতীকে দেখলেন এবং এ সবের আড়ালে দেখতে পেলেন মদনদেবকে।

    তাঁর মনে চঞ্চলতা আনার জন্যে এসব মদনদেবেরই কারসাজি বুঝে, তিনি তৃতীয় নয়নের অগ্নিতে মদনদেবকে দগ্ধ করে ফেললেন। স্বামীর মৃত্যুতে শোকাতুরা রতি মহাদেবের চরণে বিলাপ করাতে, মহাদেব বললেন, “হে ভদ্রে, তোমার পতি অনঙ্গ (কায়াহীন) হলেও তোমাদের দাম্পত্যে কোন বিঘ্ন ঘটবে না। ভগবান বিষ্ণু যখন সর্বজনের হিতের জন্যে বসুদেব-তনয় বাসুদেব হয়ে মর্ত্যে জন্ম নেবেন, তাঁর পুত্র হয়ে মদন আবার জন্ম নেবে”। মহাদেবের বরে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে রতিদেবী তাঁর বসন্ত পারিষদদের নিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিলেন।

    কন্দর্পের এই দুর্দশা দেখে দেবী পার্বর্তী আরও কঠোর তপস্যায় মগ্না হলেন। এই তপস্যায় সারাদিনে তিনি একট পাতাও মুখে দিতেন না, এই কারণে তাঁর নাম হল অপর্ণা। তাঁর এই কঠোর তপস্যায় মহাদেব বিচলিত হলেন এবং সন্তুষ্টও হলেন। তিনি ব্রাহ্মণের বেশে দেবী অপর্ণার আশ্রমে গেলেন। অলৌকিক দিব্য লক্ষণাদি দেখে দেবী তাঁকে মহেশ্বর বলে চিনতে পেরে পূজা ও স্তব করলেন। মহাদেব তখন স্বরূপ ধারণ করে স্মিতমুখে বললেন, “হে দেবি, সকলকে আমাদের লীলা দেখানোর জন্যেই তোমার বিবাহের স্বয়ংবরে, আমি তোমার সঙ্গে মিলিত হব”।  এই কথা বলে তিনি নিজের আশ্রমে চলে গেলেন, দেবী পার্বতীও তপস্যা ভঙ্গ করে ফিরে এলেন পিতৃগৃহে।

    দেবী পার্বতী ঘরে ফিরে আসাতে মাতা মেনকা ও পিতা গিরিরাজ আনন্দে বিহ্বল হলেন এবং কন্যার মুখে দেবাদিদেবের মন্ত্রণার কথা শুনে সর্বলোকে কন্যার স্বয়ংবর ঘোষণা করলেন। সেই সভায় ব্রহ্মা, বিষ্ণু থেকে সকল দেবতাই উপস্থিত হলেন। সর্ব অলংকারে ভূষিতা গিরিকন্যা যখন সভায় উপস্থিত হলেন, তাঁর সঙ্গী ছিলেন কল্পদ্রুম-পুষ্পের মালা হাতে জয়া এবং ব্যজন (চামর) হাতে বীজন করছিলেন বিজয়া। সভাস্থলে দেবী পার্বতী যখন বরমাল্য হাতে নিলেন, তখন অকস্মাৎ ভগবান মহাদেব লীলা করার ইচ্ছায় শিশুরূপ ধারণ করে তাঁর কোলে শুয়ে পড়লেন। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত দেবতারা সকলেই ক্ষুব্ধ হলেন, এই শিশু কে? দেবরাজ ইন্দ্র শিশুকে হত্যা করার জন্যে বজ্র নিক্ষেপ করতে উদ্যত হতেই, শিশুর হাতের ইঙ্গিতে ইন্দ্র পুতুলের মতো নিঃসাড় হয়ে গেলেন। এভাবেই যে যে দেবতা তাঁদের অস্ত্র হাতে শিশুকে আঘাত করতে উদ্যত হলেন, সকলেই স্থির, নিশ্চেষ্ট, স্পন্দনহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। দেবতাদের এই অদ্ভূত দুর্দশা দেখে ব্রহ্মা ধ্যানমগ্ন হলেন এবং জানতে পারলেন, ওই শিশুই ভূতভাবন ভূতপতি মহেশ্বর। তিনি তখন উঠে দাঁড়িয়ে শিশু দেবাদিদেবকে নমস্কার করে, তাঁর স্তব ও স্তুতি করতে লাগলেন। তারপর ব্রহ্মা সকল স্তম্ভিত দেবতাদের উদ্দেশে বললেন, “ওহে দেবতাগণ, দেবাদিদেব মহেশ্বর যে শিশুরূপে এখানে উপস্থিত হয়েছেন, তা তোমাদের কেউই বুঝতে পারোনি? অতএব তোমরা সকলেই মূঢ় প্রতিপন্ন হয়েছ। এখন সকলে মহেশ্বর ও মহেশ্বরীর শরণাপন্ন হও। দেবতারা সকলেই মোহমুক্ত হয়ে দেবাদিদেব শঙ্কর ও দেবী পার্বতীকে ভক্তিভরে প্রণাম করলেন এবং নানান স্তবস্তুতিতে তাঁদের অর্চনা করলেন।

    এরপর বহুবিধ আড়ম্বরে সকল দেবতাদের উপস্থিতিতে উভয়ের বিবাহ সম্পন্ন হল এবং যথাকালে তাঁদের পুত্র কার্তিকেয়র জন্ম হওয়ার পরে, বালক কার্তিকের হাতেই তারকাসুর নিহত হল (লিঙ্গপুরাণ/১০১, ১০২, ১০৩)।

    এই কাহিনী নিয়ে কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন, কিন্তু একটা বিষয় বেশ উপভোগ্য। দেবরাজ ইন্দ্র অসুর ও দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রায়শঃ পরাজিত ও স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে পরিত্রাণের জন্য ত্রিদেবের শরণ নিয়ে থাকেন। কিন্তু এক্ষেত্রে দেবী পার্বতীর কোলে থাকা একটি শিশুকে বধ করার জন্য তাঁকে প্রথমেই হাতে বজ্র তুলে নিতে হল! আবার শিশুরূপী দেবাদিদেবের হাতের ইশারায় তিনি একেবারে জড়বৎ পুতুল হয়ে গেলেন! দেখা যাচ্ছে ভাগবত এবং শৈব - উভয় পুরাণকারই সুযোগ পেলে বৈদিক দেবরাজ ইন্দ্রকে অপদস্থ করতে দ্বিধা করেননি। 

    ৫.৫.৫ হরি-হর
    খ্রীষ্টপূর্ব শেষ শতাব্দী এবং পরবর্তী দুই শতাব্দীতে আমরা হিন্দু ধর্মের ভাগবত এবং শৈব দুই শাখারই সুস্পষ্ট অস্তিত্ব দেখেছি।  ভাগবত শাখার প্রধান দেবতা বিষ্ণু, যাঁর আরেক নাম হরি। এবং শৈব শাখার প্রধান দেবতা শিব, যাঁর আরেক নাম হর। প্রাথমিক পর্যায়ে এই দুই শাখার মধ্যে সহাবস্থান থাকলেও কিছুটা রেষারেষি এবং প্রতিদ্বন্দ্বীতার আভাস পাওয়া যায় পুরাণগুলিতে। যেমন বিষ্ণু-মহিমার পুরাণগুলিতে, বিষ্ণুকেই পরমব্রহ্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং অন্যান্যরা তাঁর তুলনায় কিছুটা হলেও গৌণ।
    যেমন শ্রীমদ্ভাগবতের সৃষ্টিতত্ত্বে বলা হয়েছে, যখন এই বিশ্ব একার্ণব[4] জলে নিমগ্ন ছিল, সেই সময় শ্রীনারায়ণ[5] অনন্তশয্যায় যোগনিদ্রায় শুয়ে ছিলেন। তাঁর এই যোগনিদ্রার অর্থ, তাঁর চিৎ-শক্তি মায়া বিরহিত হয়ে, স্বরূপানন্দে নিমগ্ন ও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বিরাজ করছিল। যোগনিদ্রায় সহস্র চতুর্যুগ পরিমিত কাল পার হওয়ার পর কালশক্তির প্রভাবে তিনি সৃষ্টিক্রিয়ায় নিযুক্ত হলেন। প্রলয়ের সময় সমস্ত লোকসকল সূক্ষ্মভাবে তাঁর শরীরেই লীন হয়ে থাকে, এখন সেই সূক্ষ্মতত্ত্ব তাঁর নাভি থেকে পদ্মকোষের আকারে উঠে এল। সেই পদ্মকোষেই আবির্ভাব হল বেদময় ব্রহ্মার। তিনি সেই পদ্মাসনে বসে, চতুর্মুখে চারদিক নিরীক্ষণ করেও কোন ভুবন বা জগৎ দেখতে পেলেন না। তিনি বিস্মিত হয়ে চিন্তা করলেন, এই পদ্মের কোথা থেকে সৃষ্টি হল? তিনি বহু কাল অন্বেষণ করেও, এই প্রশ্নের সমাধান খুঁজে পেলেন না। তখন তিনি সেই পদ্মাসনে যোগসমাধিতে প্রবৃত্ত হলেন।

    দীর্ঘ শত বৎসর পর তাঁর যোগ সম্পন্ন হলে, তিনি নিজের হৃদয়ে উপলব্ধি করলেন, এক পুরুষ শেষনাগের শয্যায় এবং অনন্তনাগের সহস্রফণার আচ্ছাদনে, প্রলয়-জলের উপরে শুয়ে আছেন। তাঁরই নাভি থেকে সৃষ্ট পদ্মের উপর তিনি বসে আছেন। এবার ব্রহ্মা তাঁকে শ্রীহরি বলে চিনতে পারলেন এবং বুঝতে পারলেন ভগবান হরির লোকসৃষ্টির ইচ্ছাতেই, এই নাভিপদ্ম এবং তিনি সৃষ্ট হয়েছেন। ব্রহ্মা এবার একনিষ্ঠ মনে ভগবানের স্তব শুরু করলেন। দীর্ঘ তপস্যার পর, প্রকৃতি ও পুরুষের অধিপতি পদ্মনাভ শ্রীহরি, ব্রহ্মাকে সৃষ্টির তত্ত্ব সকল বুঝিয়ে দিলেন এবং বললেন, “তুমি আমার থেকেই উৎপন্ন হয়েছ, অতএব তুমিও জ্ঞানশক্তি ও ক্রিয়াশক্তির আধার। তুমি সর্ববেদময়। অতএব পূর্বকল্পের মতো সমগ্র ত্রিলোক, যা এখন আমার মধ্যেই নিহিত আছে, সেই সব আবার সৃজন কর এবং প্রকাশ কর”। এরপর পদ্মনাভ ভগবান শ্রী নারায়ণ রূপে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। (শ্রীমদ্ভাগবত/৮, ৯)।

    শিব-মহিমা বর্ণিত লিঙ্গপুরাণের কাহিনী মূলতঃ একই, কিন্তু সেখানে অদ্ভূত এক মোচড় আছে, সেটাই লক্ষ্য করার বিষয়। সেখানে বলা হয়েছে, পাদ্ম-কল্পের শুরুতে এই জগৎ অতি ভয়ংকর ও অন্ধকারময় বিভাগশূণ্য একার্ণব ছিল। সেই একার্ণব জগতে একমাত্র প্রভু হরি সহস্রফণাবিশিষ্ট অনন্তনাগের দেহ-শয্যায় অনির্বচনীয় যোগ আশ্রয় করে শুয়ে ছিলেন। অনন্তশয্যায় শয়ান জগৎকারণ বিষ্ণু খেলাচ্ছলে নিজের নাভিদেশে একটি পুষ্কর সৃষ্টি করলেন, সেই পদ্ম শতযোজন বিস্তীর্ণ। এই সময় সেখানে উপস্থিত হলেন চতুর্মুখ ব্রহ্মা, তিনি সুগন্ধি দিব্যপদ্ম নিয়ে খেলায় নিরত দিব্য পুরুষকে দেখে বিস্মিত হলেন, এবং জিজ্ঞাসা করলেন, “হে সৌম্য, আপনি কে? জলের মধ্যে অনন্ত শয্যায় শুয়ে আছেন কেন?” তখন বিস্মিত ভগবান অচ্যুত হরি শয্যা থেকে উঠে বসলেন এবং বললেন, “আমি জগন্নিবাস, প্রতি কল্পেই আমার এই আশ্রয়। আমিই স্বর্গ ও পৃথিবী; আমিই পৃথিবীর পরমস্থান। কিন্তু তুমি কে? তুমি কোথা থেকে আমার কাছে এলে, যাবেই বা কোথায়? তোমার আশ্রয় কোথায়?” ভগবান হরি এই কথা বলায়, পিতামহ তাঁকে বললেন, “শম্ভুর মায়ায় মুগ্ধ হয়ে আমি আপনাকে চিনতে পারিনি, আপনিও আমায় চিনতে পারেননি। আপনি যেমন সৃষ্টিকর্তা ও প্রজাপতি, আমিও তেমনই সৃষ্টিকর্তা ও প্রজাপতি”।

    দুজনের এই রকম নানান কথোপকথনের মধ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন শূলপাণি মহাদেব, তিনি অনন্তশয্যার কাছে উপস্থিত হলেন। তাঁর পায়ের আঘাতে সমুদ্রের বিক্ষিপ্ত জলকণা হয়ে উঠল মেঘ, স্থির বাতাসও হয়ে উঠল চঞ্চল বহমান। ভগবান ভবকে সামনে দেখে বিষ্ণু বললেন, “আপনার পদভারে সমুদ্রের জল থেকে আকাশমণ্ডলে জলধর সৃষ্টি হয়েছে। ঘ্রাণজ-বায়ু স্পন্দিত হয়ে উঠেছে। আপনি অনাদি অন্তকৃৎ[6] ও প্রভু, আপনিই ঈশ্বর। আমি আপনার স্তব ও উপাসনা করি। আপনিই মহাযোগের ইন্ধন, আপনি সাক্ষাৎ ধর্ম ও বরদাতা, এই জগতের হেতু। আপনি পুরাণপুরুষ ও অব্যয়। আপনিই বীজবান, ব্রহ্মাই বীজ, আমি যোনি ও সনাতন”। বিষ্ণুর এই স্তববাক্য শুনে ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি যোনি, আমি বীজ, মহেশ্বর বীজবান– এই বিষয়ে আমার সংশয় হচ্ছে, হে বিষ্ণু, তুমি আমার সংশয় দূর কর”। বিষ্ণু বললেন, “আত্মা দুই প্রকার – নির্গুণ ও সগুণ, এর মধ্যে নির্গুণ আত্মা অব্যক্ত এবং সগুণ আত্মাই মহেশ্বর। হে ব্রহ্মা, মহেশ্বরের লিঙ্গ থেকে উৎপন্ন প্রথম বীজ তুমি। বীজস্বরূপ তুমিই আমার যোনিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, কালপর্যায়ে হিরণ্ময় অণ্ড জন্ম নিয়েছিল। জলের মধ্যেই অধিষ্ঠিত সেই অণ্ড সহস্র বছর পর দুইভাগে বিভক্ত হল, উপরের খণ্ড হল স্বর্গ, এবং অন্য খণ্ড হল পৃথিবী। এইভাবেই জগতের সৃষ্টি সম্পাদন হয়”। (লিঙ্গপুরাণ/২০)

    দুই পুরাণের সৃষ্টি কাহিনী থেকে স্পষ্টতঃই অনুমান করা যায়,
    ১. শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের রচনাকাল লিঙ্গপুরাণের অনেকটাই আগে। ভাগবত পুরাণের সৃষ্টিতত্ত্বে বিষ্ণুই পরমেশ্বর, ব্রহ্মা তাঁর অধীনস্থ সৃষ্টিকর্তা। মহেশ্বরের কোন উল্লেখই নেই। লিঙ্গপুরাণ যখন রচনা করা হয়েছিল, সেসময় আগের পুরাণটি যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচারিত হয়ে গেছে। সে কারণেই লিঙ্গপুরাণের পুরাণকারকে, ভাগবত পুরাণের বিষ্ণু ও ব্রহ্মার কাহিনী-কাঠামোর মধ্যে মহেশ্বরকে অনুপ্রবেশ করাতে হয়েছে।
    ২.  লিঙ্গপুরাণ রচনার আগেই বিষ্ণু পুরুষোত্তম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন, অতএব লিঙ্গপুরাণে সেই বিষ্ণুকে দিয়েই বলাতে হয়েছে, মহেশ্বর পুরুষোত্তম এবং বিষ্ণু ও ব্রহ্মা তাঁর অধীনস্থ।

    অতএব এমত পরিস্থিতিতে সমাজে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত ভাগবতদের সঙ্গে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়া শৈবদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ঘটতে থাকা খুবই স্বাভাবিক। এই কারণেই এই পর্যায়ের শৈবরা বেশ কয়েকবার ভয়ংকর আগ্রাসী হয়ে উঠেছিলেন এবং সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে তাঁদের “রুদ্র-ভৈরব”-আতঙ্কের একটা আবহ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ভগবান বিষ্ণুর হাতে অজস্র অসুর, দৈত্য, রাক্ষস, নর নিধনের কাহিনী থাকা সত্ত্বেও, মানুষের মনে কোনদিনই তাঁর যোদ্ধা ইমেজ গড়ে ওঠেনি, অথচ গুটিকয়েক অসুর নিধন করে, মহেশ্বর রূদ্র যোদ্ধারূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। অতএব বুঝতে অসুবিধে হয় না, সামাজিক প্রতিষ্ঠা পেতে ভাগবতদের তুলনায় শৈবদের অনেকবেশি আগ্রাসী হতে হয়েছিল, সেই স্মৃতিই সাধারণের মনে শিবের রুদ্ররূপটি গেঁথে দিয়েছে।  

    যদিচ হরি ও  হর ভক্ত গোষ্ঠীদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব সম্ভবতঃ কোনদিনই ভয়াবহ হয়ে ওঠেনি, কিন্তু ছোটখাটো বিবাদ ও সংঘর্ষের ঘটনা লেগেই থাকত। যে বিভেদ ও দ্বন্দ্বের অবসান করেছিলেন যুগপুরুষ শঙ্করাচার্য। মূলতঃ তাঁর প্রচেষ্টাতেই হরি ও হর প্রায় অভিন্ন দেবতা হরি-হর আত্মারূপে হিন্দু ভক্তদের মনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। তিনিই হিন্দুধর্মের গঠন সম্পূর্ণ এবং সম্পন্ন করলেন, যার মূল তত্ত্ব আজও হিন্দু সমাজে একইভাবে প্রবহমান। সেকথা সংক্ষেপে আসবে একটু পরেই।

    ৫.৫.১ অন্যান্য হিন্দু দেবতা
    হিন্দুদের ত্রিদেব - অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর ছাড়াও জনপ্রিয় আরও বেশ কিছু দেবতা রয়েছেন, যেমন কার্তিকেয়, গণেশ বা গণপতি। যদিও ষড়ানন কার্তিকেয় বা কার্তিকের জন্ম নিয়ে বিভিন্ন ধরনের পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে, তবু কার্তিক ও গণেশ, দুজনেই ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর পুত্র হিসেবেই সমধিক পরিচিত। ভগবান গণেশের প্রধান দুটি রূপের মধ্যে প্রথমটি হল তিনি সিদ্ধেশ্বর বা সিদ্ধিদাতা এবং দ্বিতীয়টি হল বিঘ্নেশ বা বিঘ্ন নাশকারী। ভগবান গণেশ ভারতীয় হিন্দু বণিকমহলের একমাত্র দেবতা, তিনিই বাণিজ্যে সিদ্ধি এবং ঋদ্ধি দান করেন। দেবতা হনুমান, তিনি প্রধানতঃ সংকট-মোচন এবং বিঘ্ন-নাশকারী ভারতের সর্বত্র পূজিত এবং অত্যন্ত জনপ্রিয়। দেবতা বিশ্বকর্মা শিল্পী, কলাকুশলী ও দক্ষ কারিগর মহলে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

    ৫.৫.২ দেবীরূপা নদী
    নদীসমূহতে দেবীত্ব আরোপ করার প্রাচীন প্রচলন যে অনার্য ভারতীয়দের মধ্যে ছিল, সেকথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি। ব্রাহ্মণ্যধর্ম সেই নদীগুলিকেও নানান পৌরাণিক কাহিনীতে সাক্ষাৎ দেবীরূপে বরণ করে, হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করে নিল। হিন্দু ধর্মের যে কোন দেব বা দেবী পূজায় জলশুদ্ধি একটি আবশ্যিক প্রকরণ এবং তার মন্ত্রটি হল, “গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতি। নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু”।।

    মন্ত্রোক্ত সাতটি নদীকে ভারতবর্ষের পবিত্রতম নদী হিসেবে মান্য করা হয়, যদিচ এগুলির মধ্যে সরস্বতী নদী খ্রিস্টিয় চতুর্থ বা পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যেই অবলুপ্ত হয়েছিল এবং সিন্ধু নদী ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর ভারতবর্ষের বাইরে রয়ে গেছে। কিন্তু তাও পূজার সময় কোশা-কুশি বা তাম্র কুণ্ডের জল স্পর্শ করে, আজও আমরা এই মন্ত্রই উচ্চারণ করি, এবং বিশ্বাস করি ওই জলে সাতটি নদীর পবিত্র জল যেন সংস্থিত হল। এই মন্ত্রটির আপডেটেড ভার্সান, “গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি মহানদী। নর্মদে কৃষ্ণা কাবেরি জলেস্মিন সন্নিধিং কুরু” হওয়া যুক্তিযুক্ত হলেও, আমরা সেই ১৩০০ সি.ই.-র আগের মন্ত্রই সংস্কারবশতঃ ব্যবহার করে চলেছি ও চলব।

    যাই হোক, এই সাতটি পবিত্র নদীর মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ নদী গঙ্গা ও নর্মদা। গঙ্গা এবং নর্মদা সাক্ষাৎ দেবী মূর্তিতে পূজিতা হয়ে থাকেন।

    ৫.৫.২.১ গঙ্গা
    গঙ্গা মকরবাহনা দেবী। একদিকে গঙ্গা ও তাঁর অজস্র শাখানদী ও উপনদীর পবিত্র জলধারায় উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ জনজীবন একান্তভাবেই নির্ভরশীল। অন্যদিকে তিনিই পাপীজনের সকল পাপ ও কলুষহারিণী। গঙ্গার ভৌগোলিক উৎস যেখানেই হোক, পৌরাণিক মতে গঙ্গার উৎপত্তি ভগবান বিষ্ণুর চরণ থেকে। ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই প্রবল জলধারার প্রপাত ধারণ করার সাধ্য পৃথিবীর ছিল না, অতএব ভগীরথের তপস্যায় সন্তুষ্ট মহাদেব তাঁর জটায় গঙ্গার সেই প্রপাত ধারণ করলেন। তারপর ভগীরথের প্রদর্শিত পথে গঙ্গা হিমালয় থেকে নেমে এলেন এবং দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শেষ করলেন বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমে।    

    এ গেল পূতসলিলা গঙ্গা নদীর পৌরাণিক কাহিনী। এ ছাড়াও আছে দেবীরূপা গঙ্গার কাহিনী। তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কুরুরাজ শান্তনু, গঙ্গাদেবীকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। দেবী গঙ্গা প্রথমে নারাজ হলেও, শর্ত সাপেক্ষে শান্তনু-জায়া হতে সম্মতা হলেন। শর্ত ছিল, তাঁর গর্ভজাত পুত্রদের তিনি জন্ম মূহুর্তেই গঙ্গাজলে বিসর্জন দেবেন, এবং তাঁর এই আচরণ বিনা প্রতিবাদে মেনে নিতে হবে রাজা শান্তনুকে। নচেৎ তিনি তৎক্ষণাৎ ত্যাগ করবেন স্বামী ও সদ্যজাত পুত্রকে। রাজা শান্তনু নির্দ্বিধায় এই শর্ত মেনে নিলেন। তারপর “ত্রিপথগামিনী গঙ্গা রমণীয় কলেবরধারণপূর্বক পরম ভাগ্যবান শান্তনু রাজার মহিষী হইয়া মনোহর হাব-ভাব বিলাস ও সম্ভোগাদি দ্বারা নরেন্দ্রের মন মোহিত করিলেন”।

    কয়েক বছরের মধ্যে দেবী গঙ্গা দেবতুল্য সাতটি পুত্র সন্তান প্রসব করেছিলেন এবং পুত্ররা ভূমিষ্ঠ হওয়া মাত্র তাদের সকলকেই গঙ্গার ধারাস্রোতে বিসর্জন দিচ্ছিলেন। রাজা শান্তনু প্রতিবারই দেবী গঙ্গার এই আচরণে ক্ষুব্ধ হলেও প্রিয়তমা জায়ার বিরহের কথা মনে করে নির্বিকার রইলেন। এরপর অষ্টম পুত্র ভূমিষ্ঠ হতেই রাজা শান্তনু আর থাকতে পারলেন না, পুত্রশোকে কাতর হয়ে বললেন, “এই পুত্রকে বিনষ্ট করিও না; তুমি কে? কী নিমিত্ত আত্মজদিগের প্রাণবধ করিতেছ? তুমি এই গর্হিত নিষ্ঠুরাচরণে ক্ষান্ত হও”।

    তখন দেবী গঙ্গা বললেন, “আমি এখন থেকেই তোমার সহবাস ত্যাগ করলাম। আমি মহর্ষি জহ্নুর কন্যা, আমি গঙ্গা বা জাহ্নবী। আমি যে সাতটি পুত্রকে গঙ্গা স্রোতে বিসর্জন করেছি, তাঁরা কেউই সাধারণ মানুষ নন, তাঁরা অষ্ট বসুর সাতজন। মহর্ষি বশিষ্ঠের অভিশাপে তাঁরা মনুষ্য জন্ম নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। তুমি তাদের পিতা এবং আমি তাদের মাতা হয়ে তাদের গর্ভে ধারণ করেছিলাম, এবং জন্ম মূহুর্তেই তাদের গঙ্গাস্রোতে বিসর্জন দিয়ে তাদের শাপমুক্তি ঘটিয়েছি। তাঁদের যে প্রতিশ্রুতি আমি দিয়েছিলাম, আজ আমি তার থেকে মুক্ত হলাম। অতএব আপনার সঙ্গে আমার পূর্ব শর্ত অনুযায়ী আমি ফিরে চললাম আমার নিজস্থানে। আপনি আমার এই পুত্রকে গ্রহণ করুন, সে গঙ্গাপুত্র দেবব্রত নামেই আপনার কাছে বড়ো হয়ে উঠুক”। এই শিশুই বড়ো হয়ে মহাবীর ও মহাজ্ঞানী হয়ে উঠেছিলেন, এবং পিতাকে সন্তুষ্ট করতে কঠোর প্রতিজ্ঞা করে “ভীষ্ম” নাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর হাত ধরেই এক সময় কৌরব বংশ যেমন আর্যাবর্তের শ্রেষ্ঠ গোষ্ঠী হয়ে উঠেছিল, তেমনি তাঁর উদাসীনতায় তার ভয়ংকর পতনও হয়েছিল। তাঁর পরোক্ষ সহযোগিতায় কুরু গোষ্ঠীর জ্ঞাতিশাখা পাণ্ডবরা উঠেছিলেন উন্নতির শিখরে এবং ঘটনাচক্রে তৃতীয়-পাণ্ডব বীর অর্জুনই হয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর কারণ। [মহা/আদি/৯৮]                       

    ৫.৫.২.২ নর্মদা
    নর্মদা গঙ্গার মতো বিষ্ণুপদী নন। তিনি রুদ্রের কন্যা - ভগবান মহাদেবের তেজ থেকে তাঁর জন্ম। গঙ্গার অপরিসীম মহিমার কথা মনে রেখেও মহর্ষি ভৃগু, কর্দম, কপিল, দুর্বাসা, অণীমান্ডব্য প্রমুখ বলেছেন নর্মদা ভারতবর্ষের সমস্ত নদীকুলের মধ্যে শ্রেষ্ঠা; রুদ্রের তেজ থেকে তিনি সমুৎপন্না; স্থাবর জঙ্গম সমস্ত কিছুকেই তিনি ত্রাণ করেন। শুদ্ধচিত্তে তাঁর তট পরিক্রমা করলে সর্বসিদ্ধি উপলব্ধি করা যায়।

    মহাভারতের বনপর্বে ঋষি পুলস্ত্য যুধিষ্ঠিরের তীর্থ ভ্রমণের সঙ্কল্পের কথা শুনে তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, “দেখ যুধিষ্ঠির তুমি অন্যান্য তীর্থে তো যাবেই, কিন্তু বিশেষ করে ত্রিলোক-প্রসিদ্ধা নর্মদা দর্শনে অবশ্যই যেও। নর্মদায় পিতৃপুরুষ এবং দেবতাদের তর্পণ করলে, অগ্নিষ্টোম যজ্ঞের তুল্য ফললাভ হয়”।

    নর্মদার উৎস মধ্যপ্রদেশের অনুপপুর জেলার মহাতীর্থ অমরকণ্টকে, যার অপর নাম মেকলে বা ঋষ্য – বিন্ধ্য পর্বতের একটি শৃঙ্গ। এই নদী মধ্যপ্রদেশ ও গুজরাটের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমদিকে প্রবহমানা, এবং এই দুই রাজ্যের জলসম্পদের প্রধানতম উৎস। এই নদীর দৈর্ঘ প্রায় ১,৩১২ কি.মি. এবং গুজরাটের খাম্বাৎ খাঁড়ির কাছে আরব সাগরে মিলিত হয়েছে। এই মোহানা থেকে ৩০ কি.মি. দূরের ভারোচ শহর, যার প্রাচীন নাম ছিল ভৃগুকচ্ছ, প্রাচীন সমুদ্র বন্দর ও হিন্দুদের প্রাচীন তীর্থক্ষেত্র।
       
    নর্মদার উত্তর তট বরাবর দাঁড়িয়ে আছে বিন্ধ্য পর্বতশ্রেণী আর দক্ষিণতটে সাতপুরা পর্বতমালা। আজ থেকে একশ বছর আগেও নর্মদার উভয় তীরে ছিল শ্বাপদসংকুল দুর্ভেদ্য অরণ্য রাজি। এই নিবিড় অরণ্য, দুই পর্বতশ্রেণী এবং তার মাঝখানে প্রবহমানা স্রোতস্বিনী নর্মদার জন্যেই উত্তরভারত থেকে দক্ষিণভারতের যাওয়ার স্থলপথ বহুদিন দুরধিগম্য ছিল। নর্মদা উপত্যকার প্রাচীনতা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই, কারণ ধারণা করা হয়  এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম ভূভাগ গণ্ডোয়ানাভূমির একটি অংশ। এই অঞ্চলের পলির নানান স্তরে বেশ কিছু ডাইনোসোরসের জীবাশ্মও উদ্ধার করা গেছে।

    এই নদীর উভয়তটেই অনার্য মানুষের সম্পন্ন জনপদ ও গ্রামের প্রাগৈতিহাসিক কালের প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে বিস্তর। ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক কালে আমরা যে সব সম্পন্ন নগর ও জনপদের সন্ধান পাই সেগুলি হল, মাহিষ্মতী, উজ্জয়িনী, বিদিশা, চেদি ইত্যাদি।  

    নর্মদা - এই ত্র্যক্ষর শব্দটি শৈবদের কাছে “গায়ত্রী”-র সমতুল্য একটি বীজমন্ত্র। নৃ ধাতু থেকে নর্ম বা নর্মন  শব্দটি নিষ্পন্ন করা যায় – নর্ম কথার অর্থ ক্রিয়া, খেলা বা লীলা, আরও সঠিক বললে, আনন্দ-লীলা।  অতএব নর্মদা কথার অর্থ যিনি আনন্দ-বিলাস দান করেন। এই আনন্দের সংজ্ঞা মিলবে তৈত্তিরীয় উপনিষদের তৃতীয় ভৃগুবল্ল্যধ্যায়ের ষষ্ঠ অনুবাকে –
    “আনন্দই যে ব্রহ্ম একথা জেনে রাখুন। কারণ আনন্দ থেকেই এই জীব ও জড় জগতের সৃষ্টি হয়, আনন্দের আবহেই তারা প্রতিপালিত হয় এবং অন্তিমে এই আনন্দেই তারা ফিরে আসে ও আনন্দেই বিলীন হয়” [বাংলায় সরল অনুবাদ – লেখক]। অতএব নর্মদা শুধু স্থূল ও সাধারণ জলধারা নয়, চিন্ময়ী রূপে তিনি ব্রহ্মস্বরূপা আনন্দময়ীও। নর্মদার অন্য নাম রেবা, এই নামও বীজমন্ত্রের মতো জপ করলে, শোনা যায়, সর্বসিদ্ধি লাভ সম্ভব।

    নর্মদার পবিত্রতা সম্পর্কে আরও জনশ্রুতি হল, সারাদিন স্নানরত পাপী ও তাপীদের পাপ ও কল্মষ ধুতে ধুতে পতিতপাবনী গঙ্গা নিজেই যখন মলিন হয়ে ওঠেন, দিনান্তে তিনি নর্মদা তটের কহ্লোড়ি ঘাটে আসেন কৃষ্ণা গাভীর বেশে। এবং নর্মদার পূত সলিলে অবগাহন করে নির্মল শুভ্র গাভীরূপে ফিরে যান স্বস্থানে। শিব ভক্তগণ আরও বিশ্বাস করেন, নর্মদাতটের প্রতিটি কংকর – অর্থাৎ প্রতিটি নুড়ি এবং কাঁকরই শিবময় শংকর। অতএব উওরভারতে কাশি যেমন একটি শিবক্ষেত্র, নর্মদা তট তার থেকেও বরেণ্য শিবক্ষেত্র।               

    চলবে....
    (পঞ্চম পর্বের ষষ্ঠ ভাগ আসবে ১৭/০৯/২২ তারিখে।)

    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১. শ্রীমদ্ভাগবত– মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় গদ্য অনুবাদ – সম্পাদনা তারাকান্ত কাব্যতীর্থ ভট্টাচার্য।
    ২. মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস রচিত মহাভারত – মূল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ – মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয়। বসুমতী সাহিত্য মন্দির, কলকাতা ৭০০০১২।
    ৩. তপোভূমি নর্মদা (সাতটি খণ্ডে প্রকাশিত) – শ্রী শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী, Director of The Vaidic Research Institute
    ৪. তৈত্তিরিয় উপনিষিদ - স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত এবং উদ্বোধন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত। গ্রন্থাংশের সরল বাংলা অনুবাদ- লেখক।

    [1] শব্দকোষে মার্জ্জালীয় শব্দের অর্থ বলছে, ১. মার্জ্জার, ২. কিরাত বা শুদ্ধদেহ, ৩. শূদ্র। (মহাদেব কী তাহলে শূদ্র কিরাতের ছদ্মবেশে নয়, নিজের স্বাভাবিক বেশেই অর্জুনের সঙ্গে লড়াই করলেন? তা না হলে, অর্জুন তাঁকে সাক্ষাৎ মহাদেব জেনেও, তাঁর কিরাত বা শূদ্র রূপেরও সম্বর্ধনা করলেন কেন? )

    [2] সম্ভবতঃ সত্যযুগে– এই সময়েই বিখ্যাত অসুর এবং দৈত্যদের সংহার করে আর্যরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করছিলেন, এই অসুর, দৈত্য, দানব সকলেই যে অবৈদিক অনার্য সেকথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

    [3] প্রমথাধিপত্য>প্রমথদের আধিপত্য – প্রমথ মানে ভূত বা প্রেত – মহাদেবের পারিষদদের “গণ” বলা হত, গণপতি তাদের প্রধান। 

    [4] একার্ণব–এক+অর্ণব - গোটা পৃথিবী একটিমাত্র সমুদ্রের জলে ডুবে ছিল।

    [5] নারায়ণ – নার মানে জল, আর অয়ণ মানে আশ্রয় – একার্ণব জলের মধ্যে তিনিই একমাত্র আশ্রয় বলে, তাঁর নাম নারায়ণ।

    [6] অন্তকৃৎ - অন্তকারক, নাশক । “অনাদি অন্তকৃৎ” - যাঁর শুরু নেই অথচ যিনি প্রলয়কারী বিনাশক – অর্থাৎ ভগবান মহাদেব।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১০৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • guru | 103.175.62.218 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১১:০১511844
  • @কিশোরবাবু 
     
    ভীষণ ভালো হচ্ছে | আপনার এই বইটি ভারতে ইতিহাস রচনাতে অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত |
     
    কয়েকটি প্রশ্ন আছে |
     
    ১ | আচ্ছা হিন্দু পুরান গুলী তে একটি ক্লিয়ার প্যাটার্ন দেখা যায় যে যত অসুর রাক্ষস দানব তাদের শেষ পর্যন্ত নিহত হতে হয় | এই বিষয়ে একটি চীনা পুরাণের দৃষ্টিভঙ্গি একটু অন্য | আমি এইখানে "Xī Yóu Jì" বা "journey to the west" ষোড়শ শতাব্দীতে লিখিত এই পুরানটিতে যেসব দানব গুলির দেখা পাই তারা প্রত্যেকেই দুর্দান্ত কিন্তু কেউ শেষ পর্যন্ত নিহত হননা বরঞ্চ বিভিন্নভাবে তারা বিভিন্ন সৎ কাজে নিয়োজিত হন বা বোধিস্বত্ব ও বুদ্ধের দ্বারা বিভিন্ন শ্রেষ্ট পদ লাভ করেন | তাহলে হিন্দু পুরান ও চীনা পুরানের গল্পের এই প্যাটার্নের ভিন্নতার কারণ কি ?
     
    ২ | এই journey to the ওয়েস্ট গল্পটি আমি অনেকাংশেই রামায়ণের অনেক মিল খুঁজে পাচ্ছি | রামায়ণের হনুমানের মতো এইখানেও একটি অলৌকিক ক্ষমতাশালী বানর চরিত্র সুন্ wukong আছে | এইখানেও একটি অনেক দূর দেশে অভিযানের ব্যাপার আছে ও অনেক দানবদের সঙ্গে লড়াই এর ঘটনা আছে | পার্থক্য হচ্ছে যে এইখানে শেষপর্যন্ত কোনো দানবের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনা যেমন রামায়ণে ঘটে | তাহলে এই লেখাটিকে কি রামায়ণের ইনফ্লুয়েন্স বলা যেতে পারে নাকি vice versa ?
  • Sara Man | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৭:২৬511849
  • কিশোরবাবু, প্রথমবার অমরকন্টকে গিয়ে শুনেছিলাম, এখানকার মন্দিরের শিবলিঙ্গ গুলি মানব - প্রতিষ্ঠিত নয়, সবগুলোই পাতাল থেকে স্বপ্রকাশিত। অল্পবয়সী শহুরে দিদিমণি হিসেবে পাত্তা দিইনি। পরে আবিষ্কার করলাম। প্রতিটি শিবলিঙ্গ আগ্নেয় উদ্ভেদ। উল্লম্ব ডাইক। সারফেস ইরোশনের ফলে বেরিয়ে পড়েছে। ঐ লিঙ্গ মানুষের প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন ই ওঠে না। মানুষ ওগুলো কে ঘিরে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে। ঐ মহাকাল পর্বত থেকে অজস্র নদী প্রবাহিত হয়েছে। প্রতিটির উৎস ভূগর্ভস্থ জল। নদীগুলো বেরিয়েছে শিবমন্দির থেকে। কারণ ডাইকের গায়ে আছে ফাটল, আর ভৌমজলস্তর ভূপৃষ্ঠের খুব কাছে। ঐ ফাটল দিয়ে শ্রাবণ মাসে ভলকে ভলকে জল বেরোয়। স্থানীয় মানুষ বলে নর্মদার সঙ্গে মা গঙ্গা দেখা করতে আসেন। কিন্তু তিনি আসেন সৎ মেয়ের মান ভাঙাতে। নর্মদা কেন অভিমানিনী সে আর এক ব্লক বাস্টার কাহিনী। আরও অনেক কিছু আছে। ঐ স্থানটি আমার ব‍্যক্তিগত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী একটি প্রহেলিকা। 
  • Kishore Ghosal | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৮:৫৭511852
  • @ গুরুবাবু, 
    আমার লেখাটি পড়ে বারবার উৎসাহ দেওয়ার জন্যে অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই। 
    তবে আপনি যে বিষয়ে আলোচনা করেছেন, সেই চীনা পুরাণ সম্বন্ধে আমার বিন্দুমাত্র পড়াশুনো নেই, অতএব এ বিষয়ে কিছু বলার সাধ্যও নেই।   
  • Kishore Ghosal | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ১৯:৪৭511853
  • @ শারদা ম্যাডাম, নর্মদা উপত্যকার অধিকাংশ লিঙ্গ-প্রস্তরকে স্বয়ম্ভূ বলা হয়। প্রাচীন যুগ থেকেই বিশেষ আকারের প্রস্তর খণ্ডকে অনার্যরা লিঙ্গ নাম দিয়ে দেবপ্রতীক হিসেবে পূজা করতে শুরু করে। নর্মদা উপত্যকায় সেই লিঙ্গ আকৃতির অজস্র প্রাকৃতিক পাথরকেই তারা স্বয়ম্ভূ  আখ্যা দিয়ে সমগ্র নর্মদা উপত্যকাকেই শিব ক্ষেত্র বলে কল্পনা করেছে। 
     
    Plate Tectonic Evolution theory অনুযায়ী যে ভারতীয় প্লেট  ছিল আফ্রিকা, আনটার্কটিকা আর অস্ট্রেলিয়ায় ঘেরা - সেই প্লেট কোটি কোটি বছরের প্রাকৃতিক খেয়ালে ভেসে এসে ধাক্কা  খেল এশিয়ার প্লেটে - তাতে কত কী ঘটে গেল তার হিসেব রাখবে কে?  পৃথিবীর বুকে বুদ্ধিমান মানুষতো সেদিনের ছোকরা।  আর প্রাকৃতিক বিস্ময়কে ঈশ্বরে আরোপ করা আমাদের সাধারণ চরিত্র - আমরনাথ গুহার তুষার লিঙ্গের মতো - সবই স্বয়ম্ভূ।          
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন