এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - দ্বিতীয় পর্ব - পঞ্চম ভাগ

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ২০ মে ২০২২ | ১৮৭৮ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • দ্বিতীয় পর্ব - ১২,০০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই – পঞ্চম ভাগ
     
    ২.৫.১ চতুর্বর্ণাশ্রম  

    ব্রাহ্মণ্য সমাজের এই চারটি শ্রেণী – ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র - বিন্যাসকে চতুর্বর্ণাশ্রম বলা হয়ে থাকে। এই বর্ণ মানে কি রঙ? চলন্তিকা অনুযায়ী – বর্ণ শব্দের অর্থ বলা হয়েছে – রঙ, অক্ষর (যেমন স্বরবর্ণ ইত্যাদি), এবং জাতি (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি)। শব্দকোষের বক্তব্যও প্রায় একই।
      
    তাহলে কী এই শ্রেণী বিভাগ ত্বকের রঙ দেখে করা হয়েছিল? সেক্ষেত্রে আর্য ব্রাহ্মণ – যারা সারাদিন গাছের ছায়ায়, কুটিরে বসে বেদচর্চা করত, তাদের গায়ের রঙ গৌরবর্ণ (? গোধূমবর্ণ)। আর্য ক্ষত্রিয়দেরও একই গায়ের রঙ হওয়ার কথা - কিন্তু রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে তাদের যুদ্ধ শিখতে হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে চোট-আঘাত সহ্য করতে হয়েছে – অতএব তাদের গায়ের রঙ তামাটে (তাম্রাভ) হতে পারে। সমাজের দক্ষ কাজের মানুষরা বৈশ্য - তাদের অধিকাংশ মানুষই ছিলেন অনার্য - তাদের গায়ের রঙ ছিল কালো (কৃষ্ণ)। শুদ্রদের সকলেই অনার্য – তাদেরও গায়ের রঙ কালো। ত্বকের এই বর্ণ বিচার করেই কি ব্রাহ্মণরা চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করেছিল? নাঃ, ব্যাপারটা এত সহজ ও সরল বলে মনে হয় না।
     
    সংস্কৃতে একটি ক্রিয়াপদের মূল বা ধাতু হল, বৃ। ব্যাকরণ কৌমুদীতে এই বৃ ধাতুর অর্থ দেওয়া আছে to choose। বৃ-ধাতুর সঙ্গে নানান প্রত্যয়ের যোগসাজসে অনেকগুলি শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ল্যুট্‌ প্রত্যয়ে সিদ্ধ হয়ে বৃ হয়েছে বরণ বা বরণম্‌। যার অর্থ বরণ করা, সসম্মানে গ্রহণ করা  – যেমন বধূবরণ, পতিত্বে বরণ। কিংবা কোন বিশেষ উদ্দেশে কষ্ট স্বীকার করা, যেমন কারাবরণ। ক্ত-প্রত্যয়ে সিদ্ধ হয়ে বৃ হয়ে যায় বৃত, যার অর্থ নির্বাচিত, মনোনীত, সিদ্ধান্ত-কৃত (selected, decided)। যদিচ বৃ-ধাতু থেকে কোন প্রত্যয় যোগ করে, “বর্ণ” শব্দে পৌঁছানো যায় – এমন কোন সূত্র ব্যাকরণ কৌমূদীতে মেলেনি। তবু আমার ধারণা, এই শব্দগুলি ব্রাহ্মণদের সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তোলার চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। ব্রাহ্মণরা অনেক বিচার-বিবেচনা, চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, এবং নির্বাচন করেছিল, সমাজের কোন স্তরে থাকবে আর্যরা এবং অনার্যদের কোথায় স্থান দেওয়া হবে।

    এই প্রসঙ্গে  অনেক বিতর্ক ও  আলোচনার অবকাশ রয়ে গেল। অতএব এ প্রসঙ্গের এখানেই সমাপ্তি হোক। আমরা বরং মেনেই নিই, অন্যান্য অর্থের সঙ্গে বর্ণ শব্দের মানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ইত্যাদি জাতি।

    এবার আমরা  চোখ ফেরাই, নিজেদের মনোমত বর্ণ-ব্যবস্থা গুছিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণ ঠিক কেমন সমাজ গড়ে তুলল। আর এই সমাজ ব্যবস্থা ভারতের কোন কোন অঞ্চলকে কতখানি প্রাভাবিত করল। এই বিষয়ে আমি “মহাভারত”-এর মতো মহাকাব্যকেই প্রামাণ্য হিসেবে ধরেছি। অতএব মহাভারত এই বিষয়ে আমাদের কতখানি সাহায্য করতে পারে সেটাও দেখে নেওয়া যাক।

    ২.৫.২  ভারতে আর্যদের প্রাথমিক বিস্তার

    ১৫০০ বি.সি.ই-তে ভারতে পা রেখে, মোটামুটি গুছিয়ে বসে কর্তৃত্ব নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেতে আর্যদের চার-পাঁচশ বছর চলেই গেল। বিভিন্ন গোষ্ঠী বিভিন্ন অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিল। যদিও প্রাথমিক ভাবে আর্যরা গঙ্গা পার হয়ে দক্ষিণদিকে তখনও সম্ভবতঃ আসেনি। সে সময় আর্যাবর্তের সীমানা ছিল যমুনা নদী থেকে পূর্বদিকে বঙ্গ[1]র সীমানা পর্যন্ত। দক্ষিণে গঙ্গা এবং উত্তরে হিমালয় পর্যন্ত তরাই অঞ্চল। এই সময়কার প্রত্ন-নিদর্শনেও কিছু কিছু শহরের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যেমন হস্তিনাপুর, অহিচ্ছত্র, কাশি, বিদেহ এবং কৌসাম্বী। এই জনপদগুলির সময়কাল ঐতিহাসিকরা বলেন ৯০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই-র কোন সময়ে। প্রত্নখননে, কিছু PGW-এর টুকরো, কিছু তামার যন্ত্রপাতি, সামান্য কিছু লোহার টুকরো, আর রোদে-পোড়া ইঁটে বানানো বাড়িঘরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এখন হস্তিনাপুরের নাম শুনলেই আমাদের মহাভারতের কথা মনে পড়ে যায়। মহাভারতের সব ঘটনাই কী তাহলে ঐতিহাসিক?

    ঐতিহাসিকেরা সিদ্ধান্ত করেছেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময়কাল খ্রী.পূ. নবম শতাব্দীর কোন এক সময়ে। কিন্তু মহাভারতে কুরু এবং পাণ্ডব রাজাদের যে জৌলুষ এবং জাঁকজমকের বর্ণনা পাওয়া যায়, (ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের নতুন জমকালো প্রাসাদের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে গিয়ে রাজা দুর্যোধন ও তাঁর ভাইদের অত্যন্ত অপদস্থ হতে হয়েছিল এবং তাঁরা ঈর্ষায় জ্বলে গিয়েছিলেন!) তার তুলনায় প্রত্নখননে পাওয়া অবশেষ অতীব সাধারণ এবং গুরুত্বহীন। তবে কুরুগোষ্ঠী, পাঞ্চালগোষ্ঠীর নাম অন্যান্য বেদের “ব্রাহ্মণ” অংশে, পুরাণ ও অন্যান্য শাস্ত্রে পাওয়া যায় এবং কুরু রাজাদের মধ্যে পরীক্ষিৎ এবং জন্মেজয়েরও নাম পাওয়া যায়। মহাভারতের প্রধান দুই চরিত্র –যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধন - হয়তো প্রতীকী চরিত্র, পুরোটা না হলেও অনেকটাই কাল্পনিক। কারণ কর্ণ ও যুধিষ্ঠির সহ পঞ্চপাণ্ডব এবং দুর্যোধন সহ শত-কৌরব ভাই ও এক বোনের জন্মবৃত্তান্ত খুবই অস্বাভাবিক। তাছাড়া তাঁদের নামগুলি, যুধিষ্ঠির, দুর্যোধন, দুঃশাসন, দুঃসহ, বিকট, দুরাধন, দুঃশলা ইত্যাদি এবং তাঁদের মামা শকুনি, যেন চরিত্রগত নাম! কোন বাবা-মায়ের পক্ষে জন্মের সময়েই তাঁদের সন্তানেরা ভবিষ্যতে কী চরিত্রের হবে বুঝে নিয়ে প্রত্যেকের এমন সব মোক্ষম নাম দেওয়া সম্ভব?

    কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যদি খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর কোন সময় হয়ে থাকে, তাহলে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাসকেও সমসাময়িক হতেই হবে। কারণ সমগ্র মহাভারতে এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ঘটে ওঠার পেছনে বেদব্যাস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। তিনিই ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুরের পিতা, অর্থাৎ কৌরব এবং পাণ্ডবদের পিতামহ। পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর পক্ষপাতিত্ব সুবিদিত এবং সঠিক সময়ে জ্যেষ্ঠ নপ্তা যুধিষ্ঠির এবং পুত্রবধূ কুন্তীকে উপযুক্ত উপদেশ দিয়ে সঠিক পথে চালনা করেছেন বারবার। কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়ের পশ্চাৎপটে তাঁর অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রচলিত প্রবাদ ও তথ্য অনুযায়ী এই বেদব্যাসই বেদের সংকলক এবং মূল মহাভারত মহাকাব্যের রচয়িতা। অতএব এই সংকলন এবং রচনা - দুটোই খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর ঘটনা হওয়া উচিৎ। ঋগ্বেদের সংকলন তিনি পরিণত বয়সে করেছিলেন আর মহাভারত রচনা করেছিলেন বৃদ্ধ বয়সে, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের পর।

    প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, তিনি শ্রুতিলিখনে (Dictation) গণপতিদেবকে দিয়ে মহাভারত লিখিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন উঠে আসে, কোন লিপিতে লিখিয়েছিলেন? ভারতবর্ষের প্রথম যে লিপির ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়, সে লিপি ব্রাহ্মীলিপি এবং তার ব্যাপক প্রচলন করেছিলেন মৌর্য সম্রাট অশোক, তাঁর রাজত্বকালে। ব্রাহ্মীলিপির সীমিত প্রচলন তার আগেও নিশ্চিত ছিল, বণিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এবং রাজকোষগুলিতে (Treasury) – স্থূল আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখার জন্যে। মনের ভাব প্রকাশ অথবা জনগণকে লিখিত নির্দেশ দেবার জন্যে এই ভাষার প্রথম ব্যবহার করেছিলেন সম্রাট অশোক। অন্ততঃ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে সে কথাই প্রমাণ হয়। তার আগে, বৈদিক ব্রাহ্মণ্য যুগ এমনকি বুদ্ধদেবের সময়েরও কোন লিপির নিদর্শন আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে কোথাও পাওয়া যায়নি। অতএব এই সময়ে বেদ সংকলিত এবং মহাভারত রচনা হলেও, ওই সময়েই লেখা হয়েছিল কিনা, সে কথা নিশ্চিতভাবে বলার কোন অবকাশ নেই। প্রকৃতপক্ষে, মহাভারতের কাহিনী শুরুই হয়েছে, একজনের আবৃত্তি এবং অনেকের শোনার মধ্যে দিয়ে, যেমন, -
    “কোন সময়ে নৈমিষ্যারণ্যে কুলপতি শৌনক দ্বাদশ বার্ষিক যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিয়াছিলেন। একদা মহর্ষিগণ দৈনন্দিন কর্ম সমাধানপূর্বক সকলে সমবেত হইয়া কথা প্রসঙ্গে সুখে অধ্যাসীন হইয়া আছেন, ইত্যবসরে লোমহর্ষণ-পুত্র পৌরাণিক সৌতি অতি বিনীতভাবে তথায় সমুপস্থিত হইলেন। নৈমিষ্যারণ্যবাসী ঋষিগণ তাঁহাকে অভ্যাগত দেখিয়া অত্যাশ্চর্য কথা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিয়া দণ্ডায়মান রহিলেন। উগ্রশ্রবাঃ সৌতি কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাদিগকে অভিবাদন করিয়া তপস্যার কুশল জিজ্ঞাসা করিলেন। তাঁহারাও অতিথির যথোচিত পূজা করিয়া বসিবার নিমিত্ত আসন প্রদানপূর্বক আপনারাও যথাস্থানে উপবেশন করিলেন। অনন্তর সৌতি নির্দিষ্ট স্থানে উপবিষ্ট হইলে ঋষিরা তাঁহাকে বিশ্রান্ত দেখিয়া কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে কমললোচন সূতনন্দন! এখন কোথা হইতে আসিতেছ এবং এত কাল কোন্‌ কোন্‌ স্থানেই বা পর্য্যটন করিলে, তাহা আনুপূর্ব্বিক সমুদয় বল”। সৌতি এরূপ জিজ্ঞাসিত হইলে অতি শান্ত প্রকৃতি ঋষিদিগের সমক্ষে কহিতে লাগিলেন, “হে মহর্ষিগণ! আমি মহাত্মা জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে গমন করিয়াছিলাম। তথায় বৈশম্পায়নের মুখে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন-প্রোক্ত মহাভারতীয় কথা শ্রবণ করিলাম। অনন্তর তথা হইতে প্রস্থান করিয়া বহুবিধ তীর্থ দর্শন ও অনেক আশ্রমে ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে সমন্তপঞ্চক তীর্থে উপস্থিত হইলাম; - পূর্ব্বে যথায় কুরু ও পাণ্ডব এবং উভয়পক্ষীয় ভূপালদিগের তুমুল সংগ্রাম হইয়াছিল। তথা হইতে আপনাদিগের দর্শনার্থে এই পবিত্র আশ্রমে আসিয়াছি”।... (মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের মূল সংস্কৃত মহাভারতের বাংলা অনুবাদ থেকে উদ্ধৃত – বানান অপরিবর্তিত।)

    উপরের উদ্ধৃতিটুকু মহাভারতের আদিপর্বের – অনুক্রমণিকা অধ্যায়ের, প্রথম স্তবক থেকে নেওয়া। এখানে সৌতি অর্থাৎ সূত-পুত্র। বৈদিক যুগে সূত বা সূত্রধর[2]-রা পুরাণের কাহিনী এবং গল্পকথার ভাণ্ডারী ছিলেন। তাঁরা বিভিন্ন যজ্ঞে বা রাজসভায় অর্থাৎ যেখানে অনেক বিশিষ্ট মানুষের সমাবেশ হত, সেখানে পুরাণকথা শুনিয়ে বেড়াতেন। পুরাণ কথা শোনানোর উদ্দেশ্য বহুবিধ। যিনি পুরাণকথা বলছেন তাঁর এবং যাঁরা শুনছেন তাঁদের - সকলেরই অশেষ পুণ্য এবং পরমা লাভ হয়ে থাকে। একথা মহাভারত তো বটেই, যে কোন পুরাণের প্রত্যেকটি অধ্যায়ের উপসংহারে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পুণ্য সঞ্চয় ছাড়া আরও জরুরি সঞ্চয় ছিল, উপার্জন। যে রাজার যজ্ঞ অথবা সভা, তিনি এবং অন্যান্য সম্পন্ন সভাসদরাও সূতকে দক্ষিণা বা পুরষ্কার দিতে কার্পণ্য করতেন না। শোনা যায়, যেহেতু বিভিন্ন রাজ্যের রাজা এবং উচ্চমহলে তাঁদের অবাধ যাতায়াত ছিল, তাঁরা পারষ্পরিক গুপ্ত তথ্যেরও আদানপ্রদান করতেন – অর্থাৎ তাঁরা প্রচ্ছন্ন গুপ্তচরও বটেন!

    সে যাই হোক, এখানে সূত্রধর উগ্রশ্রবাঃ বলছেন, “তিনি বৈশম্পায়ন-এর মুখ থেকে সেই মহাভারত শুনেছেন, যে মহাভারত বৈশম্পায়ন শুনেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়নের মুখ থেকে – “প্রোক্ত” কথার অর্থ যা প্রকৃষ্টভাবে বলা হয়েছে। এখানে কোথাও পুঁথি বা গ্রন্থ দেখে পাঠ করা হয়েছে, এমন কথা উগ্রশ্রবাঃ বললেন না। অতএব এই সময়ে মহাভারত লিখে ফেলা হয়েছিল, এমন কথা মহাভারতেও পাওয়া গেল না।

    আমাদের দুই মহাকাব্য রামায়ণ এবং মহাভারত থেকে সমস্ত ঘটনার ঐতিহাসিক প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কষ্টসাধ্য। তবে যে জনপদগুলির নাম পাওয়া যায়, সেগুলি সবই ঐতিহাসিক, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। ঐতিহাসিকেরা বলেন, আর্যদের বিশিষ্ট কিছু গোষ্ঠীপতি রাজা এদেশে এসে উপনিবেশ গড়ে তোলার সময়, কখনও অনার্য অধিবাসীদের সঙ্গে লড়েছেন, কখনো নিজেদের মধ্যেও গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন। সেই কাহিনী চারণকবিরা অলংকৃত এবং অতিরঞ্জিত করে, প্রধানতঃ রাজসভায় কিংবা বিশেষ কোন যজ্ঞের সমাবেশে আবৃত্তি করতেন। যে রাজার যজ্ঞ, সেই রাজার এবং তাঁর পূর্বপুরুষ রাজাদের স্তুতি, স্তব এবং মহত্ব প্রচার করে, রাজাদের মনোরঞ্জন করাই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞে তাঁর প্রপিতামহ[3]দের মহিমা কীর্তনই ছিল মহাভারতের মূল কাব্য কথা। অতএব তার থেকে ইতিহাস খুঁজতে যাওয়া, খড়ের গাদা থেকে ছুঁচ খোঁজার মতোই দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা।

    যেমন মহাভারতে বলা হয়েছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের রাজ্যের রাজারা সমবেত হয়েছিলেন। সেখানে পশ্চিমে সিন্ধু নদের ওপারের রাজ্য থেকে পূর্বের আসাম, কিংবা উত্তরের পাঞ্জাব থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্য কোন রাজ্যই বাকি নেই। কিন্তু ৯০০ বি.সি.ই-র বাস্তব বিস্তার আদৌ তেমন ছিল না। পূর্বের বঙ্গ, রাঢ়, সমতট, কলিঙ্গ, পৌন্ড্র, সুহ্ম, প্রাগজ্যোতিষপুর রাজ্য বা জনপদে আর্যদের অস্তিত্ব তখনও প্রতিষ্ঠাই হয়নি। এমনকি দক্ষিণের সঙ্গে যোগাযোগও শুরু হয়েছে, কয়েকশ বছর পরে, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের হাত ধরে। অর্জুনের মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদার পাণিগ্রহণের কাহিনী বহু শতাব্দী পরে সংযুক্ত হয়েছে। সেকথা পরবর্তী পর্বে আলোচনা করা যাবে।

    ২.৫.৩ মহাভারতে সমাজ কথা

    সমাজের একক যদি ধরা হয় পরিবার, সেক্ষেত্রে পরিবারের অন্যতম সামাজিক অনুষ্ঠান বিবাহ। বিবাহ ছাড়া দাদু-ঠাকুমা-মাতা-পিতা-পুত্র-কন্যা-ভাই-বোন সম্পর্কগুলির প্রবাহ, নির্দিষ্ট অবস্থান, অধিকার ও দায়িত্ব নির্ণয় করা যায় না। এই বিবাহ সম্পর্কে মহাভারতের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গীর দিকে নজর রাখা যাক।
     
    ঋষি উদ্দালকের পুত্র ঋষি শ্বেতকেতু আর্যসমাজে প্রথম বিবাহ ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছিলেন। এই প্রসঙ্গ এসেছিল নিজের অক্ষমতার কারণে রাজা পাণ্ডু যখন পত্নী কুন্তীকে নিয়োগ প্রথায় সন্তান ধারণের কথা বোঝাচ্ছিলেন। তিনি পত্নী কুন্তীকে বলছেন, “হে সুমুখশ্রীযুক্তে, আগেকার দিনে মহিলারা অনাবৃত ছিলেন। তাঁরা ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারতেন। তাঁদের কারও অধীনে থাকতে হত না। যৌবনে তাঁরা এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষে আসক্ত হলে কোন দোষের হত না। ইতর প্রাণী অর্থাৎ পশুপক্ষীরা আজও তাই করে থাকে। উত্তরকুরু[4]তে আজও এই প্রথাই চালু রয়েছে। হে চারুহাসিনি, এই (বিবাহের) প্রথা কীভাবে এদেশে প্রচলিত হয়েছিল, বলছি শোন। প্রাচীন কালে উদ্দালক নামে এক মহর্ষি ছিলেন, তাঁর পুত্রের নাম শ্বেতকেতু। একদিন তিনি বাবা-মায়ের সঙ্গে বসে আছেন, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ এসে তাঁর মায়ের হাত ধরে বললেন, “এস, আমরা যাই”। পিতার সামনেই মাতাকে জোর করে তুলে নিয়ে যাওয়াতে মহর্ষিপুত্র ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। তাই দেখে মহর্ষি উদ্দালক বললেন, “বৎস, ক্রোধ করো না। এটাই স্বাভাবিক ধর্ম। গাভীদের মতো মহিলারাও সজাতীয় শত-সহস্র পুরুষে আসক্ত হলেও, কোন দোষের হয় না”। মহর্ষি পুত্র পিতার কথা শুনে আরও ক্রুদ্ধ হলেন এবং এরপর মানব সমাজে জোর করে এই নিয়মের প্রচলন করে বললেন, “আজ থেকে যে স্ত্রী পতি ছাড়া অন্য পুরুষের সংসর্গ করবে এবং যে পুরুষ পতিব্রতা স্ত্রীকে ছাড়া অন্য মহিলায় আসক্ত হবে, দুজনকেই ভ্রূণহত্যার মতো ঘোরতর পাপের পাঁকে লিপ্ত হতে হবে। আর স্বামী পুত্র লাভের ইচ্ছায় নিয়োগ করলে যে স্ত্রী তাঁর আজ্ঞা অমান্য করবে, তারও ওই একই পাপ হবে”। [আদি/১২২][5]

    এর অর্থ আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে আসার বেশ কয়েকশ বছর পরে, “বিবাহ” নামক প্রথম সামাজিক অনুষ্ঠানের সূত্রপাত করেছিল। মহারাজ পাণ্ডুর মুখে আমরা এই কথা যখন শুনলাম, তখনও যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম হয়নি, তাঁদের জন্ম বিষয়ে তাঁদের পিতা-মাতার মধ্যে সবে মাত্র আলোচনা শুরু হয়েছে। অতএব কুরুক্ষেত্রর যুদ্ধ যদি ঐতিহাসিক মতে ৯০০ বি.সি.-র কাছাকাছি কোন সময়ে হয়ে থাকে, তাহলে রাজা পাণ্ডু ও রাণি কুন্তীর এই কথোপকথন তার থেকে আরও বছর চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগেকার, অর্থাৎ ৯৫০ বি.সি.-র কাছাকাছি কোন সময়ের ঘটনা অনুমান করা যায়। উত্তরকুরু যদি উত্তরভারতেরই কোন অঞ্চল হয়, সেক্ষেত্রে তখনও সেখানে বিবাহ প্রথার চল শুরু হয়নি। আর উত্তরকুরু যদি কিরঘিজস্তানের কোন অঞ্চল হয়, তাহলে তো এই প্রথার প্রচলন হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নেই। কারণ, উত্তর ভারতের গাঙ্গেয় সমভূমির নতুন সামাজিক প্রথা, সে সময় সুদূর কিরঘিজস্তানে কে প্রচার করবে? তবে আর্যরা নতুন দেশের সন্ধানে কিরঘিজস্তান ছেড়ে বেরিয়ে পারস্য হয়ে, এদেশে পৌঁছতে অন্ততঃ দেড়-দু হাজার বছর সময় নিয়েছিলেন। অতএব দেড়-দু হাজার বছর আগে ছেড়ে আসা কিরঘিজস্তানের সামাজিক প্রথা নিয়ে, রাজা পাণ্ডুর মাথাব্যথা থাকার কথা নয়, অতএব নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় উত্তরকুরু উত্তর ভারতেরই কোন অঞ্চল।

    অতএব মোটামুটি ১৫০০ বি.সি.তে, মূল ভারতীয় উপমহাদেশে পা দেওয়ার পর, আর্যদের বিবাহ নামক গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানটিকে প্রথা হিসেবে প্রচলিতি করতে প্রায় তিন-চারশ বছর লেগে গিয়েছিল। এবার অনেক মানুষ প্রশ্ন তুলবেন, আর্যদের মতো তীক্ষ্ণ ধীসম্পন্ন মানুষরা যদি মাত্র ১২০০-১১০০ বি.সি.ই-তে বিবাহের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে আমি কী করে অনুমান করলাম, অনার্যদের মতো মাথামোটা মানুষেরা আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগেই সেটা বুঝে ফেলেছিল?

    এই অনুমানের প্রধানতম কারণ, অনার্যদের গড়ে তোলা সিন্ধু সভ্যতা, যার সূত্রপাত হয়েছিল, আর্যরা এদেশে আসার অন্ততঃ দু-আড়াই হাজার বছর আগে। এই পর্বে আমরা দেখেছি, প্রায় ১৭৫০ বছর ধরে একটানা টিকে থাকা সিন্ধুসভ্যতা, যা পরিবারভিত্তিক বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট গোষ্ঠীর পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এর পিছনে ছিল নিবিড় সামাজিক মৈত্রীবন্ধন ও যৌথ উদ্যোগ। আর বলা বাহুল্য, নিবিড় এই সামাজিক বন্ধন হঠাৎ একদিনে গড়ে ওঠেনি, তার পিছনে ছিল দীর্ঘদিনের পথ চলা।

    কাজেই আজ থেকে প্রায় চল্লিশ হাজার বছর আগে বিবাহের সূত্রপাত মোটেই আশ্চর্যের নয়, কারণ অনার্য মানবগোষ্ঠীই বৈবাহিক সম্পর্ক দিয়ে সমাজ গড়ে তোলার প্রাথমিক ধারণাটা আবিষ্কার করেছিল। একবার যখন এটা শুরু হয়ে গেল, এর সঙ্গে গড়ে উঠতে লাগল আরও নানারকম বৃহত্তর সামাজিক বন্ধনের উপকরণ। যার মধ্যে অন্যতম বাণিজ্য। এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রযুক্তি ও উদ্বৃত্ত সম্পদ আদানপ্রদানের মাধ্যমে।
     
    এখানে আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, চাষবাস শিখে যাওয়ার পর, এদেশের অনার্য অধিবাসীরা, নিজ নিজ অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী সামাজিক স্থিতাবস্থায় চলে এসেছিল। সামাজিক স্থিতাবস্থা মানেই, নিজেদের প্রচলিত প্রযুক্তি ও ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে থাকা এবং নতুন প্রযুক্তিকে চট করে গ্রহণ করতে প্রাথমিক অনীহা।

    উদাহরণে বলা যায়, আমাদের পিতাদের প্রজন্মে রেডিওর ব্যবহারে অনীহা ছিল – তাঁরা আশঙ্কা করেছিলেন, ছেলেমেয়েরা দিনরাত ‘লারেলাপ্পা’ গান শুনে উচ্ছন্নে যাবে। তার বছর পঞ্চাশেক বছর পরে এল সাদাকালো টিভি। বাড়িতে টিভি মানেই ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া মাথায় উঠবে। সারাক্ষণ টিভির দিকে তাকিয়ে চোখ খারাপ হবে। সন্ধে হলেই, সবাই নিজের নিজের বাড়িতে বসে টিভি দেখবে, আর আড্ডা, গল্পগাছা, আত্মীয়স্বজন, লোকলৌকিকতা চুলোয় যাবে, সামাজিকতা উচ্ছন্নে যাবে। অতএব, প্রচলিত স্থিতাবস্থা থেকে আমরা চট করে নিজেদের পরিবর্তন করতে চাই না। এই একই কারণে আমাদের প্রাচীন অনার্য ভারতীয়দের, সামাজিক পরিবর্তনের এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে যেতে সময় লাগত অনেক বেশি। ধীরে ধীরে হাজার হাজার বছর ধরে পরিবর্তন হতে হতে, সিন্ধু সভ্যতার উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে, তাদের সময় লেগেছিল প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার বছর!

    উল্টোদিকে নিজের দেশ থেকে উৎখাত হয়ে, মূলতঃ পশুপালক আর্যদের ছোট ছোট পারিবারিক গোষ্ঠীগুলি  এদেশে আসছিল ভাগ্যের সন্ধানে, তাদের উদ্দেশ্য শস্যশ্যামল প্রকৃতির বরপুত্র এই দেশে নিজেদের উপনিবেশ গড়ে তোলা। নতুন এবং অচেনা পরিবেশে স্থিতু হয়ে জাঁকিয়ে বসা। পেছনে আসা আরও আর্যগোষ্ঠী দলের তাড়া খেতে খেতে তারা যত উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে পূর্ব আর দক্ষিণদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল, ততই তারা অনার্য ভারতীয় সমাজের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছিল। পশুপালক এবং যাযাবর আর্যগোষ্ঠী ততই শিখছিল, অনেক মানুষ মিলে স্থায়ী গ্রাম বা জনবসতি গড়ে তোলার সামাজিক নিয়ম-কানুনগুলো। এভাবেই ভারতের প্রাচীন অনার্য সমাজের থেকে তারা সামাজিক বন্ধনের প্রথম চাবিকাঠি যে “বিবাহ” – সেটা বুঝে ফেলল, মাত্র সাড়ে তিনশ কি চারশ বছরের ভেতরে।

    বিশেষজ্ঞরা বলেন, অনাত্মীয়া নারী ও পুরুষের মধ্যে সাংসারিক বন্ধনের যে সামাজিক অনুষ্ঠান, যার সংস্কৃত নাম “বিবাহ”, সেই অনুষ্ঠানের অধিকাংশ রীতি ও প্রথাই এসেছে অনার্য সংস্কৃতি থেকে। অর্থাৎ পাত্র ও পাত্রীর প্রাক-বিবাহ এবং বিবাহ-পরবর্তী যাবতীয় প্রথা, সবই অনার্যদের রীতি। এর মধ্যে আর্য রীতি ঢুকেছিল যজ্ঞের অগ্নিকে সাক্ষী রেখে, সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করে বর ও কনের সারাজীবন একত্রে থাকার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ। আর্যদের অগ্নি ছিল অন্যতম অবসেসন (obsession) – জন্ম থেকে মৃতদেহ সৎকার তাদের জীবনের প্রতিটি অনুষ্ঠানের আবশ্যিক উপকরণ হল আগুন। প্রসঙ্গতঃ আর্যরাই আমাদের দেশে শবদাহের প্রথারও প্রচলন করেছিল।

    অতএব, এমন সিদ্ধান্ত করাই যায়, ঠিক এই সময় থেকেই, সংস্কৃত ভাষার মোড়কে অনার্য সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্য-ধর্মে ঢুকে পড়ল এবং সম্ভবতঃ এটাই তার হিন্দু ধর্ম হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। বিবাহ-অনুষ্ঠানের সৃষ্টি যদি ব্রাহ্মণ্যধর্মের হত, সারা ভারতে তার প্রকরণ মূলতঃ একই রকম থাকত। কিন্তু তেমনটা হয়নি, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের হিন্দুদের মধ্যে, আঞ্চলিক নিজস্ব রীতি ও প্রথায় বিচিত্র ধরনের বিবাহ-অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, যার মধ্যে অগ্নিসাক্ষী রেখে পাত্র-পাত্রীর জীবন সঙ্গী হয়ে ওঠার শপথ গ্রহণেই একমাত্র মিল দেখতে পাওয়া যায়।
      
    এই আনুষ্ঠানিক বিবাহ সহ মহাভারতে আটপ্রকার বিবাহের বিধান দেওয়া আছে, সেই আটটি হল,
    ১. ব্রাহ্ম – বরের বিদ্যা, বুদ্ধি ও বংশ বিচার করে, কন্যাকর্তা যখন কন্যাদান করেন।
    ২. দৈব - যজ্ঞের ঋত্বিকের উপর সন্তুষ্ট কন্যার পিতা যদি তাঁকে কন্যা দান করেন।
    ৩. আর্য – কন্যার শুল্কস্বরূপ বরের থেকে দুই বা ততোধিক গো গ্রহণ করে কন্যাদান।
    ৪. প্রাজপত্য– বরকে প্রচুর ধনরত্নে সন্তুষ্ট করে কন্যাদান।
    ৫. আসুর – কন্যাপক্ষকে প্রচুর ধনসম্পদে সন্তুষ্ট করে, কন্যা গ্রহণ।
    ৬. গান্ধর্ব -  বর ও কন্যার প্রণয় থেকে যে বিবাহ সম্পন্ন হয়। 
    ৭. রাক্ষস – কন্যাপক্ষ কন্যা দানে রাজি না হলেও, বর যদি গায়ের জোরে ক্রন্দনরতা কন্যাকে বিবাহ করে।
    ৮. পৈশাচ – ঘুমন্ত অথবা প্রমত্তা কন্যাকে বলাৎকার করে, রমণ করা। [অনু/৪৪]

    উপরের আটটি বিবাহ পদ্ধতির মধ্যে ব্রাহ্ম, দৈব এবং প্রাজপত্য সকলের জন্য ধর্মসঙ্গত। এই প্রথার বিবাহ অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষের অভিভাবকের সম্মতি আবশ্যিক ছিল। গান্ধর্ব ও রাক্ষস ক্ষত্রিয়দের পক্ষে চলতে পারে। আর্য ও আসুর নিন্দনীয়। পৈশাচ বিবাহ সমাজে নিন্দিত। এই বিবাহ প্রথার নিয়মগুলি থেকে আন্দাজ করা যায়, আর্য সমাজে তখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক বিবাহ অনুষ্ঠান ছাড়াও, নারী-পুরুষের কিছু নিন্দনীয় সম্পর্কও প্রচলিত ছিল। যাকে সমাজ একধরনের বিবাহ বলেই স্বীকৃতি দিয়েছে। অতএব আর্যদের প্রাচীন সামাজিক রীতির কিছুটা আভাস এর থেকে আন্দাজ করা যায়। এ ছাড়াও আরেকটি ধর্মসঙ্গত বিবাহের প্রথা ছিল, স্বয়ংবর বিবাহ। যদিচ সেই প্রথা সাধারণের জন্যে নয়, বিশেষ কোন অসামান্যা রাজকন্যার জন্যে প্রচলিত ছিল।

    যদিও ধর্মসঙ্গত প্রথাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, মহাভারতের বেশ কয়েকটি প্রধান চরিত্র, কামনা চরিতার্থ করেছিলেন। যেমন,

    দুষ্মন্ত-শকুন্তলা – শকুন্তলা তাঁর পালক পিতা কণ্বমুনির অনুমতি ছাড়া মিলিত হতে না চাইলেও, দুর্দান্ত রাজা, দুষ্মন্ত বলেছিলেন, “তোমার শরীর তোমারই অধীন, পিতার অপেক্ষার প্রয়োজন কী? আত্মাই আত্মার বন্ধু, আত্মাই আত্মার গতি। অতএব তুমি নিজেই আমাতে আত্মসমর্পণ করতে পারো”। (আদি/৭৩)  আশ্রমবাসীনি এক কিশোরীকে কামনা করে দুষ্মন্তের মতো বিখ্যাত রাজার এই প্ররোচনামূলক উপদেশ তাৎপর্যপূর্ণ বৈকি! প্রসঙ্গতঃ তাঁদের এই মিলনে জাত পুত্রের নাম, ভরত, যাঁর থেকে এই দেশের নাম ভারতবর্ষ।

    পরাশর-সত্যবতী – সর্বজনশ্রদ্ধেয় ঋষি পরাশর, কুমারী ধীবরকন্যা সত্যবতী (মৎস্যগন্ধা)-কে কামনা করায়, সত্যবতী বলেছিলেন, “ভগবন্‌, আমি পিতার অধীন, সুতরাং আপনি সংযত হন। আমার কৌমার্য নষ্ট হলে আমি কী করে পিতৃগৃহে বাস করব?” (আদি/৬৩)। কিন্তু ঋষি সে কথায় নিরস্ত হননি। মিলনের আগে তিনি কন্যাকে পদ্মগন্ধী করে তোলেন এবং  মিলনের পরেও কন্যার অক্ষত কৌমার্যের বর দিয়ে ঋষি পরাশর সত্যবতীর সঙ্গে নির্জন এক নদী-দ্বীপে মিলিত হন। তাঁদের পুত্র কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস – বেদের সংকলক ও মহাভারতের রচয়িতা! এই ধীবরকন্যা সত্যবতীই আবার ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পিতামহী এবং বেদব্যাস তাঁদের পিতা! অর্থাৎ কৌরব আর্যগোষ্ঠীর রক্তে ওতপ্রোত মিশে গিয়েছিল অনার্য রক্ত।    

    সূর্য্য-কুন্তী – মুনি দুর্বাসার বরের সত্যতা পরীক্ষা করতে কৌতূহলী কিশোরী ও কুমারী কুন্তী সূর্যকে আহ্বান করেছিলেন। সত্যি সত্যি সূর্যদেব যখন উপস্থিত হলেন, কুন্তী ভয়ে এবং লোকলজ্জায় বলেছিলেন, “দেব, আমার পিতামাতা প্রমুখ গুরুজন আমাকে দান করার অধিকারী। দয়া করে আমাকে অধর্মে লিপ্ত করবেন না”। (বন/৩০৫)। বলা বাহুল্য, সূর্যদেব কুমারী কুন্তীকে দয়া করেননি এবং তাঁদের মিলনে জাত পুত্রের নাম, কর্ণ। মহাভারতে অর্জুনের পরেই সব থেকে বর্ণময় চরিত্র।
     
    সাধারণ সমাজে পুরুষের এক বিবাহের প্রচলন থাকলেও, রাজপরিবারের বহুবিবাহ সাধারণ ঘটনা ছিল। অতি প্রাচীন পৌরাণিক কালে ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ-প্রজাপতি, তাঁর তেরটি কন্যা মারীচ-কশ্যপকে, দশটি কন্যা ধর্মকে এবং সাতাশটি কন্যা চন্দ্রকে দান করেছিলেন। মহারাজা পাণ্ডুর দুই পত্নীর - কুন্তী ও মাদ্রীর সংস্থান করেছিলেন, তাঁর পিতৃব্য মহামতি ভীষ্ম। পাণ্ডব ভাইদের যৌথ পত্নী দ্রৌপদী ছাড়াও সকলেরই অন্য পত্নী ছিলেন।

    পাণ্ডবদের পাঁচ ভাই মিলে দ্রৌপদীকে বিবাহ করা, আর্যসমাজে বিরলতম একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এই বিবাহের অনুমোদন ও আয়োজন স্থির করতে রাজা দ্রুপদের রাজসভায় বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। রাজা যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, তিনি শুনেছেন, পুরাকালে জটিলা নামের এক ধর্মপরায়ণা গৌতমবংশীয়া কন্যা সাতজন ঋষিকে বিবাহ করেছিলেন। বার্ক্ষী নামের আরেক মুনিকন্যা প্রচেতা নামের দশভাইকে বিবাহ করেছিলেন। তারপরে আরও বললেন, পণ্ডিতেরা বলেন, গুরুর আদেশই ধর্ম এবং সে আদেশ নিঃসংশয়ে পালন করা উচিৎ। পুত্রদের কাছে মায়ের থেকে পরমগুরু আর কে হতে পারেন, সেই মা-ই আমাদের এই আদেশ দিয়েছেন। কিন্তু তবুও সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছিল না, কারণ বিরোধীদের যুক্তিগুলিও ছিল অকাট্য এবং সারগর্ভ। এই সময়েই রাজসভায় উপস্থিত হলেন স্বয়ং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস। তিনি উভয়পক্ষের কথা শুনে বললেন, যুধিষ্ঠির যে কথা বলেছেন, সেটাই সনাতন ধর্ম। তাছাড়া পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর বিষয়ে আমি এমন কিছু গুহ্য তত্ত্ব বলব, যা সকলের সামনে বলা যাবে না। তিনি রাজা দ্রুপদের হাত ধরে, রাজার নিভৃত মন্ত্রণা কক্ষে গেলেন, সেখানে আর যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেন, মাতাকুন্তী, পঞ্চপাণ্ডব এবং রাজা দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন। সেখানে তিনি পঞ্চপাণ্ডব ও দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের এক পৌরাণিক কাহিনী শোনালেন। পরিশেষে বললেন, এই বিবাহ পূর্ব নির্ধারিত নিয়তির নির্দেশ, অতএব এই বিবাহে কোন ভাবেই কোন অধর্ম ঘটতে পারে না। (আদি/১৯৬,১৯৭)

    সে সময় কিন্নরদেশে (আধুনিক হিমাচলের একটি জেলা) নারীর বহুস্বামীত্ব (Polyandry) প্রচলিত ছিল এবং আজও নাকি কিন্নরের কোন কোন গ্রামে এমন প্রথার প্রচলন আছে। মহাভারত এবং পুরাণে কিন্নরী নর ও নারীদের গীত ও রূপের প্রশংসা করা হয়েছে বারবার। অতএব অনার্য কিন্নরদের সঙ্গে আর্যদের ঘনিষ্ঠ পরিচিতি ছিল, একথা সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে পৌরাণিক কাহিনীর মোড়কে, দ্রৌপদীর পঞ্চ-স্বামীত্ব হয়তো কিন্নরী প্রথার অনুসরণ!

    বিবাহের অনুষ্ঠান ছাড়াও রাজপরিবারে বংশরক্ষার জন্যে নানাবিধ উপায় তখন বহুল প্রচলিত ছিল। নিঃসন্তান বিধবা এমনকি সধবা নারীদেরও নিয়োগ-প্রথায় সন্তান ধারণ করতে হত। সাধারণতঃ এই নিয়োগের পুরুষরা হতেন, পতির ভাই বা গুণসম্পন্ন কোন সৎ-ব্রাহ্মণ। আবার অন্যদিকে বিবাহের অনুষ্ঠান ছাড়াই, রাজন্যবর্গ এবং উচ্চশ্রেণীর মানুষেরা অন্তঃপুরের দাসীদের সঙ্গেও কামনা চরিতার্থ করেছেন বারবার। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে রাণিরাও অবাঞ্ছিত পুরুষদের সংস্রব এড়াতে দাসীদের ব্যবহার করেছেন। অতএব রাজা বা ধনী ঘরের প্রভু এবং প্রভুপত্নীরা তাঁদের খেয়ালখুশি মতো দাসীদের যেমন ইচ্ছা ব্যবহার করতেন। মহাভারত থেকে দু একটা উদাহরণ দিলে, এই দুটি বিষয়ই স্পষ্ট হবে।
     
    কুরুবংশ রক্ষার কারণে, অকালে মৃত রাজা বিচিত্রবীর্যের দুই নিঃসন্তান পত্নীতে রাজমাতা সত্যবতী মহর্ষি বেদব্যাসকে নিয়োগ করেছিলেন। এই বেদব্যাস ছিলেন, রাজামাতা সত্যবতীর কুমারী বয়সের পুত্র, অতএব রাজা বিচিত্রবীর্যের বৈপিত্রেয়[6] দাদা, বিধবা দুই বধূর ভাসুর। বিধবা দুই রানী, অম্বিকা ও অম্বালিকা মহর্ষির রূপ ও চেহারায় মোটেই স্বস্তি পাননি। অম্বিকা চোখ বন্ধ করে এবং অম্বালিকা ভয়ে বিবর্ণ হয়ে মহর্ষিকে শয্যায় সহ্য করেছিলেন। যার ফলে, অম্বিকার পুত্র হল জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র এবং অম্বালিকার পুত্র পাণ্ডুর[7] বর্ণের পাণ্ডু। পৌত্রদের দেখে রাজমাতা সত্যবতী খুশি হলেন না, তিনি পুত্র বেদব্যাসকে আরেকবার অম্বিকার জন্য নিয়োগ করলেন। কিন্তু অম্বিকা এবার নিজে না গিয়ে, তাঁর বিশ্বস্ত এক দাসীকে মূল্যবান বস্ত্র ও অলংকারে রাণি সাজিয়ে শয্যায় পাঠালেন। সেই শূদ্রাদাসী ভক্তিভরে মহর্ষিকে গ্রহণ করলেন, তাঁর পুত্র হলেন, মহাত্মা বিদুর।

    অন্ধতার কারণে জ্যেষ্ঠ পুত্র হয়েও ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারলেন না, কুরু বংশের সিংহাসনে বসলেন পাণ্ডু। বেশ কিছুদিন দাপটে রাজত্ব করার পর, তিনি দুই পত্নী সহ রাজ্য ছেড়ে বনবাসী হলেন। শারীরিক অক্ষমতায় তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। এই বনবাসের সময়, স্বামীর সকরুণ অনুরোধে, দুর্বাসা মুনির থেকে পাওয়া বরের সাহায্যে রাণি কুন্তী তিনটি পুত্রের জন্ম দিলেন, যুধিষ্ঠির, ভীম ও অর্জুন, যথাক্রমে ধর্মদেব, পবনদেব ও দেবরাজ ইন্দ্রের প্রসাদে। তারপর স্বামী ও সতীন মাদ্রীর একান্ত অনুরোধে, কুন্তী মাদ্রীকেও যমজ পুত্রের জন্ম দিতে সাহায্য করলেন, নকুল ও সহদেব, দেবযুগল অশ্বিনীকুমারের প্রসাদে।

    গান্ধারী তাঁর সুদীর্ঘ গর্ভাবস্থায় যখন কাতর হয়ে পড়েছিলেন, এক বৈশ্যা পরিচারিকা রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পরিচর্যা করতেন। তাঁর গর্ভে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র যুযুৎসুর জন্ম হয়। পাণ্ডবেরা যখন বিরাটনগরে অজ্ঞাতবাসে ছিলেন, সেসময় দ্রৌপদী সৈরিন্ধ্রী ছদ্মনামে রাণি সুদেষ্ণার পরিচারিকা ছিলেন। বিরাট রাজের শ্যালক ও সেনাপতি কীচকের হাতে, রাণি সুদেষ্ণার প্ররোচনায় এবং বিরাট রাজার ঔদাসীন্যে, সৈরিন্ধ্রীকে যে ভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়েছিল, তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, অন্তঃপুরের দাসীদের কতটা দুর্গতি নীরবে সহ্য করতে হত। এমনকি কৌরব রাজসভায়, পাশা খেলায় সর্বস্ব হারানো পাণ্ডব-পত্নী দ্রৌপদীকে “দাসী” সম্বোধন করে, দুর্যোধন, দুঃশাসন এবং কর্ণ যে আচরণ করেছিলেন, তার থেকেও দাসী সম্পর্কে তাঁদের কদর্য ধারণাই স্পষ্ট হয়। বস্তুত মহীয়সী নারী দ্রৌপদীর বারবার ভাগ্য বিড়ম্বনা না ঘটলে, রাজান্তঃপুরের পরিচারিকা ও দাসীদের দুর্গতির কথা আমরা হয়তো জানতেও পারতাম না।

    মহাভারত গ্রন্থের এইখানে অনন্যতা, রাজা-রাজড়াদের স্তব-স্তুতি মূলক অতিরঞ্জন বর্ণনা যেমন আছে, তেমনই আছে এমনই লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা অনেক ঘটনার উদ্ঘাটন। এবার আমরা মূল আলোচনায় আবার ফিরে যাই।  

      
    ২.৫.৪ বর্ণভেদের সমাজ

    শুরুতে আর্যদের গোষ্ঠীতে প্রাথমিক ভাবে কোন বর্ণভেদ ছিল না। খুবই স্বাভাবিক, পরিবারভিত্তিক গোষ্ঠীর একই পরিবারের মধ্যে বর্ণভেদ হয় কী করে? অন্য পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে যুক্ত হয়ে যখন সমাজ গড়ে উঠতে লাগল, তখনই বর্ণভেদের সূত্রপাত। প্রথম দিকে পারিবারিক গোষ্ঠীর সদস্যরা সকলেই ব্রাহ্মণ ছিলেন, কারণ ভগবান ব্রহ্মা ছিলেন তাদের সবার পিতামহ। তবে সেই ব্রাহ্মণ চতুর্বর্ণের ব্রাহ্মণ নন, বলাই বাহুল্য।
     
    আর্যদের বহু গোষ্ঠী এবং অনার্য মানুষদের নিয়ে যখন বৃহত্তর সমাজ গড়ে ওঠার সূত্রপাত হল, তখন দেখা গেল, কিছু মানুষ চিন্তাভাবনা, শাস্ত্র-টাস্ত্র এবং ঈশ্বরের ধ্যান নিয়ে শান্তিতে থাকতে ভালোবাসেন - এগুলি তাঁদের সত্ত্বগুণ। কিছু মানুষের স্বভাব মারকুটে, হাঁকডাক করা এবং কর্তৃত্ব ফলানো – এগুলি রজোগুণ। কিছু মানুষের স্বভাব সারাদিন কিছু না কিছু কাজ করে যাওয়া। অনার্যদের থেকে শিখে কেউ চাষবাস করছে, মাটির পাত্র, হাঁড়ি-কলসি বানাচ্ছে। কাঠ দিয়ে রথের চাকা, আসবাবপত্র বানাচ্ছে। লোহা পিটিয়ে যন্ত্রপাতি অস্ত্র-শস্ত্র বানাচ্ছে। এগুলির কিছু রজো আবার কিছু তমোগুণ। আবার কিছু মানুষ একটু বোকাসোকা ধরনের। নিজে থেকে তেমন কিছুই করতে পারে না, কিন্তু অন্যে বলে দিলে, মন দিয়ে সে কাজটা করতে পারে অথবা অন্যের সেবা করতে পারে – এটি তমোগুণ। এই ভাবেই গুণগতভাবেও চার বর্ণের সূত্রপাত হল, যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র (শান্তি/১৮৮)। প্রসঙ্গতঃ মহাভারতের এই অধ্যায়েই বলা হয়েছে, ভগবান্‌ ব্রহ্মা “দেব, দানব, গন্ধর্ব, দৈত্য, অসুর, যজ্ঞ, রাক্ষস, নাগ, পিশাচ এবং ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চতুর্বিধ মনুষ্যজাতির” সৃষ্টি করেছিলেন। কাজেই এই পর্যায়ে শুধু আর্যরাই ব্রহ্মার সন্তান – এমন সীমিত ধারণা থেকে পিতামহ ব্রহ্মার মুক্তি মিলল।     

    সামাজিক এই বিন্যাস নিয়ে মানুষের মনে যাতে কোন বিভ্রান্তি না আসে তার পেছনে একটা ধর্মীয় মোড়ক প্রয়োজন। আগে সব মানুষের সৃষ্টি হয়েছিল ব্রহ্মার থেকে, এখনও তাঁরা তাই রইলেন। কিন্তু তাঁদের জন্মস্থান বদলে গেল। ব্রাহ্মণদের জন্ম হল ভগবান ব্রহ্মার মুখ থেকে, তাঁর বাহু থেকে ক্ষত্রিয়দের, উরু থেকে বৈশ্যদের এবং পা থেকে শূদ্রদের (ভীষ্ম/৬৭)। এবং তাঁদের মধ্যে সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ– এই তিনটি গুণগত পার্থক্য দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হল, কেন তাঁরা একে অপরের থেকে আলাদা ও নিকৃষ্ট। চার বর্ণের আরও একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রত্যেকটি বর্ণই জন্মগত বর্ণ। অর্থাৎ জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণের সন্তান ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়ের সন্তান ক্ষত্রিয়, ইত্যাদি।

    প্রত্যেক বর্ণেরই প্রধান কর্মসমূহ নির্দিষ্ট ছিল, যার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু বর্ণ অনুযায়ী কর্ম না করলেও ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণত্ব নষ্ট হত না। যেমন পরশুরাম, কৃপাচার্য, দ্রোণাচার্য এবং তাঁর পুত্র অশ্বত্থামা, এঁরা সকলেই ভয়ংকর যোদ্ধা এবং প্রথম তিনজন তো রণশিক্ষকও। তাঁদের কাজ-কর্ম আচার আচরণ দেখে ব্রাহ্মণ বলে যেন মনেই হয় না, বরং নিঃসন্দেহে ক্ষত্রিয়বর্ণ অনুসারী। কিন্তু তাও তাঁরা ব্রাহ্মণ। আচার্য দ্রোণকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্ন নিহত করেছিলেন বলে, তিনি ব্রহ্মহত্যার পাতকী হয়েছিলেন। একজন ব্রাহ্মণ বেদ-চর্চা ও যাগ-যজ্ঞ ছেড়ে, রণক্ষেত্রে অজস্র শত্রুসৈন্য হত্যা করলেন, তাতে বিন্দুমাত্র দোষ হল না। কিন্তু সেই রণক্ষেত্রেই তাঁকে হত্যা করার জন্যে একজন ক্ষত্রিয় পাতকী হয়ে গেলেন! অশ্বত্থামা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্তে কাপুরুষের মতো রাতের অন্ধকারে পাণ্ডব শিবিরে ঢুকে শিশু ও বালকদের হত্যা করেছিলেন, তাঁকে অভিশাপ এবং শাস্তি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু অর্জুন, ভীম এবং ভগবান কৃষ্ণ তাঁকে হত্যা করেননি, তিনি ব্রাহ্মণ বলে। অতএব জন্মানোর সঙ্গেসঙ্গেই  পিতা-মাতার বর্ণ সন্তানদের বর্ণ হয়ে যেত। তবে কোন ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় অত্যন্ত গর্হিত কাজ করলে বা অনাচার করলে, শূদ্রসম-ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় হয়ে যেতেন এবং সমাজে পতিত হয়ে যেতেন (অনু/১৩৫)। যেমন অশ্বত্থামা হয়েছিলেন।

    কিন্তু নিম্ন বর্ণের মানুষ ব্রাহ্মণের মতো জ্ঞানী ও ধার্মিক হলেও, তাঁকে ব্রাহ্মণসম-শূদ্র বলার নিয়ম ছিল না। যেমন শূদ্রা দাসীর গর্ভজাত মহর্ষি বেদব্যাসের পুত্র বিদুর। তাঁকে অধিকাংশ সময়েই মহাভারতে “মহাত্মা বিদুর” বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর মতামত এবং পরামর্শকে পাণ্ডবরা, রাজা ধৃতরাষ্ট্র, মহামতি ভীষ্ম অত্যন্ত সম্মান করতেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে দৌত্য করতে এসে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কৌরবদের আতিথ্য স্বীকার না করে, বিদুরের গৃহে রাত্রিযাপন করেছিলেন, তবুও তিনি ব্রাহ্মণ-সম হতে পারেননি। তুলাধার নামে বারাণসীর এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর নাম জানা যায়, যিনি বর্ণে বৈশ্য কিন্তু ধর্মতত্ত্বে বিশেষ প্রাজ্ঞ ছিলেন। (শান্তি/২৬১, ২৬২)। মিথিলা নগরীর এক মাংসবিক্রেতা ব্যাধ, মহাভারত যাঁকে ধর্মব্যাধ বলে বিশেষ সম্মান দেখিয়েছেন, তিনিও ধর্মশাস্ত্রে মহাপণ্ডিত ছিলেন। ধর্মব্যাধ শূদ্র এবং তুলাধার বৈশ্য ছিলেন বলেন, শূদ্র বা বৈশ্যদের গর্ব করার কোন কারণই নেই। কারণ মহাভারত রচয়িতা, মনে করিয়ে দিয়েছেন, এঁরা দুজনেই পূর্বজন্মে ঋষি ছিলেন, সেই জন্মের সামান্য ভুলের জন্যে শাপগ্রস্ত হয়ে, এ জন্মে যথাক্রমে শূদ্র ও বৈশ্য হয়েছেন। এই জন্মে তাঁরা সুকর্ম করছেন, অতএব পরজন্মে তাঁরা আবার ঋষিই হবেন, এই জন্মের বৈশ্যত্ব বা শূদ্রত্ব নিছক কালক্ষেপ মাত্র! অর্থাৎ জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো, এই আপ্তবাক্য ব্রাহ্মণ্য সমাজের ক্ষেত্রে খাটে না।

    এমন উদাহরণ আরও আছে, যেমন, সূতপুত্র কর্ণ যখন আচার্য দ্রোণের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র শিখতে এসেছিলেন, তিনি কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কারণ কর্ণ ব্রাহ্মণ নন। কিন্তু তিনি ক্ষত্রিয় অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্র শিক্ষা দিয়েছিলেন। প্রিয় শিষ্য অর্জুনের প্রতিদ্বন্দ্বীকে এড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই তিনি এমন অজুহাত খাড়া করেছিলেন। যেমন নিষাদ-রাজপুত্র একলব্যের শর-সন্ধানে আশ্চর্য দক্ষতা দেখে, তাঁর থেকে গুরুদক্ষিণা হিসেবে, ডান হাতের বুড়ো আঙুল কেটে নিয়েছিলেন। অথচ একলব্য নিষাদ বলে, আচার্য দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণই করেননি হননি। এই দুটি ঘটনা থেকেই আচার্য দ্রোণের ব্রাহ্মণত্ব এবং তাঁর সাত্ত্বিক গুণ সম্পর্কে ঘোরতর সন্দেহ হয় বৈকি!

    চতুর্বর্ণের বাইরেও মহাভারতে বেশ কয়েকটি জাতির নাম পাওয়া যায়। এই জাতিগুলির নামকরণ প্রধানতঃ তাঁদের বৃত্তি অনুযায়ী হলেও, মহাভারতে তাঁদের বর্ণসংকর বলে হেয় করা হয়েছে। যেমন, সৈরন্ধ্র জাতি, রাজা ও ধনী পুরুষদের পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজগোজ এবং সৈরিন্ধ্রীরা রাণি ও অন্তঃপুরিকাদের সাজসজ্জা ও প্রসাধনে নিযুক্ত ছিলেন। এই কারণেই বিরাটরাজার অন্তঃপুরে ছদ্মবেশীনি দ্রৌপদী, সৈরিন্ধ্রী নাম নিয়ে রাণি সুদেষ্ণার কেশবিন্যাস ও প্রসাধনের পরিচারিকা হয়ে ঢুকেছিলেন। সূত জাতি, সাধারণতঃ রাজাদের রথের সারথি হতেন, আবার তাঁরা প্রায়ই রাজাদের স্তবগান এবং কথকতা, ধর্মকথা শোনাতেন। বৈদেহক নামে একটি জাতির নাম পাওয়া যায়, যাঁদের দায়িত্ব ছিল, রাজপ্রাসাদ এবং অন্তঃপুর পাহারা দেওয়া এবং সুরক্ষিত রাখা। মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীদের যাঁরা মুণ্ডচ্ছেদ করতেন, তাঁদের চণ্ডাল জাতি বলা হয়েছে। বস্ত্র ও কাপড়চোপড় পরিষ্কারের দায়িত্ব ছিল রজক জাতির। রাজসভায় উপস্থিত থেকে রাজা ও অন্যান্য রাজ-অতিথির বন্দনা করতেন বন্দী জাতির মানুষরা। নিষাদ জাতির কাজ ছিল মাছধরা। মদ প্রস্তুত করতেন, মৈরেয়ক জাতি। মাছধরা কিংবা অন্যকাজের জন্যেও যাঁরা জাল বুনতেন, তাঁদের আয়োগব জাতি বলা হয়েছে। দাস জাতির মানুষেরা নৌকা বানিয়ে এবং নৌকা চালিয়ে জীবিকা অর্জন করতেন।(অনু/৪৮)।  যাঁরা চিকিৎসা করে, অসুস্থকে নিরাময় করতেন, তাঁরা হলেন, অম্বষ্ঠ বা বৈদ্যজাতি। এরকম আরও কিছু বর্ণসংকর জাতির নাম পাওয়া যায়, যাঁদের বৃত্তি সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা পাওয়া যায় না, যেমন, উগ্র, শ্বপাক, পুক্কশ, স্তেন, মাগধ, করণ, ব্রাত্য ইত্যাদি। (শান্তি/২৯৭)। এই ধরনের জাতিগুলিকে বর্ণ-সংকর বলে, সমাজে নিজেদের বর্ণাশ্রমকে শ্রেষ্ঠতা প্রতিপন্ন করাই যে সমাজরক্ষকদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, একথা সহজেই অনুমান করা যায়।

    ২.৫.৫ সামাজিক ক্ষোভ ও অসন্তোষ

    সামাজিক এই শ্রেণী বিভাগে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছিল শুরুর থেকেই। এতদিন যারা নিজেদের সুখ-দুঃখ নিয়ে নিজেদের সামাজিক ব্যবস্থায় অভ্যস্ত ছিল, নতুন বিভাজনে তাদের মনে ক্ষোভ ও বিরক্তি আসবেই। ব্রাহ্মণরাও তার আঁচ বুঝতে ভুল করেনি। তারা এই অসন্তোষ এবং ক্ষোভ প্রশমনের দাওয়াই নিয়ে এল - জন্মান্তর। এই জন্মে তোমরা যে কষ্ট পাচ্ছো, তার কারণ তোমাদের পূর্বজন্মের কৃতকর্ম। এই জন্মে মন দিয়ে নিজেদের কাজ করো, উচ্চশ্রেণীর সেবা করো। ঝগড়াঝাঁটি, ঝুটঝামেলা বাধিও না, পরজন্মে তোমাদেরও ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় ঘরে জন্ম হবে, তখন সুখই সুখ।

    ক্ষোভ এবং অসন্তোষ যতই হোক, অসহায় অনার্যদের কিছু করারও ছিল না, শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। এমনকি তাদের এতদিনের ভরসা দেব-দেবীদের কাছে আকুল প্রার্থনা করার স্বাধীনতাটুকুও তারা হারিয়ে ফেলছিল। সেখানেও আর্য মানুষেরা বিদ্রূপ করে, অবহেলা করে, কখনো কখনো তাদের দেব-দেবীর মূর্তি ছুঁড়ে ফেলে দিল আবর্জনায়[8]। আর্যদের দেবতা ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ। তাঁদের জন্যে আছে গ্রামভারি মন্ত্র, যজ্ঞ, যজ্ঞের আগুনে আহুতি। সে মন্ত্রের ভাষা সাধারণ অনার্যদের কাছে দুর্বোধ্য। তারা দূর থেকে দেখে, পুরোহিতদের গম্ভীর আচরণ, তাদের পোষাক-পরিচ্ছদ, মন্ত্রের উচ্চারণ, যজ্ঞের আগুনে প্রচুর ঘি এবং প্রচুর আহুতি দান। যজ্ঞের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় গ্রাম। যজ্ঞশেষের ছাই উড়তে থাকে বাতাসে।

    এই যজ্ঞের সমস্ত উপচার, অনার্য দাসেরাই সংগ্রহ করে দেয়। যজ্ঞের বেদী নির্মাণ, বিপুল সমিধসম্ভার, তৈজসপত্র, ঘি, দুধ, শস্য, ফল-মূল সর্বত্র তাদেরই হাতের স্পর্শ। যজ্ঞ শেষে পুরোহিতরা দক্ষিণা হিসাবে তাদের ঘরে নিয়ে যায় যে বিপুল সম্পদ – সোনা, রূপো, সবৎসা-গাভী, অজস্র শস্য সম্ভার, ধাতব কিংবা মাটির পাত্র – সে সবই অনার্য বৈশ্য ও শূদ্রদের পরিশ্রমের উৎপাদন। অথচ তারা বুঝতেই পারে না, দেবতারা কারা। পুরোহিতরা কাদের জন্যে যজ্ঞ করছেন। যে মন্ত্র তাঁরা বলছেন, তার মধ্যে কোথাও কী আছে বিপুল এই অনার্য শ্রমের সামান্যতম স্বীকৃতি? কঠোর শ্রমের পরিবর্তে অসহায় তাৎপর্যহীন এই জীবন তাদের ঠেলে দিতে লাগল আরও নিরাশার দিকে। মনে মনে আকুল প্রার্থনায় তারা আরও বেশি করে মাথা কুটতে লাগল তাদের নিজস্ব দেবতাদের পায়ে।
     
    চলবে...
    (দ্বিতীয় পর্বের ষষ্ঠ ও অন্তিম ভাগ আসবে  ২৭/০৫/২০২২ তারিখে)
     
     
    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১) The penguin history of Early India – Romila Thapar
    ২) The wonder that was India – A. L. Basham.
    ৩) মহাভারতের সমাজ - শ্রীযুক্ত সুখময় শর্মা। 
    ৪) মহাভারত (মূল সংস্কৃত হইতে বঙ্গানুবাদ)–মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ।
    ৫) শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলা অনুবাদ (চিরসখা হে) – কিশোর ঘোষাল

    [1] তখনকার বঙ্গের পুরোটাই প্রায় আধুনিক পূর্ব-বিহার।

    [2] সূত্রধরের প্রচলিত অর্থ ছুতোর – অর্থাৎ যাঁরা টুকরো-টুকরো কাঠ জুড়ে কাঠের দ্রব্যাদি বানান। আবার সংস্কৃত শাস্ত্র বা নাটকের শ্লোকগুলিকে “সূত্র” বলা হয়, সেই সূত্রগুলি যাঁরা স্মরণে রাখেন তাঁরাও সূত্রধর। 

    [3] অর্জুন > অভিমন্যু > পরীক্ষিৎ > জন্মেজয় – অতএব পঞ্চপাণ্ডব জন্মেজয়ের প্রপিতামহ।  

    [4] উত্তরকুরুর অবস্থান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ আছে। তাঁদের কেউ বলেন, কুরু রাজ্যের উত্তরে, হিমালয়ের পাদদেশে উত্তরকুরুর অবস্থান। কেউ বলেন, উত্তরকুরু আর্যদের আদি বাসস্থান - কিরঘিজস্তানের কোন অঞ্চল, আবার কেউ বলেন, উত্তরকুরুর বাস্তবে কোন অস্তিত্বই নেই।    

    [5] মহাভারতের যে পর্বের যে অধ্যায় থেকে উদ্ধৃতিগুলি নেওয়া হয়েছে, এটি তার সংকেত। আদি/১২২-এর অর্থ আদি পর্বের ১২২ তম অধ্যায়। এই পদ্ধতি সর্বত্রই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি।  

    [6] বৈপিত্রেয় বলে বাস্তবে কোন শব্দ আমি পাইনি, কিন্তু পিতার একাধিক পত্নীর সন্তানেরা যেমন পরষ্পরের “বৈমাত্রেয়” ভাই বা বোন হয়, তেমনি একই মাতার একাধিক স্বামীর সন্তানদের “বৈপিত্রেয়” ভাই বা বোন বলা যেতেই পারে।

    [7] পাণ্ডুর বর্ণের অর্থ - “শ্বেতপীত, ফ্যাকাসে, শ্বেত” [শব্দকোষ]।

    [8] এ ধরনের ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি, কিন্তু পরবর্তী কালে আমরা এরকম ঘটনার অজস্র উদাহরণের সম্মুখীন হবো, এবং আমরা বুঝতে পারবো ব্রাহ্মণ্য সমাজ কোনদিনই পরমতসহিষ্ণু ছিল না, বরং নৃশংস বিরোধিতায় অভ্যস্ত ছিল।   
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২০ মে ২০২২ | ১৮৭৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • &/ | 151.141.85.8 | ২৭ মে ২০২২ ০৩:২২508101
  • সেই বেপথু কেস। লোকে ভাবে বিপথগামী। কিন্তু আসল অর্থ কম্পমান। ঃ-)
  • হীরেন সিংহরায় | ২৭ মে ২০২২ ০৩:৪১508103
  • অসাধারন লিখছেন। শিখছি। শেখা ও জানার শেষ নেই 
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন