এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - প্রথমপর্ব / ২য় ভাগ

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১২ মার্চ ২০২২ | ১৩৭০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৩ জন)
  • ১.২ আগুনের সীমিত ব্যবহার
     
    দুটো পাথরে ঠোকাঠুকি করলে ছোটখাটো যে আগুনের ফুলকি দেখা যায়, তা দিয়ে কিন্তু আগুন জ্বালানো যায় না। আগুন জ্বালানোর জন্য অনেক বড়ো ফুলকির দরকার হয়, আর যে দুটো পাথর ঘষে আগুন জ্বালানোর মতো ফুলকি তৈরি করা যেত তারা প্রধানতঃ হল ফ্লিন্ট (Flint) আর পাইরাইট (Pyrite) পাথর। এই পাইরাইট যদি লোহা মিশ্রিত হয়, তবে তার ফুলকি হয় সবচেয়ে জোরদার। চক বা চুণাপাথরের (Lime stone) মধ্যে কেলাসিত (crystallized) একটি বিশেষ কোয়ার্জ (Quartz) পাথরকে ফ্লিন্ট বলে। 
     

     
    উপরের ছবিটি প্রস্তর যুগের একটি ফ্লিন্ট পাথরের অস্ত্র[1]।  এই ফ্লিন্ট পাথরের বিশেষত্ব হল, একটা বিশেষ দিক থেকে আঘাত করলে, বেশ পাতলা, মসৃণ অথচ শক্ত স্তরে ভেঙে যায়। তারপর একটু ঘষাঘষি করলে, পাথরের ধারালো অস্ত্র বানিয়ে তোলা যেত সহজেই। প্রস্তর যুগের মানুষেরা যখন পাথরের অস্ত্রশস্ত্রই বহুল ব্যবহার করত, তাদের কাছে ফ্লিন্ট পাথরের অস্ত্র ছিল সব থেকে কাজের জিনিষ। আর পাইরাইট একধরনের খনিজ পাথর, প্রধানত লোহা বা তামার সালফাইড; পাললিক (sedimentary) পাথরের স্তরে মাঝে মধ্যেই পাওয়া যায়। বহুদিন পরে মানুষ যখন লোহা আবিষ্কার করতে পেরেছিল, তখনও লোহা আর এই ফ্লিন্ট পাথরের ঘর্ষণে আগুনের ফুলকি ব্যবহার করেই আগুন জ্বালাত। সত্যি বলতে ইলেক্ট্রনিক লাইটার আবিষ্কারের আগে, সেই সেদিন পর্যন্ত আমরা যে গ্যাসলাইটারে লোহার চাকায় চাপ দিয়ে আগুন জ্বালতাম, তার নিচেয় থাকত ফ্লিন্ট পাথরের ছোট্ট একটা কুচি, যাকে চলতি বাংলায় আমরা চকমকি পাথর বলি। অতএব ইরেক্টাস প্রজাতির সেই ছোকরা মানব দৈবাৎ যে পাথরে আগুনের ফুলকি খুঁজে পেয়ে আশ্চর্য হয়েছিল, সেটি ছিল এই Flint stone-এর টুকরো।
     
    তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, কয়েক লক্ষ বছর ধরে ইরেক্টাস এবং নিয়াণ্ডারথাল মানব প্রজাতি নিয়মিত আগুন ব্যবহার করলেও (অধ্যায় ১.১-এর সারণি দেখুন), তারা আগুনের সীমাহীন সম্ভাবনার কথা চিন্তাই করতে পারেনি। শুরুর দিন থেকেই তারা আগুনের ব্যবহার করেছিল রাতের অন্ধকারে বন্যপশুদের আক্রমণ থেকে তাদের আশ্রয়গুলিকে নিরাপদ রাখতে। আর প্রচণ্ড ঠাণ্ডার দিনে আগুনের তাপে হাত-পা গা সেঁকে একটু আরাম উপভোগ করতে। এছাড়া আগুনের অন্য কোন ব্যবহারের নিদর্শন প্রত্নবিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি।
    কিন্তু আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ - পঞ্চান্ন হাজার বছর আগে আগুনের আরেকটি চমকপ্রদ গুণ আবিষ্কার করে ফেলেছিল, আমাদের পূর্বপুরুষ - হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ। সেটাও একটা দৈবাৎ ঘটনা, কিন্তু তার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। পৃথিবীতে আমরা যে আজ শ্রেষ্ঠ এবং সব থেকে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি, তার সূচনা হয়েছিল সেই দিনটিতেই। কল্পনায় সেদিনের ঘটনাটার দিকে একটু চোখ ফেলা যাক। তারপর আলোচনা করা যাবে এই আবিষ্কারের আশ্চর্য ফলাফলের।
    ১.২.১ দাবানলের অভিজ্ঞতা
    এবার আমি পৌঁছে গেছি আজ থেকে পঞ্চাশ - পঞ্চান্ন হাজার বছর আগের এক রাতে। ছোট্ট এক পাহাড়ের মাথায় বসে, পাহাড়তলির জঙ্গলে আমি ভয়ংকর এক দাবানল দেখছি। আমার সামনে বেশ বড়ো একটা গুহা আর তার সামনে অনেকটা সমতল জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির একটি বড়ো দল। ছেলে-মেয়ে, ছোকরা-ছুকরি, প্রৌঢ়া-প্রৌঢ়, বুড়োবুড়ি সবাই বসে বসে নিরীক্ষণ করছে, নিচের অরণ্যের তাণ্ডব দহন। চোখ ঝলসানো কমলা রঙ আর তার সঙ্গে উজ্জ্বল হলুদের লকলকে শিখায় আকাশের গায়েও যেন আগুনের রঙ ধরেছে। ঘন ধোঁয়ার কুণ্ডলী বয়ে তপ্ত বাতাস আমাদের শরীরেও মাঝেমাঝে জানান দিয়ে যাচ্ছে ওই আগুনের তীব্রতার আঁচ।
     
    ছোট বড়ো গাছের কাণ্ড আর ডালপালা দাউ দাউ আগুনে ফট-ফট, মটমট শব্দে ফাটছে। তাদের ডালে ডালে বাসা বেঁধে থাকা পাখিরা তীব্র ভয়ে ডাকতে ডাকতে উড়ে পালাচ্ছে। আর কত পাখি যে বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঝরে পড়ছে আগুনের মধ্যে, তার কোন হিসেব নেই। জঙ্গলের জন্তু জানোয়ারেরাও চিৎকার করতে করতে দিশাহারা হয়ে দৌড়চ্ছে। কত প্রাণী জ্বলতে জ্বলতে পড়ে গেল আগুনের মধ্যে, তারও কোন ইয়ত্তা নেই।  তপ্ত বাতাস বয়ে আনছে তাদের মরণ আর্তনাদের আওয়াজ, আর রোম ও চামড়া পোড়া উৎকট গন্ধ। সে আওয়াজ আর গন্ধ মৃত্যুভয়ের কাঁপন তুলছে মানুষগুলোর পাঁজরেও। ওই আগুন উঠে এসে ছোট্ট এই পাহাড়ের মাথার বসতিকেও গ্রাস করে নেবে না তো? তাঁরাও কী নিচের ওই জন্তু জানোয়ারের মতো চিৎকার করতে করতে ঝলসে পুড়ে মারা যাবেন?
     
    সারারাত পুরো দলটা দু চোখে আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে রইলেন নিচের আগুনের দিকে। অবুঝ শিশুরা ছাড়া কেউই ঘুমোনোর কথা ভাবতেও পারেননি। এই দলের প্রবীণতম মানুষটিও ঠায় বসেছিলেন গুহামুখের বাইরে। নিঃশব্দে তাকিয়ে ছিলেন নিচের জঙ্গলের দিকে।
     
    তেমন কোন বিপদ অবিশ্যি ঘটল না। শেষ রাতের দিকে আগুন ঝিমিয়ে এল, যদিও অজগর সাপের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছিল সর্বত্র। মধ্যবয়স্ক এক মানুষ, খুব ক্লান্তির মধ্যেও স্বস্তির সুরে বৃদ্ধকে বললেন, “এবার মনে হচ্ছে, আগুনটা নিভে যাওয়ার মতো হয়েছে, তাই না বাবা?”
    এই বৃদ্ধের পাঁচ পুত্র, সাত কন্যা। তাদের মধ্যে তাঁর বড়ো কন্যাই এই দলের নেত্রী। তিনি রাতজাগা ঘোলাটে চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় বললেন, “মনে তো হচ্ছে তাই। জন্তুদের ভয় দেখাতে রোজ রাত্রে আমরা যে আগুন জ্বালি। সেই আগুনই কী ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, দেখলি?" বৃদ্ধের দুর্বল ঘাড়ের ওপর মাথা নড়তে লাগল, কাঁপতে থাকা দুই হাত জড়ো করে তিনি আগুনকে প্রণাম করলেন, বললেন, “রুষ্ট হলে এক রাত্রের মধ্যে, আগুন জ্বালিয়ে ছাই করে দিতে পারেন এত বড়ো একটা জঙ্গল। চোখের পলকে ঝলসে, পুড়িয়ে মারতে পারেন ভয়ংকর সব জন্তুকেও...। তিনি অগ্নি, তিনি রুদ্র, তিনি ভয়ংকর। কিন্তু কী উজ্জ্বল সুন্দর তাঁর এই ধ্বংসের রূপ ...”।
     
    ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে নিচের জঙ্গলের পরিস্থিতি মানুষগুলোর চোখে পরিষ্কার হয়ে উঠল ধীরে ধীরে। বিস্তীর্ণ ওই জঙ্গলের থেকেই মানুষের এই দলটি তাঁদের খাদ্য আহরণ করেন, কখনো কখনো শিকার করেন ছোট ছোট প্রাণী। কিন্তু আজ সেই জঙ্গল দগ্ধ, নিঃস্ব, সেখানে কোথাও কোন প্রাণের সাড়া নেই। সবুজ অরণ্য আজ ঢাকা পড়েছে ধূসর ছাইয়ের তলায়।  
    দলের ছোকরাদের মধ্যে একজন তার পাশে বসে থাকা মধ্যবয়স্কা মহিলাকে বলল, “আমাদের খাবারের যা যোগাড় আছে তাতে আজকের দিনটা হয়তো টেনেটুনে চলে যাবে, মা। কিন্তু কাল? নিচের জঙ্গল থেকে বহুদিন আর কিছুই পাওয়া যাবে না। আমাদের আজই এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে, নতুন জঙ্গলের খোঁজে। নয়তো...”।
     
    মধ্যবয়স্কা মহিলাই ওই বৃদ্ধার বড়ো কন্যা - এ দলের নেত্রী। তিনি পুত্রের কথার না বলা অংশটুকু অনেক আগেই বুঝেছিলেন, ‘নয়তো মরতে হবে অনাহারে’। কিন্তু এই সংকট থেকে সহজে পরিত্রাণ পাওয়ার হদিশ তাঁরও জানা নেই। তিনি তাঁর বৃদ্ধ পিতার দিকে তাকালেন কোন পরামর্শের আশায়। কিন্তু বৃদ্ধও কোন উত্তর দিলেন না, তাঁর দুর্বল কাঁধের উপর নড়বড়ে মাথাটি নড়তেই লাগলো।
     
    এই সময়েই পায়ে চলা পথে হেঁটে এক তরুণ নিচের থেকে উঠে এল সমতলে। এসময় পাহাড়তলি থেকে উঠে আসা এতই অপ্রত্যাশিত সকলেই অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে এসে দলনেত্রীর পাশে বসল, বলল, “ভোরের আলো ফোটার একটু আগেই আমি নিচেয় গিয়েছিলাম, মাসি”।
    বৃদ্ধ ও দলনেত্রীকে ঘিরে বসে থাকা দলের সমস্ত পুরুষ ও মহিলারা তরুণের কথা শুনে আরও বিস্মিত হল। তাদের সকলের চোখে একই প্রশ্ন, কেন গিয়েছিলি? কী করতে? এসময় একা একা কেউ নিচেয় যায়? কী দেখলি সেখানে?
    কেউ জিজ্ঞাসা না করলেও তরুণ বলল, “গোটা জঙ্গলটাই বিলকুল সাফ হয়ে গেছে, মাসি। মাটিতে পড়ে আছে ছাই আর পোড়া কাঠের স্তূপ। আগুনের আঁচে ঝলসে কালো হয়ে যাওয়া প্রাণহীন বিশাল গাছগুলো আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও কোন পাখির ডাক নেই। ছোট বড়ো কোন প্রাণীর কোন সাড়াশব্দ নেই। পোকামাকড়, প্রজাপতি, ফড়িং, এমনকি একটা পোকাও দেখতে পেলাম না কোথাও। সমস্ত জঙ্গলটা নিষ্প্রাণ, বোবা হয়ে গেছে একদম”। তরুণ একটু থামল। সকলেই তার কথা শুনছিল, কেউ কোন কথা বলল না, অপেক্ষায় রইল তরুণের মুখের দিকে তাকিয়ে।
     
    তরুণ একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “কাল সন্ধেয় আমার তেমন খাওয়া হয়নি, আমার বড্ডো খিদে পেয়েছিল, মাসি”। তরুণ এই ছেলেটি দলনেত্রীর এক বোনের ছেলে। এই ছেলেটি ওর বয়সী অন্য ভাইদের মতো দুর্দান্ত সবল নয়। বরং একটু শান্ত, ভিতু ভিতু, দল থেকে সর্বদাই আলাদা থাকে। অন্য সবাই যখন দলবেঁধে জঙ্গলের এদিক সেদিক খাবার খুঁজে বেড়ায়, এই ছেলেটা তখন পাথরের ওপর বসে, পাহাড় দেখে, আকাশ দেখে, পাখি দেখে, প্রজাপতি দেখে সময় নষ্ট করে। তাকে শোধরানোর চেষ্টাতেও বড়োরা এখন ক্ষান্তি দিয়েছে। অপদার্থ একটা - ওকে দিয়ে কিছু হবার নয়। তবুও মা-মাসির মন - দুর্বল নিরীহ এই ছেলের প্রতি একটু যেন বেশিই প্রশ্রয় তাঁদের। দলনেত্রী কিছুটা অধৈর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, “খিদে পেয়েছিল তো নিচেয় গিয়েছিলি কী করতে?”

    ১.২.২ ঝলসানো মাংসের স্বাদ
    কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে, তরুণ বলল, “ভীষণ খিদে পেয়েছিল, বিশ্বাস করো মাসি। কিন্তু চারদিকে কিচছু ছিল না খাবার মতো। একটা ফল, একটা কন্দ, এমনকি এতটুকু শাকপাতাও নয়। এধারে ওধারে পড়ে আছে অজস্র পশুর দেহ - পোড়া, ঝলসে যাওয়া। তাদের গায়ে লোম নেই, চামড়া নেই। দগদগে মাংসের স্তূপ। কোনটা কোন জন্তু চট করে চেনাও যাচ্ছে না। যাদের মাথার শিং আর পায়ের ক্ষুর বা থাবাগুলো আস্তো আছে, শুধু তাদেরই চেনা যাচ্ছে”।
    সামান্য বিরতি নিয়ে, তরুণ মাসির মুখের দিকে একবার তাকাল, তারপর আবার বলতে শুরু করল, “আমার সঙ্গে বাঘনখের ছুরিটা ছিল, সেই ছুরি দিয়ে শিংওয়ালা একটা হরিণের গা থেকে এক চাকলা মাংস কেটে নিলাম। সে মাংস এতই নরম, এতটুকু কষ্ট হল না ছাড়াতে! প্রথমে একটু ঘেন্না হচ্ছিল, কিন্তু তাও মুখে দিলাম। একদম অন্যরকম স্বাদ। একটু পোড়া পোড়া গন্ধ, কাঁচা রক্ত-মাংসের গন্ধ প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু সে মাংস তুলতুলে নরম, চিবোতে, দাঁতে কাটতে এতটুকু অসুবিধে হল না। খারাপ লাগল না, মাসি। খুব খিদে পেয়েছিল, মাসি, অনায়াসে ভরপেট মাংস খেয়ে ফেললাম”।
    দলের সবাই অস্ফুট আওয়াজে শিস দিয়ে উঠে বলল, “ইসসসস, শেষ পর্যন্ত তুই পোড়া মাংস খেলি? ছি ছি ছি, তোর কী এতটুকু ঘেন্না-পিত্তি নেই রে?”  
    সে কথায় কান না দিয়ে, তরুণ খুব উৎসাহের সঙ্গে আরো বলল, “আমি বলি কি, মাসি। চলো না, আমরা সবাই মিলে পাহাড়তলিতে যাই, বেশ কয়েকটা ঝলসানো পশু তুলে আনি ওপরে। তাতে আমাদের তিন-চারদিন সহজেই চলে যাবে। এর মধ্যে নতুন জঙ্গলের সন্ধানে আমরা কিছুটা সময়ও পেয়ে যাবো...”।
     
    বৃদ্ধ এতক্ষণ শুনছিলেন তরুণের কথা, শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “হতভাগা, অপদার্থ, করেছিস কী? অগ্নির মুখের গ্রাস তুই চুরি করেছিস? তিনি ক্রুদ্ধ হলে, কী করতে পারেন গতকাল রাত্রে চোখের সামনে দেখলি না? এরপরেও তোর এমন দুর্বুদ্ধি হল কী করে?” পাঁজর কাঁপিয়ে কয়েকবার শ্বাস টেনে তিনি আবার বললেন, “তুই তো মরবিই, মারবি আমাদের সকলকে, আমাদের গোটা দলকে। হতভাগা, তোর জন্যে আমাদের সকলকে অগ্নির রোষানলে জ্বলতে হবে”।  বৃদ্ধ ক্রোধে এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন যে, তাঁর সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল থরথর করে।            
    দলনেত্রী বৃদ্ধ পিতার অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হলেন, বললেন, “বাবা, তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না তো। সারারাত তুমি একভাবে বসে আছো, এতটুকুও ঘুমোওনি। ভেতরে গিয়ে একটু বিশ্রাম করো দেখি, আমি এদিকটা সামলাচ্ছি”। তিনি দুই তরুণীকে ইশারা করলেন, বৃদ্ধকে ধরে গুহার ভিতরে নিয়ে যেতে। মেয়েদুটির কাঁধে ভর রেখে গুহার দিকে হাঁটতে হাঁটতে সেই বৃদ্ধ তখনো বলে চললেন, “ওই ছোঁড়াকে দূর করে দে দল থেকে! দলের ভালো চাস তো এরকম দুরাচারকে প্রশ্রয় দিস না। হতভাগাকে শেয়ালে শকুনে ছিঁড়ে খাক, ওই হবে ওর সঠিক শাস্তি। তা নাহলে এই দলের প্রত্যেকে মরবে - জ্বলে ছাই হয়ে যাবে সব্বাই...”।
    বৃদ্ধ পিতার গুহার ভেতরে না যাওয়া পর্যন্ত, দলনেত্রী কোন কথা বললেন না। তারপর বোনপোকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তুই ওই পোড়া মাংস খেলি? তোর ভালো লাগল?  কাঁচা টাটকা রক্ত মাংস ছাড়া অন্য কোন মাংস খাবার কথা আমি তো ভাবতেই পারি না”! প্রৌঢ়া নেত্রীর কথা সব্বাই সমর্থন করল, অনেকে সেই যুবককে উপহাস করে বলল, “তাই না বটে, পোড়া মাংস আবার কেউ খায় নাকি? থুঃ থুঃ। কোন পশুকেও কোনদিন পোড়া মাংস খেতে দেখিনি। তুই তো পশুরও অধম হয়ে গেলি!”।
     
    প্রৌঢ়া নেত্রী হাত তুলে সবাইকে চুপ করার আদেশ দিলেন, সবাই থামলে তিনি বললেন, “আমি অবশ্য অতটা বিরুদ্ধে যেতে চাইছি না। কারণ, আমরা এখন ভীষণ সংকটে, জঙ্গল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, জ্যান্ত পশুরা পালিয়ে গেছে দূরের কোন জঙ্গলে। নতুন জঙ্গল খুঁজে আমাদের সকলের বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট খাবার যোগাড় করতে বেশ কদিন সময় লাগবে। ততদিন, যদি একদম অখাদ্য না হয়, আমরা সবাই নিচেয় গিয়ে ব্যাপারটা দেখে আসতেই পারি”।
    কয়েকজন বৃদ্ধবাবার এবং অগ্নির রোষের কথা মনে করিয়ে দিল, কিন্তু প্রৌঢ়া নেত্রী সে কথায় কান দিলেন না। তিনি জানেন এই পরিস্থিতিতে এত বড়ো দলটাকে সুস্থ ভাবে বাঁচিয়ে রাখাটা অনেক বেশি জরুরি। অনাহারে যদি দলের অধিকাংশ  মারাই যায়, তখন অগ্নির রোষে কী আর এমন এসে যাবে? তরুণ বোনপোর কথাগুলো পুরোটা মেনে নিতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু অস্বীকার করে উড়িয়ে দেওয়ার জোরও পাচ্ছেন না।  শিশু আর বৃদ্ধদের দেখা শোনার জন্যে কয়েকজন মহিলা থেকে গেল, দলের বাকিরা দ্রুত নেমে গেল পাহাড়তলির দিকে, সকলের সামনে সেই যুবক আর নেত্রী মহিলা। সকলের হাতে বাঘ কিংবা ভালুকের নখ দিয়ে তৈরি নানান আকারের ফলা।
     ফেলে যাওয়া সেই হরিণের পা থেকে বেশ কয়েকটা টুকরো মাংসের ফালি কেটে তুলল সেই তরুণ। একে একে  বাড়িয়ে দিল প্রৌঢ়া নেত্রী, তার মা ও অন্যান্য মাসীদের দিকে। অধীর আগ্রহে অন্য সকলে তাকিয়ে রইল তাঁদের দিকে। মহিলারা জিভে ঠেকিয়ে স্বাদ নিলেন, গন্ধ নিলেন, তারপর দাঁতে কেটে চিবোতে লাগলেন মাংসের টুকরো। একদম অন্য রকম স্বাদ। একটু পোড়া পোড়া গন্ধ, কিন্তু তাতেও পশুর নিজস্ব গন্ধ সামান্য হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে। তবে সব থেকে আশ্চর্য – মাংস এতই নরম, এ মাংস পূর্ণ বয়স্ক হরিণের বলে মনেই হচ্ছে না, মনে হচ্ছে খুব বাচ্চা কোন হরিণের। তাঁদের আচরণে দলের অন্য সকলেই কিছুটা ভরসা পেল, তারাও সবাই নিজেদের ফলা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মাংস কেটে কেটে তুলতে।
    পোড়া মাংসের অভিনব স্বাদ নিতে নিতে প্রৌঢ়া দলনেত্রী এবং তাঁর বোনেরা, দলের অন্য সকলের দিকেই লক্ষ্য রাখছিলেন। তাঁরা দেখলেন, শিকার করে আনা বড়ো একটা হরিণকে শেষ করতে যে সময় লাগে, তার অর্ধেক সময়েই দু দুটো প্রমাণ সাইজের আধপোড়া হরিণ শেষ করে দিয়েছে তাঁর দলটা। তার মানে ঝলসে যাওয়া এই পশুর মাংস ছাড়িয়ে খেতে অনেক কম সময় লাগছে। এই মাংস শিশু এবং নড়বড়ে দাঁত বৃদ্ধদের পক্ষেও অসুবিধের হবে না।
     
    প্রৌঢ়া নেত্রী সবাইকে নির্দেশ দিলেন, যতগুলো সম্ভব এমন ঝলসানো পশু নিয়ে উপরে গুহার মধ্যে সংগ্রহ করতে, তারপর তরুণ বোনপোর কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন, “তোর থেকে আমরা এ এক নতুন শিক্ষা পেলাম। বিপদের সময় জীবন ধারনের জন্যে প্রচলিত ভাবনা চিন্তাগুলোকে সরিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। আর এ কথাও ঠিক,  আগুনে ঝলসানো পশু খাবার পক্ষে খুবই সুবিধের।  কিন্তু এমন তো রোজ হবে না। আর একবার আগুন লাগলে পুরো জঙ্গলই তো সাফ হয়ে যাবে! মাংস ছাড়া আমাদের আর কোন খাবারও জুটবে না। কাজেই এমন সুবিধে আমাদের ভাগ্যে রোজ রোজ না আসাই মঙ্গলের”।
    “কিন্তু, মাসি, আমাদের দরকার মতো আমরা তো শিকার করে এনেও, আগুনে ঝলসে নিতে পারি!” যুবকের এই কথায় প্রৌঢ়া নেত্রী ভীষণ বিরক্ত হলেন, রূঢ়ভাবে বললেন, “অমন কথা মুখে আনলি কী করে, হতভাগা? অগ্নি আমাদের তাপ দেন, আলো দেন, রাতের অন্ধকারে পশুদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করেন। তিনি এই জঙ্গলকে কেন জ্বালিয়ে ছাই করলেন, সে তাঁর খেয়াল। কিন্তু সেই অগ্নিকে আমরা ব্যবহার করবো এমন একটা নোংরা কাজে? আমাদের শিকার করে আনা পশু ঝলসাতে? ছি, ছি, এমন কথা কোনদিন যেন আর না শুনি”। তরুণ বোনপো মাথা নিচু করে রইল, কিছু বলল না। প্রৌঢ়া নেত্রী আবার বললেন, “তাছাড়া ঝলসানো এই মাংস খেয়ে আমাদের শরীর কেমন থাকে, সেটাও তো বোঝা দরকার। আমাদের বাপ-ঠাকুরদাদের কেউ কখনো কাঁচা মাংস ছাড়া অন্য কিছু মুখেও তোলেননি, এই পোড়া মাংস যদি আমাদের পেটে সহ্য না হয়? না বাপু, যুগ যুগ ধরে যেমনটা চলে আসছে, সে পথেই চলা ভাল।”
    ওই ঝলসানো মাংস যে তাঁদের অনভ্যস্ত পেটে সহ্য হয়েছিল এবং অতি সহজে হজমও হয়েছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এবং অচিরেই যুগ যুগ ধরে প্রচলিত কাঁচা খাবার খাওয়ার প্রবণতা থেকেও মানুষ সম্পূর্ণ সরে এসেছিল। যদিও সেই প্রৌঢ়া দলনেত্রী আর তাঁর তরুণ বোনপো সেদিন কল্পনাই করতে পারেননি, এই আকস্মিক ঘটনা মানুষকে কোন সুদূরপ্রসারী সভ্যতার পথ দেখিয়ে দিল। পরবর্তী কয়েক হাজার বছরের মধ্যে মানুষ আগুনে ঝলসে, পুড়িয়ে, সেঁকে - শুধুমাত্র মাংস নয়, কন্দ, মূল, নানান আনাজও খেতে শুরু করেছিল। শিখে গিয়েছিল ফুটন্ত জলে সেদ্ধ করে খাবার বানানোর অজস্র প্রণালী। যাকে আমরা বলি রন্ধন। মানুষ এই রন্ধন প্রক্রিয়ায় যত সড়গড় হয়েছে, ততই প্রকৃতি থেকে আবিষ্কার করেছে নিত্য নতুন খাদ্য সম্ভার। তার মেনু ততই সমৃদ্ধ হয়েছে সুদীর্ঘ খাদ্যতালিকায়।          
     
    ১.২.৩ আগুনই সভ্যতার মূল অনুঘটক

    নৃতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বলেন, আদিম হোমো স্যাপিয়েন্স থেকে আধুনিক সভ্য মানুষ হয়ে ওঠার মূল অনুঘটক হল রান্নাতে আগুনের ব্যবহার। এ কথার তাৎপর্য স্পষ্ট হবে নিচের বিষয়গুলিতে নজর দিলে।  

    ক. ভয়কে জয় ও আত্মবিশ্বাস
    আগেই বলেছি কয়েক লক্ষ বছর ধরে ইরেক্টাস এবং নিয়াণ্ডারথাল প্রজাতির মানবেরা এবং আদিম মানুষেরাও আগুনের তিনটে ব্যবহার জানত। আলো, উত্তাপ আর রাতের অন্ধকারে হিংস্র পশুদের দূরে রাখা। আগুনের আলোয় রাতের অন্ধকার আর নিশ্ছিদ্র রহস্যময় এবং ভয়ংকর রইল না। জনসংখ্যা বেড়ে ওঠার সঙ্গে তাল রেখে যেহেতু প্রাকৃতিক গুহার সংখ্যা বেড়ে ওঠা সম্ভব নয়। অতএব পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা গুহার বাইরে, খোলা আকাশের নিচে ডালপালার কাঠামো আর পাতার ছাউনি বানিয়ে – সেটাকেই নিরাপদ আশ্রয় বানিয়ে তুলতে শিখে ফেলল। সে ছাউনি যতই দুর্বল হোক, রাতে আগুন জ্বাললে পশুদের সহজের ঠেকিয়ে রাখা যেত। তিন দেওয়ালে ঘেরা গুহায় শীতের বাতাসের প্রকোপ কম হত। সেই অভাবটুকুও অনেকটাই দূর করল আগুন। শীতের রাতেও খোলা আকাশের নিচে, আগুন ঘিরে গোল হয়ে বসে গা হাত-পা সেঁকে নিলে শীতের কামড়কে অনেকটাই হার মানানো যায়। অতএব আগুনের সামান্য এই তিনটে ব্যবহারই মানব প্রজাতি এবং মানুষকে প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজের অনুকূলে আনার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলল।
      
    খ. দৈহিক পরিবর্তন
    বিজ্ঞানীর বলেন আমাদের দেহে শক্তির (Calorie) উৎপাদন কেন্দ্র হল আমাদের উদর। আর এই উৎপন্ন শক্তির অধিকাংশই খরচ হয় আমাদের খাদ্য হজম করতে আর আমাদের মস্তিষ্কের ক্রিয়ায়। অতএব আমরা যত বেশি খাদ্য গ্রহণ করি, সেই খাদ্য হজম করতে আমাদের উদরকে তত বেশি শক্তি ক্ষয় করতে হয়।

    ব্যাপারটা বুঝতে সুবিধে হবে, আমাদের প্রত্যেকের জীবনে প্রায়শঃ যে ঘটনা ঘটে থাকে তেমনই একটি উদাহরণ দিলে। যেদিন কোন পার্টিতে বা নেমন্তন্নে গিয়ে আমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাদ্য (একগাদা junk food) উদরস্থ করি, সেদিন আমরা পেটে আর শরীরে নানান অস্বস্তি অনুভব করি। আমাদের স্বাভাবিক ভাবনা চিন্তাগুলিও উদরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে – “ইস, ছটা ভেটকির পাতুড়ি খাওয়ার পর অতটা মাংস না খেলেই হত! অথবা মাংস দিয়ে অতগুলো লুচির পর একগাদা রসগোল্লা খাওয়াটা উচিৎ হয়নি। এখন অম্বলের ওষুধ খাবো, নাকি হজমিগুলি খাবো, নাকি একটু জোয়ান চিবোবো”? এই সব চিন্তাতেই সেদিন বা তার পরদিন আমরা কাজে মন বসাতে পারি না। অর্থাৎ আমরা আমাদের মস্তিষ্ককে তার প্রয়োজনীয় শক্তি থেকে বঞ্চিত করি, উদরকে অতিরিক্ত শক্তি ব্যয়ে বাধ্য করে।

    পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণীদের মধ্যে মানুষের শ্রেষ্ঠতার কারণ তার মস্তিষ্ক। এই মস্তিষ্ক নিয়ে আমদের গর্বের শেষ নেই। কিন্তু সেই আদিমকালে এই মস্তিষ্কই ছিল মানুষের অন্যতম দুর্বলতার কারণ! অবাক লাগছে? একটু হিসেব করে দেখা যাক।

    বিজ্ঞানীরা বলছেন, একজন মানুষের দেহের ওজনের তুলনায় তার মস্তিষ্কের আয়তন, অত্যধিক বেশি। ষাট কিলো ওজনের অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মস্তিষ্কের গড় আয়তন হয় মাত্র ২০০ ঘন সেন্টিমিটার (সি.সি.)। সেখানে প্রাচীন মানবপ্রজাতিদের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল প্রায় ৬০০ সি.সি.। আর আধুনিক মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন হয় ১২০০ থেকে ১৪০০ সি.সি.! এর ওপর আরও সংকটের বিষয় আমাদের দেহের ওজনের মাত্র ২ থেকে ৩% হল আমাদের মস্তিষ্কের ওজন। কিন্তু আমরা যখন ঘুমোই বা বিশ্রাম করি, তখনও আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্যশক্তির প্রায় ২৫% একা মস্তিষ্কই শুষে নেয়! তুলনায় আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিজন শিম্পাঞ্জির মস্তিষ্ক, বিশ্রামের সময় মাত্র ৮% শক্তি ব্যবহার করে।

    অতএব মস্তিষ্কের এই বিপুল শক্তির চাহিদা মেটাতে আদিম মানুষকে একজন শিম্পাঞ্জির তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ খাদ্য খেতে হত। আর সেই খাদ্য যোগাড় করতে অনেক বেশি সময় – সূর্যোদয় থেকে প্রায় সূর্যাস্ত পর্যন্ত – ধরে জঙ্গলের আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াতে হত।

    একমাত্র পাকা ফল ছাড়া আগুনে পোড়ানো বা ঝলসানো যে কোন খাদ্য – সে মাংস হোক বা কন্দ-মূল – মানুষের খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত সুপাচ্য হয়ে উঠল। মাংস বা কাঁচা আনাজ, কন্দ মানুষের পরিপাক তন্ত্রে সম্পূর্ণ হজম হওয়া খুবই কষ্টসাধ্য। কিন্তু সামান্য আগুনের স্পর্শে এই খাদ্যগুলিতেই এমন কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে যায়, যাতে শুধু যে খেতে সুবিধে হয় তাই নয়, তার খাদ্যগুণও অনেক বেড়ে যায়। দু একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা খোলসা হবে।

    কাঁচা আলু খেলে আমাদের আধুনিক উদর নিঃসন্দেহে বিদ্রোহ করবে, কিন্তু আলু পোড়া[2] বা আলু সেদ্ধ, আমাদের যে শুধু খেতে ভালো লাগে তাই নয়, অত্যন্ত পুষ্টিকরও বটে। কাঁচা বেগুন আমরা খাওয়ার কথা চিন্তাও করিনা, কিন্তু শীতকালে বেগুন-পোড়া অত্যন্ত সুখাদ্য হিসাবেই গণ্য হয়। একই ভাবে কাঁচা চাল, গম বা ভুট্টা আমাদের খাদ্যের মধ্যে আদৌ গণ্য হতে পারে না, কিন্তু আগুনের স্পর্শে এইগুলিই হয়ে উঠেছে আমাদের প্রধান খাদ্য (staple food)  – যা আমাদের আধুনিক শরীরে ক্যলোরির অধিকাংশ সরবরাহ করে। এর ওপর আগুন আমাদের খাদ্যশুদ্ধিও ঘটায়। যে কোন খাদ্যের গায়ে লেগে থাকা বীজাণু (bacteria), ছত্রাক (fungus) এবং আরো নানান অবাঞ্ছিত সংক্রমণ দূর করে, আমাদের পরিপাক তন্ত্রকে নিরাপদ রাখে।

    সেই আদিম কাল থেকে আজ পর্যন্ত একটি আধুনিক শিম্পাঞ্জিকে তার প্রয়োজনীয় ক্যালোরি সংগ্রহ করতে সারাদিনে প্রায় পাঁচ থেকে ছ ঘন্টা খাদ্য চিবোতে হয়। সেখানে সারাদিনে তিন থেকে চারবার – সাকুল্যে ঘন্টাখানেক ‘চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়’ খাবার খেয়ে একজন মানুষ, শিম্পাঞ্জির থেকে অনেক বেশি ক্যলোরি সংগ্রহ করতে পারে[3]

    অতএব এই অধ্যায়ের সারাংশ করলে দাঁড়ালো,  
    খ(১)  আগুনের স্পর্শে আমাদের খাবারের খাদ্যগুণ বেড়ে গেল, ফলে কম খাদ্যে বেশি শক্তি পাওয়া সম্ভব হল।
    খ(২)  কম খাদ্য মানেই, খাদ্য সংগ্রহের পরিশ্রম এবং সময় অনেকটাই কমে গেল। কমে গেল বেশিক্ষণ গভীর অরণ্যে
           ঘুরে বেড়ানোর ঝুঁকি।
    খ(৩)  পরিমাণ কম হওয়াতে এবং খেতে সুবিধা হওয়াতে – খাওয়ার সময়টাও অনেকটাই কমে গেল। যার ফলে
            মানুষের হাতে দিনের অনেকটা সময় রয়ে গেল – অন্য কিছু ভাবার এবং অন্য কিছু করার।   
    খ(৪)  খাদ্য হজম করা সহজ হয়ে যাওয়াতে, আমাদের বৃহদন্ত্র ও ক্ষুদ্রান্ত্রের (Large and small intestines) দৈর্ঘ্য
           অনেক ছোট হয়ে গেল, পরিপাক তন্ত্রের (Digestive system) শক্তির চাহিদাও কমে গেল।
    খ(৪)  এই বাড়তি শক্তি আরো পুষ্ট করতে লাগল আমাদের মস্তিষ্ককে, আমাদের মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে জাগতে লাগল[4]
         খ(৫) খাদ্য গ্রহণ সহজ হয়ে যাওয়াতে, দ্রুত বদলে যেতে লাগল, আমাদের মুখমণ্ডল। আমাদের দাঁত, চোয়ালের হাড়
               হাল্কা হতে শুরু করল। সেই অনুপাতে কমে গেল মুখের, কপালের এবং রগের পেশীগুলি। এর ফলে আমাদের
               খুলির আকার কিছুটা বেড়ে ওঠার সুযোগ পেল, এবং মস্তিষ্কে আরো কয়েক ছটাক ঘিলু বেড়ে ওঠার জায়গা
               মিলল।
         খ(৬) খাদ্য গ্রহণ অনায়াস হওয়াতে, আমাদের ঠোঁট, জিভ ও তালু অনেক নরম ও মসৃণ হয়ে উঠল। কণ্ঠ, আলজিভ
               (epiglottis) ও স্বরতন্ত্রী (vocal cord) অনেক নমনীয় (Flexible) হয়ে উঠতে লাগল। অনর্গল কথা বলার
               জন্যে আমাদের মুখ প্রস্তুত হয়ে উঠল।
         খ (৭) বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমস্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীরই পরিবেশের (গ্রীষ্ম বা শীত) সঙ্গে তাল মিলিয়ে, দেহের উত্তাপ
                নিয়ন্ত্রণ করে তাদের গায়ের রোম অথবা তাদের পুরু চামড়া। শীতের প্রকোপ কমাতে আগুনের নিয়মিত
                ব্যবহার - হোমো স্যাপিয়েন্সদের গায়ে রোমের ঘনত্ব কমিয়ে আনল!                       

    আমাদের পূর্বপুরুষেরা এতগুলি সুবিধের কী কী সদ্ব্যবহার করেছিলেন, সে কথা আলোচনা করব পরের অধ্যায়ে।

    চলবে...

    গ্রন্থঋণঃ

    1. Sapiens – A Brief History of Humankind – Yuval Noah Harari.
           

    [1] চিত্র ঋণ Wikipedia

    [2] শহরের মানুষেরা আলুপোড়া খাওয়ার ব্যপারটা হয়তো জানেন না। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে আমাদের বাল্যে এবং কৈশোরে, শীতের শেষে ক্ষেতের থেকে কাঁচা আলু তুলে, ওই মাঠেই আগুনে পুড়িয়ে খাওয়াটা একটা দারুণ আনন্দময় অ্যাডভেঞ্চার ছিল। অবিশ্যি সঙ্গে থাকত একটু নুন-গোলমরিচের ছিটে – সেটুকু যোগাড় করতে আদিম মানুষদের আরও তিরিশ চল্লিশ হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল! অবিশ্যি এখানে বলে রাখা ভাল, ভারতীয় উপমহাদেশে আলু আমদানি করেছিল পোর্তুগিজ বণিকেরা, আজ থেকে পাঁচ-ছশ বছর আগে। অতএব আমাদের দেশের আদিম মানুষেরা আলুর স্বাদ চেখে যেতে পারেননি।   

    [3] যাঁরা একটু অতিরিক্ত খাদ্যোৎসাহী মানুষ তাঁরা ওই সময়েই এত বেশি ক্যালোরি সংগ্রহ করে ফেলেন, যে তাঁদের আবার সেই অতিরিক্ত ক্যলোরি ঝরাতে অনেকটা সময় অপব্যয় করতে হয়!  

    [4] মস্তিষ্কের জেগে ওঠা কথাটাই আমার উপযুক্ত মনে হল, কারণ আগুনের ব্যবহার শিখেও মানব প্রজাতিগুলি কয়েক লক্ষ বছর ধরে, প্রাণী হিসেবে একেবারেই তাৎপর্যহীন হয়ে প্রকৃতিতে বাস করত। কিন্তু মানুষ রান্নার সূত্রপাত করেছে আজ থেকে হয়তো পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন হাজার বছর আগে। মাত্র এই কটা বছরেই প্রাণী জগৎ তো বটেই, পৃথিবী নামের এই সুন্দর গ্রহটিকেও মানুষ “ত্রাহি মাম্‌” অবস্থায় দাঁড় করিয়ে ছেড়েছে!    
     
  • ধারাবাহিক | ১২ মার্চ ২০২২ | ১৩৭০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১২ মার্চ ২০২২ ২৩:৫৬504852
  • বাহ 
  • সে | 2001:1711:fa42:f421:b8d2:1393:53fc:ba4d | ১৩ মার্চ ২০২২ ০৫:১৯504857
  • চলুক
  • kk | 2600:6c40:7b00:1231:91bb:7efa:1be1:d19e | ১৩ মার্চ ২০২২ ০৫:৪৪504859
  • ভালো লাগছে পড়তে।
  • Kishore Ghosal | ১৩ মার্চ ২০২২ ১১:১৩504864
  • সকলকে জানাই আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা - পড়ার জন্যে আর ধৈর্য রাখার জন্যে। 
  • প্রত্যয় ভুক্ত | ১৩ মার্চ ২০২২ ১২:০৭504865
  • চমৎকার ঝরঝরে স্বাদু গদ্য,তথ্য  পরিবেশন‌ও বেশ কুশলী উপায়ে করা হয়েছে।আগের পর্বটাও পড়লাম,এমনিতেও আপনার অন্য লেখাগুলোও বেশ ভালো লেগেছিল আগে।এই সিরিজটা চলুক।heart
  • Kishore Ghosal | ১৪ মার্চ ২০২২ ১৪:১৭504879
  • এমন আন্তরিক উৎসাহের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ, প্রত্যয়বাবু।  
  • a | 110.174.180.49 | ১৪ মার্চ ২০২২ ১৬:৩৮504880
  • এটা কি হারারিবাবুর লেখার অনুবাদ? 
  • Subhra Halder | ১৪ মার্চ ২০২২ ১৬:৫৮504881
  • বাহ্  খুব সুন্দর |
  • Banerjee Arup | ১৫ মার্চ ২০২২ ০৮:৩৩504891
  • ধর্ম যে আগুনের ব্যবহার থেকেই উদ্ভুত, জানা ছিল। কিন্ত গল্পের সাহায্যে অপূর্ব উপস্থাপনা পড়ার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল। অপেক্ষায় রইলাম পরবর্তীর জন্য। 
  • Kishore Ghosal | ১৫ মার্চ ২০২২ ১১:১৩504893
  • Subhra এবং অরূপ অনেক ধন্যবাদ। enlightened
     a - আপনার এটা হারারিবাবুর অনুবাদ মনে হলে, আমি হার মানলাম। smiley
     
  • Banerjee Arup | ১৫ মার্চ ২০২২ ২২:৫৯504914
  • a- হারারি মোটেই এসব লেখেননি। আবার একটু দেখে নিন। হারারি যেমন মজার ছলে লিখেছেন, কিশোর তেমনি নিজস্ব স্টাইলে লিখছেন ধর্ম নিয়ে, যা মামুষেরই তৈরি। 
  • hu | 129.1.127.109 | ১৬ মার্চ ২০২২ ০০:০০504915
  • খুব ভালো লাগছে পড়তে
  • Prajna Paromita | ১৬ মার্চ ২০২২ ১৫:২৮504926
  • অনবদ্য লাগছে। স্বাদু সাধু।
  • Madhuri Hazra | ১৭ মার্চ ২০২২ ১৪:০৪504939
  • নমস্কার নেবেন। নানান জায়গা থেকে মানুষ এবং মানবের টুকরো টুকরো নতুন নতুন খবর আমার মস্তিষ্কটি সংগ্রহ করে চলেছিল। আপনার লেখায় একই জায়গায় এবং তুলনামূলক ভাবে আমাদের ক্রমবিকাশের কথা জানতে পেরে খুব ভাল লাগছে। 
    ইতিহাসে চিরকালই পাতিহাঁস ছিলাম। তার কারণ এইভাবে ইতিহাস পড়ানো হয়নি আমাকে কখনোই। 
    সাগ্রহে অপেক্ষায় রইলাম। 
  • Kishore Ghosal | ১৭ মার্চ ২০২২ ২১:৪৭504945
  • @ Prajna Paromita : অনেক ধন্যবাদ, ম্যাডাম, পড়ার জন্যে ও উৎসাহ দেওয়ার জন্যে। 
     
    @ Madhuri Hazra:  আমাদের স্কুল লেভেলে, ইতিহাসের মতো বিরক্তিকর বিষয় খুব কমই ছিল। যে ইতিহাস বইটি পড়ে প্রথম  অবাক ও শিহরিত হয়েছিলাম সেটি 'ডঃ নীহার রঞ্জন রায়ের  "বাঙ্গালীর ইতিহাস"। সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। 
    আশা করি আপনাকে হতাশ করবো না।   
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন