এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - দ্বিতীয় পর্ব - তৃতীয় ভাগ

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ০৬ মে ২০২২ | ১৫৫৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • দ্বিতীয় পর্ব - ১২,০০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই  ( তৃতীয় ভাগ)
     
    ২.৩.১ সিন্ধু সভ্যতা এবং হরপ্পা সংস্কৃতির বিস্তার        

    শুরুতেই বলে রাখি, এই সভ্যতার সমস্ত শহরগুলির কোন নামই, ওই শহরগুলির ভূমিপুত্রদের রাখা নাম নয়। এই নামগুলি আমরা রেখেছি প্রত্নখননের সময়ে বা পরে – নিকটবর্তী কোন আধুনিক শহর বা গ্রাম অথবা কোন লোকশ্রুতি থেকে। নিচের মানচিত্র থেকে সিন্ধু ও হরপ্পা সভ্যতার বিস্তারের আন্দাজ অনেকটাই পাওয়া যাবে।



    সিন্ধু সভ্যতার কেন্দ্রবিন্দু ছিল দুই শহর হরপ্পা (পাঞ্জাব প্রদেশ, পাকিস্তান) এবং মহেঞ্জোদারো (সিন্দ প্রদেশ, পাকিস্তান)। এই দুই প্রধান শহর ছাড়াও আরও চারটি গুরুত্বপূর্ণ শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে, ধোলাভিরা (রান অফ কছ, গুজরাট, ভারত), গানেরিওয়ালা (পাঞ্জাব প্রদেশ, পাকিস্তান), রাখি গারহি (হরিয়ানা, ভারত) এবং লোথাল (খাম্বাৎ খাঁড়ি, গুজরাট, ভারত)। এছাড়াও হরপ্পা সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত এবং প্রভাবিত প্রচুর ছোট শহর এবং জনপদ ছিল। যার অনেকগুলিকেই চিহ্নিত করা গেলেও, প্রত্নখননের কাজ শুরু করা যায়নি। এবং কে জানে আরো অনেক জনপদই হয়তো রয়ে গেছে অনাবিষ্কৃত। বিস্তৃত এই সভ্যতার ব্যাপ্তি ছিল,  উত্তর-পশ্চিমের পামির মালভূমির শরতুঘাই থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে আরবীয় উপদ্বীপের ওমান। পূর্বদিকে রাজস্থান, হরিয়ানা এবং দোয়াব অঞ্চলের কিছুটা। উত্তরে নিম্ন কাশ্মীর এবং দক্ষিণে গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের উত্তরাংশ পর্যন্ত।

    ২.৩.২ নগর নির্মাণ

    প্রত্যেকটি শহর নির্মাণে সুষ্ঠু নাগরিক বোধ এবং সুপরিকল্পিত চিন্তা-ভাবনার পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও প্রত্যেকটি শহরের পূর্ণ প্রত্নখনন করা হয়ে ওঠেনি, তবুও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা অনুমান করেন, বৃহত্তর মহেঞ্জোদারো শহরের আয়তন প্রায় দু’শ হেক্টেয়ারের কাছাকাছি। তবে মূল বড় শহরগুলির আয়তন কমবেশি একশ হেক্টেয়ার[1]। ছোট শহরগুলির আয়তন এর থেকে অনেকটাই ছোট। প্রত্যেকটি শহরই নির্দিষ্ট কয়েকটি পাড়ায় ভাগ করা হত। যেমন কাজের জায়গা, আবাস পাড়া, মালপত্র-রাখার গুদাম এবং অফিস পাড়া। আবাস পাড়াগুলি সাধারণতঃ শহরের পশ্চিমদিকে হত, আর কাজের জায়গা ও অফিস পাড়া হত পূর্বদিকে।

    পশ্চিম আর পূর্বদিকের এই উপযোগীতাকে বাস্তুবিজ্ঞান ভেবে বসবেন না। কারণ খুব স্বাভাবিক সরল ধারণা থেকেই এই নগর নির্মাণের পরিকল্পনা।  পূর্বদিকে সূর্যোদয় হয় – অতএব দিনের আলোর পূর্ণ ব্যবহারের জন্যেই এরকম ব্যবস্থাপনা। আধুনিক প্রযুক্তিতে কাচের বড়ো বড়ো জানালায় ভারি ভারি পর্দা দিয়ে দিবালোক বর্জিত অন্ধকার হলঘরে লুকোনো ডিফিউজ্‌ড্‌ আলোকমালায় সজ্জিত অফিস স্পেস নির্মাণের প্রযুক্তি তখন জানা ছিল না যে! দিবালোকের সদ্ব্যব্যবহারে কত যে বিদ্যুতের সাশ্রয় হয় – কমিয়ে ফেলা যায় বিদ্যুতের চাহিদা এবং পাওয়ার প্ল্যান্টের দূষণ মাত্রা - আমাদের বিজ্ঞান সচেতন রুদ্ধদ্বার মস্তিষ্কে  সে কথা প্রবেশের পথ হারিয়ে ফেলেছে!          

    আবাসিক পাড়াঃ আবাস পাড়ায় শ্রমিক, কর্মী, কেরানি, ছোট-বড় অফিসাররা সবাই থাকত। আবাস বাড়ির নিদর্শন যা পাওয়া গেছে, তাতে শ্রেণীগতভাবে খুব পার্থক্য ছিল না। আজকাল যে কোন শিল্পনগরীতে সচরাচর যেমন দেখা যায়, লেবার কলোনি থেকে জি.এম-বাংলোর গ্রেডেশন, সেরকম কোন পার্থক্য প্রত্নবিদেরা খুঁজে পাননি। শহরের বড়ো রাস্তা এবং পাড়ার ভেতরের সমস্ত রাস্তাই হত সোজা এবং যথেষ্ট চওড়া। কোন শহরেই অ্যাঁকা-ব্যাঁকা গলি ও তস্য-গলির নিদর্শন পাওয়া যায়নি। রাস্তাগুলি সবই ছিল বাঁধানো, পাথরের ব্লকে অথবা পোড়া-ইঁটে। বড়ো কিংবা ছোট প্রত্যেকটি রাস্তার দুপাশে ছিল বাঁধানো নর্দমা, এমনকি কিছু কিছু শহরে ছিল ঢাকা-নর্দমা।
     

    সমস্ত বাড়িগুলিই বানানো হত, রোদে-শুকোনো ইঁটে, যাকে আমরা আমা-ইঁট বলে থাকি। কিছু কিছু শহরে পাথরের ব্লক দিয়ে বানানো বাড়িও পাওয়া গেছে। একটি উন্মুক্ত উঠোন ঘিরে বেশ কয়েকটি বাড়ি বানানো হত এবং কোন বাড়ি থেকেই সরাসরি রাস্তায় ওঠা যেত না। বাড়ির দরজা এবং জানালাগুলো হত, উঠোনমুখী, বিপরীত দিকে জানালা থাকত না। একতলা এবং দোতলা বাড়ির সমতল ছাদ হত চুণ-সুরকির ঢালাই করা। প্রত্যেকটি বাড়ির নর্দমা, উঠোনের পরিসীমা ঘুরে রাস্তার নর্দমার সঙ্গে যুক্ত থাকত। বেশ কিছু বাড়িতে নিজস্ব স্নানাগার থাকত, থাকত রান্নাঘর – হয়তো এই বাড়িগুলিই ছিল অফিসারদের মতো কিছু উচ্চশ্রেণীর মানুষদের জন্যে। সাধারণের জন্যে থাকত যৌথ স্নানাগার। পানীয়জলের সরবরাহ হত কুয়োর জল থেকে।

    কারখানাঃ দক্ষকর্মী এবং শিল্পীদের জন্যে ছিল আলাদা আলাদা কাজ করার জায়গা। কর্মকার – যারা ধাতুর কাজ করত। সূত্রধর – যারা কাঠের কাজ করত, কুম্ভকার যারা – মাটির নানান পাত্র বানাত, শিল্পী – যারা নানারকম পাথরের অলঙ্কার, মাটি এবং ধাতুর মূর্তি, পুতুল বানাত। সমকালীন সব কটি সভ্যতার মধ্যে, সিন্ধু সভ্যতার অনন্য বৈশিষ্ট্যই ছিল এই ধাতুর কাজ, পাথরের কাজ, মৃৎপাত্র এবং নানান শিল্প সামগ্রী, সে কথা আসবে পরে।

    গুদামঘরঃ এর মধ্যে শস্যাগার ছিল, শহরের অধিবাসীদের জন্যে মজুত রাখা হত খাদ্য ভাণ্ডার, যেমন গম, যব, ভুট্টা, ধান। বিভিন্ন দূরের এলাকা থেকে সংগ্রহ করে আনা কাঁচামাল মজুত করে রাখা হত, যেমন তামা, টিন, সোনা, রূপো, খনিজ পাথর, যেমন লাপিস, টারকোয়েজ, সামুদ্রিক সামগ্রী, যেমন কড়ি, ঝিনুক, শাঁখ, মুক্তো। আরও মজুত করা থাকত কাঁচামাল থেকে বানানো সামগ্রী (finished products), যেমন নানান অলংকার, মাটির, পাথরের  এবং ধাতুর পুতুল, মূর্তি, পাত্র। এই সামগ্রীগুলিই রপ্তানি হতো ভারতীয় উপমহাদেশের ভেতরে এবং সমুদ্র বন্দর পথে বিদেশেও।

    অফিসপাড়াঃ আজকের যে কোন শহরের মতোই অফিসপাড়া ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখান থেকেই শহরের এবং শহরের বাইরের যাবতীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত হত। কাঁচামাল সংগ্রহ করা, গুণগত মান পরীক্ষা করা এবং হিসেব করে গুদামে তুলে রাখা। কাজ অনুযায়ী দক্ষ কর্মী ও শিল্পীদের কাঁচামাল বণ্টন করা এবং তার হিসেব রাখা। শিল্পীদের কাজ হয়ে গেলে, তাদের বানানো সামগ্রীর গুণগত মান পরীক্ষা করা, হিসেব রাখা এবং নির্দিষ্ট গুদামে সযত্নে তুলে রাখা। আন্তর্দেশীয় এবং অন্তর্দেশীয় বণিকদের চাহিদা অনুযায়ী বানানো সামগ্রী হস্তান্তর করা এবং তার হিসেব রাখা। এছাড়াও ছিল শহরের অধিবাসীদের জন্যে নানান খাদ্য সংগ্রহ করা, তার সঞ্চয় এবং বণ্টন। শহরের রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, গুদামের নিয়মিত দেখভাল করা এবং প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের কাজ। এ ছাড়াও ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা বা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিশেষ সংরক্ষণের কাজ।

    এরকম নিখুঁত পরিকল্পনার কেজো শহর নির্মাণ যেমন আশ্চর্যের – তার থেকেও আশ্চর্যের বিষয় এই সভ্যতার কোন শহরেই যা পাওয়া যায়নি - সেটাও! নগর-প্রধান অথবা রাজা কিংবা সমাজপতিদের থাকার যোগ্য, সবার থেকে আলাদা প্রাসাদতুল্য কোন বড় বাড়ির নিদর্শন কোন শহরেই পাওয়া যায়নি! পাওয়া যায়নি কোন দেব বা দেবী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত কোন মন্দির বা ধর্মস্থল মনে করার মতো নকশাদার, সুন্দর সাজানো বাড়ি অথবা ভবনের প্রত্ননিদর্শন। অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এই বিষয়ের আলোচনা যথাস্থানে করা যাবে।

    ২.৩.৩ খাদ্য সরবরাহ

    সিন্ধু সভ্যতার খাদ্য সরবরাহ হত আশেপাশের গ্রামগুলি থেকে এবং শহরের বাইরের আবাদি জমিতে চাষ করে। খাদ্যশস্যের মধ্যে ছিল প্রধানতঃ গম, যব, জোয়ার, ভুট্টা এবং কিছু কিছু ধান। নানা রকমের ডাল, ছোলা, মটরের নিদর্শনও পাওয়া গেছে। অনুমান করা যায় ওই সব আবাদি জমি থেকে নানানধরনের সবজিও সরবরাহ হত। তার কোন নিদর্শন পাওয়া সম্ভব নয় কারণ সব্জি সঞ্চয় করা যায় না এবং তার অবশেষ এতবছর পরে পাওয়া সম্ভবও নয়। ফলমূলও হয়তো খাদ্য ছিল, অন্ততঃ শুকনো ফল হিসেবে খেজুরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। ওই অঞ্চলের মেওয়া, যেমন আখরোট, আঞ্জির, খেজুর, পেস্তা আজও বিখ্যাত। আশেপাশের গ্রাম এবং শহরের বাইরের পশুচারণক্ষেত্রগুলি, দুধ, ঘি এবং মাংস সরবরাহ করত।
     
    বড়ো শহরগুলির আবাসন পরিকল্পনা থেকে প্রত্নবিদেরা অনুমান করেন, এক একটি শহরে মোটামুটি বাইশ থেকে পঁচিশ হাজার লোক বসবাস করতে পারত। এতগুলি লোকের দৈনন্দিন খাদ্য সরবরাহ খুব সহজ কাজ নয়। আশেপাশের গ্রাম এবং শহর সংলগ্ন কৃষিক্ষেত্র থেকে এই উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপন্ন করত যে কৃষকেরা, তারা যে অত্যন্ত দক্ষ, বিচক্ষণ এবং প্রযুক্তিতেও উন্নত ছিল, সে কথা বলাই বাহুল্য। এমন কথাও ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে, সিন্ধু ও হাকরা অববাহিকার অনুকূল উর্বর মাটি ও পর্যাপ্ত জলধারায় তারাই প্রথম খরিফ শস্য হিসেবে ধান এবং রবি শস্য হিসেবে গম, ভুট্টা, জোয়ারের চাষ শুরু করেছিল। কারণ ধান সেই সময় ওই অঞ্চলের স্বাভাবিক শস্য ছিল না, ধান চাষের উৎপত্তি হয়েছিল চিন,  উত্তরপূর্ব এবং পূর্ব ভারতে। প্রসঙ্গতঃ “খরিফ” শব্দটি আরবি শব্দ – যার অর্থ শরৎঋতু, বিজ্ঞানীরা বলেন এই শব্দটি ভারতে এসেছিল মুসলিম বিজেতাদের সঙ্গে। কিন্তু কথাটা সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই জনপ্রিয় হওয়া অসম্ভব নয়, কারণ ওই অঞ্চলের সঙ্গে ইরান, মেসোপটেমিয়া (ইরাক) এবং আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান ছিল।

    সে যাই হোক, একথা স্পষ্ট অনুমান করা যায়, বিস্তীর্ণ সিন্ধুসভ্যতার এতগুলি শহরের এতগুলি মানুষের দৈনন্দিন অন্ন সংস্থানের জন্যে প্রচুর শস্যের প্রয়োজন হত। অতএব এই বিপুল উদ্বৃত্ত শস্য উৎপাদনের জন্যে সৃষ্টি করতে হয়েছিল বিস্তীর্ণ কৃষিক্ষেত্র। ফলতঃ প্রচুর বনভূমি এবং প্রাকৃতিক তৃণক্ষেত্রকে নির্দ্বিধায় ধ্বংস করতে হয়েছিল, সেকথা বলাই বাহুল্য। যার ফল হয়েছিল মারাত্মক, এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা পরে আসবে।

    ২.৩.৪ বাণিজ্যই ছিল শহরগুলির একমাত্র উদ্দেশ্য

    শহরগুলির উদ্দেশ্য ছিল একটাই, নিবিড় বাণিজ্য শৃঙ্খল (Trade chain) গড়ে তোলা। সিন্ধুসভ্যতার সম্পূর্ণ বিস্তারের দিকে চোখ রাখলেই এই উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বাণিজ্য শৃঙ্খলের প্রধান স্তম্ভ ছিল দুটি, প্রথমতঃ কারিগরি এবং শিল্প কুশলতা এবং দ্বিতীয়তঃ বন্ধুত্বপূর্ণ নিবিড় যোগাযোগ।

    কারিগরি এবং শিল্প কুশলতাঃ হরপ্পা সভ্যতার বেশ কয়েকটি সামগ্রী যে গুণগত উৎকৃষ্টতায় সমসাময়িককালে যথেষ্ট জনপ্রিয় এবং সমাদর পেয়েছিল, সে কথা স্পষ্ট। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে গড়ে ওঠা এই শহরগুলি অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট লাভজনক (viable) ছিল, তা নাহলে এই শহরগুলির গড়ে ওঠা এবং এতদিন ধরে সগৌরবে টিকে থাকা সম্ভব হত না। সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের শুরু মোটামুটি ৩৫০০ বি.সি.ইতে এবং অন্তিম সময় মোটামুটি ১৭৫০ বি.সি.ই।

    রাজস্থান এবং বালুচিস্তান থেকে আসত তামা, টিন আর রূপো। রাজস্থান থেকেই পাহাড়ি নদীর বালু চেলে সংগ্রহ করা সোনা আসত। পশ্চিম ভারত থেকে আসত মূল্যবান পাথর, লাপিস আসত ছাগাই পর্বত বা পামির থেকে। দামি কাঠ, যেমন সেগুন বা মেহ্‌গিনি আসত গুজরাটের অরণ্য থেকে। সুদীর্ঘ সমুদ্র তটরেখা থেকে আসত ঝিনুক, শাঁখ, কড়ি। তাছাড়া সিন্ধু ও হাকরা অববাহিকায় প্রত্যেকবার বন্যায় জমে ওঠা মিহিন পলিমাটি ছিল মাটির পাত্র বানানোর জন্যে।  
     
    দূর দূর প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করে আনা এই সমস্ত উপকরণ দিয়ে অপূর্ব সব সামগ্রী বানিয়ে তুলত দক্ষ শিল্পী এবং কর্মীরা। এই দক্ষ শিল্পীদের সকলেই কী স্থানীয় ছিল? নিশ্চিতভাবে জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু আন্দাজ করাই যায়। ছাগাই পাহাড় থেকে আনা, খনিজ পাথর কেটে কী ভাবে লাপিস লাজুলির দানা বানাতে হয় এবং পালিশ করে তাকে চকচকে করতে হয়, কী ভাবে শিখে যাবে, হরপ্পার পাশের গ্রামের একটি সাধারণ ছেলে বা মেয়ে? যে জীবনে কোনদিন ওই পাথর হয়তো চোখেই দেখেনি। অথবা রাজস্থানের তামা বা টিনের ইনগট থেকে কীভাবে সেরা ব্রোঞ্জ বানাতে হয়। কী ভাবে কাঠের ছাঁচ বানাতে হয়, সে ছাঁচে গলানো ব্রোঞ্জ ঢেলে কীভাবে বানাতে হয়, অপূর্ব ভঙ্গিমার নারী কিংবা মাতৃকা মূর্তি? তাও কী জানা সম্ভব ছিল স্থানীয় অধিবাসীদের? 

    অতএব ধরে নেওয়াই যায়, দক্ষ কারিগর এবং শিল্পীদের আনা হয়েছিল, সংলগ্ন সব অঞ্চল থেকে। অন্ততঃ প্রথম দিকে তো বটেই, যতদিন না, স্থানীয় ছেলে বা মেয়েরা, দক্ষ শিল্পী ও কারিগরদের থেকে শিখে নিতে পারে এই কুশলতা।

    সেক্ষেত্রে দক্ষ এই শিল্পীদের দল, অবশ্যই বিভিন্ন অঞ্চলের, সমাজের এবং সংস্কৃতির মানুষ। নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে কেন এসেছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত এক অঞ্চলে? নিশ্চিতভাবে বলা খুবই কঠিন। তবে ক্রীতদাস হয়ে যে নয়, সেটা হয়তো নিশ্চিত। অনুমান করা যায়, হয়তো লোভনীয় পারিশ্রমিক, গুণের যথোচিত মর্যাদা  এবং গভীর আস্থা ও মৈত্রীর টানে।

    সে যাই হোক সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান পণ্য ছিল, দামি পাথরের দানা বসানো সোনার অলংকার। হাতির দাঁত, ঝিনুক আর শাঁখ কেটে বানানো নানান অলংকার এবং বিলাসসামগ্রী। মাটি এবং ব্রোঞ্জের অজস্র মূর্তি। মাটির খেলনা, পুতুল। তবে এই সভ্যতার অনন্য নিদর্শন হল, বিচিত্র নকশাকাটা, উজ্জ্বল রঙের চকচকে মাটির নানান পাত্র। সেই সময়ে এই পাত্রগুলি যেন সিন্ধু সভ্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। দেশ বা বিদেশের কোন জনপদের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া হরপ্পার মাটির পাত্র কিংবা তার ভগ্নাংশ দেখে, প্রত্নবিদেরা সেই জনপদের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার যোগসূত্র নির্ধারণ করতে পারেন। অন্যান্য জনপদের মাটির পাত্রটি হয়তো হরপ্পার উৎকৃষ্ট পাত্র নয়, তার অনুকরণে স্থানীয় কুম্ভকার বানিয়েছে। কিন্তু তাতেও প্রমাণ হয়, কুম্ভকার অন্ততঃ কয়েকটি হরপ্পার মৃৎ-পাত্র চাক্ষুষ করেছিল।

    সিন্ধুসভ্যতার মৃৎপাত্রের নমুনা। 
     

    মাতৃকা মূর্তি 
     
     
    Indus Seals and Glyptic Studies: An Overview | Harappa     
    বিশেষজ্ঞদের মতে - পশুপতি মূর্তি 
     

    সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া - চিত্র এবং চিত্রলিপি সম্বলিত কিছু সিল। 

    দেশের বাইরে সিন্ধুসভ্যতার সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল মেসোপটেমিয়া (ইরাক), পারস্য (ইরান), ওমান, আরব এবং হয়তো আরো পশ্চিমে মিশর পর্যন্ত । এই দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল স্থলপথে এবং জলপথে। বোলান গিরিপথ ধরে স্থলপথের কথা আগেই বলেছি, যে পথে লক্ষলক্ষ বছর ধরে মানব প্রজাতি এবং মানুষের যাতায়াত। আর জলপথ ছিল, সমুদ্রের উপকূল ধরে, পারস্য উপসাগরের পথে। মেসোপটেমিয়া এবং পারস্য উপসাগরের দুপাশের উপকূলে হরপ্পা সভ্যতার অনেক নিদর্শন পাওয়া গেছে। কোন এক মেলুহা দেশ এবং তার অধিবাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায় মেসোপটেমিয়ার কিছু প্রাচীন লিপিতে। সেই দেশ থেকে তারা হাতির দাঁত, সোনা, নানা দামি পাথরের অলংকার, কাঠ এবং লাপিস আমদানি করত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মেলুহাই হল সিন্ধু সভ্যতা। অতএব এই সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতা না বলে – হয়তো “মেলুহা সভ্যতা” বললে – অসাধারণ ওই মানুষদের কৃতিত্বকে আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো হবে।    

    সফল বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হল গুণমান নিয়ন্ত্রণ (Quality control)। সোনা বা দামী পাথরের সূক্ষ্ম ওজন থেকে ভারি শস্যের বস্তা ওজনের সরঞ্জাম সবই পাওয়া গেছে এই সিন্ধুসভ্যতায়। বিশেষজ্ঞরা হরপ্পা, মহেঞ্জোদারো এবং চানহু-দারো থেকে মোট ৫৫৮টি ছোটবড়ো বাটখারা সংগ্রহ করতে পেরেছেন। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, এই বাটখারাগুলির ওজনের মান যথেষ্ট নিখুঁত ছিল। আজকের ১৩.৭ গ্রাম ওজন ছিল তাদের ওজনের একক। এই বাটখারাগুলির অধিকাংশই বানানো হত চুণের ঘনক (lime cube) থেকে। দৈর্ঘ্য মাপার জন্যে হাতির দাঁতের রুলার পাওয়া গেছে, যার একক ছিল ১.৩২ ইঞ্চি বা ৩৩.৫০ মিমি। এই পরিমাপের সূক্ষ্মতা ছিল আশ্চর্যজনক। এই সভ্যতায় ব্যবহার করা যত ইঁট পাওয়া গেছে, এই পরিমাপ অনুযায়ী তাদের ছিল সুনির্দিষ্ট আকার। প্রত্নখননে দাঁড়িপাল্লাও পাওয়া গেছে। তামা কিংবা ব্রোঞ্জ দিয়ে বানানো হত দাঁড়ি (stand বা bar) আর দুপাশের পাল্লা (pans)। সার্ভে এবং নির্মাণ কাজের জন্যেও অনেক যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে, যার থেকে বোঝা যায়, এই সভ্যতার মানুষেরা কৌণিক পরিমাপেও দক্ষ ছিল। কয়েক হাজার বছর আগে বিশ্‌ভাই পরিমিতির (mensuration and measurement) যে ধারণার সূচনা করেছিলেন, সেই ধারণাই আরও অনেক উন্নত হয়ে উঠেছিল সিন্ধু সভ্যতার সময় কালে।

    ২.৩.৫ সিন্ধু সভ্যতার সিল

    মাটির পাত্র যেমন সিন্ধু সভ্যতার অনন্য প্রতীক, তেমনি আরেকটি প্রতীক হল তার সিল। সাধারণতঃ স্টিটাইট[2] পাথরে তৈরি পাতলা এই সিলগুলি হত বর্গাকার বা আয়তাকার। সিলগুলির ওপরে নানান চিত্র, নকশা এবং বেশ কিছু লিপি আঁকা থাকত। চিত্রের মধ্যে ছিল নানান ধরনের পশু, মানুষের আকৃতি, জ্যামিতিক নকশা। লিপিগুলির পাঠোদ্ধার এখনও সম্ভব হয়নি, যেদিন হবে সিন্ধুসভ্যতার নতুন মূল্যায়ন আমাদের ইতিহাসকে আরো উজ্জ্বল করে তুলবে। বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, এগুলি আমাদের অ-আ-ক-খ-র মতো বর্ণলিপি নয়, বরং চিত্রলিপি। যে ধরনের চিত্রলিপি আমরা আজও ব্যবহার করি ট্র্যাফিক সিগন্যালের “নো-হর্ণ জোন” বা “স্কুল-জোন” বোঝাতে অথবা পাব্লিক টয়লেটের মহিলা-পুরুষ চিহ্নিত দরজায়। যে কারণে বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সমাজে – মেসোপটেমিয়া থেকে গুজরাট – সবার কাছেই এই চিত্রলিপি সেসময় পাঠযোগ্য ছিল। সিন্ধু সভ্যতার ধোলাভিরা শহরে বড়ো বড়ো লিপি খোদাই করা একটি পাথরের বড়ো ব্লক পাওয়া গেছে, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, এটি হয়তো কোন সাইনবোর্ড ছিল।

    খুব স্পষ্ট না হলেও, অনুমান করা যায়, পণ্য চিহ্নিতকরণের জন্যেই এই সিলগুলির বহুল ব্যবহার ছিল। যেমন পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করা, পণ্যটি কোন শহরে বানানো, কোন আধিকারিক সেটি শংসিত করেছে, ইত্যাদি। এমনকি কোন বিখ্যাত শিল্পীর বানানো, হয়তো সেটাও। আজও, আমাদের বহু পণ্যে যেমন “চেক্‌ড্‌ ওকে”, “মেড ইন ইণ্ডিয়া”, “হলমার্ক”, ব্যাচ নাম্বার উল্লেখ করা থাকে। সিলগুলিতে কোন রং বা কালি মাখিয়ে ছাপ দিয়ে দেওয়া হত, কিংবা সরাসরি নরম অবস্থায় ধাতু এবং মাটির গায়ে চাপ দিয়ে ছাপ ফেলা হত। অর্থাৎ ছাপ দেওয়ার জন্যে আমরা রাবার স্ট্যাম্পের লেখা বা লোগোচিহ্ন যেমন উলটো করে লিখি, এই সিলগুলির চিত্র, নকশা বা লিপিগুলিও উলটো করে লেখা হয়েছিল।  

    ২.৩.৬ সিন্ধু সভ্যতার সুদীর্ঘ অস্তিত্ব

    ভারতীয় উপমহাদেশ তো বটেই, সারা বিশ্বে সুদীর্ঘ এক হাজার সাতশ পঞ্চাশ বছর ধরে, কোন মহিমময় সাম্রাজ্যই সগৌরবে টিকে থাকতে পারেনি। পৃথিবী বিখ্যাত বারোটি মহান সাম্রাজ্যের সময়কালে একবার চোখ রাখা যাকঃ-

    ১) আক্কাদিয়ান সাম্রাজ্য (বিশ্বের প্রথম সাম্রাজ্য)
       দেশ বা অঞ্চল – মেসোপটেমিয়া (আধুনিক ইরাক)
       সময় কাল – ২৩৩৪ – ২০৮৩ বিসিই = ২৫০ বছর।
    ২) অ্যাকিমিনিড বা পারস্য সাম্রাজ্য
       দেশ বা অঞ্চল – পারস্য (আধুনিক ইরান)
       সময় কাল – ৫৫০ – ৩৩০ বিসিই = ২২০ বছর।
    ৩) রোমান সাম্রাজ্য
        দেশ বা অঞ্চল – ইটালি এবং ভূমধ্য সাগরীয় অঞ্চল।
        সময় কাল – ২৭ বিসিই – ৪৭৬ এডি/ ১৪৫৩ এডি = ৫০৩ / ১৪৮০ বছর।
    (মূল রোম সাম্রাজ্যের সময়কাল ৫০৩ বছর। তারপর বহুবার ভেঙে টুকরো হয়েছে এবং সম্রাটদের হাত বদল হয়েছে।)
    ৪) উম্মায়েদ খলিফা সাম্রাজ্য
        দেশ বা অঞ্চল – আরব, ইজিপ্ট, ইরাক। 
        সময় কাল – ৬৬১ – ৭৫০ এডি = ৮৯ বছর।
    ৫) কিং সাম্রাজ্য
        দেশ বা অঞ্চল – চিন, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত।  
        সময় কাল – ১৬৪৪ – ১৯১২ এডি = ২৬৮ বছর।
    ৬) জার সাম্রাজ্য
        দেশ বা অঞ্চল – রাশিয়া।   
        সময় কাল – ১৭২১ – ১৯১৭ এডি = ১৯৬ বছর।
    ৭) মঙ্গোলিয় সাম্রাজ্য
        দেশ বা অঞ্চল – মঙ্গোলিয়া ও আংশিক চিন।   
        সময় কাল – ১২০৬ – ১৩৬৮ এডি = ১৬২ বছর।
    ৮) মুঘল সাম্রাজ্য
        দেশ বা অঞ্চল – দাক্ষিণাত্যের কিছুটা ছাড়া, সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ।    
        সময় কাল – ১৫২৬ -১৮৫৮ এডি = ৩৩২ বছর।
    ৯) ব্রিটিশ সাম্রাজ্য
       দেশ বা অঞ্চল – পৃথিবীর স্থলভূমির প্রায় এক চতুর্থাংশ।
        সময়কাল – খ্রিষ্টাব্দ ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্য ভাগ = প্রায় ৩০০ বছর।
    ১০)  অটোম্যান সাম্রাজ্য
         দেশ বা অঞ্চল – ভূমধ্য সাগরের তিনদিক, আরবের কিছু অংশ, ইরাক।
         সময়কাল – ১২৯৯ – ১৯২৩ এডি  = ৬২৪ বছর।
    ১১) মৌর্য সাম্রাজ্য
        দেশ বা অঞ্চল – অখণ্ড ভারতের অধিকাংশ।
        সময়কাল – ৩২৩ – ১৮৪ বিসিই = ১৩৯ বছর।
    ১২) গুপ্ত সাম্রাজ্য
         দেশ বা অঞ্চল – আধুনিক ভারতের সিংহভাগ।
        সময়কাল – ৩৭৫ – ৫৫০ এডি = ১৭৫ বছর।
     
    সিন্ধু সভ্যতা কিন্তু কোন সাম্রাজ্য নয়, কাজেই তার সঙ্গে সম্রাট বা রাজবংশের পরিচালনাধীন সাম্রাজ্যের কোন তুলনাই চলতে পারে না। তবুও তথ্যগুলি আমি তুলে ধরলাম, এই কারণে যে, আমাদের বাল্যবয়সে এই সব রাজবংশের উত্থান-সাফল্য-পতনের বৃত্তান্ত আমাদের কত না রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার গুরুত্ব অবহেলায় সরিয়ে রাখা হয়েছিল মাত্র দু-তিন পাতায়।

    ২.৩.৭ গণসঙ্ঘী প্রশাসন

    সাম্রাজ্যই হোক বা কোন উদ্যোগই হোক, তার সাফল্য এবং দীর্ঘস্থায়ীতা নির্ভর করে প্রশাসনিক দক্ষতার ওপর। আমার বিস্ময় এখানেই, কোন প্রশাসনিক দক্ষতার জোরে, বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা এমন একটা উদ্যোগকে এত দীর্ঘ সময় সাফল্যের সঙ্গে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হল? আমার বিশ্বাস – এই প্রশাসন চালাতেন নির্বাচিত কোন গণসঙ্ঘ বা বুধমণ্ডলী। তাঁদের এতদিন ধরে সগৌরবে টিকে থাকার রহস্য হল বন্ধুত্বপূর্ণ নিবিড় যোগাযোগ। তাঁদের মূলমন্ত্র ছিল – যুদ্ধ নয়, রাজ্য জয় ও ক্ষমতার লিপ্সা নয় - মৈত্রী এবং সহযোগীতা। যার সূচনা করেছিলেন, পিতা পশুপতি, মাতা মিত্তিকা এবং বিশ্‌ভাই।

    সিন্ধু সভ্যতার এত জটিল এবং ব্যপ্ত নাগরিক সমাজকে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ করত কে বা কারা, সে বিষয়েও বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন না। এতগুলি শহর কী নিয়ন্ত্রিত হত একই প্রশাসনের অধীনে? নাকি প্রত্যেকটি শহর এবং আশেপাশের কৃষিক্ষেত্র আলাদা আলাদা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকত? সেক্ষেত্রে প্রত্যেকটি শহরের পণ্যের গুণমান কী করে একই রকম হতে পারত?

    শহরগুলির গঠন এবং সুশৃঙ্খল কার্যপ্রণালী দেখে, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, প্রত্যেকটি শহরকে নিয়ন্ত্রণ করত পরিচালন সমিতি। আঞ্চলিক এই পরিচালন সমিতি আবার বৃহত্তর এক পরিচালক সমিতিকে অনুসরণ করত। এই বৃহত্তর সমিতি গঠিত হত, সবগুলি শহরের আঞ্চলিক সমিতির দু’একজন প্রতিনিধি নিয়ে। এই ধরনের প্রশাসনকে নিশ্চয়ই গণসঙ্ঘ (confederation) প্রশাসন বলা যায়। যে গণসঙ্ঘের স্পষ্ট রূপ আমরা এই ভারতেই আবার দেখতে পাবে প্রায় হাজার খানেক বছর পরে। সে কথা আসবে যথা সময়ে, তবে একথা নিশ্চিতভাবেই আন্দাজ করা যায়, এই পরিচালন সমিতিগুলির মধ্যে যে নিবিড় সমন্বয় ছিল, তার অকাট্য প্রমাণ এই সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ীতা। যুদ্ধ এবং অসভ্য হানাহানিহীন - এক হাজার সাতশো পঞ্চাশ বছরের নিরবচ্ছিন্ন নিবিড় সভ্যতা। এই সভ্যতা হয়তো আরও দীর্ঘায়ু হত, যদি না পরপর অনেকগুলি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটত।  সে কথায় একটু পরেই আসছি।
     
    অতএব এই কারণেই সিন্ধুসভ্যতার কোন শহরেই রাজকীয় কোন প্রাসাদ, বিশিষ্ট কোন সমাধি মন্দির অথবা কোন স্মারক ভবনের নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
     
    প্রশাসনের এই পেশাগত দক্ষতা এবং নির্দিষ্ট বাণিজ্যিক দায়বদ্ধতার কারণেই কোন শহরেই গড়ে উঠতে পারেনি কোন ধর্মস্থান বা ধর্ম মন্দির। বিভিন্ন অঞ্চলের বিবিধ সামাজিক-সংস্কৃতির মানুষেরা এই শহরগুলিতে এসেছিল তাদের কারিগরি দক্ষতা নিয়ে, প্রশাসনের চাহিদা শুধু সেটুকুই। কোন আঞ্চলিক ধর্মীয় প্রথা বা ব্রতপালনকে প্রশ্রয় দিয়ে অন্য অঞ্চলের মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তাঁদের ছিল না। কাজেই কোন ধর্ম প্রতিষ্ঠান, কিংবা চোখ ধাঁধানো কোন মন্দির বা ধর্মস্থান গড়ে তোলার কোন পরিকল্পনা তাঁরা কোন শহরে কোনদিনই করেননি। কিছু কিছু মূর্তি – যেগুলিকে বিশেষজ্ঞরা দেবমূর্তি এবং মাতৃকা মূর্তি বলে মনে করেছেন, সেগুলি শিল্পীরা হয়তো তাদের ব্যক্তিগত অবসরে বানিয়েছিল, নিজের সমাজ ও সংস্কৃতির স্মৃতিটুকু চোখের সামনে ধরে রাখার জন্যে। আজও যেমন আমাদের মধ্যে অনেকে সর্বদাই পার্সের মধ্যে ঠাকুর রামকৃষ্ণ কিংবা তিরুপতি বাবা অথবা কামাখ্যা কালীমাতার ছবি এবং দূর প্রবাসে গেলে তাঁদের একটি ফটো আমাদের ব্রিফকেসে বহন করে থাকি। 

    ২.৩.৮ নিরাপত্তা ও রণসম্ভার

    সিন্ধু সভ্যতার সবকটি শহরেই নিরাপত্তা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ছিল চোখে পড়ার মতো। ব্রোঞ্জের কিছু অস্ত্র–শস্ত্র যা পাওয়া গেছে, সেগুলিকে শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার রণসম্ভার বলা যায় না। হয়তো সেগুলি বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবেই তৈরি করা হয়েছিল। কোন শহরের কোথাও অস্ত্রাগার কিংবা সেনা আবাসের কোন নিদর্শন পাওয়া যায়নি। বহু শহরেই বেশ কিছু সমাধির গর্ভে অনেক কংকাল পাওয়া গেছে। তার মধ্যে কয়েকটিকে গণ-সমাধি বলা যায়। যেগুলিকে প্রথম দিকে মনে করা হত যুদ্ধে বা সংঘর্ষে মৃত। কিন্তু পরবর্তী কালে ময়না তদন্ত করে দেখা গেছে, মৃতদের মৃত্যুর কারণ যুদ্ধ বা সংঘর্ষজনিত কোন আঘাত নয়, বরং তীব্র রক্তাল্পতা। যার একমাত্র কারণ হতে পারে অসুস্থতা - হয়তো কোন মহামারি। বাকি সব সমাধিই নেহাত ব্যক্তিগত সাধারণ সমাধি। অতএব যুদ্ধে অথবা অন্য কোন কারণেই শহরে গণ-হত্যার ঘটনা যে ঘটেনি, সে কথা সহজেই অনুমান করা যায়।

    বেশ কিছু শহরের সীমানায় শক্ত-পোক্ত পাথর বা ইঁটের প্রাচীরের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এগুলি শত্রু আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্যে নয়, বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন, নদীর বন্যার জল আটকানোর জন্যে। কারণ এমন অনেকগুলি শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলি কয়েকশ বছরে কয়েকবার বন্যার জলে সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছিল। এবং তার ওপরে আবার নতুন করে শহর নির্মাণ হয়েছিল। অতএব খামখেয়ালী সিন্ধু এবং হাকরা নদীর প্লাবনই ছিল সিন্ধুসভ্যতার শহরগুলির আতঙ্কের একমাত্র কারণ, কোন আগ্রাসী শত্রুপক্ষ নয়।

    ২.৩.৯ সিন্ধুসভ্যতার অবসান

    সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলি আবিষ্কারের প্রথম দিকে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করতেন, এই সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল আর্যদের আক্রমণে। কিন্তু এখন সেই অনুমান সম্পূর্ণ বাতিল হয়ে গেছে। আধুনিক বিজ্ঞানীদের স্থির বিশ্বাস আর্যদের সঙ্গে গুরুত্বহীন কিছু ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়তো হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলি অত্যন্ত গৌণ।  সিন্ধুসভ্যতার সম্পূর্ণ অবলুপ্তির মুখ্য কারণ তো বটেই, হয়তো একমাত্র কারণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়।

    ১৯৪০ সালে একজন ভারতীয় জীবাশ্মবিদ, এম আর সাহ্‌নি, সিন্ধু সভ্যতার অবলুপ্তির প্রথম এবং প্রধান কারণগুলি আবিষ্কার করেছিলেন। এই উপমহাদেশে সে সময়টা ছিল প্রাক-স্বাধীনতা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়। অতএব সে সময়ে তাঁর বক্তব্য নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল না এবং কেউই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু পরবর্তী কালের বিজ্ঞানীরা আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে তাঁর তত্ত্বকে শুধু সমর্থন নয়, দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
     
    আজ থেকে মোটামুটি পাঁচ থেকে চার হাজার বছর আগে ওই অঞ্চলে বেশ কয়েকবার – অন্ততঃ তিনবার - যে ব্যাপক ভূতাত্ত্বিক বিপর্যয় ঘটেছিল সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা নিঃসন্দেহ। এমনই এক ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের ফলে মহেঞ্জোদারো শহর থেকে প্রায় ১৫০ কি.মি. দক্ষিণে সেহ্‌ওয়ান অঞ্চলে বেশ বড়োসড়ো এক ভূস্তরীয় চ্যুতি (fault) ঘটেছিল। সেই চ্যুতির ফলে ওই অঞ্চলে সিন্ধু নদের স্বাভাবিক প্রবাহপথের সামনে গড়ে উঠেছিল মাটি ও পাথরের বিস্তীর্ণ এক প্রাকৃতিক বাঁধ। সেই বাঁধে আটকে যাওয়া সিন্ধুর জল জমে উঠছিল সেহ্‌ওয়ানের ওপরের দিকে। আর সেহ্‌ওয়ানের নিচে আরব সাগর পর্যন্ত সিন্ধুর স্বাভাবিক প্রবাহ শুকিয়ে গিয়েছিল। বাঁধের ওপারে সিন্ধুর জলপ্রবাহ জমতে জমতে বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে গিয়েছিল প্রাকৃতিক এক সরোবরের গভীর জলের তলায়। যার মধ্যে ছিল মহেঞ্জোদারো শহর এবং তার আশেপাশের বেশ কিছু শহর, অজস্র জনপদ ও গ্রাম। অদ্ভূত এই বিপর্যয়ের আরও প্রমাণ পাওয়া যায়, মহেঞ্জোদারো শহরের নগর নির্মাণের বিভিন্ন স্তর পর্যবেক্ষণ করলে। অভূতপূর্ব এই প্লাবন থেকে শহরকে রক্ষা করার জন্যে, শহরের চারদিকে প্রাচীর দেওয়ার প্রচেষ্টা হয়েছিল। ১৯৬৪ সালের প্রত্নখননে বিশাল সেই প্রাচীরের যে নিদর্শন পাওয়া গিয়েছিল, তার উচ্চতা ছিল পঁচিশ ফুটেরও বেশি! তাছাড়াও সরোবরের জলস্তর থেকে উঁচুতে শহরের ভিত তুলে আনারও চেষ্টা করেছিল, মহেঞ্জোদারো শহরের প্রশাসন।

    প্রায় পঞ্চাশ-ষাট বছর ধরে ভূমিক্ষয় করে, সেহ্‌ওয়ানের প্রাকৃতিক বাঁধ উপচে সিন্ধু তার নতুন যাত্রা পথ তৈরি করে আরব সাগরে আবার মিশে যেতে পেরেছিল। সরোবরের জলও বেরিয়ে এসেছিল সিন্ধুর প্রবাহ ধরে, পিছনে ফেলে এসেছিল বিশাল পলির স্তর। বহু জনপদ ও গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল পঁচিশ থেকে তিরিশ ফুট গভীর সেই পলির তলায়।

    ওই অঞ্চলে অন্ততঃ তিনটে বড়ো ভূমিকম্পের প্রমাণ প্রত্নবিদেরা পেয়েছেন, ২৯০০, ২৭০০, এবং ২২০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি সময়ে। এই ভূমিকম্পের ফলে গোটা অঞ্চলেরই ভূস্তরে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল, তার আরও একটি প্রমাণ হাকরা নদীর গতিপথের আমূল পরিবর্তন। যে হাকরা নদীর জলের ভরসায় গড়ে উঠেছিল বেশ কয়েকটি শহর এবং অজস্র জনপদ, সেই হাকরা শুকনো হয়ে গিয়েছিল মোটামুটি ২০০০ বি.সি.ই-তে।

    অতএব একের পর এক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বারবার বিপন্ন হয়ে উঠল সিন্ধু সভ্যতার সুশৃঙ্খল বাণিজ্যিক অন্তর্জাল। অজস্র জনপদ ও ছোট শহর অবলুপ্ত হয়ে গেল, বড়ো শহরগুলিকে সুরক্ষিত করতে বিপুল অর্থব্যয় করতে হচ্ছিল বারবার। জলের অভাবে শুকনো হাকরা অববাহিকার শহরগুলিকেও পরিত্যক্ত করতে হল। নিশ্চিন্ত অন্নসংস্থান হত যে বিপুল কৃষিক্ষেত্র থেকে তারও অনেকখানি চলে গেল পলির তলায় অথবা শুষ্ক অনুর্বর হয়ে উঠল। সব মিলিয়ে ভেঙে পড়ল গোটা সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতি। যার থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথ খুঁজে না পেয়ে, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষরা ফিরে যেতে শুরু করল তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে। সিন্ধু সভ্যতার সুখের স্মৃতি ও দুঃখের ভয়ংকর রেশটুকু নিয়ে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা সরে আসতে লাগল রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানায়। পরবর্তী কালে তারা ছড়িয়ে পড়ল আরও পূর্বদিকে গঙ্গার অববাহিকায়, দক্ষিণের গুজরাটে, এমনকি মধ্যভারতের নর্মদার অববাহিকা অঞ্চলেও।

    ২.৩.১০ দেবতার অভিশাপ

    ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের, যার অধিকাংশই এখন পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত, ভূতাত্ত্বিক চরিত্র কিছুটা অনন্য। দুটি টেকটনিক[3] প্লেটের ওপর অঞ্চলটি বিস্তৃত। সিন্ধ, পাঞ্জাব এবং জম্মু-কাশ্মীরের অধিকাংশ অঞ্চলই রয়েছে দক্ষিণ-এশিয় প্লেটের ওপর। বাকি সব অঞ্চলের অবস্থান ইউরেসিয়ান প্লেটের পারস্য মালভূমির ওপর। এই দুই প্লেটের সঞ্চলনের ফলে এই অঞ্চল অত্যন্ত ভূমিকম্প প্রবণ। এই অঞ্চলের বিগত তিনশ’ বছরের ভূমিকম্পের তথ্যের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে অন্তত তিনবার পঞ্চাশ হাজারের বেশী মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। অন্ততঃ দুবার সুনামি এবং একবার ভয়ংকর ভূস্খলনের ঘটনা ঘটেছিল। আর ছোটখাটো ভূমিকম্পে এই অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় প্রত্যেক বছর।

    ২৯০০ বি.সি.ই-র বিপর্যয় হয়তো অনেক কষ্টে সামলে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু মোটামুটি দু’শ বছরের ব্যবধানে, ২৭০০ বি.সি.ই-র দ্বিতীয় বিপর্যয়ে সিন্ধু সভ্যতা শুধু অর্থনৈতিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ল না, এখানকার অধিবাসীরা মানসিকভাবেও দুর্বল হয়ে উঠতে লাগল। ২৯০০ বি.সি.ই-র বিপর্যয় যদি টেকটনিক প্লেট থিওরির তত্ত্ব অনুযায়ী ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে পরবর্তীকালে ছোটখাটো ভূমিকম্প মাঝে মধ্যেই ঘটে চলাও বিচিত্র নয়। তারপরেই দুশ বছরের পরে আবার এল ২৭০০ বি.সি.ই-র বিপর্যয়। বারবার এই বিপর্যয়, যার নিয়ন্ত্রণের সাধ্য কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়, কেন হচ্ছিল বারবার?

    অধিবাসীদের মনে বাসা বাঁধতে লাগল আশঙ্কা এবং আতঙ্ক। এই পর্যায় থেকেই বহু মানুষ সরে আসতে লাগল ওই অঞ্চল থেকে। নতুন নতুন শহর এবং জনপদ গড়ে উঠতে লাগল, রাজস্থান, পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং গুজরাটে। তার বহু প্রত্ন নিদর্শন পাওয়া গেছে। বারবার বিপর্যয়ে অর্থনৈতিক দিক থেকেও দুর্বল হতে থাকা পরিচালক সমিতির নিয়ন্ত্রণ কমতে লাগল। সিন্ধু সভ্যতার অনন্য গুণমান নিয়ন্ত্রণের গুণ ও মান কমতে লাগল ধীরে ধীরে, হারাতে লাগল তার বাণিজ্যিক গৌরব । অতএব ২০০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি আবার একটি বিপর্যয়ের পরেই সিন্ধু সভ্যতার শহর এবং জনপদগুলি একে একে পরিত্যক্ত হতে শুরু করল। এবং মোটামুটি ১৭৫০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি সময় থেকে, সিন্ধু সভ্যতার সদাব্যস্ত শহরগুলি পরিত্যক্ত পড়ে রইল, খুব দ্রুত বিস্মরণের অপেক্ষায়।

    প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পূর্বসূরীদের মুখে শুনে আসা একদা উজ্জ্বল গৌরবময় অতীতের কাহিনী এবং শহর ও জনপদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়া এখনকার আতঙ্কিত মানুষদের মনে এখন জমা হতে লাগল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আধুনিক টেকটনিক তত্ত্ব তাদের কল্পনার বাইরে। কিন্তু নতুন জনপদে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হতে নিজেদের মতো করেই তারা বিশ্লেষণ করতে লাগল এই পরিণতির। তারা বিশ্বাস করত দেবতা এবং দেবীরাই মানুষকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা-ভূমিকম্পের সৃষ্টি করেন। অতএব লাগাতার এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলিও নিশ্চয়ই তাঁদের অভিশাপের ফল। কিন্তু কোথায় হয়েছে মানুষের অপরাধ? সে কোন পাপ, যার ফলে এমন চরম শাস্তি দিলেন দেবতারা? চিন্তাভাবনা ও বিশ্লেষণ করে, তারা বের করে ফেলল নিজেদের যথেষ্ট অপরাধ ও প্রচুর পাপের হিসাব।

    পশুপতিদেব, মাতৃদেবী এবং বিশ্‌দেব তো শুধু মানুষের দেবতা নন। সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ, অরণ্যের গাছপালা নির্বিশেষে, তাঁরা তো সবার দেবতা। হাকরা-সিন্ধু উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অরণ্য এবং তৃণভূমি নির্মূল করে গড়ে তোলা হয়েছিল অজস্র শহর, জনপদ, গ্রাম এবং কৃষিক্ষেত্র। সে কী অপরাধ বা পাপ নয়? কত গাছপালা, কত জীবজন্তু, সরীসৃপ, পাখি, কীটপতঙ্গ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। জীবন ধারণের জন্যে দুচারটে জীব হত্যা কিংবা গাছের ফলমূল আহরণ, সে তো দেবতারাই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের এমন নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া? দেবতারা ক্রুদ্ধ হবেন না?

    সিন্ধু সমাজের পাপ আরো আছে।

    পিতৃ-পিতামহের কাল থেকে তাদের যে কোন সাফল্যে কিংবা বিপদে মানুষ দেবতাদের কাছে গিয়েছে। তারা কখনো জানিয়েছে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, কখনো বা করুণা ভিক্ষা করেছে। দেবতারা সন্তুষ্ট হয়েছেন, কখনো কখনো লঘু অপরাধ ক্ষমা করেছেন, কখনো বা পাপের শাস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু এভাবে গোটা সিন্ধু-সমাজকে তিনি চিরতরে উৎখাত করে দিলেন কেন? কোন পাপে? সে পাপ তাঁকে নিয়মিত স্মরণ না করার পাপ। সিন্ধু-সমাজের মানুষ কোনদিন কোন ব্রত পালন করেছে? করেনি। কোনদিন কোন পুজোর আয়োজন করেছে? করেনি। এমন সফল বাণিজ্যের জন্যে কোনদিন কোনভাবে তারা কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে? জানায়নি। কোন অপরাধের জন্যে কোন দিন ক্ষমা ভিক্ষা চেয়েছে? চায়নি। তাহলে? মানুষের এই সীমাহীন ঔদ্ধত্যে, দেবতারা ক্রুদ্ধ হবেন না?

    প্রাচীন সমাজের মুখ্য হতেন সমাজের প্রাজ্ঞ গুরুজন স্থানীয় কেউ, তিনিই দেবতাদের সঙ্গে নিয়মিত সংযোগ রাখতেন। আর এদিকে সিন্ধু-সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখ? এমন কী কেউ কোনদিন ছিলেন? ছিলেন না। পরিচালন সমিতির সকলেই ছিলেন পেশাদার বণিক, তাদের কারও সঙ্গে তো দেবতাদের সংযোগ ছিল না। তাহলে কার মাধ্যমে দেবতারা তাঁদের সন্তুষ্টি বা বিরক্তির বার্তা দেবেন? দেবতাদের থেকে মানুষ যদি বিচ্ছিন্নই হয়ে যায়, তাহলে আর সমাজের রইল কী? এতেও যদি দেবতারা ক্রুদ্ধ না হন, তাহলে আর কিসে হবেন?

    পরিত্যক্ত সিন্ধু-সমাজ থেকে বেরিয়ে আসা জনসংখ্যা ধরা যাক পাঁচ লক্ষাধিক। বড়ো শহরগুলির গড় জনসংখ্যা যদি বিশ-পঁচিশ হাজার হয়, তাহলে যে ছটি বড়ো শহরের উল্লেখ করেছিলাম, তাতেই জনসংখ্যা হয় দেড় লক্ষের কাছাকাছি। তার ওপরে ছিল আরও অনেক ছোট শহর, অজস্র জনপদ ও গ্রামের সপরিবার কৃষিজীবী এবং পশুপালক। সব মিলিয়ে পাঁচলক্ষ না হওয়ার কোন কারণ নেই। এই পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থী মানুষ প্রায় চার-পাঁচশ বছর ধরে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে এবং ধীরে ধীরে মিশে গিয়েছে ভারতের জন সমাজের মধ্যে। তাদের স্মৃতি রোমন্থন, অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছে, স্থানীয় মানুষরাও। সিন্ধু-সমাজের মানুষরা ঠেকে শিখেছিল, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের দেখে শিখল, অপরাধ কী? পাপ কী? দেবতাদের সন্তুষ্টি কী, তাঁদের ক্রোধ কী?

    অতএব বিপুল এবং বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভারতীয় জনগোষ্ঠী, পশ্চিমের রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তরের জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যভারত এবং দক্ষিণের রায়চুর দোয়াব পর্যন্ত পরোক্ষ অভিজ্ঞতায় উপলব্ধি করল যে, নির্বিচারে অরণ্য এবং আরণ্যকদের নিশ্চিহ্ন করা নাগরিক সভ্যতা মঙ্গলকর নয়। দেবতারা ক্রুদ্ধ হন। দেবতাদের সঙ্গে সতত সংযোগ রাখা একান্ত জরুরি এবং নিয়মিত সংযোগর জন্যে নির্দিষ্ট হবেন কোন শ্রদ্ধেয় মানুষ – শমন, ওঝা, গুণিন অথবা সমাজের প্রাজ্ঞ কোন গুরুজন। দেবতাদের নিয়মিত কৃতজ্ঞতা এবং কৃপা ভিক্ষা করার জন্যে অবশ্যই পালন করতে হবে ব্রত, পার্বণ, পুজো। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু, সকল কার্যের কারণ দেবতারাই। শিশুর জন্ম, অন্নপ্রাশণ, (কন্যাদের ক্ষেত্রে) ঋতুদর্শন, বিবাহ ও মৃত্যু – সকল ক্ষেত্রেই দেবতাদের স্মরণ করা একান্ত জরুরি। কৃষিজীবিরা কৃষি কাজের শুরুর থেকে শস্য ঘরে তোলা পর্যন্ত – প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে দেবতাদের স্মরণ করে থাকে। অম্বুবাচীর - ওই সময় জমি রজঃস্বলা হন, জমিকর্ষণ নিষিদ্ধ - ব্রত পালনের পর চাষ শুরু হবে। শেষ হবে নবান্নে – দেবতাকে নতুন শস্য উৎসর্গের ব্রতে।

    এভাবেই জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে, সমাজের প্রতিটি কাজে ওতপ্রোত জড়িয়ে গেল ব্রত, মানত, পার্বণ পুজো। দেবতাদের খুব পরিবর্তন হল না, পশুপতিদেব এবং বিশ্‌ভাই হলেন বিশ্‌দেব। কিন্তু অঞ্চল ভেদে মাতৃদেবী মিত্তিকার এখন অজস্র নাম এবং রূপ। কখনো তিনি রুদ্ররূপা কালী, তারা, করালী, চণ্ডী। কখনো বরাভয়দায়িনী
    ব্যঘ্রবাহনা, কখনো সিংহবাহিনী, কখনো অন্নপূর্ণা। যেভাবে মাকুর টানাপোড়েনে তন্ত্রী নিবিড় বুনোটে বস্ত্র বয়ন করে, সেভাবেই নিবিড় তন্ত্রে ধীরে ধীরে একসূত্রে বাঁধা পড়তে থাকল ভারতের অধিকাংশ সমাজ। এই তন্ত্র সমাজকে ধরে রাখে, সহযোগী করে তোলে, সহাবস্থান গড়ে তোলে অরণ্য, আরণ্যক, প্রকৃতি এবং প্রতিবেশী মানুষদের নিয়ে।

    চলবে...
    (১৩/০৫/২০২২ তারিখে আসবে দ্বিতীয় পর্বের চতুর্থ অধ্যায়।)

     
     
    গ্রন্থঋণ/তথ্যঋণঃ
    ১) The penguin history of Early India – Romila Thapar
    ২)বাঙ্গালীর ইতিহাস (প্রথম পর্ব) –ডঃ নীহাররঞ্জন রায়।
    ৩) https://www.harappa.com
    ৪) The Decline of Harappans – A research report (1966) - Mr. George F Dales (উৎসাহী পাঠকেরা এই লিংক থেকে পুরো রিসার্চ রিপোর্টটি পড়ে নিতে পারেন, - https://www.harappa.com/content/decline-harappans
    ৫) Ancient Gold Mining Activities in India - An Overview: An Article published in Iranian Journal of Earth Sciences 7 (2015) – by A.K. Grover and M.K. Pandit 
    ৬) The wonder that was India – A. L. Basham.
     
    চিত্র ও মানচিত্র ঋণঃ https://www.harappa.com

    [1] হেক্টেয়ার (hectare): ১ হেক্টেয়ার = ১০,০০০বর্গ মিটার; অর্থাৎ ১০০ হেক্টেয়ার = এক বর্গ কিলোমিটার।

    [2] স্টিটাইট (steatite) একধরনের নরম পরিবর্তিত শিলা, সাধারণতঃ সোপস্টোনও বলে। খুব সহজে কাটা যায়, খোদাই করা যায়।

    [3] পৃথিবীর কেন্দ্রের লাভার উপরে ভাসমান সাতটি বিশাল এবং বেশ কিছু ছোট স্থলভূমিকে টেকটনিক প্লেট (tectonic plate) বলে, এগুলি অতি ধীরে সতত সঞ্চরমান। 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৬ মে ২০২২ | ১৫৫৭ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • তুষার মুখার্জী | 43.252.250.134 | ০৭ মে ২০২২ ১৭:২৮507354
  • প্রথমত লেখাটি বেশ ভালো লেগেছে। অনেক বিষয়েই সংক্ষেপ বা অতি সংক্ষেপ করতে হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। তবে হয়ত তার ফলেই কিছু কথা যথেষ্ট পরিস্কার করে বলা যায় নি। তবে কিছু কথা এমনও আছে যা চলে আসছে বা অতি জনপ্রিয় বা হয়তো পাঠ্যবইতেও লেখা থাকে। ৬০ বৎসর আগের আমার স্কুল পাঠ্যবইতে তো ছিলই।  তবে আশা করেছিলাম বিগত ৬০ বৎসরে সে সব ভ্রান্তি ঘুচেছে। এই লেখা পড়ে মনে হল আমার তেমন আশা করা উচিত হয় নি। ৬০ বৎসর ধরে অনেক ভুলই চলছে।

    ১। যেমন সব বাড়ি পোড়া ইঁটের হতঃ- এটা একদম ঠিক কথা না। মহেঞ্জোদারোতে হরপ্পায়  প্রচুর বাড়ি পোড়া ইঁটের ছিল,বা বলা যায় বেশির ভাগই তাই ছিল। কিন্তু অন্য শহরগুলোতে যেমন কালিবঙ্গান সেখানে সবই কাদা মাটির ইঁটের। আসলে গুনতিতে ধরলে বেশির ভাগ নগর বসতির বাড়িই ছিল কাদা মাটির ইঁটের। পোড়া মাটির ইঁট ব্যবহার হতো কেবল ড্রেন বা ও বাথরুমের মত জায়গায়। যেখানে জলের ব্যবহার বেশি। কারন কাদা মাটির ইঁট জলে গলে যাবে তাই পোড়া মাটির ইঁট।  সব ২। সব ইঁটের মাপ এক। না একদম ভুল। যা হত তা হল লম্বা চওয়া আর ঘনত্বের আনুপাতিক হার এক রাখা হত। তাও অবশ্যই সব নগর-বসতিতে না। বেশির ভাগের বেলা।
     
    ৩। সব নগরে পশ্চিম দিক উঁচু পূর্ব দিক নীচু থাকতো নাঃ- বেশ কিছু নগরে ছিল।  এখানে আরো দুএকটা কথা বলা দরকার। আমরা জানি না তাদের কোন বাস্তু শাস্ত্র ছিল কি না। না জেনে বলি কি করে তারা এই উঁচু নীচু বাস্তু শাস্ত্র না মেনে করেছিল। রোদ আগে আসবে বলে পূর্বদিকে বাসগৃহ বানাতো যুক্তি খুব একটা জোরালো না। কারন ভোরে রোদ পূর্বে থাকলেও দিন ভর ,মানে কাজের সময় রোদ থাকবে উত্তরে বা দক্ষিণে। কাজেই এই পশ্চিম দিক উঁচু করার নিশ্চয় কোন বিশেষ কারণ ছিল। কেননা এই কাজ করা হত মাটি ফেলে ভরাট করে। একটা বিশাল এলাকা মাটি কেটে,কাটা মাটি দিয়ে ভরাট করে উচু করার জন্য যে সময় লোকবল অর্থব্যয় হত তার পেছনে একটাই জিনিষ কাজ করবে তা হল  অন্ধ বিশ্বাস। কি সেই অন্ধ বিশ্বাস তা আমরা জানি না। কিন্তু তার ক্ষমতা এতটাই ছিল যে একটি চার একরের বসতিতে ২ একরই মাটি ফেলে ভরাট করা হয়েছিল,স্রেফ উঁচু করার জন্য।
     
    ৪। শষ্যাগারঃ- এটা মর্টিমার হুইলারের দেওয়া নাম। তিনি ভারতে আসার আগে মিশর মেসোপটেমিয়া ঘুরে এসেছেন,ফলে তাঁর মাথায় সব সময়ই ঐ দুটি সভ্যতার মিরর ইমেজ খুঁজতেন। এটা যে কোন লোকের জন্যই স্বাভাবিক। আসল কথা হল গোটা হলঘরে বা তারা চৌহদ্দিতে এক দানাও শষ্য পাওয়া যায় নি। একই স্থাপত্যের আরেকটি বাড়ি ছিল হরপ্পাতেও। সেখানে জে।এফ. কেনয়ের তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একদানা শষ্যও পান নি। কেনয়েরের মতে এটা শষ্যাগারছিলো না। তবে সঠিক ব্যবহারও জানা নেই। হতে পারে নগরের কিছু লোকের বিশেষ অনুষ্ঠানে বা সভায় একত্রিত হবার জায়গা ছিল এটা। 
     
    ৫। প্রাসাদঃ- না পাওয়া যায় নি। তবে আমাদের প্রাসাদের গৎ বাঁধা কনসেপ্টের বাইরেও তো অন্য স্থাপত্য হতে পারে। মেসোপটেমিয়ার মারি শহরে ২১৬টি ঘরের প্রাসাদ ছিল গোটাটাই মাটির,একতলা। চিনের রাজ প্রাসাদগুলো ছিল কাঠের একতলা। রাজপ্রাসাদেই থাকতো ব্রোঞ্জ ঢালাই কারখানা।  হরপ্পা এফ ব্লকে কিন্তু বেশ বড় বাড়ি পাওয়া গেছে। যার চৌহদ্দিতে ছিল  মহে়্জোদারো স্নানাগারের মিনি সংস্করণ।
     
    ৬.ধাতুশিল্পঃ- দক্ষতা ছিল। যথেষ্ট দক্ষ ছিল। কিন্তু ধাতুর অভাব ছিল। ফলে ব্রোঞ্জ যুগের সভ্যতায় ব্রোঞ্জের উৎপাদনই প্রায় ছিল না।  টিন মিশ্রিত (২০  শতাংশের আশপাশ) ভালো ব্রোঞ্জ প্রায় ছিলো না। 

    ৭। অস্ত্র সেনা রাজাঃ- ঐ  যে ব্রোঞ্জের অভাব। ব্রোঞ্জের অভাব থাকলে এক কোপে গলা কাটার মত  অস্ত্রের অভাব থাকবে। ফলে কোন বড় সেনা বাহিনী তৈরী করা যাবে না। আর সেনা বাহিনী না থাকলে রাজা ও থাকার কথা না।  মোট কথা  হরপ্পা সভ্যতায় যুদ্ধ ছিলো না  ছিলো না  রাজা-সেনা-অস্ত্র পরম শন্তিতে বসবাস করত সকল নাগরিক । আহা। কল্পলোক। না শান্তি হয়ত ছিল কিন্তু সেই শান্তি বাই কম্পাল্শন নট বাই প্যাশন। 
     
  • Kishore Ghosal | ০৮ মে ২০২২ ১৩:২৯507404
  • তুষারবাবু, লেখাটি আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমিও খুব আনন্দ পেলাম। তবে আরও ভালো লাগল, আপনার দীর্ঘ আলোচনার জন্যে।  এবং একথা ঠিক, যেহেতু সিন্ধু সভ্যতা আমার শেষ লক্ষ্য নয়, অতএব এই প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত বিবরণই দিয়েছি। যার থেকে অন্ততঃ সে যুগের মানুষদের নিখুঁত নগর পরিকল্পনা, নিবিড় বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার সফল ও গভীর ভাবনা-চিন্তার কিছুটা আঁচ পাওয়া যায়। এবং নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে এই সভ্যতার অবসানে সিন্ধু সভ্যতার পড়শি ভারতীয় সমাজের মানুষদের মনে কি কি প্রতিক্রিয়া ঘটে থাকতে পারে, সেটাও একটু আন্দাজ করার জন্যে।
     
    সে যাই হোক, আপনার আলোচনায়, কয়েকটি বিষয়ে আমার দ্বিধার কথাও আমি সবিনয়ে জানাইঃ –
     
    ১। সব বাড়ি পোড়া ইঁটের হত – এমন কথা আমি লিখিনি – আমি লিখেছি, “সমস্ত বাড়িগুলিই বানানো হত, রোদে-শুকোনো ইঁটে, যাকে আমরা আমা-ইঁট বলে থাকি”।  পোড়া ইঁটে যে রাস্তা, বাঁধানো নর্দমা বানানো হত, সে কথাও বলেছি।
     
    ২। সব ইঁটের এক মাপ বলিনি, লিখেছি “এই সভ্যতায় ব্যবহার করা যত ইঁট পাওয়া গেছে, এই পরিমাপ অনুযায়ী তাদের ছিল সুনির্দিষ্ট আকার। 

    ৩। নগরের পশ্চিমদিক উঁচু এবং পূর্বদিক নিচু রাখা হত এটা আমি জানতাম না, লিখিওনি। অফিস পাড়া এবং কাজের পাড়াগুলি পূর্বদিকে রাখা হত, সেটা লিখেছি। সেটার যুক্তিতে আমার অনুমান দিবালোকের পূর্ণ ব্যবহারের কথা লিখেছি।  আমাদের সমাজে বিদ্যুত আসার আগে, রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া এবং ভোরে উঠে কাজের যোগাড় শুরু  করার প্রচলন গ্রামাঞ্চলে আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি। আর পূর্বদিকের বাড়িতে কাজ করার মতো উত্তর বা দক্ষিণের আলো থাকবে না – এমন আমার মনে হয় না। [এ প্রসঙ্গে বাস্তুবিদ্যার কথা না বললেও চলত, কিন্তু আজকাল পাড়ায় পাড়ায় এত বাস্তুবিদ-বাস্তুসংস্কারক, নানান বিভ্রান্তি ছড়িয়ে ব্যবসা করে চলেছেন, তাই ভয় হয়। এটাকে কেউ বাস্তুবিদ্যা না ভেবে বসেন।]

    ৪। শস্যাগার – মার্টিমার হুইলার (তাঁর লেখা পড়ার সুযোগ আমার ঘটেনি) বলুন বা না বলুন শহরের এতগুলি অধিবাসী (প্রায় বিশ-পঁচিশ হাজার) এবং দূর দেশ থাকা আসা অতিথি বণিকদের খাদ্য সংস্থানের জন্যে প্রত্যহ সকালে বাজার-সরকার বাজারে যেতেন, এটা মানতে পারলাম না। কোন ঘরের কোনে প্রায় চার-পাঁচহাজার বছরের পুরোনো যব বা গমের জীবাশ্ম মেলেনি বলেই শস্যগার ছিল না, এ যুক্তিও মানতে আমার দ্বিধা আছে। মানুষ সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলি ছেড়ে এসেছিল, কিন্তু পিঁপড়ে, কীট-পতঙ্গ শহর ছেড়ে দিয়েছিল এমন ভাবা যায় না। অতএব কোন রকম প্রত্যক্ষ প্রমাণ না পেলেও, circumstantial evidence থেকে অনুমান করা যায়, শস্যাগার নিশ্চিতভাবেই ছিল।
     
    ৫। প্রাসাদ বলতে আমি মাইশোর প্যালেস বা আমাদের কলকাতার মার্বেল প্যালেসের তুল্য কোন বাড়ি বোঝাতে চাইনি অবশ্যই। প্রাসাদ বলতে পরিবার, পরিজন, অনেক দাসদাসী, খিদমদগার একত্রে থাকার মতো  আলাদা ধরনের building clusters বোঝাতে চেয়েছি।
     
    ৬। আধুনিক যুগের মতো খাঁটি তামা, টিন বা ব্রোঞ্জ তারা বানাতে শেখেনি, তাদের সীমিত  প্রযুক্তি দিয়ে তেমন করা সম্ভবও ছিল না, একথা বলাই বাহুল্য।  প্রসঙ্গতঃ বলি, ব্রোঞ্জ আবিষ্কারের দেড়-দু হাজার বছরের মধ্যে লোহার ব্যবহার শিখে  যাওয়ায় ব্রোঞ্জের সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সে জায়গাটি অধিকার করেছিল লোহা। আর আজ থেকে পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও ব্রোঞ্জ ও তামার ব্যাপক ব্যবহার প্রচলিত ছিল বাসন-কোসন ও অজস্র অপূর্ব মূর্তি রচনায়। আজও তাম্রকুণ্ড, তামার কোশাকুশি, তামা বা কাঁসার ঘট, ইত্যাদি গৃহস্থ পূজার আবশ্যিক তৈজসপত্র।   
     
    ৭। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাক-আর্য মানুষরা শান্তিতেই বসবাস করত, এটা সবটাই আমার কল্পনা - এমন নয়। সমগ্র ভারতে এই পর্যায়ে অজস্র নিওলিথিক এবং চ্যালকোলিথিক সংস্কৃতির সমাজের প্রত্ন নিদর্শনে পাওয়া অজস্র সমাধির মধ্যে গণসমাধি নেই বললেই চলে। অন্ততঃ এমন গণসমাধি যার মৃতদেহের অবশেষ থেকে ধারণা করা যায় মানুষগুলির মৃত্যুর কারণ যুদ্ধ বা লড়াইজনিত আঘাত বা মুণ্ডচ্ছেদ। প্রসঙ্গতঃ বলি, সিন্ধু সভ্যতার অবসানের অততঃ সাত-আটশ বছর পরের ঘটনা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র ছিল, তীর - ধনুক, গদা – অসি বা তলোয়ারের উল্লেখ যা আছে তা খুবই গৌণ।
     
    অতএব যুদ্ধ মানেই তলোয়ারের এক কোপে গলা কাটতে হবে, তখনও পর্যন্ত এমন ধারণা তৈরি হয়নি। বরং তীরে বিদ্ধ হয়েই ভীষ্ম, দ্রোণাচার্য, কর্ণ প্রমুখের মৃত্যু ঘটেছিল। এর আগের যুগে পরশুরামের অস্ত্র ছিল – পরশু অর্থাৎ কুড়ুল।  ভগবান কৃষ্ণের দাদা বলরামের অস্ত্র ছিল হল – অর্থাৎ লাঙল এবং গদা। তিনি ভীম ও দুর্যোধনকে গদা চালনা শিক্ষা দিয়েছিলেন। ভগবান কৃষ্ণের অস্ত্রটি অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক – সুদর্শন চক্র, যে অস্ত্র আর কাউকেই  কোনদিন ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। অর্জুন, কর্ণ, একলব্য ছিলেন ধুরন্ধর তীরন্দাজ আর ভীম ও দুর্যোধন ছিলেন গদা চালনায় সিদ্ধহস্ত।  আরও পরবর্তীকালে ভারতে তলোয়ার, খড়্গ-র প্রচলন এবং জনপ্রিয়তা বেড়েছিল হয়তো গ্রীক ও পারস্য সভ্যতার সংস্পর্শে।
     
    অতএব, ঘচাং করে গলা কাটতে না পারলেও যুদ্ধ হত, যুদ্ধে নিহতও হত বিস্তর, সমসাময়িক বিশ্বে এমন ঘটনার প্রত্ন নিদর্শন প্রচুর পাওয়া গেছে। আসলে যুদ্ধ বা লড়াই করে গণহত্যা করা বিশেষ এক মানসিকতার ব্যাপার, অস্ত্র সেখানে উপকরণ মাত্র।

    শেষে আবারও বলি, আপনার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ রইলাম, আপনি এক কথায় ভালো লেগেছে বলে দায় না সেরে, আপনার দীর্ঘ মতামত জানিয়েছেন। অতএব আমাকেও আমার লেখাটি আবার খুঁটিয়ে পড়তে হল, এবং তথ্য সংগ্রহ করেছি যে গ্রন্থ বা ওয়েবসাইটগুলিতে - সেখানেও ঢুকতে হল। সত্যি বলতে, আপনি কাল রাতে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন, মশাই!   
     
    আরেকবার অজস্র  ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।        
     
  • তুষার মুখার্জী | 43.252.250.134 | ১১ মে ২০২২ ০০:১২507493
  • ধন্যবাদ কিশোর বাবু।  
    বুঝলাম আমি মনে হয় লেখাটি পড়তে বা পড়ে মাথায় রাখতে গোলমাল করেছি।  আবার অনেক জায়াগায় নিজের কথাই আগবাড়িয়ে ভেবে বলেছি। যাই হোক এটা তো কোন তর্কের আসর না। আলোচনা মাত্র। 
    ১.রোদের জন্য পূর্ব দিকে কাজের লোকের বাস সেটা মানতে পারলাম না। আমি এখনো বিশ্বাস করি ওটা তাদের কোন এক অন্ধ বিশ্বাসের জেরেই করা হত। সে রকম বিশ্বাস নানা কারনে জন্মাতে পারে। তেমন একটি সম্ভবনার জন্ম হতে পারে মহেঞ্জোদারো নগর থেকে। মহেঞ্জোদারোতে পূর্বদিকে ছিল সিন্ধু নদী। ফলে  নদীর পাড় থেকে সরিয়ে খানিক উঁচুকরে পশ্চিমদিকে ঐ রকম স্থাপনাগুলো গড়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে। আসলেই পশ্চিম দিকে এক সময় বন্যা ডুবে গিয়েছিল তারপরে একবারে অনেকটা উঁচু করা হয়।  হতে পারে তার থেকে এই প্রথা চালু হয়। ঐ কপি পেষ্ট। না কোন বিজ্ঞানী লেখেন নি। আমিই ভেবেছি।  আরেকটা দিক থাকতে পারে,সেটা হল সাইকোলজিকাল। উঁচু মানেই সম্ভ্রম। এটা মানুষের স্বাভাবিক মনোভাব। পশ্চিমে প্রধান স্থাপনা (সাথে অনুমেয় প্রশাসকদের বাসস্থান) নীচু এলাকার কর্মীদের মনে সম্ভ্রম গড়ে পারে। 
    ২। তীরধনুক দিয়ে যুদ্ধঃ- এ নিয়ে রমায়ন মহাভারত চেনে আনায় আমার নানা কারনে আপত্তি আছে। প্রধান আপত্তি হল ঐ সব যুদ্ধের বর্ণনা বেশিটাই মহাকাব্যের কবির লেখা। কাব্যে কল্পনা থাকবেই। তবে তার মানে এই না যে তীরধনুক দিয়ে বড় যুদ্ধ সম্ভব না। তীরধনুক দিয়ে তো লৌহযুগেও যুদ্ধ হয়েছে। সমস্যা হল তীরের মাথায় তামার ফলা লাগিয়ে জমাটি যুদ্ধ হয় না। তার জন্য় নিদেন পক্ষে ব্রোঞ্জোর ফলা দরকার,বল্লম বা বর্শার বেলাও তাই। এক কোপে গলা নামানো মানে তলোয়ারই হতে হবে তা না অস্ত্রের ধাতুটি কঠিন হতে হবে। যদি রামায়ন মহাভারতের যুদ্ধের কথাও ভাবা যায় তাহলেও দেখবেন মহারথীদের জন্য বিশেষ বিশেষ তীরের কথা বলা হচ্ছে। কারন মহারথীরা তমা বা ব্রোঞ্জের বর্ম পরে তাকে। তার জন্য দরকার বর্মভেদী ফলা।  মোটকথা িসাল এলাকার জনসংখ্যা বেশি হলবে,তার জন্য প্রতি যুদ্ধেও সৈন্য সংখ্যা বিশাল হবে। আর ঐ সৈন্যদের অস্ত্র যোগাতে যত ব্রোঞ্জ দরকার শুধু তীরের ফলা হলেও তা হরপ্পা সভ্যাতর ছিলো না। হরপ্পা সভ্যতার সাম্রাজ্য পর্যায়ে ওটার পক্ষে সেটাই ছিল সব চেয়ে বড় বাধা। আর সেই বাধা ছিল বলেই তারা গড়েছিল শান্তি পূর্ণ সভ্যতা। 
    ৩। মহাভারতে তীরন্দাজ বা গদাধারীদের প্রশংসা বেশি মানেই কেবল তাই ছিল তা কিন্তু না। সহদেব সিদ্ধ হস্ত ছিলেন খড়্গে। যুধিষ্ঠির ভল্লে। ইত্যাদি। এবং অনেকেরই মাথা কাটা হয়েছে। লাঙল দিয়ে যুদ্ধ করলে সেটা ঠিক কোন পর্যায়ের যুদ্ধ হল তা কল্পনা করুন একটু।  কালীপ্রসন্নের মহাভারতে আছে ঐ যুদ্ধের অস্ত্রের মধ্যে ছিল হাঁড়িতে ভরা সাপ। এমনকি নর্তকীও । নর্তকীদের কাজ হল যোদ্ধাদের মনযোগ নষ্ট করা। মানে যুদ্ধ করতে করতে একটু নাচ দেখে নি আগে ভেবে যদি দাঁড়িয়ে পড়ে--- ইত্যাদি ইত্যাদি।  যাক। আঠার দিনে আঠার অক্ষৌহীনী এমন কাব্যিক মিলের যুদ্ধে অমন হতেই পারে। 
    ৪। আরেকটু বলি, নব্যপ্রস্তরযুগ তাম্রযুগ কোন যুগেরই কোন গণকবর কেন তেমন কোন কবরই পাওয়া যায় নি। গোটা হরপ্পা সভ্যাতর দেড় হাজার বছরে দুই হাজারের বেশি প্রত্নক্ষেত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে মোট ৫০টি কবরখানা। আর ৬০০টি কবর। কাজেই কবর পাওয়া যায় নি,তার থেকে বিশেষ কিছু অনুমান করা উচিত হবে না বোধহয়। (আর ইয়ে---- কুরুক্ষেত্রে ৪২লক্ষ মৃতসৈন্যের কোন কবর শ্মশান কিছুই নেই--- পোড়ালে কয়েক লক্ষ গাছের কাঠকয়লা থাকত,তাও নেই।)

    সব শেষে কিছু মনে করবেন না। আপনার লেখা পড়ে মনে হল আপনার সাথে মন খুলে আলোচনা করা যেতে পারে। তাই করলাম। একটু বোধহয় বিরক্ত করাই হয়ে গেল। 
     
  • হীরেন সিংহরায় | ১১ মে ২০২২ ২১:৩৫507527
  • অসাধারন । সব যেন দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে । আমার মনে হয় আপনি Mud bricks এর কথাই বলেছেন। নগর পরিচালনার ব্যাপারটা হানসা লিগের কথা মনে করিয়ে দেয়! টালিনের পরিচালকরা সবাই ব্যবসায়ী - এক পরিবার থেকে একজন মাত্র থাকতে পারেন। দু শহরের মধ্যে কোনদিন লড়াই হয় নি। খরিফ শব্দটা হিবরুতেও পাওয়া যায়! মানেটা একটু আলাদা । ভীষন ভাল লাগল
  • Kishore Ghosal | ১২ মে ২০২২ ১৫:৫১507543
  • @ তুষারবাবু, এ আলোচনায় বিরক্ত হবো কেন? 
     
    তবে এটুকু বলাই যায়, সিন্ধু সভ্যতার বহু বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে - কারণ এই সভ্যতার পরম্পরা আমারা হারিয়ে ফেলেছি কয়েক হাজার বছর আগে  এবং এর লিপিগুলি আজও পাঠোদ্ধার করা যায়নি। কিছু কিছু জিনিষ আপনি, বিশেষজ্ঞগণ এবং আমিও অনুমান করছি মাত্র। 
     
    আমার লেখা এর আগের অধ্যায়গুলো আপনি মনে হয় পড়ে উঠতে পারেননি, পড়লে আমার এই লেখার উদ্দেশ্যটা, আশা করি কিছুটা বুঝতে পারবেন। পরবর্তী অধ্যায় ও পর্বগুলিতে মহাভারত, রামায়ণ এবং পৌরাণিক প্রসঙ্গগুলিও যথা সময়েই আসবে - সে আলোচনাতেও অংশগ্রহণ করলে খুশিই হবো।
     
    আপনাকে অনেক চিন্তাভাবনায় প্ররোচিত করতে পেরেছি এবং এই আলোচনার সূত্রপাত করাতে পেরেছি, এই প্রাপ্তিটুকু, এর পরবর্তী লেখার ব্যাপারে আমাকে অনেকটাই উৎসাহ দেবে সন্দেহ নেই। 
     
    সঙ্গে থাকুন, আমার অনুরোধ পড়তে থাকুন। আগামী অধ্যায় আসছে কালকে।           
  • Kishore Ghosal | ১২ মে ২০২২ ১৫:৫৯507544
  • @ হীরেন স্যার, 
     
    Mud bricks কেই আমি রোদে শুকানো - আমা ইঁট বলেছি। এই ইঁটের ব্যবহার আমাদের ছোটবেলাতেও দেখেছি গ্রামের গরিব-গুর্বোদের বাড়ি নির্মাণে। 
     
    অনেক ধন্যবাদ স্যার, আমার বক্তব্যের সমর্থনে এই যে বিদেশের দৃষ্টান্তগুলি আপনি প্রায়শঃ তুলে আনেন, তাতে বুঝতে পারি, আমার সামগ্রিক লেখাটা হয়তো বিপথে যাবে না।   
  • যোষিতা  | 194.56.48.114 | ১২ মে ২০২২ ১৮:৪১507549
  • সাংঘাতিক ভালো লেখা 
     
     
     
  • Sara Man | ১২ মে ২০২২ ২১:১১507552
  • আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ছি। বিভিন্ন আলোচনা খুব ভালো লাগছে। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১২ মে ২০২২ ২১:৩৯507553
  • কিশোর 
     
    অনবদ্য লিখছেন । ঘুম ছুটে গেলো বলে আরও দু চারটে জ্ঞান গর্ভ মতান্তরে অপ্রয়োজনীয় কথা বলি - মানুষের সবচেয়ে পুরনো বাসভূমি বলে জেরিকোকে সম্মান দেওয়া হয়( দশ হাজার বছর ) সেখানে অনেক মাড ব্রিকসের দেখা পেয়েছি ।স্তম্ভিত হতে হয় । তাহলে জেরিকো কি সিন্ধু সভ্যতার চেয়ে পুরনো ? মেসোপটেমিয়া ( দুই নদীর মাঝখানে )সিন্ধু সভ্যতার তুলনায় হাঁটুর বয়েসি সিরিয়াতে ওই ব্রিকস দেখা যায় কিন্তু মিশরের বাড়িগুলো কোথায় গেলো? আমরা পাথরে তৈরি মন্দির পেয়েছি কিন্তু ঠিকসিন্ধু সভ্যতার মতন প্রাসাদ পাই নি ! টেন কমান্ডমেনটস ছবিতে ইয়ুল ব্রাইনার যে প্রাসাদে খড়মের আওয়াজ তুলে হাঁটছিলেন , সেটা কোথায় গেলো ? তাহলে কি জীবন নশ্বর বলে তাঁরা মাটির চালায় থাকতেন আর অনন্ত পরলোকবাসের  কামনায় পিরামিড বানাতেন ? 
     
    শহর গুলোর জনসংখ্যা জানার কৌতূহল আছে আমার - হাজার বছর আগে লন্ডনের জনসংখ্যা ২৫০০০ অথচ ১৩শ শতাব্দীতে আঙ্কর ভাটে এক লক্ষ বা তারও বেশি !সিন্ধু সভ্যতার শহরে  কতজন থাকতেন ? চাষ বাসের ব্যপারে কি জানা যায় ? 
     
    আরেকটা জিনিসে আমাকে চমকে দিলেন - ভাবতাম হানসা লিগ প্রথম ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের  ধরনে প্রথম বাণিজ্যিক রাষ্ট্র সমবায় যা ছিল একান্ত ব্যবসা ভিত্তিক - হামবুর্গ ব্রেমেন লুইবেক কোপেনহাভন ভিবরগ তারতু টালিন ইত্যাদি কয়েক ডজন স্বাধীন শহর ( হামবুর্গ ব্রেমেন আজও আলাদা শহর /রাজ্য ) কেউ কারো সঙ্গে লড়ে নি । বিতর্ক হলে শহর পরিচালকরা জাহাজে বসে আপোষে তার সমাধান করেছেন ।আপনার লেখা পরে জানলাম এই শান্তিপূর্ণ কূটনীতি অনেক পুরনো । 
     
    জানার কোন শেষ নেই। 
     
    অজস্র ধন্যবাদ । 
  • Kishore Ghosal | ১২ মে ২০২২ ২৩:৪৮507555
  • @ হীরেন
     
    স্যার,  আপনার চোখ এড়িয়ে গেছে, আমি সিন্ধু সভ্যতায় জনসংখ্যার আন্দাজ দিয়েছি, আরও একবার এখানে উল্লেখ করছি - 
     
    "বড়ো শহরগুলির আবাসন পরিকল্পনা থেকে প্রত্নবিদেরা অনুমান করেন, এক একটি শহরে মোটামুটি বাইশ থেকে পঁচিশ হাজার লোক বসবাস করতে পারত"।
     
    "পরিত্যক্ত সিন্ধু-সমাজ থেকে বেরিয়ে আসা জনসংখ্যা ধরা যাক পাঁচ লক্ষাধিক। বড়ো শহরগুলির গড় জনসংখ্যা যদি বিশ-পঁচিশ হাজার হয়, তাহলে যে ছটি বড়ো শহরের উল্লেখ করেছিলাম, তাতেই জনসংখ্যা হয় দেড় লক্ষের কাছাকাছি। তার ওপরে ছিল আরও অনেক ছোট শহর, অজস্র জনপদ ও গ্রামের সপরিবার কৃষিজীবী এবং পশুপালক। সব মিলিয়ে পাঁচলক্ষ না হওয়ার কোন কারণ নেই। এই পাঁচ লক্ষাধিক শরণার্থী মানুষ প্রায় চার-পাঁচশ বছর ধরে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে এবং ধীরে ধীরে মিশে গিয়েছে ভারতের জন সমাজের মধ্যে। তাদের স্মৃতি রোমন্থন, অভিজ্ঞতা ও চিন্তা-ভাবনায় প্রভাবিত হয়েছে, স্থানীয় মানুষরাও। সিন্ধু-সমাজের মানুষরা ঠেকে শিখেছিল, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের দেখে শিখল, অপরাধ কী? পাপ কী? দেবতাদের সন্তুষ্টি কী, তাঁদের ক্রোধ কী?"
     
    তখনকার সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের জনসংখ্যা,  অনেক বিশেষজ্ঞ অনুমান করেন, তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ। তার মধ্যে সিন্ধুসভ্যতার এই ভাগ্যাহত লাখপাঁচেক মানুষ (শতকরা প্রায়  ১৫%) তাদের ভাগ্য বিড়ম্বনার কথায় বাকি ভারতবাসীদের মনে যথেষ্ট প্রভাব ফেলতে পেরেছিল - সেকথা বলাই বাহুল্য।   
  • Kishore Ghosal | ১২ মে ২০২২ ২৩:৫১507556
  • @ যোষিতা ম্যাডাম, @ সারা ম্যাডাম, অনেক ধন্যবাদ, লেখাটি পড়ার জন্যে। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১৩ মে ২০২২ ০১:২৮507559
  • কিশোর 
     
    জন সংখ্যার হিসেব দেখেছি বলেই আমার প্রশ্ন - সেই সময়ের তুলনায় পঁচিশ হাজার লোক অনেক লোক ! এক হাজার বছর আগে লন্ডনের জনসংখ্যা পঁচিশ হাজার ! 
  • Kishore Ghosal | ১৩ মে ২০২২ ০৮:৫২507567
  • এটা স্যার আমি বলতে পারব না, আমি বিশেষজ্ঞদের অনুমানেই ভরসা রেখেছি। 
  • হীরেন সিংহরায় | ১৩ মে ২০২২ ১৩:১২507571
  • মাড ব্রিক প্রসঙ্গে আমার দেখা 
    জেরিকো 
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন