এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • বৃত্তরৈখিক (৯)

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ১৭৪৩ বার পঠিত
  • ~৯~

    দুটো অফিসে নিয়মিত গেছে জয়মালিকা, কিন্তু সে দুটোর সঙ্গে মেলাতে পারে না স্টীল প্লান্টের এই অফিসকে। বেঙ্গল লেদারের অফিসে লোকজনকে দেখতেই পাওয়া যায় না, যে যার নিজের জায়গায় সারাদিন বসে কাজ করে, চেঁচিয়ে কথা বলে না কেউ। কারোর টেবিলে বিশেষ কাগজপত্র পড়ে থাকে না, হল দিয়ে হেঁটে গেলে পরিচিত মুখগুলো হয় একটু হাসে, আর নয়তো বড় জোর কেমন আছেন বলে উত্তর শোনবার আগেই আবার নিজের কাজে মন দেয়। ফ্রী স্কুল স্ট্রীটে ক্ল্যারিয়নের অফিসে ঢুকলেই রিসেপশনিস্ট মহিলা একটু হাসেন, মাপা হাসি, আর তারপর বসতে বলেন; বসার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ম্যাজিকের মতো চা নিয়ে আসে উর্দি পরা একজন ট্রেতে করে ; মহিলা চাপা গলায় টেলিফোনে কথা বলেন, কোন কোনদিন চা শেষ হলেই পাঠিয়ে দেন বিভাসদার ঘরে, কখনো কিছুক্ষণ বসতে হয়। অফিসে আরও লোকজন আছে কিনা, থাকলেও তারা কোথায় বসে, কী কাজ করে, বোঝা যায়না কিছুই। জয়িদের স্টীল প্লান্টের এই অফিসের বিরাট হলে ঢুকলেই একটা সমবেত গুঞ্জনধ্বনি, প্রায় দেশি ইশকুলের মতো। পাখাগুলো আপন মনে ঘুরছে, সবকটা আলো জ্বলা, অথচ অনেক টেবিলই ফাঁকা, কোন কোনটায় দুয়েকটা ফাইল পড়ে আছে, ফিতে বন্ধ কোনটায়, কোনটায় হয়তো খোলা হয়েছে, কিন্তু পড়ে আছে ও ভাবেই।

    ঢুকেই সামনের টেবিলে যে ভদ্রলোক বসে আছেন তাঁর কাছে গিয়ে জয়মালিকা নিজের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটা দেখালো, বললো জয়েন করতে এসেছে। ভদ্রলোক নিজের চেয়ারে বসেই একটা হাঁক দিয়ে বললেন, এই যে হালদার বাবু, জয়েন করতে এসেছে। হালদার বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, দ্রুতপদে এগিয়ে এসে জয়িকে বললেন, আসুন, আসুন আমার সঙ্গে। হালদার বাবুর পেছন পেছন জয়মালিকা এগিয়ে যায়, হলঘরটার শেষ প্রান্তে একটা কাঠের ঘেরাটোপের সামনে দাঁড়ায় দুজন, ওকে ইসারায় অপেক্ষা করতে বলে ঘেরাটোপের পর্দাটা ঠেলে হালদার বাবু ঢুকে যান ভেতরে, মিনিট খানেক পর বেরিয়ে এসে ওকে ডেকে নিয়ে আবার দুজনেই ভেতরে। যে ভদ্রলোক বসে আছেন, জয়িকে ইঙ্গিতে একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে হেসে বলেন, গূড মর্ণিং, ওয়েলকাম টু অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। জয়ি গূড মর্ণিং বলে প্রত্যুত্তর জানায়। ভদ্রলোক পাশের আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করে কয়েকটা কাগজে সই করান জয়িকে দিয়ে, তারপর বলেন, হালদার বাবু আপনার সীনিয়র, ওঁর সঙ্গে চলে যান, উনিই আপনাকে কাজকর্ম বুঝিয়ে দেবেন। তারপর হালদার বাবুর দিকে ফিরে বলেন, বসার ব্যবস্থা কোথায় করেছেন?

    আপাতত দিনকয়েক আমার টেবিলে আমার সঙ্গেই বসুক, তারপর দেখা যাক কোথায় ব্যবস্থা করা যায়।

    ঠিক আছে, বলে হাত নেড়ে ভদ্রলোক বুঝিয়ে দেন, আপনারা আসতে পারেন।

    জয়িকে কাজের ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেন হালদার বাবু সংক্ষেপে। জেনারাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ডিপার্টমেন্টই সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিপার্টমেন্ট প্লান্টে। প্রায় সব ডিপার্টমেন্টেরই প্রাথমিক কাগজপত্র এই ডিপার্টমেন্টে আসে, এখান থেকে ঘুরেই নিজের নিজের ডিপার্টমেন্টে যেতে পারে তারা। এত কাজের চাপ সামলানো শক্ত, তাই ডিপার্টমেন্টটাকে অনেকগুলো সেকশনে ভাগ করা হয়েছে। মিস – কী যেন, আপনার কী যেন পদবি?

    পদবি নেই, ব্যবহার করি না, আমার নাম জয়মালিকা, জয়মালিকা বলেই ডাকবেন, মিসের দরকার নেই।

    ঠিক আছে, তো মিস জয়মালিকা, আপনি যে সেকশনে এলেন, মানে যে সেকশনে আমরা কাজ করি, সেটা হলো বিল্ডিং অ্যাণ্ড এডুকেশন সেকশন। আমি হেড ক্লার্ক, এখানে সবাই বড় বাবু বলে ডাকে, আর ঐ যে সাহেবের সাথে আপনাকে আলাপ করিয়ে নিয়ে এলাম, উনিই সেকশন অফিসার, জি-কে রায়।

    আচ্ছা, এডুকেশন সেকশন মানে কী? ট্রেনিং দেওয়া হয় এখানে?

    না না, তা নয়। আমাদের স্টীল প্লান্ট স্কুল আছে জানেন তো?

    হ্যাঁ জানি তো, আমিই তো পড়েছি সে স্কুলে।

    আপনি ঐ স্কুলে পড়েছেন? ও আচ্ছা। তো, ঐ স্কুলের যাবতীয় রিকোয়ারমেন্ট আমরাই দেখাশোনা করি। ফার্নিচার, স্যালারি-ট্যালারি, এমনকি রিক্রুটমেন্ট পর্যন্ত। আপনাদের প্রিন্সিপালকেও দেখবেন, মাঝে মাঝেই এখানে আসেন তদ্বির-তদারক করতে।

    স্টীল প্লান্টের ইংলিশ মীডিয়াম স্কুলে জয়ি পড়েছে শুনে ও থাকে কোথায় জানতে চাইলেন হালদার বাবু। ঠিকানাটা শুনে প্রায় আঁতকে উঠলেন তিনি: কেন, ওখানে থাকেন কেন?

    কেন, কী ভাবে ওখানে থাকে, ওর চাকরি এখানে কোন্‌ সূত্রে হলো, সবটা শুনে হালদার বাবু বললেন, তাহলে তো প্রথমেই আপনার শিফ্‌ট্‌ করা দরকার। ওখানে থাকবেন কেন? এখন তো আপনার এনটাইট্‌ল্‌মেন্ট ডী-ওয়ানে। দাঁড়ান, আমি দেখছি, বলে একটা ফাইল নিয়ে আসেন হালদার বাবু। উল্টে-পাল্টে বললেন, তিনটে কোয়ার্টার খালি আছে ডী-ওয়ানে, তেইশ নম্বর, একচল্লিশ আর আটাত্তর। আজ যাবার আগে আমার কাছ থেকে চাবি নিয়ে যাবেন তিনটে কোয়ার্টারের, দেখে নিন তিনটেই, বলে দেবেন কোন্‌টা পছন্দ। রিপেয়ার-পেন্টিং সব করিয়ে দেব তিন-চার দিনের মধ্যে। এই সপ্তাহেই শিফ্‌ট্‌ করে নিন, আমি কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে কথা বলে রাখবো, গাড়ি-টাড়ি নিয়ে চলে যাবে, ওর লোকজনরাই সব গুছিয়ে গাছিয়ে দিয়ে আসবে।

    মা শুনে খুব খুশি। মেয়েটা কেমন বদলিয়ে গেলো কলকাতায় যাওয়ার পর থেকে। দৈ কিনে এনে খাইয়েছে, যেন অমৃত! দামি শাড়ি কিনে এনেছে, সায়া-ব্লাউজ সব! এখন ভালো বাড়ি পাওয়া যাবে, মাকে নিয়ে যাবে পছন্দ করাতে। এত সুখ ছিলো তার কপালে! বাবা অবিশ্যি যেতে রাজি হলো না, বললো তোর মাকে পছন্দ করিয়ে নিয়ে আয়, সে-ই তো থাকবে। স্টীল প্লান্টের রাস্তা দিয়ে মা-মেয়ে এক সঙ্গে হাঁটলো এই প্রথম!

    শাম্বর পরের সংখ্যা বেরিয়ে গেলো। নিজেদের বন্ধুবান্ধবদের কবিতা-গল্প-ছবি তো বটেই, জয়ির ঝোলায় অনেক বিখ্যাত লোকের রচনা ছিলো, বেরিয়েছে তার থেকেও কিছু কিছু। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও তুষার রায়ের কবিতা আছে, আর আছে তারাপদ রায়ের ছড়া। চমকপ্রদ একটা প্রবন্ধ লিখেছেন কমলকুমার মজুমদার, গণিতবিষয়ে একটি চিন্তা। কিসমত সোরাবজি ছবি এঁকে দিয়েছেন একটা, ফাউন্টেন পেনের কাজ। আর আছে জয়ির আঁকা দু পাতা জোড়া ছবি, সেটাও ফাউন্টেন পেনের, ছবির নাম স্টীল প্লান্ট দপ্তর।

    কাকু বললেন, কখন আঁকলি ছবি, জয়ি? অফিসের কাজের ফাঁকে?

    কাজ কোথায় কাকু? কাজ তো নেই-ই। একটু-আধটু যা কাজ থাকে, ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকেই করি সে সব। কাজের ফাঁকে ছবি নয়, ছবির ফাঁকে কাজ !

    আর কী এঁকেছিস প্লান্টে?

    দেখবে?

    ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ে ছবি। অনেকগুলো। ডজন খানেক তো হবেই।

    কাকু একটা একটা করে ছবিগুলো দেখে, সব ডেস্কে বসেই এঁকেছিস?

    সব।

    এগুলো কি তোর কাজে লাগবে, না আমি রাখতে পারি?

    রাখতে চাও রাখো। কী আর এমন ছবি। কিন্তু করবেটা কী রেখে? বাঁধাবে নাকি? বাঁধাও, কিন্তু তুলি টাঙাতে দেবে না।

    দেখি কী করি, ছবিগুলো কাকু তুলে রাখে নিজের ব্যাগে।

    পোস্ট অ্যাণ্ড টেলিগ্রাফের টেলিফোন নয়, কিন্তু প্লান্টের ইন্টারকম একটা জয়ির কোয়ার্টারেও আছে এখন। সেই ইন্টারকমে হঠাৎ কাকুর ডাক এলো একদিন, শনিবার রাতে, তোর কী আমাদের বাড়িতে কাল আসার প্ল্যান আছে?

    প্ল্যান কিছু নেই, কিন্তু এসে যেতেও পারি তুমি চাইলে।

    তাহলে চলে আয় কাল সকালে, তোর সঙ্গে কথা আছে।

    জি-এম-অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের সঙ্গে কথা বলেছে কাকু, আর জয়ির ছবিগুলো দেখিয়েওছে। প্লান্টে কেরাণীগিরি করে সময় নষ্ট করছে জয়ি। স্টীল প্লান্টের কী লাভ হচ্ছে ওকে দিয়ে একটা জুনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্টের কাজ করিয়ে, যখন ওর ট্যালেন্টকে অন্যভাবে কাজে লাগানো যায়!

    কী ভাবে কাজে লাগানো যায়, জিজ্ঞাসা করেছেন জি-এম-অ্যাডমিনিস্ট্রেশন।

    ইদানিং অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের আওতায় একটা পাবলিক রিলেশন অফিসারের পোস্ট তৈরি হয়েছে প্লান্টে। পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্ট তো এখানে নেই, সেটা কলকাতায় মার্কেটিং অ্যাণ্ড রিজিওনাল অফিসে। বিশেষ করে এই প্লান্টের জন্যে পাবলিক রিলেশনের যা কাজ, সেটা এখানকার পি-আর অফিসার কলকাতার অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করে ম্যানেজ করেন। জয়িকে যদি ওই সেকশনে পাঠিয়ে দেওয়া যায় বিল্ডিং অ্যাণ্ড এডুকেশন সেকশন থেকে সরিয়ে, তাহলে ওর ট্যালেন্টও কাজে লাগলো প্লান্টের, আর ও-ও মনের মতো কাজ পেলো একটা।

    পি-আর অফিসারের সঙ্গে কথা বলেছেন জি-এম। এমনিতে কোন আপত্তি নেই পি-আর-ও-র, সত্যি কথা বলতে গেলে ভালোই হবে তাঁর, ওয়র্ক-লোড খানিকটা কমবে, কিন্তু তাঁর একটাই ভয়। পি-আরের কাজ তো মূলত কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ করেই, সে ক্ষেত্রে এই কাজে অনবরতই কলকাতায় যেতে হবে, দিনের পর দিন সেখানে থাকতে হতে পারে। একা একা একটা মেয়ের পক্ষে সেটা কি সম্ভব?

    কী রে জয়ি, সম্ভব তোর পক্ষে?

    তুমি কী বলেছো কাকু?

    আমি আর কী বলতে পারি বল ! তোর সঙ্গে কথা না বলে কি বলে দেওয়া উচিত যে এক পায়ে খাড়া হয়ে আছিস তুই! সেটা কি ভালো দেখায়!

    প্লীজ কাকু, প্লীজ, তুমি এটা করিয়ে দাও। রোজ আট ঘন্টা ঐ প্লান্টের চেয়ারে বসে থেকে থেকে আমার কোমর ধরে গেলো। দেখো না, রীতিমতো ভুঁড়ি হচ্ছে আমার !

    সেটা তো সিলভার টনিকের জোরে, রোজ দুবেলা ডাম্বেল করলেও এখন ভুঁড়ি হবে তোর।

    কাকুর কথামতো পরের দিন ডি-কে উপাধ্যায় পি-আর-ও সাহেবের সঙ্গে দেখা করলো জয়ি। ওর ছবিগুলো কাকু দিয়ে দিয়েছিলো, বলেছিলো, সঙ্গে করে নিয়ে যাস। আমি পি-আর-ওকে বলেছি তুই ভালো ছবি আঁকিস, দেখাইনি। দেখতে চাইলে দেখাবি।

    উপাধ্যায় সাহেব প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন ঘন ঘন কলকাতায় গিয়ে থাকতে ওর অসুবিধে হবে কিনা। ও বললো, কলকাতায় ওর অনেক জানাশোনা, কোনই অসুবিধে নেই। এমনকি থাকার জায়গাও আছে।

    না না, থাকার জায়গার দরকার নেই, তুমি তো অফিশিয়াল কাজে যাবে, আমাদের গেস্ট হাউজ আছে ক্যামাক স্ট্রীটে, সেখানে থাকতে পারবে। কিন্তু ভয়-টয় করবে না তো? বাড়ি থেকে আপত্তি করবে না তো?

    কেউ আপত্তি করবে না স্যর।

    তুমি নাকি ভালো ছবি আঁকো, প্লান্টের ছবি এঁকেছো নাকি।

    ঠিক প্লান্টের নয় স্যর, অফিসের।

    সঙ্গে আছে?

    হ্যাঁ স্যর, দেখবেন?

    ছবিগুলো দেখায় জয়ি। একটা একটা করে প্রতিটি ছবি দেখেন উপাধ্যায় সাহেব, তারপর বলেন, তুমি তো খুবই ভালো আঁকো, শিখেছো কোথাও?

    আলাদা করে শিখিনি স্যর, স্কুলেই মিসেস পাণ্ডে যেটুকু শিখিয়েছিলেন।

    সে তো উনি সবাইকেই শেখান। নাঃ, তোমার আলাদা ট্যালেন্ট আছে।

    চেয়ার থেকে হঠাৎ উঠে দাঁড়ান উপাধ্যায় সাহেব, চলো, তোমাকে জি-এম সাহেবের কাছে নিয়ে যাই। উনি দেখতে চেয়েছেন তোমাকে।

    বাবা শুনে বললো, অনেক ভাগ্য করে বন্ধু পেয়েছিলি। চাকরিটাও হলো, কলকাতার সঙ্গে তোর সম্পর্কটাও থেকে গেলো, এ তো ভাবাই যায় না। সামনের মাসে মাইনেটা পেয়ে একটা পুজো দিস।

    পুজো-টুজো দিয়ে কী হবে বাবা?

    দিয়ে কী হবে জানি না, কিন্তু না দিলে দেবতা ঠিক আদায় করে নেবেন। আর, দেবতার আদায় করে নেওয়াটা সব সময় ভালো না-ও তো হতে পারে ! চাকরি পেলি, ভালো বাড়ি পেলি, মনের মতো কাজও হলো, মেঘ না চাইতেই এত জল পেয়েও যদি কৃতজ্ঞতা না দেখাস, সেটা ভালো হবে কি? ব্লাস্ট ফার্নেসে বাঘের কাহিনীটা বলেছিলাম তো তোকে।

    প্রথম মাসের মাইনে পাওয়া পর্যন্ত কলকাতায় যেতে হলো না জয়িকে, বাবাও গেলো না কোথাও। এতদিন ধরে একটানা বাড়িতে বাবাকে কখনো থাকতে দেখেনি জয়ি। মাইনে যেদিন পেলো, সে দিন শনিবার, তাড়াতাড়ি ছুটি; মার জন্যে শাড়ি, বাবার জন্যে চামড়ার ব্যাগ একটা, ভাইবোনদের জন্যে কিছু কিছু জামাকাপড় কিনে বাড়িতে এলো জয়ি। বোন্টির জন্যে একটা শার্ট ছিলো, নিয়ে বললো, ভালোই হলো দিদি, কাল থেকে বাড়িতে থাকবো না।

    কেন রে?

    ওড়িয়াদের যাত্রা হয়, জানিস তো? উড়েযাত্রা বলে পাঁচজনে!

    জানবে না কেন, জানে তো সবাই! ভ্রাম্যমান যাত্রার দল, ওদের 'শো' থাকে যে রাত্তিরে, স্টীল প্লান্টের উঁচুতলার লোকরা ছাড়া, আর সবাই সারা রাত কাটায় সেখানেই। নাচ-গান-উচ্চকিত যন্ত্রসঙ্গীত-উঁচু পর্দার অভিনয়ে জমজমাট হয়ে ওঠে আসর! সারা রাত!

    বোন্টি যোগ দিয়েছে এরকম একটা দলে। ছ মাস একটানা ঘুরবে দলের সঙ্গে, যেখানে আসর সেখানেই থাকা। ছ মাস পর আবার হয়তো আসতে পারে বাড়িতে দুয়েকদিনের জন্যে। না যদি মন চায়, আসবে না। একটা কিছু তো করতেই হবে তাকে!

    সকালেই চলে গেলো বোন্টি। বাবা বললো, আমিও যাবো রে আজ।

    কোথায়? কোথায় যাবে? – জিজ্ঞেস করে জয়ি।

    জানিনা ঠিক কোথায় যাবো, কিন্তু যেতে হবে। এবার যাবো অনেকদিনের জন্যে।

    কিন্তু আজ যে পুজো দেবো ভেবেছিলাম। পুজোর প্রসাদ খাবে না?

    প্রসাদ? ঠিক আছে, তুই পুজো দিয়ে ফের, তারপর যাবো।

    আজ আর তুলিকার সঙ্গে নয়, একাই যায় জয়ি বেদব্যাস গুহায়। পুরোহিত ওকে দেখে কোন বিস্ময় প্রকাশ করেন না, জানতেও চান না কেন এসেছে, শুধু হাসেন একটু।

    জয়ি বলে, বাবার চাকরিটা আমি পেলাম, বাবার ইচ্ছে পুজো দিই।

    তোর বাবা বললো এখানেই পুজো দিতে?

    বাবা বলেনি, বাবা শুধু পুজো দিতেই বলেছে। আমি ভাবলাম এখানেই দেবো।

    বেশ তো, দে।

    মহুয়া কোথায় পাওয়া যায় দাদু?

    মহুয়ার পুজো দিবি?

    হ্যাঁ, এত মহুয়া, যেন সাতদিন অন্য কিছু না লাগে পুজো দিতে।

    এখানে বোস শুক্তিমতীর দিকে তাকিয়ে। আমাকে টাকা দে, আমি আনিয়ে নিচ্ছি।

    যত টাকা ছিলো ব্যাগে, সব বের করে দেয় জয়মালিকা। বলে, একটা কাপড় আর গামছা দেবে, চান করবো?

    কাপড় আর গামছা নিয়ে নদীতে চলে যায় জয়ি। ফিরে এসে ফাঁকা মন্দিরটায় একা একা বসে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর পুরোহিত ফিরে আসে, একটা মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে, তার মাথায় একটা ঝুড়ি, তাতে বোতল কয়েকটা, আর ঠিক মাঝখানে বসানো মাটির একটা কলসি। ঝুড়িটা নামিয়ে চলে যায় সে। পুরোহিত পুজোয় বসে।

    প্রসাদ নিবি কিসে? – জিজ্ঞেস করে পুরোহিত।

    একটা বোতল নিয়ে যাবো, আর তোমার ঐ কলসি থেকে দাও, খাব এখানে।

    যতটা ইচ্ছে খায় জয়ি, নিঃশব্দে। পুরোহিত খায় না, ওকে দেখে, বাধা দেয় না একটুও।

    জয়ি যখন ফেরার জন্যে প্রস্তুত, পুরোহিত বলে, চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি। মন্দির থেকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে যখন, মহুয়া এনেছিলো যে মেয়েটা, তাকে দেখা যায়। সে বসে আছে। পুরোহিত বলে, ও বসে আছে তোকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। একা যাস না। মেয়েটা জয়ির কোমর জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। জয়ি হাত নাড়ায়। কথা না বলে দাঁড়িয়ে থাকে দাদু।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৭ অক্টোবর ২০২০ | ১৭৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৭ অক্টোবর ২০২০ ১৩:২৩98571
  • সঙ্গে আছি।

  • Moulik Majumder | ১৭ নভেম্বর ২০২০ ০১:২১100324
  • পড়ছি আর ভালোলাগা বিস্তারিত হচ্চ্ছ্ছে 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন