এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • বৃত্তরৈখিক (৩১)

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৪ এপ্রিল ২০২১ | ২০৬৮ বার পঠিত
  • ~৩১~

    এক কথাতেই রাজি নিলীন, বললো রোববার সকালেই পৌঁছিয়ে যাবো। সুকান্তদা বলেছিলো শুধু নিলীন আর তুলিকে খবর দেওয়ার দায়িত্ব জয়ির। সুকান্তদা নির্ঘাত জলধরের কথাটা ভুলে গেছে। জলধরকে সুকান্তদা খবর দেবে কীভাবে? নিলীনকেই দায়িত্ব দিলো জয়ি জলধরকে খবর দেওয়ার।

    কিন্তু আঁতকিয়ে উঠলো তুলি। কী বলিস, সম্ভব নাকি এর মধ্যে সব ব্যবস্থা করে এখান থেকে অতদূর যাওয়া? তোরা নে না ডিসিশন, আমার সাথে কোনদিন মতবিরোধ হয়েছে তোর?

    দুটো খুব ক্রুশিয়াল ডিসিশন নিতে যাচ্ছি। একা একা নিতে পারবো কিনা জানিনা। তুই সঙ্গে থাকলে ভরসা পাই। পারলে বরঞ্চ মহেশকেও নিয়ে আসিস।

    মহেশ তো আউট অব কোয়শ্চেন। ভি-আই-পি লোক, ওর তো তিনমাসের প্রোগ্রাম অ্যাডভান্স করা থাকে।

    তুলিকার বাবা রিটায়ার করে কলকাতায় সল্ট লেক-এ বাড়ি করেছেন, এখন সেখানেই থাকেন। কাজেই তুলিকাকে শনিবারের সুবিধেজনক একটা ফ্লাইটে প্রথমে কলকাতায় পৌঁছোতে হবে, তারপর রবিবার সকালে হাওড়া স্টেশন থেকে ইস্পাত ধরে গালুডি হয়ে পৌঁছোতে হবে খুশিঝোরা। জয়ি বললো, নিলীনও একই ট্রেনে আসছে।

    তাতে আমার কী ! ও তো উঠবে খড়গপুর থেকে !

    ঠিক এগারোটায় ফুল হাউজ। দশজনই উপস্থিত, সভার কাজ শুরু হলো। এই সভা মূলত খুশিঝোরার ভবিষ্যত কাজকর্মের বিষয়ে। জয়ির এগজিবিশনের ফলে খুশিঝোরা এখন মোটামুটি পরিচিত নাম। স্থানীয় সংস্কৃতির প্রসারের কাজই করবে খুশিঝোরা, এমনটাই এখানকার মানুষ, এমনকী হয়তো বাইরের মানুষ কিন্তু খুশিঝোরার কথা শুনেছেন যাঁরা, তাঁরাও মনে করেন। জয়ি বললো, কাজ আমরা শুরু করে দিয়েছি এটা দেখেছেন সবাই। এখন থেমে গেলে চলবে না।

    এর মধ্যে একটা প্রস্তাব এসেছে, বললো অনলাভ। তারপর সে ক্যালকাটা ক্লাবের মীটিঙের সমস্ত আলোচনাটাই জানালো উপস্থিত সবাইকে। অমিতাভ সিংহল এবং কমলাক্ষ দাশের বক্তব্যসহ।

    কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর উঠে দাঁড়ায় জলধর। বলে, আমি একটু বলতে চাই, একটু সময় নিয়েই বলতে চাই, সেটা ঠিক আছে?

    সুকান্তই সভাপতি, সে বললো, নিশ্চয়ই ঠিক আছে। যতটা সময় নিতে চাও, নাও।

    আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, জলধর বলে, সেটা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া জেলার একটা প্রান্ত। স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক ভূগোল এটাই। কিন্তু এই ভূগোলের বাইরেও একটা ভূগোল আছে। সে ভূগোল জঙ্গলের মানুষকে নিয়ে। সে ভূগোল যে অঞ্চলের সেই অঞ্চলের যে কোন জায়গা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলেই শাল-মহুয়ার জঙ্গল, ছোট-বড়ো পাহাড়, লালচে মাটি যার অনেকটাই কাঁকুড়ে, অজস্র তিরতিরে ছোট ছোট নদী-ঝোরার গুনগুনানি, আর কালোকোলো বেঁটেখাটো মানুষ – আপনি মাইলের পর মাইল হাঁটুন – এই একই দৃশ্য – মাইলের পর মাইল। কতো মাইল? কতো মাইল আমি ঠিক ঠিক জানিনা, কিন্তু অনেকটাই। এখান থেকে হাঁটতে শুরু কোরে বাঁকুড়া-মেদনীপুরের ভেতর দিয়ে ঢুকে যান সিংভূমে; ঘাটশিলা-জামশেদপুরের কারখানাগুলোর দক্ষিণে এসে ময়ূরভঞ্জ-কেওনঝর-সম্বলপুর হয়ে পশ্চিমে গিয়ে পৌঁছিয়ে যান সুন্দরগড়-রায়গড়-সরগুজা, তারপর আবার পূবের দিকে এসে পালামৌ-হাজারিবাগ-রাঁচি-গিরিডি-সাঁওতাল পরগণা দিয়ে ধানবাদ হয়ে ফিরে আসুন এই পুরুলিয়ায়। এক দৃশ্য, একই মানুষ, প্রায় চার কোটি যাদের সংখ্যা। যতোই চার রাজ্যের মধ্যে টুকরো টুকরো করে এদের বাসভূমিকে ভাগ করে দিক আধুনিক ভারতের ভূগোল, বাসভূমিটার চেহারা বদলায় না, বদলায় না মানুষগুলোও। প্রায় চার কোটি এই খোরোয়াল জাতির জনসংখ্যার অন্তত অর্ধেক আজও তাদের বেঁচে থাকার জন্যে জঙ্গলের ওপরেই নির্ভরশীল। এরাই উপজাতি, আদিবাসী, ইণ্ডিজেনাস পপুলেশন। বড়ো বড়ো নৃতত্ত্ববিদরা এদের অনেক রকমের আলাদা আলাদা নাম দিয়েছেন – সাঁওতাল, মুণ্ডা, খাড়িয়া, ভূমিজ, হো, ওরাওঁ – আরো কতো কী, আর সেই নামগুলো লুফে নিয়েছে যখন যারা শাসক। পঞ্চাশটা যদি আলাদা আলাদা নাম পাওয়া যায় পঞ্চাশ রকমের ভাগে এদের টুকরো টুকরো করে দেওয়াটা খুব সুবিধের হয়ে যায়। কিন্তু যে যতই চেষ্টা করুক এদের ভাগ করা যায়নি, কারণ মূলত একই সংস্কৃতি এদের, একই জীবিকা, একই বাসস্থান। এই বাসস্থানের আয়তন এবং পরিধি আমি যতটা বললাম – পুরুলিয়া থেকে বাঁকুড়া-মেদনীপুরের মধ্যে দিয়ে শুরু কোরে, ধানবাদ হয়ে ফের পুরুলিয়ায় পৌঁছোন পর্যন্ত – সবটারই একই নাম, জঙ্গলভূম। ঝাড়খণ্ড। এমনকি ছোট ছোট পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একটা সাধারণ ভাষাও কালে কালে তৈরি হয়ে গেছে এখানে – যার একটুখানি আমি শুনিয়েছিলাম একদিন জয়িদিকে – ঝাড়খণ্ডী উপভাষা।

    মুশকিলটা হলো জঙ্গলভূমির এই ঝাড়খণ্ডী মানুষদের বাসভূমিটা বড়োই লোভনীয়। আমাদের এই কাঁকুড়ে মাটির নীচে আছে অফুরন্ত খনিজ আকর, জঙ্গলের প্রাকৃতিক সম্পদের কথা কী আর বলবো – একটা শাল গাছই কয়েকটা পরিবার প্রতিপালন করতে পারে, আমাদের নদী-ঝোরাগুলোর জল যদি কোনমতে নিয়ে যাওয়া যায় জঙ্গলের বাইরের সমতলে, হাজার হাজার একর জমির সেচের ব্যবস্থা করা যায়। তাই গত দুশো বছর ধরে ডিকুরা এসেছে ঝাড়খণ্ডে ডাকাতি করতে।

    ডিকু? তারা কে? – প্রশ্ন করে সুজয়।

    জলধর কিছু বলার আগেই বলে নিলীন, ডিকু মানে বিদেশী, বাইরের লোক। আমার মনে হয় জলধর ঠিক এই সরল অর্থে ডিকু শব্দটা ব্যবহার করছে না। ডিকু একটা প্রায়-গালাগাল, ডেরোগেটারি শব্দ। বাইরের থেকে যে সব লোভী মানুষ এই অঞ্চলে এসেছে নানা অছিলায় এখানকার মানুষদের অসুবিধে করতে আর এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করতে, তাদেরই ও সম্ভবত ডিকু বলছে। জলধর তো এইমাত্র ঝাড়খণ্ডী উপভাষার কথা বললো। সে ভাষায় কিন্তু বাইরের মানুষের ভাষাও ঢুকে গেছে, যেমন বাংলা বা হিন্দী। এই বাংলা বা হিন্দীভাষী ঝাড়খণ্ডীদের ও ডিকু বলবে না, কারণ তারাও বহুদিন ধরে ওদের পাশাপাশি, ওদের সুখদুঃখের সাথী হয়ে এখানেই থেকে গেছে। অথচ এই হিন্দী-বাংলাভাষীদের মধ্যেও কিছু ডিকু আছে। সেই ডিকু তারাই যারা সুদের ব্যবসা করে, ওদের জমি হাতিয়ে নেয়, আর শাসনযন্ত্রের নানারকমের হাতিয়ার হয়ে জখম করে ওদের, শরীরে আর মনে।

    ঠিকই বলেছেন নিলীনদা – কৃতজ্ঞতায় প্রায় বুজে আসে জলধরের স্বর – এরাই ডিকু, এবং এদের সাথেই দুশো বছর ধরে লড়াই কোরে আসছে ঝাড়খণ্ডীরা, সেই চুয়ার বিদ্রোহের সময় থেকে।

    একটু থেমে জলধর আবার বলে, চুয়ার বিদ্রোহ নামটা লক্ষ্য করবেন। আমরা, যারা এখানকার মাটির মানুষ, তারা শুধু মানুষ নামে বর্ণিত হতে পারিনা, আমরা চুয়ার ! ছোটলোক !

    যাই হোক, আবার শুরু করে জলধর, আমি আপনাদের এই দুশো বছরের লড়াইয়ের কথা শোনাতে চাইছি না, আমি শুধু এই দুশো বছরের একটাই ডিকু-প্যাটার্নের কথা আপনাদের বলবো। ডিকুরা বরাবরই চেয়েছে জঙ্গলের মানুষকে নিজভূমে পরবাসী করে তুলতে, অথবা জমি থেকে উৎখাত করে নানা অছিলায় তাদের এই মূল্যবান জমি লুঠ করতে। মাটির নীচের সম্পদ আহরণ করার জন্যে একটা খনি যখন তৈরি হয়, ঐ মাটিতে বসবাসকারী কিছু মানুষ তখন ঐ খনিতেই অপটু কুলির কাজ পেয়ে যায় ! সেটাও যাদের সাধ্যাতীত, তারা ভিখারি অথবা কুলি হয়ে জঙ্গলের বাইরে অন্য কোথাও চলে যেতে বাধ্য হয়, আর মেয়ে হলে শরীরের বেসাতি নিয়ে ডিকুদের মনোরঞ্জন করে ! অর্থাৎ যেভাবেই হোক্‌, নিজেদের জমি থেকে তারা উৎখাত !

    উনিশশো সাতচল্লিশে দেশ স্বাধীন হলো। এখন তো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, সংখ্যাগুরুর সরকার। অর্থাৎ জঙ্গলভূমে যদি সেখানকার মানুষের জন্যে একটা রাজ্য তৈরি হয়, সেই রাজ্য চালাবে সেখানকারই মানুষ। ডিকুতন্ত্রের অবসান হবে। কিন্তু হলো না সেটা। গোটা জঙ্গলভূমটাকে চার টুকরো করে চারটে রাজ্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হলো, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা আর মধ্য প্রদেশ। ফলে জঙ্গলের মানুষ একেবারেই সংখ্যালঘু হয়ে চারটে রাজ্যের লেজুড় হয়ে গেলো। সংখ্যালঘু, অতএব গুরুত্বহীন তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, মতামত, বাঁচার অধিকার। কিন্তু সম্পদ? সম্পদ তো গুরুত্বহীন হতে পারে না, অতএব জঙ্গলভূমে আবার ডিকুতন্ত্র !

    প্রথম কয়েকটা বছর আশায় আশায় থেকেছে জঙ্গলের মানুষ। কয়েকটা নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেছে তারা। অনেক কিছু ঘটেছে, তার মধ্যে আমি যাচ্ছি না। জঙ্গলের মানুষের যারা নেতা, তাদের ভুল বুঝিয়ে, ঘুষ দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, ডিকুতন্ত্র চলেছে অনেকদিন পর্যন্ত। চলছে আজও। অবাধে চলছে লুণ্ঠন, মানুষকে ভিটেমাটিছাড়া কোরে জঙ্গলভূমের সম্পদ পাচার হচ্ছে 'মেনস্ট্রীম' দেশবাসীর বাসভূমে ! এর মধ্যেও যারা অবাধ্য হয়েছে, তাদের এমনকি দেশদ্রোহী বলতেও ছাড়েনি ডিকুরা। এরকম এক দেশদ্রোহীর কাহিনী শোনাই আপনাদের।

    এই মানুষটির নাম গঙ্গাধর কালুণ্ডিয়া। অল্প বয়েসে ভারতীয় সেনাদলে যোগ দেয় সে। তিন-তিনটে যুদ্ধে সে লড়েছে দেশের হয়ে, কৃতিত্বের সাথে। উনিশশো বাষট্টিতে চিনের বিরুদ্ধে, উনিশশো পঁয়ষট্টিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, আর উনিশশো একাত্তরে আর একবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়। এর মধ্যে পদোন্নতিও হয়েছে তার। সেনাদলের নিয়ম অনুযায়ী উনিশশো ছিয়াত্তরে নায়েক সুবেদার গঙ্গাধর সেনাদলের চাকরি থেকে অবসর নেয়।

    গঙ্গাধরের গ্রাম সিংভূমের চাইবাসা থেকে মাইল সাতেক দূরে ইলিগারাতে। অবসরের পর তার গ্রামের জমিটুকুতে সে সবজির চাষ করে। কিন্তু মুশকিল তার শেষ সম্বল এই জমিটা নিয়েই। আমি আপনাদের আগেই বলেছি আমাদের এই জঙ্গলভূমের অজস্র ঝোরা আর নদীর জল জঙ্গলের বাইরের সমতলে নিয়ে গিয়ে সেখানকার কৃষিজমির সেচে কাজে লাগানো শুরু হয়েছিল আগেই, স্বাধীনতার পর এই ডাকাতি বেড়ে গেলো। নানা ড্যাম থেকে তৈরি হওয়া জলবিদ্যুৎ আর সেচের জলের ছিটেফোঁটাই জোটে আমাদের এই জঙ্গলভূমের বা ঝাড়খণ্ডের মানুষের কপালে, কিন্তু ধ্বংস হয় লক্ষ লক্ষ একর জমি, হাজার হাজার গ্রাম। অন্তত ছ' লক্ষ ঝাড়খণ্ডী উচ্ছেদ হয়েছে ভিটে থেকে শুধুমাত্র ষাট আর সত্তরের দশকেই। ওয়র্ল্ড ব্যাঙ্ক আর তার সহযোগী নানা ফাণ্ডিং এজেন্সীর সহায়তায় সুবর্ণরেখা ভ্যালি প্রজেক্টের কুজু ড্যামের কাজ শুরু হলো যখন, তখন গঙ্গাধরের ঐ সবজি চাষের এক চিলতে জমিটারও আর বাঁচার কোন সুযোগই রইলো না, ঐ জমি সমেত ভেসে যাবে একশোরও বেশি গ্রাম। এবারটা গ্রামের মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরতে রাজি হলো না, তৈরি হলো কড়কাই বাণ সংঘর্ষ সমিতি, তার সম্পাদক গঙ্গাধর।

    বিহারের মুখ্যমন্ত্রী তখন ব্রাহ্মণ নেতা জগন্নাথ মিশ্র। আদেশ দিলেন সন্ত্রাস সৃষ্টির, এক-আধটা খুনে পরোয়া নেই। চৌঠা এপ্রিলের ভোরে গঙ্গাধরের গ্রামের বাড়িতে হানা দিলো পুলিশের সদর উপপ্রধান, সঙ্গে চাইবাসার সার্ক্‌ল্‌ ইনস্পেক্টর, আর আইনের অভিভাবক এক ম্যাজিস্ট্রেট, তার নাম চতুর্বেদী। বেচারা গঙ্গাধর তখন ঘুমোচ্ছে তার গোয়ালে, সেখান থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। পরের দিন দয়া করে পুলিশপ্রধান স্বয়ং এলেন তার বাড়িতে আবার, তার স্ত্রীকে বললেন সে যেন মর্গের থেকে তার স্বামীর মৃতদেহটা সংগ্রহ করে আনে। গঙ্গাধরের সৎকারের সময় তার শবদেহ থেকে প্রায় এক কিলোগ্রাম বুলেট আর কার্তুজের গলিত ধাতু - স্লাগ নামে আপনারা যাকে
    জানেন – পাওয়া যায়। বলাই বাহুল্য, এই মৃতদেহের ময়না তদন্তের কোন রিপোর্টের কথা কেউ কখনো শোনেনি। শুধু যা শোনা গেছে তা হলো পাটনা থেকে চীফ সেক্রেটারির দেওয়া এক বিবৃতি: গঙ্গাধর শুধু ঘৃণ্য এক দেশদ্রোহীই ছিলো না, সে ছিলো এক কুখ্যাত অপরাধী, যদিও পুলিশের রেকর্ড থেকে তার বিরুদ্ধে পুরোনো কোন অপরাধের রেকর্ডের কথা শোনেনি কেউ !

    এই আসলে ডিকুতন্ত্র ! জঙ্গলভূমের একশো গ্রামের অধিবাসীর জীবন এবং জীবিকার বদলে ডিকুদের দালানে ঝকঝকে বিজলীবাতি আর ক্ষেতে শ্যামলিমা !

    গঙ্গাধরকে যখন খুন করা হচ্ছে চাইবাসায়, তার কয়েকমাস আগেই পুরুলিয়ায় ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এক সমাবেশ ডাকে। পুরুলিয়ায় ! আমাদের এই প্রগতিশীল বাম মোর্চার রাজত্বের জমানায় ! সেই বিশাল জনসমাবেশকে ঘিরে রেখেছিলো শুধুমাত্র রাজ্যের সাধারণ পুলিশের দলই নয়, ছ' ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশও ! ঝাড়খণ্ডীদের বিশ্বাস নেই, তারা যদি পুরুলিয়া বা ঝাড়গ্রাম বা তার আশপাশের মানুষদের নিয়ে জোট বাঁধার জন্যে এককাট্টা হয় ! তাই দলে দলে পয়সাওয়ালা ডিকুদের জমি দেওয়া হলো ঝাড়গ্রামে। জৈব সারের প্রয়োগে সবজি ফলাবে তারা ! রেসর্ট তৈরি হবে তাদের বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ফূর্তি করার ! মাটির নীচ থেকে জল টেনে এনে তৈরি হবে বোতল-ভরা নির্দোষ পানীয় ! এটাই প্যাটার্ণ ! ভূমিপুত্ররা ধীরে ধীরে উচ্ছেদ হোক আর তাদের জায়গা দখল করুক আমরা যাদের ডিকু বলি তারা ! জয় ডিকুতন্ত্র !

    আপনাদের এতগুলো কথা বললাম এই জন্যে যে আমার ভয় হচ্ছে ডিকুদের নজর পড়েছে খুশিঝোরায়। জয়িদির এগজিবিশনটা এত ভালোভাবে উতরে গেছে যে জায়গাটা নিয়ে কলকাতায় আলোচনা হচ্ছে। এখানে এখন ডিকুদের অবাধ প্রবেশ চাই, তৈরি হোক কলকাতার ধনীদের জন্যে বৃদ্ধাবাস। আর খরচ, মানে যাকে বলে বিনিয়োগ, তার জন্যে তো চিন্তা নেই। সিংহলরা আর চৌধুরিরা তার জন্যে প্রস্তুত !

    কিন্তু একটা কথা আপনাকে বুঝতে হবে জলধর, বলে ওঠে তুলি, ওঁরা কিন্তু শুধুমাত্র কলকাতার ধনী বৃদ্ধদের কথা বলেননি, নিঃশুল্ক একটা ব্লক তৈরির প্রস্তাব দিয়েছেন স্থানীয় বৃদ্ধদের জন্যেও।

    সুকান্ত যখন খুশিঝোরার সভ্য হওয়ার প্রস্তাব দেয় প্রথম, তখন ওর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মজা করে ও খুশিঝোরাকে স্টার্লিং রেসর্টের সাথে তুলনা করে রেসর্ট অভিধা দিয়েছিলো। জলধরের মুখে ঝাড়গ্রামের রেসর্টের উল্লেখের পর থেকে মরমে মরে যাচ্ছিলো ও। সুকান্তই বলে উঠলো, তোর কী মনে হয় তুলি, যে এখানকার স্থানীয় বৃদ্ধরা ঐ পাঁচতারা বৃদ্ধাবাসে থাকতে আসবে এমনকী বিনি-পয়সায় থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেলেও?

    আসলে ঐ ব্লকটা দেখিয়ে সরকারী একটা অনুদানের কথা আগে থেকেই ভেবে রেখেছে অরুণ চৌধুরি, বলে ওঠে অনলাভ। তাতে ব্যক্তিগত বিনিয়োগের ভারটাও কমানো যাবে স্থানীয় মানুষদের শিখণ্ডী বানিয়ে ! নীট ফরমূলা ! স্থানীয় মানুষের সেবাকল্পে সরকারী বদান্যতায় ডিকুতন্ত্র ! নাঃ, এ চলবে না ! জলধর আমাদের চোখ খু্লে দিলো।

    এবার কথা বলে অরুণিমা, কিন্তু যা-ই বলো তোমরা একটা কথা মিঃ চৌধুরি ঠিকই বলেছেন। আমাদের যেটা ঘোষিত কর্মসূচী, অর্থাৎ স্থানীয় সংস্কৃতির প্রসার, সেটা ঠিক ঠিক মতো করতে হলে টাকাপয়সার কথাটা ভাবতেই হয়। সে ক্ষেত্রে একটা নিয়মিত আয়ের ব্যবস্থাও আমাদের করতে হবে। কী করবো আমরা সে ব্যাপারে?

    নিলীন বলে, অনেক কিছুই করতে পারি। সংস্কৃতি তো অর্থনীতির বাইরে নয়। সংস্কৃতির প্রসার মানে অর্থনীতির প্রসারও। এখানকার যেগুলো লোকাল প্রোডিউস, সেগুলোর ব্যাপারে মন দিতে হবে আমাদের। স্থানীয় মানুষদের সাথে নিয়েই করতে হবে এই কাজ।

    সেগুলো কী? করবো কীভাবে আমরা? – শ্যামলিমার প্রশ্ন।

    এতক্ষণ জয়ি প্রায় কোন কথাই বলেনি। শ্যামলিমার প্রশ্নের উত্তরে সে বলে উঠলো, আমার মনে হয় এত সহজে তোর প্রশ্নের উত্তর হবেনা। এর উত্তর পেতে হলে দূর থেকে পাওয়া যাবে না। আমাদের কাউকে পার্মানেন্টলি এখানে এসে থাকতে হবে।

    একেবারে ঠিক কথা, বলে জলধর।

    পার্মানেন্টলি তো আপনিই আছেন জলধর, বলে জুঁই।

    পার্মানেন্টলি? কোথায়? পার্মানেন্টলি এখানে থাকেন কাকু, আমি তো থাকি বান্দোয়ানে, আর বান্দোয়ানেই থাকতে হবে আমাকে। এখানে বলতে, আমার মনে হয়, জয়িদি খুশিঝোরায় থাকার কথা বলছেন। আর সত্যি কথা বলতে কী, আমারও মনে হয় কোন একজন যদি খুশিঝোরায় পার্মানেন্টলি না থাকে তাহলে খুশিঝোরাকে বাঁচানো যাবে না।

    ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সুকান্ত বললো, আজকের মীটিং খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে বলে মনে হয় না আমার, আমরা একটা ব্রেক নিয়ে নিই এখন, খাওয়া-দাওয়ার পর আবার শুরু করা যাবে।

    জয়ির এগজিবিশনটা হয়েছিলো যে হল দুটোয় তার মধ্যে একটাতে হচ্ছিলো মীটিংটা, আর একটায় খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। মীটিং থেকে বেরোতে বেরোতে তুলি বললো জয়িকে, খুব যে আমাকে হুটোপাটি করে ডেকে আনলি, কী ক্ষতি হতো আমি না এলে?

    তোর সাথে দুটো ব্যাপারে সীরিয়স আলোচনা আছে, তার খানিকটা মীটিঙেই হবে, বাকিটা হবে মীটিঙের পর।

    মীটিঙের পর? মীটিঙের পরই তো তাড়াহুড়ো করে দৌড়োতে হবে গালুডি, ট্রেন ধরতে হবে। মাকে কথা দিয়ে এসেছি ফিরবো, তোদের সাথে ফিরে গিয়ে কারো বাড়িতে যে থেকে যাবো তার উপায় নেই।

    পর্বত মহম্মদের কাছে না এলে মহম্মদই যাবে পর্বতের কাছে, ধর মীটিঙের পর আমিও তোর সাথে গালুডি গেলাম, সেখান থেকে কলকাতা, তোর বাড়িতে।

    সত্যি? ফাটাফাটি আইডিয়া, খুশিতে ডগমগ তুলি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে, আজ অনেকদিন পর তোর সাথে রাত জাগবো।

    মীটিঙে অনেক আলোচনা হলো, সবাই একমতও হলো যে ওদেরই মধ্যে কোন একজনের অন্তত খুশিঝোরায় পাকাপাকি থেকে যাওয়াটা জরুরি। কিন্তু কে থাকবে?

    এবার কথা বলে জয়ি। জানিনা শেষ পর্যন্ত থেকে যেতে পারবো কিনা, আমি কিন্তু মাসখানেকের একটা ট্রায়াল দিতে চাই।

    তুই? তোর চাকরিটা কে করবে? – প্রশ্ন করে সুকান্ত।

    সেটা ভাবিনি এখনো, তাই ট্রায়াল বললাম। একটা কিছু তো করতেই হবে। খুশিঝোরার কাজ শুরু হয়ে গেছে, এখন কী আর বন্ধ করা যায়?


    (ক্রমশঃ)

    ছবিঃ ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২৪ এপ্রিল ২০২১ | ২০৬৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Jol Dip | ২৬ এপ্রিল ২০২১ ১৪:২০105201
  • taarapara

  • moulik majumder | ০৪ মে ২০২১ ২৩:৪৬105472
  • ভালোলাগা 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে প্রতিক্রিয়া দিন