এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ব্যক্তি আক্রমণ ও রেটোরিকাল ডিভাইস নিয়ে কিছু কথা

    Sumit Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ৩১ জুলাই ২০১৯ | ২৯৪৭ বার পঠিত
  • * ভূমিকা

    ব্যক্তি আক্রমণ আর রেটোরিকাল ডিভাইস দুটো ভিন্ন জিনিস। এই দুটোর মধ্যে সম্পর্ক আছে, অনেক সময় রেটোরিকাল ডিভাইস দিয়ে ব্যক্তি আক্রমণ করা হয়। তারপরও বলব এই দুটো বিষয় আলাদা, দুটো ভিন্ন ভিন্ন শাখায় এগুলো নিয়ে স্টাডি করা হয়। ব্যক্তি আক্রমণ আমি এখানে আলোচনা করব লজিক বা যুক্তিবিদ্যার দিক থেকে, যুক্তিবিদ্যাই ব্যক্তি আক্রমণকে যৌক্তিক ফরমেটে সাজিয়ে একে বিশ্লেষণ করেছে। যুক্তি বিদ্যায় যে লজিকাল ফ্যালাসি বা কুযুক্তি বা হেত্বাভাসকে এড হোমিনেম বলা হয় তাকেই আমি বাংলায় ব্যক্তি আক্রমণ বুঝি। কেন আমি ব্যক্তি আক্রমণ বলতে "এড হোমিনেমকেই" ইঙ্গিত করছি তা লেখায় বলা হবে। রেটোরিকাল ডিভাইসকে মোটামুটিভাবে বলা হয় ফিগার অফ স্পিচ, বাংলায় অলঙ্কার। রেটোরিক, আরও ব্যাপকভাবে লিংগুইস্টিক্সের আলোচনায় এটাকে পড়া হয়। কিন্তু ব্যক্তি আক্রমণের এই আলোচনায় আমি অলঙ্কার নিয়েও কথা বলছি, বলার প্রয়োজন মনে করছি। আর এই সমস্ত আলোচনা করার তাগিদ আমি বোধ করেছি ফেইসবুকের গ্রুপগুলো পর্যবেক্ষণ করে। গ্রুপগুলোতে প্রায়ই ব্যক্তি আক্রমণ হয়, গ্রুপের এডমিন-মডারেটরদেরকে সেগুলো প্রতিনিয়ত নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হয়, আবার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে মেম্বাররা ক্ষেপে যায়, নিয়ন্ত্রণে যদি একদেশদর্শিতা দেখা যায় তাহলে তো কথাই নেই। আমার মনে হয়েছে, যদি এই এই ব্যক্তি আক্রমণকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, বা এখান থেকে বিরত থাকতে হয় তাহলে এগুলো সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একটু জ্ঞান রাখা জরুরি, সেই ব্যাবহারকারী কোন গ্রুপের মেম্বারই হোন, আর এডমিন-মডারেটরই হোন। বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে এই ইন্ট্রোতেই কিছু উদাহরণ দেই -

    - "তোমার মাথা গেছে তাই এখন আজেবাজে বকছ" (এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল))
    - "আমার কথার সমালোচনা করছ? তুমি নিজে মনে হয় খুব সাধু?" (এড হোমিনেম (টু কুওকুয়ি))
    - "পলপত জানোয়ারটার মত এই ব্যাটাও নাস্তিক, এও আরেকটা জানোয়ার" (এড হোমিনেম (গিল্ট বাই এসোসিয়েশন))
    - "আরে এই লোক তো একটা গাড়ল, এর কথার আবার কী দাম?" (এড হোমিনেম (এবিউসিভ))

    অনেক সময় অলঙ্কার ব্যবহার করেও ব্যক্তি আক্রমণ করা হয়, তারও কিছু উদাহরণ দেই -

    - একটি বিষয়ে সমালোচনা করার পর বলা হচ্ছে, "কেন? আঁতে ঘা লাগল বুঝি?", "আপনি এত গাধা কেন?" (এরোটেমা অলঙ্কারের মাধ্যমে এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল) জনিত ব্যক্তি আক্রমণ)
    - কেউ একজন (পুরুষ) নারীবাদের পক্ষ নিয়ে বলার পর তাকে বলা হল- "That will not get you any crumb of pussy (or vagina)" (সিনেকডকি অলঙ্কারের মাধ্যমে এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল) জনিত ব্যক্তি আক্রমণ)
    - এই লোক তো এরকম যুক্তিতে ভরপুর কথাই বলবে। (এন্টিফ্রেসিস অলঙ্কারের মাধ্যমে এড হোমিনেম (এবিউসিভ) জনিত ব্যক্তি আক্রমণ)
    - "মনে হচ্ছে, এই কথাটি শুনে তিনি যারপরনাই আহত হলেন, সব কিছু সবসময় নিজের মতের পক্ষে যায় না কিনা..." (এপোরিয়া অলঙ্কারের মাধ্যমে এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল) জনিত ব্যক্তি আক্রমণ)

    মানুষ অলঙ্কার কেন ব্যবহার করে তা নিয়ে আমার কিছু নিজস্ব চিন্তা আছে। মানুষ অনেক সময় সরাসরি ব্যক্তি আক্রমণ করতে পারে না। ব্যক্তি মধ্যে থাকা সংস্কারের জন্য, সভ্যতার জন্য (মানে তিনি সভ্য বলে) অন্যকে ডিরেক্ট এটাক করতে তার বাধে। তাই এই গ্লানির থেকে বের হবার জন্য কোপিং স্ট্র্যাটেজি হিসেবে মানুষের মধ্য থেকে ব্যক্তি আক্রমণ সরাসরি আক্রমণ হিসেবে বের না হয়ে আলঙ্কারিক আক্রমণ হিসেবে বের হয়। তাতে সেই মানুষের সেভাবে খারাপ লাগে না, তার মধ্যে ইল্যুশন তৈরি হয় যে তিনি ব্যক্তি আক্রমণের দায় নিলেন না, তিনি ব্যক্তি আক্রমণ করেন নি। এতে তিনি তো তার নিজের গ্লানি থেকে উদ্ধার পান, কিন্তু যাকে আলঙ্কারিক আক্রমণ করা হল তিনি উদ্ধার পান না। আমাদের, মানে মানুষের ভেতরের এমপ্যাথি বা সহমর্মিতা, ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এতটাই বেশি যে আমরা খুব সহজেই অন্যদের ইমোশন, তাদের কথার ভেতরের ইঙ্গিত সনাক্ত করে ফেলি। তাই আলঙ্কারিক আক্রমণের ক্ষেত্রে যে আক্রমণ করছেন তিনি খুব একটা দায় বোধ না করলেও যাকে আক্রমণ করা হচ্ছে তিনি ঠিকই ভালভাবেই আক্রান্ত হন। এমনকি সরাসরি আক্রমণের চেয়ে এরকম আলঙ্কারিক আক্রমণে তিনি আরও বেশি আক্রান্ত হতে পারেন। আবার বেশি আক্রান্ত করার জন্যেও কোন ব্যক্তি তার ব্যক্তি আক্রমণে অলঙ্কার মেশাতে পারেন। তো যাই হোক, ব্যক্তি আক্রমণের সাথে অলঙ্কারের ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে বলেই আমার মনে হয়েছে ব্যক্তি আক্রমণের আলোচনায় অলঙ্কার নিয়ে আলোচনা করাও দরকার। আর তাই এড হোমিনেম এর আলোচনার পর রেটোরিকাল ডিভাইস নিয়ে কিছু কথা যুক্ত করেছি। তো শুরু করা যাক।

    * ব্যক্তি আক্রমণ বা এড হোমিনেম

    এখানে চার প্রকারের ব্যক্তি আক্রমণ বা এড হোমিনেম নিয়ে লেখা হচ্ছে। এড হোমিনেম (এবিউসিভ), এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল), এড হোমিনেম (গিল্ট বাই এসোসিয়েশন), এবং এড হোমিনেম (টু কুওকুয়ি)। এই চারটি এড হোমিনেম নামক লজিকাল ফ্যালাসি বা যৌক্তিক হেত্বাভাস বা কুযুক্তির অন্তর্গত। কোন আলোচনা বা বিতর্কের সময় খেয়াল রাখা উচিৎ যাতে এগুলো আলোচনায় না আসে। ফেইসবুকের মত অনলাইন যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা ও তর্ক বিতর্ক লেগেই থাকে। আর সেখানে স্বভাবতই প্রবেশ করে এড হোমিনেম বা ব্যক্তি আক্রমণগুলো। কিন্তু শেষপর্যন্ত এগুলো আলোচনার পরিবেশকেই নষ্ট করে, কেননা এড হোমিনেম বা ব্যক্তি আক্রমণগুলো কোনটাই যুক্তিসঙ্গত নয়, সবকটাই কুযুক্তি।

    ১। এড হোমিনেম (এবিউসিভ)

    এটি পারসোনাল এবিউজ, পারসোনাল এটাক, এবিউসিভ ফ্যালাসি, ড্যামিং দ্য সোর্স, নেম কলিং, রিফিউটেশন বাই কেরিকেচার, এগেইনস্ট দ্য পারসোন, এগেইনস্ট দ্য ম্যান নামেও পরিচিত। এই এড হোমিনেম (এবিউজ)-কে পারসোনাল এটাক বা বাংলায় ব্যক্তি আক্রমণ বলা হয় বলে ভাববেন না কেবল এর মাধ্যমেই ব্যক্তি আক্রমণ ঘটে। বাদ বাকি তিনটি এড হোমিনেমও ব্যক্তি আক্রমণ ঘটে থাকে। তাই সকল এড হোমিনেমকেই এই লেখায় ব্যক্তি আক্রমণ বলা হচ্ছে। কেন বলা হচ্ছে তা বাকিগুলো পড়লেই পরিষ্কার হবে। যাই হোক, এই এড হোমিনেমের ক্ষেত্রে ব্যক্তি যে যুক্তি দিচ্ছেন তাকে আক্রমণ না করে, যে ব্যক্তি যুক্তি দিচ্ছেন তাকে আক্রমণ করা হয়, যেখানে ব্যক্তির উপর আক্রমণটি সেই ব্যক্তি যে যুক্তি দিচ্ছেন তার সাথে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। এর যৌক্তিক আকার বা লজিকাল ফর্মটি হচ্ছে -

    ১ নং ব্যক্তি এর দাবি হচ্ছে "ক"
    ১ নং ব্যক্তি একজন মূর্খ
    সুতরাং, "ক" দাবি সত্য নয়।

    উদাহরণ দেয়া যাক -

    (১) আমার বিরোধী দাবি করলেন যে কর কমিয়ে দেয়া একটি উত্তম প্রস্তাব। এই দাবিটি এমন একজন নারীর কাছ থেকে আসছে যিনি প্রতি রাতে এক পাঁইট করে বেন এন্ড জেরির পণ্য গেলেন।

    (২) টনি আমাদের এটাই বিশ্বাস করাতে চায় যে প্রাণের উৎপত্তি একটি "একসিডেন্ট" ছিল। টনি একজন নাস্তিক মুর্খ, যে চার্চের চেয়ে হাজতেই বেশি সময় কাটায়। তাই তার কথায় বিশ্বাস করার কিছু নেই।

    প্রথম উদাহরণে সেই ব্যক্তি আইসক্রিম ভালোবাসেন, এর সাথে কর কমানোর কোন সম্পর্ক নেই, তাই এটি তার যুক্তির সাথে অপ্রাসঙ্গিক। এড হোমিনেম আক্রমণগুলো সেই হতাশা বা মরিয়া অবস্থার সময়ই ঘটে থাকে যখন ব্যক্তি কোন উপযুক্ত প্রতি-যুক্তি খুঁজে পান না। দ্বিতীয় উদাহরণের ক্ষেত্রে বলব, টনি নাস্তিক হতে পারে, সে চার্চের চেয়ে বেশি কারাগারেও বেশি দিন কাটাতে পারে। কিন্তু এগুলো তার প্রাণের উদ্ভব সংক্রান্ত যুক্তির সাথে অপ্রাসঙ্গিক।

    যারা যারা এরকম ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হবেন তাদেরকে কিছু কথা বলে রাখছি। কেউ যদি আপনার উপর এরকম আক্রমণ করে তবে আপনি সেটাকে আপনার যুক্তির উচ্চমানের একটি প্রশংসা হিসেবে গ্রহণ করুন। এটি সাধারণত তাদের হতাশা বা মরিয়াভাবেরই লক্ষণ।

    ২। এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল)

    এটি আপিল টু মোটিভ, আপিল টু পারসোনাল ইন্টারেস্ট, আরগুমেন্ট ফ্রম মোটিভস, কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট, ফল্টি মোটিভস, নাইভ সিনিসিজম, কোয়েশ্চেনিং মোটিভস, ভেস্টেড ইন্টারেস্ট নামেও পরিচিত। এই এড হোমিমের ক্ষেত্রে নির্দেশ করা হয় যে, যে ব্যক্তি কোন যুক্তি প্রদান করছেন তিনি কোন পক্ষপাত বা কোন বিশেষ অবস্থানকে পূর্ব থেকেই সমর্থন করার কারণে সেই যুক্তিটি প্রদান করছেন। আর তাই তার যুক্তিটি অকার্যকর বা তার দাবিটি মিথ্যা। এর যৌক্তিক আকার বা লজিকাল ফর্মটি হচ্ছে -

    ১ নং ব্যক্তির দাবি হচ্ছে "ক"
    "ক" দাবি সত্য হওয়ায় ১ নং ব্যক্তির স্বার্থ রয়েছে
    সুতরাং "ক" দাবি মিথ্যা

    এবারে উদাহরণ দেয়া যাক -

    (১) বিক্রেতা - এই গাড়ির গ্যাস মাইলেজ অন্য গাড়িগুলোর তুলনায় উৎকৃষ্ট, এবং এটি কনজিউমার রিপোর্ট অনুযায়ী সব থেকে বেশি নির্ভরযোগ্য গাড়ি।
    ক্রেতা - আমার সন্দেহ হচ্ছে। তোমার আমাকে এই গাড়িটি গছিয়ে দিতে চাইছ।

    (২) অবশ্যই আপনার মন্ত্রী বলবেন যে তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন। না হলে তো তার আর মন্ত্রিত্ব থাকবে না।

    প্রথম উদাহরণটিতে গাড়িটি বিক্রি করায় বিক্রেতার স্বার্থ রয়েছে। তার মানে এই নয় যে তিনি মিথ্যা বলছেন। তিনি মিথ্যা বলতে পারেন, কিন্তু এই উপসংহার আপনি কেবল তার স্বার্থের উপর ভিত্তি করে টানতে পারেন না। এটি ধরে নেয়া যৌক্তিক যে, বিক্রেতাগণ তার পণ্য ও সেবা এই কারণে বিক্রি করেন, কারণ তারা তাদের পণ্য ও সেবায় বিশ্বাস করেন। দ্বিতীয় উদাহরণটির ক্ষেত্রে মন্ত্রী ঈশ্বরে বিশ্বাস করে মানে এই নয় যে, তিনি মন্ত্রী হবার জন্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস করার নাটক করছেন।

    যারা এরকম ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হয়েছেন বা হন বা হবেন তাদের জন্য কিছু কথা বলে রাখি। কোন বিশেষ অবস্থানে থাকা এবং তার মাধ্যমে বিশেষ কিছু অর্জন করতে চাওয়া ভুল কিছু নয়। কোন বিশেষ মতবাদ সমর্থন করা এবং তার সমর্থনে যুক্তি দেয়াও ভুল কিছু নয়। নিজের অবস্থান, উদ্দেশ্য, আদর্শকে সমর্থন করা ও তার স্বপক্ষে যুক্তি দেয়ায় দোষের কিছু নেই। এগুলোতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু কেউ আপনার এই অবস্থান, এই আদর্শ এর অযুহাত দেখিয়ে আপনার দাবিকে মিথ্যা বলতে পারেন না, আপনার যুক্তিকে অকার্যকর করতে পারেন না। খুব ভাল হয় যদি আপনি এটা নিয়ে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে নিজেই এই ব্যাপারে পরিষ্কার করে দিন।

    ৩। এড হোমিনেম (গিল্ট বাই এসোসিয়েশন)

    এটি এসোসিয়েশন ফ্যালাসি, ব্যাড কোম্পানি ফ্যালাসি, কোম্পানি দ্যাট ইউ কিপ ফ্যালাসি, দে আর নট লাইক আস ফ্যালাসি, ট্রান্সফার ফ্যালাসি নামেও পরিচিত। এই এড হোমিনেমের ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা বিষয়কে নেতিবাচকভাবে দেখা হয় কেননা সেই ব্যক্তি বা বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তি বা বিষয় নেতিবাচক। এর যৌক্তিক আকারটি হল -

    ১ নং ব্যক্তি "ক" দাবি করছেন
    ২ নং ব্যক্তি "ক" দাবি করেন, এবং তিনি একজন মুর্খ
    তাই ১ নং ব্যক্তিও মুর্খ

    উদাহরণ দেখা যাক -

    (১) ডেলোরেস সমান শ্রমে সমান মজুরির সমর্থক। সকল এক্সট্রিম নারীবাদী দলগুলোই এটি সমর্থন করে। তাই ডেলরেস এর মত এক্সট্রিমদেরকে এত গুরুতরভাবে নেয়ার কিছু নেই, অন্তত রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তো নয়ই।

    (২) কম্বোডিয়ান মাওবাদী বিপ্লবী পল পত ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন, এবং তিনি নিষ্ঠুর ও অমানুষ ছিলেন। ফ্র্যাংকিও ধর্মের বিরুদ্ধে, তাই ফ্র্যাংকিও অবশ্যই একটা বাজে লোক।

    প্রথম উদাহরণে ডেলোরেস সকল নারী ও পুরুষের সমান শ্রম ও সমান মজুরির নীতিতে বিশ্বাস করেন বলেই তাকে এক্সট্রিম নারীবাদী ধরে নেয়া যায় না। দ্বিতীয় উদাহরণের ক্ষেত্রে পল পত ও ফ্র্যাংকির একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে একই মত থাকার কারণে এটা বলা যায় না যে সম্পর্কিত নয় এমন অন্যান্য বিষয়ে তারা অভিন্ন হবেন তা বলা যায় না, বিশেষ করে এটা তো বলা যায়ই না যে ফ্র্যাংকিও একজন বাজে লোক। পল পত ধর্মের বিরুদ্ধে থাকায় একজন খারাপ লোক ছিলেন না, গণহত্যার সংঘটন করার জন্য তাকে বাজে লোক বলা হয়।

    যারা এরকম ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হন তাদেরকে বলব আপনার আচরণের সাথে কোন নেতিবাচক চরিত্রের কোন আচরণের মিল থাকতেই পারে, তাতে দোষের কিছু নেই। কোন নেতিবাচক আচরণ এর উদ্ভব কোথা থেকে, তার সাথে অন্যান্য আচরণগুলোর কার্যকারণ সম্পর্ক কী সেগুলো নিয়েও বিচার বিশ্লেষণ দরকার। কেউ এরকম দাবি করলে তাকে সেই বিচার বিশ্লেষণ থেকে বলতে পারেন যে এরকম আচরণের অনুরূপতা দোষের কিছু নয়, সেই সাথে সেই আচরণের সাথে আপনার আচরণের মধ্যে কার্য কারণ সম্পর্ক নেই তাও দেখিয়ে দিতে পারেন।

    ৪। এড হোমিনেম (টু কুওকুয়ি)

    একে "ইউ টু" ফ্যালাসি, হিপোক্রিসি, পারসোনাল ইনকনসিস্টেন্সিও বলা হয়ে থাকে। এখানে কোন ব্যক্তি তার যুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ আচরণ করেন না এই দাবি করে তার যুক্তিকে ভিত্তিহীন বা অকার্যকরী দাবি করা হয়। এর লজিকাল ফর্মটি হচ্ছে -
    ১ নং ব্যক্তি বলছেন "ক" দাবি সত্য, কিন্তু ১ নং ব্যক্তি এমন আচরণ করছেন যেন "ক" দাবি সত্য নয়
    সুতরাং "ক" দাবি অবশ্যই সত্য নয়

    উদাহরণ দেয়া যাক -

    ১। - তোমার ওটা খাওয়া উচিৎ নয়... বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে ফ্যাট বার্গার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
    - তুমি সবসময়ই ফ্যাট বার্গার খাও, সুতরাং সেটা সত্য হতে পারে না

    ২। জিমি সোয়াগার্ট (ইভাঞ্জেলিস্ট নেতা) যৌন অনৈতিকতা বিরুদ্ধে যুক্তি দেন। তবুও বিভিন্ন যৌনকর্মীর সাথে তার সম্পর্ক রয়েছে। কাজেই যৌন অনৈতিকতা গ্রহণযোগ্য।

    ১ম উদাহরণে ১ম ব্যক্তি আসলেই তার উপদেশটি নিজে অনুসরণ করেন কিনা তাতে কিছু আসে যায় না। বক্তব্যটির সত্য বা মিথ্যা ১ম ব্যক্তি সেই অনুযায়ী আচরণ করছেন নাকি করছেন না তার উপর নির্ভর করবে না। এমন নয় যে প্রথম ব্যক্তির ফ্যাট বার্গার খাবার কারণ হল তার দাবিটি মিথ্যা, বরং এর অন্য অনেক কারণ থাকতে পারে, একটি সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে ফ্যাট বার্গার দেখলে লোভ সংবরন করাটা কঠিন হয়ে যায়। ২য় উদাহরণে জিমি সোয়াগার্ট যৌনকর্মীদের সাথে কী করেন সেটা তার যৌন অনৈতিকতার সাথে সম্পর্কিত হতে পারে, কিন্তু যৌন অনৈতিকতার পক্ষের বা বিপক্ষের যুক্তির সাথে তার কোন সম্পর্ক নেই।

    যারা এরকম ব্যক্তি আক্রমণের শিকার হন তাদের জন্য কিছু কথা বলে রাখি। আপনি নিজে কী করছেন কোন কাজ করতে পারছেন কিনা তার সাথে আপনার কোনটাকে ঠিক মনে করেন, সেই সম্পর্কে আপনার কী মত তা সম্পর্কিত নয়, যদি না আপনি নিজে যা করেন তাকেও আপনার এই মত বা আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন। ব্যক্তির আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাশক্তির অভাব, সিস্টেমের ত্রুটি ইত্যাদির কারণে তিনি যেটাকে ঠিক মনে করেন সেখান থেকে বিচ্যুত হতেই পারেন। কেউ যদি তাকে কেন্দ্র করে আপনাকে আক্রমণ করে তবে তা নিয়ে বিচলিত হবেন না। আপনি জানেন আপনি কেন আপনি যা ঠিক মনে করেন সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারছেন না। সেই বিষয়গুলো অবাস্তব নয়, সেগুলোকে সামনে তুলে ধরুন। পারলে অপরপক্ষ তা নিয়ে কিছু বলার আগেই বিবৃতি দেবার সময় নিজের এই অক্ষমতার ব্যাপারগুলো বলে দিন। যেমন ধূমপানের বেলায় বলতে পারেন, "আমার মত ধূমপান শুরু করে কখনই বোকা হয়ো না। আমি জানি যে এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, আর আমার স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও এটা খুব ক্ষতি করছে, আমার মৃত্যুরও কারণ হতে পারে এটা। কিন্তু তুমি যদি ধূমপান শুরু না করো তবে তুমি এটাকে মিসও করবে না, বাধ্য হয়ে ধূমপানও করবে না, যেমনটা আমি করি।"

    * ব্যক্তি বা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানভিত্তিক বিতর্কে এই কুযুক্তিগুলোর সীমাবদ্ধতা

    এবারে আসা যাক এই এড হোমিনেম বা ব্যক্তি আক্রমণের কিছু সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে। সাধারণ আলোচনায় এইসব সীমাবদ্ধতা কাজ করে না। কিন্তু বিতর্ক তো কেবল সাধারণ কোন বিষয়েই ঘটে না, লিগাল ডিবেটগুলোতে বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান। এই অবস্থায় বিশেষ এই যৌক্তিক হেত্বাভাসগুলোর সাথে আরও বেশ কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হয়। যেমন এড হোমিনেম (এবিউসিভ) ও এড হোমিনেম (সারকামস্টেনশিয়াল) এর ক্ষেত্রে কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা ব্যক্তি স্বার্থ সামনে চলে আসে। যখন ব্যক্তির উপর আক্রমণটি তার যুক্তির সাথে প্রাসঙ্গিক হবে তখন সেটি কুযুক্তি হবে না। একটি উদাহরণে বেন এন্ড জেরির পণ্য ব্যবহারের কথা ছিল। সেখানে একজন ব্যক্তি পণ্যের উপর কম কমাতে চেয়েছিলেন। তিনি বেন এন্ড জেরির প্রোডাক্ট এক পাঁইট করে রাতে খান, সেটা আনা কুযুক্তি ছিল। কিন্তু যদি তিনি বেন এন্ড জেরির পণ্যে ট্যাক্স কমাতে চান, এবং প্রতি রাতে সেই প্রোডাক্ট বেশি করে খান তবে সেটা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা ব্যক্তি স্বার্থের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসবে। রাতের বেলায় বেন এন্ড জেরির পণ্য খাবার খাদ্যাভাস কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট এর একটি শক্তিশালী সাক্ষ্য হবে। এগুলোতে ব্যক্তির বিশেষ পক্ষপাত বা বায়াসও সামনে চলে আসে।বিশেষ বিষয়ে কোন মানুষের পক্ষপাত বা বায়াস, অথবা কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট বা স্বার্থের সংঘাত যুক্তির সাথে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলে, সাধারণত যদি সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তা অধিক পরিমাণে চিহ্নিত হয়, তবে যুক্তিটিকে কুযুক্তি কম এবং বৈধ মোটিভ হিসেবে বেশি দেখা হয়।

    এড হোমিনেম (গিল্ট বাই এসোসিয়েশন) এর ক্ষেত্রে যদি এটি দেখানো যায় যে, দুটো বৈশিষ্ট্যের মধ্যে (উপরের উদাহরণে ঈশ্বরে বিশ্বাস ও খারাপ ব্যক্তি হওয়া যেমন দুটো বৈশিষ্ট্য ছিল) সম্পর্ক কোন ভাবে কার্যকারণ সম্পর্কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত, তবে কোন ব্যক্তির মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য দেখা গেলে অপর বৈশিষ্ট্য দেখার সম্ভাবনা প্রবল হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে দাবিগুলো কুযুক্তি না হয়ে বৈধ হতে পারে। যেমন পল পত গণহত্যা করেছিলেন তাই তিনি খারাপ ব্যক্তি ছিলেন। এখন যদি ফ্র্যাংকিও গণহত্যা সংঘটন করে তবে সেও খারাপ ব্যক্তি। এড হোমিনেম (টু কুওকুয়ি) এর উদাহরণের ক্ষেত্রে যদি জিমি সোয়াগার্ট দাবি করতেন যে তার কাজটি যৌন নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাহলে একে ঘিরে বিতর্কের সুযোগ রয়েছে।

    যাই হোক, সাধারণ আলোচনার সময় এরকম সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচ্য নয়, কেননা সেগুলোতে বিতর্কের বিষয়বস্তু ব্যক্তি হয়না। যার সাথে কোন বিষয়ে বিতর্ক হচ্ছে, বিতর্কের বিষয় রেখে ব্যক্তির চরিত্র নিয়ে বিতর্ক শুরু করাটা ব্যক্তি আক্রমণই হবে। কিন্তু যখন কোন ব্যক্তিকে নিয়েই বিতর্ক শুরু হয়, যেমন অনেক সময়েই কারও টাইমলাইনে বা কোন গ্রুপে কোন ব্যক্তির আচরণ নিয়ে বিচারসভা বা খাপ বসতে দেখা যায়, সেসব ক্ষেত্রে ব্যক্তি আক্রমণের এই সীমাবদ্ধতাগুলো বিবেচ্য হতে পারে। অন্যথায় এগুলো বিবেচ্য হবে না।

    * রেফারেন্স:
    Walton, D. (1998). Ad hominem arguments. University of Alabama Press.

    * অলঙ্কার এর সমস্যা

    বিভিন্ন বক্তব্য বা আলোচনা থেকে কুযুক্তি বা যৌক্তিক হেত্বাভাসগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য যুক্তিবাক্য বা আর্গুমেন্ট গঠন করে সেগুলোকে লজিকাল ফর্মে বসিয়ে তারপর দেখতে হয় এগুলো আসলেই কুযুক্তি কিনা। মানুষের কথাবার্তায় থেকে সবসময় যুক্তিবাক্য বা আর্গুমেন্ট বের করা সহজ হয়না। কেননা মানুষের কথায় থাকে বিভিন্ন রকমের অলঙ্কার বা রেটোরিকাল ডিভাইস (রেটোরিক এর পরিভাষা অলঙ্কারশাস্ত্র ও রেটোরিকাল ডিভাইস এর পরিভাষা হিসেবে অলঙ্কার ব্যবহার করছি)। অলঙ্কার সাহিত্যে বা আমাদের বিভিন্ন কথায় সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এগুলো মানুষকে প্রভাবিতও করে। আর এগুলোকে ব্যবহার করে মানুষ ব্যক্তি আক্রমণও করেন। যিনি অলংকার প্রয়োগ করে ব্যক্তি আক্রমণ করবেন তিনি হয়তো যাকে প্রভাবিত করতে চাইছেন তাকে আরও বেশি করে প্রভাবিত করার জন্য অলংকার ব্যবহার করবেন, অথবা তিনি নিজের ব্যক্তি আক্রমণকে সরাসরি প্রকট করতে চান না বলে অলংকার প্রয়োগ করবেন, অথবা অধিক আবেগ প্রকাশের জন্য করবেন, অথবা অভ্যাসবশতই করবেন। অনেক কারণই থাকতে পারে, কিন্তু কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা, যুক্তিতর্কের ক্ষেত্রে সেই অলংকারগুলোকে সরিয়ে বিবৃতির আসল অর্থ বের করে আনতে হবে।

    আমরা মানুষেরা যুক্তিবাক্য তৈরি করে কথা বলি না, এদিকে আমাদের সকলের মধ্যেই কম বেশি সাহিত্য চেতনা, শিল্প চেতনা রয়েছে, যার ফলে কথা বলার সময় আমরা চেতনে অচেতনে বিভিন্ন ফিগার অফ স্পিচ বা রেটোরিকাল ডিভাইস বা অলঙ্কার ব্যবহার করি। আমাদের এই ফিগার অফ স্পিচ ব্যবহারই দেখিয়ে দেয় যে আমরা মানুষেরা কতটা জটিল প্রাণী, আমাদের চিন্তা করার প্রক্রিয়া কত জটিল, কত সম্পৃদ্ধ, কত সুন্দর। মানুষের কথা বলার এই বৈশিষ্ট্যগুলোর জন্যই তো মানব সভ্যতায় বিকশিত হয়েছে সাহিত্যের, শিল্পের। এগুলো মানব সভ্যতাকে করে মহিমান্বিত।

    মানুষের এই বৈচিত্র্য তাদের ব্যক্তি আক্রমণকেও করেছে বৈচিত্র্যময়। ব্যক্তি আক্রমণের ক্ষেত্রেও মানুষ ব্যবহার করে এই অলঙ্কারগুলোকে। আর তাই ব্যক্তি আক্রমণকে চিহ্নিত করতে হলে রেটোরিকাল ডিভাইস বা অলঙ্কারগুলো সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখা ভাল। গত পর্বেই বলেছিলাম, বিভিন্ন বক্তব্য বা আলোচনা থেকে কুযুক্তি বা যৌক্তিক হেত্বাভাসগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য যুক্তিবাক্য বা আর্গুমেন্ট গঠন করে সেগুলোকে লজিকাল ফর্মে বসিয়ে তারপর দেখতে হয় এগুলো আসলেই কুযুক্তি কিনা। এই পর্বে তাই ব্যক্তি আক্রমণ বা কুযুক্তিগুলোকে চিহ্নিত করতে যাতে সুবিধা হয় তাই উদাহরণ সহ বেশ কিছু রেটোরিকাল ডিভাইস বা অলঙ্কার সম্পর্কে দু-একটি কথা বলা হল। অলঙ্কারের সংখ্যা বহু, ৩০০-৪০০ এর মত চিহ্নিত অলঙ্কার রয়েছে, আর সবগুলোই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই পরিসরে অল্প কিছু উদাহরণই দেব, যাতে আমি যা বলতে চাই তা যাতে স্পষ্ট হয়। উদাহরণগুলোর অনেকগুলোই সাহিত্য থেকে নেয়া।

    তাহলে শুরু করা যাক। ফিগার অফ স্পিচ বা রেটোরিকাল ডিভাইসের আলোচনায় প্রথমেই শুরু করছি আয়রনি বা বক্রাঘাত দিয়ে। আয়রনি বলতে এমনভাবে কথা বলা বোঝায়, যার দ্বারা যেটা বলা হয়েছে বা লেখা হয়েছে সেটা না বুঝিয়ে অন্য কিছু বোঝানো হয়। এই ধরণের অলঙ্কার প্রায়ই উপহাস, বিদ্রুপ বা ঠাট্টা এর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। আয়রনি প্রকাশ করে এরকম কয়েক ধরণের অলঙ্কার আছে। কয়েকটা সম্পর্কে জানা যাক -

    ১। এন্টিফ্রেসিস (antiphrasis) - আয়রনি যদি একটি শব্দ নিয়ে হয় তবে তাকে এন্টিফ্রেসিস বলে। যেমন একজন লম্বা ব্যক্তিকে আসতে দেখে বলা হল, "আমাদের মিজেট এসে গেছে", কিছুদিন আগে একজনকে লিখতে দেখলাম "ইনি তো যুক্তিতে ভরপুর মিমই শেয়ার করবেন" (তার মিমটি অযৌক্তিক ছিল এটি প্রকাশ করলেন)। বাংলা সাহিত্যে এটি নিয়ে বেশ কিছু অসাধারণ উদাহরণ আছে। রবীন্দ্রনাথের ব্যবহার করা একটি বিখ্যাত এন্টিফ্রেসিস হল -
    "তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে" - রবীন্দ্রনাথ
    এখানে 'সাধু' ও 'চোর' শব্দ দুটি উচ্চারণের সময় স্বাভাবিক ভাবেই এমন একটা মোচড় এসে যায় যে, বিপরীত অর্থ গ্রহণ করা ছাড়া আর উপায় থাকে না (অর্থাৎ মহারাজই চোর, বক্তা সাধু)। সুতরাং এটি এন্টিফ্রেসিসের উদাহরণ।

    ২। প্যারালিপসিস (paralipsis) - এই অলঙ্কারের ক্ষেত্রে কোন কিছু বলে অন্যদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু অভিনয় করা হয় যে গ্রাহ্যই করছেন না। যেমন -
    (১) এই নির্বাচনী প্রচারণায় আমি প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বয়সকে সামনে নিয়ে আসতে চাই না। আর তাই আমি এটা বলতে চাইনা যে আমার প্রতিপক্ষ ব্যক্তিটি একজন অনভিজ্ঞ ও অভিজ্ঞতাশূন্য ক্যান্ডিডেট।
    (২) কেনেডির মদ্যপানের নেশার ব্যাপারে বলাটা আসলে ঠিক হবে না। ইতিমধ্যেই অনেকে তার উইমেনাইজার হবার ব্যাপারটা সামনে নিয়ে এসেছেন।

    ৩। এপিট্রোপ (Epitrope) - এই অলঙ্কারের ক্ষেত্রে অপরপক্ষের কথা মেনে নেয়া হয়, কিন্তু সেটা করা হয় বিদ্রুপাত্মক বা পরিহাসমূলকভাবে, যাতে তা আপাতভাবে পরাজয় স্বীকারমূলক, বা সম্মতিসূচক হলেও অন্য কিছুর আভাস দেয়। যেমন -
    (১) ক্লিন্ট ইস্টউডের বিখ্যাত ডায়ালগ "Go ahead, make my day"। কিছু দুষ্কৃতিকারী এক রেস্টুরেন্টে ডাকাতি করছিল, এক দুষ্কৃতিকারী সেখানকার এক নারীর মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে ক্লিন্টকে ব্ল্যাকমেইল করলে তিনি এই ডায়ালগটা দেন। এই কথাটিতে পরিহার ফুটে উঠেছিল কেননা ইতিমধ্যেই পুলিস চলে এসেছিল, দুষ্কৃতিকারী মহিলাকে খুন করলে তার বিশাল সাজা নিশ্চিত, তাই এভাবে তার বাঁচার আর কোন উপায়ই নেই। মুভি সিনটি দেখতে চাইলে ডায়লগটি ইউটিউবে লিখে সার্চ করে দেখতে পারেন।
    (২) এবারের উদাহরণটি একেবারে বাইবেল থেকে নেয়া - "Rejoice, O young man, in thy youth; and let thy heart cheer thee in the days of thy youth, and walk in the ways of thine heart, and in the sight of thine eyes: but know thou, that for all these things God will bring thee into judgment. —Ecclesiastes 11:9"
    (৩) নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটার জিমি নিশাম এর সাম্প্রতিক টুইট - "Kids, don't take up sport. Take up baking or something. Die at 60 really fat and happy."

    ৪। সারকাজম (sarcasm) বা পরীবাদ - সারকাজম এর আক্ষরিক অর্থই হচ্ছে কটূবচন। এটা আসলেই একরকম ইনসাল্টিং স্পিচ যা ভাষার চাতুর্যের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কোমল কথায় তা লুকিয়ে থাকে। যেমন -
    (১) জন লক এরিস্টোটলিয়ান লজিককে বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, "ঈশ্বর মানুষকে তৈরি করে তাকে এরিস্টোটলের কাছে পাঠিয়ে দেন নি, যাতে তারা যুক্তিবাদী হয়ে ওঠে"।
    (২) শেক্সপিয়র এর এন্টোনি এন্ড ক্লিওপেট্রায় একটা অসাধারণ সারকাজমের নজির পাওয়া যায় যখন এন্টনির কাছে সিজার বা তার স্ত্রীর কাছ থেকে বার্তা আসে। এই বার্তা আসতে দেখে ক্লিওপেট্রা এন্টোনিকে বিদ্রুপের সাথে বলেছিল -
    Nay, hear them [the messages], Antony.
    Fulvia perchance is angry; or who knows
    If the scarce-bearded Caesar have not sent
    His pow'rful mandate to you: "Do this, or this;
    Take in that kingdom, and enfranchise that;
    Perform't, or else we damn thee."
    —Antony and Cleopatra 1.1.19-24

    বাংলায় সারকাজমকে বলা হয় পরীবাদ। জীবেন্দ্র সিংহ রায় তার গ্রন্থ "বাঙলা অলঙ্কার"-এ লিখছেন, যখন প্রশংসার দ্বারা নিন্দা না করে অভিপ্রেত নিন্দার ভাবটিকে একটু বৈচিত্র্যের সাহায্য নিয়ে সোজাসুজিই প্রকাশ করা হয় তখন পরীবাদ বা সারকাজম অলঙ্কার হয়। যেমন -
    (৩) থাকতে দিলি না ভাত-কাপড়,
    মরলে করবি দান-সাগর।
    এই প্রবাদ-বাক্যে মাতার মুখ দিয়ে পুত্রদের কর্তব্যহীনতার নিন্দা সোজাসুজি হলেও একটু বৈচিত্র্যের সাহায্যে করা হয়েছে বলে পরীবাদ বা সারকাজম অলঙ্কার হয়েছে।

    ৫। এস্টেইসমাস (asteismus) - এই আইরনিতে একটা প্রশ্ন থাকে, এরপর উত্তর দেবার সময় সেই প্রশ্ন থেকে কিছু অংশ গ্রহণ করে এমনভাবে উত্তর ছুড়ে দেয়া হয় যাতে বিদ্রুপ বা পরিহাস প্রকাশ পায়। শেক্সপিয়রের Much Ado About Nothing থেকে উদাহরণ টানছি -
    Benedick: God keep your ladyship still in that mind! [of not marrying] so some gentleman or other shall scape a predestinate scratch'd face.
    (বেনেডিক - ঈশ্বর তোমার নারীত্বকে সবসময় স্মরণে রাখুন, যাতে কেউ ভুল করে কোন জেন্টলম্যান বা অন্য কেউ তোমাকে বিবাহ করে মুখে স্ক্র্যাচ লাভ না করেন)
    Beatrice: Scratching could not make it worse, an 't were such a face as yours were.
    (বিয়েট্রিস - স্ক্র্যাচিং এর ফলে বেশি খারাপ হবে না, তোমার মুখের দশা এমনিতেই খারাপ)
    Benedick: Well, you are a rare parrot-teacher.
    (বেনেডিক - তুমি একটি বিরল তোতাপাখির শিক্ষক (বিয়েট্রিসের মুখরা স্বভাবকে ইঙ্গিত করা হয়েছে))
    Beatrice: A bird of my tongue is better than a beast of yours.
    (বিয়েট্রিস - আমার কথায় কথা বলা পাখি তোমার অন্তরের পশুর থেকে ভাল)।
    —Shakespeare, Much Ado About Nothing 1.1:133-140

    ৬। শ্লেষ বক্রোক্তি - এস্টেইমাস এর কথা বলতে গিয়ে বাংলা অলঙ্কারশাস্ত্রের শ্লেষ বক্রোক্তির কথা মনে পড়ে গেল। পুরোপুরি এক না হলেও কিছু মিল অন্তত আছে। বক্তার বক্তব্যকে তার অভিপ্রেত অর্থে গ্রহণ না করে অন্য অর্থে গ্রহণ করা হলে তাকে শ্লেষ বক্রোক্তি বলে। যেমন -
    (১) প্রশ্ন - দ্বিজ হয়ে কেন কর বারুণী সেবন?
    উত্তর - রবির ভয়েতে শশী করে পলায়ন!
    দ্বিজ শব্দের অর্থ হল ব্রাহ্মণ আর বারুণী অর্থ হচ্ছে মদ। প্রশ্ন করা হচ্ছে, ব্রাহ্মণ হয়েও কেন মদ্যপান করো? উত্তর কিন্তু সেই অর্থগুলো ভেবে দেয়া হয়নি। দ্বিজ শব্দের আরেকটি অর্থ হল চাঁদ বা শশী, আর বারুণী শব্দের আরেকটি অর্থ হচ্ছে পশ্চিম দিক। প্রশ্নটাকে উত্তরদাতা ধরে নিয়েছেন এই অর্থে যে, "চাঁদ কেন পশ্চিম দিকে গমন করে?" উত্তরদাতাও উত্তর দিলেন, সূর্যের ভয়েই চাঁদ পশ্চিম দিকে পালায়।
    (২) সভাকবি - ওঁদের শব্দ আছে বিস্তর, কিন্তু মহারাজ, অর্থের বড়ো টানাটানি।
    নটরাজ - নইলে রাজদ্বারে আসব কোন দুঃখে? - রবীন্দ্রনাথ
    এখানে সভাববি অর্থ বলতে বুঝিয়েছেন শব্দের অভিধেইয় তাৎপর্য বা meaning - কে। অন্যদিকে নটরাজ উত্তর দেবার সময় অর্থ বলতে বুঝিয়েছেন টাকা পয়সাকে।

    আয়রনি আরও অনেক রকমের আছে, সেদিকে গিয়ে এত বিস্তারিত আলোচনা করছি না। অন্য ধরণের অলঙ্কারে যাওয়া যাক।

    ৭। ইনুয়েন্ডো (Innuendo) - এক্ষেত্রে একটি বাক্যের মধ্যে কোন লুক্কায়িত ভিন্ন কোন অর্থ থাকে। এই লুক্কায়িত অর্থটি নিন্দামূলক হয়ে থাকে, অনেক সময় যৌনতাসূচকও হয়ে থাকে। ইনুয়েন্ডো যৌনতাসূচক হলে তাকে সেক্সুয়াল ইনুয়েন্ডো বলে। উদাহরণ দেয়া যাক -
    (১) "We need to go deeper" - এই কথাটিকে আরও বেশি তদন্ত করার কথা বোঝাতে পারে, আবার শরীরের প্রাইভেট পার্টের গভীরে যাবার কথাও বোঝাতে পারে।
    (২) ক্লাসে ছাত্র কলম আনেন নি বলে শিক্ষক তাকে বলছেন, "Oh my poor boy, what will you do in your life without a pen?" (এখানে পেন দ্বারা কলম বোঝানো যায়, আবার এর দ্বারা ছাত্রের পুরুষাঙ্গের কথাও ইঙ্গিত করা যেতে পারে)।
    (৩) এক মেয়ে ক্লাসে দেরিতে আসায় শিক্ষক জিজ্ঞেস করছেন, "সারারাত কি নিয়ে ব্যস্ত ছিলে?" (এটির দ্বারা দেরিতে আসার কারণ দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা ধরে তার কারণ জিজ্ঞাসা করা বোঝাতে পারে, আবার কেন দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা হয়েছে তার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে রাতে মেয়েটি যৌনক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছিল সেটাকেও ইঙ্গিত করা হতে পারে)।

    কিছু রেটোরিকাল কোয়েশ্চন জাতীয় অলঙ্কারের কথা আনা যাক।

    ৮। এরোটেমা (erotema) - এধরণের রেটোরিকাল প্রশ্নে কেবল একটি প্রশ্ন করার মাধ্যমে শক্তিশালীভাবে কোন পয়েন্টকে জোড় দিয়ে স্বীকার বা অস্বীকার করা হয়। যেমন -
    একজন ব্যক্তি একটা বড় বোকামি করে ফেলার পর কেউ তাকে প্রশ্ন করেছেন, "তুমি এত বোকা কেন?" এই প্রশ্নটি কোন উত্তরের আশায় করা হয়নি, "লোকটি খুবই বোকা" এই কথাটি জোড় দিয়ে বলার জন্য এটি বলা হয়েছে।

    ৯। এনাকোয়েনোসিস (anacoenosis) - এই প্রশ্নটি বিচারক বা শ্রোতার উদ্দেশ্যে করা হয় যেখানে প্রশ্নের আড়ালে তাদের উপর বক্তা নিজের ইচ্ছা বা চিন্তা আরোপ করে দেন। যেমন -
    (১) এবার আমি আপনাদের বিচারের জন্য বিষয়টি ছেড়ে দিচ্ছি। আপনারাই বিচার করুন, এই লোকটি কি তার কৃতকর্মের জন্য জনতার ন্যায্য ক্ষোভ আশা করেন না?
    (২) বাইবেল থেকে একটা উদাহরণ দিচ্ছি -
    And now, O inhabitants of Jerusalem, and men of Judah, judge, I pray you, betwixt me and my vineyard. What could I have done more to my vineyard, that I have not done in it? —Isaiah 5:3-4

    ১০। এপোরিয়া (aporia) - এক্ষেত্রে ব্যক্তি তার প্রশ্নের মাধ্যমে মনের মধ্যকার সন্দেহ ব্যক্ত করেন। তবে এই সন্দেহটা যে আন্তরিক হতে হবে এমন নয়, তা ফেইকও হতে পারে। উদাহরণ -
    Where shall I begin to describe her wisdom? In her knowledge of facts? In her ability to synthesize diverse matters? In her capacity to articulate complex ideas simply?

    ১১। এপিপ্লেক্সিস (epiplexis) - এই অলঙ্কারের দ্বারা শোক প্রকাশ করা হয়। যেমন -
    কেন আমি জন্মগ্রহণ করলাম?

    ১২। এক্সাসসিটাশিও (exuscitatio) - এই অলঙ্কারের দ্বারা নিজের অনুভূতি অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। যেমন -
    আমরা কি কেবলই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সরকারকে আমাদের অধিকারকে পদদলিত করতে দেখব? এটাকি আমাদের জন্য নিরাপদ? এটা কি আমাদের জন্য সঠিক? আমাদের কেউ কি এভাবে চলতে দিতে সক্ষম?

    ১৩। কাকু বক্রোক্তি - এটি বাংলা অলঙ্কারশাস্ত্রের রেটোরিকাল কোয়েশ্চেন। সরাসরি উদাহরণে যাচ্ছি। -
    (১) রাবণ শ্বশুর মম, মেঘনাদ স্বামী,
    আমি কি ডরাই, সখি, ভিখারী রাঘবে? - মধুসূদন
    (২) আজ শতবর্ষ পরে
    এ সুন্দর অরণ্যের পল্লবের স্তরে
    কাঁপিবে না আমার পরাণ? - রবীন্দ্রনাথ

    আরও বিভিন্ন রকমের রেটোরিকাল কোয়েশ্চেন আছে। আলোচনা ব্যাপক আকার নেবে বলে যাচ্ছি না। এবার অন্যদিকে যাচ্ছি।

    ১৪.১৫। ইউফেমিজম ও ডিসফেমিজম (Euphemism and Dysphemism) - এই দুটো অলঙ্কার নিয়ে একসাথে বললেই সুবিধা হব। কোন কথা প্রকাশ করা যদি অসভ্য বা অপ্রীতিকর বলে মনে হয় তবে দেখা যায় সেই কথাটি প্রকাশ না করে কোন বিকল্প কথাকে প্রকাশ করা করা হয়। কথাটি শব্দও হতে পারে, বাক্যও হতে পারে। একে ইউফেমিজম বা সুভাষণ বলে। যেমন -
    (১) শেক্সপিয়র থেকে একটা উদাহরণ দেই -
    King Richard: What says he?
    Northumberland: Nay, nothing, all is said.
    His tongue is now a stringless instrument
    —Shakespeare, Richard II 2.1.147-149
    এখানে "stringless instrument" এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে তিনি মারা গেছেন।
    (২) "কর্তাবাবু, আপনাকে খাওয়ানোর মধ্যে আনন্দ আছে। আপনি খেতে বসেন সকলের আগে, খানও তাড়াতাড়ি, আর ওঠেনও সকলের শেষে।"
    এখানে, আপনি বড় বেশি খান - এই কঠিন কথাটি এখানে পরোক্ষভাবে কোমল করে বলা হয়েছে বলে সুভাষণ বা ইউফেমিজম অলঙ্কার হয়েছে।
    (৩) কিছুক্ষণ আগে একটা লেখা পড়তে গিয়ে একটা বাক্য সামনে এল। সেটা ছিল, "The fact Jimmy Swaggart likes to play a round of bedroom golf with some local entrepreneurial ladies, is not evidence for sexual immorality in general, only that he is sexually immoral."
    এখানে bedroom golf বলতে বোঝানো হচ্ছে যৌনক্রিয়া আর local entrepreneurial ladies দ্বারা বোঝানো হচ্ছে যৌনকর্মীকে। দুটোই ইউফেমিজম।
    ইউফেমিজম নিয়ে জর্জ কার্লিন এর একটা অসাধারণ স্ট্যান্ড আপ কমেডি আছে। ইউটিউবে সার্চ দিলেই দেখতে পাবেন।
    (৪) বর্তমানে হিজড়া শব্দটির জায়গায় কিন্নরী, বৃহন্নলা, শিখণ্ডিনীর মত পৌরাণিক চরিত্রকে ব্যবহার করাও ইউফেমিজম।

    ডিসফেমিজম হল ইউফেমিজমের উলটো। যখন কোন সাধারণ কথাকে এমনভাবে প্রকাশ করা হয় যার ফলে সেটি অফেন্সিভ বা অপ্রীতিকর হয়ে যায় তখন তাকে ডিসফেমিজম বলে। কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে আক্রমণ করার জন্য, বা অফেন্স করার জন্য শব্দের ডিসফেমিজম ব্যাবহার করতে পারেন। এগুলোর অনেকগুলোই স্লার বা গালি হিসেবে পরিচিত। ডিসফেমিজম এর উদাহরণ এর মধ্যে আছে, সিগারেটের জায়গায় ক্যান্সার স্টিক, হোমোসেক্সুয়াল ম্যান এর জায়গায় ফ্যাগ, মিথ্যার বদলে বুলশিট, টয়লেট টিস্যুর জায়গায় ম্যানহোল কাভার বলা ইত্যাদি। ব্যক্তির নামকে পরিবর্তন করেও ডিসফেমিজম হয়। যেমন জগন্নাথ এর জায়গায় জগা বলে ডাকা ডিসফেমিজমের মধ্যে পড়ে।

    অনেক শব্দের ক্ষেত্রেই ইউফেমিজম ও ডিসফেমিজম দুইই থাকতে পারে। যেমন টয়লেট এর ইউফেমিজম হল বাথরুম, আর ডিসফেমিজম হল পিসার, অরকা নামক সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীর ইউফেমিজম হচ্ছে সি পান্ডা আর ডিসফেমিজম হচ্ছে কিলার হোয়েল, রেবেল এর ইউফেমিজম হল ফ্রিডম ফাইটার আর ডিসফেমিজম হল টেরোরিস্ট, সিগারেট এর ইউফেমিজম হল টর্চ অফ ফ্রিডম আর ডিসফেমিজম হল ক্যান্সার স্টিক। বাংলা ভাষায়ও কিছু উদাহরণ দেয়া যায়। মুমূর্ষু ব্যক্তির ইউফেমিজম হিসেবে বলা যায় মৃত্যু পথযাত্রী আর ডিসফেমিজম হিসেবে বলা যায় ঘাটের মরা, মানসিক রোগীকে ইউফেমিজম হিসেবে বলা যায় মানসিক ভারসাম্যহীন বা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী আর ডিসফেমিজম হিসেবে বলা যায় পাগলা, পড়াশোনায় দুর্বল বাচ্চাদের ইউফেমিজম হল কোমলমতি শিশু আর ডিসফেমিজম হল গাধা।

    অনেকগুলো রেটোরিকাল ডিভাইস নিয়ে কথা হল। মেটোনিমি ও সিনেকডকি নিয়ে কিছু কথা বলেই আপাতত শেষ করে দেব।

    ১৬।মেটোনিমি (Metonymy) বা অনুকল্প - কোনো রকমের সম্পর্কের সূত্রে এক নামের নস্তুকে অন্য বস্তুর নামে অভিহিত করা হলে অনুকল্প বা মেটোনিমি অলঙ্কার হয়। যেমন -
    (১) জওহরলালের মৃত্যুতে সমগ্র ভারতবর্ষ শোকাভিভূত।
    এখানে 'সমগ্র ভারতবর্ষের' অর্থ হচ্ছে 'সমগ্র ভারতবর্ষের অধিবাসিবৃন্দ'। সুতরাং দেশের নামে অধিবাসিবৃন্দকে বোঝানো হয়েছে বলে এখানে অনুকল্প বা মেটোনিমি অলঙ্কার হয়েছে।
    (২) "The pen is mightier than the sword" - এখানে পেন বা কলম দ্বারা চিন্তাকে বোঝানো হচ্ছে, আর সর্ড দ্বারা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ যেমন মিলিটারি একশন বা পুলিসি একশন বোঝানো হচ্ছে।
    (৩) "My son, give me thy heart" - এখানে হার্ট বলতে ভালোবাসা বোঝানো হচ্ছে।

    ১৭। সিনেকডকি (Synecdoche) বা প্রতিরূপক - এক বস্তুকে অন্য বস্তুর দ্বারা বোঝানো হলে প্রতিরূপক অলঙ্কার হয়। এতে সাধারণত ব্যাপকতর কথার দ্বারা অপেক্ষাকৃত সঙ্কীর্ণ বিষয়কে বা সঙ্কীর্ণতর কথার দ্বারা অপেক্ষাকৃত ব্যাপক বিষয়কে বোঝানো হয়ে থাকে। সিনেকডকি একটি বিশেষ ধরণের মেটোনিমি। উদাহরণ -
    (১) উন্মত্ততরঙ্গ মাঝখানে
    যে পুত্র সঁপেছে অঙ্গ, তারে কোন্‌
    প্রাণে ছাড়ি যাব? - রবীন্দ্রনাথ
    এখানে 'অঙ্গ' কথাটি ব্যবহারের দ্বারা অধিকতর ব্যাপক 'দেহকে' বোঝানো হয়েছে। সুতরাং এটি প্রতিরূপক বা সিনেকডকি অলঙ্কার।
    (২) কড়ি দিয়ে কিনলাম - এই কথাটিতে কড়ি দ্বারা অর্থ বা টাকাপয়সা বোঝানো হয়েছে। তাই এটিও সিনেকডকি বা প্রতিরূপক অলঙ্কার।
    (৩) "He shall think differently," the musketeer threatened, "when he feels the point of my steel." - স্টিলের দ্বারা এখানে তরবারিকে বোঝানো হচ্ছে।
    (৪) দুই দিন আগে একজনকে ফেইসবুকে ব্যক্তি আক্রমণ করে লিখতে দেখলাম "that won't get you any crumb of pussy" - এখানে ক্রাম্ব অফ পুসি বলতে যোনি বোঝানো হয়নি, যৌনসুখ প্রাপ্তিকে ইঙ্গিত করা হয়েছি।
    (৫) একটি প্রসিদ্ধ ইংরেজি গালি - "What an asshole!" - এখানে এই এসহোলও সিনেকডকি, এখানে আসলে ব্যক্তির এসহোল বা গুহ্যদেশকে না বরং সমগ্র ব্যক্তিকেই নির্দেশ করা হচ্ছে।

    যাই হোক, লেখা বেশি বড় করব না এই সিদ্ধান্ত নিলেও ১৭টা রেটোরিকাল ডিভাইস নিয়ে লেখা হয়ে গেল। কিন্তু এগুলোই সব না, আরও অনেক আছে। আপনারা প্রত্যহ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে অনেক অনেক রেটোরিকাল ডিভাইস দেখেন। সব কিছু নিয়ে এই পরিসরে আলোচনা করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যতে আরও অনেকগুলো রেটোরিক ডিভাইস নিয়ে হয়তো লিখব। তবে আমি যা বোঝাতে চেয়েছিলাম তা আশা করি বোঝাতে সক্ষম হয়েছি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ৩১ জুলাই ২০১৯ | ২৯৪৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Sumit Roy | 237812.69.453412.44 (*) | ৩১ জুলাই ২০১৯ ১০:৩০50600
  • আলোচনায় তুললাম
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন