এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ভ্রমণ  যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে  খাই দাই ঘুরি ফিরি

  • ডেভিড লিভিংস্টোনের খোঁজে

    হেনরি মর্টন স্ট্যানলে
    ভ্রমণ | যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে | ১২ আগস্ট ২০২১ | ১২৮৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ | ৩২ | ৩৩ | ৩৪ | ৩৫ | ৩৬ | ৩৭ | ৩৮ | ৩৯ | ৪০ | ৪১ | ৪২ | ৪৩ | ৪৪ | ৪৫ | ৪৬ | ৪৭ | ৪৮ | ৪৯ | ৫০ | ৫১ | ৫২ | ৫৩ | পর্ব ৫৪ | পর্ব ৫৫ | পর্ব ৫৬ | পর্ব ৫৭ | পর্ব ৫৮ | পর্ব ৫৯ | পর্ব ৬০ | পর্ব ৬১ | পর্ব ৬২ | পর্ব ৬৩ | পর্ব ৬৪ | পর্ব ৬৫ | পর্ব ৬৬ | পর্ব ৬৭ | পর্ব ৬৮ | পর্ব ৬৯ | পর্ব ৭০ | পর্ব ৭১ | পর্ব ৭২ | পর্ব ৭৩ | পর্ব ৭৪ | পর্ব ৭৫ | পর্ব ৭৬ | পর্ব ৭৭ | পর্ব ৭৮ | পর্ব ৭৯ | পর্ব ৮০ | পর্ব ৮১ | পর্ব ৮২ | পর্ব ৮৩ | পর্ব ৮৪ | পর্ব ৮৫ | পর্ব ৮৬ | পর্ব ৮৭ | পর্ব ৮৮ | পর্ব ৮৯ | পর্ব ৯০ | পর্ব ৯১ | পর্ব ৯২ | পর্ব ৯৩ | পর্ব ৯৪ | পর্ব ৯৫ | পর্ব ৯৬ | পর্ব ৯৭ | পর্ব ৯৮ | পর্ব ৯৯ | পর্ব ১০০ | পর্ব ১০১ | পর্ব ১০২ | পর্ব ১০৩ | পর্ব ১০৪ | পর্ব ১০৫ | পর্ব ১০৬ | পর্ব ১০৭ | পর্ব ১০৮ | পর্ব ১০৯ | পর্ব ১১০ | পর্ব ১১১ | পর্ব ১১২ | পর্ব ১১৩ | পর্ব ১১৪ | পর্ব ১১৫ | পর্ব ১১৬ | পর্ব ১১৭ | পর্ব ১১৮ | পর্ব ১১৯ | পর্ব ১২০
    ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলেজাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হলো অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। এ অধ্যায়ে উন্যাময়েজি অঞ্চল, যেখানে বর্তমান টাবোরা শহর, সেখানে শিবির ফেলার কাহিনি। তরজমায় স্বাতী রায়




    আমরা আধুনিক মানচিত্রের সাহায্যে কিছুটা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি হেনরি মর্টান স্ট্যানলে-র যাত্রাপথ। নইলে পাঠকের পক্ষে বোঝাই মুশকিল এইসব কাণ্ড ঘটছে কোথায়। কাজটা কঠিন। কারণ, এই পথে এমন অনেক জায়গার নাম রয়েছে যার আজ কোনো অস্তিত্বই নেই। যেমন, আগের কিস্তিগুলোতে আমরা পেয়েছি, এমপোয়াপোয়া থেকে রওনা হয়ে কিদিদিমো হয়ে এমসালালো দিকে এগিয়ে যাওয়ার বর্ণনা। এ কিস্তিতে পেয়ে গেলাম কিরুরুমো তারপর উন্যাময়েজি। এই উন্যাময়েজি অঞ্চলই বর্তমানে টাবোরা শহর । এখানে বর্ণিত যা-কিছু ঘটছে সবই (ওপরের) মানচিত্রে সবুজ দাগ দেওয়া পথের আশেপাশেই।



    এনগারাইসো ও কুসুরির মাঝে কিরুরুমো নামের একটা গ্রাম পেরোলাম। বেশ সমৃদ্ধ জায়গা, আশেপাশে আরও বেশ কয়টি সমৃদ্ধ গ্রাম।  গ্রামের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের লোকেরা সাহেবকে স্বাগত জানাতে বেরিয়ে এল। এরা এতদিন ধরে সাহেবের কাফেলার হট্টগোল শুনছিল আর কাফেলার সৈন্যরা গ্রামের লোকদের জিওয়ে লা এমকোয়ার ঝামেলাবাজ ভাইদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিততে সাহায্য করেছিল।

    আর একটু এগিয়েই আমরা একটা বিশাল শিবির-এলাকার সামনে পৌঁছলাম। উচ্চবংশোদ্ভূত ওমানি আরব সুলতান বিন মোহাম্মদ রয়েছেন সেখানে। আমার কাছে আসার খবর পেয়েই তিনি আমাকে স্বাগত জানাতে বেরিয়ে এলেন আর আমাকে তাঁর শিবিরে আমন্ত্রণ জানালেন। তাঁবুতে  তাঁর হারেমের মেয়েরা ছিলেন। অবশ্যই সেখানে আমাকে নিমন্ত্রণ করা হয়নি; তবে অতিথিদের জন্য  বাইরে একটি কার্পেট পাতা ছিল। আমার স্বাস্থ্য, রাস্তার খবরাখবর, জাঞ্জিবার ও ওমানের সর্বশেষ খবরাদি সম্পর্কে সাধারণ প্রশ্ন করা শেষ হলে তিনি জানতে চাইলেন আমার সঙ্গে অনেক কাপড় আছে কিনা।  ফেরত-কাফেলার মালিকরা এই প্রশ্নটা প্রায়ই করেন। এর কারণ হ'ল ট্যাঙ্গানিকার ধারের হাতির দাঁতের বাণিজ্যবন্দর ও অন্য জায়গাতে কাপড়ের থেকে যতটা বেশি সম্ভব লাভ করার উদগ্র আকাঙ্খায় আরবরা ফেরত-যাত্রার জন্য যে কিছুটা কাপড় রাখা দরকার তা মাঝে মাঝেই ভুলে যায়।  উপকূলে বসে কাফেলার জিনিসপত্র গোছানোর সময় আমার দলের পাথেয় হিসেবে যতটা কাপড় হিসেব করা হয়েছিল, তার আর মাত্র একটা গাঁটরিই বাকী আছে। অতএব আমি একদম নির্লজ্জভাবে 'না' বলতে পারলাম।  কয়েক মিনিট পরেই শেখ হামেদ এসেছে বলে জানানো হল, আর সঙ্গে সঙ্গেই সে হাজির হল। মহাশয়কে গভীর অভিবাদন জানিয়ে, তাঁর হাতে চুমো দেওয়ার বিশাল ভড়ং টড়ং করে,  তাঁর 'কাইফ হালেক'[i] অত্যন্ত উদ্বেগ দেখালেন,  সুলতান বিন মোহাম্মদ ভাল মানে খুব, খুব ভাল আছেন কিনা তা জানার জন্য।  প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে দুই আরব একে অপরের স্বাস্থ্য, সৌভাগ্য ইত্যাদি নিয়ে আকুল আলাপ চালাল। তারপরে একটা ছোট্ট বিরতি আর আমাকে আমার কাপড়ের সম্ভার নিয়ে যে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সেই একই প্রশ্ন হামেদকে করা হল । “খুবই সামান্য,” শেখ উত্তর দিলেন; যদিও সুলতান বিন মোহাম্মদ এবং আমি ভাল করেই জানতাম যে হামেদের কাফেলাতে পঞ্চান্নটা কাপড়ের গাঁটরি রয়েছে।

    অচেনা আরব তার চাকরকে দিয়ে একটা ছাগলের চামড়া বোঝাই উন্যানয়েম্বের সুন্দর, সাদা চাল কুসুরিতে আমার শিবিরে পাঠিয়েছিল। আগেই তাকে না বলেছি, কাজেই আমার তো মনে হচ্ছিল এই উপহারও অস্বীকার করাই উচিত। এছাড়াও জাঞ্জিবারে কোন ছোটখাট পোঁটলা পাঠাতে চাইলে তিনি সঙ্গে নিয়ে যাবেন বলে জানান।  আর যখন জানলেন যে এমপাওয়াপাওয়াতে আমি একজন অসুস্থ সাদা লোককে ছেড়ে এসেছি, তিনি তাকে জানজিবারে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

    কুসুরিতে পৌঁছাবার পরেই, জিয়েহ লা সিংগার বাসিন্দা একদল সোয়াহিলি হাতি শিকারী  আমার কাছে আসে। এক বুড়ো তাদের নেতা। সে আবার আগে বাগামোয়োর দেওয়ান ছিল। আমার জন্য হাতে করে কিছুই আনে নি।  তাতেও কিন্তু তাদের কাগজ, কারি আর সাবান ভিক্ষা চাওয়ার কিছুমাত্র কমতি হয়নি, তবে আমার কাছেও এই তিনটে জিনিস খয়রাতি করার মতো যথেষ্ট পরিমাণে ছিল না, মাকাটার জলাভূমি আমার দ্রব্যসম্ভার নেহাতই ক্ষইয়ে দিয়েছিল।

    টানা অনেকদিন ধরে দীর্ঘ পদযাত্রার পরে কাফেলাকে একটু  বিশ্রাম দেওয়ার জন্য কুসুরিতে একদিন থামলাম, এরপরই তো আবার জনমানবশূন্য প্রান্তরের মধ্য দিয়ে দু'দিন হাঁটতে হবে।  উয়ানজি জেলার জিওয়েহ লা সিংগা ও  উন্যানয়েম্বের  তুরার মাঝে এই  প্রান্তর ।  হামেদ এগিয়ে গেল, কথা দিয়ে গেল যে সৈয়দ বিন সালেমকে আমার আসার খবর জানাবে, আর আমার জন্য একটি টেম্বে দেওয়ার অনুরোধও জানাবে।

    শেখ থানিকে বেশ কিছুদিন কুসুরিতেই কাটাতে হবে। তার দলের অনেকজনই পূর্ব আফ্রিকার ভয়াবহ মারী গুটিবসন্তের আক্রমণে শয্যাশায়ী।  তাকে বিদায় জানালাম, তারপর আমার কাফেলা কুসুরি ছেড়ে আরও একবার প্রান্তর ও জঙ্গলের দিকে রওনা দিল । দুপুরের অল্প আগে আমরা এমগোনগো টেম্বোর শিবিরে থামলাম। এই জায়গাটাকে হাতিপিঠও বলে— নামটা এসেছে একটা শৈল-তরঙ্গের থেকে, প্রাকৃতিক কারণে যার উপরের দিকটা গাঢ় বাদামি বর্ণের[ii]।  স্থানীয়রা মনে করে যে জঙ্গলের দৈত্যের নীল-বাদামী পিঠের সঙ্গে তার বড় মিল। আমাদের কাফেলার লোকজনের সঙ্গে  আমার এখানে বেশ ঝগড়াই হল, আমাদের দ্বিপ্রাহরিক পথচলা কি সেদিনই শুরু হবে নাকি তার পরের দিন। বেশিরভাগেরই বক্তব্য ছিল যে পরের দিন হাঁটা শুরু করাই ভাল; তবে কিনা আমি 'মালিক'  - নিজের স্বার্থের খেয়াল করে, সেদিনই হাঁটা শুরু করতে হুকুম দিলাম। একটা দুটো চাবুকের বাড়িও যে এদিক- ওদিক পড়ল না এমন নয়!

    বার্টন ও স্পেক যখন এসেছিলেন,  তখন এমগোনগো টেম্বো একটা সম্ভাবনাময় বসতি, অনেকখানি জমি নিয়ে। তবে এখানকার লোকেরা কোন এক কাফেলার উপর দুঃসাহসী আক্রমণ করে আর তার ফলে  দু'বছর আগে যুদ্ধ বাঁধে,  উন্যানয়েম্বে থেকে এনগোয়ানা দাসদের নিয়ে আরবরা আসে, আক্রমণ করে, গ্রামগুলো পুড়িয়ে দেয়, বহু বছরের শ্রমকে নষ্ট করে দেয়। সেই থেকে এমগোনগো টেম্বো কেবল ঘরবাড়ীর পোড়া ধ্বংসস্তুপ, চাষের ক্ষেতে জঙ্গল গজাচ্ছে।

    এমগোনগো টেম্বোর নালার কাছে একটি ঘন কুঞ্জবনের মাথার উপর দিয়ে খেজুর গাছের গুচ্ছ উঁকি মারছে - দেখেই আমার মিশরের স্মৃতি মনে এল। স্রোতের দুধার দিয়ে সবুজ পাতার রাশি - দুদিকের শুকনো, বাদামী জঙ্গলের সঙ্গে কী আশ্চর্য বৈসাদৃশ্য!

    বেলা ১ টার সময়  আমরা মালপত্র তুলে, পথচলার সরঞ্জাম সব গুছিয়ে  অল্প সময়ের মধ্যে ফের এনগওহালাহ নদীর  দিকে হাঁটা শুরু করলাম - জায়গাটা এই শিবির থেকে পৌনে নয় মাইল দূরে। গনগনে রোদ; সূর্যটা যেন একটা জ্যান্ত, হিসহিসানো আগুনের গোলা, মাথার উপর লকলকে শিখা বাড়িয়ে দাউ দাউ করে জ্বলছে -  তারপরে যতই পশ্চিমে ঢলে পরে, বাতাস-আকুল ফুসফুসে ঢোকার আগেই হাওয়াকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়। গলা-বুক জ্বালানো ভয়াবহ উত্তাপ নিবারণের জন্য জলের পাত্রগুলি দ্রুত খালি হচ্ছিল। একজন কুলির মারাত্মক গুটিবসন্তের সংক্রমণ হয়েছিল, সে আর পারল না, মরার জন্য পথের পাশেই শুয়ে পড়ল। আর তাকে পরে কখনও দেখিনি। দীর্ঘ দ্বিপ্রাহরিক টানা পথচলার সময় কাফেলার এগিয়ে চলা অনেকটা সমুদ্র-ঝড়ের মুখে পড়া জাহাজের মতনই।  তাকে এগোতেই হবে, যে পিছিয়ে পড়বে তার কপালে দুর্ভোগ লেখা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা তাকে আঁকড়ে ধরবে - প্রবল ঝড়ে সলিলসমাধির থেকে বাঁচার জন্য যেমন জাহাজকে উর্ধশ্বাসে ঝড়ের আগে আগে ছুটতে হয়  - তখন কেউ জলে পড়লে বিপদ তারই !

    নদীখাতের গভীর পাথুরে খোঁদলের থেকে আমরা প্রচুর ভাল, মিষ্টি আর ঠান্ডা জল পেলাম। মাবানগুরুর মত এখানেও তীব্র জলস্রোতের দাগ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।

    এনগওহালাহ এসেছে উত্তর দিকের উবানারামা অঞ্চল থেকে - সে জায়গাটা খুব ভাল জাতের গাধার জন্য বিখ্যাত। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-দক্ষিণ-পশ্চিমে চলে, উন্যানয়েম্বের রাস্তা পেরিয়ে,  নদী পশ্চিমে মোড় নিয়েছে।

    ১৬ তারিখে আমরা মাদেদিতায় পৌঁছালাম, এমন একটা গ্রামের থেকে সেখানে এলাম,  যেটা আগে ছিল,  তবে এখন আর নেই। মাদেদিতা এনগওহালাহ নদীর  থেকে সাড়ে বারো মাইল দূরে। উন্যাময়েজির তুরাতে পৌঁছানর আগে রাস্তার থেকে কয়েকশ গজ দূরে একটা ভাল জলের পুকুরই এখানে কাফেলাগুলোর একমাত্র জলের উৎস ।  সোয়াহিলিরা যাকে চুফওয়া-মাছি বলে সেই সেৎসে কামড়ে আমরা জ্বলে যাচ্ছি - অবশ্য এ থেকে বোঝা যায় যে ওই পুকুরে মাঝেমাঝে বড় জন্তুরা আসে, তবে জলের ধারেকাছে কেউ ঘাপটি মেরে আছে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। একটাই মাত্র পুকুর, প্রয়োজনে থামা কাফেলার লোকেরা যেখানে প্রায়ই যাতায়াত করে, সেখানে বন্য প্রাণীরা নিত্য যাতায়াত করতে পারে না, আফ্রিকার এই অঞ্চলের প্রাণীরা মানুষের চলার পথের থেকে দূরেই থাকে।

    পরের দিন ভোরে আমরা আবার পথে - অন্য সব দিনের চেয়েও দ্রুত হাঁটা হচ্ছে আজ, আজই মাগুন্ডা মালি ছেড়ে উন্যাময়েজিতে ঢুকব আমরা— সে জায়গাটা একটু বেশি উন্নত,  আরও বেশি লোকের বাস।  অনেকক্ষণ ধরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি, বেশ বিরক্তিকর রকমের বেশি সময় ধরেই । তবে ঘণ্টা দুয়েক পরে আস্তে আস্তে বন পাতলা হতে থাকল, তারপর বেঁটে হয়ে ঝোপে পরিণত হল, শেষে একদম মিলিয়ে গেল আর আমরাও উন্যাময়েজির মাটিতে পা রাখলাম। বহুদূর ছড়ানো সমতল, একবার উঠছে, আবার পড়ছে, চোখের সামনে চমৎকার, টানা ঢেউএর মত বহুদূরের অস্পষ্ট রক্তবর্ণ দিগন্তে মিলিয়ে যাচ্ছে।  সুপক্ক শস্যও উপস্থিত সেই ছবিতে, মাটির ঢেউ এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তারা উসাগারার হিম বয়ে আনা সকালের বাতাসে আনন্দে দোল খাচ্ছে।

    সকাল আটটায়, আমরা উন্যাময়েজির পূর্ব তুরার সীমান্তবর্তী গ্রামে পৌঁছালাম, সেখানকার সামান্য ক'ঘর বাসিন্দার পছন্দ-অপছন্দের তোয়াক্কা না করেই গ্রামে ঢুকেও পড়লাম। এখানেই নানদোকে পেলাম, সে স্পেকের দল ছেড়ে পালিয়েছিল। বোম্বের বিরুদ্ধে যারা বারাকার পক্ষ নিয়েছিল, তাদের একজন। সে আমার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল, নিজের পুরোন সাথীদের ও শেষে কুলিদের মধু ও শরবত জোগানর কাজে যথেষ্ট ব্যস্ত ছিল। একটা ছোট্ট বিরতির পরে আমরা মধ্য তুরার উদ্দেশে রওনা দিলাম।

    পূর্ব তুরার থেকে বেরোন রাস্তাটা বাজরা ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে গেছে, ভারতীয় ভুট্টা, জোয়ার, বাজরি বা মাওয়েরি, আরবরা যাকে প্যানিকামও বলে; মিষ্টি আলুর বাগান, টানা টানা বড় বড়  শসা,  তরমুজ, ফুটির ক্ষেত, এছাড়াও আছে শস্যের  সারির মাঝের গভীর লাঙ্গলটানার গর্তে গজানো চিনাবাদাম।

    গ্রামের আশেপাশে একরকম চওড়া-পাতাওলা কলাগাছ দেখা যাচ্ছিল, যতই এগোচ্ছি ততই তারা সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে অগুনতি হচ্ছে। কিম্বুদের গ্রাম গোগোদের গ্রামের মতই, চৌকো, সমতল ছাদ ওলা, একটা খোলা জায়গা ঘিরে যেটা আবার অনেকসময়ই বেড়া বা মাটামার গোড়া দিয়ে তিন চারটে ভাগে ভাগ করা।

    মধ্য তুরায়, যেখানে আমরা শিবির পেতেছি, সেখানে আমাদের কাছে তুরার কিম্বুদের বদমাইশির যথেষ্ট প্রমাণ ছিল।  হামেদ অনেক চেষ্টা করেছিল  যাতে অন্য আরবরা তাদের কাপড়ের সম্ভার নিয়ে এসে পৌঁছানোর আগেই সে উন্যানয়েম্বে পৌঁছাতে পারে আর নিজের কাপড় বিক্রি করতে পারে। তবু তাও সে নিজের কুলিদের প্রতিদিন দুগুণ পথ হাঁটতে বাধ্য করতে পারেনি। অগত্যা সেও মধ্য তুরাতেই শিবির করে ছিল। সংগে ছিল আরব দাসরা,  যারা থানির সাবধানে পথ চলার তুলনায় হামেদের আহাম্মক-সুলভ তাড়াহুড়ো বেশি পছন্দ করত।  উন্যাময়েজিতে আমাদের প্রথম রাতটা ভারি রোমাঞ্চকর কাটল। দুজন চোর হামাগুড়ি দিয়ে সাহেবের শিবিরে হানা দিল। তবে শিগগিরই তারা পুর্বলক্ষণ হিসেবে একটা  ট্রিগারটানার ক্লিক শব্দ শুনে বুঝে গেল যে সাহেবের শিবিরটা ভাল মতন সুরক্ষিত।

    এরপর তারা যায় হামেদের শিবিরে। কিন্তু সেখানেও মালিকের ছটফটানি তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করল, কারণ সে গোটা শিবির জুড়ে সামনে-পিছনে পায়চারি করছিল, হাতে গুলিভরা বন্দুক। অতএব চোরেরা সেখান থেকে কোনও কাপড়ের গাঁটরি চুরির আশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হল। হামেদের শিবির থেকে তারা গেল হাসানের শিবিরে (হাসান আরব বান্দাদের একজন), সেখানে অবশ্য কয়েক গাঁটরি কাপড় তারা প্রায় বাগাতে পেরেছিল। তবে, দুর্ভাগ্যক্রমে, তারা আওয়াজ করে ফেলেছিল, তাই শুনে সতর্ক, কান-খাড়া দাসের ঘুম ভেঙ্গে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে গাদা বন্দুক তুলে একজনকে বুকে গুলি করে।  তুরার কিম্বুদের নিয়ে আমাদের এমনই অভিজ্ঞতা।

    পরের দিন সকালে প্রতিবেশী গ্রামগুলোতে তাদের লোকদের দুর্ঘটনার খবর জানানো হল, তবে রাতের বেলা সাহসী চোর হলেও দেখা গেল দিনের বেলা তারা ল্যাজগুটানো কাপুরুষ, পুরো ব্যাপারটাতে এক ফোঁটাও কেউ কোন ক্ষোভ প্রকাশ করল না -  না কথায়, না মুখচোখে। এই দিনটা বিশ্রামের, তুরার বাসিন্দারা শিবিরে এত প্রচুর পরিমাণে মধু ও ঘি, মিষ্টি আলু আর শস্য এনেছে যে আমি মাত্র দুই ডটির বিনিময়ে  আমার লোকদের জন্য মহাভোজের আয়োজন করলাম।  উন্যাময়েজিতে পৌঁছানো উদযাপনের জন্য।



    ক্রমশ...




    [i] ‘কাইফ হালেক’ একটি আরবি শব্দ যার মানে ‘কি খবর’? তবে খুব সম্ভবত স্ট্যানলি শুনে শুনে লিখেছেন বলে লিঙ্গ গুলিয়েছেন। কাইফ হালেক মেয়েদের বলা হয়, ছেলেদের বলা হয় ‘কাইফ হালক’। 

    [ii] আসলে নামটা এমগোনগো ওয়া টেম্বো— বা হাতি-পিঠ। এই পাহাড় এখনও এই নামেই পরিচিত। এই তার বর্তমান চেহারা—



    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    | | | | | | | | | ১০ | ১১ | ১২ | ১৩ | ১৪ | ১৫ | ১৬ | ১৭ | ১৮ | ১৯ | ২০ | ২১ | ২২ | ২৩ | ২৪ | ২৫ | ২৬ | ২৭ | ২৮ | ২৯ | ৩০ | ৩১ | ৩২ | ৩৩ | ৩৪ | ৩৫ | ৩৬ | ৩৭ | ৩৮ | ৩৯ | ৪০ | ৪১ | ৪২ | ৪৩ | ৪৪ | ৪৫ | ৪৬ | ৪৭ | ৪৮ | ৪৯ | ৫০ | ৫১ | ৫২ | ৫৩ | পর্ব ৫৪ | পর্ব ৫৫ | পর্ব ৫৬ | পর্ব ৫৭ | পর্ব ৫৮ | পর্ব ৫৯ | পর্ব ৬০ | পর্ব ৬১ | পর্ব ৬২ | পর্ব ৬৩ | পর্ব ৬৪ | পর্ব ৬৫ | পর্ব ৬৬ | পর্ব ৬৭ | পর্ব ৬৮ | পর্ব ৬৯ | পর্ব ৭০ | পর্ব ৭১ | পর্ব ৭২ | পর্ব ৭৩ | পর্ব ৭৪ | পর্ব ৭৫ | পর্ব ৭৬ | পর্ব ৭৭ | পর্ব ৭৮ | পর্ব ৭৯ | পর্ব ৮০ | পর্ব ৮১ | পর্ব ৮২ | পর্ব ৮৩ | পর্ব ৮৪ | পর্ব ৮৫ | পর্ব ৮৬ | পর্ব ৮৭ | পর্ব ৮৮ | পর্ব ৮৯ | পর্ব ৯০ | পর্ব ৯১ | পর্ব ৯২ | পর্ব ৯৩ | পর্ব ৯৪ | পর্ব ৯৫ | পর্ব ৯৬ | পর্ব ৯৭ | পর্ব ৯৮ | পর্ব ৯৯ | পর্ব ১০০ | পর্ব ১০১ | পর্ব ১০২ | পর্ব ১০৩ | পর্ব ১০৪ | পর্ব ১০৫ | পর্ব ১০৬ | পর্ব ১০৭ | পর্ব ১০৮ | পর্ব ১০৯ | পর্ব ১১০ | পর্ব ১১১ | পর্ব ১১২ | পর্ব ১১৩ | পর্ব ১১৪ | পর্ব ১১৫ | পর্ব ১১৬ | পর্ব ১১৭ | পর্ব ১১৮ | পর্ব ১১৯ | পর্ব ১২০
  • ভ্রমণ | ১২ আগস্ট ২০২১ | ১২৮৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • rhishin sinha | ১৫ আগস্ট ২০২১ ০১:৫৭496778
  • চমৎকার 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন