আজকে অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় হয়েছে। একজনের যাবজ্জীবন আর পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত। বিভিন্ন রায়ের পর আমরা বাদী বিবাদীর মতামত শুনে থাকি। সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন কেউ, কেউ বা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের বিচারের রায় নিয়ে উনার স্ত্রী সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন নাই। উনি কিছু প্রশ্ন তুলেছেন যা খুবই ন্যায্য প্রশ্ন। রাষ্ট্রের উচিত এই সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। অন্যদিকে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামিরা হাসিমুখে দুই আঙুল তুলে ভি চিহ্ন দেখিয়েছে। মানে উনারা রায় নিয়ে সন্তুষ্ট। অন্তত তাদের এই উপলব্ধির কারণে আমি সন্তুষ্ট!
আমি রায় নিয়েও সন্তুষ্ট। নানান প্রশ্ন আছে, নানান কথা তুলাই যাবে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে। যেখানে একই হামলায় বন্যা আহমেদ আহত হয়েছে, উনি এই জঘন্য ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী আর তাকেই যখন একবারের জন্য আদালতে হাজির হতে হয়নি সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য, তখন বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন কেউ তুললে তাকে খুব একটা দোষ দেওয়ার উপায় থাকে না, দেওয়া যায় না। কিন্তু আমি তবুও সন্তুষ্ট। কারণ আমি আমার দেশটাকে খুব ভাল করেই চিনি, এই দেশের বাস্তবতা মোটামুটি বুঝি। এই বিচারের রায় আসতে যদি বিশ বছর লাগত আমি তবুও অবাক হতাম না। আমাদের নানান সমস্যা, আমাদের এইটুকু সীমানার ভিতরে সতেরো আঠারো কোটি লোক বাস করে, আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, জনবলের সীমাবদ্ধতা আছে। আইন এবং আইনের প্রয়োগ নিয়ে নানান কিচ্ছা কাহিনী আছে। চাইলেও অনেক কিছুই করার উপায় নাই এই দেশে। এত কিছুর পরে ছয় বছরের মধ্যে রায় এবং সন্তুষ্টিমূলক রায় পাওয়াকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখব। এই রায় কার্যকর করা, যে আসামিরা এখনো ধরা পরে নাই তাদের ধরা হচ্ছে এখনের প্রধান কাজ। রাষ্ট্র সেই কাজও করবে বলেই আমার বিশ্বাস।
তাহলে রায় হওয়াতে অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে মারার জন্য যে ক্ষোভ আমার মনে জমা ছিল তার কিছুটা কি প্রশমন হয়েছে? না, হয়নি। মুশকিল হচ্ছে এই রায় কার্যকর হোক বা না হোক, এই রায় আজকে আসুক আর পরশু আসুক, অভিজিৎ রায়রা এই ভূখণ্ডে হেরে গেছে বা এখন পর্যন্ত হেরে রয়েছে। আমরা ধীরে ধীরে তাদেরকে হেরে যেতে দিয়েছি। অভিজিৎ রায়রা আবার বাংলায় কবে জয়ী হবে তা এই অন্ধকার সময়ে দাঁড়িয়ে ঠিক ঠাওর করতে পারছি না। কিন্তু এখন যে অন্তত কোন আলো নেই সেই ব্যাপারে নিশ্চিত। কেন এমন বললাম? বলছি।
অভিজিৎ রায়ের মৃত্যুর পরে যারা যারা উল্লাসে ফেটে পড়েছিল, প্রকাশ্যে সেই অনুভূতি প্রসব করে অনলাইন সয়লাব করে দিয়েছিল যেই নরকের কীটেরা তারা এখন নিজেদের সংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। এই সময়ের ভিতরে হুহু করে বেড়েছে এদের সংখ্যা। আর আলোর হাতে যারা ছিল তারা নিরাপত্তার স্বার্থে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, সংকুচিত করছে চিন্তার পরিধি। কেউ কোপ খেয়েছে, কেউ দেশ ছেড়েছে আর আরিফ আজাদ সেরা লেখকের পুরস্কার হাতে নিয়েছে, হাসিমুখে ছবি তুলেছে এই সমাজের গণ্যমান্যদের কাছ থেকে। যিনি একজন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন সেই মৃত মানুষকে ব্যাঙ্গ করে! বাংলার আপামর জনতা সেই লোকের পিছনে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছেন। এই নোংরামির জন্য বিন্দুমাত্র জবাবদিহিতা না চেয়েই তার বইকে, তাকে তারকা বানিয়েছে। আমি এক আরিফ আজাদের উদাহরণ দিলাম, এমন অনেক তৈরি হয়েছে, এক আরিফ আজাদ এখন লক্ষ হয়েছে, তার অবিশ্বাস্য ফ্যান ফলোয়ার তৈরি হয়েছে। মুক্তচিন্তা সিন্দুকে তুলে রাখা হয়েছে এই দেশে।
আরিফ আজাদদের এই উত্থান অভিজিৎ রায়দের পরাজয়। খুব কুৎসিত শোনালেও এইটাই সত্য, বর্তমান সময়ের জন্য বাস্তব। কারণ এখনো অভিজিৎ রায়ের বই পাওয়া যায় না। নামি দামী দোকানেও কেউ রাখে না। কেউ রাখতে চাইলেও পারে না কারণ বইই নাই। কেউ প্রকাশ করলে তো পাওয়া যাবে! এখনো এই দেশে নতুন কোন অভিজিৎ রায় নিজের চিন্তা নিজের কাছে রেখে জীবনকে আগলে রাখতেই বেশি পছন্দ করে, কারণ করতে বাধ্য সে। কি দরকার পৈত্রিক ঘাড়ের উপরে অত্যাচারের ঝুঁকি নেওয়া? এখনো এই দেশে নেহায়েত জানার জন্যও একটু ভিন্ন ধর্মী প্রশ্ন করতে পারবেন না। এখনো এই দেশে বিজ্ঞানকে শুধু বিজ্ঞান হিসেবে পড়তে পারবেন না, পড়তে পারলেও প্রচার করতে পারবেন না। নানান ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে বিজ্ঞান পড়তে হবে। যে কোন বিষয়, এইটা ধর্মগ্রন্থে আছে বলে যদি প্রচার করেন তাহলেই রক্ষা। নাহলে ধর্ম অবমাননার জন্য আপনি শেষ!
জিয়া, ফারাবিসহ সমস্ত আসামিকে যদি দুইশ বার করেও ফাঁসি দেওয়া হয়, আর দেশে যদি একজন মুক্তচিন্তার মানুষও নিজের যে ঢঙের চিন্তাই হোক তা প্রকাশ করতে না পারে তাহলে ধরে নিতে হবে আলো আসেনি। অভিজিৎ রায়ের মৃত্যু ততদিন পর্যন্ত ব্যর্থ হিসেবেই থাকবে। আর সেই দায় রাষ্ট্রের নিতে হবে। রাষ্ট্র ব্যর্থ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
আলো আসুক। আলোকে আসতেই হবে। এই আশা করা ছাড়া আমাদের সামনে অন্য কোন রাস্তা নাই, শেয়াল কুকুরে দেশ ভরে যাচ্ছে, আমাদের আশা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতা দিয়ে শেষ করি -
যে তুমি ফোটাও ও ফুল ঘ্রাণে ভরো ব্যাপক সবুজ
জমিতে বিছিয়ে দাও ধান শিম খিরোই তরমুজ
কুমড়োর সুস্বাদ, যে তুমি ফলাও শাখে ফজলি আম
কামরাঙা পেয়ারা, বাতাসে দোলায় গুচ্ছগুচ্ছ জাম,
যে তুমি বহাও নদী, পাললিক নদীর ভেতরে
লালনপালন করো ইলিশ বোয়াল স্তরেস্তরে,
যে তুমি উঠাও চাঁদ মেঘ ছিঁড়ে নীলাকাশ জুড়ে
বাজাও শ্রাবণ রাত্রি নর্তকীর অজস্র নূপুরে ,
যে তুমি পাখির ডাকে জেগে ওঠো, এবং নিশ্চুপে
বলিকার সারা দেহ ভরে দাও তিলেতিলে রূপে
আর কণকচাঁপার গন্ধে আর ভাটিয়ালি গানে,
যে তুমি বইয়ে দাও মধুদুগ্ধ গাভির ওলানে
খড় আর ঘাস থেকে, যে তুমি ফোটাও মাধবী
আর অজস্র পুত্রকে দাও ছন্দ- করে তোলো কবি,
যে তুমি ফোটাও ফুল বনে বনে গন্ধভরপুর-
সে তুমি কেমন করে, বাঙলা, সে তুমি কেমন করে
দিকে দিকে জন্ম দিচ্ছ পালেপালে শুয়োর কুকুর?
আরিফ আজাদদের পাশাপাশি, সাদেক, আপনার মত লোকজনও তো আছেন।
'আলোকে আসতেই হবে'
@aranya, আমাদের সংখ্যা দিন দিন কমছে, সমস্যা তো সেখানেই। হু হু করে কমছে। গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশকে দেখলে কেউ চিন্তাই করতে পারবে না এই দেশ একদিন যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। আমাদের আশেপাশে, চেনা মুখ এখন এমন অচেনা সুরে কথা বলে যে বিশ্বাস করা মুশকিল। নিজেদের বৃত্তের ভিতরের বন্ধুদের দেখছি পরিবর্তন হতে, ফেসবুকে ব্লক খাইছি তাদের কাছ থেকে যারা এক সময় নিত্যদিনের সাথী ছিল। আমি ঢাকাও থাকি না, মফস্বল শহরের পরিস্থিতি অকল্পনীয়। আলো আসবে, সেই আশায় আছি। স্বপ্ন দেখা ছাড়া তো আর কোন উপায় নাই বেঁচে থাকার।
#IamAvijit
অভিজিৎরা হারলে হেরে যাবে বাংলাদেশ! কলম চলবেই