পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
সেই মেয়েটা ভেলভেলেটার কথা কারো মনে আছে, সেই যে ভাগাড়পাড়া স্কুলে পড়ত? সেই যে সেই মেয়েটা গো যার কিচ্ছুটি গুণ ছিল না। না পারত ছবি আঁকতে, না পারত গান গাইতে, না ছিল খেলাধুলোয় ভাল, আর হাতের লেখা! সে দেখলে ছোটমামা বলত আরশোলার পায়ে কালি লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ওদিকে পড়াশুনোতেও তো ‘ফেলের মধ্যে ফার্স্ট। ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ার খবর দেওয়ায় দিদার সেই অমর বাণী ‘মাস্টারপাড়া ইসকুল দেইখ্যা ফ্যালের মইধ্যে ফার্স্ট’,যা আত্মীয়সমাজে মেয়েটার অ্যাকাডেমিক স্ট্যান্ডার্ড হয়ে দীর্ঘকাল চালু ছিল। তো সেই মেয়েটা সেই যে একখান নিতান্ত সাদামাটা রেজাল্ট জাপটে নিয়ে এগারো-বারো ক্লাসের দিকে পা বাড়াল, তার পর তো কেটে গেল কত্ত বচ্ছর। মাঝে যে কত্ত কী সব হয়ে গেল --- হঠাৎ তাকিয়ে দেখি ভেলভেলে মেয়েটা এক আদ্দিকেলে বদ্দিবুড়ি হয়ে বসেছে। আর বদ্দিবুড়ি হলে যা হয়, কোনওকিছুই পরপর মনে পড়ে না। সব কেমন এলোমেলো জড়িয়ে মড়িয়ে সবই ছেঁয়াবাজীর ছলনা হয়ে গেছে। তার থেকেই যতটা যা পারি ছাড়িয়ে ছুড়িয়ে টুকিয়ে রাখি।
সে কতকাল আগের কথা। তখন সকাল ন'টায় ভবানীপুর থানা থেকে টানা এক মিনিট ধরে ভোঁ বাজত, বকুলবাগানের মোড়ে শ্রীহরি মিষ্টান্ন ভান্ডারের জিলিপী কচুরি ফুরিয়ে যেত ন'টার ভোঁ বাজার বেশ খানিক আগেই। দিনের কোনও একটা সময় গঙ্গাজলের পাইপ দিয়ে জল আসত ঘোলাটে বিশ্রি, অনেক সময় কাদাগোলা, মাঝেমধ্যে তাতে দুই চারটে কেঁচো টেচোও থাকত বৈকী। সে অবশ্য হরিণঘাটার দুধেও কখনও সখনও কেঁচো পাওয়া যেত। সেই সময় একটা পুঁচকে মেয়ে সাদা ধবধবে ইস্ত্রী করা জামা, কোমরে লাল বেল্ট, সাদা মোজা কালো জুতো পরে পিঠে একটা খাকি রঙের চৌকোমত ব্যাগ আর হাতে একটা লাল রঙের জলের বোতল নিয়ে ন'টার ভোঁ পড়ার একটু আগে গিয়ে 'নদীয়া শাল রিপেয়ারিং' স্টোর্সের সামনে দাঁড়াত। দোকান তখনও খোলে নি, পাশের টায়ারের দোকান খোলা, ইয়াব্বড় রঙ্চঙে পাগড়ি পরা একজন টায়ারের গায়ে কিসব করছে আর কেমন আগুন চিকমিকিয়ে উঠে ছিটকে যাচ্ছে। পুঁচকে খুকী একটু ভাল করে দেখবে বলে এগোলেই পাশে দাঁড়ানো মন্টুদাদা গম্ভির হয়ে বলে 'যেও না ওদিকে এক্ষুণি বাস আসবে'। আর সত্যি একটা বড়সড় হলদে রঙের বাস তার মাথাটা লাল রঙ পেটের কাছে গোল করে লেখা 'গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল', এসে চুপ করে রাস্তার পাশে দাঁড়ায়। বাস থেকে লাফিয়ে নামে বাদলদা - সে যে কেমন দেখতে ছিল তা আর কিচ্ছুটি মনে নেই এখন। খুকী একটু লাফিয়ে একটু হোঁচট খেয়ে বাসের তিন ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে যায়। ড্রাইভার গোপালদাকে খুকী খুব ভয় পায়, গোপালদার চোখে প্রায়ই একটা কালো চশমা থাকে, কেমন ভয় ভয় লাগে দেখতে। গোপালদা খুকীকে বলে 'আয় আমার পেছনের সীটে বোস' খুকী বাধ্য মেয়ের মত ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে কোলে নিয়ে সিটে বসে যায়। বাদলদা ততক্ষণে দরজা বন্ধ করে গোপালদর ঠিক পাশে গিয়ে মুখোমুখী বসে। এক একদিন খুকী বসার আগেই বাস ছেড়ে দেয়, খুকী টাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে যায় আর গোপালদা জোরে জোরে বকে ওঠে।
নীচের বাথরুমে গঙ্গার জলের কলটা আলাদা, চৌবাচ্চার সাথে পাইপ দিয়ে জোড়া নেই। হরিণঘাটার দুধও কমই আসে, যুগলরাম এসে একটা বেঁটে বালতি থেকে হিন্ডালিয়ামের মগে করে মেপে মেপে দুধ যায়, বেশী দুধের দরকার হলে মা কিম্বা জিজি নীচে এসে বলে যায় কালকে তিনপোয়া কি চারপোয়া দুধ বেশী দিতে। যুগলরামের খাটাল কাছেই কোথায় যেন। হঠাৎ এক আধদিন যুগলরামজি এসে জানায় বাছুরে দুধ খেয়ে নিয়েছে তাই আজ আর দুধ দেওয়া যাবে না। মা সেদিন মন্টুদাদাকে হরিণঘাটায় পাঠায়, বেঁটে বেঁটে কাচের বোতলে ভরা দুধ নিয়ে আসে মন্টুদাদা। মা কি একটা দিয়ে কিরিকাটা ঢাকনির পাশে চাড় দেয় আর অমনি কেমন টকাশ টকাশ করে ঢাকনিগুলো ছিটকে ছিটকে মাটিতে পড়ে। বোতল কাত করে দুধটা মা কড়াইতে ঢেলে দিয়ে খুকীর মাথায় নারকেল তেল ঘষে ঘষে মাখিয়ে দিয়ে বলে 'যাও নীচের বাথরুমে গিয়ে চান করে এসো, খবদ্দার গঙ্গাজলের কল খুলে গায়ে জল ঢালবে না কিন্তু।' খুকী সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামতে নামতে ভাবে ওদের ইস্কুলের সিঁড়িগুলো বেশ নীচু নীচু, কটকের বাড়ির সিঁড়িও এত খাড়া খাড়া ছিল না। কটক - কটক - কাটজুড়ি নদী এঁকেবেঁকে চলে গেছে, চাদ্দিকে খালি বালি আর বালি, মধ্যিখানে একটু জল ---
'আমাদের ছোট নদী চলে আঁকেবাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে'
এই কবিতাটা ক্লাসে মিস গাঙ্গুলী একসাথে সবাইকে দিয়ে সুর করে পড়ান। মিস গাঙ্গুলীকে ওরা ক্লাসশুদ্ধ সবাই খুব ভালোবাসে। কিন্তু উনি তো সবার দিকে তাকান না, খালি সুমিতা আর সুলগ্নার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসেন, কানের লতি ছুঁয়ে ঝুলে থাকা সাদা পাথরটা ঝিকমিক করে ওঠে। গঙ্গাজলের কলের নীচে ওদিকের কোণায় কেমন শ্যাওলা হয়েছে, সবুজ নরম পা দিলেই হড়কে যায়। কর্পরেশানের জল আসে যে কলটা দিয়ে, ঐটার পাশ থেকে একটা পাইপ গিয়ে ঢুকেছে চৌবাচ্চার নীচের দিকে। পাইপটার উপরে এই কলের জোড় থেকে এক বিঘৎ জায়গা ছেড়ে আরেকটা কল। ঐটে খুলে দিলে চৌবাচ্চায় জল ভরে। বাথরুমের উপরে টিনের চাল জায়গায় জায়গায় ভেঙে ফাঁক হয়ে আছে, রোদ্দুর আসে, বিষ্টি আসে। খুকী সাবধানে পাইপের উপর উঠে দাঁড়িয়ে চৌবাচ্চার ধারে ঝুঁকে পড়ে, আধ চৌবাচ্চার কিছু বেশী জল ভরা তাতে খুকীর মুখ। খুকী মুখ ভ্যাংচায়, জলের ভেতর থেকে ঐ খুকীটাও উল্টে ভ্যাংচায়। চৌবাচ্চার ওদিকের দেওয়ালটা টিনের ছাদের থেকে হাত দুয়েক নীচে থেমে গেছে, দেওয়ালের ঐ পারে নাইলনদের বাথরুম। ওপরের বসার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে দেখলে নাইলনদের চৌকো উঠোন, একদিকের ঘর দেখা যায়। দুপ্পুর ঠিক বারোটার সময় উথোনতার মাথার উপরে সুর্য্য, বাঁদিকের ঘর আর বারান্দার তেরচা বেঁটে একটা ছায়া উঠোনটার একপাশে গুটিয়ে মুটিয়ে শুয়ে থাকে।
কটকে এরকম উঠোন ছিল না, কিন্তু পেছনের সুন্নি চুন্নিদের বাড়িতে ছিল । মা’য়ের নিয়ম সন্ধ্যের বাতি জ্বলার আগে ঘরে ঢুকতে হবে| এখানে আসার আগে খুকীরা থাকত কটকে| সেখানে একবার বিকেলে খেলে ফিরতে দেরী হওয়ায় মা খুকীকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়| সেই ঘরে মা'র ঠাকুরের ছোট ছোট ছবি, মুর্তি থাকত আর থাকত এটাসেটা সংসারের নানান জিনিষ, বাবার কিছু কাগজপত্র ইত্যাদি| মা তো ভেবেছিল খুকী খুব কান্নাকাটি করলে ভবিষ্যতে আর দেরী না করার কড়ারে খুলে দেবে| খুকী এদিকে নিশ্চিন্তে আসন থেকে তুলে ঠাকুর আর ঠাকুরের ছোট্ট ছোট্ট থালা গেলাস জানলা দিয়ে নীচে ফেলছিল| খুকীদের বাড়ীর পেছনদিকটায় ছিল সুন্নি চুন্নিদের ঘর| একটা উঠোনের চারিদিকে গোলকরে পরপর কিছু ঘর, ৫-৬টা পরিবার থাকত| সেই উঠোনটা নাইলনদের থেকে আরো বড়| থালা গেলাসগুলো নীচের উঠোনে পড়ে কি সুন্দর একটা ঠননন ঠননন আওয়াজ হচ্ছিল| সুন্নিরা নাকি মেথর ছিল, তাই ভয়ে ঠাকুরের মুর্তি বা ছবিতে হাত না দিয়ে হাঁউমাউ করে চেঁচিয়ে মা'কে ডাকে| তা খুকীর বছর তিনেক বয়সের এই কালাপাহাড় সদৃশ কর্মটা পরবর্তীতে বারেবারে সবাই মা'কে মনে করিয়ে দিয়ে সাবধান করে দেয় যে খুকীর পাপের পরিমাণের একটা নিয়মিত চেক-ব্যালেন্স দরকার; নচেৎ নিজে তো পাপে ডুববেই সঙ্গে সঙ্গে মা আর ভাইকেও ডোবাবে| তা যতরকম পাপ মা ভাবতে পারে খুকী তার প্রায় সবকটাই করে ছেড়েছে অবশ্য, তবে সেসব তো খুকী যেই 'আমি' হয়ে গেল, তারপরের গল্প।
# আগে যাঁরা ভাগাড়পাড়া স্কুলের গল্প পড়েছেন তাঁদের অনেক জায়গাই রিপীটেশান মনে হবে। বস্তুত ঐটা আর এদিক ওদিক লেখা আরো কিছু কুড়িয়ে বাড়িয়েই এটা চলবে। আরেকবার ফিরেদেখা। কেউ যদি পড়ে মন্তব্য করেন সম্ভবতঃ উত্তর দেব না, কারণ এটা আমার নিজের জন্যই নিজের সাথে কথা বলা। আগাম মাপ চেয়ে রাখলাম।
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |
চলুক। অপেক্ষায় আছি।
কিরিকাটা শব্দটা কতোদিন পরে শুনলাম !
আমি প্রথম পড়লাম। খুব ভাল লাগল