গায়ক ছেলেটা ইতিমধ্যে একটা ইংরেজি গান ধরেছে, আর অনেকেই হাততালি দিয়ে তাল দিচ্ছে। বিনীতা বুঝল নিশ্চয় জনপ্রিয় গান, তবে তার জানা নেই। “বিলিভার” আর “পেইন” এই দুটো শব্দ ঘুরে ঘুরে আসছিল গানটায়। ইংরেজি গানে অবশ্য তার আগ্রহ নেই। যাতে আগ্রহ আছে সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত নিশ্চয় এই ছেলেটা গাইবে না। ... ...
“সত্যিই তো… টেগোর কেন?” বলল বিনীতা। “ইয়েস। এই একটা প্রশ্ন লোককে হন্ট করবে। একজন জিজ্ঞেস করবে আর একজনকে - হোয়াই টেগোর? সে আবার জিজ্ঞেস করবে তিন নম্বর লোককে - হোয়াই টেগোর? এই চেন চলতে থাকবে আর দোকানের নাম ছড়িয়ে পড়বে ইন ওয়ার্ড অফ মাউথ। নতুন দোকান, তাও সেক্টর ফোরে। পাবলিসিটি তো লাগবেই,” ছদ্ম গাম্ভীর্যের সাথে বলল রঞ্জিত। “আইডিয়া আচ্ছা হ্যায়,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল অরুণাভ। “ওই নামের জন্যই লোকে দোকানে আসবে। আর বৃষ্টি যদি হয় তবে ছাট আসবেই,” বলল রঞ্জিত। “মানে দোকানে লোকজন এলে বিক্রিও হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর ফ্যাশন…?” পুরোন কথায় ফিরে এল দাস সাহেব। ... ...
যথাসম্ভব শব্দ না করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চিরুনি তুলে নিয়ে সে গেল বারান্দার খোলা দরজার দিকে। এই বারান্দার সামনে একটা মুসান্ডা আর একটা হলুদ জবা গাছ আছে। দরজাটা বাইরের রাস্তা থেকে খুব চোখে পড়ে না। তাই এইখানে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায় বিনীতা, চিরুনিতে চুল উঠে এলে সেগুলো আঙুলে পাকিয়ে ঘরের কোণে রাখা ঢাকনা দেওয়া ছোট ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। আজও তাই করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল ... ...
ড্রইং খাতা ফেরত নিয়ে কিৎকিৎ খেলার মত করে রঙিন ঘর ছাড়ে। তার হাঁটার ভঙ্গিতে মজা পায় ইন্দ্রনীল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, বিনীতার কথায় থেমে গেল। “আমাদের একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনার মিসেসকেও বলা উচিত ছিল।” “কিছু ভুল হয়নি,” একটু থামল ইন্দ্রনীল, তারপর বলল, “আমার কোনও মিসেস নেই।” অরুণাভ জিজ্ঞেস করল, “আপনি ব্যাচেলর?” “ডিভোর্সি,” একটা শব্দে উত্তর দিল ডাক্তার। একটা অস্বতিকর নীরবতা নেমে এল ঘরে। ... ...
এই অভিযোগের উত্তরে অরুণাভ বলল, “আসলে কি জানেন, কোলিয়ারি কলোনিতে থাকি, সবাই কলিগ। আড্ডা দিতে গেলে অফিস ঢুকে পড়ে।” সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল ইন্দ্রনীল। “আমারও খানিকটা একই রকম অবস্থা।” বিনীতা বলল, “ওর তেমন বন্ধু নেই। অফিসের পার্টি থাকে, ক্লাব আছে, তবে ও বিশেষ কোথাও যায় না।আমার এক কলিগ আসে মাঝে মাঝে ওর হাসব্যান্ডকে নিয়ে। তার সাথে আমাদের বন্ডিংটা ভাল। সার্জারির দিন ওরা পুরো দিন হসপিটালেই ছিল। আর কেউ তেমন নেই।” ইন্দ্রনীল বলতে যাচ্ছিল এবার উঠতে হবে কেমো শুরু করার জন্য। অরুণাভ হঠাৎ বলল, “আপনি আসুন না এক দিন।” “কোথায়,” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল ডাক্তার। “আমাদের বাড়িতে, আবার কোথায়।” অরুণাভ খেয়াল করলে দেখতে পেত তার কথায় যে শুধু ডাক্তার অবাক হয়েছে তাই নয়, স্ত্রী বিনীতাও কম আশ্চর্য কম হয়নি। ... ...
শোবার ঘরে এসে দেখে ল্যাম্পের আলো তখনও জ্বলছে, বিছানার পাশে বই খোলা, অরুণাভ ঘুমিয়ে পড়েছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা বোতল থেকে জল খায় বিনীতা, তারপর আস্তে আস্তে বইটা সরিয়ে রাখে, আলোটা নিভিয়ে দিতে গিয়েও দেয় না। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। গোল, দাড়ি গোঁফ কামানো মুখ, ডান দিকের গালের উঁচু অংশে একটা কালো জরুল। নাকের এক পাশে ল্যাম্পের আলো পড়ায় অন্য দিকে ঢালু হয়ে আবছা অন্ধকার নেমে এসেছে। অপারেশনের ধকল সামলাতে বা অন্য কোনও কারণে চোখের নিচে কালি পড়েছে তার। বিয়ের একেবারে প্রথম দিকে ছাড়া আর কখনও ঘুমন্ত স্বামীকে লুকিয়ে দেখেছে কি সে? ... ...
ফোনে কথা বন্ধ করল ইন্দ্রনীল, জামার পকেটে মোবাইল রেখে দুজনের দিকে একবার তাকাল। তারপর খামটা এগিয়ে দিল বিনীতার দিকে, সে ওটা হাতে নিল। ইন্দ্রনীল দেখল অরুণাভর বই বুকের ওপর খোলা, চোখ তারই দিকে। “সার্জারি ভালই হয়েছে। কিন্তু কন্ডিশন ভাল নয়। টিউমারটা ম্যালিগন্যান্ট,” কথা বলতে বলতেই ডাক্তার দেখল অরুণাভর চোখ বইয়ের দিকে ঘুরল। “আমি অকারণ আশা দিতে চাই না। মেটাস্টেসিস শুরু হয়েছে, মানে ছড়িয়ে গেছে রোগ, স্টেজ ফোর।” বিনীতা বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ইন্দ্রনীলের দিকে, তারপর দেখল তার স্বামীর দিকে। তার চোখ বইয়ের পাতায়, তবে মন কোথায় বলা কঠিন। ... ...
ডাক্তারের চেম্বারের দরজা ঠেলে ঢুকে বিনীতা দেখল ব্যাগ গোছাচ্ছে ইন্দ্রনীল। বিনীতাকে দেখে একটু অবাক হল সে। “কিছু বলবেন, ম্যাডাম?” “আপনি বললেন প্রতিটা দিনই ইমপরট্যান্ট। ওর কন্ডিশন ঠিক কতটা খারাপ?” “আরে না না। শুনুন, এই কন্ডিশন থেকে লোকে সুস্থ হয়েছে এমন অনেক এক্সাম্পল আছে।” “তার মানে কন্ডিশন খারাপ। কতটা? ও কি–” বিনীতার কথা থামিয়ে দিল ইন্দ্রনীল। “শুনুন, যা যা করার সব করা হবে। বললাম না প্রথমে সার্জারি, তারপর–” এবার ইন্দ্রনীলকে থামাল বিনীতা। “ও সব আপনি আগেই বলেছেন। এখন ক্লিয়ারলি বলুন, ও কি টার্মিনাল পেশেন্ট?” “দেখুন ম্যাডাম…” “আমি যথেষ্ট স্ট্রং, আপনি বলুন।” ইন্দ্রনীল চুপ করে থাকে। ... ...
“অরুণাভ দাস। আপনাদের তো দেখেছি, গত মাসে মিস্টার শর্মার ছেলের বার্থডে পার্টিতে। গেছিলেন না?” পরিস্কার বাংলায় বলল ডাক্তার। “হ্যাঁ, কিন্তু…,” অরুণাভর কথা শেষ হল না, ইন্দ্রনীল হাত তুলে তাকে থামাল। “আপনার শার্ট, টাই আর স্যুট ছিল ডিফরেন্ট শেডস অফ ব্লু। আর ম্যাডাম,” বিনীতার দিকে তাকাল সে, “আপনি পরেছিলেন একটা লাল গর্জাস শাড়ি।” “বাব্বা, আপনি তো দারুণ লোক। গত মাসে পার্টিতে একবার দেখলেন, আর তাদের ড্রেস, শাড়ি সব মনে করে রাখলেন,” বলল অরুণাভ। “শুধু শাড়ি না, আরো অনেক কিছু বলতে পারি।” “মানে?” ভ্রূ কুঁচকে গেল বিনীতার। ... ...
“অঙ্কোলজিস্ট! কেন? ওনার কি… আমরা তো ভাবছিলাম টিবি হয়েছে,” বলল বিনীতা। “না ম্যাডাম। টিবির টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। আমার মনে হচ্ছে অঙ্কোলজি রিলেটেড কিছু হয়েছে স্যারের। ডক্টর বিশ্বাসের সাথে আমার ভাল আলাপ আছে। আমি ওনাকে বলে দেব। উনি রোজ বসেন, আপনারা কালই অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে নিন। আমি ওনার নম্বর আর হাসপাতালের নম্বর দুটোই দিয়ে দিচ্ছি,” বললেন শ্রীবাস্তব। “কাল হবে না,” এতক্ষণে মুখ খোলে অরুণাভ, “কাল অফিসে একটা খুব ইম্পরটান্ট মিটিং আছে।” “কিন্তু স্যার…” “বললাম তো কাল হবে না।” কথা শেষ করে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল অরুণাভ। স্বামীকে ভালই চেনে বিনীতা, তাই কালকের দিন নিয়ে আর কথা বাড়াল না সে। বলল, “আপনি নম্বরটা দিন। পরশুর জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট করব।” ... ...