ইন্টারকমে রামাকৃষ্ণানজীর একটা ফোন এল, মিনিট তিনেক কথা বলে অধৈর্যভাবে ঘড়ির দিকে তাকাল সে, বিনীতার কাছ থেকে কোনও ফোন এল না এখনও। অরুণাভর বিরক্তি বাড়ছে, এইটার একটা ডিসশন নিয়ে নিলে অফিসের কাজে মন বসাতে পারে। এখনও অনেক কাজ বাকি, পরে শরীর কেমন থাকবে কে বলতে পারে? তাই এই প্রজেক্টটা শেষ হলে নিশ্চিন্ত হবে সে। ... ...
একটা সকাল কখনও কখনও একই সঙ্গে রোদ ঝলমলে আর মেঘলা গুমোট হতে পারে। বাইরে সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে শীতের সকালে, মানুষজন নানান কাজে বেরিয়েছে, রবিবার বলে তবু হয়তো রাস্তায় লোক একটু কম। আর অরুণিমার মনের মধ্যে মেঘলা আকাশ। দাদা আর কিছুক্ষণের মধ্যে অফিস বেরিয়ে যাবে। তার পর আর কি কখনও দেখা হবে? হলেও কী অবস্থায় হবে। অরুণাভ ব্রেকফাস্ট খেতে এলে টেবিলে বসল অরুণিমা। দাদার হাতে বই ছিল, সেটা নামিয়ে রাখল সে। তবে সেভাবে কেউ কথা বলতে পারল না। বরং বিনীতাই একটা দুটো কথা বলে পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছিল। সময় এসে গেল। ড্রাইভার বিকাশ এসে নিয়ম মতো তার স্যারের অফিস ব্যাগ আর খাবার নিয়ে গাড়ির দিকে চলে গেল। ... ...
অরুণিমা বলে চলে, “দেখ দাদা, আমার ইমোশন টিমোশন নেই। ডিভোর্সের পর থেকে বোধ হয় আরও কাঠখোট্টা হয়ে গেছি। তাই যা বলছি, সেটা শুনতে খারাপ লাগতে পারে। বৌদিকে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেওয়াটা ভাল। আগে কোনও দিন দিয়েছিস বলে তো মনে হয় না। তবে তার চেয়ে অনেক ভাল গিফট হবে ওর আর রঙিনের ভবিষ্যতের জন্য কিছু একটা করে যাওয়া। তোর তো যে কোন দিনই কিছু হয়ে যেতে পারে।” অরুণাভ গম্ভীর ভাবে শুনতে থাকে, চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে এক টুকরো কেক তুলে নেয়। বিনীতা বলে, “সকাল সকাল এসব আলোচনা না করলেই নয়?” ... ...
বিনীতা আর গায়ত্রী বাইরের ঘরে এসে দেখে প্রচুর খাবারের প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকছে ড্রাইভার বিকাশ, তাকে সাহায্য করছে রঞ্জিত আর সবার পিছনে কেকের বাক্স নিয়ে আসছে অরুণাভ। গায়ত্রী হাসি মুখে বন্ধুর দিকে তাকায়। আর বিনীতা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে। রঞ্জিত আর বিকাশ ভেতরে গিয়ে ডাইনিং টেবিলের ওপর প্যাকেটগুলো রাখে। তাদের সাথে রঙিনও গেছে ভেতরে। ওদিকে অরুণাভ স্ত্রীর হাতে কেকের প্যাকেট তুলে দিয়ে বাইরের দরজার দিকে তাকায়। তার ভাব দেখে মনে হয় আরও কেউ আছে বাইরে। আর কে এল? মুহূর্তের মধ্যে আশা আর আশঙ্কা মেশানো একটা মিশ্র অনুভূতি হয় বিনীতার মনে। ডাক্তারবাবু নাকি? ... ...
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের দরজা খুলল সে, বাইরে এল। ঠান্ডা রয়েছে ভাল, চাদরটা ভাল করে জড়িয়ে নিল। আকাশ ঘন নীল, পূর্ব দিকে আলো ফুটছে, আশেপাশের গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে তারাও বিনীতার চাদর গায়ে দিয়েছে, তবে তাদের চাদরগুলো কুয়াশা দিয়ে তৈরি। সেই চাদরের আড়াল থেকে পাখি ডাকছে নানা রকম, শহর থেকে দূরে হওয়ায় অনেক পাখির ডাক শোনা যায় এখানে - বুলবুল, ছাতারে, সাতভাই, মাঝে মাঝে কাঠঠোকরাও আসে দু-একটা। দরজার পাশে একটা লাল সিমেন্টের বেঞ্চ আছে দেওয়ালের গায়ে। কয়েকটা উড়ে আসা শুকনো শিরিষ আর শাল পাতা পড়ে আছে তার ওপর, ছাদেও। কয়েক পা হেঁটে প্যারাপেটের কাছে গিয়ে নিচে বাগানটা দেখল। টেবিল-চেয়ার রাখার জায়গা তৈরি হয়েছে, নতুন কিছু গাছও লেগেছে। ছাদের ধার থেকে ফিরে শুকনো শাল পাতার পাশে বেঞ্চের ওপর বসে পড়ল বিনীতা, পাতাটা হাতে তুলে ধরল, শিশির লেগে আছে তার গায়ে। রোদ উঠে গেলে শিশির আর থাকবে না। শিশির ভেজা শুকনো পাতাটাকে পাশে রেখে দিল সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বড় একটা শ্বাস নিল। ... ...
গায়ক ছেলেটা ইতিমধ্যে একটা ইংরেজি গান ধরেছে, আর অনেকেই হাততালি দিয়ে তাল দিচ্ছে। বিনীতা বুঝল নিশ্চয় জনপ্রিয় গান, তবে তার জানা নেই। “বিলিভার” আর “পেইন” এই দুটো শব্দ ঘুরে ঘুরে আসছিল গানটায়। ইংরেজি গানে অবশ্য তার আগ্রহ নেই। যাতে আগ্রহ আছে সেই রবীন্দ্র সঙ্গীত নিশ্চয় এই ছেলেটা গাইবে না। ... ...
“সত্যিই তো… টেগোর কেন?” বলল বিনীতা। “ইয়েস। এই একটা প্রশ্ন লোককে হন্ট করবে। একজন জিজ্ঞেস করবে আর একজনকে - হোয়াই টেগোর? সে আবার জিজ্ঞেস করবে তিন নম্বর লোককে - হোয়াই টেগোর? এই চেন চলতে থাকবে আর দোকানের নাম ছড়িয়ে পড়বে ইন ওয়ার্ড অফ মাউথ। নতুন দোকান, তাও সেক্টর ফোরে। পাবলিসিটি তো লাগবেই,” ছদ্ম গাম্ভীর্যের সাথে বলল রঞ্জিত। “আইডিয়া আচ্ছা হ্যায়,” মাথা ঝাঁকিয়ে বলল অরুণাভ। “ওই নামের জন্যই লোকে দোকানে আসবে। আর বৃষ্টি যদি হয় তবে ছাট আসবেই,” বলল রঞ্জিত। “মানে দোকানে লোকজন এলে বিক্রিও হবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর ফ্যাশন…?” পুরোন কথায় ফিরে এল দাস সাহেব। ... ...
যথাসম্ভব শব্দ না করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে চিরুনি তুলে নিয়ে সে গেল বারান্দার খোলা দরজার দিকে। এই বারান্দার সামনে একটা মুসান্ডা আর একটা হলুদ জবা গাছ আছে। দরজাটা বাইরের রাস্তা থেকে খুব চোখে পড়ে না। তাই এইখানে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়ায় বিনীতা, চিরুনিতে চুল উঠে এলে সেগুলো আঙুলে পাকিয়ে ঘরের কোণে রাখা ঢাকনা দেওয়া ছোট ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। আজও তাই করতে যাচ্ছিল, এমন সময়ে বাড়ির সামনে একটা গাড়ি এসে থামল ... ...
ড্রইং খাতা ফেরত নিয়ে কিৎকিৎ খেলার মত করে রঙিন ঘর ছাড়ে। তার হাঁটার ভঙ্গিতে মজা পায় ইন্দ্রনীল। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সে, বিনীতার কথায় থেমে গেল। “আমাদের একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনার মিসেসকেও বলা উচিত ছিল।” “কিছু ভুল হয়নি,” একটু থামল ইন্দ্রনীল, তারপর বলল, “আমার কোনও মিসেস নেই।” অরুণাভ জিজ্ঞেস করল, “আপনি ব্যাচেলর?” “ডিভোর্সি,” একটা শব্দে উত্তর দিল ডাক্তার। একটা অস্বতিকর নীরবতা নেমে এল ঘরে। ... ...
এই অভিযোগের উত্তরে অরুণাভ বলল, “আসলে কি জানেন, কোলিয়ারি কলোনিতে থাকি, সবাই কলিগ। আড্ডা দিতে গেলে অফিস ঢুকে পড়ে।” সম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকাল ইন্দ্রনীল। “আমারও খানিকটা একই রকম অবস্থা।” বিনীতা বলল, “ওর তেমন বন্ধু নেই। অফিসের পার্টি থাকে, ক্লাব আছে, তবে ও বিশেষ কোথাও যায় না।আমার এক কলিগ আসে মাঝে মাঝে ওর হাসব্যান্ডকে নিয়ে। তার সাথে আমাদের বন্ডিংটা ভাল। সার্জারির দিন ওরা পুরো দিন হসপিটালেই ছিল। আর কেউ তেমন নেই।” ইন্দ্রনীল বলতে যাচ্ছিল এবার উঠতে হবে কেমো শুরু করার জন্য। অরুণাভ হঠাৎ বলল, “আপনি আসুন না এক দিন।” “কোথায়,” অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল ডাক্তার। “আমাদের বাড়িতে, আবার কোথায়।” অরুণাভ খেয়াল করলে দেখতে পেত তার কথায় যে শুধু ডাক্তার অবাক হয়েছে তাই নয়, স্ত্রী বিনীতাও কম আশ্চর্য কম হয়নি। ... ...