এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  শিক্ষা

  • উলুখাগড়ার পদাবলী

    স্বাতী রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | শিক্ষা | ২৯ অক্টোবর ২০২০ | ৪৮৭৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)
  • এক আশ্বিনের সকাল। নদীর ছলাত ছলাত জলে তখনও রোদের ঝিলিমিলি। তাকিয়ে থাকলে একটু ঝিম ধরে। এতই সুন্দর। এখনও তাকিয়ে থাকা যায়। মানে সূর্যদেব ততটাও তেতে ওঠেন নি। জাহাজখানা নদীর পার থেকে একটু দূরত্ব রেখেই এগোচ্ছিল। এখানে পাড়ের কাছাকাছি জলে বাঘ নেমে আসা বিচিত্র না। দুপারেই ঘন জঙ্গল। তবে এবার পারে জাহাজ ভেড়াতে হবে। এসে গেছে চাঁদপাল ঘাট। তেরচাভাবে জল কেটে ঘাটের দিকে এগোচ্ছে নৌকা। সেখানে একটা দুটো করে গাড়ী জমতে শুরু করেছে। বিলেতের জাহাজ তো নয়, তাই ভিড় কম অবশ্য। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে পাড়ের গাড়ীর জমায়েতের দিকে দেখছেন এক সাহেব। বয়স ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ তো বটেই। এর আগে দাক্ষিণাত্যে ছিলেন অনেক বছর। সেখান থেকে এই শহরে। সঙ্গে আছে বৌ আর শিশুপুত্র। ১৭৫৮’র ২৯শে সেপ্টেম্বর।


    সবে শেষ হয়েছে পলাশীর যুদ্ধ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাথায় উঠেছে যুদ্ধজয়ের পালক ।দু’বছর আগের নবাবী আক্রমণে প্রায় গুঁড়িয়ে যাওয়া কলকাতাকে আবার গুছিয়ে তোলার কাজ চলছে। শোনা গেছে, কোম্পানি নাকি অনেক টাকা ক্ষতিপূরণও পেয়েছে। বাড়ি-ঘর সারিয়ে তোলা চলছে। আবার একটু একটু করে সেজে উঠছে কলিকাতা। নতুন করে দুর্গ বানানোর কাজ চলছে। লাল দিঘির আশেপাশে গুটিকতক সাহেবের বাস। সব কোম্পানির লোক। সব মিলিয়ে শহরে বোধহয় তখন হাজার দুয়েক ইউরোপিয়ান। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা। মাঝে মাঝে জঙ্গল, জলা, নলখাগড়ার বন। বাঘ শেয়ালের রাজত্ব। কাঁচা মাটির সরু পথ চলে গিয়েছে দিকে দিকে। ঘোড়ার গাড়ি, পালকি, টাট্টু ঘোড়ার পাশে পাশে পায়ে-চলা লোকের দল। উত্তরে চিৎপুরের দিকটায় নেটিভদের ঘরবাড়ি। সে দিকে অবশ্য লোকজন, ভিড়ভাট্টা বেশি। শহরের উত্তর আর পূর্ব দিক বেড় দিয়ে রয়েছে মারহাট্টা ডিচ। তার ওপারে ঘন জঙ্গল। এই হল ক্লাইভের কলকাতা। কোম্পানির নয়নমণি।


    কোম্পানির খাস-নিয়ম, যেখানেই আস্তানা গাড়বে সেখানেই যাজক আর স্কুলমাস্টার থাকতে হবে। তাই কোম্পানির কলকাতায় আছেন রেভারেন্ড বাটলার আর রেভারেন্ড কেপ। কিন্তু কলকাতায় তখন গির্জা কোথায়? একটা ঠেকনা-দেওয়া আস্তানায় প্রভু যীশুর ভজন-পূজন চলছে। সেও আবার আদতে পর্তুগীজদের গির্জা। মুর্গিহাটার আওয়ার লেডি অব দ্য রোজারি। কোম্পানির এলাকায় ফ্রেঞ্চ বা পর্তুগীজ পাদ্রীদের ঢোকা মানা। আর্মেনিয়ান চার্চ আছে একটা। কলকাতার প্রথম চার্চ। কিন্তু প্রটেস্টান্ট ইংরেজ সাহেবরা সেখানে যান কি করে? এর আগে লোকজনের থেকে চাঁদা তুলে একখানা গীর্জা বানানো হয়েছিল বটে, আজকের রাইটার্স বিল্ডিং এর জায়গাতেই। পর পর দুটো বিপর্যয়, ১৭৩৭ সালের বিধ্বংসী ঝড় আর বন্যা আর ১৭৫৬ য় সিরাজ-উদ-দৌলার আক্রমণে সে গির্জা আর নেই।


    সেই কলকাতায় পা রাখলেন কিয়েরনান্ডার। কলকাতার প্রথম প্রটেস্টান্ট মিশনারি। ‘সোসাইটি ফর প্রোমোটিং ক্রিস্টিয়ান নলেজ’ এর মিশনারি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অবশ্য তখনও দেশজ মানুষদের মধ্যে মিশনারি কাজকর্ম চালানোর বাবদে খুব একটা রাজি নয়। তবে তাতে কিয়েরনান্ডারকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাতে ত্রুটি হয়নি। আর কিয়েরনান্ডার স্বপ্ন দেখলেন, কলকাতায় একটা চার্চ তৈরি করতে হবে। নিজের পয়সায় জমি কিনে সেই জমিতে ১৭৭০ সালে একটা চার্চ বানিয়েই ফেললেন এই জন্ম-সূত্রে সুইডিশ যাজকমশাই। আজকের বিবাদীবাগ চত্বরের ওল্ড মিশন চার্চ, চার্চ অফ ইংল্যন্ডের অনুমোদিত । কলকাতার দ্বিতীয় চার্চ। সাহেব অবশ্য এদেশেই মারা গেলেন, ১৭৯৯ সালে। আর রোমানিস্টদের চার্চ অব ইংল্যন্ডের অধীনে নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ২০৯ জন হিন্দুকেও খ্রিস্টান বানালেন।


    সেই সঙ্গে আর একটা বড় কাজ করলেন। পৌঁছনোর মাত্র দুমাসের মাথায় শুরু করে দিলেন একটা স্কুল। গরীব ছেলেদের জন্য - ইংরেজ, পর্তুগীজ, আর্মেনিয়ান আর বাঙ্গালী সবাইকে নিয়ে । শুধুই খ্রিস্টানদের জন্য হলেও, নেটিভদের জন্য প্রথম স্কুল। শুধুই যে ধর্মকথা পড়াতেন তাই না, লিখতে পড়তে আর অঙ্ক কষতেও শেখাতেন। তখন আসলে নিয়মটা ওই ধাঁচেরই ছিল। ওইটুকু জানলেই কাজও মিলত। গরীবের বাচ্চা বা অনাথ বাচ্চার আর কি-ই বা লাগে! ইউনিভার্সিটি বা কলেজ বড়লোকদের, জমিদারদের ব্যাপার। আর কলকাতায় তখন কলেজ, ইউনিভার্সিটি কোথায়! এরও আগে ইউরোপিয়ান মিলিটারির অনাথ ছেলেদের জন্য বেলামী সাহেব ১৭৩১ সালেই একটা চ্যারিটি স্কুল খুলেছিলেন। তবে তিনি নিজেই নবাবের কলকাতা আক্রমণের সময় মারা যান।


    স্কুল খোলার মাত্র এক বছরের মধ্যেই কিয়েরনান্ডার সাহেব জানাচ্ছেন একটি বাঙ্গালি ছেলে গোটা ইংলিশ বাইবেল পড়ে ফেলেছে। তবে আরও ইন্টারেস্টিং খবরটা জানা যায় দ্বিতীয় বছরের রিপোর্ট থেকে। ১৭৬০ সালের শেষের মধ্যে তাঁর স্কুলে রয়েছে উনিশটি মেয়ে। ইংরেজ এবং পর্তুগীজ। বাংলার মাটিতে মেয়েদের স্কুলে গিয়ে বই পড়তে শেখার এই শুরু। নাই বা হল বাঙ্গালির মেয়ে।


    মেয়েদের জন্য এরপর সার দিয়ে প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুলের খবর মেলে। তবে বিভিন্ন সুত্রের খবর আলাদা। আর সব তথ্যের ঠিক-ভুলও বোঝা দায়। তাই ঠিক ঠিক ছবিটা মেলে না। কিছু কিছু স্কুলের নাম শোনা যায় - মিসেস হেজেসের স্কুল ( ১৭৬০ নাকি ১৭৮০) , মিসেস পিটের স্কুল – দুজনেই প্রথম মেয়েদের স্কুল খোলার কৃতিত্বের ভাগিদার। এছাড়াও ছিল মিসেস ডারেলের বা রেভারেন্ড লওসনের স্কুল। তবে ওই নামটুকুই মেলে, ব্যস। বিশদ বিবরণ মেলে না তেমন। জানা যায়, মিসেস হেজেসের স্কুলে মেয়েদের ফ্রেঞ্চ আর নাচ শেখান হত। এই স্কুলের মেয়েরা নাকি বড্ড নাকউঁচু, মেয়েলি ছলা-কলায় পটু। তবে বিয়ের বাজারে তাদের ভারি কদর! অনুমান করা যায় যে এগুলো সব ফিনিশিং স্কুল ধাঁচের, ইউরোপীয় মেয়েদের জন্য । অবশ্য ভারতীয় মেয়েদের তখন স্কুলে দেখা যাবে কি করে? তাদের তো তখন দুধের বয়সে পরাতে চাপিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।


    এ জমানা প্রাইভেট স্কুলের। ক্যালকাটা গেজেটে ১৭৮৫ সালে জন স্টান্সবেরো বিজ্ঞাপন দিয়েছে তেমনই একটি স্কুলের, যেখানে ছেলেদের ও মেয়েদের লিখতে , পড়তে আর অঙ্ক করতে শেখানো হবে। মেয়েদের সেলাই ও লেস বুনতেও শেখানো হবে। মেয়েদের মাসিক থাকা-খাওয়া-পড়ার খরচ মাসে তিরিশ টাকা, ছেলেদের অবশ্য ২৫ টাকা। তখন এক টাকায় ১১ সের চাল মেলে। টাকার পরিমাণ থেকেই বোঝা যায়, এই স্কুলে সাধারণ ভারতীয়দের এমনিতেও ঠাঁই মিলত না।


    সাধারণ ঘরের মেয়েদের তবে পড়াশোনার কি হাল? একটা বড় শূন্য। তবে একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে এই সময় বাঙ্গালী বাড়ির সব মেয়েদেরই ক-অক্ষর গোমাংস ছিল। তা ঠিক নয়। কোনও কোনও ভদ্রবাড়ীর মেয়েরা পড়তে পারতেন। এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীতে দু চারজন সংস্কৃত বিশারদ মেয়ে পণ্ডিতের নামও পাওয়া যায়। কিন্তু সব মেয়েদের তা মোটেই আয়ত্তে ছিল না।


    বাঙ্গালী মেয়েদের কপালে তাহলে কবে শিকে ছিঁড়ল? সে খুঁজতে হলে এগিয়ে যেতে হবে ১৭৯৯ সালের অক্টোবর মাসে। ক্রাইটেরিয়ন জাহাজে করে একদল ব্যাপিস্ট মিশনারি এসে পৌছালেন ভারতে। তাঁদের দলে রয়েছেন জোশুয়া আর হানা মার্শম্যান, আর তাদের দুটি সন্তান। প্রায় সাড়ে চার মাসের জাহাজের দুলুনিতে ক্লান্ত। ভাগ্য মানুষকে কোথায় নিয়ে ফেলে! মাত্র আটবছর আগে বিয়ের সময় জোশুয়াকে দিয়ে হানা কড়ার করিয়ে নিয়েছিলেন, নিজের দেশ, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে হানাকে বিদেশ যেতে বলবেন না কখনো। জোশুয়া তখন স্বপ্ন দেখছিলেন আমেরিকায় যাওয়ার। অথচ সেই হানা মাত্র ক’বছর পরেই স্বামীর সঙ্গে কোন দুরের ভারতে থাকতে এসেছে। এদেশে কোম্পানি তখনও মিশনারিদের উপর সদয় না বিশেষ। তার উপর তালেগোলে কাগজে প্রকাশ হয়েছে ওঁরা প্যাপিস্ট মিশনারি। সামান্য ছাপার দোষ, অথচ সেই কারণে কলকাতায় ঠাঁই মিলল না। চলে গেলেন কাছেই ফ্রেডরিকনগরে, তৈরি হল শ্রীরামপুর মিশন। এসে যোগ দিলেন উইলিয়াম কেরীও।


    সেখানে তখন বাচ্চা বুড়ো মিলিয়ে প্রায় উনিশজন মানুষ। খরচ চালানোর জন্য হানা চালু করে দিলেন একটি বোর্ডিং স্কুল। তবে সে শুধু ইউরেসিয়ান বাচ্চাদের জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যে পুরো দমে মিশনের কাজকর্ম চালু হয়ে গেল। নেটিভ ধর্মান্তরীদের জন্য স্কুল খুললেন। ইতিমধ্যে ২০০৯ সালে শ্রীরামপুর মিশন কলকাতায় বেনেভলেন্ট ইন্সটিটিউট খোলে গরীব খৃস্টান বাচ্চাদের জন্য । মেয়েদের জন্য তারা দরজা খোলে ১৮১১ সালে। আর বছর ছয়ের মধ্যে তাদের ১২ টা স্কুলে ২৮০ জন ছাত্রী হয়ে যায়।


    অবশেষের ১৮১৩ সালে ইংল্যন্ডের চাপে পড়ে কোম্পানি বাধ্য হয়ে তার এলাকায় মিসনারিদের নেটিভদের মধ্যে ধর্মপ্রচার করা মেনে নিলেন। শিক্ষার মাধ্যমে হিদেনদের যীশুর পায়ের কাছে টেনে আনার জন্য এবার স্কুল খোলার হিড়িক পড়ল। মেয়েদের শিক্ষা নিয়েও ভাবনা চিন্তা শুরু হল। ১৮১৬-১৭ সালে শ্রীরামপুরে হানা নেটিভ হিদেন মেয়েদের জন্য স্কুল খুললেন। লিখতে পড়তে শেখানো ছাড়াও তাঁর স্কুলে মেয়েদের ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, বিজ্ঞান পড়ানো হত। সেই সঙ্গে অবশ্যই বাইবেল পড়ানো। তবে সেখানে বোধহয় একই স্কুলে ছেলেদের সঙ্গে পর্দার আড়ালে মেয়েদের বসানো হত। ১৮২৪ সালে তাঁর স্কুলে ২৩০ জন ছাত্রী পরীক্ষায় বসেছিল। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা খুব বেশি না হলেও একেবারে ফেলনা নয়। দুঃখ এই যে হানা বা হানার মত অনেক মিশনারিদের বৌদের কথা আমরা খুব বেশি শুনি না বটে, ইতিহাসে হানার পরিচয় মার্শম্যানের ‘ ডমিনীয়রিং ওয়াইফ’ ।


    ফিমেল জুভেলাইন সোসাইটি অফ কলকাতা (১৮১৯ ) র গৌরিবাড়ি, জানবাজার ইত্যাদি শহরের বিভিন্ন জায়গার চারটে স্কুলে ১৮২২ এর গোড়ায় ৯৬ জন নেটিভ মেয়ে। প্রসঙ্গত এই সোসাইটির একজন হর্তা কর্তা হলেন মিসেস ইয়েটস। তিনি ছোট থেকে হানার কাছে বড় হয়েছেন । এই সময়ে রাধাকান্ত দেবের নির্দেশে গৌরমোহন বিদ্যালঙ্কার লিখে ফেলছেন স্ত্রীশিক্ষাবিধায়ক।


    ১৮২১ সালে কলকাতায় এসে পৌছালেন চার্চ মিশনারি সোসাইটির মিস মেরি অ্যান কুক ( পরে মিসেস উইলসন )। লেডিস সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশনের ( লেডি আর্মহার্স্ট এর পৃষ্ঠপোষক ) সাহায্যে ঠনঠনিয়া, মল্লিকবাজার, শোভাবাজার ইত্যাদি সব জায়গা জুড়ে মেমসাহেব দেশি মেয়েদের জন্য স্কুল খুলতে লাগলেন। ১৮২৫ সালে শুধু লেডিস সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন ২৪ টা মেয়েদের স্কুল চালাচ্ছে , মোট ছাত্রী সংখ্যা ৪০০। এছাড়াও আরও অনেক মিশনারি সোসাইটিই নিজের নিজের মত করে চেষ্টা চালাচ্ছিলেন।


    মেমসাহেবদের যদিও স্কুল খোলার উৎসাহের ঘাটতি নেই, আর এই সব স্কুলে ভর্তি হতে গেলে খ্রিস্টান হওয়াটা বাধ্যতামূলকও না, তবু সম্ভ্রান্ত হিন্দু ভদ্রলোকদের কিন্তু তাতে কোন উৎসাহ নেই। একে তো মেয়েরা পড়াশোনা করলে বিধবা হবে। তার উপর মেমসাহেবরা ছলে-কৌশলে মেয়েদের খ্রিস্টান করতে চায়। রিপোর্টে এও বলা হচ্ছে, নিচু জাতের মেয়েরা জামা-কাপড়-উপহারের লোভে এই স্কুলগুলোতে ভিড় জমাচ্ছে। শেষে কি অজাত-কুজাতের সঙ্গে একসঙ্গে বসে বাড়ির মেয়েরা পড়বে নাকি?


    এদিকে দেশীয় বাবুরা বুঝতে পারছেন যে হাওয়া বদলাচ্ছে। মেয়েদের পড়াশোনার বাবদে কিছু একটা করা দরকার। অবশেষে কলকাতার কাছেই বারাসাতে বাবু কালীকৃষ্ণ মিত্রের সহায়তায় প্যারীচরণ সরকার একটি মেয়েদের স্কুল খোলেন। ১৮৪৭। ভারতের প্রথম নেটিভদের খোলা মেয়েদের ইংরেজি মতে শিক্ষার স্কুল। কালীকৃষ্ণের ভাই নবীনকৃষ্ণের মেয়ে কুন্তীবালা ( ভাল নাম স্বর্নলতা) সেই স্কুলের প্রথম মেয়েদের একজন। কুন্তীবালার পরীক্ষা নিয়ে সন্তুষ্ট হাইকোর্টের স্যার জেমস কেলভিন তাঁকে বই প্রাইজও দেন। অবশ্য এহেন শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাজ করার জন্য প্যারীচরণ ও কালীকৃষ্ণকে সমাজচ্যুত করা হয়, তাদের বাড়িতে ডাকাতির পরিকল্পনা করা হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। তারপর তো বেথুন সাহেব ইস্কুল খুলে ফেললেন কলকাতাতেও। ঘোষণা করলেন, শুধু সম্ভ্রান্ত হিন্দু ঘরের মেয়েদের জন্য স্কুল। শহুরে বাবুরা খুশি। প্রথম ভর্তি হওয়া মেয়েদের মধ্যে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে গেল মদন মোহন তর্কালঙ্কারের মেয়ে ভুবনমালা, কুন্দমালার নাম। ধীরে ধীরে বেণী দুলিয়ে খড়খড়ি দেওয়া ঘোড়ার গাড়ী চেপে ইস্কুলে যাওয়া কলকাত্তাই বিবিদের নতুন ‘ফ্যাশন’ হয়ে গেল। মেয়ে-শিক্ষার রাশ ফিরে এল সম্ভ্রান্তদের হাতে।


    রাম-শ্যাম-যদু-মধুদের অবশ্য তখনও আড় কাটে নি। পঞ্চাশ বছর পরে আরেক বিদেশিনী নিবেদিতার ইস্কুলে তাই মেয়ে ভর্তি করানোর জন্য বিবেকানন্দকে নাম ধরে ধরে ডেকে ডেকে প্রায় জবরদস্তি মেয়ে দিতে রাজী করাতে হয়। তারপরও কত জল গেল, তবে সাধারণ মেয়েদের স্কুলের পথ দুরস্ত হল সে অন্য গল্প।


    কুন্তীবালার আগের স্কুলের মাটি-ছোঁয়া বাঙ্গালি মেয়েদের কিন্তু কোন নাম নেই। তাঁরা শুধু সংখ্যা মাত্র। আর এর পরে এক সময় মিশনারি মহিলাদেরও আসা কমে গেল। তাদের করা স্কুলগুলোরও বেশিরভাগেরই স্বর্গপ্রাপ্তি হল। নিট ফল, হানার এদেশে আসার প্রায় দেড়শ বছর পরে যখন ভারত স্বাধীন হল, দেখা গেল শিক্ষার আলোটি মূলত একটা প্রিভিলেজড শ্রেণীর মেয়ের হাতেই আটকে আছে।


    ( তথ্য গুলি চেষ্টা করেছি বিভিন্ন সে আমলের এ আমলের বই ঘেঁটে যতদূর সম্ভব নিখুঁত করার। তবে মূলেও অনেক গোলযোগ আছে। তাই কোথাও চেষ্টার পরেও ভুল থেকে গেলে দুঃখিত। )


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৯ অক্টোবর ২০২০ | ৪৮৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • এলেবেলে | 202.142.71.193 | ০৫ নভেম্বর ২০২০ ১১:৩৮99657
  • কেরির একটা লেখাও কেরির নিজের কি না, সেই নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। সুকুমার সেন তার অন্যতম। কেরির বাংলা ব্যাকরণ প্রকাশিত হয় ১৮০১এ। একটা ক্লাস এইটের বাচ্চা বাংলা ব্যাকরণ লিখতে পারে না। আর বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়ন প্রক্রিয়া কেরির অন্যতম বদমাইশি। তার সাক্ষী রামরাম বসু এবং মৃত্যুঞ্জয় তর্কালঙ্কার। এই প্রক্রিয়াকে তীব্র নিন্দা করেছেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়। যাই হোক। আপাতত চুপ করে গেলাম।

  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন