দেশ ভাগ জ্বলজ্বলে এক সত্য এখন আমাদের জন্য। যখন দেশ ভাগ হয় তখন ঠিক এত সহজ ছিল না যেমন সহজে বলে ফেললাম দেশ ভাগের কথা। কোথাকার কোন নেতারা আর কিছু সাদা সাহেব বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল তুমি এদিকে যাবে আর সে ওইদিকে যাবে! কারো ঘর গেল একদিকে তো রান্নাঘর আরেক দিকে! চিরকালের প্রতিবেশী আজকে শুনছে সে আর এই দেশের বাসিন্দা না, তার দেশের পরিচয় বদলে গেছে। কোন কিছুর খবর না জেনেই অনেকে দুই দেশের বাসিন্দা হয়ে গেছে। ধর্ম দিয়ে দেশ ভাগ করেই ক্ষান্ত হয়নি বিভাজনের যুদ্ধ। বলা হল এই দিকে মুসলিম বেশি এরা পাকিস্তানে যাবে, এই দিকে হিন্দু বেশি এরা ভারতে যাবে। মানুষ বুঝল এদিকে শুধু মুসলিম থাকবে আর ওইদিকে শুধু হিন্দুরাই থাকবে! ফলাফল? অবিশ্বাস্য এক রক্তপাতের ইতিহাস।
এই বিভাজনের সূত্রপাতের সময়ই, মানে দেশ ভাগের আলাপ চলার সময়ই শুরু হল হত্যাযজ্ঞ। মানুষ হুট করেই পশুতে পরিণত হয়ে গেল। কলকাতার বুকে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় সাক্ষাৎ নরক নেমে এসেছিল। ইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরী তার বাঙ্গালনামায় বলেছেন সেদিন কোন মানুষ মনুষ্যত্ব দেখায় নাই। উনি হিন্দু পাড়ার কথা বলেছেন। অফেন্স ইজ বেস্ট ডিফেন্স বলে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তৈরি সবাই। তিনি ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না আশেপাশে কোথায় ঠিক অফেন্সটা হবে? এদিকে তো মুসলিম তেমন নেই! দেখা গেল পাশের মুসলিম বস্তিতে সকলে মিলে আক্রমণ করা হল, যারা কিসের দাঙ্গা কিসের গণ্ডগোল কিছুই জানত না। স্রেফ কচুকাটা করে আসল বীর পুঙ্গবেরা! আগুন লাগানো হল, আগুন থেকে বাঁচাতে শিশুদের আক্রমণকারীদের হাতে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল কোন কোন মায়েরা। কিন্তু সেদিন এদের উপরে পিশাচ ভর করেছিল। শিশুদের ধরে ধরে ছুড়ে ফেলেছিল ওই আগুনে!
উল্টো দৃশ্যও ছিল। শিবরাম তার জীবনীতে বলেছেন সেই গল্প। ভুল ট্রামে চড়ে হাজির মুসলিম এলাকায়। তাঁর পোশাক দেখে সন্দেহ, সবাই ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে! পরিচয়? পরিচয় কী আবার, মুসলিম! কোন সর্দার গুলের কাছে শেখা কলেমা পড়ে শুনিয়েও রেহাই পায়নি শিবরাম। কাপড় খুলে পরিচয় নির্ণয় করা হয়েছিল, ভাগ্যক্রমে শিবরাম ছিলেন আমরা যাকে বলি খোদাই মুসলমানি, তাই! বেঁচে জান সে যাত্রায়! শিবরাম তাঁর স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে এমন ভয়ংকর অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করছেন রম্য করে। কিন্তু আমাদের কে কি এই ঘটনা প্রচণ্ড আঘাত করে না? লজ্জায় মনে হয় না মরে যাই? না, সেদিন কারো এমন মনে হয়নি। শক্তি প্রদর্শনীই ছিল শেষ কথা সেদিন।
মীজানুর রহমান তাঁর কমলালয়া কলকাতা বইয়ে দিয়েছেন আরেক রোমহর্ষক বর্ণনা। বাড়িতে উনার মা ছিলেন, ছোট ভাই বোনরা ছিল। তাদের বাড়ি ছিল হিন্দু পাড়ায়। সন্ধ্যা নামতেই ঘিরে ফেলা হল বাড়ি। বাইরে থেকে শ্লোগান, চিৎকার। "শ্লা নেড়ে কুত্তারা, নেবে আয়! ভেবেছিস তোদের সুয়ারহাড্ডি (সোহরাওয়ার্দী, তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী) তোদের বাঁচাবে? না, সেদিন মীজানুর রহমানের মাকে সোহরাওয়ার্দী বাঁচাতে আসেনি, এসেছিল পাড়ার বিষ্টুকাকা, তিনি বন্দুক হাতে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন কেউ ঢুকেছ কী মরেছ! আর নাহলে আমার লাশের উপর দিয়ে যেতে হবে এই বাড়িতে!
তিনদিন চলেছে এই পিশাচনৃত্য। প্রশাসন নিশ্চুপ, সোহরাওয়ার্দী সরকারের পুলিস চুপ, প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজ লাট চুপ। তিন দিন পরে যখন প্রশাসন ব্যবস্থা নিলো তখন কিন্তু দ্রুতই শান্ত হয়ে যায় পরিস্থিতি। তপন রায় চৌধুরী লিখেছেন আমরা আমেরিকার বর্বরতা নিয়া নিন্দা জানাই তাদের ভিয়েতনামে বা ইরাকের ঘটনার জন্য, আমরা জার্মানদের গালি দেই ইহুদি হত্যাকাণ্ডের জন্য। অথচ আজ পর্যন্ত কোন হিন্দু বা মুসলিম নতমস্তকে অপরাধ স্বীকার করেনি। তাঁর ভাষ্যতে - 'আমার ধারনা, ৪৬ সনে কলকাতা শহরে দাঙ্গা বলতে যা বুঝায় তা বিশেষ ঘটেনি। দুই দল ক্ষিপ্ত মানুষ পরস্পরের সাথে সঙ্গে লড়াই করছে, এই দৃশ্য যতই বেদনাদায়ক হোক, মানুষের ইতিহাসে সংঘাত অপরিহার্য জেনে ওই দৃশ্যে কোথাও যেন একটু মনুষ্যত্বের তলানি পাওয়া যায়। কিন্তু কলকাতায় রাস্তায় যা ঘটেছিল তাঁর ভিতর মনুষ্যোচিত কোন ব্যবহারের লক্ষণ দেখা যায়নি। বিবেক বর্জিত কিছু দ্বিপদ সম্পূর্ণ অসহায় কিছু মানুষের নারী পুরুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। হিন্দু পাড়ায় মুসলমান আর মুসলমান পাড়ায় হিন্দু নর-নারী-শিশু কোতলে-আম নীতির শিকার। প্রতিরোধের প্রশ্ন কোথাও উঠেনি।'
এবার পাল্টা জবাবের নামে শুরু হল পূর্ব বাংলায় হত্যাযজ্ঞ। নোয়াখালীতে গোলাম সোরয়ার নামে মানুষের সুরতে এক প্রাণী ঠাণ্ডা মাথায় দাঙ্গা লাগায়। দাঙ্গা মানে ওই আগের দৃশ্য! একপক্ষ নির্বিচারে কচুকাটা করে গেছে। পরবর্তীতে এই নেতা পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভার সভ্য হয়।
আমি যদিও রক্তপাতের কথা বলার জন্য আজকে আসিনি। কিন্তু দেশ ভাগের কথা বলতে গেলেই রক্তপাতের ইতিহাস এসে যায়।এরপরেই আসে ভিটে মাটি হারানোর কষ্টের কথা। অজানা অচেনা দেশের উদ্দেশ্যে অসহায় এক যাত্রা। সোনার সংসার ফেলে কোন এক অচেনা দেশে গিয়ে থাকতে হবে। নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে উপন্যাসে ইসম বুঝে না দেশ ভাগ আবার কীভাবে হয়। আরে, কার দেশ? দেশ তো একটাই, এইটা ভাগ হয় কীভাবে? জমি এখানে, মাটি এখানে তাহলে দেশ ভাগ হয় কীভাবে? ইশম বোঝে না। আমরাও ঠিক বুঝি না আজো। সোহরাওয়ার্দী শরৎ বোস আর কিরণশঙ্করেরা শেষ চেষ্টা করে বাংলা যেন ভাগ না হয়। কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না। হয়ে উঠে না কলকাতায় অবাঙ্গালি গোষ্ঠী বিশেষের প্রবল আপত্তির কারণে। শুধু অবাঙ্গালিদের দোষ দিলে ভুল হবে, জয়া চ্যাটার্জী তাঁর বাঙলা ভাগ হল বইয়ে সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করেছেন বাংলা ভাগের জন্য মূলত দায়ী উচ্চশ্রেণীর হিন্দু সমাজ! যারা নিজেদের স্বার্থে বাংলা ভাগের মত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। নিম্নশ্রেণীর হিন্দু মুসলিম কারোরই কথা কেউ ভাবেনি একবারের জন্যও। ফলাফল দেশ ভাগ হল, বাংলা ভাগ হল!
এই যে দুই দুইটা সম্প্রদায় প্রবল ভাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। একজনের রক্তে আরেকজনের হাত রঞ্জিত হল, এত কিছুর পড়েও তো আমরা একদিন বুঝতে পারলাম আমরা আসলে এক। আমাদের জাতি পরিচয় এক। ৪৭ সনের দুঃখ ভুলতে আমাদের বেশি সময় কিন্তু লাগেনি। সময় আমাদের আবার একটা সুযোগ দিয়েছিল। দুই সম্প্রদায় সমস্ত নীচতা, সমস্ত কালিমা ভুলে গিয়ে ১৯৭১ সালে মিশে গিয়েছিল। গোলাম মুর্শিদ তাঁর হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতি বইয়ে নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনায় লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতার কথা। সেবার দুর্গা পূজায় পূজা মণ্ডবে দুর্গা প্রতিমার সাথে বঙ্গবন্ধুর ছবি রাখা হয়েছিল! উনাকে অমিতাভ চৌধুরীর স্ত্রী সুনন্দা চৌধুরী তাঁর একমাত্র ভাইয়ের সাথে একত্রে বসয়ে দিয়েছিলেন ভাই ফোঁটা! ভাই ফোঁটা দিয়ে ভাই হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তাকে। এমন অজস্র উদাহরণ তৈরি হল সে সময়। এর আগের সমস্ত কালিমা নিমিষে দূর হয়ে গেল। হাওয়ায় উড়ে গেল যেন ধর্ম বর্ণ, ঘটি বাঙালি সহ যত বাধা ব্যবধান!
এই অপূর্ব সময়টাকেও আমরা নষ্ট করে ফেলছি। এখানেই এসে যায় ১৪ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্টের গল্প। নানান প্রতিকূলতা থাকার পরেও দেশকে অসাম্প্রদায়িক রাস্তা থেকে যে লোকটা সরে যেতে দিল না তাকেই সরিয়ে দেওয়া হল। সৈয়দ মুজতবা আলী আর সন্তোষ কুমার ঘোষের সাথে আলাপকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "স্বাধীন বাংলাদেশ ও সেক্যুলার বাঙালী জাতির অস্তিত্বের রক্ষাকারী হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। আমি এই ধর্মনিরপেক্ষতার চারা বাংলাদেশের মাটিতে পুঁতে রেখে গেলাম। যদি কেউ এই চারা উৎপাটন করে, তাহলে বাঙালী জাতির স্বাধীন অস্তিত্বই সে বিপন্ন করবে।" এই মানুষটাকে মেরে ফেলা হল আর রচিত হল ভিন্ন বাংলাদেশের গল্প। যিনি বারবার বাঙালি বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে গেছেন, তাকে হত্যা করে ইসলামিক রিপাবলিক অফ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা হল। অবিশ্বাস্য রকম ভাবে আমরা পেলাম আকাশ থেকে নেমে আসা এক তত্ত্ব, আমরা বাঙালি থেকে বাংলাদেশি হয়ে গেলাম। জাতি পরিচয় আর নাগরিকত্ব যে এক জিনিস না, তা এই ২০২০ সালে এসেও আমরা বুঝি না। আমাদেরকে চোখে সানগ্লাস দিয়ে, এক বর্ণ বাংলা লেখতে পড়তে না পারা এক সৈনিক একদিন বললেন আজকে থেকে আমরা বাঙালি না, বাংলাদেশি! বাঙালি বললে ভারতীয়দের সাথে গুলিয়ে যাবে, কাজেই বাঙালি বলা যাবে না। আমরা বুঝলাম না গুলিয়ে যাক বা এক হয়ে যাক, যা ইচ্ছা তাই হোক, কোনভাবেই কোন জাতি তার জাতি পরিচয় বদলে ফেলতে পারে না।
এরপরের কাহিনী শুধই দূরত্বের। আমরা আবার একে অপরের রক্ত পিপাসী হয়ে উঠলাম আমরা। সুকৌশলে আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হল আমাদের জাতি পরিচয়। আমরা ভুলে যাওয়া জাতি, তাই আমরা এখন বিশ্বাস করি কাঁটাতারের একটা হাস্যকর রেখা একটা জাতিকে দুই ভাগ করে ফেলতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি এবং তা আমাদের কাজকামে প্রবল ভাবে প্রকাশ পায়। " দুইজনাই বাঙ্গালী ছিলাম - দেখ দেখি কান্ডখান! তুমি এখন বাংলাদেশী আমারে কও ইন্ডিয়ান।।" এগুলা এখন আমাদের কাছে অতি আবেগি কথা মনে হয়। প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে বাস্তব বিবর্জিত মানুষ বলে ভাবতে ভাল লাগে।
দীর্ঘ লেখা হয়ে গেছে শেষ করি। শেষ করি একটা বড় অসঙ্গতির কথা বলে। এত বছর পরেও আমরা এই ভুল নিয়ে চলছি। এর কথা আজকে এখানে না বলতে পারলে আমার মূল বক্তব্য সম্ভবত অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আমরা কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেছি তা বুঝাতে হলে এই শেষ কথাটা বলতেই হবে। আমরা আমাদের পাসপোর্টে কোন অজ্ঞাত কারণে ( আসলেই কি অজ্ঞাত কারণ? ) জাতীয়তা লিখে চলছি বাংলাদেশি বলে। বাংলাদেশি জাতীয়তা কবে থেকে হল? যদি সৈনিকের তত্ত্ব মেনেও নেই তবুও তো আমাদের জাতীয়তা বাংলাদেশি হতে পারে না। আমাদের নাগরিকত্ব হতে পারে বাংলাদেশি, জাতীয়টা কীভাবে বাংলাদেশি হয়? ব্রিটিশ পাসপোর্টে কখনই জাতীয়তা লেখা থাকবে না, থাকে না, সেখানে লেখা থাকে সিটিজেন অফ গ্রেট ব্রিটেন। বাংলাদেশি লেখতে হলে সেখানে আগে লিখতে হবে নাগরিকত্ব, জাতীয়তা না। তখন লেখা যাবে বাংলাদেশি। কবে এই ভুল সংশোধিত হবে? বাংলাদেশের নাগরিক যে কেউই হতে পারে, তাই নাগরিকত্বের জায়গায় লিখুন বাংলাদেশি। যদি জাতীয়তা লিখেন তাহলে বাঙালিই লিখতে হবে, অন্য কোন কিছুই আমাদের পক্ষে লেখা সম্ভব না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।