বিএনপি জামাত সরকারের সময় আমরা কলেজে পড়ি। শেরপুরে কামরুজ্জামানের বাড়ি হওয়ায় রমরমা অবস্থা জামাতের। আমরা হচ্ছি কামরুজ্জামানের শ্বশুর বাড়ির এলাকার মানুষ। কামরুজ্জামানের স্ত্রীকে ফুফু ডাকতাম। এলাকার যে কোন অনুষ্ঠানে ভাল আর্থিক সাহায্য পাওয়া যেত। আমাদের কাছে এর চেয়ে বড় তখন আর কিছু ছিল না। কলেজে পড়ার সময় পরিচয় হয় এক ভাইয়ের সাথে। তিনি কামরুজ্জামানের কাছের লোক। আমারা কামরুজ্জামান কে তা জানার পরেও গভীর ভাবে ভাবতাম না তেমন কিছুই। ওই ভাইয়ের কাছে গেলে চা খাওয়ায়, আপেল খাওয়ায়, আর সি খাওয়ায়, আমরা খাই। তিনি যে প্রচুর মিথ্যা বলেন তা কিছুদিনের মধ্যে আমরা পরিষ্কার বুঝে গেলাম। রনি আরেকজনের রোল নাম্বার দিয়ে বলছিল রাজশাহী ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য যদি কোন সাহায্য করতে পারেন, করবেন। ওই পরীক্ষার্থীর সুযোগ হয় নাই, কিন্তু রনির সুযোগ হয়েছিল। ওই চাপাবাজ বড় ভাই ধরেই নিয়েছিল যে ওইটা রনির রোল নাম্বার। তিনি আমাদের সামনে শুরু করলেন মিথ্যার মেশিনগান! কত কষ্ট করে রনিকে রাজশাহীতে সুযোগ করে দিছেন তিনি, ব্লা ব্লা ব্লা... ! আমরা শুনতাম আর হাসতাম। আমাদের লক্ষ্য তখন আর সি খাওয়া। টাকা পয়সা দিয়েও সাহায্য করত, যখন যার যা লাগত। ওই বয়সে এসব ছিল আমাদের জন্য পরম পাওয়া। তবুও কেন জানি আমাদের গিলে খেতে পারেনি। কেন পারেনি তাই বলব।
একদিন শহর জামাতের কোন এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বলল ওই বড় ভাই। তিনি কোনদিন আমাদের সরাসরি জামাতে বা শিবিরে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেননি। এবার বললেন ভিন্ন ভাবে। বললেন মিটিং শেষে সবাইকে কিছু নাস্তা করাইতে হবে, তোমরা নাস্তা গুলো নিয়ে দিয়ে চলে আইসো! আমরা আবার নাস্তার গন্ধ পাইলাম তাই রাজি হয়ে গেলাম। সকালে উঠে মিষ্টি সহ আরও কী কী জানি নিয়ে শহরের একটু বাইরে, বাজিতখিলার দিকে কোন এক বাড়িতে গেলাম। গিয়ে দেখলাম মিটিং চলছে শেরপুর জামাতের। পরিচিত মুখ দেখলাম বেশ কিছু। আমরা নাস্তা দিয়ে চলে আসব, ওই বড় ভাই বলল একটু দাঁড়াও, আমিও চলে যাব। দাঁড়ালাম এবং শুনলাম অমিয় বানী! এক বক্তা সরাসরি বলছে এখন আপনাদের এত সমস্যা ক্যান? খুব তো দেশ স্বাধীন স্বাধীন বলে দেশ স্বাধীন করলেন! পাকিস্তান আপনাদের ভাল লাগে না, বাংলাদেশ বানাইলেন, এখন বুঝেন কত মজা! কী প্রসঙ্গে ক্যান বলছেন আমি জানি না। আমি আর রনি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি বিনিময় করলাম শুধু। চলে আসছি এরপর। সেই চলে আসাই শেষ। এরপর আর ওই বড় ভাই আমাদের আর খোঁজ পায় নাই। রনি এরপর আমাকে একটা টি শার্টে লিখে দিল তুলি দিয়ে - “Beware : Dogs And Rajakar Ahead” আমি পরে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। রনি নিজে একটা টি শার্টে লিখল এই সেই যুদ্ধ বিরোধী মাছ, যাকে আজকে সকালেই খেয়ে ফেলেছি! রনি ওর টিশার্টে একটু ভুল করে ফেলল, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী মাছ না লিখে যুদ্ধ বিরোধী লিখে ফেলল। তাতে অবশ্য কোন সমস্যা হল না, সকলেই বুঝল কি উদ্দেশ্যে কার জন্য লেখা হয়েছে। ( রনির টিশার্টটাই আছে আমার কাছে, আমারটা কই জানি হারিয়ে গেছে!)
এই কথা আজকে কেন লিখলাম? লিখলাম এই কথা বলার জন্য যে আমাদের প্রবল সম্ভাবনা ছিল ভেসে যাওয়ার। আমরা খুব সহজেই জামাতের শীর্ষ নেতাদের সাথে দেখা করতে পারতাম। ক্ষমতার প্রবল দাপট চোখের সামনে দেখেছি। খুব কঠিন ছিল না গা ভাসানো। এইযে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ালাম তার জন্য যে শক্তি দরকার ছিল তা আমরা পেয়েছিলাম ডক্টর মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছ থেকে। তার হাত দিয়েই আমাদের পরিচয় একাত্তরের দিনগুলির সাথে, জাহানারা ইমামের সাথে। বলা চলে এক একাত্তরের দিনগুলিই বদলে দিয়েছিল আমাদের চিন্তা চেতনা। রুমির সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমরা আমাদের চিনে গিয়েছিলাম। বয়সের স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী জামাত নেতার কিনে দেওয়া আপেল খাইতাম কিন্তু নিজের অজান্তেই জানতাম ওইটা আমার পথ না। ধীরে ধীরে যত আমাদের চিন্তা চেতনা পরিশীলিত হয়েছে তত আমরা আমাদের অবস্থান খুঁজে পেয়েছি। ওই চিন্তা ভাবনা তৈরির কারিগর ছিল একাত্তরের দিনগুলি। প্রতিটা লাইন আমাদের বুকে শেলের মত লাগত। বয়স কম থাকতে পড়ছি যখন তখন যেমন কান্না আসত, এখন যখন পড়ি একই রকম কান্না আসে। আমাদের শহীদ জননীকে জননী হিসেবে মেনে নিতে দুই বার ভাবতে হয়নি। জাহানারা ইমাম ৯৪ সালে মারা গেছে, আমরা বা আমাদের প্রজন্ম তখন খুব ছোট। কিন্তু তখনই তো জানতাম উনি কে। "যা, দেশের জন্য তোকে কুরবান করে দিলাম" রুমিকে বলা সেই উক্তি তো তখন ওই বয়সেই আমাদের হতবাক করে দিয়েছিল। এবং তখনই যখন শুনছি যে এই উক্তি বলা মহিলাকে সরকার দেশদ্রোহীতার মামলা দিয়েছে তখন আমাদের পথ কী পরিষ্কার হয়ে যায়নি?
আমাদের আগের প্রজন্ম হয়ত সরাসরি উনার সংস্পর্শ পেয়ে ধন্য হয়েছে। কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। আমরা ধন্য হয়েছি বই পড়ে। বইয়ের মাধ্যমেই উনি আমাদের এত কাছের হয়ে ছিলেন যে আমরা যখন ২০১৩ সালে শাহবাগে বিশাল ক্যানভাসে উনার অদ্ভুত জ্যোতির্ময় ছবিটা দেখি তখন বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। রাতের বেলা যখন ছবিটার দিকে তাকাতাম তখন মনে হত ওই তো শহীদ জননী তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, আমাদের ভয় কী?
শুভ জন্মদিন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের বীজ বপন করে দেওয়ার জন্য, ধন্যবাদ শহীদ রুমির সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য, শহীদ আজাদের সাথে পরিচয় করিয়েদেওয়ার জন্য, আমাদের পথ সহজ করে দেওয়ার জন্য। শুভ জন্মদিন জননী।