এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বিশ্বকাপ, ধর্ষণ, মৌলবাদ.....কয়েকটি কথা

    Animesh Baidya লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১১ জুলাই ২০১৪ | ১৫৭৭ বার পঠিত
  • আমাদের গভীরে লুকিয়ে থাকা মৌলবাদ আসলে সব থেকে বেশি প্রকাশিত হয় আবেগের হাত ধরে। অমাদের সচেতন স্বত্ত্বায় পলিটিকাল কারেক্টনেসের দায়ে আমরা নিজেদের প্রতিনিয়ত সভ্য এবং সুশীল বলে বিজ্ঞাপিত করতে ভালোবাসি। আমাদের সচেতন স্বত্ত্বা একদম গলা পর্যন্ত পোশাকে ঢাকা যুক্তিবাদী আমি। কিন্তু আবেগ আমাদের অবচেতনকে অজান্তেই সামনে টেনে আনে। পোশাকের আড়াল সরিয়ে ক্রমশ স্পষ্ট করে তোলে আমাদের নগ্নতা। আর বিশ্বকাপ ফুটবল যেহেতু আবেগের উদযাপন, তাই এই সময়ে যুক্তির বাইরের আমাদের মৌলবাদী নগ্ন স্বত্ত্বাটাও প্রকাশ পায়। আমাদের অসচেতন আবেগের আতিশয্যে।

    খুঁজলে হয়তো ভুরিভুরি উদাহরণ পাওয়া যাবে। আপাতত আমার চোখে পড়া দুটো উদাহরণ দিচ্ছি। প্রথমটা অবশ্য ইতিমধ্যেই বহু লোক বহু ভাবে বলেছেন। মানে তা বহু-চর্চিত ইতিমধ্যেই। কি সেই উদাহরণ? কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, দেব এবং তাপস পাল। এই চারটি বিষয় আর নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। সকলেই জানেন। এই সবগুলির পরেই আমাদের সুশীল স্বত্তা প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। প্রত্যেকেই আমরা নিজের নিজের মতো করে ঘৃণা জানিয়েছি। ধর্ষণ ঘিরে আমাদের সুশীল বয়ান রচনা করেছি। এই যে সুশীল আমরা যারা চিল্লামিল্লি করে পাড়া মাতিয়েছিলাম তারাই আবার ধর্ষণ শব্দটির ভিন্ন প্রয়োগ করেছি এই ফুটবল আবেগের প্রেক্ষাপটে। ব্রাজিল জার্মানীর কাছে ৭-১ গোলে হেরে যাওয়ার পরে এই বহু আপাত সুশীল আমরাই সেই পরাজয়ের সঙ্গে ধর্ষণের তুলনা করে দাঁত কেলিয়ে হেসেছি। কিছুদিন আগে দেবের ওই ধর্ষণ নিয়ে করা মন্তব্যের পরে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেখানে প্রশ্ন তুলেছিলাম যে, আমাদের অচেতন স্বত্ত্বায় আমরা অনেকেই আসলে দেবের মতো করেই ভাবি কি না। খেলায় জেতা নিজেদেরকে আমরা গর্বিত ধর্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতেই ভালোবাসি। এই আমরাই একটা সময়ে দাঁত কেলিয়ে বলতাম, ‘ধরা পড়লে ধনঞ্জয়, আর ধরা না পড়লে এনজয়’। তখন খিল্লির হিল্লোলে কেঁপে উঠতো সক্কলে। অবশ্য সেই লেখাটিতে কেউ কেউ আমাকে তৃণমূলী বলেছিল এবং জানিয়েছিল আমার অভিপ্রায় নাকি দেবের অপরাধকে লঘু করে দেখানো। সে যাই হোক। এই ধর্ষণ নিয়ে খিল্লি ওড়ানো আমরাই কামদুনি, মধ্যমগ্রাম, দেব, তাপস পালের পরে সুশীলের পোশাক পড়ে নেমেছিলাম ধর্ষণ ঘিরে আমাদের সচেতন পলিটিকালি কারেক্ট নানান বক্তব্য নিয়ে। আর ব্রাজিল হারার পরে সেই আমরাই আবার ওই হারের সঙ্গে ধর্ষণের উপমা টেনে খিল্লি উড়িয়েছি। প্রকাশ করেছি সুশীলের নীচে লুকিয়ে থাকা আমাদের প্রকৃত নগ্ন মানসিকতা। বাহ!!! যদিও এই বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। ধন্যবাদ তাদের।

    এই বার আসি দ্বিতীয় উদাহরণে। আমাদের এই বঙ্গ বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা এই দুই ভাগে বিভক্ত। আগের উদাহরণের ক্ষেত্রে মূলত ব্রাজিল বিরোধী সমর্থকেরাই প্রকাশ করেছিলেন তাদের অসচেতন আবেগী মানসিকতা। আর এ বার বলছি কিছু ব্রাজিল সমর্থকদের কথা। কোয়ার্টার ফাইনালে নেইমার চোট পেয়ে টুর্নামেন্টের বাইরে চলে যায়। অতীব দুঃখজনক একটি ঘটনা। তার পরের দিন বহু ব্রাজিল সমর্থক একটি লিঙ্ক পোস্ট করে তাদের ফেসবুকে। এবং অবশ্যই একটি ভূমিকাও লিখেছিলেন সেই লিঙ্কের। কি ছিল সেই লিঙ্কে? নেইমারের চোট পাওয়ার খবরে উল্লসিত কিছু আর্জেন্টাইনদের উল্লাসের ছবি। এবং সেই লিঙ্কের ভূমিকা অংশে তারা প্রমাণ করতে চাইলেন আর্জেন্টাইনরা কি ভীষণ অসভ্য। তারা একটি অসভ্য জাতি। তাই আর্জেন্টাইনদের উপর তারা তাদের ঘৃণা উগড়ে দি্য়েছিলেন সেই লিঙ্কের সাথে লেখা তাদের নিজস্ব ভূমিকায়। এই তাদের অনেকেই বাকি সময়ে তাদের সচেতন স্বত্তায়, সুশীল অবস্থায় মৌলবাদ বিরোধী সেকুলার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত যে, গোধরাতে কোনও হিন্দু মৌলবাদী কোনও মুসলিমকে মারছে এমন ছবি আপলোড করে তার ভূমিকায় যদি কেউ লিখত যে গোটা হিন্দু সমাজটাই এমন হিংস্র এবং খুনী, তাহলে এই তারাই তুমুল প্রতিবাদে ফেটে পড়তেন। কিংবা কোনও মুসলিম মৌলবাদী জঙ্গির কোনও কুকর্মের ছবি আপলোড করে তার ভূমিকায় কেউ যদি লিখত যে, গোটা মুসলিম জাতিই আসলে এমন, তাহলে এই তারাই ফের সুশীল পোশাক পরে নিজেদের বিবেকবোধ প্রমাণ করতেন এবং এই অতি-সরলীকরণের তীব্র বিরোধিতায় মেতে উঠতেন। কিন্তু কি আশ্চর্য! খবরের কাগজে পড়লাম যে নেইমারের চোট পেয়ে সরে যাওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন বহু আর্জেন্টাইনরাও। যে হাসপাতালে নেইমার ভর্তি ছিলেন তার বাইরে নেইমারের আরোগ্য কামনায় জড়ো হওয়া হাজারো মানুষের মধ্যে ছিলেন বেশ কিছু আর্জেন্টাইনও। কিন্তু এই মৌলবাদী বাঙালি ব্রাজিল সমর্থকরা ওই কিছু আর্জেন্টাইন দর্শকদের উল্লাসের ছবি দেখিয়ে প্রমাণ করতে চাইলেন যে, আর্জেন্টাইন জাতিটাই এমন অসভ্য। যা কিছু গন্ডগোল ওই জাতির মধ্যেই লুকিয়ে আছে। তারা আসলে অসভ্যের জাত। মুসলিম মানেই সন্ত্রাসবাদী- এই ধারণার তীব্র বিরোধিতা করা যুক্তিবাদী সেই বহু সুশীল বাঙালিরাই ফুটবল আবেগের বশে শত্রু জাতির কয়েকজনের কুরুচিকর আচরণকে গোটা জাতির আচরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। সত্যিই অঙ্ক কি কঠিন!

    শেষে কেবল একটাই কথা, অন্যের দিকে প্রশ্ন তোলার আগে আমরা বরং নিজেদের দিকেও তাকাই একবার। প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাই আমাদের সচেতন সুশীল স্বত্ত্বার বাইরে আমাদের আবেগী অচেতন স্বত্ত্বাকেও। নইলে বিভিন্ন বিষয় ঘিরে নানান সময়ে আমাদের চেঁচামিচিটুকুই থেকে যাবে, সমাজ বদলাবে না এক বিন্দুও। নিজেরা গভীর থেকে না বদলালে সমাজ বদলের স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে বরাবর।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১১ জুলাই ২০১৪ | ১৫৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Pubদা | 85.115.164.180 (*) | ১২ জুলাই ২০১৪ ০২:৫২74555
  • খুব ভালো লিখেছো । অমিও সেটাই বলছি - এই শব্দটাকেই আমাদের দৈনন্দিন জীবণের ব্যাবহার থেকে মুছে ফেলতে হবে ।।
  • দেব | 111.221.128.186 (*) | ১২ জুলাই ২০১৪ ০৬:৪৫74556
  • ঠিক
  • susil | 24.99.192.112 (*) | ১২ জুলাই ২০১৪ ০৭:৫১74557
  • "অন্যের দিকে প্রশ্ন তোলার আগে আমরা বরং নিজেদের দিকেও তাকাই একবার। প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাই আমাদের সচেতন সুশীল স্বত্ত্বার বাইরে আমাদের আবেগী অচেতন স্বত্ত্বাকেও" - একদম ঠিক।
    এক ই রকম "আবেগ" দেখা যায় মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল এর ম্যাচে সিপিএম তৃনমূল লড়াই তে। আমাদের এরাজ্যেই দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারপিট মানুষ খুন হয় ভোটের সময় । বাইরে যাবার দরকার নেই ,লিবারাল গুরুতেই মারাঠি দের শিবাজি প্রীতি নিয়ে খোরাক করে দস্যু আখ্যা দিয়ে বিতর্কিত কার্টুন শেয়ার করা হয় (এটা জেনেও যে কাজটা IT act আইনবিরুদ্ধ) , গুজরাতি দের জাত তুলে বাপবাপান্ত করা হয় , ১৬ মের রেসাল্ট বেরোনোর পর বলা হয় "চাড্ডি ক্যালাও , যারা বিজেপি কে ভোট দিয়েছে লাল সবুজ মিলে তাদের ক্যালাও" ইত্যাদি।সত্যিই অঙ্ক কি কঠিন!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন