এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • তেল, তেল-এ

    সুকান্ত ঘোষ লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ | ৩৯৪৯ বার পঠিত
  • পর্ব – ১
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------
    হুমায়ুন আহমেদ একবার তাঁর লেখায় তাজমহল প্রথমবার দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছিলেন – লিখেছিলেন যে তিনি মনে মনে তাজমহল যত বড় এবং সুন্দর বলে ভেবে রেখেছিলেন বাস্তবের তাজমহল নাকি তার থেকেও বড় এবং জমকালো। সেই প্রথমবার কোন কিছু দেখার বাস্তবতা তাঁর কল্পনাকে হার মানিয়ে দিয়েছিল। তেল (এই লেখায় তেল অর্থে পেট্রোলিয়াম ওয়েল-কে বোঝানো হবে), তেল কম্পানি এবং তেল ব্যবসা সম্পর্কে কিছু লিখতে বসে হুমায়ুণ আহমেদের সেই তাজমহল-এর তুলনার কথাটা মনে পড়ে গেল। আপনি যদি প্রতক্ষ্য ভাবে এই তেল ব্যবসার সাথে যুক্ত না থাকেন এবং এই ব্যবসা সম্পর্কিত আপনার জ্ঞান যদি শুধুমাত্র বই পড়ে বা গুগুল সার্চের মাধ্যেমে হয়ে থাকে – তাহলে নিশ্চিত থাকতে পারেন যে আপনি যতটা ম্যাগনিচ্যুডের ভাবছেন, তার থেকেও আরো অনেক গুণ বড়, গভীর ও জটিল এই ব্যবসা। আমার এই লেখায় হয়ত বেশী থাকবে তেল উৎপাদন সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপারের উল্লেখ – তৈল পরিশোধন নিয়েও আলোচনা হবে, তবে সেই নিয়ে কতটা গভীরে ঢুকব তা নির্ভর করবে আমার এনার্জী লেভেলের উপরে!

    চারিদিকে আজকাল যুদ্ধু যুদ্ধু আবহাওয়া তৈরী হওয়াতে এবং তেলের সাথে এই সব যুদ্ধের এক আপাত সম্পর্ক থাকায় পাবলিক আজকাল তেল-যুদ্ধু নিয়ে হেভি সচেতন হয়ে গ্যাছে। বিশেষ কোন ধর্মের মৌলবাদ, উগ্রপন্থী হামলা, বোমা ফাটানো এই সব জিও-পলিটিক্যাল জিনিস পত্র তেলের মধ্যে ঢুকে এমন ঘেঁটে দিয়েছে যে, শুধু মাত্র রাজনীতি-তে আসক্ত পাবলিকও এই তৈল ব্যাবসা সম্পর্কে সুনিপুণ মতামত দিতে শুরু করেছে। তৈল রাজনীতি – ধর্ম – মৌলবাদ এই সব আমার প্রিয় বিষয় নয়। তবে তেল নিয়ে কিছু লিখতে হলে না চাইলেও ওই সব জিনিসের রেফারেন্স হয়ত চলে আসবে। সেই ক্ষেত্রে আমি নিজে যেটুকুতে ইন্টারেষ্ট পাই, সেইটুকুই আলোচনা করব।

    বেশী গভীরে ঢোকার আগে কিছু বেসিক ব্যাপার পরিষ্কার করে নিয়ে সবাই এক লেভেল ফিল্ডে চলে আসা যাক। প্রথম প্রশ্ন হল তেল আমাদের কাছে জনপ্রিয় কেন? এবং এর সংক্ষিপ্ততম উত্তর হল - সস্তা বলে!

    একটা হালকা মানসিক ব্যায়াম করে নেওয়া যাক – বেশী ঘবড়াবার কিছু নেই। এই মানসিক ব্যায়াম অন্য সব সফিস্টিকেটেড ইন্ডাষ্ট্রি যেমন ইলেক্ট্রসিক্স, কম্পিউটার, টেলিকম, এরোস্পেস, স্পেস – এতে ব্যবহৃত মানসিক চর্চার মত কমপ্লেক্স নয়। পাবলিকের ভ্রান্ত ধারণা আছে যে তেল তোলার মধ্যে সফিস্টেকেসি কিছু নেই – গর্ত খোঁড়, তেল তোল। সেই ধারণা ঠিক এই ভুল, সেই নিয়ে আলোচনা পরে, প্রথমে সেই ধারণার সাথে সাযুজ্য রেখে আমাদের আনসফিষ্টিকেটেড মানসিক ব্যায়াম।

    আমাদের অনেকেরই চার-চাকা গাড়ী ঠেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে জীবনের কোন না কোন সময়। যদিও বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সেই ঠ্যালা দিতে হয় গাড়ী খারাপ হয়ে গেলে, তবে ধরে নেওয়া যাক আমরা এখন ঠ্যালা দিচ্ছি মাত্র কিছু মিটার কারণ গাড়ির তেল শেষ হয়ে গ্যাছে। এবার আমরা এই ঘটনাকে এক্সট্রাপোলেট করি, ভাবি যে আমরা সেই গাড়ি ঠেলে ঠেলে প্রায় কুড়ি মাইল বা বত্রিশ কিলোমিটার নিয়ে গেলাম। মানে ধরুণ দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বেহালা পর্যন্ত। এই মানসিক ব্যায়ামের নিয়ম অনুযায়ী, এই গাড়ি ঠেলতে আপনি পুলি বা লিভার ব্যবহার করতে পারেন যদি গাড়ি উঁচু দিকে নিয়ে যেতে হয়। তবে কোন ভাবেই আপনি তেল ঢেলে গাড়ির ইঞ্জিন চালাতে পারবেন না। তাহলে ভাবতেই পারছেন এ কি চাপের কাজ! বত্রিশ কিলোমিটার গাড়ি ঠ্যালা! যদি এই কাজকে এনার্জিকে আপনি কনভার্ট করেন, তাহলে দেখা যাবে এ প্রায় একমাসের হিউম্যান লেবারের সমান। এক মাসের একটা লোকের কাজ! – এবং গাড়িতে তেল ঢাললে এই সার্ভিস আপনি পেতেন ৩-৪ লিটার তেলের মূল্যে, যার বাজার দর ২০০-৩০০ টাকা। সস্তা কিনা?

    বিংশ শতাব্দীর দুর-দার অগ্রগতির প্রায় বেশীর ভাগ অবদান এই তেল থেকে এসেছে এবং তেল হল গিয়ে পৃথিবীর মুখ্য পরিবহন জ্বলানী। আমরা প্রায় অবিশাস্য ভাবে এবং অনেকাংশে নির্লজ্জভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি এই এনার্জি ডেন্স এবং ভার্সাটাইল তেল নামক জ্বালানীর উপরে কারণে এটা এতো সস্তা ও পূর্বসূরী জ্বালানী সোর্সগুলির থেকে এতো বেশী কনভিনিয়েন্ট। শক্তির উৎস হিসাবে মাত্র দুই শতাব্দী আগেও এই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশও নির্ভরশীল ছিল বেশির ভাগ সময় পেশী শক্তির উপর – সেই মানুষের বা পশুর যাই হোক না কেন। কিন্তু জ্বালানী ঢালা ইঞ্জিনের কাছে এই পেশী শক্তি প্রায় কিছুই নয়। এবং মনুষ্য সভ্যতার অগ্রগতি আমাদের শিখিয়েছে যে কাঠ বা কয়লার থেকে এই তেল অনেক বেশী কার্যকরী জ্বালানী হিসাবে। তাই ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা – বুদ্ধিমান মানুষ দিন দিন নতুন উপায় বের করেছে তেল ব্যবহার করার। ক্রমশঃ তেল ব্যবহারের বিস্তার বেড়ে বেড়ে এমন জায়গায় এসে গেল যে পরিষ্কার ভাবে আমাদের অগ্রগতির ইতিহাস দুই ভাবে ভাগ হয়ে যায় – তেলের আগে ও তেলের পরে।

    কিছু ঘটনা হল, তেল তো আর পুর্নব্যবহার যোগ্য নয়! একবার মাল ব্যবহার হয়ে গেলেই খেল খতম, আবার নতুন যোগান দাও। আর তা ছাড়া তেল জ্বালানো পুরোপুরি পরিবেশের পক্ষেও ভাল নয়! – সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে ক্ষণ! আপাতত দেখা যাক বর্তমান সভ্যতায় কি ভাবে আমরা তেল ব্যবহার করছি –

    ১। পরিবহন – আজকের পৃথিবীর প্রায় ৯০% যানবাহনের জ্বালানী হচ্ছে এই তেল (বা তৈলজাত জ্বালানী) - সে গাড়ি বা এরোপ্লেন যাই হোক না কেন! আর বিগত শতাব্দীতে তো পরিবহন ব্যবস্থার বিস্তার বেড়েছে অকল্পনীয় ভাবে। হিসেব বলছে ১৯০০ সাল থেকে ২০০০ সালের মধ্যে পার-ক্যাপিটা যাতায়াতের বাৎসরিক বৃদ্ধি হয়েছে ১০০০%! এর সাথে সাথে বেড়েছে সংলগ্ন ইন্ডাষ্টী গুলো – যেমন এয়ারলাইন্স, রোড কনষ্ট্রাকশন, ট্যুরিজিম ইত্যাদি ইত্যাদি। সস্তা জ্বালানী পেয়ে আমাদের ইন্ড্রাষ্টি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে – এবং আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই নিয়ে বেশী ফাঁদার কিছু নেই – বহুল প্রচলিত গল্প।

    ২। চাষ-আবাদ – এই বিষয়টি বেশ ইন্টারেষ্টিং। চাষ আবাদের সাথে তেলের সম্পর্ক ততটা ক্লিয়ার কাট বা অবভিয়াস নয়! তথাকথিত ইন্ডাষ্ট্রীয়াল চাষা আবাদ পুরোপুরি ফসিল ফ্যুয়েল এর উপর নির্ভরশীল। ন্যাচারাল গ্যাস এবং বাতাস থেকে প্রাপ্ত নাইট্রোজেন থেকে তৈরী হয় আজকের আমাদের চাষে ব্যবহৃত মূল সার যেগুলি অ্যামোনিয়া বেসড্‌। আজকের পৃথিবীর বেশীর চাষের জমি এতো বেশী জর্জরিত হয়েছে যে, সে তার উর্বরা শক্তি অনেকটা হারিয়েছে। কাব্যিক ভাষায় বলতে গেলে বিপুলা এই পৃথিবীর অসংখ্য জীবিত মানুষকে খাদ্য জোগাতে গিয়ে আবাদী জমি বারে বাড়ে ধর্ষীত হচ্ছে। তাই কৃত্রিম সার প্রয়োগ ছাড়া সেই জমিতে চাহিদা অনুযায়ী ফসল ফলানো প্রায় অসম্ভব। আগের দিনে মানুষ চাষ করত পশু ব্যবহার করে – মানে বিপুল সংখ্যক পশু। সেই পশুদের খাবার উৎপাদন করতে বিস্তারিত এলাকা আমরা মানুষের জন্য ফসল ফলাতে ব্যবহার করতে পারতাম না। আজকের দিনে আমাদের চাষের ক্ষেত্রে পশুদের উপর নির্ভরশীলতা কমে এসেছে। ফলে এই সমস্ত জমি যেখানে আগে পশু চরে বেড়াত, সেখানে আমরা চাষ করতে পারছি। আর তা ছাড়া তেলকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহার করেই আমরা চাষে মেসিন ব্যবহার করতে পারছি। মানে বলতে গেলে তেল ছাড়া আমরা আবার নির্ভর হয়ে পড়ব চাষের ক্ষেত্রে পশুদের উপর।

    যত বেশী ফসল, তত বেশী পোকামাকড় – আগেকার সাধারণ বিষে পোকামাকড় আর মরছে না। পোকারাও বিবর্তিত হচ্ছে – তাই আমাদেরও আবিষ্কার করতে হচ্ছে নতুন নতুন মেলা কীটানাশক যার বেশীর ভাগই হল গিয়ে তৈলজাত। তেলকে ফীডষ্টক হিসাবে ব্যবহার করে তৈরী এই কিটনাশক গুলি সস্তা এবং এফেকটিভও। ১৯৬০ সালের পর থেকে তৃতীয় বিশ্বে শুরু হয় সবুজ বিপ্লব যার মূলে ছিল ইন্ডাষ্ট্রিয়াল-ক্যেমিক্যাল চাষাবাদ পদ্ধতি। মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে এই ভাবে পৃথিবীর খাদ্য উৎপাদন শক্তি বেড়ে গিয়েছিল প্রায় তিন গুণ! এই ভাবে চাষবাসের ক্ষেত্রে হল গ্লোবাইলাইজেশন – এখানকার মাল গেল ওখানে, ওখানকার মাল এল এখানে – ফিল গুড ফ্যাক্টর! যাতে করে মাল এদিক-ওদিক যাচ্ছে, তা চলছে কিসে? সেই তেলে!

    ৩। ক্যেমিক্যাল ও প্লাষ্টিক – এই যে আমি এখন লিখছি, মানে কম্পিুটারে টাইপ করছি, সেই করতে গিয়ে আমি যা যা স্পর্শ করছি, বা হাতের নাগালের মধ্যে যা দেখছি, সবকিছুতেই তেলের ছোঁয়া। প্রায় সব জিনিসই তৈরী হয়েছে কোন না কোন ভাবে তেল-কে ফীডস্টক হিসাবে ব্যবহার করছে। সে আপনি না লিখে যদি ড্রয়িং রুমে বসে টিভি দেখেন, বা কিচেনে যান বা টয়লেটে – তেল আপনাকে পিছু ছাড়বে না। আপনার অজান্তেই আপনি তেল জাত মালপত্র ঘেঁটে যান রোজ রোজ, সকাল থেকে রাত।

    পেট্রোক্যেমিক্যাল জিনিসপত্র তৈরী হয় তেলকে ‘ক্র্যাক’ করে – প্রচুর তাপ বা কোন কোন সময় অনুঘটক (ক্যাটালিষ্ট) এর সাহায্য নিয়ে হাইড্রোকার্বন চেন ভেঙে তেলে থেকে তৈরী হয় অগুণিত দ্রব্য। সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত পেট্রোক্যামিক্যাল বিল্ডিং ব্লক আমাদের বাণিজ্য শিল্পে হল গিয়ে ইথিলিন, প্রোপিলিন এবং বুটাডাইন। মাত্র এই তিন ক্যেমিক্যালের উপর কেরামতি করে আমরা তৈরী করেছি সলভেন্ট, অ্যান্টিফ্রিজ, ডিস-ইনফ্যাক্ট্যান্ট, কুল্যান্ট, লুব্রিক্যান্ট, এবং অবশ্যই প্লাষ্টিক।

    ইথিলিন থেকে তৈরী হয়েছে পলিইথিলিন যা কিনা এক ধরণের প্লাষ্টিক যার থেকে খেলনা হতে আসবাবপত্র এমনকি খাবার রাখার পাত্রো তৈরী হয়েছে। এর পরে ইথিলীনকে একা থাকতে দেওয়া হল না – ইথিলীনের সাথে ক্লোরিনের বিক্রিয়া ঘটিয়ে আমরা বের করে ফেললাম ভিনাইল ক্লোরাইড এবং তার থেকে পলি ভিনাইল ক্লোরাইড বা PVC. PVC নিয়ে আলাদা করে কিছু লেখার নেই – এই মাল সব জায়গায় – বাড়ি তৈরী কাঁচামাল, জামাকাপড়, থেকে খেলনা।
    আমাদের চারিপাশের পরিবহনের মেসিন পত্র, খাদ্য ও মালপত্রের বিতরণ, প্রমোদ সাম্রগ্রী, মেডীক্যাল টেকনলজি, কনস্ট্রাকশন – ইনফরমেশন কালেকশন করা, প্রসেস করা ও পরিবেশন করা – এই সব কিছু মালপত্র নয় তৈরী হয়েছে তৈল জাত বস্তু দিয়ে, নয়ত ওদের তৈলাক্ত (লুব্রিকেট) করা হয় তেল দিয়ে।

    এমনকি রাতে শুতে যাবার আগে আপনার বউ ড্রেসিং টেবিলের সামনে যেটি লাগাচ্ছেন এবং আপনি বিছানায় শুয়ে যেটা নিয়ে নাড়াচাড়া বা অপেক্ষা করছেন – তা সবের মূলেই আছে তেলের দান!

    নীচে কিছু নিত্যব্যবহার্য জিনেসের উদাহরণ দেওয়া হল যেগুলি তেল থেকে তৈরী –

    ডিসোয়াশিং লিক্যুইড, পেন্ট ব্রাশ, টেলিফোন, অ্যান্টিসেপ্টিকস, ডিওড্রেন্ট, টায়ার, মোটর সাইকেল হেলমেট, তাঁবু, জামাকাপড়, ফ্রীজের লাইনিং, ফ্লোর ওয়াক্স, জুতো, ইলেক্ট্রিশিয়ান টেপ, গ্লু, ট্র্যাস ব্যাগ, হ্যান্ড লোশন, সফট কন্ট্যাক্ট লেন্স, স্যাম্পু, প্যান্টি হোস, ক্যামেরা, মাছ ধরার ছিপ, কালি, অ্যানাসথেটিক্স, ডিসপোজেবল ডাইপার, সি ডি, ঘরের রঙ, অ্যামোনিয়া, গাড়ির ব্যাটারী খাপ, সেফটি গ্লাস, হেয়ার কারলার, কৃত্রিম রাবার, আইগ্লাস, ভিটামিন ক্যাপ্সুল, মুভি ফিল্ম, বাতি, বেলুন, ক্রেডিট কার্ড, ফার্টিলাইজার, পোকা মাকড় তাড়ানোর লোশন, জলের পাইপ, টয়লেট সিট, শাওয়ার কার্টেন, বাগানে জল দেবার পাইপ, গলফ বল, ছাতা, ডিটারজেন্ট, টুথপেষ্ট, কোল্ড ক্রীম, ব্যান্ডেজ, চুলের রঙ, নেল পোলিশ, গিটারের তার, নকল দাঁত, গলফ ব্যাগ, পারফিউম, লাগেজ, জুতো পালিশ, বলপয়েন্ট পেন, কার্পেট, হার্ট ভাল্ভ, লিপস্টিক, অ্যাস্পিরিন, শেভিং ক্রিম ইত্যাদি ইত্যাদি ।

    মোট কথা হইল, পেট্রোক্যেমিক্যাল ছাড়া – মেডিক্যাল সায়েন্স, ইনফরমেশন টেকনলজি, আধুনিক বসতবাড়ি এবং আরো অসংখ্য আধুনিক জীবনের আনুসাঙ্গিক জাষ্ট একজিষ্ট করবে না। ইন সামারি – তেল হইল গিয়ে আমাদের আধুনিক জীবনের মূলমন্ত্র বা প্রাণবীজ।

    [ক্রমশঃ]

    পর্ব – ২
    ----------------------------------------------------------------------------------------------
    আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন – আজকালকার দিনে কোন তেল কোম্পানী যা খুশী করে পার পেয়ে যাবে না, অন্ততঃ উন্নত দেশ গুলিতে। নানা রেগুলেশন মেনে চলতে হয় - সে টেকনিক্যাল বা এনভায়রনমেন্টাল যাই হোক না কেন। তবে কিনা ক্যাচ আছে - উন্নত দেশে তেল তোলা আর অনুন্নত দেশে তেল তোলা কি আর এক জিনিস? এক ব্যারেল (প্রায় ১৫৯ লিটার) খনিজ তেল তুলতে কিছু দেশে খরচ হতে পারে ৫৫ ডলার, আর অন্যদেশে খরচা হতে পারে মাত্র ৮ ডলার – এতটাই পার্থক্য। তেল উৎপাদনকারী কোম্পানীর মূল কাজ কি? উত্তর সোজা – যত দামে তেল বিক্রী হচ্ছে তার থেকে কম খরচে তেল উৎপাদন করা।

    এবার প্রশ্ন হল এতো বেশী রেগুলেশন মেনে চলতে গেলে কি কম দামে তেল উৎপাদন চলতে পারে? এখানেও একটা ক্যাচ আছে – ALARP নামে একটা টার্ম ব্যবহার করা হয় যার মূল কথা হল As Low As Reasonably Practicable. এখানে খেলটা হল ‘Reasonable’ জিনিসটি কি? এটা কি ভাবে ডিফাইন করা যাবে? তেলের ব্যারেল প্রতি দাম যখন ১০০ ডলার ছিল তখনকার ‘Reasonable’ কি এখনকার সময়ে যখন তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৩৬ ডলার সেই ‘Reasonable’ এর সমার্থক? এর সঠিক উত্তর বলে কিছু হয় না – আপনি যেমন ভাবে ডিফেন্ড করবেন। উন্নত দেশে বেশী কড়াকড়ি হলে আপনাকে তেল উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হতে পারে।

    একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – কোন তেল কোম্পানীকে তার কম্পাউন্ড থেকে জল নিস্ক্রমণ করার আগে, সেই জল পরিশোধন করতে হয় একটা রেগুলেশন মেনে। মোদ্দা কথা নিস্ক্রীত জল থেকে তেল আলাদা করে তবেই বাইরে মাল ফেলা যাবে। এটা বিশেষ করে প্রযোজ্য সমুদ্রের মাঝে প্লাটফর্ম গুলিতে। যা খুশী মেশানো জল হদ হদ করে মাঝে সমুদ্রে ঢেলে দিলাম – এমনটা কভি নেহী চলেগা। মোটামুটি মাত্রা হল দেখা যে এক লিটার নিস্ক্রীত জলে তেলের পরিমাণ যেন ৩০ মিলিগ্রামের কম থাকে। সমুদ্রের মাঝখানে জল-তেল সেপারেট করা এক ঝকমারি ব্যাপার। আপনি যতই শুনে থাকুন তেল-জলে মিশ খায় না – কিন্তু বিশ্বাস করুণ এমন প্রকৃতির তেল আছে যে সেই মাল নিঃসার্থ বা পুরোপুরি জল ছাড়তেই চায় না! সল্যুবিলিটি অব ওয়াটার ইন ক্রুড অয়েল – এই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারেন ইচ্ছা থাকলে। তেল কিছু জল বা জল কিছু তেল রেখে দেবেই। প্রবলেম হচ্ছে সেই লিমিট টার্গেট নীচের দিকে করতে গেলে – মানে যত বেশী জল থেকে তেল বা তেল থেকে জল ঝড়াতে চাইবেন তত বেশী খরচা। তো এবার সেই তেল-জল আলাদা করতে হলে আপনাকে অন্য এক প্লাটফর্ম বানাতে হবে যেখানে গুচ্ছের মেশিন পত্র বসাবেন আপনি। এই ভাবে আলাদা করুন – জল ফেলুন সমুদ্রে আর তেল আনুন ডাঙায়। আর না হয় তেল-জল দুইকেই ডাঙায় নিয়ে আসুন পাইপলাইনে করে বা ট্যাঙ্কারে করে – ডাঙায় আলাদা করুণ এবং তারপর ফেঁকুন। কিন্তু এই দুই খরচা সাপেক্ষ ব্যাপার। ১০০ ডলার তেলের দাম হলে হয়ত আমার কোম্পানী এই নিয়ে ভাবতে পারত – কিন্তু ৩৬ ডলার ব্যারেল প্রতি দাম নিয়ে আমার কোম্পানী জাষ্ট তেল-জল আলাদা করার কথা ভাবতে পারছে না। তাহলে এবার কি করব? বেশী পরিবেশ রেগুলেশন নিয়ে হইচই হলে বা সরকার দাবকানি দিলে আমার কোম্পানিকে তেল উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে সেই প্লাটফর্ম থেকে। কারণ? কারণ আমার কোম্পানি ইকো-ফ্রেণ্ডলি হতে পারছে না।

    এবার যদি আমি এমন কোম্পানীতে কাজ করি যে যার ইনকাম থেকেই সেই দেশের সরকার চলে? বা আমি সরকারী তেলের কোম্পানীতেই কাজ করি – যে দেশের সমস্ত বাড়ফাট্টাই এই তেল থেকে? তাহলে? তাহলে কি আমার কোম্পানী সত্যিকার তেল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়ে পরিবেশবন্ধু হিসাবে নাম লেখাবে – জাষ্ট বিকজ উই ওয়ান্ট টু বি পরিবেশ ফ্রেণ্ডলি? নাকি সেই কোম্পানী এবার পেপার ওয়ার্ক-এর খেলা খেলবে ‘Reasonable’ জিনিসটাকে কেন্দ্র করে? এটা কি কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করবে না যে এতো কম দামে বেশী মেশিন পত্র বসিয়ে ইকো-ফেন্ড্রলি হওয়া আর ‘Reasonable’ নেই? আর যদি সরকারী কোম্পানি হয় তাহলে কি সেই পরিবেশ রেগুলেশন কমিটির কাছে হালকা একটা বার্তা যাবে না যাতে বলা হবে – ভাইসকল, একটু রয়ে সয়ে, আপনি বাঁচলে বাপের নাম! আগে তুমি তোমার চাকুরী বাঁচিয়ে (কারন তেল না থাকলে তার চাকুরীও নেই) নিজের ডাইরেক্ট ছেলে মেয়েকে বাঁচাও – তারপর না হয় আগত পৃথিবী এবং বিশ্ব ভাতৃত্বের কথা ভাববে? আপনার কি মনে হয়?

    বিশ্বাস করুণ তেল কোম্পানী কিন্তু চাইছে পরিবেশ বন্ধু হতে – কিন্তু কাজের ধরণটাই এমন যে, সব সময় চাইলেও বন্ধু হওয়া যায় না! ব্যাপারটা এতোটাই সোজা আবার একই সঙ্গে বাজে রকম ভাবে জটিল। বন্ধু হওয়া জরুরী তেল কোম্পানী জানে – কিন্তু ঠিক কতটা? আজকের দিনে পৃথিবীর সমস্ত মেজর তেল কোম্পানীর যে কোন মিটিং শুরু হয় যে বিষয় দিয়ে তার নাম HSE, অর্থাৎ Health, Safety, এবং Environment. বলছি না যে এনভায়রনমেন্ট আছে কোম্পানী বিচারে?

    তেল কোম্পানীতে পরিবেশ সচেতন হওয়াকে ধরা হয় – ‘গুড বিসনেস’ হিসাবে। গুড বিসনেস নিয়ে বেশী ভাবার কারণও সেই বিজনেস! এক তেল কোম্পানী যদি অন্যের থেকে বেশী পরিবেশ বন্ধু হয়ে যায়, তাহলে অন্য কোম্পানী কিন্তু তার কাছে কম্পিটিশনে হেরে যেতে পারে। বাজার দখলের লড়াই-তে হেরে যাওয়ার ভয়তেই এই সব কোম্পানীর আপাত পরিবেশ সচেতনতা, এমনটা আপনি কনক্লুড করতেই পারেন। কোম্পানী তার অধীনে চাকুরীরতদের বারবার বলে স্যোসালি রেসপনসেবল্‌ হতে – বলে থাকে রেগুলেশন মেনে কোন কিছু এক্সপ্লোর বা ডিজাইন করতে। সবাই চেষ্টা করে – কিন্তু সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ব্যাবসা মার খেলে কি আর করা যাবে!

    বড় তেল কোম্পানীরা এই ভাবে চেষ্টা করে নিজেদের দায় এড়াতে – যাতে পরে কেউ বলতে না পারে, ভাই তোমরা এটা কেন কর নি? কোম্পানী চেষ্টা করে যায় এটা দেখাবার জন্য যে, তারা ভুলে যায় নি ব্যাপারটা – তারা চায় –

    -বর্জ্য পদার্থ ত্যাগ সংক্রান্ত দূষণ কমাতে
    -প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ, পরিমাপ এবং নথিবদ্ধকরণ পদ্ধতির অবলম্বন
    -যে অসংখ্য কনট্রাকটর তাদের অধীনে কাজ করছে তাদের তত্ত্বাবধান ও সচেতন করা। যে ভাই আমরা পরিবেশবন্ধু হবার চেষ্টা করছি, তাই তোমারাও ফেলে ছড়িয়ে যেতে পারবে না।
    -তেল উৎপাদনের কাজ মিটে গেলে সেই জমিকে পুনর্জিবিত করা (ল্যান্ড রিষ্টোর)

    এ ছাড়াও আরো হাজারো রকম রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট আছে, তার প্রয়োগ আছে। প্রত্যেক কোম্পানীতে এক একটা বিশাল HSE এবং ট্যেকনিক্যাল সেফটি বলে ডিপার্টমেন্ট আছে।

    সেফটি বা সুরক্ষা জিনিসটার উপর আরো বেশী জোর দেওয়া হয় – এই নিয়ে আলাদা করে লিখব। বিগত কয়েক দশক ধরে তৈল ব্যবসা দেখেছে কিছু সাংঘাতিক দূর্ঘটনা – সেই ঘটনা থেকে শিখেছে অনেক কিছু। সেই সমস্ত শেখা থেকে তৈরী হয়েছে ইণ্ডাষ্ট্রি স্ট্যান্ডার্ড, কোম্পানীর নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড। এর মধ্যে কিছু কিছু স্ট্যান্ডার্ড আবার নন-নেগোশিয়েবল। এদের উপর ওই খরচ কম বেশী এই তুলনা টানা যাবে না – জাষ্ট মেনে চলতে হবে সেই রেগুলেশন। সে তেলের দাম ৩০ ডলার বা ১৩০ ডলার, যাই হোক না কেন। এই সমস্ত ঘটনাকে বর্ণণা করা হয় ‘প্রসেস সেফটি ইনসিডেন্ট’ বলে (Process Safety) – পরের বার কিছু দূর্ঘটনার উদাহরণ দিয়ে সেখান থেকে কেমন ভাবে এই রেগুলেশনগুলি এসেছে সেটা লেখার চেষ্টা করব।

    তবে পরিবেশ বা সুরক্ষা ছাড়া তৈল উৎপাদনকে যে জিনিসটা বেশী ভোগায় তা হল ‘অনৈশ্চয়তা’ (Uncertainty)। তৈল অন্বেষণ এবং উৎপাদন গোটাটাই বিশল এক অনৈশ্চয়তার মধ্যে কাজ করে। তেল রিসার্ভারের ধর্মই এমন যে গুটিকতক প্রধান বিষয় (fact) ছাড়া ওদের সম্পর্কে আর প্রায় কিছুই জানা যায় না! এটা কিন্তু আমাদের এখনো পর্যন্ত লব্ধ জ্ঞানের এক সীমাবদ্ধতা! সমুদ্রের মাঝে হলে তো মথাই নেই – সমুদ্র মাঝে মাঝে নিজেই ৩০০০ মিটার পর্যন্ত গভীর – তদোপরি আবার মাটির নীচে ঢোকা আছে ৫০০০-৬০০০ মিটার। ৩০০০ মিটার গভীর তেলের গর্ত তো হামেশাই খোঁড়া হয়!

    এখন ঘটনা হচ্ছে এতো নীচে গিয়ে মাল কি আছে সেটা তো আর দেখা সম্ভব নয়! আমাদের জ্ঞানের সেই সীমাবদ্ধতা আমরা অতিক্রম করার চেষ্টা করছি ‘অনুমান’ বা Assumption দিয়ে। আমরা পৃথিবীর উপরে দেখা ফিজিক্যাল প্রিন্সিপ্যাল আরোপ করে বা পুরানো রিসার্ভার থেকে লব্ধ জ্ঞান নিয়ে সেই ফাঁক পূরণ করার চেষ্টা করি। কিভাবে একটা রিসার্ভার-কে ম্যাচিওর বা ডেভেলপ করা হবে তার একটা নয়, বরং অসংখ্য সমাধান থাকে। এবং এই ধরণের সমস্যা সমাধান করার জন্য যে মেন্টালিটির দরকার হয় দূর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়-গুলিএ তা শেখানো হয় না। তার মানে আমরা যা কলেজে শিখে ঢুকলাম কোম্পানিতে, সেই মেন্টালিটির এক মেজর সিফট দরকার হয়। ব্যাপারটা ইন্টারেষ্টিং কারণ, শুধু টেকনিক্যাল জ্ঞান দিয়ে রিসার্ভার ডেভেলপ করা যায় না – দরকার হয়, ইকনোমিক্স, কমার্শিয়াল, অর্গানাইজেশনাল এবং পলিটিক্যাল সচেতনতাও। সুতরাং যারা নিদারুণ কনফিডেন্ট হয়ে জ্ঞান দেন বা দেবেন তেল ব্যাবসা কেমন ভাবে চলা উচিত – তাদের উদ্দেশ্যে বলি – ভাই, একটু সমঝে, হাম লোগ ভি থোডা থোডা জানতে হ্যায়! মানে দায়ে পড়ে জানতে হয়েছে আর কি!

    এবার দেখা যাক যে একটা তৈল অন্বেষণ এবং উৎপাদন প্রসেসে কি কি স্টেপ আসতে পারে – এর প্রধান স্টেপ গুলি হল –

    -এক্সপ্লোর (অন্বেষণ)
    -আপ্রেজ (Apprise – মালটা মেপে নেওয়া যাকে বলে)
    -ডেভলেপমেন্ট প্ল্যান বানানো
    -ডেভলপমেন্ট প্ল্যান-টা আগে বাড়ানো, যাকে বলে একজিকিউট করা
    -মাল উৎপাদন করো এবং
    -পরিত্যাগ করো (Abandon)

    উপরেরটা হল গিয়ে মূল ব্যাপার – এবার সাপোর্ট ফাংশনতো লেগে আছেই। এরা হল গিয়ে স্কিল ম্যানেজমেন্টের লোকজন, কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট, লিগ্যাল, কেনার লোকজন (contracting and procurement), ফিন্যান্স, আই টি-র লোকজন, কোয়ালিটি ম্যানেজমেন্ট, হেলথ-সেফটি ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রোজেক্টের উপর নির্ভর করবে আরো নতুন কিছু যোগ-বিয়োগ হবে কিনা।

    তবে আপনি যতই ভেবে ভাবে যোগদানকারী এক্সপার্ট কারা হবে ভেবে লিষ্টী করুণ, মাঝে মাঝে চমকে কিন্তু আপনি যাবেনই – আর সেখানেই বিউটী। ধরুণ ইরাকে তেল উৎপাদনের প্রোজেক্ট হচ্ছে, ডাঙাতে (যাকে তৈল পরিভাষায় বলে Onshore)। এবার ধরুণ মেশিন পত্র বসাবার জন্য জায়গা পরিষ্কার করতে গিয়ে দুম করে এক বোম ফেটে গেল – কারন কিনা উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়কালীন থেকে পড়ে থাকা না-ফাটা বোমা এবং ল্যান্ডমাইন! আপনি কি প্রোজেক্ট ম্যানেজার হিসাবে ধরেছিলেন যে আপনাকে বোম্ব-ডিফিউজ করার এক্সপার্ট এবং ডিফেন্স কনট্রাকট্রর দের নিয়ে কাজ করতে হবে? এবার খোঁজ খোঁজ কোথায় পাওয়া যায় এক্সপার্ট – বিদেশী এক্সপার্ট পাওয়া গেল – কিন্তু ইরাকী সরকার তাদের ঢুকতে দেবে না দেশে, সেন্সিটিভ ব্যাপার বলে কথা। তাহলে হবে কি? ট্রেনিং দিয়ে ইরাকী দেশী এক্সপার্ট তৈরী করা হবে – আপনি প্রোজেক্ট ম্যানেজার মাঝখান থেকে গেলেন ফেঁসে – আপনি বসে আছেন, আর আছেন, আর আছেন – ওদিকে বোম পরিষ্কার হছে, আর হচ্ছে আর হচ্ছে –

    পরের পর্বে আমরা দেখব এই রিসার্ভার কি জিনিস, এর স্ট্রাকচার কি রকম, তেল কিভাবে উৎপন্ন হয়েছে, গ্যাসই বা কিভাবে – তেল কিভাবে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় মাইগ্রেট করেছে – সেই সব –

    [ক্রমশঃ]


    পর্ব – ৩
    ------------------------------------------------------------

    দুনিয়া না-ইনসাফি তে ভরা, আর সেটা আপনি আরো বেশী করে বুঝতে পারবেন এই তেল ব্যবসায় প্রথম চাকুরী করতে ঢুকলে! আপনি ধরুণ গাঁতিয়ে পড়াশুনা করে ফাটিয়ে রেজাল্ট করে ইলেক্ট্রনিক্স/কম্পু সায়েন্স/মেকানিক্যাল/ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি নিয়ে প্রথম দিকে র‍্যাঙ্ক করে নায়ক হয়ে ঢুকলেন কোন প্রিমিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে – তারপর মাল্টিন্যাশানাল ওয়েল কোম্পানিতে গ্র্যাজুয়েট হিসাবে চাকুরী পেলেন, সেও নায়ক হিসাবেই। যদিও তখনও আপনার ঠিক ধরণা নেই যে তেলের সাথে ইলেক্ট্রনিক্স/কম্পু ইত্যাদির কি সম্পর্ক – আর তেল কোম্পানী গুলিও আপনার ওই গ্রাজুয়েট ডিগ্রীর খুব একটা পরোয়া করে না – ওদের চাই এক প্রিমিয়ার ইস্টিটিউট থেকে ভালো রেজাল্ট করা ছেলে। তা আপনি নায়ক হিসাবে ঢুকলেন ঠিকই, কিন্তু নায়ক আর নাও থাকতে পারেন তেল কোম্পানিতে যদি না আপনি “সাব-সারফেস” বিভাগে অ্যাসাইন্ড হন। তেল কোম্পানীতে ‘সারফেস’ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ঢুকলেই আপনি হয়ে গেলেন গিয়ে পার্শ্ব নায়ক, তা সে আপনার কেপেবেলিটি যতই থাকুক না কেন। আপনাকে তরুণ কুমার হয়েই থাকতে হবে পার্শ্ব রোলে, উত্তম কুমার আর আপনি হতে পারবেন না!

    ‘সাব-সারফেস’ আর ‘সারফেস’ ব্যাপারটা একটু ক্লিয়ার করে নেওয়া যাক এই বার। ‘সাব-সারফেস’ হল গিয়ে মাটির নীচের যা কিছু হচ্ছে তার সাথে যুক্ত, আর ‘সারফেস’ বিভাগ মাটির উপরের জিনিস নিয়ে নাড়াচাড়া করে। ‘সাব-সারফেস’ ডিসিপ্লিন বলতে – জিওলজি, জিও-ফিসিক্স, পেট্রোফিসিক্স, রিজার্ভার ইঞ্জীনিয়ার, প্রোডাকশন টেকনোলজিষ্ট, ওয়েল-ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদি। আর সারফেসে বাকি যা কিছু – মেক্যানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, সিভিল, কন্ট্রোল অটোমেশন, ক্যমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং (এদের এক গাল ভরা নাম আছে – প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার), মেটিরিয়্যালস, প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি ইত্যাদি। যদিও আমি এখনো জানি না প্রোজেক্ট নিয়ে হ্যাণ্ডেল করাকে ইঞ্জিনিয়ারিং বলা হবে কেন? ম্যানেজমেন্ট বলা ঠিক আছে – তা বলে ইঞ্জিনিয়ারিং? সে আর এক না-ইনসাফি! ইন ফ্যাক্ট সমগ্র ইঞ্জিনিয়ারিং কুলের এবং বিদ্যার অপমান।

    তেল কোম্পানীতে চাকুরী করতে ঢুকে আপনার মাথায় যেটা সর্বপ্রথম ঘুঁসে যাওয়া উচিত সেটা হল – ‘সাব-সারফেস’ মানে ‘কোর’ ডিসিপ্লিন, আর ‘সারফেস’ সাপোর্ট রোলে। এমনকি বিভাজন এতই প্রকট যে, সাব-সারফেস এবং সারফেস এই দুই বিভাগের স্যালারী স্ট্রাকচার আলাদা বেশীর ভাগ কোম্পানীতে। এবার চেষ্টা করা যাক মেন না-ইনসাফি টা এক্সপলেন করতে – ভারতের মতন দেশে তেল বিজনেস নিয়ে তেমন সচেতনতা নেই। তেম নিয়ে পড়াশুনা করার ব্যাপারে সচেতনতা তো আরো কম – আমি তো গুগুল সার্চ না করে বলতেই পারব না যে ভারতে ইন্ডিয়ান স্কুল অব্‌ মাইনস ছাড়া আর কোথায় তৈল সংক্রান্ত পড়াশুনা (যেমন পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং) করানো হয়! আর আমি কিনা তৈল ব্যবসার সাথে জড়িত! তা হলে বুঝতেই পারছেন সাধারণ জনতা কেরিয়ার পছন্দ করার আগে কতটা পেট্রোলিয়াম নিয়ে পড়াশুনা করা তে জোর দেয়?

    আপনি প্রশ্ন করতে পারেন যে ভাই, পড়াশুনা তো করতে বলছ তেল নিয়ে, কিন্তু জব মার্কেট আছে কি? এটা এক হক্‌ প্রশ্ন, এর গ্যারান্টেড উত্তর আমি জানি না। কারণ পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশুনা শুরু করার মানে আপনার ফিল্ডটা অলরেডি ছোট হয়ে গেল – আপনি পেট্রলিয়াম ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে তো আর এয়ারক্রাফট তৈরী করার ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে যোগদান করবেন না! আপনাকে ওরা ইন্টারভিউ-তেই ডাকবে না! কিন্তু ফিল্ড ছোট হলেও একবার কোন ক্রমে তেল ব্যবসায় ঢুকে যেতে পারলেই কেল্লা ফতে! তেল ব্যবসার কোম্পানীরা এমনেই ওয়ান ওব দি হায়েষ্ট পেড্‌ চাকুরী দেয়। এমনটাও বলা যেতে পারে যে আপনি সাধারণ এক ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে তেল ব্যবসার চাকুরী থেকে বেশী কামাই এমন জব পাবেনই না!

    তাহলে জিনিসটা দাঁড়ালো কি? পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হলে আপনাকে তেল ব্যবসায় চাকুরী করার জন্যই অপেক্ষা করতে হবে। অন্যদিকে সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লে আপনি অন্য অনেক চাকুরীতে জয়েন করতে পারেন – অনেক অপশন খোলা থাকবে। মাইনে কিন্তু তেল কোম্পানীর থেকে কম পাবেন! অবশ্য আপনি পেট্রোলিয়াম ইঞ্জনিয়ারিং পড়ে আই টি তে জব করতে ঢুকতে পারেন, সে পথ সব সময়েই খোলা – সেতো আপনি ইতিহাসে অনার্স করেও আই টি জব করতে পারেন, তাই আই টি আমি এই আলোচনায় আনছি না।

    এর মধ্যে কিছু ডিসিপ্লিন আছে যেখানে অন্য ফিল্ড থেকে চেঞ্জ করে সেই ডিসিপ্লিনে সাধারণত ঢোকানো হয় না, যদি না আপনি গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করবার পণ না ধরে বসেন! তেমন ডিসিপ্লিন গুলি হল জিওলজি, জিও-ফিসিক্স, পেট্রোফিসিক্স ইত্যাদি। অন্যদিকে কেউ আন্ডাগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রী করে রিসার্ভার ইঞ্জিনিয়ার কেপেবিলিটি নিয়ে বেরোয় না! এমনও দেখা গেছে যে সাপ্লাই এর অভাবে ক্যামিকাল ইঞ্জিনিয়ার, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইত্যাদিদের ট্রেনিং দিয়ে রিজার্ভার ইঞ্জিনিয়ার বানানো হয়েছে। আমার অ্যাডভাইস হবে আপনার সামনে এমন সুযোগ থাকলে তেমনটা ব্যবহার করুন। তেল কোম্পানীতে চাকুরী করতে ঢুকে কোর ডিসিপ্লিনে ট্রান্সফার হবার চান্স কোনদিন ছাড়বেন না। এ সুযোগ হল জাতে ওঠার সুযোগ। এমনটাই বলা যেতে পারে ওয়েল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং প্রোডাকশন টেনকোনজি সম্পর্কে। হামেশাই মেকানিক্যাল, সিভিল, মেটিরিয়্যালস ইঞ্জিনিয়ার রা ওয়েল ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে। আর সবচেয়ে বেশী চাহিদা এদের – একবার যদি ভালো ওয়েল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নাম ফাটাতে পারেন, তা হলে আপনাকে আর জব সিকিউরিটি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। প্রোডাকশন টেনকোনজি হল খিচুরী জিনিস – এতে যে কমন সেন্স ছাড়া কি জিনিস লাগে সেটাই আমি বুঝতে পারলাম না এতোদিনে! যে কোন ইঞ্জিনিয়ারিং থেকেই ট্রেনিং দিয়ে এই মাল বানানো যায়।

    এবার ছোট্ট প্রশ্ন, ভারতে (বা বেশীর ভাগ দেশে) জিওলজি, জিও-ফিজিক্স এরা কারে পড়ে? বেশী ভনিতা না করে ডাইরেক্ট উত্তর হল আজকাল কার দিনে যারা অন্য কোন সায়েন্স বা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চে চান্স না পায়! আইরনি হল – যারা আপনার যোগ্য ছিল না (অন্তত মার্কেট বিচারে), তারাই তেল কোম্পানীতে যোগদান করে হয়ে গেল কোর ডিসিপ্লিন বা নায়ক – আপনি চলে গেলেন সাপোর্ট রোলে বা পার্শ্ব নায়ক যাকে বলে! কষ্ট হয় না বলুন? আমি বলি কি – হ্যাঁ হয় – কষ্ট আরো বেড়ে যায়, বুকে চাপ লাগে যখন দেখেন মিটিং এ এই সব পাবলিক-দের দুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বেশী আপনার থেকে! চক্রাকার পরিবর্তন্তে সুখানি চ, দুঃখানি চ্‌ - যদি একই ইউনিভারসিটি থেকে পড়েন আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আপনার বন্ধু জিওলজি – সেই বন্ধু মনে মনে নিশ্চয়শই হালকা হিংসা বা ঈর্ষা করত আপনার উপরের দিকে থাকা ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চকে, আর আপনিও বেশ ঘ্যাম নিতেন – তাহলে কি রিভেঞ্জ হবে না এবার? সুদে-আসলে হবে – যতদিন আপনি তেল কোম্পানীতে কাজ করবেন আপনার বন্ধু মনে করিয়ে দেবে ঠারে ঠোরে যে তারা কোর ডিসিপ্লিন। আর মনে না করালেও, আপনার বন্ধু খুব উদার হলেও, আপনি ভুগবেন ইনফিওরিটি কমপ্লেক্সে – সেই সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ারিং রোলে!

    আরো একটা হালকা পরামর্শ – তেল কোম্পানীতে চাকুরী করতে হলে যত তাড়াতাড়ি পারেন, মানে যত কম বয়েসে পারা যায় চাকুরী করতে ঢুকে পড়ুন। এ এমন এক ব্যবসা যেখানে আপনার ডিগ্রীর থেকে অভিজ্ঞতার দাম দেওয়া হয় বেশী। ওই সব মাষ্টার ডিগ্রী, পি এইচ ডি এই সবের বিশেষ কোন ভ্যালু নেই – এট আরো বেশী সত্যি যদি আপনি অপারেটিং ইউনিটে (মানে যেখানে একচ্যুয়েলি তেল তোলা হচ্ছে) কাজ করতে ঢুকেন! তাহলে কি বড় বড় ওয়েল কোম্পানীতে আর অ্যান্ড ডি বলে কিছু নেই? সেখানেই কি রিসার্চ হয় না? বিলকুল হয় – অনেক পি এইচ ডি ওয়ালা আছে – তবে কিনা তেল কোম্পানিতে পি এইচ ডি দের জন্য বিশাল কিছু ডিফারেন্স প্যাকেজ নেই। বাকিটা আপনার প্যাশানের ব্যাপার – আপনি যদি ২২ বছর বয়সে চাকুরী করতে ঢোকেন, আর আমি যদি মাষ্টার্স, পি এইচ ডি ইত্যাদি গাঁতিয়ে আরো ৬-৭ বছর পরে সেই একই কোম্পানীতে ঢুকি – তাহলে আপনি আমার থেকে আলরেডি এগিয়ে গ্যাছেন দৌড়ে। তেল ইন্ডাষ্ট্রিতে ৬-৭ বছরের এক্সপিরিয়েন্সের দাম ওই মাষ্টার্স/পি এইচ ডি র সমতুল্য নয়, বরং অনেক বেশী! এও এক না-ইনসাফি! আর তা ছাড়া কি করবেন রিসার্চ করে? আসল মাল তো কিছু পাবলিশ করতে দেবে না – পেটেন্ট নিতে পারেন, তাতে আপনাকে দেবে একটা টোকেন মানি – আপনি না ঘরকা, না ঘাটকা হয়ে থাকবেন। নিজের ফিল্ডে আপনাকে (কোর ডিসিপ্লিন বাদ দিয়ে, ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা বলছি এখানে) কেউ চিনবে না বাইরের জগতে – এদিকে বেশী পয়সাও কামাতে পারছেন না বিনা পি এইচ ডি-র থেকে! তাহলে খামোকা ডিগ্রী নিয়ে হবেটা কি? ভেবে দেখুন ভালো করে –
    যদি আপনি বুঝতে পারেন আপনি কারো চোখের মণি, মানে গিয়ে কোর ডিসিপ্লিন – তাহলে আপনার আচার আচরণে তার বর্হিপ্রকাশ ঘটবে। এটা সব সময় কিন্তু খারাপ জিনিস নয়! সাব-সারফেসে জয়েন করা ছেলে মেয়ে দেখা গেছে এক বছর পরে কোম্পানীতে তাদের বন্ধু একই ডিগ্রী করা সারফেস ছেলে-মেয়েদের থেকে বেশী কনফিডেন্ট! সেই কি তেজ তাদের! আর সাবসারফেস-সারফেস এর মধ্যে জিনিস পত্র নিয়ে নেড়াচাড়ার বিস্তারই আলাদা! আমি শালা সারফেল মেক্যানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ২ সপ্তাহ একটা ভাল্ভ কেনার জন্য ছোটাছুটি করছি যার মূল্য হয়ত ১০০০ ডলার এর থেকে কম – অন্যদিকে আমার বন্ধু ওয়েল ইঞ্জিনিয়ার ১ মিলিয়ন ডলারের ডিসিশন নিচ্ছে টেলিফোনে কলের মাধম্যে! এর পরেও কি আপনি তুরুশ্চু বোধ করবেন না? না করলে আপনি মহাপুরুষ!

    এর পর আছে ট্যাবু – কোন প্রোজেক্ট করতে গেলে সাব-সারফেস পাবলিকেরা বেশী প্রিভিলেজ পায়। ওরা নন-টাচেবল, ওদের চ্যালেঞ্জ করা যাবে না বাইরে থেকে! তাহলে কি ওদের চ্যালেঞ্জ শেসন হয় না? অবশ্যই হয় – সেখানে অন্য সারফেস ডিসিপ্লিন নট্‌-অ্যালাউড, এমনকি মাঝে মাঝে প্রজোক্ট ইঞ্জিনিয়ারও। সাব-সারফেস নিজেরাই নিজেদের চ্যালেঞ্জ করে – নিজেরা রোল প্লে করে চ্যালেঞ্জ শেসন জমায় – নিজেরাই খেলোয়াড়, নিজেরাই রেফারি! সে এক বড় আজব জিনিস – তারা সব মাল নেড়েঘেঁটে দেখবে যে সারফেসের তলায় কিছু আছে কিনা। মানে ড্রিল করে তে ফেসিলিটি বানাবো, সেই পয়সা উঠবে কিনা! তা ভালো কথা – এবার জানতে চান, আচ্ছা ভাই এই যে বলছ তেল আছে ঠিক ঠাক, তা এর কনফিডেন্স লেভেল কেমন? রেগুলার, স্ট্যান্ডার্ড উত্তর হল প্লাস-মাইনাস চল্লিশ শতাংশ! এটা কোন কথা হল? এবার আপনি একটা সারফেস ফেসিলিটি বানিয়ে বলুন তো যে আপনার কনফিডেন্স লেভেল প্লাস-মাইনাস চল্লিশ শতাংশ! পিছনে বাম্বু ঢুকে যাবে! আমাকে প্রসেস টেম্পারেচার প্রেডিক্ট করতে হবে উইথ ইন ২-৫ ডিগ্রীর মধ্যে!

    এইভাবে খেলা যায়! আপনি বলুন যে আপনি খেলবেন না – আপনি বলুন প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারকে যে বাবা, আমাকে সাব-সারফেস থেকে একটু ভালো কোয়ালিটি ডাটা এনে দাও না! আমার মডেলে গার্বেজ ইন – ওদিকে গার্বেজ আউট, ভুল ভাল প্রেডিকশন হলে আমাকে কিন্তু ধরনে পারবে না! এ জিনিস আপনি বলেও কিছু লাভ হবে না। প্রজেক্ট ম্যানেজারদের সাব-সারফেস কে প্রশ্ন করার ধক্‌ই থাকে না? আপনাকে বলতে অ্যাডজাষ্ট করে নিতে! সুপিরিয়র আপনি ইন-ফিরিওরের সাথে অ্যাডজাষ্ট করছেন! এর থেকে বড় তুরুশ্চু আর কি হতে পারে! এখানেও ওরা জিতে গেল! তাই বলছি – তেল কোম্পানিতে কাজ করতে হলে – মাটির তলার জিনিস পত্র নিয়ে কাজ করুন, কোর ডিসিপ্লিনে ঢুকে রাজার মতন বাঁচুন –

    তাহলে এই পর্বের সামারি হল – সাবসারফেসের জিনিস পত্র দেখা যায় না, এদের ঘ্যাম বেশী, মর্যাদা বেশী, এমনকি মাইনেও বেশী। সারফেস জিনিসপত্রে আপনি আমি গাঁতানো ইঞ্জিনিয়ার – প্রোজেক্ট ইঞ্জিনিয়ারের হুমকি, অপারেশনের ধাতানি এবং উপরের বস-দের তেরছা চোখের শিকার। আমার সাব-সারফেস বন্ধু বলে, ওরে পাগলা, আমরা নীচের মাল খুঁজে বের করে গর্ত খুঁড়ে না দিলে তুলবি কি? ইহাই সার কথা – এখানেই ওদের জিত। এমন যদি বলা যেত, ওরে সবই তো বুঝলুম – কিন্তু শুধু খুঁজলে আর গর্ত করে হবে কি, যদি তুলতেই না পারিস! কিন্তু এ জিনিস আপনার মাথাতেই আসবে না – এতো বুদ্ধি আপনার থাকলে আপনি বেশী দিন তেল কোম্পানীতে কাজ করতে পারবেন না। কিছু কিছু জিনিসে বেশী বুদ্ধি না লাগানোই ভালো – আখেরে লাভ হয় –

    ও হ্যাঁ, আর একটা কথা – সাবসারফেস হোক বা সারফেস, তেল কোম্পানীতে একবার ঢুকে পড়তে পারলে সমস্ত অবিচার, অবঞ্চনা সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকুন শোলে সিনেমার বিরুর সেই ডায়লগ মনে করে – “হাম সির্ফ প্যয়সো কে লিয়ে কাম করতে হ্যায়”!

    [ক্রমশঃ]


    পর্ব – ৪
    -----------------------------------------------------------------------------------

    আগের পর্বে সাব-সারফেসকে একটু বেশী চটকানোতে আমার বন্ধু একটু নারাজ হয়ে গেল – বলল, জানিস আমাদের কত দোলচালে থাকতে হয়, আমাদের কত দিক নিয়ে ভাবতে হয়, আমাদের আন-সার্টেনটি কত ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর কি বলি, একটু ড্যামেজ কনট্রোল করার চেষ্টা করলাম। বন্ধু আবার আমার সাথে একটু ফিসলফি মারালো – দ্যাখ, ২ + ২ = ৪ হয়, ৩ + ১ = ৪ আবার ০ + ৪ = ৪ ও হয়। তুই তো শুধু চার দেখছিস, আর তাও সেটা যে ৪ তাই তুই জানবি মাল সারফেসে উঠে এলে। আমরা অনুমান – ক্যালকুলেট করছি ৪ হতে পারে বলে – কিন্তু কি ভাবে যে চার হয়েছে সেটা তো জানি না! আমাদের তাই ‘সিন্যারিও’ বানাতে হয়। ২ + ২ = ৪ হলে যে ভাবে ফিল্ড ডেভেলপ করতে হয়, ৩ + ১ এর বেলায় সম্পূর্ন অন্যরকম – এই খানেই অনিশ্চয়তা, এখানেই আমাদের চ্যালেঞ্জ। বেশীর ভাগ সময়েই আমাদের জিত হয়, আমরা ঠিক বলি – মাঝে মাঝে ছড়াই – তখন গর্ত খুঁড়ে কেবল জল বেরোয়, তেল পাওয়া যায় না!

    আমি ভেবে দেখলাম বন্ধুর কথায় যুক্তি আছে – ফিলসফি আছে। এমন তো আর নয় যে মাটির তিন কিলোমিটার নীচে কোকা কোলার ক্যানের মত সসীম আয়তনের কোন ভান্ডার আছে, আমি ছোট্ট করে ফুটো করে স্ট্র ঢুকিয়ে চোঁ চোঁ করে টেনে নিলাম – দিয়ে ৩৩০ মিলি হয়ে গেলেই বুঝলাম ক্যান শেষ! মাটির নীচে পাথরই পাথর – সেই পাথরের মাঝে ফাঁক, আর সেই ফাঁকের মাঝে গ্যাস, তেল, জল এই সব। সরসরি সেই ভাণ্ডার পরিমাপের কোন উপায়ই নেই, যা করবে সব ইন-ডাইরেক্ট। দুম-দাম বোম (ডাইনামাইট) ফাটিয়ে শব্দ সৃষ্টি করে সেই শব্দের রেসপন্স রেকর্ড করা হয় মাটির তলার বিভিন্ন স্তর থেকে। শব্দ যে ভাবে এক স্তরের বা মাধ্যমের ভিতর দিয়ে ট্র্যাভেল করে, প্রতিফলিত হয়, প্রতিসারিত ইত্যাদি হয় তা অন্য স্তরের বা মাধ্যমের থেকে আলাদা। এবার সেই বিভিন্ন রেসপন্স আপনাকে রিকনস্ট্রাক্ট – ডিকনস্ট্রাক্ট – ডিকোড করে তেল বা গ্যাস পরিমাপ করতে হবে! চাপের কাজ কিনা? শব্দের রেসপন্স ডি-কোড করা এতো সোজা? আমি তো অন্য ঘর থেকেই অনেক সময় বুঝতে পারি না বউ কি বলছে পাশের ঘর থেকে, মাঝে শুধু একটা দেওয়াল! তেলে পরিমাপের ক্ষেত্রে তিন কিলোমিটার গভীরতা জুরে দেওয়াল – ভাবুন এবার! শব্দের দোষ দিলে হবে? ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী শব্দ হল গিয়ে ব্রহ্ম – বুঝবার চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু পুরোপুরি বুঝতে পারবে না কোনদিনও!

    কিন্তু তা বলে সাব-সারফেসের মালকে চিমটি না কেটে ছেড়ে দিলে হবে? সে যতই বন্ধু হোক! আমি চিমটোলাম, তা রিসেন্ট তোদের টিম কবে ছড়িয়েছে? আমাকে বলল তুই ডেস্কে ফিরে গুগুলে সার্চ কর এই টার্ম গুলো দিয়ে – ENI, gas field, Egypt দেখবি দেখাবে যে ENI মাস দু তিন আগে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কার করেছে – মানে বিশাল, কাতার-কেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। আমি বললাম – ভালো তো, তা এর সাথে তোদের ছড়ানোর কি হল! আমাকে বলল, তুই কি জানিস যে এই ফিল্ডটা আগে আমাদের কোম্পানীর ছিল? আমরা সাব-সারফেস ডাটা ইন্টারপ্রেট করে বলেছিলাম যে মাল তলায় কিছু নেই, শুধু ইগ্নিশিয়াস পাথর – ০ + ৪ । সেই শুনে আমাদের কোম্পানী দিল ফিল্ড বেচে – বুড়ো গরু আর রেখে কি হবে! তারপর সেটা ENI কিনে নিয়ে ইন্টারপ্রেট করেছিল কার্বনেট রকে গ্যাস বলে, ২ + ২। এক্সপ্লোর করে দ্যাখে তাদের ইন্টারপ্রিটেশনই ঠিক – মাল গ্যাসে ভর্তি! তাই বলছিলাম সামটাইম ইউ উইন ব্লা ব্লা ব্লা – প্রায় চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল আমার বন্ধুর। গ্যাস ছেড়ে আনন্দই হয় জানতাম এতদিন, গ্যাস ছাড়ার পর এতো দুঃখ পেতে এই প্রথম দেখলাম কাউকে!

    ভুলে যাবার আগে বলে নিই – পৃথিবী ‘তেল’ শেষ হয়ে যাচ্ছে এই কনসেপ্টটি কিন্তু খুবই গোলমেলে। এখনো পর্যন্ত আমরা যে প্রযুক্তি ব্যবহার করছি তাতে করে আমরা পৃথিবীকে তেল-শূন্য করতে পারব না কোন দিন! মাটির নীচে কোন এক রিসার্ভারে মোট যা তেল আছে আমরা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেও গড়ে মাত্র চল্লিশ শতাংশ তুলতে পারি! অর্থাৎ, যদি ১০০ লিটার খনিজ তেল থাকে তলায়, তার চল্লিশ লিটার তুলতেই আমাদের হাঁফ ধরে যায়। তাহলে বাকি ৬০ লিটার কি হয়? প্রশ্ন জটিল – কিন্তু উত্তর তার সোজা – ওই ৬০ লিটার মাল নীচে থেকেই যায়! চালাক ছেলে এবার প্রশ্ন ছুঁড়বে, স্যার, স্যার, আমরা বাকিটা তুলি না কেন? তুলি না কারণ তোলাটা ইকনিমিক্যাল নয় – বাকিটা তুলতে যা খরচা হবে, তেলের দাম তার থেকে কম! ফলতঃ, এই ফিল্ড ছাড়ো এবং আগে বাড়ো। এবার ছেলের বাবা প্রশ্ন করবে, স্যার তাহলে কি আপনি বলতে চাইছেন ওই বাকি পড়ে থাকা তেল তোলা কোনদিনই সম্ভব নয়? স্মার্ট কিড্‌! না ছেলের বাবা, আমি তা বলতে চাই নি – আপনার ছেলে যদি বড় হয়ে এমন কোন টেকনোলজির জন্ম দেয় যা সস্তায় তেল তুলতে পারবে, তা হলে না হয় আমরা আবার ওই ফিল্ডে ফিরে আসব!

    এমনটা কিন্তু বাস্তবে হয়েছে বা হচ্ছে – নতুন টেকনোলজি নিয়ে পুরানো ছেড়ে আসা ফিল্ডে ফিরে আসা। আর তা ছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে – বড় বড় কোম্পানীর বড় বড় ব্যাপার – যত বড় হাতি, তার নাদও তত বড়। জটিল ভাষায় তার নাম ফুটপ্রিন্ট – অনেক সময় হয় কি বড় কোম্পানীর থেকে ছোট কোম্পানী কম খরচে তেল তুলতে পারে। ফলে এমনটাও হয় যে এক ঢাউস কোম্পানী এক ফিল্ড আর চালাতে পারছে না – তাই সেটা বিক্রী করে দেবার অ্যাড দিল ফ্লিপকার্টে – আর আমি ‘ঘোষ অ্যান্ড সনস্‌’ সেটা কিনে নিলাম দুম করে। এই কোম্পানীতে আমি সি ই ও, আমার বউ এইচ আর কাম সেক্রেটারী, সেফটি টিম বলে কিছু নেই – বাড়ির কাজ করার বিশু আর ভোমলা যথাক্রমে আমার ওয়েল ইঞ্জিনিয়ার এবং ফেসেলিটি ম্যানেজার। ব্যাস – সাব-সারফেস, সারফেস সব কী-ডিসিপ্লিন কভারড্‌, এবার তোল তেল!

    পৃথিবীতে যেমন বিশুদ্ধ চাকুরী বলে কিছু নেই – তেমনি মাটির নীচে বিশুদ্ধ তেল বলে কিছু হয় না। ক্রুড ওয়েল নিয়ে আলোচনা পরে – এখন আমি যেটা বলতে চাইছি তা হল, আপনি চাইলেও কেবলমাত্র তেল তুলতে পারবেন না মাটির নীচে থেকে – জল আসবেই তেলের সাথে, ফাউয়ের মত। প্রথম দু-এক বছর হয়ত ভালোই তেল তুললেন, কিন্তু তারপরেই জলের পরিমাণ বাড়তে থাকবে – ক্রমশঃ বেড়ে ৬০ শতাংশ, ৭০ শতাংশ, ৮০ শতাংশ জল উঠবে। মানে, ১০০ লিটার মাল মাটির তলা থাকে তুলতে তাতে জল ৮০ লিটার! এবার কতটা জল আপনি বরদাস্ত করবেন, সেটা আপনার ব্যাপার, আপনার কোম্পানীর ইকনিমিক্সের ব্যাপার। ডাঙাতে এমন তেলের ওয়েল ও আছে যেখানে ৯৫ শতাংশ জল উঠছে! কিন্তু অফসোরে ওয়েল চালু রাখার খরচ বেশী, তাই অনেক সময় বেশী জল বেরোলে সেই ওয়েল পরিত্যাগ করে দিতে হয়। তুমি ভালো দুধ দিয়েছে এতদিন, এবার তোমার বানপ্রস্থে যাবার পালা – এর মধ্যে কোন ইমোশ্যনাল ব্যাপার নেই!

    এবার দেখা যাক মাটির তলায় তেল/গ্যাস জড়ো হবার জন্য কি কি সহায়ক পরিবেশ থাকার দরকার। রিসার্ভার বেশীর ভাগ সময় তৈরী হয় স্যান্ডস্টোন দিয়ে, যার মূল উপাদান হচ্ছে কোয়ার্জ, মানে পাতি বালি SiO2, সিলিকা। এই বালির দানার মধ্যেকার মধ্যে যে ফাঁক বা ছিদ্র থাকে সেইখানে জমে ওঠে হাইড্রোকার্বন। এই রিসার্ভারের পোরোসিটি হল রিসার্ভারের মোট আয়তনের এক খুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র। স্বাভাবিক ভাবেই হাইড্রোকার্বন কিন্তু রিসার্ভারের মধ্যে ঢুকতে বা বেরোতে পারবে না যদি না এই ছিদ্রগুলি পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে। এই জিনিসকে বলা হয় রিসার্ভার পারমিয়েবিলিটি যা হল মূলত ছিদ্রগুলির মধ্যে সংযুক্ততার পরিমাপ। মোটকথা ফুটো এক জরুরী জিনিস –

    এবার দরকার সীল (seal) বা ঢাকা। রিসার্ভার সীলড থাকতে হবে এমন এক পাথরের আস্তরণ দিয়ে যে পাথর পারমিয়েবল নয়, মানে ওই পাথরের স্তরে ছিদ্রগুলি পরস্পরের সাথে সংযুক্ত নয়। এই সীল যদি না থাকে তাহলে হাইড্রোকার্বন চলাফেরায় বাধা দেবার কেউ থাকবে না। নীচের চাপেতে ক্রমশঃ হাইড্রোকার্বন মাটির উপরে উঠে এসে – হুস্‌ - ভ্যানিস! কোন কোন রিসার্ভারের এই সীল তৈরী হয় ‘সেল’ নামক পাথুরে জিনিস দিয়ে যার আদি উৎপত্তি হচ্ছে কাদার পিন্ড! আবার অনেক ক্ষেত্রে এই সীল তৈর হয় অজৈব রাসায়নিক মৌল যেমন হ্যালাইট (NaCl) বা অ্যানহাইড্রাইট (CaSO4) যা সমুদ্রে জল শুকিয়ে তৈরী হয়েছে।

    উপাদান হল, সীল হল – এবার চাই হাইড্রোকার্বন ধরে রাখার ফাঁদ (Trap)। এই ফাঁদ হতে হবে থ্রি-ডাইমেনশনাল যা কিনা এক আধার রূপে কাজ করবে এবং হাইড্রোকার্বনকে অন্য জায়গায় গড়িয়ে চলে দেবে না। মূলত তিন ধরনের ট্র্যাপ হয় – স্ট্রাকচারাল (Structural) ট্র্যাপ, স্ট্রাটিগ্রাফিক (Stratigraphic) ট্র্যাপ এবং এই দুইয়ের মিশ্রণ। স্ট্রাকচারাল ট্র্যাপ তৈরী হয়েছে পৃথিবীর উপরের খোলসের পাথরের স্তরে ভাঁজ খেয়ে। স্ট্রাটিগ্রাফিক তৈরী হয়েছে পাললিক (sedimentary) শীলার মধ্যে বিভিন্নতার কারণে যে কিনা ফেঁদেছে পারমিয়েবল নয় এমন বাধা, শুদ্ধ বাংলায় অভেদ্য বাধা। আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রায় ৭৮% খনিজ তেল পাওয়া গেছে এই স্ট্রাকচারাল ফাঁদে, ১৩% পাওয়া গ্যাছে স্ট্রাটিগ্রাফিক ট্র্যাপে।

    টুইষ্ট হল, হাইড্রোকার্বন কিন্তু রিসার্ভারে জন্মায় না! এরা তৈরী হয় ‘সোর্স রক্‌’-এ (Source Rock) এবং ধীরে ধীরে চলে আসে রিসার্ভারে। কৃষ্ণ-র মতন ব্যাপার স্যাপার আর কি – বাড়ছে গকুলে, পরে কোথায় যাবে যে জানে! সোর্স রকের আবার মূল উপাদান হল শেল (shale) – কারণ এই সেল-এর মধ্যেই ৯০ শতাংশ জৈব পদার্থ জমা থাকে বাকি পাললিক মালপত্রের তুলনায়। আর এই জৈব পদার্থই হল প্রাণ ভোমরা – এর থেকেই তেল – এর থেকেই গ্যাস। প্রশ্ন হল – তাহলে সোর্স রক নিজে কেন ভালো রিসার্ভার নয়? ওই যে, এর মূলে হল ফুটোর সংযুক্ততা – মানে পারমিয়েবিলিটি – সোর্স রকের পারমিয়েবিলিটি খুব একটা ভালো নয়, তাই এরা ইকনোমিক রিসার্ভার গঠন করতে পারে না। যদি নাছোর বান্দা হয়ে আপনি সোর্স রক থেকে তেল বা গ্যাস উৎপাদন করতে চান, তাহলে আপনাকে সেই রক ১০০ ডিগ্রীর বেশী গরম করতে হবে অনেক অনেক সময় ধরে – এতো বেশী সময় যে সেই সময়কে আপনাকে জিওলজিক্যাল টাইম দিয়ে রিপ্রেজেন্ট করতে হবে!

    সোর্স রকে হাইড্রোকার্বন একবার ম্যাচিওর হয়ে গেলেই তার মধ্যে একটা পালাই পালাই বাই চাপবে – এরা সোর্স রক থেকে মুক্ত হয়ে সারফেসে উঠার চেষ্টা করবে কারণ এদের ঘনত্ব জলের থেকে কম যা কিনা পাললিক শীলাকে সম্পৃক্ত করে রাখে। এই যাবার পথে যদি হাইড্রোকার্বন এমন এক বাড়ি পেয়ে যায় যার ভিত আছে, সীল (উপরে বর্নিত) আছে, থ্রী-ডাইমেনশনাল স্ট্রাকচার আছে, তাহলে সে বিশ্রাম নেবে সেখানে – বিশ্রাম নিতে গিয়ে ভেতো বাঙালির মত ক্রমশঃ গেড়ে বসবে এবং তামিলদের মত স্বজাতীয় তেল অ্যাকুমুলেট করবে। কিন্তু যদি মনমত জায়গা না পায়, হাইড্রোকার্বন কিন্তু কারো জন্য ইন্তেজার করবে না – সারফেসে এসে পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে যাবে। আপনি বললে হয়ত বিশ্বাস করবেন না এই ভাবে প্রায় ৯৫ শতাংশ হাইড্রোকার্বন আমরা হারিয়েছি! তাদের ঠিক মত ঘর দিতে পারি নি জমিয়ে বসার জন্য – তারা আমাদের ছেড়ে গ্যাছে। আজকালকার আমরা সেই বাকি পড়ে থাকা ৫% নিয়ে ফাইট দিচ্ছি!

    এর পরের কেস হল টাইমিং – সময় খুব গুরুত্ব পূর্ণ ব্যাপার। যেমন গার্লফ্রেন্ড (বা বয়ফ্রেণ্ড) বিষয়ক পুরো প্যাকেজের মজা পাওয়ার জন্য বয়ঃস্বন্ধি এবং যৌন বোধ আগে জাগা জরুরী – ঠিক তেমনি হাইড্রোকার্বন ম্যাচিওর এবং সোর্স রক থেকে মাইগ্রেট করার আগে রিজার্ভার তৈরী থাকা জরুরী। মাল ফেঁকার আগে মাল যেখানে ফেলবেন সেটা তৈরী থাকা জরুরী – তা সে মানব জীবনই হোক বা হাইড্রোকার্বন। তবে আইনষ্টাইন বলার আগে থেকেই সময় গোলমেলে জিনিস ছিল – আমাকে সেদিন একজন বলল আমার বিড়ালের বয়স ৫০ বছর! আমি চমকে গেলাম – কি বিড়াল রে ভাই! পরে জানলাম সে হল ৫০ ক্যাট ইয়ার, মানে মনুষ্য জীবনের ৮ বছরের ইক্যুইভালেন্ট। ঠিক তেমনি হাইড্রোকার্বন ফর্মেশন আমাদের চেনা সময়ের বিস্তার অনুযায়ী অনেক অনেক অনেক ক্ষণ ধরে হয়েছিল – সেই টাইমস্কেল নিয়ে আলোচনা পরের বার।

    এই পর্বের সামারি – ফুটো খুবই গুরুত্বপুর্ণ এক জিনিস, সময় আরেক গুরুত্বের ব্যাপার। সময় পরিপক্ক হলে তবেই ফুটো কাজে আসবে – তবে শুধু আবার সময় ও ফুটো থাকলেই হবে না, তার সাথে পরিবেশও চাই। সময়ে ফুটো পেলেন, সাথে অনুকূল পরিবেশ, তবেই না তেলের গল্প আসবে!

    [ক্রমশঃ]


    পর্ব – ৫
    -------------------------------------------------------------------------------------------------

    পৃথিবীর বয়স হল গিয়ে মোটামুটি সাড়ে চার বিলিয়ন বছরের মত – অবশ্য যদি না আপনি গোঁড়া খৃষ্টান ধর্মালম্বী হন যাঁরা বিশ্বাস করেন পৃথিবী ছয় দিনে তৈরী হয়েছিল, তাও মোটে ছয় হাজার বছর আগে! এতে তেমন কোন প্রবলেম নেই, কনট্রাডিকশনও নেই – কারণ ওই বিশ্বাসে মানুষ এবং তেল দুই ঈশ্বর দ্বারা তৈরী! অতিপ্রাকৃতিক এর বদলে প্রাকৃতিক জিনিসে বিশ্বাস করতে চাইলে আপনাকে শেখানো হবে যে সেই সারে চার বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীর উপরিভাগে নানা পরিবর্তন হয়েছে যার ফলঃস্রুতি হিসাবে গাদা গাদা পাথরের রকমারি লেয়ার তৈরী হয়েছে। রিলেটিভ বা অ্যাবসলিউট ডেটিং পদ্ধতি ব্যবহার করে এই পাথরের লেয়ারের বয়স জানা যায়।

    অ্যাবসলিউট পদ্ধতিতে সেই সব পাথরের লেয়ারের বয়স পরিমাপ করা যায় যাদের মধ্যে রেডিও-অ্যাক্টিভ আইসোটোপ আছে। আর সে সব পাথরের লেয়ারে তেমন আইসোটোপ নেই, তাদের জন্য ব্যবহার করতে হবে রিলেটিভ পদ্ধতি। রিলাটিভ পদ্ধতির মূল তত্ত্ব কথা হল – ছেলের বয়স বাপের থেকে বেশী হতে পারে না! পাথরের স্তর আসলে জমে উপর উপর, প্রবীণের উপর চেপে বসে নবীন। এবার যদি আপনি নবীনের নয়, কিন্তু প্রবীণের বয়স জানতে পারেন – তাহলে রিলেটিভ টেকনিক ব্যবহার করে আপনি মোটামুটি বয়স অনুমান করতে পারবেন নবীনেরও।

    ফসিল লব্ধ প্রমাণ ইঙ্গিত দেয় যে এই পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি প্রায় ৬০০ মিলিয়ন বছর আগে হয়েছিল, মানে সে সেই প্রিক্যামব্রিয়ান (Precambrian) যুগের শেষের দিকের কথা। জিওলজি টাইমস্কেলের নামও তেমনি – জামকালো যাকে বলে। যুগ – কাল সব মিশে গিয়ে একেকার – মিলিয়ন ছাড়া কথাই নেই। চারটে প্রধান যুগ ধরুন গিয়ে Precambrian, Paleozoic, Mesozoic আর Cenozoic। প্রত্যেক যুগের আন্ডারে আবার আছে কাল – আমাদের চেনাশুনা নাম জুরাসিক কাল যেমন পড়ে মেসোজয়িক যুগের মধ্যে – আর এই জুরাসিক কাল স্থায়ী হয়েছিল ৫৪ মিলিয়ন বছর এবং যা প্রায় ১৩৬ মিলিয়ন বছর আগে খেলা গুটিয়েছে। আল্পস আর হিমালয় তৈরী হয়েছিল সেনোজয়িক যুগে, টার্সিয়ারি কালে, প্রায় ২ মিলিয়ন বছর আগে। আমাদের ইন্টারেষ্টের খনিজ তেলের সোর্স রক বেশীর ভাগ টাই ফর্ম করেছিল প্রায় ১৪৫-৬৫ মিলিয়ন বছরের মধ্যে মেসোজয়িক কালে – মানে ডাইনোসারেরা পুরোপুরি টেঁসে যাবার ঠিক আগে। জিওলজি বলছে, পৃথিবী থেকে মাস এক্সটিনশনের পর আর কোন সোর্স রক জমা পড়ে নি। যে সব রক জমা পড়েছে Tertiary, Cretaceous, Permian, Pennsylvanian, Mississippian, Devonian, এবং Ordovician কালে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বেশী দেখা গেছে। অন্যদিকে Jurassic, Triassic, Silurian, and Cambrian কালের পাথর কম উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন আর Precambrian age সময়ে জমা পড়া পাথর থেকে তেল বেরোতে প্রায় দেখাই যায় না।

    এবার অধৈর্য্য ব্যক্তি প্রশ্ন করতে পারে, সবই তো বুঝলুম – সময়ে গেল, পাথর হল – কিন্তু, আসল মাল পেট্রোলিয়াম কি ভাবে তৈরী হল? পেট্রোলিয়াম মূলত জৈব পদার্থ থেকেই তৈরী হয়েছে। কিন্তু সেই নিয়েও গোলযোগ – এই পৃথিবীতে, বিশেষ করে অ্যাকাডেমিক জগতে একমাত্র থিওরী বলে কিছু হয় না – সব কিছুর কাউন্টার থিওরী আছে, এমনকি আছে কনস্পিরিসি থিওরীও! পেট্রোলিয়াম জন্মের দুই মেন থিওরী হল – ১) Abiogenic theory আর ২) Biogenic Theory। সেই সব থিওরী এই লেখায় মারানোর কোন মানে হয় না – যারা ডিবেট করার তারা ডিবেট করতে থাকুক, আর সাথে কনফারেন্স গিয়ে লেকচার। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, আমাদের জন্মের জন্য অক্সিজেন যেমন জরুরী, পেট্রোলিয়ামের জন্মের জন্য তা কিন্তু নয়! বরং ঠিক উলটো – পেট্রোলিয়ামের জন্মের জন্য অক্সিজেনহীনতা খুবই জরুরী।

    তা হলে বাকি রইল কি? চাপ আর তাপ – এছাড়া আর কি? চোখ বন্ধ করে মনে করুন ক্লাস সেভেন – এইটের ভূগোল। তখন থেকে চাপের-তাপের আইডিয়ার তেমন কোন পরিবর্তন হয় নি পেট্রোলিয়ামের জন্মের পরিপেক্ষিতে। জৈব বস্তুর সাথে চাপের-তাপের কি হইতে কি হইয়া গেল – আর আমরা পেলাম পেট্রোলিয়াম! জৈব বস্তু হিট খেয়ে নাকি কেরোজেন (kerogen) এ প্রথমে পরিণত হয়েছিল, আর সেখান থেকে পেট্রোলিয়াম। মেরিন অ্যালগী থেকে এসেছে হালকা, উচ্চ কোয়ালিটির তেল (গ্যাসোলিন), মিশ্র মেরিন জৈব পদার্থ থেকে প্রধানত এসেছে ক্রুড অয়েল ও কিছু গ্যাস আর ডাঙার গাছ পালা জৈব পদার্থ থেকে এসেছে গ্যাস। এটা আমরা সবাই জানি ক্রুড অয়েলের গুণমান সব জায়গায় এক নয়! এখন রিজার্ভার এখানে রয়েছে বলে সারাজীবনই এখানে ছিল এমন তো কোন কথা নেই! আজকের সমুদ্রের নীচের রিজার্ভার হয়ত কোন একদিন ডাঙায় ছিল এবং ভাইস ভার্সা। আর তাছাড়া তেলের কোয়ালিটি নির্ভর করবে ওই কেরোজেন থেকে কিভাবে মাল ম্যাচিওর করেছে, চাপ-তাপ-গভীরতা-রক প্রপার্টি ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে। জন্ম একজায়গায় হলেই এন্ড প্রোডাক্ট যে এক রকম হয় না – এটা আমাদের বাস্তব জীবনের থেকে আর কেই বা ভালো জানবে?

    তেলের জন্ম নিয়ে আর বেশী ঘাঁটাঘাঁটি করব না – উৎসাহী ব্যক্তিরা এই ব্যাপারে গুগুল সার্চ করে দেখতে পারেন। আর তা ছাড়া থিওরী বেশী হয়ে গেলে এই লেখা আর্ট ফিল্ম হয়ে যাবে – সবাই ভাববে কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কেউ পড়ে দেখার সাহস করবে না। তাই চলে আসা যাক পেট্রোলিয়াম জিনিসটার নিজের গঠন সংক্রান্ত দু-চার কথায় – এ মাল আসলে কি জিনিস? প্রায় ১২০০ রকম হাইড্রোকার্বন যৌগ আছে এই পেট্রোলিয়াম বস্তুটির ভিতরে। একটি যৌগের একটি অণুর (molecule) ভিতরে কয়টি কার্বন অ্যাটম আছে সেই অনুযায়ী ভাগ করা হয় পেট্রোলিয়ামকে এবং সেই ভাবে কাটাছেঁড়া করে মোট সাত বিভাগে ভাগ করা গেছে (এখানে C হল গিয়ে কার্বন, আর পাশের নম্বরটি উল্লেখ করে কয়টি কার্বন পরমাণু আছে)

    C1-C3: গ্যাস
    C4-C10: গ্যাসোলিন
    C11-C13: কেরোসিন
    C14-C18: ডিজেল
    C19-C25: গ্যাস ভারী গ্যাস অয়েল
    C26-C40: লুব্রিকেটিং তেল
    C40 এর উপরে:গ্যাস

    পেট্রোলিয়াম এবং তার থেকে জাত বস্তুর বঙ্গানুবাদ করতে গিয়ে আমি নিজেও কনফিউজড। ক্লীয়ার করে নেওয়া ভালো যে আমি এই প্রবন্ধে পেট্রোলিয়াম বলতে ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত তেল) এবং ন্যাচারেল গ্যাস সমষ্টিকে বোঝাচ্ছি। এটা ঠিক শ্রেণী বিভাগ কিনা বলতে পারব না – তবে বোঝার সুবিধার জন্য ঠিক আছে বলেই আমার মনে হয়। আসলে জৈব বস্তু অধঃক্ষিপ্ত হয়ে (organic sediments) তিন ধরণের কার্বন-জাত খনিজ মাল তৈর করেছে – গ্যাস, তরল ও কঠিন। গ্যাসের মধ্যে পড়ছে গিয়ে ন্যাচারেল গ্যাস; তরলের মধ্যে পড়ছে পেট্রোলিয়াম ও টার-স্যান্ড বিটুমিন; কঠিনের মধ্যে পড়ছে কয়লা ও অয়েল শেল। এর মধ্যে গ্যাস ও তরলকে ধরা হয় প্রাকৃতিক ভাবে প্রাপ্ত হাইড্রোকার্বন হিসাবে। আর কয়লা এবং অয়েল শেল থেকে হাইড্রোকার্বন বানাতে গেলে কৃত্রিম পদ্ধতির অবলম্বন দরকার। তাহলে দেখছেন, পেট্রোলিয়াম বলতে কেবল তরলকেই বোঝানো উচিত বৈজ্ঞানিক ভাবে – কিন্তু আমি এই প্রবন্ধে লিবার্টি নিয়ে ন্যাচারেল গ্যাস ও ক্রুড অয়েল দুইকেই পট্রোলিয়াম বলে চালাচ্ছি মাঝে মাঝে – তবে গ্যারান্টি, এই কনফিউশনের জন্য তেল ব্যবসা উপর উপর বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না।

    যখন অপরিশোধিত তেল এক রিজার্ভার থেকে পাম্প করে তুলে নেবার মত অবস্থায় থাকে এবং যার রঙ ঘন কালো থেকে হালকা রঙের বয়ে চলা তরলের মত দেখায় সারফেসে, সেই জিনিসকেই বলা হয় “প্রচলিত অপরিশোধিত তেল”। কোন কোন দেশের কাছে এই তেল আছে, কারা সবচেয়ে বেশী উৎপন্ন করে এবং কারাই বা সবচেয়ে বেশী তেল ব্যবহার করে সেই সব নিয়ে আলোচনা পরে করা যাবে। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে আমেরিকা প্রায় তার প্রয়োজনের ৬০-৬৫ ভাগ তেল আমদানী করে দিন চালায় (বা চালাত) আর এর ফলে আমেরিকা হয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল আমদানীকারি এবং তার সাথে ব্যবহার কারী দেশও। এর সবের ফলে তেল ব্যবসার সাথে ঢুকে গেছে রাজনীতি, যুদ্ধু – সেই প্রসঙ্গেও দু-চার কথা পরে।

    এটা মনে রাখা দরকার যে, আমেরিকাই হোক বা ভারত, আজকের রিফাইনারী থেকে প্রাপ্ত পরিশোধিত তেলের গুণমাণ আজ থেকে ৫০ বছরে আগের তেলের থেকে অনেক ভালো এবং আলাদা। আগে হয়ত একটা রিফাইনারী কেবল এক ধরণের তেল পরিশোধন করতে পারত, কিন্তু আজকাল একই রিফাইনারীকে নানা ধরণের তেল পরিশোধন করতে হয় – এটা কিন্তু চয়েস নয়, বেঁচে থাকার তাগিদ। ভালো কোয়ালিটির অপরিশধিত তেল ক্রমশঃ কমে আসছে – এখন সেই সব তেলের পরিমাণ বাড়ছে যার সাথে প্রচুর ভেজাল বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস পত্র মিশে থাকে। সেখান থেকে তেল পরিশোধন করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ – নতুন টেকন্যলজি চাই – নিদেন পক্ষে পুরানো মেশিন পত্রের আপগ্রেড। এই সব ভজকট অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে ব্যবসা –

    ক্রুড অয়েল যত ভারী হবে, চ্যাটচ্যাটে হবে তাকে পরিশোধন করে কাজের ব্যবহারের তেল বানানো তত কঠিন হয়ে যায়। তেলের ঘনন্ত্ব মাপা হয় সাধারণত যে পরিমাপে তার নাম হল API গ্র্যাভিটি। API গ্র্যাভিটি কম মানে তেল বেশী ভারী হয়ে যাওয়া, এই সব ভারী তেলে আবার দেখা যায় সালফার (গন্ধক) বেশী থাকে। সালফার খুব খতরনাক জিনিস, কেউই চায় না সে থাক – কিন্তু তবুও থাকে। তাই নানা পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে সালফার-কে তেল থেকে আলাদা করা হয় – এমন বাজে তেলও আছে যেখান থেকে এই আলাদা করা সালফার টন টন জমা হয় – এবার ফেলবে কোথায় মালকে? তাই সেই সালফার থেকে বানানোর চেষ্টা করা হয় আমাদের কাচজের কিছু জিনিস – সালফার থেকে নাকি কনক্রীট বানানো হচ্ছে – সালফার দিয়ে বানানো হচ্ছে চলার রাস্তার ট্র্যাক।
    সাধারণত প্রচলিত হালকা বাদামী সবুজ – কালো রঙের অপরিশোধিত তেলের স্পেসিফিক গ্র্যাভিটি থাকে ০.৮১ থেকে ০.৯৮৫ এর মধ্যে এবং বয়েলিং পয়েন্ট থাকে (C1 হতে C4 গ্যাস ছাড়া) বিচরণ করতে পারে ২০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড থেকে ৩৫০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত। এই সব তেলের ধর্মের উপর নির্ভর করে পরিশোধন হয় তেলের এবং আলাদা করা হয় কেরোসিন, গ্যাস অয়েল, আরো উচ্চ গলনাঙ্কের মালপত্র, এমনকি খুব থকথকে ও অনুদ্বায়ী লুব্রেকেটিং অয়েল/অ্যাস্ফাল্ট। পৃথিবীর নানা জায়গায় প্রাপ্ত অপরিশোধিত তেলের ধর্ম আলাদা – তেলের উৎপাদনকারী দেশে জন্মানো এক ভ্যাগের ব্যাপার, আরো ভ্যাগের ব্যাপার ভালো তেল তোলা দেশে জন্মানো! সোনার চামচ থেকে প্ল্যাটিনাম চামচের ডিফারেন্স আর কি!

    ন্যাচারেল গ্যাস হচ্ছে নানা গ্যাসের মিশ্রণ যার প্রধান উপাদান হল মিথেন (CH4), তবে এর সাথে মিলে মিশে থাকে আরো অনেক প্রকৃতির দাহ্য গ্যাস এবং অনেক সময় নন-হাইড্রেকার্বন যৌগও! ন্যাচারাল গ্যাসের নিজের কোন বিশিষ্ট গন্ধ নেই ও এর প্রধান ব্যবহার হল জ্বালানী হিসাবে। তবে ন্যাচারাল গ্যাস থেকে ক্যামিক্যাল বা তেল ও বানানো যায়! ন্যাচার‍্যাল গ্যাস ক্রুড অয়েলের সাথে মাটির নীচে রিজার্ভারে বা নিজে একাই থাকতে পারে ফুটো যুক্ত পাথরের ফাঁকে ফাঁকে। যদি গ্যাস তেলের সাথে মাটির নীচে একসাথে থাকে, তাহলে গ্যাস তৈরী করে ‘গ্যাস ক্যাপ’, যা কিনা তেলের লেয়ার আর ‘ক্যাপ রকের’ মধ্যবর্তী জায়গাটা। আবার নীচে যদি চাপ বেশী হয়, তাহলে গ্যাস গুলে যাবে (dissolve) কিছুটা তেলের মধ্যে – এবার মাটির উপরে উঠে আসার সময় চাপ ক্রমশ কমতে থাকবে এবং তেল থেকে গ্যাস বেরোবে। আবার ফিরে আসা যাক কোকা-কোলার ক্যানের সাথে তুলনায় – ওই ক্যান থাকে প্রায় ৩ বার চাপে (3 atm) এবং সেই চাপের জন্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস গুলে থাকে চিনি গোলা বাকি জলটায়। এবার যেই আপনি ক্যান খুললেন, ৩ বার থেকে চাপ দুম করে কমে গেল ১ বার – গ্যাসের সলিউবিলিটি জলে কমে গেল – ফলে ভুস ভুস করে বেরিয়ে এল গ্যাস, আপনি খুশী, আপনার বাচ্চাও আনন্দিত!

    গ্যাস নিজে তেলের সাথে আছে, নাকি একা – তার উপর নির্ভর করে গ্যাসকে আবার অনেক ভাগে ভাগ করা হয়, নন্‌-অ্যাসোসিয়েটেড গ্যাস (একা একা), অ্যাসোসিয়েটেড গ্যাস (তেলের সাথে)। এছাড়ার আছে লীন গ্যাস, ওয়েট গ্যাস, ড্রাই গ্যাস, সাওয়ার গ্যাস (যাতে H2S আছে) ইত্যাদি – এত্তো সব ডিটেলস আমাদের না জানলেও চলবে আপাতত। শুধু জেনে রাখুন আপনি বাড়িতে যে এল পি জি ব্যবহার করছেন তার মূল উপাদান হল প্রোপেন (C3H8) এবং বিউটেন (C4H10), সাথে কিছু পরিমাণের ইথেন (C2H6) এবং পেন্টেন (C5H12)। অন্যদিকে গ্যাসোলিন হল গিয়ে মূলত পেন্টেন (C5H12) এবং তার সাথে আরো ভারী হাইড্রোকার্বনগুলি।

    ব্যাস হয়ে গেল – তেলের এবং গ্যাসের মূল উপাদান নিয়ে যা জানার আপনি জেনে গেলেন – এই দিয়ে আপনি অনেক আসর গরম করার মশালা (বা বউকে জ্ঞান দেওয়া) পাবেন, ট্রেনে ডেলি-প্যাসেঞ্জার হলে তো আর কথাই নেই – যা দিলাম সারা জীবনে ভাঙিয়ে শেষ করতে পারবেন না!

    পরের পর্বে দেখা যাবে মাল কবে থেকে, কিভাবে তোলা চালু হল – কারাই বা এটা করল –

    [ক্রমশঃ]


    পর্ব – ৬
    ---------------------------------------------------------------

    খুব বেশী তর্ক-বিতর্ক না করেও এটা মোটামুটি বলা যেতে পারে যে, পেট্রোলিয়াম এবং তার সম্পর্কিত প্রযুক্তি আরো ৫০-৬০ বছর হয়ত টেনে দেবে মানব সভ্যতার প্রধান শক্তি সরাবরাহক হিসাবে। অন্তত যতদিন না অন্য পরিবর্ত প্রযুক্তি আবিষ্কার এবং ব্যবহৃত হওয়া শুরু হচ্ছে কমার্শিয়াল ভাবে। এই নিয়ে ইদানিং কালে হই-চই কম হয় না। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে বেশীর ভাগ অলটারনেট এনার্জি সোর্স নিয়ে আলোচনাই অসম্পূর্ণ দেখা যায়। এর মূল কারণ নানাবিধ – হয়ত যিনি লেখাটি লিখেছেন তাঁর কমার্শিয়াল মার্কেট নিয়ে কোন ধারণা নেই, ল্যাব-এ কোন টেষ্ট সফল হলেই সেই নিয়ে হইচই। যেন আমি আজকে ল্যাবে নতুন কিন্তু বের করলাম, আর আপনি কালকে সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গাড়ি চাপা শুরু করবেন! অনেকে সফট-ওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনের সাথে এই জাতীয় প্রযুক্তি ব্যবহার এবং ডেভলপমেন্ট ধাপ গুলোর সাথে ঘুলিয়ে ফেলেন। অনেকের আবার লুকানো অ্যাজেন্ডা থাকে – ইউনিভার্সিটি তে ফান্ডিং এর ব্যাপার আছে। নতুন টেকনলজির দরকার যত বেশী করে বোঝাতে পারা যাবে – তত বেশী ফাণ্ডিং এর চান্স। অনেকের আবার এর ভিতরের পলিটিক্স জানা থাকে না – অনেকে আবার কনস্পিরিসি থিওরী নিয়ে মাথা ঘামায়। মোটকথা অলটারনেট এনার্জি নিয়ে অর্ধসত্য, কিছুটা সত্য এবং বেশীটা মিথ্যা – এমন খবরে মার্কেট ছেয়ে গেছে। কোনটা বিশ্বাস করবেন সেটা নির্ভর করে আপনি কোন গ্রুপের লোক।

    অনেকে ভাবে যে এখন কার বড় বড় তেল কোম্পানীর নাকি রাতের ঘুম চলে যায় এটা ভেবে যে পরিবর্ত শক্তি আবিষ্কার হলে কি হবে! কিন্তু বিশ্বাস করুন – মূল ব্যাপার এমন নয় মোটেই! অবশ্যই সেই নিয়ে আলাপ আলোচনা চলে তেল কোম্পানীতে – কিন্তু এই মুহুর্তে তাদের হাতে আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার সমাধান করার রয়েছে – পরিবর্ত শক্তি কি ভাবে বাম্বু দিচ্ছে সেই নিয়ে ঘুম নষ্ট না করে! যা তেল আছে তা যদি তুলতে পারি ঠিক ঠাক, পরিবর্ত শক্তি বাম্বু দেওয়ার মত জায়গায় আসতে দেরী সইবে। আরে ভাই, তেল কোম্পানী কি দাবী করে চলেছে নাকি বিজ্ঞাপন দিয়ে যে তাদের বিজনেস নিট অ্যান্ড ক্লীন? নাকি বললেই আপনি বিশ্বাস করবেন? আগেই বলেছি, তেল ব্যবসার মত কলঙ্কিত ব্যবসা মনে হয় আর নেই! আর এই তেল কোম্পানী গুলিতে চাকুরী করলে তাদের যে পরিমাণ অ্যান্টি-কোরাপশন, অ্যান্টি-ব্রাইবেরী, অ্যান্টি-ট্রাষ্ট ট্রেনিং-এর সম্মুখিন এবং ডিক্লিয়ারেশন দিতে হয় তা মনে হয় আর অন্য কোন ইন্ডাষ্ট্রিতে কাজ করলে দিতে হয় না।

    তাই বলছি এই অবস্থায় আর বার বার তেল কোম্পানীর অ্যাজেন্ডা আছে – তেল কোম্পানী সর্বগ্রাসী – তেল কোম্পানী কনস্পিরেসী থিওরীতে পার্ট নেয় – তেল কোম্পানী পৃথিবীর পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছে, এই সব কথা বলে আর নতুন কিছু ভ্যালু অ্যাড করা যায় না! এ তেল কোম্পানীর দোষ নয়, এ আমাদের নিজেদের দোষ – আমাদের তেল-এর উপর নির্ভর হয়ে যাবার দোষ। নিজেরা এই নির্ভরতার বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারলে এমন চলবে – আর যদি বেরিয়ে আসতে পারি, তা হলে এত বেশী হই-চই করার দরকার হবে না – তেলের বাতি এমনি নিভবে। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, আমরা কি করতে পারি? ক্ষুদ্র হলেও কি কিছু কনট্রিবিউট করতে পারি যাতে করে এই তেল নির্ভরতার খপ্পর থেকে মুক্ত হতে পারি? জানি না এই খপ্পর থেকে একেবারে মুক্ত হতে পারব কিনা – কাগজে, ইণ্টারনেটে ফাটানো আর বাস্তব – এই দুই বড় আলাদা জিনিস – তবে কিছু তো করতেই পারি – সেই নিয়ে আলোচনায় আমরা যাব আরো কিছু পরে।

    পুরান, উপকথা, ধর্মগ্রন্থ বাদ দিলে আধুনিক কালে তেলের যুগ শুরু হয়েছিল প্রায় নিশ্চিত ভাবেই ১৮৫৯ সাথে আমেরিকার পেনসিলভিনিয়ায় যখন কর্নেল এডুইন ডেরেক মাটির ৬৯ ফুট গভীরতা থেকে তেল আবিষ্কার করেছিলেন। সেই তল্লাশির মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘রক অয়েল’ আবিষ্কার যে রিফাইন করে কিনা কেরোসিন বানানো যাবে বাতি জ্বালানোর জন্য। ডেরেকের প্রথম আবিষ্কারে তেল বের হচ্ছিল দিনে ১৫ ব্যারেল মত। এটা আমাদের ভাবতে খুব একটা অসুবিধা হবার কথা নয় যে এই আবিষ্কারের সাথে সাথে তেল তোলার হিড়িক কেমন বেড়ে যেতে পারে! সে এমনই হিরিক যে আবিষ্কারের এক বছরের মধ্যে পেনসিলভিনিয়ায় তেল তোলা হতে লাগল দিনে পাঁচ লক্ষ ব্যারেল, দুই বছরের মধ্যে সেই উৎপাদন বেড়ে দিনে তিরিশ লক্ষ ব্যারেল!

    আধুনিক তেলের যুগ তো শুরু হল – কিন্তু কোন ইণ্ডাষ্টির রেগুলেশন না থাকায়, কারো কোন নিয়ন্ত্রন না থাকায় – তেল পরিশোধন করে কেরোসিন বানানো ব্যবসা পুরো আগোছালো হয়ে গেল – মানে গোদা বাংলায় মৎসান্যায় যাকে বলে – সাপ্লাই ডিম্যান্ড এর কোন মাথা মুন্ডু নেই। এমন অবস্থায় এগিয়ে এলেন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী জন রকফেলার এই ব্যবসা ঠিক ঠাক সাজিয়ে, সাপ্লাই-ডিম্যান্ড সূত্র খাটিয়ে কেরোসিন বিজনেসকে লাভজনক করতে। এই ভাবে প্রতিষ্ঠা হল স্ট্যান্ডার্ড অয়েল এবং রকফেলার তাঁর ব্যবসা বুদ্ধি খাটিয়ে এমন ভাবে মার্কেট থেকে প্রতিযোগিতা হাটিয়ে দিলেন যে ১৮৯০ নাগাদ আমেরিকার ৯০% তেলের বাজার কনট্রোল করতে শুরু করল। সেই একাধিপত্য চলতে থাকল ১৯১১ সাল পর্যন্ত না আমেরিকা সরকার অ্যান্টি-ট্রাষ্ট আইন এনে কোম্পানীকে ৩৪ টি ইনডিপেনড্যান্ট কোম্পানীকে ভেঙে দিল। কিন্তু ঘটনা কি সেখানেই থেমে থাকে? এক যুগের শেষ বলার থেকে এই ঘটনাকে অন্য এক নতুন যুগের শুরু বলা যেতে পারে – আজকের দিনের প্রধান আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী গুলির বেশীর ভাগ, যেমন এক্সন, চেভরণ, টেক্সাকো, কনোকো, এমনকি বিপি-র বেশীর ভাগটার জন্মকথাও ট্রেস করা যায় ওই স্ট্যান্ডার্ড অয়েলে! এ যেন সেই সংস্কৃত ভাষা থেকে তৈরী হচ্ছে বাঙলা, হিন্দী সহ উত্তর ভারতের বেশীর ভাগ ভাষা! শুধু আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীই নয় – সারা পৃথিবী জুড়ে তেলের সন্ধানে বেরিয়ে এবং নিজেদের ব্যবসাকে প্রসারিত করতে গিয়ে এরা জন্ম দিল নানা ন্যাশানাল ওয়েল কোম্পানী যারা এখন পৃথিবী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে (বা বলা যেতে পারে তেল ব্যবসাকে কন্ট্রোল করছে) – এমন কিছু উদাহরণ হল সৌদি আরামকো, ন্যাশানাল কোম্পানী অব ইরাণ, ইরাকের ন্যাশানাল তেল কোম্পানী, কুয়েত অয়েল কোম্পানী, অ্যাডনক এবং আরো কিছু – এরা সবাই বলে গেলে ‘সিষ্টার’ কোম্পানী যার মূল প্রাণ ছিল সেই স্ট্যান্ডার্ড অয়েল।

    যারা এই সব মেজর আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়ে ভোগে এবং সন্দেহ প্রকাশ করে যে এই তেল ব্যবসা আর কতদিন চলবে – তারা কিন্তু ভুলে যায় এই ব্যবসা এমন ভাবেই রাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ এই সবের সাথে যুক্ত যে, এই কোম্পানীগুলির ইতিহাস অনেক আধুনিক দেশের ইতিহাসের থেকে প্রাচীন! কত নতুন সরকার এসেছে, কত নতুন নিয়ম, নীতির পরিবর্তন এসেছে, মাঝে বেশ কত যুদ্ধ হয়ে গেছে – কিন্তু এই বড় বড় তেল কোম্পানীগুলি টিকে থাকার পথ ঠিক বের করে নিয়েছে। এত ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে যখন এরা মুছে যায় নি, তখন এটাও অনুমান করে নিতে অসুবিধা নেই যে আরো ঝড় ঝাপটার মোকাবিলা করার ক্ষমতা এদের আছে। নিজেরা যেমন ভাবেই হোক অভিযোজিত হয়ে ঠিকে থাকার চেষ্টা করবে – কেমন ভাবে অভিযোজিত হবে, সেটা প্রডিক্ট করা খুবই দুঃসাধ্য কারণ তা নির্ভর করবে তৎকালীন পারিপার্শ্বিক ঘটনাসমূহের উপরে।

    নীচে তেলের ইতিহাসের এক সংক্ষিপ্ত পুঞ্জি দেওয়া হলঃ

    ১৮৫৯ - ড্রেক ওয়েল আমেরিকায়, প্রথম তেলের ড্রিল।
    ১৮৬৩-৭০ -স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানীর জন্ম।
    ১৮৭৮ - তেল মার্কেটের মন্দা। টমাস এডিসন বৈদ্যুতিক বাতির অবিষ্কার করলেন, ফলে তেলের চাহিদায় ঘাটতি।
    ১৮৮৬ - গ্যাসোলিন চালিত গাড়ির প্রবেশ বাজারে।
    ১৯০১ - টেক্সাস অয়েলের বাজার গরম। টেক্সাকো, গালফ অয়েলের জন্ম।
    ১৯০৭ - রয়েল ডাচ এবং শেল জুড়ে গিয়ে রয়েল ডাচ-শেল কোম্পানীর জন্ম।
    ১৯০৮ - ইরান অয়েল এবং বিপি-র জন্ম।
    ১৯১১ - স্ট্যান্ডার্ড অয়েলের কোম্পানী হিসাবে মৃত্যু
    ১৯১৭ - রয়েল ডাচ-শেল, এক্সন, নোবেল সব ব্যবসার জায়গা এবং অ্যাসেট হারালো।
    ১৯২২ - শেল খুঁজে পেল তেল ভেনিজুয়েলায়
    ১৯২৮ - ইরাকে পাওয়া গেল তেল
    ১৯৩১ - তেল সরাবরাহ খুব বেড়ে যাওয়ায় তেলের দাম পড়ে গেল।
    ১৯৩১-৩৮ - আমেরিকা চালু করল প্রোডাকশন কোটা তেলের দাম ঠিক রাখার জন্য।
    ১৯৩২ - ইরান তেলের জাতীয়করন করল, কিন্তু তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত বদল।
    ১৯৩৮ - সৌদিতে আবিষ্কার হল ‘গাওয়ার’ ফিল্ড (the single greatest prize in all history).
    ১৯৪৭ -অফসোর তেল তোলার পত্তন।
    ১৯৫১ - ইরান এবার জাতীয়করণ করল। নাম হল অ্যাঙলো-ইরানিয়ান, পরে যা দাঁড়ায় বিপিতে।
    ১৯৫৯ - আবার ওভার-সাপ্লাই
    ১৯৬০ - ওপেক-এর (OPEC) জন্ম বাগদাদে (তখন ছিল সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, ভেনিজুয়েলা, কুয়েত এর সদস্য)। ইন্দোনেশিয়ার তেলের জাতীয়করন।
    ১৯৬৭ -ছয় দিন ব্যাপী যুদ্ধ। তৃতীয় আরব-ইজারেয়িলি যুদ্ধ। আরবরা তেলের এম্বারগো চালু করলে যারা ইজারেয়েলের বন্ধু তাদের বিরুদ্ধে।
    ১৯৬৯ - নর্থ-সী তে তেলের আবিষ্কার।
    ১৯৭০ - আমেরিকার অয়েল পিক। পৃথিবীর তেলেদ চাহিদা তার জোগানের সাথে ব্যবধান কমিয়া আনে। পাওয়ার সিফট করতে শুরু করে মিডিল ইষ্টে।
    ১৯৭৩ - আবার অয়েল এম্বারগো – এবার আমেরিকার ইজারেয়েলকে সাপোর্ট করার জন্য।
    ১৯৭৪ - ইরাক জাতীয়করণ করল। সৌদি আংশিক জাতীয়তা করন।
    ১৯৭৫ - কুয়েত ন্যাশানেলাইক করল, ভেনিজুয়েলাও।
    ১৯৭৯ - ইরাণে বিপ্লব। তেলের দাম ৪০ ডলার ছুঁল সাপ্লাই কম না হওয়া সত্ত্বো।
    ১৯৮০ - সৌদি ১০০ ভাগ ন্যাশানেলাইজ করল আরামকো-কে।
    ১৯৮২ - ওপেক-দেশেরা কোটা সিষ্টেম চালু করল তেলের দাম ধরে রাখতে।
    ১৯৮৬ - ওভার সাপ্লাই – দাম পড়ে গেল তেলের। ১০ ডলার হয়ে গেল।
    ১৯৯১ - গালফ ওয়ার। ইরাক কুয়েত আক্রমণ করল – দুড়ুম করে আমেরিকার হাতে হেরে গেল। তেল আবার ছুঁল ৪০ ডলার প্রতি ব্যারেল।
    ১৯৯৮-২০০১ - সুপার মার্জ যুগ। বিপি-আমোকো-আর্কো; এক্সন-মোবিল, চেভরন-টেক্সাকো, কনোকো-ফিলিল্প, টোট্যাল-এলফ-ফিনা।
    ১৯৯৮ - তেলের দাম কমে গেল এশিয়াতে ক্রাইশিস এর জন্য।
    ২০০৩-২০০৮ - তেলের দামের শক। ইরাকে সিভিল ওয়ার, ইরাণে পরমাণু এই নিয়ে টেনশন ইত্যাদি, প্রায় ১৫০ ডলার ছুঁয়ে গেল দাম।
    ২০০৮- ২০০৯ - তেলের দাম পড়ে গেল পৃথিবী জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার জন্য।
    ২০১০-২০১১ - তেলের দাম বাড়তে শুরু করল ক্রমশঃ।
    ২০১২ - আমেরিকার অনসোরে টাইট অয়েল এর পূর্নজন্ম। তাহলে কি আবার আমরা দামের সাইকেলে ঢুকতে যাচ্ছি?
    ২০১৫ - সন্দেহ যে অমূলক ছিল না বোঝা গেল। অনেক অনেক দিন পর তেলের দাম এত কমে গেল – ৩৫ ডলার প্রতি ব্যারেল। তেলে ইন্ডাষ্ট্রিতে মেজর ধাক্কা। অনেক অনেক বা প্রায় সব বড় প্রোজেক্ট হয়ে গেল বন্ধ। আবার বেঁচে থাকার লড়াই শুরু!

    তাহলে দেখা গেল যে, ডাঙার (Onshore) রিজার্ভার থেকে তেল/গ্যাস তোলা শুরু হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে কিন্তু সমুদ্রে মাঝ (Offshore) থেকে তেল তোলার ইতিহাস মাত্র ৪০-৫০ বছরের পুরানো। অবশ্য এর মাঝে অগভীর সমুদ্র থেকে তেল তোলা শুরু হয়েছিল – যেমন ভেনিজুয়েলা, ক্যাস্পিয়ান সি, গালফ অব্‌ মেক্সিকো ইত্যাদি। কিন্তু গভীর সমুদ্রে মাঝখান থেকে তেল তোলা ১৯৬০ এর দশক থেকে শুরু মূলত আমেরিকা থেকে। পৃথিবীর জন্যজায়গায় সমুদ্র থেকে তেল তোলা সেই ফিল্ড গুলো থেকে যেগুলি ডাঙার সাথে কোনভাবে সংযুক্ত ছিল না তা শুরু হয়েছিল প্রায় ১৯৭০ এর দশক থেকে। কিন্তু ওই ৬০ বা ৭০ এর দশক থেকে তেল ব্যবসায় বড় বড় পরিবর্তন আসতে লাগল – আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীর ব্যবসার ক্ষেত্র সংকুচিত হতে লাগল – তেলের স্বদেশীয়করণ হতে থাকতে সেই সমস্ত দেশে যাদের তেলের রিসার্ভ আছে। মিডিল ইষ্ট এবং অন্য ওপেক (OPEC) দেশে আন্তর্জাতিক কোম্পানীগুলির তেলের সরাসরি অধিকার বা প্রতিপত্তি ক্রমশঃ কমতে কমতে থাকল এবং অনেকাংশে অবলুপ্ত প্রায় হয়ে গেল।

    এর ফলে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলি নজর দিতে বাধ্য হল তেল অধিকার করে রাখা দেশ গুলির সাথে সম্পর্ক ঠিক ঠাক প্রতিষ্ঠা করতে। এবং কোম্পানীগুলি নিজেদের ক্ষেত্র প্রসারিত করার চেষ্টা করতে শুরু করল আমেরিকার গালফ অব মেক্সিকো, নর্থ সি, সাউথ চায়না সি, ইষ্টার্ণ কানাডা, সাউর্থান ব্রাজিল, ওয়েষ্ট আফ্রিকা, মেক্সিকোর দিকে গালফ মেক্সিকোতে এবং গালফ অব সুয়েজে।

    আজেকের দিনে তেলের টানাপোড়েনে একদিকে রয়েছে ওপেক দেশগুলি, অন্যদিকে মেজর ইন্টারন্যাশানাল কোম্পানী গুলি – এবং রাশিয়া। বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় এবং প্রধান ছয়টি আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি হল –

    ১)এক্সন-মোবিল
    ২)রয়েল ডাচ শেল
    ৩) বিপি
    ৪) চেভরন
    ৫) ট্যোটাল
    ৬) কনোকো-ফিলিপস

    এই সব কোম্পানী গুলির সংক্ষিপ্ত বর্ণণা এবং তার সাথে ওপেক দেশ গুলি নিয়ে নাড়াচাড়া পরের পর্বে।

    [ক্রমশঃ]

    পর্ব – ৭
    ---------------------------------------------------------------------------------------

    আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীদের মধ্যে প্রবল প্রতিপত্তিধারী (সুপার-মেজর) বলতে সাধারণত যে পাঁচটি কোম্পানীকে বোঝানো হয় তারা হল - এক্সন-মোবিল, রয়েল ডাচ শেল, বিপি, চেভরন এবং ট্যোটাল। এছাড়াও রয়েছে কনোকো-ফিলিপ্স, স্ট্যাট-ওয়েল, ই-এন-আই এর সব কোম্পানীগুলোও যারা নিতান্তই ছোট কিছু নয়! এই সব প্রধান তেল কোম্পানীগুলির ইতিহাস অনেক পুরানো - যেমন এক্সন-মোবিল, শেল, বিপি, কনোকো এরা বাজারে রয়েছে ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে। ট্যোটাল প্রায় ৮০ বছরের প্রাচীন, যেখানে ই-এন-আই এর ইতিহাস বিগত ৫০ বছরের।

    ১৮৫৯ সালের ২৭ শে আগষ্ট ২৩ মিটার গর্ত খুঁড়ে কর্ণেল ডেরেক তেল খুঁজে পাবার পর ২০ বছর তেল কেন্দ্রীক ব্যাপার স্যাপার সব কিছু আমেরিকাতেই সীমাবব্ধ ছিল এবং বলাই বাহুল্য যার ব্যাবসার কেন্দ্রে ছিল স্ট্যান্ডার্ড অয়েল। কিন্তু খুব দ্রুত গতিতে পেট্রোলিয়াম ব্যবসা এক আন্তর্জাতিক ব্যবসাতে পরিণত হল। ইউরোপেতেও এই ব্যবসার আঁচ লাগে প্রবল ভাবে যদিও ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তেল উৎপাদনের প্রায় ৫০ ভাগই আসত আমেরিকা থেকে। কেবল মাত্র ইউরোপই নয়, রাশিয়া এবং এশিয়াও ক্রমশঃ তেলের চক্রে ঢুকে পরে – নতুন নতুন কোম্পানীর প্রতিষ্টা হয়। তেলের ব্যবসার জগতে অনেক সময় ‘সাত বোন’ (সেভেন সিষ্টারস্‌) ব্যাপারটার উল্লেখ হয়, সেই সাত বোন ছিল – ১) স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব নিউ জার্সি (পরে এসো, তারো পরে এক্সন), ২) স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব কালিফোর্ণিয়া (এখন চেভরন), ৩) স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব নিউ ইয়র্ক (পরে মোবিল), 8) টেক্সাকো, ৫) রয়েল ডাচ শেল, ৬) গালফ, ৭) বিপি।

    আগের পর্বে যেমন কিছুটা লিখেছি - বাপের বাপ, মায়ের মা – যা কিছু বলবেন বা বলতে চাইবেন তার সবকিছুই আপনি বলতে পারেন “স্ট্যান্ডার্ড অয়েল” তেল কোম্পানী সম্পর্কে, জন ডি রকফেলার যার প্রতিষ্ঠা করেছিলান ১৮৭০ সালে। এমনটা বলা হয়ে থাকে যে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল হল সেই যুগের বা হয়তবা সর্বযুগেরই সবচেয়ে সফল ভাবে পরিচালিত বাণিজ্যিক কোম্পানী। রকফেলার কাকু ব্যবসা বাড়াতে এবং বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে কি করেন নি – যথেচ্ছ ঘুষ খাইয়েছেন ঠিক জায়গায়, রেল পথ ব্যবহার করেছেন নিজের সুবিধামত ট্রানজিট ফিস ব্যবহার করে, তেলের দাম নিয়ে যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। বাজার ধরে রাখতে, প্রতিযোগীতা থেকে অন্যদের ছিটকে দিতে, তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রকফেলার যা শুরু করেছিলেন তার থেকে মুক্তি পাবার জন্য আমেরিকা সরকার অ্যান্টি-ট্রাষ্ট আইন এনে কোম্পানীকে ৩৪ টি ইনডিপেনড্যান্ট কোম্পানীকে ভেঙে দেয় ১৯১১ সালে। কিন্তু ওই যে, কম্‌লি নাহি ছোড়তা! এই ভেঙে আসা কোম্পানী গুলির মধ্যে এক্সন, চেভরণ, টেক্সাকো, কনোকো এখনো মার্কেটে খেলে যাচ্ছে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে আমাদের ভবিষ্যত রচনায় আমাদের অজান্তেই! যে সব সবজান্তা বোদ্ধারা ভাবছেন কেন অ্যান্টি-ট্রাষ্ট আইন আগে ফাঁদা হল না, ব্যাপারতো খুব সিধাসাধা, তাঁদের রকফেলার কাকু সেই কবেই চেতাগ্নি দিয়ে গিয়েছিলেন, “I have ways of making money that you know nothing of.”

    রকফেলার প্রথমে হোলসেল বিজনেস চালু করেন যেই ব্যবসার একটা দ্রব্য ছিল পেট্রোলিয়াম। এর প্রায় সাথে সাথেই তিনি পেনসিলভিনিয়ায় প্রথম তেলের পরিশোধনাগার প্রতিষ্টা করেন এবং কালক্রমে দ্বিতীয়। প্রখর ব্যবসায়ী বুদ্ধিধারী রকফেলার কাকা পেট্রোলিয়াম ব্যবসাটা আগাপাস্তালা ধরার জন্য চারিদিকে জাল ছড়াতে শুরু করেন – মানে হল গিয়ে তেল তোলা থেকে তেল পরিশোধন করে বিক্রী। তেল ব্যবসায় এন্ড-টু-এন্ড কনসেপ্টের জনক বলতে গেলে কাকা-ই। ব্যবসা তিনি চালাতে লাগলেন খুবই সাধারণ নীতি দিয়ে – ব্যবসার সব কিছু নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ – তোলা থাকে বেচা। তারপর তো তিনি ১৯৭০ সালে নিজের ভাই এবং কিছু বন্ধুদের সাথে শুরু করলেন “স্ট্যান্ডার্ড অয়েল”। কোম্পানীর নামে স্ট্যান্ডার্ড থাকার কারণটাও নাকি সিম্পল – তিনি চেয়েছিলেন যে দ্রব্য তিনি বেচবেন তা যে বরাবর উঁচু মানের থেকে। তার পর তো আগেও লিখেছি, ১০ বছরের মধ্যে ব্যবসার ৮০% দখল নিয়ে নিয়েছিল স্ট্যান্ডার্ড অয়েল। কাকার সেই প্রায় নিষ্ঠুর ব্যবসায়িক আচরণ শুধুমাত্র তেল ব্যবসার প্রতিযোগীদেরই নয়, সরকার এমনি আমজনতারও গোঁসার কারণ হয়েছিল। চারিদিকের সেই সাঁড়াশি আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল নাকি ট্রাষ্ট-ফ্রাষ্ট কি সব গঠন করে। দি স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ট্রাষ্ট ৭০০০০০ শেয়ার ছাড়ে এবং ভাগ করে দেয় মেম্বাদের মধ্যে। তার ভিতরের জটিল ব্যাপার আমি ঠিক বুঝি নি এবং আমার এই তেলের গল্পের সাথে তার খুব একটা সম্পর্কও নেই। মোট কথা সেই প্রথম ধাক্কা এবং যার পরে ১৯১১ সালে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল-এর বিভাজন।

    ১) এক্সন – এক্সন হল গিয়ে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল প্রসবিত সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বলশালী পুত্র যার পরাক্রম এখনো বর্তমান। ১৯৯৮ সাল নাগাদ নিজেরই ছোটভাই মোবিল এর সাথে মিলে গিয়ে এক্সন-মোবিল কোম্পানীটি গঠন করে। আমেরিকার ইতিহাসে এই হল গিয়ে সবচেয়ে বড় মার্জার। দেখা গেল যে আমেরিকার সুপ্রীম কোর্ট প্রায় ৯০ বছর আগে যাদের আলাদা করে দিয়েছিল জোর করে, ইতিহাসের পথ পেয়ে তারা আবার মিলে গেল। অনেকে অবশ্য গেল-গেল রব তুলেছিল। কিন্তু তাতেও বিছরে হুয়ে ভাই-দের মিলন ঠেকানো যায় নি!

    ২) চেভরন – এর ইতিহাসের সাথে জড়িত আছে পৃথিবীর তৈলাক্ত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তৈলখনি আবিষ্কারের গল্প। যাকে ইংরাজীতে গালভরা নামে ডাকা হয় – “সিঙ্গেল গ্রেটেষ্ট প্রাইজ ইন হিষ্টরি”। স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া জুড়ে যায় স্ট্যান্ডার্ড অয়েল-এর সাথে, কিন্তু মাত্র ১১ বছর পর আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে তৈরী করে চেভরন। সেই চেভরন সৌদি আরবে তেল নিয়ে নাড়াঘাঁটার অনুমতি পায় এবং তাই করতে গিয়েই ১৯৩৩ সালের তেলের স্বর্ণখনি ‘গওহর’ ফিল্ড আবিষ্কার করে, যার থেকে বড় তেলের খনি এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি। ১৯৮৪ সালে চেভরনের মিশে যাওয়া গালফ্‌-এর সাথে (তখনকার দিনে সবচেয়ে বড় মার্জার) এবং আরো পরে ২০০১ সালে টেক্সাকোর সাথে।

    ৩) বিপি – এর জন্ম ইরানে বললেও অত্যুক্তি হয় না। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আমেরিকা, ইউরোপ এবং রাশিয়া মূলত প্রধান তেল বিষয়ক খেলোয়াড় হলেও হালকা একটা আভাস আসছিল যে এশিয়া (বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য) এর মধ্যে নিজেদের নাক গলাতে যাচ্ছে। প্রথম অনুসন্ধান শুরু হয় পার্শিয়া (এখনকার ইরান) এবং পরে তুরস্কে। পার্শিয়ার সুলতান নিজের দেশে পেট্রোলিয়াম খুঁজে পেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন। এবং সেই মত ১৯০১ সালে উইলিয়াল নক্স ইরানে তেল নাড়াঘাঁটার অনুমতি পান। ১৯০৮ সালে প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে তিনিই বাণিজ্যিক কোম্পানী স্থাপন করেন। কিন্তু প্রথম দিকে নক্সের ভাগ্য মোটেই ভালো ছিল না। একের পর এক তেলের খনি থেকে কিছুই বেরোয় না – মূলধন শেষ হয়ে আসছিল। এমন সময় ভারতের বার্মা অয়েল কিছু পয়সা ঢালে সেখানে এবং পরিশেষে অনেক মাস ব্যাপী পঞ্চম প্রচেষ্টায় তেলর খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু সেই খোঁজ পাওয়াকে বাণিজ্যিক তেল উৎপাদনে পরিণত করতে অনেক মূলধনের দরকার হয়ে পরে। মূলধনের যোগান দিয়ে এক অ্যাঙ্গলো-পার্শিয়ান কোম্পানী স্থাপিত হয় যার পার্টনার ছিল বার্মা অয়েল। সেই অ্যাঙ্গলো-পার্শিয়ান কোম্পানী কালে কালে বিপি-তে পরিণত হয়।

    ১৯৫৩ সালে যখন জাতীয়করণ শুরু হয় তখন বিপি ইরান থেকে মোটামুটি অনেক কিছু খুইয়ে ফেলে – কিন্তু দুম করে নর্থ-সী তে ১৯৬০ সালে তেল-ফেল খুঁজে পেয়ে আবার ফ্রন্ট-ফুটে ফিরে আসে বিপি। পরের দুই-তিন দশক ধরে বিপি অনেক কর্ম-কান্ড করে একে-ওকে কিনে নিয়ে যার মধ্যে ১৯৯৮ সালে অ্যামোকো-কে কিনে নেওয়াও পরে। সব কিছু মোটামুটি চলছিল – টুকটাক ফাইন ইত্যাদি নিয়ে, কিন্তু ২০১০ সালে হল গিয়ে গালফ অব মেক্সিকোতে মক্যান্ডো নামে এক তেলর খনির বিপর্যয়। সে ফেটে ফুটে গিয়ে একসা – এই নিয়ে সিনেমাও হয়েছে একটা। ভালোই সিনেমা – তেলে নিয়ে বেশী কিছু না জেনেও সেই সিনেমাটা উপভোগ করা যায়। মোদ্দা কথা সেই মক্যান্ডো ফেটে গিয়ে বিপি-র ও ফাটিয়ে দিয়েছিল। কোম্পানী প্রায় আন-স্টেবল হয়ে পরে, ভবিষ্যত অনিশ্চিত। ৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ছেটকায় সেই ফেটে যাওয়া – ক্ষতিপূরণ, পরিষ্কার খরচ, জরিমানা সব মিলিয়ে বিপি-কে দিতে হয় প্রায় চল্লিশ বিলিয়ন ডলার। বিপি ঘেঁটে ঘ হয়ে যায় এর পর।

    8) রয়েল-ডাচ শেল – বৃটিশ শেল এবং হল্যান্ড এর রয়েল ডাচ দুই মিলে ১৯০৭ সালে মিলে গিয়ে তৈরী করে এই কোম্পানী। মার্কোস স্যামুয়্যাল তেল পরিবহনের ব্যবসার জন্য ১৮৭৮ সালে স্থাপন করেন বৃটিশ শেল । আমেরিকাতে যখন স্ট্যান্ডার্ড অয়েল, নোবেল ভ্রাতৃদ্বয় এবং রথস্‌চাইল্ড ফ্যামিলি নিজেদের মধ্যে তেল ব্যাবসা নিয়ে খেয়োখেয়িতে মেতে উঠেছিল তখন রথস্‌চাইল্ড ফ্যামিলি নিজেদের ব্যাবসা এশিয়ার দিকে বাড়ানোর জন্য কেরোসিন রপ্তানীর জন্য মার্কোস স্যামুয়্যাল-এর তেল পরিবহনের ব্যবসা ব্যবহার করতে শুরু করে। এদিকে স্যামুয়্যালের কেরোসিন ব্যবসা তো হিট! ব্যবসা সুপার হিট হয়ে গেল যখন ১৮৮৫ সালে কার্ল বেঞ্জ ইন্টারন্যাল কম্বাশন ইঞ্জিন আবিষ্কার করলেন এবং পাবলিকের গ্যাসোলিনের প্রয়োজন হঠ করে বেড়ে গেল! স্যামুয়্যাল দেখলেন শুধু মাল চালান করে পয়সা কামাই কেন, নিজে তেল খুঁজে পেতে ব্যবসা বাড়ানো যাক না! যেমন ভাবা তেমন কাজ, ডাচ ইষ্ট ইণ্ডিজে তিনি তেল খুঁজে পেতে তুলতে লাগলেন। এই পূব দিকেটা সামলে স্যামুয়্যাল এবার হাত বাড়ালেন টেক্সাসের দিকে – সেখান থেকে তেল কেনার চেষ্টা করতে লাগলেন। স্ট্যান্ডার্ড অয়েল দেখল, এতো বড় বিপদ – মালটার কোম্পানীটাকে কিনে নেওয়া যাক। কিন্তু স্যামুয়্যাল সেই কিনে নেবার প্রস্তাব নাকচ করে দেন।

    ওই প্রায় একই সময়ে রয়েল ডাচও আস্তে আস্তে জন্মাছিল – ১৮৯০ সালে বিশাল ভজকট নামের অধিকারী ইষ্ট সুমাত্রা টব্যাকো কোম্পানীর প্রাক্তন প্রধান সুমাত্রায় প্যারাফিন যুক্ত পেট্রোলিয়াম খুঁজে পেয়ে নিজেকে তেল ব্যবসায় ছুঁড়ে দেওয়ার মনস্থির করেন। তাঁর খোঁড়া প্রথম তেলের খনি থেকে কিছুই ওঠে না – কিন্তু ১৮৮৫ সালে তিনি খুঁড়লেন ১২১ মিটার মত দ্বিতীয় খনি এবং পেলেন তেল যা তার পর প্রায় ৫০ বছর ধরে উৎপাদন করে চলে। ব্যবসা ক্রমশ বেড়ে চলে এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরও ডাচ রাজার সাপোর্ট যায় না। ১৮৯৪ সাল নাগাদ এই ভাবে রয়েল ডাচ হয়ে ওঠে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল-এর প্রবল প্রতিদ্বন্দী। সেই দেখে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল এশিয়ার মার্কেট ধরার জন্য ফ্রীতে তেলের ল্যাম্প বিলি করতে শুরু করে – বিশেষ করে চীনে। তবে শুধু স্ট্যান্ডার্ড অয়েল এর থেকেই নয় রয়েল ডাচ কম্পিটিশনের আঁচ পায় শেলের স্যামুয়্যাল-এর কাছ থেকেও, যে কিনা ঘরের পাশেই তৈল পরিশোধনের কারখানা খুলে বসেছিল।
    স্ট্যান্ডার্ড অয়েল-এর সাথে ফাইট দেবার জন্যই বলতে গেলে রয়েল-ডাচ শেল-এর জন্ম হয় এবং অনেকাংশে তারা সফলও হয়েছিল সেই ফাইটে। সেই ১৯০২ থেকে শুরু হয় রয়েল ডাচ এবং শেল-কে এক সাথ জোড়ার ফাইট। প্রায় ৫ বছর ধরে এটা সেটা চলার পর পরিশেষে ১৯০৭ সালে চার হাত ভালো করে এক হয়। এর পর অনেক দিন ধরে রয়েল-ডাচ শেল বড়সড় মার্জার থেকে নিজেদের আলাদা করে রেখেছিল, দুই একটা ছোটখাট কেনা ছাড়া। কিন্তু এই হালে তারা কিনে নেয় ৫০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে বিজি গ্রুপকে।

    ৫) কনোকো-ফিলিপ্স – কনোকো তো বলতে গেলে স্ট্যান্ডার্ড অয়েল-র বাচ্চা (বৈধ বা অবৈধ যেমন ভাবে আপনি দেখবেন)। কিন্তু আজকাল এই কোম্পানীতে ফিলিপ্সের লিগ্যাসীটাই বেশী প্রকট। ফ্রাঙ্ক ফিলিপ্স ১৯০৫ সালে সেই কোম্পানী শুরু করে ওকলাহামা-তে এক সার তেলের খনি আবিষ্কার করে। ২০০১ সাল নাগাদ এদের মার্জার হয়। এরা আবার ফস করে ২০১১ সালে নিজেদের ভেঙ্গে দেয় – তেল তোলা এবং তেল পরিশোধন এই দুই-এর উপর ভিত্তি করে।

    ৬) ট্যোটাল – ১৯২৪ সালে ফ্রান্স সরকার এই কোম্পানীর স্থাপন করে। ইরাক পেট্রোলিয়ামের সাথে ভাব করে এর প্রথম বিদেশে কাজ শুরু করে। ১৯৯৯ সালে এরা আরেক ফ্রেঞ্চ তেল কোম্পানী এলফ্‌-কে কিনে নেয়।

    [ক্রমশঃ]

    পর্ব – ৮
    -----------------------------------------------------------------

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর বৃটিশ ফরেন সেক্রেটারী জর্জ কার্জন ভাষণ দিলেন যে “The allies had floated to victory on a sea of oil” এর মন্তব্যের গভীর অর্থ কি ছিল বলতে পারব না, আমি যা বুঝলুম কার্জন বলতে চেয়েছেন যেন, বুঝলে তোমরা, তেল আমাদের খুব কাজে দিয়েছে যুদ্ধের সময়। ততদিনে বিশ্বের প্রধান নৌবহর গুলো তাদের যুদ্ধ জাহাজের ইঞ্জিনের বয়লার গুলোর জ্বালানী কয়লা থেকে খনিজ তেলে রূপান্তর করে নিয়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তেলের সরাবরাহ প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু চালাক রাজনীতিকরা এক স্টেপ আগে গিয়ে ভাবলেন – আজ তেল যখন চেয়েছি পেয়ে গেছি বলে কাল যে পাব তার কি গ্যারান্টি আছে? সেই সব ভেবে চার্চিল কাকু বিপি-তে ৫১% দাবী সরকারের থাকবে বলে দিলেন।

    তেল নিয়ে অন্যদেশের সরকারের তেমন বিশেষ কিছু উচ্চ-বাচ্চা ছিল না তখন। যেমন অমেরিকাতে – সেখানে প্রাইভেট তেল কোম্পানী বাণিজ্য চালাচ্ছে দেশ এবং দেশের বাইরে – তো কি? আমেরিকা সরকার নিজে সরাসরি বিদেশে তেল ব্যবসার বিস্তারে নাক না ঘামালেও, নিজেদের দেশের কোম্পানীগুলিকে প্রবল সমর্থন জানিয়ে এসেছে। মধ্য প্রাচ্য অনেক দিন বৃটিশ-দের ছত্রছায়ায় ছিল। আমেরিকার কোম্পানীরা ইরাকে প্রথম নাক গলায় ১৯২৮ সাল এবং ১৯৩৪ সাল নাগাদ স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল অব নিউ-জার্সি (এক্সন) এবং স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল অব নিউ-ইয়র্ক (মোবিল) ইরাকি পেট্রোলিয়াম কোম্পানীর ২৫% দখল করে ফেলে। একই ভাবে স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল অব ক্যালিফোর্ণিয়া ১৯২৭ সালে বাহারিণে প্রধান্য বিস্তার করে এবং সৌদি আরবে ১৯৩৩ সালে।

    তেলের ইতিহাস ঘাঁটলে এটাও দেখা যাবে যে পৃথিবীর প্রধান চার ক্ষমতাশালী জাতীয় তেল কোম্পানীর সূচনা হয়েছিল সেই পশ্চিমী আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলির সহচার্যে এবং সংগঠনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে। প্রধান চার সেই দেশ হল – ইরাণ, ইরাক, সৌদি আরব এবং কুয়েত। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলি (বিশেষত আগের পর্বে উল্লেখিত ‘সেভেন সিষ্টার’ বলে পরিচিত কোম্পানীগুলি) মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলির সাথে গোপন আঁতাত গড়ে তুলে দীর্ঘদিন ধরে সেখানকার তেলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে এসেছিল। টুপি পড়ার খেলায় লিপ্ত থাকার অনেক দিন পর একদিন ঘুম ভেঙে দেশগুলি দেখল যে – বাঃ এতো বেশ মজা, আমার দেশ, আমার তেল – আর দই খাচ্ছে নেপোয়! তখন সেই দেশের চালাক মন্ত্রী/রাজা সকল বলল যে, হে আমার আন্তর্জাতিক তেল বন্ধু কোম্পানী – তোমরা আমাদের দেশে এসে ক্ষীর খাচ্ছ খাও, কিন্তু আমাদের অন্তত দুধটা দাও! আগে তবুও তো দুধ পেতাম – কিন্তু আজকাল তো দুধের হিসাবই পাচ্ছি না ঠিক ঠাক, যদিও দেখছি আমার গোয়ালে প্রচুর গরু গিজগিজ করছে!

    এই টানা হেঁচড়া চলতে থাকলে, কখনো প্রকাশ্যে, কখনো তলে তলে। দেশ বেশী ভাগ চায় লভ্যাংশের, কিন্তু আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলির নানা বাহানা। ১৯৫০ সাল নাগাদ সৌদি আরব আরামকো থেকে ৫০-৫০ ভাগ আদায় করে নিয়ে সক্ষম হয়। অনেক দেশ ততো সফল হয় না – মাটির তলার তেলের খনির ভাগ বাটরা নিয়ে খেয়োখেয়ি চলতেই থাকে। এ বলে – ভাই, খুঁজে তো আমি পেলাম। তো দেশ বলে, আরে পেলি তো কি হয়েছে, জমিটা কার বাপের সেটা তো দেখবি! আমার দেশের মাটির তলা থেকে পাওয়া তেলের অধিকার আমার দেশের লোকদেরই বেশী থাকবে। এই করতে করতে টেনশন চরমে পৌঁছে গেল ১৯৭০ সাল নাগাদ। এই জাতীয় তেল কোম্পানীগুলিই পরে ‘ওপেক’ সংস্থা গঠন করে – যা নিয়ে কিছু পরে আলোচনা করব।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তেলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব নিয়ে রাষ্ট্র নেতাদের মধ্যে সচেতনতা বেড়ে গেল। যার কাছে তেল আছে, সেই দেশ যে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা সম্পর্কিত ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে এই বিষয়ে খুব বেশী পাবলিক আর দ্বিমত হল না। হিটলার যখন ১৯৩৯ সালে পোল্যান্ড আক্রমণ করেন তখন তেল বিষয়ক শতকরা ৩০ভাগ তাঁর নির্ভরতা ছিল সিন্থেটিক তেলের উপর। কিন্তু জার্মানীর যে তেল প্রয়োজন ছিল আরো সেটা বোঝা যায় যখন হিটলার রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয় ১৯৪১ সালের জুন মাসে। মস্কো ছিল আক্রমণের লক্ষ্য ইত্যাদি ইত্যাদি এই সব নিয়ে অনেক চর্চা হলেও অনেকে এটা কম জানেন যে সেই একই সময়ে বাকু এবং সংলগ্ন তেলের প্রাচুর্যের এলাকায় হিটলারের বাহিনীর অগ্রসর। এই একই ভাবে দেখা যায় আমেরিকা জাপানে উড়োজাহাজের তেল রপ্তানীতে ব্যাগড়া দিলে পার্ল হারবার আক্রমণ। এবং পরে জাপানীদের ডাচ অধ্যুষিত ইষ্ট ইন্ডিজ-এর দিকে আক্রমনও। তেল নিয়ে আরো যুদ্ধ আছে – পৃথিবীর নানা দেশে আমেরিকার আগ্রাসন মূলত তেলের সন্ধানে অনেক ক্ষেত্রেই। তেল যুদ্ধ নিয়ে এখনি আর বিশেষ আলোচনায় যাচ্ছি না, পরে উৎসাহ থাকলে লেখা যাবেক্ষণ।

    কিছু কিছু দেশ যেমন রাশিয়া (১৯১৮), মেক্সিকো (১৯৩৮), ইরান (১৯৫২), ভারত (১৯৫৮) – এরা আগেই তেলের জাতীয়করণ করেছিল, কিন্তু ১৯৭০ থেকে ১৯৮০ এর মধ্যে তেলের জাতীয়করণ নিয়ে বিশাল হিরিক পড়ে যায়, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকার দেশগুলির অনেকের এই জাতীয়তাবাদী বিষ্ফোরণের বিনিময় ঘটে সেখানের তৎকালীন প্রাধান্যবিস্তার কারী কোম্পানীটির সাথে। যেমন ১৯৭১ সালে আলজেরিয়া ৫১% ভাগ কনশেশন দখল করে নেয় ফরাসী কোম্পানীগুলির হাত থেকে। ১৯৭১ সালের পর থেকেই লিবিয়া-ও অনুরূপ ভাবে বিপি-র কাছ থেকে ৫০% এবং অন্য কোম্পানীগুলির কাছ থেকে ৫১% ভাগ নিয়ে নেয়। ইরাকও একই পথ অনুসরণ করে। ১৯৭৫ সালের কুয়েত এবং কাতার, ১৯৭৬ সালে ভেনিজুয়েলা, সৌদি আরব ১৯৭৪ থেকে ১৯৮০ এর মধ্যে তেলের জাতীয়করণ সম্পন্ন করে ফেলে।

    আমার দেশের তেলে আমার দেশের জনতার সমান অধিকার এই কনসেপ্টের একটা ছোট্ট সাইড এফেক্ট ছিল – সবাই মনে করতে লাগল যে যেহেতু আমার দেশ থেকেই তেল পাওয়া যাচ্ছে, তাই দেশের জনতার মধ্যে তেল বিতরণ করতে হবে খুবই নগণ্য মূল্যে। সেই মুল্য ফলতঃই বাইরের দেশের অন্তর্জাতিক তেলের দামের তুলনায় অনেক কম। সেই দেশের বাজারের তুলনাতেও তেল পর্যাপ্ত সস্তা। এটা একটা ঘটনা যে, ভেনিজুয়েলার মত অনেক দেশে এক লিটার তেলের দাম এক লিটার জলের দামের থেকে কম। পাবলিক তেল ফেলে ছড়িয়ে খরচা করতে লাগল – এই ফেলে ছড়িয়ে খরচার উদাহরণ এখনো আপনি পাবেন মধ্য প্রাচ্যে বা ব্রুনাই এর মত দেশে গেলে। বউ শপিং মলে বাজার করতে গেছে, বর গাড়িতে বসে আছে ৩ ঘ্ন্টা ধরে ইঞ্জিন চালিয়ে এসি ছেড়ে দিয়ে। এমনো দেখা গেছে যে পাবলিক সকালে গাড়ি পার্ক করে ইঞ্জিন বন্ধ করে না – কারণ দুপুরে লাঞ্চ করতে যাবার সময় তা হলে গাড়ি খুব গরম হয়ে যাবে ৪০ ডিগ্রী গরমে! এক এক বাড়িতে ৪-৫ টা করে গাড়ি! তেলের অপচয় এবং বাপের শ্রাদ্ধ। ঘটনা হচ্ছে দেশের নিজের পাবলিক তেল সস্তা বলে ফেলে ছড়িয়ে এতো তেল খরচা করলে তো বৈদেশিক মুদ্রার একটু হলেও কম আমদানী হবে! কিন্তু কে কাকে বোঝায়! ১৯৮০ সালের পর থেকে এই কনসেপ্ট একটু হলেও পাল্টেছে – অনেক পণ্ডিত বলেন এর সাথে কমিউনিজমের জামানা খতম এবং বার্লিণ দেওয়ালের পতনের নাকি সম্পর্ক আছে! আমি যেহেতু পণ্ডিত নই, তাই বিশেষ কিছু যোগ করতে পারব না – তবে এটুকু বলতে পারি আমি যে গাড়ি চড়া তেল অপচয়ের পাবলিকদের গল্প করলাম তারা কম্মিকালেও বার্লিন দেওয়ালের নাম শোনে নি এবং কমিউনিজম খায় না মাথায় দেয় তা জানে না!

    যাই হোক, তা হলে এবার হালকা করে প্রধান জাতীয় তেল কোম্পানীগুলিকে একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক –

    ১) সৌদি আরামকো – এর টিকি ধরে টানলে চলে আসবে সেই চেভরণ কোম্পানীর গল্প যার সাথে সৌদি আরবের ইন্টু-মিন্টু চলতে সেই ১৯৩৩ সাল থেকে। সৌদি আরামকো এখন হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে বড় তেলের কোম্পানী এবং উৎপাদন বাদ দিয়ে এদের হাতেই আছে সবচেয়ে বেশী তেলের রিজার্ভ। মোটের উপর এরা কিন্তু বেশ ভালো ভাবে পরিচালিত কোম্পানী – অনেক বিষয়ে এদের দক্ষতা আছে, ডাঙা এবং সল্প জলে তেল তোলার টেকনোলজি তে।

    ২) ইরান – এদের জাতীয় তেল কোম্পানির নাম হল ‘দি ন্যাশানাল ইরানিয়ান ওয়েল কোম্পানী’ যার ইতিহাস ১৯৫১ সালের শুরু যখন তখনকার ইরানিয়ান প্রাইম মিনিষ্টার তেলের জাতীয়করণ করেন বিপি-র হাত থেকে। তেল নিয়ে তারপর গোপন উত্থান-পতন চলে সেই দেশীয় রাজনীতিতে, গণ-অভ্যুত্থান জাতীয় কিছু নাকি হয়। ১৯৫১ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত সেই টালাবাহানা, টেনশন চলে। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সাল নাগাদ যাকে বলে ইরানে তেলের পূর্ণ জাতীয়করণ হয়। কিন্তু ১৯৮০-১৯৮৮ সালের মধ্যে হতে থাকা ইরাক-ইরান যুদ্ধ এই কোম্পানীর পারফরমেন্সে বিশাল প্রভাব ফেলে। ইরাণের সাথে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলির লাভের ভাগ নিয়ে খেয়োখিয়িতে অনেক প্রাজেক্টে টাকা ঢালতে অনিহী দেখা দেয়।

    ৩) ইরাক – কাগজে কলমে ইরাকের জাতীয় কোম্পানীর সৃষ্টি হয় ১৯৬৬ সালে কিন্তু এর ইতিহাস ট্র্যাক করলে পৌঁছে যাওয়া যাবে ১৯২৮ সালে যখন তখনকার ইরাক পেট্রোলিয়াম কোম্পানী কিরকুক্‌ বলে একটা বিশাল তেলের ভান্ডার আবিষ্কার করে। ১৯৬১ ইরাক তেলের জাতীয়করন করে, কিন্তু ইরাক পেট্রোলিয়াম কোম্পানীর হাতে (মিলে থাকা বিপি, শেল, টোটাল, এক্সন, মোবিল এবং গালবেনকিয়ান) তখনো সব কিছু ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর এলেন সাদ্দাম কাকা। ১৯৭১ সালে কাকা সব কিছু কেড়েকুড়ে ইরাণের নিজের জাতীয়ন তেল কোম্পানীর হাতে ন্যস্ত করলেন। ২০০৩ সালের যুদ্ধের পর আরো ধোঁয়াশা তৈরী হয় যে কেমন ভাবে ওখানে বিজনেস চলবে। কিন্তু ২০০৯ নয় সালের পর আবার অনেক আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীকে ইরাকে অপারেট করার অনুমতি দেওয়া হয়।

    ৪) কুয়েত – কুয়েত ওয়েল কোম্পানী ১৯৩৪ পত্তন নয় বিপি এবং গালফ এর সাথে ৫০-৫০ রফাতে। এই কোম্পানী ১৯৩৮ সালে প্রথম ব্যবসা করার মত তেলের খনির আবিষ্কার করে। ১৯৭৫ সাল থেকে আশে পাশের দেশের মত কুয়েত জাতীয় তেল কোম্পানীও একলা চলো-রে এর পথ ধরে নিল। এই খানে বলে রাখা ভালো যে ১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের শুরুই হয় এই কুয়েতকে ইরাক আক্রমাণ করার জন্য – বলাই বাহুল্য সাদ্দাম কাকার মূল লক্ষ্য ছিল কুয়েতের তেল।

    ৫) কাতার পেট্রোলিয়াম – কাতারে নানা আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী কাতারে কাতারে ভিড় করেছিল মধুর লোভে। ১৯৭৪ সালের দিকে কাতার সরকার বলে ভাই সকল, অনেক মধু খেয়েছ – এবার আমাদের নিজেদের একটু খেতে দাও। এদের উত্তর দিকে রয়েছে বিরাট তেলের ফিল্ড যেটা কাতার ভাগ করে নেয় ইরাণের সাথে। আর গ্যাস রিসার্ভের কথা বলতে গেলে তো বলতে হয় যে, কাতার একটা গ্যাস বোমার উপর বসে রয়েছে – সেই খান থেকে গ্যাস তুলে যাচ্ছে কাতার গ্যাস (কাতার পেট্রোলিয়াম, ট্যোটাল এবং এক্সন) এবং ছোট ভাই রাস-গ্যাস। তবে কাতারের সরকার মাল মশলা বিলি করেছে নিজেদের জনতাদের অন্য দেশের সরকারের তুলনায় একটু বেশী। সেটা অবশ্য কাতারের লোক সংখ্যা অনেক কম হওয়ার জন্যও হতে পারে। কাতার অনেক ছেলে কলেজে আসে ফেরারী ড্রাইভ করে।

    ৬) ভেনিজুয়েলা – এখানেও নানা কোম্পানী চুটিয়ে ব্যবসা করেছে – ১৯৭৫ সালে তেলের জাতীয়করণ। নম্বই এর দশকের দিকে ভেনিজুয়েলা তেলের উৎপাদন জারি রাখতে সমস্যায় পরে। ২০০২ সালে জাতীয় তেল কোম্পানীর কর্মচারীরা স্ট্রাইকে চলে যায় – এর উত্তরে প্রসিডেন্ট চ্যাভেজ ৩৮০০০ কর্মচারীর মধ্যে ১২০০০ কে দুম করে ছাঁটাই করে দেন। এদের অনেকে বিদেশে পাড়ি দেয় পেটের ধান্ধায়। যারা আজাকাল তেলের কোম্পানীতে কাজ করেন, আমি নিশ্চিত যে তাদের সেই ছেড়ে আসা ভেনিজুয়েলান বন্ধু আছে কোম্পানীতে। অনেক দক্ষ কর্মচারীর নাকি ভেনিজুয়েলা ছেড়ে দেয় তিতিবিরক্ত হয়ে। পশ্চিমবঙ্গের পাবলিক হয়ে আমার অবশ্য তেমন কোন অবাক লাগে না এই ঘটনায় – তিতি বিরক্ত হয়ে জায়গা ছেড়ে যাবার গল্প আমাদের বড় চেনা।

    ৭) ব্রাজিল – এখানের জাতীয় কোম্পানী হল পেট্রোব্রাশ যা স্থাপিত হয় ১৯৫৩ সালে এবং সরকারের ৫৩% অংশীদারীরে। গভীর সমুদ্র থেকে তেল তোলার ব্যাপারে নাকি এড়া এক্সপার্ট – তবে এক্সপার্ট হলেও ২০০১ সালে এদের একটা তেল তোলার প্লাটর্ফম দুক করে ফেটে যায় এবং জলে ডুবে যায়। জোরে ধাক্কা লাগলেও এরা সেই ধাক্কা সামলে ওঠে।

    ৮) পেট্রোনাশ – এ হল মালএশিয়ার জাতীয় তেলের কোম্পানী। এটা ১৯৭৪ সালে স্থাপিত হয়েছিল মালএশিয়া সরকার দ্বারা এবং এখনো তাই আছে। এর প্রথম শেল-এর সাথে মিশে এল এন জি উৎপাদন শুরু করে ১৯৮৩ সালে এবং পরে ব্যবসা আরো বাড়ায়। আজকাল এরা বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ছে।

    ৯) চীন – সি এন পি সি হল চীনের জাতীয় তেল কোম্পানী। ১৯৪৯ সালে তেলের মন্ত্রীসভা থেকে শুরু করে এই ১৯৮৮ সালে এসে এই কোম্পানী প্রতিষ্ঠা পায়। কর্মী সংখ্যার দিক থেকে এই কোম্পানী হল বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ নিয়োগকারী। দেশের ভিতরের কাজ কার্যকলাপের জন্য চীনে রয়েছে পেট্রোচায়না ১৯৯৯ সাল থেকে। আর সি এন পি সি নাম দিয়ে কোম্পানী চীন ছাড়ার বিদেশের দিকে হাত বাড়িয়েছে তেলের ধান্দায় – ভেনিজুয়েলা, সুদান, পেরু, আলজেরিয়া এই সব জায়গায়।

    ১০) রাশিয়া – এদের দুই প্রধান কোম্পানী হল রস্‌নেফট এবং গ্যাজপ্রম। রস্‌নেফট মনে হয় প্রায় বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল কোম্পানী হতে চলেছে। রাশিয়ান সরকার ৭৫% আর বিপি নাকি ১৯.৭৫% নিয়ন্ত্রণ করবে এই কোম্পানীর। বলাই বাহুল্য এই কোম্পানীর ইতিহাসের সাথে অতোপ্রোত জড়িয়ে আছে পূর্বতন সোভিয়েত সরকারের পতন। রস্‌নেফট-কে নাকি গ্যাজপ্রমের সাথে মেলাবার চেষ্টা করা হয়েছিল অনেক, কিন্তু সব কিছু ব্যররথ করে দিয়ে ২০০৪ সালে এই কোম্পানীর রকেটপ্রম উত্থান হয়। বিপি-এর সাথে এরা প্রবল গাঁটছড়া বাঁধার চেষ্টা চালিয়েছে বা সফলও হয়েছে অনেক অংশে। অন্যদিকে গ্যাজপ্রমের ইতিহাস পাওয়া যায় সেই ১৯৪৩ সাল থেকে যখন সোভিয়েত গ্যাস শিল্পের পত্তন হয়েছিল। গরভচভের সোভিয়েত সংস্কার একটু ভালো করেছিল এই কোম্পানীর কিন্তু দূর্ণিতিও ছেয়ে গিয়েছিল কোম্পানীতে। পুতিনের আমলে ২০০১ সালে গ্যাজপ্রমের আমূল সংস্কার হয় এবং তারা পৃথিবীর গ্যাস দুনিয়ায় আবার দাদা টাইপের হয়ে ওঠে।

    [ক্রমশঃ]


    পর্ব – ৯
    -----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

    আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলির ক্ষমতা যে কত সুদূর প্রসারিত ছিল এবং তারা কিভাবে নানা দেশের ভাগ্য এবং রাজনীতি স্থির করে দিত সেই নিয়ে আলোচনা বারে বারে এই লেখার মধ্যে হয়ত চলে আসবে আমি না চাইলেও! আজকাল হয়ত নানাবিধ আইন, প্রচার, পাবলিক ভয়েস ইত্যাদি দিয়ে সেই প্রতিপত্তি অনেকটা কমে এসেছে (অন্ততঃ যতটুকু কাগজে কলমে আমরা পড়ি বা আমাদের বোঝানো হয়), কিন্তু এককালে এই তেল কোম্পানী গুলি নিজেরা ইচ্ছেমত নেচেছে এবং অন্যদেরও নাচিয়েছে সে তারা নাচতে না চাইলেও। সেই কবেই ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট আক্ষেপ করে গিয়েছিলেন, “The trouble with this country is that you can’t win an election without the oil bloc, and you can’t govern with it.”

    দীর্ঘদিন যাবৎ তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণ নিজদের ইচ্ছমত করে গ্যাছে আগের পর্বে উল্লাখিত সেই ‘সেভেন সিষ্টারস্‌”। এরা নিজেদের মধ্যে কার্টেল বানিয়ে তেলের উৎপাদন, দাম এবং বাণিজ্যিক ব্যাপার স্যাপার সবই কুক্ষিগত করে রেখেছিল। এমন কিছু ঘটনা নয় যে কেউ এটা জানত না বা এটা খুব গোপনীয় ব্যাপার ছিল – বরং অনেকক্ষেত্রে উল্টোটাই সত্যি। আমেরিকার সরকার বা অন্যদেশের সরকার সবই জানত, কিন্তু কেউ বিশেষ মাথা ঘামাত না – অন্তত একটা সময় পর্যন্ত। এই তেল কোম্পানীগুলির আচার-আচরণ এবং প্রভাব বোঝাতে গেলে, আমেরিকার অ্যান্টিট্রাষ্ট ইনষ্টিটিউট-এর একসময়ের প্রেসিডেন্ট জনাথন কানিও-এর একটা উদ্ধৃতি বেশ কাজে দেয় “The [Seven Sisters] International Oil cartel was perhaps the most significant and successful example of anti-competitive conduct in history, realigning world power, destabilizing economics and toppling governments”.

    সেই তেল কার্টেল অন্তত ততদিন পর্যন্ত তড়তড়িয়ে চলেছিল যত দিন পর্যন্ত না তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির নিজেদের বিশেষ কোন ক্ষমতা ছিল না তেল বাণিজ্য সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করার। আমেরিকার সরকারও তাই এই সব আঁতাত জেনেও চুপ চাপ থাকত এবং বখে যাওয়া ছেলেকে মা জেনে শুনে যেমন প্রশ্রয় দিয়ে চলে, তেমনি প্রশ্রয় দিয়ে বা তোল্লা দিয়ে চলত। বলতে গেলে আমেরিকার সরকার ধৈর্য্য ধরেই দুষ্টু সন্তানের কার্যকলাপ মেনে চলছিল – কিন্তু তৈল ভান্ডার যে দেশ গুলোতে আছে তাদের ধৈর্য্যের বাঁধ ক্রমশঃ ভেঙে যাবার উপক্রম হচ্ছিল। এবং কার্যত দেখা গেল যে আমেরিকার সরকারের ধৈর্য্যচ্যুতির আগেই সেই তৈল-ভাণ্ডার ধারী প্রায় শোষিত দেশ গুলির ধৈর্য্য চ্যুতি হয়ে গেল। সে এক জাতীয়তা বাদী সময় ছিল বটে – ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে অনেক দেশ স্বাধীন হব বলে নড়েচড়ে বসল এবং ফাইট দিয়ে বৃটিশ বা ফেঞ্চ কলোনীর উপাধি ঝেড়ে ফেলে নিজেরা স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। তৈল ভান্ডার ধারী দেশগুলি গুঁইগাঁই জমে জমে বারুদের পাহাড় তৈরী করলেও, তাতে আগুনের কাঠিটা দেবার প্রসঙ্গ পাওয়া যাচ্ছিল না। দূর্ভাগ্যক্রমে এমতঅবস্থায় আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানী কার্টেল-এর একটা ভুলই স্ফুলিঙ্গ ক্ষেপন করল সেই বারুদের স্তূপে।

    ১৯৬০ সাল নাগাদ আমেরিকার বাজারে চাহিদার তুলনায় তেলের যোগান বেশী হয়ে গেল। তখন স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল কোম্পানী অব নিউ জার্সি, যারা তেলের বাজারের চিরকালীন বড়দা আর কি, তারা দুম করে ঘোষণা করে দিল যে মধ্য প্রাচ্য থেকে তেল কেনা হবে ব্যরেল প্রতি ১০ সেন্ট কম দামে। আমেরিকার বাকি তেল কোম্পানীগুলিও বড়দার কথা শুনে চলল – বলল তবে তাই হোক! আর আগেই তো লিখেছি যে তখনো তেল ভান্ডার ধারী দেশ গুলির নিজেদের কোন প্রভাব ছিল না তেলের বাণিজ্য বা দাম নির্ধারণের ব্যাপারে। এর ফলে কি হল, ওই দেশ গুলির বৈদেশিক মুদ্রার আমদানী ব্যহত হল প্রবল ভাবে এবং পরোক্ষ ভাবে সেই দেশগুলির অর্থনীতি। সাদামটায় বলতে গেলে সেই দেশ গুলির অর্থনীতি কেমন চলবে ঠিক হয়ে গেল আমেরিকার এক তেল কোম্পানীর বোর্ড মিটিং-য়ে। এই জিনিসটা অতি সরলীকরণ মনে হলেও, আসলে কিন্তু তাই ঘটেছিল।

    তেলের দাম কমানোর সিদ্ধান্তের একমাসের মধ্যে তৈল-ধনী দেশগুলি সিদ্ধান্ত নিল, অনেক হয়েছে – এবার কিছু করা যাক। বাগদাদে এক মিটিং অহ্বান করা হল ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যাতে যোগ দিল সৌদি আরব, ইরান, কুয়েত এবং ভেনিজুয়েলার প্রতিনিধিরাও। এর নিজেদের মধ্যে ‘কার্টল’ বানালো, আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলির বানানো ‘কার্টেল’ এর মুকাবিলা করার জন্য। টিট-ফর-ট্যাট জাতীয় জিনিস গড়ার চেষতা আর কি। এই ভাবেই সৃষ্টি হল ‘ওপেক’ এর (OPEC – Organization of Petroleum Exporting Countries). ওপেক এর মূল লক্ষ্য ছিল বাইরের দেশ বা তেল কোম্পানীর সাথে রফা করে নিজেদের আখের আরো ভালো করে বুঝে নেওয়া।

    ওপেক গঠন হবার পর তো আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলি ক্ষেপে লাল হয়ে গেল – বলতে লাগল, এটা কি ধরণের বচ্‌পনা? এবং এটাও বলে দিল যে ওপেক জিনিস গঠনটাই এতো বালখিল্য যে, আমরা ওপেক এর অস্তিত্ত্বই মানব না! তবে ওপেক গঠনে একটা সুবিধা এই হয়েছিল যে, আমেরিকার তেল কোম্পানী গুলি সরকারকে উদাহরণ দিয়ে দেখাল যে, দ্যাখো, ওই তৈল-ধারী দেশগুলি নিজেরা কেমন খেলাঘর বানিয়েছে নিজেদের মধ্যে একসাথে মিলে। তাহলে আমাদের দেশের তেল কোম্পানীগুলির নিজেদের মধ্যে মেলামেশা বাড়তে দেওয়া হোক – এতে আখেরে আমেরিকারই লাভ। বাইরের চাপ আমরা একসাথে মিলে ট্যাকেল করব। তখন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডি – তিনি আবার পরামর্শ চাইলেন জন ম্যাকলয় এর কাছ থেকে ১৯৬১ সাল নাগাদ – হ্যাঁগো, এই ওপেক নিয়ে তা হলে আমেরিকার কি করা উচিত। জন ম্যাকলয় আবার বহু পোড় খাওয়া মাল – আমেরিকার তেল কোম্পানীগুলিকে সে অনেকদিন ধরে পরামর্শদান কারীর কাজে ছিল। সে তো মুক্ত কন্ঠে বলল – ওপেককে মুকাবিলা করতে গেলে, আমেরিকার নিজেদের তেল কোম্পানীগুলিকে আরো বেশী মেলামেশা করে একজোট হতে হবে। এবং সেই মেলামেশা সরকার তেড়ছা চোখে দেখলে হবে না।

    তবে ব্যাপার হল গিয়ে, গোটা ষাটের দশক জুড়ে আমেরিকা খুব একটা মাথাব্যাথার কারণ ওপেক হয় নি। কারণ ওপেক নিজেদের নাবালকত্ব কাটিয়ে উঠিতেই করতেই ব্যস্ত ছিল। ১৯৭০ দশক নাগাদ আমেরিকার নিজেদের আভ্যন্তরীণ তৈল উৎপাদন সর্বোচ্চ স্তরে গিয়ে পৌঁছালো – কিন্তু দেশের ভিতরে তোলা সেই তেল দিয়ে পুরো চাহিদা মেটানো যাচ্ছিল না। এই ব্যাপারে আমেরিকার আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলির নিজেদের কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে ঠিক মত চাহিদার অন্দাজ করতে না পারার। আমেরিকায় তেলের ১৯৭০ সাল নাগাদ যা চাহিদা হতে পারে ভবিষ্যৎবাণী করেছিল কোম্পানীরা, তার থেকে চাহিদা অনেক বেশী দেখা গেল কার্যক্ষেত্রে। কিন্তু এবার চেষ্টা করেও আর তেল কোম্পানীগুলু তেলের উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হল না। ফলে সেই সময় থেকেই আমেরিকা নির্ভর করতে শুরু করল অনেকাংশে আমদানীকৃত তেলের উপর। পাশার ডান পাল্টাবার সময় এসে গেল – ওপেক গঠনের পর সেই প্রথম বার তেল ভান্ডারধারী দেশগুলি তেলের দাম নিয়ে রফা করার মত অবস্থায় চলে এল।

    ওপেক-র অংশগ্রহনকারী দেশের সংখ্যা দুরদার করে বেড়ে উঠল এই সময় – আস্তে আস্তে যোগদান করল কাতার (১৯৬১), ইন্দোনেশীয়া (১৯৬২, অবশ্য ২০০৯ সাল থেকে আবার এরা মেম্বার নয়), লিবিয়া (১৯৬২), সংযুক্ত আরব আমির শাহী (১৯৬৭), আলজেরিয়া (১৯৬৯) এবং নাইজেরিয়া (১৯৭১)। সব মিলিয়ে ওপেক দেশগুলি মোট তৈল উৎপাদনের অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল – নিজেদের মধ্যে যুক্তি করে এমন ভাবে তেলের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল যে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলি ওপেক দেশ গুলির নির্ধারিত দাম মেনে নিতে বাধ্য হল। মাঝে ওপেকে ঢুকেছিল ইকুয়েডর এবং গ্যাবন – কিন্তু এরা বাচ্চা তেল উৎপাদনকারী দেশ – ২০০৭ সালে ইকুয়েডর অপেক থেকে সরে গিয়েছিল, গ্যাবন তো তার আগেই ১৯৯৪ সালে। অ্যাঙ্গোলা ঢুকেছিল ২০০৭ – তাহলে দাঁড়াচ্ছে আজকের ওপেক-এ রয়েছে ১২টি দেশ।

    তেল নির্ভর আধুনিক সভ্যতায় ওপেক দেশগুলির প্রভাব প্রথম হাড়ে হাড়ে মালুম হতে শুরু করল ১৯৭৩ সালের আরব-ইজরায়েলের যুদ্ধের পর। আমেরিকা ইজরায়েল-কে খুল্লাম-খুল্লা সমর্থন করল যেটা ওপেকের আরব দেশ গুলি খুব একটা ভালো চোখে দেখল না। ততোদিকে ওপেক দেশগুলি এই টুকু বুঝে ফেলেছে যে তেল-কে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার যুগ চলে এসেছে। আমেরিকার ইজরায়েল সমর্থনে নারাজগি প্রকাশ করে সৌদি আরবের রাজা বললেন যে এমত অবস্থায় আমাদের আমেরিকাকে তেল সরবরাহ করা সম্ভব নয় এমনকি আমেরিকা-কে বন্ধু বলে ভাবা যাবে কিনা সেটাও পুনর্বিবেচনার সময় চলে এসেছে। আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলি অনেকে তাড়াতাড়ি সৌদির পক্ষ নিতে শুরু করল – কারণ সৌদির তেল তাদের প্রচুর মুনাফার মুখ দেখায়। টেক্সাকো, মোবিল এই কোম্পানীগুলি আমেরিকার সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করল এই বলে যে, মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলের সমর্থন নয় – বরং বিরোধিতা করা হোক। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিক্সন সেই দাবী মেনে নিলেন না।

    আরব ইজরায়েলের যুদ্ধু শুরু হল ৬ই অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে। এর একমাসের মধ্যেই ওপেক দেশ গুলি ঠিক করে নিল যে আমেরিকায় তেল সরাবরাহ করা হবে না। ওপেক আরো ঠিক করে দিল যে ব্যরেল প্রতি তেলের দাম হবে ১১.৬৫ ডলার যা কিনা ১৯৭০ সালের ব্যারেল প্রতি তেলের দামের থেকে ৪৬৮ শতাংশ বেশী! আমেরিকার এবং পৃথিবীর অর্থনীতিতে চোট পৌঁছালো – কিন্তু আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলির কিছুই ক্ষতি হল না! ব্যবসার এমনি মজা – সৌদির নির্দেশে আমেরিকার নিজের দেশের কোম্পানীই তাদের দেশে তেল পাঠানো বন্ধ করেছিল। আর বাইরের বাজারের বেড়ে যাওয়া দামের সাথে পাল্লা দিতে সেই আমেরিকান কোম্পানীগুলি নিজেদের লাভ কমায় নি আম জানতার মুখ চেয়ে – বরং দাম বাড়িয়ে জনতার নাভিশ্বাস ফেলে দিয়েছিল।
    অক্টোবর ১৯৭৩ থেকে ফেব্রুয়ারী ১৯৭৫ সালের মধ্যে আমেরিকার গ্যাসোলিনের দাম বেড়েছিল ৩০% এবং ঘর গরম করার তেল (হিটিং ওয়েল) এর দাম বেড়েছিল ৪০%। আর ওদিকে আমেরিকার তেল কোম্পানী গুলির মুনাফা বেড়েই চলেছিল – লালে লাল হয়ে গিয়েছিল। এক্সনের ল্যাব বেড়েছিল ২৯%, মোবিলের ২২%, টেক্সাকোর ২৩% এবং স্ট্যান্ডার্ড ওয়েল অব ইন্ডিয়ানার লাভ বেড়েছিল ৯০%। তবে সুখের কথা আরব-ইজরায়েল নিজেদের মধ্যে মারপিট থামালে (বা কম করে আনলে) তেলের এম্বার্গো উঠে যায় ১৮ই মার্চ, ১৯৭৪ সালে – শুরুর ঠিক তিন মাস পর।

    সেই তিন মাসেই ওপেক দেশগুলি আমেরিকা-কে যা খেল দেখিয়েছিল – তাতে করে আমেরিকা বুঝে গিয়েছিল কিছু একটা করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য এবং ওপেক দেশ গুলির তেলের বিষয়ে আমেরিকার অবশেসনের সেই শুরু। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং ফোর্ডের আমলে সেই কাজ পুরো দমে শুরু হয় – এবং এতটাই বিস্তারিত কাজ হয় যে, এমন মন্তব্যও গবেষকরা করেছেন যে, “The primary goal of Nixon and Ford administration was to break OPEC.” সরকারের সুরক্ষা পরমর্শদাতা হেনরী কিসিঙ্গার তিন মূল বিষয়ের উপর জোর দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন, ১) সৈন্য জোর করে ঢুকিয়ে তেলের দখল নেওয়া, ২) তৈল সম্পদ রক্ষা এবং ৩) ওপেক দেশগুলির বাইরে তেল খুঁজে বের করা। ইনি নাকি এটাও পরামর্শ দিয়েছিলেন সরকারকে যে আমেরিকার বায়ুসেনা ব্যবহার করে সৌদি আরব, আরব আমিরসাহী এবং কুয়েতের তেল খনির দখল নিয়ে নিতে। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সেই প্রস্তাবে সায় দেন নি। এবার বেশী বেশী রাজনীতির গল্প চলে আসছে মনে হচ্ছে – তেল রাজনীতি এবং যুদ্ধের গল্প আবার পরে হবেক্ষণ।

    তাহলে ওপেক-এর কাজটা ঠিক কি এবং এরা কেমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করে? মোদ্দা কথা বলতে গেলে ওপেক ঠিক করে যে তাদের সদস্য দেশ গুলি ঠিক কি পরিমাণে তেল উৎপাদন করবে যাতে করে পৃথিবীর তেলের বাজারের ব্যালেন্স ঠিক থাকে এবং তেলের দাম এক পূর্বনির্ধারিত পরিসীমার মধ্যে থাকে। সদস্য দেশ গুলির প্রত্যেকের তেল উৎপাদনের কোটা (ভাগ) আছে – যদিও ওপেক নিজে কোনদিন খোলসা করে বলে নি যে সেই কোটা ঠিক কি নিয়ম মেনে তৈরী হয়েছিল। তবে অনেকে অনুমান করে যে সেই কোটা ঠিক করার একটা প্রধান ফ্যাক্টর ছিল সেই সদস্য দেশের তেলের প্রমাণিত সংরক্ষণ (রিজার্ভ) কত আছে। বলাই বাহুল্য সে এই ওপেক দেশগুলির মধ্য সৌদি আরবই বড়দা। কাগজে কলমে সব দেশেরই সমান ভয়েস থাকার কথা – কিন্তু ওই যে – সব কিছু তো আর গণতন্ত্র দিয়ে বিচার করা হয় না। সৌদির ধার বেশী – ভারও বেশী। এই মুহুর্তে পৃথিবীতে প্রমাণিত তেলের রিজার্ভের প্রায় ৭৩% আছে ওপেক দেশগুলির কাছে – এই এক পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যেতে পারে তেলের দামের নির্ধারণে কেন এরা এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বেশী কচকচির মধ্যে গিয়ে লাভ নেই – একথা বলা যেতে পারে যে এই মূহুর্তে সৌদি আরবের তেলের ট্যাপ বন্ধ করা বা না করার সিদ্ধান্ত আপনার-আমার জীবনে বেশ কিছুটা প্রভাব ফেলবে, আমাদের অজান্তেই, এমনকি না চাইলেও! তা সে আপনি যতই পবন বা সূর্য দেবের উপাসক হোন না কেন!

    [ক্রমশঃ]
    পর্ব – ১০
    ----------------------------------------------------------------------------------------

    আর বাকি সব ব্যবসার মতই তেল ব্যবসাতেও সাপ্লাই-ডিমান্ড ব্যাপারটা খুব প্রকট ভাবে আছে। পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও তেলের দামের উপর প্রায় কোন আঁচই ফেলে না যদি না নেই ঘটনা তেলের সরাবরাহকে কোনভাবে বিঘ্নিত না করে। তাই দেখা গেছে যে কোরিয়ায় যুদ্ধ (১৯৫০-১৯৫৩), কিউবার মিসাইল সঙ্কট (১৯৬২) বা ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৬৫-১৯৭৫) এরা কিছুই তেলের বাজারকে খুব বেশী প্রভাবিত করতে পারে নি, কারণ এই সব যুদ্ধের সাথে তেলের সরাবরাহের কোন সরাসরি সম্পর্ক ছিল না। এবার তাহলে ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে যে তেলের দাম কি হবে আর সেটা ঠিক করবে কে? ব্যবসা চালাতে গেলে পণ্যের বিক্রয় মূল্য তার উৎপাদন খরচের থেকে বেশী হবে হবে একটা একটা নূন্যতম শর্ত – কিন্তু কত বেশী? তৈল উৎপাদনকারী দেশ গুলি বিশেষ করে যাদের জি ডি পি-র বেশীর ভাগটাই নির্ভর করছে তেল রপ্তানীর উপরে তারা যে তেলের দাম বেশী চাইবে সেটাই স্বাভাবিক। ন্যায্য মূল্য তা হলে ঠিক হবে কি ভাবে? এ এক জটিল ব্যাপার – আমাদের বাঙলার আলু চাষের পর আলুর দাম কেমন হবে – তার থেকেও ঘোরতর বিষয়। আলুর প্রকার ভেদের থেকেও তেলের প্রকারভেদ অনেক অনেক বেশী। কিন্তু এবার আপনি যদি ভেবে ফেলেন যে তেলের দামের বাড়া-কমা শুধু মাত্র সাপ্লাই-ডিম্যান্ড এর উপর নির্ভর করছে তা হলে অতি সরলীকরণ করে ফেলবেন – এখানেই আলুর থেকে তেলের ব্যবসা আলাদা। সাপ্লাই-ডিম্যান্ড এর সূত্র না মেনেই তেল যে কেমন ভাবে নিজের মত নেচে গ্যাছে মাঝে মাঝে সেই নিয়ে আমরা খানিক পরে আলোচনা করব।

    নয় নয় করেও পৃথিবীতে প্রায় ৪০০ রকমের অপরিশোধিত তেল (ক্রুড অয়েল) পাওয়া যায়। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশাল তৈল খনি থেকে পাওয়া তেলের ধর্ম অনুযায়ী এক প্রকার অপরিশোধিত তেলের নামকরণ করা হয় – যেমন ‘আরব লাইট’ – এটা হচ্ছে সৌদি আরবে গওয়ার তৈলখনি থেকে পাওয়া তেলের ধর্ম অনুযায়ী সনাক্তকরণের পদ্ধতি। আবার অনেক ক্ষেত্রে ছোট ছোট ফিল্ড থেকে পাওয়া তেল মিশিয়ে একপ্রকার ব্লেন্ড তৈরী করা হয় যাতে করে তেলের কোয়ালিটি এক নির্দিষ্ট মাত্রার হয়। এর উদাহরন হল – ব্রেন্ট ব্লেন্ড।

    কোন অপরিশোধিত তেলের উপযোগীতা কত (এবং তার উপর নির্ভর করেই দাম), সেটা নির্ভর করে তা পরিশোধন করে কি কি পাওয়া যাবে তার উপর। যেমন হালকা অপরিশোধিত তেল (লাইট ক্রুড) থেকে পাওয়া যায় গ্যাসোলিন, জেট-ফুয়েল এবং ডিজেল। অন্যদিকে হেভী ক্রুড পরিশোধনে করলে পাওয়া যায় ভারী জ্বালানী তেল গুলি। বাজারে গ্যাসোলিন এবং ডিজেলের দাম ভারী জ্বালানী তেলের থেকে বেশী – তাই লাইট ক্রুডের চাহিদাও বেশী।
    ক্রুড অয়েলের ঘনত্ব মাপতে সচারচর যে পরিমাপক ব্যবহার করা হয় তাকে বলে ডিগ্রী এ পি আই (API – American Petroleum Institute)। সেইমত ক্রুড অয়েলকে নিম্ন লিখিত ভাবে ভাগ করা যাবেঃ

    ১) এক্সর্টা লাইট ক্রুড – ৪৫° API এর থেকে বেশী
    ২) লাইট ক্রুড – ৩৩ থেকে ৪৫° API
    ৩) মিডিয়াম ক্রুড – ২২ থেকে ৩৩° API
    ৪) হেভী ক্রুড – ১০ থেকে ২২° API
    ৫) এক্সর্টা হেভী ক্রুড – ১০° API থেকে কম

    ক্রুড অয়েলের মধ্যে কত গন্ধক (সালফার) আছে তার উপর নির্ভর করেও তেলের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। কারণ সলফার খুব একটা সুবিধার জিনিস নয় বা পরিবেশের জন্যও ভালো নয়। তেল পরিশোধনের সময় সেই সালফার নিষ্কাষন করতে হয় তেল থেকে। এবার যেই ক্রুডে সালফার যত বেশী তাত বেশী শক্ত এবং তত খরচা সাপেক্ষ সেই তেল পরিশোধন। মোটামুটি দেখা গ্যাছে যে লাইট ক্রুডে সলফারের পরিমাণ কম থাকে – হেভী ক্রুডে অনেক সময় নয় নয় করেও ৫-৬% বা তার বেশী সালফার থাকে।

    ক্রুড অয়েলের দাম বলতে আমরা সাধারণত যেটা উল্লেখ করে থাকি সেটা হল ফ্রী অন্‌ বোর্ড (FOB) দাম। এ দামটা হল ক্রুড ওয়েলের জাহাজে চাপার সময় উৎস বন্দরের দাম, মানে যেখান থেকে লোডিং হচ্ছে সেই বন্দরের দাম। ক্রুড অয়েলের দাম বলতে আবার একটা জিনিস উল্লেখ করা হয়, যা হল CIF (cost, insurance, and freight) – মানে সেই ক্রুড গন্তব্য বন্দরে পোঁছবার পর তার দাম। কোন এক নির্দিষ্ট সময়ে এক বিশেষ প্রকার তেলের FOB দাম একটাই হওয়া উচিত নিয়মমত, যদিও সেই ক্রুডে-রই CIF দাম বিভিন্ন হতে পারে মাল কোথায় গিয়ে পোঁছাচ্ছে তার উপর।

    আমি যদি তেলের রিফাইনারীর মালিক হই, তাহলে বলাই বাহুল্য যে দুই জায়গা থেকে আগত ক্রুড অয়েল এক কোয়ালিটির হলে যার দাম কম আমি তার কাছ থেকেই কিনব। মানে আমার কাছে দাম হচ্ছে CIF দাম। এবার ধরা যাক নর্থ সী থেকে আর নাইজেরিয়া থেকে আমি একই কোয়ালিটির তেল পাচ্ছি ইউরোপের রটারডামের আমার রিফাইনারীতে। নর্থ সী থেকে রটারডামের পরিবহন খরচা ০.৫ ডলার/ব্যারেল – অন্যদিকে নাইজেরিয়া থেকে পরিবহণের খরচা ১ ডলার/ব্যারেল। তাহলে নর্থ সী যদি FOB দাম ধার্য করে ২৫ ডলার/ব্যারেল, তাহলে নাইজেরিয়াকে সেই একই তেল ২৪.৫০ ডলার/ব্যারেল এ বিক্রী করতে হবে, বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য।

    ১৮৫৯ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত তেলের দাম খুব ওঠা নামা করছিল কারণ চাহিদার হেরফের এবং নতুন নতুন তৈল খনির আবিষ্কার। তেলের চাহিদা বাড়ছিল, কিন্তু নতুন খনি আবিষ্কারের ফলে বাজারে দুম করে তেল চলে আসতে শুরু করেছিল বেশী করে। ফলে দাম পড়ে গেল আবার – এই ভাবেই চলছিল যতদিন না রকফেলার কাকু তেলের মার্কেট কুক্ষিগত করে ব্যাপারটা সিধা করলেন। কাকু চালু করলেন একটা কনসেপ্ট যার নাম ছিল তেলের “পোষ্টেড প্রাইস”। যেহেতু কাকুর অধীনেই বেশীর ভাগ তৈল পরিশোধন কারখানার মালিকানা ছিল, তাই তিনি বললেন, বাপু যে যা পারছ খুঁড়ছ আর তেল তুলছ ঠিক আছে, কিন্তু আমার রিফাইনারীতে আমি এর চেয়ে বেশী দামে ক্রুড কিনতে পারব না! সেই দামটাই হল “পোষ্টেড প্রাইস”। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সেই “পোষ্টেড প্রাইস”-এর কনসেপ্ট তেল ব্যবসার অন্য ক্ষেত্রেও চালু হতে শুরু করল। যারা তেল উৎপাদন করত তারা এবার “পোষ্টেড প্রাইস” ঠিক করল – বলল এর থেকে কম দামে আমরা তেল বিক্রী করব না! ১৯৭০ সালের পর থেকে তেলের জাতীয়করণ শুরু হলে প্রধান তেল কোম্পানীগুলি কতৃক স্থির করে দেওয়া “পোষ্টেড প্রাইস” ব্যাপারটা লোপ পায়।

    যখন আমেরিকায় স্ট্যান্ডার্ড অয়েল ভেঙে গেল, রাম-শ্যাম-যদু মার্কেটে ঢুকে পড়ে এবং আঁদারে-পাঁদাড়ে তেল আবিষ্কার করে তেল ব্যবসায় লাগামছাড়া কম্পিটিশন এনে দিল এখন ‘প্রো-রেটিং’ বলে একটা ব্যাপার আমেরিকায় চালু করা হয়। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ চালুকালীন এবং যুদ্ধ শেষের ঠিক পরে তেলের দাম খুব বড়ে গিয়েছিল – ১৯১৬ সালে ১.২০ ডলার /ব্যারেল থেকে ১৯২০ সালে ৮ ডলার/ব্যারেল। কিন্তু ওই যে দামের কোন স্থিরতা রইল না লাগামছাড়া প্রতিযোগিতা এবং আরো নতুন নতুন তেলের খনি আবিষ্কারের ফলে। বরং এই সবের ফলে তেলের দাম দুম-দাম করে পড়ে গেল। তিরিশের দশকে তেলের দামের এই চুরমার হয়ে যাওয়া সামাজিক দাঙ্গা-হাঙ্গামা এবং অস্থিরতা ডেকে আনে। তার ফলে সরকার বাধ্য হল যেখান-সেখান থেকে যেমন-তেমন তেল উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করার কথা ভাবতে। এই ভাবেই জন্ম হল ‘প্রো-রেটিং’ সিষ্টমের যেখানে আন্ত-রাজ্য কমিটি বসে বিভিন্ন রাজ্যের কোটা এবং তেলের দাম স্থির করে দিল।

    সেই সময় পৃথিবীর মোট তেল উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক হত আমেরিকায় – কিন্তু সেই ‘প্রো-রেটিং’ ব্যাপারটা ক্রমশঃ আমেরিকার তেলের বাজারকে আন্তর্জাতিক তেলের বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল। আর সেই আঁচটা বেশ ভালো ভাবে মালুম করছিল বাইরে ব্যবসা করে খাওয়া আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলি। নিজেদের মধ্যে খেয়োখিয়ি করেই নিজেদের মুনাফা কমিয়ে ফেলছিল। ১৯২৮ সাল নাগাদ যখন আবার তেলের দাম পড়ে গেল – তখন সেই বড় কোম্পানীগুলি ঠিক করল অনেক হয়েছে, এবার নিজেদের মধ্যে একটু বসা যাক। যেমন ভাবা তেমন কাজ, রয়েল ডাচ শেল, স্ট্যান্ডার্ড অয়েল অব নিউ জার্সি (পরে এক্সন) এবং অ্যাংলো-পার্শিয়ান (পরে বিপি) -র বড় কর্তারা মিটিং করলেন স্কটল্যান্ডের অখনাক্যারী বলে একটা জায়গার ক্যাসেলে-এ। এরা নিজেদের মধ্যে মিটিং করে ঠিক করলেন যে তেলের উপরি (সারপ্লাস) উৎপাদন উনারা বন্ধ করবেন, নিজেদের মধ্যে মার্কেট শেয়ার ভাগাভাগি করে নেবেন এবং নতুন মার্কেট দখল করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে রেশারেশি করবেন না।

    উনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষ দশক পর্যন্ত তেলের দামের এই রীতি ছিল যে, যেখান থেকেই তোলা হোক না কেন, তা বিক্রী হত এমন ভাবে যেন সেই তেল আদপে উৎপন্ন হয়েছে নিউ-ইয়র্ক-এ। এমনি ছিল আমেরিকার প্রাধান্য তেলের বাজারে। আখনাক্যারী চুক্তি নিউ-ইয়র্ক থেকে ব্যাপারটা একটু সরিয়ে টেক্সাস ভিত্তিক করে ফেলল, কারণ টেক্সাস-ই তখন আমেরিকার তৈল-কেন্দ্র বলা যেতে পারে। এবার চালু সারা বিশ্বে গালফ-অব-মেক্সিকো ভিত্তিক ফ্রী-অন-বোর্ড (FOB) দাম, যার উপর এবার যুক্ত হবে সেই উপসাগর থেকে তেল যেখানে সরাবরাহ করা হচ্ছে সেখানকার পরিবহন খরচা। ১৯৩০ সালের বড় সড় সব তৈলখনি মধ্যপ্রাচ্যে আবিষ্কার হবার পর গালফ-অব-মেক্সিকো ভিত্তিক ফ্রী-অন-বোর্ড (FOB) দামের কনসেপ্ট মধ্যপ্রাচ্যকে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে লাগল কারণ সেখানে তেলের উৎপাদন খরচ কম। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই দাম ফিক্সের ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ করল আমেরিকান এবং বৃটিশ নেভী। তারা দেখল গালফ-অব-মেক্সিকো ভিত্তিক ফ্রী-অন-বোর্ড (FOB) দাম দিতে গিয়ে তাদের তেলের দাম অনেক বেশী পড়ে যাচ্ছে। তারা তখন দাবী করল যে, ভাইলোগ, এটা খুব না-ইন্সাফি হচ্ছে – তোমরা তেল তুলছ মধ্যপ্রাচ্যে কম দামে, আর মাল বেচছ টেক্সাসের দামে! তোমরা আরব উপসাগর ভিত্তিক দামের রেফারন্স চালু কর। আরবিয়ান- গালফের FOB দামের সামজ্ঞস্য রাখা হল গালফ-অব-মেক্সিকো ভিত্তিক FOB এর সাথে। যুদ্ধ শেষের পর জল আরো বয়ে গেল নদী দিয়ে – যুদ্ধের পর আমেরিকায় এবং ইউরোপের উন্নত দেশগুলিতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেলের আমদানী বেড়ে গেল – যার ফলে ১৯৪৯ সাল নাগাদ চালু হল “পোষ্টেড – প্রাইস”। ক্রুড অয়েলের FOB দাম এমন রাখা হল যাতে নিউ ইয়র্ক এবং টেক্সাসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে নব্বই দশকের মাঝ পর্যন্ত তেলের “পোষ্টেড – প্রাইস” কখনও অনেকদিন বা কখনও স্বল্প সময় দামের স্থিরতা দেখেছিল। সেই পোষ্টেড প্রাইস নয় ঠিক করে দিয়েছিল প্রধান আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানীগুলি বা তেল উৎপাদনকারী দেশের সরকার। ১৯৮৫ সালের পূর্বে ফ্রী-মার্কেট মেকানিজম্‌ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে নি তেলের দাম নির্ধারণে।

    আগেই যেমন লিখেছি, আন্তর্জাতিক বড় বড় তেল কোম্পানীগুলি (বিগ অয়েল) নিজেদেরও ক্রমবিবর্তমান বাজারের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সাজিয়ে নিচ্ছিল। তেলের জাতীয়করণের পর বিগ ওয়েলের মধ্যে যে ঢেউটা এল তা হল কোম্পানীর মার্জার। কিছু বড় বড় তেল কোম্পানীগুলি নিজেরা মিশে গেল – যার ফলে তাদের হাতে চলে এল দুই কোম্পানীর মিলিত তেল রিজার্ভ এবং বেশী মূলধন। সেই মূলধনের সাহায্যে বিগ অয়েল এমন সব টেকনলজী ব্যবহার করতে লাগল এবং এমন সব জায়গায় তেল এক্সপ্লোর করতে লাগল যেখানে আগে যাওয়া খুব খরচসাপেক্ষ হতে মনে হত। বিগ অয়েল শুধু তেল তোলা নয় – তোলা থেকে পরিশোধন থেকে তেলকে কমোডিটি হিসাবে বেচা – অর্থাৎ পুরো সাপ্লাইচেনেই নাক গলিয়ে বাজার কন্ট্রোল করতে উৎসুক হয়ে পড়ল আরো বেশী করে। কিন্তু এত করেও বিগ অয়েল তাদের সেই ‘সেভেন সিষ্টারস্‌’ আমলের প্রতিপত্তি আর ফিরে পেল না – না তেলের মার্কেট নিয়ন্ত্রন করতে না তেলের দাম নির্ধারণ করতে! কিন্তু আবার যদি আপনি ভাবেন বিগ অয়েল হাল ছেড়ে দিয়ে বসে রইল, তা কিন্তু নয়! হাল ছেড়ে বসে দেবার পাবলিক এরা নয় এবং হাল ছাড়ার অভ্যাস থাকলে একশো বছরের বেশী সময় ধরে এরা নিজেদের অস্বিত্ত্ব টিকিয়ে রাখতে পারত না!

    আজকের দিনে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম কত হবে তার অনেকটা নির্ভর করে ‘এনার্জি ফিউচারস্‌ ট্রেডারস্‌’ দের কার্যকলাপের উপর। এদের অনেকেই আবার বিগ অয়েলর হয়েও কাজ করে। তেলের কোম্পানীগুলি, আমেরিকার প্রধান প্রধান ব্যাঙ্কগুলি, এনরন এবং সম-মনোভাবাসম্পন্ন উৎসাহী পার্টিরা সরকারের কাছে লবি করে করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে এই তেলের দাম রেগুলেশন ইত্যাদি সম্পর্কে সরকার চোখটি বুজে থাকবে এবং বিশেষ কোন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে না। এইভাবে দেখা যায় তেল যদিও অত্যন্ত মূল্যবান একটি দ্রব্য জাতীয় অর্থনীতি, সুরক্ষা এবং প্রগতির দিক থেকে – কিন্তু এর বাজার বলতে গেলে সরকার দ্বারা সবথেকে কম নিয়ন্ত্রিত! তেলের দাম বাকি অনেক কিছুর উপর নির্ভর করলেও, জ্ঞানী গুণি লোকেদের মতে তেলের দাম নির্ধারণকারী কারণগুলির মধ্যে সবচেয়ে কম আলোচিত বিষয় হল ‘ডি-রেগুলেশন অব এনার্জি ট্রেডিং’। অ্যানালিষ্টরা এও দাবি করেছেন, এমন সময় গ্যাছে যখন ব্যারেল প্রতি তেলের দামের প্রায় অর্ধেক প্রভাবিত ছিল এই এনার্জি ট্রেডারস্‌দের দ্বারা। এনরন যেমন ২০০০ সালে ওয়েষ্ট কোষ্টের ইলেক্ট্রিক মার্কেটকে প্রভাবিত করে ম্যানুপুলেট করেছিল, ঠিক তেমন ভাবেই নাকি তেলের মার্কেটকে ম্যানিপুলেট করা হয়েছিল এই ডি-রেগুলেশন দ্বারা। এনরন ভেঙে পড়ার পর এই অবস্থার অনেকটা পরিবর্তন হলেও এখনও নাকি তেলের ট্রেডারস্‌ দের কাছে ‘এনরন লুপহোল’ একটা পরিচিত এবং ব্যবহৃত নাম।

    বাকি সব ভোগ্যপণ্যের মত তেল ব্যবসাতে সাপ্লাই-ডিম্যান্ড ব্যাপারটা বেশ ভালো ভাবে থাকলেও, এই যে তেলের দাম মাঝে মাঝে রকেটের মত চড় চড় করে উঠে যায় তা কিন্তু সাপ্লাই-ডিম্যান্ড সূত্র দিয়ে ব্যখ্যা করা যায় না! সে এক জটিল জিনিস, আমিও ঠিক বুঝি তা নয় – তবে বই পড়ে যা জেনেছি তা সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। ২০০৮ সালের আগে তেলের দাম সবচেয়ে বেশী দেখা গিয়েছিল ১৯৮১ সালে, ৪৪ ডলার/ব্যারেল, যেটাকে মুদ্রাস্ফিতি ইত্যাদি দিয়ে অ্যাডজাষ্ট করলে ২০০৮ সালের দাম দাঁড়ায় ১০৪ ডলার/বারেল। তা ২০০৮ সালের ৫ই মার্চ তেলের দাম সেই ১০৮ ডলার ছাড়ালো এবং আরো বাড়তে থাকল জুলাই পর্যন্ত যখন দাম গিয়ে দাঁড়ালো ১৪০ ডলার/ব্যারেল। ১৯৮১ সালের তেলের দামের সেই বেরে যাওয়া পৃথিবীতে এক বাজে রকমের মন্দা ডেকে এনেছিল এবং তারই প্রায় পুনরাবৃত্তি দেখা গেল আবার ২০০৮ সালের পর। সেই সালের ডিসেম্বর মাসে তেলের দাম প্রায় ৪০ ডলার ছুঁল। সৌভাগ্যবশতঃ চার-পাঁ মাস পর থেকে দাম আবার বাড়তে শুরু করে ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে ৮০ ডলার ছাড়ালো। তখন থেকে শুরু করে ২০১৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তেলের দাম ৮০ ডলার/ব্যারেল এর উপরেই ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের পর থেকে শুরু হল তেল ইন্ডাষ্ট্রির মন্দা। মজার কথা এই যে এই বার কিন্তু গ্লোবাল ইকনমি ততো সাফার করল না যতটা করল তেল ব্যবসা নিজে। তেলের দাম কমতে কমতে ২৫ ডলার/ব্যারেল হয়ে গেল ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে। তার পর আবার আশার আলো – আস্তে আস্তে তেলের দাম বাড়া শুরু, এই লেখার সময় তেলের দাম প্রায় ৫৮ ডলার ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ এর মধ্যে তেলের ইন্ড্রাষ্টিতে অনেক পাবলিক চাকুরি হারাল – অনেকে বলেন সেই সংখ্যা নাকি ৪-৫ লক্ষরও বেশী।

    ১৯৮৮ সাল থেকে ২০০৮ সালের তেলের দাম পড়ে যাবার আগে কিন্তু তেলের দাম বেশ ভালোই বাড়ছিল এবং ভালো মানে খুবই দুর্বার গতিতে। ১৯৮৮ সালের গড় দাম ১৮ ডলার/ব্যারেল থেকে ২০০০ সালে গড় দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেল – ৩৬ ডলার/ব্যারেল। ২০০০ থেকে ২০০৫ এর মধ্যে আবার দাম দ্বিগুণ – ৬০ ডলার/ব্যারেল। কিন্তু ২০০৭ থেকে ২০০৮ এর মধ্যে তেলের দাম বাড়া সব কিছু আগের ইতিহাস ছাড়িয়ে গেল, ৫৫ ডলার/ব্যারেল থেকে বেড়ে হয়ে গেল ১৪৫ ডলার/ব্যারেল! এমন লাগামছাড়া দাম বাড়া তেলের ইতিহাসে মাত্র দুই বার হয়েছিল – ১৯৭৩ এবং ১৯৭৯ এনার্জী সঙ্কটের সময়, যখন মার্কেটের ম্যানিপুলেশন করা হয়েছিল প্রবল ভাবে যাতে করে তেল উৎপাদনকারীদের সুবিধা হয়। অনেকে বলেন ডলারের দাম পড়ে যাওয়ার সাথে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার এক সম্পর্ক আছে – হ্যাঁ, সম্পর্ক আছে, কিন্তু তা এমন প্রবল নয় যে যখন ২০০৭ আর ২০০৮ এর মধ্যে ডলারের ভ্যালু ১০% কমে যায়, তখন তেলের দাম বাড়ে ৮৫%!

    তাহলে কি তেলের দামের এই বাড়া কমা পুরোটাই সাপ্লাই-ডিম্যান্ডের ভিত্তিতে? একটু দেখা যাক এই ব্যাপারটা – আমরা সবাই জানি যে মনুষ্য সভ্যতা হিসাবে আমরা ক্রমশঃ পিক্‌ অয়েলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি (পিক্‌ অয়েল নিয়ে পরে আরো কথা হবে)। মানে হল গিয়ে পিক্‌ অয়েলের পর শুধুই ডাউনফল। তেলের ভাঁড়ার ক্রমশ খালি হয়ে আসবে এবং তেল অপর্যাপ্ত। তাহলে আমরা ভেবে নিতেই পারি যে, তাহলে তো তেলের দাম বাড়বেই! এতে অবাক হবার কি আছে? সাপ্লাই কমলে আর ডিম্যান্ড বাড়লে তেলের দাম তো বাড়বেই! কিন্তু ব্যাপারটা অতো সরল নয়, বরং একটু জটিল।

    বিশ্বে তেলের চাহিদা প্রধানত নির্ধারিত হয় আমেরিকা, চীন এবং ভারতের দ্বারা। কিন্তু দেখতে গেলে আমরা এমন অবস্থায় এখনো পৌঁছুই নি যেখানে চাহিদার তুলনায় যোগান কম! বরং উল্টোটাই – পৃথিবীতে বেশ অনেকদিন ধরেই তেলের যোগান চাহিদার থেকে বেশী। আমেরিকাতে ২০০৭ সালে স্টোরেজ ট্যাঙ্কে পড়ে থাকা তেলের পরিমাণ তার আগের এক দশকের থেকে অনেক বেশী ছিল – কিন্তু সেই জমে থাকা তেল দামের চড়-চড় বাড়া থামাতে পারে নি। ২০০৭ সালের বিপি-র এনার্জি রিভিউ (BP Statistical Review of World Energy) পড়লে দেখা যাবে যে ২০০৩ সাল থেকেই প্রতি বছর পৃথিবীতে তেলের যোগান প্রায় ১৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন টন বেশী ছিল তেলের চাহিদার তুলনায়। ১ মেট্রিক টন মানে যদি প্রায় ৭ ব্যারেলের কাছাকাছি হয়, তাহলে প্রতি বছর শত শত মিলিয়ন ব্যারেল তেল বাড়তি! এই বাড়তি তেল সারা পৃথিবী জুড়ে তেলের ট্যাঙ্কে বেফালতু পড়ে আছে – সভ্যতার প্রতি এই পড়ে থাকা তেলের কোনই অবদান নেই। তবে সেই তেলের দিকে শকুনির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে ইনার্জি ট্রেড্রারস্‌-রা। দাম বাড়লেই ট্যাঙ্কের মাল বাজারে ছাড়া হবে – দেদার ইনকাম! এই সব দেখেই পৃথিবীর তাবড় তেল অর্থনীতিবিদরা স্থির করে ফেললেন যে, সাপ্লাই-ডিম্যান্ড তত্ত্ব সব সময় তেলের ব্যবসায় খাটিয়ে লাভ নেই – কারণ তা খাটে না অনেক সময়।

    তাহলে দাঁড়ালো এই যে, আজকের দুনিয়ার এনার্জি ট্রেডারস্‌-রা, যারা বিগ অয়েলে বা তাদের হয়ে কাজ করে, তারা এক বিশাল ভূমিকা বা বলা যেতে পারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে ব্যারেল প্রতি তেলের দাম কত হবে সেটা ঠিক করাতে। কেউ কেউ তো আবার এই এনার্জি ট্রেডারস্‌-দের তেলের দাম বাড়ানোর মিসিং লিঙ্ক বলে অবহিত করেছেন। সরকারের সাথে লবি বাজি করে, তাদের সস্নেহ দৃষ্টির তলায় দাঁড়িয়ে, অনেকাংশে নিয়ম-নীতির বাইরে থেকে এরা নাকি খেলে যাচ্ছে। এনার্জি ট্রেডারস্‌-রা অনেকেই নাকি সেই ডার্ক-আর্ট রপ্ত করেছিল এনরণের হয়ে কাজ করার সময় – আমাদের জ্ঞানত বা অজ্ঞানত তেল ম্যানিপুলেট হয়ে যাচ্ছে এনরন লুপহোলের মাধ্যমে।

    [ক্রমশঃ]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৩ জানুয়ারি ২০১৬ | ৩৯৪৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শঙ্খ | 126.206.220.177 (*) | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৪:০১58186
  • আগে আগের পর্বগুলো পড়েছিলুম, মন্তব্য করেছিলুম কিনা মনে নেই। তবে সুকির লেখা বরাবরই ভালো লাগে। এটাও লাগছে, যদিও এটা চরিত্রগত দিক থেকে অনেক সিরিয়াস, অনেক তথ্যগত লেখা। প্রসাদগুণে ঝরঝরিয়ে পড়ে ফেলা যায়।
  • dd | 59.207.61.187 (*) | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৪:৪০58187
  • কমেন্ট করছি না কিন্তু পড়ছি তো হড়হড়িয়ে।
  • সিংগল k | 57.15.110.21 (*) | ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১১:০১58188
  • সেই ষোলো সালের লেখা। কিন্তু ডিডিদা এটা এতদিনে পড়ছেন কেন? আগেও কি পড়েছেন?

    দিশি তেলের হিস্টিরি তো এখনো শুরুই হল না, কি অনশোর কি অফশোর। পাইদিদিদের একশৃঙ্গ রাইনো আঁকা অসাম অয়েল বা ওএঞ্জিসির নীল আরবসাগরের মধ্যে হীরা পান্না মুক্তা নীলম...... কিরকম আবেগময় ব্যাপার বলুন তো। এমন নামটি কোথাও খুঁজে.... হুঁ হুঁ..
    মাননীয় মোদিজী এমন আদখ্যাঁচড়া লেখা দেখলে খুবই অসন্তুষ্ট হবেন। এতে পুরো জাতির ভাবাবেগই আঘাত পাচ্ছে। তাই পুরোটা একসঙ্গে প্রকাশ করা উচিত ছিল, কিম্বা শেষ থেকে শুরু করলেও চলত।

    ভারতবর্ষের তৈল আহরনের ইতিহাসে একেবারে শেষদিকে আমার নাম সোনার অক্ষরে লেখা থাকা উচিত, কারন আমার জন্য আরেকটু হলে ভারতবর্ষে তেল তোলাই বন্ধ হয়ে যেতে বসেছিল।
  • pi | 24.139.221.129 (*) | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৫:২৬58191
  • কেলোদা, নতুন পর্ব এসেছে তো। খুব ভাল হচ্ছে। আর আপনিও লিখুন।
  • rabaahuta | 132.171.239.193 (*) | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৫:৪২58192
  • পেট্রোনাশ - কি বিচ্ছিরি নাম।
  • সুকি | 71.6.236.249 (*) | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৮:৩০58193
  • বড়দিনের ছূটিতে কোন কাজ নেই - উচ্ছলতাও নেই - তাই ঘরে বসে বসে তেল নিয়ে নাড়াচাড়া করা।
  • avi | 57.11.0.155 (*) | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:৩৭58189
  • অবদানের গপ্পো শুনব। আশা করব মূল লেখায় তৈলক্ষেত্রে ওএনজিসির বর্তমান কর্তা ডাক্তারবাবুর উদ্যোগের কথাও স্বর্ণাক্ষরে লেখা হবে।
  • সুকি | 71.6.238.118 (*) | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ১২:৪০58190
  • দ, শঙ্খ, ডিডিদা, সিংহল k সবাইকে ধন্যবাদ লেখা পড়ার জন্য।

    সিংহল k,
    আরে ৭, ৮ এবং ৯ পর্ব হাতে গরম নতুন দিলাম তো! লেখাটা ২০১৬ তে শুরু করেছিলাম ঠিকই - কিন্তু মাঝখানে কন্টিনিউ করা হয় নি। আবার লেখার চেষ্টা করছি। তবে মনে হচ্ছে আপনার কাছে কিছু রোমহর্ষক কাহিনী জমা আছে তেল নিয়ে - লিখে ফেলুন না প্লিজ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন