এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • হস্টেলের মেয়েরা - ৩

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২০ জুলাই ২০২২ | ৫৭৫ বার পঠিত
  • আমাদের তক্তপোষে লম্বা করে বিছানার চাদর পাততাম আমরা। বেশ ঝুলিয়ে। যাতে ট্রাঙ্ক, স্যুটকেস না দেখা যায়। ঘরে একটু ফুল পাতাও রাখা হত।দেওয়ালে কোলাজ। মোটমাট ঘরে ঢুকেই একটা রঙচঙে উষ্ণ আভাস পাওয়া যেত। হস্টেলে খবরের কাগজ আসতো। তবু আমরা রুমে আলাদা করে কাগজ নিতাম কারণ সকালে উঠে কাগজ নিয়ে টানাটানি পোষাতো না। আমরা স্টেটসম্যান রাখতাম। রত্না  যেহেতু সকালে খেলতে চলে যেত, ও ফিরে চেঞ্জ করে কাগজ পড়তো। সোজা হয়ে পা ঝুলিয়ে বসে। উর্মি কমপ্ল্যানের গ্লাস হাতে নিয়ে বিছানায় বেশ বাবু হয়ে বসে, চুল খুলে কাগজ পড়তো। রিতা দাঁড়িয়ে কাগজ পড়তো। আমি শুধুই এডিটোরিয়াল পড়তাম।

    যখন ন' নম্বর ঘরে এলাম, তখন আমাদের পূর্বকথিত প্রণয়বিলাসিনীর  সাহচর্যে আসার সৌভাগ্য হল। সে এক কান্ড। আমাদের গ্রুপে ইনি এক এবং অদ্বিতীয়ম।

    নাম তো বলবো না। মনে করা যাক সে সুহানা। সুহানা মুখোপাধ্যায়। বেশ ডাগর ডাগর চোখ। ঐ বয়সেই সে চোখ দিয়ে বিশ্বজগৎ ঘায়েল করা যায়, এমনটি মনে করতো। ঐ যে রেখা বলেছিলেন না, যে উনি যে কোনো পুরুষকে জল দিয়ে একটি ট্যাবলেটের মতো ... । তা আমাদের সুহানার কনফিডেন্স লেভেল ঐ পর্যায়ের ছিল। একেকজনের মেয়াদ ম্যাক্সিমাম তিনমাস। মুশকিল এই যে সুহানা কাপড় কাচতো না। যে মহিলা আমাদের কাপড় নিতে আসতেন, তিনি যখন আসতেন, সে নিদ্রামগ্ন থাকতো। আর নিজে কাচবে? তাহলেই হয়েছে! মাসের পর মাস আলনায় কাপড় জমছে। ঘেমো জামাতে পার্ফ্যুম ঢেলে বেরিয়ে যাচ্ছেন অভিসারিকা। আমি তো একটু ঠাকুমা টাইপ। বলতাম, অন্তত কাচা ড্রেস পরে যা। ঘামের গন্ধেই তো পালিয়ে যাবে তো! সে তুড়ি মেরে বলতো, তার আগেই আমি "চল ফুট" করে দেবো। এরপরে আর কীই বা বলা যায়! আমাদের মধ্যে তিনিই একমাত্র ম্যাট্রিমনিয়াল কলামটি মন দিয়ে পড়তেন এবং পড়ে শোনাতেন। মোটামুটি একটা সোশ্যাল স্টাডি হয়ে যেত!

    ব্রণের অজস্র দাগ গালে। ক্লিনসিং মিল্কের কারবার নেই। তার ওপরেই কঠিন মেকাপ।  চুলে সাধনা স্টাইলে পাফ করে চুলগুলোর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল।

    এই প্রেমগুলো যে ওর কী করে হত, সে বোঝা হেব্বি মুশকিল। আমরা ধরুন জনা বারো মেয়ে ফিল্ম দেখতে গেছি ভবানীপুর। বা চৌরঙ্গীপাড়া। ফেরার পথে গোলপার্কে নেমেছি তেলেভাজা খেতে। মিশনের বাসস্ট্যান্ডে হয়তো কিছু ছেলেরা আড্ডা মারছে। আমরা তেলেভাজা খেয়ে আবার বাসে উঠে ফিরে দেখি সুহানা নেই। নেই তো নেই। আমরা বাস থেকে নেমে হোস্টেলে ফিরে আসি। ডিনার করি। সে ফিরলো সাড়ে দশটায়।
    কোথায় গেছিলি রে?
    সে চোখ নাচিয়ে বলল, ঐ! ঘুরে এলাম।
    কার সঙ্গে? কখন গেলি গোলপার্ক থেকে?
    ঐ যে উল্টোদিকের ফুটপাথে.. যেটা লম্বা ছিল
    তাকে তো চিনিস না! তুই তো এখন অমুকের সঙ্গে..
    নাহ্। ওকে ল্যাং মেরে দিয়েছি। এই ছেলেটা বেশি স্মার্ট। 
    কি করে আলাপ হল?
    তোরা যখন বেগুনি খাচ্ছিলি। চোখে চোখে কথা হয়ে গেল।

    সত্যি কথা বলতে কি আমরা খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম যে কোনদিন ওকে কেউ অ্যাসিড ট্যাসিড ছোঁড়ে। যে হারে লেঙ্গিবাজি করতো সেটা রীতিমত বিস্ময়কর। কিন্ত সে এই বিষয়ে ডিটারমাইন্ড ছিল যে বিয়ে সে বাড়ি থেকে ঠিক করা পাত্রকেই করবে। তাকে হতেই হবে ছ' ফিটের ওপরে। পেশায় হতেই হবে ইঞ্জিনিয়ার। এবং স্মার্ট। নিজের নামের পাশে ব্যানার্জি এবং চ্যাটার্জি এই দুটি পদবীকে সে ঠাঁই দিতে রাজি ছিল। গাঙ্গুলি কোনোমতে চলবে। এমনকি চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য, মৈত্রও চলবে না। বাকিসব তো অসম্ভব। তার "চল ফুট" সংক্রান্ত বিষয়ে বিয়ের পরে কি হবে জানতে চাইলে সে বলতো, "ঘরে লালু, বাইরে চালু।" "চল ফুট" এর দয়ায় বিবাহ বিষয়ে তার সমস্ত ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। সে এখন অতি সুখী প্রবাসিনী গৃহিণী।

    আমাদের টিফিনের ঘন্টা পড়তো সাড়ে চারটেতে। যে ডিপার্টমেন্ট থেকে আগে ফিরতো, সে তিনজনের খাবার ঘরে নিয়ে আসতো। চিঁড়ের পোলাও। কখনো ঢপের চপ। মানের পাউরুটির মধ্যে আলুর পুর দিয়ে ডিপ ফ্রাই। মোটেই চপ নয়। আমরা যে যার প্লেট নিয়ে টিফিন আনতে যেতাম। তো সুহানার টিফিন এনে ওর টেবলে ঢাকা রাখা হত। খাওয়া হলে আমরা নিজেরাই প্লেট ধুয়ে রেখে দিতাম। কিছু একস্ট্রা প্লেটও রাখা হত। তো সুহানা ফিরে খায় আর একটা করে প্লেট চৌকির নিচে চালান করে দিত। ধোওয়ার সময় নেই। মেকাপ করতে হবে। বেডকাভার ঝোলানো বলে চোখেও পড়ে না। আমাদের ঘর ঝাড় মোছ করে দেওয়ার একজন মহিলা ছিলেন কিন্ত নিজেদের বাসন নিজেদের ধুতে হত।

    হঠাৎ একদিন দেখি এক ইঁদুর বাবাজি এই বিছানা থেকে ঐ বিছানা লাফালাফি করছেন। তারপর সুহানার চৌকির নিচে ঢুকে যাচ্ছেন। সাহস করে তার বিছানার চাদর  সরিয়ে দেখা গেল যে চৌকির নিচে অন্তত বারোখানা এঁটো প্লেট। মানে রোজই অন্য একস্ট্রা প্লেটে তার খাবার আসতো আর তিনি খেয়ে সটান সেটা চৌকিরা নিচে ... ইঁদুর বাসা বেঁধেছিল তার পড়ার টেবলে, তার কোনো এক প্রাক্তন প্রেমিকের দেওয়া টুপির মধ্যে !
    ইঁদুরেরও কত বুদ্ধি!
    তবে সুহানার মাসতুতো একটি ভাই ছিল। ঐ ফিল্থি রিচ যাকে বলে। বেশ গোলুমোলু। ভালোমানুষ। সে তার দিদির বন্ধুদের জন্য হিট ছবির টিকিট, নেতাজি ইন্ডোরে হেমা মালিনীর নাচের টিকিট ইত্যাদি করে দিত! তার নাম বোধহয় টিম ছিল। ভালো নাম মনে নেই। তবে তার বিয়েতে আমাদের সবাইকে একখানা কার্ড দিয়ে নেমন্ত করেছিল বলে আমরা সবাই মিলে তাকে একটা পেন দিয়েছিলাম! এইসব হস্টেলেই ঘটে !
  • ধারাবাহিক | ২০ জুলাই ২০২২ | ৫৭৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন