এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  টুকরো খাবার

  • হোস্টেলের মেয়েরা - ১

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    টুকরো খাবার | ১৮ জুলাই ২০২২ | ৯২২ বার পঠিত
  • পুরোনো বিল্ডিংয়ের তিনতলায় বাঘা বাঘা সিনিয়র দিদিদের বাস। ভুলেও সেদিকে যেত না বাছুররা। বুলকিদি, নুপূরদি, কুমকুমদি ছিল র্যাগিংএর মাস্টারমাইন্ড। বুলকিদি ভীষণ রোগা। চোয়াল একটু উঁচু।

    চুলটা একটা ক্লিপ দিয়ে বাঁধা থাকত। সাদার ওপর ফুলছাপ রাতপোশাকে দেখতাম তাকে। ক্লাসে যাবার সময় শাড়ি। কেন জানিনা, তাকে খুব ভয় পেতাম। নুপূরদি বোধহয় কেমিস্ট্রিতে ছিল। কোনোদিন চুল বাঁধা। লম্বা খোলা চুল। বেশ নজরকাড়া সুন্দরী ছিল সে। কুমকুম দত্তার কথা আগেই বলেছি। 

    শীত শীত ছিল। তখন কলকাতাতে শীত পড়তো। পূজোর আগেই আমাদের সেশন শুরু হয়েছে কিন্ত হোস্টেল পেতে অনেকেরই দেরি হয়েছে। দিদিরা গোয়াল পূর্ণ হবার অপেক্ষায় ছিলেন।
    আমরা প্রায় কাঁপতে কাঁপতে হাজির হলাম মহারাণীদের সামনে। তারা সব আয়েস করে কেউ চুল বাঁধছিলেন, কেউ হরলিক্স খাচ্ছিলেন। মুরগী দেখে কী খুশি! 

    আশ্চর্যের ব্যাপার, আমাদের সঙ্গে তেমন কিছুই হল না! কী সব মিথ কানে এসেছিল। কমোডে মাথা ঢুকিয়ে ফ্লাশ টানা ! কার্নিশে হাঁটানো। নাহ্। খুব নিরিমিষ অত্যাচার হল ভাগ্যিস! তখন মিঠুনের ডিস্কো ডান্সার হিট। কাজেই রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে ডিস্কো নাচো। আমাদের রুমা ছিল একটু স্বাস্থ্যবতী। ভীষণ মিষ্টি। গালে বেবি ফ্যাট। সবকিছুই ডজন ধরে কিনত। রুমাল। হেয়ারব্যান্ড। ক্লিপ। তাকে বলা হল সারা ঘরে হামাগুড়ি দিতে। সঙ্গে হাততালি দিয়ে সিনিয়রদের গান। "আহা দেখেই বোঝা যায় গ্ল্যাক্সো বেবি।"

    আর এক বন্ধু, তার নাম করবো না। সুখী গৃহিণী এখন। তিন মাসের মধ্যেই সিনিয়রদের জানা হয়ে গেছিল যে সে বয়ফ্রেন্ড বানাতে ও বদলাতে দক্ষ। জামাকাপড়ের মতো ইয়ে পাল্টায়। তখন কেষ্ট মুখার্জি মারা গেছেন। আমাদের প্রণয়বিলাসিণী বন্ধুকে বলা হল, কেষ্টর আত্মা এই ঘরে ঘুরেছে। তুমি লাফিয়ে লাফিয়ে ধরো। আর প্রত্যেক বার বলো 'যাহ্! ফস্কে(ske) গেল! তারপর কিছু জোকস টোকস। নন-ভেজ তবে হার্ড নয়। ছেড়ে দিল। আমার ঐ বাউল গানের সঙ্গে ডিস্কো নাচে উৎরে গেল। গান গাইতে পারলে একটু ছাড় ছিল।

    আমরা যে অল্পের ওপরে বাঁচোয়া  পেলাম তার কারণ, আমার ধারণা সুমিদি। উর্মির দিদি। সে তখন ওখানেই এম এ পড়ে। ইউ জি থেকেই ওখানে। সে ভীষণ ভালো ছাত্রী ছিল। আর পরে যখন প্রমথেশ বড়ুয়ার নাতি সৌম্যনারায়ণ বড়ুয়ার সঙ্গে তার কোর্টশিপ চলছিল, আমি এপ্রিল লিস্টে লিখেছিলাম, "সৌম্যলোকে সুমি তুমি, নারায়ণের নারায়ণী/ জেনো রে পড়ুয়া মাগো, বড়ুয়া হবেই তুমি" ইত্যাদি। ( আই হোপ সুমিদি ডাজ নট মাইন্ড!)

    ওরা এখন কানাডা নিবাসী।  সুমিদির চশমার ফ্রেমটা মনে আছে আর কমলা রঙের স্লিভলেস হাউসকোট। সৌম্যদা সম্ভবত কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ছিল। ইউনিভার্সিটি ব্লু। ওরা দুজনেই ব্রিলিয়ান্ট ছিল। এখনও মনে আছে উর্মি সুমিদির জন্মদিনে বইতে লিখে দিল "টু দিদি, মাই প্রাইড।" সুমিদি উর্মিকে দাস ক্যাপিটাল সব গুলো ভল্যুম দিয়েছিল।

    আমরা বেঁচে গেলাম। 

    দশ নম্বর ঘরের কম্প্যুটার ইঞ্জিনিয়ারিংএর সুপ্রিয়া আর স্বাগতা (তখন সোয়াগাতা) আর ইলেকট্রনিক্সএর কাকলিদের কিন্ত অত সহজ হয়নি। শীতের রাতে কম্বলের মধ্যে জল টল ঢালা হয়েছিল। টানা হ্যাঁচড়াতে  কাকলির হাতে চোট। দাঁতে চোট। সেমেস্টারের আগের দিন। এরা তিনজনেই বিদেশে এখন। তবে সুপ্রিয়াকে যখনই একটা লম্বা মত ছেলের সঙ্গে দেখা যেত এবং জিজ্ঞেস করা হত, ওটা কে র্যা? সে জানাতো মাসতুতো দাদা।  তবে এই " মাসতুতো দাদা" টি রিপ্লেসড হয়নি। তারা বে করেছে।

    অনেক কিছু মনে আছে। আবার কত কী ভুলে গেছি! রত্নামালার হালকা ব্রাউনের ওপর ডিপ ব্রাউন ছাপ হাউজকোট, কপালে ছোট্ট খয়েরি বা কালো টিপ মনে আছে। রিতার চুলও কোমরের নিচে।সবসময় একবেণী বা দুবেণী। ভেরি মাচ ফন্ড অব ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স। স্বাভাবিক। ওরা দুইবোন ছিল। মিতা আর রিতা।  ঘরোয়া। বোঝাই যেত তখন এয়ার ফোর্স অফিসারের ঘরেলু বউ হবার জন্য আদর্শ মেয়ে। ওরা এয়ার ফোর্সের বাইরে ভাবতেই পারতো না। মিতাদি বিয়ে করল উইংগ কম্যান্ডার অনুপ ঘোষকে।  ওরা আমার দাদাটির বেজায় ভক্ত ছিল। তিনি ছিলেনও ভীষণ ড্যাশিং ও হ্যান্ডসাম। তখনই বুঝতাম ঐ কম্যুনিটির বাইরে ওরা অসুবিধে বোধ করে। পার্টি। আর্দালি। ক্যান্টিন। ফ্রিজের দামও অর্ধেক। দাদা গল্প করতো যখন বাগডোগরায় পোস্টিং ছিল "শোলে" দেখতে দিল্লি উড়ে গেছিল এক সন্ধের জন্য। 

    রত্না তখন থেকেই খুব ফোকসড ছিল। বেশ লম্বা। তখন আমাদের একটা ফেভারিট বুলি ছিল, মাগো মা, লম্বা করো। কেন কে জানে! রত্না মাঝেমাঝেই মাঝে শাড়ি পরতো। ভয়েলের শাড়ি।একটি নীল শাড়ি খুব পরতো ও। ওর মা ছিলেন না। তিন বোন ছিল ওরা। রত্না ছোট। দুর্গাপুর কার্মেল থেকে এসেছিল। ও কখনো চুল খোলা রাখতো বলে মনে পড়ে না।একটা বেণী। ক্লাস করে, খেলে পিঠে র্যাকেট নিয়ে ফিরতো।

    অল্পবয়সে আমরা সবাই একটু ইনসেনসিটিভ থাকি। 

    কখনও কখনও কেউ যে কারু মনের সূক্ষ্ম তন্ত্রীতে আঘাত দিয়ে ফেলতাম না, তা তো নয়। তবে মেপে চলতাম না বলেই ঝগড়া হত। মন কষাকষি হত। আবার ভাব হত। রত্নামালা রাও এখন স্টেটসে বসে বাংলা হরফে এই লেখা পড়ছে। এও তো কম বড়ো যোগাযোগ  নয়! মনে আছে। ঝিলের ধারের ঠান্ডা হাওয়া, সুপারের তেতো বচন, জলের অসুবিধে মাঝেমাঝেই। এসবের মতোই মনে আছে রুমার রঙচঙে স্কার্ফ, রিতার গোলগলা হাল্কা নীল স্লিপিং স্যুট, সুমিতার হাল্কা গোলাপি হাউসকোট। ঠোঁটের ওপর একটা আঁচিল ছিল না ওর? ওষুধ খেত বলে মনে পড়ছে। আরো ঝাপসা হয়ে যাবার আগেই লিখে ফেলতে চাই 

    সেসব দিনের কাঁপা আলো
    ফেলে আসা যত পিছুটান
    আর খুব বেশিদিন নেই
    স্মৃতি যেন ভোরের আজান।
  • টুকরো খাবার | ১৮ জুলাই ২০২২ | ৯২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • যোষিতা | ১৮ জুলাই ২০২২ ২০:৫৭510010
  • নূপুর
  • হজবরল | 109.70.100.32 | ১৮ জুলাই ২০২২ ২২:২৩510011
  • তাপ্পর নিজেরা যখন সিনিয়র হলেন আর ছোটদের ওপর যে র্যাগিং গুলো কল্লেন সেগুলোও লিকুন , নইলে গপ্পটা ওয়ান সাইডেড হয়ে গেল ত
  • π | ১৮ জুলাই ২০২২ ২২:৩১510012
  • বেশ লাগছে!  কত গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে 
     
    চলুক! 
  • Amit | 121.200.237.26 | ১৯ জুলাই ২০২২ ০৯:৩২510022
  • এহ। এগুলোকেও আপনেরা ৱ্যাগিং বলেন- হেসে গড়িয়ে গেলুম। এতো সব একটু আধটু আতুপুতু আদর করে ছেড়ে দেওয়া। 
     
    ৱ্যাগিং কি জিনিস বুঝতে হলে ছেলেদের হোস্টেলে দেখতে হয়। এতো বছর পরেও মনে আছে প্রথম এক দেড় মাস সন্ধে হলেই  বুকটা ধড়পড় করতে শুরু করতো আজকে রাতে কি আছে কপালে। 
  • π | ১৯ জুলাই ২০২২ ১৮:৫৪510044
  • আরে এতো আমাদেরই হোস্টেল!  তাই এত চেনা লাগছিল!  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন