সকালের আধো ঘুমে ফেসবুকে একটা পোস্ট দেখলাম, একটা ভিডিও। যেখানে একজন অশীতিপর বৃদ্ধ,যার সারা মুখে বয়সের বলিরেখা আঁকিবুকি টেনেছে, যার সামনের দাঁতগুলো ভাঙ্গা, যিনি আবিল শরীরে, একটা ছেঁড়া অপরিষ্কার ধুতি জড়িয়ে কোনরকমে লজ্জা-নিবারণ করছেন, সেই বৃদ্ধ কান্নাভেজা চোখে হাত জোড় করে বলছেন_ "আপনারা আমারে ঘেন্না করবেন না মা, আমি বহুদিন কিছু খাই নাই।"
মুহূর্তে ছ্যাকা খেলাম। মনে হল হাতের মধ্যে একটা জ্বলন্ত কয়লা ধরে রেখেছি। সেই ঝটকায় নিজের অজান্তেই মোবাইলটা হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। আমার আপাত নিরাপদ জীবন, সুখনিদ্রা, নরম বিছানা হঠাৎ আমার কাছে জবাব চাইছে। এই নিরন্ন মানুষগুলো আমারই সহনাগরিক, এই কালবেলায় এদের কি হবে?
গত কয়েকদিন ধরেই ফেসবুকে টিভিতে বিভিন্ন খবরে এ ধরনের অনেক ছবি দেখেছি। মানুষগুলো ঘরে ফেরার জন্য কয়েক শ' কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। যুবক,যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অন্তঃসত্ত্বা নারী, ছোট ছোট বাচ্চা, সবাই হাঁটছে।তাদের খাবার টাকা নেই, জল নেই, তারা শুধু জানে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে। কয়েকদিন আগে এক মা তার 5 সন্তানকে নদীর জলে ... বেঁচে থাকার যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন। হাজার হলেও মা তো, খিদা তৃষ্ণাতুর সন্তানদের জ্বালা সহ্য করতে পারেনি। মুক্তি দিয়েছেন তাদের। এক 84 বছরের পিতা, তার 45 বছরের মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে গলায় গামছা পেচিয়ে.... নিষ্কৃতি দিয়েছেন। একটা ছোট্ট মেয়ে টানা তিন দিন হেঁটে স্রেফ মারা গেছে। জানি না মৃত্যুর আগে শেষ কবে পেট ভরে খেয়েছিল মেয়েটি। এমন আরও অজস্র ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে। অন্নের অভাবে গ্রামের প্রান্তিক মানুষগুলো পচা ভাত রোদে শুকিয়ে নিচ্ছেন যাতে সেই শুকনো ভাত গুলো আবার ফুটিয়ে খেতে পারেন। আমরা পাথরের চোখ দিয়ে দেখে যাচ্ছি। আমরা ঈশ্বর দর্শন করছি। ঈশ্বর দর্শন অর্থাৎ ঈশ্বরের দৃষ্টিতে জগৎকে দর্শন করা। ঈশ্বর যেভাবে নিরাসক্ত বোধে জগৎ-সংসারের পাপ পুণ্য, ভালো-মন্দ, দেখে থাকেন আমরাও ঠিক সেরকম নিরাসক্ত ভাবে তাকিয়ে আছি। চারদিকে কাঁচা মৃত্যুর গন্ধে ইঁদুরের মতো গর্তে সেঁধিয়ে আছি। আমাদের বাড়িতে খাবার মজুদ আছে, আর ওরা নিরন্ন পেটে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিচ্ছে।
একটু ধাতস্থ হয়ে মোবাইলটা হাতে তুলে সেই ভিডিওটা বহুবার খুঁজলাম কিন্তু আর পেলাম না। সেই বৃদ্ধের আকুতি, অন্নের জন্য এই অসহায় কান্না, কোথায় একটা ফাটল ধরালো।
এভাবে পাথর হয়ে থাকাটাকে কি বেঁচে থাকা বলে। আমাদের বিবেকটাকে আমরা যে কবে গলা টিপে মেরে ফেলেছি তার খোঁজ আর রাখি না। যদি সে বিবেক কোথাও বেঁচে থাকে আর পথ ভুলে ফিরে আসে তবে কি জবাব দেব তার কাছে। এটা কোন সমাজ ?
আসলে আমরা মৃতদেহকে বড্ড ভালোবাসি। এই অত্যন্ত আধুনিক সভ্যতা এক অত্যন্ত অনুন্নত দু-পেয়ে জীবের জন্ম দিয়েছে, যারা মানুষের মতন দেখতে। যাদের জন্মটা মানুষের মতন ছিল, সমস্ত সম্ভাবনা ছিল মানুষ হয়ে ওঠার, কিন্তু তারা পারেনি। বোধের শূন্যতা, চেতনার প্রতিবন্ধকতা, মায়াহীনতা এই দু'পেয়ে জন্তুগুলোকে জীবন্ত মৃতদেহে পর্যবসিত করেছে। আমরা ফুল ভালোবাসি। ঘর সাজানো, পূজার উপকরণ, প্রেম নিবেদন, শোক প্রদর্শন পুরো যাত্রাপথেই ফুল আমাদের বড্ড প্রিয়। কিন্তু আমরা এটা ভুলে যাই, বৃন্তচ্যুত প্রতিটা ফুল আসলে এক একটা ফুলের মৃতদেহ। আমরা মৃতদেহ বড্ড ভালোবাসি।
সেই যে আমরা জন্মের পর ছুটতে শিখলাম, তারপর আর থামলাম ই না। ছোটবেলায় শিক্ষার পেছনে ছুটলাম, অথচ সেই জ্ঞানার্জনই আমাদের কখনো হলো না। তারপর রূপ-যৌবন-যৌনতার পেছনে ছুটলাম, কিন্তু মানুষ অধরা রয়ে গেল। তারপর অর্থ, স্বাচ্ছন্দ, সমৃদ্ধি, উন্নতির পেছনে ছুটলাম, সুখ,শান্তি, মানুষত্ব হাতছাড়া হয়ে গেল। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজের যাত্রা পথের দিকে তাকালে কেউ যদি হঠাৎ আবিষ্কার করেন, ছোটবেলায় তিনি বড্ড সুখী ছিলেন, তাহলে তাকে কি বলবেন, সুখ কোনটা। সারা জীবন যার পেছনে ছুটে বেড়ানো হলো, সেটা যদি সুখ না হয়, তাহলে কেনো এই ছুটে বেড়ানো। মৃতদেহ তো সবাইকে হতে হবে। হাসপাতালে রোজ যে মানুষগুলো মৃতদেহে পরিনত হচ্ছে, আজ কিংবা আগামীকাল, আমি, তুমি, আপনারা যখন মৃতদেহে পরিনত হব, কি আশ্চর্য আমরা কিন্তু মৃত মানুষের সম্মানটুকুও পাবো না। আমরা মৃতদেহ-ই হব। ধাবার মাঠে অনান্য জঞ্জালের মত চরম অশ্রদ্ধায় পুড়তে থাকবো। অথবা অজ্ঞাত কোন স্থানে মাটির নিচে কবরে পচতে থাকবো।
আমার মোনালিসা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শুধুই হাসে। মাঝে মাঝে ভাবি ও হয়তো আমাদের ব্যঙ্গ করছে। মোনালিসার সদাহাস্যময়ী মুখের দিকে তাকিয়ে, আমি জিজ্ঞেস করি, 'তোমার কখনো রাগ হয় না, দুঃখ কিংবা কান্না কিংবা চিৎকার করো না তুমি কখনো'। সে হেসে বলে, "স্রষ্টা যে আমাকে আর কোন অভিব্যক্তি দেয়নি, কি করি বল"। ঠিক, মোনালিসা শুধু হাসতেই জানে। কিন্তু স্রষ্টা তো আমাদের অনেক অভিব্যক্তি দিয়েছিল। কোন কাজে লাগলো সেগুলো। জন্ম থেকে মৃত্যু আমরা তো একটা গতবাধা ফ্রেমে আটকে গেলাম। ব্যতিক্রমী কিছু মানুষ অবশ্য সেই ফ্রেম ভেঙ্গে দুমড়ে-মুচড়ে বাইরে বের হলেন। কিন্তু তারা ব্যতিক্রমী। নিরন্ন মানুষ হাহাকার করে, আমরা নেটফ্লিক্স দেখি। রক্তাক্ত পা হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে, আমরা ঘরে খাদ্যের স্তুপ বানাই।
মোনালিসা কে জিজ্ঞেস করি, এমন কেন হলো বল তো? এমন তো হবার কথা ছিল না। মোনালিসা তার স্মিতহাস্য মুখে জিজ্ঞেস করে," ওই সামনে একটা জাম গাছ ছিল। অনেক জাম হতো তাতে, গাছটা কোথায় গেল, এখন আর দেখি না"। অবাক হয়ে বলি, 'সেতো বহু বছর আগের কথা, হ্যাঁ ওখানে একটা জাম গাছ ছিল। খুব মিষ্টি জাম হত। গাছটাকে কেটে ওইখানেই তো গ্যারেজ তৈরি করা হলো'। কিছুক্ষণ চুপ করে মোনালিসা আবার জিজ্ঞেস করল, "ক মাস আগে ইঁদুরের বিষ দিয়েছিলে না ঘরে, তাতে অনেক ইঁদুর মরেছিল"? বললাম, 'হ্যাঁ তবে বড় ইঁদুরগুলোর থেকে বাচ্চা ইঁদুরগুলো বেশি জলদি মরলো। অনেকগুলো বাচ্চা ইঁদুর মরেছিলো জানো'।
মোনালিসা, যার মুখ থেকে হাসি কখনো মোছে না, সে বলল -"প্রত্যেকবার তো এই সময়ে মাধবীলতায় ছেয়ে থাকে এই জায়গাটা। কি মিষ্টি গন্ধ। কই এবার তো ফুল গুলো দেখছি না"। 'আরে গেলবার গাছটার আগামুড়ো ছেটে দেওয়া হলো না! রোদ আসতো না তো ঘরে। ঘরগুলো অন্ধকার হয়ে গেছিল। তবে মাধবীলতা গাছটা এখনও আছে, কিন্তু এবার আর ফুল ধরেনি তাতে। কি জানি সামনের বার হয়তো....'। মোনালিসা আবার হাসলো। আর কিছু বললো না।
সময় মত আমি মৃতদেহ হয়ে মোনালিসার পাশের দেয়ালে একটা ফ্রেমে ঝুলে পড়লাম। তখন মোনালিসা কে বললাম, "দেখলে আমি এখন ফ্রেমবন্দি তোমার মত"। এবার মোনালিসা গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লো, বললো,"তুমি স্রেফ একটা মৃতদেহের অবয়ব। তুমি ততদিন আছো যতদিন তোমার কাছের মানুষগুলোর স্মৃতিতে থাকবে। তারপর তুমি কোথাও নেই। আর আমি মোনালিসা। আমি শিল্পী নই আমিই শিল্প। আমি স্রষ্টা নই, আমিই সৃষ্টি। প্রত্যেক প্রলয় শেষে আমাকে নতুন করে গর্ভধারণ করা হয়। আমার ধ্বংস আছে কিন্তু মৃত্যু নেই"।