এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • রি-ইউনিয়ন

    Rumela Saha লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৪ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০৬৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • 21 টা চেয়ার পাতা, ওরা 20 জন বসে আছে ৷ একটা চেয়ার ফাঁকা ৷ কলেজের রি-ইউনিয়ন। 15 বছর পর আবার একসঙ্গে পুরনো বন্ধুরা। কত গল্প, স্মৃতি, কত ঝগড়া, অমীমাংসিত আবেগ আর পুরনো প্রেম ৷ রাত বাড়ছে, সেই সঙ্গে স্মৃতি-মেদুর আচ্ছন্নতা বাড়ছে সবারই।


    সবাই ব্যস্ত, কথায়। গত ১৫ বছরের ঘটনাক্রম অল্প সময়, বিস্তারিত ভাবে পাশের একদা খুব কাছের মানুষের সঙ্গে ভাগাভাগি করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। মৃদু গুঞ্জন, হালকা হাঁসি, সীমাহীন অভিমান সব আছে। 


     স্মৃতি, শেষ পর্যন্ত শুধু স্মৃতিটুকু রয়ে যায়। বইয়ের ভেতর থেকে হঠাৎ পাওয়া বিবর্ণ গোলাপের মূল্য সেই বোঝে, যিনি বহু যত্নে সেটিকে সেখানে গচ্ছিত রেখেছিলেন। বাকিদের কাছে ওটা আবর্জনা।


      একটা হাহাকার মেশানো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেয়েটি পাশের ফাঁকা চেয়ারে হাত রাখে। এখানে আসা পর্যন্ত মেয়েটি খুব চুপচাপ ৷ সামান্য কিছু কথা বাকিটা নীরবতা ৷ অথচ তখন কত হাসিখুশিই না ছিল সে ৷ প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর, উদ্যাম জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ একটি মেয়ে ৷ আজকের নারীটি খুব শান্ত ৷ সমুদ্রের খুনসুটি, তার ঢেউ ভেঙে লুটিয়ে পড়া, সব বালুতটের বুকে। কিনারা থেকে যত সে দূরে গেছে, যত বিচ্ছিন্ন হয়েছে তত সে শান্ত হয়েছে। 


    ফাল্গুণী বাতাস আলতো করে মেয়েটির কানের লতি ছুঁয়ে গেল। সে পেছনে তাকালো, আলোয় আলোয় ঝকঝক করছে কলেজের মাঠ। বিস্তৃতি মাঝে মাঝে শূণ্যতাকে অপরিহার্য করে তোলে। অপরিমেয় শূন্যতা।


    বন্ধুরা প্রশ্নোত্তরের খেলায় মাতলো ৷ সবাইকে একই প্রশ্ন করা হচ্ছে, এবং সবাই তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন উত্তর দিচ্ছে ৷


    যেমন , যদি কোন ভাবে 15 বছর আগেকার কলেজ জীবনে আবার ফিরে যাওয়া যায়, তবে সে তার জীবনে কি কি পরিবর্তন করতে চাইবে ৷


    একেক জন একেক রকম উত্তর দিচ্ছে ৷ কেউ বলছে পড়াশোনা করতাম মন দিয়ে ৷ কেউ বলছে অন্য প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে প্রেম করতাম ৷ কেউ বলে, একটার বদলে 10টা প্রেম করতাম৷ কেউ বললো, অন্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করে খুব ভালো একটা কেরিয়ার তৈরি করতাম ৷ এমন অনেক উত্তর পাওয়া গেল ৷ 


    শেষে প্রশ্নটা মেয়েটার কাছে এলো। সেই মেয়েটা যার প্রেম কলেজে খুব বিতর্কিত ছিলো।


     একজন হেসে বলল,- "জানি তুই কি বলবি, তুই তখন হয়ত অন্য কোন পুরুষকে বাছতি কিম্বা কেরিয়ারের দিকে অনেক বেশি মনোযোগী হতি ৷ আমাদের মধ্যে তুই সব থেকে ব্রাইট ছিলি, কিন্তু আজ দেখ ৷ তুই মাঝ পথে থমকে গেলি ৷ হারিয়ে গেলি "।


     মেয়েটা হাল্কা করে হাসল ৷ এই ছেলেটা কখনো তাকে ভালোবাসতো ৷ তাকে পাওয়ার জন্য একসময় কত পাগলামী করেছে। ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে ৷ আকাশে চাঁদ নেই, তাই হয়তো তারাগুলো আজ এত স্পষ্ট ৷


     থেমে থেমে আস্তে আস্তে মেয়েটা বলল, "যদি সত্যি ফিরে যেতে পারতাম সেই সময় তবে, ব্যাগ থেকে রুমালটা বের করতাম না ৷"


     সবাই অবাক হয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো৷ নিজের মনে হেসে মেয়েটা বললো, _" তখন, আমি মাঝে মাঝে রুমাল আনতে ভুলে যেতাম , আমি ঘামিয়ে গেলে ও নিজের রুমাল দিয়ে আমার কপালের ঘাম মুছে দিত৷ বড্ড আরাম লাগতো আমার।"


    মেয়েটির চোখে তখন লক্ষহীরকদ্যুতি। সে বলে চলে, "যদি ফিরে যেতে পারি তবে, ওর ওপর অভিমান বা রাগ করে যে সময়টা নষ্ট করেছি সেটা আর করতাম না ৷ আমার যে ব্যবহারে ও কষ্ট পেয়েছে সেগুলো সব শুধরে নিতাম ৷ কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে আমাদের সম্পর্ক, এবার ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিন থেকেই প্রেমটা শুরু করতাম ৷ ওকে এমন ভাবে হারাতে হবে জানলে,ওকে পাওয়ার প্রতিটা মুহূর্ত দ্বিগুণ ভাবে বাঁচতাম৷"


      একটি মেয়ে প্রশ্ন করে, "এই যে লাভ জিহাদ এই জিনিসটা সম্পর্কে তোর কি মতামত?"


    মেয়েটি একটি কবিতা গুনগুন করল, 


    _"সে যদি তোমাকে পিষে করে ধুলোবালি?’


    পথ থেকে পথে উড়ে উড়ে যাব খালি


    উড়বে?– আচ্ছা, ছিঁড়ে দেয় যদি পাখা?


    পড়তে পড়তে ধরে নেব ওর শাখা


    যদি শাখা থেকে নীচে ফেলে দেয় তোকে?’


    কী আর করব? জড়িয়ে ধরব ওকেই"


    তারপর বললো ,


    _ " লাভ জিহাদ এর মানে আমি জানি না। এই শব্দগুলো পাশাপাশি বসতে পারে বলে মনে হয় না। আর প্রেম.... আগুনের মতো‌ প্রেম ও সর্বগ্রাসী। ছাইয়ের কোন‌ অহংকার থাকে না, থাকতে পারে না। যারা ভালোবাসতে জানে, তারা জানে প্রেম ঈশ্বরের প্রতি হোক বা মানুষের প্রতি, সে নিজে দাহ্য, অন্যকে জ্বালায় না।"


     দীঘল চোখ দুটো দিয়ে মেয়েটি অতীত দেখে। জীবনে সব থেকে সুন্দর দিনগুলো। 


     অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেম গুটি গুটি ঠিক সেখানেই বাসা বাঁধে, যেখানে তার থাকার কোনো কথা ছিল না। তারপর একদিন হঠাৎ করে যখন শিকড় সুদ্ধ টান মেরে নিজেকে জাহির করে, তখন হতবাক মন নিজেকেই প্রশ্ন‌ করে, এটা কি করে সম্ভব।


    নদীর ভাঙন সব সময় বাইরে থেকে দেখা যায় না। হুড়মুড় শব্দের উৎস সন্ধানে হঠাৎ আবিষ্কার হয়, জমির একটা বিশাল অংশ নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। সেই রকমই, যাকে ভালবাসার কোন কথাই ছিল না, প্রেম যখন সেখানে আত্মসমর্পণ করে, চিরায়ত ধারনাকে নস্যাৎ করে নিজেকে ভাঙে, আমিত্বকে বিসর্জন দেয় তখন শুধু ছাইটুকুই অবশিষ্ট রয়ে যায়। ..... 


     মেয়েটা মুখ ঘুরিয়ে চোখ আড়াল করে জলটা মুছল ৷ বহু দূরে কবরে ছেলেটা পাশ ফিরে শুলো ৷ যে পাশ থেকে নক্ষত্রের আলোতে মেয়েটার মুখটা স্পষ্ট দেখা যায় ৷                                                                     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৪ জানুয়ারি ২০২১ | ৩০৬৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রুটি - Rumela Saha
    আরও পড়ুন
    কাঠাম - Rumela Saha
    আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ০৪ জানুয়ারি ২০২১ ১১:২৫101487
  • আপনার ছোটগল্পের হাত চমৎকার, 

  • keya bagchi | ০৬ জানুয়ারি ২০২১ ১৫:৫০101537
  • সাবলীল লেখা।  সুন্দর। 

  • Jharna Biswas | ১২ জানুয়ারি ২০২১ ০৯:৫২101641
  • ভীষণ ভালোলেগেছে গল্পটা...

  • দোলা সেন | 117.203.151.181 | ১৯ জানুয়ারি ২০২১ ১৪:৫৯101855
  • সুন্দর লেখা।বিন্দুমাত্র চড়া রঙ ব্যবহার না করেও যে সমস্যাটায় অন্যরকম আলো ফেলা যায়,সেটা বড়ো সুন্দরভাবে দেখিয়েছেন।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন