এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • চাঁদমণি

    Rumela Saha লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ | ৯৬১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মাটির রান্নাঘরের এক কোণে একটা ছোট্ট কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। বাতির ভিতু ভিতু, কাঁপা কাঁপা আলো মাটির ঘরের অন্ধকারকে আরও হতাশ করে তুলেছে। নিভু নিভু উনুনে ভেজা কাঠপ্রসূত ধোঁয়াগুলি খড়ের চালে অদৃশ্য কালো ঝাড়বাতির মতো ঝুলে আছে। সেই ঘরভর্তি অন্ধকারের পরত আর ধুঁয়োর চাদর সরালে দেখা যাবে একটি মানুষ, যার শরীরের ভেতরে মনের সমস্ত সম্ভাবনাকে পিষে মেরে শুধুই রক্ত মাংসের একটা কাঠামো রয়ে গেছে, সেই নিষ্প্রভ চোখের মানুষটি গুটিসুটি হয়ে বসে উনুনের দিকে তাকিয়ে আছে। টগবগিয়ে ফুটন্ত চালের ছটফটানি, হাঁড়ি থেকে বেরিয়ে আসার দুরন্ত প্রচেষ্টা, মাড়ের নৃত্যরত উচ্ছ্বাস, নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখে চাঁদমণি। হাঁড়িটা যদি সংসার হয়, আর তার নীচে জ্বলতে থাকা এই আগুন জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চালিকাশক্তি হয়, তা হলে প্রত্যেকটা চালের ভাত হয়ে ওঠার এই যাত্রাপথটা কিন্তু বড্ড কষ্টের। ফটফট আওয়াজে কাঠগুলো জ্বলতে জ্বলতে ফাটছে। চিতা হোক বা উনুন কাঠ ফাটার আওয়াজটা একই রকম কানে লাগে।

    উত্তরের হাওয়ায় মাটির জানলার সামনে রাখা ল্যাম্পের শিখাটা একটু কেঁপে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে অজানা একটা ভয়ে চাঁদমণির বুকটাও কেঁপে উঠল। হাতে একটা দা নিয়ে শাশুড়ি রক্তচোখে বলেছিল, "মাইয়া হইলে তোরে, তোর মাইয়ার সঙ্গে কাটমু, আমার লাতি চাই। শোনছোস লাতি।"

    পেটের বাচ্চাটা লাথি মারছে। পরম মমতায় চাঁদমণি নিজের পেটে হাত বোলায়। বাৎসল্য আর স্নেহ মাখামাখি হয়ে আঁধার গহীন মুখে চতুর্দশীর চাঁদের আভা খেলে যায়। শাশুড়ি সুর করে মনসামঙ্গল পড়ছে।
    "চান্দ বলে কাণী তোর লাজ নষ্ট চিত্ত।
    কোন মুখে আইলি তুই মোধ পূজা খাইতে।।
    যেই হাতে পূজি আমি শঙ্কবা ভবানী।
    সেই হাতে পূজা পাইতে চাই দুষ্ট কাণী।।"
    চাঁদমণি মাঝে মাঝে ভাবে, লক্ষ্মীন্দরের জায়গায় যদি বেহুলা মরতো তা হলে লক্ষ্মীন্দর বেহুলাকে বাঁচানোর জন্য এত চেষ্টা করতো ? তার পর নিজেই ঘাড় নেড়ে ভাবে— না, এ দেশে ভাগ্যবানের বউ মরে। আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে লক্ষ্মীন্দরের বেশি সময় লাগত না। যেমন সে বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে মরলে শম্ভ‌ুর আবার বিয়ে করতে দেরি করবে না। চাঁদমণির শাশুড়ি, পাড়া-প্রতিবেশী সবাইকে বলে রেখেছে; ছেলে না হলে বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে, ছেলের আবার বিয়ে দেবে।

    নিজের উদ্বেগের কথা বাপের বাড়িতে জানিয়েছিল চাঁদমণি। বাপ বলেছে, "আবার বিয়ে দেবে বললেই হল। দেশে আইন-আদালত নেই?"

    কিন্তু দেশে হাসপাতাল-ডাক্তার সবই তো ছিল! তা-ও এত লোক মরল কেন এই পোড়ামুখো রোগে? ভাগ্য, সবই ভাগ্য! আইন-আদালত কি তাঁর মতো গরিবদের জন্য? দেয়ালে মাথা ঠোকে চাঁদমণি, মেয়ে জন্মালে কী হবে?
    চাঁদমণির বর শম্ভ‌ু রাস্তায় রাস্তায় আইসক্রিম ফেরি করে। বিয়ে হয়েছে চার বছর। চাঁদমণি তখন ১৬। "কালো...তা সে যতই কালো হোক..." এসব কাব্যিক কথা বইয়ের লাইন থেকে বাস্তবে পা দেয় না। চাঁদমণির ক্ষেত্রেও দেয়নি। নগদ ৫০ হাজার টাকা পণ আর একটা বাইক যৌতুক দিয়ে দ্বিগুণ বয়সি শম্ভ‌ু চাঁদমণির বুকে চেপে বসার অধিকার পেয়ে গেল। প্রত্যেক রাতে বিছানায় তাণ্ডব করত শম্ভ‌ু। ভয়ে রাত হলেই সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কখনও, মসুর ডালের খেতে, কখনও পুরনো ভাঙা মসজিদের মধ্যে লুকিয়ে থাকতো। শম্ভ‌ু ঠিক খুঁজে বের করত।
    ''ছাইড়া দাও, বড় লাগে।'' চাঁদমণির আকুল কান্নাকাটি দেখে আশপাশে বাড়ির সবাই দাঁত বের করে হাসতো। কেউ প্রতিবাদ করেনি কখনও। সারারাত চলত অকথ্য নির্যাতন। খুব কালো বলে চাঁদমণির শরীরে দাগগুলো চট করে বোঝা যেত না। থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট আর ফুলে যাওয়া চোখ দেখলে অবশ্য বোঝা যেত শম্ভ‌ুর পৌরুষ আছে। সত্যিকারের পুরুষ সে। বাঘের বাচ্চা। একেই কালো বউ, তাঁর আবার ঢং কত!
    মেয়ের নাকি ব্যথা লাগে! আরে মেয়েমানুষ ব্যথা সহ্য করবে না তো কী! আর মাটি লাল হোক বা কালো, ভালো করে খেত মাড়াই না করলে ভালো ফসল ধরবে? ছেলে চাই তাঁর। ঘর আলো করা ছেলে।
    শ্বশুরবাড়িতে ওরা তিন জন। বাপের বাড়িতে অনেক মানুষ ছিল। দুই দাদা, তাঁদের ভরা সংসার। কিন্তু বাপের বাড়িতে এত ভয় ছিল না। এখানে হাত থেকে এক গ্লাস জল পড়লেও চাঁদমণি ভয়ে কাঠ হয়ে যায়। কী জানি এই অপরাধে কী শাস্তি হয় তাঁর। গত চার বছরে শাশুড়ি মানুষটাকে কখনও হাসতে দেখেনি।

    চাঁদমণি ভাবে, রাবণের চিতা আর শাশুড়ির মুখ প্রায় সমান। খালি জ্বলতে জানে, নেভে না কখনও।‌ শম্ভ‌ুর অত্যাচারে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হলেও শাশুড়ির মার সহ্য করার অভ্যাস এখন হয়নি। শাশুড়ি উনুনের চ্যালা কাঠ ভাঙে চাঁদমণির পিঠে। এখন সে যতটা পারে মুখ বুঁজে থাকে, কথা বলে না। রাতের বেলায় শম্ভ‌ুর পাশবিক খিদের কাছে উলঙ্গ শরীরটাকে ছেড়ে দিয়ে, আনমনে নিজের আঙুলের কড় গুনে ভাবে আজ ক'টা শব্দ উচ্চারণ করেছে। মাঝে মাঝে ভয় হয়, সে হয়তো কথা বলতেই ভুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। তিনটে মানুষের থাকার কথা এই বাড়িতে কিন্তু মনে হয় মানুষ থাকে দুটো। অন্যটি কেবল ছায়া। এমন এক ছায়া যে শুধুমাত্র কায়া ধারণ করে আছে।

    বিয়ের পর থেকে চাঁদমণি সুখ পায়নি কোনওদিনও। আর এখন এক আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাঁকে। পোয়াতি হবার পর থেকেই মা আর ছেলে মিলে একটাই কথা বলেছে, ছেলে চাই। বাড়িতে নাতি লাগবে। নয়তো এ বাড়িতে চাঁদমণির আর কোনও জায়গা নেই। ভয়ে উৎকণ্ঠায় প্রথম প্রথম সে খেতে ঘুমাতে পারত না। মনে মনে ভগবান কে বলত যাকে পাঠিয়েছ তাঁকে ফিরিয়ে নাও। সে মেয়ে চায় না কারণ মেয়ে জন্মালে বাঁচাতে পারবে না। আর ছেলে চায় না কারণ, শম্ভ‌ুকে সে মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। তাই, চাঁদমণি আর একটা শম্ভ‌ুর জন্ম দিতে চায় না। সে দিনরাত মৃত সন্তান কামনা করে। কিন্তু বাচ্চাটা অনায়াসে নয় মাস পার করে দিল। নিজের অনাগত অদৃষ্ট আর সন্তানের ভবিষ্যৎ ভেবে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চাঁদমণি। নীরবে চোখের জলে বুক ভেসে যায়। দুধের বোঁটা টনটন করে। কত যন্ত্রণায় মা তাঁর সন্তানের মৃত্যু কামনা করে সে ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে কেমন করে?

    শম্ভ‌ু এখন বাড়িতেই থাকে। কাজকর্ম নেই। এই বিদেশি রোগটা সব খেয়েছে মানুষের। প্রাণ, আয়ু, কাজ, বেঁচে থাকার অধিকারটাও পর্যন্ত খেয়েছে । একেই গ্রামের দিকে তাঁদের ঘর। করোনার মধ্যে কে আর আইসক্রিম খাবে? তাই স্থানীয় আইসক্রিম ফ্যাক্টরি বন্ধ হতে বেশি সময় লাগেনি। তবে মালিক বলেছে কয়েক মাস পর আবার ফ্যাক্টরি খুলবে। তখন সবাই কাজে ফিরবে। কিন্তু মুখের কথার কি দাম আছে?

    দু'বছর আগে প্রথম বার চাঁদমণি পোয়াতি হয়। চড়কের সময় গ্রামের শিবমন্দিরে খুব বড় মেলা সেইসঙ্গে পুজো হয়। সেবার শাশুড়ি বলল, তিনি নাতি হওয়ার জন্য মানত করেছেন আর তাই চাঁদমণিকে দণ্ডি কেটে মন্দিরে গিয়ে পুজো দিতে হবে। তখন পাঁচ মাসের গর্ভ। আশপাশে অনেকেই বারণ করেছিল শাশুড়িকে। এই অবস্থায় দণ্ডি কাটতে পারবে না। শাশুড়ি কারও কথা শোনেনি। তাঁর‌ মানত রাখতেই হবে। খুব খুব... কষ্ট হয়েছিল চাঁদমণির। প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা দণ্ডি কেটে যেতে হয়েছিল। সে শম্ভ‌ুকে বলেছিল, শাশুড়িকে বারণ করতে। শম্ভ‌ু ওর চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকিয়ে বলেছিল, ছেলের জন্য এটুকু কষ্ট করতে পারবে না? সেই রাতেই গর্ভ নষ্ট হয়। পাড়া-প্রতিবেশীরা শাশুড়িকে খুব কথা শোনায়। সবাই বলে শাশুড়ির জেদের জন্যই এমনটা হল। ঘরে এসে শাশুড়ি ছেলেকে বলেছিল, "ভালই হইসে বুঝঝোস। মাইয়া ছিল, তাই ভগবান নষ্ট কইরা দিসে।" মানুষের চোখে জল আসে, পাথরের চোখে জল আসে না। অহল্যার কাছে যা ছিল অভিশাপ, চাঁদমণির কাছে তাই আশীর্বাদ। নিজেকে ক্রমশ পাথরে পরিণত করছে সে। শম্ভুর অত্যাচার, শাশুড়ির নির্যাতন, গায়ে হয়তো লাগে কিন্তু মনে লাগে না আর। কিন্তু মানুষ তো, লোহার বাসর ঘরে কোন অদৃশ্য ফাটলের মতো একটা ছিদ্র ঠিক রয়ে যায়। আর সেখান থেকেই কালনাগিনী ঢোকে।

    পেটে হাত দিয়ে চাঁদমণি অঝোরে কাঁদে। অনাগত সন্তানের প্রতি পরম মমতা আর অসহায়তায় এক জননীকেও হার স্বীকার করতে বাধ্য করে। অতি কষ্টে ভাতের হাঁড়ি উনুন থেকে নামায় চাঁদমণি। মাড় গালে। তার পর পায়ে পায়ে পুকুরের দিকে এগিয়ে যায়। নিকষ কালো জলের দিকে থমকে তাকায় চাঁদমণি। সন্তানের জন্য কোন অন্ধকার বেশি কাম্য। এই জলের গহীন, নিবিড় তমশা নাকি জন্মের পরে সারা জীবনব্যাপী দুঃসহ যন্ত্রণা? পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামে। আর ভাবে, সকালে যখন জানাজানি হবে তখন লোকে বলবে, সে সন্তান কে মেরেছে। কিন্তু কই গঙ্গাকে কেউ তো খুনি বলে না। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে গঙ্গাও তো নিজের ৬ সন্তানকে মৃত্যু উপহার দিয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে মাথাটা ঘুরে গেল হঠাৎ করে। সঙ্গে সঙ্গে টাল সামলাতে না পেরে পা পিছলে গেল চাঁদমণির। সে জলে পড়ল। মৃত্যু মৃত্যু। বড় কাঙ্ক্ষিত এই মৃত্যু।

    জ্ঞান ফিরল হাসপাতালের বিছানায়। না মরেনি। পুকুরে কিছু পড়ার আওয়াজ পেয়ে আশপাশের বাড়ির লোকেরা ছুটে আসে, তারাই তাঁকে জল থেকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সিজার করতে হয়। বেঁচে যায় সে, বাঁচে তার গর্ভস্থ সন্তান। হাসপাতালে জ্ঞান হলে চাঁদমণি দেখে, তাঁর দু’দিকে দুই সন্তান। নার্স হেসে বলে," কী খাওয়াবে বলো? যমজ সন্তান হয়েছে তোমার, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।"

    চাঁদমণির‌ বিশ্বাস হয় না। সে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। নার্স বাচ্চা দুটোকে একসঙ্গে দুই হাতে তুলে দেয়। বাচ্চাদের দেখে আনন্দে, মমতায়, অপরাধবোধে, চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। তাঁর দীর্ঘ লালিত সংযম বাঁধ ভাঙে। সারা হাসপাতাল জুড়ে এক মায়ের কান্না হাহাকারের মতন এ ঘর থেকে সে ঘরে ঘুরতে থাকে।

    হাসপাতালে কয়েক দিন থাকতে হল চাঁদমণিকে। শরীর বড্ড দুর্বল। তার ওপর অ্যানিমিয়া। বুকের দুধে বাচ্চাদের পেট ভরে না। বাচ্চাগুলো কাঁদে অনবরত। কয়েক দিন পর একজন বয়স্ক মহিলাকে শাশুড়ির সঙ্গে করে নিয়ে এলো। মহিলার একটা চোখ অন্ধ। চাঁদমণির হাতে হাত রেখে সে বলে, "আমার নাম পদ্মাবতী। তুমি আমাকে পদ্মা মাসি বলে ডেকো।" তার পর চাঁদমণির সঙ্গে অনেক গল্প করল। চাঁদমণি একটু অবাকই হল বটে। শাশুড়ির সঙ্গে এসেছে অথচ এত ভালো ব্যবহার! কী জানি হবেও বা।
    সেদিন বিকেলে শম্ভ‌ু এসে একটু আড়ালে নিয়ে গেল তাঁকে। তার পর বলল, "শোনো, তুমি তো বাচ্চা পয়দা করেই খালাস। এখন এই সময়ে বাচ্চা দুটোকে কী করে মানুষ করবে কিছু ভেবে দেখেছ?"

    চাঁদমণি মনে মনে ঠিক এই ভয় পাচ্ছিল। সে নীরব হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকে। এ সব কথার কী উত্তর দেবে। শম্ভ‌ু বলেই চলেছে," আমার কোনও কাজকম্ম নেই এখন। ঘরে কোনও জামানো গুপ্তধনও নেই যে তোমার আর তোমার বাচ্চাদের পেট চালাব।" অনেকক্ষণ একতরফা শোনার পর একটু শুকনো গলাতেই চাঁদমণি বলল,"আমি তো ইচ্ছে করে দুটো বাচ্চাকে আনিনি। ভগবান যখন দিয়েছে তখন তার...‌।'' কথাটা শেষ করা হল না। কথাটা ছিনিয়ে নিয়ে খেঁকিয়ে, শম্ভ‌ু বলল, "ভগবান তো এই রোগটাও দিয়েছে। তবে কি এটাকে ভগবানের আশীর্বাদ বলে দু'হাত তুলে নাচব, চলবে তো"? চাঁদমণি আবার চুপ।

    শম্ভ‌ু বলে, "শোনো দুটো বাচ্চাকে আমি মানুষ করতে পারব না। একটা হলে তা-ও ঠিক আছে কিন্তু একসঙ্গে দুটোকে অসম্ভব।" চাঁদমণি এ বার চোখে চোখ রেখে বলে,"কী করবে তবে, মেরে ফেলবে?"

    শম্ভ‌ু বলল, "আমি আর মা ঠিক করেছি একটা বাচ্চাকে দিয়ে দেব।"

    _ " দিয়ে দেবে? কাকে?"
    _ "একজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের ছেলে মেয়ে নেই। হবে না কখন। তাঁদের দিয়ে দেবো। আমাদের কাছে থাকলে তো খেতে পরতে পারবে না। তাঁরা নিজেদের সন্তানের মতো মানুষ করবে। তাঁর সঙ্গে কিছু টাকাও দেবে।"
    চাঁদমণি চিৎকার করে বলে , "টাকা মানে, তুমি বাচ্চা বিক্রি করবে?"
    শম্ভ‌ু তাড়াতাড়ি চাঁদমণির মুখ চেপে সতর্ক দৃষ্টিতে চার দিকে তাকায়। এখানে কেউ নেই । কেউ তাঁদের কথা শুনছে না। তার পর কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে সে বলে, "আমাদের কথা হয়ে গেছে। বেশি বেগড়বাই করলে তুই তোর বাচ্চাগুলোকে নিয়ে বাপের কাছে চলে যা। আমার বাড়িতে আর ফিরবি না। আর যেন কখনও তোর মুখ না দেখি। বাপের বাড়িতে গিয়ে বাচ্চা মানুষ কর।''

    শম্ভু চলে গেল। চাঁদমণি মাথায় হাত দিয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।
    সে দিন সারাদিন সে কিছুই মুখে তুলল না।‌‌ শাশুড়িও‌ একই কথা ইনিয়ে বিনিয়ে বলেছে। পদ্মা মাসি সুযোগ পেলেই চাঁদমণিকে বারবার বলছে, "তুমি সংসারের কথা ভাবো, দুই সন্তান নিয়ে কী করবে। এই অবস্থায় পারবে দু'জনকে খাইয়ে-পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে। তার থেকে একটাকে যেতে দাও। অন্যটা বাঁচুক অন্তত।"

    ছেলেটাকে শাশুড়ি নিজের কাছ ছাড়া করে না। মেয়েটার দিকে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পদ্মামাসি। চাঁদমণি, মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে রাখে, তাঁর ভয় হয়, ছেড়ে দিলে ওরা কেড়ে নেবে।

    শাশুড়ি নাতির কপালে চুমু খেয়ে বলে, "ওরে আমি লক্ষ্মীন্দর কইয়া ডাকমু।" চাঁদমণি মেয়েটাকে দেখিয়ে বলে ‘আর ওর নাম ?’
    _"কয়েক ঘণ্টার জন্য আর নাম দিয়া হইব কী?"
    চাঁদমণির চোখের দৃষ্টি কঠোর হয়।
    পদ্মামাসি বিকেলে আবার আসে, মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে তার পর অনেক নরম স্বরে কথা বলে, "বাচ্চা মানুষ করা মুখের কথা নয়। একজনকে নিয়েই পারা যায় না, তায় ওপর আবার দুটো। তার মধ্যে যা অবস্থা চারদিকে। টাকা নেই, কাজ নেই, মানুষ দুটো খেতে পারছে না।..."

    সারাটা দিন অনেক আকাশ-পাতাল ভাবে চাঁদমণি। পুলিশে যাওয়া থেকে বাপের বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত। কিন্তু সব রাস্তাই কোন একটা বন্ধ দেয়ালের সামনে এসে থেমেছে। থানা পুলিশ করলে বাচ্চা দুটোকে নিজের কাছে রাখতে পারবে, কিন্তু তার পর? শাশুড়ি, স্বামী তাঁকে কোনও দিনও ঘরে নেবে না। কী হবে তাঁর ভবিষ্যৎ? আর বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যতই বা কী হবে? বাপের বাড়িতে দুই দাদার বিয়ে হয়ে যাওয়া পর্যন্ত মা-বাবাই তাঁদের গলগ্রহ। সেখানে একদিনের বেশি দু-দিন থাকলেই বৌদিদের মুখ ভার হয়ে যায়। না বাপের বাড়িটা এখন আর তাঁর আশ্রয় নয়।
    যদি এখানে সে হাঙ্গামা করে, তবে বাচ্চা দুটো আপাতত বেঁচে যাবে কিন্তু তার পর? সে কোথায় যাবে, বাচ্চা দুটোর কী হবে?

    দুর্বল‌ শরীরে আর কোনও কূলকিনারা না পেয়ে অবশেষে আবার জ্ঞান হারায় চাঁদমণি। সত্যিই তাঁর কিছু করার নেই। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান আসলে দেখে শাশুড়ি আর পদ্মা মাসি সেখানে আছে। পদ্মা মাসি চাঁদমণির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। চোখের কোণ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরে। সে দাঁতে দাঁত চেপে জিগ্যেস করে,

    " দর কত?"

    পদ্মা মাসি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে, তার পর আস্তে আস্তে বলে, "মেয়ে ১২ হাজার টাকা, আর ছেলে ২০ হাজার টাকা। তবে শরীর-স্বাস্থ্য, চেহারা সবকিছুর ওপর দর ওঠানামা করে।"
    শাশুড়ি ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে বলে, "মাইয়া, আমরা মাইয়া দিমু।''
    পদ্মাবতী বলে, "জানি গো জানি, ছেলে কেউ দিতে চায় না। এ দেশে মেয়ে বড় সস্তা। তাই ছেলের দর অনেক বেশি।"
    তার পর একগাছি কালো সুতোর বিনুনি চাঁদমণির হাতে দিয়ে বলে, "আজ রাতে সবাই যখন ঘুমাবে তখন এই সুতোগাছাটা মেয়ের বা হাতে বেঁধে রেখো। কোনও এক ফাঁকে আমি ওকে নিয়ে যাব।"

    তার পর শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, "কালকে অনেক পুলিশের হাঙ্গামা হবে আপনারা কিন্তু কেউ মুখ খুলবেন না। যদি মুখ খোলেন বাচ্চাটাকে তো পাবেনই না। আমরাও বিপদে পড়ব, আপনারাও বিপদে পড়বেন।"
    কথাগুলো প্রচ্ছন্ন হুমকির মতো শোনায়। সে টাকা দিয়েছে কিনছে, চুরি তো করছে না। কাজেই হুমকি দেওয়ার অধিকার তাঁর আছে বইকি। তার পর আবার চাঁদমণির হাতটা নিজের হাতে টেনে নিয়ে পদ্মামাসি বলে, "তোমার অল্প বয়স। মা ষষ্ঠীর কৃপায় আবার কোল ভোরে যাবে, কিন্তু যাঁদের বাচ্চা হয় না। সারাজীবন কত কষ্টে থাকে তাঁরা। তুমি ভাবো তুমি তাঁদের কত উপকার করছ। আর মেয়েকে তো একদিন পরের বাড়ি যেতেই হয়। তোমার মেয়ে না হয় ছোট বয়সেই গেল। চিন্তা করো না। মেয়ে তোমার ভালো থাকবে। কাল পুলিশকে এসব নিয়ে কিছু বলো না কিন্তু।"
    তার পর সুতোটা দিকে তাকিয়ে বলল, "শক্ত করে বেঁধো খুলে না যায়।"

    রাতে বাচ্চা দুটোকে খাইয়ে বুকের কাছে জড়িয়ে রাখল চাঁদমণি। তার পর বাচ্চাদের শুইয়ে, পাগলের মতো নিজের চুল ছিঁড়তে শুরু করল। অনেকগুলো চুল জড়ো হলে সেগুলো দিয়ে বিনুনি বাঁধল‌। তার পর তাতে গার্ডার জড়াল। একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, কপালে চুমু খেয়ে অতি সন্তর্পণে তার বাঁ-হাতে কালো বিনুনিটা বেঁধে দিল। চাঁদমণির বিছানাটা একদম জানলার কাছেই। বাইরের হাওয়াতে বিনুনিটা বাচ্চাটির হাতে কালো সাপের মতো দুলতে থাকে।
    চাঁদমণি পাশ ফিরে শোয়।

    সকালে সারা হাসপাতাল জুড়ে হইচই। গতরাতে বাচ্চা চুরি হয়েছে। ডাক্তারবাবু, নার্স, পুলিশ সবাই এসে বারবার জিজ্ঞাসাবাদ করে গেল চাঁদমণিকে। চাঁদমণি একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে পাথরের মতন বিবশ হয়ে বসে রইল। শরীরে কোনও সার নেই যেন। নীরব চোখের জলে বুক ভিজে যাচ্ছে। অন্য দিকে শাশুড়ি টিকটিকির খসে যাওয়া লেজের মতো ছটফট, উথালি পাথালি চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে। তাঁকে সামলানো দায়। চাঁদমণির বরের ও পাগলের মতন অবস্থা। বাচ্চাটার শোক তিন জনকেই বড্ড আঘাত দিয়েছে।

    ঝামেলা কিছু মিটলে বিকেলের দিকে শম্ভ‌ু এসে চাঁদমণিকে জিজ্ঞেস করল, "সুতোটা ঠিকঠাক বেঁধেছিলে ?"
    চাঁদমণি ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। শম্ভ‌ু হাত পাতে, চাঁদমণি পদ্মামাসির দেওয়া বিনুনিটা শম্ভ‌ুর হাতে দিয়ে দেয়। শম্ভ‌ু সুতোটা হাতে নিয়ে বলে, "চুতিয়া বুড়িমাগী, আমার ৮ হাজার টাকা লোকসান করে দিল।"

    রাত্রিবেলা যখন সবকিছু শান্ত, চারপাশের সবাই ঘুমোচ্ছে, চাঁদমণি তখন অবশিষ্ট সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে তার কানে কানে বলে, "তুই আমার বেহুলা। যমের সঙ্গে এ বার নিজের জন্য লড়বি বুঝলি, আর কারও জন্য নয়।"

    পূর্বে প্রকাশিত : https://www.4numberplatform.com/?p=29619
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ | ৯৬১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রুটি - Rumela Saha
    আরও পড়ুন
    কাঠাম - Rumela Saha
    আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন