এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • আ মরি বাংলা ভাষা...

    Muhammad Sadequzzaman Sharif লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ৩১২৪ বার পঠিত
  • ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কী হয়েছিল তা সকলের জানা। ভাষার প্রশ্নে এক বিন্দু আপোষ না করে রক্ত ঝড়িয়ে অধিকার আদায় করেছিল মানুষ। অধিকার আদায়ের এই পথ পরবর্তীতে বাংলাদেশ নামক একটা দেশের জন্ম দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ঠিক সময়ে যা করার দরকার তা সে সময়ের সকল মানুষ তা করেছে। যে সময় প্রতিবাদে ফেটে যাওয়ার দরকার তখন প্রতিবাদে আকাশ কম্পিত করেছে। বিনিময়ে যখন জেলে যেতে হয়েছে তখন জেলে গিয়েছে, যখন রক্ত দিতে হয়েছে তখন রক্ত দিয়েছে। জীবন দেওয়ার সময়ও পিছুপা হয়নি কেউ। আমরা আজকে ওই সময়ের প্রতিবাদী প্রত্যেকটি মানুষের কাছে চির ঋণী। ভাষা হল, স্বাধীনতা পেলাম সকলই আমাদের আগের প্রজন্ম আমাদের জন্য করে দিয়ে গেছে। আমরা সুবিধা ভোগ করে যাচ্ছি শুধু। অমূল্য এই সম্পদ গুলো যখন আমাদের হাতে এসেছে তখন আমরা কী করছি? স্বাধীনতার মর্যাদা বা রক্ত দিয়ে পাওয়া ভাষার মর্যাদা কতটুকু রেখেছি আমরা?

    ২১ ফেব্রুয়ারি তো, তাই আজকে ভাষার কথাই বলি। উর্দু রাষ্ট্র ভাষা হলে যা যা সমস্যা হওয়ার কথা তা আজকে রাষ্ট্র ভাষা না হয়ে ইংরেজির কারণে হচ্ছে। সমান যোগ্য দুইজন চাকরি প্রত্যাশীর ভিতরে যিনি ইংরেজিতে একটু ভাল সে অগ্রাধিকার পাচ্ছে। তিনি পেতেই পারেন, তিনি মাতৃভাষার বাইরে ভিন্ন একটা ভাষা ভাল পারেন, কিন্তু যেখানে অন্য একটা ভাষার দরকার নেই সেখানেও তো একই চিত্র! কিংবা আরও করুণ উদাহরণ দেওয়া যায়, যোগ্য হওয়া সত্তেও ইংরেজি বলায় সাবলীল না তাই চাকরি পাচ্ছে না অনেকে। আমরা জ্ঞানী আর ইংরেজী ভাষায় পারদর্শী মানুষকে এক করে ফেলেছি। কোন কোন ক্ষেত্রে ইংরেজিকে আরও উঁচু স্থান দিতেও কার্পণ্য করছি না। ইংরেজি ভাষাভাষী মানুষদের সাথে কাজকর্ম থাকলে অবশ্যই ইংরেজি জানা লোকের দরকার এবং সেখানে নিশ্চয়ই কেউ আপত্তিও করবে না। কিন্তু আমরা দিনদিন যে ইংরেজিকে জ্ঞানের মানদণ্ড বানিয়ে ফেলছি তার সমাধান কী? ইংরেজি যে শুধু মাত্র একটা ভাষা এই সত্য বুঝতে এত কষ্ট কেন হচ্ছে? মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া জাতি যদি মাতৃভাষাকে দ্বিতীয় স্থানে রেখে দেয় তাহলে একুশের রাতে প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দেওয়ার মানে কী?

    আমরা দ্বিতীয় স্থানে রেখেছি আমাদের বাংলাকে। বেশি বাড়াবাড়ি রকমের কিছু বলে ফেললাম মনে হচ্ছে? এক বিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না আমি। বাংলা ছাড়া বা বাংলা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া বাংলা ভাষায় কোন উচ্চ শিক্ষা নেওয়া যায় না। তেমন কোন উপায়ই নাই দেশে। উচ্চ শিক্ষা নিতে হলে বিশেষ করে বিজ্ঞানের কোন বিষয় ইংরেজী ছাড়া রাস্তা নাই। প্রকৌশল বা চিকিৎসা শাস্ত্র, ইংরেজ বানিয়ে ছেড়ে দেয় সবাইকে। আর এই ইংরেজরা বেশির ভাগই পরে সারা জীবন ইংরেজ থেকে যায়। ভিন্ন আরেকটা ভাষা জানা ভাল কিন্তু বাধ্যতামূলক? হাস্যকর না? বাংলা ভাষা যদি নবীন কোন ভাষা হত তবু মেনে নেও যেত। তা তো না, তবু কেন ইংরেজির উপড়ে নির্ভর করে থাকতে হবে? জার্মানরা বা চাইনিজরা সবাই ইংরেজি ভাষায় পড়াশোনা করে উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে এমন তো না। ইউরোপে ইংরেজি ভাষা থেকে স্প্যানিশ ফ্রেঞ্চ অনেক জরুরি ভাষা। এগুলা না জানলে ইউরোপ দর্শন মুশকিল। কারণ এই ভাষাভাষীরা ইংরেজিকে পাত্তাও দেয় না। ওরা ভাষাটাকে গভীর ভাবেই ভালবাসে। খুব জরুরি না হলে ইংরেজি ব্যবহার করতে চায় না ওরা। বিফোর সানরাইজ নামে একটা সিনেমা আছে। আমেরিকান এক টুরিস্ট জার্মান একজনকে জিজ্ঞাস করছে, "তুমি কী একটু ইংরেজি বলতে পার?" জার্মান ব্যাক্তি মজা করেই তাকে খোঁচা দেয় "তুমি কি একটু জার্মান বলবে আমার জন্য?" দেখার দৃষ্টিভঙ্গিটাই আসল। আমি ইংরেজি বলব কেন? তুমি কী আমার দেশে এসে জার্মান বলতে পার না? আমরা বলতে পারি না এই কথা, আমরা পারি না যে ভাই, বাংলা বলতে পার না একটু? আমরা নিজেরাই বিশ্বাস করি না যে এটা সম্ভব।

    দীর্ঘদিন ইংরেজ শাসনে থাকর কারণে আমাদের মজ্জায় ইংরেজি প্রেম ঢুকে গেছে। আমরা চিন্তাই করতে পারি না এর বিকল্প সম্ভব। তাই দুইজন বাঙালী মেইল চালাচালি করে ইংরেজিতে! ধরেই নেওয়া হয়েছে মেইল করতে হয় ইংরেজিতে। তাও অফিসিল মেইল হলেও কথা থাকে ( কোন কথাই থাকে না, ইংরেজি ভাষাভাষী কেউ এই কাজে যুক্ত না থাকলে কোন যুক্তিই নেই শুধু শুধু ইংরেজি ব্যবহারের), ব্যক্তিগত ইমেইল করার সময়েও অনেকে ইংরেজি ব্যবহার করে। ইউটিউবে কলকাতার এক অনুষ্ঠানের ভিডিও দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। তাতে আলোচনা হচ্ছিল বাংলা সাহিত্য নিয়ে। চন্দ্রিল ভট্টাচার্য বাদে বাকি সব বক্তা বাংলা সাহিত্য নিয়ে আলাপ করে গেল ইংরেজিতে! সেখানে সকলে বাঙালী, তবে ইংরেজি কপচানো কিসের জন্য? কারণ আমরা বাঙালীরা ধরেই নেই ইংরেজিতে বলছে মানে তিনি কিছু জানে! ইংরেজিতে আলাপ হচ্ছে মানে প্রচুর জ্ঞানের আলাপ হচ্ছে! ইদানীং আমাদের মাহফিল জমানো হুজুরেরা এই জিনিস শিখে ফেলছে। বধ্য গ্রামে ওয়াজ করছে, মাঝে মাঝেই ইংরেজি দুই একটা লাইন বলে নিজের জ্ঞান জাহির করছে। বলা যায় এখন ওয়াজের মাঝে ইংরেজি লাইন বলে না এমন বক্তা বাংলাদেশেই নাই। যারা বলে না তারা ইংরেজি ক্লাসে ভর্তি হয়েছে, অপেক্ষা করুন, সামনের শীতেই শুনতে পারবেন।

    আমরা যে ইংরেজদের অনুসরণ করে এখনো চলছি তার বড় উদাহরণ হচ্ছে আমাদের বিচারের রায় দেওয়া হয় ইংরেজিতে। স্বাধীন একটা দেশের রায় কেন ইংরেজিতে দেওয়া লাগবে? এই রায় যদি আন্তর্জাতিক কোন ক্ষেত্রে কাজে লাগে তাহলে তা অনুবাদ করে দেওয়া হতে পারে কিন্তু মূল রায় তো ইংরেজিতে দেওয়ার কোন যুক্তি নাই। কিন্তু তাই হয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই বেশ কিছু রায় বাংলায় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা খুবই অপ্রতুল । উচ্চ আদালতে এর হার খুবই কম। তবে আশার কথা যে এখন কম হলেও বাংলায় রায় লেখা হচ্ছে।

    বাংলায় রায় লেখা বা বাংলা বিজ্ঞান বিষয় উচ্চ শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাংলায় বই নাই। আইনের বই নাই, ডাক্তারির বই নাই, বিজ্ঞানের বই নাই। এই যে নাই, এটাই আমার ভাষার দৈন্য অবস্থা প্রকাশ করছে না? এত বছরেও কেন করতে পারলাম না আমরা? কত টাকা খরচ হত এই কাজে? কয়েকশ কোটি টাকার ফুল দেওয়া হবে আজকে শহীদ মিনারে। অথচ ভাষার কাজে লাগে এমন কাজের উদ্যোগ নেই। আমি কোন বিরোধিতা করছি না শহীদ মিনারে ফুল দেওয়ায় বা মানুষের প্রচণ্ড ভিড়ের। আমি সাধুবাদ যাই এই আগ্রহকে। এই ভিড় আমাদের অনেক কিছুর জবাব দেয়। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে শক্তি যোগায়। সকল প্রকার অপশক্তির গালে সপাটে থাপড় চালায় এই ভিড়। কিন্তু এই ভিড় যদি শুধু মাত্র উৎসবের মেজাজে ফুল দেওয়ায় শেষ হয়, যদি শহীদ দিবস উৎযাপনের বিষয় হয়ে যায় আর যে বাংলার জন্য মানুষ জীবন দিয়ে দিল তা হতে থাকে দিন দিন দ্বিতীয় ভাষা তাহলে আমাদের আবার ভাবতে হবে। আমাদের একটু দাঁড়াতে হবে স্থির হয়ে। সত্যিই আমরা সঠিক পথে আছি কিনা দেখা দরকার।

    সর্বস্তরে বাংলার ব্যবহার চাই। ইংরেজি না জানাটা অপরাধ না। তবে বাংলায় জন্মে, বাংলায় বড় হয়ে বাংলা না জানা অপরাধ। এত বছর পরে এসে শহীদের রক্ত যেন কোনমতেই বৃথা না যায় সে দিকে নজর রাখি। শহীদ দিবসে সকল শহীদদের প্রতি গভীর শ্রাদ্ধা জানাই।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ৩১২৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন