এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • জাতীয় পতাকা, দেশপ্রেম এবং জুতো

    Anamitra Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৬ আগস্ট ২০১৮ | ১৬৫৮ বার পঠিত
  • কাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পোস্ট দেখছি, কিছু ছবি মূলত, যার মূল কথা হলো জুতো পায়ে ভারতের জাতীয় পতাকাকে সম্মান জানানো মোটেও ঠিক নয়। ওতে দেশের অসম্মান হয়। এর আগে এরকমটা শুনিনি। মানে ছোটবেলায়, অর্থাৎ কিনা যখন আমি প্রকৃতই দেশপ্রেমিক ছিলাম এবং যুদ্ধে-ফুদ্ধে যাবো ভাবতাম, তখন ইশকুলে যতবার জাতীয় পতাকা উঠতো জুতো কিন্তু আমার পায়েই থাকতো বলে মনে পড়ছে। তাতে আমার বাচ্চা বয়সের দেশপ্রেম খুব একটা অপবিত্র হয়ে গেছে বলে তো কখনো মনে হয়নি। আমরা জানতাম মন্দিরে ঢুকতে গেলে জুতো খুলতে হয়। জুতো খুলতে হয় মসজিদের প্রার্থনাকক্ষে ঢুকতে গেলেও। ব্যান্ডেল চার্চেও যদ্দুর মনে পড়ছে প্রার্থনাকক্ষের বাইরে জুতো খুলে রেখে ভেতরে ঢোকাই রীতি। আসলে বাঙালিদের চার্চ তো! এর ফলে অবশ্য কখনো কোনো বিদেশী টুরিস্ট অযথা বিড়ম্বনায় পড়েছেন কিনা জানা নেই। হলিউড ছবিতে তো চিরকাল দেখেছি ওনারা জুতো পায়েই ঢুকে যান প্রায় সব জায়গায়।

    সে যাই হোক, সায়েবদের কথা আলাদা। ওরা ব্লাসফেমীকেও সময়ে সময়ে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে জানে। কোন একটা সিনেমায় যেন রোয়ান আটকিন্সন কফিনের ওপর জুতো পরে উঠে নাচছিলেন। তাতে কেউ ওদেশে সিনেমাহল পুড়িয়ে দিয়েছিলো বলে তো শুনিনি! সাহাগঞ্জ ডানলপে থাকার সময় জিটিরোডের গুরুদ্বারে কয়েকবার গিয়েছি। মাথা ঢাকতে হয়েছিল রুমাল দিয়ে মনে আছে, জুতো খুলেছিলাম কিনা পরিষ্কারভাবে মনে নেই। সম্ভবত খুলেছিলাম, একটা ঘরে ঢোকার আগে।

    কিন্তু কথা হচ্ছিলো দেশপ্রেমের। জুতো পায়ে স্যালুট মারলে দেশের অসম্মান হয় কি হয় না ! --- খুবই গম্ভীর প্রশ্ন।
    তাহলে জানতে হয় মন্দিরে প্রবেশ করার সময় আমরা জুতো কেন খুলি। জুতো মানেই যে চামড়া দিয়ে তৈরী এমনটাতো নয়, কাজেই একদিক থেকে বলা যায় যে এর সাথে গো-মাতার কোনো সম্পর্ক নাই। ভারতবর্ষে এই রেওয়াজ চামড়ার জুতোর প্রচলনের আগে থেকেই চলে আসছে; শোনা যায় সেই খড়মের আমল থেকেই। তাছাড়া ইসলামে মসজিদের প্রার্থনাকক্ষে প্রবেশের আগেও জুতো খোলার রেওয়াজ আছে। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় রেওয়াজটি মূলত পবিত্রতার ধারণার সাথে যুক্ত। পবিত্রতা মানে কিন্তু (অর্থের অধ্যাত্মিক অংশটি বাদ দিলে) পরিচ্ছন্নতাও, ভারতবর্ষের অধিকাংশ মন্দির দেখলে অবশ্য একথা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন, মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা প্রার্থনাকক্ষে প্রবেশের পূর্বে জুতো খোলা ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ জল দিয়ে পরিষ্কার করে নেন। অথবা হিন্দুধর্মেও সাধারণত স্নান করে পুজোয় বসা হয় এবং ব্রাহ্মণ ধার্মিক আচারের আগে শুচিমন্ত্র জপ করেন নিজের শুদ্ধিকরণের জন্য।
    ইসলাম ধর্মে জুতো খোলার প্রথার সাথে সম্ভবত ইহুদী ধর্মেরও একটা সম্পর্ক আছে। ওদের থেকে আলাদা হওয়া বা এরকম কিছু একটা; এই জায়গাটা আমার কাছে খুব একটা পরিষ্কার নয়। ধর্ম নিয়ে আমার ফান্ডা বেশ সীমিত।
    এছাড়াও কিছু কারণের কথা জানতে পারা যাচ্ছে যেগুলি হয় বিশ্বাস অথবা বাস্তবনির্ভর। যেমন মন্দিরের ভিতর একধরনের এনার্জিতরঙ্গ থাকে যা কিনা পায়ে জুতো থাকলে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে না। অথবা আগেকার দিনে (এবং কিছু ক্ষেত্রে এখনও) মন্দিরের মেঝেতে সিঁদুর-চন্দন-হলুদ ইত্যাদি ভেষজগুণ সম্মৃদ্ধ নানান বস্তু লেপা থাকতো। সেইসমস্ত ভেষজগুণ যাতে শরীরে প্রবেশ করে সেজন্যেই নাকি জুতো খুলে প্রবেশ করার চল। আবার পৃথিবীর অধিকাংশ খ্যাতনামা মসজিদেই প্রার্থনাকক্ষে কার্পেট পাতা থাকে। নামাজ পড়ার সময় এই কার্পেটে মাথা ঠেকানো হয়, ফলে কার্পেটটি পরিষ্কার রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। এইজন্যেই নাকি জুতো পায়ে প্রার্থনাকক্ষে ঢুকে যাওয়া উচিত নয়।

    তাহলে দুটি কারণ পাওয়া যাচ্ছে মূলত; ১) পরিচ্ছন্নতা এবং ২) পবিত্রতা। প্রথম কারণটিকে আমরা শুরুতেই বাদ দিয়ে দিতে পারি। কারণ জাতীয় পতাকা হামেশাই তোলা হয় মাঠে-ঘাটে জল-কাদার মধ্যে। একবুক জলে দাঁড়িয়ে পতাকা স্যালুট করা কিন্তু চূড়ান্ত দেশপ্রেমের পরিচায়ক। এবং ভারতবর্ষের অধিকাংশ অঞ্চলেই অগাস্ট মাস সাধারণত বৃষ্টির সময়। জাতীয় পতাকা তোলার আগে স্নান করে আসতে হবে জাতীয় কোনো নিয়মের কথাও কখনো শুনিনি। একবার তো ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় কে একটা যেন ইয়েই করে দিলো প্যান্টে স্বাধীনতা দিবসের দিন। মাথার ওপর তেরঙ্গা উড়ছে ওদিকে নীল প্যান্ট পেছনের কাছে খানিকটা অংশ সবুজ হয়ে আছে! কি অবস্থা! শক্তি স্যার মাথায় চাঁটি মেরে তাকে বাথরুমে পাঠিয়ে দিলো। কিন্তু পুলিশ ডাকতে হয়নি। সে আমলে অবশ্য পায়ে জুতো থাকা নিয়েও কারুর আপত্তি ছিলো বলে মনে পড়ছে না। আপত্তি হচ্ছে ইদানিং, আরও নির্দিষ্ট করে বললে, গতকাল থেকে। এবং হোমসয়ীও ডিডাকশন পদ্ধতিতে এতদূর ভেবে যা মনে হচ্ছে পবিত্রতার উদ্ভট ধারণা ছাড়া এর পিছনে আর কোনো কারণ থাকতে পারে না। ভারতমাতা একজন দেবী, এবং স্যালুট হচ্ছে ওনার প্রণাম। আর একথা কে না জানে যে ভগবানকে নমো করার সময় পায়ে জুতো থাকতে নেই। এই অতিসরলীকরণই বোধ করি এই ধারণার জন্ম দিচ্ছে যে জুতো খুলে জাতীয় পতাকাকে স্যালুট করলে ৩-৪ আউন্স বেশি দেশভক্তি প্রকাশ পায়। কোথায় আবার কোন অফিসার যেন মাটিতে আঁকা মানচিত্রের আদলের ওপর জুতো পরে দাঁড়িয়ে পতাকা স্যালুট করেছে। মানে একেবারে জাগ্রত মূর্তিতে লাথি মারা যাকে বলে আরকি। তুই ম্যাপটা মাটিতে আঁকলি সেটা দোষের নয়, একজন জুতো পরে দাঁড়ালো তার ওপর সেইটা নাকি দোষের হয়ে গেলো! তোর কলেজে কি স্বয়ং গো-মাতা লজিকের ক্লাস নেন?

    জুতো পরে স্যালুট করা যদি অসম্মান হয় তাহলে তো আর্মিতে জুতো পড়ার রেওয়াজই তুলে দিতে হবে। নাহলে তো যতবার স্যালুট মারবে ততবার অসম্মান। সিপাহী কম্যান্ডান্টকে স্যালুট মারছে, পায়ে জুতো --- কোর্ট মার্শাল! কম্যান্ডান্ট পতাকাকে স্যালুট মারছে, পায়ে জুতো --- কোর্ট মার্শাল! প্রত্যেকবার স্যালুট মারার আগে জুতো খুলতে হবে। কি গেরো! ওদিকে জুতো না পরাও আবার ও পাড়ায় নিয়মভঙ্গের সামিল। মানে তুমি যাই করো না কেন পিঠে রাইফেল নিয়ে ৫ কিলোমিটার দৌড় অন্তত, যদি কোর্ট মার্শাল নাও হয়। এসবের থেকে ভালো বরং হুজুগে না লাফিয়ে নিয়মগুলো জেনে রাখা। নিচে তুলে দিচ্ছি যাঁদের জানার ইচ্ছা বা প্রয়োজন আছে তাঁদের জন্য।
    বিঃ দ্রঃ - মূল ফ্ল্যাগ কোডটি বেশ বড় হওয়ার দরুন একটা ছোট ভার্শন খুঁজছিলাম। নিচে কোটেশনের ভিতরের অংশটি খোদ হিন্দুজাগ্রতি-র ওয়েবসাইট থেকে কপি করা। অতএব কোনো ভুল থেকে থাকলে খিস্তিগুলোও ওনাদেরই প্রাপ্য। মূল ফ্ল্যাগ কোডের লিংক উদ্ধৃত অংশটির নিচে দেওয়া রইলো।

    " 1. The flag should not be used as a drapery in any form whatsoever except in State, Military, Central Para-military Forces funerals.
    2. The flag cannot not be draped or stuck over any vehicle, train or boat.
    3. The flag should not be used as a curtain in any household.
    4. The flag should not be printed on any clothing or over handkerchiefs, napkins, cushions etc.
    5. Nothing should be written or printed on the National flag.
    6. The flag should not be used in any form of advertisement nor shall an advertising sign be fastened to the pole from which the flag is flown.
    7. Only on Independence Day and Republic Day flower petals are kept inside the flag before it is unfurled.
    8. During the ceremony of hoisting or lowering of the flag, all persons present should face the flag and stand at attention. Those present in uniform should render the appropriate salute.
    9. During a parade, when the flag is in a moving column, persons present will stand at attention and salute as the flag passes by them. A dignitary may take the salute without wearing a cap."

    https://en.wikisource.org/wiki/Flag_Code_of_India
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৬ আগস্ট ২০১৮ | ১৬৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন