এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • প্রিয় চিনার পাতা, ইতি সেগুন

    Anamitra Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২২ নভেম্বর ২০২২ | ৫৩৬ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | | পর্ব ৩ 
    বাবাদের প্রজন্মটা কীরকম যেন আসা-যাওয়ার মাঝেই জীবনটা কাটিয়ে দিল। রোজ সকালে শহরতলি অথবা নিকটবর্তী মফঃস্বল থেকে ট্রেন ধরে শহরের দিকে ছোটা, আবার লেট সন্ধে কিংবা রাত্তিরের দিকে ফিরতি ঢেউয়ের মতো ঘরে ফিরে আসা ক্লান্ত শরীরে। এর ফাঁকেই কখন যেন আমরা বড় হয়ে গেলাম। এখন বাবা অফিস যায় না বলে শনি আর রবিবারগুলোর যেন আলাদা করে মূল্য নেই কোনও। অদ্ভুত লাগে সারাজীবন দৌড়ে বেড়ানো এইসব মানুষদের বাড়িতে দেখতে। যেন সত্যিই আর কোথাও যাওয়ার নেই বলে সকাল হলে বাজারের রাস্তা থেকেই হেঁটে ফিরছে একটু। আরও অদ্ভুত লাগে যখন আমার বয়সী বা আমার থেকেও ছোট কেউ বলে, "আমি আর পারছি না অনমিত্র দা। নিজের জন্য একটা ঘন্টা সময় বার করতে পারি না দিনে। আমার নিজের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে!" অথবা, "এভাবে কতদিন টানা সম্ভব বলো তো? রোজ রোদ্দুরে বেরিয়ে বেরিয়ে চামড়ার রঙ বদলে যাচ্ছে আমার! গাল ভেঙে চোখ ঢুকে গেছে গর্তে। সারাদিনের পর যখন বাড়ি ফিরি মনে হয় কোনওমতে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে যাই। আর খাওয়ার ক্ষমতাটুকুও থাকে না!" --- শুনতে শুনতে আমার বাবার কথা মনে পড়ে। একটা বয়স অবধি রোজ বাড়ি ফেরার সময় হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসত বাবা। একবার দুটো টেবিল টেনিসের ব্যাট আর পিংপং বল এনে দিয়েছিল। আমার তিন বছরেরও কম বয়স তখন। তার মানে বাবা একচল্লিশ-বিয়াল্লিশ। ব্যাটে করে মেরে মেরে বলটা মাটিতে ড্রপ খাওয়াচ্ছিল বাবা, শেখাচ্ছিল কীভাবে খেলতে হয়। মাটিতে পড়ে বলটা আবার ব্যাটে উঠে আসছিল। বাবাদের জীবনটাও ওই বলটার মতো ছিল; শহর অবধি ছুটে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে ঘরে ফিরে আসা রোজ রাত্তিরে। আমাদের জীবনগুলোও এখন ওই পিংপং বলটার মতো হয়ে গেছে।

    যেদিনগুলোয় বাবা হাতে করে কিছু নিয়ে আসতে পারত না বাড়ি ফিরে একটা ছবি এঁকে দিত আমাকে। একবার বাবা এঁকেছিল একটা বাঁদর মাথায় টুপি পরে ব্যাট হাতে মাঠে ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে আর বাঁদিকে ওপরে সূর্য জ্বলজ্বল করছে একটা। আমি ওই বাঁদরটা হতে চেয়েছিলাম। তার বদলে একটা অহল্যাবৎ প্রস্তরখন্ড হয়ে গেছি যার সামনে দাঁড়িয়ে কেউ একজন বলে যাচ্ছে, "যখন ঘামে ভিজে জামাটা লেপ্টে থাকে গায়ের সাথে, ট্রেনের ভেতর যখন মানুষের ঘামের গন্ধ ছাড়া আর কিছু আসে না নাকে, আমার কী প্রচন্ড ঘেন্না হয় নিজের ওপর। মনে হয় এক্ষুনি স্নান করে ফেলি নেমে গিয়ে। মনে হয় জীবনটা নষ্ট করে ফেললাম কিচ্ছুটি না করে উঠতে পেরে!" আমার মনে পড়ে একবার বাবার গায়ে ঘামের গন্ধ পেয়েছিলাম আমি অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর। "ইঁস! কীঁ বিঁচ্ছিরিঁ গঁন্ধঁ!" বলে নাক চেপে ধরেছিলাম নিজের। "মানুষের মেহনতের গন্ধ এরকমই হয়। আমি চাই বড় হলে তোর গা থেকেও যেন এই গন্ধটাই বেরোয়"--- বাবা বলেছিল হালকা গর্বের সুরে। আমার গায়ে এখন ঘামের গন্ধ নেই কোনও। আমি টাটাদের কিনে নেওয়া বিগবাস্কেট অথবা জেফ বেজোসের আমাজন কোম্পানির কাছ থেকে অফারে ডিওডোরেন্ট কিনি।

    "কিন্তু আমি তো এই জীবনটা চাইনি, অনমিত্র দা! আমি তো অন্য একটা জীবন চেয়েছিলাম। একটা কোনওকিছু কি আমার মনের মতো হতে পারত না? মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয় ঝুলে পড়ি। এভাবে আর পারছি না। কেউ খোঁজও তো নিতে আসবে না একদিন ঝুলে পড়লে সত্যিই! আমার এক্সও না!" আমার মায়ের কথা মনে পড়ে এবার। সকালে উঠে থেকে বাবার জন্য খাবার বানিয়ে, দুটো বাচ্চাকে রেডি করে ভাত খাইয়ে ইস্কুলে পাঠিয়ে, নিজে স্নান করে খেয়ে ইস্কুল পৌঁছে যেত রোজ ঠিক দশটা পঞ্চাশের মধ্যে। কোয়ার্টার থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ ছিল মায়ের ইস্কুল। যেদিন ইস্কুল যাওয়া থাকত না, লুচি বা পরোটা হতো সকালে বাড়িতে। সেইসব পরোটার স্বাদ কোনও শের-এ-পাঞ্জাব ভোলাতে পারবে না আজও। এখন এই বয়সেও দেখি আমার বাড়িতে এলে সকাল থেকে রান্নাবান্না-ঘর পরিস্কার কী অপরিসীম এনার্জি নিয়ে লাগাতার কাজ করে যেতে পারে। আমি বাবাকে বাগান করতে দেখেছি, অথবা কোয়ার্টারের উঠোনের বেড়া ঠিক করতে। না করলেও এসে যেত না কিছুই, তবু বাবা করতো। যতবার গরু বা মহিষ বেড়া ভেঙে ঢুকে ফুলগাছ খেয়ে যেত বেড়া সারাই করতো বাবা পরবর্তী ছুটির দিনে। একবার ছুটির দিনে এক শীতের দুপুরে বোর্ডগেমে জোচ্চুরি করতে গিয়ে বাবা আমার কাছে ধরা পড়ে যায়। বাবাকে ধরে ফেলার শাস্তি হিসেবে বাবা গালে দাড়ি ঘষে দিয়েছিল আমার। তখন দাড়ি কাটতো রোজ, তাই খোঁচা খোঁচা দাড়ি উঠেছিল গালে সেদিন। আমাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে গালে দাড়ি ঘষছিল বাবা। আমার বয়স তখন পাঁচ-ছয় বছর মতো হবে। আমার সুড়সুড়ি লাগছিল। খলখল করে হাসছিলাম আমি বিছানায় পড়ে। পরের দিন আবার অফিস ছিল বাবার মনে আছে। আগের দিনও ছিল সম্ভবত।

    আমার ওই হাসির আওয়াজটার কথা মনে পড়ে আজকাল প্রায়ই। ওইরকমভাবে জীবনে আর কখনও হেসেছি কিনা আমার জানা নেই। আমি জানি আমি পারব। আমি না পারলে আর কেই বা পারবে! আমি চাই আমার প্রতিটা বন্ধু জানুক যে সে পারবে। কারণ সেও না পারলে আর কেউই পারবে না কোনওদিন। একদিন জন্মেছিলাম আমরা, আর একদিন নিঃশ্বাস নিতে শিখেছিলাম নিজে নিজে। ভাতের স্বাদ আমরা ফিলোজফির বই পড়ে জানিনি, জিভে দিয়ে চিনেছি ছোটত্থেকে। আমরা এক ম্যাজিকপ্রজন্মের সন্তান। তাই আমরাও ম্যাজিক জানি। আজ মাদার্স ডে নয়, ফাদার্স ডেও নয়; আমার বাবা বা মা কারও জন্মতারিখও নয় আজ। আগের প্রজন্মের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বীকারস্বরূপ এইটুকু অঙ্গীকার রেখে গেলাম।

    আমরা বাঁচব।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | | পর্ব ৩ 
  • ব্লগ | ২২ নভেম্বর ২০২২ | ৫৩৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন