এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • পাখিদের পাঠশালা

    কুশান গুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ৩৬৩০ বার পঠিত
  • 'আচ্ছা, সারা দেশে মোট কতজন ক্যান্ডিডেট এই পরীক্ষাটা দেয়?', লোকটা সিগারেটে একটা টান দিয়ে প্রশ্ন করলো।

    -'জানা নেই। তবে লাখ দশেক তো হবেই।', আমি বললাম।

    - 'বাব্বা! এতজন! সিট কতো ?'

    -'বলতে পারব না। ভাল কলেজ পেতে গেলে মেরিট লিস্টে যথেষ্ট ওপরে নাম থাকতে হবে।'

    -' তার মানে একটা লম্বা মেরিট লিস্ট হবে নিশ্চয়। তা, সবাই সবার নাম দেখতে পাবে ?'

    এই প্রশ্নে একটু অবাক হলাম। একটু বিরক্তিও বোধ হলো।

    -'সবাই সবার নাম দেখতে পাওয়াটা ইস্যু না। যে যার নামই নিশ্চয় খুঁজে নেবে। কিন্তু একটা ট্রান্সপারেন্সিও তো রাখতে হয় সিস্টেমে' একটু জোর দিয়েই বললাম কথাটা।

    'তা ঠিক', একটু মিইয়ে গেল ওর গলাটা। লোকটা আনমনে একটা হাত দিয়ে ঘাস খুঁটতে লাগলো। তারপর মুখ তুললো, বললো, 'আমি একটা অন্য কথা ভাবছি।'

    আমি এর জবাব দিলাম না। চুপ করে থাকলাম।

    মাঠের ধার ঘেঁষে গাছ বেছে বেছে ইতিউতি ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে লোকজন। আই আইটি জয়েন্ট এন্ট্রান্স এর মেইন্স এর পরীক্ষা দিচ্ছে পাশের স্কুলে হাজারখানেক ক্যান্ডিডেট। আমিও এসেছি ভাগ্নিকে নিয়ে। দিদি আসতে পারত না অত দূর থেকে। প্রকাশদা, মানে, জামাইবাবুরই আসার কথা ছিল। কিন্তু ওর কাল রাত থেকে জ্বর। অগত্যা আমার ঘাড়েই আজকে ভাগ্নির দায়িত্ব। ফার্স্ট হাফের পরীক্ষা হয়ে গেছে। মাঝে বিরতি ছিল। এখন সেকেন্ড হাফ চলছে। একটা গাছের ছায়া বেছে আমিও বসেই ছিলাম। কাছে পিঠে আরো দু চারজন বসে। অনতিদূরে একজন খবর কাগজ মুখে ঢেকে শায়িত। দুজন মৃদু গলায় নিজেদের মধ্যে জয়েন্ট এন্ট্রান্স সংক্রান্ত নানান আলোচনা অনেকক্ষন ধরে করে যাচ্ছে। মনে হয় পূর্বপরিচিত। আমি একা বসে বসে মোবাইল খুটখুট করছিলাম। এমন সময় লোকটা এসে আমার মুখোমুখি বসে দেশলাই চাইল। সিগারেট ধরাল।

    'আমি ভাবছি যে', লোকটা এবার বলে, 'যে সবার শেষে নিজের নামটা দেখবে তার কী হবে?'

    কথাটা শুনেই আশ্চর্য লাগল। এমন অদ্ভুত যে কারুর ভাবনার পদ্ধতি হতে পারে ধারণা ছিল না। এবার একবার ভাল করে তাকালাম ওর দিকে। চেহারাটা রোগা রোগা, কিন্তু শক্তপোক্ত। গালটা একটু ভাঙা, সারা মুখে অযত্নলালিত কাঁচাপাকা দাড়ি। সাধারণ ইস্ত্রিহীন শার্ট প্যান্ট। পায়ের হাওয়াই চটি জোড়া ঘাসে খুলে বসেছে। পাশে একটা ঝোলাব্যাগ নামানো। দেখে মনে হয় পাঁচের ঘরে বয়েস।

    -'আপনার কী মনে হয়? যে লিস্টে সবার শেষে সে এটা মেনে নিতে পারবে ?', লোকটা সিগারেটটা মাটিতে ঘষে নেভালো।

    -' যে কোনো কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় কেউ না কেউ তো লাস্ট হবেই। এতে তো মহাভারত উল্টে যায় না। তাকে লড়াই চালাতে হবে। খাটতে হবে। লাইফ তো আর ফুরিয়ে যাচ্ছে না।', আমি বিরক্তির স্বরে বললাম।

    -' সেটা ঠিকই। কিন্তু, ব্যাপারটা একটা তীব্র মানসিক চাপ তৈরি করবে না কি? যদি এত প্রেসার সে সামলাতে না পারে?'

    -' আপনার কেউ কি পরীক্ষা দিচ্ছে এখানে?', আমি কথা ঘোরানোর জন্য বললাম।

    -' না। আমি এমনিই রোববার এই সময়ে এখানে আসি। অন্যদিনও আসি কখনো কখনো। মন্টুর সঙ্গে। রোববার মাঝেমধ্যে পরীক্ষা হয় এখানে দেখি।'

    -'মন্টু কে?'

    লোকটা আমার প্রশ্নটা ইগনোর করলো। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকল। আমি এই সুযোগে মোবাইল বের করে খুটখুট করতে থাকি।

    'এটা দেখেছেন?', ওর আওয়াজে আমার সম্বিৎ ফিরলো। লোকটা তার হাতের মোবাইল সাগ্রহে আমার দিকে বাড়ায়।

    তাকিয়ে দেখি একটা ভিডিও। লক্ষ্য করলাম। এক ভারতীয় মহিলা অ্যাথলিট দৌড়োচ্ছে। কোনো একটা ইন্টারন্যাশনাল মিটে সোনা জিতেছে। পুরো দৌড়টার ছবি। পুরোনো ভিডিও। ভিডিওটা আমার দেখা।

    'হ্যাঁ। এটা আমার দেখা।', যথোচিত নির্লিপ্তির সঙ্গে কথাটা বলি।

    'আরেকবার দেখুন-ই না', লোকটা একপ্রকার আমার হাতে মোবাইলটা গুঁজে দেয়। আমি বাধ্যত দেখতে থাকি। কী-ই বা আর দেখার। জনা দশেক অ্যাথলিট তীব্র গতিতে আপ্রাণ দৌড়চ্ছে। শেষের দিকে দুজনকে অতিক্রম করে বিজয়ী এগিয়ে যায়। দশ সেকেন্ডের মধ্যে দৌড় শেষ। তারপর বিজয়ী অ্যাথলিটকে দুজন জড়িয়ে ধরে। তাকে ক্যামেরা জুম করে। ইন্ডিয়া নামটাও দেখা যায়। ভিডিওটা হার্ডলি পনেরো সেকেন্ডের।

    -'দেখলেন?'

    -'হুঁ।'

    -'কী দেখলেন?'

    -' কী আর আছে এমন দেখার ? তবে দৌড়েছে ভালো। ক’টা ইন্টারন্যাশনাল মিটে আর ইন্ডিয়া সোনা আনে? '

    -' যে লাস্ট হলো তাকে দেখতে পেলেন?'

    ' না। খেয়াল করিনি।'

    -'আমি জানতাম আপনি খেয়াল করবেন না। আমরা কেউই করি না। বিজয়ীর দিকেই ক্যামেরার চোখ থাকে।'

    -' সেটা স্বাভাবিক নিয়ম। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বের দেশের একটা দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা একজন উন্নত দেশগুলোকে হারিয়ে দিলো। এটা তো সেলিব্রেট করতেই হয়।'

    'তা ঠিক। যে জিতছে তার কৃতিত্ব খাটো করা চলে না। কিন্তু আমি ভাবছি যে, যে ওই দশজনের মধ্যে লাস্ট হয়ে নিজের দেশে ফিরবে তাকে সবাই দুয়ো দেবে। যদি কেউ না-ও দেয় তাকে মনে মনে একটা হীনমন্যতা নিয়ে দিন কাটাতে হবে। সে ভাববে আমি লাস্ট, আমি সবচেয়ে পরাজিত। এমনকী তাকে কেউ সিমপ্যাথি জানালেও সেটা হয়ত কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে হতে পারে।'

    রাগ হচ্ছিল। লোকটা মনে হয় ফ্রাস্ট্রেটেড। প্রবল রকমের নেতিবাচক মানসিকতার। একটা জেনুইন সেলিব্রেশন এর মধ্যেও চূড়ান্ত নেগেটিভ কিছু খুঁজে পায়।

    'আপনি যেভাবে ভাবছেন, সেটা ভাবনার সঠিক পদ্ধতি নয়। দেখুন, হার জিত থাকেই। অপ্টিমিজিম নিয়ে সব কিছু দেখুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।' হাল্কা বিদ্রূপের সুরে কথাগুলো বললাম।

    ' ঠিক হয়ে যাবে ? বলছেন ? হবে হয়তো।'

    এ-কথা বিড়বিড় করে লোকটা গুম মেরে বসে থাকলো। আমি আবার নিজের মোবাইলে মনোনিবেশ করি। কিছুক্ষণ পরেই খুচ করে একটা আওয়াজ পেলাম। সিগারেট ধরিয়েছে আবার। লক্ষ্য করলাম, ওর হাতেই লাইটার। তার মানে ওর কাছে লাইটার ছিলো। আমার কাছে দেশলাই চাওয়াটা নেহাতই অজুহাত। টাইম পাস করার জন্য আর কাউকে না পেয়ে আমাকেই আপাতত বেছেছেন উনি ! যাকগে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। তার আগেই এই জায়গা ছেড়ে উঠে গেলেও হয়।

    -'সিগারেট হবে নাকি একটা ?', বলেই, আমি কিছু বলার আগেই একরকম আমার দিকে ব্যাকুল হয়েই একটা অযাচিত সিগারেট বাড়িয়ে দেয় লোকটা। ভদ্রলোকই বলতে হবে। যদিও আশাকে পোশাকে কিছুটা আনইম্প্রেসিভ। অনেকক্ষণ সিগারেট খাইনি। একটু ইচ্ছেও হচ্ছিলো। অনিচ্ছা-ইচ্ছার দোলাচল কাটিয়ে নিয়েই নিলাম সিগারেটটা। লোকটা আন্তরিক ভাবে লাইটার দিয়ে আমার মুখের কাছে আগুন জ্বালালো।

    'আপনাকে একটা পার্সোনাল ঘটনা বলি', একদলা ধোঁয়া ছেড়ে লোকটা বেশ জমিয়ে বসলো এবার।

    'আশির দশকের প্রথম দিক সেটা। তখন রিষড়াতে থাকতাম। ছোটবেলা থেকে ফুটবল খেলতাম। স্থানীয় ক্লাবে, স্কুল টিম দিয়ে শুরু। আন্ডার এইটটিনে ডিস্ট্রিক্ট খেলে চোখে পড়ে গেলাম একজনের।'

    -'কোন পজিশনে খেলতেন?'

    'স্ট্রাইকার। ব'লে ব'লে গোল করতাম। আমাকে অপরচুনিস্ট প্লেয়ার বলতো সবাই। আমি গোলের গন্ধ পেতাম। মাঝমাঠ থেকে পেনাল্টি বক্স এই অঞ্চলে বল ঘোরাঘুরি করলে আমি ঠিকঠাক পজিশন নিতাম', লোকটার সিগারেট হাতেই জ্বলে যাচ্ছিল।

    'সে-বছর কলকাতার সোনালী শিবিরে চান্স পেলাম। এ-ডিভিশন লীগে খেলছি। গোটা কতেক গোল দিয়ে ফেলেছি লীগে, বুঝলেন?'

    -' বড় টিমের এগেইনস্ট এ খেলেছেন? মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল?'

    -' না। তার আগেই ঘটল ঘটনাটা। এরিয়ান্সের সঙ্গে ম্যাচে একটা গোল করে দিয়েছিলাম। অনেকেই পিঠ চাপড়াত। বেশ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি।' ওর হাতের সিগারেট জ্বলে জ্বলে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো। সেটাকে মাটিতে ঘষে নেভালো। তারপর আবার শুরু করল:

    ' আমার এক ছোটবেলার বন্ধু গোলে খেলত। প্রমিসিং প্লেয়ার। ও সেবারে এ-ডিভিশনে একটা দলের হয়ে খেলছে। দলটা বেশ নামজাদা।'

    -'কোন দল?'

    'বলছি। ঘটনাটা শুনুন। আমার ওই বন্ধুর নাম তোতা। মানে আমরা ওই নামেই ডাকতাম। ও একটু তোতলা ছিলো। নার্ভাস হলে বেশি তোতলা হয়ে যেত। কানগুলো লাল হয়ে যেত তখন। আমরা রিষড়ায় খুব ছোটবেলা থেকে এক ক্লাবে খেলতাম', একটু থামল এবার, তারপর, দম নিয়ে আবার শুরু করে:

    'তো, পরে তোতাদের ওই ক্লাবের সঙ্গে আমাদের ম্যাচ। হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছিল। ওই টিমের সোনালী শিবিরের এগেইনস্ট এ জেতা খুব জরুরী। কেননা স্বাভাবিক ভাবে ওরা শক্তিশালী, ওপরের দিকের টিম। অন্য দিকে সোনালী শিবির চায় কোনোমতে ম্যাচ ড্র করে এক পয়েন্ট পেতে।'

    'ফার্স্ট হাফে গোল হলো না। তোতাদের টিম গোল করার মত পরিস্থিতি তৈরি করেও হলো না। এরপর সেকেন্ড হাফেও সোনালী শিবির বেশ কয়েকবার গোল খেতে খেতে বেঁচে গেল। এরপর, বুঝলেন, ম্যাচ শেষের মিনিট দুয়েক আগে, একটা বল মাঝ মাঠ থেকে উড়ে এলো। আমি ধরে একটু এগিয়ে বুঝলাম সামনে মাত্র একজন ডিফেন্ডার। তাকে কাটিয়ে এগুতেই দেখি গোল পোস্টের নীচে তোতা দু হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেমন ওঁৎ পেতে গোলকিপাররা দাঁড়ায়। আমি একটু এগুলাম। বাঁ পায়ে শট নিলাম। মাটি কামড়ানো দুর্বল শট। তোতার হাতের তলা দিয়ে অনায়াসে গলে গেল। দেখে মনে হবে যেন ইচ্ছে করেই ফসকালো। আমি কনফিউজড হয়ে তাকিয়ে আছি। গোটা সোনালী শিবির টিম এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। দেখলাম তোতা গোলের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে মুখে অবিশ্বাস। বলটা জালের মধ্যে।' বলে লোকটা থামলো একটু। অন্যদিকে তাকালো। তারপর বললো:

    'সোনালী শিবির আমার গোলে জিতে গেল। পয়েন্ট কেড়ে নিল বড় ক্লাবের থেকে। শুনেছি, ম্যাচের পরে তোতা টেন্টে বসে কাঁদছিল। আমি অস্বস্তিতে দেখা করতে যাই নি। পরে শুনলাম প্রচুর বিদ্রূপ আর টিটকারি শুনেছে। সবচেয়ে মারাত্মক ব্যাপার, কেউ জানিয়েছে, আমার আর ওর মধ্যে একটা গোপন বোঝাপড়া আছে। আসলে, সেই সময়ে ময়দানে গট আপ কথাটা খুব চলতো। ওদের টিম সেবারে লিগে ওই ম্যাচ হেরে কিছুটা নেমে যায়', আবার ও থামলো। একটু পরেই আবার বলতে শুরু করলো:

    ' পরের ম্যাচগুলোয় তোতা টিম থেকে বাদ পড়ে যায়। একটা স্টিগমাও লেগে গিয়েছিল। আমি একদিন দেখা করতে গিয়েছিলাম ওর বাড়িতে। মুখটা লাল হয়ে ছিল। কোনো কথা বলতে চায় নি। এড়িয়ে গিয়েছিল। তার এক সপ্তাহের মাথায় রেল লাইন ক্রস করতে গিয়ে তোতা কাটা পড়ে যায়। কেউ কেউ বলেছিল অ্যাক্সিডেন্ট, কেউ বলল সুইসাইড।'

    -' আপনার ওই বন্ধু কি ডিপ্রেশনে ছিলেন তখন?'

    -' না সেটা আমার মনে হয় নি। আপসেট ছিল হয়তো। আসলে ও আমাকে এড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি... আমি ওকে আজীবন এড়াতে পারলাম না', বলে আবার থামলো লোকটা, তারপর বললো,

    ' এর পরের ম্যাচে পেনাল্টি বক্সে বল নিয়ে ঢুকে দেখি গোলপোস্টে তোতা দাঁড়িয়ে আছে। অন্য কোনো দলের প্লেয়ার। কিন্তু, যেন তোতার ছদ্মবেশে। যেন অনুনয় করছে, গোল দিস না। গোল দিস না।'

    'পরপর তিনটে ম্যাচে এটা ঘটলো। গোলের কাছে এসে আমি নার্ভাস হয়ে যেতাম। দেখতে পেতাম অসহায় তোতা দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে যেন কাকুতি মিনতি করছে। একের পর এক গোল মিস করতে লাগলাম'

    ' এর পরে সোনালী শিবির আমাকে বসিয়ে দিলো। বড় দলের সঙ্গে ম্যাচ খেলা বলছিলেন। ওটা আর হলো না। আমারও ফুটবল জীবনের ইতি।'

    'তাছাড়া আমি ফুটবল খেলা দেখা-ও ছেড়ে দিলাম। প্রতি ম্যাচে যখনই কোনো গোল হয় আমি ওই অসহায় গোলকিপারকে দেখতে পেতাম। এখনো কোনো ম্যাচ টিভিতে দেখলে গোল হওয়া মাত্রই আমি দেখতে পাই অবিশ্বাস আর গ্লানি নিয়ে হতবাক গোলকিপার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তোতার লাল হয়ে যাওয়া অপমানিত মুখ ভাসতে থাকে। আমি টিভি অফ করে দিতে বাধ্য হই।'

    -'আপনি খেলা ছেড়ে দিয়ে তারপর কী করলেন? আপনার এখনকার প্রফেশন কী?'

    -'বলছি। সে এক অন্য গল্প। খেলা টেলা ছেড়ে বছর চারেক বেকার ছিলাম। তারপর অনেক লড়ে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের একটা সংস্থায় একটা ক্ল্যারিক্যাল জব পেলাম। মন্দ নয় মাইনে। তখন ধরুন এই সাতাশ বছর বয়েস। যখন আমার বত্রিশ, বাড়ির লোকেরা বলল বিয়ে করতে। আসলে মধ্যবিত্ত পরিবার। বোনের সম্বন্ধ বারবার রিফিউজড হচ্ছিল। অবশেষে বোনের বিয়ে হলো। তখন আমার বিয়ের কথা উঠলো। আমার ওপরে বিবাহিত দাদা ছিলো। দাদা বড় চাকুরে ছিল, ব্যাঙ্কের।'

    -'বিয়ে করলেন কী নিজেই পছন্দ করে?'

    -' একরকম তাই। তবে তার গল্পটাও বড় অদ্ভুত।' লোকটা মৃদু হাসল এবার। 'বলছি, দাঁড়ান', বলে আবার শুরু করে:

    -' আপনি ভাবছেন প্রেম। কিন্তু, না, আমাদের সময়ে ওই মফস্বলে খুব একটা প্রেমের চল ছিলো না। আমি তো ছোটবেলা থেকে একটা সময় অবধি মাঠেই পড়ে থাকতাম। তা ছাড়া পড়েছি বয়েজ স্কুলে। এমনকী কলেজে গ্র্যাজুয়েশন করার সময়েও চুটিয়ে খেলতাম। তাই যাকে বলে নারীসান্নিধ্য, তা হয়নি। বাড়ির চাপাচাপিতে বাড়ির ক’জন আর আমি মিলে মেয়ে দেখতে গেলাম। ব্যাপারটা নিয়ে এমনিতেই অস্বস্তি ছিলো আমার। বিশেষত বোনের ব্যাপারটা দেখে। সেজেগুজে টেনশন নিয়ে বসে থাকতে হয়। অচেনা লোকের হাজার প্রশ্ন। মেয়েদের খুব হ্যাটা হতে হয়। বোনের খুব মন খারাপ হতো। মুখে কিছু বলতো না। কিন্তু মুখ ভার করে থাকতো।'

    -হ্যাঁ। এই সিস্টেমটা খুব অমানবিক। তাছাড়া ডাউরি ইত্যাদি। আজকের দুনিয়ায় এই মধ্যযুগীয় প্রথা জাস্ট মানা যায় না।'

    -'কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না, জানেন। মানে আমাদের যুগে ইন্টারনেট ইত্যাদিও ছিল না। আর আমার প্রেম করার এলেমও ছিল না। অপরিচিত মেয়ে দেখলে আমি সঙ্কুচিত হয়ে পড়তাম।'

    -'না না। আপনাকে মিন করিনি। আমি একটা জেনেরাল কমেন্ট করলাম। আপনি বাকিটা বলুন।'

    আর মিনিট কুড়ি বাকি আছে পরীক্ষা শেষ হতে। মোবাইলের সময় তাই বলছে। লোকটা বলতে শুরু করে আবার:

    'প্রথম যে মেয়েটিকে দেখতে গেলাম সেখানে গিয়ে খুব অস্বস্তি হতে লাগলো আমার। আপ্যায়ন ইত্যাদির পরে মেয়েটি সঙ্কুচিত হয়ে বসলো। আমাদের বাড়ির লোকেরা কেউ যে খুব বিব্রতকর প্রশ্ন করছিল এমনটা নয়। মেয়েটি আপাতভাবে অসুন্দর। এইচ এসে ব্যাক পেয়েছে পাঁচ বছর আগে। তার বসে থাকার ভঙ্গিতে একটা লক্ষ্যণীয় গ্লানি ছিল। সেটা আমার অস্বস্তি বাড়িয়ে দিল। বাড়ির লোকজন টুকটাক কথা বলার পরেই উঠতে চাইল। আমি ওখানেই বুঝে গেছি যে আমাদের বাড়ির কারুর ওকে পছন্দ হয় নি। মনে হয় মেয়েটিও বুঝেছিল। কিন্তু ওর গ্লানি যেন আমার গ্লানির কারণ হয়ে যাচ্ছিল। আমি আলাদা করে কোনো কথা বলিনি। একবারই ওর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম, বুঝলেন। সেই চোখ দুটো যেন আমাকে তিরস্কার করছিল।'

    আমি শুনছিলাম। লোকটির কথা আমাকে এখন স্পর্শ করছিল। হয়তো সে ব্যক্তিগত কথা বলছিল, তাই।

    'বাড়ি ফিরে সেই রাতে ঘুমানোর সময় মেয়েটির চোখ দুটো মনে পড়তে লাগল। কী ছিল তাতে? করুণা না গ্লানি নাকি তিরস্কার? সে রাতে বারবার রঙ ময়লা অসুন্দর মেয়েটিকে মনে হলো আমার বহুদিনের পরিচিত।'

    'কিন্তু বাড়ির লোক পত্রপাঠ নাকচ করেছিল ওকে। অথচ, আমি ওকে ভুলতে পারছিলাম না আদৌ। মেয়েটি যেন তার চোখ দুটি দিয়ে আমাকে ডাকছিল বারবার। বাড়ির অনুরোধে আরেক পাত্রীকে অনিচ্ছাসত্ত্বেও দেখতে যেতে হলো। এই পরের মেয়েটি চমৎকার সপ্রতিভ। গ্র্যাজুয়েশন করা। গায়ের রঙ উজ্জ্বল। সুশ্রী। বসে থাকার ভঙ্গিতে কোনো জড়তা নেই। এককথায় বাড়ির লোকের তাকে পছন্দ হয়ে গেল।'

    -' আপনার মধ্যে কি তাহলে একটা দ্বন্দ্ব কাজ করছিল তখন? কাকে নির্বাচন করবেন, এই নিয়ে?' আমি ওকে থামালাম একটু।

    -' দ্বন্দ্ব ঠিক নয়। আমাকে প্রতিনিয়ত প্রথম মেয়েটিই আহ্বান করত। যখন একা থাকতাম তখন বেশি। দ্বিতীয় মেয়েটির কথা বাড়ির লোকেরা বেশি ভাবছিল। কিন্তু, আমার ভাবনায় পরের মেয়েটি বিন্দুমাত্র আসতো না। একদিন বাড়িতে বলেই ফেললাম যে প্ৰথম মেয়েটিই আমার পছন্দ হয়েছে। সবাই অবাক হলো। মানে, কী দেখে বিয়ে করছি, এ ব্যাপারে সবাই সন্দেহ প্রকাশ করতে লাগল। কিন্তু, আমি নিজের অবস্থানে এতটাই দৃঢ় ছিলাম যে বাড়ির লোকেরাও শেষে মেনে নিল।'

    -'তারপর? কীভাবে এগুলেন?'

    -' আমি সরাসরি মেয়েটির বাড়িতে গিয়ে প্রস্তাব দিলাম। ওদের বাড়িও এককথায় রাজি হয়ে গেল। কিন্তু মেয়েটি আমার সঙ্গে একবার আলাদা করে কথা বলতে চাইলো।'

    - 'বেশ ইন্টারেস্টিং। বলুন তারপর।'

    -' মেয়েটি একটি ঘরে নিয়ে আমার সঙ্গে বসলো। দরজাটা ভেজিয়ে দিলো। তারপর জিজ্ঞেস করলো যে, আমি কী যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করে ওকে বিয়ে করার কথা ভাবছি নাকি এটা আমার কোনো সাময়িক খেয়াল।'

    -' আপনি ঠিক কী বলেছিলেন তখন? মেয়েটিকে তো ভালো করে চিনতেনও না।'

    -' আমি বললাম, আমার ওকে পছন্দ হয়েছে কেননা আমার ওই ধরনের মেয়েই ভালো লাগে। তাছাড়া কাউকে ভালো লাগার কোনো সঙ্গত ব্যাখ্যা হয় না। কিন্তু, এটা বলেছিলাম যে ওর চোখ দুটি খুব সুন্দর। এ কথা বলার সময় মেয়েটি হঠাৎ কান্নার উপক্রম করে। তাতে ওকে আরো সুন্দর লাগছিল আমার। মানে ওই একটা অচেনা ঘরে একটি অচেনা মেয়ে আমার একটা সামান্য কথায় যে অমন সজল হয়ে উঠবে ভাবতে পারিনি। মুহূর্তটা খুব সুন্দর ছিল।'

    -'তারপর?'

    -' মেয়েটি বললো, ওর একটা কথা আমাকে বলার আছে। যদিও পরিবারের সবাই গোপন রাখতে বলেছে, তবুও সে কথাটা আমাকে বলতে চায়। বলে সরাসরি বললো, 'শুনুন, আপনাকে আমার একটা কথা বলার আছে। সেটা হলো, আমার শারীরিক একটা সমস্যা আছে।''

    ' আমি একথা শোনার পর ওকে বলি নির্দ্বিধায় যে কোনো কথা আমাকে বলতে। এটাও প্রমিস করি যে ওর এই কথা আমি ব্যক্তিগত রাখবো।'

    -'হুঁ। তারপর?'

    -'ও বললো ওর একটা মারাত্মক স্কিন ডিজিজ আছে। একজিমা। উরুতে।'

    -'আচ্ছা।'

    -' আমি বললাম, সেটা কোনো বাধা-ই না। সেজন্য ট্রিটমেন্ট করানো যায়। এবং আমি দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসা করাবো। কিন্তু ও বললো, এই রোগ ট্রিটমেন্টে সারে না। ডাক্তার ইত্যাদি দেখানো হয়েছে। তবু সারে নি। কিন্তু, ও এটা বলার পরে আমার ওর প্রতি আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল। ব্যাপারটা হলো, ও আমার কাছে কিছুই গোপন করছে না। এটা আমার ভরসা আরো বাড়িয়ে দিলো।'

    'তারপর ও বললো, আমি যদি চাই ও খুলে দেখাতে পারে ওর ওই জায়গাটা। এ কথায় আমি শিউরে উঠেছিলাম। একটু গ্লানি আসছিল। যেন ব্যাপারটা এমন, যে, ভাল করে সব কিছু দেখে শুনে নিতে বলছে, কী কী খুঁত আছে পণ্যের। তবু ওর বোল্ড অ্যাপ্রোচ আমাকে মুগ্ধ করলো।'

    -'তারপর?'

    -' ও বললো আরো একটা কথা আছে।'

    -'ও। সেটা কী?'

    -' ও বললো, ও একবার ধর্ষিত হয়েছিল। চোদ্দ বছর বয়সে। যদি জানতে চাই, তার ডিটেইলস ও পুরোটা দিতে পারে।'

    -' এ কথা শুনে আপনার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?'

    -' মায়া হয়েছিল। ওর কষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছিল। সেই মুহূর্তে আমি তীব্র চুম্বনেচ্ছা দমন করি। কিন্তু, মনে আছে, আমি ওর হাত হাতে টেনে নিয়েছিলাম। ও হাত সরিয়ে নেয় নি। দুজনেই চুপ করে ছিলাম। সময় বয়ে যাচ্ছিল। ওই নীরবতার মধ্যে আমি প্রথম বুঝতে পারি প্রেম আসলে এইরকম কোনো পবিত্র অনুভূতি।'

    আমি শুনছিলাম। ভদ্রলোক সত্যিই অন্যরকম মানসিকতার। এমন রূঢ় বাস্তবতা কতজনই বা মানতে পারবে কে জানে।

    'তারপর বিয়েটা হয়ে গেল। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই আমি এখানে চলে আসি। এখানে একটা প্লট কেনা ছিল। পরে হাউসিং হয়। নতুন সংসার। ঠিকঠাক ছিল সবকিছু। কিন্তু বিয়ের পরে একটা সমস্যা হতে লাগলো।'

    -'কী সমস্যা?'

    -'বলছি। আসলে বুলবুলির নিজের শরীর নিয়ে অত্যধিক জড়তা ছিল যেটা আমি প্রথমে ধরতে পারিনি। ওর খুব ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেই ও খুব সিঁটিয়ে যেত। তারপরে উরুর ওই দগদগে ঘা, যেটা ও অনেক সময়েই একটা কাপড়ের ব্যান্ডেজে বেঁধে রাখত। আমাকে কোনোদিন দেখায় নি। অথচ, দেখাতে চেয়েছিল। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। সারে নি। দ্বিতীয়বার অন্য ডাক্তারের কাছে যেতে আর রাজি হয় নি। ওর একটা সঙ্কোচ আমার কাছে রয়েই গেল।'

    খুব নিচু গলায় কথাগুলি বলে লোকটা। আমি শুনে যাচ্ছিলাম।

    'একদিন, বুঝলেন, একদিন, কী যে হলো...আমি আমার লিবিডো কন্ট্রোল করতে পারলাম না। মানে, কিছুটা জোর করেই....আসলে যৌনতা ব্যাপারটার মধ্যে একটা পাশবিকতা আছে তো।', লোকটা মাথা নীচু করে বললো।

    'ও কাঁদছিল। চেঁচাচ্ছিল। ওর শারীরিক ও মানসিক কষ্ট হচ্ছিল। পশু, জানোয়ার বলে আমাকে গালাগাল দিচ্ছিল।'

    বলতে বলতে আড়ষ্ট হয়ে থেমে গেল লোকটা। তারপর আবার শুরু করলো:

    'কিন্তু, তারপরে আর কোনোদিন আমাদের শরীর পরস্পরের সংস্পর্শে আসে নি। আমাদের, যেটাকে বলে কনজুগাল লাইফ, সেটা ছিলো না।'

    -'একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারতেন তো।'

    -'হ্যাঁ। পারতাম। কিন্তু, আমার মনে হতো ও কষ্ট পাবে। ওর সেই কান্না মনে পড়ত আমার। হয়ত ওর ধর্ষণের স্মৃতি ফিরে আসতো ওই সময়ে। আমি ওর ওই দুঃসহ স্মৃতি আর জাগাতে চাই নি।‘
    -‘আচ্ছা।‘

    -'বছর কয়েক পরে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি শিশুকে অ্যাডপ্ট করলাম। ওকে ঘিরেই দুজনের জীবন কাটতে লাগল। কিন্তু পাঁচ বছর পরে হঠাৎ ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ায় আমাদের ছেলেটা মারা গেল।'

    -'ইসস !'

    -' এর পরে আমরা নিঃসঙ্গ হতে লাগলাম। জীবন থেকে আনন্দ উবে গেল। বুলবুলি সিরিয়াস ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে উঠল। ডাক্তার বললো, সিজোফ্রফেনিয়া। ওর ক্যান্সার ধরা পড়লো একদিন। তার বছরখানেকের মধ্যে ও মারা গেল। খুব বেশি ট্রিটমেন্টের সুযোগ ছিল না।'

    -'কত বছর আগে ?'

    -' বছর তিনেক।'

    আমার মনে হচ্ছিল লোকটার অপরিসীম নিসঙ্গতাই ওকে আমার কাছে টেনে এনেছে। কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল ও। তারপরে বললো:

    'একদিক দিয়ে, সমস্যা না থাকার চেয়ে সমস্যা থাকাই ভালো। আগে আমার, মানে আমাদের অনেক সমস্যা ছিল। সমস্যাগুলো মেরামত করতেই জীবন কেটে যেত। কিছুই থাকল না আর। অফিসেও মন বসছিল না। বুলবুলি চলে যাওয়ার পরে এক বছরের মাথায় ভি আর এস নিয়ে নিলাম। অখন্ড অবসর। সময় কাটতেই চায় না। একদিন, বুঝলেন, এই স্কুলটার ছোটদের স্পোর্টস হচ্ছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি। একটা দৌড় হচ্ছিল। দৌড়ে জেতার পর ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ফার্স্ট সেকেন্ড থার্ড উঠলো। একটা বাচ্চা, বুঝলেন, যে কিছু হতে পারেনি। সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। আমার মায়া হলো। আমি একটা চকোলেট এনে ওকে দিলাম, যখন গেটের বাইরে বেরুচ্ছে। ছেলেটা ঘৃণার সঙ্গে চকোলেটটা মাটিতে ফেলে দিলো।'

    -'তাই?'

    - হ্যাঁ। আমি বুঝলাম প্রতিযোগিতায় পরাজয় শুধু গ্লানি ও অপমান দেয় না। মানুষকে শৈশব থেকে হিংস্র ও অস্থির করে তোলে। এই হিংসার চাষ সারা পৃথিবী জুড়ে হচ্ছে।'

    -'হ্যাঁ, কিন্তু, কী করবেন। প্রতিযোগিতা এড়িয়ে চলারই বা কী আর উপায় আছে?'

    -' ঠিকই। আমিও প্রথমে এই কথাই ভাবছিলাম। যারা প্রতিযোগিতায় ঢুকে গেছে, তাদের কি আমি কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারবো? এই এত বড় সিস্টেম স্থানে কালে, যুগ যুগ ধরে প্রতিযোগিতা দিয়েই গড়ে উঠেছে।' লোকটার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিলো। সে টানা বলতে লাগলো:

    'কিন্তু, ভেবে দেখুন, একটা বড় অংশ এই প্রতিযোগিতার বাইরে রয়ে গেছে। এই এলাকাই দেখুন। দুটো বড় বড় বস্তি। স্কুলে কতজন যাচ্ছে? গেলেও কোনো উৎসাহ পায়? এরা অনেকেই স্কুল ছেড়ে দেয়। কেউ আগে। কেউ পরে। আমি দেখলাম, একটা সুযোগ এখনো আছে।'

    -' কী সুযোগ?'

    -' আমি একটা স্কুল তৈরি করেছি। নাম, পাখিদের পাঠশালা। যে কোনো পিছিয়ে পড়া কোনো শিশু, পাঁচ থেকে পনেরো, এই স্কুলে এসে বাঁচার শিক্ষা পেতে পারে। এবং এই স্কুল প্রতিযোগিতাহীন।' এই কথা বলেই লোকটা তার ঝোলা থেকে একটা কাগজের তাড়া বের করল, একটি কাগজ আমার হাতে গুঁজে দিলো , বললো

    'একটু দেখুন একবার।'

    কাগজটা হাতে নিয়ে পড়তে থাকি:

    পাখিদের পাঠশালা

    দোয়েল, চড়ুই, ময়না সহ নানাবিধ পাখিদের মুক্ত আকাশে ওড়ার প্রণালী শেখানোর এই পাখিদের পাঠশালা। শুধু আকাশ স্পর্শ ছাড়া কোনো উদ্দেশ্য নেই যার। আমরা চাই প্রতিযোগিতাহীন মুক্ত জীবন, যে জীবন ফড়িং ও দোয়েলের। এখানে আমরা সবাই রাজার রাজা, রাণীর রাণী। রঙ বেরঙি ফুলগুলি ইচ্ছেডানা পাক। যার যেমন সামর্থ্য সহায়তা করুন। চাঁদা নয়, প্রত্যক্ষভাবে আমাদের স্বপ্নের অংশীদার হন। আসুন, একটা সবুজ, স্বপ্নের জয় পরাজয়হীন পৃথিবীর বাসিন্দা গড়ে তুলি।

    নীচে ঠিকানা ও দীননাথ সাহা ও মোবাইল নম্বর লেখা।

    আমি পড়ে ওর দিকে একবার তাকাই। ও আমার মুখ তোলার অপেক্ষায় ছিলো। এবার বলতে শুরু করে:

    ' তিনজন ছাত্র দিয়ে একবছর আগে স্কুল শুরু করি। এখন সংখ্যাটা পঁচিশ ছাড়িয়েছে। কয়েকজন টিচার হিসেবে ভলান্টিয়ার করছে। অংক, সাহিত্য, বিজ্ঞান ইত্যাদির মডিউল পড়ানোর জন্য কিছু কলেজের উদ্যোগী ছাত্র পেয়েছি। আমি নিজেও অংক দেখাই। এছাড়া গান শেখান এক সহৃদয় শিক্ষিকা। যোগব্যায়ামে একজন প্রশিক্ষক পেয়েছি। পড়াশুনোর পাশাপাশি কিছু টিফিনের আয়োজন, সামান্য হলেও, করি। সপ্তাহে একদিন ফুল মিল। এলাকার রাস্তা মাঠ আমরা মাসে দুদিন একসঙ্গে লেগে থেকে পরিষ্কার করি। কিছু কিছু গাছ একসঙ্গে মিলে লাগাই। খেলাধুলোও হয় পাশাপাশি। সব মিলিয়ে ছেলে মেয়েরা খুব হ্যাপি। যারা পিছিয়ে পড়ছে, তাদেরকে যারা এগিয়ে যাচ্ছে, তারা সাহায্য যাতে করে, সেই শিক্ষাও দেওয়া হয়। গল্প পড়ে শোনানো হয়। ছবি আঁকতে উৎসাহ দেওয়া। কিন্তু প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিয়ে নয়।'

    -'এ তো অসাধারণ উদ্যোগ।'

    -' আপনিও আসুন। যোগ দিন। যে বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা তা এসে শেয়ার করুন ছেলে মেয়েদের সঙ্গে। আমরা সবাইকে ডাকছি।'

    মাঠের অন্য প্রান্ত থেকে লোকজন আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হল আমাদের পেছন দিকে। পরীক্ষা শেষ প্রায়। আমি উঠলাম।

    লোকটাও উঠলো, বললো, 'আসি তাহলে। প্রয়োজনে যোগাযোগ করবেন। প্রত্যাশা রইলো।'

    আমিও উঠলাম। হঠাৎ দেখলাম লোকটা, 'মন্টু' বলে ডেকেই একটা শিস দিলো। কোত্থেকে একটা কালো কুকুর ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এগিয়ে এলো। ঘাড়ে একটা ব্যান্ডেজ, পেটটা অস্বাভাবিক ফোলা, কুকুরটার পেছনের একটা পা নেই।

    তারপর মাঠের যেদিক থেকে লোকজন এগিয়ে আসছিল, তার উল্টো দিকে মাঠের প্রান্ত ধরে ধীরে ধীরে হাঁটা লাগাল ও। একটু দূরত্বে খোঁড়াতে খোঁড়াতে কুকুরটা ওকে অনুসরণ করতে লাগল।

    ফেরার আগে ওদিকেই তাকিয়ে ছিলাম।

    মনে হচ্ছিল কোনো এক মহাপ্রস্থানের দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে একটা মানুষ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ | ৩৬৩০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • aranya | 236712.158.3467.81 (*) | ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১২:২৯47684
  • এমন একটা পাঠশালার কথা শুনেছিলাম, এক্জন নিজের ছেলেকে স্কুলে না পাঠিয়ে বাড়িতে পড়াতেন, তার সাথে পাড়ার আরও কিছু বাচ্চাকে। সেটা আরও সপ্ম্প্রসারিত হয়, আরও কিছু শিক্ষক যোগ দেন , অনেকটা এই লেখাটারই মত
    তবে এই বাচ্চাগুলোকেও শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে বসতেই হয়,দশম শ্রেণীর পর থেকে। সিস্টেম-কে এড়িয়ে যাওয়া মুশকিল
  • | 172.68.146.235 | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৪:০০90907
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন