এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটা অ-সমাপ্ত গল্প (পর্ব - ১৮ - ২১)

    Kaushik Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৬৯২ বার পঠিত
  • ১৮।

    সকাল হলে তোমার কাছে যাবো ভাবি
    দুপুর হলে তোমার কাছে যাবো ভাবি
    বিকেল হলে তোমার কাছে যাবো ভাবি
    রাত্রি হলে পলিয়ে আসি ভয়ে

    সকাল হলে বকুল্গুলি গন্ধ ছড়ায়
    দুপুর বেলা রেলিং জুড়ে ডুরে শাড়ি
    বিকেল হলে খোঁপায় শুধু জুঁই টগর
    রাত্রিবেলা ফিরে আসি ভয়ে

    সকাল দুপুর বিকেল জুড়ে ইচ্ছাগুলি
    রাত্রিবেলায় কঠিন সুরে কথা বলে
    ভালোবাসায় স্মৃতিগুলি রৌদ্র মেখে
    রাত্রি হলে অন্ধকারে মুখ লুকোয়।

    বিকেলের রোদ পড়ে আসছে। চারদিকে সিঁদুরের ফিকে রঙ। ছাদে একা একা পায়চারি করছে রতন। ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটার ওধারের ফাঁকা জায়গাটায় মেয়েরা বুড়ি বাসন্তি খেলছে। সুবোধ কাকার মেয়ে শোভাই মেয়েদের দলটার পান্ডা। খেলাধুলোতে খুবই চৌখস। আজকে কিন্তু পেরে উঠছেনা শোভা; বারে বারে হার হচ্ছে ওর।

    সব দিন কি আর সকলের সমান যায়! ভাবল রতন।

    গরমের ছুটি শেষ হয়ে স্কুল গুলো সবে খুলেছে; পড়াশুনোর চাপ এই সময়টায় সকলেরই কম। অন্যদিন রতনও এই সময় ফুটবল খেলতে যায় চটির মাঠে। আজকে আর ইচ্ছে করছে না।
    আসলে মনটা একটু বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। খেলার মাঠে গতকাল কমল'দার সাথে দেখা হয়েছিল। রতনদের চাইতে খানিকটা বড় হলেও, আগে ওদের সাথেই খেলত কমলদা। অনেকদিন হল মাঠে যায়না আর। গতকাল কমল'দার সাথে দেখা হওয়াতে ওকে সে কথাই জিজ্ঞেস করেছিল রতন। ওর প্রশ্ন শুনে ম্লান হেসে কমল বলেছিল -কি লাভ বল পিটিয়ে? আমি কি আর আপ্পারাও হতে পারব?
    তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ সাইডলাইনের পাশে বসে মাঠের ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেছিল, "বেকার ছেলে। এই বুড়ো বয়সে বল পেটালে লোকে বলবে কি?"

    কমল'দার মনের অবস্থাটা খানিক বুঝেছিল রতন। সান্তনা দেওয়ার জন্য বলেছিল, " তুমি তো সেদিন কলকাতা গেছিলে ইন্টারভিউ দিতে। ভালো হয়নি?"
    -ভালো ইন্টারভিউতে চাকরি হয়না রে আজকাল! চেনা জানা লাগে।

    আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে চলে গেছিল কমলদা। আর তারপর থেকেই মনের মধ্যে কিছু নতুন চিন্তা দানা বাঁধছে রতনের।

    কমলদা লেখাপড়ায় নেহাত খারাপ ছিলনা। সে ছেলেও আজ প্রায় দু বছর মতন বাড়িতে বেকার বসে। রতনের যদিও ইচ্ছে অনেকদুর পড়ার, কিন্তু সংসারের যা অবস্থা তাতে সেই আশা কতদূর পূর্ণ হবে; বলা মুস্কিল। তাই চাকরি যদি একটা জোটাতেই হয়; তবে ওর জন্যও কি কমল'দার মতনই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে আছে? নিজের ওপর রতনের আস্থা আছে, কিন্তু সর্বদা কি নিজের চেষ্ঠাই শেষ কথা? পারিপার্শিক ও কি একটা মানুষের জীবনের গতিপথ নির্নয় করে দেয়না?

    সন্ধ্যে হয়ে আসছে। আজ একটু পরেই পড়তে বসবে। মন শান্ত না হলে পড়ায় মন বসেনা। কমল'দার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎই খেয়াল হল; আজ কমলদার ছোট বোন কিরণ কটা অঙ্ক দেখাতে আসবে ওর কাছে। কটা অঙ্ক দিয়েও গেছিল রতনকে - কষে দেওয়ার জন্য।

    মেয়েটার অঙ্কে একদম মাথা নেই। অন্য বিষয় গুলোতে কিন্তু বেশ ভালো! ক্লাসে নিয়মিত স্ট্যান্ড করে। একটু আগে খেলুড়েদের দলটার মধ্যে কিরণ ও ছিল। খুব হুটোপাটি করে খেলছিল, যা হোক! আচ্ছা, অঙ্ক গুলো যখন হয়নি তখন না খেলে সেগুলো নিয়েই কি বসলে ভালো করত না কিরণ? আর যে অঙ্ক গুলো ও করতে দিয়ে গেছে, সেগুলোও নেহাতই পাতি অঙ্ক! মেয়েটার বোধহয় অঙ্কে ভীতি আছে! নইলে ক্লাসে স্ট্যান্ড করা মেয়ের ওই সহজ অঙ্ক গুলো আটকানোর কথা নয়! একটু মাথা খাটালেই ...

    ধীর পায়ে নিচে নেমে এল রতন। পায়ে পায়ে রান্না ঘরে এসে ঢুকল ও। ওকে দেখতে পেয়ে মা বলল, " কি রে, খিদে পেয়েছে? দাঁড়া! গরম গরম রুটি বানাচ্ছি, খেয়ে নে। "
    একটা পিঁড়ি টেনে নিয়ে বসল রতন। উনুনের আঁচে মায়ের ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম ও দেখা দিয়েছে মায়ের সারা মুখে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে রতন দেখে আসছে মায়ের কয়েকটা ছবি - উনুনের ধারে , নয়ত ওদের জামায় বোতাম লাগাচ্ছে বা হয়ত অন্য কোনো ব্যস্ততার ছবি। ছবি গুলো ওর মাথায় খোদাই হয়ে গেছে। বড় বেশিই জীবন্ত যেন ছবি গুলো; চাইলেও তাই মাথার ভেতর থেকে ওগুলো মুছে অন্য ছবি বসাতে পারে না ও।

    কলতলা থেকে হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে ফিরে এল রতন। থালায় রুটি আর ঢ্যাঁড়সের তরকারি বেড়ে রেখেছে মা। চুপচাপ খেতে শুরু করল। ঢ্যাঁড়স খেতে ওর খুব ভালো লাগে।

    রুটি সেঁকা সেরে নিবিষ্ট মনে ছেলের খাওয়া দেখছে ছন্দা। সন্তানদের মধ্যে রতনই ছন্দার সব চাইতে প্রিয়। পড়াশুনোয় ভালো বলে নয়। ছেলেটার চোখের দিকে তাকালেই মনে হয়, ও বড় দুঃখি। এটুকু বয়সে কিসের দুঃখ তোর বাবা? মনে হয়েছে, কিন্তু কখনও জিজ্ঞেস করতে পারেনি ছেলেকে। আসলে ছেলেটাকে লজ্জা দিতে চায়নি ছন্দা। ছোটোবেলায় আচার চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়লে যে রকম লজ্জা পেত - তার চাইতে অনেক বেশি লজ্জা পাবে ছেলেটা এই প্রশ্নটার সম্মুখিন হলে।
    আর জিজ্ঞেস করতে পারেনা বলেই যেন জ্ঞানে-অজ্ঞানে ছেলেটাকে আরো-ও বেশি ভালোবেসে ফেলে ছন্দা প্রতিদিন। একটু একটু করে।

    একটা রুটি খাওয়া শেষ হয়ে গেছে রতনের। পরেরটার দিকে হাত বাড়াতে মা জিজ্ঞেস করল - আর একটু তরকারি দেব? মুখ তুলে তাকাল রতন। মায়ের মুখটা বড় সুন্দর দেখাচ্ছে। মেজ জেঠিমা রান্না ঘরে ঢুকলেন। জলের গেলাসটার দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে রতন বলল - না।

    খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ল রতন। ছন্দার হাতে এখন কোনো কাজ নেই। এই সময়টা তাই একটু বই পড়ে ছন্দা। বরাবরের অভ্যেস। বরাবর বলতে অবশ্য এ বাড়িতে আসার পরের থেকেই হয়েছে অভ্যেসটা। ষোলো বছর বয়সে এসেছে এ বাড়িতে। তার আগে বাপের বাড়িতে পড়ার বই ব্যতিরেক অন্য বই পড়ার ফুরসৎ কই? সারাদিন ওই গমগমে বাড়িতে বই নিয়ে কেউ একলা থাকতে দিলে তো! খুড়তুতো বোনেদের সঙ্গে জুটে সারাদিন হইহল্লা,নইলে পুকুর দাপিয়ে সাঁতার কাটা, নইলে মাঠে গিয়ে ধান বোনা দেখা।
    তাই আর বই নিয়ে আড়াল হতে হতনা নিঃসঙ্গতা থেকে। তা ছাড়া ওই বয়সে মানুষ চাইলেও নিঃসঙ্গ হতে পারে কি?

    পাবনা জেলার অকুলীন এক গ্রামের ভূস্বামী ছন্দাদের পরিবার। বাড়ির লোকজন ছাড়াও আশ্রিত-অতিথিতে বাড়ি সর্বদাই সরগরম। টুকরো টুকরো সাদা-কালো কিছু জলছবি। সকালবেলায় পন্ডিত মশাই এসেছেন। ভাইবোনেরা সকলে মিলে তালপাতার ওপর হাতের লেখা অভ্যেস করছে। সন্ধ্যে বেলায় ছোটো কাকা এসে ছন্দাকে বলছেন, ”আমারে একবাটি চুন হলুদ গরম কইর্যা্ দে তো। বেজায় রাফ্‌ খেলে ওসমানটা!” বাবা কাছারিতে বসে সরকার বাবুর সাথে তর্ক করছেন - আরে, দু দিনে জোড়া লাগব! শুধু শুধু বেচতে যামু কেন! ফজলুল সাহেব প্রধান মন্ত্রি; বাংলা ভাগ উনি বইসা বইসা দেখবেন নাকি!
    বছর বিশেক আগের ছবি গুলোর সব রঙ আজ মিলে মিশে একাকার হয়ে ধূসর রান্নাঘরটার দেওয়ালে সেঁটে গেছে।

    বই পড়তে ইচ্ছে করছে না আজকে। রোয়াকটায় গিয়ে একটু দাঁড়ালে হয়। রোয়াকটায় যেতে হলে বাইরের ঘরটার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বাড়ির সব ছেলে মেয়েদের পড়ার ঘর এটা। বটঠাকুর শান্তিপুরে গেছেন বোনের বাড়ি। সেই সুযোগে পোড়োর দল ফাঁকি মারছে দেদার। ঘরটায় আজকে শুধু রতন বসে অঙ্ক করাচ্ছে মজুমদারদের ছোটো মেয়ে কিরণ কে। কিরণরাও আদতে পাবনার লোক। ভারি সুন্দর মুখ মেয়েটার।

    রোয়াকে এসে মাথায় কাপড় তুলে দিল ছন্দা। সন্ধ্যে নেমেছে গাঢ় হয়ে। কাছের মন্দিরটার থেকে ভেসে আসছে ঘন্টা ধ্বনি। এ শহরে মন্দিরের যেন শেষ নেই। ছন্দাদের গ্রামে একটাই মন্দির ছিল; ছন্দার ঠাকুর্দার প্রতিষ্ঠা করা। একটা পাঠশালা। একটাই বাজার। সবই ছন্দাদের পরিবারের কারুর না কারুর পত্তন করা। ছোটোবেলার গ্রামটার তুলনায় এ শহরে সব কিছুই বেশি বেশি; শুধু সুখ ছাড়া। বিয়ের পরের এই কুড়ি বছরে একটা দিনও সুখী হয়নি ছন্দা। নিজের চাইতে ষোলো বছরের বড় স্বামীর সাথে মনের মিল হলনা একটা দিনের জন্যও। এ কথা কাউকে বলার নয়; তাই নিজেকেও বলে না ছন্দা।
    তবে রতনের বাবা একজন ভালো মানুষ। মন আছে মানুষটার; লোকের দুঃখে মন কাঁদে। শুধু ছন্দাকেই যা বুঝতে পারেননা। এই যে মাসের পর মাস কলকাতায় পড়ে আছেন; ছন্দা কেও কি নিয়ে যেতে পারেননা? যা হোক করে ঠিক চলে যাবে একরকম।

    আজকাল থেকে থেকে চোখের কোল দুটো ভিজে যায়। আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ মুছে ঘরের দিকে পা বাড়াল ছন্দা। রতন একা বসে পড়ছে বাইরের ঘরটায়। কিরণ চলে গেছে। কখন গেল মেয়েটা? ছন্দার সামনে দিয়েই গেছে, অথচ…।
    -কিরণ কখন গেল রে?
    --অনেকক্ষন, মা।

    ***************************************************************************

    কিরণ অনেক্ষণ চলে গেছে, কিন্তু রতনের বুকে রেখে গেছে অচেনা অনুরণন ।
    অঙ্ক নিতে এসেছিল কিরণ। অঙ্ক দুটো দিয়ে রতন জিজ্ঞেস করেছিল, এই সহজ অঙ্ক গুলো না পারলে তো মুস্কিল! মন দিয়ে অঙ্ক করিস না কেন ?
    করি তো! বলেছিল কিরণ।
    -তা হলে পাঁচ নম্বর অঙ্কটা আটকাল কেন?

    ঠোঁটের কোনে হাল্কা হাসি লেপে কিরণ বলেছিল, ”একটা মজা দেখবেন? উঃনক্ষদভড়ন-এর শেষের দুটো ছাড়া আর সব আমি বাড়িতে করে ফেলেছি।”
    খাতার পাতায় গোটা গোটা হাতের লেখায় কষা অঙ্ক গুলো হতবাক করে দিয়েছিল রতনকে। অবাক গলায় কিরণকে জিজ্ঞেস করেছিল তবে?
    রতনের হাত থেকে অঙ্কের খাতাটা টেনে নিয়ে উঠে পড়েছিল কিরণ। চলে যেতে যেতে বলেছিল, ” তবে কি; তা বোঝেন না ? ”

    আর দাঁড়ায়নি কিরণ। রথের মেলায় মণিহারি দোকানের থেকে ভেসে আসা চুড়ির রিনিরিনি শব্দ রতনের বুকের মাঝে রেখে চলে গেছিল।

    ১৯।

    ছোট ঘরটার মধ্যে বক্তৃতা দিচ্ছে লোকটা। একহারা চেহারা। মাথার চুল এলোমেলো। ঘরের মধ্যে জনা পনের লোক। পার্টির মিটিঙ চলছে। পোশাকি নাম জিবি। জেনারেল বডি মিটিঙ। এই ভদ্রলোক নবদ্বীপের মানুষ নন। শিলিগুড়ি থেকে এসেছেন বিশেষ আমন্ত্রনে।
    অশোকই সব চাইতে ছোট এখানে। গণেশটা নেই। মামার বাড়ি গেছে।

    গমগমে গলায় বলে চলেছে মানুষটা। " কংগ্রেস সরকার আমাদের বাঙালিদের জন্য কি করেছে? বাঙলা ভেঙে দু খন্ড করেছে। উনিশ বছর হতে চলল, আজও ছিন্নমূল মানুষদের দুঃখ পুরোপুরি ঘোঁচেনি। আজও তাদের আস্তানা কলকাতার কলোনি গুলোতে। আজ না হয় তাঁরা নিজেদের জীবনীশক্তি, নিজেদের লড়াইয়ের দ্বারা বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করেছেন; করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু ভেবে দেখবেন কমরেড, কি ছিলো তাঁদের অবস্থা দেশভাগের ঠিক পরেই, যখন শিয়ালদা স্টেশনে কাতারে কাতারে ভিটে-মাটি ছাড়া অসহায় মানুষ এসেছেন। এ কথা আমাদের তরুণ কমরেডদের জানা দরকার। "

    টেবিলের ওপর রাখা জলের জগটা তুলে ঢক ঢক করে দু ঢোঁক জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করল লোকটা।”কলোনিতে ঠাঁই পাওয়ার আগে সে সব মানুষদের ঠাঁই হত ট্র্যানজিট ক্যাম্পে। কি এই ট্র্যানজিট ক্যাম্প? একটা জমির ফালি। চল্লিশ ফুট মতন লম্বায় আর চওড়ায় তার খানিকটা কম। সেই অপরিসর জায়গায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ গরু ছাগলের মতন গাদাগাদি করে রয়েছেন। হ্যাঁ, তরুণ বন্ধুরা পাঁচ থেকে ছয় হাজার মানুষ। অত মানুষের জন্য তৎকালিন সরকার কি রকম সুব্যবস্থা করেছিল তাও একবার জেনে নিন! তিনটি কল আর চোদ্দটা পায়খানা - একটা গোটা ক্যাম্পের জন্য। মহিলাদের জন্য বরাদ্দ মাত্র দুটি শৌচালয়! আমার কথা বিশ্বাস করতে হবেনা, এই দেখুন সেদিনের অমৃতবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন।” পকেট থেকে একটা হলদে হয়ে যাওয়া খবরের কাগজের টুকরো বের করল লোকটা। ইংরাজিতে লেখা। বড়রা ঝুঁকে পরে দেখতে লাগল কাগজটাকে। অশোকের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। ওরকম অপরিসর, অস্বাস্থ্যকর জায়গায় মানুষ থাকতে পরে? এসবের পরেও সেই একই সরকারকে ভোট দিয়ে গদিতে টিকিয়ে রেখেছে মানুষ! অশোকের ভোটাধিকার হয়নি এখনও। হলে কি করত তা ভাবতে হয়না একবারের জন্যও। ইস্‌, এই সময় গণেশটা থাকলে ভারি ভালো হত।

    লোকটা আবার বলতে শুরু করেছে। দেশের বেকার সমস্যার কথা। কিন্তু অশোকের মাথায় এখন শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে ওই কটা কথা - পাঁচ হাজার মানুষ, তিনটে কল, চোদ্দটা পায়খানা।

    ঘরের ভেতরটায় বাতাস বদ্ধ হয়ে গেছে। বাইরে বেড়িয়ে এল অশোক। পার্টি অফিসের গায়েই একটা কাঁঠাল গাছ। গাছটার নামেই ওদের পার্টি অফিসটার নাম; কাঁঠালতলা অফিস। গাছটার তলায় গিয়ে দাঁড়াল অশোক। গাছটার পায়ের চারিদিকে ছায়া ঘন হয়ে আছে। গাছটার একটা শেকড় মাটির ভেতরে ঢুকে আবার বেড়িয়ে আবার ঢুকে গেছে মাটির নিচে। যেন গুণ সূঁচ দিয়ে দিস্তা খাতা সেলাই করছে কেউ। শেকড়টার বেড়িয়ে থাকা অংশটার ওপর গিয়ে বসল অশোক। চারিদিকে রোবিবারের অলস দুপুর। ওর পিঠের দিকটায় গণেশদের বাড়ি। সোজা তাকালে কিরণদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। গণেশদের বাড়িটা থেকে টুকটাক শোনা যাচ্ছে মানুষের গলা। রাস্তার ওপারে কিরণদের বাড়িটা ঝিম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে; যেন বা ঘুমিয়েই পড়েছে।

    আরেকটু বসে তারপর ঢুকবে মিটিঙ ঘরে। চিন্তাটা মাথায় আসতে নিজের অজান্তেই চোখ চলে গেল পার্টি অফিসের দড়জার দিকে। রতনদা বেড়িয়ে আসছে। রতনদা গণেশের সাথে মামার বাড়ি যায়নি এবার।

    ওর দিকেই এগিয়ে আসছে রতনদা। উঠে দাঁড়াল অশোক। ওর কাছে এসে রতনদা বলল, "ভিয়েতনাম নিয়ে আলোচনা শুরু হবে একটু পরে। ভেতরে যা। আমিও যাচ্ছি একটু পরেই, বড্ড গুমোট ভেতরটা। "

    -ভদ্রলোকের নামটা যেন কি রতনদা?জিজ্ঞেস করল অশোক।
    -কি এক মজুমদার যেন। হ্যাঁ, মনে পড়েছে, চারু মজুমদার।
    -ব্যাটাছেলের নাম চারু হয়?
    -হয় যে তা তো দেখতেই পাচ্ছিস! ভেতরে যা।

    অশোকের ছেড়ে যাওয়া জায়গাটাতে গিয়ে বসল রতন। কিরণদের বাড়ির দিকে তাকাল একবার। সেদিনের পর থেকে দিন গুলো কেমন যেন বদলে গেছে রতনের। পড়াশুনো, খেলাধুলো, পার্টি - সবই করছে কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই যেন একটা আনন্দের হাতছানি। নিজের মনের ভেতরে যে এত আনন্দ লুকিয়ে ছিল, তা আগে কখনও বোঝেনি রতন। আনন্দের ফাঁকে ফাকে একটা চাপা উৎকন্ঠাও কাজ করছে বটে; কিন্তু নবলব্ধ এই আনন্দের ওজনে বারে বারে চাপা পড়ে যাচ্ছে তা। তবু পুরোপুরি পিষে মারা যাচ্ছে কোথায় সেই উৎকন্ঠাকে? ভবিষ্যৎ সুনির্দিষ্ট নয়। কয়েক মাসের মধ্যেই হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা । তা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই রতনের। কিন্তু তারপর? ওর নিজের ইচ্ছা ফিজিক্স অনার্স পড়ার। প্রেসিডেন্সিতে। সারা বাংলার বাঘা বাঘা ছেলেরা তাকিয়ে ওই কলেজের দিকে। পারবে তো ও তাদের সাথে লড়াই করতে? মফঃস্বলের স্কুলে ফার্স্ট হওয়া এক ব্যাপার আর…।

    তার মধ্যে সেদিন একটা ব্যাপার হল বটে! চটির মাঠ থেকে ফেরার পথে একবার গেছিল অপুদের বাড়ি। মোটা বলে অপু কোনদিনই খেলাধুলোয় তেমন দড় নয়। তা সে খামতি অপু পুষিয়ে দেয় অঙ্ক কষে। যত কঠিন অঙ্কই হোক না কেন, অপু ক্লাসের আর সকলের আগে সেটা করবেই।

    অপুর পড়ার ঘরটাতে ঢুকে রতন সেদিন দেখেছিল অপু আর ওদের পাড়ার দুজন ছেলে টেবিলের ওপর ঝুঁকে পরে কি যেন একটা করছে। রতনের গলা শুনে টেবিল থেকে মুখ না তুলেই ওর দিকে একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়েছিল অপু। বলেছিল, "ভরে ফেল এটা"
    -কি রে এটা?জিজ্ঞেস করেছিল রতন।
    -জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফর্ম।
    -কিন্তু আমি তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ব না!
    -পড়িস না। তোর জন্য কলকাতা থেকে একটা বাড়তি ফর্ম আনিয়েছিলাম বাবা কে দিয়ে। ভরে দে।

    দায় সারা ভাবে ফর্মের সবকটা কলাম ভরেছিল রতন। অপুদের দেখেই বোঝা যাচ্ছিল ওরা মনে মনে খুবই উত্তেজিত! পরীক্ষা টায় পাশ করলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারবে বলে। পাগলের গো-বধে আনন্দ! পড়াশুনো শিখে কেউ মিস্তিরি হতে চায়? ধুস্‌!

    উঠে পড়ল রতন। কিরণদের বাড়ির দিকে একবার তাকিয়ে পার্টি অফিসের ভেতরে ঢুকে পড়ল। পার্টি ক্লাস গুলোর চাইতে ওর অঙ্কের ক্লাস করতে ঢের ভালো লাগে। ফিজিক্সের তো কথাই আলাদা! পার্টি ক্লাসে কিছু স্থবির তত্ত্ব দিয়ে চলমান সময়ের নানান ঘটনার ব্যাখা, বিশ্লেষণ করে সকলে। ব্যাপারটা কতটা বিজ্ঞান সম্মত? কিন্তু তবু আসে রতন পার্টির মিটিঙ গুলোতে। ও এই মিটিঙ গুলোতে এলে ন'কাকা ভীষণ খুশি হন; ওনার মুখ দেখে বুঝতে পারে রতন। ভাঙাচোরা একটা মানুষকে এটুকু খুশি দিতে কার্পণ্য করেনা ও।

    আরো কিছুক্ষন আলাপ-আলোচনার পর মিটিঙ শেষ হল। ইন্টারন্যাশানাল গাওয়া হবে এবার। বাংলা অনুবাদটা অবশ্যই।

    গান শেষ হলে পর সকলে একে একে বেড়িয়ে আসছে ঘরটা থেকে। সবার পেছনে বসেছিল বলে সকলের আগেই বেরল রতন। পেছন থেকে মনোরঞ্জন কাকার গলা শুনতে পেল। ”অশোক, সামনের মিটিঙের আগে তুই ভিয়েতনাম নিয়ে একটা লেখা জমা দিবি।”

    ২০।

    অন্য দিন এই সময়টা রান্নাঘরেই কাটে ছবির। রাতের রান্না। আজকে শরীরটা যেন দিচ্ছেনা আর। লিপিকে তাই আজ বলেছেন রান্নাটা করতে। বড় ভালো রান্নার হাত মেয়েটার। আর রাঁধতে ভালোওবাসে লিপি। তবু সাধারনত ওকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেননা ছবি। সারাটা জীবন তো এই কাজের জন্য পড়েই রইল ওর! হাতে হাতে মেয়েদের সংসারের টুকিটাকি কাজ করতে বলেন অবশ্য - এখন থেকেই অল্প স্বল্প কাজ শিখে রাখা দরকার। পরের ঘরে সব রকম পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা চাই।

    সুধা গেছে ছাত্র পড়াতে। কিরন আর শোভা ওদের বাবার ঘরে বসে পড়ছে। খোকনটা কোথায় যেন বেরল! এই ঘরটায় আলো নিভিয়ে তাই একটু একলা থাকা যাচ্ছে। সারাটা জীবনই একলা, তবু একটু একলা থাকার জন্য জায়গা খুঁজতে হয়। জায়গারই বড় অভাব এ বাড়িতে। পাবনায় থাকতে আর যাই হোক একলা থাকার জায়গার অন্তত অভাব হত না। তখন একলা থাকাটা ছিল অভ্যেস আর আজ, এই এখন , একটু একলা থাকা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। মনটা অস্থির লাগছে। কদিন ধরেই, একটা ব্যাপারে কর্তার সাথে একটু আলোচনা করবেন ভাবছেন। বহুবার ভেবেছেন। কিন্তু প্রায় সিকি শতাব্দী পার হতে চলা সম্পর্কটার মাঝের কাঁচের দেওয়ালটাকে আর ভাঙতে ইচ্ছে করে না! কর্তার কাছে এই সব গতানুগতিকতা মূল্যহীণ। দৈনন্দিনতা স্পর্শ করেনা মানুষটাকে একটুও। সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেও তো কোনদিন শিহরিত হতে দেখলেন না মানুষটাকে! নইলে পাবনায় থাকতেই দেশভাগের হাওয়া যখন চরমে উঠেছিল, তখনই কি সব বিক্রি করে চলে আসতেন না এ দিকে?
    মাঝে মাঝে বুকের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আগ্নেয়গিরিটা জেগে উঠতে চায় সশব্দে। খোকন-কিরনদের তো এরকম জীবন পাওয়ার কথা ছিলনা! পাবনার বাড়ির আউটহাউসের দুগুন হবে বড়জোর এই বাড়িটা। এরকম একটা বাড়িতে জীবন কাটানোর কথা তো দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি ছবি কোনদিন! তবে কার পাপে ছেলেমেয়ে গুলোকে মানুষ হতে হচ্ছে এহেন কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে?

    মানুষটার কোনদিনই বৈষয়িক নন। কিন্তু নিজের অধিত বিদ্যাকে পুঁজি করে উপার্জন - সেও তো করল না মানুষটা! একজন এডভোকেট যদি নিজের পেশাগত অনুভূতি গুলোর থেকে নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি গুলোকে আলাদা করতে না পারেন - তবে তার দায় কার? অসহায়া বিধবার সম্পত্তি লুন্ঠনে নিজের স্বামী শামিল হননি - তাতে কিছুতেই নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করতে পারেন না ছবি। গর্ব তো তখন হত, যদি ভদ্র মহিলার অধিকারের জন্য লড়ত মানুষটা। আর তা না হলে অন্য মামালা লড়তেন না হয়! খুব কি অসুবিধে ছিল তাতে? নিজের সন্তানদের জন্য এটুকু আপোষ কে না করে? অথচ এমন নয় যে উনি ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে উদাসীন। ছবি জানেন, কর্তা ছেলেমেয়েদের যতটা ভালোবাসেন, ছবি তার চাইতে বেশি ভালোবেসে উঠতে পারেননি আজও।কিন্তু শুধু লেখাপড়া নামক অস্ত্র দিয়ে যে জীবনযুদ্ধে জেতা যায়না - এই সত্যিটা মানুষটা বুঝলনা!

    আসলে মানুষটা চিরকালই ওই রকম। বেশি ঝুটঝামেলা পছন্দ করেননা। একটু ভীতুও যেন বা। ও দেশে তো হিন্দুরা আজও রয়েছে; থেকে যেতে পারতেন না কি ছবিরাও? তাহলে বাবাকে অন্তত এই বুড়ো বয়সে ছবির এহেন অবস্থা দেখতে হতনা। দেখতে অবশ্য হয়ও না! ফুলিয়ার বাড়িটায় বাবা একাই থাকেন। সাথে একজন সহায়ক। গ্লোকুমা কেড়ে নিয়েছে বাবার চোখ দুটো।

    প্রথম প্রথম বাবা চাইত ছবিকে আর্থিক সাহায্য করতে। কিন্তু ছবির সিদ্ধান্তের সামনে মাথা নোয়াতেই হয়েছে বাবাকে। কিরন-শোভাদের বাবাকে অপমান করার কোনো অধিকার তো ছবির নেই! তাছাড়া মনের মধ্যে হয়ত একটা প্রতিশোধ স্পৃহাও কাজ করত ছবির যখন দেখতেন বাবা অস্থির হয়ে পড়ছেন ছবির বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতি দেখে।

    আজকাল অবশ্য একটা নির্লিপ্তি চলে এসেছে ছবির মধ্যে। নিজের ভাগ্যের জন্য অপরকে দোষারোপ করার মতন ছেলেমানুষি পার করে এসেছেন বহুকাল।

    এখন মাঝে মধ্যে বাবার কাছে গেলে বাবা বাঁশি বাজিয়ে শোনান। বুকের ভেতরে জমে থাকা, সন্তানকে না বলা কথা গুলো সুর হয়ে বেরয়।

    দাদারা অনেকবার নিষ্ফল চেষ্ঠা করেছে বাবাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে। কলকাতা; বাবার সুখ এবং দুঃখদের বাসস্থান। তাদের মুখোমুখি আর হতে চান না বাবা। ছবি বোঝে।

    ভাবনাগুলো ঘুরপাক খেতে খেতে এসে স্তব্ধ হচ্ছে দিন সাতেক আগের সন্ধ্যের একটা ঘটনায়। আপাত দৃষ্টিতে যা কোন ঘটানাই নয়। শোভা গান শিখতে চায়। এক সপ্তাহ আগে সন্ধ্যেবেলায় ইতস্তত পায়ে ছবির কাছে এসে শোভা বলল যে ও গান শিখতে চায়। সংসারের একটুখানি বাড়তি খরচ কি ভাবে সামাল দিতে হয়, সে ভোজবাজি ছবির এতদিনে শেখা হয়ে গেছে। টাকাটা কোন কথা নয়। গানের জন্য ও কটা টাকার ব্যবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে। কিন্তু মায়ের চোখ দিয়ে ঘটনাটাকে দেখতে না পেলে ব্যাপারটা নিয়ে বিচলিত হবেনা কেউই। শোভা যদি ওর স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে দুম করে এসে বলত - মা, এবার থেকে কিন্তু আমি গান শিখব বলে দিচ্ছি - তা হলে নাহয় বুঝতেন যে মেয়েটা গানই শিখতে চাইছে। কিন্তু ওর সেদিনকার হাবভাব যে মা হয়ে বড় অচেনা ঠেকল ছবির! সঙ্কুচিত হয়ে তো কখনও শোভাকে থাকতে দেখেননি উনি! মেয়েটার সেদিনের হাবেভাবে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল - মেয়েটা মরেছে। কতকটা মেরেছে গান আর কতকটা বিশ্বনাথ। বড় ভয় হয় ছবির! এই কাঁচা বয়সে মনে কোন চোট না খায় মেয়েটা। আঘাতের চিহ্ন মিলিয়ে গেলেই ভালো; কিন্তু যদি না মেলায়! সারা জীবন যদি সেই আঘাতের অভিজ্ঞান বহন করতে হয় মেয়েটাকে-তখন? না, না, এসব কি ভাবছেন ছবি! মেয়েটার মঙ্গল কামনায় মনে মনে অজানা কোন এক ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে হাত জোড় করলেন। এবার কিন্তু নিজের জন্যই বড় করুনা হল ছবির। জীবনের আর সব কিছুর মতই ঈশ্বরও ছবির কাছে ধূসর, অবয়বহীণ, অধরা। কার্সিয়াঙের সেন্ট মেরিজ কনভেন্টের যিশু, ব্রাক্ষ্ম বালিকা বিদ্যালয়ের নিরাকার ব্রক্ষ্ম আর জন্মাসূত্রাধিকারের তেত্রিশ কোটি - সকলে মিলে মিশে আরো আরো দিশাহীণ করে তোলে ছবিকে।

    বেড়ার ঘেরাটোপ দিয়ে চারা গাছ পালন করা যায়; মানুষকে নয়! এ কথা ছবি মানেন বরাবরই। সন্তান কে ভুল করবার অধিকার দাও। দুঃখের আগুনে ঝলসাতে দাও। সেই তাত কে উপেক্ষা করার মতন মানসিক দৃঢ়তাও দা ও- তবেই হবে সে সম্পূর্ণ মানুষ। আলেক একবার বলেছিল - ঈত্স নোত োর্থ সইলিঙ্গ ইফ থে সেঅ ইস্ন'ত রৌঘ!

    শোভার জিজ্ঞাসার উত্তরে ছবি সেদিন বলেছিলেন, ভেবে দেখছি। এখন হঠাৎ করে ছবির মনে হছে - ভাবা হয়ে গেছে। গলা তুলে পাশের ঘর থেকে ডাকলেন শোভাকে। জীবন পথের প্রথম মোড়ে হাত ছেড়ে দিয়ে একা একা প্রথম পা টা ফেলতে চাইছে মেয়েটা। ফেলুক। হোঁচট খেলেও নিজেই উঠে দাঁড়াবে। শোভার ওপর সেটুকু বিশ্বাস আছে ছবির।

    ২১।

    ব্ল্যাক আউট। শব্দ দুটো আগেও শুনেছে কমল। স্বাধীনতার আগে জাপানী বোমার ভয়ে কলকাতার মানুষ সন্ধ্যে হলেই ঘরের বাতি নিভিয়ে দিত। কর্পোরেশনের লোক এসে রাস্তার ধারের গ্যাসের বাতিগুলোতে ঠুলি পরিয়ে দিত। ওর নিজের মনে নেই; মায়ের কাছে শোনা। পাবনার বাড়ি থেকে মা তখন কমল আর বোন লিপিকে নিয়ে শ্যামবাজারে মামার বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল কিছুদিনের জন্য; যুদ্ধ লেগে যাওয়ায় আটকা পড়ে যায়। তখন অবশ্য অতশত বোঝবার বয়স নয় ওর। মামারা একটা ছড়া শিখিয়েছিল তখন ওকে - সেইটা শুধু মনে আছে। ”সা রে গা মা পা ধা নি/ বোম ফেলেছে জাপানী/ বোমের মধ্যে কেউটে সাপ/ ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ।”

    শ্যামবাজারের বাড়িটা আর এখন নেই। দাদুর স্বপ্নের প্রজেক্ট ফেল করল। হেমলতা মেডিকেল কলেজ। বড় মামারা চলে এলেন আনন্দ পালিত রোডে আর ছোট মামারা ভবানীপুরে। তা সেই ভুলে যাওয়া ব্ল্যাক আউটের স্মৃতিই মনে পড়ে গেল আজ বড়মামাদের বাড়ির জানলার কাঁচগুলোর দিকে তাকিয়ে। কালো রঙ করা, যাতে রাতের বেলা ঘরের ভেতরে আলো জ্বললেও বাইরে থেকে না দেখা যায়। তবে এবার আর জাপানী নয়। সেবার যারা হয়ত কলকাতার মানুষদের মতন একই সঙ্গে বিনিদ্র রজনী কাটিয়েছে বোমার ভয়ে - এবার তারাই হানাদার। পূর্ব পাকিস্তানের কোন অজানা এয়ার বেস থেকে উড়ে এসেছে পাক পুষ্পক। এখনও বছর ঘোরেনি, এবারের যুদ্ধের স্মৃতি তাই একেবারে টাটকা কমলের মনে।

    কলকাতায় গতকালই এসেছে কমল। চাকরির ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট বেড়িয়েছে। আগামীকাল মেডিক্যাল টেস্ট আছে। কমল জানে মেডিক্যাল টেস্টে ও আটকাবে না। ও সম্পূর্ণ সুস্থ। সবল। কোন রকমের নেশা করেনা। তবু, না আঁচালে বিশ্বাস নেই।

    গেস্টরুমের লাগোয়া বারন্দাটায় এসে দাঁড়াল কমল। রাতের কলকাতা বড় মোহময়ী। বারন্দাটা থেকে আকাশ দেখা যায়। ঘাড় তুলে ওপরে তাকাল ও। আকাশ এখন পরিষ্কার। হানাদারদের আর কোন চিহ্ন নেই।

    নিচের তলা থেকে বড়মামার গলা পাওয়া যাচ্ছে। ক্লাব থেকে এই ফিরলেন বোধহয়। মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য উনি। এক সময় ওই ক্লাবেরই খেলোয়াড় ছিলেন। প্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন ক্লাবকে। এখনও প্রত্যেক দিন ক্লাবে ওঁনার যাওয়া চাইই। দক্ষিণ কলকাতার এই অঞ্চল থেকে ক্লাবটা বড় কম দুর নয়। বাড়িতে তিন তিনটে গাড়ি থাকা সত্ত্বেও এই এতটা রাস্তা রোজ হেঁটে যাতায়াত করেন। এটা মামার খেলোয়াড় উত্তর জীবনের ব্যায়াম। চেহারাটাও যে কারনে এখনও সুঠাম রয়েছে। মামা ইস্টবেঙ্গলে খেললে বেশ হোতো!

    এই ব্যাপারটা ভাবতে একটু অদ্ভূত লাগে কমলের। দুটো ক্লাবের সমর্থক-সদস্যদের কি সুন্দর দু ভাগে ভাগ করা যাচ্ছে - হয় ঘটি নয় বাঙাল। কিন্তু দেশটাকে সুন্দর ভাবে ভাগ করতে পারলেন না গান্ধি-নেহেরু-আজাদরা। কাগজের ওপর পরিষ্কার ভাবে দাগ কেটে জনগনমনঅধিনায়কেরা কমলদের বুঝিয়ে দিয়েছেন - এটা তোমার দেশ, ওটা ওর। তুমি হিন্দু, ও মুসলমান। বুঝিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কমল আজও বোঝেনা, কেন মাঝে মাঝেই ঘুমের মধ্যে ও স্বপ্ন দেখে ওদের শালগেড়িয়া গ্রামের বাড়িটার। বাড়িটার আনাচ কানাচ সমস্ত ধরা দেয় ওর মনের মধ্যে। আর ঘুম ভাঙার পর ওর চোখে উচ্ছিষ্ট ঘুমের সঙ্গে কেন লেগে থাকে চাপ চাপ বিষাদ - তাও বোঝেনা ও। ওরই মতন কোন সিরাজুল বা আসলাম হয়ত আজ পাবনা জেলার শালগেড়িয়া গ্রামে ঘুমের মধ্যে দেখছে বর্ধমান-নদীয়ায় ফেলে যাওয়া নিজেদের স্মৃতির জলছবি!

    গতকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ হলের সামনের পুকুর পাড়ে বসেছিল কমল। এম।এ। পড়া এ জন্মে আর হলনা ওর! তবু একবার কলকাতায় এলে ফাঁক পেলেই ও পায়ে হেঁটে ঘুরে দেখে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো। তা সেই আশুতোষ হলের তলাতেই কাল দেখল ইস্টবেঙ্গল সোসাইটি। ভিঁটে মাটি ছেড়ে এসেও মানুষ মন কে প্রবোধ দিতে চায়; মনরে, কিছুই বদলায়নি! ইস্টবেঙ্গল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতারাও হয়ত চেয়েছিলেন সব ছিন্নমূল মানুষেরা একত্রিত হলে মনে মনে ফিরে যেতে পারবেন নিজেদের ফেলে আসা ঘর বা পরিজনেদের কাছে। মনে মনে। শুধুই মনে মনে।

    রাস্তায় অনেক গাড়ির সারি। রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে দেশের টালমাটাল অবস্থাটার কথা আন্দাজ করা মুশকিল। বেকারের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। কমল নিজেও তাদের মধ্যে একজন। হে ভগবান, চাকরিটা যেন হয়! চাকরি না হলে বড় বোন লিপির বিয়েটা অনিশ্চিত। ছোটো ভাই বোনেদের ভবিষৎ ও অনিশ্চিত। আর ওর চাঁপাকে নিজের করে পাওয়ার ভাবনাও অনিশ্চিত। চাকরিটা পেয়ে গেলে একদিন ও যাবে চাঁপাদের বাড়িতে। চোরের মতন আর ওদের বাড়ির দোড় গোড়া থেকে পালিয়ে আসবেনা বারে বারে। চোখ তুলে তাকাবে চাঁপার চোখের ভেতর।

    কমল বোঝেনা, বুঝতে চায়না যে চাকরি পেয়ে গেলেই সকল সমস্যার সমাধান হবেনা। আট হাত কাপড়ে মাথায় ঘোমটা টানা চলেনা কোন মতেই। চাকরি পাওয়ার সাথে সাথে মানুষের জীবনে অনিশ্চয়তার কুয়াশা কেটে গিয়ে প্রকাশিত হয় দায়িত্বের ছদ্মবেশে একরাশ নতুন সমস্যা। সংসারের জাঁতকলে দু-বেলা পিষ্ঠ হতে হতে সে হারিয়ে ফেলে নিজের স্বকীয়তা, স্বাধীনতা ও স্বপ্নগুলোকে। চোখের সামনে দু-বেলা দেখে নিজের কল্পনার তিল তিল অপমৃত্যু। পেছনে ফিরে সে দেখতে পায়না ফেলে আসা রাস্তাগুলোকে। সেই রাস্তা গুলো, যে গুলো ধরেই সে পৌঁছেছে সেখানে, যেখানে সে আজ দাঁড়িয়ে। রাস্তা গুলো সব মুছে গেছে সময়ের পায়ের চাপে। তাই উপায় রয়ে যায় একটাই।

    এগিয়ে চলা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ ডিসেম্বর ২০১৩ | ১৬৯২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন