এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটা অর্ধ-সমাপ্ত গল্প

    Kaushik Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৬ অক্টোবর ২০১৭ | ২৮৭৬ বার পঠিত
  • পর্ব ১।

    ঘুম ভাঙতেই পাশ ফিরে মা, বাবা আর ছোট্ট ভাইটাকে একবার দেখে নিল ডোডো। সবাই ঘুমোচ্ছে। খাট থেকে আস্তে করে নেমে, ঘরের বাইরে চলে এল। ঘরটা থেকে বেরোলে ডান হাতে আরেকটা বেডরুম। এটার দরজা বন্ধ। সেটা পেরোলে একটা খুব ছোট্ট গলি দিয়ে ডাইনিঙ রুম। গলিটার একটা দেওয়াল তৈরি হয়েছে প্যান্ট্রির দেওয়ালে, আরেকটা বন্ধ বেডরুমটার দেওয়াল দিয়ে। তারপরে ড্রয়িং রুম। একটা সোফা টেনে ড্রয়িং রুমের দড়জাটার কাছে নিয়ে এল ডোডো। বেশ ভারি সোফাটা। কার্পেটের ওপর দিয়ে নিয়ে অসতে একটু কষ্টই হচ্ছিল।

    ছিটকিনি খুলে বাইরে এল ডোডো। একটা বারান্দা। বেতের চেয়ার টেবিল পাতা রয়েছে। বারান্দাটা থেকে দুটো সিঁড়ি নামলে মাথা ঢাকা একটা গাড়ি বারান্দা। আর গাড়ি বারান্দাটার দু দিকে কি ভীষণ সুন্দর বাগান!

    বাগানে চলে এল ডোডো। কত রকমের গাছালি আর ফুল। গোলাপ আর গাঁদা ছাড়া একটারো নাম জানে না ডোডো। আসেপাশে কেউ নেই। ঘুরে ঘুরে বাগানটা দেখতে লাগলো ও। কাল রাতে যখন ওরা এখানে এসে পৌঁছেছে, তখন কিছুই দেখা হয়নি ওর। ভীষণ ঘুম পাচ্ছিলো। কালকের সারাটা দিনই একরকম ঘুমিয়েই কেটেছে ওর। কালকের দিনটার কথা মনে করার চেষ্টা করলো ডোডো।
    রাত থাকতে থাকতেই মা ঘুম থেকে তুলে দিয়েছিলো ওকে। ওদের ব্যানার্জী পাড়ার বাড়িটার সামনে বাবার অফিসের জীপটা দেখতে পেয়েছিলো। জীপের ভেতরে দাস কাকু। দাস কাকু রোজ সকালে বাবাকে অফিসে নিতে আসে এই জীপটাকে নিয়ে। সবাই জীপে চাপলে পর ওরা চলে এসেছিলো একটা জায়গায়। বাবা বলেছিলো জায়গাটাকে বলে এয়ারপোর্ট। অনেক লোক। ওদের সাথে মেজো মাসি ও এসেছিলো এয়ারপোর্টে। বাবা কোথা থেকে যেন চা নিয়ে এসেছিলো সবার জন্য। এরকম চা আগে দেখেনি ডোডো। একটা কাপে দুধ আর সাথে সাথে একটা কালো রঙের সুতো বাঁধা ছোট্ট পুটুলি। ওটাকে বলে টি ব্যাগ। বাবা বলেছিলো। ওর হাতে কাপটা দিয়ে বাবা বললো, ম্যাজিক দেখবি? ওই পুটুলিটাকে দুধের মধ্যে ডোবাতেই, কি আশ্চর্য, দুধটা চা হয়ে গেল! ঠিক যেরকমটা মা বানায়। তারপর ছোট্ট একটা সাদা চৌকো মতন জিনিস চায়ের মধ্যে ফেলে দিলো বাবা। ওটার নাম সুগার কিউব। একটা সুগার কিউব চেয়ে নিয়েছিলো ডোডো বাবার কাছ থেকে। প্লেনে ওঠার আগে চেটে চেটে খাচ্ছিলো।

    সিঁড়ি দিয়ে প্লেনে ওঠার আগে পে্ছন ঘুরে মেজোমাসি কে টা-টা করে দিয়েছিলো ডোডো। অনেকটা দুরে একটা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো মেজোমাসি আরো অনেক লোকের সাথে। মেজোমাসি রুমাল দিয়ে চোখ মুছছিলো।
    প্লেনে উঠে জানলার পাশের সীটটায় বাবা বসালো ওকে। প্লেনটা আকাশে উঠতেই বাবা বলল, নিচে দেখ। ঘর বাড়ি রাস্তা ঘাট সব হঠাৎ করে ছোটো হতে লাগলো! ঠিক মিতুলদির ডল হাউসের সেটটার মতন। কিছুক্ষণের মধ্যে আর কিছুই দেখা গেল না, চারিদিকে শুধু সাদা সাদা মেঘ। তার কিছুক্ষন পর মাথার ওপরে একটা লাইট জ্বলে উঠতেই বাবা বললো, যাক! ডোডোর আর নিজের পেটে বাঁধা বেল্টটা খুলে দিয়ে সিগারেট খেতে শুরু করলো বাবা। বাবাকে সিগারেট খেতে দেখতে ডোডোর খুব ভালো লাগে। একটা সিগারেট শেষ হলে পর ডোডো বলেছিলো, বাবা আরেকটা সিগারেট খাও।
    -তা ঠিকই বলেছিস, এখনি খেয়ে নিই। এরপরে তো আবার নো স্মোকিঙ লাইট জ্বেলে দেবে।
    ভাইটা কাঁদতে শুরু করেছিলো। একটা আন্টি এসে ইংলিশে মা কে কিছু একটা বললো। মা ব্যাগ থেকে দুধের বোতল বের করে ভাইয়ের মুখে ধরতেই কিছুক্ষনের মধ্যে চুপ করে গেল ভাই। ডোডোর সামনে এক ট্রে ভর্তি লজেন্স এনে ধরলো আন্টিটা। বাবার দিকে তাকাতে বাবা হেসে বললো নিয়ে নে। দু মুঠোয় লজেন্স তুলে নিয়েছিলো ডোডো। প্যান্টের পকেটে এখনো তার কয়েকটা পরে আছে।

    ভালো করে সকাল হয়নি এখনো। কাউকে দেখা যাচ্ছেনা আসেপাশে। বাড়িটাকে ভালো করে দেখতে শুরু করলো ডোডো। দুটো গেট। একটার সামনে লেখা IN, আরেকটার সামনে লেখা OUT।
    IN লেখা গেটটা থেকে একটা রাস্তা শুরু হয়ে ধনুকের মতন বেঁকে গাড়ি বারন্দাটায় এসেছে। গাড়ি বারান্দাটা যেন ঠিক ধনুকের মাঝখানটা, যেখানে ধনুকটাকে ধরে তির ছোঁড়ার জন্য। সেখান থেকে আবার ধনুকের মতন বেঁকে রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে OUT লেখা গেটটার সামনে। দুটো গেটের মাঝে গাড়ি বারান্দার লাগোয়া জমিটায় সবুজ ঘাসে ঢাকা। তার মাঝামাঝি জায়গায় আর একটা বিরাট উঁচু লোহার রড মাটিতে পোঁতা আছে - আকাশ ছোঁবে যেন। দুটো সিঁড়িও আছে। কিসের জন্য লাগানো রডটা? বাবাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।

    বাড়িটার দু দিকে বাগান। পেছনেও। ডান দিকে একটা বাড়ি আছে, বাঁদিকেও। ওদেরও বাগান আছে। প্রত্যেক দুটো বাড়ির মাঝে জবা গাছের ঝোপ দিয়ে তৈরি মোটা ফেন্সিঙ।
    ঘুরতে ঘুরতে বাগানের ডানদিকটায় চলে এল ডোডো। এক ধরনের লালচে রঙের গাছের সারি দিয়ে একটা দেওয়াল মতন বানিয়েছে! গাছ গুলোর ভেতর দিয়ে দেওয়ালের ওপারে গেল ডোডো। এদিকটায় সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ নেই। মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে শাক সবজি লাগানো হয়েছে। লাল গাছের দেওয়াল ভেদ করে ওদিকটা দেখা যায়না। ওদিক থেকেও এদিকটা দেখা যায়না। বাড়িটার শেষ প্রান্তে চলে এল ডোডো। একটা খুউব উঁচু গাছ। ভীষন মোটা। অনেক ওপরে লাল লাল ফুল হয়েছে। ডোডোর হাত যাবেনা। বাবারও না। গাছটার নীচে বসে পড়লো ডোডো। এটা বাড়িটার পেছোন দিকটা। একতলা বাড়ি। মাথায় লাল রঙের টিনের ছাউনি। ঠিক যেমনটা H for hut এ দেখা যায়!

    পকেট থেকে কালকের একটা লজেন্স বের করলো ডোডো। গোল মতন। কমলা রঙের। অল্প হাওয়া দিচ্ছে। লজেন্স মোড়ার কাগজটা হাওয়াতে ভাসিয়ে দিল ও। দুলতে দুলতে কিছু দুরে গিয়ে মাটিতে পড়লো কাগজটা। কালকে প্লেনটা ওদের যেখানে নাবালো, সেখান থেকে ওদের জন্য গাড়ি এসেছিলো। সেই গাড়ি চড়ে একটা নদী পার হলো ওরা। ব্ৰহ্মপুত্ৰ । কি বিশাল নদী! মা বললো, নদ। নদ মানে কী ?

    দুটো নৌকার মাঝে একটা কাঠের পাটাতনের ওপরে গাড়িটাকে নিয়ে পার হচ্ছিলো ওরা। ভয় করছিলো ডোডোর। তার পরে বোধহয় আরেকবারও ওই একই ভাবে আরেকটা নদী পার হতে হয়েছিলো ওদের। ঠিক মনে পড়ছেনা। আসলে প্রথম বার নদী পার হওয়ার পর থেকেই খুব ঘুম পাচ্ছিলো ওর। ঘুমিয়ে পড়েছিলো গাড়িতে বাবার কোলে। মাঝে মাঝে ঘুম ভাঙছিলো, আবার ঘুমিয়ে পড়ছিলো ও। তারপর কালকে রাত্রিবেলায় এসে পৌঁছেছে ওরা এই বাড়িটায়। মা বললো, এবার থেকে ওরা এখানেই থাকবে। বাড়িটা ভীষন সুন্দর। তবে এখানে ওর ব্যানার্জী পাড়ার বন্ধু বুবলা থাকলে আরো ভালো লাগতো। আর জেঠুর বাড়িটাও যদি এখানে থাকতো? জেঠু, জেম্মা, মিতুলদি - ওরা কি এখানে আসবে না?
    এত সুন্দর বাড়িতে এর আগে কখনো থাকেনি ডোডো। কিন্তু ওর বুবলার জন্য মন খারাপ করছে। গুড়িয়ার জন্যও। ব্যানার্জী পাড়ার সবার জন্যই ওর একটু একটু মন খারাপ করছে। বাবুজীদা, সুমনদা, সঞ্জয়দারা ডোডো কে খুব ভালো বাসে। রবি কাকু, টনটন কাকু, মুকুল কাকুরাও কত ভালো বাসে ডোডো কে। কিন্তু ওরা কেউ এখানে নেই।

    ডোডো। বাড়ির সামনের দিকটা থেকে আবছা একটা ডাক ভেসে আসছে। মা।
    উঠে পড়লো ডোডো।

    ক্রমশ

    পর্ব ২।

    দুপুরবেলাটায় একটু আলস্য লাগে বটে, তবু না ঘুমিয়ে বারন্দাটায় এসে বসেছে কিরণ নতুন জায়গা। গত কালই এসে পৌঁছেছে ওরা। বড্ড লম্বা জার্নি ছিলো! ভোর রাতে উঠে এয়ারপোর্ট আসা। ডিব্রুগড়ে নেমে গাড়ি করে ঘন্টা চারেক চলতে হয়েছে ওদের। রাস্তার বেশিরভাগটাই খারাপ। বড্ড ঝাঁকুনি দিচ্ছিলো জীপের পেছনে। সামনে ড্রাইভারের সাথে রতন আর ডোডো। রাস্তায় নাম না জানা অনেক গ্রাম আর চা বাগান। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে আসতে গিয়ে একটা ভারি অদ্ভূত জায়গার নাম দেখা গেল - ডুমডুমা। কিলোমিটার স্টোনে লেখা ছিলো। লেখার হরফ দেখে বোঝা গেল, জায়গাটা আসামের মধ্যেই পড়ে। অবশ্য চা বাগান যা আছে সব আসামেই; অরুণাচলে ঢোকার পর থেকে একটাও চা বাগান দেখতে পায়নি কিরন।
    রাস্তায় দুবার নদী পেরিয়েছে -ব্রহ্মপুত্র আর নোয়াডীঙ।প্রথমটা আসামের পরেরটা অরুণাচলের। নোয়াডীঙ নদীটা পেরোলেই এই ছোট্ট জনপদ - নামসাই।

    দমদমে প্লেনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চোখে জল চলে আসছিলো। মেজদি ভিজিটর্স ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে যাচ্ছে সমানে। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিলো কলকাতা শহরটা ওর চোখের সামনে। আজ অবশ্য মন খারাপ লাগছে না। পথশ্রম জনীত ক্লান্তি, নতুন জায়গায় আসার উৎসাহ আর আজানা পরিমন্ডলে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চিন্তা - এই তিনে মিলে ওকে দুখি হতে দিচ্ছেনা ছেড়ে আসা পরিজন আর চেনা শহরটার জন্য।

    সকলেই ভীষন ক্লান্ত কিন্তু তবু রতন আজকেই এখানকার অফিসে জয়েন করল। এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে প্রথম দিন। অন প্রোমোশান ট্রান্সফার। বাংলোর পেছন দিকটাতেই অফিস। তবু গাড়ি এসেছিলো নিতে। জীপ। নম্বর প্লেটে লেখা আR ৮০। নামসাই লোহিত ডীস্ট্রিক্ট-এর অন্তর্গত। ড্রাইভারের নাম গণেশ। নেপালি, কিন্তু ভারি সুন্দর বাংলা বলে। পরে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে কোথা থেকে বাংলা শিখল।
    কিরণের জীপের চাইতে এম্বাস্যাডর ভালো লাগে। কলকাতাতেও রতন কে জীপ দিতো। ভেবেছিলো এখানে হয়ত এম্বাস্যাডর পাওয়া যাবে। ডিব্রুগড়ের পর বড় শহর পড়েছিলো তিনসুকিয়া। সেখানেও বেশ কিছু অ্যাম্বাস্যাডর চোখে পড়েছিলো কিন্তু অরুণাচলে ঢোকার পর থেকে আর অ্যাম্বাস্যাডর দেখতে পায়নি কিরণ।

    চব্বিশ ঘন্টাও পুরো হয়নি এখানে এসেছে ওরা কিন্তু তার মধ্যেই কিরণ বুঝতে পারছে এখানকার ব্যাপার স্যাপার গুলো বড্ড সাহেবি। সাহেবি কেতার বাংলো। প্রায় বিঘা দুই জমির মাঝামাঝি জায়গায় বাংলোটা। তিনটে বেডরুম। বাংলোর সামনে আর দুপাশে বাগান। গাড়ি বারন্দাটার ওপারের লনটায় একটা ফ্লাগ মাস্ট রয়েছে। পেছন দিকে সবজী বাগান। জনা তিনেক কাজের লোক। যে ছেলেটি রান্না করে তার নাম কৈলাশ। বিহারি। ওর খুড়তুতো ভাইও কাজ করে বাংলোতে - সঞ্জয়। রাম নামের নেপালি ছেলেটি মালি। ওরা তিনজন কিরন কে মেমসাহেব মেমসাহেব বলে ডাকছে। কানে লাগছে ডাকটা তবে শুনতে খারাপ লাগছে না।

    জিনিশ পত্র কিছুই এখনো এসে পৌঁছোয়নি। আসার আগ দিয়ে রতন সব প্যাক করে লরিতে তুলে দিয়েছিলো, কিন্তু সে সব আসতে এখনো দিন দশেক তো বটেই! জিনিশ গুলো চলে এলে সেগুলো আনপ্যাক করতে, সাজাতে কিছুটা সময় ব্যয় হত। চুপচাপ বারন্দায় বসে এক ঘেয়ে একটা পাখির ডাক শোনা ছাড়া এখন আর কোনো কাজ নেই। হাতের কাছে একটা গল্পের বইও নেই। ড্রয়িঙ রুমে রাখা বুক শেল্ফে কিছু বই আছে বটে, কিন্তু তার মধ্যে বিশির ভাগই ড-র ওয়ার্কস ম্যানুয়াল। আর কিছু দর্শনের বই। সিভি রামন। কলেজে চার বছর ফিলোসফি অনার্স পড়লেও বিষয়টাকে হয়ত মন থেকে কোনো দিন ভালোবাসেনি কিরণ।

    কলেজে থাকতে শ্রীপারাবতের লেখার খুব ভক্ত ছিলো ও। সেকেন্ড ইয়ারে ওর হস্টেলের রুমমেট অনিমার কাছ থেকে "আরাবল্লি থেকে আগ্রা" বইটা নিয়ে পড়েছিলো কিরন। তারপর থেকে গোগ্রাসে গিলেছে শ্রীপারাবতের লেখা অনেকদিন অবধি। ধীরে ধীরে কেন যেন সেই মুগ্ধতাটা কেটেও গেছিলো । তারপর সেই জায়গাটা নিয়েছিলেন তারাপদ রায়। ডোডোর নামটা তো ওঁনার লেখা থেকেই নেওয়া!
    বাকি ফার্নিচার সবই আছে বাংলোতে কিন্তু ফ্রীজটা না আসা অবধি একটু অসুবিধেই হবে। আর কিছু নয়, ফ্রীজটা না থাকলে ছোটোটার দুধের একটু অসুবিধা। রতন বলছিলো এখানে তেমন গরম পড়ে না, দুধ চট করে খারাপ হওয়ার ভয় কম, তবু সাবধানের মার নেই।

    ছোটোটা হওয়ার পরের সপ্তাহেই রতনের প্রোমোশনের খবরটা এসেছিলো দিল্লি থেকে। ওর মাইনে এখন পাঁচ হাজার টাকা হয়েছে। ভগবান মুখ তুলে চেয়েছেন এতদিনে।

    কলকাতায় ভাড়া বাড়িতে বেশ কষ্ট করেই দিন গুজরান করেছে কিরণ। ছোটো দুটো ঘর। তার মধ্যে নবদ্বীপ থেকে ওর বা রতনের বাড়ির লোকজন কেউ কলকাতায় কোনো কাজে এলে উঠতেন কিরনদের কাছেই। নিজেদের জন্য একটু সময় বের করাও ছিল অসম্ভব। এত বড় বাংলোটায় এসে থেকে মনটা খুশি খুশি হয়ে রয়েছে কিরনের - ডোডোটা খেলার প্রচুর জায়গা পাবে!

    কাল সকালে একবার ডোডোকে নিয়ে এখানকার সেন্ট্রাল স্কুলটায় যেতে হবে। কেজি টু তে পড়ার কথা এখন ওর। কিন্তু এই ছোট্ট জায়গায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল আর কোথায়! সরাসরি ক্লাস ওয়ানেই ভর্তী করতে হবে। গতকাল রাতে পাশের বাংলো থেকে মিসেস দে এসেছিলেন। উনি বললেন এখানে পশ্চিমবঙ্গের বোর্ডের মতন স্কুলে নতুন ক্লাস জানুয়ারিতে শুরু হয়না। শুরু হয় মার্চে। মিস্টার দে রতনের সাব অর্ডিনেট। ওদের বাংলোটার দিকে একবার তাকালো কিরন - যথেষ্ঠই বড়।

    কলকাতায় এত বড় বাংলোর কথা ভাবাই যায়না। রতন তো পাঁচ বছর ধরে চেষ্টা করে কোয়ার্টারই পায়নি কলকাতায় - সব ভর্তী। অগত্যা ব্যানার্জী পাড়ার ওই খুপড়ি ভাড়া বাড়িই সম্বল। Rা যা পেত, তা দিয়ে কলকাতায় ওর চেয়ে ভালো বাড়ি আর হয় না। তাও ঢাকুরিয়া বলে সস্তায় বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেছিলো। প্রপার কলকাতায় হলে ও টাকায় কিছুই পাওয়া যেত না।
    বারন্দাটার ডানদিকের লনটায় একটা ব্যাডমিন্টন কোর্টও রয়েছে। একবার একটু বাগানটা ভালো করে দেখা যাক। উঠে পড়লো কিরণ।

    পুব দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলোটা। বাংলোর পেছন দিকে দূরগত পাহাড়ের রেখা। ডানদিকে দে সাহেবদের বাংলো। ওদের বাংলোটার গা ঘেঁসে চলে গেছে রাস্তা। রাস্তা টুকু পেরোলেই জঙ্গল। হিংস্র জানোয়ার থাকে না নিশ্চয়ই!

    এখানে এসে যে একজন বাঙালী কে প্রতিবেশী হিসেবে পাওয়া যাবে তা একেবারেই আশা করেনি কিরণ় যাক বাবা‚ একটু প্রাণ খুলে কথা বলা যাবে! নইলে ওই খাতা হ্যায় যাতা হ্যায় করে কতক্ষণ কাটানো যায়! অবশ্য দে সাহেব রা পশ্চিম বঙ্গের বাঙালী নন় সিলেটী় এ অঞ্চলে বাঙালী মাত্রই হয় সিলেটী‚ নয় পূর্ব বঙ্গীয়় মিসেস দে বলেছিলেন় আর বলেছিলেন বাঙালী নাকি এই ছোট্ট জায়গাটাতেও বেশ ভালো সংখ্যায় রয়েছে় দূর্গা পুজো ও হয়় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলো কিরণ়

    বাগানটা রাম সুন্দর সাজিয়েছে। সূর্যমুখী গোলাপ গাঁদা মোরগঝুঁটি ইত্যাদি ফুলে ভরা। পেছন দিকটায় পুরোটাই প্রায় কিচেন গার্ডেন। মাঝে মাঝে পায়ে চলার রাস্তা। বাঁ দিকেও একটা বাংলো। মোটা করে জবা গাছের ঝার দিয়ে টানা ফেন্সিঙ প্রত্যেক দুটো বাংলোর মাঝে। বড় গাছ বলতে পেয়ারা জলপাই আর একটা বিরাট উঁচু গাছ দেখা যাচ্ছে। লাল লাল ফুল গুলো শিমুলের মতন, কিন্তু শিমুল নয়। আর কয়েকটা বেঁটে বেঁটে কলা গাছ। তাতে আবার কলার কাঁদি ঝুলছে! দাঁড়িয়ে থেকে হাত বাড়িয়ে ডোডোও পারবে কলা পাড়তে এ গাছ থেকে!

    একটু দুরে রাম খুপরি দিয়ে গাছের আগার মাটি আলগা করছিলো। ওকে ডাকলো কিরণ। ইয়ে কৌন সা কেলা কা পেড় হ্যায়?
    -ইসে হাতি কোল বোলতা হ্যায় মেমসাব! অহমিয়া মে কেলা কো কোল বোলতা হ্যায়।
    -ইসসে জ্যাদা লম্বা নহি হোগা ইয়ে পেড়?
    -নহি মেমসাব! ইসকা উঁচাই তো বস ইতনিহি হ্যায়!

    সবজির মধ্যে ফুলকপি আলু আর লাউ দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট একটা মাচায় দুটো কচি লাউ। কিন্তু এত ফুলকপি খাবে কে?

    -আচ্ছা ঢ্যাঁড়স হোতা হ্যায় ইঁয়হা?
    -ও কিয়া হোতা হ্যায় মেমসাব?
    - লেডিজ ফিঙ্গার!
    -হাঁ হাঁ, বিলকুল হোতা হ্যায়! উগানা হ্যায় কিয়া?
    -পারবে? তো কাল বীজ পুঁতে দিও।

    দে সাহেবদের বাংলোর দিকে তাকালো কিরণ। ওদের মালিও বাগানে কাজ করছে। বাঁ দিকের বাংলোটা কি খালি? না বোধহয়। কাউকে দেখা যাচ্ছে না যদিও, কিন্তু ফেন্সিঙ টপকে যতটুকু ওদের বাগানটা দেখা যাচ্ছে, তাতে মানুষের আনাগোনার ছাপ স্পষ্ট।

    এত খানি জায়গা, রতনকে বলে নিজেদের বাংলোর পেছনে একটা দোলনা টাঙাবে কিরণ। চটিটা খুলে খালি ঘাসের ওপর দিয়ে হাঁটতে থাকলো ও। খুব আরাম লাগছে। ব্যাডমিন্টন কোর্টটায় আলো লাগানোর ব্যবস্থা আছে রাতে খেলার জন্য।
    রাম ছুটে এল। মেমসাব, জুতা পহন লিজিয়ে। বহুৎ জোঁক হ্যায় ইঁয়হা।
    - ও কিছু হবে না, তুমি যাও।

    অনিচ্ছা সত্ত্বেও নিজের কাজে চলে যায় রাম। আরো কিছুক্ষণ বাগানটায় এলোমেলো ঘুড়ে বারন্দাটায় ফিরে আসে কিরণ। ছোটোটা এখনো ঘুমোচ্ছে় ঘরে ঢোকার আগে পাপোশের পাশে চটিটা খুলতে গিয়ে গিয়ে দেখল বাঁ পাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠল কিরণ। রান্নাঘর থেকে কৈলাশ ছুটে এসেছে। কিয়া হুয়া মেমসাব?

    হাত পা ভয়ে কাঁপছে কিরণের। কোনোমতে শাড়িটা পায়ের পাতার ওপরে সামান্য তুলতেই পায়ের গোছের কাছটায় কালচে লাল রঙের প্রাণীটার দেখা মিলল - রক্ত খেয়ে পুরুষ্ট হয়ে আটকে রয়েছে একটা জোঁক।

    -ডরিয়ে মৎ মেমসাব। ম্যায় অভি আয়া।
    ছুটে চলে যায় কৈলাশ। শরীরে কোনো অস্বস্তি নেই। এতটা রক্ত বেরোলো, কোনো ব্যাথা বেদনাও নেই। কখন ধরলো জোঁকটা?
    রান্নাঘর থেকে হাতে করে একটু নুন নিয়ে এসেছে কৈলাশ। জোঁকটার গায়ে দিতেই কিরণের পা ছেড়ে টুপ করে খসে পড়লো মাটিতে।

    কিরণের

    পর্ব ৩।

    দুপুরেরে দিকটায় অফিসে চাপ একটু কম থাকে। সকালে এসেই পেন্ডিঙ ফাইল গুলো সেরে নেয়ে রতন। তাতে লাঞ্চের পরে একটু রেস্ট হয়ে যায়। বিকেল হতেই আবার ফীল্ডের অনেক ডেটা চলে আসে। সে সব প্রসেস করতে বসতে হয় ওর অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়র মিস্টার দে'র সাথে। বয়স্ক মানুষ। একটু ঢিলে। রাগ হয় রতনের, কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। একে তো বয়সে বড়, তারপরে আবার প্রতিবেশী । বাঙালী। ওর নিজের অবশ্য বাঙালী নিয়ে কোনো মাতামাতি নেই, কিন্তু কিরণের জন্য খুব দরকার ছিলো একজন বাঙালী প্রতিবেশীর। দে বলেছে এখানে নাকি প্রচুর বাঙালী আছে। সিলেটি। দূর্গা পুজো হয়। আসাম পাশে হওয়ার জন্য, চাকরি সূত্রে অনেক বাঙালী আর অসমিয়ার বাস এই নামসাই শহরে। এই অফিসে তো অরুনাচলের ভূমিপুত্র বলতে কেউই নেই প্রায়। রতন নিজে এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়র, দে অ্যাসিসট্যান্ট ইঞ্জিনিয়র আর জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ররা চারজনই উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। তা ছাড়া এই কদিনে শহরটা পায়ে হেঁটে যতটা ঘুরেছে ও, তাতে দেখেছে যে পথে ঘাটে লোকে অসমিয়াটাই বেশি বলে।

    আসলে এই জায়গাটা দেশের মূল ভূখন্ড থেকে এখনো বিচ্ছিন্ন । সংস্কৃতি, ভূগোল, লোকাচার - সবই আলাদা। পড়াশুনার চল তেমন নেই। ভীষণই দূর্গম। এই জায়গাটা পাহাড়ের পাদদেশে, তাই সমতল। কিন্তু রাজ্যটার বেশিরভাগ জায়গাই অগম। দে বলে, এমন সব দুর্ভেদ্য জঙ্গল যে সার্ভেয়াররা অনেক সময়ই খালি হাতে ফিরে আসে। এখনো সাইটে একবারো যায়নি রতন। সবে পনের দিন হল এসেছে। এ মাসের শেষের দিকে যেতে হবে সাইটে। কয়েকটা সাইটে তো হাতির পিঠে করেও যেতে হয়। শুনেই রোমাঞ্চ হয়েছে ওর। স্কুলে পড়ার সময় এই অঞ্চলটাকে নেফা বলে জেনে এসেছে । নর্থ ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি - মূলত পাঁচটা জেলা নিয়ে গঠিত; কামেঙ‚ সুবনসিরি‚ সিয়াং‚ লোহিত আর তিরাপ় আজকাল নতুন নাম হয়েছে অরুণাচল প্রদেশ। দেশের মধ্যে এখানেই সবার আগে পড়ে সূর্যের আলো। সকাল চারটে থেকেই চারিদিক পরিষ্কার হয়ে যায়, এটা দেখেছে রতন। আর সন্ধেও হয় বড্ড তাড়াতাড়ি । বিকেল পাঁচটায়।

    একতলা অফিস। সামনে বাগান। এখানকার সব বাড়িই একতলা। মাথায় টিনের ছাউনি। ইঁটের ব্যবহার ভিত বাদ দিলে, মাটি থেকে কোমর সমান। তার পর থেকে ছাদ অবধি বাঁশের দেওয়াল, ওপর দিয়ে প্লাস্টার করে রঙ করা; ওপর ওপর দেখে কিছুতেই বোঝা যায়না যে দেওয়ালটা ইঁটের নয়। কিছু কিছু বাড়িতো পুরোটাই কাঠের; ভিতের বালাই নেই। শক্ত শক্ত এক মানুষ সমান কাঠের খুঁটির ওপরে দাঁড় করানো গোটা বাড়িটা। উত্তর পুর্বাঞ্চলের এই সমগ্র এলাকাটাই ভূমিকম্প প্রবণ, তাই এহেন সাবধানতা।

    ফাঁকা ফাঁকা ছবির মতন সাজানো শহরটা প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেছে রতনের। নোয়াডীঙ নদীটার পাড়ে অবস্থিত এই ছোট্ট শহর নামসাই। নদীর পাড়েই লেবার দের বস্তি। নদী থেকে একটা সোজা রাস্তা শহরটার মেরুদন্ডের মতন সোজা এগিয়ে গেছে আর মূল রাস্তাটার দুদিক দিয়ে লাম্বার স্পাইনের মতন ঢুকে গেছে অনেক গুলো রাস্তা শহরের অভ্যন্তরে।
    লেবার বস্তির পরে রাস্তাটার ডান দিকে পড়ে একটা শ' মিল। সকালে বিকেলে শহরের লোকে ঘড়ি মেলায় এই শ' মিলের ভোঁ শুনে। মিলটা থেকে সামান্য এগোলেই রাস্তাটার বাঁ দিকে বসে বাজার। কাছে-দুরের গ্রাম গুলো থেকে চাষীরা আসে নিজেদের পসরা নিয়ে। শাক সবজি তো আছেই, সাথে থাকে মাছ মুরগী কচ্ছপ।
    আরো কিছু দূর এগোলে রাস্তাটার বাঁ হাতেই পড়বে একটা ফাঁকা মাঠ- দে বললো ওখানেই হয় দূর্গা পুজো। মাঠটার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে নামসাইয়ের একমাত্র সিনেমা হল। কাঠের তৈরি। সামনে শ্রমিক শ্রেণীর মানুষদের ভিড় লেগে থাকে। সিনেমা হলটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে এলে তিনালি বলে যে জায়গাটায় এসে পড়ে রাস্তাটা, সেটাকে এই শহরটার প্রাণকেন্দ্র বলা চলে। একটা তেমাথার মোড়। নিত্য দিনের সকল ব্যবহার্য জিনিশপত্রের দোকান। সেলুন মিষ্টির দোকান দর্জির দোকান ইত্যাদি নিয়ে মোটামুটি জমজমাট একটা ব্যাপার। মূল রাস্তাটার পেটের কাছে আরেকটা রাস্তা শিব মন্দিরের দিকটা থেকে এসে ইংরাজির ট অক্ষর গঠন করেছে। তাই হয়্ত এই নাম। একটা দায়সারা বাংলা অনুবাদ করলে হয়ত মানেটা ত্রিধারা দাঁড়ায়।
    আর তিনালি ছাড়ালেই দেখা যায়, রাস্তাটার দুদিকের লাম্বার স্পাইন গুলো কে আঁকড়ে গড়ে ওঠা সার্কিট হাউস, সরকারি অফিস, স্থানিয় বিধায়কের বাংলো, ফরেস্ট অফিসারের বাংলো আর অ্যাকাউন্টেন্ট জুনিয়র ইঞ্জিনিয়র ইত্যাদিদের কোয়ার্টার।
    এই কোয়ার্টার গুলো ছোট কিন্তু সকলের কোয়ার্টারের সাথে লাগোয়া বাগান আর কিচেন গার্ডেন। এদের কোয়ার্টার গুলোর পরে লাম্বার স্পাইন গুলো ধরে আরেকটু ভেতর দিকে এগোলে শুরু হয় গ্রুপ ফোর স্টাফেদের কোয়ার্টার। এক কামরার, কিন্তু তাদেরও এক চিলতে জায়গা আছে বাড়ির সাথে লাগোয়া। পাশাপাশি সব একই রকমের বাড়ি, নির্দিষ্ট বাউন্ডারি দেওয়া।
    বড় রাস্তাটা ধরে এবার আরেকটু এগোলে পরে বাঁ হাতে একটা বুদ্ধ মন্দির আর ডান দিকে একটা পুলিশ থানা। পুলিশ থানা পেরোলে পরে আসে এখানকার পাওয়ার স্টেশন আর বুদ্ধ মন্দিরের পর থেকে শুরু হতে থাকে একটা জঙ্গল। জঙ্গলটা এর পর ধীরে ধীরে ঘন হতে হতে রতনদের বাংলো, অফিস ছাড়িয়ে ডোডোদের স্কুলটার সামনে দিয়ে রাস্তাটাকে সাথে নিয়ে চলে যায় নামসাইয়ের সীমানার বাইরে । রাস্তাটার পোশাকী নাম - নামসাই টাউন রোড।
    ডোডোদের স্কুলটা মাঠ, হস্টেল, স্টাফ কোয়ার্টার ইত্যাদি নিয়ে অনেকটা বড়। স্কুলের সীমানা শেষ হলে একটা আসাম অয়েলের পেট্রল পাম্প। পেট্রল পাম্পটাই শহরের শেষ বিন্দু।

    এই অফিসে রতনই সর্বেসর্বা। কলকাতার নিজাম প্যালেসের অফিসে কত লোক। সেখানে রতনকে কেই বা চিনত! সম্মানের সাথে সাথে অবশ্য দায়িত্ব ও বেড়েছে। এখানে উন্নয়ন বলতে কিছুই হয়নি প্রায়। কতদিন এখানে রাখবে জানে না রতন, কিন্তু আশা করা যায় বছর তিনেকের কম নয়। এই সময়টুকুর ভেতরে কতটা কি করতে পারবে জানে না। চেষ্টা তো ও করবেই, কিন্তু দে'র মতন ঢিলা লোককে সাথে নিয়ে খুব একটা ভরসা পাচ্ছে না ও।
    কিরণ অবশ্য ভীষণ খুশি। বিকেল হলেই মিসেস দে'র সাথে গল্পে মাতছে। অন্য পাশের কোয়ার্টায় রোড ওয়ার্কস ডীপার্টপেন্ট বা Rড-র এক ইঞ্জিনিয়র থাকেন। কন্নড়। তবে সারা ভারতে ভালো রাস্তা যা আছে তা একমাত্র ন্যাশানাল হাইওয়ে। আর তা রতনদের ডীপার্টমেন্ট - ড- বানায় । দেশের বাকি রাস্তা গুলো পাতে দেওয়ার মতন নয়!

    কলকাতায় থাকতে একদিন অপুর সাথে খুব তর্ক হয়েছিলো। অপু ওর স্কুলের বন্ধু। শিবপুরেও একসাথে পড়েছে ওরা দুজনে। রতনের সিভিল অপুর মেক্যানিক্যাল। অপু এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমলা। রতন বলেছিলো পশ্চিমবঙ্গের স্টেট হাইওয়ে গুলো সাব স্ট্যান্ডার্ড রাস্তা। অপুর বক্তব্য - তোরা অনেক বেশি ফান্ড পাস। বেশি গুড় ঢাললে মিষ্টি বেশি হবে, এ আর আশ্চর্য কি!

    কিন্তু শুধু টাকা দিয়ে কি রাস্তা হয়! কত ঘাম রক্ত থাকে তাতে। সেটা তো অপুও বোঝে। বাংলার টিরেন তো কোনো চ্যালেঞ্জই নয়! কাশ্মীর বা অরুনাচলে পাহাড় কেটে ন্যাশানাল হাইওয়ে বানানো - এ কি মুখের কথা! এ রকম টিরেনে কাজ করতে গেলে প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হয়। রতনেরো হয়েছে। তখনো ড-তে জয়েন করেনি ও। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনে আছে। সিকিমের লোয়ার লাগইয়াপ হাইডাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ইনস্টলেশন এ গেছে। তাঁবু খাটিয়ে সাইটেই থাকতে হয়। একদিন রাতে প্রচন্ড আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। সকলে তাঁবুর বাইরে এসে দেখলো পাহাড় থেকে পাথরের বড় বড় চাঁই গড়িয়ে পড়ছে সামনের নদীতে। বিস্ময়ের ঘোরে বাকিদের থেকে খানিকটা এগিয়েই গেছিলো রতন। সমানে চলছে পাথর গড়িয়ে পড়া আর কানে তালা লাগানো ওই আওয়াজ। হঠাৎই পাথর গড়ানোর ওই আওয়াজ ভেদ করে রতনের মনে হল পেছন থেকে যেন একটা ডাক ভেসে এল - ঘোওওওষ! নিজের অজান্তেই দু কদম পিছিয়ে এসেছিলো রতন। আর পেছনে যেতেই একটা বড় পাথর এসে পড়েছিলো ওর আগে দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটার ওপরে। মৃত্যুকে ওই প্রথম অত কাছাকাছি দেখেছিলো ও। ছাত্রাবস্থায় একবার ছুটিতে শিবপুরের হস্টেল থেকে নবদ্বীপে ঢুকতে কংগ্রেসের ছেলেরা মাটিতে ফেলে মেরেছিলো ওকে। পার্টি অফিস থেকে মনোরঞ্জন কাকা লোকজন না নিয়ে এলে হয়ত মেরেই ফেলত ওরা সেদিন রতন কে। সেদিন একা হাতে এলোপাথারি মার ফিরিয়ে দিতে দিতে আর চারিদিক থেকে লাঠির বাড়ি খেতে খেতে কিন্তু একবারো ওর মনে হয়নি মরে যাবে। অথচ মাথা ফেটে রক্ত ঝরছিলো ওর।

    অপুর কথা মনে হলেই দুটো ঘটনার কথা মনে পড়ে রতনের। প্রথমটা জয়েন্টের ফর্ম ভরা। রতনের তো ইঞ্জিনিয়ারিঙ পড়ার কোনো ইচ্ছাই ছিলো না। ঘুরতে ঘুরতেই অপুদের বাড়ী গেছিলো সেদিন ও। রতনের জন্য একটা অতিরিক্ত ফর্ম আনিয়ে রেখেছিলো অপু। রতন বলেছিলো, ও ইঞ্জিনিয়ারিঙ পড়বে না। অপু কান দেয়েনি ওর কথায়, বলেছিলো পড়তে হবে না, শুধু ফর্মটা ভরে দে।

    অপু সেদিন জোর করে ফর্মটা না ভরালে রতন আর যাই হোক, ইঞ্জিনিয়ার হতো না। হয়ত কোনো কলেজে ফিজিক্স পড়াতো বা গবেষণা করত, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ার নয়। তবে আখেরে কোনটা যে ভালো, সেটা এখনো পরিষ্কার নয় ওর কাছে।

    দ্বিতীয় ঘটনাটা শিবপুরের। সেকেন্ড, না না, থার্ড ইয়ারের ঘটনা। নাকি সেকেন্ড? বাইশে এপ্রিল। কোঅর্ডিনেশন কমিটি বিরাট মিটিঙ ডেকেছিলো। অপু ধর্মতলায় গেছে মিটিঙ শুনতে। রতনেরো যাওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু গত রাতে ধুম জ্বর আসায় আর যাওয়া হয়নি। সন্ধ্যে অনেক্ষণ গড়িয়ে যওয়ার পরে অপু এসে ঝড়ের মতন ঢুকেছিলো ওর ঘরে। বিদ্ধস্ত। চুল উস্কোখুস্কো, জামা ছিঁড়ে গেছে। সেদিকে অবশ্য খেয়াল নেই অপুর। রতনের খাটে শরীরটাকে ছেড়ে দিতে দিতে অপু বলেছিলো, কানু বাবুরা পার্টি ভেঙে নতুন দল গড়লেন ।

    ক্রমশ
    পর্ব ৪।

    ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে প্রায় শহরের শেষ সীমানায় এসে পৌঁছেছে শোভা। এদিকটায় ধু ধু প্রান্তর। হাইওয়ে ধরে সোজা চলে গেলে বিহার শরীফ। হাইওয়ের উল্টো দিকটা ধরলে বক্তিয়ারপুর পৌঁছোনো যায়। কুড়ি নম্বর জাতীয় সড়ক। আরেকটা জাতীয় সড়ক - চারশো একত্রিশ নম্বর - সেই গঙ্গাবিঘার দিক থেকে এসে কুড়ি নম্বরটার পেট ফুঁড়ে চলে গেছে ধরমপুরের দিকে। রাস্তা দুটোর কাটাকুটি কমবেশি নব্বই ডীগ্রীতে হওয়ার ফলে চারটে কোয়াড্র্যান্ট-এর সৃষ্টি হয়েছে। এই চারটের একটা কোয়াড্র্যান্ট -এর দিকে একটু বেশি মাত্রায় হেলে, সড়ক দুটোর সঙ্গম স্থলে গড়ে উঠেছে এই জনপদ - হরনৌত।

    বিহারের ছোটো মফঃস্বল শহর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে শোভার ফেলে আসা মফঃস্বল নবদ্বীপের মতন, কিছু ক্ষেত্রে আলাদা। অনেকটাই আলাদা। ভাষা আলাদা, মানুষ আলাদা। খাদ্যাভাস বা পরিবেশগত বেশ কিছু মিল থাকলেও, জায়্গাটা অনেকটাই আলাদা। কিন্তু অনেক কিছু আলাদা হওয়া সত্ত্বেও, শহরটার অন্তরাত্মার সাথে কোথায় যেন মিল আছে নবদ্বীপের। জনজীবনের মূল সুরটি যেন অনেকটাই একই তারে বাঁধা দুটো শহরেরই। হয়ত সেভাবে দেখতে গেলে পূর্ব ভারতের সকল মফঃস্বলের জনজীবনের প্রবাহের ভেতরে এই মিল খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু তবু এই নানান অমিলে ঘেরা শহরটার ভেতরে নবদ্বীপের মিল খুঁজে পায় শোভা। মিল খুঁজে দিন কেটে যায় একটা দুটো করে। দিন কেটে গেছে অনেক গুলো। চোদ্দোটা বছর।

    মেঘ করেছে। বৃষ্টি হবে কি? হাইওয়ের পাশের বড় বড় গাছ গুলো ছাড়া আশ্রয় নেওয়ার মতন আর কিছু নেই; কাক ভেজা ভিজতে হবে। অবশ্য ভিজলেই বা কি! অনেকদিন ভেজা হয়না বৃষ্টিতে। আগামীকাল ডিউটি নেই। শ্লথ পায়ে ফেরার রাস্তা ধরলো শোভা।

    ডিউটি না থাকলে বিকেলের দিকে শহরের বাইরের যাওয়ার চারটে রাস্তার মধ্যে যে কোনো একটা ধরে নেয় শোভা, তারপর হাঁটতে থাকে নাক বরাবর। শহর ছাড়ালেই রাস্তার দু দিকে শুরু হয় ধান ক্ষেত বা ধুধু প্রান্তর। মাঝে মাঝে হাইওয়ে ধরে ছুটে যাওয়া ট্রাক গুলো ছাড়া আর কেউ থাকে বিরক্ত করার। নিজের সাথে অনেক কথা বলা যায় এই সময়টা।

    ডিউটি থাকলে অবশ্য অন্য রকম একটা মানসিক স্থিতির ভেতর দিয়ে যায় সারাটা দিন। স্নায়ু তন্ত্রী গুলো থাকে অনেক সজাগ। রুগীদের সেবা সুষ্রুস্বাতে বেশ একরকম কেটে যায় দিনটা।

    ছোটো একটা সরকারি হাসপাতাল। ডক্টর সাব ছাড়া শোভারা তিনজন নার্স। LHV- লেডি হেল্থ ভিজিটর - শোভার পদের পোষাকি নাম। বাবার অনেক আশা ছিলো শোভাকে নিয়ে। লেখাপড়াতে নেহাত মন্দও ছিলো না শোভা। হায়ার সেকেন্ডারিতে হাই সেকেন্ড ডিভিশনে পাশ করেছিলো। পড়াশুনা করতে বরাবর ভালোই লাগতো ওর। বাবা চেয়েছিলো শোভা ফিলসফি অনার্স নিয়ে বিএতে ভর্তি হোক। শোভার নিজেরও পছন্দ ছিলো বিষয়টা কিন্তু বিশ্বনাথের বাড়ী থেকে বিয়ের জন্য আর অপেক্ষা করতে রাজি ছিলো না। তাই ওই সতের বছর বয়সেই বিয়ে হয়ে গেছিলো শোভার। আঠারোতে বর্ষা কোলে এল। শোভা আর বিশ্বনাথের মেয়ে। সেই ছোট্ট বর্ষা সামনের বছর মাধ্যমিক দেবে! শোভাদের সময় মাধ্যমিক ছিলো না। ক্লাস নাইন থেকে স্ট্রীম চেঞ্জ হয়ে যেত। নাইন টেন ইলেভেনের সিলেবাসে হত হায়ার সেকেন্ডারি। আজকাল ক্লাস টেনের পরে স্ট্রীম চেঞ্জ হয়। টেনের পরীক্ষাটাই প্রথম বড় পরীক্ষা। আরেকটা নতুন ক্লাস যোগ হয়েছে - টুয়েলভ। ইলেভেন টুয়েলভ নিয়ে হয় হায়ার সেকেন্ডারি - কলেজে ঢোকার পরীক্ষা।

    বর্ষাটার কথা মনে পড়লে বুকটা ভারি হয়ে আসে। ওই একরত্তি মেয়ে বাবা বা মা - কাউ কেই পেলনা দু বছর বয়সের পর থেকে। দাদু দিদার কাছে মানুষ হচ্ছে সেই কবে থেকে। মাঝে সাঝে নবদ্বীপ গেলে দেখা হয় আর তা না হলে চিঠিতেই মেয়ের কুশল জানে শোভা। তাও মা চিঠি লিখলে। বর্ষা নিজে কখনো চিঠি লেখে না শোভা কে। এক গভীর অভিমান - যা ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে শোভার প্রতি রাগে - চারিত হয়ে চলেছে বর্ষার মনে। এতদুর থেকেও বুঝতে পারে শোভা। ও যে মা!

    বর্ষা আজকে হয়ত বুঝবে না, কিন্তু একদিন ঠিক বুঝবে শোভাকে কোন পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিলো। সেদিন নিশ্চয়ই ক্ষমা করে দেবে বর্ষা নিজের মাকে! করবে না ?

    দু এক ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় লোকালয়ের ভেতরে চলে এসেছে শোভা। এদিকে মাথা বাঁচানোর আশ্রয় পাওয়া যাবে। তবে আজ ভিজবে শোভা। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকলো একই ভাবে। বৃষ্টির ফোঁটা গুলো বাড়তে লেগেছে অল্প অল্প করে। রাস্তায় লোকজনের ভেতরে ব্যস্ততা চোখে পড়ছে, কিন্তু শোভা হেঁটে চলেছে নিরুত্তাপ। আজকাল আর ছোটোখাটো কোনো ঘটনা ওর মনে কোনো তরঙ্গ তোলে না। বা হয়ত সব ঘটনাই আজকাল ওর কাছে ছোটো খাটো। এই পয়ঁত্রিশ বছরেই জীবন আজকে ওর কাছে অনেকটাই ক্লিশে। বাঁধনহারা আনন্দ বা গভীর বিষাদ - দুটোর কোনোটাই আজকাল আর স্পর্শ করতে পারেনা ওর মনকে। মধ্যম লয়ে চলে চলা জীবনটাকে ঘৃণা বা উপভোগ - কোনোটাই করেনা ও। জীবন ওর কাছে আজকে কিছু ডিউটির সমষ্ঠি। সংসারের প্রতি ডিউটি। বাবা মায়ের প্রতি ডিউটি। পেশেন্টদের প্রতি ডিউটি। ডিউটি গুলোকে শুধু ঠিকঠাক পালন করে চলে শোভা। খারাপ লাগেনা ওর। শুধু বাড়ীর মানুষটাকে আরো অনে-ক কিছু দেওয়ার ছিলো - পারলো না- এইটুকুই খারাপ লাগা।

    রাস্তার ধারের মিষ্টির দোকানের সামনে বড় কড়াইতে দুধ জাল দেওয়া হচ্ছে। রাবড়ি তৈরি হবে। দোকানের সামনে অনেকটা এগিয়ে আসা ছাউনিটা কড়াইটাকে বাঁচাচ্ছে বৃষ্টির হাত থেকে। এ রকম বড় বড় কড়াইতে দুধ জাল দিতে শোভা প্রথম দেখে বেনারসে। নবদ্বীপে মিষ্টি তৈরি হয় ময়রার হেঁসেলে, এরকম খোলা আকাশের নিচে নয়।

    বেনারস। ১৯৬৭। ষোলো বছর হয়ে গেল। হায়ার সেকেন্ডারি পরিক্ষা দিয়ে মা আর বড় মামার সাথে শোভাও গেছিলো বিশ্বনাথকে খুঁজতে। বড় মামার শেভ্রলে গাড়ীতে করে প্রথমেই ওরা গেছিলো বেনারস। পুরো রাস্তা মামাই চালিয়েছিলেন গাড়ী। সেই মানুষ আজকে বিছানায় শয্যাশায়ী।

    ষোলো বছর হয়ে গেল তবু আজো সব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে মনে আছে শোভার। বেনারসের অলিতে গলিতে ওরা খুঁজেছিলো গুরুজীকে। কিন্তু অনন্তপ্রকাশ ত্রিবেদি নামটুকু ছাড়া গুরুজী সম্পর্কে আর কিছুই জানতো না ওরা কোনোদিন আর বিশ্বনাথকে বেনারসে কেই বা চিনবে।
    তাই বেনারসে সাত দিন ধরে খুঁজেও গুরুজী বা বিশ্বনাথ - কাউকেই পায়নি ওরা। শোভা তো আশা ছেড়েই দিয়েছিলো। কিন্তু বড়মামা বলেছিলেন, চিরকাল ফরওয়ার্ডে খেলেছি। লাস্ট মিনিট অবধি গোলের চেষ্টা করতাম, একটা লাস্ট চান্স নিয়ে দেখি।
    মণিকর্নিকার দিয়ে গাড়ি চালিয়েছিলো ওরা। গুরুজীর ঘরের দেওয়ালে যে মণিকর্নিকার একটা ছবি টাঙানো থাকতো, সেই তথ্যটা শোভার কাছ থেকে আগেই নিয়েছিলেন মামা। শ্মশানের দিকে গাড়ি যত এগোচ্ছিলো, মড়া পোড়ানোর গন্ধে বমি উঠে আসছিলো শোভার। মামা কিন্তু অবিচল ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। বলেছিলেন, সিক্সথ সেন্স বলছে এখানে কিছু খবর পাওয়া যাবে।

    শ্মশানের বাইরে গাড়িতে শোভা আর মাকে বসিয়ে রেখে মামা গেছিলেন ডোমরাজার সাথে দেখা করতে। ডোমরাজা মণিকর্নিকার ডোমেদের প্রধান। গাড়িতে বসে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো শোভার। মনে হচ্ছিলো - মামা কতক্ষণে ফিরবেন। আধঘন্টার অপেক্ষার পরে দুর থেকে মামার কোট গায়ে দেওয়া লম্বা শরীরটা দেখতে পেয়ে চেপে রাখা উৎকন্ঠা নিঃস্বাস হয়ে বেরিয়ে এসেছিলো শোভার বুকের ভেতর থেকে। গাড়ির দরজাটা খুলতে খুলতে মামা বলেছিলেন - ফর্টি এইটে গ্রীয়ারের সাথে ম্যাচে একটা ফিফটি-ফিফটি বল ছিলো ওদের বক্সের মধ্যে। একটা ফ্লাইঙ হেডের চান্স নিয়েছিলাম। পরের দিন স্টেটসম্যানে পর্যন্ত ছবি বেরিয়েছিলো। বিকেলে এখানে আরেকবার এলে বোঝা যাবে গোলটা হয়েছে কিনা।

    হোটেলে ফিরতে ফিরতে মামা ঘটনাটা খুলে বলেছিলেন। ডোমরাজার কাছ থেকে খবর পাওয়া গেছে - এক বাংগালি লড়কা হর রোজ শাম কো আতা হ্যায় ইঁয়াহা। লম্বী সময় তক বৈঠতা হ্যায়।

    সন্ধেবেলায় যখন বিশ্বনাথকে ওরা দেখতে পেল, তখন ওদের চেয়েও বেশি চমকে উঠেছিলো বিশ্বনাথ। শোভাও কম চমকায়নি। ময়লা জামাকাপড়, অবিন্যস্ত চুল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখে শূণ্যতা। এরকম বিশ্বনাথকে তার আগে কোনোদিন দেখেনি শোভা।
    গুরুজীকে খুঁজতে বিশ্বনাথ বেনারসেই এসেছিলো। খুঁজেও পেয়েছিলো। কিন্তু গুরুজী তারপর দিন দশেকের বেশি বাঁচেননি। ওঁনাকে দাহ করার পর থেকে বিশ্বনাথ রোজ শ্মশানে এসে বসে থাকতো রাত অবধি।

    বিশ্বনাথকে নিয়ে নবদ্বীপে ফেরার সময় শোভার নিজেকে পৃথিবীর সুখিতম মানুষ মনে হয়েছিলো।

    পোস্ট অফিসের কাছে এসে ডানদিকের রাস্তাটা ধরলো শোভা। এই রাস্তাটা হাসপাতালের পেছন দিকটা দিয়ে গিয়ে শোভাদের কোয়ার্টারের সামনে হয়ে সোজা চলে যাবে রেল গেট অবধি। রাস্তার বাতিগুলো কাজ করছে না আজকে। তবে চেনা রাস্তার খানা খন্দও মানুষের চেনা হয়ে যায়।

    কোয়ার্টারের ছোট্ট গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকলো শোভা। এক চিলতে বারন্দায় উঠে দড়জায় কড়া নাড়লো। ভেতরে বাবলুর পড়ার আওয়াজ কানে আসছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আরেকবার কড়া নাড়লো শোভা। দরজা খুলে গেল। ডক্টর সাব হাতে একটা তোয়ালে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।

    -তুরন্ত যা কে সর পোঁছ লো, বরনা বিমার পড়নে মে দের নহি হোগী।

    পর্ব ৫।

    স্কুল থেকে বেড়িয়েই ছুটতে হবে মাস্টার বাড়ী। শেষ পিরিয়ডটা মঞ্জুলিকা'দির ছিলো। উনি আসেননি আজকে স্কুলে, তবু বসিয়ে রেখেছে চুপচাপ। কোনো মানে হয়! এর চাইতে ছুটি দিয়ে দিলে তো পারে! এই স্কুলেই বর্ষার মা এবং মাসিরা সকলে পড়েছে। মঞ্জুলিকা'দি নাকি তখনো পড়াতেন!

    ক্লাসের মেয়েরা যে যার মতন গল্পে মেতেছে। পাশের ক্লাশের থেকে শেফালিকা'দির পড়ানোর শব্দ আসছে। জীবন বিজ্ঞান। বর্ষার জীবন বিজ্ঞান পড়তে ভালো লাগে। সামনের বছর মাধ্যমিক। মাধ্যমিকের পর কী নিয়ে পড়বে তা এখনো ঠিক করে উঠতে পারেনি বর্ষা। সায়েন্স নেবে কি? জীবন বিজ্ঞান ওর খুবই প্রিয় বিষয়। ভৌত বিজ্ঞানটাও মোটের ওপরে ভালোই লাগে ওর; কিন্তু অঙ্ক যে একদমই পারে না বর্ষা! সায়েন্স নিয়ে পড়তে গেলে তো অঙ্ক লাগবে! অবশ্য বায়ো সায়েন্স নিলে অঙ্ক না নিলেও চলবে। কিন্তু উচ্চ-মাধ্যমিকের ফিজিক্সের অঙ্কও কিছু কম কঠিন নয় - ও শুনেছে স্কুলের উঁচু ক্লাসের দিদিদের কাছ থেকে।

    বাংলা পড়তেও বেশ লাগে ওর। কিন্তু মেজমাসি বলে, বাংলা পড়ে চাকরি পাওয়া মুস্কিল। দাদু'র চাকরি আর বেশি দিন নেই। বড়জোর বছর পাঁচেক। তারপর ওকেই দাঁড়াতে হবে মেজমাসি পাশে। মেজমাসির মতন যদি ভূগোল নিয়ে পড়ে বর্ষা! না বাবা, থাক! ভূগোলে মোটামুটি নম্বর পেলেও, ওই সব মৌসুমী বায়ু আর গাঙ্গেয় অববাহিকা ওর মোটেও ভালো লাগে না। আর দাদুর মতন ইংরেজি পড়াতেও পারবে না ও। অঙ্কের মতনই, বর্ষা ইংরেজিতেও কাঁচা।

    কতক্ষণে ছুটির ঘন্টা বাজবে কে জানে! এখান থেকে সেই দণ্ডপাণি তলা অবধি যেতে হবে। মেজোমাসি অবশ্য রিক্সা ভাড়া দিয়ে রেখেছে ওকে, কিন্তু ও হেঁটেই যাবে। সামনের মাসে দাদুর জন্মদিন। হাত খরচের এই সব টুকটাক পয়সা গুলো জমিয়ে দাদুকে একটা আর্টেক্সের পেন কিনে দেবে ও। তা ছাড়া মেজমাসি নিজে হেঁটে ফেরে স্কুল থেকে; সেখানে বর্ষার এ হেন বিবিয়ানা ভালো দেখায় না।

    মেজমাসির জন্য বর্ষার মাঝে মাঝে খুব কষ্ট হয়। সব মাসিদের বিয়ে হয়ে গেছে। সকলে নিজের নিজের স্বামী-সংসার নিয়ে তা একরকম ভালোই আছে। কিন্তু মেজমাসি আজও এই সংসারের জোয়াল বয়ে চলেছে। মেজমাসির ও তো নিজের একটা সংসার হতে পারতো! কিন্তু মেজমাসি অপরের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছে। নিজের বোনের মেয়েকে মানুষ করবে বলে নিজে বিয়ে করলো না। মায়েদের চার বোনের মধ্যে ছোটো মাসি আর মেজমাসিকেই সব চাইতে সুন্দর দেখতে। ছোটোমাসি তাও অরুণাচলে যাওয়ার পর থেকে মোটা হতে শুরু করেছে, কিন্তু মেজমাসির এখনো একহারা ছিপছিপে চেহারা। কোনো পরিচর্যা নেই, তবু গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে! পিঠ ছাপানো লম্বা চুল। মেজমাসি একবার চাইলেই কত ভালো বিয়ে হতে পারতো। এ সব কথা কাউকে বলতে পারেনা বর্ষা, কিন্তু ও বোঝে সবই। বাড়ীতে সকলে মনে করে ও ছোটো। কিন্তু যে মেয়ে দু-বছর বয়স থেকে জানলো না মা-বাবা কি, সে যে মনে মনে আর সকলের চাইতে অ-নেক আগেই বড় হয়ে যায়, এটা ও বোঝাবে কাকে? তা ছাড়া গত বছর থেকে শরীরেও পরিবর্তন এসেছে ওর; নিজেকে তাই জোর করে ছোটো ভেবে বসে থাকতে রাজি নয় বর্ষা। বড় হওয়ার মধ্যে দায়িত্ব পালন করার একটা শর্ত চাপানো থাকে। সেই শর্ত পালনের চাপটা এখন থেকেই অনুভব করতে চায় বর্ষা।

    বর্ষার মায়েরা চার বোন আর এক ভাই। বড় মামা সবার বড়। বড় মাসির বিয়ে হয়েছে গোমোতে; মামাও ওখানেই চাকরি করেন। ছোটো মাসির বিয়ে তো এই নবদ্বীপের রামসিতা পাড়াতেই হয়েছে। তবে বিয়ের পর থেকেই ছোটো মাসিরা নবদ্বীপ ছাড়া। মেসোর বদলির চাকরি। দাদুরা আগে যে বাড়ীটাতে ভাড়া থাকতো, তার উল্টোদিকের ঘোষ বাড়ীর ছেলে রতন কাকুর সাথেই বিয়ে হয়েছে ছোটো মাসির।ছোটোমাসির বিয়ের আগে রতন মেশোমসাইকে কাকুই বলতো বর্ষা। কত বয়স তখন ওর? নয়-দশ হবে।
    দাদুদের আগের বাড়ীটাতে বর্ষা নিজে অবশ্য কোনোদিন থাকেনি । ওই বাড়ীর বাড়ীওয়ালার ছেলেই হচ্ছে বর্ষার বাবা। বাবা-মায়ের বিয়ের কথা বার্তা শুরু হওয়ার আগেই দাদু ওই বাড়ী ছেড়ে দিয়েছিলো।

    মায়ের কথা মনে হলেই একটা বোবা রাগ মাথার তালু থেকে উদ্ভূত হয়ে ক্রমশ সারা শরীরে ছরিয়ে পড়ে ওর ! বর্ষাকে মেজমাসির ঘাড়ে চাপিয়ে নিজে দিব্বি বিহারে গিয়ে বসে আছেন! আবার বলে চিঠি লিখিস না কেন! মরে গেলেও চিঠি লিখবে না বর্ষা! কেন লিখবে? মা হয়ে কোন দায়িত্বটা তুমি পালন করেছো শুনি? কেন থাকতে হবে বর্ষাকে দাদু-দিদা-মেজমাসির গলগ্রহ হয়ে? বর্ষা মনে মনে একরকম মেনেই নিয়েছে যে ও অনাথ। ওর কাছে ওর বাবা-মা এক প্রকার মৃত।

    মা না হয় বিহারে থাকে, কিন্তু ওর বাবা যে নবদ্বীপে থেকেও কোনোদিন ওর সাথে দেখা করে না, এটা ভাবলে নিজেকে দুনিয়ার সব থেকে বড় অভাগিনী বলে মনে হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে মায়ের অর্ধেক ঘেন্নাও করতে পারেনা বর্ষা। হ্যাঁ, বাবা-মা কে ঘেন্নাই করে বর্ষা। আর সারা পৃথিবীতে সব চাইতে বেশি ঘেন্না বর্ষা করে ওর নিজের মাকে।

    "এই বর্ষা, চল তাড়াতাড়ি, মাষ্টারবাড়ী যেতে দেরি হয়ে যাবে।" ওর বন্ধু সোনালী ডাকছে। অর্ধেক মেয়ে ইতিমধ্যে বাইরে ক্লাশের চলে গেছে।

    কখন পড়লো ছুটির ঘন্টা?

    (ক্রমশ)

    পর্ব ৬।

    ডালিম গাছটায় ফল এসেছে। ছোটো ছোটো ডালিম ফলেছে গাছ জুড়ে। আর মাসখানেকের মধ্যেই পেড়ে খাওয়ার মতন হবে ফল গুলো। তবে হনুমানের যা উপদ্রব এখানে, ততদিন ফল গুলো থাকলে হয়! নবদ্বীপে আসা ইস্তক এ জিনিস দেখে আসছেন ছবি - কারোর বাড়ীতে একটু বাগান করার জো নেই! ফুলের গাছ, ফলের গাছ - কিছুই রক্ষা পায় না ওদের হাত থেকে। নতুন বাড়ীটায় আসা ইস্তক এক চিলতে জায়গাটায় কর্তা কিছু না কিছু লাগাতেন নিয়ম করে। কিন্তু ছবির ওসবের প্রতি কোনোদিন কোনো উৎসাহ না থাকায়, কোনোটাই বেশি দিন আগলে রাখা যেত না ওই হনুমান বাহিনীর হাত থেকে। তবে ডালিম গাছটা কি করে যেন বেঁচে গেছিলো। আর যবে থেকে ডোডোটা একটু বড় হয়েছে, তবে থেকেই ছবির নিজের ভেতরেই একটা চাড় এসেছে গাছের ফল গুলো কে হনুমানের হাত থেকে রক্ষা করার। ডোডো নবদ্বীপে এলে ওকে নিজের হাতে গাছটা থেকে ডালিম পেড়ে খাওয়ানোর মধ্যে একটা পরিতৃপ্তি পান ছবি। বাজারে এর চাইতে ভালো ডালিম পাওয়া গেলেও ডোডোকে তা খাইয়ে মন ভরে না ছবির। নিজেদের গাছের ফল বলে কথা। হোক না ভাড়া বাড়ী, কিন্তু গাছটা তো কর্তার নিজের হাতে লাগানো!

    এই সব সেন্টিমেন্ট ছবির আগে কোনোদিন ছিলো না। আসলে ছবির ছোটোবেলাটা অত্যন্ত শহুরে, অত্যন্ত সাহেবি হওয়ার দরুন, কোনোদিন বুঝতে পারেননি "নিজের" গাছের ফল-সবজির স্বাদ কেনো সেরা। বেয়ারা-বাবুর্চি যা সাজিয়ে এনেছে, ভালো লাগলে তাই খেয়েছেন আর না লাগলে ফেলে দিয়েছেন। ভোজ্যের সাথে জিহ্বার অতিরিক্ত মনেরো যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে, তা ধারনা তেই ছিলো না কোনোদিন। কর্তারা পাবনার ভূস্বামী ছিলেন। বিয়ের পরে যে ছ'টি বছর পবনায় ছিলেন, তখন খাবার জিনিষ মাত্রেই নিজেদের এস্টেটের উপজ। দেশভাগের পর থেকে নবদ্বীপেই। তখন শুরুর দিকের কিছু বছর দেখেছিলেন কর্তার হা-হুতাশ - পটল গুলার কোনো স্বাদ নাই, বা শালগেড়িয়ার বড় পুকেরের মতন আর মাছ খাইলাম না! সত্যি বলতে কি, কথা গুলো শুনলে তখন গ্রাম্য-মধ্যবিত্ত আদিখ্যেতা বলেই মনে হত ছবির। কিন্তু এই যে আজ তিনি দুপুরে জেগে আছেন হনুমান তাড়ানোর জন্য, এর মধ্যেও কি সেই একই গ্রাম্য ও মধ্যবিত্ত আদিখ্যেতা নেই?

    তবে বোধহয় গ্রাম্যই হয়ে গেছেন ছবি। বিত্ত তো সেদিনই হারিয়েছেন যেদিন রাতারাতি পাবনা ছেড়ে দুটো সুটকেস নিয়ে নবদ্বীপের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিয়েছিলেন। আর বিয়ের আগের বছর গুলো বাদ দিলে শহরে থাকা আর হয়নি ওঁনার। হিসেব করলে তেতাল্লিশ বছর দাঁড়ায়, যবে থেকে উনি কলকাতা ছাড়া। তেতাল্লিশ বছরের সংসার করা হয়ে গেলো ছবির। বিয়ের পর কলকাতা ছেড়ে পাবনায় থাকতে অসুবিধে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাতে অসম্মান ছিলো না। সাঁইত্রিশ বছর ধরে এই নবদ্বীপের জীবনটা মানিয়ে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু প্রতি পদে গায়ে লেগে থেকেছে অপমান। দারিদ্রের অপমান।

    মধ্যবিত্ত যে আসলে একটা মানসিকতা, একটা জীবনধারার নাম - সে কথা ছবি বুঝেছেন বিয়ের পরে পরেই। স্থাবর অ-স্থাবর সম্পত্তি খুব কম ছিলো না কর্তাদের - হয়ত বা বাপের বাড়ির থেকে বেশি কিছুই ছিলো। কিন্তু চলতি ভাষায় যেটাকে বলে পালিশ; তা ছিলো না। গ্রাম্যতা তো ছিলোই, সৌখিনতার অভাবো বিদ্যমান ছিলো পুরো মাত্রায়। খাওয়া দাওয়া ভিন্ন আর তেমন কোনো বিলাসিতা ছবি দেখেননি শ্বশুর বাড়ীর লোকেদের মধ্যে। কর্তার বই কেনার নেশা বাদ দিলে আর কোনো নেশা ছিলো না। শার্ট ধুতি যা পড়তেন তা সবই শালগেড়িয়া টাউনের বাজার থেকে কিনে আনা। বাড়ীর অন্য লোকেদের তো কথাই নেই! তাঁদের সকালে উঠেই প্রথম চিন্তা - জলখাবারে কি রান্না হবে। ঠাকুর ঘি দিয়া ভালো কইরা লুচি ভাজবা কিন্তু! তা সেই লুচি খেয়ে উঠে আঁচাতে না আঁচাতেই আবার হাঁক ডাক শুরু হয়ে যেত - নিতাইয়ের মা কুমড়া গুলা ডুমো ডুমো কইরা কাটবা আর মাছের পেটি বাইর কোইরো না! সে খাবারটা হজম হতে না হতেই আরেক চিন্তা - রাত্রে পাঁঠার মাংস রান্ধন করলে কেমন হয়? কর্তার কথা অবশ্য আলাদা। সারা জীবন জ্ঞান চর্চায় কাটানোর ফলেই হয়ত একটা সহজাত পরিমিতি বোধ ওঁনার জীবনধারায় দেখতে পাওয়া যায়। তখনো দেখা যেত। আসলে মানুষটা আলাদা মাটি দিয়ে তৈরি।
    খাওয়া দাওয়া বাদ দিলে বাড়ীর লোকেদের আলোচনায় খালি ফিরে ফিরে আসতো জমি জমার কথা - এবার ধানের ফলন আগের বারের থিক্যাও ভালো হইবো বা পাট গাছ গুলায় আঁশ কম।

    যদিও পাবনায় থাকতে সংসারে কোনো কায়িক শ্রম দান করতে হয়নি ছবিকে, কিন্তু সর্বক্ষণ এহেন স্থুল সাংসারিক কথাবার্তায় দম বন্ধ হয়ে আসতো ওঁর। রাত্রে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে গ্র্যান্ড পিয়ানোটা বাজাতেন একা একা। ফিরে যেতে চাইতেন নিজের ফেলে আসা অতীতের কাছে। কার্সিয়াঙের সিস্টার ভেরনিকার কাছে, রবি কাকার কাছে, মিসেস ও'ব্রায়ানের কাছে। ছবির নিজের জীবনের প্রিয়তম মানুষ বাবা। সেই বাবার কাছে কিছুতেই ফিরতেন চাইতেন না ছবি। পাবনার ওই ডানা ভাঙা ছবিকে দেখলে বাবা কষ্টই পেতেন।
    আর কারুর কাছে কি ফিরে যেতে চাইতেন ছবি? না। তার কাছে আর যে ফেরা যায় না।

    দেখতে দেখতে প্রায় চোদ্দোটা বছর কেটে গেলো এই বাড়ীতে, তবু এটাকে এখনো মনে মনে "নতুন বাড়ী" বলেই ডাকেন ছবি। বিশ্বনাথের সাথে শোভার ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর থেকেই এই বাড়ীতে চলে আসা। শোভা আর বিশ্বনাথের বিয়ের পরেই অবশ্য ছবি চলে আসতে চেয়েছিলেন আগের বাড়ীটা ছেড়ে - বেয়াই বাড়ীতে ভাড়া থাকলে সম্মান থাকে না - কিন্তু কর্তার মাথায় এ সকল সাংসারিক সমীকরন কোনোদিনই ঢোকে না। সেদিনও ঢোকে নি।
    আজো কি ঢুকেছে? এই যে সুধাটার বিয়ে হলোনা এখনো, তা নিয়ে ওঁনার কোনো তাপ উত্তাপ আছে বলে তো মনে হয়না। ছবির রাগ হয়, কিন্তু কর্তার ওপরে রাগ প্রকাশ করার কোনো অধিকার ছবির নেই। যে মানুষটাকে খুশি করতে পারেননি, তার ওপরে রাগ করবেন কোন অধিকারে? এতগুলো বছরে কর্তার কোনো অভিব্যক্তিতেও প্রকাশ হয়নি যে উনি অখুশি; ওঁনার স্বভাবই সেরকম নয়। কিন্তু ছবি নিজে তো জানেন! মানুষটাকে সম্মান করেছেন চিরকাল, কিন্তু ভালোবাসতে যে পারেননি, সে কথা নিজের থেকে গোপন করবেন কী ভাবে?

    সন্তানদের জন্যই বা কী করতে পেরেছেন ছবি? শোভাটাকে নিজের মনের মতন করে মানুষ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারলেন কোথায়? লেখাপড়া শেষ করার আগেই বিয়ে করলো। অল্প বয়সে সন্তানের জন্ম দিলো। বিয়েটাও ভেঙে গেলো। তবে শোভার চেয়েও সুধাটার কথা ভাবলে বড় কষ্ট হয় ছবির। শোভা নিজের জীবনের পথ নিজে বেছে নিয়েছে। সে অধিকার ওর ছিলো, আছে। কিন্তু সুধা? ঊনচল্লিশ বছর বয়সেও যে ও অনূঢ়া, সে লজ্জা কি ছবির নয়? সুধার মতন গুণী মেয়ের জীবনে কেউ এলো না, এটা মেনে নিতে পারেন না ছবি। আসলে সুধাই আসতে দেয়নি কাউকে ওর কাছে। জানেন ছবি। ভেবেছে বাবা-মা'কে দেখবে কে? বিয়ের পর থেকেই খোকন গোমোতে। তার নিজের সংসার আছে। কর্তার রিটায়ারমেন্টেরও বিশেষ দেরি নেই। এ সব ভেবেই মেয়েটা বিয়েই করলো না। মুখে না বললেও ছবি জানেন এটাই আসল কারন। মা হিসেবে এর চেয়ে বেশি লজ্জার আর কিছু কি থাকতে পারে ছবির কাছে? ঈশ্বর বোধহয় ওঁনার কপালে নানাবিধ লজ্জাই লিখেছেন। ভালোবাসা হারানোর লজ্জা, দারিদ্রের লজ্জা, সন্তানের প্রতি কর্তব্য পালন করতে না পারার লজ্জা।

    লিপি আর কিরণ অবশ্য নিজেদের জীবনে সুখি। ভালো বিয়ে হয়েছে দু'জনারই। এইটুকুই বা কম কি! এইটুকুই যদি ঈশ্বর ছবির কপালে লিখে থাকেন, তাই সই।

    বিকেল হয়ে এল। কর্তার ফেরার সময় হয়ে এসেছে। সুধার ও। চায়ের জলটা উনুনে চড়িয়ে দিতে উঠে পড়লেন ছবি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৬ অক্টোবর ২০১৭ | ২৮৭৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    শপথ  - Prolay Adhikary
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ঝর্না | 24.97.103.54 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০৪:৩৩61722
  • দারুন...
  • Du | 182.56.6.172 (*) | ০১ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:১০61723
  • আগ্রহ নিয়ে পড়ছি।
  • de | 69.185.236.52 (*) | ০২ নভেম্বর ২০১৭ ০৯:৩২61724
  • ভালো হচ্ছে। এতো চরিত্র - দেরী করবেন না পরের পর্ব দিতে - তাহলে ভুলে যাবো -
  • kaushik | 125.113.187.2 (*) | ০২ নভেম্বর ২০১৭ ১০:১২61725
  • ঝর্ণা, দু, দে - সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

    দে,
    ওটাই একটা বড় সমস্যা - বড্ড সময় লাগে। জানি এতে পাঠকের ধৈর্যচ্যূতি হয়, কিন্তু ....

    একটু শিবের গীত - এই লেখাটা আগের একটা লেখার দ্বিতীয় ভাগ। আগের লেখাটা - "একটা অ-সমাপ্ত গল্প" নামে এখানে দিয়েছিলাম। পড়ে মতামত দিলে ভালো লাগবে।
  • Ela | 116.203.136.191 (*) | ০২ নভেম্বর ২০১৭ ১১:৩৮61727
  • পড়েছিলাম আগের লেখাটা আর খুব ভালও লেগেছিল। এটাও পড়ছি।
  • Suhasini | 213.99.208.2 (*) | ০৩ নভেম্বর ২০১৭ ০৪:৪৫61728
  • পড়ছি। আগের লেখাটাও ভালো লেগেছিলো।
  • kaushik | 76.160.188.88 (*) | ০৪ নভেম্বর ২০১৭ ০৬:১৭61729
  • দে, এলা, সুহাসিনি

    অনেক ধন্যবাদ। আশা করছি, কিছুদিনের মধ্যে নতুন পর্ব দিতে পারবো। ভালো থাকবেন।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন