এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • তাই আমি শেফালির, কিছুতেই বকুলের নয় (পর্ব - ১০)

    Sukanta Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৫ নভেম্বর ২০১৩ | ১৮১৫ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • বাঁশের তীর ধনুক দিয়ে পাখি মারার পর্যায়ের বয়সটা সবে শেষ করে মোড়লদের বাগানে নেউল কামারের তৈরী কাঠের ব্যাট নিয়ে ক্রিকেট খেলায় ঢুকেছি আর ঠিক তখনই প্রথম ঝটকাটা লাগল। সেই তখনও পর্যন্ত আমার মূল কৌতূহল সাধারণত খাদ্য বস্তুর ভিতরেই সীমাবদ্ধ ছিল। আনন্দমার্গ স্কুল থেকে সুবল কাকা সাইকেলে করে বাড়ি নিয়ে আসার সময় খালের মিষ্টির দোকানে পেটা সন্দেশ আমার বরাদ্দ ছিল। তৎকালীন বয়েসে আমি বেশীর ভাগ ভাবনাটাই কেন্দ্রীভূত করেছিলাম এটা বের করার জন্য যে পেটা সন্দেশ এ্যাতো ভালো খেতে হয় কেন! জ্যাঠা কলকাতা থেকে হালখাতার সময় মহাজনের দোকান থেকে ভ্যারাইটিস নামকরা দোকানের মিষ্টি আনলেও – খালের দোকানের পেটা সন্দেশের কাছে তারা বেমালুম হেরে যেত।

    খাদ্য বস্তুর বাইরে আমাকে প্রাথমিক পার্থিব ধাক্কা দেয় ওই মোড়লদের বাগানই। তখনও আমাদের গ্রামে রাম যাত্রা হত। রাম যাত্রা মানে চার পাঁচ জনের একটা দল গ্রামে এসে প্রায় একমাস যাবত থাকত – এবং রোজ সন্ধ্যাবেলা রামায়ণের অংশ বিশেষ অভিনীত হত। এই রামযাত্রার মূল দ্রষ্টব্যের বিষয় ছিল মালা ডাকা। গ্রাম বাসীরা অনেকে লজেন্সের মালা, বিস্কুটের মালা তৈরী করে রাম যাত্রার টিমকে উপহার দিত। বলাই বাহুল্য সেই মালাগুলি সবই সিম্বলিক ছিল – মালা পড়ে অভিনয়ের পর সেই মালার ডাক হত। ডাক অর্থে নীলাম – এ কোন পিকাসো বা ভ্যান গগের ছবি নয়, নয় নিউটনের ছেড়ে যাওয়া চপ্পল বা আইনষ্টাইনের নস্যির ডিবে – এ ছিল ছড়া কেটে মালা ডাকা ও নিখাদ আনন্দ। এক টাকা থেকে ডাক শুরু হত – পাঁচ, দশ, কুড়ি টাকার মধ্যেই ডাকাডাকি খতম। আমলা ডেকে আমাদের চোখে তখন হিরো ছিল জেলেদের মনু ও গপেশ। এরা দুজনাই মেমারীতে মাছের আড়তে ব্যবসা করত – তাই বেলা দশটার মধ্যেই বিজনেস খতম। ১১টার লোকালে ব্যাক করে নিমো ভারত সেবক সমাজে বেলা ১ট পর্যন্ত ক্যারাম খেলা। স্নান করে, ভাত খেয়ে হালকা ন্যাপ নিয়ে বিকেল ৩ টে থেকে বামুনদের খামারে গুলি বা ভ্যাঁটা খেলা। পড়ন্ত বিকেলে খেলা শেষ হলে স্নান-টান করে গায়ে আতর লাগিয়ে স্টেশন চত্ত্বরে ঘুরে বেড়ানো। দূর্দান্ত ঈর্শনীয় রুটিন ছিল তাদের – গুরুজনেরা বলত কাঁচা পয়সা – আমরা পোলাপানরা স্পর্শকাতর ছিলাম না – তাই হরি, আলম সহ মনু ও গপেশও আমাদের যৌবনের হিরো ছিল। রাম যাত্রের দল চিরকালই গ্রামে এসে বামুনদের বাইরের বৈঠকখানার ঘর দুটিতে থাকত। রাম আমাদের ক্রিকেট খেলায় পরামর্শ দিত, লক্ষণ চা খেতে খেতে রোয়াকে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকত – লক্ষ্য করত কিনা বলতে পারব না। আর সীতা রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত – মাঝে মাঝে কলতলায় জল নিতে এলে আমাদের কাউকেই টিপকলটা টিপে দিতে বলত – আমাদের মধ্যে তখন সীতার কাছাকাছি যাবার জন্য হুরোহুরি – সে এক স্বর্ণযুগ ছিল।

    “নীল একটি ছেলে-ভুলানো ছড়ার মতো দিনগুলি যায়
    হাওয়ার ভিতর ভাসতে-ভাসতে যেমন গন্ধ
    মনের মধ্যে যেমন-তেমন এক রমণী মুখচ্ছবির
    খোলা জানালা, দুয়ার বন্ধ”।

    এমনই একদিন আমরা মোড়লদের বাগানে খেলছি – আর মোড়লদের নারকেল গাছে ডাব পাড়তে এসেছে খদ্দেরে। ডাব সব গাছের নীচে জড়ো করে সাইকেলে তোলা হবে কাঁদি সমেত। লক্ষণ আশে পাশে থাকায় একটা ডাব চায় ওদের কাছ থেকে। ডাব বিক্রেতারা একটা ডাব লক্ষণকে দিলে, লক্ষণ আরও একটা ডাব ফ্রীতে পাবার জন্য রিকোয়েষ্ট করতে থাকে। ওরা বিনা পয়সায় আর ডাব দেবে না – সীতা এসে সীতাকেও দিলে না। লক্ষণ আর সীতা তখনও ডাব চেয়ে অনুনয় করছে!

    এতোদিন পর লিখে বোঝাতে পারব না – কিন্তু এই দৃশ্য বহুদিন আমাকে হন্ট করেছে – লক্ষণ আর সীতা সামান্য ডাবের জন্য অনুনয় করছে, তাও ডাব বিক্রেতা রাস্তাপারের লুঙ্গি পরা বিশুকে – এটা জাষ্ট মেনে নিতে পারি নি। সেই আমার প্রথম পার্থিব শক। এক ঝটকায় যেন আমি অনেকটা বড় হয়ে গেলাম! রাম যাত্রা থেকে পরে দেখেছি প্রকৃত যাত্রার অন্দরমহল। দেখেছি শেফালি নামে যে মেয়েটি ফিমেলের রোল করতে আসত আমাদের গ্রামের যাত্রায় – তার সাথে ঘোষ বাপির রোমান্টিক সম্পর্ক। বাপির বউ সামনের সারি থেকে দেখছে শেফালির গলায় প্রয়োজনের থেকে বেশী সময় নিয়ে পড়ানো হচ্ছে হার – অনাবশ্যক জোরে টেনে নেওয়া শেফালি চলে আসছে বুকের কাছে। এ গুলি আমাদের কাছে ঝটকা ছিল না – বরং ছিল বড় হয়ে ওঠার সোপান। জানি না যাত্রার শেষে ঘোষ বাপি শেফালির হলুদ বোঁটা দেখতে পেয়েছিল কিনা (পিন্টুর খবর অনুযায়ী এর অনেক আগেই রিহার্সালের সময় হলুদ বোঁটা আর কাঁটা সবই দেখা হয়ে গিয়েছিল) – তবে তার পর বকুল আর কোনদিন আমাদের গ্রামে ফিমেলের রোল করতে আসে নি।

    “অনেক শেফালি আমি দেখিয়াছি, এ-জীবন আর
    দেখিতে চাহি না কোন শেফালিরে, শেফালি দেখুক
    ঝরিতে – ঝরিতে পারে দেখে নিক অপাঙ্গে আমায়
    আমি কোনদিন কিছু দেখিব না, ডুবিয়া মরিব।

    তাই আমি শেফালির, কিছুতেই বকুলের নয়
    শেফালি ঘড়িতে ঝরে গত মুহুর্তের স্তব্ধ কাঁটা
    হলুদ বোঁটার জোরে করে দেয় চলচ্ছক্তিময়”

    তারও অনেক পরে, আমাদের যখন ক্লাশ নাইন – তখন এসেছিল এক রাজনীতি ঘেঁসা ঝটকা। আমরা যে সময়ে কৈশোর যাপন করছিলাম তখন কাস্তে-হাতুরি-তারা চিহ্নের উপর সন্ধিগ্ধতা প্রকাশের কোন কারণই আসে নি। তেল দেওয়া ধান ঝাড়া মেশিনের মত লাল দূর্গ বর্ধমান জেলা ও তদোপরি গাঢ়তর লাল মেমারী এলাকা সরগর করে চলছিল। মেমারী স্কুলের শিক্ষক সমিতি লাল – নিমো গ্রামের পঞ্চায়েত লাল, মেমারী পৌরসভাও লাল – দোলের সময়ের থেকেও আমাদের দোকানে লাল আবীর বেশী বিক্রি হত ভোট জাতীয় মহোৎসবগুলির সময়।

    সেই লাল রঙের অপার মহিমায় আমার মননে হঠাৎ চিরফাট ধরল এক সকালে। সেই – যে সকালে কলঘরের তরুণের বীচি টিপে ধরল পালেদের কার্ত্তিক। এই সেই ঝটকাই – সকাল বেলা দোতলার ঘরে পড়াশোনা করছি এমন সময় পাড়ার উত্তর-পূর্ব কোণে বিশাল গোলযোগের শব্দ এল। এমন নয় যে সকাল বেলা আমাদের ওখানে গোলযোগ হত না – বরঙ উলটো – সকালের কাঁচা রোদে ও বিকেলে্র কনে দেখা আলো কলহের জন্য প্রকৃষ্ট ছিল। যারা ঝগড়া করছে তাদের জন্য তো বটেই, যারা দর্শক তাদের জন্যও। যাই হোক উল্লেখিত ঝগড়াটি কান টেনে নিয়েছিল কারণ মিলিত চিৎকারের মধ্যেও একটি হাই-পিচ্‌ টোন অচেনা। শব্দের উৎস সন্ধানে গিয়ে দেখা গেল তরুণ হাউমাউ করে চিৎকার করছে। আরো কাছে গিয়ে ডিটেলেস্‌-এ প্রত্যক্ষ হল লিটারেলি তরুন কাটা পাঁঠার মত ছট-ফট করছে – কারণ কার্ত্তিক পাল লুঙ্গির ভিতর হাত ঢুকিয়ে তরুণের বীচিদুটিকে সজোরে চেপে ধরেছে এবং উপর্যপুরি নিষ্পেশন করছে।

    “তোমার হাত যে ধরেইছিলাম তাই পারি নি জানতে
    এই দেশে বসতি করে শান্তি শান্তি শান্তি

    বেশ কিছুদিন সময় ছিলো – সুদুঃসময় ভাঙতে
    গড়তে কিছু, গড়নপেটন – তার নামই তো কান্তি?
    এ সেই নিশ্চেতনের দেশের শুরু না সংক্রান্তি –
    তোমার হাত যে ধরেইছিলাম তাই পারি নি জানতে” ।।

    তরুণ কার্তিক পালের হাত ধরেছিল জরুর, কিন্তু নিষ্পেশন জনিত ব্যাথা তাকে মালুম পেতে দেয় নি যে হাত আদৌ ধরা হয়েছিল। পরের শান্তি বজায় রাখতে উৎসর্গীকৃত প্রাণ তরুণের পার্থীব দেহে নেমে এসেছিল অশান্তি – দুঃসময়ের শুরু।

    এই দৃশ্যের তাৎপর্য বুঝতে হলে তরুণের ব্যাকগ্রাউণ্ড সমন্ধে সম্যক ধারণা থেকে দরকার। তরুণ আমাদের এলাকার প্রবল প্রতাপান্বিত সি পি এম নেতাদের মধ্যে একজন – অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ছিল হাত বাঁকা মহানন্দ, তাতারপুরের গোপালমাষ্টার, রসুলপুরের বাবুল স্যার, বাউরি পাড়ার বসু ও বাগদিদের ভোমলা। এখানে ভোমলাকে বাগদি বলা কোন অসম্মানের অভিপ্রায়ে নয় – আমাদের গ্রামে বেশ কিছু সংখ্যক ভোমলা থাকায় এই রূপ আইডেন্টিফিকেশনের সাহায্য নিতে হচ্ছিল। অন্যান্য ভোমলারা ছিল – সার ভোমলা, কোচো-র ভাই ভোমলা ইত্যাদি।

    ব্যাপার হইল বাসু ও ভোমলা দিনের বেলা আমাদের জমিতে কাজ করত – অনেক পরের দিকে ভোমলা অবশ্য মাঠের কাজ ছেড়ে বাগান নিতে আরম্ভ করে। বাগান অর্থে মূলত আমবাগান – ভোমলা আমবাগানের ডাক নিত ও বাগান পাহারা হেতু খড়ের কুঁড়েতে রাত্রি যাপন। ফাঁকা মাঠে খড়ের কুঁড়েতে রাতে একা থাকা সত্ত্বেও ভোমলার চরিত্র নিয়ে কথা উঠে নি গ্রামেতে যেটা একটা বিরাট অ্যাচিভমেন্ট হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে সেই খড়ের কুঁড়ে সঠিক ব্যবহার করেছিল বাগানের মালিক শৈলেন – এই শৈলেনের বিচার, জরিমানা, বিচারক, পুনঃ-বিচার বিষয়ক গল্প অন্য সময়।

    বাসু অবশ্য শেষের দিকে একটু দালাল টাইপের হয়ে গিয়েছিল। সাম্য তত্ত্বের পরিহাসে দিনের বেলা কাজের মনিবের পঞ্চায়েত টাইপের মিমাংসাগুলিতে বসু ও ভোমলার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত। যে ঝামেলাগুলির জন্য মীমাংসা দরকার হত সেগুলি সাধারণত জমি কেন্দ্রিক, কৃষি কেন্দ্রিক ও অবৈধ সম্পর্ক কেন্দ্রিকই হত। সেই সময় নিমো ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান ছিল তরুণ। ওদের বাড়িটিকে কলঘড় কেন বলা হত তার সঠিক ব্যখ্যা আমি পাই নি – তবে প্রচলিত তত্ত্ব ছিল যে তরুণদের বাবা পঞ্চায়েতের পিওন জাতীয় কাজগুলি করত। কাউকে ডেকে পাঠানোর দরকার হলে তাকে ‘কল’ পাঠানো হত। সেই ‘কল’ দেবার কাজ থেকেই কলঘর। তরুণরা তিন ভাই তিনটি পৃথক পার্টি করত – তরুণ সিপিএম, সমীর কংগ্রেস ও ছোট ভাই ফরোয়ার্ড ব্লক। অর্থাৎ সব পার্টি থেকেই ছাঁকা অ্যাডভান্টাজগুলি কলঘর ভোগ করত।

    সেই তরুণের বীচিতে হাত দেবার সাহস মনে হয় কেবলমাত্র কার্তিক পালেরই ছিল। তিন মেয়ে ছাড়া কার্ত্তিক পাল প্রকৃত অর্থেই সর্বহারা ছিল আর তার প্রধান টাইম পাস ছিল নিজের বউয়ের সাথে ঝগড়া। সেই ঝগড়া কোন সফিস্টিকেটেড বাতানুবাদ নয় – নতুন করে ডিকেশনারী লিখতে পারার মত স্টক শব্দ ব্যবহৃত হত সেই পর্যায়ে। অগুনতি বার সেই ঝগড়ার মিমাংসা করার চেষ্টা হয়েছে পঞ্চায়েত ডেকে যার মধ্যমনি থাকত তরুণ। তরুণ সাধারণত পাজামা বা প্যান্ট পড়েই বিচার সভায় আসত শিবতলায়। সেই দিন সকালে কার্তিকদের ঝগড়াটা একটু ভায়োলেন্ট হয়ে যাবার জন্য তরুণের জরুরী ডাক পরে। ঘুম থেকে সবে ওঠা তরুণ লুঙ্গি পাল্টাবার সময় না পেয়ে ঝগড়াস্থলে হাজির হয়। কিঞ্চিত বার্তালাপের পর ফেড আপ হয়ে কার্ত্তিক তরুণের বীচি টিপে ধরে। তার আগে পর্যন্ত আমাদের কাছে তরুণ ছিল সিম্বল – লাল পার্টির, ক্ষমতার, ছোঁয়ার বাইরে থাকা আজ্ঞাকারী কর্তার। এর বিরুদ্ধে যে কথা বলা যায় এটা অকল্পনীয় ছিল। তাই বলছিলাম তরুণের বীচির উপর হামলা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন বা টের্গার্টের উপর হামলা এই সবের মতই যুগান্তকারী ছিল। বদ্ধ ধারণা ভেঙে বেরিয়ে নতুন কিছু পাবার স্বপ্ন। আরও প্রায় দেড় দশক লেগে গিয়েছিল পরিবর্তন দেখতে – তরুণের জাগয়া নিয়েছিল কেবিনের অশোকের মায়ের সাথে পালানো পোড় খাওয়া ধান্দাবাজ।

    তবে তরুণ এবং তার সহকর্মী বন্ধু মহাদেব প্রকৃত অর্থেই সাম্যবাদে বিশ্বাস করত, অন্ততঃ তারুণ্যের চঞ্চলতার সময়টায়। সেই যৌবনবেলা আমি প্রত্যক্ষ করি নি, কিন্তু যৌবন সায়াহ্নে মহাদেব ঘোষ গত হলে তার বউয়ের ভার তরুণ নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিল। এবং আশ্চর্য জনক ভাবে আমাদের গ্রাম এই ব্যাপারে প্রায় নীরব ছিল। আমি মহাদেব ঘোষের বউকেও যৌবনে দেখি নি – যৌবন সায়াহ্নে দেখেছি। তাকে যদি কারো পছন্দ হয়ে থাকে, তা হলে সেই টেষ্টকে ব্যাখ্যা করার একটাই শব্দ আছে – অন্যরকম।

    “তোমার বুক দেখলে আমার মেদিনীপুরের কথা মনে পড়ে
    দেশ – গ্রাম নয় – সুদ্দু ঐ মেদিনী শব্দটা
    নাম বদলে মাঝে মাঝে ‘মেদিনীদুপুর’ করতেও ইচ্ছে হয় –
    দুপুর – মানে দুখানা, দুখানা মানে দু-বুক।।।”

    ওই বুক দেখে তরুণের কি মনে পড়ত জানা নেই, তবে সুজলা সুফলা বর্ধমান যে মনে পড়বে না সেটা স্বাভাবিক ছিল। মেদিনীপুর মনে পড়লেও আশ্চর্য – বরং রুক্ষ বীরভূম মনে পড়লে সেটা কাছাকাছি হত। আর মেদিনীদুপুর ওরা আকছারই করত – মহাদেব ঘোষের মাটির বাড়িতে দুপুর যাপন। আমরা যা মহাদেব ঘোষের বউকে দেখেচি তাতে করে তার বুক দুই-খান না একখান, অস্তিত্ত্ব আছে কি না – সেটা তরুণকে কষ্ট করেই খুঁজে নিতে হত - ইহা গ্যারান্টি।

    তরুণ নিজে বিয়ে করে নি – দিনের বেলা সে পার্টির কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও রাতের বেলা ভাঙা সাইকেল নিয়ে ঘোষপাড়ার মহাদেবের বাড়িতেই ফিরত। এই বিষয়ে আর একটু ডিপে গেলে প্রায় হিন্দী সিনেমার গল্প উঠে আসবে। মহাদেবের সাকুল্যে দুটি মাটির ঘর চিল – ছেলে অশোক বড় হলে একটি ঘরে সে একাকী – অন্য ঘরে নাতি সমেত মহাদেবের বউ। এক মেয়ে অকালে গত হলে তার ছেলে ভার নিতে হয়েছিল – যখন ছোট ছিল এটা কোন প্রবলেমেটিক ব্যাপার ছিল না। কিন্তু বড় হলে একঘরে তরুণ-দিদিমা এবং তার নিজের থাকাটা ফ্রয়ডীয় ব্যাখার উর্দ্ধে এক সঙ্কট তৈরী করেছিল। ফলে তার ঠাঁই হত পাশের বারান্দায় ছাগল রাখার ঘেরা জায়গাটায়। প্রকৃতি নিজের ব্যালেন্স ঢেকে আনে এর হাইপোথিসিস আরো একবার প্রমান হয়েছিল এইখানে। মহাদেবের নাতিকে আমরা রিপোর্টার বলতাম – মেন্টাল প্রবলেম ছিল তার – সেই হেতু তরুণ-দিদিমা জনিত ঘটনা মাথায় ঢোকানোর মত ক্ষমতা ও সময় কোনটাই রিপোর্টারের ছিল না। আমরা বিষ্মিত ছিলাম অশোকের নির্লিপ্ততায়। তরুণ কেবল মাত্র পার্টি করলেও মহাদেব ঘোষ রাইটার্সে ক্লার্কের চাকুরী পেয়েছিল। মহাদেব অকালে প্রয়াত হলে সেই চাকুরী হস্তান্তরিত হয় ছেলে অশোকের কাছে। আমাদের কৈশোরে সেই অশোক প্রেম করে এক সহকর্মীকে বিয়ে করে আনল। এই বার আমাদের গ্রাম জেগে উঠল – কারন অশোক সিম্পল বিয়ে নয় – বাছুর সমেত গাই ঢোকালো গ্রামে।

    (ক্রমশঃ)

    [এখানে ব্যবহৃত কবিতা পঙতিগুলি আমার এক প্রিয় কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় -এর লেখা বিভিন্ন কবিতা থেকে নেওয়া। কবিতাগুলির নাম যথাক্রমে –

    নীল একটি ছেলে ভুলানো ছড়া, চর্তুদশপদী কবিতাবলী – ৩১, তোমার হাত, মজা হোক – ভারি মজা হোক]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৫ নভেম্বর ২০১৩ | ১৮১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • bd | 227.164.76.12 (*) | ০৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৫:৫৫45577
  • খুব ভালো লাগল। আগের পর্ব গুলির লিন্ক যদি কেউ দ্যান.....
  • ন্যাড়া | 172.233.205.42 (*) | ০৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৬:২১45575
  • অসম্ভব ভাল লাগে এনার লেখা পড়তে। কন্টেন্ট, স্টাইল সব মিলিয়ে দুর্দান্ত।
  • ঐশিক | 213.200.33.67 (*) | ০৬ নভেম্বর ২০১৩ ০৮:৪০45576
  • সুকান্তদা,
    খুব ভালো লাগলো লেখাটা, আগের পর্ব গুলো একটু পড়তে পারলে আরো ভালো লাগত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন