এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো  শরৎ ২০২১

  • প্রাকার পরিখা

    মলয় রায়চৌধুরী
    গপ্পো | ৩১ অক্টোবর ২০২১ | ১৫৩২৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)
  • স্কেচ ৬ | পানুর মেটামরফোসিস | চালচিত্রের চালচলন | কেমন আছে ওরা? | চাও করুণানয়নে | পুত্রার্থে | সই | আপনি যেখানেই থাকুন | কিসসা গুলবদনী | জনৈক আবহ ও অন্যান্যরা | গুচ্ছ কবিতা | অমল রোদ্দুর হয়ে গেছে | ইনি আর উনির গপ্পো | দুগ্গি এল | দুর্গারূপে সীতা, ভিন্নরূপে সীতা | প্রিয় অসুখ | শল্লকী আর খলিলের আম্মার বৃত্তান্ত | রানার ছুটেছে তাই | বিসর্জনের চিত্রকলা | কল্পপ্রেম | লম্বা হাত খাটো হাত | কেন চেয়ে আছো গো মা, মুখ পানে! | ছোট্ট পরীর জন্মদিন | জাপানি পুতুল | আধাঁরে আলোঃ শারদ সাহিত্য | ইন্দুলেখার ইতিকথা | মুর্শিদাবাদ | এই দিনগুলি | জ্বিন | জোনাকি এবং ডোরেমিরা | বাসায় চুরি | বিশ্বকর্মার গুপ্তঘট | দুর্গাপূজা - দুটি প্রবন্ধকথা | টিউশন | ফেরা | মায়া | বন্দী | মেয়েদের কিছু একটা হয়েছে | কেল্লা নিজামত | সীতারাম | দড়াবাজি | মায়াফুলগাছ | যখন শ্যামের দ্বারে | কুয়াশা মানুষের লেখা | সময় হয়েছে নতুন খবর আনার | মিষ্টি চেখে ওড়িশার ডোকরা শিল্পীদের গ্রামে | নিশি | পথ | প্রাকার পরিখা | নীল সাইদার গল্প | তুষারাচ্ছন্ন ইউরোপে শ্রীমতী ফ্রয়ডেনরাইখের আশ্চর্য বিষাদ | দীপাবলীর বারান্দায় | কলমি শুশনি | এক অনিকেত সন্ধ্যা | গৌরি বিলের বৃত্তান্ত | আনন্দগামী বাস থেকে | মুয়াজ্জিনকে চিরকুট | দেবীর সাজে সৌরভ গোস্বামী | শরৎ ২০২১
    মলয় রায়চৌধুরীর সম্পূর্ণ উপন্যাস। আকারে ছোটো হলেও ভারে নয়।
    ্মো
    এক

              যোনি কাকে বলে জানিস?

              জানি-জানি, বললো অমিত, রোজ একঘেয়ে লেকচার শুনে-শুনে ওসব আংরেজি তাকিয়া-কালাম মুখস্হ হয়ে গেছে, ইসকুলে যদি রোজ কেউ অমন লেকচার দিতো তাহলে দেখতে, সব সাবজেক্টে চৌয়া-ছক্কা পেটাতুম।

              বল তাহলে, কাকে যোনি বলে?




              ওফ অনেক আংরেজি ঝালরবাজি, মানে-ফানে জানি না, সব ক্রান্তিকারী ঘসিটারাম, বলছি শোনো, অ্যালিয়েনেশান, অ্যাণ্টাগনিজম, অ্যারিসট্রোক্র্যাসি, বারটার, বুর্জোয়াজি, বুরোক্র্যাসি, ক্যাপিটাল, ক্যাপিটালিজম, ক্লাস, কমোডিফিকেশান, কমোডিটি, কমোডিটি ফেটিশ, কনজাম্পশান, প্রোডাকশান, কনট্রাডিকশান, ক্রেডিট, ডেমোক্র্যাসি, ডায়ালেকটিকাল মেটেরিয়ালিজম, ডায়ালেকটিকস, ডিভিজন অফ লেবার, ইকুইভ্যালেন্ট ফর্ম, এমপিরিসিজম, এক্সচেঞ্জ ভ্যালু, ইউজ ভ্যালু, ফল্স কনশাসনেস, ফিউডাল সোসায়টি, গ্লোবালাইজেশান, হেজিমনি, ইনটারেস্ট, আইডিওলজি, লেবার পাওয়ার, লুম্পেন প্রলেতারিয়েত, ল্যাণ্ড, মারকেট, মেটেরিয়ালিজম, মিনস অব প্রোডাকশান, মিডল ক্লাস, মোড অফ প্রোডাকশান, মানি, নেশান স্টেট, পিজ্যানট্রি, পেটি বুর্জোয়া, পলিটিকাল ইকোনমি, প্রোলেতারিয়েত, প্রপারটি, প্রফিট, রেন্ট, র‌্যাডিকাল ডেমোক্র্যাসি, সোশালিজম, স্টেট, সাবলেশান, সুপারস্ট্রাকচার, সারপ্লাস ভ্যালু, সিনথেসিস, প্র্যাকসিস, ট্রেড ইউনিয়ান, ট্রাইবাল সোসায়টি, ইউজুরি, ইউটিলিটেরিয়ানিজম, ইউটিলিটি, ইউটোপিয়া, ওয়েজ লেবার।

              এক নাগাড়ে বলে দম ফুরিয়ে গিয়েছিল অমিতের, কাতলা মাছের মতন জলের ওপরে ওঠার ঢঙে শ্বাস নিয়ে বলল, কী, ঠিক বলিনি? আরে সব তাকিয়া-কালামের মানে ওই একই, যাহাঁ সঠিয়া তাহাঁ ঘটিয়া, যোনি বলো আর আলুকাবলির ঘুগনি বলো।

              কিস্যু জানিস না তাহলে, অবশ্য শব্দ না জানলেও চলে, কাজটা জানলেই হলো, বললে কমরেড ডিবি বা ডাক্তার বর্মণ বা ডাক্তার ঘোষ।

              ধুলো-পড়া কালো পলিথিন-তেরপল দিয়ে তৈরি, ঘনসবুজ জংলি বাঁশঝোপের ঝিরিঝিরি আড়ালে ঘেরা, মাথায় বিকেলের রোদমাখা শাল শিশু খয়ের গাছের  মাঝখানে সামান্য ফাঁকা জায়গায়, তাঁর ভ্রাম্যমাণ ডাক্তারখানায় , ওষুধ আর আঘাতের রক্তের ফেলে যাওয়া ভিনিভিনি গন্ধে, জঙ্গলের বুনো প্রকৃতিকে  অস্বীকার করার প্রয়াসের মাঝে, আসন্ন গোধূলির  ঝিঁঝিপুরুষের ডাকে উতরোল প্রায়ান্ধকারে তাঁর সামনের ফোল্ডিং চেয়ারে তাঁর স্ত্রীর গর্ভজাত ছেলেকে বসিয়ে, প্রশ্নটা করলেন ডাক্তার ঘোষ, যাঁকে সকলে ডাক্তার বর্মণ বা কমরেড ডিবি বলে ডাকে, কেননা ওঁর স্ত্রীর নাম মানসী বর্মণ বা কমরেড জ্যোতি।

              প্রশ্নটা করার জন্য বেশ কিছুকাল যাবত নিজেকে তৈরি করেছে কমরেড ডিবি, মানে ডাক্তার, নিজের সঙ্গে তর্কাতর্কি করে নির্ণয়টা নিয়েছে, আর এখন, আজকেই সুযোগ, মনে হল, কেননা ওর স্ত্রীর গর্ভের ছেলের তাঁবু-গার্জেন, যে কিনা ছেলেটার বাবা হিসাবে ক্রান্তিকারীদের মধ্যে প্রচারিত, মানে কমরেড দীপক, প্রকৃত নাম অতনু চক্রবর্তী, পাশের তাঁবুতে যাঁর ক্রান্তিকারী দপ্তর, অতনু আর তার প্রেমিকা কমরেড জ্যোতি, মানে ডাক্তার বর্মণের স্ত্রী মানসী বর্মণ, দুজনেই কাছাকাছি বিধাবৌড়িয়া  গ্রামে সিআরপিএফ-এর গুলিতে আহত তরুণ-তরুণীদের জমায়েতে গিয়েছে, কিছুক্ষণেই হয়তো এসে পড়বে।

              নিজেকে স্তোক দেয় ডাক্তার, মানে, কমরেড ডিবি : সকলেই জীবনে অন্তত একটা মিথ্যাকে আশ্রয় করে বাঁচে, অনেকে একাধিক মিথ্যাকে আঁকড়ে থাকে জীবনভর, আমি না-হয় একটাই।

             দোহারা, ফর্সা, সামান্য টাক, বাইফোকাল চশমা, অলিভ-মুফতি বোতামখোলা শার্ট, গেঞ্জি নেই,  ডাক্তার পরে আছেন লুঙ্গি, যার রঙ বাগবাজার ক্লাবের দেয়ালে গত বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়ে আঁকা ব্রাজিলের পরাজিত জার্সির মতন, কালবৈশাখীর ফ্রি-কিক ভলি খেয়ে ফ্যাকাশে। নিজেকে নিজে নিঃশব্দে শুনিয়ে বললে, এখানে আর থাকা যাবে না, এ আমার স্বপ্নের ক্রান্তিকারী রাস্তা নয়, কেউই কোথাও পৌঁছোচ্ছে না। অবিচারের মধ্যে দিয়ে অবিচারের বিরুদ্ধে লড়া যায় না।

              ব্যাস, ওইটুকুই জানিস। ওটুকু তো যোনির রস রে, ক্রান্তির ঝর্ণা। তুই তো আসল অরগ্যাজমের কথা বললি না? শেখায়নি তোর সোকলড মা-বাপ? অরগ্যাজম জানিস তো, নাকি? রিয়াল ক্রান্তি? শরীর আর মনের সুনামি,  জিগ্যেস করলে ডাক্তার।

              না, জানি না, সুনামি শুনেছি কোথাও, এখন যা আংরেজি বললুম, তা কনকদুর্গা শিখিয়েছে, বলেছে মুখস্হ করে রাখ, পরে বুঝতে পারলে আওড়াস।  অ্যালুমিনিয়ামের নড়বড়ে চেয়ারে নড়াচড়ার মাধ্যমে অপ্রস্তুতভাব লুকোবার চেষ্টা করে, ডান হাতের মধ্যমার নখ খেতে-খেতে বলল অমিত বর্মণ যে, ওর বোন মানে প্রেমিকা ইতুকে ছত্তিশগড়ের রায়পুরে, নারায়ণপুর যাবার নৌকরওয়ালা বাসে তুলে দিয়ে, সেখানেই একটা আয়নাভাঙা সস্তা সেলুনে ন্যাড়া হয়ে গিয়েছিল; চুলদাড়ি আর রাখবে না ঠিক করেছে।

              ইতু পাছা অব্দি দীর্ঘ কোঁকড়াটে  চুল ববছাঁট করিয়ে নিলে, বাড়ি ছেড়ে উধাও হবার সময়ে নিজের খাটে চুলের কাটা আংশ দুজনের একসঙ্গে বাড়ি থেকে কেটে পড়ার গর্বোদ্ধত ইঙ্গিত হিসাবে ফেলে রেখে। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাসের তাপ দিয়ে, অমিতই কেটে দিয়েছিল ইতুর চুল, কেননা ইতু বলেছিল, যা আমার গর্বের, তা কেটে বাদ দিয়ে দে, যতটা পারা যায় গর্বহীন করে তুলি বেঁচে থাকাকে।

              জানিস না কী রে! জোয়ান ছেলে, সমাজে ক্রান্তি আনার জন্য রোজ কতো পাঁয়তাড়া ভাঁজছিস, আর অরগ্যাজম কাকে বলে জানিস না? ডাক্তার ঘোষ ওরফে ডাক্তার বর্মণ, যে প্রায় প্রাগৈতিহাসিক আড়ম্বরহীনতায় বসবাস করে, বসে আছে  অ্যালুমিনিয়ামের ফোল্ডিং চেয়ারে,  জেনেশুনে, যে কমরেড জ্যোতি লুঙ্গি পরা বরদাস্ত করতে পারে  না; সামনে এক ফুট চওড়া দু ফিট লম্বা হালকা অ্যালুমিনিয়াম টেবিল, সেটাও ফোল্ডিং, ফোল্ডিং খাটে টাঙানো মশারি চব্বিশঘন্টা পাতা, খাটে একটা চাদর, বালিশ নেই। 

              কিছুক্ষণের নোটিসেই পুরো পাত্তাড়ি গুটিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে তেরপল খাটাবার সুব্যবস্হা হিসাবে সব কিছুই ফোল্ডিং আর অস্হায়ী, ডাক্তার  নিজেও নিজেকে পাটে পাট ভাঁজ-করা মানুষ বলে মনে করে, অস্হায়ী। প্রতিদিন উঠে পড়ে ঘষাকাচ ভোরে, তবু তখনই মশারি থেকে বেরোয় না। তাঁবুতে সৌরলন্ঠন আর ব্যাটারিলন্ঠন দুইই  আছে, পোকাদের অনাহুত উড়াল আর ডানাসঙ্গীতের ভয়ে জ্বালে না সচরাচর।

              বাংলা কথনি? না সংস্কৃত? হিন্দিতে কী? নখ খাওয়া মুলতুবি রেখে জানতে চাইল অমিত।

              হিন্দি আর সংস্কৃততে ইয়োনি আর বাংলায় যোনি, সেই যোনি যখন মুগ্ধ হয় তখন তাকে বলে অরগ্যাজম, আসল ক্রান্তি, ডিকটেটরশিপ অব দি রেজিং ফ্লেশ, বুঝলি, বললে ডাক্তার, ওছাড়া বাদবাকি ক্রান্তি ফালতু, বুকনির বাতাসা, অরগ্যাজমের বাংলা নেই, হয়তো বাৎসায়নে সংস্কৃততে আছে, ঠিক জানি না।

              নাঃ, কোনো ক্লাসের বইতেই কথনিটা ছিল না; ক্লাসমেটরাও কখনও বলাবলি করেনি; কী করেই বা জানব! তাছাড়া আমাকে তো সবচে রদ্দি স্কুলে পাঠানো হয়েছিল : গাঁঠরিচোর টিচাররা ঘুষ দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছে, নিজের ভাই হলেও ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না, নিজেরাই কিছু জানে না, সব রগড়ঘস, টিউশানির চকরলস কেটে বেড়ায়। কোনো টিচারের মুখেও শুনিনি কথাটা। বাংলা তো আর পড়ানো হয় না কোনো স্কুলে; সংস্কৃতের টিচার নেই। হিন্দি টিচার আছে,  সেও কখনও ইয়োনি কথাটা ব্যবহার করেনি।

              টিচাররা অমন শব্দ বলে না, বুঝলি, টিচাররা কি ছাত্রদের ক্রান্তির কথা শেখায় কখনো, গোরু হতে শেখায়, চাকরি-বাকরি করে লিটার-লিটার দুধ দেবে, জেইই, আইআইটি, আইআইএম, রাজস্হানি কোচিং, ধাঁআআআ, নিউ ইয়র্ক। যোনি, অরগ্যাজম যে ধরণের ক্রান্তিকারী বুলি, যাকে তুই কথনি বলছিস, দশ-বারো বছর বয়স থেকে বন্ধুবান্ধবরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে। টেবিলের ওপর  বাইফোকাল চশমা খুলে রাখতে রাখতে বললে ডাক্তার ঘোষ, মানে কমরেড ডিবি;  কণ্ঠস্বরে স্বনিত হল এক ভিন্ন সুর, নিজেকে বললে, চশমাটা বদলানো দরকার, কিন্তু কী-ই বা হবে বদলে, বদলাতে হলে চোখ দেখাতে হবে, হয়তো নাম ভাঁড়িয়ে, দূরের কোনো রাজ্যে গিয়ে, সে অনেক হ্যাঙ্গাম, যা  পোষায় না। প্লাসটিক লেন্সের চশমা, স্ক্র্যাচ পড়ে লেন্সদুটো নিজেরাই  মায়োপিয়ায় আক্রান্ত।

              ডাক্তার, কমরেড ডিবি, এখন হাত দিয়ে তাকায়, চোখের প্রয়োজন হয় না, হাত দিয়ে নাড়ি পরখ, হাত দিয়ে ওষুধের বড়ি বের করা, হাত দিয়ে ঘায়েল শরীর থেকে বুলেট বের করা, হাত দিয়ে ব্যান্ডেজ  বাঁধা। হাত যে নারীকে আদরও করতে পারে তা ভুলে গেছে হাতেরা। হাতদুটো ওর মতনই হয়ে গেছে, রুটিনবাঁধা। নতুন ওষুধের জন্য মেডিকাল ম্যাগাজিন পড়া জরুরি বলে কমরেডদের আদেশ দিয়ে ভারতীয় মেডিকাল জার্নাল আনায়, ইংরেজি জানে এমন কাউকে পড়তে বলে আর শুনে-শুনে মনে রাখে, কিংবা নিজেই পড়ে নেয়, এখানে তো মেডিকাল রিপ্রেজেনটেটিভ এসে ওষুধের বাখান করে ডাক্তারকে এটা-সেটা ঘুষ দিয়ে যাবে না, জার্নাল পড়া হয়ে গেলে ওষুধের জেনেরিক নামগুলো স্মৃতির আলমারিতে তুলে রাখে, তারপর ম্যাগাজিনগুলো সমবায়িক রান্নার উনোনে পোড়াতে পাঠিয়ে দেয়; ওষুধের কেবল স্ট্রিপ আনায়, বাক্সে প্যাক করা নয়, কাগজে মোড়া।

              টেবিলের ওপর পড়ে আছে আগের বছরের মেডগেট টুডে আর ইনডিয়ান জার্নাল অফ মেডিকাল সায়েন্সের সংখ্যা, অতিব্যবহারে ময়লা, পাতাগুলো নিজেরাই কোনাগুলো ভাঁজ করে আরাম করছে। সকাল থেকে দুপুরের খাওয়ার রুটিন বাদে  বেশির ভাগ সময় মশারিতে ঢুকে শুয়ে থাকে, ম্যাগাজিন পড়ে, রোগীরা এলে বা কোনো বেয়ারফুট কমরেড কিছু জানতে এলে মশারির ভেতর থেকেই নির্দেশ দেয়, কেবল ঘায়েল কমরেড এলে ওর দৌড়ঝাঁপ হয় দেখার মতন, বিশেষ করে সে যদি বুলেটফোঁড় হয়, যেন ওর কাছে পাঠাবার জন্যই আধামিলিট্রি জওয়ানরা রাইফেল চালিয়েছিল।

              মানুষকে বাঁচিয়ে আবার জীবনের লাথি খেতে পাঠানোর চেয়ে বড়ো প্রাপ্তি আর নেই, মনে করে কমরেড ডিবি, যাকে কমরেড বললে মনে-মনে চটে যায় বটে, কিন্তু মৃদূ শ্লেষহাসিতে মনের অন্ধকার দমিয়ে রাখে লোকটা।

              বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আমি কোনো ক্লাসেই পাইনি, পাড়াতেও কেউ বন্ধু করতে চায়নি; নিজের বাড়িতেই বোলতিবন্ধ ফেকলু, ওরা তো দেখতেই পেতো, বন্ধু করবে কেন, তাই ভিতরঘুন্না হয়ে বড়ো হয়েছি! বন্ধু বলতে শুধু ইতু। চেয়ারে দুই পা তুলে হাঁটু মুড়ে বসতে বসতে বলল অমিত।

              নামিয়ে রাখলে অমিতের পা নাচাতে ইচ্ছা করে। সামনে যে বসে আছে সে মনে করে ওর পায়ে ব্যথা, ইতুও তাই মনে করে বলত, এই ডাফার, পা নাচাসনি, পা ব্যথা করছে তো পা তুলে বোস। পা নাচানোটা ওর অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার উপায়। পা নাচাতে নাচাতে জিন্সের ঘসটানি খেয়ে বসন্তকালের হাওয়ায় ওর লিঙ্গ দাঁড়াতে আরম্ভ করেছিল বলে থামিয়ে চেপে বসল। বলে উঠলো, দাঁড়াও দাঁড়াও, মনে পড়েছে, একটা কাগজে লিখে নিয়ে মুখস্হ করেছিলুম, এক্ষুনি মনে পড়ে গেল। বলব?

              ডাক্তার হাই তুলতে তুলতে বললেন, বল, দেখি অরগ্যাজম বলতে কী বোঝায়, জানিস কিনা।

              অমিত যতক্ষণ নিজের মগজে মুখস্হ করছিল, ডাক্তার একটা বাংলা লিফলেট টেবিল থেকে তুলে নাকের সঙ্গে সাঁটিয়ে, পড়া আরম্ভ করলে, বোধহয় ওষুধের মোড়কে এসেছিল, চোখ কুঁচকে, টাকে হাত বোলাতে বোলাতে,  পড়তে বেশ ভালোই লাগছিল, সরেস লিখেছে, লাথি খাচ্ছে আর লিখে যাচ্ছে ব্যাটা বাঙালির দল, লেখা ছাড়া আর তো কিছু করার নেই, “সম্প্রতি রাজ্যে রামনবমীতে তরোয়াল নিয়ে শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বলা হচ্ছে, ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অস্ত্র নিয়ে মিছিল বাঙালি সংস্কৃতি নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধংদেহী মেজাজে নগরের মিছিল শাসক থেকে আম জনতাকে বিস্মিতই করেনি, পাল্টা কিছু করতে শাসক দলকে প্ররোচিতও করেছে। রাজ্যের শাসক দল রামনবমীর পাল্টা হনুমান জয়ন্তী পালন করেছে। এলাকায় এলাকায় হনুমানের প্রতিকৃতি নিয়ে শোভাযাত্রাও করেছে। মিছিল ও পাল্টা মিছিলে ভক্তিরসের তুলনায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিদ্বেষের বীজ বপন করা হয়েছে। এই সংস্কৃতি কোনো কালেই ধর্মগুরুদের সংস্কৃতি নয়, এমনকি বাঙালিদেরও সংস্কৃতি নয়। কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর ‘শ্রীরাম পাঁচালী’তে বিষ্ণুর অবতার হলেও সেখানে বীররসের প্রাধান্য ছিল না। ছিল ভক্তিরসের প্রাধান্য। কৃত্তিবাসের কাব্যের মূল সুরের সঙ্গে বৈশাখের গরমে টিনের প্যাঙপ্যাঙে তরোয়াল হাতে ছেলে-মেয়ে বুড়ো-বুড়িদের মিছিল খাপ খায় না। কৃত্তিবাস ওঝার যাঁরা অনুগামী তাঁদের সংস্কৃতির সঙ্গেও এই সংস্কৃতি মেলে না। অথচ কলকাতা মহানগরীতে রামনবমী উপলক্ষে অস্ত্র-মিছিলে কাতারে-কাতারে মানুষজন নগর দাপিয়ে বেড়ালো। কপালে লাল তেলক কেটে, কাঁধে চাদর, হাতে চিৎপুর অপেরার তরোয়াল,  আর মুখে ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে রোদ্দুরের ভিড়কে  মাতালো। বিদগ্ধজন থেকে সচেতন আমজনতা বলছেন, এটি বাংলার সংস্কৃতি নয়, এই সংস্কৃতি উত্তর ভারতের সংস্কৃতি; বিদগ্ধজন মানে যারা অণ্ডকোষ চুলকোয় আর টিভির তর্কাতর্কিতে জ্ঞান দেয়। মিছিলে বাঙালিদের সংখ্যাধিক্য ছিল না। অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। মিছিলে ওড়ানো ঝান্ডাগুলোতেও বাংলা হরফে কিছু লেখা ছিল না, যা লেখা ছিল তা কেবল নাগরী হরফে। সেগুলো সংস্কৃত না হিন্দিতে লেখা তা বোঝার উপায় ছিল না। প্রশ্ন উঠেছে, এই ব্যাপক জনসমাগম কী ভাবে ঘটল? এঁরা নিশ্চয়ই পাশের রাজ্য উড়িষ্যা বা অন্ধ্রপ্রদেশ-তেলেঙ্গানা বা উত্তরপ্রদেশ থেকে আসেনি। এঁরা সকলেই এই পশ্চিমবঙ্গের। এঁরা বাঙালি হোন বা নাই হোন, পশ্চিমবঙ্গেরই নাগরিক। আমাদের এই রাজ্যে বাঙালি সংস্কৃতির ঘোর সংকট; বাঙালি বলতে যে কী বোঝায় তা বাঙালি নিজেই ভুলে গেছে। বিশেষ করে আমাদের রাজধানী যে কলকাতা, সারা রাজ্যের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কর্মস্হল, খোদ সেখানেই বাঙালিরা এখন সংখ্যালঘু। উনিশ শতকের মতন মনীষীরা আর জন্মান না এই শহরে, শুধু মাস্তান গুন্ডা আর দলদাসরা জন্মায়। কেউ কেউ হয়তো ‘আমরা বাঙালি’ প্রাদেশিকতাবোধে উষ্মা প্রকাশ করতেই পারেন। কিন্তু বর্তমান সংস্কৃতি সুকুমার রায়ের ভাষায় ‘হাঁসজারু’ সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে। কলকাতার চারিদিক ধরলে মধ্য কলকাতা বরাবরই  জারজ সংস্কৃতির কেন্দ্র। এর মধ্যে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রভাব কিছুটা আছে। উত্তর কলকাতা বা পূর্ব কলকাতা, বিশেষ করে সল্টলেক, এখন হিন্দিভাষী অবাঙালিদের প্রাধান্য, যা ঘটেছে বাঙালি মধ্যবিত্তের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে। বিধান রায় বাঙালিদের জন্য সল্ট লেক কলোনি তৈরি করেছিলেন; বাঙালিরা সেখানে জমি কিনে বাড়ি তুলেছিল, তারপর সেই লোভী বাঙালিরা একে একে মারোয়াড়িদের বিক্রি করে শহরতলির দিকে পেছিয়ে গেছে। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ বামপন্হীদের প্ররোচনায় বাঙালি উদ্বাস্তুরা দখল করে বইয়ের আর নানা জিনিসের দোকান দিয়েছিল; তারা সেসব দোকান অবাঙালিদের বিক্রি করে একইভাবে শহরতলিতে পেছিয়ে গেছে। বাকি রইলো দক্ষিণ কলকাতা, যেখানে উচ্ছিন্ন হিন্দু বাঙালির জীবন সংগ্রামের মূল জায়গা। এককালে মুসলমানরা এই অঞ্চলে চাষবাস করতো, তাদের সরিয়ে, দাঙ্গায় মেরে ফেলে, অজস্র উদ্বাস্তু কলোনি গড়া হলো, সেসব নিয়ে প্রচুর কাঁদো-কাঁদো বেস্টসেলার লেখা হয়েছে। এক সময়ে দক্ষিণ কলকাতার উপনিবেশগুলো থেকে সংসদীয় বামপন্হীরা তাঁদের আন্দোলনের রসদ পেয়েছিলেন, তাঁরা জোর খাটিয়ে আর ভয় দেখিয়ে এই উদ্বাস্তুদের আন্দামানে যেতে দেননি, নয়তো আন্দামান আজ বাঙালি উপনিবেশ হয়ে উঠতো। সেই সমস্ত সংগ্রামের জায়গাও মুছে ফেলে প্রাক্তন উদ্বাস্তুরা জমিবাড়ি অবাঙালিদের বেচে শহরতলিতে পেছিয়ে যাচ্ছেন। বৃহত্তর কলকাতা শহরে এখনও বাঙালিদের প্রাধান্য থাকলেও, দুই প্রজন্ম জুড়ে বাঙালির পোলারা এখন বাংরেজি ও বাংদি -- বাংলা-হিন্দি মেশানো --- সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, হিন্দি ফিল্ম দেখার জন্য হুড়োহুড়ি করে মরে, বেরিয়ে এসে সালমান শাহরুখ আমির খানের সংলাপ ভাঁজে, আনোয়ার শা রোড আর মেটিয়াবুরুজ তো নবাবদের হারেমের বংশধরদের গুণ্ডামিতে থরহরি, তাদের ধারণা তাদের রক্তে বইছে টিপু সুলতান আর ওয়াজেদ আলি শাহের রক্ত। মহরমের সময়ে পাকিস্তানি ধরণের পতাকা উড়িয়ে তাজিয়া বের করে ঝাঁপাই ঝোড়ে। বড়বাজারে বরাবরই মারোয়াড়ি আর গুজরাটিদের রবরবা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সময় থেকে। হাওড়া শহর দখল করে নিয়েছে বিহারি আর উত্তরপ্রদেশের মাফিয়া, তাদের বিরোধিতা করলেই মুঙ্গরের দিশি পিস্তলের গুলি। সুতরাং বাংলা সংস্কৃতির অবশিষ্টাংশ সত্যিই কি পারবে এই ‘হাঁসজারু’ সংস্কৃতি রুখতে? দেড়শো বছর আগে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখে গিয়েছিলেন, ‘হুতোম পেঁচার নকশা’। রামনবমী বা রামলীলা সম্পর্কে যা বিতর্ক থাকুক না কেন, তা যে বাঙালি সংস্কৃতি নয়, তা তিনিও জানিয়েছেন। রামলীলা সম্পর্কে সেই কবে তিনি বলে গিয়েছেন, এ সংস্কৃতি আমাদের সংস্কৃতি নয়। বাঙালি সংস্কৃতি জানতে হলে আজও ‘হুতোম পেঁচার নকশা’ পড়া দরকার।”

              পড়া শেষ হলে, যে শব্দটা নিজের মনে নিজেকে শোনাবে ভেবেছিল ডাক্তার, তা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে মুখ দিয়ে বেশ জোরেই উচ্চারিত হলো, “মাদারচোদ, গান্ডু কা জনা”।

              অমিত চমকে বলে উঠলো, আরে, আমাকে গালাগাল দিচ্ছ নাকি গো? মায়ের সঙ্গে ওইসব করেছিলে বলে আমাকেই নোংরা করে দিচ্ছ!

              ডাক্তার বললে, না রে, তোকে বলিনি, ওই চুতিয়াগুলোকে বলছি, যাদের পোঁদে সোভিয়েত দেশ এককালে রুবল গুঁজে দিতো, তারপরে চীন কিছুদিন লাখ লাখ রেমনিমবি ইয়ান গুঁজেছে ওদের পোঁদে, তারপর মার্কিন কোম্পানির মারোয়াড়ি এজেন্টরা গুঁজেছে, গুঁজেই চলেছে, চটকলগুলোর লালবাতি জ্বেলে, বাঞ্চোৎরা পোঁদ ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ডুবিয়ে দিল পশ্চিমবাংলাকে, ময়দানে র‌্যালির‌্যালা করে ভাড়াটে পাবলিক এনে,  আর লাউডস্পিকার লাগিয়ে নিজের নুনু নিজের পোঁদে  ; আর কিচ্ছু হবে না, তোর মা-বাপের ক্রান্তিও পাঁক থেকে তুলে আনতে পারবে না। যাকগে, তোর মনে পড়েছে কি অরগ্যাজম কাকে বলে?

              হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়ে গেছে, কনকদুর্গা আংরেজি মুখস্হ করতে শিখিয়েছে, ওই যে কমরেড কুনকি, অমিত বলা আরম্ভ করলো, ডিকটেটারশিপ অফ দি প্রলেটারিয়েট, ইনটারপেলেশান, মেটাবলিক রিফ্ট, পারমানেন্ট রিভলিউশান, প্রিমিটিভ কমিউনিজম, রিলেটিভ ডিপ্রাইভেশান, রেনটিয়ার ক্যাপিটালিজম, রিভলিউশানারি সিচুয়েশান, আলট্রা ইমপিরিয়ালিজম, বলশেভিক, বোনাপার্টিজম, ক্যাডার, শভিনিজম, ডুয়াল পাওয়ার, ইকোনমিজম, মেনশেভিক, ফ্যাসিজম, মেটাফিজিক্স, নিও লিবারালিজম, অপরচুনিজম, প্ল্যান্ড ইকোনমি, পলিটিকাল স্ট্রাইক, রিঅ্যাকশানারি। বলা শেষ করে গলা ছেড়ে হাসতে লাগলো অমিত, তারপর বললো, বুঝলে, আংরেজি ঝাড়তে পারলে এই জঙ্গলেও কদর বাড়ে। অরগ্যাজমও তো আংরেজি, ঝেড়ে দিলেই হলো সময় বুঝে, লেকচারবাজি আমি পারি না, ওরা কতো শেখাচ্ছে, আমার ভালোই লাগে না, কেন যে এলুম এখানে, ধুৎ শালা, ইসকি মাকা,  বুড়মে পেল দেঙ্গে রামরতিয়া চুতিয়াপা।

              কমরেড ডাক্তার বললে, অমিতের দিকে তাকিয়ে নয়, আস্তানার বাইরে প্রায়ান্ধকারের দিকে চোখ মেলে, আসল বয়সের আনন্দটাই পাসনি দেখছি। কথা বলাবলিরও আনন্দ আছে, নিজেদের মধ্যে সমবয়সি মেয়েদের নিয়ে ফিসফিস করার, নোংরা  হাসাহাসি করার বুক-ঢিপঢিপ আনন্দটাই মিস করেছিস। মেয়েদের নিয়ে ফিসফিস করে কথাবার্তা হতো না? নাইন টেন টুয়েলভে? টাচিফিলি খেলাখেলি?  অমিতের দুই পায়ের দিকে তাকিয়ে বললে ডাক্তার ঘোষ, যে,  পিঠে ব্যাকপ্যাকে দাতব্য ওষুধ, যা  নিজে কখনও খায় না যতই জ্বরজারি হোক, তাতে নিজের সিনথেটিক মশারি ঢুকিয়ে,  কিলোমিটারের পর কিলোমিটার ক্যাডারদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটে, তাকালো অমিতের দিকে,  পেশার গাম্ভীর্যের সঙ্গে কথা বলার শৈলী মিশিয়ে ; বছরের কতদিন হতে চলল এই একটা  ছেঁড়া রঙওঠা জিনস পরেই চালিয়ে দিচ্ছে ছেলেটা, ক্যাডারদের মতন মুফতি পরতে ওর ভালো লাগে না, তা জানে  ডাক্তার।

               ছেলেটা ওর, মানে ডাক্তার কমরেড ডিবির ছেলে, না অতনু চক্রবর্তীর ছেলে তা মানসী বর্মণ, যে অমিতের মা, সেও নিশ্চিত নয়, ওর বউয়ের ছেলে, তবু ছেলেটা ওর মতই হয়ে চলেছে, যেমন চলছে তেমনই চলুক টাইপের। লোকে বলবে বাপ-ছেলে যেন যমজ ভাই।

              এই জীবন নিজে বেছে নিয়েছে ডাক্তার, স্রেফ মানসী বর্মণের খাতিরে। মানসী যেদিন আধামিলিট্রির গুলিতে মরবে, সেদিন ওর ছুটি। ডাক্তার নিজেও উড়িয়ে দিতে পারে মানসী বর্মণ আর ওর বিয়ে-না-করা বর অতনুকে, নাইন এম এম একটা লোডেড থাকেই ওর কাছে, সাইলেন্সার লাগানো, যাতে আধামিলিট্রির কাছে আত্মসমর্পণ করতে না হয়। কিন্তু মানসী মরে গেলে  বেঁচে থাকার কোনো উদ্দেশ্য থাকবে না, মানসী তা জানে, তাই অস্তিত্ব দিয়ে আটক করে রেখেছে ডাক্তারকে।

             অমিতকে ডাক্তার বললে, কী হলো? কী জিগ্যেস করেছিল, সেটা মনে করার চেষ্টায় বললে, কী হলো ।

              নাঃ, জানি না, হতো হয়তো, আমার সঙ্গে হয়নি। যাকগে যাক, তুমিই বলো না যোনি আর অরগ্যাজম ব্যাপারগুলো আসলে কী,  আর কেনই বা জিগ্যেস করছ, আমাকে এই ক্যাম্পে বাবা-মা আর ক্যাডাররা যা শিখিয়েছে,  তা তো এতক্ষণ বললুম, তোমার মুখ দেখে বুঝতে পারছি বিশ্বাস করোনি।  জানতে চাইল অমিত, চেয়ারে বসে হাঁটু নাচাতে নাচাতে, লিঙ্গকে কাবু করে পোষ মানিয়ে নিয়েছিল।

              সেক্স করেছিস কোনো মেয়ের সঙ্গে? আই মিন কোনো ছেলের সঙ্গে করিসনি বলেই মনে হয়, বিহারে অবশ্য লালটুস ছাত্ররা হোমো টিচারদের পাল্লায় পড়ে। ডিজিটাল সেক্স হোক বা রিয়াল পেনিট্রেটিভ সেক্স, করেছিস কোনো মেয়ের সঙ্গে? কথাগুলো বলতে বলতে নিজের কাছে হাসলো, কমরেডরা ওকে সাধুসন্ত মনে করে, সংসারত্যাগী সংসারী-ক্রান্তিকারী। অন্তর্লীন হাসি, যা মুখে ফোটে না সচরাচর। কেবল তখনই  মুখে মৃদু হাসি খেলে যায় যখন কোনো উপজাতি তরুণ বেয়ারফুট ডাক্তার হবার জন্য ডাক্তারের কাছে প্রথমদিন শিখতে আসে। হবু শিক্ষার্থীকে  প্রথম প্রশ্ন, ‘ইমপিরিয়ালাইস্টস, কমপ্রাডর বুর্জোয়াজি আর ফিউডাল লর্ডস কাকে বলে জানিস’, আর সে, বলা কথাই যে শোনেনি, ঘাড় নাড়ে, ডাক্তার ঘোষ তাকে মাথায় হাত রেখে আদর করে বলে  ‘ভালো ডাক্তার হবি তুই’।

              ডিজিটাল? সেটা কী? থুতনি ওপরে তুলে প্রশ্ন করল অমিত।

              গণিত নয়, ইলেকট্রনিক্স নয়, আঙুল আঙুল, তর্জনী, এই দ্যাখ, এই আঙুলটা,  ঢুকিয়ে। রাশভারি কণ্ঠস্বর ডাক্তারের।

              ওসব জানতে চাইছ কেন? ওর সঙ্গে তোমাদের  ক্রান্তির সম্পর্ক আছে নাকি? জিগ্যেস করল অমিত, ডান হাতের কড়ে আঙুলের নখ খেতে-খেতে। নখের টুকরোটা থুঃ করে ফেলে বলল, যোনি নিয়ে আমার হবেটাই বা কি, আমি তো ক্রান্তি করতে আসিনি! সুযোগ বুঝলেই কেটে পড়ব, তোমার পিস্তলটা গেঁড়িয়ে।

             তোমাদের মানে? তোর বাপ-মা তো তোকে রাইফেল আর পিস্তল চালাতে শিখতে পাঠায় মাঝে-মধ্যে। তুইও তো একজন ক্রান্তিকারী! আমি তো ক্রান্তিকারী নই ; আমি ওদের, হো-মুণ্ডা-সাঁওতাল, বিরহোর-কোরওয়া-মাহলি আর মাড়িয়া-গোণ্ড-লোহরা চিকবারিকদের ডাক্তার।

               বাপ-মা? ওনারা? তোমার বউ আমার মা,  আর তোমাকে আমার মা বিয়ে করেছিল, তা-ই তো জানি।

              কিন্তু তোর মা যার সঙ্গে সেক্স করে তোর জন্ম দিয়েছিল  সে তো কমরেড দীপক, আই মিন অতনু চক্রবর্তী, আমি নই। তোর মার সঙ্গে সেক্স করে আমি  যে বাচ্চাটার বাবা হতাম  সে তো জন্মাবার আগেই মারা গিয়েছিল বলে শুনেছি।

              অমিত ছেলেটা তারও হতে পারে, অতনুরও হতে পারে, কিন্তু অমিতের জন্মের কাহিনি যেভাবে চাউর করা হয়েছে, সে গল্পকে অমিতের মনে চারিয়ে আপাতত সন্দেহে ভারাক্রান্ত হতে দিলো না ডাক্তার।

              তোমাকে বিয়ে করলেন আর প্রেমে পড়লেন ওই লোকটার! সেক্স করার ছিল তো সেক্স করলেই হতো, আমাকে জন্ম দেবার কি দরকার ছিল? টোপি পরে নিলেই হতো, ইতু বলেছিল টোপি পরে করলে বাচ্চা-ফাচ্চার জুঠঝামেলা হয় না।

              তোকে জন্ম দেবার জন্যই সেক্স করেছিল, বুঝলি, তুই হলি ওদের ভালোবাসার ফসল, ভালোবাসার প্রতীক, রাশিয়া চীন কিউবা ভিয়েৎনামে এই ধরণের অনেক প্রেমের গল্প আছে, বললো ডাক্তার, যে আজও বুঝে উঠতে পারেনি, কেন দুজনের সঙ্গে ইচ্ছানুযায়ী সেক্স করতো ওর স্ত্রী, অথচ ওকে ডিভোর্সও দিতে চায়নি, কেননা মানসী বর্মণ বা কমরেড জ্যোতি বলেছিলো, আমার দুজনকেই চাই, আমি তোমাদের দুজনকেই ভালোবাসি, শুধু একজনকে নিয়ে আর থাকতে পারবো না, দুজনের কেউ একজন যদি আমাকে ছেড়ে যাও তাহলে আত্মহত্যা করে নেবো, সে অনেককাল হলো।

              ফিল্মি তক্কো দিও না। এদিকে ক্রান্তি করছি আবার ভালোবাসাবাসিও করছি, হ্যাক থুঃ। হ্যাক থুঃ করলেও, থুতু ফেলল না অমিত, গলা শুকিয়ে এসেছে বলে জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিল। টেবিলের ওপর থেকে দুশো এমএল জলের বোতল এগিয়ে দিলো ডাক্তার ঘোষ। এক ঢোঁক খেল অমিত, জেনে গেছে যে জল এখানে, জঙ্গলের ভেতরে, মহার্ঘ।

             ক্রান্তির সঙ্গে ভালোবাসার কোনো বিরোধ আছে নাকি রে? ভালোবাসাবাসি কোনো ইজম নয়। ওটার জন্যেই মানুষরা জন্তু-জানোয়ার বা কীটপতঙ্গ হয়নি, মানুষ হয়েছে। এখন তোর বয়স কম, তাই জেনে রাখ, ভালোবাসা হল মানবজীবনের মিথ্যেগুলোর প্রধানতম।

              আবার জ্ঞান দিচ্ছ, ভঁয়সালোটন টিচারদের মতন। টিচাররা যা বলে নিজেরা তা মানে না, ক্লাস ফোর থেকে দেখেছি। বলে এক করে আরেক। ওই তোমার বউ আর তোমার বন্ধুর মতন।

              তা তুই সেক্স করেছিস কিনা বললি না তো।

              তুমিও তো বললে না যোনি কাকে বলে।

              আগে বল সেক্স করেছিস কি না।

              করেছি।

              রেডলাইট এরিয়ায় যাসনি তো? গিয়ে থাকলে ব্লাড টেস্ট করিয়েছিস? আমার কাছে যে ব্লাড টেস্ট কিট আছে তা দিয়ে যৌনরোগ ধরা পড়ে না। একটু থেমে বললো, নাঃ, কী করেই বা যাবি, সেখানে তো টাকা ছাড়তে হবে, আর তুই বলছিস তুই ছিলি ইতুদের বাড়ির চাকরের মতন।

              ফিরকি নিও না; কি আবোল তাবোল বকছ। যারা আমাকে ভালোবেসেছে আর আমি যাদের ভালোবেসেছি তাদের সঙ্গে সেক্স করেছি।

              তাদের ফেলে পালিয়ে এলি এই জঙ্গলে?

              না, তাদের প্রথম জনকে তোমরা ছত্তিসগড়ের অবুঝমাড় জঙ্গলে পাঠিয়ে দিয়েছ, ডাক্তারি করার জন্য, ক্রান্তিকারীদের রোগ-জখমের চিকিৎসা করার জন্য।

              ইতু? ইতু ঘোষ তোর প্রেমিকা? সে তো তোর বোন হয়, তার সঙ্গে সেক্স করলি।

              বোন আবার কোথায়। তবে ইতু বলেছিল যে ও যদি আমার নিজের বোন হতো তাহলেও আমাকে ভালোবাসতো, আমার সঙ্গে সেক্স করতো। আমি কিছুই করতে চাইনি। ইতুই যাবার আগে আমাকে ওর ভার্জিনিটি উপহার দিয়ে গেল, ও-ই বলেছিল যাবার আগে আমাকে আমার প্রাপ্য দিয়ে যাচ্ছে। ও কিন্তু প্রিকশান নিয়েছিল। ভার্জিনিটি, উপহার, প্রাপ্য, প্রিকশান এইসব কথা ইতুর, আমি জানতুমই না এগুলো কী ব্যাপার! আরেকজন এখানেই আছে, কনকদুর্গা, কমরেড কুনকি, ছবিলি নম্বর ওয়ান।

              এবার বুঝেছি। শুনলে কেমন যেন কাব্যি-কাব্যি মনে হয়।

              কী বুঝেছ?

              ইতুকে তোকে দিয়ে ফুসলিয়ে কেন অবুঝমাড়ের জঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়া হল। কনকদুর্গা কি করে তোর প্রেমে পড়ল রে? আগে ইতুর গল্প করি, তারপর কনকদুর্গার করব, কী বল?

              কেন? ইতু তো মানুষের সেবার জন্যে নিজেই গেল। ফোসলাবো কেন? আর কনকদুর্গাকেও আমি ফোসলাইনি, ও একদিন আমাকে ম্যাস্টারবেট করতে দেখে ফেলেছিল, তারপর হাত ধরে জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে আমার গালে দুই চড় কষিয়ে মাটিতে ফেলে আমার উপর শুয়ে পড়েছিল, ওর গতর দেখেছো তো, ইয়া সলিড মাল, জড়িয়ে ধরলে ছাড়ানো যায় না, ভাঙা-ভাঙা বাংলা মিশিয়ে তেলেগু আর আংরেজি ভাষায় কি-কি সব বলতে থাকে সেক্স করার সময়ে, সারা গায়ে থুতু মাখিয়ে দেয়, ওর কাছ থেকেই তো ছিলিম টানতে শিখেছি। বলে ছিলিম টেনে সেক্স অনেকক্ষণ করা যায়, সত্যিই তাই, মাটির ছিলিম গরম হয়ে গেলে নিজের সেক্সের জায়গায় ঢুকিয়ে ঠেলাঠেলি করে বলে, নে এবার টান, ঠাণ্ডা করে দিয়েছি।

              ম্যাস্টারবেট করা খারাপ নয়, যদি না করিস তাহলে আপনা থেকে মরা ধাতুরস রাতের বেলা বেরিয়ে যাবে, কম বয়সে সব ছেলেরই তাই হয়। তুই একেবারে লবড়ধোধো থেকে গেলি, পড়লিও তো কনকদুর্গার পাল্লায়, ও তো বাচ্চা হাতি, তবে দয়ামায়া নেই, ঘায়েল কমরেডদের হ্যাঁচড়াতে-হ্যাঁচড়াতে নিয়ে আসে। ওই যে তুই বললি ছিলিমটা ঠেলাঠেলি করে কনকদুর্গা, ওই ঠেলাঠেলিটা ওর আনন্দের জন্যে জরুরি, ও নিজের অরগ্যাজমের জন্যে সেটা করে, এখানকার উত্তেজনার চাপ থেকে ছাড়ান পায়।

             আমায় আবার কি বলছ, নিজেও তো খাড়ুস থেকে গেছো, গুরুঘণ্টাল। মরা না জ্যান্ত ধাতু অতোশত জানি না, ম্যাস্টারবেট করতে ভাল্লাগে বলে করি, তবে এখানে জলের অভাবে ধোয়াধুয়ির ঝামেলা, কনকদুর্গা বলেছে ও যতোদিন এখানে আছে ম্যাস্টারবেট করার দরকার নেই। আসলে দলমের কেউই ওকে দেখে টান পায় না। ও আমাকে চুসকিও শিখিয়েছে। চুসকি জানো তো? অন্ধকারে টের পাই না কোথায় মুখ দিয়ে চুসকি মারছি, এমন কালো রঙের আঙুর।

              ফাজলামি রাখ, যা করার করিস, আমাকে হিসেব দেবার দরকার নেই। ইতুকে তো তোর সঙ্গে এখানেই রাখতে পারত, যেমন তোর মা-বাপ রয়েছে। তোদের দুজনকে আলাদা করে দেবার প্যাঁচ মেরে ইতুকে ওই ফিল্ডে, আর তোকে এই ফিল্ডে রাখা হল।

              ওই লোকটাকে আমার বাপ বানিও না। ওটা একটা স্কাউন্ড্রেল, চুতিয়া, মাদারচোদ কোথাকার। ও তো এক নম্বরের লুচ্চা-লোফার, বন্দুকবাজ লাফাঙ্গা কাঁহিকা,  জানো তুমি। যেদিন আমাকে আর ইতুকে বাড়ির লোকেরা  বকুনি দিচ্ছিল, সেদিন ওরা অতনু চক্রবর্তী সম্পর্কে যা-যা বলছিল , শুনলে তোমার কান লাল হয়ে ঝলসে শিক কাবাব হয়ে যেতো, বুঝলে।

             অমিত বলল, ওদের, মানে অতনুদের,  একটা গ্যাং ছিল যাকে ওদের অফিসের লোকেরা বলত নারী-নারকো গ্যাং, যতো তিলেখচ্চররা ছিল ওই দলে, এরিক পেজ, মাহমুদ জোহের, মলয় রায়চৌধুরী, অসীম পোদ্দার, দেবেন্দ্রবাবু, অভিজিৎ বাবু, দাশগুপ্ত সায়েব, মুদালিয়ার সায়েব, বাঙালি বিহারি পাঞ্জাবি ওড়িয়া মিলে  সে নাকি লম্পটদের বিরাট কিচাইন। ওরা সবাই অফিস ছুটির পর পেছনের গলির ঝোপড়িতে বসে ভাঙ, কানট্রি লিকার, তাড়ি, চরস, স্ম্যাক নিতো। মাহমুদ জোহেরের ছিল জানলায় পর্দাটানা ম্যাটাডর ভ্যান, পেছনের দুদিকের সিট টানলে বিছানা হয়ে যেতো, আর ছুটিছাটায় ওদের পিকনিক হতো, লটারি করে যে জিততো সে ভাড়াকরা মাগিকে ওই বিছানার ওপর শুইয়ে এপিঠ-ওপিঠ যা ইচ্ছে তাই করত।

              যতই যাই হোক, হি ইজ ইওর বায়োলজিকাল ড্যাড। বললো ডাক্তার, যে কথায় ওর নিজেরই সন্দেহ আছে।



    দুই

             এই ঘটনাগুলো যে ঘটছে, তা ওই তোর বাপের বন্ধু মলয় রায়চৌধুরী ঘটাচ্ছে, ঘটিয়ে চলেছে লোকটা, লিখেও রেখেছে। তুই যদি মলয় রায়চৌধুরীর লেখা ঘটনাগুলো একের পর এক পড়িস তাহলে অতনু চক্রবর্তী আর ওর বন্ধুদের কেলোর কিত্তি জানতে পারবি। এর আগে মলয় রায়চৌধুরী চারটে পার্ট লিখে ফেলেছে, ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ আর ঔরস। কলকাতায় গেলে খতিয়ানগুলো পাওয়া যাবে, ডাক্তার এক নাগাড়ে বলে থামলো, তারপর বললো, আমার কাছে মলয় রায়চৌধুরীর ওই সব ঘটনার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি আছে, এখন তো লোকটা বুড়ো হয়ে গেছে, আঙুলে আরথ্রাইটিসের কারণে কমপিউটারে এক আঙুলে টাইপ করে লেখে, এই যে এখনকার ঘটনাগুলো, আঙুলে টাইপ করতে-করতেই লেখে, লিখতে বসে ভাবে যে এক্ষুনি যদি মরে যায় হার্টফেল করে, কিংবা হার্নিয়া বার্স্ট করে কিংবা হাঁপানির টানে, তাহলে এই শেষ পার্টটা কমপিউটারেই থেকে যাবে, আমরা সবাই মলয় রায়চৌধুরীর কমপিউটারে থেকে যাবো, কেউ আর জানতে পারবে না, তোর, আমার, তোর মা-বাপের, ইতুর,  কনকদুর্গার শেষ পর্যন্ত কী হলো। আমরা সবাই সমুদ্রের ডুবজলে লাশ হয়ে মাংসখোর মাছেদের খোরাক হয়ে যাবো।

             চলো না দুজনে মিলে পাটনায় পালাই, বলল অমিত, ওখানে ভিড়ের ভেতরে ঢুকে গেলে কেউ তোমাকে খুঁজে পাবে না, আর আমাকে তো কেউই তেমন চেনে না। আমি কিন্তু পাটনার গরিববস্তিগুলো চিনি। যাবার সময় কলকাত্তা হয়ে যাবো; কলকাত্তা ঘুরে দেখার খুব শখ আমার, এখানে একদিন আধামিলিট্রির হাতে মরার চেয়ে কলকাত্তায় গিয়ে গাড়িতে চাপা পড়ে মরা ভালো। তোমার পিস্তলটা গেঁড়িয়ে কমরেড দীপক আর কমরেড জ্যোতিকে খাল্লাস করে  চুপচাপ কেটে পড়ব, একদিন রাত্তিরে।  আমি আর কনকদুর্গা এসে দেখে গেছি, নাক ডেকে ঘুমোও ।

            গেঁড়াতে হবে না ; যেদিন কাজটা করবি, চেয়ে নিস।

            মনে থাকে যেন, সেদিন আবার টাঁয় টাঁয় ফিস কোরো না।

             কলকাতার পুলিশ মলয় রায়চৌধুরীকে ওদের ভ্যানে বসিয়ে কলকাতার অন্ধকার জগত দেখাতে নিয়ে যেতো রে। ওরা পুরোনো কলকাতার পরিবার, সেকালের ঘাঁত-ঘোঁত জানে। আর জন্মেছিল পাটনায়,  তোকে ঠিক খুঁজে বের করবে, আর কী-কী করলি তা লিখে রাখবে।


    তিন

              অতনু চক্রবর্তী তোর বায়োলজিকাল ড্যাড, বুঝলি?

              তার কোনো প্রমাণ নেই, ওটা বানানো গল্প, আমি যা জানি, আমি তোমার ছেলে, আমাকে দেখতে তোমার মতন। কী করে যে ওই লোকটা ক্রান্তিকারী কমরেড দীপক হয়ে গেল তা-ই ভাবি।

              মানসী বর্মণের প্রেমে পড়ে। ওরা একে আরেকজনকে ভালোবাসে। তোর মা তো ভালো চাকরি করতো, আমিই ওকে ক্রান্তি দিয়ে সমাজবদলের স্বপ্ন দেখিয়ে এই রাস্তায় এনেছিলুম, এখন বুঝতে পারছি কতো ভুল করেছিলুম সেসময়। সমাজটা বদলায় না, মানুষগুলো বদলে যায়।

              প্রেম না ঘেঁচু. যত্তো সব ঢাকোসলা। কেমন করে যে একজন লোক আরেকজন লোকের বউকে ফাঁসায়, বুঝতেই পারিনা শালা। যখন এখানে প্রথমবার এসেছিলুম, তখন মনে হয়েছিল অতনু চক্রবর্তী লোকটা আমাকে মায়ের চেয়ে বেশি পছন্দ করে, এত দিনে বুঝে ফেলেছি যে ও ভালো নৌটাঙ্কি করতে পারে, ড্রামাবাজ শালা চাপলুস চুকন্দর।

              বাবার সম্পর্কে এরকম কথা বলিসনি। এইসব গল্প কক্ষনো কাউকে বলিসনি। তোর বাবাকে ক্রান্তিকারীরা শ্রদ্ধা করে।

              তুমিই আমার বাবা। ইতুই তো আমাকে বলল যে তুই তোর বাবা-মার কাছে চলে যা, বাবা-মাকে যদি বাবা-মা না মনে করিস, তাহলে মনে করিসনা, কিন্তু ওনাদের সঙ্গেই থাকগে যা। আমি চলে এলুম কারণ তুমি, আমার বাবা, এখানে রয়েছ, আমার মাও এখানে রয়েছে। জানি না ওদের বাবা-মা বলে মনে করি কি না, এখনও তো আপনি থেকে তুমিতে যেতে পারছি না। তোমাকে তো প্রথম থেকেই তুমি বলছি, তুমি আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করছ, অথচ ওরা আমার সঙ্গে তুই-তোকারি করে না, তুমি-তুমি করে, নিজেদের ছেলে বলে মনে করে না, আমার এখানে আসাটাও ওরা ভালো চোখে নেয়নি, বুঝতে পারি, অথচ ওদের ফোসলানোতেই এলুম, ইতুটাও চলে গেল অবুঝমাড়ের জঙ্গলে।

              আমি তোর লিগাল বাবা, তোর বায়লজিকাল বাবা হল অতনু চক্রবর্তী মানে কমরেড দীপক। তোর নাম অমিত বর্মণ কেন? কারণ তোর মায়ের পদবি বর্মণ। তোর মাও আমায় বিয়ে করে বর্মণ পদবি ছাড়েনি, ওটা ওর বাপের পদবি, আমার পদবি ও কোনো কালেই নিজের নামের সঙ্গে জোড়েনি।

             ভালোই করেছে, আমি অন্তত ওর পদবিটা পেয়েছি, আর তো কিছু পাইনি। তোমার পদবি যদি পেতুম তাহলে অমিত ঘোষ হয়ে যেতুম আর লোকে ভাবত যে অমিত ঘোষ আর ইতু ঘোষ সত্যি-সত্যি ভাই-বোন। এমনিতেই ওদের বাড়িতে আর পাড়ায় ভাই-বোন ভাই-বোন বলে-বলে ঘিনিয়ে দিয়েছিল আমাদের, যত্তো শালা আনপড় ঘড়িয়াল-কুত্তা। আমি সেই জন্যেই আরও পালিয়ে এসেছিলুম ওই বাড়ি থেকে। ইতুও তাই অবুঝমাড়ের অজানা জঙ্গলে যেতে রাজি হয়ে গেল। মায়ের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কী?

            ডিভোর্স তো করিনি আমরা, সেপারেটও হইনি। ওদের মা-বাবা বলার অভ্যাসটা এবার ছাড়। অতনু চক্রবর্তী হল কমরেড দীপক, আর মানসী বর্মণ হল কমরেড জ্যোতি। তোর উচিত সবায়ের মতন ওই ভাবেই ওদের নাম উচ্চারণ করা। যা সত্য আর বাস্তব তাকে ওদের অবিশ্বাস সত্ত্বেও ওরা তো আফটার অল ক্রান্তিকারী, হ্যাঁ কিনা বল?  আর আমাকে বাবা বলবিনা, কমরেডও বলবি না, ডকটর বা ডাগডার সাহাব বলবি, সবাই যেমন বলে।

            ধুসসসসস, ছাড়ো, বাবা বলে ডাকিই না লোকটাকে, তোমাকেও তো ডাকি না বাবা বলে, মনে-মনে বলি। যাকগে যাক। হওনি কেন? তুমি হওনি না ও হয়নি? আজব বর-বউ তোমরা। পাশাপাশি রয়েছ, কথাবার্তাও বলছ নিজেদের মধ্যে, ওই অতনু চক্রবর্তী লোকটাও রয়েছে এখানে। তোমাদের কাউকেই আমি বুঝতে পারছি না, আজ চার বছরের বেশি হয়ে গেল, তোমরা অ্যালজেব্রা না ট্রিগনোমেট্রি, ফেল মারার সাবজেক্ট?

             ও তুই বুঝবি না, এখন বুঝবি না, পরে, আরেকটু বয়স হলে, কপালে বলিরেখা পড়া আরম্ভ হলে, লিঙ্গ অভিজ্ঞ হয়ে উঠলে,  বুঝতে পারবি, হয়তো বুঝতে পারবি। তোর আর ইতুর মাঝে হঠাৎ কেউ এসে যদি শুয়ে পড়ে তখন টের পাবি কোথা থেকে কী ঘটে যায় মানুষের জীবনে।

             হুঁঃ। যোনি কি বললে না তো? আমরা আর পাশাপাশি শোবো না, সুযোগ হবে বলে মনে হয় না, ওই জঙ্গলে পুলিশ এত বেশি হানা দেয় যে ইতু কত দিন ওখানে বেঁচে থাকবে কে জানে, বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। যোনি কী তা-ই বলো।

             ওকে রাইফেলধারী দেহরক্ষী দেবার কথা, বেঁচে আছে বলেই মনে হয়। শোন, যেখান দিয়ে তুই সেক্স করেছিস আর যেখান দিয়ে তুই জন্মেছিস, তাকে বলে যোনি।

             যোনি বলে? ওকে তো কোক বলে, গালাগাল দেবার সময়ে বুড় বলে, জানতুম। কতো ডায়ালগ শুনেছি, মেরে কোক সে যো পয়দা হুয়া, মা কি কোক কি কসম, হিন্দি ফিলিমে, হিন্দি টিভিতে। স্কুলে গালাগালি দেবার সময়ে যোনি বলতো না কেউ, বলতো বুড়, রেন্ডিদের বলতো বুড় মারাউনি। তো হঠাৎ এই সন্ধেবেলা যোনির লেকচার মারছো কেন? পুরোনো দিনের কথা চোখে ভাসছে বুঝি? চোখের সামনে জোয়ান বয়সের গোলাপি যোনি, ফরফরাতি বুড় কি চকাচৌঁধ আঁধি ভেসে উঠছে?

             বাপের বয়সি লোকের সঙ্গে ফাজলামি করছিস? প্রশ্রয়ের চিলতে হাসি ঠোঁটে খেলিয়ে বললো ডাক্তার।

             ওসব ছাড়ো, যোনির কথা বলো, জানি ভাসছে তোমার চোখের সামনে, কেন যোনির কথাটা হঠাৎ পাড়লে সেটাই বলো, কার যোনি, বুড়কে ভমচৌলা ঢাকোসলা ?

             একটা বাচ্চা যার যোনি থেকে জন্মায়, সেই মায়ের বুকের দুধ খাওয়া শিশুটার মানুষের মতন মানুষ হয়ে ওঠার জন্য খুবই জরুরি, তাই প্রসঙ্গটা তুলেছি। তুই যে একটুতেই ভয় পাস, ডেডবডি দেখলে কেঁদে ফেলিস, কোনো ক্রান্তিকারী সামান্য জখম হলে তার দিকে তাকাতে পারিস না, চোখ ছলছল করে, একবার রক্তক্ষয় দেখে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলিস, অনবরত নখ খাস, পা নাচাতে থাকিস, তা সেই কারণেই। তুই তোর মায়ের বুকের দুধ খাবার সুযোগ পাসনি, বোতলের দুধ খে্য়ে, কিংবা দুধ না খেয়েই বড়ো হয়েছিস ।

             অমিত বলল, তোমাকে একটা মনের কথা বলব? যবে থেকে মানসী বর্মণকে দেখেছি, ওনার ফর্সা মাইতে চুসকি দেবার ইচ্ছে ধরে রাখতে পারিনি, স্বপ্নেও দেখেছি, ওনার গোলাপি মাইতে চুসকি দিচ্ছি, আর প্যান্ট ভিজে গেল। তোমার তো বউ ছিল এককালে, নিশ্চই অনেক চুসকি দিয়েছিলে? কনকদুর্গা আমার চুসকি খুব পছন্দ করে, চুসকি দিতে-দিতে দম বন্ধ হয়ে যায়।

             তক্ষুনি  কোনো উত্তর দিলো না ডাক্তার। একটু পরে বলল, ক্রান্তি হলো তার সামনে একজন উলঙ্গ সুন্দরী, তোর ইচ্ছে করবে গিয়ে জড়িয়ে ধরি, চুমু খাই, কিন্তু আমরা ক্রান্তি করছি না, নিজেদের মতন করে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করছি, যদিও ক্রান্তিকারিরা জানে না যে রাষ্ট্রটা কোথায়, এই জঙ্গলে নিশ্চই নয়।

              অমিত বলল, যাদের বাড়িতে কোলের শিশুকে মানসী-অতনু ফেলে দিয়ে এসেছিল, তাদের বাড়িরও কারোর বুকের দুধ খাবার সুযোগ পাইনি, রাঙাবাবা আর রাঙামা আমাকে নিজেদের ছেলে হিসেবে নিয়েছিল বলে শুনেছি, রাঙামার তো বাচ্চাই হয়নি, কতবার কাঁড়ি-কঁড়ি টাকা খরচ করে আইভি এফ করিয়েও হয়নি, বুকে দুধ আসবে কোথ্থেকে? দুধ খাওয়াবার মাসিও রাখেনি যে তার বুকের দুধ খাবো। তাদের বাড়িতে তো চাকরের মতন ছিলুম ; সেকারণেই তো গর্দানিবাগের ঘোষবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলুম, তারপর কতো চাপ খেয়ে এখানে এসে জুটেছি। শালা, ইঁদুরকল যেন। ইতু বলত, ফাকিং একান্নবর্তী পরিবার।

              না, যার যোনি থেকে জন্মেছিস, তারই বুকের দুধ জরুরি, চরিত্র গড়ার জন্য জরুরি। আমি কথাটা ডাক্তার হিসেবে বলছি। মায়ের দুধে করটিজল থাকে, তার কাজ প্রায় ফেরোমোনের মতন। ফেরোমোনের মাধ্যমে একজন মানুষ আরেকজনকে সংকেত পাঠায়। ঠিক সেভাবেই করটিজলের মাধ্যমে মা শিশুকে আর শিশু মাকে সংকেত পাঠায়। করটিজল হল স্ট্রেস হরমোন। শরীরের ভেতর দিয়ে যখন করটিজল যাতায়াত করে তখন তা মানুষের মগজে ভয়, আতঙ্ক, ক্ষোভ, অপমানবোধ, গ্লানি, পরাজয়বোধ, ক্রোধ  এই ধরণের প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হবার জন্য তাকে আগেভাগে তৈরি করে দেয় ; মগজের গ্লুকোজ কনজাম্পশান কমিয়ে পাচনশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে। মাসি-পিসির দুধ খেলে হবে না, কৌটোর দুধ খেলে হবে না,  শৈশবে নিজের মায়ের দুধ খেতে হবে। প্রাণীর শরীরের সবরকমের লিকুইডের মাধ্যমে বার্তা গড়ে ওঠে।

              কী যে মাথামুন্ডু বোঝাতে চাইছ কিছুই বুঝতে পারছি না, খোলোসা করে বলো, খাড়ুসকে খাড়ুসই রয়ে গেছো।

              সেক্স করার সময়ে কী করলি? তুই তোর আর ইতু কিংবা তুই আর কনকদুর্গা যে যার নিজের লিকুইড ব্যবহার করলি , পরস্পরকে খবর পাঠালি যে একজন আরেকজনের দেহকে ভালোবাসছিস।

             শুধু দেহকে ভালোবাসিনি আমরা, নিজেদের পুরোটা দিয়ে ভালোবেসেছি। ইতু বলত, কারনিভোরের মতন রক্তমাংস দিয়ে ভালোবাসা।

              পুরুষ-মানুষের শরীরের ষাট ভাগ লিকুইড, বুঝলি। মেয়েদের অবশ্য একটু কম, পঞ্চান্ন ভাগ। আমাদের মগজ আর হৃদয়ে আছে তার সত্তরভাগ ; হাড়কে মনে হয় শুকনো খটখটে, তাতেও লিকুইড আছে একত্রিশ ভাগ। বাচ্চারা যখন জন্মায়, তাদের শরীরে আটাত্তরভাগ লিকুইড থাকে, মাকে খবর পাঠাবার জন্য, নাল ফ্যালে, দুধ তোলে, মাকে বার্তা পাঠায়।

             শুনছি তোমার গ্যাঁজাবিদ্যে,  হুলোকুমির লবডঙ্কায়, জানি আমাকে তুমি লাল্লোচাপ্পো মনে করো, লবড়ধোধো। আমার তো মা ছিল না, দুধ খাইনি, অতএব তুলিনি, নাল ফেলতুম কিনা জানি না।

              তাহলে তোকে বলি, মানুষ নানারকম মিথ্যেকে আশ্রয় করে বেঁচে থাকে, একটু আগেই তো বললুম,তার মধ্যে প্রধান হল প্রেম। এই মিথ্যেটা বেঁচে থাকার প্রাণশক্তি। সব রকমের প্রেমই কোনো না কোনো মিথ্যাকে আঁকড়ে নিজের সততা প্রমাণের চেষ্টা করে , দেশপ্রেম, সংসারপ্রেম, মানবপ্রেম, সমাজপ্রেম, ধর্মপ্রেম, ঈশ্বরপ্রেম এটসেটরা। দেখছিস না এখানে যেমন ক্রান্তিকারিরা, তেমনি বর্ডারে জওয়ানরা মারা যাচ্ছে, আর আরামে ঠাণ্ডাঘরে মজা নিয়ে চলেছে নেতারা। মুসলমানদের দেশে এখন জোর লড়াই চলছে স্বর্গে যাবার, শয়ে-শয়ে মানুষ বোমাবুমি করে মারা যাচ্ছে বা আত্নহত্যা করছে রোজ রোজ। বুঝিয়েও কিছু হবে না ; মিথ্যাই সত্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

              মারো গোলি ; যে যার লুঙ্গি তুলে পুঙ্গি বাজাক, আমার তাতে কি!

              চুমু খাবার সময়ে লিকুইড আদান-প্রদান করেছিলিস, খবর পৌঁছে দেবার জন্য , মুখে থুতু না থাকলে কথা বলতে পারবি না , আমি তোমায় ভালোবাসি বলতে হলেও মুখের ভেতরটা ভিজে থাকা দরকার , জড়িয়ে ধরার সময়ে  ঘাম দিয়ে ফেরোমোনের দেয়া-নেয়া করেছিলিস। লোকে কাঁদে, তাতে চোখের জল কেন বেরোয়? জানাবার জন্য যে মনের অবস্হা তখন কেমন।

              ডাক্তার ঘোষ  পেশার মর্যাদা আর স্ত্রীর ছেলের প্রতি পিতৃত্বসুলভ আদরের মাঝে মনে-মনে দোল খেতে লাগলো। অমিতের ওপর  দখল প্রসারিত করার খেলায় ছেলেটাকে জ্ঞানের জাল দিয়ে আটকে নেবার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে সে এসে অব্দি।

              তুমি এখানে পড়ে আছ কেন? এই জঙ্গলে? জ্ঞান তো মাঠে মারা গেল। বিপ্লবের ব-নিয়েও তোমার একরত্তি আগ্রহ নেই, তা এতদিনে বুঝে গেছি, ঝাঁটের বাল তোমার কাছে এই ক্রান্তিকারী খুনোখুনি। ক্রান্তি-ফান্তিতে তুমি বিশ্বাসই করো না, তবু এখানে পড়ে আছো! শহরে থাকলে মারোয়াড়ি হাসপাতালে ডাক্তারি করে পেল্লাই বাড়ি করে ফেলতে পারতে, গাড়ি হাঁকাতে, এখানে ফালতু জীবন নষ্ট করে ফেললে।

              ক্রান্তি? নিজেকে চুপিচুপি প্রশ্ন করলো ডাক্তার, ক্রান্তির হাতছানি তো আমিই দেখিয়েছিলুম মানসীকে, সেই হাতছানির ডাকে যে আরেকজন এসে ক্রান্তির স্বপ্নটাকে হাতিয়ে নেবে, মানসীকে হাতিয়ে নেবে, তা তো তখন ভাবিনি। এখন আর সমাজবদলে বিশ্বাস করি না, জানি সমাজ কোনো দিনই বদলাবে না, বইতে সমাজ বদলের যতো গপ্পো আজ পর্যন্ত লেখা হয়েছে, সব গাণ্ডুগর্দি। সোভিয়েত রাশিয়ার মতন শেষ পর্যন্ত মাফিয়ারা হাতিয়ে নেয়, চীনের মতন পুঁজিপতিরা হাতিয়ে নেয়।

              তুই যা জানতে চাইছিস তার উত্তর তুই জানিস। আমি এও জানি যে তুই সেই একই মহিলার জন্য এখান থেকে যেতে পারছিস না, যে মহিলার জন্যে আমি নিজের তৈরি করা ফাঁদে আটক পড়ে গেছি।

              কে? কমরেড জ্যোতি? কমরেড দীপকের জ্যোতি? ওই মহিলা তো তোমাকে ভালোবাসে না। আমাকেও পছন্দ করে কিনা তাও নিশ্চিত নই। তবে বদলা একদিন নেবোই নেবো, ইসপার ইয়া উসপার।

              না বাসলেই বা, আমি তো... যাকগে, তুই জেনে কীই বা করবি।

              হুঁঃ, ছুঁতে পর্যন্ত পাও না, শেষ বোধহয় পঁচিশ বছর আগে ছুঁয়েচো।

              তেইশ বছর তিন মাস আট দিন। তারপর কমরেড দীপক একবস্তা টাকা নিয়ে এসে শুয়ে পড়ল আমাদের মাঝে। আর তুই পয়দা হয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলি।

              হুঁঃ, এই জঙ্গলে ক্যালেন্ডার-ট্যালেন্ডার না থাকা সত্ত্বেও এত হিসেব রেখে চলেছ। দেবদাস সেজে থাকো, চুল আঁচড়াও না, রেগুলারলি দাড়ি কামাও না, লুঙ্গিটা বোধহয় একসপ্তাহ হয়ে গেল ছাড়োনি, বুশশার্টে সবকটা বোতাম নেই। নিজেই নিজেকে লণ্ডভণ্ড করে রেখেছ, এসে থেকে দেখছি। শুধু দিনের বেলা খাও, রাতে কখনও খেতে দেখিনি তোমাকে।

             ভালোবাসার জন্য ছুঁতে হয় নাকি!

              আমি তো ভালোবাসি না। আমি ওই মহিলাকে আর ওনার সঙ্গীকে ঘেন্না করি বলে এখানে আছি। একটা দুহাজার টাকার প্যাকেট তো আমিও এনে দিয়েছিলুম কমরেড জ্যোতিকে, সুশান্তজেঠু দিয়েছিলেন, কীই বা করব অত টাকা, তাই দিয়ে দিলুম, একটা অবশ্য নিজের কাছে লুকিয়ে রেখেছি, বলা তো যায় না, যেদিন পালাবো সেদিন কাজে দেবে। কমরেড জ্যোতি কী বলেছিলো  জানো? বলেছিলো যে যাক, কয়েকটা হ্যাণ্ড উইপন কেনা যাবে। ওইসব ফালতু জিনিস কেনার প্ল্যানের কথা আমি যদি আগে জানতুম, তাহলে এক পয়সাও দিতুম না। ওই বিধাবৌড়িয়া গ্রামে একটা টিউকল বসালে বরং ভালো হতো, জল আনার জন্য কত দূর যেতে হয় বউগুলোকে, মেয়েগুলোকে; ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে যায় ওদের শাড়ি, কুড়ি হাত দূর থেকেও সেই মেয়েলি ঘামের গন্ধ পাওয়া যায়, জানো তুমি?

              একটা গ্রামে বসালে অন্য গ্রামগুলোর মানুষ মনে করবে তাদের অবহেলা করা হচ্ছে ; সরকার অমন অবহেলা করলে গ্রামবাসীরা তেমনকিছু মনে করে না, কিন্তু ক্রান্তিকারীরা যদি করে তো সন্দেহ করবে। ছেলে-মায়ের সম্পর্কটা ভালোবাসাবাসির নয়, ওটা জৈবিক, দুজনে একে আরেকজনের প্রতি চৌম্বকক্ষেত্র গড়ে তোলে; সে-সম্পর্ক কিন্তু মিথ্যা নয়। কথা বলতে বলতে ডাক্তার নিজের মনে বলতে থাকলো, এ নিউজপেপার ইজ নট ওনলি এ কালেকটিভ প্রোপাগাণ্ডিস্ট অ্যান্ড এ কালেকটিভ এজিটেটর, ইট ইজ অলসো এ সোশ্যাল অরগ্যাজম।

             অমিতের জানা আছে, কথা বলতে বলতে মগজের আরেকটা ঘরে সেঁদিয়ে যায় ডাক্তার, মগজ যেন হাজারখানেক পাকানো কেঁচো দিয়ে তৈরি। সে দিকে খেয়াল না দিয়ে বলল, হবেও বা, আমার কোনো চুম্বকটান আছে কি না জানি না। যাকগে যাক,  এমন কোথাও টিউকল বা কুয়ো বসালেই তো হল যেখানে কয়েকটা গ্রামের বউরা জল তুলতে আসতে পারবে। আমি নিজের চোখে দেখেছি ঘামে মুখ একেবারে থমথমে হয়ে থাকে মেয়েগুলোর।

              দ্যাখ, এটুকু কথা বলতে গিয়েও তুই কাঁদো-কাঁদো হয়ে যাচ্ছিস। দেখেছিস কখনও যে তোর মায়ের ঘামের ফোঁটা কেমন জোনাকির মতন জ্বলজ্বল করে, অন্ধকারে উড়তে থাকে, তাঁবুর ভেতর আলো হয়ে থাকে?

              হ্যাঁ, দেখেছি, এখন আমি ওর তেরপলে শুই, অতনু চক্রবর্তীর তেরপলে শুই না। বলেছিলুম যে আমাকে ক্রান্তিকারীদের কোনো একটা তাঁবুতে শুতে দেয়া হোক, দুজনে রাজি হল না কেন কে জানে, কনকদুর্গাও ওদের বলেছিল যে অমিতের বয়স তো কম, মেয়েদের তেরপলে শুতে পারে। ওরা রাজি হয়নি, বোধহয় কনকদুর্গার হামলেপড়ার ব্যাপার ওরা জানে, দলে এতো ছিপকিলি পুষে রেখেছে।

             বলার পর, অমিতের মনে হল, মায়ের সঙ্গেই বা কেন শোবে না! মায়ের পাশে শোবার জন্মগত অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবো, মায়ের বুকের দুধ খাবার অধিকার থেকে কেন বঞ্চিত হবো, একদিন না একদিন মায়ের বুকের দুধ আমি নির্ঘাৎ খাবো, দুধ থাকুক বা না থাকুক। গোঁফের রেখা দেখা দেয়া শুরু হয়েছে তো কি হয়েছে, আমিই তো মায়ের একমাত্র সন্তান। নিজের ফোল্ডিং খাটকে মায়ের খাটের পাশে নিয়ে গিয়ে শোবো। কোনটা বাবা তা গোলমেলে হলেও মা তো মানসী বর্মণ, এতো সুন্দরী মা, আমার পুরো ছোটোবেলা নষ্ট করে অতনু চক্রবর্তীর পেছন-পেছন ঘুরে বেড়াচ্ছে।

             ওরা এক আধজন মেয়ে ক্রান্তিকারীকে সন্দেহ করে। বিশেষ করে কনকদুর্গাকে।

             সন্দেহ করার তো দরকার ছিল না; ওরা জানে আমি ইতুকে ভালোবাসি। যদিও জানে না যে কনকদুর্গাকেও ভালোবাসি। দুজনকে কি একসঙ্গে ভালোবাসা যায় না? আমাকে বললে আমি দুজনকেই বিয়ে করে কিংবা না করেও, ঘর করতে পারি। কমরেড মানসী বর্মণ তো তোমাকে আর অতনু চক্রবর্তীকে একই সঙ্গে ভালোবাসে।

            কনকদুর্গা, মানে কমরেড কুনকি একজন ইমপরট্যাণ্ট ক্রান্তিকারী, বুঝলি।  ভীষণ ডেনজারাস মেয়ে, মনে রাখিস, ওকে দল ছাড়বে না, তোকেও জোর করে ওর কাছ থেকে ছাড়াতে পারবে না। তবে কী জানিস? ডেনজারাস মেয়েরাই ভালোবাসার জন্যে জি-জান লড়িয়ে দ্যায়।

            জানি, ঝাড়খন্ড থেকে পালিয়ে কলকাতায় ফিরে সারেন্ডার করবে ভেবেছিল, তাইতে নাকি দুজন ক্যাডারকে দিয়ে ওকে বডি-প্যাঁদানি দেয়া হয়েছিল, সেই দুজনকে আধামিলিট্রি মেরেছিল না কনকদুর্গা, তা জানা যায়নি। আমি তবুও ওকে ভালোবাসি, ও আমার কান্নার ওষুধ। বললে না তো, দুজনকে একসঙ্গে নিয়ে ঘর করা যায় কিনা।

             জানি না যায় কিনা , ওটাই আমার জীবনে প্রধান প্রশ্ন হয়ে আছে আজও। অন্য কাউকে ভালোবাসলেও, যদি কোনো তরুণী তোকে রাতের বেলায় আঁকড়ে ধরে, বুঝলি, তুই ছাড়াতে পারবি না নিজেকে, দেখবি তোর শরীরে আপনা থেকে সাড়া জেগে উঠছে, কনকদুর্গা ঠিক তাই করেছে তোর সঙ্গে, তার ওপর গাঁজা ফোঁকার নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। ক্রান্তিকারীদের কি আর দেহ-মন নেই? তোর পাশে যদি কোনো মেয়ে শোয়, তাহলে তার মাথায় সেসময়ে ক্রান্তির কথা থাকার কথা নয় , তোকে দেখতে-শুনতে যথেষ্ট ভালো, তোর বাবার হাইট, চোখ-মুখ-নাক আর তোর মায়ের গায়ের রঙ পেয়েছিস। মাঝরাতে তোর শ্বাস যদি কোনো যুবতীর মুখের ওপরে অনবরত পড়তে থাকে, ফেরোমোনের ঝাপটায় তার পক্ষে নিজেকে কনট্রোল করা কঠিন হতে পারে। ক্রান্তিকারীদের তাঁবুতে হয়, এমনকি ক্রান্তিকারীরা যখন অপারেশান করতে যায়, তখনও ক্লান্তি আর টেনশান কাটাবার জন্যে লিঙ্গ-যোনির স্মৃতিতে জড়িয়ে পড়ে, জানাজানি হলে তাদের আলাদা করার জন্য বিভিন্ন ফিল্ড-এরিয়ায় পাঠানো হয়, যেমন তোকে আর ইতুকে পাঠানো হয়েছে। তোর লিঙ্গের স্মৃতি তোর নিজের নয় রে, তা যুগ যুগ ধরে স্মৃতি ধরে রেখেছে, ডায়নোসরদের সময় থেকে। তুই না চাইলেও তোর লিঙ্গের স্মৃতি তোকে বিগড়োবার রাস্তায় নিয়ে যাবে, ইউ মে কল ইট ভালোবাসা কিংবা  সেক্স বা ভালোবাসা উইথ সেক্স। কনকদুর্গার সঙ্গেও সেক্স করেছিস, আই মিন কুনকি তোর সঙ্গে সেক্স করেছে, ওতো ভীষণ ডিমান্ডিং? কপালে নাইন এমএম ঠেকিয়ে তোকে দিয়ে কাজ আদায় করে নেবে।

                  হ্যাঁ, প্রথমবার মুখ দিয়ে, ও-ই শিখিয়েছে, এখানে প্রিকশান নেবার কোনও ওষুধ ছিল না , তাই আমরা সেক্স দিয়ে সেক্স করতে পারিনি, ও বলে ওটা ব্লোজব, মজা একই, বরং বেশি মজা। তুমি ওকে প্রিকশানের  ট্যাবলেট দাও না কেন? ওর মান্হলি ব্লিডিঙের সময়ে আমরা রোজই সেক্স করেছি, ঘাসের ওপর, বুঝলে, জোনাকি উড়তে থাকে, ঝিঁঝি ডাকতে থাকে , জঙ্গলের গন্ধর সঙ্গে ওর বুনো গন্ধ মিশে যায়, যাকগে যাক, যে কথা হচ্ছিল, কমরেড দীপক তোমার চেয়ে বেঁটে আর তুমি কমরেড জ্যোতির চেয়ে ফর্সা, অমন যুক্তি অনুযায়ী তাহলে আমি তো তোমার ছেলে, কী, কেমন দিলুম, বেশি পাঙ্গা নিও না। কিন্তু কান্না এসেই যায়, আসলে আমি একজন ইডিয়ট বাফুন, কতবার কনট্রোল করার চেষ্টা করেছি, পারি না। ইতু বকুনি দিত, কনকদুর্গা ডরপোকি কমজোর মরদ বলে চড় মেরেছিল। কনকদুর্গাকে বলে দিয়েছি যে আমি জন্মাতে ভয় পেয়েছিলুম, জন্মেও ভয় পেয়েছিলুম, সবেতেই আমি ভয় পাই।

             অমিতের মনে পড়ল, প্রথমবার ও ছাদে বসে একা-একা কেঁদেছিল, পাড়ার গুণ্ডা রফিক মাসুম একটা ষণ্ডা মার্কা লোককে দশ হাজার টাকার সুপারি দিয়ে বলছিল কাউকে সাফায়া করে দিতে, ভয়ে গলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল অমিতের, কথাটা ইতুর সঙ্গেও শেয়ার করতে পারেনি, যা সাহসী ইতু, গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত রফিক মাসুমের ওপর, আর ওরা ওকে মুখ বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে কী করত তা তো আর ইতু জানে না, মনে হয়েছিল অমিতের।

              একদিন রাতের বেলায় আওয়াজ শুনে জানলা দিয়ে দেখেছিল অমিত , পাড়ার ফুটপাতের ওপর যে গাছগুলো ছিল তাতে ছেঁদা করে কিছু করছিল ষণ্ডাটা আর তার সাকরেদরা। অমন কেন করছে তখন বুঝতে পারেনি অমিত। সপ্তাহখানেক পরে দেখল সবকটা গাছ মরে গেছে, একেবারে শুকনো, তার কিছুদিন পরেই কর্পোরেশানের লোকদের সঙ্গে এনে গাছগুলোকে কেটে কয়েকটা লরিতে চাপিয়ে নিয়ে গিয়েছিল রফিক মাসুম। ইতুকে বলতে, ও বলেছিল, ইডিয়ট, তখনই বলতে হত, পাড়ায় যাদের গাড়ি আছে তারা রফিক মাসুমকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে; গাছের ডালে বসে পায়রা আর অন্য পাখি গাড়িগুলোর ওপর হাগত , গাড়ি খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, সুপারি দিয়ে গাছগুলো কাটিয়ে নিলে রফিক মাসুম, দুদিক থেকেই টাকা খেলো ব্যাটা। শুনে অব্দি কেঁদেছিল অমিত, লুকিয়ে লুকিয়ে।

              দ্বিতীয়বার কেঁদেছিল ব্যানার্জি দিদা মারা যেতে। ব্যানার্জি দিদা বলতেন ওনার ছেলেরা দিল্লি মুম্বাই আর লখনউতে থাকে। নাতিদের স্কুলের আর কলেজে ফলাফল ভালো হলে মিষ্টির বাক্স এনে বাড়ির সবাইকে খাওয়াতেন ; অমিতকে বলতেন, আমার নাতিদের মতন লেখাপড়া করে বড়ো হ, কতদিন এইভাবে চালাবি। কয়েকদিন ধরে পাড়ায় কুকুর মরে পড়ে থাকার মতন পচা গন্ধ আসতে জানা গেল যে ব্যানার্জি দিদার বাড়ি থেকে আসছে। সদর দরোজায় ধাক্কাধাক্কি করা সত্ত্বেও ব্যানার্জি দিদা যখন দরোজা খুললেন না, তখন পুলিশ এসে দরোজা ভেঙে কয়েকদিন আগে মরে পড়ে থাকা ব্যানার্জি দিদার লাশ পেয়েছিল, চেয়ারে বসে বসে পচে গেছেন। কতদিন যাবত টয়লেটে যেতে পারেননি, ঘরের  কার্পেটের ওপর হেগেমুতে রেখেছেন, শেষে নড়তে না পেরে রকিং চেয়ারে বসে বসে কখন যেন মরে গেছেন, কোলে হাত রেখে। সারা ঘর অগোছালো, নোংরা। পুলিশ পরে জানিয়েছিল যে ওনার স্বামী বাংলাদেশ স্বাধীন করার যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। ওনার কেউই নেই। নাতিদের গল্প সব বানানো। শুনে অনেক কেঁদেছিল অমিত। অকারণে  কান্না পায় ওর।

              অমিত বলল, কোনো মানে হয়, ভেবে দ্যাখো, বাংলাদেশ স্বাধীন করতে গিয়ে কী পেলেন ব্যানার্জিদাদু? নেড়েগুলো তো দিনকেদিন হেফাজতে ইসলামি না কী যেন হয়ে যাচ্ছে, হিন্দুদের আর থাকতে দেবে না ওদের দেশে, কতো লোক পালিয়ে আসছে, আর ফিরছে না, মন্দির-টন্দির দুর্গা কালীর মূর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। ওসব গল্প শুনি আর আমার কান্না পেয়ে যায়।

              ওটা তোর পারসোনালিটি ট্রেট হয়ে গেছে, আর তার কারণ হল তুই তোর মায়ের দুধ খাসনি, মায়ের আদর খাসনি, মায়ের গায়ের গন্ধ জানিস না।

              আমাকে ওরা ডাস্টবিনে ফেলে দিলেই পারত। যে বাড়িতে ফেলে দিয়ে এসেছিল, সেখানে আমি ডাস্টবিনেই থাকতুম, নয়তো আর কি! আমার তিনটে বাবা, ডাক্তার বাবা, কমরেড বাবা, রাঙা বাবা আর দুজন মা, কমরেড মা আর রাঙা মা, কিন্তু আপন বলতে আমার কেউই নেই। বলে, অমিতও ডাক্তার ঘোষের আদলে ষেঁড়োহাসি হাসল, তারপর বলল, আমি যদি তিনজন বাপের আর দুজন মায়ের কমবাইন্ড লিকুইড দিয়ে জন্মাতুম তাহলে বোধহয় আই ইডি বানাতে পারতুম, মাইন পুঁততে পারতুম, ক্রান্তি করার জন্যে গুলি ছুঁড়তে পারতুম, বলে, অমিত চোখ মুছল দুহাতের চেটো দিয়ে।

              চোখে জল আনিসনি, ট্রাই টু কনট্রোল ইওরসেল্ফ। ডাস্টবিনে কেন ফেলবে? বোকা নাকি! তোকে নিজের প্রিয় বন্ধুর বাড়িতে রেখে এসেছিল, যাতে তারা নিজের পরিবারের সদস্যের মতন গড়ে তোলে তোকে, শিক্ষিত করে তোলে। ওদের বাড়িতে পর পর এত দুর্ঘটনা ঘটে গেল যে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়ল। ডাক্তার নিজেকে শুনিয়ে বললে, ওরা অতনুর বন্ধু, আমার বন্ধু তো নয় ; মা বেঁচে থাকলে মানসীর বাচ্চাটাকে মায়ের কাছেই দিয়ে আসতুম, কত বাচ্চা তো ঠাকুমার কোলে মানুষ হয়।

              সবই জানো দেখছি, এই জঙ্গলে বসেও সব খবর রাখো। কিন্তু বন্ধু সুশান্তজেঠুই তো কিডন্যাপ হয়ে চলে গিয়েছিলেন, একজন বিহারি মেয়েকে বিয়ে করে সেখানেই থেকে গেছেন সুশান্তজেঠু। আমি আর ইতু বাড়ি থেকে পালিয়ে ওনার আস্তানাতেই প্রথমে ডেরা ডেলেছিলুম। টাকার বান্ডিল সুশান্তজেঠুর বিহারি বউ দিয়েছিল আমাদের।

              কানে আসে। আরও অনেককিছু জানি, যা তুই চলে আসার পর ঘটেছে, সুশান্ত জেঠু আত্মহত্যা করে নিয়েছে, আর ওনার ছেলে অপু খুনোখুনি করে ফেরার হয়ে গেছে।

              ওফ, আর বলতে হবে না।

              এখন যোনির প্রসঙ্গটা জরুরি । তুই একটুতেই ভেঙে পড়িস।

              তা নয়, মানসী বর্মণের ছেলেটার জন্য অতনু চক্রবর্তীর চেয়ে তোমার টান বেশি।

              হতে পারে। এখন যা, তোর মা-বাপ দুশ্চিন্তা করবে, ভাববে আমি তোকে  রিঅ্যাকশানারি বক্তৃতা দিচ্ছি। আমার ডাক্তারিটা ওদের দরকার, আমাকে তো ওদের দরকার নেই। আমি বেয়ার ফুট ডাক্তার তৈরি করে চলেছি, যারা শিখে-পড়ে মেডিকাল স্কোয়াডের কাজ করছে। তোকেও করতে চেষ্টা করেছিলুম, কিন্তু তুই বন্দুক-পিস্তল চালিয়ে ক্রান্তিকারীগিরিতে অংশ নিতে চাস, অথচ ভিতুর ডিপো। শেখ শেখ। শিখে নে বন্দুক-টন্দুক চালানো। তোকে কিন্তু  যেতে দেবে না, দেখে নিস, তোকে প্রোটেক্ট করে রাখবে।

              ক্রান্তিকারীগিরিতে যেতে তো আমাকে হবেই। নয়তো আমি এরকম কাওয়ার্ড ইডিয়ট থেকে যাবো। আমি ভেবে রেখেছি। তবে ওই মুফতি-পরা ক্রান্তিগিরীতে নয়, কাউকে অযথা খুন করতে পারব না। মারার জন্য কারণ থাকা দরকার। কনকদুর্গার কারণ আছে, ও পৃথিবীর সব পুরুষ মানুষের ওপর ও চটা, সবাইকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে খুন করতে পারে; বলেছিল গুলি চালিয়ে দনাদ্দন ওড়াতে ওর বেশ মজা লাগে।

              জানি, তুই  কী ভেবে রেখেছিস।

              জানো? হুঁঃ!

              জানি। তুই যা মনে মনে ভাবছিস আমি তা বহুকাল যাবত ভেবেছি।

              তার মানে তুমিও আমার মতনই কাওয়ার্ড বলো?

              না, আমি আহাম্মক।

              আহাম্মক মানে?

              বাংলা ভাষাটাও জানিস না? আহাম্মক মানে এক্সট্রিমলি ফুলিশ, ল্যাকিং ইন কমন সেন্স।

              তা ঠিক। নয়তো এখানে জঙ্গলে  দেবদাস হয়ে পড়ে থাকতে না।

              দেবদাস? শরৎচন্দ্র পড়েছিস দেখছি।

              না, পড়বো কোথ্থেকে! শাহরুখ খানের ফিল্ম দেখেছি। অইশরিয়া রায় আর মাধুরী দিকছিত ছিল। ইতু ওর ল্যাপটপে পেনড্রাইভে ফিল্ম আনতো মাঝেমাঝে।

              আমি দিলীপ কুমারেরটা দেখেছিলুম। সুচিত্রা সেন আর বৈজয়ন্তীমালা ছিল।

              যে-ই থাকুক, রেজাল্ট একই। এক্সট্রিমলি ফুলিশ , ওই যে তুমি বললে। ল্যাকিং ইন কমন সেন্স।

              অন্ধকার হয়ে যাবে। আলো তো জ্বলবে না কারোরই তেরপলে। তোর মায়ের আস্তানায় যাবি কি করে?

              কথা ঘোরাচ্ছো কেন? আমি কয়েকজন ক্রান্তিকারীর  সঙ্গে কথা বলে দেখেছি; ওরা বিশ্বাস করে যে তুমিই মানসী বর্মণের আসলি বর, কমরেড দীপকটা নকলি স্বামী। এতদিন রয়েছ পাশাপাশি। রেপ করার মতনও সাহস যোগাতে পারোনি, আর আমাকে বলছ কাওয়ার্ড। তুমি তো তোমার মায়ের দুধ খেয়েছিলে, নাকি?

              কি আজেবাজে কথা বলছিস নিজের মায়ের সম্পর্কে। মানসী বর্মণ বাইরে ক্রান্তিকারী, ভেতরে ঠুনকো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরলে ও ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

             একদিন মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোবো নিশ্চই, দেখে নিও। শ্বাস ফেলবো ওনার মুখের ওপর, শুঁকবো ওনার ঘামের গন্ধ, বুকের দুধের হারিয়ে যাওয়া গন্ধ, জবাবদিহি চাইব যে ক্রান্তি করাটা আমার চেয়ে কেন জরুরি, মায়ের দায়িত্ব আগে সন্তান না ক্রান্তি, কেন আমাকে দুধের বয়সেই ফেলে চলে এসেছিলো, তারপর কেন খোঁজ নেয়নি, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে করে পাগল করে দেবো।

              ঘুমোস। ওই যে কমরেড কনকদুর্গা  তোকে ডাকতে এসেছে; তোর খাবার সময় হয়ে গেল।

              কনকদুর্গা  মেয়েটা বাঙালি নয়, কিন্তু মহা ধাকড়নি। ওর সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারি না, তেলেগুতে, হিন্দিতে, বাংলায়, ইংরিজিতে, সব ভাষায় কথা বলতে পারে। আমি কোনো ভাষাতেই ঠিকমতন কথা বলতে পারি না। ওকে এখানে কেন এনে ফেলল বলোতো? বোধহয় কমরেডদের চুল কাটার জন্য আনিয়েছে এখানে।

             অমিতের উক্তি শুনে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ অট্টহাসি হাসলে ডাক্তার ঘোষ, যা ওর চরিত্রে বিরল। অমিত বলল, হ্যাঁ, হাসো তোমার ষেঁড়ো হাসি, কতোদিন যে হাসোনি, স্টক খালি করো।

             অনেকের চুল ও-ই কাটে বটে, আমার চুল আমি নিজেই কাটি, জঙ্গলে আবার চুলের কোনো দরকার আছে নাকি। যা, খেয়ে নিবি যা।

              তোমাদের এইসব ফালতু ক্রান্তিকারী খাবার-দাবারের চেয়ে কিন্তু ইতুদের বাড়িতে ভালো খাবার পেতুম, চাকরের জীবনে ভালো পেটপুজো।

              তুই-ই তো বোকার মতন চলে এলি।

              চলে আসিনি; ওরা তাড়িয়ে দিলে।

              মোটেই তাড়ায়নি ওরা। তুই আর ইতু ছাদের অন্ধকারে জড়াজড়ি করে কিছু একটা করছিলি বলে শুনেছি, মারিহুয়ানাও ফুঁকছিলি। জানি তোরা ভাইবোন নোস ; কিন্তু ওনাদের বাড়িতে ছোটোবেলা থেকে যেভাবে দুজনে বড়ো হয়েছিস, ওনাদের চোখে ভাইবোন হয়েই ছিলিস। আত্মমগ্নতার বিরতি মিশিয়ে-মিশিয়ে কথাগুলো বললে ডাক্তার ঘোষ।

              এসব খবরও এসে গেছে তোমাদের কাছে? তোমাদের ছিপকিলি জাসুস ওই বাড়িতেও আছে?

              আমাদের খোচর সর্বত্র আছে ; পুলিশে, প্রশাসনে, গ্রামে, হাটে, সব জায়গায়। যাকগে এখন যা, কনকদুর্গা  অপেক্ষা করছে। ওর আসল নামটা জিগ্যেস করে নিস।

             যাবো যাবো, তাড়া কিসের? কমরেড জ্যোতিকে ভয় পাও!

             পেলে তো ভালোই হতো রে। তা তুই  সেক্স-টেক্স করলে নিজেকে ক্লিন করিস তো? ক্লিন করবি, আনহাইজেনিক থাকলে যার সঙ্গে সেক্স করবি তার ইনফেকশান হয়ে যাবে ; পেনিসে লিন্ট বা ম্যাগমা জমে, এক ধরণের মোম।

              কি উল্টাসিধা পাঠ পড়াচ্ছ, ফালতু।

              ইহুদিরা আর মুসলমানরা সুন্নত করে কেন? যাতে ক্লিন থাকে, নোংরা না জমে।

              আমার ক্লিনই থাকে। প্রায়দিনই তো মিষ্টিবিষ্টি করি, কনকদুর্গাই বলেছে, পরিষ্কার রাখতে, নয়তো ওর মুখে ঘা হয়ে যাবে তো! পুরোনো পোশাক সঙ্গে রাখে ও, তাই দিয়ে নিজেই পুঁছে দেয়।

              হোয়াট ইজ দ্যাট? শুনিনি তো, মিষ্টিবিষ্টি!

              ইতুদের কোড ওয়র্ড, ওর বন্ধুর সঙ্গে মোবাইলে কথা বলছিল, তখন শুনেছিলুম। ওরা ম্যাস্টারবেশনকে বলে মিষ্টিবিষ্টি।

              আই সি। হ্যাঁ, এই বয়সে ওটা করা জরুরি, বাৎসায়নও বাতলে গেছেন কী ভাবে মিষ্টিবিষ্টি করতে হবে। দ্যাখ, ওই কাজের মাধ্যমে তুই পৃথিবীকে জানাচ্ছিস যে তোর একজন নারীর দরকার, মাটিতে বার্তা ফেলছিস, মাটি তো প্রতিদান দেবে। যাকগে, কনকদুর্গা দাঁড়িয়ে রয়েছে তোর জন্য।

              ওকেও যোনি-ফোনি এইসব বুঝিও না যেন।

              আবার তুই বাপের বয়সি লোকের সঙ্গে ফাজলামি করছিস।

              পরে আসবো, আরও কি খবর জানো খোলসা করে বোলো।

             ডাক্তার নিজেকে নিজের মনের ভেতর বললে, হয়তো এ আমারই ছেলে। এ যদি জেনে যায় যে এ নিশ্চিত আমার ছেলে, তাহলে এর সঙ্গে এমন খোলাখুলি কথা বলা যেতোনাকো ; এই বরং ভালো, কমরেড দীপকের চেয়ে কাছে টেনে আনতে পারছি।

              টাঙানো তেরপলের বাইরে, ক্রেয়নে বাচ্চাদের বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় জেতা  গোধুধূলির খাপচা কমলা-হলুদ রঙ নেমে আসছে ঘন সবুজ গাছগুলোর ওপরে।

              অমিতের হাত ধরে ওর কোমর বাঁহাতে জড়িয়ে, আলো-অন্ধকারের ভেতরে সেঁদিয়ে কমরেড কনকদুর্গা বলল অমিতকে, চল ডাক্তারকেও কনফিউজ করি, উনি এখনও দেখতে পাচ্ছেন আমাদের, বলে অমিতের দিকে ফিরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরল।

             আরে আমি এরকম আদ্দেক-প্রেম পারি না, অমিত জড়িয়ে ধরেই বলল, চুমু খাবার সময় আমার শরীর চিনচিনিয়ে সাড়া দিতে থাকে, মুখ দিয়ে আমার আশ মেটে না।

             তাহলে তুই মুখ খোল, জিভ ঢোকাই।

             কী করছিস কি? উত্তেজিত করে দিচ্ছিস।

             চল, ওই বাঁশঝাড়ের পেছনে যাই।

             চল, ডাক্তার এগিয়ে এসে উঁকি মেরে দেখছেন, পরের বার নিশ্চয়ই অন্য লেকচার শোনাবেন, সারাদিন নিজের মনে ইংরেজিতে বিড়বিড় করতে থাকেন, পাগল হয়ে যাবেন বুড়ো বয়সে।

              বিড়বিড় নয়, মার্কস লেনিন মাও ওনার মুখস্হ ; ঠিকই, বুড়ো হয়ে গেলে কমিউনিস্টরা পাগল হয়ে যেতে থাকে, স্বপ্ন ধ্বসে পড়ার বিষে ক্ষয়ে যান ওনারা। উনি কমিউনিজমে বিশ্বাস করেন না, বোধহয় মানুষের সমাজকেই বিশ্বাস করেন না।

             অমিত বলল, আমিও করি না।

              ডাক্তার ঘোষ তাকিয়ে রইলো কনকদুর্গার চুল-চিকচিকে খোঁপার দিকে, নিজেকে শুনিয়ে ফিসফিসিয়ে বললে, ‘প্রোট্র্যাক্টেড আর্মড স্ট্রাগল টু আনডারমাইন অ্যান্ড টু সিজ পাওয়ার ফ্রম দি স্টেট, স্বপ্ন দেখে যাও দেখে যাও দেখে যাও, যতদিন না ডিমেনশিয়া বা অ্যালঝিমার হয়’।

             কনকদুর্গা বলল, তোকে একটা ভয়ের খবর দেবো।

             অমিত : আমি তো চিরকেলে ভিতু। কী খবর?

             কনকদুর্গা: আমি প্রেগনেন্ট হয়ে গেছি, তিন মাস হয়ে গেল। ওরা জানতে পারলে রাখবে না। বলবে সারেন্ডার করতে।

             অমিত জড়িয়ে ধরল কনক্দুর্গাকে, যাক, রোজকার ধস্তাধস্তির ফল ফলল তাহলে। এবার এখান থেকে পালাবার পথ তুই তৈরি করে দিলি কনকদুর্গা, দুজনে পালাবো। পালাবার আগে ওই দুটোকে ওড়াতে হবে।

            কনকদুর্গা : আমি ভেবেছিলুম শুনে তোর মুখ শুকিয়ে যাবে।

            অমিত : আরে নাহ, এখন নিজেকে আসলি ষাঁড়  মনে হচ্ছে।

            কনকদুর্গা অমিতের কোমর ধরে তুলে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঘাসের ওপর নিয়ে গিয়ে ফেলল, বলল, এবার থেকে সাবধানে, নয়তো বাচ্চা নষ্ট হয়ে যেতে পারে, পাশাপাশি শুতে হবে।

             মশারির ভেতরে শুয়ে, ডাক্তার ঘোষের মনে পড়ল, মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তার শারীরিক অবস্হা বোঝার ক্ষমতা মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলো, আর শিক্ষনবিশ বেয়ারফুট ডাক্তারদের  সেই ক্ষমতাটি দেবার প্রয়াস করে, যাতে উপজাতি রোগীকে নানা প্রশ্নের মুখে পড়ে বিমূঢ়াবস্হায় না পড়তে হয়। মেয়ে শিক্ষানবিশরা তা দ্রুত শিখে ফেলতে পারে, কেননা তারা জানে যে রোগীরা কোথায় হাগতে যায়, জঙ্গলে না ঘাসের ওপর না নদীর বালিতে।

              মশারির ভেতরে ঢুকলেই মায়ের ঘুমপাড়ানি গানের সুর ভেসে আসে ডাক্তার ঘোষের কানে, একের পর এক, যার সাহায্যে জখম বা বুলেটফোঁড় ক্রান্তিকারীদের কান্না-কাতরানির অসহ্য স্মৃতিকে সামলায়, কিন্তু গানের কথাগুলো ইংরেজিতে, সেই একই, অ্যানিহিলেশান অফ ক্লাস এনিমিজ অ্যান্ড এক্সট্রিম ভায়োলেন্স অ্যাজ এ মিন্স টু সিকিয়র অরগানাইজেশানাল গোলস, মায়ের মুখ ভেসে ওঠে।

              ইংল্যাণ্ডে ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিলো, রেডিওলজি। যাবার আগে, মায়ের কথা মেনে, কচি বয়সেই উচ্চমাধ্যমিকের পর বিয়ে করে নিয়েছিলো উচ্চমাধ্যমিকেরই মানসী বর্মণকে, যাকে প্রথম দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল । মেয়েটি দৃষ্টিকটুভাবে সুশ্রী, আকর্ষণীয়ভাবে উন্নাসিক, ফুলোফুলো আঙুল, ঢাউস বর্তুল বুক, গভীর কালো চোখ, পাতলা কোমর আর হ্যাঁ, বেশ ফর্সা।

              ফুলশয্যার রাতে, ফোম লেদারের একটা ব্যাগের জিপ খুলে বিছানার ওপর অজস্র চিঠি, তার অধিকাংশ  খাম আর ইনল্যান্ড,  খোলা হয়নি, ছড়িয়ে মানসী বর্মণ বলেছিলে, এই নাও, কোনোও যৌতুক চাই না বলেছিলে, এগুলো ক্লাস এইট থেকে আমাকে লেখা ঘাড়েপড়া প্রেমিকদের প্রেমপত্র; আমি কাউকে পাত্তা দিইনি। আজ রাতে তুমি যাচাই করে দেখে নাও যে আমি ভার্জিন, নয়তো পরে তোমার মনে হবে এর তো প্রেমিকদের লাইন ছিল, নিশ্চয়ই কারোর সঙ্গে সম্পর্ক পাতিয়ে তার সঙ্গে শুয়ে থাকবে। শুইনি কারোর সঙ্গে। শুতে হলে ডিজায়ারেবল হওয়া অতি আবশ্যক, তোমাকে ডিজায়রেবল মনে না হলে বিয়ে করতুম না। তুমি শোওনি তো কোনো মেয়ের সঙ্গে, খোলাখুলি বলো, আমি সবকিছু স্পষ্ট বলি, কোনো হাইড অ্যাণ্ড সিক নেই।

             এই বয়সেই বিয়ে করতে রাজি হলাম ওই কারণেই, কৌমার্যটা তোমাকে সঁপে বিদেশে যাই। তাছাড়া তোমাদের বাড়ির লোকেরা খোঁজ নিয়ে জেনে গেছেন যে আমার বেশির ভাগ সময় কাটতো ছাত্র-রাজনীতি করে, দেয়ালে পোস্টার মেরে ; ভালো রেজাল্ট করতে পারিনি ক্রান্তিকারী রাজনীতির স্বপ্নে, নয়তো ভারতে কোনো মেডিকাল কলেজে সিট পেয়ে যেতাম। এখন কথা বন্ধ করে কাজে নেমে পড়া যাক, ফুলশয্যাকে বক্তৃতার মঞ্চ করে ফেলছ।


    চার

      মলয় রায়চৌধুরীই অতনুকে শেষ পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছিল চৌমাথার দিকে, যাতে ব্যাটা সেখানে পৌঁছে ভ্যাবাচাকা খেয়ে মরে, এবারে কোন দিকে যাবে, কোন রাস্তা বেছে নেবে, বন্ধু তো, দিয়েছে ঠেলে শুকনো কুয়োর ভেতরে। অসীম পোদ্দারের দেয়া পোর্টম্যান্টো ব্যাগের ভেতরে যে গাদা গাদা টাকা ঠাসা আছে, অফিস থেকে গেঁড়িয়ে জমিয়ে রেখেছিল আর সেই টাকায় রেন্ডিবাজি করে বেড়াতো, পুলিসের রেইড পড়তেই মানসী বর্মণের হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে নিজে নৌকো থেকে ঝাঁপ মেরে পটল তুলেছিল বাঞ্চোৎ। মানসী বর্মণ চাকরি ছেড়ে চলে যাবার আগে সেটা ধরিয়ে দিলে অতনু চক্রবর্তীকে। সহকর্মী বন্ধুদের একের পর জেরার শেষে অতনুর বিরুদ্ধে পুলিশ কোনো প্রমাণ পেলো না, তখন, সেই দিনই, সন্দেহ হওয়াতে অতনু বাড়ি ফিরে ব্যাগটা খুলে দ্যাখে টাকায় ঠাশা, হাজার-হাজার টাকা। ব্যাস বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিল, কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছিল না। মলয় রায়চৌধুরী ওকে পাঠিয়ে দিল মানসী বর্মণের কাছে, ক্রান্তির মাংসল ঘুর্ণিতে।

              মলয় রায়চৌধুরী এবার অমিতের জীবনকে জড়িয়ে দিল কনকদুর্গার সঙ্গে, যে অমিতের চেয়ে পনেরো বছরের বড়ো। ওরা দুজনে পাটনায় পালাবে তা মলয় রায়চৌধুরী জানে, এখন দেখার যে কাদের খুন করে ওরা পালাবে।


    পাঁচ

              ডাক্তার মশারির ভেতরে ঢুকে পড়লো, পায়ের ওপর পা চাপিয়ে, মাথার তলায় দুহাত রেখে মলয় রায়চৌধুরীর বই চারটে সম্পর্কে ভাবতে লাগলেো।

              ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস, জলাঞ্জলি, নামগন্ধ, ঔরস, চারটে বইতে কোথাও মলয় রায়চৌধুরী এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়নি কেন?

    ১. মাও সে তুঙ আর হেনরি কিসিঞ্জার, এই দুজনের দাঁত বের করা হাসি দেখার জন্যেই কি সাংস্কৃতিক বিপ্লবে হাজার হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল? কিসিঞ্জার তো ওই ফোটো তোলাবার সময়েও ভিয়েৎনামে নাপাম বোমা আর কমলাবিষের ধোঁয়ায় মানুষকে পুড়িয়ে মারছিল, মনে নেই?

    ২. মাও সে তুঙ আর হেনরি কিসিঞ্জার দুজনেই বুঝেছিল দু দেশের বাজারের মালপত্তরের বেচাকেনা দুই দেশের জন্যে জরুরি। বাজার যতো বাড়বে, ততো জিনিস বিক্রি হবে, ততো চাকরি বাড়বে, ততো দেশ উন্নতি করবে। তাহলে লেনিন কেন আগ বাড়িয়ে বলেছিল, ফ্রিডাম ইন ক্যাপিটালিস্ট সোসায়টি অলওয়েজ রেমাইনস অ্যাবাউট দি সেম অ্যাজ ইট ওয়াজ ইন অ্যানসিয়েন্ট গ্রিক রিপাবলিকস? ছ্যাঃ।

    ৩. ভারতে নকশাল আন্দোলন ঘটছে জেনে তাকে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ বলার সময়ে চীন কেন পাকিস্তান আর শ্রীলংকায় অমন ক্রান্তি ঘটাবার চেষ্টা করেনি?

    ৪. বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়ের মূর্তির মাথা কেটে কোন ক্রান্তি ঘটাবার চেষ্টা হয়েছিল? ভারতবর্ষ মানে কি শুধু কলকাতা, শুধু পশ্চিমবাংলা? বিদ্যাসাগরের গড়ে দেয়া ভাষায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, রেড বুক,  অনুবাদ করার সময়ে মনে ছিল না? সোভিয়েত দেশে বসে রুবল আর ভোদকা খেতে খেতে রুশভাষার বইগুলো বাংলায় অনুবাদ করার সময়ে কেন মনে পড়েনি,  ভাষাটা কারা তৈরি করে দিয়ে গেছেন! চটকলের গেটে আর গড়ের মাঠে ভাষণ দেবার সময়ে মনে ছিল না ভাষাটা কারা গড়ে দিয়ে গেছেন?

    ৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে চীন কেন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল, নিক্সনের চামচাগিরি ছাড়া আর কীই বা বলা যায় একে? এদিকে তো গায়ে পড়ে সবাইকে মানবমুক্তির লেকচার দিতো মাও সে তুঙ! চৌ এন লাই কি ইয়াহিয়া খানের গণহত্যা আর গণধর্ষণের প্রশংসা করে প্রেমপত্র লেখেনি? তাহলে?

    ৬. ১৯৭১ সালে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে পালিয়ে এসে ভিখিরির মতন রাস্তার দুধারে জীবন কাটিয়েছিল, কতো মেয়ে ধর্ষিত হয়েছিল, তার হিসেব নেই। মাও সে তুঙ আর মাওবাদীরা এ-ব্যাপারে মুখ খোলেনি কেন? চীনের সংবাদপত্রে বাংলাদেশে গণহত্যা আর গণধর্ষণের খবর চেপে যাওয়া হয়েছিল কেন?

    ৭. আমাকে এই জঙ্গলে মাওবাদীদের ডাক্তার বানিয়েছে মলয় রায়চৌধুরী। এতে আদিবাসীদের কোন উপকারে লাগছি আমি? ইতি গেছে অবুঝমাড়ের জঙ্গলে, সেখানে গিয়ে কোন কাজে লাগছে? তার চেয়ে অমিতের সঙ্গে ঘর বাঁধতে পারতো, সুখী হতো।

    ৮. ১৯৭০ সালের শীতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যকে কেন খুন করা হয়েছিল? মতাদর্শ যে বুদ্ধিকে ভ্রষ্ট করে তা টের পেতে প্রজন্মকে নস্যাৎ করে ফেলতে হয়েছিল কেন?

    ৯. চীনের কমিউনিস্ট পার্টির চরিত্র পালটে যাচ্ছে তা বুঝতে এতো দেরি হয়েছিল কেন?

              কই, মলয় রায়চৌধুরী, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপা, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামে, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, অইফব, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, বিসপামা, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে লিবারেশান, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে রেড ফ্ল্যাগ, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে নিউ ডেমোক্র্যাসি, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে অরগ্যানাইজিং কমিটি, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে শান্তি পাল, জবাব দাও জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে নয়ি পহল, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে নিউ প্রলেতারিয়ান, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে সত্যেন্দ্র সিংহ, সন্তোষ রাণা, জবাব দাও জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে নকশালবাড়ি রউফ, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে জনশক্তি কুরা রঞ্জনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে জনশক্তি রণধীর, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই ভাকপামালে জনশক্তি চন্দপুলা রেড্ডি, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে মাধব মুখার্জি, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে কেন্দ্রিয় টিম, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে জনসংবাদ, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে ভাইজি, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে প্রজাশক্তি, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে প্রজাপতিঘটনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপামালে প্রতিঘটনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ইউনিটি সেন্টার মালে ডিভি রাও, জবাব চাই, জবাব দাও।
              কই, ইউনিটি সেন্টার মালে আজমের গ্রুপ, জবাব চাই, জবাব দাও।
              কই, কপাভারত রঞ্জন চক্রবর্তী, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, লাল ঝাণ্ডা দল, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, সুসিক, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, রিকপাই, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, সিএমপি অরবিন্দাকশন, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ইউনাইটেড ভাকপা মোহিত সেন, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, কমাপা সিপি জন, জবাব দাওম জবাব চাই।
              কই, গসপা সৈফুদ্দিন চৌধুরী, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ওড়িশা কপা অজয় রাউত, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, কপাবিমা দার্জিলিঙ, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, সিআরএলআই অসীম চ্যাটার্জি, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ত্রিপুরা গণমঞ্চ অজয় বিশ্বাস, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, লাল নিশান দল লেনিনবাদী, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, মার্কসবাদী মঞ্চ আসাম জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, পিআরপিআই সুমন্ত হীরা, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, ভাকপা মাওবাদী, মুপ্পলা লক্ষ্মী রাও, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, কলিভামালে রামনাথ, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, কলিভামালে প্রতোকল্পনা, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, কলিভামালে রিভিশানিস্ট, জবাব দাও, জবাব চাই।
              কই, মলয় রায়চৌধুরী, জবাব দাও, জবাব চাই।


    ছয়

              মশারির ভেতরে শুয়ে ডাক্তার স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো ঝিঁঝি-পুরুষরা ডানা কাঁপিয়ে বলে চলেছে, জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই ঝিঁঝিঝিঁঝি জবাব নাই….

             ১৭৮৯ সাল থেকেই তো যুবকেরা, যখন মানুষ যুবক থাকে, সেই বয়সে, প্রতিষ্ঠানকে বদলাবার জন্যে মতাদর্শের আশ্রয় নিয়ে খুনোখুনি করবেই, তুমি কোন বদলকারীর দলে তাতে কিচ্ছু এসে যায় না। তুমিও তোমার শত্রুর আদলে গড়ে উঠবে। তোমার প্রজন্ম চলে যাবে, তারপর আরেক প্রজন্ম এসে বদলাবার চেষ্টা করবে। অথচ দুই পক্ষই জানে যে পৃথিবীর একটা বালও তুমি ওপড়াতে পারবে না।

            বিপ্লব হলো একধরণের বৃত্ত, সুতো দিয়ে তৈরি।

            বিপ্লব হলো শাঁখের করাত, দুদিকেই কাটে।

            চিন্তার কুয়াশায়, ডাক্তার ঘুমিয়ে পড়লো  বুকে দুই হাত রেখে, যেমনটা লেনিনের দেহকে মলম মাখিয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে, যাতে রুশ দেশের মানুষ, তাঁর পেল্লাই মূর্তিগুলো উপড়ে ফেলে দিলেও, তাঁকে না ভুলে যায়।

            মানসী ঈশ্বরে বিশ্বাস করে; বন্দুকের নলের ক্ষমতায় বিশ্বাস করে; একই সঙ্গে দুজন পুরুষকে ভালোবাসায় আর বিশ্বাস করে, এককালে দুজনের সঙ্গে একই দিনে সেক্স করায় বিশ্বাস করতো।


    সাত

            ফুলশয্যার বিছানায়, ডাক্তারের ডাক, ওকে, শুরু করা যাক।

             কাজ হয়ে গেলে স্বামী পাশ ফিরে শোবার তোড়জোড় করছে দেখে মানসী বলল, দাঁড়াও, এক্ষুনি ঘুমোতে চললে কেন। পিঁড়িতে বসে তো অনেক সংস্কৃত মন্ত্র আউড়ে ছিলে পুরুতের কথামতো; তারপর আমার শরীরের পিঁড়িতে বসে দেহের মন্তর ভাঁজলে। এবার আমার মন্তর ভাঁজার পালা, তোমার দেহের পিঁড়িতে বসে। তোমার হয়ে গেলেই হলো? আমারও তো হওয়া দরকার, নাকি?

            ঠিক আছে, বোসো, বলো কী মন্তর বলতে চাও।

            বসি আগে ; একি ফসকে যাচ্ছে কেন? মন ভরে গেল আর ব্যাস, তোমার মন অন্য দিকে চলে গেল।

            আমি ফসকাচ্ছি নাকি? পিঁড়িতে তো তুমি বসে আছো।

            দাঁড়াও, যুত করে বসি, হ্যাঁ, এইবার, আমার চোখে চোখ রেখে দ্যাখো।

            সক্রিয় হও, নয়তো ফসকাবে।

           এখানে যে ফিসফিসিনি-গুজগুজুনি ছাত্র-রাজনীতি করো, তা বিদেশে গিয়ে করা চলবে না, ফিরে এসে যে দলের ঝান্ডা চাও দেশে এসে ওড়াবে, ওদেশে নয়।

            ফসকে যাচ্ছে, বক্তৃতা দিতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছ, এখন সক্রিয় হও , পরে না হয় বক্তৃতা দিও। মনে করো দিকিনি যে তুমি ঘোড়ায় চেপে বেড়াতে যাচ্ছ আর ঘোড়াটা দুলকি চালে হাঁটছে।

           ইশশ...দুলকি চাল চাই ওনার, এই নাও রাজধানী এক্সপ্রেসের চাল। কী? হল তো?

           কই! হয়নি। ওপর থেকে নামো, আমি ট্রাই করি।

            না, ওপরে বসে কথাগুলো বললে তোমার মনে থাকবে, নয়তো বিদেশে গিয়ে ভুলে মেরে দেবে কী কী বলেছি, ওদেশে মেমগুলো আদেখলা।

            বলো, হেল্প করব?

           না, আমার গায়ে যথেষ্ট জোর আছে, তুমি পিঁড়ি হয়ে চুপ করে থাকো। টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ, টগবগ টগবগ,  টগবগ টগবগ, কী? এখন কেমন। এবার ঘোড়াকে ছোটাচ্ছি কিন্তু, রেডি স্টেডি গো। আমার সঙ্গে ইয়ার্কি, না? স্হির থাকো, নট নড়ন-চড়ন।

           রইলাম।

           মারো জোয়ান হেঁইও, জোরসে মারো হেঁইও, সাবাশ জোয়ান হেঁইও, মানসী জড়িয়ে ধরে ডাক্তারকে।

           ডাক্তার বলে ওঠে, কী হলো, ও মাঝি তোর হাল শক্ত করে ধর।

           ঠিক আছে, আবার মর্নিং শো।

           অ্যাজ ইউ প্লিজ।

           বিদেশে ঠিক মতন পড়াশুনা কোরো, রাজনীতি করার লোভে কোনো মেয়ের পাল্লায় পোড়ো না যেন, শেষে রোগবালাই হবে, আমি সামলাতে পারব না। রাজনীতি করতে হয় তো কার্ল মার্কসের কবরে গিয়ে প্রার্থনা কোরো যে মেডিকাল পরীক্ষায় যেন ভালো রেজাল্ট হয়, দেশে বউটা একা পড়ে আছে, দেশে ফিরে প্রয়োজন হলে ফিসফাস-রাজনীতি বা দলীয় রাজনীতি যা হয় করব।

              যাই তো আগে ; সত্যি ওখানে গিয়ে ফলাফল ভালো করতেই হবে, নয়তো বাবার রেখে যাওয়া টাকা নয়ছয় করা হবে, মা তা সহ্য করতে পারবেন না।

              প্রেমপত্র লিখো না ; প্রেমপত্র পেয়ে-পেয়ে ঘেন্না ধরে গেছে। সাদামাটা কথা লিখবে, ফোন করবে।

              পিঁড়ির কাজ সমাধা করে ফেলেছ? কাঁপছো দেখছি! আর কিছু বলার আছে?

              যাওয়া না পর্যন্ত প্রতিরাতে একবার আমি পিঁড়ি হব, একবার তুমি পিঁড়ি হবে।

              একবার কেন?

              একবার হল কথার কথা।

              ভার্জিনিটি যাচাই করে, একে আরেকের কৌমার্যের সিল ভেঙে, হবু ডাক্তার চলে গেলো লন্ডনের রয়াল কলেজ অফ রেডিওজিতে ডাক্তারি পড়তে।

              কোর্স পুরো করে ফেরার আগেই লন্ডনে বসে শুনলো,  স্ত্রী মানসী একাকিত্ব কাটাবার, আর শাশুড়ির উঠতে-বসতে উপদেশ এড়াবার জন্য  চাকরি নিয়ে চলে গেছে পাটনা। শুনে, ডাক্তারের  মনে হল, মানসীর কথা না শুনে, একটা বাচ্চা পয়দা করে বা বউকে প্রেগনেন্ট করে বিদেশে গেলে, বউয়ের একাকিত্বের নিদান দিয়ে যেতে পারা যেতো। বউ একা কী করে প্রেগনেন্সি সামলাবে, ওর অবর্তমানে বাচ্চা হলে, কোলের শিশুকে কে সামলাবে, মাকে কে দেখবে, কচি বয়সের দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে মানসীর কথামত বাচ্চা মুলতুবি রাখার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গিয়েছিলো।

              শাশুড়ির সঙ্গে সংঘর্ষ হবারই ছিল, দুজনেই বড্ডো বেশি কথা-কইয়ে।

              ডাক্তার কলকাতায় ফিরলো, মানসী কলকাতায় ফিরলো না, করকরে মাইনের এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, বলেছিলো মানসী, তুমিই এসো যখন মন কেমন করবে, শরীর ছোঁকছোঁক করবে। দেড় বছরের মাথায় মা মারা গেলেন, তবুও মানসীর ফেরার ইচ্ছা হল না, বললো, এই তো বেশ চলছে, তুমি তো সপ্তাহে একদিন আসছ, আমিও বড়ো ছুটি পড়লে যাচ্ছি , কারোর তো অসুবিধা হচ্ছে না। মানসীকে ডাক্তার বলে ফেলেছিলো যে সপ্তাহে একদিন এসে মন ভরে না,  রোজ দুবেলা সেক্স করার ইচ্ছে হয়।

              মানসী বলেছিলো, ডাক্তারের থুতনি ধরে, যে ওরও অমন ইচ্ছে হয়, কিন্তু কী আর করা যাবে, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে এমন মাইনের চাকরি পাওয়া যায় না, অফিস কোয়ার্টার দিয়েছে, চাইলে নানা রকম লোন দ্যায়, কতো সুবিধা। ডাক্তার যে রাতটা থাকতো, যতবার পারতো  সেক্স করতো দুজনে। সপ্তাহ-শেষে, প্লেনে সন্ধ্যায় পোঁছে পরের রাতে ট্রেনে যাতায়াত, ক্লান্ত দেহে আনন্দ নেবার মতন আহ্লাদ ভরপুর থাকত না।

             একটা রাত আর দিনের জন্য ঢুঁ মারতো, লুকিয়ে, যাতে কেউ না ওকে দেখে ফ্যালে। ইনটারভিউ দেবার সময়ে টেবিলের ওদিকে বসে থাকা তিন মাঝবয়সী সাক্ষাৎকার-গ্রহণকারীর মুখ দেখেই মানসী আঁচ করে ফেলেছিল যে এরা যেভাবে তাকাচ্ছে, টেবিলের তলা দিয়ে নিজেদের বিরাট বিরাট অ্যানাকোন্ডা সাপকে ওর দিকে পাঠিয়ে  সাপটে জড়িয়ে ধরার জন্য লড়ে মরছে । চাকরিটা পেতে হলে বিয়ে হয়ে গেছে বলা চলবে না, চাকরির দরখাস্ততেও জায়গাটায় তাই টিক দেননি, এর আগের ইনটারভিউয়ের অভিজ্ঞতা থেকে। অ্যানাকোন্ডা তিনটে ওর গলা  জড়িয়ে ধরে দমবন্ধ করে বলিয়ে নিল যে, না, বিয়ে করিনি এখনও। অফিসের সকলে জানে মানসী বর্মণ অবিবাহিত। বর লুকিয়ে এসে জমানো ফোঁটাগুলো ফেলে লুকিয়ে চলে যায়, তা কেউ জানে না।

              মানসী যখন প্রেগন্যান্ট হলো, তখন অফিসের ননীগোপাল বসু আর তাঁর মুসলমান স্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে রটিয়ে দিতে হল যে ননীবাবুর স্ত্রীর জরায়ুর সমস্যার কারণে মানসী ওনাদের বাচ্চার সারোগেট মা হতে রাজি হয়েছে। প্রেগন্যান্ট হয়েছে শুনে আনন্দে আটখানা আর কাজে অন্যমনস্ক ডক্টর ঘোষ তার হাসপাতালে এক বিপর্যয় ঘটিয়ে বসলো, আর মানসীর নির্দেশমতো কলকাতার বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে, মানসীর অফিসের চাপরাসি রাজনৈতিক কর্মী  রসিক পাসোয়ানের সঙ্গে পাটনা স্টেশানে যোগাযোগ করে ডাক্তার পালালো ওয়ারিস আলি গঞ্জের দাতব্য চিকিৎসালয়ে। রসিক পাসোয়ান লোকটা মানসীর অফিসেরই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, গরমকালেও মাথায় সর্ষের তেল চুপচুপে, অফিসের দেয়া পোশাকেও কলার তেলে চিটচিটে, মুখময় পানিবসন্তের শ্রীছাঁদ, ডান হাতের তর্জনী অর্ধেক কাটা। পরে জেনেছিলো ডাক্তার ঘোষ, আঙুল সে নিজেই অফিসের মেশিনে কাটিয়ে ফেলেছিল, অফিসের কাছ থেকে বিমার টাকা পাবার জন্য, যা ও ক্রান্তির কাজে লাগিয়েছিল।


    আট

    রায়পুর থেকে নারায়ণপুর যাবার বাসে ইতুকে  তুলে দিয়ে অমিত বলে দিয়েছিল, বাস থেকে নেমে সোজা গিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনের গেটের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকবি ; সুশান্ত জেঠুর দেয়া তোর মোবাইল থেকে, একটা ছেলেকে ফোন করে দিয়েছি। তুই মিশনের গেটের কাছে পোঁছে এই নম্বরে একটা মিস কল দিবি। নারায়নপুরে নেটওয়র্ক ততো ভালো কাজ করে না। ছেলেটা রেসপন্ড করে বলবে, ওর নাম বীরবল মাড়িয়া। হিরো হন্দার কালো রঙের স্পেলন্ডার মোটর সাইকেলে আসবে। ও তোকে নমস্তে ইতুদিদি বললে, কোনো কথা না বলে পিলিয়নে বসে পড়িস। ও তোকে যেখানে পৌঁছে দেবে, সেখানে তোর সঙ্গে আমার পরিচিতদের দেখা হবে, হয়তো তোর পরিচিতও থাকতে পারে কেউ। চিন্তা করিসনি, মনে রাখিস, যেখানে ঢুকতে যাচ্ছিস সেটাকে প্রশাসনের লোকেরা বলে জংলি পাকিস্তান।

              বাস ডিপোয় ইতুর কান্না পায়নি, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। কেঁদে ফেলেছিল অমিত, রুমাল দিয়ে চোখ পুঁছে নিচ্ছিল যাত্রীদের এড়িয়ে। বলেছিল, আর দেখা হবে না জানি, তোকে শেষবার দেখে নিচ্ছি। উত্তরে ইতু বলেছিল, আমি আমার অতীতকে কলকাতা বিমানবন্দরে প্লেনে ওঠার সময়ে কাট অফ করে দিয়েছি, তুইও তাই করে ফ্যাল। সবাইকে ভুলে গিয়ে যা করবার কর, বাবা-মায়ের সঙ্গে থাক, থেকেও তাদের ভুলে থাক। গেট রিড অফ অল মেমরিজ।

              ডেনিমের ট্রাউজার আর ঢিলেঢালা টপ পরেছিল ইতু, পায়ে জগিং করার কেডস, কাঁধে ওর রাকস্যাক। রায়পুরে দুবোতল মিনারেল ওয়াটার আর বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে নিয়েছে।

              যে বাসটায় চেপেছিল, সেটার নাম, ইতুর অবাক লাগল শুনে, নৌকরওয়ালা বাস। কন্ডাক্টার টিকিট দিল না কাউকে, স্কুলের অ্যাটেন্ডেসন্স রেজিস্টার হাতে প্রত্যেক যাত্রীর কাছে গিয়ে তাদের নামের সামনে ছককাটা ঘরে সই নিয়ে নিলো। মাসের শেষে টাকা নেবে, উপস্হিতি অনুযায়ী। প্যাসেনজারদের পোস্টিং হয়েছে নতুন জেলা সদর নারায়ণপুরে ;  তাদের পরিবারকে নিয়ে যায়নি, নারায়ণপুরে ভালো স্কুল কলেজ, সিনেমা হল, মালটিপ্লেক্স কিছুই গড়ে ওঠেনি এখনও। ইতুকে কন্ডাক্টার বলল, দিতে হবে না।

               বাস থেকে নেমে হাতে টানা রিকশোয় চেপে নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছে বীরবল মাড়িয়াকে মিসড কল দিয়ে অর্জুন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ইতু।

              নমস্তে ইতু দিদি, শুনে, কালো মোটর সদাইকেলের পিলিয়নে  বসে, ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবনগ্রন্হির ঝাপটের উগ্র গন্ধ এসে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল; উফ ফেরোমন। মুখে কাঁধের থলেটা চাপা দিয়ে সামলালো। কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারলো যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আর এক হাতে মোটর সাইকেলে হ্যান্ডেল, নয়তো সড়কের যা অবস্হা, নির্ঘাত ছিটকে পড়বে কোনো পাথরে চাকা পড়লেই। ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, ঠিক করে বসুন, রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়ণপুর জেলা তৈরি হয়েছে। ইতুর মনে পড়ল, অমিত এই ভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে আঙুল দিয়ে সুড়সুড়ি দিয়েছিল।

              যুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে, উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হবে, গায়ের রঙ মুখের গড়ন দেখে আদিবাসী বলেই মনে হয়। ইতু জিগ্যেস করল, দান্তেশ্বরীর মন্দির পড়বে কি রাস্তায়।

              -- না দিদি, দান্তেশ্বরী হলো বস্তারের দেবী। নারায়ণপুরে অবুঝমাড়িয়াদের দেবী হলো কাকসার। বৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে।

              মেঘনাদ! মাইকেলের? ইতু নিজেকে নিঃশব্দে বলল।

              যুবকটি বলল, জানেন, এখানে কেউ আসে না, বেশ দূরে দূরে প্রায় দুশো তিরিশটা গ্রাম আছে, চার কিলোমিটার জঙ্গলে ছড়িয়ে, তিরিশ হাজারের বেশি মানুষ, বেশির ভাগই  মাড়িয়া আর গোঁড়, যাদের খোঁজখবর সরকার নেয় না। কেন বলুন তো? হোল ইন্ডিয়ায় শুধু এইটুকু এলাকার কোনো সার্ভে আজ পর্যন্ত হয়নি। নারায়ণপুর, বিজাপুর আর বস্তার, এই তিন জেলার জঙ্গল এলাকা হলো অবুঝমাড়।

              ও আচ্ছা, শুকনো ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বলল ইতু।

              জানেন, অবুঝমাড়কে ঘিরে রেখেছে কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশবল আর ক্রান্তিকারীরা।

              ইতু নিজেকে প্রশ্ন করল, এখানে কেন আসতে চাইলুম? বাড়িতে কি ভালো ছিলুম না? আমি তো অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়েছি, অমিতের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কোথাও সংসার পাততে পারতুম, বস্তিতেই থাকতুম না হয়, অমিত কিছু কাজ তো করতো, অন্তত আমার ডিসপেনসারিতে হেলপার হয়ে? যাকগে, এবার নিজের জন্যে কিছু করব, ক্রান্তিকারীদের চিকিৎসা তো করতে পারব, জঙ্গলে এতো পরিচিত গাছগাছড়া রয়েছে।

             বীরবল মাড়িয়া বলল, কিছুক্ষণ থেমে, শ্বাস নিয়ে, অবুঝমাড় এমন ভুতাহা জায়গা যে ক্রান্তিকারীদের শরীরকেও অদৃশ্য ডাইনরা আক্রমণ করে, যতই বন্দুক কামান থাক, কিছুদিনের মধ্যে রোগে ভুগে ভুগে হাড্ডির চামগাদড় হয়ে যায়। আপনি দেখুন কতোদিন এখানে টিকতে পারেন। জল তো নোংরা, টিকতে হলে সালফি খেয়ে চালাতে হবে।

             সালফি?

             হ্যাঁ, সালফি হল তাড়ির মতন দেখতে একরকমের মদ। তালগাছ বা খেজুর গাছের মতন দেখতে হয় গাছগুলো, যেমন করে চেঁচে নিয়ে তালের বা খেজুরের রস বের করে, তেমনি করে সালফি বের করতে হয়।

              ছায়ায় আধঘণ্টা জিরিয়ে কয়েক ঢোঁক জল খাবার পর, মোটর সাইকেলটা চালাঘরের কাছে রেখে, বীরবল বলল, চলুন আরেকটু এগিয়ে দিই।

              মিনিট পনেরো হাঁটার পর, দুটো নীচু চালাঘরের মতন একটা জায়গায় পৌঁছোলো ইতু আর বিরবল। উলঙ্গ কিশোর-কিশোরীরা খেলা করছে, রুক্ষ চুল, দেখেই বোঝা যায় বহুদিন, বা হয়তো কখনো স্নান করেনি। শহরে এই বয়সের মেয়েরা কুঁচকি আর বুক ঢাকা পোষাক পরে ; এদের কুঁচকির চুলও দেখা দেয়া আরম্ভ হয়েছে, বুকও উঠে এসেছে, এই বয়সে ইতু বডিস আর জাঙিয়া পরা আরম্ভ করেছিল।

             কয়েকজন সিড়িঙ্গে শিথিল-দাবনা পুরুষ বসে আছে, তারাও প্রায় উলঙ্গ, কৌপিনগোছের ন্যাকড়ায় লিঙ্গ ঢাকা। বীরবল বলল, ওরা এ গ্রামের নয়, কুরসুনার গিয়ে সালফি খেয়ে এখানে মৌতাত নিচ্ছে। এই অবস্হায় ওরা ভেতরে গেলে ক্রান্তিকারীরা ধরে ফেললে ফাইন করবে।

              মানুষ যদি এরকমই থাকতে চায়, তাহলে তাতে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি ছিল না, নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ইতু। এই লোকগুলো এখনও বিস্মিত হবার ক্ষমতা রাখে, জীবনকে যথেচ্ছ উপভোগ করতে চায়, পোশাকের পরোয়া নেই, এখনও এরা কলাকৌশলের জাঁতিকলে আটকে পড়েনি, এখনও ভড়ংশূন্য, সরল, স্বাভাবিক; প্রযুক্তির প্রগতিতে এসে যায় না কিছু। সভ্যতা যতো বুড়ো হয়েছে ততো বিমূর্ত আর অবাস্তব হয়ে গেছে শহরের মানুষ, শিকড় থেকে ওপড়ানো, প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন, যেমন আমি নিজে। মেট্রপলিসের মানুষ আর জৈবিক হৃদয়ের প্রাণী রইলো না, তার আবেগের স্বাভাবিকতা আর আন্তরিকতা উবে গেছে। বোধহয় এটাই মানুষের নৃবৈজ্ঞানিক ভবিতব্য। সভ্যতা যতো সভ্যতর হয়ে চলেছে ততোই আমরা হয়ে চলেছি জটিল, খারাপ, অনৈতিক, ভয়াবহ।

              এই লোকগুলোর আনন্দের পরিভাষা তো এরাই তৈরি করবে, নাকি আমি বা ক্রান্তিকারীরা বাইরে থেকে এসে তাকে বোঝাবো কীসে তাদের আনন্দ। সভ্যতা  মানুষের যৌবনকে ক্ষইয়ে দিচ্ছে, মানুষ আসলে ভঙ্গুর, ঠুনকো, নশ্বর, তার শরীর অসুস্হ হবেই, ঋতুদের প্রকোপ সামলে চলতে হবে তাকে, সভ্য থাকার কাঁচামাল ফুরিয়ে যাচ্ছে, না-খেয়ে আধপেটা-খেয়ে থাকতে হচ্ছে, তার ওপর আবার সন্ত্রাসের আতঙ্ক। কে জানে, আমার কাছে এসব প্রশ্নের উত্তর নেই। দেখি, কী হয়। অন্যদের সুখে-আনন্দে-সুস্হতায় যদি জীবন কাজে লাগাতে পারি তাহলেই যথেষ্ট , তাহলে অমিতকে ভুলে যেতে পারবো।

              গ্রামটার পর পথ ক্রমে ওপর দিকে ওঠা আরম্ভ হলো। দুপাশে চেনা-অচেনা নানা রকমের গাছ, ছায়ায় হাঁটতে ভালো লাগছিল ইতুর। তখনই বীরবল বলল, দিদি, আমাকে এখান থেকে ফিরে যেতে হবে, সন্ধ্যা হয়ে এলো। আপনি প্রথমে যে গ্রাম পাবেন, সেখানে অপেক্ষা করবেন, কেউ আপনাকে নিতে আসবে। কিংবা এই সরু পাহাড়ি বনপথ ধরে যদি এগিয়ে যান, একটা বড়ো গ্রাম পাবেন, সেখানে অপেক্ষা করবেন। অন্ধকার হয়ে গেলে কোনো গাছে হাত দেবেন না ; সন্ধ্যার পরে গাছ আর গাছের ডালপালারা সাপ হয়ে যায়, সবুজ, কালো, হলদে, মোটা, রোগা, চিত্তিদার, নানারকম। আপনাকে সাবধানে হাঁটতে হবে। টর্চ এনে থাকলে জ্বালাবেন না, সাপেরা আলোয় বিরক্ত হয়।

             -- সে কী, তুমি যাবে না? ইতু বুঝতে পারলো যে ও এই ছেলেটির ওপর নির্ভর করছিল এতক্ষণ, ওর কল্পকাহিনি খাচ্ছিল। এবার থেকে ও একা। কারোর ঘাড়ে চাপার জন্যে তো বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েনি।

            -- না, আমি ফিরে যাই, এখানে কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করবে না। মাড়িয়া-গোঁড়রা  জানেই না কাকে ক্ষতি করা বলে। জঙ্গলের ভেতরে শহরের মানুষ পাবেন না ; যদি পান তো নিজেকে দূরে-দূরে রাখবেন।

            ইতু হাত তুলে, ফির মিলুঙ্গি জানিয়ে, এগোলো বনের পথে। বীরবল চলে গেলে, জুতো আর জিনস খুলে, প্যান্টিটা ফেলে দিয়ে, পেচ্ছাপ করে নিলো। ওহ কতক্ষণ চেপে রেখেছিলুম, বলল হলুদ ফুলের চুমকি বসানো ঘন সবুজ ঝোপকে, যে ঝোপটা হয়তো কোনো ভবঘুরে পাখির গু থেকে বৃষ্টির ছাটে দুহাত মেলে জন্মেছিল। টপ খুলে বডিসও ফেলে দিল। সেই ক্লাস এইট থেকে অভ্যাস, বাইরে থেকে বাড়িতে নিজের ঘরে ঢুকে আগে এই দুটো খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া।

             বাঁদিকের বুকটা তুলে দেখলো, দ্বিতীয়বার উত্তেজিত হয়ে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল অমিত, তাই ঘামের দরুণ জ্বালা করছিল। একটা ঘৃতকুমারী পাতা ভেঙে, তার শাঁস কুঁচকিতে আর বুকে, গোলাপি জায়গায় লাগিয়ে নিলো।

            বনের ভেতরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড়িয়ে অবর্ণনীয় ভালোলাগা পেয়ে বসল ইতুকে। দুহাত ওপরে তুলে চেঁচিয়ে উঠল, আমি ইতুউউউউউ, আমি ইতান, পৃথিবীর মাটিতে সম্পূর্ণ স্বাধীন। দুদিকে দুহাত মেলে আবার চেঁচালো, আমি ইতুউউউউউ...আমি আদি মানবিইইইই...আমি ইতু...আমি ইতু...আমি ইতুউউউউ….।

            শুকনো পাতার ওপর থেকে পোশাক তুলতে গিয়ে ইতু দেখলো, একটা কাঠবেড়ালি নতজানু হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ইতু, নগ্ন, শুকনো পাতার ওপরে উবু হয়ে বসে কাঠবিড়ালিটাকে বলল, সেতু বাঁধতে এসে থাকলে ভুল করছিস, সব সেতু ভেঙে চলে এসেছি। কাঠবিড়ালিটা পালিয়ে গেল, পোশাক আর জুতো পরে নিলো, কাঁধে ঝোলা, এগোলো বনপথে।

              ঘণ্টাখানেক চলার পর, সন্ধ্যা নেমে আসায়, অজানা এক গাছের গুঁড়ির কাছে, ছায়ায়, জুতো খুলে, বসে পড়েছিল ইতু, বুকের ভেতরে বাজতে-থাকা ভীতির দামামা দূর থেকে কানের ভেতরে ঢুকে আসছিল। ওপর থেকে কয়েকটা ফুল ঝরঝর করে ঝরে পড়তে চমকে উঠেছিল, তারপর টের পেলো যে এটা মহুয়ার গাছ ; তাইতো অমন গন্ধ বেরুচ্ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে যদি ভাল্লুক আসে, তাহলে? কোথায় যেতে হবে সুস্পষ্ট বলে দেয়নি অমিত, ওকে ওর ক্রান্তিকারী মা-বাপ যেমনটা বুঝিয়েছিল, ও সেটাই বলেছে, বলেছিল হাঁটতে থেকো যতোটা পারো, পরিচিত কাউকে ঠিকই পেয়ে যাবে। তন্দ্রা এসে গিয়েছিল ইতুর, গাছে ঠেসান দিয়ে ঢুলতে লাগল। সারাদিনের রোদের আমেজে বুঁদ গাছের পাতাগুলো অবসাদে ঝিমিয়ে।

             ঘুম ভাঙতে, দেখল অন্ধকার, আজকে বোধহয় চাঁদ ওঠার রাত নয়। জুতো পরে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে অন্ধকারে গাছে ডান হাত ঠেকতেই মনে হলো সাপের গায়ে হাত দিয়ে ফেলেছে, নরম মাংসল, যেন ভিজে-ভিজে, তাড়াতাড়ি হাত সরিয়ে নিলো। কী করবে? গাছগুলো রাতে সাপের আকার নিয়ে নিচ্ছে! বিশ্বাস করি না, অথচ বিশ্বাস করে ফেলছি, ভয়ে। এককালে অমিতকে ভিতু বলে কতো ডাঁট-ফটকার দিয়েছি। কেউ এলে তাকে দেখতেও তো পাবো না জঙ্গলের অন্ধকারে। হয়তো বিভ্রম, মনে করে, বাঁ হাত বাড়িয়ে গাছ অনুমান করে হাত বাড়াতে, ঠাণ্ডা সাপের গায়ে হাত ঠেকল, নরম। সাপের ভয়ে ইতুর বুকের ভেতরের ইঁদুরগুলো দাপাদাপি আরম্ভ করে দিয়েছিল। ইতু বুঝতে পারছিল ওর অস্তিত্ব জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আতঙ্ক, সাপের আকার পাওয়া গাছগাছালির আতঙ্ক।

              হঠাৎ ইতুর চোখের ওপর সরু নিয়নের আলোর মতন রশ্মি পড়তে, চোখ ধাঁধিয়ে গেল, বুকের দামামা আরও জোরে বাজা আরম্ভ হলো। কোনো ময়ালের চোখ নয়তো? আরও তিনটে টর্চ জ্বলতে, ইতু আবছা দেখলো, ওর চারপাশে জলপাই রঙের উর্দিতে চারজন যুবক আর একজন যুবতী। সকলের কাঁধে বন্দুক বা রাইফেল, কে জানে কী, দেখেনি তো কখনও। আমাকেও ঝোলাতে হবে নাকি! এই উদ্দেশ্যে তো আসিনি, আদিবাসীদের চিকিৎসা করতে এসেছি।

              ---ডক্টর ঘোষ? ওয়েলকাম। একজন যুবক বলল।

              ইতুর মুখ দিয়ে বেরোলো, থ্যাঙ্কস, ম্যায় বহুত ডরি হুই থি।

             যুবতী বলল, জানতি হুঁ, আপ সো গয়ে থে দেখকর আপকো নিন্দ সে নহিঁ জগায়া। আপ জব অপনা নাম লেকর চিল্লায়েঁ, তভি সে হমলোগ আপকে সাথ হ্যাঁয়।

             ওর উলঙ্গ চিৎকার এরা দেখেছে তাহলে! দেখুকগে, কীই বা এসে যায়।

             যুবতী বলল, ওর নাম সোনারি, বলল, আপ হম লোগোঁকে বিচ মেঁ রহিয়ে, ইতুকে ঘিরে ওরা হাঁটা আরম্ভ করল, অন্ধকারে, টর্চ না জ্বেলে। বনপথের সহযাত্রীদের ঘেরাটোপে বোধহয় আরও ঘণ্টা দেড়েক হেঁটেছিল ইতু।

              তখনই অন্ধকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে কয়েকবার হুইসিল বেজে থেমে গেল।

              আচমকা গুলি চলার শব্দ আরম্ভ হতে, ইতুকে টেনে শুকনো পাতার ওপর নামিয়ে, ওরা ইতুর দেহ ঘিরে শুয়ে পড়ল। ইতু অনুমান করল দুদিক থেকে গুলি চলছে, অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ওর মুখ মাটির দিকে, জিভেতে ভয়ার্ত আহ্লাদের স্বাদ। শুকনো পাতার ছোঁয়াচে গন্ধে, বাড়ি থেকে পালাবার পর, প্রথম যখন অমিত ওর ক্লিনিকে এসেছিল, ঠিক ওর শরীরের সম্মোহক গন্ধ।

              অসংখ্য গুলি ওদের দিকে এসে ঝাঁঝরা করে দিল সবাইকে, ইতুকেও। কুণ্ডলীপাকানো ময়াল সাপের মতন পড়ে রইলো ইতুর আর ওর ক্রান্তিকারী রক্ষীদের মৃতদেহগুলো।


    নয়

              হাসপাতালে, এম আর আই স্ক্যান করার জন্য একজন বয়স্ক রোগীকে শুইয়ে টেকনিশিয়ানকে নির্দেশ দিচ্ছিলো  ডক্টর ঘোষ, তখনই  বুড়ো ওয়ার্ডবয় গোপাল নস্কর পাশের ঘরে নিয়ে যাবার বদলে একটা খালি অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঢোকে, আর এম আর আই মেশিনের ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রচণ্ড আকর্ষণে সিলিণ্ডারসুদ্ধু ওয়ার্ড বয়টা রোগীকে নিয়ে বাজপাখির ছোঁমারার মতন করে সেঁদিয়ে গেলো মেশিনের ভেতরে; রোগী তক্ষুনি মারা যায়। ভ্যাবাচাকা খেয়ে টেকনিশিয়ানটা পালালো।

              মেশিনের কোয়েঞ্চিং সুইচ অফ করে ম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিঅ্যাকটিভেট করার বদলে রোগী আর ওয়ার্ড বয়কে বের করার চেষ্টা করে ডক্টর ঘোষ, কিছুই হচ্ছে না দেখে হিলিয়াম গ্যাস বের করে দিয়ে ম্যাগনেটিক ফিল্ড অকার্যকর করার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না, সুইচও নেভাতে পারে না। অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানোর জন্য গ্রেপ্তার হয়ে একদিন হাজতে থাকার পর, পাটনায় পালিয়ে গিয়ে, মানসীর পরামর্শে, রসিক পাসোয়ানের সাহায্যে, গা ঢাকা দেয় ওয়ারিস আলি গঞ্জ। এককালে ছাত্র-রাজনীতি করিয়ে ডাক্তার উন্নীত হয়ে গেল ক্রান্তিকারীর রাজনীতিতে, যে রাস্তায় যাবার গোপন ইচ্ছে অনেককাল ধরেই ছিল।

              না পালালেই হতো, পরে মনে হয়েছে  ডাক্তারের , হয়তো অতিবুদ্ধিমতী সুন্দরী মানসী ওইভাবেই তাকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিলো।  টেকনিশিয়ান প্রশান্ত সরখেল গ্রেপ্তার হয়েছিল, পুলিস হাজতে ছিল চোদ্দো দিন, মেশিনটা ডিফেকটিভ ছিল বলে হাসপাতালের কর্মী ইউনিয়ান দাবি করে পালটা মামলা করার ফলে কেস ঝুলে আছে সেই থেকে। ডাক্তারও না হয় ঝুলেই রইতো, মানসীকে বাধ্য করতো কলকাতায় ট্রান্সফার নিয়ে সঙ্গে থাকতে। ভয় ছিল যে পুলিশ শেষে বাড়িতে ঢুঁ মারলে বিপ্লবের বইপত্র দেখে অন্য মামলায় ফাঁসিয়ে দিতে পারত, হয়তো আগে থেকেই নজর রেখে থাকবে, তার চেয়ে কাগজপত্র জ্বালিয়ে গা ঢাকা দেয়াই উচিত, ভেবেছিল ডাক্তার।

              মানসীর বাচ্চাটা নির্দিষ্ট দিনের আগেই, জটিলতার কারণে, হাসপাতালে মারা গেল, জানিয়েছিল মানসী, যা আজও বিশ্বাস করে না ডাক্তার, হয়তো কোথাও কারোর জিম্মায় দিয়ে রেখেছে, যাতে বাচ্চার ঝক্কি পোয়াতে না হয়।

              অফিসের কর্মীরা সুযোগ খুঁজছিল ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে সংঘর্ষের, মানসীকে মেটারনিটি লিভ না দেয়ায়, যেহেতু অফিসের রেকর্ডে মানসীর বিয়ে হয়নি, অফিসের অনুমতি না নিয়ে সারোগেট মাদার হতে রাজি হয়েছে, আর যেহেতু বাচ্চাটা তার নয়,  হরতাল চলল বেশ কয়েকদিন।

              হরতালের সুযোগ নিয়ে নারী-নারকটিক গ্যাঙের সদস্যরা নানা জায়গায় ম্যাটাডর ভ্যান হাঁকালো কিসিম কিসিম কচি-আধপাকা-পাকা যুবতীদের দেহরঙ্গের খেলা খেলতে, কখনও বা গঙ্গার বুকে পালতোলা নৌকোর ছইয়ের ফুল্লকুসুমিত জোছনায়।

              অতনু চক্রবর্তীকে, যে কিনা অফিসে মানসীর পরের ব্যাচের, সে যখন অফিসের কাজে ট্যুরে মিজোরাম যাচ্ছিল, তাকে একটা পছন্দের পারফিউম আনতে বলেছিল মানসী বর্মণ। হরতালের তাঁবুতে মানসীর বাড়ি যাবার পথনির্দেশ যোগাড় করে, পৌঁছে অতনু কলিং বেল টিপতে, কয়েক সেকেণ্ডে ফাঁক হয় চেনবাঁধা দরোজা। টাঙাইল শাড়িতে মানসী বর্মণ, উদাসীন বহিরাবয়ব, সর্বোতোমুখী পরিব্রাজক চাউনি, নিঃশব্দ উলুধ্বনির বলয়ে ঘেরা উচ্চারণ উন্মুখ শরীর। দরোজা খুলে মানসী, ‘আরে আপনি; চিনতে পারিনি প্রথমটা, অনেকদিন দেখিনি তো, আসুন না ভেতরে আসুন না, বারমহল আর খাসমহল আমার এই দুঘরের ফ্ল্যাট। ওপরের ফ্ল্যাটে আগরওয়াল সায়েব থাকেন, বড় ছ্যাঁচড়া, তাই চেন লাগিয়ে রাখি।’

              অতনু আঁচ করেছিল অনেক লোকজন থাকবে মানসী বর্মণের বাসায়, তার সমর্থনে হরতাল হচ্ছে যখন, থাকবে ধর্মঘটের রেশ, একাধজন নেতা সাঙ্গপাঙ্গ সুদ্দু। পুরো ঘরটা আসবাব কার্পেট কিউরিওতে ঠাসা, সামলে চলাফেরার পরিসর। কোনও অজানা প্রতিপক্ষের দুঃখ ছেয়ে আছে যেন।

              মানসী : ( সোফায় বসতে বসতে ) আসুন না, ওখানটায় বসুন, জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসে। ধ্যাৎ, আপনি আপনি বলতে পারছি না। তোমাকে তুমিই বলছি। তুমি তো বেশ ছোটো আমার চেয়ে, তাই না? ( ঘাম না থাকা সত্ত্বেও আঁচল দিয়ে কপাল পুঁছে ) তুমি তো কোথাও যাও না, কারোর সঙ্গে মেশো না বলে বদনাম। উন্নাসিক, না। কৌতূহল হল বুঝি। ইউনিয়ন এমন পাকিয়ে ফেলেছে ব্যপারটা…

              অতনু : ( মানসীর পাশে ধপ করে বসে, পকেট থেকে পারফিউম বের করে এগিয়ে দ্যায়; মানসী হাতে নিয়ে দ্যাখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ) পুরো ঘটনাটা কেমন যেন অবিশ্বাস্য। ননীদার বিয়ে তো রূপকথার গল্প, তারপর আপনার এই দুঃসাহসী কাজ।

              মানসী : ( মৃদু হাসি ঠোঁটে খেলিয়ে, মাথা নাড়িয়ে আলগা খোঁপার ঢল পড়ে যেতে দ্যায় কাঁধে-পিঠে ) ও বাবা, বেশ গুছিয়ে কথা বলতে জানো। ( পারফিউমের ঢাকনি খুলে বাতাসে স্প্রে করে ) আর কী হবে এসবে! আমার গা থেকেই এখন মৃগনাভির গন্ধ বেরোয় ( ডান হাতের তর্জনী রাখে বুকের ওপর )।

              অতনু : ( ঝুঁকে পড়ে প্রায় বুকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে শোঁকে ) হ্যাঁ, সত্যি তালশাঁসের মতন গন্ধ।

              মানসী : ( অতনু কাছাকাছি চলে আসায় বুক ঢিপঢিপ লুকোতে, অতনুর চুলে আঙুল বুলিয়ে ) দুর বোকা। তালশাঁসে কি মৃগনাভির গন্ধ হয়। মাস্ক পারফিউমের নাম শোনোনি?

              অতনু : ( আচমকা উদাসীন ) কে জানে , গন্ধটা পেলে টের পাবো। কিন্তু আপনি এত বড়ো ঝুঁকি নিলেন যে? কিছু যদি হয়? যদি কমপ্লিকেশন হয়।

              মানসী : ( খরস্রোতা ভঙ্গীতে ) কীইইই বা হবে। বরের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি না হলে আমার ছেলেমেয়ে ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়ত এখন। ( চিন্তিত ভ্রূযুগল )।

              অতনু : ( মুখ ফসকে অথচ মানসীর দৃষ্টির গভীরে তাকিয়ে ) ছাড়লেন কেন? সবাই বলে আপনিই তালাক দিয়েছেন।

              মানসী : ( গম্ভীর ) হ্যাঁ, আমিই ছেড়েছিলুম ( ক্ষুব্ধ ) হিজড়ে ছিল লোকটা।

              অতনু : ( বিস্মিত ) হিজড়ে? হিজড়েরা বিয়ে করে নাকি?

              মানসী : ( পরাজিত হাসি ) সে হিজড়ে হতে যাবে কেন? ছোটোবেলায় অসুখ-বিসুখ হয়েছিল কিছু, তাইতে অ্যালিগোস্পারমিয়া হয়। ডাক্তার দেখায়নি। অ্যাজোস্পারমিয়া হয়ে গিয়েছিল। ( উষ্মা ফুটে ওঠে ) অমন বর থাকাও যা, না থাকাও তা। পোকাই নেই তো ডিম ফোটাবে কী করে?

              অতনু : তাতে কী হয়েছে? এখন যেমন করলেন, তখনও চুপিচুপি কারোর স্পার্ম নিয়ে নিতেন।

              মানসী ( অবাক ) কী বলছ কি তুমি! এখন ব্যাপারটা আলাদা। বর থাকতে ওসব করে কখনও কোনো বউ? ঢি ঢি পড়ে যেত। কেলেংকারির একশেষ। বরও মেনে নেবে কেন? এখন যা করেছি তাতে কত গর্ব বলো ইউনিয়ানের। টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে বাংলা অ্যাকাডেমির জীবনময় দত্ত আমাকে নিয়ে ফিচার লিখেছেন, তা জানো?

             অতনু : ছাড়াছাড়ির পর আবার বিয়ে করতে পারতেন।

             মানসী : কুমারী মেয়েরাই বসে রয়েছে, বিয়ে হয় না, ডিভোর্সিকে কে বিয়ে করবে?

             অতনু: কেন? আমি!

             মানসী : ( অতনুর চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষণ হতবাক ) তুমি? পাগল নাকি? ভেবেচিন্তে বলছ? আগে বলোনি তো কখনও! ভালো করে কথাই বলতে না। বেশি পড়াশুনা করেছ বলে একটা ভয়-ভয় ভাবও ছিল। তোমার মা কেন মেনে নেবেন?

              অতনু : ভেবেচিন্তে বলছি না। আবেগেও বলছি না। মাও মেনে নেবে না জানি। কিছুকাল আগে হলে আমিও মেনে নিতুম না। কীই বা এসে যায় তাতেও! কিছুই মানামানির দরকার হয় না মানুষের মতন থাকতে গেলে। জানেন প্রেম মায়া মমতা ভালোবাসা শ্রদ্ধা লোভ সবকিছুই ক্ষণস্হায়ী। মুহূর্তটা ধরুন, ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিন।

              মানসী : ( বিস্ময় আর শ্রদ্ধা ) কত কথা বলতে পারো, সত্যি।

              অতনু : ( উঠে দাঁড়ায়। দরোজার দিকে এগোয় ) কথায় আর কাজে মিল ঘটে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না।

              মানসী ( উঠে দাঁড়ায়। অতনুর হাত নিজের দুহাতে নিয়ে ) আবার এসো, অ্যাঁ, আসবে তো? চা কফি কিচ্ছু খাওয়ালুম না তোমায়।

              অতনু : ( ম্লান হাসে। মাস ছয়েক আগে হলে মানসীর স্পর্শে বজ্রপাত ঘটে যেত তার স্নায়ুকেন্দ্রে )

              অতনু চক্রবর্তী চলে যাবার পর তার দেহের গন্ধ ঘরের ভেতরে উড়ে বেড়াচ্ছিল। মানসী বর্মণ টের পেলো তার অরগ্যাজমের অনুভূতি আরম্ভ হয়েছে। দৌড়ে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো, চোখ বুজে স্বামীর মুখ মনে আনার চেষ্টা করা সত্ত্বেও অতনুর মুখ ভেসে উঠতে লাগল। দেহ কেঁপে উঠল কয়েকবার, সত্যি অরগ্যাজম ঘটে গেল, জীবনে প্রথমবার, কেবল একজন পুরুষের দেহের গন্ধের প্রতিক্রিয়ায়, তা কি এই জন্য যে লোকটা দুশ্চরিত্র বলে প্রচারিত, আর মানসী তার লাম্পট্যের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণে আক্রান্ত হলো। প্রেগনেন্ট তো ছিলই, অতনুকে শোবার ঘরে ডাক দিয়ে তার সঙ্গে একবার শুয়ে দেখা যেত হয়তো। শুলে, ফিসফিসিয়ে  জীবনের প্রকৃত অবস্হা বলা যেত ওকে, বিশ্বাস করতে অসুবিধা হতো না বলেই মনে হয়, তরল চরিত্রের যুবকদের কাছে বিশ্বাস জিনিসটা তেমন গুরুত্ব রাখে না। অফিসের শ্যামলী কর্মকার বলে, যৌনতা বাদ দিলে লম্পটদের চরিত্র আদারওয়াইজ ভালো হয়।

              ভ্রুণটা নির্দিষ্ট সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হলে, আর নষ্ট বলে প্রচারিত হবার পর,  মানসী ডেকে পাঠালো অতনু চক্রবর্তীকে।

              সন্ধ্যাবেলা মানসী বর্মণের ফ্ল্যাটের কলিং বেল বাজিয়ে মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে অপেক্ষার পর ফিরে যাবে কিনা ভাবছিল অতনু, দরোজা খুলতেই ধুপকাঠির গন্ধ আর মানসী, রোগাটে, চুলে ববছাঁট, ফ্রিলদেয়া হলুদ ব্লাউজ, তাঁতের ফিকে হলুদ শাড়ি। কই, দুঃখকষ্টের ছাপ, অফিসের বন্ধুরা বলেছিল, পেল না অতনু, চেহারায়, ঘরের আসবাবে।

              আরে, অতনু!

              আমি ভাবলুম, এখনও ওপরতলার আগরওয়ালের নেকনজর এড়াতে খুলতে চাইছেন না।

              ও ব্যাটা বিদেয় হয়েছে এই বিল্ডিং থেকে। পুজো করছিলুম, তাই দেরি হল।

              পুজো? আপনি পুজো করেন বুঝি? জানতুম না।

              কেন? ঠাকুর দেবতা মানো না? বোসো না, দাঁড়িয়ে রইলে কেন?

              মা মারা যাবার পর ঠাকুর দেবতাদের তোরঙ্গে বন্দি করে রেখেছি। একদিন গিয়ে গঙ্গা ব্রিজ থেকে বিসর্জন দেবো।

              ছিঃ, অমন বলে না। কত বিপজ্জনক চাকরি, কখন কী হয় তার ঠিক আছে। ভগবানে বিশ্বাস রাখতে হয়।

              এসব কী এখানে?

              মানসীর ড্রইংরুমে সেন্টার টেবিলের ওপর রাখা ছিল তুলো, সাইকেল রিকশার ভেঁপুর মতন  লাগানো রবারের হর্ন কাচের গোল বালবে, স্টেনলেস স্টিলের বাটিতে কয়েক চামচ দুধ, গোলাপি হাতলের ডিম্বাকার আয়না। মানসী বর্মণের দপ করে রং পালটানো মুখশ্রী দেখে অতনু টের পেল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। শাড়ির আঁচল সরায় মানসী। দুই বৃন্তকে ঘিরে ব্লাউজে ছড়িয়ে-পড়া দুধের ভিজে ছোপ দেখে অতনু নির্বাক। দেখিয়ে, মানসীর মনে হল, এর আগে অতনু এসে গন্ধের টোপ ফেলে চলে গিয়েছিল, তার পাল্টা টোপ ভিজে বুকের গন্ধ।

              কী করি, ডাক্তার বলেছে পাম্প করে বের করে দিতে, নইলে ক্যানসার হতে পারে, বলল মানসী। নিজেকে নিঃশব্দে বলল, আমার বর যদি এখন আসতো তাহলে তাকেই বলতুম মুখ দিয়ে টেনে বের করে দাও।

              রোজ পাম্প করতে হয়?

              দু-বেলা। দাঁড়াও চা বসাই। আগের বার না খেয়েই চলে গিসলে। টোস্ট খাবে? চানাচুর?

              মানসী রান্নাঘরে ঢুকতেই, অতনু টুক করে খেয়ে ফেলল বাটির দুধ। ঠাণ্ডা কিন্তু মিষ্টি। সোঁদা আচ্ছন্ন করা গন্ধ, সারা শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যায়।

              অনভিপ্রেত আকস্মিকতায় থ, ও, মানসী, ‘পাগল., না মাথা খারাপ, ওঃ সত্যি, ওফ, কোন জগতের জীব তুমি?’ ভেতরের ঘরে চলে যায় মানসী, আর বুঝতে পারে যে সেই অনুভূতিটা আবার ছড়িয়ে পড়ছে দেহে, কেঁপে কেঁপে অরগ্যাজম হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে পড়ল মানসী, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে নাকি নিজের ওপর, কিংবা অন্য ধরণের প্রেমে পড়ে চলেছে, স্বামী তো রয়েছেই, তার সঙ্গে সময়-সুযোগ পেলেই সঙ্গম করে নিয়েছে, এই যুবক এসে কী ঘটিয়ে চলেছে! গায়নাককে কি জিগ্যেস করবে? নাঃ, গায়নাক কী ভাববে! যেমন চলছে চলুক, পরে আবার ঘটলে দেখা যাবে।

              অসীম পোদ্দার অতনুদের লম্পট পিকনিকে নৌকো থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করার আগে একটা ঢাউস ব্যাগ রেখে গেছে মানসীর কাছে, বলেছিল, এটা প্লিজ আপনার কাছে রাখুন, আমি বাইরে যাবো কিছুদিনের জন্য, বন্ধুদের তো জানেনই কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।

              ব্যাগে তালা দেয়া ছিল না, বলে কৌতূহল মেটাতে মানসী একদিন জিপ খুলে দেখেছিল, একটা ডায়রিতে পেছনের দিকে পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে প্রেমপত্র লিখে গেছে অসীম পোদ্দার, আর সামনে দিকে লাল কালিতে পাতার পর পাতা লিখে রেখেছে ওঁ রামকৃষ্ণায় নমোঃ, পোর্টম্যাণ্টো ব্যাগের ভেতরে ডায়েরির সঙ্গে ঠেসে-ঠেসে ভরা দোমড়ানো-মোচড়ানো অজস্র  টাকা। নিশ্চয়ই অফিস থেকে চুরি করে রেখেছিল, সুযোগ পেয়ে গছিয়ে গেছে মানসীকে, আত্মহত্যা করার আগে। ব্যাগটা আপাতত অতনুর হাতে ধরিয়ে দেয়া যাক, ওর তো কেউ নেই বাড়িতে, মা মারা গিয়ে অব্দি ঝাড়া হাত-পা। মানসী নিজেকে বোঝালো যে অপ্রত্যাশিত অরগ্যাজমের আনন্দ দেবার জন্য অতনুকে তার দাম হিসাবে দিচ্ছি ব্যাগটা ; তারপর তো চুপচাপ বরের কাছে চলে যাব, যা করার করবে অতনু, খরচ করুক বা বিলি করুক।

              অতনুকে বসিয়ে রেখে, সেজে নেয় মানসী, লালপাড় গরদ, কপালে বিশাল লাল টিপ, হাতে টাকাঠাসা আর আসীম পোদ্দারের ডায়েরি রাখা ব্যাগটা এনে রাখে অতনুর পায়ের কাছে, ‘তালশাঁসের গন্ধ পাচ্ছ না’ জানতে চায়।

              না, চারিদিকে কেমন দুধ-দুধ গন্ধ। বাচ্চাটা নষ্ট হল আপনার মনখারাপ হয়নি?

              এখন জানি আমার পেটে বাচ্চা হতে পারে। তোমার কথা বল। অনেক কানাঘুষো শুনি।

              যা শোনেন সবই সত্যি।

              সত্যি?

              বোঝা গেল অমন সরাসরি সত্যি কথা আশা করেনি মানসী, তাই অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, ‘আমার এই ব্যাগটা তোমার কাছে রেখে দিও, অ্যাঁ, কিছু দরকারি কাগজপত্র আছে। আমি কিছুদিনের জন্য ওরসলিগঞ্জ যাচ্ছি।

              ওয়ারিস আলি গঞ্জ? ও তো মারাত্মক জায়গা, মুসহররা থাকে, সৎযুগ মানঝি, ঝাড়ুদার, কেয়ারটেকার রাঘবের পেছন-পেছন চাবি নিয়ে ঘুরত, ও তো ওখানকার। ইঁদুর পুড়িয়ে খায়।

              ইঁদুর পুড়িয়ে তো অনেক দেশেই খায়, চীনে আর থাইল্যান্ডের ভালো রেসিপি আছে ইঁদুর রান্নার, লোকে থাই ফুড বলতে অজ্ঞান, দেখেছো তো। ওতে আবার খারাপ কীসের? আসলে ওরা একেবারে একঘরে হয়ে গেছে উঁচু জাতের লোকগুলোর চাপে। কুচ্ছিত অবস্হা।

              ওরা তো বিয়ে করে আর ছাড়ে। করেই না অনেক সময়ে, এমনিই থাকে। সৎযুগ মানঝির কতগুলো ছেলেমেয়ে ও নিজেই জানে না। কিন্তু আপনি অমন একটা জায়গায় যাচ্ছেনই বা কেন?

              আমার এক নিকটাত্মীয় ওখানকার গান্ধি আশ্রমে মুসহরদের উন্নতির জন্য কাজ করেন।

              তাই বুঝি?

              হ্যাঁ। দ্বারভাঙা কালী বাড়ি যাচ্ছি, তুমি যাবে?

              চলুন। ব্যাগটা তুলে নিল অতনু। ভাগ্যিস মোটর সাইকেল আনেনি। মোটর সাইকেলে মানসী কি বসতে চাইতো পেছনে। চাইতো না বোধহয়। মেয়েরা জানে যে ব্রেক কষলেই যে মহিলা পিলিয়নে বসে তার বুক চালকের পিঠে ধাক্কা খাবে।

              রিকশয় ঠেসাঠেসি, দুধের গন্ধ পায় অতনু। রাস্তায় এত গর্ত যে ছিটকে পড়তে হবে শক্ত করে ধরে না থাকলে। রাজেন্দ্রনগর, মেছুয়াটুলি, মাখানিয়াকুঁয়া হয়ে অশোক রাজপথে পড়ে। বাঁদিকে গলিতে ঢুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিলডিং, এর ভেতরে গঙ্গার তীরে মন্দির। দ্বারভাঙ্গা বিলডিঙে ঢোকার মুখে পথের দুপাশে চর্মরোগ যৌনরোগের হাসপাতাল-বিভাগ। খুঁটিতে বাঁধা গোরু-মোষ।

              ছাত্র ইউনিয়ানের নির্বাচনের সময়ে যে পাম গাছটায় বেঁধে অরবিন্দ অবস্হির মাথায় লোমনাশক লাগানো হয়েছিল, অতনু দেখল, গাছটা এখনও তেমনি ঠায় একা দাঁড়িয়ে, অরবিন্দ অবস্হির স্মৃতি নিয়ে।

              অন্ধকারে প্রাচীন মন্দির, কালচে ধরেছে দেয়ালে, পায়রা চামচিকে অবাধ, ফুল-পচা বেলপাতা শুকনো রেড়ির তেলের গন্ধ। মন্দিরে ঢোকার মুখে অতিগরিব ভিকিরি আর গরিব জুতোরক্ষক। জলভেজা পাথরের ঠাণ্ডা মেঝে। সিঁদুরমাখা হাড়িকাঠ, কখনও ছাগবলি হতো। পাকাদাড়ি আদুলগা বুড়োদের প্রায়ান্ধকার জটলা। ঝোঁপতোলা ঘোমটায় বউ।

              ‘খুব জাগ্রত এই মন্দিরের ঘণ্টা, আপনা থেকে বাজে, রাত্তির আটটায়’, জানায় মানসী। অতনু উত্তর দেয় না। ও তখন দেখছিল, নিরন্তর পরিপূর্ণতায় উপচে-পড়া নর্দমা, কুলুঙ্গির মধ্যে শ্যাওলাপোশাক দেবতাদের দুর্বল ভঙ্গি, নিরীহমুখ দেবী-দেবতা, দালানে শুয়ে নিজের কুঁই কুঁই উপলব্ধিকে প্রকাশে মশগুল কুকুর। ‘খুব জাগ্রত, মাথায় জবাফুল রাখার পর যদি পড়ে না যায়, তাহলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়’, মানসী বোঝাল।

              আপনার ফুল পড়ে যায়, না থাকে? জিগ্যেস করল অতনু।

              পড়ে যাবে কেন! থাকে। একবারও পড়েনি আজ অব্দি।

              নিজেকে নিজে অতনু বলছিল, বাচ্চাটার স্বাস্হ্যের জন্য কি মানত করেছিল মানসী বর্মণ? কে জানে। জিগ্যেস করা ঠিক হবে না।

              অন্ধকারে প্রদীপ জ্বালিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, একদা দ্বারভাঙ্গা মহারাজের, এখন কারোরই নয়, কালী প্রতিমা। বোধহয় দুধে-চিনিতে চান করানো হয় তাই মাথার ওপরে আটকে থাকে ফুল। দর্শনার্থীরা একের পর এক ফুল চাপিয়ে, পুরুতকে টাকা দিয়ে, মনস্কামনা পুরো করার আগাম মিটিয়ে চলে যাচ্ছে। মানসী ব্লাউজ থেকে টাকা বের করে পুরুতকে দিল, হাত জোড় করে দেখে নিল প্রতিমার মাথার ওপর ফুল রয়েছে, পড়েনি, তার মানে ওনার বর ডাক্তার ঘোষ বহাল তবিয়তে আছেন, পুলিশ পেছু নেয়নি।

              তুমি চাও না কিছু। দেখ না। হয়তো ঝট করে বড়ো অফিসার হয়ে যাবে।

              একটা করকরে নতুন নোট দিল অতনু, পুরুত ফুল চাপালো হাসি মুখে, তক্ষুনি পড়ে গেল ফুলটা। মানসী গম্ভীর, পুরুত গম্ভীর। অতনু আবার একটা করকরে নতুন নোট দিল, পুরুত ঠিক মতন জায়গা বেছে ফুল রাখল যাতে না পড়ে, বেশ কিছুক্ষণ প্রতিমার মাথার চিনিমাখানো মুকুটে ফুল রেখে সরিয়ে নিল হাত, পড়ে গেল ফুলটা। দর্শকদের গুঞ্জন আরম্ভ হয়ে গেছে অতনুকে ঘিরে। তিন বার চড়ানো যায় জানাল এক ভক্তিমতী বউ। অতনু আবার দিল নতুন নোট, প্যাকেট থেকে বের করে। পুরুতের হাত থরথর। ফুল পড়ে গেল। ভিড় জমতে থাকে অতনুকে ঘিরে। মানসীর কাঁপতে-থাকা হাত ধরে বাইরে আসে অতনু,  জুতো পরে যে যার, হাঁটে গলিপথ ধরে দু-জনে চুপচাপ।

              প্রাঞ্জল রাজপথে পোঁছে যে যার বাড়ি যাওয়াই, কোনও কথা না বলে, উচিত মনে করে। নভেলটি বুক ডিপোর বহুতল বাড়িটার কাছে রিকশায় তুলে দিল মানসীকে। রিকশয় চাপার আগে অব্দি, অতনুর পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল মানসী, নিয়ন্ত্রণহীন, এমনকি হ্যালোজেন আলোয় আবছা বেজে উঠছিল পায়ের মল।

             মানসী আক্রান্ত হয়েছিল অরগ্যাজমে, মন্দিরের ভেতরেই ওর শরীরে আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল ঢেউ, অতনুর পাশে দাঁড়িয়ে ঘটে গেল কেঁপে কেঁপে। অতনু নির্ঘাত ভাবছে কালী প্রতিমা ফুল নিলেন না বলে মানসীর অমন প্রতিক্রিয়া ; অতনুর সঙ্গে থাকলেই কেন এমন ঘটছে, দুশ্চিন্তায় মানসী, মন্দিরের মতন জায়গাতেও ঘটে গেল। গায়নাক দেখাবে, নাকি স্বামীকে বলবে? কী করেই বা স্বামীকে বলবে যে একজন পরপুরুষের চৌম্বকক্ষেত্র মানসীকে পরপর যৌন আকর্ষনে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে!

              অতনু টের পায়নি মানসীর কাঁপুনির উৎস, ও বোধ করছিল এক গোপন আনন্দ, কালী প্রতিমাকে পরাজিত করার আনন্দ, মানসীর দৈববিশ্বাস টলিয়ে দেবার আহ্লাদ। ওর আনন্দ দেখে ছুটন্ত ট্রাকগুলোর চক্ষুস্হির। মানসী অমনভাবে না কাঁপলে, কী এক অচেনা থরথর, বাড়ি অব্দি পৌঁছে দিয়ে আসার প্রস্তাব দিত অতনু।

              মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে অফিসের সহকর্মী অরিন্দম মুখোপাধ্যায়, যে হিউমান রিসোর্সে কাজ করে, অতনুর সঙ্গে অফিস ফেরতা ওর বাড়িতে এসেছিল দিনকতক পরে, দুচার ফুঁক চরস খাবার গোপন সদিচ্ছা নিয়ে। পাকানো সিগারেট তামাকে মিশেল দিয়ে টেনে ঘণ্টা দুয়েক এমন একনাগাড় হেসেছিল অরিন্দম যে, অতনুর মনে হচ্ছিল, আগে একবার অপ্রকৃতিস্হ অরিন্দমের আবার বুঝি ঘটল মগজের বেগড়বাঁই, ফের ফিরে যাবে মানসিক চিকিৎসালয়ে।

            পাশবালিশ টেনে, আয়েস করে ফুঁক মেরে অরিন্দম বলল, জানেন তো মানসী বর্মণ রিজাইন করে চলে গেছে ওরসলিগঞ্জের গান্ধি আশ্রমে কাজ করার জন্যে?

            চলে গেছে? কবে? জানি না তো!

            আপনি তো এমন বলছেন যেন আপনার অনুমতি নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল।

            হ্যাঁ, খবরটা শুনে ভেতরে ভেতরে খারাপ লাগল। কবে গেছে?

            গত মাসের পনেরো তারিখে ; উনি বলেছিলেন, জানাজানি না করতে।

            ওয়ারিস আলি গঞ্জ তো মারাত্মক জায়গা। মুসহররা থাকে। বিনোদ মিশ্রর নকশালদের গড়। একজন সুন্দরী আধুনিকা থাকবেন কী করে সেখানে গিয়ে? ওরকম একটা জায়গায় গান্ধি আশ্রম করেটাই বা কী?

             আশ্রম পরিচালক ওনার স্বামী।

             স্বামী? মানসী তো ডিভোর্সি?

             সব বানানো গল্প। লোক দেখানো। ওনার স্বামী এম বি বি এস ডাক্তার। ডাক্তারি করেন আর নিচু জাতের লোকেদের মধ্যে বিপ্লবের প্রচার। বাচ্চাটাও ওনারই। আর, গান্ধি আশ্রম বলে কিছুই নেই ওখানে। আছে ডাক্তারখানা। শুনেছি যে মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টারের ক্রান্তিকারী কিষাণ সমিতির অফিস ওটা।

              আপনি কী করে এতসব জানলেন?

              উনি চলে যাবার পর জানতে পারলুম রসিক পাসওয়ানকে খুঁচিয়ে-খুঁচিয়ে।

              অতনুর মন খারাপ হয়ে গেল শুনে।

              মানসী বর্মণের জন্য মনকেমন করে অতনুর; অন্যের স্ত্রীর জন্য মনকেমন। জানা তো ছিল না,  যে  অন্যের স্ত্রী, কেন জানায়নি মানসী, কেন বুকের দুধ দেখিয়েছিল, কেন তালশাঁসের গন্ধ শুঁকিয়েছিল, কেন কালী মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল রিকশয় পাশে বসিয়ে, কেন তাহলে ব্যাগটা রাখতে দিয়েছিল, ওটা নিয়ে আমি কী করব, মনের গভীরে ফুঁপিয়ে ওঠে ও, অতনু।

              অফিসের কর্মীদের মাঝে খবর নেয়াদেয়া হয়, মুসহর ছেলেমেয়েদের অক্ষরজ্ঞান দিতে দেখা গেছে মানসী বর্মণকে, গয়া নওয়াদা অওরঙ্গাবাদ জেহানাবাদের গ্রামে, বন্দুকধারী যুবকেরা থাকে ওর পাহারায়।

             বছরখানেক পরে অফিসে একদিন কি হ্যাঙ্গাম, পাগলা ঘণ্টি। বিপদ আপদ ডাকাতি সামলাবার জন্য অফিসে নানা জায়গায় অ্যালার্ম ঘন্টির বোতাম লুকানো আছে। কাচের ঢাকনি ভেঙে বোতাম টিপলে সারা অট্টালিকা জুড়ে বাজতে থাকে পাগলা ঘণ্টি। ন-মাসে ছ-মাসে একবার করে মহড়া হয়। বহুক্ষণ বাজছিল বলে টের পাওয়া গেল আজকেরটা রিহার্সাল নয়, আসল। বাইরে বেরোবার আর ঢোকবার শাটার গেট দরোজা সব বন্ধ হয়ে গেল দ্রুত, তাক করে বসে গেল বন্দুকধারীরা পুরো বিল্ডিঙের বিভিন্ন ফ্লোরে, সুট-টাই পরা কর্তাদের হন-হন গট-গট, চেয়ার থেকে মুণ্ডু বার করে হাফ-কেরানি আর কেরানিদের কচাল। ঘণ্টাখানেক পরে অলক্লিয়ার ঘণ্টি বাজলে জানা যায় ব্যাপারটা। একজন অফিসার, যিনি জোড়াতালি দেয়া নোট পাস করেন এক এক করে, তিনি বাজিয়েছিলেন।

              ছেঁড়া জোড়াতালি নোটের কেরানিদের খাঁচার পেছনে ওই অফিসারের কেবিন, যিনি অ্যালার্ম বেল বাজিয়েছিলেন। পাবলিক আর নোটের দালালরা ছেঁড়াপচা নোটের লট দ্যায় কাউন্টারের কেরানিকে, সে নিজের খাতায়-কমপিউটারে এনট্রি করে অফিসারকে দেয়। তক্ষুনি বদলযোগ্য হলে অফিসার নোটের ওপর সই তারিখ দিয়ে পাঠায় হাফ-কেরানির কাউন্টারে। সেখানে টোকেন দেখিয়ে নতুন নোট নিয়ে যায় পাবলিক বা নোটের দালালরা।

             আপন মনে জোড়াতালি নোট পাস করছিলেন অফিসার। আচমকা একটা নোট হাতে নিয়ে তিনি স্তম্ভিত। নোটটা তিনি নিজেই বছরখানেক আগে ছাপ তারিখ সই দিয়ে পাস করেছিলেন। এটা তো শ্রেডারে শ্রেড হয়ে কাগজের মন্ড হয়ে যাবার কথা। বাজারে গেল কী ভাবে! তার মানে নিয়ম মেনে নষ্ট করার প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি, মাঝ পথেই মেরে দিয়েছে কেউ; কিন্তু প্রক্রিয়াটা তো এমন যে, কোনো একজনের পক্ষে একাজ করা সম্ভব নয় ; নিশ্চয়ই একটা দল কাজ করছে, বাতিল নোট পাঠিয়ে দিচ্ছে বাইরে সার্কুলেশানে। কবে থেকে চলছে, কত নোট বাজারে বেরিয়ে গেছে, তার মানে তার তো কোনো হিসাব নেই। এক বছর আগের নোট, তার মাঝে কত এরকম নোট চলে গেছে সার্কুলেশানে। যে লোকটা নোটটা দিয়েছে, ধরতে হবে তাকেই। ভয়ে গলা শুকিয়ে যায় অফিসারের, কপালে বিনবিনিয়ে ঘাম। পেপারওয়েট তুলে সজোরে কাচঢাকা অ্যালার্মবেলের কোটরে মেরে বাজিয়ে দিলেন পাগলা ঘণ্টি। খদ্দেরটা নজর রেখেছিল, অফিসার নোটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আলোয় পরখ করছেন দেখেই সে ব্যাটা হাওয়া।

              পুলিশে খবর দেয়া হল। ওই নোটটা যে কর্মীশেকলের মাঝ দিয়ে একের পর এক গেছে, তাদের নামঠিকানা যোগাড় করে ঢুঁ মারতে লাগল পুলিশ। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হল। অতনু নিজেকে বলল, মানসী বর্মণ নিশ্চয়ই এই র‌্যাকেটের অংশ নয়, কিন্তু একটা ঢাউস ব্যাগ হুট করে দিয়ে উধাও হয়ে গেলো কেন!!

              বাড়ি পৌঁছে খাটের তলা থেকে মানসী বর্মণের দেয়া ব্যাগটা টেনে, ধুলো ঝেড়ে, জিপ খুলতেই অতনু হতবাক, থ। ঠিক যা অনুমান করেছিল। অগোছালো নোটে ঠাসা, ছেঁড়াকাটা নোটের সঙ্গে বদলে নেয়া হয়েছে বা পিলফারেজ করা হয়েছে। ভেতরে অসীম পোদ্দারের ডায়রি, পাতার পর পাতা মানসী বর্মণকে লেখা প্রেমপত্র, যৌনরোগ বা যৌনস্বেচ্ছাচার থেকে পাওয়া রোগ আর সারবে না জানিয়েছে শেষ প্রেমপত্রে। ভাগ্যিস মানসী বর্মণ চলে গেছে, নয়তো এই নোটগুলো ওর বাড়িতে যদি পুলিশ পেতো কী কেলেঙ্কারি হতো!

              ভোরবেলা, বাড়িতে দরোজায় তালা ঝুলিয়ে, ওয়ারিস আলি গঞ্জ যাবার বাস ধরার জন্য বেরিয়ে পড়ে অতনু, এক হাতে টাকাঠাসা ঢাউস ব্যাগ, কাঁধে ঝোলানো থলেতে এক সেট জামা কাপড়।

              ওয়ারিস আলি গঞ্জে বাস স্ট্যাণ্ডে বাঙ্গালি ডাক্টার গরিবোঁকা মাস্টারনি কোথায় থাকেন জিগ্যেস করতে একটা রিকশঅলা জানায় চলুন বাবু, আমি পৌঁছে দিচ্ছি, ওনারা তো দেওয়ি-দেওতা।

              রিকশ থেকে অতনু নামলে রিকশঅলাটা বলল, ওই যে ডাগডরবাবু, রোগী দেখছেন।

              এত রোগিগী? এতো ছোটোখাটো জনসভার মতন, সবাই মাটিতে বসে ওনার কথা শুনছে, বলে ফেলল অতনু।

              জি হাঁ, দূর দূর থেকে আসে, ওষুধ দেন, টাকা-পয়সা নেন না।

              অতনু ঘরের ভেতরে ঢুকতেই ডাক্তার ওর হাতের ব্যাগ আর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, নিশ্চয়ই অতনু চক্রবর্তী, যিনি আমার দুধের বাটি থেকে চুমুক মেরে আমার স্ত্রীর গেলে-রাখা দুধ খেয়েছিলেন?

             আপ্যায়নে স্তম্ভিত অতনু, কী বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। কেমন স্ত্রী? এই কথাগুলোও নিজের স্বামীকে বলেছে। শহুরে মানুষ দেখে একজন রোগী ভেতর থেকে একটা মোড়া এনে দিতে অতনু দেখল, ডাক্তারও মোড়ায় বসে আছে, টাক পড়া আরম্ভ হয়েছে, ফর্সা দোহারা চেহারা, টেবিলের ওপর নানা ওষুধের স্ট্রিপ।

             অতনু মোড়ায় বসার পর ডাক্তারের বলা পরের কথায় হতবাক হয়ে গেল, ডাক্তার বলল, মানসী চলে এলো দুটো কারণে, প্রথমত বুকের বইতে থাকা দুধ, আর দ্বিতীয়ত আপনার উপস্হিতিতে ওর তিনবার অটোম্যাটিক অরগ্যাজম হয়ে গিয়েছিল; বুক থেকে দুধ গালতে গালতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, এখানে আসার পর আমিই আমার স্ত্রীর দুধ পান করার সুযোগ পেলুম, রাইট ফ্রম সোর্স। আপনি এসে ভালো করলেন, আমরা তো অনুমান করেছিলাম যে আপনি আরও আগেই আসবেন।

              ডাক্তার বলা বজায় রাখলো, মানসী বলেছে আমায় যে আপনি ওর নতুন প্রেমিক আর ও-ও আপনার উপস্হিতির প্রতি এমনই আকর্ষিত হয়ে পড়েছিল যে চলে আসতে বাধ্য হল। মানসী রোঁদে বেরিয়েছে, ঘণ্টা দুয়েকে এসে পড়বে। আপনি ততক্ষণ ভেতরে গিয়ে স্নানটান করে নিন, লুঙ্গি-পায়জামা কিছু এনেছেন, না এনে থাকলে আমারই একটা পরে নিন, ভেতরে বারান্দায় তারে ঝুলছে। ওইটা টাকার ব্যাগ তো? ভালোই করেছেন এনে, বেশ কয়েকজন রোগির যৎসামান্য দামি ওষুধ দরকার, অন্য কাজেও লাগবে। অসীম পোদ্দারের প্রেমিকের ডায়েরিটাও ওতে আছে? থাকুক কখনও সময় হলে পড়ব। মানসী তো ফুলশয্যার রাতে ক্লাস এইট থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত যে তিনশো প্রেমপত্র পেয়েছিল সেগুলো পড়ার সুযোগ হয়নি আমার। অনেক কথা বলে ফেললাম। বাংলা বলার সুযোগ পেয়ে ছাড়তে চাইছিলাম না। যান যান, আপনি ভেতরে যান।


    দশ

              মলয় রায়চৌধুরী ডাক্তার ঘোষকে প্রথমে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন জঙ্গলমহলে আদিবাসিদের কুঁড়হা পরবের দিন, গা ঢাকা দেবার আর আদিবাসী রোগীদের সেবা করার জন্য, সেখানে মাওবাদীদের জমায়েতে ভিড়ে গিয়ে তাদের নির্দেশ মতো যাতে কাজ করতে পারে। সেখান থেকে চলে যেতে হলো ওয়ারিস আলি গঞ্জে, গান্ধি আশ্রমের নাম করে পার্টির কাজ করার জন্য, রোগীদের মধ্যে বিপ্লবের কথা প্রচারের জন্য। মানসী বর্মণ আর ডাক্তার দুজনে ভালোই ছিল ওয়ারিস আলি গঞ্জে, কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী সেখানে পাঠিয়ে দিলেন অতনু চক্রবর্তীকে,  আর ডাক্তারের জীবন ওলোট-পালোট হয়ে গেল। চৈত্রসংক্রান্তির দিন জঙ্গলমহলের আদিবাসিরা মুড়ি বা ছোলার ছাতু আর আম দিয়ে কুঁড়হা উৎসব করে। আগে এই পরব কুরমি আর আদিবাসীরা করতো, ক্রমশ ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম, উত্তর দিনাজপুর, ঝাড়খণ্ড রাজ্য, বিহার, উড়িষ্যা রাজ্যের জনজাতির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কুরমি সম্প্রদায়ের মানুষরা সেই দিন সকালে গোবর গুলে ঘরের সব ঘরগুলোয় আর উঠোনে ন্যাতা দেন যাতে বাড়ি শুদ্ধ হয়ে ওঠে। মহিলারা বাড়ির দোরগোড়ায়, উঠোনে, তুলসীমঞ্চে, হরিমঞ্চে আলপনা দেন। বাড়ির কর্তা বা বড়ো বউ যিনি উপোসি থাকেন, তিনি চান করে কচি শালপাতার থালাতে আম, মুড়ি বা ছোলার ছাতু আর মহুয়া রেখে পূর্বপুরুষের আত্মার উদ্দেশ্যে তুলসীমঞ্চে প্রার্থনা করেন। পুজোর আগে যাবতীয় সমিধ বাড়িতে জড়ো করে রাখতে হয়। পয়লা মাঘ হলো আখান যাত্রা। অনেকে মানত করে পাঁঠা কিংবা মোরগ বলি দেন। পুজোর মাংস গ্রামের সবাইকে ভাগ করে দেয়া হয়। কুরমিরা মহুয়াকে নারী আর আমকে পুরুষ হিসাবে অনন্তকাল থেকে মান্যতা দিয়ে এসেছে। তারা বলে ‘আম ডাকে বান’ আর ‘মহুল ডাকে খরা’। যে বছর আম বেশি হয় সে বছর প্রচুর বৃষ্টি পড়ার কথা। যে বছর মহুয়া বেশি হয় সে বছর বৃষ্টি কম হবার কথা। এখন আমও বেশি হয় না, মহুয়াও বেশি হয় না। বৃষ্টি আর খরা নিজের ইচ্ছেমতন আসে।

              ডাক্তার কুরমিদের কুঁড়হা উৎসব মনে রেখেছে, মহুয়ার মদ প্রথমবার খেয়ে বাঁধনছেঁড়া মাতলামো করেছিলো।

              ডাক্তারের মনে আছে পালামৌয়ের নরসিংহপুর পাথরা গ্রামের কথা, সেখানে গিয়েছিলো মলয় রায়চৌধুরীর প্ররোচনায়, দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত গ্রামে, খরা, প্রচণ্ড গরম, জল নেই, খাবার নেই, মানুষেরা যে গাছের পাতা আর আমের আঁটি খেয়ে বাঁচার চেষ্টা করে তা কলকাতায় ছাত্র-রাজনীতি করার সময়ে ভাবতেও পারেনি। সরকার খিচুড়ি বিলি করতো, যার জন্যে ছেলে বুড়ো বউ সবাই হাতের তলায় হাত পেতে খিচুড়ি নিয়ে খেতো, ব্যাস এক হাতা, তার চেয়ে বেশি খিচুড়ি যোগাতে পারতো না সরকার। গ্রামের ডিসপেনসারিতে কোনো ওষুধ ছিল না, সেখানেই শুতো ডাক্তার। অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষেপে গেলো ডাক্তার। মানসীকেও নিজের বিশ্বাসে চুবিয়ে ফেলতে সময় লাগলো না।

          তারপর থেকে ডাক্তার কেবল একবেলা খায়, রাতে খায় না কিচ্ছু।

           ১৯২৯ সালে লেখা মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী’ বইয়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল ডাক্তার ঘোষের। উনি লিখেছিলেন, “তখনকার দিনে অধিকাংশ লোক ভাত খাইত। সহরে লোকেরা দিনে আড়াই পোয়া চালের ভাত, রাত্রে আধসের চাল ও তদোপযুক্ত তরকারি। অনেক লোকের বাযিতে গোরু ছিল এইজন্য দুধও পাওয়া যাইত। না হইলে গয়লাদের বাড়ি হইতে দুধ আসিত, সেও সস্তা। কলকাতার দক্ষিণদেশ বা বর্ধমান হইতে আমাদের বাটীতে যখন লোকজন আসিত, তাহারা অধিক পরিমাণে আহার করিত। দুপুরবেলা তিন পোয়া হইতে এক সের চালের ভাত খাইত এবং রাত্রে কিছু কম।”

            আজ, কেন ওনার মনে হচ্ছে যে অবিচারের বিরোধিতা করতে গিয়ে অবিচারের আশ্রয় নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আজ কেন মনে হচ্ছে মানসীকে ভুল পথে এনে মানসীকে ছাড়তে না পেরে নিজের ভেতরে নিজেই হারিয়ে গেছেন।

            মনে পড়ে যাচ্ছে, মেক্সিকো অলিম্পিকে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিযোগীদের ব্ল্যাক পাওয়ার স্যালিউট।
            মনে পড়ে যাচ্ছে ভিয়েৎনামে ন্যাশানাল লিবারেশান ফ্রন্টের টেট আক্রমণ-প্রণালী।
            মনে পড়ে যাচ্ছে চেকোসলোভাকিয়ার প্রাগ বসন্তকাল।
            মনে পড়ে যাচ্ছে প্যারিসের পথে-পথে ১৯৬৮ সালের মে মাসে ছাত্রদের উথ্থান।
            মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৬৪ সালে কলকাতায় হাংরি আন্দোলনকারীদের হাতে হাতকড়া কোমরে দড়ি পরিয়ে রাস্তায় হাঁটানো।
            মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯৭১ সালের আগস্টে বরানগরে শয়ে-শয়ে যুবহত্যা, ঠেলায় গাদাগাদি চাপিয়ে গঙ্গায়।
            মনে পড়ে যাচ্ছে লাতিন আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, প্যালেসটাইন, ভিয়েৎনাম।
            মনে পড়ে যাচ্ছে ঈশ্বরের মৃত্যু।

            মানসী এখনও ঈশ্বরে বিশ্বাস ছাড়তে পারেনি, জানে অতনু ওর মায়ের দেবী-দেবতাকে থলেতে ভরে গঙ্গার জলে ফেলে দিয়েছিল।


    এগারো

              কী করছ কী? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আঃ, ছাড়ো।

              মনে করুন আপনি আমাকে জন্ম দিচ্ছেন, তাই কষ্ট হচ্ছে, মনে করুন, মনে করুন, সেই সময়ের যন্ত্রণা, আপনি কি মনে করেন আমার জন্মাবার কোনো যন্ত্রণা হয়নি, কষ্ট হয়নি?

              আর ইউ ম্যাড? কী করছ কী, নামো নামো, আমি তোমার মা, কী করছ কী, অমিত, এত জোরে জড়িয়ে ধোরো না, ছাড়ো ছাড়ো, মুখ সরাও, দাঁতও মাজো না কখনও, নোংরা জানোয়ার কোথাকার। ইট ইজ ইনসেস্ট, বাস্টার্ড!

              জানি আমি জারজ, জানি  আপনি আমার মা, কিন্তু জানি না আমার বাবা কে, অতনু না ডাক্তার ঘোষ? দুজনের সঙ্গেই তো শুতেন এক সময়, তাই না? এখন না হয় আমার সঙ্গেই শুলেন।

              ছাড়ো, ওফ, ছাড়ো, লুম্পেন একটা। এটা আনন্যাচারাল, এটা ইনসেস্ট, ডোন্ট ডু ইট, প্লিজ, ওফ, আমার তো বয়স হয়েছে, এই বয়সে এসব, প্লিজ ছাড়ো, বয়স হলেও এখনও মেন্স হয়, আমি তোমার সন্তানের মা হয়ে যেতে পারি।

              আমি তো সেটাই চাই, আপনি একই সঙ্গে আমার মা আর আমার ছেলের মা। বিপ্লব দীর্ঘস্হায়ী হোক, তাই না? আমি বিপ্লব করছি এখন,। কেন ছাড়বো, ওনাদের দুজনকে তো আপনার দুধ খাইয়ে ছিলেন, যা আমার প্রাপ্য ছিল।

              কী করছ কী?

              আপনার দুধ খেতে চেষ্টা করছি।

              দুধ থাকে নাকি এই বয়সে, ইউ ইডিয়ট, নেমে পড়ো, ছাড়ো, ছাড়ো, কখন আমার বিছানায় চলে এসেছো! আরে কী করছ কী!

             কাঁদতে আরম্ভ করেন কমরেড মানসী, ফুঁপিয়ে, যাতে কেউ না শুনতে পায়।

             কাঁদুন, কাঁদুন।

             কী করলে তুমি জানো?

             দুধ নেই জানি, তার বদলে আপনার ঘামই খাচ্ছি, গন্ধ খাচ্ছি, আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্ককে গড়ে তুলতে চাইছি। মিষ্টি দুধের বদলে নোনতা ঘাম, আপনার শরীরের জোনাকিদের মুখে পুরে নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে নিতে চাইছি।

             পাগল নাকি? বন্ধ করো, ওফ, নাম, নাম আমার ওপর থেকে, নাম, তোকে এখানে আনাই উচিত হয়নি। মুখের ওপর থেকে মুখ সরা।

             মারুন চড়। যাক তুইতোকারিতে তো এলেন, এতদিন ছিলাম আপনার সঙ্গে, যেই নিশ্বাস বন্ধ হতে লেগেছে তখন বুঝতে পারলেন যে তুইতোকারি করতে হবে।

             অমিত, তুমি জানোয়ারের কাজ বন্ধ করো, ছাড়ো আমায়, ছাড়ো।

             ছাড়ব না।

             কী করছ,  ইউ স্কাউন্ড্রেল, কী করার চেষ্টা করছ?

             আপনার তৃতীয় প্রেমিক হবার চেষ্টা করছি। মুখ বন্ধ রাখুন। নিন প্রেম, নিন প্রেম,  ক্রান্তি, ক্রান্তি, ক্রান্তি….।

             কষ্ট হচ্ছে, কষ্ট হচ্ছে, ব্যথা করছে। বয়স হয়ে গেছে, এই বয়সে হয় না ওসব, গেট ডাউন, ইউ স্কাউণ্ড্রেল কী চাই তোমার?

             আপনাকে চাই। জানতে চাই, আমার বাবা কে?

             তুমি অতনুর ছেলে নও , তুমি ডাক্তারের ছেলে।

             হ্যাঁ, কাঁদুন, আমি চাই কষ্ট হোক, নিজের কাছে অপমানিত বোধ করুন, নিজের সম্পর্কে আপনার ঘেন্না ধরে যাক, যেমন আমার নিজের জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে। যা চাই তা্-ই তো নেবার জন্য আপনার বুকের ওপর চেপেছিলুম। বালিশের তলায় কী খুঁজছেন? সায়লেন্সার-লাগানো রিভলভার? আমার দেয়া  টাকায় কিনেছিলেন, এখন আমায় মারবার জন্য চালাতে চান, তাই না? সেটা আমি আগেই সরিয়ে রেখেছি, জানি আপনার কাছে আপনি ছাড়া আর কারোর কোনো দাম নেই। ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, শুনেছি, ডাক্তার ঘোষ বলেছেন আমায়, দেখুন ঈশ্বর এখন আপনাকে বাঁচাতে আসছে না। বন্দুকও আপনাকে বাঁচাতে আসছে না। চুলোয় যাক আপনার ক্রান্তি, এটা আমার বদলা নেবার ক্রান্তি। আপনি চেঁচাতেও পারবেন না, জানি, আপনার ক্রান্তিকারীরা জড়ো হলে লজ্জায় বেঁচে থাকতে পারবেন না।

             কী করলে কী তুমি, ছি ছি ছি ছি।

             ওই ছিছি নিয়ে আমি এতকাল বেঁচে ছিলুম, এবারে আপনি আমার সারা জীবনে জড়ো করা ছিছিক্কার নিয়ে বাঁচুন। খাট থেকে উঠবেন না, চুপ করে শুয়ে থাকুন, নয়তো মরবেন, এই দেখুন সায়লেন্সার লাগানো আপনার ক্রান্তির যন্তর, আমারই দেয়া টাকায় কেনা।

             মানসী বর্মণের তেরপলের বাইরে বেরিয়ে অমিত দেখল দূরে অন্ধকারে কনকদুর্গা  দাঁড়িয়ে; যন্তরটা মানসী বর্মণের তেরপলের কাছে ফেলে দিলো।


    বারো

              কনকদুর্গা বললো, আই অ্যাম প্রেগন্যান্ট উইথ ইওর চাইল্ড, বাট আই ডোন্ট ওয়ান্ট হিম টো গ্রো আপ এ কিলার লাইক মি, উই আর গোইং টু পাটনা, টু গেট লস্ট ইন দি ক্রাউড।

              অমিত বলল, ঠিক আছে, ইংরিজি ঝাড়িসনি, ভাল্লাগে না শুনতে, মুখস্থ করতে করতে জান হালকান হয়ে গেছে এই ক্রান্তিকা্রী ঢকোসলাবাজিতে,  টাকার বান্ডিলটা রেখে নিয়েছি ; অতনু চক্রবর্তীকে মাথায় নল ঠেকিয়ে উড়িয়ে দিয়েছি। মানসী বর্মণ বেঁচে থাকুক ক্রান্তি করার জন্য, সারা জীবন ভুগুক ছেলেকে অন্যের বাড়িতে ফেলে আসার পাপে, এবার ঘেন্নায় মরে যাবে কেঁদে-কেঁদে, পাগল হয়ে গেলে ভালো হয়। জানাজানি হবার আগে অনেক দূরে চলে যেতে হবে, পাটনায় চলে যাবো, ওখানকার গরিবদের বস্তিগুলো সব আমার জানা।

         হ্যাঁ, ঝিয়ের কাজ করে চালাবো যতোদিন পারি, তুইও পারলে সাইকেল রিকশা চালিয়ে রোজগার করিস। আমি তোর চেয়ে পনেরো বছরের বড়ো; পনেরো বছর বয়সে বিয়ে হলে তোর বয়সের ছেলে হতো। কোথাও কেউ জিগ্যেস করলে আমি বলবো তুই আমার ছেলে। তুইও তাদের সামনে মা বলে ডাকবি।

             কতোবার যে জীবনে নকল মায়ের পাল্লায় পড়তে হবে কে জানে।

              চল, পালাবার শর্টকাট আমি জানি।

             শোন তাহলে, বৈদিক সাহিত্যে, মানে আগেকার দিনে যেসব বই সংস্কৃততে লেখা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে যে পৃথিবীর সৃষ্টি হয়েছিল ইনসেস্টের মাধ্যমে, বুঝলি। ইনসেস্ট মানে মায়ের সঙ্গে ছেলের বা বাপের সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক হলে যেসব বাচ্চা হয়, তারা ইনসেস্টের প্রডাক্ট।

             তুমি বলতে চাইছ আমি ইনসেস্টের ফলে জম্মেছি? কী যে বলো! তুমি মানসী বর্মণের ছেলে না বাবা? নাকি ওই লোকটা, মানসী বর্মণের বাবা না ছেলে? আমি আবার তোমার ভাই হতে যাবো কেন? তুমি তো বুডঢা।

             আরে ধ্যুৎ, আমি বলতে চাইছি কী আর তুই বুঝছিস কী!

             ওহ, আরেকটা কাহানি চালু করছ। বলো, বলো। গ্রিস, রোম, পারস্য, আরব রাত্তিরের কাহানি তো শুনিয়েছ, কখনও ইনসেস্টের কাহানি বলোনি তো কোনো?

             বলব, বলব, সেই গল্পই আজ বলব তোকে। প্রথমের ইনডিয়ার গল্প শোন। পৃথিবী শুরু হয়েছিল প্রজাপতি ব্রহ্মা যখন ওর মেয়ে উষার পেটে বাচ্চা এনে দিয়েছিল। আরেকটা ইনসেস্টের গল্প আছে বেদে, মানে ঋগ্বেদে, যম আর যমা ভাই-বোন মিলে বাচ্চা পয়দা করেছিল। ব্রহ্মার যে ছেলে ইনসেস্টের ফলে জন্মেছিল তার নাম মনু। সে, মানে মনু, বিয়ে করেছিল নিজের বোন শতরূপাকে, যাতে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বাড়ে। গুরুর বউয়ের সঙ্গে যদি করিস তাহলে সেটাও ইনসেস্ট। এর কোনো বাংলা আছে কিনা জানি না। ইনসেস্ট শব্দটা ল্যাটিন। ওটাও সংস্কৃত ভাষার মতন তামাদি হয়ে গেছে। গ্রিক ভাষায় কিন্তু আছে, যেমন মায়ের সঙ্গে ছেলের যৌন সম্পর্কে ওরা বলে মেৎরোকোইতেস, নিজের মেয়ের সঙ্গে করলে তার নাম থুগাত্রোমিকিসিয়া। কিন্তু ওরা সব ইনসেস্টকে বলতো গামোস আনাসিওস, মানে, অপবিত্র সম্পর্কে।

            গল্পটা চালু করবে তো? কাকে কী বলে জেনে হাত মারবো? একদম ফাট্টুস লোক তুমি।

            আসলে আগেকার দিনে ঠাকুর-দেবতার নামে গল্প চালু করেছিল যাতে নিজেরাও করতে পারে বুঝলি, ওরা করে তো আমরা করবো না কেন। ইটালির সাম্রাজ্য, যাকে ওরা বলে রোমান এমপায়ার, সেটা তো আরম্ভ হয়েছিল রোম আর ওর বোন রোমার সম্পর্কের ফলে।

            কী গপপো শোনাচ্ছ ফালতু আমার তো টনটনিয়ে যাচ্ছে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    স্কেচ ৬ | পানুর মেটামরফোসিস | চালচিত্রের চালচলন | কেমন আছে ওরা? | চাও করুণানয়নে | পুত্রার্থে | সই | আপনি যেখানেই থাকুন | কিসসা গুলবদনী | জনৈক আবহ ও অন্যান্যরা | গুচ্ছ কবিতা | অমল রোদ্দুর হয়ে গেছে | ইনি আর উনির গপ্পো | দুগ্গি এল | দুর্গারূপে সীতা, ভিন্নরূপে সীতা | প্রিয় অসুখ | শল্লকী আর খলিলের আম্মার বৃত্তান্ত | রানার ছুটেছে তাই | বিসর্জনের চিত্রকলা | কল্পপ্রেম | লম্বা হাত খাটো হাত | কেন চেয়ে আছো গো মা, মুখ পানে! | ছোট্ট পরীর জন্মদিন | জাপানি পুতুল | আধাঁরে আলোঃ শারদ সাহিত্য | ইন্দুলেখার ইতিকথা | মুর্শিদাবাদ | এই দিনগুলি | জ্বিন | জোনাকি এবং ডোরেমিরা | বাসায় চুরি | বিশ্বকর্মার গুপ্তঘট | দুর্গাপূজা - দুটি প্রবন্ধকথা | টিউশন | ফেরা | মায়া | বন্দী | মেয়েদের কিছু একটা হয়েছে | কেল্লা নিজামত | সীতারাম | দড়াবাজি | মায়াফুলগাছ | যখন শ্যামের দ্বারে | কুয়াশা মানুষের লেখা | সময় হয়েছে নতুন খবর আনার | মিষ্টি চেখে ওড়িশার ডোকরা শিল্পীদের গ্রামে | নিশি | পথ | প্রাকার পরিখা | নীল সাইদার গল্প | তুষারাচ্ছন্ন ইউরোপে শ্রীমতী ফ্রয়ডেনরাইখের আশ্চর্য বিষাদ | দীপাবলীর বারান্দায় | কলমি শুশনি | এক অনিকেত সন্ধ্যা | গৌরি বিলের বৃত্তান্ত | আনন্দগামী বাস থেকে | মুয়াজ্জিনকে চিরকুট | দেবীর সাজে সৌরভ গোস্বামী | শরৎ ২০২১
  • গপ্পো | ৩১ অক্টোবর ২০২১ | ১৫৩২৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ঘন্টাঘর - একক
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ০১ নভেম্বর ২০২১ ০৭:০৯500516
  • স্বীকার করি,  মানুষের মেটিং কল - আই লাভ ইউ! 
     
    মলয় রায়চৌধুরী সহজ লোক নন...
  • Rimbaud | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৩৫512511
  • অভিশপ্ত কবিরা – ভেরলেন, রেঁবো, মালার্মে, করবিয়ের প্রমুখ : মলয় রায়চৌধুরী
      ‘পোয়েত মদি’ ( Poète maudit ) বা ‘অভিশপ্ত কবি’ নামে ১৮৮৪ সালে ফরাসি প্রতীকবাদী ও ‘ডেকাডেন্ট’  কবি পল ভেরলেন একটি বই প্রকাশ করেছিলেন । অভিধাটি ১৮৩২ সালে প্রথম ব্যবহার করেন অ্যালফ্রেদ দ্য ভিনি ( Alfred de Vigny ) তাঁর  ‘স্তেলো’ উপন্যাসে ; তিনি বলেছিলেন ‘পোয়েত মদি’ হিসাবে চিহ্ণিত লোকগুলোকে জগতের ক্ষমতাধর মানুষেরা চিরকাল অভিশাপ দেবে।  ত্রিস্তঁ করবিয়ের (Tristan Corbière ) , জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো, স্তেফান মালার্মে, মারসেলিঁ দেবোর্দে-ভামো ( Marceline Desbordes-Valmore ) এবং আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে  আদঁকে ( Auguste Villiers de l’Isle-Adam ) পল ভেরলেন চিহ্ণিত করেছিলেন অভিশপ্ত কবি হিসাবে । এই তালিকায় তিনি নিজেকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন পুভ লেলিয়ান ( Pauvre Lélian ) ছদ্মনামে । উল্লেখ্য যে ১৮৮৪ সালে স্ত্রী মাতিলদে ভেরলেনকে আইনত ডিভোর্স করেছিলেন ।
              পল ভেরলেন তাঁকে ‘অভিশপ্ত কবি’ সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করার আগে ত্রিস্তঁ করবিয়ের ( ১৮৪৫ – ১৮৭৫ ) ফরাসি আলোচকদের কাছে সম্পূর্ণ অবহেলিত ছিলেন ; বহুকাল পরে এজরা পাউণ্ড ও টি. এস. এলিয়ট তাঁর কবিতা বিশ্লেষণের পর ত্রিস্তঁ করবিয়েরকে কাব্যসাহিত্যে গুরুত্ব দেয়া আরম্ভ হয় । করবিয়েরের মা, মারি-অঞ্জেলিক-আসপাসি পুয়ো’র বয়স যখন উনিশ তখন করবিয়েরের জন্ম হয় । তাঁর বাবা আঁতোয়াঁ-এদুয়া করবিয়ের ‘লে নেগরিয়ের’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন । রাজকীয় উচ্চবিদ্যালয়ে ১৮৫৮ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত পড়ার সময়ে তিনি ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হন এবং রিউমেটিজমের কারণে হাত-পা বিকৃত হয়ে যায় । বাড়ি থেকে অনেক দূরে স্কুলে দেবার এবং শারীরিক বিকৃতির দরুন তিনি বাবা-মাকে দোষ দিতেন । স্কুলের কড়া নিয়মনীতি ও শিক্ষদের প্রতি ঘৃণা তাঁর কবিতায় একটি বিশেষ কন্ঠস্বর গড়ে দিতে পেরেছে।করবিয়ের মারা যান যক্ষ্মারোগে, মাত্র তিরিশ বছর বয়সে । করবিয়েরের একটি কবিতা :
    বিপরীত কবি
    আরমোরিকার সাগরতীরে । একটি নির্জন মঠ ।
    ভেতরে : বাতাস অভিযোগ করছিল : আরেকটা হাওয়াকল ।
    এলাকার সমস্ত গাধা বীজসুদ্ধ আইভিলতায় তাদের দাঁত ঘষতে এসেছিল
    ফুটোয় ভরা এমনই এক দেয়াল থেকে যা কোনও জীবন্ত মানুষ
    দরোজার ভেতর দিয়ে ঢোকেনি।
    Advertisements
    REPORT THIS AD
    একা— তবু নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, ভরসাম্য বজায় রেখে,
    একজন বুড়ির থুতনির মতন ঢেউখেলানো
    তার ছাদ কানের পাশে চোট দিয়েছিল,
    হাবাগবা মানুযের মতন হাঁ করে, মিনারটা দাঁড়িয়েছিল ।
              অভিশপ্ত কবি জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবোর ( ১৮৫৪ – ১৮৯১ ) কবিতার সঙ্গে পাঠকরা পরিচিত ; তাঁর ‘ইল্যুমিনেশানস’ বইটির নামকরণ করেছিলেন পল ভেরলেন । বইটি থেকে ‘শহর’ শিরোনামের গদ্যকবিতা :
    এক মহানগর যাকে এই জন্যে আধুনিক মনে করা হয় যে বাড়িগুলোর বাইরের দিক সাজানোয় আর নগরের পরিকল্পনায় প্রয়োগ করার জন্য পরিচিত উপলব্ধিগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ; তারই  আমি এক ক্ষণজীবী আর তেমন বিচ্ছিন্ন নাগরিক নই । এখানে তুমি কুসংস্কারের একটিও স্মৃতিস্তম্ভের হদিশ পাবে না । সংক্ষেপে, নৈতিকতা আর ভাষাকে সরলতম প্রকাশে নামিয়ে আনা হয়েছে ! লক্ষাধিক এই লোকজন যারা পরস্পরকে জানার প্রয়োজন অনুভব করে না, নিজেদের শিক্ষাদীক্ষা, কর্মকাণ্ড, বার্ধক্যে এতো মিল যে  তাদের আয়ু  মহাদেশের গোলমেলে সংখ্যাতত্ব যা বলেছে তার চেয়েও বেশ  কম । তাই, আমার জানালা দিয়ে, দেখতে পাই নতুন প্রেতরা শাশ্বত ঘন ধোঁয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে — আমাদের বনানীঘেরা ছায়া, আমাদের গ্রীষ্মের রাত ! — প্রতিহিংসর নতুন গ্রিক দেবতারা, আমার কুটিরের সামনে, যা আমার স্বদেশ, আমার সমগ্র হৃদয়, কেননা এখানে সবকিছুরই পরস্পরের সঙ্গে মিল আছে — ক্রন্দনহীন মৃত্যু, আমাদের সক্রিয় কন্যা আর চাকরানি, রাস্তার কাদায় বেপরোয়া ভালোবাসা আর ফালতু অপরাধ ফুঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ।  
     স্তেফান মালার্মে ( ১৮৪২ – ১৮৯৮ )  বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ কবিতাটির টাইপসেটিং সাজানোর ও সেকারণে মর্মার্থের বহুত্বের জন্য পরিচিত হলেও, বর্তমানে খুব বেশি পঠিত নন । বলা যায় যে ‘এ রোল অব ডাইস উইল নেভার মিস এ চান্স’ ইউরোপের কবিতার ধারায় বৈপ্লবিক ঘটনা ছিল; ঘুটির চাল ডিগবাজি খেতে-খেতে এঁকে বেঁকে যেভাবে এগিয়ে যেতে পারে সেইভাবে পঙক্তিগুলো সাজিয়েছিলেন মালার্মে ।কবিতার মধ্যে সহজাত শুদ্ধতা ও পরিপূর্ণতা আনার প্রচেষ্টায়  ভাষাগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে না পেরে তিনি প্রায়ই উদ্ভাবনী শব্দ বিন্যাস, জটিল উপমা ও পরীক্ষামূলক মুদ্রণবিদ্যা প্রয়োগ করে কবিতা লিখে পাঠকের বিশ্লেষণ ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। মালার্মের সাহিত্য চর্চায় সারা জীবনের গোঁ ছিল যে, পাঠকরা প্রতীকের অর্থ বুঝুক । সাহিত্য ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক তুষ্টিকে তিনি অবজ্ঞার চোখে দেখতেন । তাঁর বাড়িতে প্রতি মঙ্গলবার সাহিত্যিকদের আড্ডা বসতো, কিন্তু স্কুলে শিক্ষকতা করার দরুণ তাঁর আর্থিক অবস্হা কোনো দিনই ভালো ছিল না ।স্বাভাবিক যে পাঠকদের মনে হয়েছে তাঁর কবিতার ভেতরে ঢোকা যায় না । এখানে তাঁর ‘কবিতার আবির্ভাব’-এর বাংলায়ন দিচ্ছি
    দু:খি হয়ে পড়ছিল চাঁদ। কাঁদুনে দেবশিশুরা স্বপ্ন দেখছিল।
    শান্ত ও বাষ্পীয় ফুলের তোড়ায় তাদের তীরবাহী আঙুল
    যেন তাদের মরণাপন্ন বেহালার তার বাজছিল
    আর আকাশ-নীল ফুলের পাপড়িতে গড়িয়ে পড়ছিল স্বচ্ছ অশ্রু।
    সে ছিল তোমার প্রথম চুমুর আশীর্বাদ-পাওয়া দিন,
    আর আমি  আমার স্বপ্নের কাছে শহিদ হলুম,
    যা বিষাদের সুগন্ধীর উপর ভর করে বেঁচেছিল,
    এমনকি কোনও পরিতাপ বা দূর্ঘটনা ছাড়াই
    একটি স্বপ্নকে সেই হৃদয়ের কাছে রেখে গিয়েছে
    যে প্রথম স্বপ্নটি তুলেছিল।
    এখানে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম, পাথরে বাঁধানো রাস্তায়
    আমার চোখ নাচছিল।
    যখন তুমি চুলে সূর্যের উচ্ছাস নিয়ে, রাস্তায় আর রাতের বেলায়
    হাসিমুখে  আমার কাছে এসেছো,
    আর আমি ভাবলুম  আলোর টুপি পরা এক পরীকে দেখছি,
    যে আমার ছোটোবেলাকার ঘুমে স্বপ্নে দেখা দিত,
    আর  যার আধখোলা-মুঠো থেকে
    সুগন্ধী নক্ষত্রের দলে ঝরে পড়তো  তুষারপুঞ্জ
    গাছেদের সরু ডালে ।
             মহিলা কবি মার্সেলিন দেবোর্দে-ভামো’’র ( ১৭৮৬ – ১৮৪৯ ) জন্ম রনেঁর দুয়া তে। ফরাসি বিপ্লবের কারণে তাঁর বাবার ব্যবসা নষ্ট হয়ে যায় এবং আর্থিক সাহায্যের জন্য মায়ের সঙ্গে গুয়াদালুপ চলে যান; সেখানে তাঁর মা জনডিসে মারা যান আর ষোলো বছর বয়সী মারসেলিঁকে প্যারিসে ফিরে নাটকের দলে যোগ দিয়ে রোজগারের পথ বেছে নিতে হয় । ১৮১৭ সালে নাটকদলের একজন মামুলি অভিনেতা প্রসপার লাশান্তাঁ-ভামোকে বিয়ে করেন । ১৮১৯ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্হ ‘এলেজি এবং রোমান্স’ । ১৮২১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর ক্রীতদাসদের নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘অ্যান্টিলেসের সন্ধ্যা’ । তাঁর ‘উদ্বেগ’ কবিতার বাংলায়ন দিচ্ছি এখানে ; ওনার নাম বাঙালি পাঠক শুনেছেন বলে মনে হয় না ; বাঙালি পাঠকের কাছে তিনি সত্যিই অভিশপ্ত :
    কি যে আমাকে বিপর্যস্ত করে ? কেনই বা অপেক্ষা করব ?
    এই শহরে, বড়ো বেশি বিষাদ ; তা থেকে, প্রচুর অবসর ।
    আধুনিক সুখানুভব নামে যা চলছে
    প্রতি ঘণ্টার পেষাই থেকে আমাকে সুরক্ষিত করতে পারে না ।
    একসময়ে বন্ধুত্ব ছিল, কোনো বইয়ের আকর্ষণ
    চেষ্টা ছাড়াই ভরে তুলতো অতিরিক্ত সময় ।
    ওহ এই অস্পষ্ট আকাঙ্খার উদ্দেশ্য কি ?
    আমি তা এড়িয়ে যাই, কিন্তু উদ্বেগ আমাকে ফিরে দেখতে বলে ।
    আনন্দ যদি আমার হর্ষে ধরা না দ্যায়
    তাহলে আমি তাকে দুঃখের বিশ্রামেও পাবো না,
    তাহলে কোথায়ই বা পাওয়া যায় আমোদপ্রমোদ ?
    আর তুমি যে আমাকে যা চাইছি তা দিতে পারো,
    তুমি কি আমাকে চিরকালের জন্য ছেড়ে যাবার নির্ণয় নিয়েছ ?
    আমাকে বলো, যুক্তিতর্ক, অনিশ্চিত, বিভ্রান্তিকর,
    তুমি কি প্রেমের ক্ষমতাকে  অনুমতি দেবে আমায় দখল করতে ?
    হায়, নামটা শুনলেই আমার হৃদয় কেঁপে ওঠে !
    কিন্তু যে ভয় উদ্বুদ্ধ করে তা অমায়িক আর সত্যি ।
    যুক্তিতর্ক, তোমার কাছে ফাঁস করার মতন আর কোনো গোপনীয়তা নেই,
    আর আমি ভাবি এই নামটি তোমার চেয়ে তাদের কথা বেশি বলেছে ! 
              এবার জানা যাক আগুস্তে ভিলিয়ার্স দ্যলিজলে আদঁ-র ( ১৮৩৮ -৮৯ ) কথা । ব্রিট্যানির এক অভিজাত পরিবারে জন্ম, যদিও তাঁদের আর্থিক অবস্হা ভালো ছিল না আর নির্ভর করতে হতো মায়ের কাকিমা মাদামোয়াজেল দ্য কেরিনুর দান-খয়রাতের ওপর । তার ওপর ভিলিয়ার্সের বাবার গোঁ চাপে যে তিনি মালটায় গিয়ে ফরাসি বিপ্লবের সময়ে লুকোনো গুপ্তধন উদ্ধার করবেন । ফলে তিনি জমি কিনতেন আর গুপ্তধন না পেয়ে বেচতেন । এই করে ফতুর হয়ে যান । ভিলিয়ার্সকেও ডজনখানেক স্কুল পালটাতে হয় । ১৮৫০ এর পর তিনি বেশ কয়েকবার প্যারিসে গিয়ে কাজের খোঁজ করে কিছুই যোগাড় করতে পারেননি । পাকাপাকি প্যারিসে থাকার ব্যবস্হার জন্য তাঁর এক আত্মীয়া মাসিক খরচের ব্যবস্হা করেন । তিনি ল্যাটিন কোয়ার্টারের মদ্যপ কবি-লেখকদের আড্ডায় যোগ দ্যান এবং শার্ল বোদলেয়ারের পরামর্শে এডগার অ্যালান পোর রচনাবলী পড়া আরম্ভ করেন । ১৮৫৯ সালে নিজের টাকায় প্রকাশ করেন ‘প্রথম কবিতাবলী’ । বইটা কোথাও আলোচিত হলো না । উপরন্তু তিনি লুইজি দায়োনে নামে এক বহুবল্লভা যুবতীর সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করলেন ; তাঁর পরিবারে সদস্যদের চাপে ১৮৬৪ সালে যুবতীটিকে ছেড়ে গীর্জায় আশ্রয় নিতে হয় । ভিলিয়ার্স অনেক চেষ্টা করেও বিয়ে করার মতন যুবতী পাচ্ছিলেন না ; তিনি থিয়োফিল গতিয়েকে তাঁর মেয়ে এসতেলে সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দিলে গতিয়ের তাঁকে তাড়িয়ে দিয়ে বলেন যে তিনি ভবঘুরে মাতাল অখ্যাত কবির সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান না । অ্যানা আয়ার পাওয়েল নামে বৈভবশালী ইংরাজ যুবতীকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েও প্রত্যাখ্যাত হন । শেষে তিনি এক বেলজিয় ঘোড়ার গাড়ির চালকের অশিক্ষিতা বিধবা স্ত্রী মারি দানতিনের সঙ্গে বসবাস আরম্ভ করেন আর ১৮৮১ সালে তাঁর ছেলে ভিক্তরের জন্ম হয় । কিন্তু কবিস্বীকৃতি, ভেরলেনের বইতে অন্তর্ভুক্ত হবার আগে, তিনি পাননি । এখানে ভিলিয়ার্সের  ‘স্বীকৃতি’ কবিতাটির বাংলায়ন :
    যবে থেকে আমি শব্দগুলো ভুলে গেছি, যৌবনের
    ফুল আর এপ্রিলের টাটকা বাতাস…
    আমাকে তোমার ঠোঁট দুটি দাও ; তাদের সুগন্ধি যৌতুক
    গাছেদের ফিসফিস কথাবার্তা হয়ে দেখা দেবে !
    যবে থেকে আমি গভীর সমুদ্রের দুঃখ হারিয়েছি
    মেয়েটির কান্না, তার অস্হির টান, তার মৃত্যুর আলয়…
    একটা শব্দেরও শ্বাস ফেলে না ; তা বিষাদ বা আনন্দ
    হয়ে উঠবে ঢেউদের কলকল-ধ্বনি !
    যবে থেকে আমার আত্মায় অন্ধকারের ফুল
    আত্মমগ্ন, আর পুরোনো সূর্ষেরা উড়াল নেয়…
    প্রিয়তমা আমাকে তোমার মলিন বুকে লুকিয়ে নাও,
    আর তা হয়ে উঠবে রাতের প্রশান্তি !
              কিন্তু অভিশপ্ত কবিদের তালিকায়  তাঁর গুরু শার্ল বোদলেয়ার, কোঁতেদ্য লুতিয়ামোঁ (Comte de Lautréamont ) , অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( Alice de Chambrier ), আঁতোনা আতো ( Antonin Artaud ), জঁ-ফিয়ে দ্যুফে ( Jean-Pierre Duprey )  প্রমুখকে যোগ করেন পরবর্তীকালের আলোচকরা ; বস্তুত পল ভেরলেনই ছিলেন সবচেয়ে বেশি অভিশপ্ত। এই কবিরা তাঁদের কবিতার জন্য অভিশপ্ত নন ;  তাঁদের জীবনের দুঃখ, বিষাদ, আর্থিক দৈন্য, পরাজয়বোধ, অবহেলা, মাদকে আসক্তি, যৌনরোগ ইত্যাদির কারণে তাঁদের মনে করা হয়েছে ‘অভিশপ্ত’। তাঁর মৃত্যুর পর Fin de siècle বা শতাব্দী শেষের কবিদের অন্যতম মনে করে হয় পল ভেরলেনকে। 
            প্রথমে পড়া যাক শার্ল বোদলেয়ারের গদ্য কবিতার বই ‘বিষণ্ণ প্যারিস’ এর একটি রচনা : 
    আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।
    আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে — যাকিছু আমি অনুভব করি — তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে।তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।
    তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।
    তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।
    আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।
    আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।
              কঁতে দ্য লুতিয়ামোর ( ১৮৪৬ – ১৮৭০ ) প্রকৃত নাম ইসিদোরে লুসিয়েন দুকাস, জন্মেছিলেন উরুগুয়েতে । তাঁর জন্মের পরেই মা মারা যান ; তখন আর্জেনটিনা আর উরুগুয়ের যুদ্ধ চলছে । তাঁর বাবা, যিনি ফরাসিভাষী ছিলেন, তাঁকে তেরো বছর বয়সে প্যারিসে পাঠিয়ে দ্যান স্কুল শিক্ষার জন্য । সতেরো বছর বয়সে উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি দাঁতে, মিলটন, বোদলেয়ার এবং রাসিনে মুখস্হ বলতে পারতেন বলে শিক্ষকদের প্রিয় ছিলেন । কিন্তু নির্ণয় নেন যে তিনি নিজে ‘নিষ্ঠুরতার আনন্দবোধ’ নিয়ে কবিতা লিখবেন । ‘মালদোরোরের গান’ নামে তিনি একটি কাব্যোপন্যাস লেখেন, ১৯৬৮ থেকে ১৯৬৯ সালের মাঝে,  তাঁর এই নির্ণয়কে রূপ দেবার জন্য । নায়কের নাম মালদোরোর । বইটি ছয় পর্বে আর ষাটটি কবিতাংশে বিভাজিত । ডাডাবাদীরা, পরাবাস্তববাদীরা, বিশেষ করে সালভাদোর দালি,  তাঁর এই বইটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বইটির বহু দৃশ্যের এচিং করেছিলেন দালি । আমি বইটি থেকে একটি কবিতাংশ তুলে দিচ্ছি:
    আমি নোংরা । আমার সারা শরীরে উকুন । শুয়োররা, যখন আমার দিকে তাকায়, বমি করে। আমার চামড়া কুষ্ঠরোগের মামড়ি আর আঁশে ছয়লাপ, আর তার ওপরে হলুদ রঙের পুঁজ । আমার বাঁদিকের বগলে এক ব্যাঙ পরিবার বসবাস আরম্ভ করেছে, আর, তাদের কোনো একটা নড়াচড়া করলে, কাতুকুতু দ্যায় । মনে রাখতে হয় যাতে বাইরে বেরিয়ে মুখ দিয়ে কান আঁচড়াতে না আরম্ভ করে ; তাহলে সেটা মগজে ঢুকে যাবে । আমার ডানদিকের বগলে রয়েছে একটা গিরগিটি যে সব সময়ে ওদের তাড়া করে যাতে খাবার না জোটায় মারা যায় : সবাইকে তো বাঁচতে হবে । আমার পোঁদের ভেতরে একটা কাঁকড়া ঢুকে গেছে ; আমার কুঁড়েমিতে উৎসাহিত হয়ে, ঢোকার পথটা নিজের দাড়া দিয়ে পাহারা দ্যায় আর আমাকে দ্যায় অসহ্য যন্ত্রণা ।
    অ্যালিস দ্য শমবিয়ে ( ১৮৬১ – ১৮৮২ ) একুশ বছর বয়সে কোমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তার কিছুকাল আগেই তিনি লিখেছিলেন ‘ঘুমন্ত সুন্দরী’ । তাঁর অধিকাংশ বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পর । এখানে তাঁর ‘পলাতক’ কবিতাটির বাংলায়ন :
    আমরা সবাই আগন্তুক আর পৃথিবী হয়ে চলে যাই
    খেলার সময়ে উধাও আলোর নৌকোর মতো
    হালকা হাওয়ায় চুপিচুপি চুমুর আড়ালে,
    আর নীল দিগন্ত ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় ;
    উড়ালের সময়ে যদি হলরেখার খাত গড়তে পারে তাহলে আনন্দিত
    সে চলে যাবার পরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো ;
    যে পথ সে দ্রুত যাত্রায় খুঁজতে চেয়েছিল
     কোনো ঘুর্ণিঝড় তাকে মুছে দিতে  পারে না;
    আনন্দিত, যদি অদৃষ্ট আমাদের টেনে বের করে আনে
    আমরা তবুও হৃদয় হয়ে বাঁচি যেখানে থেকেছি চিরকাল,
    সুদূর সমুদ্রতীর পর্যন্ত যে হৃদয় আমাদের অনুসরণ করে
    তাহলে এখানে এক মৃত মানুষের সমাধিকে কী বলা হবে ?
              আঁতোনা জোসেফ মারি আতো ( ১৮৯৬ – ১৯৪৮ ), যিনি আঁতোনা আতো নামে অধিক পরিচিত, ছিলেন কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, নাট্য পরিচালক এবং ইউরোপীয় আভাঁগার্দ আন্দোলনের পুরুষদের অন্যতম । ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি’ তত্বটির জন্য তিনি অধিকতর পরিচিত । যদিও তাঁর জন্ম ফ্রান্সের মার্সাইতে, তাঁর বাবা-মা ছিলেন গ্রিক । জাহাজের মালিক ছিলেন তাঁর বাবা । তাঁর মায়ের নয়টি বাচ্চা হয়েছিল, চারটি মৃত অবস্হায় জন্মায় আর দুটি শৈশবেই মারা যায় । পাঁচ বছর বয়সে আতো আক্রান্ত হন মেনেনজাইটিসে, যার দরুন কোমাটোজে ছিলেন কিছুকাল এবং বিভিন্ন স্যানাটোরিয়ামে চিকিৎসার জন্য পাঁচ বছর ভর্তি ছিলেন । ১৯১৬ সালে তাঁকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনিতে যোগ দিতে হয়েছিল কিন্তু মানসিক অস্হিরতার কারণে ছাঁটাই হন । দীর্ঘ রোগভোগের দরুণ তাঁকে ল্যডানডাম ওষুধ ( অ্যালকোহলে গোলা আফিম ) নিতে হতো আর সেখান থেকেই তাঁর আফিমের নেশা ।সাতাশ বছর বয়সে তিনি এক গোছা কবিতা ‘নতুন ফরাসি রিভিউ’ ( Nouvelle Revue Française ) পত্রিকায় প্রকাশের জন্য পাঠান ; তা প্রত্যাখ্যাত হলেও সম্পাদক তাঁর কবিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে চিঠি লেখেন এবং বেশ কিছু সময় তাঁদের মধ্যে চিঠির আদান-প্রদান হয় । এখানে তাঁর কয়েকটা কবিতার বাংলায়ন দিলুম, কেননা তাঁর কবিতার বই সহজে পাওয়া যায় না :    
    নিরংশু কবি
    নিরংশু কবি, একটি তরুণীর বুক
    তোমাকে হানা দিয়ে বেড়ায়,
    তিক্ত কবি, জীবন ফেনিয়ে ওঠে
    আর জীবন পুড়তে থাকে,
    আর আকাশ নিজেকে বৃষ্টিতে শুষে নেয়,
    জীবনের হৃদয়ে নখের আঁচড় কাটে তোমার কলম ।
    অরণ্য, বনানী, তোমার চোখ দিয়ে প্রাণবন্ত
    অজস্র ছেঁড়া পালকের ওপরে ;
    ঝড় দিয়ে বাঁধা চুলে কবি চাপেন ঘোড়ায়, কুকুরের ওপরে ।
    চোখ থেকে ধোঁয়া বেরোয়, জিভ নড়তে থাকে
    আমাদের সংবেদনে স্বর্গ উথালপাথাল ঘটায়
    মায়ের নীল দুধের মতন ;
    নারীরা, ভিনিগারের কর্কশ হৃদয়,
    তোমাদের মুখগহ্বর থেকে আমি ঝুলে থাকি ।
    আমার টাকাকড়ি নেই
    আমার টাকাকড়ি নেই কিন্তু
    আমি
    আঁতোনা আতো
    আর আমি ধনী হতে পারি
    ব্যাপকভাবে আর এক্ষুনি ধনী হতে পারি
    যদি আমি তার জন্য প্রয়াস করতুম ।
    সমস্যা হলো আমি চিরকাল টাকাকড়িকে,
    ধনদৌলতকে, বৈভবকে ঘৃণা করেছি ।
    কালো বাগান
    এই কালো পাপড়িগুলো ভারতের আকাশের  ঘুর্ণাবর্তকে ঘোরাও।
    ছায়ারা পৃথিবীকে ঢেকে ফেলেছে যা আমাদের সহ্য করে ।
    তোমার নক্ষত্রদের মাঝে চাষের জমিতে পথ খুলে দাও ।
    আমাদের আলোকিত করো, নিয়ে চলো তোমার নিমন্ত্রণকর্তার কাছে,
    চাঁদির সৈন্যবাহিনী, নশ্বর গতিপথে
    আমরা রাতের কেন্দ্রের দিকে যেতে চেষ্টা করি ।
    আমি কে
    আমি কে ?
    আমি কোথা থেকে এসেছি ?
    আমি আঁতোনা আতো
    আর আমি একথা বলছি
    কেননা আমি জানি তা কেমন করে বলতে হয়
    তাৎক্ষণিকভাবে
    তুমি আমার বর্তমান শরীরকে দেখবে
    ফেটে গিয়ে বহু টুকরো হয়ে গেছে
    আর তাকে আবার গড়ে ফেলবে
    দশ হাজার কুখ্যাত পরিপ্রেক্ষিতে
    এক নতুন শরীর
    তখন তুমি আমাকে
    কখনও ভুলতে পারবে না ।
    স্নায়ু ছন্দ
    একজন অভিনেতাকে দেখা হয় যেন স্ফটিকের ভেতর দিয়ে ।
    মঞ্চের ওপরে অনুপ্রেরণা ।
    সাহিত্যকে বেশি প্রবেশ করতে দেয়া উচিত নয় ।
    আমি আত্মার ঘড়ি ধরে কাজ করা ছাড়া আর কোনো চেষ্টা করিনি,
    আমি কেবল নিষ্ফল সমন্বয়ের যন্ত্রণাকে লিপ্যন্তর করেছি ।
    আমি একজন সম্পূর্ণ রসাতল ।
    যারা ভেবেছিল আমি সমগ্র যন্ত্রণার যোগ্য, এক সুন্দর যন্ত্রণা,
    এক ঘন আর মাংসল পীড়া, এমন এক পীড়া যা বিভিন্ন বস্তুর মিশ্রণ,
    বুদবুদ-ভরা একটি নিষ্পেশিত ক্ষমতা
    ঝুলিয়ে রাখা বিন্দু নয় — আর তবু অস্হির, উপড়ে-তোলা স্পন্দনের সাহায্যে
    যা আমার ক্ষমতা আর রসাতলের দ্বন্দ্ব থেকে আসে
    শেষতমের উৎসার দেয় ( ক্ষমতার তেজের দ্বন্দ্বের মাপ বেশি ),
    আর কোনও কিছু বাকি থাকে না বিশাল রসাতলগুলো ছাড়া,
    স্হবিরতা, শীতলতা–
    সংক্ষেপে, যারা আমাকে অত্যধিক জীবনের অধিকারী মনে করেছিল
    আত্মপতনের আগে আমার সম্পর্কে ভেবেছিল,
    যারা মনে করেছিল আমি যন্ত্রণাদায়ক আওয়াজের হাতে নির্যাতিত,
    আমি এক হিংস্র অন্ধকারে লড়াই করেছি
    তারা সবাই মানুষের ছায়ায় হারিয়ে গেছে ।
    ঘুমের ঘোরে, আমার পুরো পায়ে স্নায়ুগুলো প্রসারিত হয়েছে ।
    ঘুম এসেছে বিশ্বাসের বদল থেকে, চাপ কমেছে,
    অসম্ভাব্যতা আমার পায়ের আঙুলে জুতো-পরা পা ফেলেছে ।
    মনে রাখা দরকার যে সমগ্র বুদ্ধিমত্তা কেবল এক বিশাল অনিশ্চিত ঘটনা,
    আর যে কেউ তা খুইয়ে ফেলতে পারে, পাগল বা মৃতের মতন নয়,
    বরং জীবিত মানুষের মতন, যে বেঁচে আছে
    আর যে অনুভব করে জীবনের আকর্ষণ আর তার অনুপ্রেরণা
    তার ওপর কাজ করে চলেছে ।
    বুদ্ধিমত্তার সুড়সুড়ি আর এই  প্রতিযোগী পক্ষের আকস্মিক প্রতিবর্তন ।
    বুদ্ধিমত্তার মাঝপথে শব্দেরা ।
    চিন্তার প্রতিবর্তন প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা একজনের চিন্তাকে হঠাৎ নোংরামিতে পালটে দ্যায় ।
    এই সংলাপটি চিন্তার অন্তর্গত ।
    ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়া, সবকিছু ভেঙে ফেলা ।
    আর হঠাৎ আগ্নেয়গিরিতে এই পাতলা জলের স্রোত, মনের সরু, আস্তে-আস্তে পতন ।
    আরেকবার নিজেকে ভয়ঙ্কর অভিঘাতের মুখোমুখি আবিষ্কার করা, অবাস্তবের দ্বারা নিরসিত, নিজের একটা কোনে, বাস্তব জগতের কয়েকটা টুকরো-টাকরা ।
    আমিই একমাত্র মানুষ যে এর পরিমাপ করতে পারি ।
              ১৯৫০ সালে, কুড়ি বছর বয়সে, জাঁ ফিয়ে দুফের (১৯৩০ – ১৯৫৯ ) প্রথম কবিতার বই ‘দ্বিতীয়ের পেছনে’র পাণ্ডুলিপি পড়ে আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর প্রশংসা করেছিলেন । এক বছর পরে তিনি কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে ভাস্কর্যে আগ্রহী হন, আর পাঁচের দশকের পুরো সময় লোহা আর সিমেন্টের কাজ করেন, সেই সঙ্গে চারকোল ও কালির কাজও করেন । ১৯৫৯ সালে ব্যক্তিগত দ্রোহ প্রকাশ করার জন্য আর্ক দ্য ত্রয়েম্ফে অজানা সেনাদের শিখায় পেচ্ছাপ করার সময়ে ধরা পড়েন আর জনগণের পিটুনি খেয়ে প্রথমে কারাগারে আর তারপর পাগলাগারদে যেতে হয় । ছাড়া পেয়ে আবার কবিতা লেখা আরম্ভ করেন এবং ‘শেষ ও উপায়’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি স্ত্রীর হাতে দিয়ে নির্দেশ দ্যান তা ব্রেতঁকে ডাকে পাঠিয়ে দিতে । বাড়ি ফিরে স্ত্রী জ্যাকলাঁ দেখতে পান যে ছবি আঁকার ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলে জাঁ ফিয়ে দুফে আত্মহত্যা করেছেন । কাব্যগ্রন্হটি থেকে ‘সম্পূর্ণ’ শিরোনামের গদ্য কবিতাটির বাংলায়ন :
             জগতসংসার সম্পূর্ণ । কে সেই লোক যে রাতকে প্রতিবার একই ফাঁদে ফ্যালে ? আমি, যদি বলা হয়, কাউকেই চিনি না আর যে আকাশ আমার ওপর মনের ঝাল মেটায়, ওর বড়ো ইঁদুরের হাত আমাকে কখনও, কখনও দেখায়নি ।
              কেউ একজন দরোজাটা খুললো : ভেতরে ছিল না কেউ, ভেতরে তার ছিল হাড় আর হাড়, আর আমি প্রতিজ্ঞা করে সবাইকে জানিয়েছি যে আমি জ্যান্ত ওর চামড়া ছাড়িয়ে নেবো ।
             জগতসংসার ভয়ঙ্করভাবে সম্পূর্ণ ছিল আর জিনিসপত্রের টানাটানি চলছিল । কেউ একজন দুঃস্বপ্নকে সাজিয়ে রাক্ষসদের আলোকিত করছিল আর তাকে বলা হচ্ছিল বর্তমান, এখন…
             এই বর্তমানগুলো আমাদের বহু সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করেছিল, আমি থেকে আমিতে, আমার থেকে আমার সঙ্গে আর অন্য অনেকের সঙ্গে, আর আমার সঙ্গে অন্য অনেকের…কিন্তু অনেকসময়ে সবচেয়ে বিচক্ষণ ভাগাভাগিও আমাদের আলাদা করতে পারে, কিন্তু মাথা কখনও, আর আমি বলতে চাই কখনও, কাঁধের ওপরে স্হিতিশীল থাকেনি ।
    দুই
              ‘অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবীদের’ কালখণ্ডে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে যে পল ভেরলেন চল্লিশ বছর বয়সে কয়েকজন কবিকে ‘অভিশপ্ত কবি’ চিহ্ণিত করে একটা বই লিখলেন কেন ? তিনি কি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন, নাকি নিজেকে দেখতে চাইছিলেন সেই কবিদের সারিতে যাঁদের তিনি গুরুত্বপূর্ণ কবি মনে করলেও তখনকার ‘বুর্জোয়া পাঠক’ কোনও পাত্তা দিতেন না । চল্লিশ বছর বয়সে র‌্যাঁবোকে খুনের চেষ্টার দায়ে জেল খেটে ফিরেছেন, একজনকে ( অনেকের মতে নিজের মা-কে ) মারধর করার কারণে আবার জেলে গিয়েছিলেন, রোমান ক্যাথলিক হিসাবে দীক্ষা নিয়েছেন, তবু তাঁর কেন মনে হয়েছিল তাঁর মতনই কয়েকজন কবি অভিশপ্ত ? সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁরা ছিলেন অখ্যাত, সমাজ তাঁদের প্রতি উদাসীন ছিল কেননা তাঁদের কবিতা তারা বুঝে উঠতে পারছিল না । কেবল রসপণ্ডিতরা তাঁদের কবিতায় আগ্রহী ছিলেন আর সেকারণে তাঁদের জীবন দুর্দশাপূর্ণ ছিল । উপেক্ষার, এমনকি ‘বুর্জোয়া অশিক্ষিতদের দ্বারা’ পদদলিত হবার চর্চিত বোধ, হয়তো ছিল প্রথম পর্বের আভাঁ গার্দ লেখক-কবিদের ধ্রুপদি দাবি।ফরাসিদেশের কবি-চিত্রকরদের মাঝে আত্মক্ষয়ের গৌরব প্রশংসনীয় ছিল তাঁদের নিজেদের গণ্ডিতে ।
             অভিশাপটি একই সঙ্গে যতোটা নৈতিক ও আত্মিক মনে করেছিলেন ভেরলেন, ততোটাই সামাজিক, যে মানসিকতা থেকে এই বোধের সূত্রপাত যে ‘সত্যকার শিল্পীকে’ প্রতিভার চাপ সহ্য করে ক্লেশ ও নিদারুণ-যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় । চল্লিশ বছর বয়সে ভেরলেন মাতলামি, স্ত্রী ও মাকে মারধর করে, বাচ্চাকে যাতনা দিয়ে, সিফিলিসে ভুগে, বস্তিতে জীবন কাটিয়ে, ভিক্ষাবৃত্তি করে, জীবনের মর্মভেদী যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে অতিপরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন এবং কবিদের ক্ষেত্রে ‘অভিশাপ’ যে কেবল সমাজের দেয়া নয়, তাঁরা নিজেরাও এমন সমস্ত কাজকর্ম করেছেন যে প্রকৃতি তাঁদের জীবনে বিপদ ডেকে এনেছে, তাঁদের দেহ ও অন্তরজগতকে ক্ষইয়ে দিয়েছে, তা টের পেয়েছিলেন তিনি ।
              পল ভেরলেনের কাছে ‘অভিশপ্ত কবির’ প্রধান দৃষ্টান্ত ছিলেন শার্ল বোদলেয়ার ( ১৮২১ – ১৮৬৭ ) যাঁর ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ), ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত, ছিল উনিশ শতকের সবচেয়ে বিখ্যাত কাব্যগ্রন্হ এবং পৃথিবীর সাহিত্যে অতুলনীয় । বইটির কবিতাগুলোয় ছিল সৌন্দর্যের সঙ্গে ইতরতার বৈপ্লবিক মিশ্রণ, তাতে প্রতিফলিত হয়েছিল  চরম আধ্যাত্মিকতা যার জন্য আধুনিক যুগ বহুকাল অপেক্ষা করছিল, যা একই সঙ্গে ছিল স্বর্গে ঝড়-তোলা ও নাছোড়বান্দাভাবে  নারকীয় । মর্ত্যে নরকভোগের অভিজ্ঞতা শার্ল বোদলেয়ারের ছিল, এবং তার অধিকাংশ তাঁর নিজের গড়া নরক । লাতিন কোয়ার্টার থেকে তুলে এনেছিলেন এক শ্যামলী বেশ্যাকে, আর তার থেকে প্রেমের পাশাপাশি পেয়েছিলেন সিফিলিস । তেত্রিশ বছর বয়সে মাকে বোদলেয়ার লিখেছিলেন, “আমি প্রথম থেকেই জঘন্য।” অথচ উত্তরাধিকারসূত্রে যা টাকাকড়ি পেয়েছিলেন, তিনি সারাজীবন আরামে জীবন কাটাতে পারতেন । আঁতোনা আতোর মতন বোদলেয়ারও লডানডাম ( মদে মেশানো আফিম ) মাদকের নেশা ছাড়তে পারেননি । যে লোক নিজেকে অভিশপ্ত মনে করে, সে তার কারণ খোঁজে । বোদলেয়ারে পাওয়া যায় যিশুখ্রিস্টের উপহাস । ‘সেইন্ট পিটারের অস্বীকৃতি’ কবিতায় বোদলেয়ার বলছেন:
    আহ ! যিশু, অলিভের বাগানকে মনে করো !
    তোমার সারল্যে তুমি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করেছিলে তার কাছে
    যে স্বর্গে রয়েছে সে হাসছিল পেরেকের শব্দে
    যেগুলো নীচ জল্লাদেরা তোমার মাংসে পুঁতে দিচ্ছিল ।
              বিশোধক যন্ত্রণাবোধের ধারণাকে বোদলেয়ার দিয়েছেন এক বিশেষ উতরাই, যা টেনেছিল পল ভেরলেনকে । ভেরলেন জানতেন যে বোদলেয়ারের নায়ক ছিলেন এডগার অ্যালান পো, যিনি, বোদলেয়ারের মতে, অত্যধিক মদ খাবার কারণে মারা যান, ‘অভিশপ্ত কবি’র সৃষ্টিক্ষমতা ও আত্মধ্বংসের ক্ষমতা দুটিই ছিল অ্যালান পোর অহংকার । বোদলেয়ারের চরস আর আফিমের নেশা ছিল যা তিনি ক্ষতিকর মনে করেও ছাড়তে পারেননি ; ‘অভিশপ্ত কবির’ যদি মনে হয় মাদক তাঁর চেতনাকে উন্নীত করছে, তাহলে তার ক্ষতিকর প্রভাবকে প্রতিভার দাম চোকানো হিসেবে তিনি মান্যতা দেবেন । এডগার অ্যালান পো, শার্ল বোদলেয়ার ও পল ভেরলেনের মাতাল-অবস্হায়-থাকা হয়ে উঠেছিল এক ধরণের আধ্যাত্মিক নিয়মনিষ্ঠা ।
             পল ভেরলেন মধ্যস্হ, মীমাংসক, শান্তিস্হাপকের বেদিতে বসিয়েছিলেন শার্ল বোদলেয়ারকে । ভেরলেন লিখেছেন, “আমার কাব্যিক অনুভূতিকে, এবং আমার গভীরে যা রয়েছে, তাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন বোদলেয়র।” একুশ বছর বয়সে ভেরলেন লিখেছিলেন, “শার্ল বোদলেয়ার উপস্হিত করতে পেরেছেন সংবেদনশীল মানুষকে, এবং তিনি তাকে উপস্হাপন করেন একটি আদর্শ হিসাবে, বা বলা যায়, নায়ক হিসাবে ।” ভেরলেন আরও বললেন যে, শার্ল বোদলেয়ার “একজন দ্রষ্টা ; তাঁর রয়েছে তীক্ষ্ণ, স্পন্দমান সংবেদন, একটি যন্ত্রণাময় নিগূঢ় মন, তাঁর ধীশক্তি তামাকে প্লাবিত, তাঁর রক্ত বিশুদ্ধ সুরাসারে প্রজ্বলন্ত ।” যেহেতু অভিশপ্ত, তাই আশীর্বাদপূত ।
               বোদলেয়ারকে নায়কের বেদিতে বসিয়ে তাঁর জীবনযাত্রা অনুকরণের প্রয়াস করলেন পল ভেরলেন । মদে চোবানো অফিমের বদলে তিনি আসক্ত হলেন আবসাঁথে । আবসাঁথে আর কিছু মেশাতে হয় না, সরাসরি পান করতে হয় এবং গাঢ় নেশা হয় । বন্ধুরা নিষেধ করলে ভেরলেন তাঁদের সঙ্গে তরোয়াল বের করে মুখোমুখি হতেন । ভেরলেনের হাতে দেশলাই দেখলে তাঁর বন্ধুরা ভয় পেতেন । স্ত্রীর চুল সুন্দর বলে তাতে আগুন ধরাবার চেষ্টা করেছিলেন । যখন ‘অভিশপ্ত কবি’ ভেরলেন লিখছেন, এবং দুঃখদুর্দশায় জীবন কাটাচ্ছেন, তিনি জানতেন না যে তাঁর বেশ কিছু কবিতা সাধারণ পাঠকের কাছে পৌঁছেচে । কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে ক্ষোভ মৃত্যু পর্যন্ত ছিল যে তাঁকে আর তাঁর কবিতাকে কেউ ঠিকমতন বুঝতে পারেনি ; তাঁর মনে হতো একজন কবির কাব্যিক প্রতিভার কারণে যে আবেগের ঝড় তাকে পুষতে হয় তা লোকে টের পায় না ; প্রথানুসরণ সত্যকার শিল্পের শ্বাসরোধ করে, তাই সীমালঙ্ঘন জরুরি হয়ে ওঠে মৌলিকতাকে আয়ত্ব করার জন্য, নয়তো কবিতা হয়ে উঠবে আহরিত ; জীবনকে আত্মাহীন হলে চলবে না, তাকে হতে হবে অকৃত্রিম ও বিশ্বাসযোগ্য ।
              বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে, ইউরোপেও, অভিশপ্ত কবির যুক্তি খাটতো, কিন্তু এখন সেগুলো কিংবদন্তি মনে হয় । ইউরোপ-আমেরিকায় নৈতিক বিপথগামীতার নতুন সংজ্ঞা বাজারের চালচলনের সঙ্গে বদলাতে থাকে । এমনকি ভারতেও বোদলেয়ার বা ভেরলেনের মতন অভিশপ্ত কবির যুগ শামসের আনোয়ার ও ফালগুনী রায়ের সঙ্গে শেষ হয়ে গেছে । এখন এসেছে অভিশপ্ত বুদ্ধিজীবির কালখণ্ডে । যাতে উপেক্ষার অভিশাপে না পড়তে হয় তাই কবি-লেখকরা এখন শাসকদলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান । পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের সময়ে যাঁরা লাল ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল করতেন তাঁরা অনেকেই তৃণমূলের মন্ত্রীর পাশে বসে ফোটো তোলাতে কার্পণ্য করেন না। রাষ্ট্র এখন এমনই বেপরোয়া যে কাকে কোন অভিযোগে জেলে পুরে দেবে তার নিশ্চয়তা নেই । কেবল রাষ্ট্র নয়, বিভিন্ন গোষ্ঠীও বুদ্ধিজীবিদের খুন করতে ভয় পায় না । নকশাল নামে একদা বহু বুদ্ধিজীবি লোপাট হয়ে ছিলেন ; এখন ‘শহুরে নকশাল’ নামে কয়েকজনকে জেলে পোরা হয়েছে । ধর্মবাদীদের হাতে খুন হয়েছেন কর্ণাটক আর মহারাষ্ট্রের কয়েকজন বুদ্ধিজীবি ।
             সমাজের যাঁরা নৈতিকতার জ্যাঠামশায়, তাঁরা সাহিত্যিকদের আত্মধ্বংসে সমাজেরই পচন দেখতে পান । বোদলেয়ার, ভেরলেন, র‌্যাঁবোর সময়ে ইউরোপের সমাজে ও রাজনীতিতে বিপুল রদবদল ঘটছিল, যা আমরা দেড়শো বছর পরে ভারতেও প্রত্যক্ষ করছি । এখন ইউরোপ আমেরিকায় ধর্মহীনতা ও যৌন-যথেচ্ছাচারকে অধঃপতন মনে করা হয় না, যা ভেরলেনের সময়ে করা হতো । ১৮৫৭ সালে বোদলেয়ারের ছয়টি কবিতাকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা এখন ভারতীয় মাপকাঠিতেও হাস্যকর মনে হয় । ভেরলেনেরও মনে হয়ে থাকবে, যে, কবিতাগুলো কোন যুক্তিতে জনগণের নৈতিকবোধে আঘাত হেনেছে, যখন কিনা জনগণ নিজেরাই জীবনে বহু ঘটনা চেপে যায় । কলকাতায় কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন কবি অবিনাশ কবিরাজ লেনে যেতেন অথচ আত্মজীবনী লেখার সময়ে তা চেপে গেছেন । বোদলেয়ারের ছয়টা কবিতা থেকে নিষেধ তোলা হয় ১৯৪৯ সালে । অথচ তার কয়েক বছর পরেই দেখা দিয়েছিলেন আমেরিকার বিট জেনারেশনের কবিরা ; অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘হাউল’ ঝড় তুলেছে । প্যারিস থেকে তার আগে ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হেনরি মিলারের ‘ট্রপিক অব ক্যানসার’ । অতিযৌনতা, ভিক্ষাবৃত্তি, নেশা ইত্যাদি সত্বেও হেনরি মিলার নিজেকে অভিশপ্ত মনে করেননি ।
              বোদলেয়ারের নিষিদ্ধ কবিতা ‘লিথি’, বুদ্ধদেব বসুর অনুবাদে :
    উঠে আয় আমার বুকে, নিষ্ঠুর নিশ্চেতনা
    সোহাগী ব্যাঘ্রী আমার, মদালস জন্তু ওরে
    প্রগাঢ় কুন্তলে তোর ডুবিয়ে, ঘণ্টা ভরে,
    চঞ্চল আঙুল আমার — হয়ে যাই অন্যমনা ।
    ঘাঘরায় গন্ধ ঝরে, ঝিমঝিম ছড়ায় মনে
    সেখানে কবর খোঁড়ে আমার এ-খিন্ন মাথা,
    মৃত সব প্রণয় আমার, বাসি এক মালায় গাঁথা
    নিঃশ্বাস পূর্ণ করে কি মধুর আস্বাদনে !
    ঘুমোতে চাই যে আমি যে-ঘুমে ফুরোয় বাঁচা,
    মরণের মতোই কোমল তন্দ্রায় অস্তগামী
    ক্ষমাহীন লক্ষ চুমোয় তনু তোর ঢাকবো আমি–
    উজ্বল তামার মতো ও-তনু, নতুন, কাঁচা ।
    শুধু তোর শয়ন ‘পরে আমার এ-কান্না ঘুমোয়,
    খোলা ঐ খন্দে ডুবে কিছু বা শান্তি লোটে ;
    বলীয়ান বিস্মরণে ভরা তোর দীপ্ত ঠোঁটে
    অবিকল লিথির ধারা বয়ে যায় চুমোয় চুমোয় ।
    নিয়তির চাকায় বাঁধা, নিরুপায় বাধ্য আমি,
    নিয়তির শাপেই গাঁথি ইদানিং ফুল্লমালা ;
    বাসনা তীব্র যতো, যাতনার বাড়ায় জ্বালা–
    সবিনয় হায়রে শহিদ নির্মল নিরয়গামী !
    এ-কঠিন তিক্ততারে ডোবাতে, করবো শোষণ
    ধুতুরার নেশায় ভরা গরলের তীব্র ফোঁটায়
    ঐ তোর মোহন স্তনের  আগুয়ান দৃপ্ত বোঁটায়–
    কোনোদিন অন্তরে যার হৃদয়ের হয়নি পোষণ ।
               সমালোচকদের স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন না বোদলেয়ার, ফলে যাত্রা আরম্ভ করেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের পথে, তাঁর কবিতা সহজে কোনো পত্রিকা ছাপতে চাইছিল না, বোদলেয়ারের মনে হচ্ছিল অস্বীকার ও যন্ত্রণালাভের মধ্যে দিয়ে তাঁর স্খালন ঘটছে, কবিতায় ইতরতার সঙ্গে সৌন্দর্যের মিশেলে গড়া তাঁর পাঠবস্তুতে তিনি তাঁর প্রতি ঈশ্বরের অবিচারের প্রসঙ্গ তুলেছেন । তিনি এডগার অ্যালান পো-কে ফরাসী পাঠকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার সময়ে পো-এর জীবনেও মদ্যপানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, যা তাঁর জন্য হয়তো জীবনবিনাশী ছিল, কিন্তু তা তাঁকে করে তুলেছিল প্রকৃত সৃজনশীল মানুষ, কেননা, বোদলেয়ারের মতে,  পো কখনও নেশাহীন প্রকৃতিস্হ থাকতে চাইতেন না । বদল্যার বলেছেন যে পো সাধারণ মানুষের মতন মদ খেতেন না, খেতেন বর্বরদের ঢঙে, মার্কিনী তেজে, যাতে এক মিনিট সময়ও নষ্ট না হয়, যেন তিনি খুন করার জন্য তৈরি, এমন একটা পোকাকে খুন করতে চাইছেন যা তাঁর ভেতরে বাসা বেঁধে আছে আর মরতে চায় না ।
             বদল্যারের মতে, মত্ততা এডগার অ্যালান পো-কে কেবল যে মহান কবি করে তুলেছে, তা নয়, তাঁকে করে তুলেছে মহান মানুষ ; পো-এর মত্ততা ছিল স্মৃতিবর্ধনের ক্রোনোট্রোপ ( সময়/পরিসর ), সাহিত্যকর্মের খাতিরে একটি সুচিন্তিত ও স্বেচ্ছাকৃত উপায়, তা মারাত্মক দুর্দশাপূর্ণ হলেও, তাঁর স্বভাবচরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিল । ভেরলেন যেমন বদল্যারের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি, একই ভাবে বদল্যার আত্মক্ষয়ের গৌরবের কিংবদন্তি গড়ে তুলেছিলেন এডগার অ্যালান পো-এর মাধ্যমে ।
              উনিশ শতকের ফ্রান্সে যে কবিদের রচনা আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যকে রূপ দিয়েছে, তাঁদের প্রতি ফরাসি প্রাতিষ্ঠানিকতার দুর্ব্যবহার ব্যাখ্যার অতীত । ভেরলেন যাঁদের অভিশপ্ত কবি হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন, তাঁদের সঙ্গে ভেরলেনের জীবনযাত্রা বেছে নেয়ায় পার্থক্য আছে । আবসাঁথের নেশার প্রতি ভেরলেনের টানের কারণ তিনি তাঁর ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানাননি, এবং আবসাঁথ খাবার পর যে সমস্ত দানবিক আচরণ তিনি করতেন তারও কোনো ব্যাখ্যা নেই । অনেকে মনে করেন তাঁর বাবার পালিত মেয়ে এলিজা তাঁর সঙ্গে সঙ্গমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের কারণে ভেরলেন হীনম্মন্যতায় ভুগতে আরম্ভ করেন এবং আত্মধ্বংসের দিকে এগিয়ে যান । পরবর্তীকালে তিনি তো যথেষ্ট রয়ালটি পেতেন এবং তা থেকে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর পাঠকের সংখ্যাবৃদ্ধি আঁচ করে থাকবেন ।
             র‌্যাঁবোর অভিশপ্ত হবার কারণ পাওয়া যায় বাবার অনুপস্হিতিতে । তাঁদের পাঁচ ভাইবোনের কারোর জন্মের সময়ে তাঁর বাবা বাড়িতে ছিলেন না । তাঁর যখন ছয় বছর বয়স তখন তাঁর বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে যান, ফলে শৈশব থেকে তাঁকে আর তাঁর মাকে টিটকিরি শুনতে হতো। তাঁর মা নিজেকে বলতেন বিধবা । অনুপস্হিত বাবাকে ঈশ্বরের আসনে বসিয়ে র‌্যাঁবো ঈশ্বরনিন্দা ও খ্রিস্টধর্মকে আক্রমণ করেছেন তাঁর কবিতায় । ঈশ্বরই তাঁর ও তাঁর মায়ের দুঃখদুর্দশার জন্য দায়ি । সেই অনুপস্হিত বাবাকে তিনি প্যারিসের অগ্রজ কবিদের মধ্যে পেতে চেয়ে অবহেলিত হন । 
              ভেরলেনও জেলে থাকার সময়ে রোমান ক্যাথলিক ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন, তবু তিনি ঈশ্বরভক্তি ও ঈশ্বরনিন্দার মাঝে দোটানায় পড়ে কবিতা লিখেছেন । খ্রিস্টধর্মের প্রফেটদেরও যেহেতু যন্ত্রণাভোগ করতে হয়েছে, যিশুকে ক্রূশকাঠে পেরেকে গেঁথা অবস্হায় ঝুলতে হয়েছে, তাই একজন কবিও, যে মানবসমাজের জন্য কবিতা লিখছে, তাকেও প্রফেটদের মতন অভিশপ্ত জীবন কাটাতে হবে, মনে করেছেন ভেরলেন । আঘাত পাওয়াকে তাঁরা অপরিহার্য সত্য বলে মান্যতা দিয়েছেন । রসাস্বাদন করেছেন শহিদত্বের, জাহির করেছেন তাকে । মন্দভাগ্যের সাধনা তাঁদের অন্তরজগতকে বড়ো বেশি দখল করে নিয়েছিল, বিশেষ করে ভেরলেনের । খ্রিস্টধর্মমতে মানসিক অবস্হানটি ‘ইপিফ্যানি’ । এই মনস্হতিকে অ্যারিস্টটল বলেছিলেন ‘দৈব উন্মাদনা’, ইউরোপীয় রেনেসাঁর গবেষক বলেছিলেন ‘শনিআক্রান্ত স্বভাবচরিত্র’।
             যাঁরা আচমকা সেই ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হন, তাঁরা,  ‘বিশুদ্ধ’ অভিজ্ঞতার খাতিরে, মনের ভেতরে সন্ধান করেন সীমাহীনতার, যে পরিসরে তিনিই নিজেকে মনে করেন সর্বেসর্বা, আত্মক্ষয় তাঁর কিচ্ছু করতে পারবে না ; মাদক, যৌনতা, মৃত্যু, ধর্মহীনতা, কোনো কিছুই তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না, কেননা তিনি আত্মক্ষয়ের গৌরবে আহ্লাদিত  পরিসরের সার্বভৌম মালিক । সেই গায়ক, কবি, চিত্রকর, ভাস্কর, স্হপতির আহ্লাদের শক্তিক্ষমতা, তাঁদের যন্ত্রণাদায়ক যাত্রাপথে এগোনোয় প্ররোচিত করে ; তাঁরা জানেন যে প্রয়াস না করলে তাঁরা কিছুই নন, তাঁরা একজন ‘নেইমানুষ’ ।
             যৌনতা তাঁদের কাছে বংশরক্ষার অথবা সন্তানের জন্ম দেবার প্রক্রিয়া নয়, যেমন মাদক নয় নেশাগ্রস্ত থাকার জন্য, এগুলো তাঁদের ‘নেইমানুষ’ হতে দেয় না । বংশরক্ষা বা সন্তানোৎপাদনের যৌনতা,  ব্যক্তিঅস্তিত্বকে ধারাবাহিকতার বাইরে নিয়ে যায়, গতানুগতিকতায় বেঁধে ফ্যালে। ধারাবাহিকতাহীনতা হলো অভিশপ্ত কবিদের প্রতিদিনের জীবনের সাধারণ স্বাভাবিক ঘটনা । জনসাধারণের মাঝে একজনের সঙ্গে আরেকজনের বাধা থাকে, অনেকসময়ে দূরতিক্রম্য, ধারাবাহিকতাহীনতা থাকে, পতিত-অঞ্চল থাকে । মানুষের ব্যক্তিএকক-বোধ জন্মায় তার সামনের বস্তুপৃথিবীর জিনিসগুলোর ব্যবহারের কারণে — তাদের দরুণ বস্তুদের থেকে সে বিচ্ছিন্ন থাকে । ‘নেই-বোধ’ হলো অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা, এবং এই ধারাবাহিকতার সন্ধান করেন আত্মক্ষয়ের আহ্লাদে আক্রান্ত অভিশপ্ত কবিরা । ‘নেই-বোধ’ হলো অহং-এর সমাপ্তি, যা মানুষটি ঝেড়ে ফেলতে চাইছেন, এবং সেই কারণেই আশেপাশের জনসাধারণকে সরিয়ে দিতে চাইছেন ।
             অমন মানুষটি আত্মবলিদানের গোমরে ভুগছেন কেন ? কেননা তাঁর কাছে আত্মবলিদানের গোমর হলো কেবলমাত্র ধ্বংস, তা নিশ্চিহ্ণ হওয়া নয় । আত্মবলিদানের গোমর বস্তুদের প্রতি আনুগত্যকে ধ্বংস করে ; প্রয়োজনীয় দৈনন্দিনের উপযোগীতাবাদী জীবন থেকে টেনে বের করে আনে, এবং মানুষটিকে প্রতিষ্ঠা করে দুর্বোধ্য খামখেয়ালে , স্বকীয় পবিত্রতায়, যার খোলোশা কেবল তিনিই করতে পারবেন । তাঁর এই ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ ঘটে তাবৎ সীমাগুলোর বিদারের মাধ্যমে, যাবতীয় নিষেধ অতিক্রমের দ্বারা, যা তাঁকে একযোগে আহ্লাদ ও পীড়নের স্হিতিতে নিয়ে গিয়ে একাকী ছেড়ে  দেয় । ‘বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতা’ হলো ‘নেই-স্হিতি’, এবং সেহেতু মানসিক ও দৈহিক আত্মক্ষয় সম্পূর্ণ পরিবর্তন-পরিশীলনের জন্য একান্তই জরুরি । অভিশপ্ত কবির ভেতরে-ভেতরে যে সন্ত্রাস চলছে তা অন্য কেউ তাঁকে দেখে বুঝতে পারে না ; তার জন্য তাঁর গানে, সঙ্গীতে, কবিতায়, ভাস্কর্যে, পেইনটিঙে, স্হাপত্যে, প্রবেশ করতে হবে ।
               ব্যক্তিএককের বিশুদ্ধ অভিজ্ঞতার ক্রোনোট্রোপে বাস্তব জগত আর মিথ মিলেমিশে গেলে তার যে মানসিক অবস্হা গড়ে ওঠে তাকে ভেরলেনের আলোচকরা বলেছেন ‘নুমিনাস’, যে অবস্হায় ব্যক্তিএককের অন্তরজগতে নিদারুণ তোলপাড় ঘটতে থাকে, সে তখন বাইরের জগতের প্রতি উৎসাহহীন, তার মনে হয় সে বাইরের জগতের দ্বারা অবদমিত, হতোদ্যম অবস্হায় সে নিজের ভেতরে আরও বেশি করে ঢুকে যেতে থাকে, তখন সে বিপজ্জনক আত্মক্ষয়ের স্বাদ পেতে আরম্ভ করেছে, খাদের কিনারে পৌঁছে গেছে, বুঝে উঠতে পারছে না ঝাঁপ দেবে নাকি ফিরে যাবে ।
             সুইডেনের নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিণ্ডবার্গ, যিনি খাদের কিনারায় গিয়ে ফিরে এসেছিলেন, বেশ কিছু সময় মানসিক হাসপাতালে ছিলেন, তিনি নিজের অবস্হাটা যাচাই করে বলেছিলেন যে, ‘যারা উন্মাদ হবার সুযোগ পায় তারা যথেষ্ট ভাগ্যবান’ । মার্কিন কবি জন বেরিম্যান, যাঁর বাবা শৈশবে নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন, এবং যিনি বাবার আত্মহত্যার স্মৃতি থেকে কখনও মুক্তি পাননি , বলেছিলেন, ‘যে কবি অত্যন্ত ভয়াবহ মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে গেছে, যা তাকে মেরে ফেলতে পারতো অথচ যা তাকে প্রকৃতপক্ষে বাঁচতে সাহায্য করেছে, তার অদৃষ্টের প্রশংসা করা উচিত’।
        অভিশপ্ত কবির ভেতরে এক সৃজনশীল ক্ষমতা প্রবেশ করে ; সে চেষ্টা করে যায় যাতে বিস্ফোরণে সে নিজেই না উড়ে শতচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে চেষ্টা করে কখন সৃজনশীলতার আবেগ ও সংবেদনকে প্রয়োগ করতে হবে । সব সময় একটা ভীতি কাজ করে, কেননা সৃজনশীল মানুষটি খাদের ধার পর্যন্ত যাবেনই, আবার একই সঙ্গে তাঁর ভেতর এই ভীতি কাজ করে যে তিনি বড়ো বেশি মার্জিত রুচিশীল বিবেকী সুস্হতাবিশিষ্ট স্হিরমস্তিষ্ক হয়ে উঠছেন না তো ! সাধারণ মানুষের তুলনায় সৃজনশীল মানুষ, নিজের সৃজনশীলতার সঙ্গে আপোষ করতে না পেরে খানিকটা ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হয়ে পড়েন, এবং ম্যানিক-ডিপ্রেসিভ হবার কারণে তাঁরা যখন ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হন তখন, সাধারণ মানুষের তুলনায়, অস্তিত্বের সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হতে পারেন, অন্তদর্শী হতে পারেন, প্রতিক্ষেপক হতে পারেন । আমেরিকায় লেনি ব্রুস নামে একজন প্রতিসাংস্কৃতিক কমেডিয়ান ছিলেন, অশ্লীল ভাষায় সবায়ের সমালোচনা করতেন, যে কারণে তাঁকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল,  এবং তাঁর মৃত্যুর পর তা মাফ করে দেয়া হয়, তিনি উন্মাদ বুদ্ধিমত্তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি, তিনি নিজেও আত্মক্ষয়ে ভোগেননি ।
             ডাক্তারি ভাষায় আত্মক্ষয়ের গৌরবকে বলা হবেছে ‘হাইপোম্যানিয়া’ । কোনো সৃজনশীল মানুষকে যদি হাইপোম্যানিয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয় তাহলে তাঁর কাছে তা সৃজনের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি । সৃজনশীল মানুষ তাঁদের কাজের জন্য যে কাঁচা মাল ব্যবহার করেন, তা আসে তাঁদের অন্তর্জীবনের বুনিয়াদি বা আদিকালীন স্তর থেকে — যৌন কল্পনা, পূর্বপক্ষতা, আগবাড়া চারিত্র্য, বহুবিধ যৌনাঙ্গিকের ভাবনা থেকে । শৈশব থেকে মানুষের ভেতরে এই বোধগুলো কাজ করে, সে এই স্তরগুলো অতিক্রম করে যৌবনে পৌঁছোয় । বয়সের সঙ্গে সে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে শেখে, আদিম-চেতনাকে দাবিয়ে রাখতে শেখে, সামাজিক বাধানিষেধকে মান্যতা দিতে শেখে । কিন্তু সৃজনশীল মানুষ এগুলোর সংস্পর্শে থাকেন, আর তাদের বোঝার জন্য নিজের সঙ্গে লড়তে থাকেন, আর নিজের আদিম চারিত্র্যের সঙ্গে সংস্পর্শে থাকার অভিপ্রায়ে তিনি উন্মাদনা ও মতিস্হিরতার মাঝে ভারসাম্য বজায় রেখে চলেন আবার কখনও বা সেই ভারসাম্য হারিয়ে অভিশপ্ত হন।
    তিন
              পল-মারি ভেরলেনের জন্ম ১৮৪৪ সালের ৩০ মার্চ উত্তরপূর্ব ফ্রান্সের মোৎসেল আর সেইলি নদীর সঙ্গমস্হল মেৎজ শহরে ।   সমরবাহিনীর ক্যাপ্টেন তাঁর বাবা নিকোলাস অগুস্তে ভেরলেন  ১৮৫১ সালে মেৎজ থেকে প্যারিসে পাকাপাকি  বসবাসের জন্য চলে যান । সেখানে পল ভেরলেনকে বোনাপার্ত উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয় । স্কুলের তথ্য অনুযায়ী চোদ্দো বছর বয়সে তাঁকে দেখতে কুৎসিত মনে হতো । জীবনের প্রথম সাত বছর বাবার চাকুরির দৌলতে বিভিন্ন শহরে বসবাস করতে হয়েছিল ভেরলেনকে, যার দরুণ শৈশবে তাঁর একমাত্র বন্ধু ছিলেন তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া খুড়তুতো বোন এলিজা । এলিজার অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেননি কিশোর ভেরলেন ; এলিজা  ছিলেন তাঁর প্রথম প্রেম,  যদিও এলিজার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আর একটা বাচ্চা ছিল তবু ভেরলেন তাঁকে দৈহিকভাবে চেয়েছিলেন; এলিজাকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘দুর্দান্ত উৎসব’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৯ সালে, এলিজার মৃত্যুর পর । 
               ১৮৬২ সালে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে  ভেরলেন প্রথমে বীমা কোম্পানির  চাকুরিতে যোগ দেন। ১৮৬৫ সালে তাঁর বাবা মারা যান । দুই বছর আইন পরীক্ষা পড়ার পর ছেড়ে দ্যান। ১৮৬৭ সালে  এলিজা মোনকোঁলের মৃত্যুর ফলে তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গ বোধ করতে থাকেন আর বেয়াড়া হয়ে যান, বাবা-মায়ের কাছে তাঁর আবদার বেড়ে যায়, খামখেয়ালি, অব্যবস্হিতচিত্ত, স্বার্থপর, অপরিণত যুবক হয়ে ওঠেন ।  তাঁর মা মদ খাবার টাকা যোগাতেন না বলে বাড়িতে প্রায়ই ঝগড়া হতো । উচ্চবিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই তাঁর আবসাঁথ খাবার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল । মদ্যপ অবস্হায় দু’বার মাকে খুন করার জন্য তাঁর পেছনে তরোয়াল নিয়ে দৌঁড়েছিলেন । ভেরলেনের বন্ধু তাঁদের দুজনের মাঝে গিয়ে ভেরলেনকে কাবু করেন । মাকে দ্বিতীয়বার আক্রমণের ব্যাপার চলেছিল সাত ঘণ্টা কথা কাটাকাটির মাঝে । মা পরের দিন সবকিছু ভুলে গিয়ে আদরের ছেলেকে ক্ষমা করে দিতেন ।
             শার্ল বোদলেয়ারের ‘পাপের ফুল’ ( Les fleurs du mal ) পড়ার পর পল ভেরলেনের কবিতা লেখার ইচ্ছা হয়। ১৮৬৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘মসিয়ঁ প্রুধোম’ প্রকাশিত হয় । তিনি ‘সমসাময়িক কবিতা’ ( Le Parnasse Contemporain ) পত্রিকার সম্পাদক কাতুলে মেনদেস-এর সঙ্গে দেখা করেন । পত্রিকাটিতে তাঁর আটটি কবিতা প্রকাশিত হয় । উনিশ শতকের ফ্রান্সে একদল কবি আরম্ভ করেন পারনাসিয় আন্দোলন ; নামটি নেয়া হয়েছিল অ্যাপোলো আর মিউজদের পবিত্র গ্রিক পাহাড়ের নাম থেকে । পারনাসিয়রা বিষয়বস্তু এবং শৈলীর বিস্তার প্রদর্শন করলেও, তাঁরা গুরুত্ব দিয়েছেন কারিগরি, অশেষ সৌন্দর্য ও বস্তুনিষ্ঠাকে। রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা দিয়েছিল পারনাসিয় আন্দোলন এবং তা ক্রমে প্রসারিত হয় প্রতীকবাদ ও ডেকাডেন্ট কাব্যিক ঐতিহ্যে । পারনাসিয় আন্দোলনের প্রধান কবি বলে মনে করা হয় শার্ল-মারি-রেনে লেকঁত দ্যলিজেকে, কিন্তু আন্দোলনের অংশ হিসাবে মান্যতা দেয়া হয় থিয়োদোরে দ্যবাঁভিল, অঁরি কাজালিস, ফ্রাঁসোয়া কোপি, আনাতোল ফ্রাঁসে, থিয়োফিল গতিয়ে, জোসে-মারিয়া দ্যহেরদিয়া, সালধ প্রুধোম, পল ভেরলেন ও শার্ল বোদলেয়ারকে। ১৮৬৬, ১৮৭১ ও ১৮৭৬  সালে সবসুদ্ধ নিরানব্বুইজন কবির তিনটি সংকলন প্রকাশ করেন আলফোঁসে লেমেরে, কাতুলে মেন্দেস আর লুই জেভিয়ার । এই তিনটি সংকলনের প্রকাশকে ফরাসী সাহিত্যে বাঁকবদলকারী ঘটনা বলে মনে করা হয় । তবে থিয়োফিল গতিয়ে যখন ‘আর্ট ফর আর্টস শেক’ স্লোগান দিলেন তখন পারনাসিয় কবিরা একটা বৌদ্ধিক গতিমুখ পেলেন । ভেরলেন নিজেকে পারনাসিয় আন্দোলনের একজন সদস্য বলে মনে করতেন না ।
               ১৮৬৬ সালে প্রকাশিত হয় ভেরলেনের প্রথম কাব্যগ্রন্হ Poemes Saturniens এবং দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্হ Gallant Parties প্রকাশিত হয় ১৮৬৯ সালে । মেনদেসের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে অন্যান্য পারনাসিয় কবি লেকঁতে দ্যলিজে, থিয়োদির দ্য বাঁভিল, লুই জেভিয়ার দ্য রিকার্দ, ফ্রাঁসোয়া সিপ্পি প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় এবং সুফলো রোড-এর সস্তা মদের দোকানে সবাই মিলে আড্ডা দিতেন । বিয়ারের স্বাদ সেসময়ে ভালো ছিল না বলে আবসাঁথের প্রতি আসক্ত হন ভেরলেন ও অন্যান্য কবিরা । ভেরলেন নিজেই ‘স্বীকৃতি’ বইতে জানিয়েছেন যে তিনি একবার সারারাতে দুশোবার অর্ডার দিয়ে আবসাঁথ খেয়েছিলেন । Poemes Saturniens এর “হেমন্তের কবিতা” লিখে ভেরলেন কবিদের প্রশংসা পেয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে এই কবিতাটির প্রথম ছয় লাইন মিত্রপক্ষের সৈন্যবাহিনী নরম্যাণ্ডি অবতরণের কোড হিসাবে বিবিসি থেকে প্রসার করেছিলেন ; প্রথম তিন লাইন পয়লা জুন আর দ্বিতীয় তিন লাইন পাঁচুই জুন :
    হেমন্তের বেহালার
    দীর্ঘ ফোঁপানিগুলো
    আমার হৃদয়কে আহত করে
    একঘেয়ে সুরের অবসাদে ।
    সমস্তকিছু শ্বাসহীন
    আর ফ্যাকাশে, যখন
    সময়ের কাঁসর বেজে ওঠে,
    আমার মনে পড়ে
    বিগত দিনগুলো
    আর আমি কাঁদি
    আর আমি চলে যাই
    এক অশুভ বাতাসে
    যা আমাকে নিয়ে যায়
    এখানে, সেখানে,
    যেন গাছের এক
    মৃত পাতা ।
              বাইশ বছর বয়সে লেখা কবিতাটির শিরোনাম যদিও ‘হেমন্তের গান’, প্রতীকবাদী অন্যান্য কবিদের মতো ভেরলেনও, র‌্যাঁবোর সঙ্গে পরিচয়ের আগে, ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’কে মান্যতা দিয়ে কবির অন্তরজগতকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন এবং তিনি যে বলতেন কবিতাকে সঙ্গীতময় হয়ে উঠতে হবে, তার পরিচয় মেলে এই কবিতায় ; তিনি বলতেন যে কবিতায় সঙ্গীতই প্রথম এবং প্রধানতম । যাঁরা কবিতাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, তাঁদের বক্তব্য, ফরাসি ভাষায় না পড়লে কবিতাটির সঙ্গীতময়তা অনুধাবন করা যায় না । এই কবিতাটির অনুকরণে উনিশ শতকের শেষ দিকে বহু কবি কবিতা লিখেছেন । এই কবিতার আনুয়ি বা অবসাদ হয়ে ওঠে ভেরলেনের কবিতার বৈশিষ্ট্য। ভেরলেনের কবিতায় ক্ষয় বা অপচয় ঘুরে-ঘুরে এসেছে । কবিতাটির ধীর লয় কবির অবসাদকে তুলে ধরার জন্য প্রয়োগ করেছেন ভেরলেন । পারনাসিয় কবিদের প্রভাবে র‌্যাঁবো ‘দি ড্রাঙ্কন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ নামে একটা কবিতা লিখেছিলেন, কিন্তু পরে নিজেই এই কবিতার ধারাকে সমর্থন করেননি, এবং গদ্যকবিতার দিকে ঝোঁকেন ।
              উনিশ শতকের প্যারিসে লাতিন কোয়ার্টার ছিল যেন এক বোহেমিয়ান দ্বীপ, যেখানে জড়ো হতেন অজস্র লেখক, শিল্পী, নাট্যকার আর কবিযশোপ্রার্থী । ভিক্তর য়োগো, শার্ল বোদলেয়ার প্রমুখের মতন পল ভেরলেনও বেছে নিয়েছিলেন এলাকাটা, সস্তার মদ আর বেশ্যাসঙ্গের আকর্ষণে । প্যারিসের ইতিহাসে এই সময়টাই ছিল প্যারিস কোয়ার্টারের খ্যাতি-কুখ্যাতির কারণ — এখন তা একেবারে বদলে গিয়েছে । যারা এই এলাকায় বাস করতো তাদের কাছে পাড়াটা ছিল নরক । অত্যন্ত গরিব শ্রমজীবিদের পাড়া, দুবেলা খাবার জোটেনা, অসুখে পড়লে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে হয় ইত্যাদি । তারা প্রধানত গ্রামাঞ্চল থেকে এসে সস্তায় থাকার জায়গা হিসাবে বেছে নিয়েছিল পাড়াটা, আর বাড়তি রোজগারের জন্য ঘর ভাড়া দিতো, বেশ্যাগিরি করতো, সস্তার মদ বিক্রি করতো । ক্রমশ তারা লেখক-কবি-শিল্পীদের চাহিদা মেটাবার জন্য সারারাতের যৌনহুল্লোড়ের ব্যবস্হা করতো । ফরাসি সাহিত্যে দেখা দিচ্ছিল রোমান্টিক ঔপন্যাসিকদের জনপ্রিয়তা, আদর্শের পরিবর্তে ‘পাপের ফুলের’ বা ‘নরকে ঋতুর’ প্রতি আকর্ষণ । ফাউস্তের জায়গা নিয়ে নিচ্ছিল মেফিসতোফিলিস । ঈশ্বর-বিশ্বাস নিয়ে দোটানায় ছিলেন কবি-লেখক-শিল্পীরা । পেত্রুস বোরেল নামে এক কবি, যিনি বোদলেয়ারের বন্ধু ছিলেন, লাতিন কোয়ার্টারে গরিব সেজে ঘুরে বেড়াতেন, তাঁকে বলা হতো “নেকড়ে বাঘে পরিণত মানুষ।”    
               ভেরলেনের মতিগতি ফেরাবার জন্য তাঁর মা তাঁর বিয়ে প্রথমে ঠিক করেন কড়া মেজাজের এক মামাতো বোনের সঙ্গে,  কিন্তু তা এড়াবার জন্য ভেরলেন পছন্দ করেন এক বন্ধুর সৎবোন,  তাঁর চেয়ে বয়সে বেশ ছোটো  সুন্দরী তরুণী মাতিলদে মত দ্য ফ্ল্যেওরভিলেকে, বিয়ে হয় ১৮৭০ সালে ; মাতিলদের সঙ্গে পরিচয়ের সময়ে যুবতীটির বয়স ছিল ষোলো, তাঁর মা-বাবা ভেরলেনকে জানান যে তাঁকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে । ১৮৬৯ সালের জুনমাসের এক দুপুরে, মদ খাবার জন্য বন্ধু শালর্ক দ্য সিভরির মমার্তর বাড়িতে গিয়েছিলেন পল ভেরলেন । শার্ল তাঁর মা আর সৎবাবা থিওদোর মতে দ্য ফ্লেওরভিলের সঙ্গে থাকতেন । দুই বন্ধু যখন গল্প করছিলেন তখন ষোলো বছরের একটি সুন্দরী যুবতী ঘরে ঢোকেন, ভেরলেনের মতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢোকেন, তিনি শার্লের সৎবোন মাতিলদে মতে । ভেরলেনের কবিতা তাঁর পড়া ছিল এবং পড়ে কবিকে ভালো লেগেছিল, তিনিও ভেরলেনের প্রেমে পড়েন । বিয়ের ছয় মাসের মধ্যেই মাতিলদে গর্ভবতী হবার দরুন ভেরলেন বিষাদে আক্রান্ত হয়ে আবার লাতিন কোয়ার্টারে যাতায়াত আরম্ভ করেন ।তাঁদের একটি ছেলেও হয় ।  
             মাতিলদে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে প্রথম দুই বছর ভেরলেন তাঁকে খুব ভালোবাসতেন এবং তাঁকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছিলেন। ভেরলেনের তৃতীয় কাব্যগ্রন্হ ‘ভালো গান’-এর কবিতাগুলো  মাতিলদেকে মনে করে লেখা । কিন্তু মাঝে-মাঝে ভেরলেনের রুদ্ররূপ বেরিয়ে পড়তো আর তিনি মাতিলদের গায়ে হাত তুলতেন । একবার তিনি মাতাল অবস্হায় তাঁর ছেলে জর্জকে তুলে দেয়ালে মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন । তাঁর মা, শশুর-শাশুড়ির উপস্হিতিতেও এরকম আচরণ করতেন তিনি ।
              ভেরলেন  মিউনিসিপালিটির সরকারি চাকরিতে যোগ দেন  ১৮৭০ সালে । কিন্তু তৃতীয় নেপোলিয়ানের পতনের পরবর্তী দ্রোহের সময়ে প্যারিস-শহর ও চাকরি ছেড়ে পালান । ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৭০ থেকে ২৮ জানুয়ারি ১৮৭১ পর্যন্ত প্রুসিয় সেনারা প্যারিস শহর ঘিরে ফরাসিদের জব্দ করতে চায় । সমস্ত কিছুর অভাব দেখা দেয় । কবি-লেখকরা লাতিন কোয়ার্টারের যে পাড়ার পানশালায় গিয়ে আড্ডা দিতেন সেখানেের ভোজন-তালিকায় ঘোড়া, কুকুর, বিড়াল এমনকি ইঁদুরের মাংস বিক্রি হতো । নারী আর পুরুষ বেশ্যারা এই খাবার একপেট খাবার বিনিময়ে সঙ্গমে রাজি হয়ে যেতো । এই সময় খবর রটে যায় যে বিসমার্ক পরামর্শ দিয়েছেন প্যারিসের ওপরে চারিদিক থেকে কামান দাগা হোক, কিন্তু ব্লুমেনথেল তা সামলে দেন এই তর্কে যে ফরাসি সেনার বদলে সাধারণ মানুষ তাতে মারা পড়বে । ভেরলেনসহ অনেকেই, যাঁরা প্যারিস কমিউনে যোগ দিতে চাননি, তাঁরা প্যারিস ছেড়ে পালান । ভেরলেন অবশ্য কমিউনের প্রেস অফিসার হিসাবে ১৮৭০-এ কাজ করেছিলেন আর কমিউন ভেঙে যাবার পর রাস্তায়-রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ আরম্ভ হলে অন্যান্য কবি-লেখকদের সঙ্গে গা ঢাকা দেন  ।
              পল ভেরলেনের জীবনযাত্রা, অপরাধ আর সাধাসিধে ছলাকলাশূন্যতার মাঝে দোল খেয়েছে । স্তেফান মালার্মে ও শার্ল বোদলেয়ারের সঙ্গে তাঁকে প্রতীকবাদী কবিতার ত্রিমূর্তির অন্তর্গত করলেও, দুটি প্রতীতি প্রাধান্য পায় : প্রথম হল যে কবির অহং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ; দ্বিতীয় যে কবিতার কাজ হল চরম সংবেদন ও একক ধৃতির মুহূর্তগুলোকে অক্ষুণ্ণ রাখা । Poemes saturniens ( ১৮৬৬ ) কাব্যগ্রন্হে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, “একে মিলোর তৈরি ভেনাস বলা হবে নাকি নিছক শ্বেতপাথর ?” তাঁর কবিতায় আপাত-অনিশ্চয়তা ও অস্পষ্টতা সত্বেও, তিনি কবিতার কারিগরিতে সহজ ও সঙ্গীতময় শব্দ প্রয়োগ করে সাবধানি কারুনৈপূণ্য বজায় রেখেছেন । ফরাসি ধ্রুপদি কবিতার খোলোসের মধ্যে থেকেও ছন্দবর্জনের খেলা খেলেছেন, যেমন ১৮৭৪-এ রচিত Romances sans Paroles কবিতায় লিখেছেন :
    “আমার হৃদয়ে ক্রন্দন
    শহরে বৃষ্টি পড়ার মতো”
              মাতিলদেকে নিয়ে ভেরলেন ভালোবাসার অনেকগুলো কবিতা লিখেছিলেন Le bonne chanson ( The Good Song ) কাব্যগ্রন্হে । কয়েকটার বাংলায়ন :
    এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে
    এক নারীসন্ত তাঁর জ্যোতিতে,
    এক গিন্নিমা তাঁর মিনারে,
    মহিমা ও ভালোবাসা
    যা মানুষের শব্দাবলীতে আছে ;
    সোনার বার্তা যা বাঁশি
    বহুদূরের বনানী থেকে বাজায়,
    অবলা গর্বের সঙ্গে বিবাহিত
    যা বহুকাল আগের মহিমাময়ীদের ;
    তার সাথে, ধরা পড়ে না এমন সৌন্দর্য
    এক তরতাজা বিজয়িনী হাসির
    যা ফুটে উঠেছে রাজহাঁসের পবিত্রতায়
    আর এক নারী-শিশুর লজ্জায় ।
    মুক্তার মতো আদল, শাদা আর গোলাপি,
    এক মৃদু অভিজাত স্বরসঙ্গতি :
    আমি দেখি, আমি এই সবকিছু শুনতে পাই
    মেয়েটির শার্লমেনিয় বংশধরের নামে ।
    আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম …
    আমি অধর্মের পথে গিয়েছিলুম,
    বেদনাদায়ক অনিশ্চিত
    তোমার প্রিয় হাত  ছিল আমার পথনির্দেশক।
    তাই দূরে দিগন্তের উপর ফ্যাকাশে
    ভোরের একটি দুর্বল আশা ছড়াচ্ছিল দ্যুতি;
    তোমার দৃষ্টিতে ছিল ভোর।
    চারিদিক নিঃশব্দ, তোমার সুরেলা পদক্ষেপ ছাড়া শব্দ নেই,
    ভ্রমণকারীকে উত্সাহিত করেছো তুমি।
    তোমার কন্ঠস্বর আমাকে বলেছিল: “এগিয়ে চলো !”
    আমার ভয়ঙ্কর হৃদয়, আমার ভারী হৃদয়
    একা কেঁদেছিল দুঃখের পথযাত্রায়
    ভালবাসা, আনন্দদায়ক বিজয়ী,
    আমাদের আনন্দের বাঁধনে আবার  একত্র করেছে।
           ১৮৬৫ সালে শার্ল বোদলেয়ার সম্পর্কে লেখা দুটি প্রবন্ধে ভেরলেন জানিয়েছিলেন যে একজন কবির অন্বেষন কেবল সৌন্দর্য । কবিতা রচনায়, তিনি বলেছেন, প্রেরণা আর আবেগের যৎসামান্য স্হান থাকলেও কবির থাকা দরকার কারিকুরির সৃষ্টিশীলতা । ব্যক্তিগত আবেগকে যদি ব্যবহার করতে হয় তাহলে ছন্দ, ধ্বনি এবং চিত্রকল্পকে একত্রিত করে একটি কাব্যিক সঙ্গীত গড়ে নিতে হবে এবং সেই জগতে কোনোকিছুই আপতনিক নয় । ভেরলেনের কারিগরির ফল হল তাঁর কবিতার সঙ্গীতময়তা ; ধ্বনিরা একত্রিত হয়ে এক সুরেলা ঐকতান সৃষ্টি করে । ১৮৮২ সালে তিনি বলেছিলেন, “L’Art poetique” কবিতায়, “কবির উচিত বিজোড়-মাত্রার পঙক্তি, যথাযথ-নয়-এমন শব্দভাঁড়ার এবং প্রচ্ছন্ন চিত্রকল্প ব্যবহার করা ; রঙের বদলে অতিসূক্ষ্ম তারতম্যকে গুরুত্ব দেয়া । কবিকে ইচ্ছাকৃত ছন্দ, বৈদগ্ধ্য ও বাগ্মীতা এড়াতে হবে । কবিতা হবে হালকা, বাতাসে ভাসমান, যৎসামান্য সুগন্ধময় ও ক্ষণিক । এছাড়া সমস্তকিছু কবিতা হয়ে ওঠার পরিবর্তে হয়ে উঠবে সাহিত্য ।” 
              সমসাময়িক বাস্তববাদ এবং বাগাড়ম্বরপূর্ণ অলঙ্কার বর্জন করে অন্যান্য প্রতীকবাদী কবিদের মতো পল ভেরলেনও উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন মেজাজ, সত্তা । তাঁর কাব্যগ্রন্হ Fetes gallantes  এর অন্তর্গত Clair de Lune ( Moonlight ) “চাঁদের আলো” কবিতাটিকে মনে করা হয় তাঁর সবচেয়ে ভালো কাজ । যেভাবে চাঁদ তার আলো সূর্য থেকে পায়, ভেরলেন চাইলেন এমন বিষয়বস্তু বেছে নিতে যা সহজে অভিগম্য নয়, তাই চাঁদের মতো পরোক্ষভাবে বিষয়বস্তুকে দীপ্ত করতে চাইলেন, যা প্রতিফলন সৃষ্টি করে ।
               ভেরলেনের কবিতাটিতে আছে মুখোশ আর নৃত্য, অভূতপূর্ব ছদ্মবেশ, আহ্লাদিত ঝর্ণাদের ফোঁপানি, চাঁদের আলো : বিশেষকিছু না বলেই কবিতাটিতে ইশারামূলক ছবির স্লাইড চলে যায় একের পর এক । ডেভিড ওইসত্রাখ ও ফ্রিদা বাওয়ের এই কবিতাটিকে নিয়ে একটি নৃত্যনুষ্ঠান করেছেন । ক্লদ দেবুসি, রেনাল্দো হাহন, পোলদোস্কি, গুস্তাভ কার্পেন্তিয়ের এবং গ্যাব্রিয়েল ফাওরে নিজেদের মতো করে সুর দিয়েছেন কবিতাটিতে । ইংরেজিতে যাঁরা অনুবাদ করেছেন তাঁরা বলেছেন কবিতাটি অনুবাদ করা কঠিন। 
    Moonlight
    Your soul is like a landscape fantasy,
    Where masks and Bergamasks, in charming wise,
    Strum lutes and dance, just a bit sad to be
    Hidden beneath their fanciful disguise.
    Singing in minor mode of life’s largesse
    And all-victorious love, they yet seem quite
    Reluctant to believe their happiness,
    And their song mingles with the pale moonlight,
    The calm, pale moonlight, whose sad beauty, beaming,
    Sets the birds softly dreaming in the trees,
    And makes the marbled fountains, gushing, streaming–
    Slender jet-fountains–sob their ecstasies.
              আমি এখানে শুভদীপ নায়কের করা বাংলা অনুবাদ দিলুম । উনি নামকরণ করেছেন ‘জ্যোৎস্না’
    জ্যোৎস্না
    ( clair de lune / Moonlight)
    তোমার অন্তর এক প্রশস্ত কল্পনার মতো
    সেখানে মুখোশ ও মুখশ্রী দুই-ই প্রজ্জ্বলিত
    বীণার তার এবং নৃত্য, যা আসলে বেদনামথিত
    তোমাকে লুকিয়ে রাখে সৌন্দর্যের আড়ালে
    সঙ্গীতকে ধীরে ধীরে করে তোলো বৃহৎ জীবন
    ভালবাসাময়, নিশ্চল ও শান্ত
    তাদের সুখের ওপর বজায় রাখো বিশ্বাস
    সেইসব সঙ্গীত তুমি ধরে রাখো জ্যোৎস্নায়
    শান্ত পরাভব সেই জ্যোৎস্না, অপূর্ব ক্লেশে বিকশিত
    পাখিদের মতো এসে বসে স্বপ্নময় গাছের ডালে
    হয়ে ওঠে ঝর্ণা, চিত্তের প্রবাহ
    ঝর্ণার ঋজুতায়, — নিজস্ব উল্লাসে
              একজন মানুষের আত্মার রুপকশোভিত ছবিতে, ‘চাঁদের আলো’ জাগিয়ে তোলে সৌন্দর্য, ভালোবাসা আর প্রশান্তির আকাঙ্খা । কবিতাটি থেকে ক্রমবর্ধমান হতাশার যে আবহ গড়ে ওঠ তাতে পাওয়া যায় ভেরলেনের আত্মমগ্নতার কন্ঠস্বর । ভেরলেন পাঠকের মনে সন্দেহ তৈরি করতে চেয়েছেন, যাতে সে ভাবতে বাধ্য হয়, বাস্তবে কি সত্যিই ভালোবাসা আর আনন্দ পাওয়া সম্ভব । প্রধান উপমাটিকে প্রয়োগ করে তিনি বলতে চেয়েছেন যে প্রত্যেক মানুষই তার অন্তরজগতে একটা ভূদৃশ্য বহন করে, আর এই ক্ষেত্রে, যে উপাদান তৈরি হয় তা হলো একই সঙ্গে সুন্দর আর আশাহীন । অস্তিত্ব এবং যা দেখা যাচ্ছে, তার বৈপরীত্য কবিতাটির গুরুত্বপূর্ণ থিম । দৈহিক সৌন্দর্য আর বিষাদের মিশ্রিত অবস্হান ভেরলেন পেয়েছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে । তাঁর মতে, মানুষের জীবনে এবং আত্মায়, অর্থাৎ মৃত্যুর পর, তার নিখুঁত হবার প্রয়াস কখনও পুরণ হবে না । জীবনের সত্যকার সত্তা উপরিতলে পাওয়া যাবে না ।
              ভেরলেনের সযত্নে রচিত কবিতার বনেদ প্রায়শই তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতানির্ভর, নিঃসন্দেহে নাটকীয় এবং আবেগমথিত বিষয়বস্তু । তাঁর “Poemes saturniens”     প্রস্তাবনায় স্পষ্ট যে তিনি নিজের অবজ্ঞাত, দৈন্যপীড়িত, দুর্দশাগ্রস্ত নিয়তি আঁচ করতে পেরেছিলেন । এই কাব্যগ্রন্হের সব কয়টি কবিতায় তিনি তুলে ধরেছেন অসুখী থাকার স্বপূরক প্রত্যাশার একাধিক বিন্যাস । আনন্দের ক্ষণিক মুহূর্ত ভেরলেনের  সমস্ত কবিতায় ছেয়ে আছে । এমনকি “Sagesse” গ্রন্হে, যেখানে রোমান ক্যাথলিক রহস্যময়তার কথা বলেছেন, এবং বলেছেন যে তাতেই আছে সর্বোচ্চ আনন্দ, ঈশ্বরের সঙ্গে শান্তিময় আলাপনের সময়েও তিনি অধঃপতনের সময় ফিরে আসার ভয়ে আতঙ্কিত । যেহেতু যৌনতা, ঈশ্বর আর আবসাঁথ তাঁর ‘শনিআক্রান্ত নিয়তি’ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি, তাই তাঁকে শেষ পর্যন্ত অন্য আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে, এবং তা হল ঘুম । শেষ দিকের কবিতায় বারে বারে ঘুরেফিরে এসেছে ঘুমের কথা, চিত্রকল্পগুলো ঘুমের, যেন কমনীয় ঘুমপাড়ানি গানের মনোরম ছবি — তা থেকে রঙ, হাসি, তীক্ষ্ণতা, জমকালো, মাত্রাধিক ধ্বনি বাদ দেয়া হয়েছে — কবির ক্ষতবিক্ষত মনকে ঘুমের আরামে শান্তি দিতে পারে । বেশ কিছু কবিতায় এক মাতৃমূর্তিকে পাওয়া যায় দোলনার পাশে কিংবা এক মাতৃমূর্তি লক্ষ রাখেন ঘুমন্ত কবির পাশে দাঁড়িয়ে । যে কবিতায় ঘুমের মোটিফ নেই, তাতেও কবিতার শেষের পঙক্তিগুলোয় এসেছে মুছে যাবার রিক্ততাবোধ ।
              আলোচকরা ভেরলেনকে তাঁর কবিতার শিল্পানুগ ও গভীর অনুভূতির বৈশিষ্ট্যের কারণে ফরাসী প্রতীকবাদের অগ্রদূতদের একজন হিসাবে চিহ্ণিত করলেও, তিনি তাঁর কবিতাকে ডেকাডেন্ট বা প্রতীকবাদের তকমা দিতে অস্বীকার করে বলেছেন যে তিনি নিজেকে একজন ‘ডিজেনারেট’ বা অপজাত কবি বলতে চাইবেন, কেননা তাঁর কবিতায় থাকে অহংকার ও অরাজকতার প্রবণতা ; প্রতীকবাদীদের তুলনায় তিনি প্রচলিত ভাষাকে সঙ্গীতময় করেছেন তাঁর কবিতায়। প্রকৃতপক্ষে ভেরলেনের জীবনের ঘটনাবলী ছেয়ে ফেলেছে তাঁর কবিতার গুণাগুণ ও কাব্যিক প্রতিভা । যেমন তাঁর জীবনে, তেমনই তাঁর কবিতায়, অবিরম লড়াই দেখা যায় তাঁর অন্তরজগতের সঙ্গে তাঁর ইন্দ্রিয়ের, লাম্পট্য ও পশ্চাত্যাপের । তাঁর চরিত্রকে আক্রমণ সত্বেও, ভেরলেনকে মনে করা হয় একজন সুসম্পূর্ণ কবি, যাঁর অসাধারণ প্রতিভা দেখা যায় কবিতার অঘনিভূত মাত্রায়, ইশারামূলক ও লাক্ষণিক ভাষায় এবং প্রতিচ্ছায়াময় বাক্যালঙ্কারে । ফরাসি কবিতাকে ভেরলেনই পরিভাষাগত প্রাবল্যের বাইরে বের করে আনেন এবং ফরাসী ভাষার সহজাত সঙ্গীতময়তাকে ব্যবহার করা আরম্ভ করেন । তিনি বলেছেন কবিতা হওয়া উচিত  সুখশ্রাব্য ও সন্মোহক, অস্পষ্ট ও দ্রবনীয় ; পাঠক কবিতাকে বিভিন্ন থিমে চিহ্ণিত করতে পারবেন, এমন কবিতা লেখা তিনি পছন্দ করেন না  । সেকারণেই তাঁর কবিতার অনুবাদে তাঁকে সম্পূর্ণ পাওয়া যায় না। তাঁর বক্তব্য বোঝাবার জন্য ভেরলেন কবিতার শিল্প (Art Poetique )    শিরোনামে একটি কবিতা লিখেছিলেন ; আমি বাংলায়নের চেষ্টা করেছি :
     সবকিছুর আগে সঙ্গীতময়তা–
    আর এর জন্য আরও অস্বাভাবিকতা–
    অস্পষ্ট ও আরও বেশি বাতাসে মিলিয়ে যাওয়া, 
    তাকে ভার বইতে হয় বা বেঁধে ফেলতে হয় তাকে বাদ দিয়ে দাও
    তাকে এমন হতে হবে যে তুমি খুঁজে বেড়াবে
    তোমার শব্দগুলোয় কোনোরকম গাফিলতি ছাড়াই :
    ধূসর গান ছাড়া প্রিয় আর কিছু নেই
    যেখানে বিচলন ও যথাযথের মিল হয় ।
    আনেকটা কালোজালের আড়ালে সুন্দর চোখের মতন, 
    অনেকটা ছড়িয়ে-পড়া দুপুরের স্পন্দনের মতন,
    অনেকটা ( যখন হেমন্তের আকাশ শোভনীয় করে তোলে )
    সুস্পষ্ট নক্ষত্রদের নীল বিশৃঙ্খলা !
    কেননা আমরা আরও বেশি চাই সূক্ষ্ম তারতম্য–
    রঙ নয়, সূক্ষ্ম তারতম্য ছাড়া কিছু নয় !
    ওহ ! কেবল সূক্ষ্ম তারতম্য নিয়ে আসে
    স্বপ্নকে স্বপ্নের মধ্যে আর বাঁশিকে শিঙায় !
    খুনির ধারালো বক্তব্য থেকে দূরে রাখো,
    নিষ্ঠুর বৈদগ্ধ  আর পঙ্কিল হাসি,
    যা নীল শূন্যতার চোখে অশ্রূজল এনে দ্যায়—
    আর মৃদু আঁচের যাবতীয় রসুনরান্না ।
    বাগ্মীতাকে ধরে তার ঘাড় মুচড়ে দাও !
    তোমার তাতে ভালো হবে, কর্মচঞ্চল মেজাজে,
    যাতে কবিতার মিলকে কিছুটা সুবিচার করা যায় ।
    যদি না লক্ষ রাখা হয়, তাহলে তা কোথায় যাবে ?
    ওহ, কে আমাদের বলতে পারে মিলের ভ্রষ্ট আচরণ ?
    কোন বধির বালক কিংবা উন্মাদ কালো মানুষ
    আমাদের জন্য বানিয়েছে এই এক পয়সার খেলনা,
    যা ফাঁপা শোনায় আর শুনে মনে হয় নকল
    সঙ্গীতকে হয়ে উঠতে দাও, অনেক বেশি করে আর সবসময় !
    তোমার কবিতা হয়ে উঠুক চলমান জিনিস
    যাকে অনুভব করে মনে হবে তা বদলে যাওয়া আত্মা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে,
    অন্য আকাশ থেকে অন্য প্রেমের দিকে ।
    তোমার কবিতাকে আনন্দময় ঘটনা হয়ে উঠতে দাও,
    অস্হির ভোরের বাতাসের মাঝে,
    যা পুদিনা আর থাইমলতার সুগন্ধ নিয়ে উড়ে বেড়ায়…
    আর বাদবাকি সমস্তই সাহিত্য ।
              ফ্রান্সে, রোমান্টিসিজমের পর, তখন রোমান্টিসিজম বলতে যা বোঝাতো, আর পারনাসিয়দের দ্ব্যর্থহীন, ধ্রুপদি, অতিরিক্ত যত্নবান,  চিত্তাকর্ষকভাবে মোহনীয় কবিতার যুগের পর, সমাজ যখন কলকারাখানার আধুনিকতাবাদী সমাজে অনিশ্চিত জীবনযাপনের মুখোমুখি হওয়া আরম্ভ করল, গ্রাম থেকে দলে-দলে পরিবার শহরে অনিশ্চিত জীবনধারায় বসবাস করতে আরম্ভ করল,তখন পল ভেরলেনের মতন কবিরা কবিতায় অনিশ্চয়তার ও অনির্ণেয়তার প্রয়োজন অনুভব করলেন । পল ভেরলেনের ‘আর্ট পোয়েটিক’ কবিতাটি বাস্তব জীবনে অনিশ্চয়তার উপস্হিতিকে কবিতায় আনতে চেয়েছে । তিনি অনুভব করলেন যে মানুষ চায় না  তাকে সীমা দিয়ে বেঁধে রাখা হোক, সে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকতে চায় । নিজের বিবাহিত জীবন এবং পায়ুকামীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও কারাগারের জীবন থেকে তেমনটাই তাঁর মনে হয়ে থাকবে । ১৮৭৪ সালে যখন তিনি বললেন, ‘প্রথম এবং সর্বাগ্রে সঙ্গীত’, তখন ফরাসি কবিতায় নতুন কিছুর কথা বললেন তিনি । ফরাসি কবিতা চিরকালই সঙ্গীতময় ছিল, কিন্তু ভেরলেনের আগে কেউ বলেননি যে সঙ্গীতই কবিতায় মূল ব্যাপার । তার আগে তো ছিলই উপলবব্ধির গভীরতা, দৃষ্টিলব্ধ অবধারণা, বাচনিক নমনীয়তা ও পারিপাট্য । ভেরলেন সঙ্গীতকে কবিতায় গৌরবান্বিত করলেন । কবিতায় সঙ্গীত অদেখা বাস্তবতা সম্পর্কে যথাযথ হবার উপায় বাতলায় এবং যে বাস্তবতা স্পষ্টভাবে প্রভাবান্বিত করে তাকে কবিতার সিংহাসনে বসায় ।
    চার
              পল ভেরলেন আদেনেস থেকে জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে সতেরো বছরের এক কবিযশোপ্রার্থীর চিঠি আর চিঠির সঙ্গে তার লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে মুগ্ধ হলেন,  আর তাকে গাড়িভাড়া পাঠিয়ে বললেন প্যারিসে চলে আসতে । ১৮৭১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শার্লভিল থেকে প্যারিস পৌঁছোলেন র‌্যাঁবো, সঙ্গে নিজের পাণ্ডুলিপি নিয়ে, যার মধ্যে একটি কবিতার শিরোনাম ছিল, ‘দি ড্রাঙ্কেন বোট’ বা ‘মত্ত নৌকো’ । স্টেশনে কেউ ছিল না তাঁকে আপ্যায়ন করার জন্য। ভেরলেন, তাঁর বন্ধু শার্ল গ্রস্ত-এর সঙ্গে গার দু নর্দ আর গার্দ দ্যলেস্ত-এর মাঝে দৌড়ঝাঁপ করছিলেন তরুণ অতিথির জন্য । শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মমার্ততে মাতিলদের বাবা-মায়ের বাড়ি ফেরার পথ ধরলেন ; পল ভেরলেন বিয়ের পর শশুরবাড়িতে থাকতেন । পথে তাঁরা খুঁজে পেলেন রোদে পোড়া গম্ভীর-মুখ, নীল চোখ, তরুণটিকে, যে, তাঁদের সঙ্গে আরদেনেসের বাচনভঙ্গীতে হ্যাঁ-হুঁ করে সংক্ষিপ্ত জবাব দিয়ে কথা বলল ।   
              বারো বছর পরে তাঁর স্মৃতিচারণে ভেরলেন লিখেছেন যে, “তরুণটি ছিল দীর্ঘ, শক্ত কাঠামোর, খেলোয়াড়দের মতো আদরা, নিখুঁত ডিম্বাকার মুখ, যেন নির্বাসন থেকে ফেরা এক দেবদূত ; দেহের শক্ত কাঠামোর ওপরে শিশুসূলভ গালফোলা মুখ, হাবভাবে বয়ঃসন্ধি কাটিয়ে দ্রুত বেড়ে-ওঠা জবুথবুপনা ।” ভেরলেনের স্ত্রী আর শাশুড়ি তরুণটিকে বাড়িতে নিয়ে আসা যে ভালো হয়নি তা স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, কিন্তু তাড়াতে পারলেন না কেননা ভেরলেনের শশুর সেসময়ে বন্ধুদের সঙ্গে শিকারে গিয়েছিলেন । এক দিনেই তাঁরা টের পেলেন যে অতিথিটি চাষাড়ে, বাড়ির বাইরে বেরিয়ে উলঙ্গ হয়ে রোদ পোয়ায়, যে ঘরে থাকতে দেয়া হয়েছিল তাকে করে ফেলেছে নোংরা আর লণ্ডভণ্ড, যিশুর ছোটো ক্রস ভেঙে ফেলেছে, চুলে উকুন । ভেরলেন যা করতে চাইতেন অথচ করার সাহস পেতেন না, অতিথিকে সেসব করতে দেখে পুলক বোধ করছিলেন । 
              অতিথিকে বন্ধুদের আড্ডায় নিয়ে গেলেন ভেরলেন । লিয়ঁ ভালাদে নামে ভেরলেনের এক বন্ধু তাঁর আরেক বন্ধুকে লিখে জানিয়েছিলেন, “তুমি পল ভেরলেনের নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ পেলে না, ভেরলেন যে তরুণটির জন দ্য ব্যাপটিস্ট ; বড়ো-বড়ো হাতের চেটো, বড়ো-বড়ো পা, মুখ যেন তেরো বছরের বাচ্চার, চোখ দুটো নীল, আর তরুণটি ভিতু মনে হলেও, মতামত অসামাজিক মনে হলো, কল্পনাশক্তি অজানা কুকর্মে ঠাশা, বন্ধুরা তো সবাই তাকে দেখে একই সঙ্গে মুগ্ধ আর আতঙ্কিত । তরুণটি যেন ডাক্তারদের মাঝে একজন শয়তান ।” প্রকাশক গঁকুরভাইদের একজন জানিয়েছেন যে ভেরলেনের অতিথির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মনে হচ্ছিল সবচেয়ে বজ্জাত কোনো খুনির হাত । 
              মাতিলদের বাবার ফেরার আগের দিন ভেরলেনের অতিথিকে নিজের বাড়িতে কয়েকদিন রাখলেন শার্ল ক্রস ; তারপর পারনাসিয় কবি থিয়োদোর দ্যবাঁভিলের বাড়িতে চাকরানির ঘরে স্হান পেলেন । প্রথম রাতে জানলা দিয়ে নিজের ভিজে জামা-কাপড় রাস্তায় ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেললেন তরুণটি, চিনামাটির বাসন ভেঙে ফেললেন, বিছানায় কাদামাখা জুতো পরে শুলেন, আর গোপনে কয়েকটা আসবাব বেচে দিলেন । বাঁভিলও এক সপ্তাহ কাটতেই ভেরলেনকে বললেন নিজের অতিথিকে ফেরত নিয়ে যেতে । তরুণটির আচরণে একমাত্র ভেরলেনই আহ্লাদিত হচ্ছিলেন । মাতিলদেকে নিয়ে কবিতাগুলো লেখার পর ভেরলেন নতুন কবিতা লেখার সময় পাননি। তরুণটি তাঁকে ওসকাচ্ছিলেন অনভিজাতের মতো জীবন কাটাতে এবং মদে চুর হয়ে দ্রষ্টার মতো কবিতা লিখতে । তাছাড়া পল ভেরলেন পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর পায়ুকামের আদর্শ সঙ্গী, যাকে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে আরেক বন্ধুর বাড়িতে রক্ষিতার মতন লুকিয়ে রাখতে হচ্ছিল। ভেরলেন তাঁর অভিজাত পোশাক ছেড়ে নামানো-টুপি আর গলায় মাফলার ধরেছিলেন, অতিথির জন্য টাকাকড়ি খরচ করছিলেন প্রচুর । তাঁদের পায়ুকামের সম্পর্ক যখন আর গোপন রইলো না তখন ভেরলেনের বন্ধুরা তাঁর পাশ থেকে সরে যেতে লাগলেন । দুজনে মিলে গুহ্যদ্বার নিয়ে একটা সনেট লিখলেন ( Sonnet du trou cul ), যার প্রথম আট লাইন ভেরলেনের এবং পরের ছয় লাইন র‌্যাঁবোর । কবিতাটা ফরাসি থেকে ইংরেজিতে অনেকে অনুবাদ করেছেন ; আমি পল শ্মিট-এর অনুবাদটা দিলুম এখানে :
    Hidden and wrinkled like a budding violet
    It breathes, gently worn out, in a tangled vine
    (Still damp with love), on the soft incline
    Of white buttocks to the rim of the pit.
    Thin streams like rivers of milk ; innocent
    Tears, shed beneath hot breath that drives them down
    Across small clots of rich soil, reddish brown,
    Where they lose themselves in the dark descent…
    My mouth always dribbles with its coupling force;
    My soul, jealous of the body’s intercourse,
    Makes it tearful, wild necessity.
    Ecstatic olive branch, the flute one blows,
    The tube where heavenly praline flows,
    Promised Land in sticky femininity.
              র‌্যাঁবোকে একই সঙ্গে চরস আর আবসাঁথ খাইয়ে ভেরলেন অতিথিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন নতুন অভিজ্ঞতার সঙ্গে, যার অন্বেষণ করছিলেন তিনি, ‘ইন্দ্রিয়গুলোর অপরিমেয় ও নিয়মানুগ বিশৃঙ্খলা’ ঘটানোর জন্য । ২১ অক্টোবর ১৮৭১ ভেরলেনের ছেলের জন্ম হলো এবং সংবাদটিতে আনন্দিত হবার বদলে ক্রুদ্ধ হলেন তিনি । মাতিলদে জানিয়েছেন যে অক্টোবর ১৮৭১ থেকে জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত ভেরলেন তাঁকে মারধর করতেন আর খুন করার হুমকি দিতেন, একদিন সত্যিই গলা টিপে ধরেছিলেন, হাতখরচ না পেয়ে । স্বামীর দুর্ব্যাবহার আর মা-বাবার কাছে লুকোতে পারলেন না মাতিলদে, কেননা মাতিলদের দেহে আঘাতের চিহ্ণ আর স্বামীর কথা জিগ্যেস করলেই তাঁর কান্না থেকে তাঁরা বুঝে গিয়েছিলেন জাঁ আর্তুর র‌্যাঁবো নামে চাষার ছেলেটা আসার পরে কি ঘটছে মেয়ের শোবার ঘরে । জামাইয়ের পায়ুকামের প্রতি আকর্ষণের খবরও তাঁদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল । ডাক্তার ডেকে মাতিলদেকে পরীক্ষা করিয়ে মেয়ে আর মেয়ের ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন তাঁদের পারিবারিক বাড়ি পেরিজিউতে ।
              স্ত্রী চলে যাবার পর ভেরলেন বিয়েটা বাঁচানোর চেষ্টায় র‌্যাঁবোকে বললেন বাড়ি ফিরে যেতে ; সবকিছু ঠাণ্ডা হয়ে গেলে দুজনে আবার একত্রিত হতে পারবেন । প্যারিসে আসার ছয় মাস পরে মার্চ ১৮৭২ সালে বাড়িমুখো হলেন র‌্যাঁবো ; তিনি জানতেন যে তাঁকে ছাড়া ভেরলেনের চলবে না । মাতিলদে ছেলেকে নিয়ে প্যারিসে ফিরলেন, তাঁর মনে হলো মিটমাট হয়ে গেছে, চাষার ছেলেটা বিদেয় হয়েছে । ভেরলেনও চাকরি খুঁজতে লাগলেন । কিন্তু গোপনে চিঠি লিখতে লাগলেন র‌্যাঁবোকে, জানতে চাইলেন কেমন করে কোথায় দুজনে মিলিত হবেন । পায়ুকামর নেশায় ভেরলেনের কবিতা থেকে মিনার্ভা আর ভিনাস বিদায় নিয়েছিলেন । র‌্যাঁবোর প্রভাবে ভেরলেন তাঁর অন্তরজগতে লুকিয়ে থাকা দানবটাকে বাইরে বের করে আনার সুযোগ পেয়ে গেলেন । ভেরলেনের দানবকে সহ্য করতে না পেরে ১৮৭২ সালে মেয়ের সঙ্গে আইনি বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দিলেন মাতিলদের বাবা, তখনও ডিভোর্স প্রচলিত হয়নি । ১৮৮৪ সালে ডিভোর্স আইনসঙ্গত হলে মাতিলদের সঙ্গে ভেরলেনের ডিভোর্স হয় । মাতিলদে আবার বিয়ে করেছিলেন এবং একষট্টি বছর বয়সে মারা যান ।
            ১৮৭২ সালের সেপ্টেম্বরে ভেরলেন আর র‌্যাঁবো লণ্ডন পৌঁছোলেন ; সেইসময়ে লণ্ডন ও বিশেষ করে সোহো ছিল ফরাসি কমিউনের পলাতক সদস্যদের লুকোবার পক্ষে ভালো জায়গা । কমিউনের প্রতি ভেরলেনের আগ্রহ থাকলেও র‌্যাঁবোর ছিল না । ভেরলেনকে তাঁর বুর্জোয়া মানসিক গঠন থেকে মুক্তি দেবার জন্য র‌্যাঁবো তাঁকে উৎসাহিত করলেন মুসেত এবং লেকঁত দ্যলিজের কবিতা পড়তে, ফরাসি কবিতার বারো মাত্রার ঐতিহ্য এবং ব্যালাডের আট মাত্রা অনুসরণ না করে দশ মাত্রার কবিতা লিখতে । র‌্যাঁবো তাঁকে পরামর্শ দিলেন কবিতা থেকে মানবিক কাহিনি, বাস্তববাদী ছবি আর ভাবপ্রবণ প্রতিকৃতি বাদ দিতে । পল ভেরলেনের মতে র‌্যাঁবোর ভালো লেগেছিল লণ্ডন ; তিনি ভেরলেনকে বলেছিলেন যে লণ্ডনের তুলনায় প্যারিসকে শহরতলি মনে হয়, লণ্ডনে রয়েছে কয়লা-চালিত ফ্যাক্ট্রি, টেমস নদীর ধারে জাহাজের ডক এবং সর্বোপরি একটি সাম্রাজ্যের রমরমা। ভেরলেন সেসমস্ত ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না, তিনি কেবল কচি-তরুণ র‌্যাঁবোর সঙ্গে দৈহিক মিলনেই বেশি আনন্দ পেতেন, লণ্ডনে তাঁদের যথেচ্ছাচারে বাধা দেবার কেউ ছিল না । র‌্যাঁবোর ‘নরকে এক ঋতু’ কবিতার ‘ফুলিশ ভার্জিন’ প্রসঙ্গ ভেরলেন সম্পর্কে । তাঁরা ডেরা নিয়েছিলেন কামডেনের গ্রেট কলেজ স্ট্রিটে ( এখন রয়াল কলেজ স্ট্রিট ); বাড়িটিতে একটা প্লেট লাগানো আছে যে তাঁরা দুজনে সেখানে ছিলেন । নিজেদের ‘উৎকট দম্পতি’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন র‌্যাঁবো । লণ্ডন থেকে প্যারিসে এক বন্ধুকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আমি আর ফরাসি সংবাদপত্র পড়িনা ; পড়ে হবেই বা কি?” তাঁরা দুজনে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রন্হাগারে যেতেন বটে কিন্তু পল ভেরলেন যেতেন শহরের শীত থেকে বাঁচার জন্য, যখন কিনা র‌্যাঁবো  যেতেন বিনে পয়সায় কাগজ-কলম-কালি পাওয়া যেতো বলে। বইপত্র পড়তেন । লণ্ডনের বাইরে বেড়াতে যেতেন দুজনে, ভেরলেন হ্যাম্পস্টেড হিথের কথা লিখেছেন, গ্রামাঞ্চল দেখার জন্য । র‌্যাঁবোকে ছাড়তে না পারার কারণ হিসাবে ভেরলেন লিখেছেন যে, এক ধরণের মিষ্টতা ঝলকাতো ওর নিষ্ঠুর ফিকে-নীল চোখে আর লালচে ঠোঁটের কটু ইশারায় । ইতিমধ্যে র‌্যাঁবো তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মত্ত নৌকো’র আঙ্গিক ছেড়ে নতুন ধরণের গদ্য-কবিতার দিকে ঝুঁকছিলেন, যার পরিচয় পাওয়া যাবে তাঁর ‘নরকে এক ঋতু’ আর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর কবিতাগুলোতে ।
           লণ্ডন তাঁদের দুজনকেই অবাক করেছিল, আহ্লাদিত করেছিল । ভেরলেন বিস্মিত হয়েছিলেন দিগন্ত পর্যন্ত চলে যাওয়া রেলপথ আর লোহার সেতু দেখে, আর পথে-পথে নির্দয়, বারফট্টাই-মারা জনগণকে দেখে । ভেরলেন লিখেছেন লণ্ডন ছিল অতিশালীন, কিন্তু অসচ্চরিত্র হবার সব রকমের সুযোগ ছিল অবারিত, আর প্রচুর খরচ সত্বেও, তাঁরা সদাসর্বদা থাকতেন এইল, জিন আর আবসাঁথে মাতাল । আবসাঁথের সবুজ পরী র‌্যাঁবোকে ডাক দিয়েছিল ‘স্বরবর্ণ’ নামের কবিতাটি লিখতে ।
    স্বরবর্ণ
    A কালো, E শাদা, I লাল,  U সবুজ, O নীল : স্বরবর্ণ
    কোনো দিন আমি তোমার জন্মাবার কান্না নিয়ে কথা বলবো,
    A, মাছিদের উজ্বল কালো মখমল জ্যাকেট
    যারা নিষ্ঠুর দুর্গন্ধের চারিধারে ভন ভন করে,
    ছায়ার গভীর খাত : E, কুয়াশার, তাঁবুগুলোর অকপটতা,
    গর্বিত হিমবাহের, শ্বেত রাজাদের বর্শা, সুগন্ধলতার শিহরণ :
    I, ময়ূরপঙ্খীবর্ণ, রক্তাক্ত লালা, নিঃসঙ্গের হাসি
    যার ঠোঁটে ক্রোধ কিংবা অনুশোচনায় মাতাল :
    U, তরঙ্গ, ভাইরিডিয়ান সমুদ্রের দিব্য কম্পন,
    চারণভূমির শান্তি, গবাদিপশুতে ভরা, হলরেখার শান্তি  
    কিমিতির চওড়া পড়ুয়া ভ্রুজোড়া দিয়ে বিরচিত :
    O, চরম তূর্যনিনাদ, অদ্ভুত কর্কশ আওয়াজে ভরপুর,
    জগত আর দেবদূতে রেখিত নৈঃশব্দ :
    O, সমাপ্তি, মেয়েটির চোখের বেগুনি রশ্মি !
            র‌্যাঁবো খ্রিসমাসের জন্য বাড়ি ফিরলেও ভেরলেন ফিরতেন না ;র‌্যাঁবোর সমস্যা ছিল মা সবসময় বলতেন একটা চাকরি খুঁজে জীবনে স্হির হতে । ভেরলেন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন সংসারের বাঁধন থেকে, দায়িত্ব থেকে, এবং পাপবোধে ভুগে কাঁদতেন মাঝেমধ্যে ; তাঁর কাছে র‌্যাঁবো ছিলেন ‘দীপ্তিময় পাপ’ আর র‌্যাঁবোর কাছে ভেরলেন ছিল ‘ক্ষুদে প্রিয়তমা’ । ইংরেজি শব্দের তালিকা তৈরি করেছিলেন এবং লণ্ডনে চাকরি খুঁজতে আরম্ভ করেছিলেন ভেরলেন। ফ্রান্সের গোয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে পল ভেরলেনের ওপর লক্ষ রাখা হচ্ছিল। তাঁর ভবিষ্যতের জীবনীকার এদমন্দ লেপেলেতিয়েকে ভেরলেন লিখেছিলেন যে, “আশা করছি কয়েক দিনের মধ্যেই একটা বড়ো সংস্হায় চাকরি পাবো, যেখানে প্রচুর রোজগার করা যাবে, ইতিমধ্যে আমি কয়েকটা আমেরিকান সংবাদপত্রের জন্য কাজ করছি যারা ভালো পয়সাকড়ি দ্যায় ।” লেপেলেতিয়ে তার কোনো প্রমাণ পাননি, এবং সবই ভেরলেনের বানানো, ফরাসি কবিদের ঈর্শ্বান্বিত করার জন্য । দুজন ভবঘুরে লণ্ডনের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন কাজের জন্য কিন্তু কারোর সাড়া তাঁরা পাননি । লেপেলেতিয়ে একটা কাগজের বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পেরেছিলেন, সম্ভবত র‌্যাঁবোর তৈরি খসড়া :
    এক ফরাসি ভদ্রলোক ( ২৫ ), অভিজাত সমাজে যাঁর ভালো যোগাযোগ আছে, উচ্চশিক্ষিত, ফরাসি ডিপ্লোমাধারী, ইংরেজিতে সড়গড়, এবং বিপুল সাধারণ জ্ঞানের মানুষ, ব্যক্তিগত সচিব, পর্যটনের সঙ্গী কিংবা গৃহশিক্ষকের চাকরি খুঁজছেন । সম্ভ্রান্তদের সুপারিশ আছে । ঠিকানা : ২৫ ল্যানঘাম স্ট্রিট ।
              র‌্যাঁবোর ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর ‘ভবঘুরে’ কবিতাটি ( ১৮ নং ইল্যুমিনেশান ) তাঁদের দুজনের সেই সময়টিকে ধরে রেখেছে :
    সমব্যথী ভাই ! ওর কাছে আমার কোনও নৃশংস নিশিপালন আছে ! ‘আমি এই ঝুঁকিপূর্ণ কর্মপ্রচেষ্টাকে দখল করে নিতে বিফল হয়েছিলুম । আমি ওর অকর্মণ্যতা নিয়ে ঠাট্টা করেছিলুম । যদি আমাদের নির্বাসনে যেতে হয়, কেনা-গোলমী করতে হয়, তা হবে আমার দোষ।’ অদ্ভুত দুর্ভাগ্য আর বোকামির জন্য ও আমার প্রশংসা করেছিল, আর তার সঙ্গে জুড়েছিল অশান্তিকর কারণ ।
    এই শয়তান পণ্ডিতকে আমি বিদ্রুপ করে উত্তর দিয়েছি, আর জানালার কাছে গিয়ে তা শেষ করেছি । বিরল সঙ্গীতরেখার চালচলনের অপর পারের চারণভূমিতে আমি ভবিষ্যতের রাতের বিলাসের মায়াপুরুষ গড়েছি ।
    এই অস্পষ্ট স্বাস্হবিধিসন্মত চিত্তবিক্ষেপের পর, আমি খড়ের মাদুরের ওপরে হাতপা ছড়িয়ে শুয়ে পড়তুম । এবং, বলতে গেলে প্রতি রাতে, যেই আমি ঘুমিয়ে পড়তুম, বেচারা ভাইটি উঠে পড়তো, মুখে দুর্গন্ধ, চোখে দেখতে পাচ্ছে না — যেমন ও নিজের সম্পর্কে স্বপ্ন দেখতো — আর নিজের নির্বোধ কান্নার স্বপ্নে বিভোর আমাকে ঘরের ভেতরে টানাটানি করতো !
    বাস্তবিক, সত্যি বলতে কি, আমি ওকে ওর সূর্যসন্তানের প্রাগৈতিহাসিক স্হতিতে ফিরিয়ে আনার প্রতিজ্ঞা করেছিলুম — আর আমরা ঘুরে বেড়ালুম, গুহার মদে ভরণপোষণ করে, আর পথের বিসকিট খেয়ে, আমি পরিসর আর ফরমুলা খুঁজে পাবার জন্যে অধৈর্য ।
              তাঁদের দুজনের ঝগড়া গ্রেট কলেজ স্ট্রিটেই আরম্ভ হয়েছিল । তাঁদের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছিল । র‌্যাঁবো মাঝে একদিন ছুরি দিয়ে ভেরলেনের উরুতে আঘাত করেছিলেন । প্রেমিকের আঘাতের আদর বলে মেনে নিয়ে কাউকে জানাননি ভেরলেন । এই বিষয়ে ভেরলেন লিখেছেন, “আমি বাড়ি ফেরার সময়ে দেখলুম জানলা দিয়ে র‌্যাঁবো আমায় দেখছে । অকারেণেও আমাকে দেখে অপমানজনক ঠাট্টা-ইয়ার্কি করতে লাগলো। যাহোক আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠলুম আর ঘরে ঢুকলুম । ‘তোমার কি কোনো ধারণা আছে এক হাতে একবোতল তেল আর অন্য হাতে একটা মাছ ঝুলিয়ে কেমন দেখাচ্ছিল তোমায় ?’ বলল র‌্যাঁবো । আমি তার জবাবে বললুম, আমি তোমাকে জোর দিয়ে বলতে পারি, আমাকে মোটেই উপহাসাস্পদ দেখায়নি ।’  ভেরলেন মাছটা দিয়ে র‌্যাঁবোর  মুখে সপাটে মারলেন আর জানালেন যে তিনি আত্মহত্যা করে নেবেন । ভেরলেন চটে গিয়ে জাহাজ ধরে সোজা চলে গেলেন বেলজিয়াম, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগাবার উদ্দেশে । সেখানে মাতিলদে ছিলেন ।  
             র‌্যাঁবো কিছুক্ষণ পরেই ডকে পৌঁছে টের পেলেন যে ভেরলেন, তাঁর ‘বুড়ি শূকরী’ , সত্যিই চলে গেছেন । নিষ্কপর্দক র‌্যাঁবোকে সাহায্য করার কেউ ছিল না, আর যারা ছিল তারা দুজনের দৈহিক সম্পর্ক জানতে পেরে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছিল ।  র‌্যাঁবো ভেরলেনকে চিঠি দিলেন :
    তুমি কি মনে করো যে আমার বদলে অন্য লোকেদের সঙ্গে থাকলে তুমি আনন্দে থাকবে ? ভেবে দ্যাখো ! নিশ্চয়ই না ! আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে ভবিষ্যতে আমি তোমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করব । আমি তোমাকে অত্যন্ত ভালোবাসি, আর তুমি যদি ফিরতে না চাও, কিংবা আমি তোমার কাছে যাই তা না চাও, তুমি একটা অপরাধ করছ, আর তার জন্য তুমি সমস্ত স্বাধীনতা হারিয়ে বহুকাল আফশোষ করবে, আর এতো ভয়ঙ্কর দুঃখদুর্দশায় ভুগবে যার অভিজ্ঞতা তোমার কখনও হয়নি ।
              ১৮৭৩ সালের ৮ জুলাই র‌্যাঁবোকে টেলিগ্রাম করলেন ভেরলেন ব্রুসেলসের হোটেল লিজে পৌঁছোতে । ভেরলেনের জামাকাপড় বেচে র‌্যাঁবো পৌঁছোলেন বেলজিয়ামের হোটেলে যেখানে ভেরলেন ছিলেন । দুজনের মনের মিল হল না, টানা কথা কাটাকাটি চলল । ভেরলেন একের পর এক আবসাঁথের বোতল খালি করে মাতাল হয়ে থাকতে চাইলেন । ১০ জুলাই তিনি একটা রিভলভার আর গুলি কিনলেন, আত্মহত্যা করবেন ভেবে । চারটে নাগাদ মাতাল অবস্হায় দুটো গুলি চালালেন র‌্যাঁবোকে লক্ষ করে । একটা গুলি লক্ষভ্রষ্ট হল, অন্যটা লাগল র‌্যাঁবোর কনুইতে । আঘাতকে বিশেষ গুরুত্ব না দিয়ে সঁ-জাঁ হাসপাতালে ড্রেসিং করিয়ে ব্রুসেলস ছাড়ার কথা ভাবলেন র‌্যাঁবো । সন্ধ্যা আটটা নাগাদ র‌্যাঁবোকে গারে দু মিদি রেলস্টেশনে ছেড়ে দেবার জন্য ভেরলেন আর ভেরলেনের মা গেলেন । আদালতে র‌্যাঁবোর সাক্ষ্য অনুযায়ী ভেরলেন পাগলের মতো আচরণ করছিলেন আর তাঁর পকেটে পিস্তলও ছিল । র‌্যাঁবো পুলিশের একজন টহলদারকে দেখতে পেয়ে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে বললেন তাঁকে ভেরলেনের থেকে বাঁচাতে । ভেরলেন গ্রেপ্তার হলেন, তাঁর বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ উঠল, আদালতে তাঁদের দুজনের সম্পর্ক নিয়ে উকিল আর ডাক্তারদের প্রশ্নের মুখে পড়লেন ভেরলেন । 
              ১৭ জুলাই র‌্যাঁবোর বুলেট বের করার পর তিনি নালিশ তুলে নিলেন । পুলিশকে দেয়া বয়ানে র‌্যাঁবো লিখেছিলেন যে, গুলি চালিয়েই ভেরলেন তাঁর অপরাধের জন্য তক্ষুনি ক্ষমা চেয়ে নিলেন । পিস্তলটা আমার হাতে দিয়ে বললেন তাঁর কপাল লক্ষ করে গুলি চালাতে। তাঁর আচরণ ছিল গভীর অনুতাপের । ভেরলেনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টার অভিযোগ তুলে নিয়ে কেবল আঘাত করার অভিযোগ বজায় রইলো । তাঁদের পরস্পরের পায়ুকাম নিয়ে আদালতে অপমানজনক কথাবার্তা হলেও তাকে অপরাধ বলে মনে করা হয়নি এবং পুলিশ আরোপ করেনি । ৮ই আগস্ট ১৮৭৩ ভেরলেনের দুই বছরের কারাদণ্ডের আদেশ হল ।
              র‌্যাঁবো শার্লভিল ফিরে গিয়ে ‘নরকে এক ঋতু’ লেখা শেষ করলেন । তাতে ভেরলেনকে তিনি ‘উন্মাদিনী ভার্জিন’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন, আর নিজেকে ‘নারকীয় স্বামী’ হিসাবে আর তাঁদের একসঙ্গে বসবাসকে বলেছেন ‘গার্হস্হ প্রহসন’। ১৮৭৪ সালে র‌্যাঁবো ফিরেছিলেন লণ্ডনে, কবি জারমেইন নোভোর সঙ্গে, তিন মাস ছিলেন একসঙ্গে । এই সময়ে তিনি ‘ইল্যুমিনেশান্স’-এর গদ্য-কবিতাগুলো লেখা শেষ করেন । কিন্তু পায়ুকামের নায়ক-নায়িকা বা আদম-ইভের কাহিনি এখানেই ফুরোয়নি । জেল থেকে র‌্যাঁবোকে চিঠি লিখতেন আর নিজের নতুন লেখা কবিতা পাঠাতেন, যেগুলো পড়ে র‌্যাঁবো মোটেই উৎসাহিত হতেন না । র‌্যাঁবো তখন কবিতা ও সাহিত্যজগত সম্পর্কে উদাসীন এবং নতুন জীবনের সন্ধান করেছেন, বাবার মতো উধাও হয়ে যেতে চাইছেন । পরস্পরের দৈহিক ভালোবাসার বদলে যিশুখ্রিস্টকে ভালোবাসার কথা বলছেন তখন ভেরলেন । র‌্যাঁবো ঠাট্টা করে তাঁকে লিখলেন যে ‘লয়োলা’ স্টুটগার্টে এলে দেখা হবে । লয়োলা ছিলেন এক যিশুভক্ত পাদ্রি ।
            পরস্পরের সাক্ষাতের সেই মুহূর্তটা এলো এবং কমেডি ছাপিয়ে গেল ট্যাজেডিকে । ভেরলেন গোঁ ধরলেন র‌্যাঁবোকে দীক্ষিত করার জন্য, একটা শুঁড়িখানায় দুজনে একত্রিত হয়ে । ভেরলেন আর র‌্যাঁবো দুজনেই মাত্রাহীন মদ টেনে মাতাল হলেন এবং আবার কথা কাটাকাটি আরম্ভ হল । শুঁড়িখানা থেকে বেরিয়ে দুই বিখ্যাত কবির মধ্যে হাতাহাতি মারামারি আরম্ভ হল। র‌্যাঁবোর সঙ্গে পেরে ওঠা অসম্ভব ছিল ভেরলেনের পক্ষে । মার খেয়ে মাতাল ভেরলেন, রক্তাক্ত, পড়ে রইলেন পথের ধারে ।
               সাত এম-এম ছয়গুলির পিস্তলটা ক্রিস্টির নিলামে  কেউ ষাট হাজার ডলারে সম্প্রতি কিনে নিয়েছেন ; তার আগে পিস্তলটা ছয়বার নিলাম হয়েছিল । মায়ের দেয়া টাকায় ‘নরকে এক ঋতু’ ছাপিয়ে, মাকে এক কপি দিয়ে, কবিতার প্রতি র‌্যাঁবোর আকর্ষণ শেষ হয়ে গিয়েছিল ; ইল্যুমিনেশান্স’ আর ছাপাবার প্রয়োজন বোধ করেননি, যা করার কোরো বলে পাণ্ডুলিপি ভেরলেনকে দিয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন আফ্রিকায়, ভিন্ন জীবনের সন্ধানে । ভেরলেন কবিতাগুলো মে-জুন ১৮৮৬-এ  ‘প্যারিস লিটেরারি রিভিউতে’ প্রথমে প্রকাশ করার জন্য দেন । তারপর গ্রন্হাকারে প্রকাশের ব্যবস্হা করেন ১৮৮৬ সালের অক্টোবরে । 
    ————————————————————-XXXXXXXXXXX————————
  • সোনালী মিত্র | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৩৮512512
  • সোনালী মিত্র’র যোনিজ কবিতা : মলয় রায়চৌধুরী
    একদিন সোনালী মিত্রের একটা কবিতা হঠাৎই নজরে পড়েছিল ; পড়ে মনে হয়েছিল আমাকে আক্রমণ করে লেখা, কিন্তু না, কবিতার শেষের দিকে গিয়ে মনে হয়েছিল ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক’ ছুতার কবিতার শুভা চরিত্রটিতে প্রতিস্হাপনের গোপনেচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে । কেবল তা কিন্তু নয় ; তাঁর কাজটি একজন নারীর যৌনতাবোধকে সেনসর করার বিরুদ্ধে স্বাবলম্বী ক্ষমতা হিসাবে উপস্হাপিত ; সোনালী মিত্র কবিতাটির মাধ্যমে তাঁর নিজের দেহের কর্তৃত্ব দাবি করছেন, নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, নিজের জ্যোতির্ময়তা, যা পুরুষদের আকর্ষণ করে । বস্তুত শুভার স্হান দখলের ইচ্ছা বহু তরুণীই ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু সেগুলো সোনালী মিত্রের থেকে ভিন্ন । 
    সোনালী মিত্রের কবিতাটা এই রকম:
    হাংরি
    আরো একবার যদি প্রবল বর্ষায় ভেসে যায় দ্বীপ
    আরো একবার যদি প্রচণ্ড বিদ্যুৎএ কেঁপে ওঠে বুক
    তোমার মধ্যসত্তরের বায়োস্কোপ পিছিয়ে গেছে পাঁচটি দশক
    বলিরেখা মুছে গেছে , চুলের রঙ অভুক্তনিগ্রো
    সটান শরীরে সভ্যদেশে লিখছ- "ছোটলোকের কবিতা"
    মনোহর আইচ চেহারায় শুভাকে নিচ্ছ তোমার হাংরি বুকে
    শুভা তীব্রতম হচ্ছে , ঐ -তো শুভাকে নিয়ে লড়াই করছে
    ক'টি কালো পোশাকের আইন
    কালো পোশাক ঠিক করে দিচ্ছেন , কবি অশ্লীল , কবি ইতর
    কখন , কীভাবে অজান্তে যদি শুভা হয়ে উঠি এই একুশ শতকে
    ছিনিয়ে নিই শুভার রাজমুকুট ? যদি বলিঃ-
    কবি , নারীর গ্রীবার ওপরে মাথা , মাথায় দু'টো চোখ
    কঙ্কালযোনি একটা কবিতায় এগিয়ে যেতে পারে
    আত্মাপুড়িয়ে 'যোনিকেশরে' মন্থিত হতে পারে অমৃতযোগ
    কবি, পাঁচ দশক আগে আমি জান্মালে ? পাঁচদশক আগে
    আমাকে পুড়িয়ে দিতে - দিতে একবার ও ভাবতে না
    নারী দুষ্প্রাপ্য সোনালীসেডনা ?
    নদীর বুক ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে , ক্রমশ নৌকা ছোট
    পূর্নাঙ্গ জীবন মিলিয়ে যেতে যেতে সূর্য দেখছে সামনে অন্ধকার
    পথ অন্ধকার , অন্ধকারে একটা হাতই যথেষ্ট , কবি
    একটা হাতই যথেষ্ট, হাত ধরে অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়ার আগে
    কবিতাটি পড়ার পর ওনার কবিতাগুলো, অনুসরণ বলব না, বস্তুত ওনাকে স্টকিং করা আরম্ভ করলুম, যেভাবে একজন সুন্দরী যুবতীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তার পেছন-পেছন উন্মাদের মতন ছায়া হয়ে বেড়ায় একজন পুরুষ । পড়তে-পড়তে মনে হলো, এনার কবিতা যেভাবে গড়ে উঠছে, একে তো সমসাময়িক মহিলা কবিদের, বিশেষ করে মল্লিকা সেনগুপ্তের ফেমিনিস্ট কবিতা, কৃষ্ণা বসুর পিতৃতন্ত্রবিরোধী কবিতা, যশোধরা রায়চৌধুরীর সংসার ও গার্হস্হজীবনের কবিতা, বলা যাবে না । 
    সোনালী মিত্রের কবিতার লিরিকাল কন্ঠস্বর এবং সেই লিরিসিজমের ভেতরে বুনে দেয়া ইরটিক ন্যারেটিভ একেবারে অন্যরকম । আমি তাঁর কবিতাকে তাই বলেছি ‘যোনিজ কবিতা’ । দেহে যোনি থাকার দরুন একটি মেয়ের কৈশোর থেকে অস্তিত্বে যে বহুবিধ অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হতে থাকে তাদের প্রকাশ করার একটি পথ তিনি কবিতার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন । পথটা দ্রোহের, র‌্যাডিকাল, সমসাময়িক কবিতার প্রতিষ্ঠানের বা নির্ধারিত ক্যাননের বিরুদ্ধে দ্রোহ । সোনালী মিত্র বেপরোয়া, তাঁর চেতনা যোনিজ ।
    শুভাকে কেন্দ্র করে সোনালী মিত্রের আরেকটি যোনিজ আক্রমণ :
    বিস্ফোরণ ও শুভা
    ক্রমশ উর্দ্ধ সত্তরের প্রেমে ডুবে যাচ্ছে বসন্তবর্ষীয় আয়ু,
    সারসার দিয়ে রক্তকীট ...বাস্তুতন্ত্রের বিষাক্তফণা ধেয়ে গেল
    গঠনপোক্ত মধ্যে তিরিশের দিকে , তাদেরও
    হারিয়ে দিতে পারে বুকে লাটখেয়ে যাওয়া
    তোমার সাদা চুলের ঘোড়া । 
    ছুটছে,ছুটছে ছত্রপতি শিবাজি চত্বর পেরিয়ে মহানভারত দরজায়
    উড়িয়ে দিচ্ছে সবুজ পতাকার স্নেহ।
    পতাকার দন্ডে আত্মমৈথুনরত সাহিত্যচেতনা।
    থ্রিজি নেটওয়ার্কেও কেন গিলে নিতে পারছি না সমগ্র তুমিকে !
    পিচ্ছিলজাত পরমান্নে ফসকে যাওয়ার খেলা।
    উফ ! আর পারছি না কেন ! জ্বলে যাচ্ছে সৃষ্টিশীল তুরুপ?
    কেন ডুবে যাচ্ছি তোমার মধ্যে ?
    তোমার থেকে তোমার আগুন জ্বলানো বীর্যক্ষয়ী শব্দের শরীরে ?
    সেখানে আউসের শীষে সোনালী শিল্পের ক্ষণজন্ম 
    তেমন ভাবে জরুরী কি ?
    সেখানে আমাদের মত সহস্র তামাটে চামড়ার ছড়াছড়ি
    যারা চিচিং ফাঁক মেলে ধরে সিঁধিয়ে নিয়েছিল ছয় ফুট
    আট ইঞ্চির আত্মঘাতী ধাতব সমীকরণ ...
    দশেরার রাবণ মারতে মারতে আমিও পুরুষ বিরোধী
    হয়ে উঠছি সময় ?
    আমিও সেঁটে নিচ্ছি তকমা ! নারীবাদী হলে
    কতটুকু লাভ চেটেপুটে নেওয়া যায় ক্যালকুলেশনে বইয়ে দিচ্ছি
    ফেসিয়ালে লোমতোলা মোম ত্বক !
    আমার শিরায়-প্রতিশিরায় একশ ছিনেজোঁক বাসা
    বাঁধবে বলে নি,
    আমার জঙ্ঘার মধ্যবিত্ত গুহায় ঘোলা রসে তোমার নাম নিয়ে
    প্যান্টি ভিজিয়ে যাবে এমনও ঘটে নি প্রিয় পুরুষ।
    তবুও তোমার প্রেমে পড়া যায় !
    গত এককুড়ি রমনীর মত
    বুকের ওড়না সরিয়ে বলতেই পারি আমিই বা কম কিসে !
    যারা তোমার শীতঘুম ভাঙনের অহরহ নায়িকা, চোখ তুলে
    দেখ নব্বই মিলিয়ন উষ্ণতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি শূন্যদশকের
    খাতা জুড়ে। একশ শ্বাপদ হামলে পড়েছে নারীর
    রসালো খাদ্যের দিকে। সন্ধ্যারতি থেকে ভোরের নামাজ
    তক ছুঁড়ে দিচ্ছে মুঠোমুঠো উপঢৌকন উপাচারে ।
    আমি ওদের পাত্তা দিই না...
    তোমার কথা ভেবে,বালিসে চুমু খেতে খেতে এটা তো জানি
    কাগজের গায়ে উষ্ণতা দিতে সক্ষম বলেই আমার আগে ও পিছের
    রাধাবিন্দুর একচ্ছত্র সম্রাট তুমি ।
    অগ্রজ 'শুভা' মহলক্ষ্মী হলে তুমি শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মে 
    তেভাগার নারায়ণ,
    রূপের পরে কয়েকটা শূন্য বসালেই জলন্ত সূর্যের তাপ ক্রমশ হ্রাস।
    তখন কাকে আগ্রাধিকার দিয়ে বলবে প্রিয়
    তোর শ্রীমুখ ঐশ্বর্যের উপর অন্নপূর্ণা !
    ঐশ্বর্যের উপর নিটোল ফিগার এঞ্জেলিনা তথাস্ত ঠোঁটের আগমন !
    না মশাই কেবল রূপের মহিমা নই...
    সন্ন্যাসী এবং শরীরখোড় ঈশ্বর এলেও তরতর করে
    লিখে যেতে পারি বিশ্বাসঘাতিনী শব্দ ।
    তোমার মত একচাদরের নীচে নারী ও শিল্পকে সঙ্গমরত করে
    বলতে পারি নারী ও শিল্পের মত বিশ্বাসঘাতিনী আর কিছু নেই। 
    প্রেমিকার চোখের দিকে চোখ রেখে জেগে ওঠা পুরুষাঙ্গের মত
    অস্থির কলমের দিব্যি - ঘাড়ের নীচে কামড়ে ধরে থাকা ক্ষুধার্ত 
    বাঘিনীরদল
    তোমার শিরদাঁড়া ভাঙা জন্তুটাকেও নাড়িয়ে চাড়িয়ে
    তারাও বলতে পারে-
    যৌবন থেকে শিল্প পযর্ন্ত গল্পকে টেনে নিয়ে যাওয়াও একটা আর্ট,
    যৌনতা থেকে কবিতা পর্যন্ত সৃষ্টিকে সফলতা দেওয়াও একটা আর্ট ।
    শুধু সেখানেই তুমি-আমি কি সফল! 'ওরা' বলে, 
    নষ্ট শব্দের কচকচি ঘাঁটার চেয়ে 
    তোমার আর্থ্রাইটিস ভোগা অঙুল ঢের বেশি ভাল।
    যাদের জড়িয়ে বলতে পারি, 
    যে শিশুদের জন্ম দিয়ে গেল বাতক্ষয়িত আঙুল 
    তারা তোমার বীর্যের চেয়েও দামী ।
    শ্লেষ্মা কষ্টে হৃৎপিন্ডে জাগা বুকে শেষ বারের মত ভরে নাও
    বিশুদ্ধ অক্সিজেন আর একবার তোমার নীচে
    আরাম গ্রহণকারিনী নারীটিকে ভেবে ছড়িয়ে দাও বীর্য
    ৩০০০০০০ শিশু উড়ে যাক গ্রিক মিথোলজির দিকে
    সাবর্ণ লাম্পট্য আমপ্লিফিয়ার ছিঁড়েখুঁড়ে
    নারীর পরম মমতার দিকে বেঁচে থাক মাইলের পর মাইল
    নায়িকা ও পুরুষের পুনমিলনের পরে সৃষ্টি ইতিহাস।
    তাঁর কবিতাগুলোর জন্য সোনালী মিত্র নিজস্ব এক আঙ্গিক গড়ে নিয়েছেন । সনাতন ভারতীয় ভাবনাকে যদি আশ্রয় করি তাহলে আঙ্গিকমুক্তিকে বলতে হয় ‘নির্গুণ’, আর আঙ্গিকবদ্ধতাকে বলতে হয় ‘সগুণ’ । সোনালী মিত্র দেবী-দেবতায় বিশ্বাসী, তাঁর পুজোর ঘরে আছেন তাঁর প্রতিষ্ঠিত দেবীমূর্তি, অর্থাৎ তিনি ঘোরতর আস্তিক । হিন্দুদের ধর্মচিন্তায় ‘নির্গুণ’ হলো যৌনতাহীন, বিবাহহীন ও সন্তানোৎপাদনের অনুপযুক্ত । ‘সগুণ’ হলে তা স্বয়ম্ভূ অথবা যোনিজ । গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে তাঁর দেহে দুটি গর্ভপথ আছে, একটি যোনি এবং অপরটি আত্মা ; এই বক্তব্যটি একটি টেনশনের ভারসাম্য । এই একই টেনশনের ভারসাম্য গড়ে তোলার প্রয়াস করেন সোনালী মিত্র । সুতরাং ‘নির্গুণ’ বড়ো না ‘সগুণ’ বড়ো এরকম তর্ক তোলা যায় না তাঁর কবিতার ক্ষেত্রে । ভারতীয় মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারতে’ আমরা এই টেনশনের ভারসাম্য প্রত্যক্ষ করি । ‘মহাভারতকে’ যেমন যৌনতাহীন কল্পনা করা অসম্ভব, তেমনই সোনালী মিত্রের এই গ্রন্হের কবিতাগুলো। নারীকে সোনালী মিত্র পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে উপস্হাপনের পরিবর্তে, যা ফেমিনিস্টরা সচরাচর করে থাকেন, তিনি কাছে টেনে নিয়ে মৈত্রীবন্ধনে আটক করতে চেয়েছেন । 
    যৌনতাকে যাঁরা কবিতায় আনতে কুন্ঠিত বোধ করেন, তাঁদের আদি শঙ্করাচার্য সম্পর্কে প্রচলিত গল্পটা মনে করিয়ে দিই। শঙ্করাচার্য ছিলেন চিরকুমার । মণ্ডণ মিশ্রের স্ত্রী উভয় ভারতী তাঁর সঙ্গে তর্কে শঙ্করাচার্যকে বলেন যে তাঁর জ্ঞান খণ্ডিত, কেননা যৌনতার আনন্দ সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারণা নেই । শঙ্করাচার্য তাই কাশ্মীরের মৃত মহারাজা অমরুর দেহে প্রবেশ করেন এবং মহারাজাকে জীবিত করে তুলে যৌনতার আনন্দ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে বাধ্য হন । 
    কবি সোনালী মিত্র জানেন যে নারীর অনুভূতি ও সংবেদনকে অপব্যবহার করা হয়, বিকৃত করা হয় । তাই তিনি ইরটিসিজমকে নারীর ক্ষমতায়ন হিসাবে প্রয়োগ করেছেন তাঁর কবিতায়, যা বাংলা কবিতায় প্রান্তিক ক্যাননের স্হানও পায়নি এতোকাল । নারীর দৃষ্টিপ্রতিভা দিয়ে দেখেছেন প্রেম এবং সৃষ্টিকে, যে নারী একজন ব্রতী, সৎ ও দুঃসাহসী । 
    পাঠক, কবি সোনালী মিত্রের সুস্পষ্ট ইরটিক কন্ঠস্বরের গভীরে যে চোটজখম রয়েছে, যে সুরক্ষাহীনতার বোধ রয়েছে, তার অন্তস্হ আত্মিক, মানসিক ও দৈহিক পীড়ার সঙ্গে পরিচিত হন । তাঁর আত্মসন্দেহ ও আত্মআবিষ্কারের অভিজ্ঞতার অংশভাক হয়ে ওঠেন ।
    নাইটফল অথবা সমুদ্রযাত্রা 
    তখন রাতগুলো পরী ভালবাসায় ভরপুর 
    হরিদার চায়ের দোকানে সন্ধ্যায় ফেলে আশা
    মিঠু বউদি আর ঝিলিক সেনের ঝিকিরমিকির দুই চাঁদ
    রাতে নাড়িয়ে দিলে গো । ঘুম , ঘুম আসে না
    অস্থির , বুকের ভিতরের হ্যাংলা কুকুরটা বনেদী নয়
    ঠিক , ঠিক যেন ভাদ্রের মত অবস্থানে
    আর কুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল মিঠু না ঝিলিক সেনের বুকে
    বুঝলাম না ...... 
    আর নাভি খাচ্ছে , আর কোমর ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে দাঁতে 
    দরদর ঘামে ভিজে উঠছে গা 
    থামবে না , এ-খাওয়া থামবে না 
    সমস্ত বেডকভার ড্রেনডাইট চটচটে , আহা মায়াবী আঠা 
    ক্রমশ কুকুরের গা মোচড়ানো শিথিল হয়ে ওঠে 
    ঘুম , ঘুম , ঘুম 
    সকালে ভুলে যায় আস্ত একটা কুকুর নিয়ে আমার রাতের সংসার 
    কেননা তখন আমাদের রাত্রির বুক অবিবাহিতকলা 
    কেননা তখন পায়জামার অন্ধকারে হাজার ওয়াট 
    তখন আমাদের নিজস্ব রাতের নাম ছিল - 
    'নাইটফল মেমরি'।
    উল্লেখ্য যে সোনালী মিত্র দিল্লির মতো একটি বদনাম কসমোপলিসে চাকরি করেন, সেই শহরের বেয়াড়া ভিড় ও জাঠ খাপসংস্কৃতিতে প্রতিপালিত এঁড়ে পুরুষদের জমঘটের প্রতিদিনই মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে । ছেলের পড়াশুনার খেয়াল রাখতে হয় । সংসার সামলাতে হয় । এই কাজগুলোর পাশাপাশি তিনি কবিতা লিখে চলেছেন। কলকাতার মতো সাহিত্যিকদের সঙ্গে প্রতিদিনকার মেলামেশা, তর্ক, আলোচনা, নিয়মিত কবিতাপাঠ ও আড্ডার সুযোগ নেই সেখানে । পশ্চিমবাংলার কবিতা পত্রিকাগুলোও পৌঁছোয় না, যাতে তিনি সমসাময়িক কবিতার ট্রেণ্ড টের পেতে পারেন । তা সত্বেও তিনি নিজস্ব একটি ধারা গড়ে তুলতে পেরেছেন । কীভাবে তিনি নারীযৌনতার বিস্তার ঘটিয়েছেন তা চ্যালেঞ্জের মতো ছুঁড়ে-দেয়া, অরিণ দেবকে উদ্দেশ্য করে রচিত এই কবিতাটিতে স্পষ্ট, কোনো রাখঢাক নেই । কবিতার লাইনগুলো তাঁর প্ল্যাসেন্টার আহ্লাদযন্ত্রণাকে বয়ে নিয়ে যায় ।
    অশ্লীল কবিতা
    (অরিণ নামটি এখানে আধার মাত্র,ওই নামের স্থানে রাম -শ্যাম -যদু -মধুও হতে পারেন।কোন বিশেষ ব্যক্তির সাথে সাযুজ্য খুঁজে দয়া করে এক্সট্রা রস আস্বাদনের প্রয়াস করবেন না)
    চেনা হাফডজন পুরুষের কোলাজে তুমি ঠিক পড় না ।
    বাবুগিরির চোদ্দআনা সিনেমাটিক রঙিনজলের মেহেফিলে
    ডিগবাজি খাওয়া চোখে তুলে নিচ্ছে
    আমার যন্ত্রমুগ্ধযৌন ১৪ মেগাপিক্সেল 'অ্যাপেল ' ।
    নিম্নে ধাবমান শুক্রকীটের আক্রোশ নিয়েই কি শুধু ভাববে
    আমার অদ্বিতীয় পুরুষবাজ ? তবে কি
    মরফিন-ঘুমে তলিয়ে থাকা ভুঁইফোড় অতিরঞ্জিত সময়ে
    বিষাক্ত জেলিফিশের চেয়ে রমণীর শুঁড় আনন্দদায়ক ?
    আমিও জেলিফিশ খাওয়া কুমিরদাঁত শান দিয়ে
    ডাকব অরিণ , এসো , এসো পেতে রেখেছি
    পুরুষের অন্তিমশয্যা , জো জমিনে ফলিয়ে নাও ফসলমাঠ
    আর নারীশরীরী সমুদ্রসৌকর্য নিয়ে সৃষ্টি করো সাহিত্য ।
    পুরুষের জ্বলন্ত সিগারের ওপর চিত শুয়ে আছি
    পটাশিয়াম সাইনায়েড নেই নারী গুহা- গহ্বরে
    স্তনে , যোনিতে বাজছে পিয়ানো রিডের গিমিক
    ত্রিশলক্ষ কীট পাঠিয়ে দাও তোমাদের সভ্যতা পালিত ক্ষেতে
    আমিও ভ্যানিসিং ম্যাথডের অঙ্ক জানি
    কীটদের নিহত ভবিষ্যৎ রেখেছি জন্মনিরোধক পিলে ।
    অরিণ , পৃথিবীতে একচক্ষু মাকড়শা জাল বুনে যাচ্ছে
    নারীর স্তনের দিকে আদিমমত্ত কামনায়
    একটা গোটা 'জন ওয়াকর '- মুখে ঢেলে এগিয়ে আসছে
    যোনি-রক্তখোর মহাজোঁক ,
    র‍্যাটেল স্নেকের বিষাক্ত ধ্বনি নিয়ে
    দু'ই ঠ্যাঙের ফাঁকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছে বিশ্বশান্তির পতাকা
    প্যালেস্টাইনের হাভাতে শিশুরা গর্ভ থেকে চিৎকার করছে-
    মা , আমাকে পৃথিবীতে এনো না
    আমাকে জরায়ুর মধ্যেই হত্যা করতে পারতে মহাসৃষ্টি !
    শুধু যুদ্ধ করো নারী শরীরের অভয়ারণ্যে
    নিহত বর্তমান নিয়েই নারীর অন্তিম সুর-শয্যা ?
    আমার জীবন্ত শরীরে শবপোকায় অবৈধ রেণুসম্ভোগে
    স্যাঙাত থেমো না , মিনিটে ১২০ হার্টবিট তোল বুকে
    ৩৬০ ডিগ্রি নারী-গুহার দিকে একপাল ঘেও কুকুর লেলিয়ে
    ধ্বজভঙ্গ জানে না কোন হাতে মাই , কোন হাতে থাকে নিমাই
    আমিও আমার শরীর একান্নপীঠ তীর্থ করার জন্য
    ব্লাউজহীন নীলসৌন্দর্যের দিকে রাখবো না আর শেষশ্বাস !
    আমাকে গ্রহণ করতে কষ্ট হয় তোমার প্রেম ?
    গলার কাছে জমে আছে অমিতব্যয়ী শ্বাসকষ্ট
    ইনসুলিন নির্ভর জলসোহাগের সঙ্গমে পাঁচ'টা ঠোঁট
    পাঁচ'টা নামাজী বা পাঁচ'টা পুরোহিত বা পাঁচ'টা বিশপ
    যখন ধীরে ধীরে এঁকে দিচ্ছিল লিঙ্গকলার মধ্যে মৃতলক্ষ্মীর মুখ
    তখন বাতাসের বেগ যথারীতি স্বাভাবিক ...
    বৈদিক যজ্ঞ থেকে উঠে এসেছি আমি , নারী
    চন্দ্রের ঘরে ষোলআনা অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে শিল্পের সমাধান , নারী
    অথচ তোমরা , তোমরা ধর্ষিতা শব্দ আনলে , গণধর্ষণ আনলে
    আর শিল্প সাহিত্যে ফুটিয়ে তুললে ধর্ষণশিল্প !
    সাইজ ৩৪ ক্যাপের খোলে গণনাতীত মনু-পুরুষের লালা
    লালা শেষে হস্তমৈথুনঅঙ্গে ক্যাথিডার মালা পরে
    হাসপাতালের চির-নীরোগ নবোদয় !
    ২০১৫ সালকে প্রেমের স্মরণীয় মাইলফলক বানাতে চাও ?
    চাও কি আত্মহত্যা করি ?
    মা , পঞ্চাশ অধিবর্ষ ঘুমিয়ে রয়েছে , পঞ্চাশ অধিবর্ষ পাটক্ষেতে শুয়ে
    ঘুমন্ত শিরদাঁড়ার উপর দিয়ে খেলে গেছে ফসল
    হাজার-লক্ষ যুগসন্ধিক্ষণের শিশুরা কলরোলে হারিয়ে গেছে
    এক্স- ওয়াই ফ্যাক্টরে
    তোমার আগের প্রেমিকারা কোথায় এখন জেনেছ কি ?
    হাজার - হাজার বেদ- উপনিষদ শ্লোক জুড়ে সুস্থতা
    হাজার - হাজার তীর্থংকর বর্ণমালা
    যা শুনিয়ে গেছে জীবতত্ত্বে
    সেসব অস্বীকার করে 'এ'- ছাপ ময়দামাখা নরমের দিকে ছুটবে ?
    স্থবিরতা , শারীরিক নয় বলি যদি মানসিক ?
    মা বলেছিলেন তুলসীগাছ পুতে দিও উঠোনের কোণে
    তুলসী নারী পবিত্রতা
    তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালাতে - জ্বালাতে
    অসতী তুলসী হয়ে গেলাম মা , হাজারজোড়া
    গনবুট পিষে দেয় দু'শো ছয়'টা মেয়েহাড়ের কঙ্কাল
    তখন তোমরা কোথায় থাক পুরুষ ? কোথায় ছিলে অরিণ
    কোন বিশল্যকরণী নিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রেম ? কোন লৌকিক শিল্প
    আমার ভাঙা বুকের কাছে হয়েছিল অর্জুন সারথি ?
    প্রেম ক্রমশ বাজার দরের চেয়েও ভয়ানক সস্তা হয়ে যাচ্ছে
    রজঃস্বলা পৃথিবীর স্তন ,যোনি ,নাভি ,উরু .জঙ্ঘা ,
    শিল্প সাহিত্য ললিতকলায় ধর্ষণ শিল্পে হয়ে এলে
    আমি , হ্যাঁ আমি হাজার ধর্ষিতা নারীর প্রতিনিধি
    হয়ে অশ্লীল ও এডাল্ট কবিতায় বারবার বলবে
    ধর্ষণের চেয়ে কোন এডাল্ট শব্দ নেই
    ধর্ষণের চেয়ে অশ্লীল কোন শব্দ নেই অভিধানে ।
    সানগ্লাস চোখে যারা পৃথিবীর শিল্পের কারবারি , যারা
    নারীর উরুজঙ্ঘা, ঠোঁটের উপপাদ্যে নিজের অব্যক্ত কাম
    ফুটিয়ে তোলেন তথাকথিত শিল্প সাধনায়
    তাদের সুখের জন্য সোনালী মিত্র দায়ী নয় ।
    নারীর পায়ের ওপর কোমর , কোমরের ওপর স্তন , আর
    সবার ওপর একটা মাথা আছে এই সত্যর সামনে
    দ্বিধাহীন বলি- পৃথিবীর সমস্ত নারীঘাতী চোখ অশ্লীল
    হিন্দু পৌরাণিক অতিকথার সূত্রে সোনালী মিত্র একযোগে অভিন্নতা, সংহতি, ঐক্য এবং নিপীড়িতের বোধকে একই পাটাতনে উপস্হাপন করেছেন, যেমন তাঁর ‘রাধাতত্ত্ব’ কবিতায় । সেই সঙ্গে বৃত্তটির পরিধি বিস্তার ঘটান ইতিহাস ও পুরাণের মিশেল দিয়ে । উপস্হাপিত হয় নারীর আত্মজ্ঞান । তাঁর কবি-পারসোনার ইরটিক স্পষ্টভাষণ ও দেহের উৎসববোধ গোঁড়া সমালোচকদের বিব্রত করতে পারে । আমি বলব সেটাই সোনালী মিত্রের লক্ষ্য ।
    রাধা তত্ত্ব
    তারাখচিত ধাবা । ধুধু বিশলাখি চাকামাতম । আহাঃ প্রান্তিকট্রাক -
    ট্রাক-ট্রাক , আহাঃ পরীযোনিধাবা , চোদ্দআনাগরম ।
    ফার্মালিনব্রাহ্মণরাত । হুডখোলা প্রান্তরে উলঙ্গবন্দর । আসে ত্যাজ্যযোনি
    বাবু , রাতের অভাব জানি । জানু- জানু-জানুউ । কাতুকাতুমাখা দেহাতিট্রাক , রাতটম্বুর,শ্বাসটম্বুর , শ্বাসটম্বুর , 'খুলে দাও প্রিয়া খুলে দাও বাহুডোর' ।
    হে , সার্ফসফেদদ্রবণ , হে আকন্দক্ষয় , শাদা , মিহিনদুধশাদা , সাধি , সাধ্যাতীত নাও । পেছনে ট্রাকআলো , মেঘআলো , চিন্তিত একবিন্দু ।
    কড়কর , কড়কড়ে , ঘামমাখা টাকা একশো কুড়ি ।
    চিন্তিতসরণ , স্মরণ , শরম , সতীসাধ্বী পয়মুখতদেহ , ওগো রাখালিরাধা
    ওগো , সখিমোর লিঙ্গসাধা ।
    কেন ফোটাফোটা গোলাপজল । জালভৈরব । ক্ষয়জয় , জয়ক্ষয়
    দুঃখট্রাক পরিপাট নিখাত নিখাত ।
    জ্বলতব্য বুকপাথর , প্রথমসোহাগ শালি মাসিমণি মেয়ে । তারপর , তারপর
    অনেকটা ধনঞ্জয় । কৃষ্ণবিবর , নিকুচি করেছি মাগি , শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রজয় ।
    মাটিরাস্তা , পিচরাস্তা । রাতরাস্তা । যৌনমেদুর ।
    মাগি , এ-সস্তারাতে , শালা ফাঁকা ধাবায় , তারাদের যৌনকেলী
    এসো ছল , খল , মল , জল , ও অপ্সরা
    এসো , বিবিধ
    নলে ঝরে শেষসভ্যতার বীর্য
    কবি সোনালী মিত্রের কবিতাগুলো আক্রমণাত্মকভাবে ননকনফরমিস্ট ও মৌলিক । তাঁর সমসাময়িক কোনও কবিকে এতোটা র‌্যাডিকাল বলা যায় না ; রক্তাক্ত আঘতের মতন তাঁর কবিতার পরতে-পরতে রয়েছে স্পর্শকাতরতা, চামড়া উঠে গিয়ে ভেতর থেকে মাংস বেরিয়ে এসেছে এমন অব্যক্ত শব্দপ্রকাশ । তাঁর কবিতার গুরুত্ব হলো র‌্যাডিকালিজম, যৌনতা ও যোনিজ চেতনার স্পষ্ট উচ্চারণ । আমার ধারণা তাঁর কবিতা কোনো কমার্শিয়াল পত্রিকার সম্পাদক অনুমোদন করবেন না, হয়তো রক্ষণশীল লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক যাঁরা বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস” কালখণ্ডে ধ্বসে পড়েছেন, তাঁরা তাঁদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের কারণে অনুমোদন করতে পারবেন না । তাঁর কবিতার ইরটিক ন্যারেটিভ চালু-জনসমাজে প্রচলিত নারীযৌনতার সংজ্ঞার বিস্তার ঘটায় । এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ হেটেরোসেক্সুয়াল ন্যারেটিভ নকশা, যা বিভিন্ন নারীর অভিজ্ঞতার স্বাতন্ত্রকে দার্শনিক প্রতিরূপে প্রবর্তনের প্রয়াস করে ।
    নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও সোনালী মিত্রের কাহিনিজগত গড়ে উঠতে দেখি ; তিনি অন্যান্য কবিদের কবিতা পছন্দ হয়েছে ঘোষণা করে তাঁদের বার্তা পৌঁছে দেবার একটি প্রক্রিয়া রপ্ত করেছেন, সম্ভবত তাঁর নিজের র‌্যাডিকাল জগতের প্রতি সেই কবিদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ; সেই তরুণী কবিদের কবিতায় কিন্তু নারীদেহের বাকপ্রতিমার মোজেইক থাকে না যার মাধ্যমে নারী তাঁর দেহকে ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োগ করতে পারেন এবং তাকে নারীর বহুবিধ পলকাটা অস্তিত্বের উৎসব-সমিধ হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন । এটি একটি রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, কবিতার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, যে ক্ষমতার উৎস তার দেহ । এই অভিজ্ঞতা তিনি সংগ্রহ করেন যাপনের মাধ্যমে, যেগুলো পুরুষ কবিদের দ্বারা অবহেলিত, যা পুরুষতান্ত্রিক গদ্য-পদ্যে জায়গা পায় না । এটা কিন্তু ফেমিনিজম নয়, এটা নিজের শরীরের উৎসব, দেহের কারণেই কবি একাধারে স্ত্রী, জননী, কন্যা, শাশুড়ি, সংসারের কেন্দ্রস্হানীয়া । ‘মাতৃতন্ত্র’ শিরোনামের এই কবিতাটি উল্লেখ্য :
    মাতৃতন্ত্র
    মাকে দাহ করে ফিরলাম ।
    অদ্ভুত !আত্মাহীন মুখে কোন বিষাদের চিহ্ন থাকেনা
    অথচ খাঁ খাঁ বিছানা-বালিশে কষ্টের গন্ধ এখনো প্রকট।
    আমাদের দুইবোনের যুবতী দুপুর ঝুঁকে আছে মাতৃসভ্যতার দিকে
    মায়ের বুকের অমৃতকলসী মুখে অবাঞ্ছিত কীটের নষ্ট খিদের মাতন।
    ফোনের কন্টাক্ট লিস্টে সংরক্ষিত নম্বরে উজ্জ্বল এখনো "মা"
    বিগত দিনের মতো ডায়াল করলেই ওপ্রান্ত থেকে যেন বলে উঠবেন তিনি-
    "খেয়েছিস মা রে!"
    আসলে ঘি-কাঠের আগুনসোহাগে মুছে যায় কি মাতৃতান্ত্রিক সময়?
    অথচ, মানুষের এমনই নিয়ম বেশীদিন শোক বইতে পারেনা স্মৃতি।
    বহমানতায় ফিকে হয়ে আসবে হয়ত অস্থি ভাসানোকাল
    দেওয়ালে টাঙানো আলতা ছাপের সাথে ফোন লিস্টে "মা" শব্দ
    ধূসর হয়ে মিলিয়ে যাবে হাওয়ায়।
    একদিন মা তত্ত্ব শরীরে নিয়ে আমাদের সমস্ত মনযোগ ঝুঁকে থাকবে
    নিজস্ব মাতৃত্বের দিকে!
    সোনালী মিত্রের কবিতার ন্যারেটিভ একজন শক্তিশালী মহিলা-প্রট্যাগনিস্টকে তুলে ধরে, যাঁর আত্মআবিষ্কারের যাত্রা একইসঙ্গে ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় এবং পিতৃতান্ত্রিক এসট্যাবলিশমেন্টকে পাত্তা দিতে অস্বীকার করে, যদিও সেই ঘেরাটোপের মধ্যে বসবাস করে তাঁকে লড়াই চালিয়ে যেতে হয় । তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয় একটি নারীকেন্দ্রিক কবি-পারসোনা, যার ভূমিকা বহুবিধ, পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্হাকে বিভিন্ন স্তরে আক্রমণ চালায় । তিনি বলতে চান যে একজন নারীকে একটি ডাইমেনশানে আবদ্ধ করা ভুল, তার ডাইমেনশান অনেকগুলো এবং তারা উৎসবকল্প ।
    কবিতা রচনার মাধ্যমে নিজের দেহের সঙ্গে সম্পর্ক স্হাপন করেন সোনালী মিত্র, শরীরের মালিকানা নিজের আয়ত্বে নেন, যা তিনি জানেন, পুরুষদের এসট্যাবলিশমেন্ট সহজে দিতে চায় না । লেখনপ্রক্রিয়া তাঁকে কন্ঠস্বর দেয় ।
    কয়েকজন যুবতীকে নিয়ে আমি একটা ‘জেমস বণ্ড সিরিজের কবিতা’ লিখেছিলুম । কবিতাগুলো আমার ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’ গ্রন্হের অন্তর্ভুক্ত । সোনালী মিত্র’র জন্যও একটি প্রেমের কবিতা লিখে তাঁর যোনিজ উৎসবে অংশ নেবার প্রয়াস করেছিলুম । 
    কবিতাটি দিয়ে আমার আলোচনা শেষ করছি :
    পুরাণের সংস্কৃত গন্ধ থেকে নেমে এসে তুইই শিখিয়েছিলিস
    কবির লেখকের গণ্ডারের চামড়াখানা খুলে রাস্তার ভিড়েতে মিশে যেতে
    তার আগে নিজেকে বড় উন্নাসিক সুপারম্যান ভেবে
    হাতঘড়ির কলকবজায় ঝড়ের মেটাফরগুলো চালুনিতে চেলে
    ভেবেছি পিস্তল পাশে নেই বলে আত্মহত্যা করিনি এখনও
    দিল্লির নিম্নচাপে চোখ এঁকে ফিরিয়েছিলিস শব্দ-ভিজুয়াল
    তরোয়ালে আইনি ঝলকে লিপ্সটিকে ছাপা অটোগ্রাফ দিয়ে বলেছিলি
    প্রতিটি বিপ্লবের দাম হয়, বদলের বাজারও তো বসে
    জুলিয়াস সিজারের গম্ভীর শেক্ষপিয়ারি সাহিত্যের গমগমা ছেড়ে
    সাধারণ মানুষের মতো ক্যাবলা চাউনি মেলি তোর কথা মেনে
    বুড়ো বলে সক্রেটিস সাজবার সত্যিই দরকার ছিল নাকি
    গ্রিসের গাধার ওপরে বসে আথেন্স বা কলকাতার পচাগ্যাঞ্জামে
    ধুতি পরে ? কাঁধে উত্তরীয় ? সাহিত্য সভায় ? নাকের বক্তিমে ঝেড়ে !
    ভুলে যায় লোকে । মজার এ মরে যাওয়া । গন ফট । খাল্লাস ।
    সোনালী প্রেমিকা ! তুইই বুঝিয়েছিলিস : হুদো-হুদো বই লিখে
    বিদ্বানের নাকফোলা সাজপোশাক খুলে দেখাও তো দিকি
    কালো জিভ কালো শ্লেষ্মা কালো বীর্য কালো হাততালি
    উলঙ্গ নাচো তো দেখি তাণ্ডবের আঙ্গিকবর্জিত তালে-তালে
    চুমুর পুনঃচুমু পুনঃপুনঃচুমু দিল্লির নিম্নচাপ মেঘে
    এই দ্যাখ গণ্ডারের শিব-সত্য-সুন্দরের চামড়া ফেলে দিয়ে
    কেমন পেয়েছি নখে সোনালীর চুলের জীবাশ্ম

    'স্পর্ধাকাল' সোনালী মিত্রের প্রথম কাব্যগ্রন্থ । নিজের লেখার কাছে সৎ থেকে যে -কজন কবি ইদানিং কালে কবিতা লিখছেন সোনালী মিত্র তাঁদের মধ্যে অন্যতম । মনের কোনও অবস্থান যেমন শাশ্বত হয় না , তেমন মনের কোনও অবস্থানই অচ্ছুৎ নয় । কিন্তু সাধারণ মানুষেরা অন্যের কাছে নিজেকে সৎ প্রমাণ করার জন্য মনের গোপন কথা চেপে যায় , সোনালী মিত্রের কবিতায় যেন ভেতরের সেই গোপন কথা বেরিয়ে এসেছে । শুধু বেরিয়ে আসেনি , পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে । ভীতু সৈনিক কোনদিন যুদ্ধে জয়ী হয় না , জয় চিরকাল সাহসীদের জন্য । সোনালী মিত্রের কবিতা সাহসী সৈনিক , তেজী ঘোড়া । সোনালী মিত্র যেন বাংলা কবিতার মিথ ভাঙতে এসেছেন , যেন শব্দকে শাসন করতে এসেছেন । নাহ্‌ , পূর্বসূরির বা বর্তমানের কোনও কবির কবিতা অনুসরণ নয় , বরং নিজেকে নিজে অনুসরণ করে গিয়েছেন 'স্পর্ধাকাল' জুড়ে । যারা সমসাময়িক কবিতা নিয়ে নাড়াচাড়া করেন , তারা যদি সোনালী মিত্রের কবিতা না পড়ে থাকেন , বলব পড়ুন । পড়তে হবে এই কারণে যে , আপনি না পড়লে সোনালী মিত্র এগিয়ে যাবেন আর আপনি পুরাতন হয়ে যাবেন । কলকাতা পুস্তকমেলায় সোনালী মিত্রের 'স্পর্ধাকাল' শুধু প্রকাশই পাচ্ছে না , বাংলা কবিতাজগত পাচ্ছে উজ্জ্বল এক নক্ষত্র । আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে 'স্পর্ধাকাল' শুধুমাত্র কবিতাবীজ নয় , একটা বোধিবৃক্ষ । তাই পুস্তকমেলায় পাঠক গেলে একবার স্পর্ধাকাল হাতে নিয়ে দেখুন , আশা রাখি সোনালী মিত্র ব্যর্থতা দেবে না পাঠককে ।
    -------------------
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪১512513
  • অজিত রায়, নতুন বাংলা গদ্যের জনক : মলয় রায়চৌধুরী
    মরে গেল অজিতটা । অজিত রায় মরে গেল । ওর দেহ, কালো হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জিতে, পড়েছিল 
    হাসপাতালের স্ট্রেচারে । পড়েছিল এইজন্য বলছি, ওর পা দুটো স্ট্রেচারের ডানদিকে ছিল । দেখলেই টের পাওয়া যায় অনেকক্ষণ আগে মারা গিয়েছিল । শেষগতি কে করবেন তা হয়তো তখন পর্যন্ত নির্ণয় নেয়া হয়নি । স্ট্রেচারে পড়েছিল অবহেলায় । দীর্ঘ ১৫ দিন যাবত শয্যাশায়ী, এমনকি ফোনে কথা বলতেও খুব অসুবিধা হচ্ছিল অজিতের। ইমিডিয়েট দুই ইউনিট রক্ত দরকার ছিল।  হসপিটলাইজ করা দরকার ছিল। 
    .
    অজিতের সঙ্গে যোগাযোগ আমার বহুদিনের । আমার স্কুল-কলেজের সহপাঠি সুবর্ণ উপাধ্যায় সিন্দ্রিতে সায়েন্টিফিক অফিসার ছিল, সেই সময় থেকে । অজিতের একটা দোষ বা গুণ যাইই বলি, তা হলো প্রথম দিকে ওর সঙ্গে অবনিবনা হয়, তারপর মিটমাট হয়ে যায় । ওর স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গেও সুসম্পর্ক ছিল না। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিল, তাই শেষ পর্যায়ে আত্মীয়-স্বজনকে কাছে পায় নি । একটা লেখায় অজিত জানিয়েছিল যে ওর মুখাগ্নি যেন ওর নিকটসম্পর্কের কেউ না করেন । শেষ পর্যন্ত কে করেছিলেন জানি না ।
    .
    কিন্তু ও কোথায় থাকে, কী করে তা জানতুম না। সেসব জানতে পারলুম পরে । নিজের সম্পর্কে অজিত একবার লিখেছিল, “জন্মের বা নসিবের ফেরে নয়, আজ অবশ্যই বলতে পারি সৌভাগ্যের করুণায় আমি বসত করি বাঙালির পরিচিত ও গঙ্গাবিধৌত নাবাল গণ্ডির বাহিরে এমন এক বৃহত্তর পৃথিবীতে, যেথায় চাঁদ সূর্য নক্ষত্রের দিবারাত্রি অশুয়া ঝরে পড়ে, যেথায় পলাশ শিমুল শাল-শার্জম নিম সুজনের অনিবার সারি, যেথায় পাহাড় জঙ্গল নদী ও নদ-দামোদরের অবিরল করকাপাত। যে 'পশ্চিম' অজীর্ণকাতর কলকাত্তাই বাঙালিকে দেহ-উজ্জীবনের সুরাহা জুগিয়েছে। যে লাল পাহাড়ির দেশ বেঙ্গলি ড্যানচিবাবুদের ঔপনিবেশিক স্থাপত্য মেনে সুবিসারিত ভিলা, কুঞ্জ, নিবাস, ধামের হরিল্লুঠ দিয়েছিল। কিন্তু যাঁরা এখানকার মূল নিবাসীদের সঙ্গে আদ্যোপান্ত তেল ও জলের তফাৎ রেখে বিদায় নিয়েছেন। এখন বলার কথা এইটাই যে এই ভূখণ্ড সত্যিই কি বাঙালি চিনেছে? লাতেহারের জঙ্গলে গহীন বনরাজি এবং কুচকুচে 'জংলী' আদিবাসীদের সঙ্গে দু-চারদিন মিশেই দুর্বিষহ লেগেছিল বলে ডেপুটির চাকরি ছেড়ে মায়ের আঁচলে ফিরে গিয়ে স্বস্তি বোধ করেছিলেন সঞ্জীবচন্দ্র। লবটুলিয়ার অপার নির্জনতায় দিনদশেক কাটিয়েই সত্যচরণের মনে হয়েছিল জনহীন জঙ্গলে এভাবে হাঁপিয়ে মরার চেয়ে কলকাতায় থাকা ঢের প্রশস্ত। আমি জন্মেছি সেই ঝাড়খণ্ডে। যাহা একদা বঙ্গভূমের দেহাংশ ছিল, ১৯৫৬ সনে পুরুলিয়ার হাত ধরে নিজ মাতৃক্রোড় রিটার্ন যেতে না পারার প্যাং (pang) এদান্তি ভুলতে পারেনি ধানবাদের বৃদ্ধকুল। কিন্তু আমি এই অনাবাল টাঁড় ধরণীতে বেশ আছি। সবচেয়ে ভালো লাগে এ অঞ্চলের নিবিড় বনভূমি, কুইন অফ ছোটানাগপুর নেতারহাট। ভালো লাগে বেতলা। ঝাড়খণ্ডের তেত্রিশ শতাংশ বনভূমি, পাহাড়, নদ-নদী, উপত্যকা ও এখানকার বহুজাগতিক ভাষা। আমি আমার এই মাতৃভূমির প্রকৃতি ও মানুষের মায়ায় মজিত। এ টাঁড়ের সব ভাষাতেই মাদল বাজে। তদানীন্তন এই দক্ষিণ বিহারের 'ছিকাছিকি' বুলির মনোরম উল্লেখ আছে বিভূতিবাবুর 'আরণ্যকে'ও, কিন্তু তিনি এই দেশটিকে দেখেছিলেন 'আউটসাইডার'-দৃষ্টিতে। বহু ক্ষেত্রে তিনি ঢপের নিদর্শন দিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডের সমস্ত ক্যাটাগরির আদিবাসীকে বাঙালি প্রতিষ্ঠানের মসিহস্তীরা 'সাঁওতাল' বলে চালিয়ে দিয়েছেন। হিন্দিভাষী মাত্রেই, তাঁদের চোখে 'বেহারি' কিংবা 'হিন্দুস্তানি'। বড়ই হাস্যকর ও ক্রোধ-উদ্রেকী শব্দ। মূর্খতার সুবিশাল খ্যাতি প্রতিষ্ঠানকে লজ্জানুভিলার চূড়ান্ত নিঃশেষে নিয়ে গেছে। এবার আমি বলি। পৌরাণিক যুগের 'কীকট' বর্তমানে ঝাড়খণ্ড। এ এক অপরূপ নিরালা নিজস্ব পৃথিবী। এর সঙ্গে ভারতবর্ষের আর কোনো ভূখণ্ডের সামীপ্য নেই। আমি যাঁদের সঙ্গে অহরহ মিশি, মিশে ফীলিং গুড ফীল করি, তাঁদের রয়েছে মিলিজুলি বুলি : খানিক বাংলা, কিছু মৈথিলী, খানিক খোরঠা বা কুড়মালি, কিঞ্চিৎ ভোজপুরী এবং কিছুটা ঠেট হিন্দী। অজস্র গড়া, বাইদ, বনি, হাডু, কাটা ইত্যাদি উত্তর-পদযুক্ত গ্রাম নামে এবং মহল্লা, নদী বা পাহাড়ের নামে অবশ্য অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় প্রত্নশব্দ রয়েছে এই টাঁড়ভূমে। এমনকি ধানবাদ থেকে খুব কাছেই, ভৈরবীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত 'রাজারাপ্পা'র সঙ্গে 'হরপ্পা'র ধ্বনিগত, অর্থগত মিলও মেলে, নৃতত্ত্ববিদেরা যাই কপচান।
    তো, কথা হচ্ছে, কীয়ৎকাল পূর্বে, এক রাত্তিরে, রাত সাড়ে ন'টা নাগাদ আমি ধানবাদ টিশনে গিয়েছিলাম কোলফিল্ড এক্সপ্রেসের একটা আগাম টিকিট কিনতে। কলকাতা আসছি কিনা! তো, নিরিবিলি কাউন্টার থেকে টিকিটটা কালেক্ট করে রেলওয়ে ক্লাব অবধি এসেছি বাইকে, দেখি হুস-হুস করে পাঁচ-ছখানা বাইক এসে জমা হলো মাজারের মোড়ে। প্রত্যেকটি বাইকে তিনজন করে সোয়ারি। ওরা চা, চপ, সিঙ্গাড়া খেতে রুকেছে। দুতিনজনের হাতে ফুটবল। বুলি শুনেই বুঝলাম, ঝাড়খণ্ডি। দমে হুল্লোড় নিজেদের মধ্যে। জানতে চাইলাম, 'খেইলে আলি?'
    'ন স্যর, যাছি খেইলতে। ম্যাচ আছে।'
    'ম্যাচ! ইতো রেইতে?'
    'হঁ। রাতে ম্যাচ। ফেলাড বাতি আছে ন!'
    'অ। তাথেই হামি থামলি, তুদের দেইখে। ত, ম্যাচ টো কুথা?'
    'আমটাল গ।'
    আমটাল শুনেই রোঁয়া খাড়িয়ে গেল। বহুদিন দেখা হয়নি সে গাঁ, বড় মনোরম, স্বীয় মনের বজনিশ। বললাম, 'দাঁড়হা ক্যানে, হামিও যাছি তুদের সঁগে।'
    ওরা আমায় লুফে নিল। হৈ হৈ করে দুজন ছোঁড়া চেপে বসল আমার বাইকে। উছল আনন্দ, উদল আশ নিয়ে ধাইলাম কচি পানাগুলোর সঙ্গে। একদা, যেসময় আমি 'ধানবাদ ইতিবৃত্ত' রচনায় ব্যাপৃত ছিলাম, সেই বিশ-পঁচিশ বৎসর মগরিবে আমটাল গাঁয়ের 'রইস' তথা হতদরিদ্র কেলেকুষ্টি ডিংলাপারা মানুষজনের সঙ্গে আমার হার্দ্য রিস্তা গড়ে উঠেছিল, তবে শেষোক্ত শ্রেণীর সঙ্গেই ভাবসাব প্রগাঢ়। প্রকৃতির ক্রোড়ে ওই নিরিবিলি শ্যামলসুন্দর ধরণীকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ধ্বংস করার দীর্ঘায়িত লীলাখেলাও চোখের সমুখে প্রত্যক্ষ করেছি, সেই ইতিহাসকেও এড়িয়ে যাইনি আমি। সুফসলি জমিগুলো রইসদের কুক্ষিতে। রুক্ষ অনুর্বর চটা জমিগুলো ঠেলে দেওয়া হয়েছে আদিবাসী আর গরিবগুলোর হেফাজতে। সেখানে চলে পাথর চটিয়ে মৃদু ফসল ফলাবার দুশ্চেষ্টা। দারিদ্র ঘোচে না। অভাব অস্বাস্থ্য তাদের নিরবধি নির্দয় পীড়ন করে। সেই কয়লাকুঠি এজাদের পর থেকেই ব্যাপক অরণ্য শোষণ। অরণ্যের বদলে ঝাঁটিজঙ্গলই তাদের এখন নসিবি আস্তানা। কিন্তু তাতে আরণ্যক স্বভাব লোপ পায়নি। আরণ্যক বৃক্ষকে এরা চেনে আপন মা-বাপের মতন। তাই লোভী ইউক্যালিপটাসি ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে জরুরতের টাইমে ধনুষও ধরে। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কী-দেখব কী-দেখব উন্মেষ নিয়ে রাত প্রায় সাড়ে দশটা নাগাদ আমটালে হাজির হয়েছি। মাঠ জুড়ে ফ্লাডবাতির অজস্র রোশনাই। কিন্তু গোটা আমটাল তমসার বৃত্তে। খেলা দেখতে তো আসিনি, এসেছি মানুষ ও গাছপালা দেখতে। এত রাতেও, কোনো কোনো ঝুপড়িতে মৃদুমন্দ লণ্ঠনের জোনাক। হালকা বাতচিৎ, মুমূর্ষু গণের আনাগোনা। কোথ্যেকে যেন কাঁচা মউলের সুবাস, দীর্ঘ মি-মি ডাক ছাগশাবকের, কচি একটা সড়ক হেঁটে গেছে সুখিয়া মুর্মুর দুখিয়া ডাড়িতে। কুথা গ মুর্মু?
    বুঢ়া মুর্মু লাঠি ও লমফো হাতে সামুতে এসে খাড়ায়, লোলচর্ম মুখের অজস্র শিরা-উপশিরা কুঁচিয়ে ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয় আমার পানে।
    'চিহ্নতে লাইরলে খুড়া? সেই যে মটা বাইদ ধানের ভাত আর খুকরার ঝল খাওয়ালে! এক চুকা তুমাদের ইস্কচ, মানে মাৎকোং খাওয়ালে?'
    'হঁ হঁ', ---- বুড়োর মেমোরি হেভি শার্প, ঝটঝটিয়ে মনে পড়ে গেল, মোড়া পেতে বসাল, ---- 'ত ঠাকুর ইতো রেতে? থাকভি ন যাভি?'
    'এই ম্যাচ দেখতে আলি। সুবায় টেরেন ধৈর্তে আছে। ফিরব।'
    এরপর মুর্মুর দাওয়ায় এক-এক করে এসে জমে ভুলি টুডু, দেয়ান বাস্কে, মানিজার সরেন, আমেরিকা হেমব্রম, আরো কতিপয়। কেউ আমায় মনে রেখেছে, কেউ বা অবাক নয়নে এই উল্কা-প্রতিম বেপোট লোকটাকে খালিপিলি নিরীক্ষণ করে যাচ্ছে, কিন্তু থই পাচ্ছে না। চেনা বুড়োগুলো এখন আরও বুড়ো হয়েছে, পাক ধরেছে চুলে, কানে কালা, দৃষ্টি সরু, মাখনের মতো শরীল আজ শুষ্ক পাণ্ডু ও জিরজিরে। তবে, একটা কথা। এদের সরল চরিত্রে বরাবরই লক্ষ করেছি আনন্দ নেওয়ার, এবং দেওয়ার স্বাভাবিক প্রতিভা। এরা মাটি, জঙ্গল, পাহাড় খুইয়েও প্রকৃতির সাজেদা গায়। এই সিজিনেই আসছে এদের 'শহরায় বঙ্গা', এই উৎসব শুধু মানুষের নয়, গৃহপালিত গরুমহিষও তাতে শরিক। গরু নেই, গরু জীর্ণ, এক আঠি পোয়ালের জন্য দিবারাত্র কেঁদে ভাসায়, তবু এরা এখনো 'গোয়াল' পুজো করে। জাহের থানে হত্যে দেয় দুমুঠো ফসলের তরে। এদের কৃষি নেই, জমি নেই, ফসল নেই, তবু এদের সমস্ত পরব জমি ও কৃষিকে ঘিরে।
    ফিরে আসছি যখন, রাত বারোটা। তখনও ওরা বিনিদ্র চোখে আমায় ঘিরে। শেষে মুর্মুর ছুটো লাতিন একটা গান শোনালো, সেও বেজায় মন-কেমনের সুরে :
    নে তরা নেতে তরা মুরুম পাঞ্জা
    নে তরা নেতে তরা শলাম পাঞ্জা
    পাঞ্জায়ে পাঞ্জায়ে মুরুম পাঞ্জা ----
    পিছায়ে পিছায়ে শলাম পাঞ্জা।
    অর্থাৎ ---
    'এই যে দেখনা হরিণের পদচিহ্ন / এই যে এখানে হরিণীর পদছাপ / খোঁজো খোঁজো সেই মৃগপদলাঞ্ছনা / খুঁজে দেখো সেই হরিণীর সন্তাপ'।
    ------ কী সুন্দর! তাই না? গানের সুরে সুরেই বোনা হয়েছে শহরায় উৎসবে আগত ওঁরাও যুবতী সিগনির করুণ আখ্যান। সেই কাহিনীতে গাঢ় আরণ্য রোমান্সের সঙ্গে মিশে আছে কালো মানুষের রক্ত ঘাম কান্নার মর্মান্তিক সরঞ্জাম।”
    .
    হাংরি আন্দোলনের পৃষ্ঠপটে অজিত রায় ক্ষুধা নিয়ে লিখেছিলেন, এইভাবে, “কামজ খিদে আর পেটের খিদে। দাপট কার বেশি? দুটোই কিন্তু জোরালো। দুটো খিদে দুরকমের। এরা পরস্পর নির্ভরশীল নয়। অভুক্ত অবস্থা রতিক্রিয়ায় বাধ সাধে না। খালি পেটে কিম্বা ভরপেট মোগলাই গিলে সমান তালে শরীর-শরীর খেলা জমিয়ে তোলা যায়। পেটের খিদে যে যৌনসম্ভোগের অন্তরায় নয় তার ভূরিভূরি প্রমাণ অনাহারের বলি মেয়েপুরুষের প্রজনন হেতু গণ্ডায় গণ্ডায় অভুক্ত শিশুর আবির্ভাব। গাছের আড়ালে, ফুটপাথের অন্ধকারে, রাতের সিঁড়িতে এরা দিনের পর দিন পৃথিবীর জনসংখ্যা বাড়ায় আদমশুমারির দৃষ্টির বাইরে। যাই হোক, এটাই মানুষের যৌনতা, যা অন্য কোনো প্রাণীর নেই। বহুসময়ে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও কাম ও যৌনতাকে গুলিয়ে ফেলেন। অথচ এ-দুটিতে মূলগত কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। কাম এক নিরপেক্ষ জীবনীশক্তি, প্রাণের নির্দিষ্ট উছ্বাস যা নিম্নস্তরের প্রাণীর মতো মানুষের মধ্যেও ক্রিয়াশীল। এই কাম যদিও সর্বদা সচেতন কর্ম নয়। পশুসমাজে কাম প্রকৃতিতাড়িত, মানুষের ক্ষেত্রেও কিছুটা। কিন্তু মানুষকে পশু থেকে পৃথক করে, কাম নয় ---- রিরংসা। প্রজাতির স্থায়িত্ব ও বংশবিস্তার কাম দ্বারা সংঘটিত হলেও, কামকে যা রমণীয় ও মানুষকে সৃষ্টিশীল করে, তা যৌনতা। যৌনতা এক বহুমাত্রিক বর্ণময় বিস্ময়। তা মানুষকে পশু থেকে আলাদা করে, তাকে সমাজ ও পরিবার গঠনে ব্রতী করে, তাকে মধুর জীবনবোধ উপহার দেয় এবং তার মধ্যে রসবোধ উদ্দীপ্ত করে তাকে শিল্পী ও কবি করে। এই বহুপল্লবিত যৌনতাই আমাদের সমাজে, জীবনে, চিন্তায় ও কর্মে। আমাদের যাপন-প্রণালীর সবটাই যৌনতানির্ভর। অথচ আশ্চর্য, যৌনতার এই সর্বব্যাপ্ত কর্মজাল বহুসময়েই আমাদের কাছে অচেতন, দুর্বোধ্য। মানুষের উৎপত্তির বছরটি আমাদের জানা নেই। জানা নেই কখন হোমোসেপিয়ন্সের আবির্ভাব। কিন্তু মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার পেছনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যে একটি মস্তিষ্কের, মনের, এতে দ্বিমত নেই। আর বিকাশের বিশেষ এক অবস্থায় বিশেষ-বিশেষ স্থানে এটা ঘটেছিল বলেই আহারনিদ্রামৈথুনেই কেবল বদ্ধ নয় নিয়ানডার্থাল মানব-মানবী। সে অন্বেষণমুখী, বুভুৎসা তার প্রথম অস্ত্র। মনের বিকাশই মানুষকে নতুন সম্ভাবনা ও কল্পনার দিকে এগিয়েছে। মনের এই বিকাশ কামকে দেয় এক নতুন মাত্রা, মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। তখন কাম আর শুধু সন্তান উৎপাদনের সাধন নয়, তাকে রঙিন করে যৌনতা। আসে বিস্তারিত শৃঙ্গার, দেহ-মুদ্রা। তখন স্তনযুগল আর নিছক দুগ্ধপানের আকর নয়, তা অন্যতম এক যৌনাঙ্গ। এ থেকে শুরু হয় নরনারীর পারস্পরিক আকর্ষণ, প্রেমের অঙ্কুর। দক্ষিণী সৃজন-তথ্যে আছে, মানব-মানবী সৃষ্টি করতেই বিধাতার সর্বাপেক্ষা খাটনি হয়। তাই নর-নারী সৃষ্টি করে তিনি কেলিয়ে পড়েন এবং তড়িঘড়ি মহানিদ্রায় লগ-ইন করেন। ইত্যবসরে নর-নারীর দেহ সঞ্চালিত হতে থাকলে তাদের ভাবসঞ্চালনও ট্যাগ-আপ হতে থাকে, তৎলগ্নে কারুবাসনাও আনচানিয়ে ওঠে। তাদের দেহসংলগ্নতা নিচ্ছিদ্র হয়। বিধাতা জেগে উঠে দেখেন, লে হালুয়া! ----- মেয়ে-মদ্দাকে যে আলাদা আলাদা চেনাই যাচ্ছে না গো!! একদেহে পরস্পর লীন হয়ে গেছে! সৃষ্টির সমূহ বিপদ হবে ঠাহর করে তিনি অবিলম্বে ছিন্ন করেন ঐ একদেহে লীন মানবকে। তারপর বিশ্বময় ছুঁড়ে দেন ওই দুই বিভাজন। সেই মুহূর্ত থেকে ঐ একদা-এক-থাকার প্রমত্ত আনন্দের স্মৃতিতে এদান্তি হন্যে হয়ে আছে উন্মত্ত স্মৃতিকাতর নর-নারী। এই তো ভালোবাসার উৎস। বা, যৌনতার ইতিবৃত্ত। মানুষের যৌনতা আছে বলেই তার নিজেকে ঢেকে রাখার, সাজিয়ে রাখার এতসব আয়োজন। যৌনতা আছে বলেই মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য মরিয়া-স্তরের সচেষ্ট। প্রকৃতির শক্তিকে নিজের কাজে লাগাবে বলে সে কখনো প্রার্থনা করে, কখনো করে দ্বন্দ্ব। অতি ধীরে ইন্দ্রজাল জাদুর মত দেবতাদের উদ্ভব ঘটে ---- যে দেবতা তারই মত, তবে আরও শক্তিমান ও সুন্দর ----- সে যা হতে চায়। স্বভাবতই বিপরীত লিঙ্গের মানুষটি তখন আর নিছক শরীর নয়, তাকে ঘিরে তখন নানান কল্পনা, স্বপ্ন। দৈহিক মিথুন পর্যবসিত হয় মানসিক মিথুনেও। পাশাপাশি যৌনতাকে কিছুটা রীতি ও নিয়মের নিগড়ে বেঁধে ফেলতে থাকে মানুষ। ক্ৰমে তা সমাজবদ্ধ হয়। বিশ্বের সর্বত্র কিন্তু সভ্যতা একসঙ্গে হাঁটা শুরু করেনি। বিশেষত নদী-সন্নিহিত অঞ্চলে, যেখানে বেঁচে থাকার রসদ বেশি, শ্রম কম, সেখানেই ঘটেছে বিকাশ। যৌনতারও। উদ্বৃত্ত সময় ও অবকাশ মানুষকে সৃষ্টিশীল ও শ্রেষ্ঠ হতে প্রেরিত করেছে। আষঙ্গলাভের জন্যে কেবল দৈহিক বল নয়, সে খুঁজে পেতে চেয়েছে অন্যবিধ প্রকরণও। এভাবেই গীত ছড়া কবিতা নাটক সুর নৃত্য বাদ্য ও ছবির উদ্বোধন। ইতিহাস বলে, যে যে স্থানে যৌনতা স্বাভাবিক স্বাধীন বিচরণক্ষেত্র সেখানেই সভ্যতা বলবান হয়েছে। প্রাচীন সভ্যতাসমূহের সর্বত্রই উন্নত জীবনের পাশাপাশি উন্নত যৌনজীবন। রোম ও গ্রিসের কথা আমরা জানি। কিন্তু আমরা অনেকে জানি না বৈদিক ভারতের কথা। বেদ রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতি যত না ধর্মগ্রন্থ, তার চেয়ে বেশি প্রাচীন ভারতের জীবনযাপনের বর্ণনা, ইতিহাস-আলেখ্য; যদিও এসব কাব্য হওয়ায় অনেকাংশে দুর্বোধ্য। সেই বৈদিক ভারত ছিল অপেক্ষাকৃত বীর্যবান, প্রাণশক্তিতে ভরপুর। কিন্তু ভারতের সর্বাধিক গৌরবের যুগ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক। এসময় যৌনতার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানেরও প্রসার তুঙ্গে। ভাবুন সেই ভারতের কথা ---- বাৎসায়নের আগেই যেখানে অন্তত দশজন কামশাস্ত্র রচনা করেছেন, এবং তাঁরা কেউই নিন্দিত নন, বরং ঋষি বলে নন্দিত। আর এই কারণেই, যৌন-উল্লাসের হেতু নাট্যশাস্ত্র রসশাস্ত্র ইত্যাদিও ভাস্বর সেসময়ে। বুদ্ধের সময় আমরা সমাজে বিত্তবতী, শিক্ষিতা, কলাকুশলী স্বৈরিনীদের দেখেছি ---- তারা সমাজে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। গৌতমের গৃহত্যাগের আগে তাঁর যৌনজীবনের যে ছবি আমরা দেখেছি তার কাছে যৌনতার আরব্যরজনীও ম্লান। গুপ্তযুগও তো পারমিসিভ সোসাইটি, স্বাধীনতার জয়গানে ভরা ----- সেই তো স্বর্ণযুগ! বুদ্ধের সময় থেকেই ভারতীয় সমাজে উচ্চকোটির সুশিক্ষিত সুজন মানুষ একে-একে জড়ো হচ্ছেন মোক্ষ লাভের আশায়। আসলে গোটা বুদ্ধ-যুগটাই ছিল একটা পিনেনিয়ান ঢপ। ভেবে দেখুন আক্কেল কেমন, চারিধার থেকে ঠাসা জাবদা-জাবদা ইয়াং আর প্লডিং মেয়েছেলে। কিন্তু সব ছেড়েছুড়ে গুরু কিনা মাঝরাতে উধাও! ওই জন্যেই ইন্ডিয়াটা ভোগে গেছে। কেননা, বুডিজম গিলেই ভারতবর্ষ সেক্স ভুলেছে। ভুলেছে রসশাস্ত্র, মুদ্রাব্যবস্থা, বাণিজ্য। সমাজের এলিট তবকা রাতারাতি মেতে উঠল স্যালভাশনের ঠেকায়। তিন-চারশো বছর ধরে আকখা মুলুক জুড়ে শুধু চৈত, বিহার আর ধর্মসংঘ। রতি-রস-মুদ্রা-বাণিজ্য রসাতলে গিয়ে জেগে রইল, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের যা ছিল শ্রেষ্ঠ আকর সেই বেদ-এর বিরোধী এক ধর্মসার দর্শন ---- 'বুদ্ধতত্ত্ব'। সমাজ তাতে কী পেল? ঘন্টা। বরং হারাল অনেক। দেব-দেউল পুতুলডলে দেশ ভরল, সেক্স-পরিপন্থী সমাজে নেমে এলো ঘোর নষ্টেন্দুকলা, ----- পারভারশান, ফ্রিজিডিটি, নন-কাল্টিভেশন আর ইনারশিয়া। খেয়াল করবেন ম্যাডাম, যুগপুরুষ-টুরুষ যত যৌন-পরিপন্থী আর অহিংসাবাজ হয়েছে ডেইলি নিউজের হেডলাইনগুলো ততই অশ্লীল আর বর্বর হতে বাধ্য। তারপর এলো মধ্য এশিয়ার সেই বর্বর, অশিক্ষিত, অসভ্য লুটেরার দল। তারা তো প্রকাশ্যে মেয়ে-বউ তুলে নিয়ে যায়। কীভাবে মুক্ত থাকবে সমাজ? কীভাবে বিকাশ ঘটবে শিল্পকলার? সব ভালো শিকেয় তুলে রেখে হিন্দু সমাজপতিরাও মেতে উঠল কূটকচালি, নীচতা, শঠতা, কুসংস্কারে। সমাজে যৌনতার বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেল। তারও পর এলো মুঘল। এলোই যখন মুসলমানেরা তখন আরব-পারস্য-তুরস্ক থেকে এলে অন্তত আনতে পারত সংস্কৃতি। মন্দির ভেঙে মসজিদ, সামাজিকতা ভেঙে হিন্দু মেয়ে-বউকে তুলে, কর বসিয়ে , বড় বড় অট্টালিকা বানিয়ে, চূড়ান্ত বেলেল্লাপনা করে তারা কোথায় নিয়ে গেল ভারতবর্ষকে? এ অবস্থাতেও যৌনতার স্বাভাবিক বিকাশ থাকল অর্গলবন্দী হয়ে। আচার-সর্বস্ব পৌত্তলিক হিন্দুসমাজও মেতে থাকল বাল্য-বিবাহ, কৌলিক প্রথা, বিধবাদের জীবন্ত দাহ কিম্বা কঠোর নীরস বৈধব্য আচারে। তারপর আসিল ইংরাজ। তলোয়ার-হাতে ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা জয় তার সম্পন্ন। অহিংসা ও প্রেমের ঠাকুরকে সামনে রেখে পচা খ্রিস্টীয় মূল্যবোধ ও পাপবাদ চারিয়ে দিতে লাগল ভারতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এরাই মধ্যযুগীয় ইউরোপে স্বাধীনতাকামী যৌনতামুখী ধারাকে এন্টি-ক্রাইস্ট ব্যভিচার ভেবে পুড়িয়েছিল লক্ষ লক্ষ মানুষকে স্টেকের আগুনে, তাদের ডাইনি আখ্যা দিয়ে। সেই ইংরেজ নাকি আমাদের কুসংস্কার দূর করবে? বাঙালি বাবুরাই সর্বপ্রথম সাহেব হতে গেল। ইংরেজ আসায় কিছুটা উন্নত হলো বটে, কিন্তু দেবেন্দ্র ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রীদের ব্রাহ্ম মতবাদে সমাজ আরো পিউরিটান হলো। ব্রাহ্মদের ব্রহ্মভজনার চেয়ে সাহেবভজনাই বেশি। যৌনতা আরও যূপকাষ্ঠে ----- যা বাড়ল তা-ও ঐ ইংরেজ সাহেবদের ক্লেদজনিত; বাড়ল ভুঁইফোড় ধনী বাঙালি নিম্নশ্রেণী বাবুদের তেলমারা জমিদারি, বিকৃতকাম, নারী-লোলুপতা, ব্যভিচার। তদুপরি ভারত 'স্বাধীন' হইল এবং পৃথিবীর দাস হইল। দেশসুদ্ধ মানুষ কামচোর, নিষ্কর্মা, দুর্নীতিবাজ ও কমবেশি চোর হইল। উহাদের সততা নাই, উদ্যম নাই, উহাদের বল নাই; কারণ উহাদের প্রকৃত যৌনতা নাই। ভুল মূল্যবোধে বেড়ে উঠল খণ্ডযৌনতা, ন্যাকাপনা, চতুর যোনিলাভ। সাহিত্য-শিল্পে যৌনতা ব্রাত্য হলো। বিকৃতির থাপ্পড়ে গোটা একটা জাতি খোজা ব'নে গেল। অনুকম্পা ও আস্তরণ পড়তে শুরু করল যৌনতায়।
    উপসংহার :
    ক্ষুদে ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা সাহিত্য ধরে রাখল সেই বিকৃত ধারা। সামান্য মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকলে পাঠকও ধরে নিতে পারবেন বাংলা উপন্যাস-গল্প-কবিতা-সিনেমায় 'শুদ্ধ' প্রেম বলে যা চালানো হয়েছে এতকাল ধরে তা আসলে বিকৃতি, একধরনের প্যারানোইয়া। লিঙ্গহীন সাহিত্য যোনিহীন সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। আসলে যৌনতা না থাকলে কিছুই থাকে না। যৌনতাহীন মানুষ ক্রিয়াশীল সৃষ্টিশীল হতে পারে না। সভ্যতার এহেন দুঃসময়ে একজন অযৌন মানুষ কখনও বুদ্ধি চিন্তার বিচারে পূর্ণ সক্ষমতা পায় না। আপনি যদি রেফার করেন সেবাব্রত সন্ন্যাসীদের কথা, আমি বলব যৌনতাই তাদের উদ্বুদ্ধ করে মানব সেবায় ----- এটাই যৌনতার ট্রান্সনডেন্স, ঊর্ধায়ন। যৌনতা এক বহুধাবিস্তৃত কর্মক্ষেত্র। ভানুমাস্টারকে যে যৌনতা তার কচিবয়সী ছাত্রীর প্রতি আকৃষ্ট করায়, সেই যৌনতাই বিকাশ পাইনকে দিয়ে ছবি আঁকায়, জীবনানন্দকে দিয়ে কবিতা লেখায়, অমর্ত্য সেনকে দিয়ে অর্থনীতি ভাবায়। এই যৌনতার অবশিষ্টাংশ আছে বলেই শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান পল্লবিত হচ্ছে। ওই ক্ষুদে ব্যতিক্রমটি আছে বলেই বাংলা সাহিত্যের একটা ছোট্টো অংশ অন্তত এখনও পল্লবোন্মুখ।”
    .
     অজিত রায়ের জন্ম ১৯৬২ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন বিহারের ধানবাদ শহরের সিএফআরআই কলোনিতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন অজিত।‌সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল ছোটো বয়স থেকেই। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে 'অনন্যা’ নামের একটি কবিতা প্রকাশ করেন। নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থ র নাম রেখেন ‘অকবিতা’। চাকরি করেছেন একটি কয়লা মার্চেন্ট অফিসের অ্যাকাউন্টেন্ট হিসাবে। কিন্তু সাহিত্যের অন্যতম সৃষ্টির জন্য সেই চাকরিটি তাকে খোয়াতে হয়। স্বভাবতই আর্থিক অবস্থায় ভেঙে পড়েন এবং তিন মাস বসে থাকবার পর সাহিত্যকেই একমাত্র রুজিরুটি হিসেবে বেছে নিয়ে ফুল টাইমার হয়ে লেখায় মনোনিবেশ করেন অজিত। তাঁর প্রথম দিকের লেখায় সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ছাপ থেকে গেলেও নিজের নিবিড় অধ্যয়নের প্রক্রিয়ায় তা সহজেই কাটিয়ে উঠেন এবং আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বৃহত্তর পাঠকের সামনে কথা সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন অজিত রায়। যদিও তখনো তার ভেতর বিরাজ করছিল কবি সত্তা। কাব্যগ্রন্থের মধ্যেই অজিত রায় প্রমাণ করে দিয়েছিলেন, গতানুগতিক সাহিত্যের ভাষা থেকে বেরিয়ে এসে অন্যরকম কাজ করতে চান তিনি। কবিতাকে ছেড়ে গদ্য সাহিত্যকে আশ্রয় করে নিলেও তার মধ্যে কবিতার নানা প্রভাব সবসময়ই লক্ষ করা গিয়েছে। অজিত রায়ের সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধকে ভেঙেচুরে দেওয়া। যার কারণে বরাবর নিন্দিতও হয়েছেন তিনি। ‘যোজন ভাইরাস’ বা ‘জোখিম কোরকাপ’ উপন্যাসে সভ্য মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা পাশবিক চরিত্র গুলিকে যেভাবে তুলে ধরেছেন তিনি, তাতে সত্যিই চমকে উঠতে হয়। মানুষের জীবনের যৌন আকাঙ্খার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে গিয়ে কখনও হোঁচট খায় নি তাঁর কলম। মানুষ তাঁর সৃষ্টি গ্রহণ করবেন কিনা, তাই নিয়ে কখনো ভাবেনি অজিত, কেবল অনর্গল লিখে গিয়েছে, নিজের মতো করে । প্রবন্ধ, ইতিহাস, রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, স্ল্যাং, যৌনতা, অজাচার এবং আরও বিভিন্ন বিষয় অভিনবত্বের বৈচিত্রের অতীব বিস্ময়কর গদ্যের স্রষ্টা এবং বাংলা গদ্যের প্রথাগত ধারা থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী গদ্য প্রযুক্তির প্রবর্তক অজিত রায় । 
    .
    অবহেলার কথা, সাহিত্যিকদের দ্বারা, নিজেই লিখে গেছে অজিত, এইভাবে, “প্রাতিষ্ঠানিক মসিহস্তীরা এমন কুচুটে হন কেন? আমেরিকা থেকে সুনীল মলয়কে থ্রেট করলেন , 'তুমি কলকাতায় কীসব কাণ্ড করছো, .... মনে রেখো কলকাতা শহরটা আমার, আমি সেখানে রাজত্ব করব।' সুনীলের বন্ধু শক্তি স্বভাবে খুব স্বার্থপর, লোভী আর থুতু-চাটা ছিলেন। সমীর রায়চৌধুরীর চাইবাসার বাসায় গিয়ে তাঁরই টাকায় মাল খেতেন, তাঁরই শালীকে লাইন মারতেন, আবার সেই মানিকজোড় সুনীলশক্তি মওকা পেলেই সমীরকে হেয় করতেন। শক্তি তো দালালি খেয়ে সমীরকে টুপি পরিয়ে বাঁশদ্রোণীর জমিটা চড়া দামে ঝেড়ে দিয়েছিলেন। এটা খোদ সমীরদাই আমাকে প্রথম আলাপের দিন বলেছিলেন। 'যোজন ভাইরাসে'র সুখ্যাতি সইতে না পেরে একবার কলকাতায় মনীশ সিংহ রায়ের বাড়িতে আড্ডা চলাকালীন মদ্যপ হয়ে হঠাৎ কমল চক্রবর্তী বিচ্ছিরিভাবে ক্ষেপে উঠলেন আমার ওপর। সে কী কুৎসিৎ গলাবাজি। এই সেদিনও কফিহাউসে রবীন্দ্র গুহ স্মৃতিচারণের মধ্যে ঘটনাটির উল্লেখ করে বললেন, 'অজিত, ওই একটি জঘন্য ঘটনার জন্য আমি কমলকে আজীবন ক্ষমা করতে পারব না।' কথায় কথায় দিল্লির কথাও বললেন রবীনদা। বললেন, 'চাণক্য সেন আর শিশিরকুমার দাশের মধ্যেও এই কুচুটেপনা লক্ষ্য করেছি।
    .
    এমনি অনেক উদাহরণ। কেন এমন হয়! চেনা মানুষ দূরে সরে যায়। ওই ঘটনার পর থেকেই বইমেলায় আমি কৌরবের স্টলে যাওয়া ছেড়ে দিই এবং ক্রমশ দূরে সরে আসি। কমলদা প্রতিষ্ঠানের কোনো কেউটে মসিহস্তী নন, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের বদরক্তের কণা তাঁর ভেইনে অবশ্যই নিবিষ্ট। বরং মলয়-কথিত 'ধান্দাবাজ' বলেই বেশির ভাগ লেখক স্বীকার করেন। কেন এই পরশ্রীকাতরতা, কিসের এত অহমিকা। এই বৈরীতা এবং অহমিকায় বহু চেনামুখ আমাদের জীবন ও পরিসর থেকে দূরে সরে যান, আমরা কেবল একার মধ্যে একা হয়ে একদিন কুট করে প্লাটফর্মের ভিখিরির মতো মরে যাই।
    .
    কিন্তু একটা কথা আমায় স্বীকার করতেই হবে, প্রতিষ্ঠানের বাইরে যাঁরা 'প্রতিষ্ঠান, এবং আরও বড়মাপের মসিহস্তী যাঁরা, যেমন সমীর, মলয়, উদয়ন, রবীন্দ্র, সুবিমল বসাক, বারীন, সুবিমল মিশ্র, অরুণেশ, নবারুণ এঁদের কাছ থেকে আমি সদাসর্বদা ভালোবাসা, স্নেহ, এমনকি শ্রদ্ধাও পেয়ে এসেছি। কেবল, এই দুই ঘাটের মাঝদরিয়ায় সন্দীপনের আমার প্রতি কি মনোভাব ছিল, সেটি পাথরচাপা রয়ে গেছে। অথবা, ভজকট। গুছিয়ে মিথ্যে বলার অসামান্য প্রতিভা যাঁদের, সহজে শনাক্তও করা যায় তাঁদের প্রকৃত মনোভাব।”
    .
    অজিত সম্পর্কে গৌতম মিত্র লিখেছেন, “সময়টা ১৯৮৬।আজ থেকে প্রায় ৩৬ বছর আগের কথা।অজিত রায় ধানবাদ থেকে আমাকে কবিতা পাঠিয়েছিলেন।বেশকিছু কবিতা।আর সঙ্গে কবিতা ভাবনা।জানিনা আর কোথাও অজিত রায়ের কবিতা ভাবনা প্রকাশিত হয়েছে কিনা!
    ঠিক সময়মতো সেই লেখা পৌঁছায়নি বলে আমার পত্রিকায় ছাপতে পারিনি।আজ এতদিন পর সেই লেখা খুঁজে পেয়ে মনে হল, যদি অজিত রায়কে নিয়ে কোনও সঙ্কলন হয়, কবিতা ভাবনা সহ কবিতাগুলো প্রকাশ করা যেতে পারে।
    কবিতা ভাবনায় লিখছেন:
    'বার বার আলবেয়ার কাম্যু-র কথাটা আবৃত্তি করতে মজা পাই, বল পাই।'
    কী সে কথা?
    'Art and rebellion will only die with the death of the last man on earth.'
    অজিত রায়ও তো নিজের জীবন ও লিখন দিয়ে এই কথাটি-ই বার বার প্রমাণিত করে গেছেন।”
    .
    ‘যুগশঙ্খ’ সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত  বাসব রায় অজিত রায়ের লেখালিখিকে বলেছেন অপর সাহিত্য এবং তাঁর বক্তব্য বেশ স্পষ্ট । তিনি লিখেছেন, “বাসব রায় লিখেছেন : অপর সাহিত্যের জয়”
    বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এবার সেন্ট জেভিয়ার্স ইউনিভার্সিটিতে পাঠ্য হলেন অজিত রায়। ধানবাদের সাহিত্যকার, শহর পত্রিকার সম্পাদক অজিত রায়কে ফেসবুকে বাংলাভাষায় যাঁরা লেখালিখি করেন, সবাই চেনেন বলেই মনে হয়। এই খবরের পাশাপাশি আরেকটি খবর এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য, তা হল, সম্প্রতি দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় পাঠক্রম থেকে বাদ দিয়েছে মহাশ্বেতা দেবী, বামা ও সুকীর্থারিণীর লেখা। মহাশ্বেতার দ্রৌপদী গল্পটি বাদ পড়েছে, যার বিষয় ছিল দলিত মহিলার ওপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। আর দলিত লেখিকাদ্বয় বামা ও সুকীর্থারিণী দেখিয়েছিলেন পুরাণের অন্য টেক্সট। মহাশ্বেতা গোটাজীবনই লিখেছিলেন প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা। বাংলায় বামপন্থীদের প্রাধান্য, গণনাট্য, স্বামী নবান্ন-খ্যাত বিজন ভট্টাচার্য, নকশাল আন্দোলন, এই সবকিছুর নির্যাসে মহাশ্বেতার লেখালিখি মেনে নিতে পাঠকের কোনো অসুবিধে হয়নি। জীবৎকালেই মহাশ্বেতা কাল্টের সম্মান পেয়েছেন। ছয় দশকের গোড়ায় যখন হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হয়েছিল বড় পত্রিকাগোষ্ঠীগুলো যেভাবেই হোক একে নস্যাৎ করতে উঠেপড়ে ঝাঁপিয়েছিল। ষাট বছর পর, আজ, হাংরি জেনারেশন-এর সাহিত্যকে আমি ‘অপর সাহিত্য’ বলতে চাই। তখন পর্যন্ত বাংলা গদ্যের ধরন যা ছিল, ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা এসে তার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিল। যৌনতাকে দেখা হল, লেখা হল বিভিন্ন দিক থেকে। বাংলা গদ্যের বিন্যাস, বিষয়, আঙ্গিক বদলে দিয়েছিল ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা।
    গল্প তো বটেই এমনকি কবিতায় ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকরা নিয়ে এলেন অন্য ভাষা, রূপক, ব্যঞ্জনা। পাঠক, আপনি প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতার পাশে ১৯৬০ পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলা কবিতা, জীবনানন্দ দাশকে বাদ দিয়ে, পড়ুন, তফাত বুঝতে পারবেন। তুষার রায়ের কবিতা আর ফাল্গুনীর গল্প পড়লেই ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকদের শক্তি বোঝা যায়। তবু এই আন্দোলন তীব্র আলোড়ন তুলেই বুদবুদে পরিণত হয়েছিল। অপর সাহিত্যকে তখনকার বিগ হাউস, প্রতিষ্ঠিত লেখক তো বটেই পাঠকরাও সাগ্রহে বরণ করেনি। কিন্তু ওই আন্দোলনের ফলে বাংলা সাহিত্যে একটা নতুন ধারা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সত্যিকারের অপর সাহিত্য।
    আজ সুব্রত সেন, রণবীর পুরকায়স্থ, জয়া গোয়ালা (যদিও মৃত), সুবিমল মিশ্র, কৌশিক সরকার, অনুপম মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ প্রহরাজ, অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়রা যে ভাষায় যে বিষয় নিয়ে লেখালিখি করেন তা হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট না-হলে আমরা পেতাম না। এবং ওই আন্দোলনই বাংলা সাহিত্যের ভূগোলকেও কিঞ্চিৎ এলোমেলো করে দিয়েছিল। যার সার্থক রূপায়ণ এখন দেখা যাচ্ছে। শুধুই কলকাতা নয়, আগরতলা, শিলচর, গুয়াহাটি, তিনসুকিয়া, শিলং, ধানবাদ, শিলিগুড়ি, মেদিনীপুর, দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্বমানের লেখালিখি। আর এই অপর সাহিত্যের সার্থক প্রতিভূ হলেন অজিত রায়। তাঁর উপন্যাসের বিষয় দেখুন, যোজন ভাইরাস ছেড়ে দিন, পড়ুন হিরণ্যরেতা, চিহ্নদখলের লড়াই, বহমান নিয়ামকের সেরেস্তা, ঘামলাঘাট...। প্রতিটি উপন্যাসেই উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা। যা অপর জীবন। অজিত রায় নিজেও অবশ্য বাংলা সাহিত্যে অপর, কলকাতা তো নয়ই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গও নয়, উঠে এসেছেন বিহার থেকে, এখন অবশ্য ঝাড়খণ্ড। তাঁর লেখা কলকাতার এলিট একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্নাতকোত্তর পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে, এই বিষয়টিকে কে কীভাবে দেখছেন জানি না, আমার কাছে এটি অপর সাহিত্যের মূলস্রোতে প্রবেশ। এবং খুব গভীরভাবে দেখলে বুঝতে পারি, আসলে অজিত রায় নয়, শেষপর্যন্ত ক্ষুধার্ত প্রজন্ম আন্দোলন স্বীকৃতি পেল। জয় হোক অজিত রায়ের।”
    .
    অজিতকে আরও জানতে হলে ফিল্ম-নির্মাতা অনিন্দ্য সেনগুপ্তকে লেখা ওর এই চিঠিটায় আছে নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা, “অনিন্দ্য দত্তকে খোলা চিঠি : প্রসঙ্গ 'বৈতরণী'
    -----------------------------------------------------------
    প্রিয় বন্ধুবর,
    এই সেদিন আলপনাদি, সাহিত্যিক আলপনা ঘোষ কথা প্রসঙ্গে বললেন, অজিত, তোমার বন্ধুভাগ্যটি দারুণ! কথাটা আমি নিজেও স্বীকার করি। না হলে, নিছক 'বন্ধু' শব্দটি নিয়ে আমার কোনো দমভারিতা থাকার কথা নয়। সেইসব বন্ধুদের বন্ধুত্বের বহর এত বড় যে সেগুলি সূচিবদ্ধ মাত্র করলে নিতান্ত উলুপীর মতো স্বার্থপরতার টইটুম্বুর মাইঠালে নৈমিত্তিক হস্তব্যসনের মধ্যে ডুবে থাকা মধ্যবিত্ত ভেতো বাঙালিদের মনে হতে পারে হয় আমি গুলধাপ্পা দিচ্ছি, নয় ঢপ্। যাই হোক, অনিন্দ্য, তুমিও যে আমার সর্বময় প্রিয় বন্ধুদের একজন, বিশ্বাস করো বা নাই, তুমি কিন্তু আমার ঐ সাতাশী জনেরই এক। মেনে নিতেই হবে এমন নয়, কিন্তু তুমি তাই। ছয় মাস বিপণ্ন ও বিপর্যয়কর জীবন যাপনের মাঝে আমি একটি শব্দও লিখতে পারিনি, এবং কয় সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন লিখতে বসি, কাগজে অথবা কম্পিউটারে, পারিনি এক বর্ণও। তবে আমি নিশ্চিত এই রাইটার্স ব্লক কাটিয়ে উঠব। কিন্তু, যেটা আরও কষ্টের, এই ছয় মাসে বহু বন্ধু তাঁদের বই, লেখার পিডিএফ, ছবি, কবিতা ইত্যাদি পাঠিয়েছেন সামান্য-কিছু মন্তব্যের আশায়, সেক্ষেত্রেও আমি প্রত্যেককে নিরাশ ও দুখী করেছি। তেমনি, অনিন্দ্য, তুমি, বহুদিন হলো তোমার পরিচালনায় তৈরি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি 'বৈতরিণী' পাঠিয়েছিলে এই উজবুককে, সেই লিংক খুলে দেখার সামান্যতম তষ্টিও আমি পাইনি। কিন্তু ইদানিং তোমার তরফ থেকে বারম্বার ধমক, শব্দফেরে খোঁচা খেয়ে-খেয়ে, আর-না-পেরে, শেষমেশ ছবিটি দেখেই ফেললাম। না বললেও, তুমি অন্তত জানো, সিনেমা দেখার ব্যাপারে, মানে দর্শক হিশেবে আমি একজন উচ্চ পর্যায়ের নির্বোধ। তবু, তাকেও তুমি রাজার এই পাট দিয়েছো। বেশ। তাহলে দু-চার কথায় আমার বিশ্লেষণ সারি। মিথ্যে না-বলে বলি, আমি তোমার কিছু লেখা অবশ্যই পড়েছি, 'শহরে'ও বেশ কয়েকটি লেখা তুমি লিখেছো, কিন্তু পরিচালক হিশেবে তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় এই প্রথম। তোমার প্রকৃত এরিনা, অর্থাৎ সিনেমা, সেখানে তোমার পক্ষীচক্ষু ভেদ করার কেরদানিটিও এই প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। তা বলে, গোড়াতেই একশো দিয়ে দিলাম তা মনে করার কারণ নেই। বরং, ছবিটির শেষ সীনটা না-আসা অবধি লাগাতার আয়ুধই জমা হচ্ছিল মনে। তারপর, ক্রমে-ক্রমে আবিষ্কার করলাম, বুদ্ধিজীবী বাঙালির প্রাত্যহিক ডামাডোল, হতাশা, নিরাশা, বাঁচাহীনতার এঁড়েল স্তূপ থেকে ক্রমে ক্রমে পাখিরূপী অপরূপ এক কবিতা উঠে আসছে নিরান্দীয় ধুলো ঝেড়ে। এ ধরনের ছবি পুরোটাই একটি কবিতা হয়ে উঠতে পারে, গল্প তো হয়েই ওঠে। কিন্তু তুমি সেই কবিতা, কিংবা ঐ একখণ্ড গল্পের সলতেটুকু পাকিয়ে জীবনমুখী এক দেউটি জ্বালালে, পরিচালক অনিন্দ্য দত্ত। অতি কম সাধ্যে, হৃদের সাধ-মাত্র-দিয়ে, স্বল্প দৈর্ঘ্যে বৃহত্তর জীবনের বার্তা হয়ে উঠল বৈতরণী। আরও সূক্ষ্মভাবে বললে, একটি নির্বীয়মান শিখার ধিমি-ধিমি বেঁচে ওঠার কবিতা হয়ে উঠল তোমার এই 'বৈতরণী'। জানি, এক্ষেত্রে অনেকেই অনেকের নাম নেবেন, বিশেষত ফেলিনি; বাংলাও হয়ত কবিতাশ্রয়ী বেশ কিছু ছবির নাম উঠে আসবে, কিন্তু আমি আমার দেখা দুটি ছবির কথাই এখানে উল্লেখ করবো ---- অপর্ণা সেনের 'থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন', এবং, শর্মী পান্ডের 'এবং ফলগুনী'। হ্যাঁ, অন্তত বাংলায়, 'বৈতরণী' সেই পর্যায়েরই এক নির্মাণ। কবিতা যে সৃষ্টিশীল মানুষের এত কাছের, বরং, এত গভীরের, এই ছবি তাই বোধ করিয়ে দিল এই নির্বোধকে। আবার বলছি, ছবিটির লিংক বহুদিন আগেই পাঠিয়েছিলে অনিন্দ্য, দেখার গা হয়নি, যেহেতু মূল চরিত্রে সৌমিত্র। না, ভুল লিখলাম না। বিগত দশ-পনেরো বছর ধরে সৌমিত্রবাবুর যে-কটি ছবি দেখেছি, অভিনয়ে সুদক্ষ তিনি তবু তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্ব তাঁর আলাদা-আলাদা চরিত্রগুলির সম্যক ফুটে ওঠার ক্ষেত্রে বাধ সেধেছে। এটা একান্তই এই অধমের ব্যক্তিগত অনুগাম, পাত্তা দিও না বিশেষ। যাই হোক, ঐ প্রখর ব্যক্তিত্ব এবং তাঁর বার্ধক্যজনিত একই প্যাটার্নের অভিনয়ের পৌনঃপুনিকতার কারণেই, সম্ভবত, গোড়ার দিকে তোমার এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছবিটির প্রতি আমি কোনো আকর্ষণ ঘটেনি। এত দীর্ঘ ব্যবধানে, কেবলমাত্র বন্ধুর বারম্বার ঠেলা ও খোঁচায় শেষমেশ দেখা হয়ে গেল। ছবি দেখার ব্যাপারে আমি যে সত্যিই মিসফিট, বলার অপেক্ষা রাখে না, কিন্তু একজন সৃষ্টিশীল মানুষের চোখ আমি ধারণ করি। যে কারণে বেশ কিছু উন্নতমানের ছবি আমায় আজও লেখায় উদ্দীপিত করে। তোমার ছবির কম বাজেট এবং অল্পদৈর্ঘ্যতা অবশ্যই মাথায় ছিল, কিন্তু আমি সারাক্ষণই ভাবছিলাম কোথাও কোনোভাবে যেন ছবির কয়েকটি অংশ-অন্তত অংশত ভালো লেগে যাক, যেহেতু তুমি মধ্যখানে। হুজুর, জানাইয়া ফেলি, আমি ভ্রষ্টবুদ্ধি নহি, কালেচক্রে নিজ বাপকেও খিস্তি করিতে পারি। খিস্তির প্রচুর আঁওবাঁও খুজলাম, পেয়েছিও কিছু কিছু। যেমন, প্রথম দৃশ্যে মনেই হলো না বৃদ্ধ নিস্তেজ কবি সৌগত রায়চৌধুরী এন্ট্রি নিলেন, যিনি এলেন, তিনি প্রত্যহ টিভির স্ক্রিনে সেই একই ভাবে আসেন, আসতেন। সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল প্রাথমিক দৃষ্টে। এছাড়া, তুমি হয়ত অন্যভাবে ভেবেছিলে, কিন্তু যা হয়ে উঠেছে, এখানে ভৌতিক গল্পের অনুষঙ্গ হয়ত আছে, কিন্তু ব্যবহারে তা মার খেয়েছে। পরে বুঝলাম এটি আদৌ কোনো অকালমৃতা বালিকার মিথ বা বৈতরণী পার হবার কাহিনীই নয়, এ আসলে লাটভাঙা থাম থেকে খসে বেরিয়ে আসা ন্যাতপেতে, বিদ্ধস্ত ও বিষণ্ণ এক বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবীর ইগোর পরাজয়, এমনকি 'মৃত্যু'-ভয় ও হাহাকারের বস্তুবিসার। পরিচালক হিশেবে এক্ষেত্রে তুমি যথার্থই সার্থক। লেন্সের ভাষায় কোনো চমক নেই, কিন্তু রয়েছে এক সুদক্ষ মুনশিয়ানা। সৌগত রায়চৌধুরীর মূক অসহায়তা বিমূর্ত ভাস্কর্যে লীন হয়ে মানিপ্লান্টের মতো ডালপাত সমেত চারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অলিন্দের রুদ্ধ প্রকোষ্ঠে। আর ম্যাজিক রিয়ালিজমের কতিপয় দুরন্ত শট। সব মিলিয়ে তোমার বৈতরিণী শিল্পের ওপারের ঘাট ছুঁয়ে ফেলেছে। যদি পারো, অনিন্দ্য, নির্বোধ বন্ধুর এই অপারক রিভিউ হজম করো। বাকি তো রইলই, মুষ্টিফোনে বাকযুদ্ধ।”
    .
    অ্যালেন গিন্সবার্গ সম্পর্কে অজিতের এই গদ্যে বস্তুত অজিত রায়কেই আমরা খুঁজে পাই, “বন্ধুবর বাসব রায় পর-পর তাঁর দুটি পোস্টে জামিল, মলয় এবং বিশেষত গিন্সবার্গের জিগির তুলে আমায় উস্কে দিলেন কিছু লিখতে, বিশেষত সেই গিন্সবার্গ বিষয়ে। যদি বলি মার্কিন দেশের যীশু অ্যালেন গিন্সবার্গ, অতিরেক হলো কি? বুদ্ধের আবির্ভাবের মতোই আশ্চর্য কবিতাক্ষেত্রে তাঁর আগমন। আশ্চর্য, কেননা তিনি জন্মেছিলেন ---- তৃতীয় বিশ্বের কোন খোঁড়া দেশে নয়, ---- আমেরিকায়। এরিস্টটল থেকে এ অব্দি 'কাব্যাত্মক ন্যায়' নিয়ে বড়ফড়াঙ্গি চলে আসছে, কেউ কি ভেবেছেন সাহিত্য-ব্যাপারে একটা 'অন্যায়'ও দগদগ করে পাশাপাশি? যাঁরা গেঁতো, 'স্থা'-বাসী, তাঁরা কিছুতেই কবুল করেন না যে সমাজের সর্বস্থানে যেরকম অশুভ ও অশুদ্ধতা চলছে, সেখানে সাহিত্যেও আর 'শুভ' বা 'শুদ্ধতা' আশা করা যায় না। বাসববাবু ঠিকই বলেছেন, যাঁরা আজ সত্যিকারের সৃষ্টিশীল সাহিত্য করছেন, খেয়াল করবেন শব্দের ব্যবহার, ডিসকোর্স, সংকেত, প্রতীক, চিত্রকল্পে তাঁরা আমূল-চুল বদল ঘটিয়ে ফেলেছেন, বা তাঁরা সেই বদলের পক্ষপাতি। এই যে স্থা-বিরোধিতা, বা প্রতিষ্ঠানবিরুদ্ধতা, এটা আসলে একটা আবহমান লড়াই। 'যা চলছে' আর 'যা হওয়া উচিত'-এর নিরন্তর নিরলস সংগ্রাম। যা খদ্দরী প্রজাতন্ত্র, খাঁকি মিলিটারিতন্ত্র, লাল-কম্যুনিস্টতন্ত্র বা তিমূলতন্ত্রের কাছে তুমুল অবাঞ্ছিত ও তিরস্কৃত ধ্বনি। আর সেখানে, সেই ওয়াশিংটনের কথাই বলছি, কবিতা নয় ---- রয়েছে একটা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক বেনিয়া কনসেপশন, যা বিশ্ব-রাজনীতিকে জমা-খরচের নিক্তিতে পরখ করে বাজারে ছাড়ে। সম্ভবত এই কারণেই আমেরিকা ভালো কবিকে জন্ম দিয়েছে খুব কম। ওয়ালেস স্টিউইংসের দেহরক্ষার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর লেখনজগতে একা গিন্সবার্গই সেই বিরল অস্তিত্ব, 'হাউল'-সূত্রে বারংবার উচ্চারিত যাঁর নাম।
    .
    মহাকবি গিন্সবার্গ সম্পর্কে প্রথম পড়ি মলয় রায়চৌধুরীর বদান্যে। অতঃপর আমার জেএনইউ-প্রোডাক্ট সাংবাদিক বন্ধু পলাশ বিশ্বাসের মুখে, বিশদে। জানতে পারি, প্রতিভাবান, মেধাস্পৃহ এই হীরে বাঙালির জ্ঞানের আলোয় আসেন, তাঁর উত্তরণের যখন সবে হাতেখড়ি, প্রায় তার সমসময়ে। প্রায় আড়াই দশক ধরে তাঁর সঙ্গে বাঙালির সবিমুগ্ধ আলাপচারিতা। বহির্বিশ্বে একমাত্র বাঙালিকেই তিনি পেয়েছিলেন একান্ত আপন করে। অনেক বসন্ত দেখেছিল বাঙালি তাঁর পাশাপাশি ---- বন্ধুত্বের অনাবিল আনন্দে।
    .
    বাঙালির খ্যাপামিই সেই অমোঘ সূত্র-রজ্জু যে-কারণে গিন্সবার্গকে বাঙালি টানতে পেরেছিল। পাগলামি বা খ্যাপামি বাঙালির মজ্জাগত। জীবনের প্রত্যেক অংশে প্রত্যেক বাঙালিই কোনো না কোনভাবে আকুলতায় জড়িয়ে আছে। এই পাগলামি আসলে সেই সাধনা সেই সব্বনেশে প্রেম সেই প্যাশন যা এক সৃষ্টির থেকে আরেক সৃষ্টির পানে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় রবীন্দ্রনাথকে, এক আরম্ভের থেকে আরেক আরম্ভের দিকে ছোটায় বিনয় মজুমদারকে, এক মানুষের থেকে আরেক মানুষের দিকে ঠেলে দেয় ঠাকুর রামকৃষ্ণকে। বাঙালির বেঁচে থাকার অবলম্বনই এই পাগলামি। ইন্টার-ডিসিপ্লিনারির চতুরন্ত টপকে বাঙালি এখন সারা বিশ্বের উঠোন দাপাচ্ছে। রাজনীতি, খেলার মাঠ, সাহিত্য, সিনেমা, গান, বইমেলা, লিটল ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা, চতুর্দিকে বাঙালির ধুমা অ্যাটাক। সর্বত্র তার বুম্বাচাক! থিওরি অব কেঅস। যুক্তিভাঙার নেশামাত্রে মন মানছে না বাঙালির। এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে খাই। হয়ে যাক পাগলামির নতুন দখলতি। হুররে!
    .
    মার্কিন খ্যাপাদের সূচি শুরু হয়েছে সম্ভবত গিন্সবার্গের নাম দিয়ে। কী খ্যাপামিতে কী কবিত্বে তাঁর আমোঘতা পরম নিন্দুকেও স্বীকার করেন। শরৎ মুখোপাধ্যায় লিখছেন, "একদিন খবর পাওয়া গেল, দু'জন আমেরিকান কবি কলকাতায় এসেছে। .... গিয়ে দেখি, প্রায় আসবাবহীন একখানা ঘরে দু'জন সাহেব এসেছে সত্যি। তাদের একজন থুপথুপ করে কাপড় কাচছে কলঘরে, অন্যজন ছুরিতে তরিতরকারি কুটছে। পরনে আন্ডারওয়্যার, খালি গা ....।" ইনিই অ্যালেন গিন্সবার্গ। নামটির সঙ্গে ল্যাজেমুড়ে জুড়ে রয়েছে 'বিট' কথাটা। ভিড়ের মধ্যেও বিটবংশকে শনাক্ত করা দুষ্কর নয়। "মেয়েরা পরে কালো মোজা, লম্বা চুল রাখে, লিপস্টিক মাখে না, আর পুরুষেরা রাখে দাড়ি আর ঘাড় বেয়ে নামা লম্বা চুল, তীব্রতম শীত ছাড়া টুপি কিংবা ওভারকোট পরে না; জামা জুতো বা দেহের পরিছন্নতা-সাধন তাদের হিসেবে অনাচার।" (বুদ্ধদেব বসু) এই বংশের আদি কবি জ্যাক কেরুয়াক। অ্যালেনের, অর্থাৎ কেরুয়াকের পরেই যাঁর স্থান এবং যিনি এই উন্মুখর আন্দোলনের স্রষ্টা, তিনি মোটেও লম্বা ছিলেন না, বরং যথেষ্টই বেঁটের দিকে, ছিপছিপে শরীর, গায়ের কালার হলদে ঘেঁষা ম্লান, চোখে চশমা, নেহাৎ 'ভদ্রলোকে'র মতোই দাড়িগোঁফ কামানো, পরিষ্কার সিঁথি-কাটা চুল কিন্তু মাথা নোয়ালে অল্প টাক। অর্থাৎ চেহারায় শাস্ত্রসম্মত লক্ষণ একটিও নেই, যদিও পালিশহীন জুতো, ইস্ত্রিহীন প্যান্ট আর গলা-খোলা কোর্তায় গোষ্ঠি-চেতনার ছাপ স্পষ্ট। ---- এই হলেন অ্যালেন গিন্সবার্গ।
    .
    কিন্তু একটা কথা। গিন্সের সঙ্গে 'বিট' লেবেলটা সাঁটা থাকলেও, তিনি কিন্তু একেবারে আলাদা খাতের কবি। কোন নির্দিষ্ট খেপের মোহর দেগে তাঁকে চালানো যায় না। গিন্সবার্গের শেষ দিকের কবিতাগুলো দেখলে মনে হবে তিনি বিট কবিই নন, বরং আপাত বিটতন্ত্র-বিরোধী। আসলে, একটা 'হুজুগ' হিশেবে সূচনা ঘটেছিল বিট-আন্দোলনের। এবং ফেরলিংগোট্টি থেকে শুরু করে কেরুয়াক, গিন্সবার্গ এবং গ্রেগরি করসো প্রমুখ ব্যতিরেকেও হাঙ্গামার কাল জুড়ে ছিলেন কামিংস, মিলার, নরমান, গুডম্যান প্রমুখ। আন্দোলন ষাট দশকের পয়লাভাগে ছড়িয়ে পড়েছিল বার্লিন, পারি, কোপেনহেগেন প্রভৃতিতে। এবং যদি বলা বেশি না ঠেকে, বলতে পারি, তারই একটা ঢেউ গিন্সবার্গ ও তাঁর সগোত্ররা এনে আছড়েছিলেন বাংলা কবিতার তটভূমিতে, হাংরি আন্দোলন যার অনিবার্য বাই-প্রোডাক্ট। যাই হোক, এখানে বলার কথা, বিট-আদর্শ ও বিট-ধর্মের মিল কোন-কোন ক্ষেত্রে, গিন্সবার্গের কবিতায়, নেই-ই। গিন্স শেষবয়সে বুঝেছিলেন, হিটলার ব'নে পুরো গ্লোবটাকে দাপানো সহজ, কিন্তু 'আজ' (সেই বিশ শতকের শেষপাদে) 'রিভোল্ট' করে সফল হবার সুযোগ নেই। তাই, বিট পোয়েট্রি বলতেই যে দুরন্ত বেলাগাম গতির কথা মনে পড়ে, যিনি খোদ বিট আন্দোলনকে এইভাবে পরিচিত করেছিলেন এবং হাঙ্গামাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ---- সেই গিন্সবার্গের দুরন্ত প্রবহমান জীবনস্রোতের মধ্যবর্তী বিন্দুতে দণ্ডায়মান থেকেও, শেষাবধি মনে হয়েছে :
    "... all movement stops
    and I walk in the timeless sadness of existence,
    Tenderness flowing three the buildings
    My fingertips touch reality's face."
    .
    গিন্সবার্গ ছিলেন রাজনীতিক চেতনার মানুষ। এবং সেক্ষেত্রে কোনরকম আপোষের তেল গায়ে মাখেন নি। তাঁর সাফ কথা : "রাজনীতির কর্কশা ছবির মধ্যে কোথাও না কোথাও তার একটা মুদ্রা এমন আছেই, যেখানে স্রেফ কবিতা, কবিতা আর কবিতাই কামান দাগতে পারে।" এই চেতনা থেকেই তিনি, মার্কিন গবরমেন্টের বিখ্যাত কাস্টমস বিল্ডিংয়ের বলতে গেলে পাশেই অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের সভাগারে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে পাঠ করেন তাঁর কবিতা :
    "স্বর্গ যদি হয় তবে ঠিক এইরকম ---
    উচ্চ আদালতে থাকবে না কোন বুদ্ধ
    না রিপাবলিকান, না ডেমোক্র্যাট ..."
    .
    মৃত্যুর আগে একদশক তিনি কবিতায় টার্গেট করেছিলেন হোয়াইট হাউসকে। সেই হোয়াইট হাউস, যেখানে রয়েছে সিআইএ-র বাজেট, জার্মান মাথাব্যথা, সৈন্যদের লুকোনো দূরভাষী যন্ত্র আর এফবিআই-এর ছারপোকা। আমেরিকান শাসনতন্ত্রের গুঁজে দেয়া পিলপিলে বিষয়টাকে 'রাবণ' ঘোষণা করে আমেরিকান প্রয়াসকে নাম দিয়েছিলেন 'রেগনের থিইস্টিক প্যারোনিয়া'। এহেন সাহস আর কোনও আমেরিকান কবির ছিল কি?
    .
    বিদ্রোহ করেছিলেন গিন্সবার্গ, কিন্তু বিদ্রোহই তাঁকে 'প্রতিষ্ঠিত' করে ফেলল। লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে 'হাউলে'র। আড়াইশোর বেশি ডলার ঢুকেছে ফি মাসে, তাঁর পকেটে। এখনো 'বিদ্রোহী' বলা যাবে কি তাঁকে? অথচ তিনি আজও আমাদের নমস্য। নমস্য ও শ্রদ্ধেয় তাঁর অনন্য মানব-কবিতার কারণে। এই সেই কবি যিনি শোনাতে পারেন :
    "I saw the best minds of my generation destroyed
    by madness, starving hysterical naked." (Howl)
    .
    "A bitter cold winter night
    Conspirators at cafe tables
    discussing mystic jails."
    (Planet News)
    .
    হিরোশিমা-নাগাসাকিতে অ্যাটম বম্ব ফাবড়ানো হলে তিনি কি 'গান্ধীবাবা'র ভূমিকায় নেমেছিলেন? যদ্দূর শুনেছি, তিনি তখন থেকেই 'হোলিম্যান'। এমনিতে মার্কিন দেশে হোলিম্যান হওয়াটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। তামাম কলপূর্যা তো তেনাদেরই হাতে। ওঁরা সেই 'পাওয়া' আর 'ভোগে'র যথেচ্ছাচার থেকে রেহাই পেতে হোলিম্যান হতেই পারেন। কিন্তু না, অ্যালেন ওঁদের দলে নন। 'রিয়ালিটি স্যান্ডউইচেস' (১৯৬৩) থেকে শুরু করে হারপার অ্যান্ড রো প্রকাশিত তাঁর '৪৭ থেকে '৮০ সন অব্দি লেখা তাঁর সমস্ত কবিতা সংগ্ৰহ, তাঁর জার্নাল, চিঠিপত্র আর ক্যাসেটবন্দী সাক্ষাৎকার অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে শাস্ত্রীয় সভাগারে তাঁর মত ব্রাত্যজন জন্মেছেন খুব কমই।
    .
    বুদ্ধ, চৈতন্য আর রামকৃষ্ণর ভারতভূমিতে বাষট্টি সাল নাগাদ অ্যালেন, তাঁর বন্ধু পিটার অৱলভস্কিকে সঙ্গে নিয়ে, 'ঈশ্বর' খুঁজতে আসেননি। অধিকন্তু, এই ভাষাদেশের মরচে পড়া মানুষগুলোকে একটু চনমনিয়ে দেবার ঘোর সদিচ্ছা নিমতলা শ্মশানঘাট, খালাসিটোলা, চাইবাসা আর কাশীর পথে ঘাটে মাঠে ঘুরিয়ে মেরেছে তাঁকে। একটা কিছু গড়ে তোলার ছটফটানি তাঁকে তিষ্টতে দেয়নি একদণ্ডও। মানুষের জীবনটা দিশা না পেয়ে পুরো ভগ্নস্তূপে বদলে যাওয়ার আগেই তিনি সেটা চাইছিলেন। এটাও স্বীকার করা ভালো, যে, অ্যালেন বা বিট মানেই 'তছনছ' 'ডিস্টার্ব' 'ডেস্ট্রয়' বা 'নিছক যৌনতা' নয়। কেননা তিনি জানতেন কামশাস্ত্র-কোকশাস্ত্র সহ বাংলা ভাষায় বহু সুড়সুড়িবিদ প্রাতিষ্ঠানিক লেখকদের বইয়ের গরুর গাড়ি বোঝাই সংস্করণ বাজারে গিজগিজ করছে। তিনি যে সম্পূৰ্ণ ভিন্ন ঝড় বইয়ে দিতে চেয়েছিলেন ---- 'হাউল' তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
    .
    এখানে পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই 'কৃত্তিবাসে'র সেই সংখ্যাটা (১৯৬৩, মার্চ), গিন্সবার্গের তোলা একটি ফোটোগ্রাফ ব্লক করে ছাপা হয়েছিল যাতে। ছবিটা অ্যালেনের শুধু হাত নয়, চোখ মাত্র নয়, মনেরও যুৎসই ছাপ ফুটে উঠেছিল। দোমড়ানো জীর্ণ একটি ফ্রকপরা মেয়ের ---- যাকে নিয়ে ব্যবসা চালানো হচ্ছে ---- আধশোয়া আধন্যাংটো ছবি। কভারে বোল্ড হরফে 'কৃত্তিবাস' এমত ঘোষণা করতে পেছপা হয়নি, যে, "তীব্র উদাসীন উন্মত্ত ধীমান ক্রুদ্ধ সম্ভ্রান্ত ক্ষুধার্ত শান্ত বীটনিক ভয়ংকর মগ্ন চতুর সৎ ভূতগ্রস্ত ধার্মিক ও অতৃপ্ত কবিদের ব্যক্তিগত রচনা, কবিতা ও বিস্ফোরণ।" বলা বেশি, ওই সংকলনেই কৃত্তিবাসের লেখক-কবিরা পহেলি-বার, যাকে বলে, মুখ খুললেন। মুখ খোলালেন মহাকবি অ্যালেন গিন্সবার্গ ।”
    .
    একবার অজিত রায়কে জিগ্যেস করেছিলুম, “"অজিত, একটা কথা জানবার ছিল । নারীর যৌনতা নিয়ে লেখার সময়ে তুমি কি তার প্রেমে পড়ো ? এমন হয়েছে কি, যে লিঙ্গ দাঁড়িয়ে গেছে?"
    তার উত্তরে অজিত জানিয়েছিল, “প্রশ্নটা আমার কাছে মোটেই অস্বস্তিকর ছিল না। জবাবে লিখেছিলাম, মলয়দা, তুমি ভদ্দরলোকদের মতো 'লিঙ্গ' লিখেছো কেন? 'বাণ্ড' বললে কিচাইন হবার চান্স বলে আমি সরাসরি নিজের ভাষায় নামি। 'বাঁড়া' সহজবোধ্য, স্বয়ংসিদ্ধ ও সর্বত্রগামী শব্দ। আধুনিক বিশ্বকোষ প্রণেতা বাঁড়ার নামকরণ করেছেন 'আনন্দদণ্ড'। নামটা খাসা। তবে, অনেকে বলবেন 'মদনদণ্ড'। 'সাধনদণ্ড' বলেও সুখ। কিংবা 'কানাই বাঁশি'। কলকাতার রকফেলার আর হাফ-লিটারেট গবেষকরাও এই যন্তরটিকে নিয়ে কম মেহনত করেননি। 'কলা' 'ডাণ্ডা' 'রড' 'কেউটে' 'ঢোঁড়সাপ' 'পিস্তল' 'যন্তর' 'ল্যাওড়া' 'ল্যাও' 'লাঁড়' 'লন্ড' 'মেশিন গান' 'মটনরোল' 'ঘন্টা' 'ঢেন্ঢেন্পাদ' 'খোকা' 'খোকার বাপ' 'ধন' ' নঙ্কু' 'পাইপ' 'তবিল' 'পেনসিল' 'ফাউন্টেন পেন' 'মেন পয়েন্ট' ---- আরও কী কী সব নাম দিয়েছেন ওই প্রতাপী মহাপ্রাণীকে সদা উজ্জীবিত রাখতে! বিহার-ঝাড়খণ্ড-ইউপিতে 'ল্ওড়া' আর 'লন্ড' সুপার কোয়ালিটির স্ল্যাং, যা পূর্ব ভারতের সর্বত্র একই কিংবা খানিক বিকৃত উচ্চারণে ব্যবহার হয়ে থাকে। বাঙালি জবানে সেটা হয়েছে মিনমিনে 'ল্যাওড়া' 'ল্যাউড়া' 'ল্যাও' আর 'লাঁড়'। কিন্তু বাংলার নিখাদ 'বাঁড়া' বিহারে বোঝে না, পাত্তাও পায় না। ওপার বাঙলায়ও সর্বত্র বোঝে কি? ডাউট আছে। খোদ বর্ধমান আর বীরভূমেই বাঁড়াকে বলে 'বানা'। কুমিল্লায় ধনকে বলে 'দন'। কুমিল্লা, ঢাকা আর খুলনায় 'চ্যাট' শব্দটাও চলে। ময়মনসিংহে যেটা হয়েছে 'চ্যাম'। সিলেটেও 'চ্যাম'। সিলেটে আবার 'বটই'ও বলে। বাকরগঞ্জে 'চ্যাড' 'ভোচা'। বাকরগঞ্জের মোক্ষম স্ল্যাং হলো 'মদন কল'। 'ভোঁচান' আর 'ভুন' বলে রাজশাহীতে। এছাড়া রয়েছে 'ভুন্দু' 'ভুচা'। 'বিচা' বলে ঢাকা, কুমিল্লায়। কুমিল্লায় ফের 'শোল'ও বলে। বলে, 'নসকা'। 'সাঁও' বলে ফরিদপুরে, ময়মনসিংহে। 'প্যাল' আর 'বগা' চলে ময়মনসিংহ, রাজশাহী আর সিলেটে। চাঁটগেঁয়েরা বলে 'ফোডা'। যশোরের 'পাউন্ড' এসেছে খুবসম্ভব 'পিণ্ড' থেকে। 'বাচ্চা' বলে পাবনায়। 'পক্কি' চলে খুলনা, ফরিদপুর আর ময়মনসিংহে। 'পক্কু' শিশুদের শিশ্ন, এ-বঙ্গে যেটা 'নোঙ্কু' ব 'চেনকু' কিংবা ঝুটমুট 'পক'। ময়মনসিংহে বাঁড়ার অপর নাম 'থুরি'। আরেকটা প্রতিশব্দ 'শুনা' কুমিল্লায় চল আছে। চট্টগ্রাম আর নোয়াখালিতে বলে 'সনা'। আসলে, 'সোনা'। কেউ কেউ বলে সোনা, সোনামণি। মদনার বউটা ভোরবেলা আদর করে টুলস দিত, --- ও জামাই, ওঠো, জাগো। শ্বশুরবাড়ি যাবা না? শ্বশুরবাড়ি ছিল ওর ওইটে, আর জামাই ছিল মদনের এইটে। শ্বশুরবাড়ি ভোগে গ্যাচে, ফলে এ ব্যাটা হামানচোদা জামাই এখন ঢোঁড়সাপ হয়ে স্রেফ জাবর কেটেই খালাস। 'জাবর কাটা' বোজো তো? একষট্টি-বাষট্টি। মানে, খুচরো গোনা।। মানে, হাতলেত্তি। মানে হ্যান্ডেল করা। সকলেই নাকি করে। মদনাই বলছিল, 'মেয়েরা আঙুল করে, শুনিচি বেগুনও করে।' সত্তিমিত্তে জানিনে বাপু।ভালো কথা। আরও একটা শব্দ যোগ করি। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা মলয়দার এই 'লিঙ্গ'কে বলে 'লিকাম'।তো খালিপিলি এই লিকাম লইয়া পুরুষ কী করিবে? লিখিবেই বা কেন, আঁকিবেই বা কোন আহ্লাদে! ব্যাংক তাহার অচল যদি তার বাঁড়ার উপযুক্ত একটি পার্স না থাকে। বলছি, যেহেতু, বলছি আমাদের চালুচরকি সমাজের দিকে একপাক ঘুরে তাকাও, হালিতেই চোখে পড়বে যৌনতা। এ সমাজে যৌনতা মানে কিন্তু নারীক্ষেত্র। পুরুষ গৌণ। বেচছে ছাতু, দেখাচ্ছে নারীর বক্ষপট। পটকা, টিভি, মোবাইল, ভটভটির কথা না-হয় ছেড়েই দাও, ----- অপথ্যপথটি বাদে সেখানে নারীদেহের সব পার্টসই হাজির। বলে রাখি তোমায়, তুমি জানো, আমার সমস্ত উপন্যাসেই 'নারী' পুরুষের ইন্টেলেক্ট থেকে আঁকা। কিন্তু একজন বখাটে খানাখারাব হলে কি নারীদেহের মহার্ঘ পার্টসগুলোকে আমি অন্য চোখে দেখতাম? হয়ত, একদমই না। এ ব্যাপারে ভদ্দরলোক বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা। মাথার শিরোজ থেকে গোড়ের পদরজ, একটা হোলদামড়ি নারীর কী-ই না ভাল্লাগতো কালিদাসের! তবে আমার-মতো উনি কতখানি সাধুলোক ছিলেন, খটকা আছে। সাধুমণ্ডলে নারীর অষ্টোত্তর শতনাম। শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী ----- এসব তো মানুষের নিজস্ব এলেমে হয়নি, খোদ বিশ্বকর্তা নিজের হাতে গড়ে দিয়েছেন। ফের এদের মধ্যে শঙ্খিনী আর পদ্মিনী হলো 'আইটেম' বিশেষ। তেনার 'অন্তিমের মার'ও বলতে পারো। একা তুমি কেন, বাইবেলেও বলেছে, নারীই বিধাতার শেষ সৃষ্টি। 'হে শুভদর্শনা', অশোক ফরেস্টে সীতাকে দেখে রাবণ কেলিয়ে গিয়ে বলছেন, 'আমার মনে হয় রূপকর্তা বিশ্বনির্মাতা তোমায় রচনা করেই নিবৃত্ত হয়েছেন, তাই তোমার রূপের আর উপমা নেই।' অথবা, ঈভার প্রতি মিল্টন : 'ও ফেয়ারেস্ট অফ ক্রিয়েশন, লাস্ট অ্যান্ড বেস্ট / অফ অল গড'স ওয়র্কস'।
    বাংলা সাহিত্যেও নারীর উপমা যে একেবারেই নেই, সেটা বললে বাওয়াল হবে। তবে আমি আমার কথাই বলব। 'যোজন ভাইরাসে' কমল রানীর বুকে কান পেতে শুনেছে সমুদ্রের কলকল। নারী সমুদ্র ছাড়া আর কী, বলো! হোক নোনা। কিন্তু নোনা থেকেই লোনা। লোনা থেকে লবণ। লবণ থেকে লাবণ্য। কত নুন খেয়েছো রানী! সব নুন কি তোমার দেহে? আর খেয়ো না। এতে সৌন্দর্য হারায়। অবিকগুলি খসে-খসে সহসা খোয়ায়। সত্যি, এক বিশাল মহাযোনি পয়োধি এই নারী। আর পুরুষ কেসটা হলো, অই উষ্ণু মাংসল অলীক পাথার-কিনারে বাল্বের ছেঁড়া ফিলামেন্টের মতো অধীর কাঁপুনি সহ দাঁড়িয়ে থাকা পৌনে ছ'ফুট লম্বা একটা হাইটেন্ডেড ও ব্যবায়ী পুরুষাঙ্গ মাত্র। মাইরি একটা কথা কী জানো, খুব কৈশোর থেকে একজন পুরুষ তার যৌন-অহংকার নিয়ে তিল-তিল করে গড়ে ওঠে, স্রেফ, একজন নারীকে জয় করবে বলে। কিন্তু সে কি সেই কাঙ্খিত নারীকে পায়! পরিবর্তে যাকে পায়, তারও তল পায় না। কী যে চায় মৃণা, মহা ধাঁধা। একেক সময় মনে হয়, কী যেন খুঁজছে, অবিরত। ওফ, টস করেও বোঝা দায় এই মেয়ে জাতটাকে। একেক সময় খটকা জাগে,নারী এক হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক শিল্প। নারী মৃত্যুর বিজ্ঞান। ডেথোলজি। আচ্ছা, এ নারী কে? এ দিনে এক, রাতে আরেক! এ নারীকে সত্যিই আমি চিনি না। পরিচিত দায়রার যথেচ্ছ-নারীর কাছে কোনোকালেই বিশেষ যাচনা ছিল না আমার। আমি এমন নারী খুঁজিনি যে শুধু ঘুমোতে আগ্রহী বা গামলা-ভরা খাদ্যে। নারীকে নারীর মুখ বা নারীর চোখ মাত্র আলাদা করে চাইনি, কেবলি। চেয়েছি টরসো মূর্ধা সৃক্ক নোলা কল্লা সিনা রাং নিতম্ব পয়োধর নাভি যোনি নবদ্বার সম্বলিত একটি পূর্ণাবয়ব নারী, যাকে স্পর্শ মাত্রের লহমা থেকে শব্দের স্রোত ধেয়ে আসবে বেবাক এবং প্রতিরোধহীন। স্ব-পরিচয়হীনা, জন্মহীনা, ইতিহাসহীনা, নিয়তিহীনা সেরকম কোনও নারী আজও আমার উপজ্ঞার বাইরে রয়ে গেছে। দ্য বেস্ট রিলেশান বিটুইন আ ম্যান অ্যান্ড আ উওম্যান ইজ দ্যাট অফ দ্য মার্ডারার অ্যান্ড দ্য মার্ডারড। দস্তয়ভস্কির কথাটাই কি তবে মোক্ষম? নারী পুরুষকে হালাল করবে, তার আগেই নারী বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত-সব বাহারি শব্দঘোঁটের বিছেহার জোর করে লাথিয়ে ভেঙে ফেলা দরকার যদ্বারা উদ্ঘাটিত হবে নারীর মৌল স্বরূপ।
    খামোখা টেনশন নিও না। এটা, এই পুরুষ-সিস্টেমে স্বাভাবিক ব্যাপার। সিস্টেমটা যেহেতু পুরুষের, নারী হাজার বোল্ড হয়েও পুরুষের মতো নিজের কয়টাস চিরোতে পারে না। মানুষের সেক্সউয়াল ইন্টারকোর্স, বা কয়টাস, একটা খাড়া শিশ্নের যোনিতে প্রবেশ মাত্র নয়। সঙ্গমের ব্রড ডেফিনিশন হল, দা ইনসারশন অফ এ বাঁড়া ইনটু অ্যান অরাল, অ্যানাল, অর ভ্যাজাইনাল ওপেনিং, অ্যান্ড এ ওয়াইড ভ্যারাইটি অফ বিহেভিয়ার্স দ্যাট মে অর মে নট ইনক্লুড পেনিট্রেশন, ইনক্লুডিং ইন্টারকোর্স বিটুইন মেম্বার্স অফ দা সেম জেন্ডার্স। কিন্তু কপুলেশন বা চোদাচুদি, যা নিয়ত আমরা আত্ম-সংলাপে সহজ ভাবে ব্যবহার করি, ভদ্দরপুঞ্জে সহজ বা স্বাভাবিক উচ্চারণ নয়। কেননা এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অ্যাস্টোনিশমেন্ট আর ভ্যাজাইনাল সেন্সিবিলিটি। যে-কারণে 'চোদাচুদি' শব্দটা (যার উৎসে রয়েছে 'চোদা' ও 'চুদি' নামের দুই ভাইবোনের হাজার-হাজার বছরের মিথ-উপালেখ্য) আমাদের অন্যান্য অর্গানিক কারবার থেকে বেপোট হয়ে গ্যাছে। এ থেকেই পুরুষতন্ত্র সামাজিক ট্যাবু ম্যানুফ্যাকচার করেছে। শ্লীল-অশ্লীলের মধ্যে ভিড়িয়ে দিয়েছে কোন্দল। ওই কোন্দল আর তার অ্যাডহিরিং লুকোচাপার দরুন এদেশের ফিল্ম আর সাহিত্যেও যৌনতা দেখানো হয় পারভার্টেডলি।
    কিন্তু পুরুষের চোখে বা অনুভবে মেয়েদের শরীর? এ ব্যাপারে ভদ্দরলোকই বলো, ছোটলোকই বলো, সব মিনসের এক রা! পুরুষতন্ত্রের ঢালাইঘর নারীকে ঝুটমুঠ বহু 'শেপ' দিয়েছে ---- শঙ্খিনী, পদ্মিনী, চিত্রিণী, হস্তিনী, ---- এগুলো কি বিধাতার কেরামতি? সব শালা পুরুষতন্ত্রের ধুড়কি। পুরুষের চোখে বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন খেপের, বিভিন্ন নেচারের মাগি। তাদের নামও তেমনি ভেরিয়াস। নারী বলতে বুঝি একজন স্তন ও যোনি সমন্বিত মেয়েমানুষ, কিংবা এনি অবজেক্ট রিগার্ডেড অ্যাজ ফেমিনিন। ফের 'স্ত্রী' বললে, যার এঁড়িগেঁড়ি বা পোলাপান আছে, অর্থাৎ বিয়ারার অফ আন্ডাবাচ্চা। মাদি শেয়াল বা বাদুড়ানীও বোঝায়। 'রমণী' বলতে, এ বিউটিফুল ইয়াং উইম্যান, মিসট্রেস ---- এবং, যাহা রমণীয়, রমণযোগ্য 'মাল'। 'ললনা'ও মাল, তবে ওয়ানটেন লেডি। 'লল', অর্থাৎ খেলুড়ে মাগি। বিবিসি। মানে, বাড়ির বউ ছিনাল। 'অঙ্গনা' ---- আ উইম্যান উইথ ওয়েল-রাউন্ডেড লিম্বস।। 'কামিনী' ---- আ লভিং অর অ্যাফেকশনেট উইম্যান, কিংবা টিমিড মাল। কিন্তু কামিনী বললে এসব ভদ্দরলোক তাঁদের চুদাউড়ি বউটিকেই বোঝেন, মরাগরুর দালালটা সঙ্গে অং করে যে মাগিটা পালহুড়কি দিয়েছে। 'বনিতা'ও বউ, তবে 'বধূ' বলতে এঁরা বোঝেন বিয়ে করে আনা বউটি। আর, 'যোষিৎ' বলেছে যাকে সে কেবল ছুঁড়ি, গার্ল, ইয়াং উইম্যান; অ্যান আইটেম।
    তো, পুরুষতন্ত্র নারীর এতসব উপনাম দিয়েছে, শুধুমুধু 'যৌনতা'র দৃষ্টি থেকেই তো! মানে, পুরুষের 'একটি-মাত্র' নারী নিয়ে মন ভরে না। তারা চায় একাধিক। একটি নারীমূর্তি গড়তে বহু মডেল ইউজ করতেন প্রাক্সিটিলিস; কারো মাই, কারো মাজা, কারো দাবনা এবং কারো-বা পাছা নিয়ে রচিত হতো তাঁর এক একটি তিলোত্তমা। আমরা পুরুষরাও এহেন একটি হাগিং, লাস্টিং, উইশিং নারীমূর্তি ধারণা করি এবং তার জন্য একটা-করে জবর স্ল্যাং বানিয়ে রেখেছি। এটা পুরুষের যৌনতার হোমওয়র্ক। কাল যেন পড়া ধরবেন স্যার। নারী বাবদ স্ল্যাং বানাতে বসে প্রথমেই যেটা, নারীদেহের খুফিয়া বিভাগে এন্ট্রি মেরেছে পুরুষ। বস্ত্র সরিয়ে উদোম করেছে, সর্বাগ্রে যাঁদের দর্শন পেয়েছে, তাঁরা যমজ, উভয়েরই নাম 'স্তন'। স্তন বোঝো তো চাঁদু? যা চিলি চিৎকারযোগে নারীর যৌবন অ্যানাউন্স করে। কিন্তু গোড়ায় গলদ। বাংলা ভাষার কুঁয়োর ব্যাঙ গবেষক-সংকলকরা যে শব্দগুলোকে স্তনের এওয়জ ভেবে টুকেছেন, তাতে স্তনের শেপ বোঝা গেলেও অ্যাপিয়ারান্স আর নেচারে গড়বড় আছে। চুচি, মাই, দুদু, বেল, বাতাবি, নারকেল, তরমুজ, লাউ, বেগুন, ডিংলা, বেলুন, হেভি ওয়েট, হেডলাইট ---- এগুলো ঠিক আছে। কিছুটা মেলে। কিন্তু আতা বা উইঢিবি কেন? স্তনের গায়ে গোঁড় আছে, না ভেতরটা ফোরা? ফের দ্যাখো, 'আনারদানা'! ওটা স্তনের দ্যোতক হলো? মানে, ডালিমের দানা! ওই সাইজের স্তন নাকি হয়! হাসলে বাংলার ডাগদার বাবু। ফের কেলিয়েছো 'নিমকি' ঢুকিয়ে। নিমকি তো ঢোকাবার জিনিশ। মানে গুদ। গুদ আর মাই এক হলো? ফের হাসালে পেঁপেসার। 'মেশিন' কেন? মেশিন তো বড়জোর ল্যাওড়া। পূর্ণযুবতীর স্তন হিশেবে 'হরিণঘাটা' চলতে পারে। তবে, 'সিঙ্গাড়া', 'পিরামিড' আর 'হাইহিল' কদাপি নহে। হে বঙ্গভাষার টুলোপণ্ডিতগণ! তোমরা স্ল্যাং-এর কিচ্চু বোজো না। তোমাদের অভিধানে অনেক ঝোলঝাল আচে। ঝুলে গ্যাচে বাবা লেতাই, কাচা তোমার খুলে গ্যাচে। বলতে চাইছি, স্ল্যাং-এ থাকবে স্তনের গঠন ও প্রকৃতি, তাতে স্তনধারিণীর বয়স ও দেহের বিভাব জেগে উঠবে, সেটাই তো কাম্য। একটি অষ্টাদশী খেলুড়ে ললনার স্তনকে কি 'আমসি' বলা যাবে, নাকি 'বেগুনপোড়া'? কোন-কোন টুলো 'চুচি'কে বাদ দিতে চেয়েছেন স্ল্যাং থেকে। লজিক হলো, ওটা সংস্কৃত মূল শব্দ 'চুচক' থেকে ভায়া হিন্দী তদ্ভব 'চুচি' থেকে সরাসরি বাংলায় এসেছে, ----- এবং অভিধান স্বীকৃতও বটে। ওভাবে দেখলে, তাহলে তো 'চুত' শব্দটাকেও ছেঁটে ফেলতে হয়। কারণ সেটিও সংস্কৃত 'চুদ' জাত তদ্ভব হিন্দী আঞ্চলিক, ----- এবং সেটিও অভিধানে ঠোর পেয়েছে, যার মূল অর্থ 'যোনি'। অভিধানে ঠাঁই পেয়েছে বলে স্ল্যাং হবে না? তাহলে 'চুতমারানি'দের কীভাবে ডাকা হবে? এভাবে, তাহলে, 'মাগি'ও বাদ যাবার কথা। যেহেতু সেটা পালি 'মাতুগাম'-এর তদ্ভব রূপ এবং তার মূল ক্ষরিত অর্থ খালিপিলি 'মেয়েমানুষ'। হিন্দী 'চুচি'তে অষ্টাদশীর লমশমি স্তনের যে ব্যঞ্জনা, সে তো বহুল চালু বাংলা 'মাই'তেও দুর্লভ। আবার ভারিভরকম পেল্লাই থন-দুটিকে তো 'তরমুজ' কিংবা 'ফজলি আম'ই বলব। বড়জোর, 'বউ ফুসলানি আম'।
    স্তনের সমীপশব্দ পাচ্ছি 'বুনি' 'বুচি' 'বুটকি'। এগুলো ও-বঙ্গের। খুলনায় চুচির নাম 'ফলনা'। যেটা ময়মনসিংহে গুদের নিকনেম। কুমিল্লায় উচ্চারণদোষে স্তন হয়েছে 'তন'। আমরা বলব, 'থন'। রংপুরে 'টমটমা'। ঢাকায় স্তনযুগলের বেড়ে নাম দিয়েছে, 'জোড়ামুঠিফল'। বগুড়ায় কিশোরীর উঠন্ত চুচির নাম 'বুচি'। আমাদের এদিকে 'কুল' 'লেবু' 'পেয়ারা' দেদার মেলে। তারবাদে, টনটনে লবলবে বোঁটা দেখে কার না লালকি ঝরে! স্তনবৃন্তের কথাই বলছি, মালপোয়া বা পুলিপিঠের নয়। যা দেখে লিলিক্ষা জাগে, চোষার। তর্জনী ও বুড়ো নিশপিশ করে, দাঁতে চেপে চেবাতে জী ললচায়। স্তনবৃন্তের উপরিভাগকে বাকরগঞ্জে বলে 'পালনি'। 'বুডা' 'বুটা', এগুলোও ও-পাড়ায় চলে। তবে, আমরা সরাসরি 'বোঁটা'ই বলব। বোঁটা, বোতাম, চুমুর, কিশমিশ, নাট, সোপনাট, সুপুরি, রিঠা, ডুমুর। এছাড়া বড়জোর 'তকলি'। 'বাটিকোট' বলব বডিসকে। 'পৈতে' বলি তার স্ট্র্যাপকে। 'ব্রা' আর 'ব্রেসিয়ার' ----- দুটোই শিরশির করা শব্দ। জুড়ি নেই। কড়কড়ে বডিস বললেও অমনটা লাগে না। শকুন্তলা বলছে, 'সখী,অমন আঁট করে বাঁধিসনি,বল্কলের ভেতর বড্ড আইঢাই লাগে!' উত্তরে প্রিয়ংবদা বলছে, অত্র পয়োধর-বিস্তারয়িতৃ আত্মনঃ যৌবমেব উপালভস্ব ----- 'যে যৌবন তোর মাইদুটোকে অত বাড়ন্ত করেছে, তাকে দুষগে যা, আমাকে কেন!' এবার নিচে নামো। তলার দিকে। চোখে পড়বে পেটি। তার মধ্যমণি 'নাভি'। নাই, নায়, ঢোঁড়ি, পেটি, টুনি, পুঁতি ইত্যাদি কত নাম পড়েছে ওইটুকু গত্তে! এগুলোর মধ্যে হিন্দী 'ঢোঁড়ি' কিন্তু একটা হাইভোল্টেজ স্ল্যাং। ওটা বাংলায় তাংড়ানো উচিত। অন্তত, নারীদেহের নাভির খাটচড়ি শব্দ এর চাইতে বেস্ট আর হয় না।
    তা, মলয়দা, এরকম একটি নারীদেহ লাভিত হলে দাঁড়ায় বৈকি। তখন লেকামেকা চুলোয় যাক। বাকি কথা : লিঙ্গের লিঙ্গযোগ (পড়ো 'মনোযোগ') যেখানে দরকার সেখানেই খাড়ায় কেবল। নারী বা যৌনতা নিয়ে লেখার সময় নিরাসক্ত সন্ন্যাসী হয়ে থাকতে হয়, নচেৎ লেখাটা খাড়ায় না। এবং বলি, এই লেখাটিও লেখার সময় দাঁড়ায়নি, নট ইভন হাফ এমএম।”
    .
    এখানে রইলো হাতের লেখা বনাম কমপিউটারে লেখা সম্পর্কে অজিতের মতামত, “আমার চতুর্থ উপন্যাস "পাপরাৎজি"র হাতেলেখা পাণ্ডুলিপি 'কৌরবে' পাঠালে, কমল চক্রবর্তীর প্রথম রিয়াক্সান ছিল, 'খুব সুন্দর হাতের লেখায় এসেছে। লেখাটাও খুব সুন্দর।' উনি অবধারিতই উপন্যাসটি না-পড়েই দ্বিতীয় বাক্যটি লিখেছিলেন, এ আর বলে দেয়ার দরকার নেই। বস্তুত, আগেকার দিনে আমরা প্রত্যেকে হাতে লিখেই লেখা পাঠাতাম। আশির দশকের গোড়ার দিকে আমার অজস্র লেখা স্রেফ হাতের লেখার গুণে দৈনিক 'আজকাল' এবং সাপ্তাহিক 'পরিবর্তনে' বেরিয়ে যায়। লেখা শব্দের মধ্যে 'হাতের লেখা' এবং লেখার বিষয় ভাবনার সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। ভাবনা ও বিষয়কে শব্দ বাক্যের মাধ্যমে আমরা রূপ দিই। শব্দ বা বাক্য যেমন বিষয়-সৌন্দর্যের ধারক, বাক্যকে অক্ষরের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলাও আমাদের কালে এক শিল্পকর্মের পর্যায়ে পড়ত। সন্দীপনের হাতের লেখা জঘন্য, বাজে, কমল চক্রবর্তীর লেখা ছাপার সময় কৃষ্ণগোপাল মল্লিক ও আমাদের ফ্যাসাদে পড়তে হতো। কমল মজুমদারের হাতের লেখা ততোধিক সুন্দর ছিল, এমনকি মলয় রায়চৌধুরী, রবীন্দ্র গুহ তথা সুবিমল মিশ্রর। সুন্দর হাতের লেখা গোধূলি আলোয় কনে-দেখার মতো। চোখকে গোড়াতেই সেঁক দিয়ে দিত। কেবল দেখতে-দেখতেই ঢুকে যাওয়া যেত বুকের অলিন্দে, হোক না তা ঢাকনা-আঁটা। সবার হাতের লেখা ভালো হবেই, তা তো নয়। অনেকের সুন্দর করার চেষ্টাও থাকে না। যাঁরা ভালো লেখে, তাঁদের হতেই হবে, তার মানে নেই। আবার লেখকদের মধ্যে যাঁদের আঁকার বাতিক ছিল, অনেকেরই চমৎকার হাতের লেখা। যেমন কমলবাবু, বা সুবিমল বসাক। অন্যফুটে, মলয়দা ভালো আঁকতে পারতেন না, অথচ হাতের লেখা অতিশয় সুন্দর। আবার প্রচুর বাজে গদ্যকার ও কবির অসাধারণ হাতের লেখা। কিন্তু সে-মুতে ইন্ধন নেই। ভেজা বারুদ মার্কা। তাঁদের আর নাম নিচ্ছি না। এছাড়া অজস্র উঁচুমানিক সহ আলবালিক লেখক ও শিল্পীর বানান ও শিল্পগত ভুল দিবারাত্র চোখে পড়ে, বিজ্ঞাপনে। বাড়ি থেকে ইস্কুলের যাওনের পথে কচি ছেলেমেয়েরা দেখছে তথাকথিত 'মহান' সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হয়ত কোনো বিজ্ঞাপন-হোর্ডিংয়ে তেল ঝাঁঝে কাঁদছেন, শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কোনো কোম্পানির বিস্কুটের শিশি নিয়ে দিব্যি আয়েশে বকেশা ঝাড়ছেন। ছেলেমেয়েরা ওই ভুল বানান ও ভুল ছবির বিজ্ঞাপনকেই সঠিক মনে করছে। আকাশ ঢেকে দেওয়া বিজ্ঞাপনমালার বানান মেলে না অনেক সময়ে সঠিক বা শুদ্ধ বানানের সঙ্গে। বইয়ের বানানের সঙ্গে মিলে না খবরের বানান। ফলে দিশেহারা নতুন প্রজন্মের কবি-লেখকরা আমাদের, এমনকি বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরৎ-জীবনানন্দের বানান দেখে মুখ খুলে হাসতেই পারে। বিজ্ঞান ও যন্ত্র নির্ভর জীবন আমাদের। ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের মাথায় ডেরা বেঁধেছে যন্ত্র। আকাশ বাতাস ছবি সাহিত্য তারা যা কিছুই দেখছে, কৃত্রিম যন্ত্রের মাধ্যমে। পড়ছে না সাহিত্য। ভাষাবোধ, ছবিবোধ তৈরি হচ্ছে না। ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে হাতের লেখার ক্ষমতা। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমারই নিজের হাতের লেখা কী ছিল! আজ পঁচিশ বছর কম্পিউটারে লিখে-লিখে-লিখে-লিখে, কার্যত আমার সেই মুক্তাক্ষর যন্ত্র-দানবের পাল্লায় পড়ে শূন্যে বিলীন।”
    .
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গদ্য প্রথম দিকে অজিত রায়কে প্রভাবিত করেছিল । তা থেকে বেরিয়ে এলো বিহারের বাঙালি আর ধানবাদের বাংলা মিশিয়ে একটা গদ্য তৈরি করে, যার নকল করা অসম্ভব। সন্দীপন সম্পর্কে অজিতের লেখাটা পড়া যাক, “অতি অতীতকালের কথা। শীতনিশার নিশুতি। ৬ নম্বর রুটের শেষ বাসটি ফিরে গেছে গড়িয়া। আমি আর কমলদা হাজরায় দাঁড়িয়ে। কমলদা অধীর গলায় জানতে চাইল, এখন কোথায় মদ পাওয়া যায় বলতে পারো? সব দোকান তো বন্ধ হয়ে গেছে।
    আমি অসহায়। কলকাতার বিলিতি মদের আন-অথরাইজড ঠেকের হদিশ আমার জানা নেই। ফের কমলদাই শান্ত গলায় বলে, চলো, বসুশ্রীর পেছন গলিটায় গিয়ে দেখি!
    হাঁটা শুরু করব, হঠাৎ আমাদের দুজনের কাঁধের পেছন দিয়ে একটি ব্রাহ্মিনিক্যাল খোমা উঁচিয়ে আসে। আলো কম, কিন্তু চিনতে বিলকুল ভুল হয় না, ---- 'সমবেত প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্যান্য'-র ফোর্থ কভারে এই মুখেরই ছবি আছে।
    সন্দীপনকে সেই প্রথম দেখি। প্রথম কথা : 'আমার ব্যাগে আধখানা পাঁইট আছে।' তারপর আমার দিকে তাকিয়ে (এবং রিমলেস গ্লাশ নাকের ডগায় নামিয়ে) ---- 'তোমার চলে তো?'
    আমি জানাই, না, আমার এখনো অন্নপ্রাশন হয়নি।
    হাসলেন, 'তাহলে এ-জন্মে তোমার স্বর্গলাভ হলো না।'
    .................................................................
    ৯০-এর গোড়া। নন্দনে ইলমাজ গুনের 'দ্য ওয়াল' দেখতে গেছি। পাশের দু-একটা সিটের পর সন্দীপন, ওঁর বন্ধুদের সঙ্গে। ছবি শুরু হবার আগে বেশ প্রফুল্লই ছিলেন। তারপর, একসময়, 'ওয়াল' শেষ হলো। শ্বাসরোধী ধূসরতায় সব-ক'টি সিট নিঃশব্দে খালি হয়ে গেল। সবাই হল ছেড়ে ধীরে, নীরবে, মৃদু কথালাপে বেরিয়ে আসছেন। একা সন্দীপন ব'সে। শবের মতো অনড় ও নিস্তেজ।
    একসময় উঠে দাঁড়ালেন। আমি পাশে, কখনো পেছনে। হাঁটছেন রবীন্দ্রসদন মেট্রোর দিকে, মৃদুচরণে। তখনও নীরব, আনত শির। আঁখিদুটি চিকচিক করছে কেবল।
    চৌমাথার ক্রসিং অব্দি পৌঁছে চু-উ-প দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি পেছনে। এ পর্যন্ত কথা হয়নি। ছবি দেখে আমিও যথেষ্ট বিহ্বল। কিন্তু উনি যেন অপ্রকৃতিস্থ।
    অনেকক্ষণ ওইভাবে, নীরব ও আনত মাথায়, দাঁড়িয়েই রইলেন।
    তারপর, ধীরে, অবর্ণনীয় বিধ্বস্ত গলায়, একটিই মাত্র কথা : 'নাঃ, সারা জীবনে কিছুই লিখতে পারলাম না। ......'
    তারপর ফের চুপ।
    শেষে আর ধরে রাখতে পারলেন না নিজেকে। হু-হু করে ডুকরে উঠলেন, --- 'একজন ফিল্ম ডিরেক্টার যা দেখাতে পারলো, আমি শালা একজন লেখক হয়ে, ছিঃ, কিছুই দেখাতে পারলাম না! সিনেমা বানাতে গেলে কত কী-ঈ লাগে--- লেখার জন্য তো শুধু কাগজ-কলমই যথেষ্ট ---- তাই না? কই, লিখতে তো পারলাম না! কত কী-ঈ বলার ছিল .... কত কী-ঈ ---- না হয়, না-ই ছাপতে দিতাম! পারলাম না, পারলাম না, কিছুই পারলাম না। ওঃ, পারলাম না রে অজিত, পারলাম না।'
    .........................................................
    লেখককে কাঁদতে হবে। এমনকি, গণসমক্ষেও। মঞ্চে নয়, ছলায় নয়। কাঁদতে হবে মন থেকে, ভাষার উৎসভূমি থেকে। যিনি কাঁদতে পারবেন না, সেই না-পারার অপারগতায়, নবকুমারের মাফিক, ----- বদার্থ মৃন্ময়ীকে বাঁচাতে পারছেন না ---- অকথ্যময় এই ক্রোধেও, অন্তত, আশরীর কেঁপে উঠবেন তিনি। এটা মাস্ট। এ না হলে বুঝতে হবে কোথাও ফক্কা থেকে গিয়েছে। একখানা ঢপ বা ঢপের চপ ছাড়া আর কিছুই হয়ে উঠতে পারেননি তিনি। লেখককে 'আজন্ম' এ রেওয়াজ করে যেতে হয়। যে কাঁদতে পারে মনের কালিমা তাকে ছেড়ে চলে যায়। এটা টেস্টেড। হিস্টোরিক্যালি টেস্টেড। এ যে সবাই বুঝবেন এমন মায়ের কিরা নেই। কিন্তু, টেস্টেড।
    'লিখেছো প্রেরণা তোমার নিযুত বৃক্ষের ছায়া। ভেবেটেবে লিখেছো তো? কেননা এসব অনেকেই লিখে দ্যায়, পরে জানা যায় সব-মদন ডাবলবেডে একা।'
    মদির ভেপারের তলায় প্যান্টের ফ্রন্ট-পকেটে দু পাঞ্জা ভরে আমার দিকে অনিমিখ দিঠি ভিড়িয়ে সন্দীপন। সঙ্গে, যোগসাজশের মতো, তাঁর সেই কুখ্যাত মিসচিভিয়াস ফরাসি হাস্যটি : 'বাঞ্চোত, জবাব দিচ্ছো না কেন?'
    হ্যাঁ, ঠিকই। আমার প্রেরণা সত্যিই বিসদৃশা এক মেয়ে, খুবই বেপোট। কিন্তু কনজুগাল লাইফ নামের আজিমা দালানের কাঁথে নালিশ, তহমত, কালো-পতাকা থাকবে না, সেটি কাঁঠালের আমসত্ত্ব মাত্র। কেননা, হেজানো দাম্পত্যে একঘেয়েমি আর মুফলিসি দুই বড় জান্তব পেরিক্লিস। প্রেরণার প্রাত্যহিক সৌমনস্যও তেমনি, সেথায় নিয়ম মতো বিষাদ ও বিস্ফোরণ কোথাও, কোনো কোণে আটকে থাকে। বস্তুত, প্রেরণা এভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। সহ্য করে পর্যায়ক্রমে পুরুষের নির্পুরুষি স্পর্ধা। সয়। লেখককে, স্বামীকে। লেখক-স্বামীকে। সহনবোধ থেকে ক্রমশ বেদনার খোলসে ঢুকে পড়ে নারী। শরীর বা মেধার হাওড়ে নুড়ি হাবড়েও তরঙ্গ মেলে না আর। এভাবে, ওই টুকরো-হীরের কোথাও যদি কখনো চিজেলের ক্র্যাক পড়ে গিয়ে থাকে, সে জিম্মা তো আমারই। ওর কেন?
    না, এ কথা সন্দীপনকে বলা যায় না। সন্দীপন কি এ-পয়মাশ মানতে চাইবেন?
    জানতে চাই, 'এতগুলো বছর সেক্স লাইফ কিভাবে কাটালে?'
    ----- 'মাস্টারবেট করে। (রিমলেস গ্লাশ নাকের ডগায় নামিয়ে) ---- হ্যাঁ।'
    সন্দীপন এ কথা আরও অনেককেই বলেছেন : 'জানো, আমি কিন্তু মাস্টারবেট করেই বেশি সুখ পেয়েছি।' এই দ্বৈধের পরজারিতে কতিপয় নোট পাচ্ছি :
    'ধৃষ্টতা মাফ করবেন, ম্যাডাম, আপনি নাকি মনে করেন মাসে একবার কি বড়জোর দুবার সেক্স হওয়াটাই যথেষ্ট ---- এবং তাও শহিদসুলভভাবে? ... ইয়ে, আপনার কি কখনো অর্গ্যাজম হয়নি? নাকি আপনি সম্পূর্ণ নগ্ন হওয়াতেও বিশ্বাসী নন বা কার্যকালে জামাকাপড় সবটা খোলেন না?'
    'ইউটেরাস রিমুভ হবার পর, কিছুতেই নিতে পারত না। উঃ, আঃ, মাগো, মরে গেলাম, এইরকম বলত। মাসখানেক চেষ্টা করলাম। তারপর হঠাৎ মনে পড়ল, ছিঃ, আমি মানুষ না! হাল ছেড়ে দিলাম। ... লজ্জায় বন্ধুদের কাছে জানতে চাইনি যাঁদের স্ত্রীদের অমন হয়েছিল।' যখন জানতে পারি, 'ততদিনে বছরচারেক পেরিয়ে গেছে। ততদিনে সারদা কেঠো, কড়ে বিধবা।'
    .......................................................
    ১৯৯২ সনে দ্বিতীয় উপন্যাস, 'এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না'। উৎসর্গ করেছিলাম যুগপৎ মলয় রায়চোধুরী আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। সন্দীপন সেটা আদৌ পড়েছিলেন বলে সন্দ আছে। 'জোখিম কোরকাপ' উৎসর্গ করেছিলাম : উদয়ন ঘোষ আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে। উদয়নদা পড়েছিলেন। সন্দীপনদাও। কমেন্ট করেছিলেন, 'বানানো'। সন্দীপন কিন্তু জানতেন, জোখিমের একটিও শব্দ আমার বানানো নয়। আসলে, আমার যেটা মনে হয়, ইন্টেলেক্টের দিক থেকে মেয়েদের কাছে কখনোই খুব বেশি হাত পাতেননি তিনি। বলতেন, "মেয়েরা কী দিতে পারে জানো? শুধু সেক্স। সেটাই যদি ঠিকঠাক দেয়, ওদের কাছে আর তো কিছু চাওয়ার নেই।'' এভাবে কারো যদি মনে হয় মেয়েদের উনি খানিক ঊন-হিউম্যান বানালেন, সন্দীপন বারদিগর ঐ অনিমেষ দিঠি আছড়েই তাঁর সামনে দাঁড়াবেন। এবং, মঙ্গোলিয়ান খোমায় হাসি দাপিয়ে। এবং, রিমলেস গ্লাশ নাকের ডগায় নামিয়ে, বলবেন : 'ইয়াস, মাই ডিয়ার!'
    'যোজন ভাইরাস' পড়ে ১৫ মে ২০০৪ লিখেছিলেন : "আজ ৭টা থেকে ৯।। পর্যন্ত টানা 'যোজন ভাইরাস' পড়লাম। বাংলা বই পড়তে এতক্ষণ সময় লাগে না, লাগল। এবং, একবারও ঠোঁট তুলিনি। ... ছাড়তে পারিনি এক মুহূর্তও। .... মনে হল ভূত গদ্য লিখেছে। বাংলা ভাষায় জ্যান্ত লেখকরা এ ভাষা কোথায় পাবে!"
    কেন পড়েছিলেন সন্দীপন 'যোভা'? কেন বলেছিলেন এ-কথা? সন্দীপন যে যোজনের কায়েল হলেন, তার হেতুক বড়ই আলাদা। 'ভাষা', সে একটা তো বটে। তারও বেশি, থিম। যা নিয়ে খোদ সন্দীপন কখনো মাথা ঘামাননি। যোজনের ঐ থিমটাই সন্দীপনের ভালো লেগেছিল।
    বলেছিলেন, ----- 'সত্যিই, স্ত্রীর কাছ থেকে দুটো জিনিশ পাওয়া যায় না, ---- এক, ভালোবাসা। দুই, যৌনতা।'
    সন্দীপন তাঁর গদ্যগুলো লিখেছেন ঐ না-পাওয়ার হাশিয়ায় ব'সে। ঐ দ্বিতীয় সন্দীপনকেই আমি গ্লাসজারে দেখেছি। বনবিহারী ও হেমবরণের একটিই মাত্র আদরা-বদল 'আমি'কে। আসল সন্দীপন তথা তাঁর হাড়হদ্দ রয়েছে ঐ অদৃশ্য ও নিমজ্জমান বিটুইন-পংক্তি ছত্র-সমূহে। জীবনানন্দের কবিতার সমীপে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সন্দীপনের গদ্য, এভাবেই।”
    .
    অজিত রায়ের 'যোজন ভাইরাস' পড়ে সন্দীপন মন্তব‍্য করেছিলেন :
    ‘'আজ ৭টা থেকে রাত ৯।। পর্যন্ত টানা 'যোজন ভাইরাস' পড়লাম। বাংলা বই পড়তে এতক্ষণ সময় লাগে না, লাগল। এবং একবারও ঠোঁট তুলিনি। আদ‍্যন্ত অন‍্য, আলাদা জাতের ভাষা। আর ট্রিটমেন্ট। 'আয়, আমার পেছনটাও মেরে নে' ধরনের লেখা।  মনে হল ভূত গদ‍্য লিখছে। বাংলা ভাষায় জ‍্যান্ত লেখকরা এ ভাষা কোথায় পাবে!'’
    .
    নিজেকে নিয়ে একটা লেখা আরম্ভ করেছিল অজিত, ২০০১ সালের মাঝামাঝি । অজিত লিখেছিল, “নিজের জন্য এক্সক্লুসিভলি নিজেকে নিয়ে একটা লেখা শুরু করেছি, আর, কী আশ্চর্য, নিজের ফেলে-আসা জীবন নিয়ে লিখতে বসে, এতদূর এসে দেখছি, অনেক কিছুই না-লেখা রয়ে যাবে জীবনাবধি। খানিক স্মৃতিও ধ্বসে গিয়ে থাকবে। আমি নিরঙ্কুশ, নিরন্ন, পাংশুর মতো বেঁচে আছি। শেষ যেদিন পরীক্ষায় বসি, এম.এ, একটাও ড্যাশ, কমা বা দাঁড়ি ভুল হয়নি। একুশ-বাইশের খলবলে বয়সেও কত শান্ত, সমিধ, প্রফেটের ঘিলু! অ্যাদ্দুর এতবছর টানা লিখে এসে নিজের জীবনটাকে কার্যত যা দেখলাম, নিতান্ত ছোটবেলা থেকে আমি যা যা করেছি বা ভেবেছি এবং চাঁদমারি স্বরূপ পরবর্তীকালে যা লাগাতার সামনে থেকেছে আমার, ----- সমস্তই আমার লেখালেখি ঘিরে, লেখালেখি আর লেখালেখিই ঘিরে। তার বাইরে এমন কিছুই করিনি, ভাবিনি, যা আমার আত্মজীবনীকে আলাদা মাত্রা যোগাতে পারে। অথচ, লেখালেখি-কেন্দ্রিক এই জীবন পেয়েও, চাঁদমারি সামনে রেখেও, আমি এদান্তি নিজের জীবনকে বড় এলোমেলো ছন্নছাড়া খামখেয়ালের বশে যাপন করেছি। এবং যাপনের যাবতীয় খুঁটিনাটি আমি আমার কিছু-কিছু উপন্যাসে তুলে ধরতে চেয়েও আপামর ব্যর্থ হয়েছি। পারিনি। পারলে হয়ত দেখা যেত, আমার জীবনের যেসব গল্প, তা সত্যি হলেও, গল্পের চেয়ে মারাত্মক ও নিষ্করুণ।
    তাছাড়া এমনও অনেক কথা, পুশিদা অস্ত্র, আমার কান্না রাগ ব্রীড়া, বিশেষত বিকেল ঢলে চাদ্ধার সাঁঝ-মতন হলে, কালো লোমোলা বিশালদেহী আকাশের নিচে একা-একলা দাঁড়িয়ে থেকে বুকের ভেতরটা যখন একজাই ফাঁকা, ধড়াস, উজাড় আর যৎপরনাস্তি ইনসিকিওর্ড লাগে নিজেকে, এমন-যে ভয় কুণ্ঠা উদ্বেগ ত্রাস এসব গাদ পেতে থাকে যখন পিত্তির দহনপ্রদেশে, এবং যে-কোন ল্যাম্পপোস্টের তলায় বাইক খাড়িয়ে চিরকুটে টুকে নিই জীবনের মহোত্তম নোট, এবং এমনিতরো গোপন অরাজক আরও-কিছু যা আমার মা দাদা দিদি আত্মীয় বন্ধুরা কিম্বা পাশের বাড়ির ভঞ্জবাবু জানতে পারলে বাওয়াল হয়ে যাবে ----- আমি না-লেখা নিরস্ত অবস্থায় ছাড়তে পারছি না বলেই, এই নার্সিসাস টেক্সটে সমস্ত লিখে রেখে যাবো। জানি, সেসব সানুপুঙ্খ তুলে আনতে হলে যে-পরিমাণ আলাদা ভাষা, সিনট্যাক্স, শব্দের যোগান দরকার, এই মুহূর্তে আমার নেই। তবু লিখব। কেননা, আমার পরিপার্শ্বের মেকি শ্রদ্ধা ভালবাসা স্নেহ আমার চাই না। ছদ্ম ভালোবাসা আমার অভিপ্রেত না। ভাবতে পারো, এ আমার মিহি স্ববিরোধ; কিন্তু আমার খোয়ানোর আর কিছুই নেই।
    অবশ্য, স্ববিরোধ কোথায় নেই? প্রেরণার সঙ্গে রফা হয়েছিল, 'দাম্পত্য' হবে না, 'স্বামী-স্ত্রী' হবে না, বাচ্চা হবে না। কেননা দাম্পত্য, এর চেয়ে খোশ মস্করা আর হয় না। আমরা জানতাম, স্বামী-স্ত্রী আর ইকুয়াল পার্টনারশিপের তামাম ভোকাবুলারিকে পুরুষতন্ত্রের দুরমুশ থুরে শেষ করে দিয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মতো দুর্মদ কি আর কিছু? সুতরাং, কালক্রমে, কনজুগাল লাইফ নামের কায়েমি প্রতিষ্ঠানের কার্যত গুডডা-গুডডি ব'নেই রয়ে গেলাম আমরা দুজন। এবং, মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে আমি ধোঁকা করছি, এ আমার জীবন নয়, এ আমার ছদ্মাচার। আমি আত্মমুগ্ধ, নিজেকে ভালবাসছি। কেননা সাহিত্য করে যখন অর্থ নেই, স্বীকৃতি সামান্য, যশ যৎকিঞ্চিৎ, সাহিত্যের যেন মানেই নেই কোনো, জীবন বা সত্যের অন্বেষা নেই বেশির ভাগ লেখকের কাছে, অথচ মিডিওকার ধান্দাবাজে ভরে গেছে চত্ত্বর ----- সেখানে বউবাচ্চা ও অর্বাক গিরমি রেখে জীবন রক্ত ঘাম শেষ-প্রোটোপ্লাজম-টুকু নিঙড়ে ভাষার বনেদে কিঞ্চিৎ উখো মেরে যেতে চেয়ে আজ এতগুলো বছর, বুকে বালিশ গুঁজে, দিস্তার পর দিস্তা, পেজের পর পেজ ----- এ নিছক স্বার্থপরতা নয়, নিজেকে ভালোবাসা? পাল্টাক্ষণে মনে হয়েছে, না, বাসছি না। কোন মানুষই কি নিজেকে ভালোবাসতে পারে? তা কি নিজের প্রতি অন্যের অনুভুতি মাত্র নয়? অন্যরা আমাকে যে-যে কারণে ভালোবাসে, আমি মাত্র সেই-সেই কারণে নিজেকে ভালোবাসছি!! সে তো আত্মপ্রেম নয়, মোহ নয়। বরং অন্যকে ভালোবাসা সহজ অনেক। সেটা বোঝাও যায় চট করে। নিজেকে ভালোবাসার, আত্মাচ্ছন্ন হবার মতো পর্যাপ্ত বিবরণ বা জটিলতা আমার লেখালেখিতেও নেই যে! হয়ত এও আমার স্ববিরোধ, নিজেকে ভালোবাসতে না পারা। বা, অন্যকে দিয়ে নিজেকে দেখা। হয়ত।
    আসলে কী জানো পাঠিকা, ----- তামাম জাহাজ ডুবিয়ে কলমে থিতু হয়েছি আমি, পলাইতে পথ নাই যম আছে পিছে। লেখা নিছক উপলক্ষ নয় আমার কাছে, ---- লক্ষ্য। যদি প্লেটোর 'ডিভাইন ইনস্যানিটি' কবুল না-ও করি, কিংবা রবি ঠাকুরের 'দৈববাণী' --- তাহলেও দেখছি দৈব-উন্মাদনাই কিন্তু মূলে। অন্তত, পেছন থেকে অবিরহ ধাক্কাচ্ছে কেউ, এই টের অহরহ। আমি মনে করি সাহিত্য এমন এক জিনিশ যা একজন লেখককে একা এবং সম্পূর্ণ এককভাবে করে যেতে হয়। সেখানে কোন ক্যামেরাম্যান, কোরিওগ্রাফার বা বাজনাদার তার মদতগার নয়। বাইরের তৃণমাত্র মদত ছাড়াই এক-একজন লেখক। যারা সাহিত্যকে নিছক শখের বাগোয়ানি, জীবনের সেকেন্ডারি-কিছু, বা আর্ট অব প্লে, 'কল্পনা-ক্রিয়ার স্বতন্ত্র বৃত্তি', দুধ থেকে সরের মত করে আলাদা ভাবে দ্যাখে এবং মারিয়ে যায়, তাদের পাশে এক শ্মশানে শুতেও আমার বিবমিষা। অন্যের হাগুমাখা টিন বয়ে বেড়ানোর চেয়েও বীভৎস নিজের সঙ্গে এই গুলতাপ্পি।
    'বলাটাই যখন বিষয় হয়ে ওঠে, বলার ভঙ্গিটাই' ---- হ্যাঁ, গোদারের এই কথাটা হরদম মাথায় ঘুরপাক খায়। তথাকথিত ওপরবাজ ঢঙি-সাহিত্যের কোন ছকবাহার আমার আসে না। ফ্লো আসে ভেতর থেকে, একেবারে ছাঁকা, বেতরতিব। সেসব নিয়েই মুহূর্ত-ধারাপাতে নিজেকে হাজির করার চেষ্টা। কেননা আমার মনে হয়েছে আমি তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক মরফিয়ায় আক্রান্ত নিহায়ত ফিউডাল আর অতি নিকৃষ্ট কালো জঙ্গুলে মাটির বাসিন্দা, ---- বঙ্গসাহিত্যে আমার এন্ট্রি মকাইদানা স্বরূপ, আমাকে চেবানো দায়। দ্বি-সংস্কৃতি, দোগলাকৃষ্টি, মায় 'কালচারাল বাস্টার্ড', শব্দ তিনটি ঢুয়ে এনে নিজের পিঠে বসাই। কেননা এসব শব্দ, এরা আমার মৌল স্বরূপও বটে। আমার দেখা, বলা, কাঁদা, মস্করা, খিস্তি কিংবা প্রেম কোন মেট্রোপলিস সিটি থেকে বিলটি কেটে আসবে না। আমি মনে করি আমার নিজস্ব কিছু কাদা, তাকে খড়-ভুসি দিয়ে গেঁথে দিতে পারলেই এক-একটা নির্মাণ। আমার পকেটে হরদম ছেঁড়া চিরকুট আর কলম, যখন যেখানে যেরম মুড আসে, বাইক খাড়িয়ে উৎরে নিই ঝটপট, আর বাড়ি ফিরে-ফিরেই, প্যারা। ভাবি, এই খাটুনি আর কালঘাম আমার জীবন আর লেখার মাঝ থেকে খোঁচঅলা হাইফেনটুকু উখড়ে ফেলতে পারে যদি!
    সুতরাং, আমি লিখি আমার জন্যে। দায়বদ্ধতা, সে এখন বাংলা শব্দকোষে হাতির দাঁত ব্যতিরেকে আর কিছু না। কেননা এসব মনে করার, বিশ্বাস করার মূল বনেদটারই আজ ভুষ্টিনাশ হয়ে গেছে। বিশ শতকের গোড়া অব্দি তবু লেখক-বুদ্ধিজীবীদের অল্প-স্বল্প শোনা হতো। কিন্তু আমাদের নিজস্ব রাষ্ট্রযন্ত্র বিদেশি প্রভুদের এঁটোকাঁটা খেয়ে গাগতর ফুলিয়ে দুম করে যেদিন চড়ে বসল মসনদে, সেদিন বা তার ঠিক পরের দিন থেকে তথাকথিত লেখক-বুদ্ধিজীবীদের শোনবার কেউ থাকল না। তখন থেকে তাঁরা মসনদের চোখে ফালতু আর পালতু সম্প্রদায়-বিশেষ। ফালতু, কেননা মসনদ বা রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের বোধ-কাঠামো গড়ে নেওয়ার পর তার ব্যাখ্যাকারীর প্রভাব থেকেও পুরোপুরি মুক্ত হতে চায়। ব্যাখ্যা বা ভাবনা পরিহার্য হলে ভাবুক-বুদ্ধিজীবীরাও ফিজুল হয়ে যায়। আবার পালতু, যেহেতু এসব লেখক-টেখকরা যাতে মাঝেমধ্যে গিয়ে মসনদের গাঁড়ের তলায় বসে ল্যাজ নেড়ে আসতে পারে তাজ্জন্যে নানারকম খেতাব, বৃত্তি আর পুরস্কার সমেত খুলে দেওয়া হয়েছে 'সংস্কৃতি' নামে একটা নিকো পার্ক। কবি-লেখকরা সেখানে কাঁধে ঝুলি ঝুলিয়ে পদ্য পড়েন, ভিড় জুটিয়ে বুকনি ঝাড়েন আর মধ্যেমধ্যে 'সংস্কৃতি বাঁচাও' 'ভাষা বাঁচাও' বলে হাঁকও পাড়েন, ---- কিন্তু মসনদ বা তক্তা পালটে ফেলার বিষদাঁত তাঁদের নেই, মসনদ তা জানে।
    অতএব, এহেন প্রেক্ষায় মধ্য বা নিম্নবিত্ত থেকে আগত একজন বাঙালি লেখক নিজের দায়বদ্ধতার টেঁটুয়া টিপে এই পর্যাপ্ত ক্রাইসিসে, পলিউশান আর পেরিক্লিস সমাজের হিপোক্রিট আবিলতায় বল্গাহীন কেঁদেই উঠতে পারে স্রেফ। সে প্রতিভাবান, রহস্যময়, শয়তান, পুণ্যাত্মা, ধড়িবাজ, দুশ্চরিত্র, পাগল, কমিউনিস্ট, তিনোমুলি, বিজু, ভিখিরি যা হোক, জড় ও অজড় দুই বিশ্বেই আজ সে পূর্ণত ত্যক্ত, বর্জিত, প্রোজঝিত। সমাজ তাকে পাত্তা দেয় না। তবু সে বিইয়ে চলেছে সহস্র-একের মুনড্রিয়ান খিচুড়ি। হাপিত্যেশ এই অংশটা কেউ পড়বে, ভালো লাগবে কারো। সে জানে প্রতিটি লেখার শেষে তার মৃত্যু, তবু।
    আসলে, সে হল ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রকৃতি যত কবিতা গান ছবি মহাবিশ্বে রচনা করেছেন, তাতে তার মন ভরে না। সে আরও কিছু নতুন মাত্রা লাগিয়ে তাকে নিজের মত দেখতে, পেতে চায়। নির্মাণ করে। কবি দেখেন চুল সুন্দর, তবে বিদিশার নিশা। চোখ সুন্দর, তবে পাখির নীড়। রোদ সুন্দর, তবে কমলা রং। মানে, আমার চেতনার রঙে কান্না হল সবুজ। আমারও কিছু রং, তুলি, ইকড়ি-মিকড়ি। ভাবি, ওটা ওভাবে নয়, এভাবে। শব্দকে নতুন করে সাজাই। সে সাজুক, বাজুক। সে পরাজিত দুখি না হয়ে, আনন্দের হোক। এমন কবিতা লিখি, এমন, যেন নিজের ভেতরের সবটা, অক্ষরে। অক্ষর বেজায় দুষ্ট ছেলে, পালিয়ে বেড়ায়। আড়ালে, গোপনে। ডাকি, আয় বাবা খগেন, আয় ব্যাটা নগেন। এমন করে সাজাব তোকে, আগে কেউ দেখেনি। মানুষের ভেতরের গাছপালা পল্লবিত হয়। আমার মধ্যে যেসব দুনিয়াদারি, জগৎজীবন, রাজাগজা তারা অক্ষরে সাজলে কেমন, সেইটে দেখি। ঢালাই মিস্ত্রির সতর্কতায়, শব্দ, ফার্নেস থেকে বের করে, ঢালি। আর কী পেতে চাই আমি, লিখে? আর কোন আনন্দ?
    এবং, ঐ যে ডিভাইন ইনস্যানিটি, দৈব-উন্মাদনা ---- আমৃত্যু আমি তার নিগড় থেকে মুক্ত হতে পারব না। হ্যাঁ, সেখানে এসথেটিক প্লেজারই একমাত্র ডিভিডেন্ড।”
    .
    অজিতের পত্রিকা ‘শহর’-এর ২৬তম সংখ্যায় একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অনেকে । অজিতের দেয়া উত্তরগুলো থেকে স্পষ্ট হয় ওর অবস্হান । 
    মানস নাথ : আপনি শয়তান, নাকি ঈশ্বর?
    অজিত রায় : যে কোন সৃষ্টিই হয় শয়তান কিংবা ঈশ্বরের হাত থেকে। কেননা স্রষ্টা মাত্রেই সময়ে সময়ে ঈশ্বর, আবার শয়তানও। বিশেষত গদ্যকার। গদ্যকারদের মাথাটা অনেক জটিল ও কুটিল হতে হবে। ধড়িবাজ, খেয়ালি, বেপরোয়া, শ্যেনদৃষ্টি, হারামি, সন্ন্যাসী, রুগী, জাঁবাজ, কীর্তনীয়া, জাদুবাজ সব হতে হবে তাঁকে, তবেই যুগের উপযোগী গদ্য লেখা সম্ভব। আমাকে মনি বাউরি বলেছিল, বাবুর ধান আর ধেনোর খুব পহিচান দেখছি। কথাটা ফিলজফি ঠেকেছিল। তো, কথাটা হচ্ছে ধান, ধন আর ধেনো আমাদের অভিজ্ঞান থেকে আসে। যারা ধানের চাল খায়, তারা কি ধেনোর টেষ্ট বোঝে? আমি বহুল চালু কথা-কিসসার মুখোস নুচতে চাই, ‘কথা’য় কথা-বানাবার-খেলাই গদ্যকারকে ডোবায়, ন্যারেটিভিটি, যা থেকে আমি বাঁচতে চাই। পুরো এখুনি পারছিনা হয়ত, কিন্তু মাথায় আছে । লিখছি কি, ছাই লিখছি, কী লিখছি হরদম বুঝিনা আমাকে দিয়ে কে লেখাচ্ছে, তা-ও। লিখছি কিছু, ভাবছি হয়ত অন্য। মজার উইট আনছি, হিউমার, অথচ মনটা কী বাজেরকম বিষন্ন। এমনও হয়েছে কী লিখে ফেলেছি, কতটা, পরদিন হয়ত অবাক হয়েছি পড়ে। আমি দিনরাত এক থাকি না, যেন এক সুপারি নেওয়া খুনে, ছনভন করে ঘুরে বেড়াই, কখনো নিজেকে খুব খেলো করে মিশি, কে-টির জল-বয়, মাতাড়ু, কখনো নদীতীরে একাকী দোতারা হাতে নিঃসঙ্গ বাউল। বিশ্বাস মানুন, আমাকে যা দেখতে, আমি তা-ই নিছক নই। কখনো গান্ধীর রাজনৈতিক-নৈতিকতা ধর্ষিত ইজারাদার গেরো সিং, কখনো গোদারের ছবি দেখে বেরনো ভাবুকরাম। কখনো লাইনবাজ, কখনো-বা সভ্যতা বা সম্পর্কের জটিলতার পঙ্কিল চক্রব্যুহে ফাঁসা আসামি। ……তো, মজাটা হচ্ছে, হারিয়ে যাবার তো কোন রোকটোক নেই, ফিলজফিকাল ব্যারিয়ার নেই। হারিয়ে যাই আর-কি। ওগুলো আমার ‘দেখা’ বা ‘অভিজ্ঞতা’ হয়ে উঠে আসে। কিন্তু বেশী না। দশজন লেখকও যদি ট্রান্সপারেন্ট হয়, নিজেকে হুবহু তুলে আনে, মাইরি বলছি, বাংলা সাহিত্য ফাটাফাটি হয়ে যাবে। তখন কেউ কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ছোট বা বড় নয়, তখন প্রত্যেককেই আলাদা আলাদা চোখে দেখা হবে। পড়া হবে। এরম গড্ডালিকা চালে তো সামুদায়িক ভোজ খেতে যাই আমরা। মিথিকাল প্যারালালিজম্ বলে বাহ্যভাষায় একটা কথা আছে, কবুল করি। রুটি গুড়িয়ে চা খেত বলে ভারতচন্দ্র সৃষ্টি জানত না, এ বিশ্বাসে আনা বারণ। তবে কল্পনার সোর্ড চালাতে হবে, দ্বিমত নেই। আরে বাবা, শয়তানের কি সৌন্দর্যবোধ থাকে না? একজন চরম লম্পটও মেয়েটাকে তুলে নিয়ে যায়, মালটা ‘খাসা’ বলে।
    দীপঙ্কর দত্ত : আপনি সাহিত্য আর পর্নোগ্রাফির মধ্যে ভেদ মানেন না ?
    অজিত রায় : পশ্চিমের সাহিত্য ও সংস্কৃতির দিক থেকে তথাকথিত ভাবে পোক্ত দেশগুলিতে সাহিত্য আর পর্নোগ্রাফির মাঝের গ্যাপটা খতম হয়ে গেছে। আমি মনে করি পর্নোগ্রাফি সাহিত্যেরই একটি অনিবার্য আর এস্টাবলিশড্ genre। এই তো কিছুদিন আগে Georges Betaille-এর ‘Story of the Eye’ পড়ছিলাম, যার ওপর ৪৫ পাতা সমীক্ষা লিখেছেন Susan Sontag আর Ronald Barthes, তারপর Giyotat, যাঁর ‘Eden, Eden’-এর প্রিফেস্ লিখেছেন Michel Foucault,- এঁরা প্রত্যেকে সোকল্ড পর্নোগ্রাফি লিখেই সাহিত্যিক হয়েছেন ; শেষের দিকে ফুকো নিজেও ঐরকম একটা বই নাকি লিখেছিলেন। ‘শহরে’ সুবিমল মিশ্র যে গল্পটা লিখেছেন, ‘আলো আমার আলো ওগো’, সেটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী গল্পের উৎকৃষ্ট উদাহরণ, আবার বাংলা পর্নো-সাহিত্যেরও। প্রয়োজন বা আর্জ হলে আমিও ওরকম উপন্যাস লিখব। তবে আমি তাকে আমার সাহিত্যেরই হিসসা হিসেবে স্বীকৃ্তি দেব। সাহিত্যের নির্দিষ্ট কোন বিষয় আছে বলে আমি মানি না।
    বিমলকান্তি ভট্টাচার্য : আপনি কি প্রতিষ্ঠান-বিরোধী নন ?
    অজিত রায় : প্রথম কথা, সাহিত্যের মত নিত্য-প্রবহমান শিল্প প্রকরণের, যা কিনা গনগনে আঁচের মত, নদীর মত প্রতিমুহূর্তে প্রতিটি গড়ে ওঠা আধুনিকতা অভাবনীয় নতুনত্বের তোড়ে ভেসে যায়, দাঁড়ায় না এক মুহূর্তও, সেখানে একজন লিখিত সাহিত্যের লেখকের পক্ষে প্রতিষ্ঠানবিরোধী হওয়া খুব মুশকিল। কেউ যদি বলছেন তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী, সেটা নিছক তাঁর আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতা ছাড়া আর কিছুই নয় । তাছাড়া, এর তো কোন বাঁধাধরা ছক নেই। প্রতিষ্ঠান মুখিনতা আর বিরোধিতা দুটোই বহুস্তর পরম্পরায় পরস্পর হরদম মুখোমুখি। ঐ ছকের রাস্তাটা থেকে কেটে বেরিয়ে, বেরোতে থাকার মুহূর্তে যে-সব বাধা তার সঙ্গে যে সংঘাত সেটাই সেই মুহূর্তের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। কিন্তু যে মুহূর্তে চালু ছকটা ভেঙে ফেলছি, পরমুহূর্তেই আরেক ছকে বন্দী, তখন আমিই প্রতিষ্ঠান, বা প্রতিষ্ঠানমুখী। তখন আবার নিজেকে ভাঙতে হবে, পাল্টাখুন, জহরব্রত চালাতে হবে । তখন ফের সক্রিয় বিরোধিতা। এভাবে না-ফুরোনো লড়াই। ফলে কে কখন প্রতিষ্ঠানমুখী বা বিরোধী, তা নির্ণয় করার কোন উপায় নেই। তবে বাংলাবাজারে যে ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা’র ঝাণ্ডা উড়তে দেখছি, সেটা সহজে চেনা যায়। আনন্দবাজার, দেশ কে গুনে গুনে ক’টা গাল ডেলিভার করো, ব্যাস্, তুমি বড়কা প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব’নে গেলে। থাক তোমার পরনে অ্যাডিডাসের গেঞ্জি, নর্থস্টার জুতো, রেমন্ডের স্যুট, মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সব থুতু তোমার সর্বাঙ্গে- কিন্তু তুমি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। আমি তো ভাই বাংলা লেখালেখির জগতে গত বিশ বছর ধরে যা দেখছি, কাউকেই সম্যক অর্থে অ্যান্টি-এশটাবলিশমেন্ট বলতে পারি না। প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিভিন্ন অনুষঙ্গ অনেকের মধ্যে দেখা যায়, আমার মধ্যেও আছে, কিন্তু যে-মুহূর্তে আমার রচনা-উৎপাদনের কাজ চলছে, আমি সক্রিয়, কিন্তু লেখাটা শেষ হতেই আমি মৃত, তখন আবার সেই ছকে। বাংলাবাজারে একজন সত্যিকারের প্রতিষ্ঠানবিরোধীর, মানে একই সঙ্গে যিনি থিওরি এবং প্র্যাকটিসে, সামাজিক ও ব্যাক্তিগত কারবারে সেই বিরোধিতার একটা সদা-সক্রিয় রূপ নিজের সঙ্গে মিশিয়ে চলতে পারবেন, সেরকম একজন প্রকৃত প্রতিষ্ঠানবিরোধীর চাহিদা তাই থেকে গেছে। তাঁকে আগাগোড়া ট্রান্সপারেন্ট হতে হবে, ভেতর-বার স্বচ্ছ হতে হবে। যিনি পর্নোগ্রাফি আর সাহিত্যে ভেদরেখা টানেন, সেই স্বঘোষিত প্রতিষ্ঠানবিরোধী বাঙালীবাবুটিকে আপনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী বলবেন? যাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কোন প্রতিফলনই পঁয়ত্রিশ বছরের সাহিত্যচর্চায় প্রকাশিত নয়, তাঁকে? আত্মনৈরাজ্যের এই কীর্ণ ভূমিতে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ধারণাটাই এখন ভাঁওতা হয়ে গেছে। এবং লেখালেখির ক্ষেত্রে, আমি তো বলব, প্রথাবিরুদ্ধ শাস্ত্রবিরুদ্ধতাও এক ধরণের ব্যতিক্রমী মিথ।
    মৌলিনাথ বিশ্বাস : তোমার কাছে জীবনের শেষ অর্থ কী? যৌনতা কি তোমাকে সৃষ্টিশীল করে? করলে, কিভাবে? আমি তাত্ত্বিক অবস্থান বুঝতে চাইছি ।
    অজিত রায় : বিগত এই চব্বিশ বছরে আমি হয়ত অনেক কিছু করতে পারতাম-কিন্তু, অন্য দিকে না ‘পালিয়ে’ আমি যে লেখালেখিকেই আত্মস্ফূরণের আধার বা আধেয় হিশেবে ধরেছি, বরণ করেছি, লেখালেখি ঘিরেই আমার জীবনের যা-কিছু যখন, জীবনের অর্থ বা শেষ অর্থও, বলা বেশি আমার সমস্ত ভাবনা এবং খনন এই নর্মজীবন, যা আসলে কর্মজীবন,--- একেই ঘিরে। তাতে যদি জীবনের ‘অনর্থ’ বেরোয়, তা-ও সই। আগেই বলেছি ব্যাখ্যাহীন না-ইলাজ্ ডিপ্রেশন বা অব্যক্ত মর্মপীড়ার কথা-লেখালখি, একমাত্র লেখালখিই সে-থেকে আমাকে মানসিক উপশম দ্যায়, দিতে পারে। আমি এখন জীবন আর সাহিত্যের মাঝে হাইফেনটুকুও রাখবার পক্ষপাতী নই, এটা আমার ভেতর থেকেই এসেছে। ফলত, আমি যদি নিজেকে জানতে চাই, সম্পূর্ণ আবিষ্কার করতে চাই লেখার মাধ্যমেই আমাকে তা করতে হবে। নিজের বাইরের ‘স্ব’-এর সঙ্গে ভেতরকার সংগুপ্ত ‘আমি’র ‘স্ব’-কে মেলাবার চেষ্টা-সেই আমার লক্ষ্য। প্রতিমুহূর্তের বদল-খাওয়া ‘আমি’ কে ধরা। সেই ‘সত্য’ বা ‘অর্থে’র জন্যে আত্মখনন। পাশাপাশি গদ্য, শব্দকলাপ, তার মজা বা রগড়কে উপভোগ করা।
    আর, দ্বিতীয় যে প্রশ্নটা, যৌনতা আমাকে সৃষ্টিশীল করে কিনা, এ প্রশ্নেরও জবাব এতখানি হতে পারে যে পৃথক একটি প্রবন্ধই হয়ে যায়। তবু চেষ্টা করি। ‘যৌনতা’ তো আমাদের বানানো শব্দ, পিতৃ্তন্ত্রের ধারণায় খরাদ করা, এবং হালের আমদানি। আগে যখন পুরুষ-প্রকৃতি সম্পর্কের ব্যাপারটা ছিল, তখন ‘যৌনতা’ ছিল না। ধর্মশাসন আর অ্যাকাডেমীর ট্যাবু ব্যাপারটার সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে যৌনতা তার সনাতনী ঝংকারই ভুলে গেছে। উনিশ শতকের ফর্সারা হঠাৎ ধরে ফেলল যে যৌনতা জৈব-প্রজননের প্রবৃত্তিগত তাড়না হলেও, তাকে মন আর মগজ দিয়েও নাকি ‘করা’ যায়। যে-কারণে যৌনতার প্রতিশব্দ হিসেবে আমরা পাচ্ছি ‘কামশক্তি’ আর ‘কর্মপ্রেরণা’ শব্দ-দুটো যদিও এই ধারণা ফ্রয়েডের লিবিডো ধারণা থেকে খুব-কিছু ফারাকে নয়। ফ্রয়েড যৌনতাকে একটা স্বয়মভূ ব্যাপার ভেবে এগিয়েছিলেন। সুতরাং তাঁর ‘আমি’ হয়ে গেল ‘লিঙ্গ’। মানুষের সৃজনশীলতা, ফ্রয়েড বলেছিলেন এই লিঙ্গবোধ থেকে চাগায়। এ থেকে কিছু সরে এসে, এ-যুগের তত্ত্বদর্শী মিশেল ফুকো বললেন, সমাজের যে-কোন প্রবৃত্তিগত ক্ষমতার সম্পর্ক এবং যৌন-সম্পর্কগুলো, সরাসরি আড়ালে বা আপাত-অযৌন মনে হলেও তা আসলে প্রতাপেরই স্ফূরণ। আমি এসবের কোনটাই অগ্রাহ্য করছি না, কিন্তু যদি যৌনতা বলতে এখনো শুধু জৈবিক কামতাড়নাকেই ইঙ্গিত করা হয়, দুঃখিত, ঈশ্বরের মত তথাকথিত যৌনতাকেও আমার ভাবনার ভারসাম্যে কোথাও বসাতে পারছি না। কেননা, ঈশ্বরের কথা বাদ দিলেও, সেই ‘যোনি’-উদ্ভূত যৌনতা আমার কাছে ততখানি যথার্থ, তার অনেক বেশি কল্পনা। একটা নিরাবয়ব ফোর্সের মত আমার কাছে যৌনতা। এটাকে যে-যেমনভাবে ভাবতে চাইবে, তার কাছে তা-ই যৌনতা। কেউ নারীর পায়ের টো থেকে চুলের ঘ্রাণ অব্দি সর্বত্র যৌনতা পায়, কেউ-বা-যেমন উদয়ন ঘোষ, -কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা লতা মঙ্গেশকরের গলা শুনেও সেটা ফিল্ করেন। আমার এক বান্ধবীকে দেখতাম, সুন্দর-কিছুর রসময় বর্ণনাই তাকে বেসুধ করে ফেলত, জাগতিক যা-কিছু শুধু কল্পনায় ছোঁয়া যায় অথবা অনুপম কোন কিছুর স্বপ্নই তাকে অরগ্যাজমে পৌঁছাতে দিত। নতো, আমার কাছে যৌনতা খানিক ঐরকম। যৌনতা শব্দের উচ্চারণ-মাত্রে যে আমার লিঙ্গ বা যোনি মনে পড়ে ঈশ্বর বা অদৃশ্য-শক্তি বলে ভাবি, যে আমাকে ক্রিয়েটিভ রাখছে, আমার ‘আমি’কে স্টিয়ার করছে, হোক সে ‘অহং’, কিন্তু সেই সত্য তো আমি অনুভব করছি! সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘কামুক’রাই এগিয়ে। যৌনতা, হ্যাঁ, আধুনিক অভিধায় তো তা-ই বলব। আসলে এ-দেশে, বহির্বিশ্বেও ‘তত্ত্ব’ হিশেবে যৌনতা এখন এমন পিলপিলে পর্যায়ে আছে যে বিষয়টি উত্থাপন করাই দুরূহ এবং ঝুঁকির। পিতৃতন্ত্র আর ধর্মের ট্যাবু আমাদের গবেষণা আর জ্ঞানার্জনের ফাটক রুদ্ধ করে রেখেছে । ধর্ম বা আধ্যাত্ম নিয়ে আমরা যতটা ভেবেছি, অনাস্থা আর অস্থিরতার পাল্লা যেন ক্রমশ ভারি হচ্ছে। সংখ্যাতাত্ত্বিক হিশেব নেই, কিন্তু অনুমান করি অ্যান্টি-আরবান মানসিকতায়, নাস্তিকদের দিকেই যেন ভিড় বাড়ছে। যুক্তির কাছে পরাস্ত প্রফেটদের দাঙ্গা-উৎপাদক শাস্ত্রের উল্লাস। ঐ ধর্ম নিয়ে যতখানি মেতেছি আমরা, তার চেয়েও বেশি দরকার যৌনতা নিয়ে। এথোপোয়েটিক্যালি ভাবতে হবে ব্যাপারটা নিয়ে। ফ্রয়েডের ‘সৃজনশীলতা’র ব্যাখ্যাকে নারীবাদীরা মনগড়া বলে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, ভাবতে হবে নতুন করে । কেননা, ‘মন’ তো বস্তু-নিরপেক্ষ অন্য কিছু না। হ্যাঁ, ‘কামশক্তি’ অর্থে নয়, ‘কর্মপ্রেরণা’ বা ‘সৃজনশীলতা’ হিশেবে যৌনতাকে আমি মান্য করি।
    সঞ্জীব নিয়োগী : ‘শিল্প’ ব্যাপারটাই কি একটা কৃত্রিম ব্যাপার নয়? শিল্পের কোন ধারা-ই কি এই কৃত্রিমতা (Imitation) এড়াতে পারে? সম্ভব? কীভাবে, কীভাবে নয়? এ প্রসঙ্গে ‘বাস্তবতা’র দাবি-টাবি কী উপায়ে বিশ্লেষিত হবে?
    অজিত রায় : তুমি যে গোড়াতেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পাথরডাঙ্গা গ্রিস থেকে মাইমেসিস শব্দটা ঢুয়ে এনে আমার পিঠে বসালে, ধন্যবাদ, সেই সুদূর প্লেটো-অ্যারিস্টটল্, হোরেস, মধ্যযুগ আর রেনেশাঁর কর্তাদের থেকে ধেয়ে আসছে শব্দটা, এটা নিঃসন্দেহে শিল্প সাহিত্যের ‘সংজ্ঞা’ নিরূপণে তুমিও সত্যের কেন্দ্র-বিন্দু থেকে খুব অল্প দূরেই আছো। অনুকরণ বা মাইমেসিস হলো সর্ববিধ কলার genus. অনুকরণের রীতি-ছন্দ, ভাষা আর সঙ্গতি। সাইকোলজিক্যালি, লেখক লেখে মূলত দুটি কারণে ----- অনুকরণ-বৃত্তি আর সঙ্গতি-বোধ। Imitation as an Aesthetic term, এটা এখনো অব্দি অগ্রাহ্য হয়ে যায়নি। চারুশিল্প বা fine art কথাটা গ্রিকরা জানত না। তাদের পরিভাষা : ‘মাইমেটিকাই টেকনাই’। All art is mimesis কথাটার প্রবর্তক অ্যারিস্টটল্ নন, প্লেটো এবং তার আগেও কথাটা চালু ছিল গ্রিসে। অনুকরণ বা Imitation শুনলে মনে হবে স্বাধীন কল্পনার চান্স নেই ----- যদ্দৃষ্টং তল্লিখিতং গোছের। তা তো আর নয়। শিল্পীরা অনুকরণ করে as they ought to be . একটু আগে যেটা বলেছি, শিল্পের অনুকরণ শুধু বাহ্যদৃশ্য বা ঘটনা নয়, তার তিনটে বিষয়- চরিত্র, আবেগ আর ক্রিয়া। এগুলো ভেতরকার জিনিশ । যে-কারণে পরবর্তীকালে সাহিত্য-শিল্পে অনুকরণের ‘বিষয়’ হয়েছে- মানুষের জীবন, জীবনের মানসিক, আত্মিক আর দৈহিক আচার। প্লেটো-অ্যারিস্টটলের সময় wit, taste, imagination, fancy, feeling এসব শব্দের আবির্ভাব ঘটেনি, ফলে ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন্ সম্পর্কে তখন কোন ধারণা গড়ে ওঠেনি। অথচ লেখালেখি ব্যাপারটা সৃজনশীল কল্পনা বৃত্তিরই কাজ। ‘কৃ্ত্রিমতা’ কোন্ অর্থে বলছো বুঝতে পারছি না, লেখালেখি তো বাস্তবের হুবহু অনুকরণ বা প্রতিরূপ নয়, ---- সেই বাহ্যবস্তু বা বাস্তব লেখকের মনে যেভাবে প্রতিভাত, তারই প্রেজেন্টেশন্। লেখার যাদু লেখকের বুদ্ধিতে নয়, অনুভবে, কল্পনাবৃত্তিতে। শিল্প সত্যের রূপাভিব্যক্তি, সত্যের ধারণামাত্র নয়। আসলে, আমি যখন লিখি, অভিজ্ঞাত অভিজ্ঞান থেকে লিখি --- সেই জগৎটা কিন্তু অন্ধকার আর মায়ায় ঢাকা, মায়া সৃষ্টিতে দক্ষ না হলে বড় সাহিত্যিক হওয়া যায় না। অমিয়ভূষণ সম্ভবত একেই বলেতে চেয়েছেন সত্ত্বগুণ, এটা আমার চেয়ে অনেক বেশী মাত্রাই পাই কমল চক্রবর্তী লেখায়। সন্দীপন বা সুবিমলে তেমন পাই না। কমল এখনও সেজন্য আমাকে দিয়ে পড়িয়ে নেন। আসলে সাহিত্যের যে ‘কৃ্ত্রিমতা’ বা Imitation, তা কিন্তু প্রচন্ডভাবে Phantasia গোছের, জ্যান্ত । যে-কারণে মধ্যযুগে Phantasia আর Imagination শব্দ-দুটো একই অর্থে ব্যবহৃত হতো। যদিও ফ্রেকাসতোরো বলেছিলেন Phantasia হলো reproductive power আর Imagiও9nation হলো unifying power. আঠারো শতকে এসে প্রথম শব্দ পাচ্ছি ‘এস্থেটিক’। মানে ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশনের অটোনমি সাব্যস্ত না হওইয়া পর্যন্ত খাঁটি এস্থেটিকের জন্ম হয়নি। গামবাতিস্তা ভিকো থেকে এস্থেটিকের শুরু। এইভাবে ভিকো থেকে কান্ট, অনেক তত্ত্বদর্শী্রাই শিল্প-টিল্প নিয়ে নানারকম কথা বলেছেন, কিন্তু শিল্পের মূল যে-সংজ্ঞা প্লেটো-অ্যারিস্টটল অস্পষ্টভাবে দিয়েছিলেন, সেটা থেকে আলাদা বা নতুন কোন লক্ষণ কেউ নির্দেশ করতে পারেননি। অ্যারিস্টটলের ‘মাইমেসিস’ আর কান্টের ‘জাজমেন্ট’ পৃ্থক ধারণা নয়। উনিশ শতকে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, হেগেল, কোলরিজ, ভিক্টর কুঁজো, শেলী, হার্টম্যান, প্রুধোঁ, নীৎসে, টলস্টয় এঁরা আমাদের মাথা খারাপ করেছেন মাত্র, নতুন কিছু শোনান নি। আমাদের দেশেও রসবাদ, অলঙ্কারবাদ, নীতিবাদ, ধ্বনিবাদ, রম্যার্থবাদ এমনি আরও কতই না মতবাদ সাহিত্য শিল্পের-আত্মার পোস্টমর্টেম করবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই চেষ্টার শেষ ফল কিন্তু এক,-সবাই লেখালেখিকে অনুভব-কল্পনা-বুদ্ধিমিশেল যৌগিক মানসিক ব্যাপার বলে মনে করেন। এই প্রাগুক্ত মতবাদ আর লেখকেরা প্রত্যেকে ছিলেন ক্লাসিকাল গোষ্ঠীর, রক্ষণশীল আর এঁড়ে। সুতরাং তাঁদের উত্তরসূরীরাও, আজও, শিল্প সাহিত্যকে ‘অনুকরণ’ মনে করবেন। কিন্তু আমি মনে সাহিত্যে আজ যেরকম ভোলবদল আর পরীক্ষা চলছে, তা কোনক্রমেই নিছক ‘নকল’ হতে পারে না।
    রীনা ভৌমিক : আপনি শব্দরাজ্যে অরাজকতার তাঁবেদারি করছেন?
    অজিত রায় : অরাজকতার তাঁবেদারি! আমি করছি? মানে? এই কালো পতাকাটা তো পৃথিবীর সমস্ত ভাষাসাহিত্যকেই গোড়া থেকেই সয়ে আসতে হয়েছে বুন্টি। অ্যাংলো-স্যাক্সনে ফরাসি ভাষার মিক্সচার হচ্ছে যখন ইংল্যান্ডে, এইরকমই গেল-গেল হল্লা। সেই হাইব্রিডাইজেশনে লকড়ি লাগালে ইংরেজি সাহিত্য আজ এমন লাফ-মারা হতে পারত? ইওরোপের সব ভাষাই এমনি, জারগন্ । সব জায়গাতেই তোমাদের দল ছিল, গেল-গেল ছিল। কথাটা হলো, মুখের কথাটা যে সাধুভাষারই অপভ্রংশ, সেইটে কেউ বলে না ; শুধু সাধুভাষাই খানিক মুখের ভাষা ঢুকেছে অমনি হারেরেরে-হারে হামলা। তারবাদে, বাংলা ভাষারই কেঁচো যদি খুঁড়তে চাও, খোঁড়ো, দেখবে এ ভাষার পাতনটাই তৈরি হয়েছে সংস্কৃত শব্দের ডোয়ার্ফ আর ঠুঁটো-নুলো আধভাঙ্গা শব্দ নিয়ে। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, অক্ষয় দত্তরা তো বিভক্তিহীন সংস্কৃতটাকেই ‘বাংলা’ বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর মহাকবি মাইকেল মধুসূদন, উনি যখন আমাদের গ্রামে যান, তখন তো ভালো বাংলাই জানতেন না। ওই তোড়ফোড় গোছের এপিকগুলো, ওগুলো তো বেশির ভাগ আরকেইজম্ দিয়ে সারা। ডিকশনারি ঘেঁটে, পথচলতি মামুলি শব্দ এসবই ছিল মাইকেলের বেসিক নিওলজি। তাছাড়া, তার নাটকগুলো দ্যাখো, দীনবন্ধু মিত্র, ----- বেশি না, বঙ্কিমবাবুর মৃণালিনী আবার করে পড়ে দ্যাখো, ওগুলো কি হুতুম প্যাঁচার কোঠায় পড়ে না? রবীন্দ্রনাথ তো প্রথম ক’দিন ফয়সালাই করে উঠতে পারেন নি, প্রবন্ধগুলি মসনদী ঢঙে লিখবেন নাকি বীরবলী আন্দাজে। তো, আমার চেষ্টাটা, বলতে পারো, একটা তরতিব্। ঐ চলে আসা কালো পতাকার সারিতে, আরেকটা। গরম কড়াইয়ের ছনছন হলে তো কবেই উবে যেতাম।…তো, যে-কথাটা আমার তরফে বলার, আমি ভাই বিহার বাংলা ঝাড়খন্ডের ছিলকা-খাওয়া লোক, পিতৃভূমি বাঁকুড়া, মাতৃভূমি মানভূম। হাজার কিশিমের শব্দ শুনে আসছি হামাগুড়ির বয়স থেকে। কাজ করতে বসে যতরকম ভাষায় আমার দখল, তৎসম বাংলা তো বটেই, তদ্ভব, দেহাতি বাংলা, হাটবাজারের, ভাঁটিখানার বাংলা, ডেলি প্যাসেঞ্জারের বাংলা, তারপর হিন্দী, চোয়াড়ে হিন্দী, বিহারি বুলি, লালু-রাবড়ি বুলি, ভোজপুরী, মগহী, ঝাড়খন্ডী, খোরঠা, মায় উর্দু-ইংরেজি, যেটা যখন যতটুকু দরকার টপাটপ তুলে এনে গেঁথে দিই। মনে করি, একজন লেখক যতরকম শব্দ জানেন, সব ঢুয়ে এনে বসাতে হবে গাঁথুনিতে । এভাবে বাংলা সাহিত্যের ক্যানভাস স্প্রেড করবে। ‘কথা’য় নতুন জেল্লা ফুটে উঠবে। আমি সাহিত্যে শেকড়-বিহীনতার খেলাপ। মনে করি শেকড়হীন সাহিত্যপ্রচেষ্টা বা ঐতিহ্যবিরোধী সৃষ্টিপ্রযত্ন, কথাগুলি শুনতে যতই রেভলিউশ্যনারি লাগুক, গোটাগোটি এই ধাঁচের কোনও অভ্যুত্থান হতে পারে না। লেখককে, এবং সাহিত্যকে, জমিনের থেকে শব্দ ওঠাতে হবে, লোড করতে হবে। আর, ‘গদ্যে ঢালাও হিন্দী শব্দের অনুপ্রবেশ’। ছ্যা, আমি কি তাই করেছি নাকি? হাসালে দেখছি।
    বারীন ঘোষাল : সাহিত্যকর্মকে তুমি বলেছো পলায়নি বৃত্তি। বলেছো, ‘কাজ আর কৃত্যের বাদাড় থেকে পালিয়ে অক্ষরের মুজঘাসে লুকনো’। এটা তুমি বিশ্বাস করো ?
    অজিত রায় : পলায়ন। হ্যাঁ, বিশ্বাস করি মানে, খটকার কথায় আমি বলেছি। অবশ্য সেভাবে দেখলে মানুষ যা কিছু করছে সবেতেই, পালাচ্ছে। গান শোনা, ক্রিকেট, সোপ অপেরা, বউ-বাচ্চা সামলানো, ব্যাঙ্ক সামলানো, ভালমন্দ খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া, রাতে কাজবাজ সেরে ঘুমিয়ে পড়া, ঐ ঘুমোনোও কিন্তু একরকম পালানো। মানুষ এসবের মধ্যে নিজের স্বপ্নকে দ্যাখে, আর স্বপ্ন দেখবে বলে ঘুমোয়। লেখকের কাজটা তার-চে আলাদা কিছু নয়। তফাৎ এই যে, লেখক জেগে জেগে স্বপ্ন দ্যাখে।
    বারীন ঘোষাল : এই পলায়ন কেন?
    অজিত রায় : আমি কেন লিখি এর জবাব আত্মজীবনীতে দিয়েছি। যে, কেউ আমাকে পেছন থেকে স্টিয়ার করছে, কলকাঠি নাড়ছে। আমার মনে হয়, মাত্র সেই কারণেই শুধু নয়, লেখক পালাতে চায় নিজের দুরারোগ্য বা অব্যক্ত ডিপ্রেশন্ থেকে রেহাই পেতে, অমিয়ভূষণ বারবার যাকে ট্রমা বলে উল্লেখ করেছেন। আমি গভীর ও ব্যাখ্যাতীত ডিপ্রেশনে যখন ভুগি মাঝেমধ্যে, তখন স্ক্রু ড্রাইভার খুঁজি, খুরপি, হাতুড়ি, স্কেচপেন বা বোতল। সেমনি, কলমও খুঁজি। অমিয়ভূষণ ট্রমা বলতে অবশ্যই গ্রিক শব্দকোষে যে-অর্থে, সাইকিক ট্রমা, কবি-লেখকদের মধ্যে অব্যক্ত প্রতিকারহীন না-ইলাজ মানসিক কষ্ট, অন্তহীন ব্যথা। লেখকরা এই ট্রমা থেকে মানসিক মুক্তি পেতেই স্বপ্নবৃত্ত রচনা করে, লেখা, গল্প-উপন্যাস, সেই স্ব-সৃষ্ট স্বপ্নবৃত্তে পাক খেয়ে চলে। স্বপ্ন নির্মিতি পেলে, মানে লেখাটা বেরিয়ে এলে সে সুখও পায়। ঐ সুখ হল রস । রস না-পাওয়া কোন লেখক ‘সাহিত্যিক’ নয়, কবি নয়, স্রষ্টা নয়। সেই তার পরিপাশ আর সময় থেকে বেরিয়ে, বন্ধনমুক্ত প্রাণের এহ্সাস। কবি তখন শিশুর মতো। তার মৃত্যুভয়ও লোপাট তখন।
    তনুময় গোস্বামী : আপনি লেখালেখিকে কখনও ‘spiritual practice’ হিসেবে দেখেছেন ?
    অজিত রায় : জীবনে হয়ত অনেক কিছুই করতে পারতাম, কিন্তু, অন্যদিকে না ‘পালিয়ে’ আমি যে লেখালেখিকেই আত্মস্ফুরণের আধার বা আধেয় হিশেবে ধরেছি, লেখালেখি ঘিরেই আমার জীবনের যা-কিছু যখন, জীবনের অর্থ বা শেষ-অর্থও, বলা বেশি আমার সমস্ত ভাবনা এবং খনন এই নর্মজীবন, যা আসলে কর্মজীবন,--- একেই ঘিরে। তাতে যদি জীবনের ‘অনর্থ’ বেরোয়, তা-ও সই। আগেই বলেছি ব্যাখ্যাতীত ডিপ্রেশান্ বা অব্যক্ত যন্ত্রণার কথা- লেখালেখি, একমাত্র লেখালেখিই সে-থেকে আমাকে মানসিক উপশম দেয়। এখন আমি জীবন আর সাহিত্যের মাঝে হাইফেনটুকুও রাখবার পক্ষপাতি নই। ফলত আমি যদি নিজেকে জানতে চাই, সম্পূর্ণ আবিষ্কার করতে চাই, লেখার মাধ্যমেই আমাকে তা করতে হবে।
    তনুময় : নতুন উপন্যাস শুরু করার আগে আপনার কী ধরণের প্রস্তুতি থাকে? কোন নির্দিষ্ট গবেষণা ? হলে, তা কতদিনের? উপন্যাসের চরিত্রগুলোর নাম আপনি কীভাবে নির্বাচন করেন? আপনি কি কখনও রাইটার্স ব্লকে পড়েছেন?
    অজিত রায় : লেখালেখি খরিশ জিনিশ। জগদ্দল পাথর দেওয়া হয়েছে হাতে, তাকে ঠেলে-ঠেলে তোলা। প্রস্তুতি এটুকুই যে পাথরটা কখন হাতে আসবে। ওটা না-পাওয়া-অব্দি লেখা খোলস ছাড়ে না। তীব্র যন্ত্রণার অনুভূতি, সেটাই লেখার ভাবনাকে প্রেগন্যান্ট করে। উপন্যাসের মূল চরিত্রই আমি। সুতরাং পাণ্ডুলিপির প্রথম খসড়ায় ‘অজিত’ নামটাই বসাই। ফের হঠাৎ লাগসই নাম মাথায় এলে অজিত কেটে ওটাকে পেস্ট করে দিই। হ্যাঁ, রাইটার্স ব্লক একসময় হয়েছিল বইকি! আমার শেষ-চাকরিটা করার বছরগুলোতে, ১৯৮৯ থেকে ’৯৫- এই কাল পরিধিতে। মায় বাংলাভাষা ভুলে, বাংলা ভুলে , চাদ্ধার কেমন লোপাট আর থম্-মারা। সুতরাং বিষণ্ন ও মৃত্যুমুখী, নিজেকেও কেমন অকেজো ও মৃত ঠেকতো, তদুপরি ফতুর।
    .
    স্ত্রীর মৃত্যুর পর অজিত লিখেছিল, “বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। এ এক নতুন প্রত্যাবৃত্তি। এসেছিলাম তিন, ফিরছি দুজন। হয়ত আরও-কিছু মুছে ফিরছি। এতদিন অনেকখানি বোহেমিয়ান জীবন তো কাটালাম, অনেকে সঙ্গ‌ও দিয়েছেন। এবার অন্তর্মুখী হওয়ার পালা। এটা সত্যিই অনুভব করছি। একটু গুছনো জীবনে ফেরার তাগিদ। স্ত্রী আর মেয়ের সঙ্গে তো তেমন উপভোগ করতে পারিনি জার্নিটা, এবার প্রান্তসীমা অবধি একা মেয়ের সঙ্গলাভে কাটিয়ে দেখি। সব সময় একক থাকাই লেখার রসদ জোগায় এমনটা এখন আর মনে হচ্ছে না। অর্থাৎ, যথাসম্ভব নিজেকে পাল্টানোর পালা, জীবনকে নতুনভাবে দেখার পালা। হ্যাঁ, আমার পক্ষে এও এক চ্যালেঞ্জ, আমিই গ্রহণ করলাম। জীবনকেই কামনা করি, শেষে ও প্রথমে। জীবন একটাই, দেখা অনেকরকম।”
    তা আর হলো না । 
  • সজ্জল দত্ত | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪৩512514
  • ব্যারাকপুর স্টেশন পত্রিকার  মুখোমুখি মলয় রায়চৌধুরী 
    ( " বারাকপুর স্টেশন " কবিতা পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায়   মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সজ্জ্বল দত্ত। সাক্ষাৎকার সহায়তা গৌতম চট্টোপাধ্যায় ও রাজদীপ ভট্টাচার্য) 

    সজ্জ্বল দত্ত: মলয়দা , বারাকপুর স্টেশন পত্রিকার পক্ষ থেকে প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। আপনি এই সাক্ষাৎকারে সম্মত হয়েছেন এজন্য আমরা যারপরনাই উল্লসিত। শুরুতেই আপনার ছোটবেলার কথা, জন্ম, পারিপার্শ্বিক এবং বাল্যশিক্ষার বিষয়ে আমাদের যদি একটু জানান।
    মলয় রায়চৌধুরী : প্রশ্ন পাঠাবার জন্য ধন্যবাদ । কিন্তু প্রশ্নগুলো পড়ে বুঝতে পারলুম যে তোমরা আমার বইপত্র পড়োনি, কেননা কোনো প্রশ্নই আমার কোনো বই পড়ে করা হয়নি । আমার বাল্যস্মৃতি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ বইয়ের চারটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে । সাম্প্রতিক সংস্করণ প্রতিভাসের, নাম ‘ছোটোলোকের জীবন’ । আমি জন্মেছিলুম পাটনায় সরকারি হাসপাতালে ১৯৩৯ সালে । আমরা থাকতুম ইমলিতলা নামে একটা মহাদলিত আর গরিব শিয়া মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা বস্তিতে । বাবা ছিলেন কুড়িজনের পরিবারের প্রধান রোজগেরে । পরে বড়োজেঠা পাটনা মিউজিয়ামে মূর্তি আর পেইনটিঙ ঝাড়পোঁছের ক্লাস ফোরের চাকরি পান । শিক্ষা পাটনাতেই, রামমোহন রায় সেমিনারি ব্রাহ্ম স্কুলে। সেখানকার গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তীর প্রভাবে মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলুম।

    সজ্জ্বল :  বাংলা সাহিত্য ও কবিতার প্রতি আপনার ভাব-ভালোবাসার শুরুয়াত হল কীভাবে?
    মলয় : আমার পড়াশোনা পাটনায় হলেও, দাদা সমীর রায়চৌধুরীর চরিত্র পাড়ার প্রভাবে খারাপ হয়ে যেতে পারে আঁচ করে ওনাকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল । দাদা পাটনায় আসার সময়ে প্রচুর বাংলা বই আনতেন । আমি তিরিশের দশকের কবিতার সঙ্গে পরিচিত হই । পাশাপাশি ইংরেজি কবিদেরও পড়া আরম্ভ করি, যাদের কবিতাপাঠ ম্যাকলে সাহেবের চাপে স্কুল আর কলেজের পাঠ্যে ঢুকেছিল । ১৯৫৯ নাগাদ বাবা একটা সুদৃশ্য ডায়েরি দিয়েছিলেন, তাতেই কবিতা লেখার চেষ্টা করেছিলুম ।

    সজ্জ্বল :  আপনার দাদা আপনার সাহিত্যচর্চায় কতটা প্রভাবিত করেছেন আপনাকে?
    মলয় : দাদা পশ্চিমবাংলার সাংস্কৃতিক প্রভাবে ভিন্ন চরিত্রের মানুষ ছিলেন । আমার বিপরীত । উনি ছিলেন সোফিসটিকেটেড । আমি মিশতুম পাটনার লুচ্চা-লাফাঙ্গাদের সঙ্গে। ইমলিতলায় ছোটোবেলাতেই শুয়োরের মাংস, ইঁদুর পোড়া আর তাড়ি খেয়ে ভিন্ন ধরণের জীবনে ইনিশিয়েশন হয়েছিল । ইমলিতলার বন্ধুরা আমাকে বেশি প্রভাবিত করেছিল । দোলখেলার সময়ে পাড়ার মহিলারা যৌনতার ইনহিবিশিন বাদ দিয়ে মেতে উঠতেন রঙ খেলায় । আমার প্রথম বন্ধুনি ছিলেন কুলসুম আপা নামের এক কিশোরী, যিনি আমার সঙ্গে গালিব আর ফয়েজ আহমদ ফয়েজের পরিচয় করান । ওনার সম্পর্কে মন খুলে লিখেছি বাল্যস্মৃতিতে । একজন যুবতীর যোনি উনিই প্রথম প্রত্যক্ষ আর অনুভব করতে দিয়েছিলেন।

    সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলন বিষয়ে অবহিত নন যে পাঠক তাঁদের কথা ভেবে আপনাদের আন্দোলনের পশ্চাদপট এবং শুরুর দিনগুলির কথা সংক্ষেপে  একবার আমাদের জানান ।  
    মলয় : হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ৯৯% বাঙালি পাঠক অবহিত নন। পাঠক কেন, তরুণ কবি-সাহিত্যিকরাও জানেন না। অনেকে তো আমার নামই শোনেনি । তাই তাঁদের কথা আর ভাবি না । 

    সজ্জ্বল : ক্ষুধার্ত মানে প্যাটের না চ্যাটের ক্ষুধা? আপনার সম্পূর্ণ সাহিত্যযাপন অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে অনুসরণ করলে এই প্রশ্ন কিন্তু বহুপাঠকের ভেতরে অবধারিতভাবে উঠে আসবেই  মলয় দা, আপনার কবিতা কি আদৌ বুভুক্ষুদের কথা বলে নাকি অহৈতুকী যৌনক্ষুধাকে গুরুত্ব দ্যায়?
    মলয় : কী আর বলি ? আমার লেখাপত্র তো পড়ো না । পড়লে জানতে হাংরি শব্দটা কোথা থেকে পেয়েছিলুম । আর আন্দোলনের তাত্ত্বিক বনেদ কী ছিল । আমি ক্ষুধা শব্দটা ব্যবহার করিনি । চিরকাল হাংরি শব্দটাই ব্যবহার করেছি । 'হাংরি’ শব্দটা প্রথমে পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসারের 'In Swore Hungry Time' বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলুম অসওয়াল্ড স্পেঙ্গলারের লেখা 'The Decline of the West' বইটি থেকে। স্পেঙ্গলারের এই তত্ত্বটির সারমর্ম হলো: 
    “কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।”
    এই হাঙ্গার  শুধু আক্ষরিক অর্থেই হাঙ্গার ছিল না। তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের হাঙ্গার, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষার হাঙ্গার। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। আমার মনে হয়েছিল যে কিছুটা হলেও এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে আমি হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চেয়েছিলুম। এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যৎবাণী বলে মনে হবে ।

    সজ্জ্বল :খুব সত্যি কথা , এ' বিষয়ে আপনিও নিশ্চয়ই অবগত আছেন , হাংরি আন্দোলনের অনুসারীদের কেউ কেউ মনে করতেন যে আপনিই এই আন্দোলনকে পিছন থেকে ছুরি মেরেছিলেন! আপনার কী বক্তব্য ? 
    মলয় : আমি আর ছুরি মারব কেমন করে ? আমার বিরুদ্ধে মামলা চলেছিল ৩৫ মাস। বন্ধুরা বেশির ভাগ রাজসাক্ষী হয়ে আমার বিরুদ্ধে পুলিশে বয়ান দিয়েছিল আর কেটে পড়েছিল । সাক্ষী হবার জন্য আদালতের ট্রেজারি থেকে টাকাও পেয়েছিল । এইসমস্ত বন্ধুদের ঘৃণ্য মনে হয়েছিল। হাইকোর্টে মামলা জেতার পর ঘেন্নায় আমি এদের সংস্পর্শ ত্যাগ করে কলকাতা ছেড়ে চলে গিয়েছিলুম । সৌভাগ্যবশত পাটনায়  রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ব্যাঙ্কনোট পোড়ানোর চাকরি ছেড়ে এআরডিসিতে গ্রামীণ উন্নয়ন আধিকারিকের চাকরি পেয়ে লখনউ চলে যাই । নতুন চাকরিতে যোগ দিয়ে টের পাই যে চাষবাস, পশুপালন, জলসেচ, গ্রামজীবন সম্পর্কে কিচ্ছু জানি না । এই সমস্ত বিষয়ে প্রচুর পড়াশুনা আরম্ভ করতে হয়েছিল । সাহিত্যের বই পড়া আপনা থেকেই পেছনে ফেলে আসতে বাধ্য হয়েছিলুম । তবে সরকারি চাকরি ছাড়ার ফলে এখন আমার পেনশন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পিওনের চেয়েও কম ।

    সজ্জ্বল : রমানাথ রায় এবং শম্ভু রক্ষিতের কবিতা বিষয়ে আপনার কি মত?
    মলয় : রমানাথ রায় তো কবিতা লিখতেন না ! শম্ভু রক্ষিত সম্পর্কে আমি বিস্তারিত লিখেছি। নেটে পাবে প্রবন্ধটা ।

    সজ্জ্বল : কবিতা রচনায় বেশি মনোযোগ না দিলেও আসলে রমানাথ রায়ের কিছু ছোট্ট ছোট্ট চিত্রকল্পনির্ভর কবিতার কথা বলতে চেয়েছিলাম । যেমন - ' রাস্তায় রাস্তায় ' , ' চালের বদলে ' , ' আমার বুক ' ইত্যাদি । যাইহোক আপনার উত্তরে বুঝতে পারছি এগুলো আপনার কাছে খুব বেশি গুরুত্ব পায়নি । থাক সে প্রসঙ্গ । রমানাথ রায়ের কথা যখন উঠলোই , এই অবসরে বরং আপনার কাছ থেকে একটু জেনে নেওয়া যাক হাংরি আন্দোলনেরই প্রায় সমসাময়িক রমানাথ রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, আশিস ঘোষ দের ' শাস্ত্রবিরোধী সাহিত্য আন্দোলন '  সম্পর্কে । হাংরি আন্দোলনের ঠিক পাশাপাশি এই আন্দোলন সম্পর্কে আপনার মনোভাব কী ? আরো একটু নির্দিষ্ট বিন্দুতেই আসা যাক । ধরুন আপনার সম্পাদিত পত্রিকা 'জেব্রা 'র সঙ্গে সেইসময় শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনের ' এই দশক ' এর দৃষ্টিভঙ্গী ও লেখা নির্বাচনে ঠিক কী ধরনের মিল-অমিল আপনি চিহ্নিত করবেন ?
    মলয় : শাস্ত্রবিরোধিরা গল্প লেখায় প্রশংসনীয় কাজ করেছেন সেসময়ে । হাংরি আন্দোলনে কেবল সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত গল্প বা ফিকশানাল ন্যারেটিভ লিখতো । সুবিমল লিখেছে বাঙাল বুলিতে আর ডায়াসপোরিক বাংলায় । সুভাষ ঘোষ লিখেছে ক্রিপটিক ডিকশানে । কেবল বাসুদেব দাশগুপ্ত যে ধরণের গল্প লিখেছে তার সঙ্গে শাস্ত্রবিরোধিদের তুলনা করা যায় । আমি, ফালগুনী, অরুণেশ ঘোষ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার অনেক পরে ফিকশান লেখা আরম্ভ করি । জেব্রার মোটে দুটো সংখ্যা বেরিয়েছিল, শাস্ত্রবিরোধিদের বহু পত্রিকা আর বই প্রকাশিত হয়েছিল । 

    সজ্জ্বল : হাংরি আন্দোলনের সর্বাপেক্ষা গভীরতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী  কবি কে বা কে কে? কার কার নাম করবেন ? 
    মলয় : শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, শম্ভু রক্ষিত । আমি এনাদের সবায়ের সম্পর্কে লিখেছি । শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতার মূল্যায়ন আমিই প্রথম করেছিলুম, কিন্তু উনি যতোদিন বেঁচেছিলেন আমাকে গালমন্দ করে গেছেন, এমনকী নিজের মেয়েকেও বলে গিয়েছিলেন যে উনি মারা যাবার পর ওনার মেয়ে যেন তা বজায় রাখেন । হয়তো ওনার নাতিও বড়ো হয়ে তা বজায় রাখবে ।

    সজ্জ্বল : খুব স্পষ্ট এবং খোলাখুলিভাবে জানতে চাইছি মলয়দা , হাংরি আন্দোলনের ভাষাতেই জানতে চাইছি , জীবনের এই প্রান্তবেলায় দাঁড়িয়ে আপনি কী মনে করেন ? তরুণ হাংরি কবি মলয় রায়চৌধুরীর " প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার " তদানীন্তন থেকে প্রবহমান বাংলা কবিতায় আদৌ কিছু কী 'ছিঁড়তে' পেরেছিল , বা পারল ? 
    মলয় : এটা বাঁকবদলের কবিতা । অনেকে বুঝতে পারেনি ‘ছুতার’ শব্দটা কিসের দ্যোতক ! এই কবিতার প্রভাবে বাংলা কবিতার শব্দভাঁড়ারে অভূতপূর্ব সব বদল ঘটে গিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের শব্দভাঁড়ারকে বর্জন করার ফতোয়া ছিল কবিতাটা । দানিয়েলা কাপেলো আর শীতল চৌধুরী এই কবিতাটার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন বাংলা কবিতায় কেমন প্রভাব ফেলেছে । দানিয়েলার বিশ্লেষণ পাবে অ্যাকাডেমিয়ার সাইটে । শীতল চৌধুরীর প্রবন্ধটা নেট সার্চ করলেই পাবে।

    সজ্জ্বল দত্ত : আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ' শয়তানের মুখ ' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে । কৃত্তিবাসের কর্ণধার যিনি ছিলেন তার সঙ্গে তখন আপনার সম্পর্কের রসায়ন যাইই থাক , পরবর্তীকালে তার গোটা জীবনের সাহিত্য কর্মকাণ্ড এবং কৃত্তিবাস পত্রিকা ও প্রকাশনীর সাহিত্যধারার ওপর বড় করে আলো ফেললে পরে কখনো কি আপনার মনে হয়নি যে আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থটি আপনার  আদর্শগত জায়গার একেবারে বিপরীতে অবস্থান করা কোনো প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ?
    মলয় : কৃত্তিবাস তখনও মাঙ্কি পক্সে আক্রান্ত হয়নি । সুনীল তখনও পত্রিকাটা কৃত্তিবাসের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আনন্দ বাগচীর থেকে ছিনিয়ে নেননি । আনন্দবাজারে সুনীল ঢোকার পর কৃত্তিবাস পালটি খেয়ে যায় । আমার ‘রাহুকেতু’ আর ‘চাইবাসা আবিষ্কার’ উপন্যাস পড়লে ব্যাপারটা তোমার কাছে স্পষ্ট হবে । আমার স্কুলে পড়ার সময় থেকে সুনীল আমাদের পাটনার আর উত্তরপাড়ার বাড়িতে আসতেন । সুনীল যখন বেকার তখন দাদা কৃত্তিবাস চালাবার খরচ দিয়েছেন বেশ কয়েকবার। ‘সুনীলকে লেখা চিঠি’ বইতে পাবে । সুনীলের ‘একা এবং কয়েকজন’ দাদা ছাপিয়েছিলেন ‘সাহিত্য প্রকাশক’ নামে প্রকাশনার নাম দিয়ে। তাই বইটা কৃত্তিবাস থেকে বেরিয়েছিল বলে আমার অবস্হানের কোনো বদল ঘটেনি । সুনীল অবশ্য হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর আমার আর দাদার কাছে কবিতা চাননি ।

    সজ্জ্বল : এটা কিন্তু আজ সর্বস্তরেরই সাহিত্যপাঠক বিদিত একটি সত্য যে হাংরি আন্দোলন তাৎক্ষণিক একটা হৈচৈ পাঠকমহলে তৈরী করতে সক্ষম হলেও শেষ পর্যন্ত এই সাহিত্যআন্দোলন কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছিল এবং  সমাজমানসে দীর্ঘ কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি । এর কারণ কী বলে মনে করেন ? অন্ত:সারশূন্যতা ?
    মলয় : তোমার বোধহয় জানা নেই যে এই আন্দোলন নিয়ে বাংলা ছাড়াও অন্যান্য ভারতীয় আর বিদেশি ভাষায় গবেষণা হয়েছে আর এখনও হচ্ছে । এখনও পিএইচডি আর এমফিল করছেন অনেকে । ইতালি থেকে দানিয়েলা কাপেলো এসে তথ্য সংগ্রহ করে হাংরি আন্দোলন নিয়ে ডক্টরেট করেছেন জার্মানি থেকে । ওনার গবেষণার বইটা ইংরেজিতে প্রকাশের তোড়জোড় চলছে । উনি ফালগুনী রায় সম্পর্কে বাংলায় যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন সেটা আমি ফেসবুকে শেয়ার করেছি । সম্প্রতি  ইংরেজিতে পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরীর লেখা বই বেরিয়েছে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে । রাহুল দাশগুপ্ত আর বৈদ্যনাথ মিশ্র দুজনে একটা ইংরেজি সংকলন প্রকাশ করেছেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকা নিয়ে জুলিয়েট রেনল্ডস ‘রোডস অ্যাক্রস দি আর্থ’ নামে একটা বই লিখেছেন ২০১৮ সালে । জনমানস বলতে তুমি বোধহয় কফিহাউসের আড্ডাবাজদের বোঝাতে চেয়েছো ।

    সজ্জ্বল : ঠিক তা নয় । একটু আগেই এক প্রশ্নের উত্তরে আপনি বললেন "এখনকার পশ্চিমবাংলার দিকে তাকালে আমার বক্তব্যকে ভবিষ্যদ্বাণী বলে মনে হবে" । আপনার ওই বক্তব্যের পূর্ণ প্রতিফলন যদি আপনার কবিতা তথা সমগ্র হাংরিকবিতা হয়, তবে এখনকার পশ্চিমবাংলার পরিপ্রেক্ষিতে 'Gungshalik school of poetry' কে সরিয়ে 'আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও' কিংবা 'তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়' –এর মতো লাইনের কবিতাধারা পুরোপুরি বা অংশতঃ কোনোভাবেই কি ধীরে ধীরে মেইনস্ট্রিম কবিতা হয়ে উঠতে পারতো না ? ঠিক যেমন ব্রিটেনে দীর্ঘদিনের রোম্যান্টিক কবিতাধারাকে ঠেলে সরিয়ে বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় এজরা পাউণ্ড , এলিয়ট , ইয়েটস্ - দের modern movement কবিতাধারার মেইনস্ট্রিম হয়ে উঠতে পেরেছিল , colonial literature ধারাকে পরবর্তীতে ঠেলে সরিয়ে আফ্রিকায় চিনুয়া আচেবে বা যুক্তরাষ্ট্র ও লাতিন আমেরিকায় সলমন রুশদি ও গার্সিয়া মার্কেজরা তাদের post colonial literary movement কে অনেকখানি মেইনস্ট্রিম করে যেতে পেরেছিল ? ... জনমানসে প্রভাব বলতে হাংরি সম্পর্কে এটাই জিজ্ঞাস্য ।
    মলয় : কবিতার মেইনস্ট্রিম সরকার আর অকাদেমির সমর্থন ছাড়া হয় না । এখন কবিতার মেইনস্ট্রিম মানে চটিচাটার দল । তবে, তার বাইরে আমাদের প্রভাব লক্ষণীয়, অন্তত ফেসবুক আর ব্লগজিনগুলোতে নজরে পড়ে । ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে আমাদের লিফলেট আর লিটল ম্যাগাজিন সাহিত্যের তুলনা করা উচিত নয় । আমার তো প্রকাশকই জোটে না । গাঙচিল নামে এক প্রকাশনার কর্ণধার বললেন, “আপনার বই কেন ছাপবো ? আপনার বই তো বুদ্ধদেব গুহর মতন বিকোবে না” । মেইনস্ট্রিম ফিকশান হতে হলে, যে বিদেশিদের নাম তুমি করলে, বড়ো প্রকাশনা দরকার, অনুবাদক দরকার, রিভিউকার দরকার । হাংরি আন্দোলনের কারোরই সেসব জোটেনি । বাংলা থেকে ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ না হলে ওনাদের মতন নজরে পড়া অসম্ভব । ইংরেজিতে অনুবাদের পরও রিভিউকারদের নজরে পড়া দরকার, নেটওয়র্কিঙ দরকার । শঙ্কর, সুনীল প্রমুখের বই ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছে, কিন্তু বিদেশে আলোচিত হয়নি । 

    সজ্জ্বল : একবিংশ শতকের লেখক-কবিদের উপর হাংরি প্রভাব কতটা পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
    মলয় : এটা বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । এসব গবেষকরা বলবেন ।

    সজ্জ্বল : ঠিক দু'বছর আগে হাংরি পরবর্তী বাংলা কবিতার আর এক আন্দোলন " শতজল ঝর্ণার ধ্বনি "র অন্যতম প্রধান মুখ কবি দেবদাস আচার্য এই বারাকপুর স্টেশন পত্রিকাতেই সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন " প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা নয় , সঠিক শব্দটা বোধহয় হওয়া উচিত অপ্রাতিষ্ঠানিক " । আপনি এই দুই শব্দের মধ্যে কোনটা পছন্দ করবেন? 
    মলয় : হ্যাঁ, নিশ্চয়ই, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা । উনি বোধহয় প্রতিষ্ঠান বলতে সংবাদপত্রের কথা বলতে চেয়েছেন । প্রতিষ্ঠান বলতে রাজনৈতিক দলগুলোকে, অর্থনৈতিক কঙগ্লোমারেটদেরও বোঝায় । আমি ফেসবুকে এই পোস্টটা দিয়েছিলুম, দেখেছো কিনা জানি না : “গৃহবধূর চটি মারার সাবাশি বিষয়ক: –সবচেয়ে চুতিয়া টাইপের নিরক্ষর হল রাজনৈতিকভাবে  অশিক্ষিতরা । তারা শোনে না, কথা বলে না বা রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে না। তারা জীবনের দাম জানে না , বাজারে জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে জানে না, কারা বাড়াচ্ছে জানে না । আলু-পটলের দাম, মাছের, আটার দাম, ভাড়া, জুতো, ওষুধের দাম, সবই নির্ভর করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর। রাজনৈতিক নিরক্ষর  লোকগুলো এতটাই বোকা যে তারা গর্ব করে বুক ফুলিয়ে বলে যে তারা রাজনীতিকে ঘৃণা করে। মূর্খরা জানে না যে, তাদের রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে জন্ম নেয় পতিতা, পরিত্যক্ত সন্তান আর সর্বাপেক্ষা জঘন্য রাজনৈতিক চোর, রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক কোম্পানির দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের কোটিপতি দোস্ত।” বিরোধিতা না করলে দেশটা হিন্দুরাষ্ট্র নামের ডিকটেটরশিপে পরিণত হবে ।

    সজ্জ্বল : আপনার সাহিত্য জীবনের প্রায় গোটাটাই বাংলার বাইরে কেটেছে। ২০১৩ সাল নাগাদ একবার কোলকাতায় এসে কিছুদিন এখানে থাকার চেষ্টা করেও অবশেষে ফিরে গিয়েছেন। সাহিত্য জগতে আজীবন নিঃসঙ্গতা একাকীত্ব আপনাকে কোথাও হতাশ করে? নাকি তা শাপে বর হয়েছে?
    মলয় : না । কলকাতায় যতোদিন পিসেমশায় ছিলেন ততোদিন মাঝে-মাঝে গেছি । পিসেমশায় আত্মহত্যা করার পর পিসিমা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোতরঙ চলে গেলেন । কলকাতায় তো কোনও আত্মীয় স্বজন ছিল না তাই আদিবাড়ি উত্তরপাড়ার জমিদারি খণ্ডহরে গিয়ে থাকতে হতো। উত্তরপাড়ায় ইলেকট্রিসিটি আর জলের কল ছিল না, ঠাকুমার হবিষ্যি খেতে হতো, নয়তো মুড়ি-মুড়কি, সেসময়ে খাবার হোটেল ছিল না উত্তরপাড়ায় । ১৯৮৮ সালে নাকতলায় একটা ফ্ল্যাট কেনার পর নিয়মিত থেকেছি । ১৯৯৫ সালে কলকাতা অফিসে বিভাগীয় আধিকারিক হয়ে গিয়েছিলুম । ওই সময়েই দাদা হাওয়া-৪৯ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করেন । ১৯৮৮ এর আগে বারুইপুরে উত্তম দাশের বাড়িতে গিয়ে থাকতুম । ১৯৮৫ নাগাদ উত্তম আমার বেশ কয়েকটা বই প্রকাশ করেছিলেন । আমি আর উত্তম সন্ধ্যাবেলায় কেদার ভাদুড়ির ঘরে মদ খেয়ে নাচার আড্ডা জমাতুম । ওদের কাজের মাসি খুব ভালো মাছ রাঁধতে পারতেন । আসলে আমি সাহিত্যসভা বা কফিহাউসে যাতায়াত করিনি বলে তোমার মনে হচ্ছে কলকাতায় থাকিনি । কলকাতায় চাকরি করার সময়ে পুরো পশ্চিমবঙ্গে চষে ফেলেছিলুম । নামগন্ধ আর নখদন্ত উপন্যাসে সেসব অভিজ্ঞতা পাবে । নামগন্ধ উপন্যাসে আলুচাষের রাজনীতি আর নখদন্ত উপন্যাসে পাট চাষের রাজনীতি নিয়ে লিখেছি ।

    সজ্জ্বল : হাংরি লেখালেখির বাইরে যে বাংলা সাহিত্য সেখানে সাহিত্যিক হিসেবে আপনার পছন্দের মানুষ কারা?
    মলয় : অনেক, অনেক, অনেক । বিশেষ করে তরুণদের লেখা আমার ভালো লাগে ।

    সজ্জ্বল : একজন বাংলা সাহিত্যপাঠক মলয় রায়চৌধুরীকে কীভাবে মনে রাখবে বলে আপনি মনে করেন ?
    মলয় : মনে রাখার দরকার তো নেই ! দুশো-তিনশো বছর আগের কবিদের অনেককেই কেউ মনে রাখেনি, অনুসন্ধানী গবেষকরা ছাড়া ।

    সজ্জ্বল : সম্প্রতি জেমস ওয়েবের টেলিস্কোপ আমাদের বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য খানিকটা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। এমত পরিস্থিতিতে মলয় রায়চৌধুরীর ঈশ্বরভাবনা জানতে ইচ্ছে করে। 
    মলয় : হিন্দুধর্মে ঈশ্বর বলে কিছু নেই । ওটা এসেছে ইসলাম আর খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে আর ব্রাহ্মরা তাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। হিন্দুদের কাছে পৃথিবীর সব কিছুই পূজ্য । তাই আমাদের আছেন দেবী-দেবতারা । আমি কোনো কালে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনি, গোঁড়া সাবর্ণ রায়চৌধুরী ব্রাহ্মণ পরিবারের সদস্য হয়েও । জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ আমাদের বিস্ময় আর জ্ঞানের বিস্তার ঘটাচ্ছে ; ঈশ্বরের অস্তিত্বের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই ।

    সজ্জ্বল : মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। আপনার চেতনায় মৃত্যু কীভাবে ধরা দেয়?
    মলয় : মৃত্যু সম্পর্কে ভাবার দরকার নেই । বরং অসুখে পড়লে হাসপাতালের আর দাহ করার খরচ কেমন করে মেটানো হবে সেটাই চিন্তার। 

    সজ্জ্বল : দীর্ঘ বিরাশি / তিরাশি বছরের ফেলে আসা জীবনের দিকে ফিরে তাকালে কী মনে হয় আজ? কোনো অপ্রাপ্তির কথা মনে হয়? জীবনকে বদলে নিতে ইচ্ছে করে? 
    মলয় : হ্যাঁ। বাবাকে মুম্বাই নিয়ে আসিনি বলে রিগ্রেট হয় । এখানে ওনার ভালো চিকিৎসা করাতে পারতুম । ইন ফ্যাক্ট, আমরা বুড়ো-বুড়ি মুম্বাই চলে এসেছি চিকিৎসা ও অন্যান্য সুবিধার জন্য ।

    সজ্জ্বল : এই প্রজন্মের নবীন কবিকে পোড় খাওয়া বরিষ্ট কবি মলয় রায়চৌধুরী কী উপদেশ দিতে চাইবেন?
    মলয় : বিন্দাস লিখে যাও । কে কী বলছে ভাবার দরকার নেই ।

    সজ্জ্বল : ভালো থাকবেন মলয় দা। পত্রিকার পক্ষ থেকে আরও একবার ধন্যবাদ এবং নমস্কার জানাই।
    মলয় : তুমিও ভালো থেকো, সুস্হ থেকো আর আমার অন্তত একটা উপন্যাস পোড়ো, বন্ধুদের পড়িও । তোমরা তো আমার কোনো বই পড়োনি বলে মনে হচ্ছে। তোমাদের পত্রিকাও দীর্ঘ জীবন লাভ করুক।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪৪512515
  • হাংরি , ডাডা ও পরাবাস্তব আন্দোলন : মলয় রায়চৌধুরী
    এক
    হাংরি আন্দোলনকারীদের অবনিবনা নিয়ে যতো খিল্লি হয় তা কিন্তু পরাবাস্তববাদীদের মাঝে অবনিবনা নিয়ে হয় না, কোনও ভাষাতেই হয় না, দুই বাংলাতেও নয় । অথচ পরাবাস্তববাদীদের পরস্পরের ঝগড়া এমনকী হাতাহাতি অনবরত কতোজনের সঙ্গে যে প্রত্যেকের হয়েছিল তার কোনও হিসেব নেই ।  অথচ হাংরি আন্দোলনের আলোচনা শুরু করলেই সবাই  তাঁদের পারস্পরিক অবনিবনা নিয়ে খিল্লি করেন ; লেখালিখি বিশ্লেষণের কথা চিন্তা করেন না বা করতে চান না,  বাঙালি আলোচকরা । হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রায় সকলের অন্তত পাঁচটি থেকে দুশোটি বই প্রকাশিত হয়েছে ।
    ‘আয়নানগর’ পত্রিকার অক্টোবর ২০১৬ সংখ্যায় নন্দিনী ধর হাংরি আন্দোলন আলোচনা করতে বসে দুম করে লিখে দিলেন যে আমার সংকলিত বই থেকে শৈলেশ্বর ঘোষকে বাদ দিয়েছি ; অথচ আমি হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনার কোনো সংকলন প্রকাশ করিনি । নন্দিনী ধর লিখেছেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা নিজেদের ‘ছোটোলোক’ ঘোষণা করে বিবিক্ততাকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন ; উনি জানতেন না যে আমি পাটনায় ইমলিতলা নামে এক অন্ত্যজ অধ্যুষিত বস্তি-এলাকায় থাকতুম, অবনী ধর ছিলেন জাহাজের খালাসি আর পরে ক্রেন-ড্রেজার-ডাম্পার অপারেটার, লরি-ট্যাকসি-প্রায়ভেট মোটরগাড়ি চালক, রেলওয়ে ক্যাটারিঙের বেয়ারা, কোককয়লা ফেরি, ঠোঙা ও প্যাকেট তৈরি, পোস্টার-ফেস্টুন লেখা ইত্যাদি, অসংগঠিত শ্রমিকের জন্য যে-ধরণের কাজ পাওয়া যায় সবই করেছিলেন । সমীরণ ঘোষ ছিলেন ডাকপিওন, প্রদীপ চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ এসেছিলেন উদ্বাস্তু পরিবার থেকে, দেবী রায় চায়ের ঠেকে চা বিলি করতেন, শম্ভু রক্ষিত নিজের গ্রামে চাষবাস করতেন, নিজেই প্রেসে গিয়ে কমপোজ করতেন, সুবিমল বসাকের শৈশবে পরিবারকে পথে বসিয়ে তাঁর বাবা দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় হিন্দি পত্রিকার মলাট এঁকে রোজগার করতেন, ফালগুনী রায় কিছুই করতেন না । এ-থেকে টের পাওয়া যায় যে আলোচকরা কোনও বই পড়ার আগেই ভেবে নেন যে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনার সময়ে কী লিখবেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের সমাজচিন্তা ও বিশ্ববীক্ষার তর্ক-বিতর্ক ও লেখালিখি বাদ দিয়ে আলোচকরা তাঁদের অবনিবনাকে গুরুত্ব দেন ।
    অন্য বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁরা এমন অডিটরসূলভ বিশ্লেষণ করতে বসেন না । বিদেশি সাহিত্যিকদের মাঝে নিজেদের বিশ্ববীক্ষার সমর্থনে পারস্পরিক বিবাদ-বিতর্কের কথা যেমন শোনা যায় তেমনটা বাঙালি লেখকদের ক্ষেত্রে বড়ো একটা লেখালিখি হয় না । আমরা পড়েছি টলস্টয় - ডস্টয়েভস্কি বিবাদ, গোর ভিডাল আর নরম্যান মেইলারের বিবাদ এমনকি হাতাহাতি, ভারগাস য়োসা ঘুসি মেরে নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের, ভ্লাদিমির নবোকভ - এডমাণ্ড উইলসন বিবাদ, মার্ক টোয়েন - ব্রেট হার্ট বিবাদ, আলেকজাণ্ডার পোপ - জন হার্ভে বিবাদ, সিংকলেয়ার লিউইস - থিয়োডোর ড্রেজার বিবাদ, সালমান রুশডি - জন আপডাইক বিবাদ, হেনরি জেমস - এইচ জি ওয়েল্স বিবাদ, জোসেফ কনরাড - ডি এইচ লরেন্স বিবাদ, ভার্জিনিয়া উলফ - অ্যারনল্ড বেনেট বিবাদ, সি. পি. স্নো - এফ. আর. লিভিস বিবাদ, জন কিটস - লর্ড বায়রন বিবাদ, চার্লস ডিকেন্স - হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসন বিবাদ, পিকাসো-দালি বিবাদ, আলবেয়ার কামু - জাঁ পল সার্ত্রে বিবাদ, মার্সেল প্রুস্ত - জাঁ লরেনস বিবাদ, রিচার্ড ফোর্ড - অ্যালিস হফম্যান বিবাদ, ডেরেক ওয়ালকট - ভি এস নাইপল বিবাদ, হেমিংওয়ের সঙ্গে ওয়ালেস স্টিভেন্স, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, ও উইলিয়াম ফকনারের বিবাদ, ইত্যাদি । আলোচকরা কিন্তু তাঁদের রচনাবলী বিশ্লেষণের সময়ে সৃজনশীল কাজকেই গুরুত্ব দেন, বিবাদ নিয়ে খিল্লি করেন না ।        
      
    বাঙালি সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন, মনে করেন মানুষ ও প্রাণীরা এসেছে অন্য গ্রহ থেকে, তিনি অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য । ওই একই দপতরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর পাশের কেবিনেই বসতেন ,যিনি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন না, ডারউইনের তত্বে বিশ্বাস করতেন, বামপন্হী ছিলেন । অথচ পরপস্পরের লেখা আলোচনার সময়ে এই বিষয়গুলো ওনাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যেত, যেন সাহিত্য আলোচনায় লেখকের বিশ্ববীক্ষার ও কৌমচিন্তার কোনো প্রভাব থাকে না । অধিকাংশ বাঙালি সাহিত্যিক এই ধরণের ভাই-ভাই ক্লাবের সদস্য । এদিকে হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনা আলোচনা করতে বসে তাঁদের ব্যক্তিগত অবনিবনাকে তুলে ধরতে আগ্রহী,  আর লেখালিখি না পড়েই খিল্লি করেন।         
    এই তো সেদিন ক্লিন্টন বি সিলির জীবনানন্দ বিষয়ক গ্রন্হ ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট, পড়ার সময়ে হাংরি আন্দোলনকারীরা খালাসিটোলায় জীবনানন্দের যে জন্মদিন পালন করেছিল, তার বর্ণনা পড়ছিলুম । উনি ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ তারিখে প্রকাশিত সংবাদ তুলে দিয়ে পরবর্তী প্রজন্মে জীবনানন্দের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করেছেন । একই খবর প্রকাশিত হয়েছিল তখনকার সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ পত্রিকায় । সেদিন সন্ধ্যায় জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালনের জন্য  টেবিলে উঠে পড়লেন হাংরি আন্দোলনের গল্পকার অবনী ধর আর নাচের সঙ্গে গাইতে লাগলেন একটা গান, যা তিনি জাহাজে খালসির কাজ করার সময়ে গাইতেন, বিদেশি খালাসিদের সঙ্গে । উপস্হিত সাংবাদিকরা,  ভেবেছিলেন গানটা আবোল-তাবোল, কেননা ইংরেজিতে তো এমনতর শব্দ তাঁদের জানা ছিল না ।  তাঁরা গানটাকে ভেবেছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীদের বজ্জাতি, প্রচার পাবার ধান্দা ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ শিরোনামে ঠাট্টা করে দুই পাতা চুটকি লেখা হয়েছিল, অবনী ধরের কার্টুনের সঙ্গে ।  ‘অমৃত’ পত্রিকায় ‘লস্ট জেনারেশন’ তকমাটি যিনি ব্যবহার করেছিলেন তিনি জানতেন না যে এই শব্দবন্ধ তৈরি করেছিলেন গারট্রুড স্টিন এবং বিশ শতকের বিশের দশকে প্যারিসে আশ্রয় নেয়া আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, এফ স্কট ফিটজেরাল্ড, টি. এস. এলিয়ট, জন ডস প্যাসস, ই ই কামিংস, আর্চিবল্ড ম্যাকলিশ, হার্ট ক্রেন প্রমুখকে বলা হয়েছিল ‘লস্ট জেনারেশন’-এর সদস্য । অবনী ধর-এর নামের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত নন । যাঁরা তাঁর নাম শোনেননি এবং ওনার একমাত্র বই ‘ওয়ান শট’ পড়েননি, তাঁদের জানাই যে ছোটোগল্পের সংজ্ঞাকে মান্যতা দিলে বলতে হয় যে অবনী ধর ছিলেন হাংরি আন্দোলনের অন্যতম ছোটো গল্পকার । 
    গানটা এরকম, মোৎসার্টের একটা বিশেষ সুরে গাওয়া হয়:
    জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
    জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
    জিং গ্যাং গুলি গুলি গুলি গুলি ওয়াচা,
    জিং গ্যাং গু, জিং গ্যাং গু ।
    হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা উউউউউহ,
    হায়লা, ওহ হায়লা শায়লা, হায়লা শায়লা, শায়লা, উহ
    শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি, শ্যালি ওয়ালি ।
    উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ, উউউমপাহ । 
    ১৯২০ সালে,, প্রথম বিশ্ব স্কাউট জাম্বোরির জন্য, রবার্ট ব্যাডেন-পাওয়েল, প্রথম বারন ব্যাডেন-পাওয়েল (স্কাউটিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা) সিদ্ধান্ত নেন যে একটা মজার গান পেলে ভালো হয়, যা সব দেশের স্কাউটরা গাইতে পারবে ; কারোরই কঠিন মনে হবে না । উনি মোৎসার্টের  এক নম্বর সিম্ফনির ইবি মেজরে বাঁধা সুরটি ধার করেছিলেন । গানটা স্কাউটদের মধ্যে তো বটেই সাধারণ স্কুল ছাত্রদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়েছিল । এই স্কাউটদের কেউ-কেউ জাহাজে চাকরি নিয়ে খালাসি এবং অন্যান্য কর্মীদের মধ্যে এটাকে ছড়িয়ে দিতে সফল হন । অবনী ধর বেশ কিছুকাল জাহাজে খালাসির কাজ করেছিলেন এবং তাঁরও ভালো লেগে যায় সমবেতভাবে গাওয়া গানটি । শতভিষা, কৃত্তিবাস, কবিতা, ধ্রুপদি  পত্রিকার কর্নধারদের প্রিয় সঙ্গীত-জগত  থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে যাওয়া এই গান সেসময়ে নিতে পারেননি সাংবাদিক আর বিদ্যায়তনিক আলোচকরা, তার ওপর যেহেতু হাংরি আন্দোলনের ব্যাপার, তাই তাঁরা এটাকে অশিক্ষিত নেশাখোর-মাতালদের কারবার ভেবে হেঁ-হেঁ করে হেসে খিল্লি উড়িয়ে ছিলেন ।
    দুই
    উত্তরবঙ্গে হাংরি জেনারেশনের প্রসার সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে, হাংরি পত্রিকা ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’ এর সম্পাদক অলোক গোস্বামী তাঁর রচনা ‘মেমরি লোকাল’-এ এই কথাগুলো লিখেছিলেন, তা থেকে অবনিবনার যৎসামান্য আইডিয়া হবে, আর এই অবনিবনার সঙ্গে পরাবাস্তববাদীদের নিজেদের অবনিবনার যথেষ্ট মিল আছে :-
    “নব্বুই দশকে সদ্য প্রকাশিত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বগলে নিয়ে এক ঠা ঠা দুপুরে আমি হাজির হয়েছিলাম শৈলেশ্বরের বাড়ির গেটে। একা। ইচ্ছে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে মুখোমুখি বসে যাবতীয় ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে খোলাখুলি কথা বলবো। যেহেতু স্মরণে ছিল শৈলেশ্বরের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি তাই আস্থা ছিল শৈলেশ্বরের প্রজ্ঞা,ব্যক্তিত্ব,যুক্তিবোধ তথা ভদ্রতাবোধের ওপর। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল শৈলেশ্বর আমাদের ভুলগুলো ধরিয়ে দেবেন এবং যৌথ আলোচনাই পারবে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নতুন উদ্যমে একসাথে পথ চলা শুরু করতে। কিন্তু দুভার্গ্যবশতঃ তেমন কিছু ঘটলো না। বেল বাজাতেই গেটের ওপারে শৈলেশ্বর। আমাকে দেখেই ভ্রূ কুঁচকে ফেললেন।
    --কী চাই!
    মিনমিন করে বললাম, আপনার সঙ্গে কথা বলবো।
    --কে আপনি?
    এক এবং দুই নম্বর প্রশ্নের ভুল অবস্থান দেখে হাসি পাওয়া সত্বেও চেপে গিয়ে নাম বললাম।
    --কি কথা?
    --গেটটা না খুললে কথা বলি কিভাবে!
    --কোনো কথার প্রয়োজন নেই। চলে যান।
    --এভাবে কথা বলছেন কেন?
    --যা বলছি ঠিক বলছি। যান। নাহলে কিন্তু প্রতিবেশীদের ডাকতে বাধ্য হবো।
    এরপর স্বাভাবিক কারণেই খানিকটা ভয় পেয়েছিলাম কারণ আমার চেহারাটা যেরকম তাতে শৈলেশ্বর যদি একবার ডাকাত, ডাকাত বলে চেঁচিয়ে ওঠেন তাহলে হয়ত জান নিয়ে ফেরার সুযোগ পাবো না। তবে 'ছেলেধরা' বলে চেল্লালে ভয় পেতাম না। সমকামিতার দোষ না থাকায় নির্ঘাত রুখে দাঁড়াতাম।
    ভয় পাচ্ছি অথচ চলেও যেতে পারছি না। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে আরও খানিকটা জানা বোঝা জরুরি।
    --ঠিক আছে, চলে যাচ্ছি। তবে পত্রিকার নতুন সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে সেটা রাখুন।
    এগিয়ে আসতে গিয়েও থমকে দাঁড়ালেন শৈলেশ্বর।
    --কোন পত্রিকা?
    --কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প।
    --নেব না। যান।
    এরপর আর দাঁড়াইনি। দাঁড়ানোর প্রয়োজনও ছিল না। ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি ব্যক্তি শৈলেশ্বর ঘোষকে চিনতে ভুল হয়নি আমাদের। আর এই সমঝদারি এতটাই তৃপ্তি দিয়েছিল যে অপমানবোধ স্পর্শ করারই সুযোগ পায়নি।
    শৈলেশ্বরের হাত ঝাপটানিতে ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ থেকে সরে গেলেন অনেকে। অরুণেশ ঘোষ তো সরে গিয়েছিলেনই, সঙ্গে নিয়ে গেলেন তাঁর কিছু কাছের মানুষজনকেও, যাদের কাউকে কাউকে আমরাও কাছের মানুষ ভাবতাম। তাতে অবশ্য আমাদের কিছু এসে গেল না। বরং ‘কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প’-এর কভারে লিখে দিলাম, “সত্যের ঘাত অসহ্য হলে বুর্জোয়া ভাইরাসেরা গড়িয়ে যায় নিজস্ব ভাগাড়ের দিকে।” লিখে দিলাম, “ জানি পাঠক, তুমি পাজামা কিংবা পেন্ডুলাম নও।”
    কিন্তু আমাদের কিছু না এসে গেলেও একজনের গিয়েছিল, সুভাষ ঘোষের। চটে গিয়েছিল সুভাষ-শৈলেশ্বর রসায়ন। যদিও নিজস্ব অবস্থান এবং অসহায়তার কথা বন্ধু ‘শৈলেশ’কে আপ্রাণ বোঝাতে চেয়েছিলেন সুভাষ, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতা এতটাই চরমে উঠেছিল যে খোদ কোলকাতাতেই শৈলেশ্বরের ইশারায় সুভাষকে শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিতও হোতে হয়েছিল। বাল্যবন্ধুর সেই লাঞ্ছনা সংবাদ উত্তরবঙ্গের অনুচরদের কাছে পৌঁছে দিতে দ্বিধা দেখাননি শৈলেশ্বর ঘোষ।
    হ্যাঁ, ততদিনে এক অলিখিত নিয়মে ক্ষুধার্ত শিবির ত্রিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছে যেটা আমাদের আদৌ অভিপ্রেত ছিল না। এক শিবিরের অধিনায়ক শৈলেশ্বর ঘোষ। অন্য শিবিরের অধিনায়ক মলয় রায়চৌধুরী এবং তৃতীয় শিবির ‘কনসেনট্রেশান ক্যাম্প’, যার নেতৃত্বের দায় জোর-জবরদস্তি চাপিয়ে দেয়া হলো সুভাষের কাঁধে। অথচ আমরা কোনদিনই কারো নেতৃত্বকে স্বীকার করার মতো অবস্থানে ছিলাম না। সুভাষও অপচেষ্টা করেননি চেপে বসার, তবু ইতিহাসের রসিকতা বোধের ফের একবার প্রমাণ পাওয়া গেল। ইতিহাসের রসিকতা বলার কারণ সেই ষাটের দশকে প্রকাশিত সুভাষের একটি গদ্যগ্রন্থের নাম ছিল,‘যুদ্ধে আমার তৃতীয় ফ্রন্ট।’ নামকরণের সেই ক্ষণে সুভাষ কি আদৌ ধারণা করতে পেরেছিলেন ভাবী সময় কোনওদিন তাঁকে সত্যি সত্যি এমন জায়গাতেই এনে দাঁড় করাবে?
    রসিকতা দূরে থাক, মূল সত্য এটাই যে, এরপরও সুভাষ ঘোষের কোনো নিজস্ব শিবির ছিল না। ছিল না নিজস্ব অনুচর বাহিনী। ছিল না সঙ্গী নির্বাচনের উপযুক্ত কোনো মেটাল ডিটেক্টর। এমন কী মনমতো হাংরি ইতিহাস লেখারও কোনো অ্যাজেন্ডা ছিল না। যা ছিল তা শুধু ঘাড় নীচু করে লিখে যাওয়া, নিজের লেখা পাঠ করে শোনানোর পাশাপাশি তরুণ লেখকদের লেখা শোনা এবং মতামত দেয়া। এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোনো উদ্দেশ্যও ছিল না সুভাষের। যে কোনো যৌথতায় বিনা আমন্ত্রণে হাজির হতে আপত্তি ছিল না কোনো।
    আমাদের অবাধ্য হওয়ার নমুনা পাওয়া মাত্র শৈলেশ্বর ঘোষ ভিন্ন শিবিরের খোঁজার পালা শুরু করে দিয়েছিলেন। সৃষ্টিশীলতা, ইতিহাস প্রসিদ্ধি এবং ক্ষুরধার বুদ্ধির ত্র্যহস্পর্শে পেয়েওছিলেন তৃতীয় প্রবাহের সন্ধান। তবে এক্ষেত্রে খানিকটা সমঝোতা করতে উনি রাজী হয়েছিলেন। যেমন ওই শিবির কবি শৈলেশ্বরকে স্বীকৃতি দিলেও ক্ষুধার্ত আন্দোলনের প্রতি তাদের বিন্দুমাত্র সহানুভূতি ছিল না। অবশ্য তখন শৈলেশ্বরের তাতে আর কিছু এসে যায় না। যথারীতি সে পর্বও দীর্ঘদিন লাস্টিং করলো না। করার কথাও নয়, জানতাম আমরা। কিভাবে জানতাম বলতে চাইছি না। অহেতুক তৃতীয়পক্ষকে টেনে কী লাভ ! বরং সেসময়ের একটা শ্লোগানের কথা বলি-- “অস্তিত্ব পুড়ছে, আসুন সেই আলোয় আমরা পরস্পকে শনাক্ত করি।”
    উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রসার সম্পর্কে রাজা সরকার লিখেছেন,”প্রসঙ্গত ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’এ সুভাষ ঘোষের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর আমরা নানা ভাবে আক্রান্ত বোধ করতে থাকি। সেই সাক্ষাৎকারে হাংরি কনসেপ্ট নিয়ে সুভাষের কথায় অনেকে অস্বস্তি বোধ করেন। অনেকেই আন্দোলন নিয়ে সুভাষের কথার বিরোধিতা করতে গিয়ে আমাদেরও তার সঙ্গে জড়িয়ে নেয়। সঙ্ঘ ভাঙা মানুষেরা বোধ করি কোনও সঙ্ঘ আর পছন্দ করেন না। কিন্তু ততদিনে পাশাপাশি আমরা জেনে যাচ্ছি যে হাংরিদের অভ্যন্তরীণ মত পার্থক্য, মামলা কেন্দ্রিক কিছু ব্যক্তিগত বিভেদের সালতামামি। এসব অগ্রাহ্য না করতে পারলেও আমরা আমাদের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। ততদিনে কিছুটা বিস্মৃত হয়ে যাওয়া ফালগুনী রায় ও অবনী ধর এর লেখা আমরা আমাদের কাগজে পুনঃ প্রকাশ করতে শুরু করি। হাংরি লেখকদের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বইও ঐসময় ‘কনসেনস্ট্রেশন ক্যাম্পের’ লেখকদের নিজ উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ।” 
    তিন
    অলোক গোস্বামী আর রাজা সরকারের বক্তব্য থেকে অনুমান করা যায়, পরাবাস্তববাদীদের  মতনই, শৈলেশ্বর ঘোষের হয়তো মনে হয়েছিল যে কলকাতায় তিনি হাংরি আন্দোলনের যে কেন্দ্র গড়ে তুলতে চাইছেন তাতে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করছেন সুভাষ ঘোষ । তাঁর আচরণ ছিল হুবহু আঁদ্রে ব্রেতঁর মতন । সুভাষ ঘোষের আচরণ ছিল লুই আরাগঁর মতন ; লুই আরাগঁ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন বন্ধু আঁদ্রে ব্রেতঁ থেকে, মতান্তরের কারণে ।পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে অনেকের সম্পর্ক ভালো ছিল না, দল অজস্রবার ভাগাভাগি হয়েছিল, অথচ সেসব নিয়ে বাঙালি আলোচকরা খিল্লি করেন না, যতোটা হাংরি আন্দোলনের দল-ভাগাভাগি ও বিবাদ নিয়ে করেন। ইংরেজিতে মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘দি হাংরিয়ালিস্টস’ নামে একটি বই লিখেছেন, পেঙ্গুইন র‌্যাণ্ডাম হাউস থেকে প্রকাশিত । সেই বইটি বাংলা পত্রপত্রিকায় আলোচিত হল না । ইংরেজিতে হাংরিদের সম্পর্কে সংকলিত “লিটারেচার অফ দি হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট : আইকনস অ্যাণ্ড ইমপ্যাক্ট” বইটিও আলোচিত হল না ; হাংরি আন্দোলনের চিত্রশিল্পী অনিল করঞ্জাই সম্পর্কে জুলিয়েট রেনল্ডসের লেখা  ‘রোডস অ্যাক্রস দি আর্থ : অন দি লাইফ, টাইমস অ্যাণ্ড আর্ট অফ অনিল করঞ্জাই’ বইটির আলোচনা হল না । অথচ বিট ও পরাবাস্তব আন্দোলন সম্পর্কে লেখা প্রায় সব বইই আমেরিকান ও ইউরোপীয় পত্রিকায় আলোচনা হয় । মৈত্রেয়ী ভট্টাচার্য চৌধুরী তাঁর বইতে লিখেছেন যে, “আন্দোলনটি সম্পন্ন হওয়ার পরে, বিশ্ব তাদের ভারতবর্ষের সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে মর্মভেদী, সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবশালী এবং উদ্ভাবনী শিল্পীর দল হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যাদের জীবন একটি অসাধারণ ফ্রেমে বিস্তৃত হয়েছিল, ফলে অনেকের কাছে বৃহত্তর চিত্রটি ছিল পরিবর্তিত । এই লেখক-কবিরা ছিলেন গোষ্ঠীভূত, আকস্মিক বিদ্রোহী এবং এই আন্দোলনটি  নেহাত বিকল্প জীবনধারা ছিল না, বরং ছিল জীবন ।”
    অবনিবনা প্রসঙ্গে সালভাদর দালি ও পিকাসোর বিবাদ নিয়ে, তাঁদের ছবিগুলো আলোচনায় খিল্লি করেন না আলোচকরা । আলোচিত হয় তাঁদের অবদান । ১৯৩০ সালে পরাবাস্তব আন্দোলনে দালি ছিলেন একজন বিতর্কিত সদস্য এবং অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে আঁদ্রে ব্রেতঁর সঙ্গে, তাঁর সংঘাত ঘটত প্রায়ই । এমনকী, ১৯৩৪ সালে পরাবাস্তববাদীরা একটি ‘বিচারসভা’ বসিয়ে’ দালিকে আন্দোলন থেকে বের করে দেন । দালিকে তাঁরা মনে করতেন প্রতিক্রিয়াশীল, সাম্যবাদ-বিরোধী, এবং ফ্রাংকোর চাটুকার চিত্রশিল্পী । বের করে দেবার পরও বহুকাল পর্যন্ত দালি  পরাবাস্তববাদী চিত্র-প্রদর্শনীতে অংশ নিতেন । দালি জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন আমেরিকায় । পিকাসো ছিলেন জেনেরাল ফ্রাংকোর শাসনের বিরোধী এবং বলেছিলেন যে যতোদিন ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদী শাসন থাকবে ততোদিন তাঁর আঁকা ‘গুয়ের্নিকা’ স্পেনে ঢুকবে না । পিকাসো সারাজীবন সাম্যবাদী ছিলেন । এই পরস্পরবিরোধীতা নিয়ে, তাঁদের পেইনটিঙ আলোচনার সময়ে কিন্তু খিল্লি করা হয় না । দালি বলেছেন যে যখন তিনি আঁকেন তখন কী আঁকছেন তা নিজেই বুঝতে পারেন না, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ছবিগুলোর কোনও মর্মার্থ নেই ; বরং বিপরীত, তাদের মর্মার্থ এতো জটিল, অনৈচ্ছিক, সুসংহত ও গভীর যে সেগুলো যৌক্তিক স্বজ্ঞাততার সবচেয়ে সাধারণ বিশ্লেষণ থেকে মুক্ত । দালি বলতেন যে তিনি তাঁর মৃত ভাই হিসেবে পুনর্জন্ম নিয়েছেন আর তাই তিনি দ্বৈত চরিত্রের মানুষ ।  এই ধরণের কথাবার্তা যদি ছবি-আঁকিয়ে সুবিমল বসাক, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় বা অনিল করঞ্জাই বলতেন, তাহলে বাঙালি আলোচকরা তার খিল্লি করবেন ।
    আলোচকরা মনে হয় জানেন না যে সুভাষ ঘোষ ছিলেন সিপিএমের কার্ড হোলডার, তাঁর বাড়ি থেকে গণশক্তি পত্রিকা বিতরণ হতো এবং লাঠিতে পরানো সিপিএমের ঝাণ্ডা তাঁর বাড়িতে ডাঁই করে রাখা থাকতো ; কমিউনিজম নিয়ে মাওবাদে বিশ্বাসী বাসুদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী মার্কসবাদী সুভাষ ঘোষের সিরিয়াস তর্ক-বিতর্ক ঘটেছিল, অথচ তা বিশ্লেষিত হয় না । কেবল তাঁদের অবনিবনা নিয়ে খিল্লি হয় ।
    চার
    আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৬ জুন ২০১৩ তারিখে গৌতম চক্রবর্তী হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এই কথাগুলো লিখেছিলেন ; তাতেও রয়েছে খিল্লি, যা তিনি পরাবাস্তববাদীদের সম্পর্কে কখনও করেছেন কিনা জানি না । উনি লিখেছিলেন :
    “মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র ও বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়।... এখন কবিতা রচিত হয় অর্গ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে।
    ১৯৬২ সালে এই ভাষাতেই কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস থেকে খালাসিটোলা, বারদুয়ারি অবধি সর্বত্র গোপন বিপ্লবী আন্দোলনের ব্লু প্রিন্টের মতো ছড়িয়ে পড়ে একটি ম্যানিফেস্টো। ২৬৯ নেতাজি সুভাষ রোড, হাওড়া থেকে প্রকাশিত এই ম্যানিফেস্টোর ওপরে লেখা ‘হাংরি জেনারেশন’। নীচের লাইনে তিনটি নাম। ‘স্রষ্টা: মলয় রায়চৌধুরী। নেতৃত্ব: শক্তি চট্টোপাধ্যায়। সম্পাদনা: দেবী রায়।’
    তখনও কলেজ স্ট্রিটের বাতাসে আসেনি বারুদের গন্ধ, দেওয়ালে লেখা হয়নি ‘সত্তরের দশক মুক্তির দশক’। কিন্তু পঞ্চাশ পেরিয়ে-যাওয়া এই ম্যানিফেস্টোর গুরুত্ব অন্যত্র। এর আগে ‘ভারতী’, ‘কবিতা’, ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ অনেক কবিতার কাগজ ছিল, সেগুলি ঘিরে কবিরা সংঘবদ্ধও হতেন। কিন্তু এই ভাবে সাইক্লোস্টাইল-করা ম্যানিফেস্টোয় আগে কখনও ছড়ায়নি বাংলা কবিতা।
    ওটি হাংরি আন্দোলনের দ্বিতীয় ম্যানিফেস্টো। প্রথম ম্যানিফেস্টোটি বেরিয়েছিল তার কয়েক মাস আগে, ১৯৬১ সালের নভেম্বর মাসে। ইংরেজিতে লেখা সেই ম্যানিফেস্টো জানায়, কবিতা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যায় না, বিভ্রমের বাগানে পুনরায় বৃক্ষরোপণ করে না। ‘Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of bamboozled gardens.’ বিশ্বায়নের ঢের আগে ইংরেজি ভাষাতেই প্রথম ম্যানিফেস্টো লিখেছিলেন হাংরি কবিরা। কারণ, পটনার বাসিন্দা মলয় রায়চৌধুরী ম্যানিফেস্টোটি লিখেছিলেন। পটনায় বাংলা ছাপাখানা ছিল না, ফলে ইংরেজি।
    দুটি ম্যানিফেস্টোতেই শেষ হল না ইতিহাস। হাংরি আসলে সেই আন্দোলন, যার কোনও কেন্দ্র নেই। ফলে শহরে, মফস্সলে যে কোনও কবিই বের করতে পারেন তাঁর বুলেটিন। ১৯৬৮ সালে শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর ‘মুক্ত কবিতার ইসতাহার’-এ ছাপিয়ে দিলেন ‘সমস্ত ভন্ডামির চেহারা মেলে ধরা’, ‘শিল্প নামক তথাকথিত ভূষিমালে বিশ্বাস না করা’, ‘প্রতিষ্ঠানকে ঘৃণা করা’, ‘সভ্যতার নোনা পলেস্তারা মুখ থেকে তুলে ফেলা’ ইত্যাদি ২৮টি প্রতিজ্ঞা। পরে বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া বাধবে। মলয় ব্যাংকের চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যাবেন। শৈলেশ্বর, সুবো আচার্য এবং প্রদীপ চৌধুরীরা বলবেন, ‘মলয় বুর্জোয়া সুখ ও সিকিয়োরিটির লোভে আন্দোলন ছেড়ে চলে গিয়েছে।’কী রকম লিখতেন হাংরিরা? বছর দুয়েক আগে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ‘বাইশে শ্রাবণ’ ছবিতে গৌতম ঘোষের চরিত্রটি লেখা হয়েছিল হাংরি কবিদের আদলে।
    ‘জেগে ওঠে পুরুষাঙ্গ নেশার জন্য হাড় মাস রক্ত ঘিলু শুরু করে কান্নাকাটি
    মনের বৃন্দাবনে পাড়াতুতো দিদি বোন বউদিদের সঙ্গে শুরু হয় পরকীয়া প্রেম’,
    লিখেছিলেন অকালপ্রয়াত ফালগুনী রায়। র‌্যাঁবো, উইলিয়াম বারোজ এবং হেনরি মিলারের উদাহরণ বারে বারেই টেনেছেন হাংরিরা। ঘটনা, এঁরা যত না ভাল কবিতা লিখেছেন, তার চেয়েও বেশি ঝগড়া করেছেন। এবং তার চেয়েও বেশি বার গাঁজা, এলএসডি, মেস্কালিন আর অ্যাম্ফিটোমাইন ট্রিপে গিয়েছেন।
    অতএব, সাররিয়ালিজ্ম বা অন্য শিল্প আন্দোলনের মতো বাঙালি কবিদের ম্যানিফেস্টোটি কোনও দিন গুরুত্বপূর্ণ হয়নি। কিন্তু ‘হাংরি’রা আজও মিথ। এক সময় ‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ বলে তৎকালীন মন্ত্রী, আমলা, সম্পাদকদের বাড়িতে ডাকযোগে তাঁরা মুখোশ পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার এক সময় ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি লেখার জন্য অশ্লীলতার মামলা হল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে। উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাকের বিরুদ্ধে জারি হল গ্রেফতারি পরোয়ানা।
    রাষ্ট্র ও আদালত কী ভাবে কবিতাকে দেখে, সেই প্রতর্কে ঢুকতে হলে ১৯৬৫ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলাটি সম্পর্কে জানা জরুরি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় কাঠগড়ায় উঠেছেন মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। পাবলিক প্রসিকিউটরের জিজ্ঞাসা, ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে?
    শক্তি: ভাল লাগেনি।
    প্রসিকিউটর: অবসিন কি? ভাল লাগেনি বলতে আপনি কী বোঝাতে চাইছেন?
    শক্তি: ভাল লাগেনি মানে জাস্ট ভাল লাগেনি। কোনও কবিতা পড়তে ভাল লাগে, আবার কোনওটা ভাল লাগে না।
    শক্তি সাক্ষ্য দিয়েছিলেন মলয়ের বিরুদ্ধে। কয়েক মাস পরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়ের সমর্থনে...
    প্রসিকিউটর: কবিতাটা কি অশ্লীল মনে হচ্ছে?
    সুনীল: কই, না তো। আমার তো বেশ ভাল লাগছে। বেশ ভাল লিখেছে।
    প্রসিকিউটর: আপনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে?
    সুনীল: না, তা কেন হবে? কবিতা পড়লে সে সব কিছু হয় না।
    একই মামলায় শক্তি ও সুনীল পরস্পরের বিরুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা, ’৬৫ সালে এই সাক্ষ্য দেওয়ার আগের বছরই সুনীল আইওয়া থেকে মলয়কে বেশ কড়া একটি চিঠি দিয়েছিলেন, ‘লেখার বদলে আন্দোলন ও হাঙ্গামা করার দিকেই তোমার ঝোঁক বেশি। রাত্রে তোমার ঘুম হয় তো? মনে হয়, খুব একটা শর্টকাট খ্যাতি পাবার লোভ তোমার।’ ব্যক্তিগত চিঠিতে অনুজপ্রতিম মলয়কে ধমকাচ্ছেন, কিন্তু আদালতে তাঁর পাশে গিয়েই দাঁড়াচ্ছেন। সম্ভবত, বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে অনুজ কবিদের কাছে সুনীলের ‘সুনীলদা’ হয়ে ওঠা হাংরি মামলা থেকেই। প্রবাদপ্রতিম কৃত্তিবাসী বন্ধুত্বের নীচে যে কত চোরাবালি ছিল, তা বোঝা যায় উৎপলকুমার বসুকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি চিঠি থেকে, ‘প্রিয় উৎপল, একদিন আসুন।...আপনি তো আর শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না।’
    তা হলে কি হাংরি আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে প্রভাবহীন, শুধুই কেচ্ছাদার জমজমাট এক পাদটীকা? দুটি কথা। হাংরিদের প্রভাবেই কবিতা-সংক্রান্ত লিটল ম্যাগগুলির ‘কৃত্তিবাস’, ‘শতভিষা’ গোছের নাম বদলে যায়। আসে ‘ক্ষুধার্ত’, ‘জেব্রা’, ‘ফুঃ’-এর মতো কাগজ। সেখানে কবিতায় বাঁকাচোরা ইটালিক্স, মোটাদাগের বোল্ড ইত্যাদি হরেক রকমের টাইপোগ্রাফি ব্যবহৃত হত। পরবর্তী কালে সুবিমল মিশ্রের মতো অনেকেই নিজেকে হাংরি বলবেন না, বলবেন ‘শুধুই ছোট কাগজের লেখক’। কিন্তু তাঁদের গল্প, উপন্যাসেও আসবে সেই টাইপোগ্রাফিক বিভিন্নতা। তৈরি হবে শ্রুতি ও শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন। হাংরিরা না এলে কি নব্বইয়ের দশকেও হানা দিতেন পুরন্দর ভাট?
    আসলে, ম্যানিফেস্টোর মধ্যেই ছিল মৃত্যুঘণ্টা। ’৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ম্যানিফেস্টোর শেষ লাইন, ‘কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।’ হাংরিরা নিজেদের যত না সাহিত্যবিপ্লবী মনে করেছেন, তার চেয়েও বেশি যৌনবিপ্লবী।”
    গৌতম চক্রবর্তী লেখেননি যে ম্যানিফেস্টো আর বুলেটিনগুলো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউ কফি হাউস, আনন্দবাজার, যুগান্তর, কবিতা ভবন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি, স্কটিশ, আশুতোষ, সিটি কলেজ ইত্যাদিতেও  বিলি করা হয়েছিল এবং পাঠানো হয়েছিল ব্রিটিশ লাইব্রেরি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
    হাংরি আন্দোলনকে ফিল্মে খিল্লি করেছিলেন সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় তাঁর বাইশে শ্রাবণ-এ । কোনও প্রয়োজন ছিল না অথচ তিনি গৌতম ঘোষকে একজন হাংরি কবি হিসেবে তুলে ধরলেন যার লেখা নাকি কোথাও ছাপা হয় না আর যার বুদ্ধিবিভ্রম ঘটে গেছে ।  হাংরি আন্দোলন এই সিনেমায় এসেছে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী’র হাত ধরে। মানসিক বিকারগ্রস্থ এই কবি  হাংরি আন্দোলনকে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছেন এবং কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে গভীর রাতে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ান, সেলফোনে তাঁর কবিতার বইয়ের প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলেন, কবিতা আবৃত্তি করে শোনান রাতের মাতালদের। এই কবি পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত,  কলকাতা বইমেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে।  এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে হয়েছিল। কোলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিঙ একসময় এই কবির দিকেই আঙ্গুল তুলে ধরে। 
    লোকটা কেমন হাংরি, যার বন্ধুবান্ধব নেই, দল নেই, কফি হাউসে যায় না, খালাসিটোলায় যায় না, বন্ধুদের নিয়ে হ্‌ইচই করে না, মধুসূদনের সমাধিতে খালাসিটোলায় বারদুয়ারিতে হাওড়া স্টেশনে নিমতলা শ্মশানে কফি হাউসে দাঁড়িয়ে জোরে-জোরে কবিতা পড়ে বন্ধুদের শোনায় না, মাদক নেয় না, নিজেদের দলের পত্রিকা নেই, নিজেই লিফলেটে ছাপাবার বদলে একজন খোচরের ওপর নির্ভর করে কবিতা প্রকাশের জন্য ! প্রসঙ্গত আমি প্রকাশ করতুম ‘জেব্রা’, সুবিমল বসাক ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, অরুণেশ ঘোষ ‘জিরাফ’, দেবী রায় ‘চিহ্ণ’, ত্রিদিব ও আলো মিত্র ‘উন্মার্গ’ আর The Waste Paper,  প্রদীপ চৌধুরী ‘ফুঃ’, শৈলেশ্বর ঘোষ ‘ক্ষুধার্ত’, সুভাষ ঘোষ ‘ক্ষুধার্ত খবর’ এবং পরে অলোক গোস্বামী প্রকাশ করতেন ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’।  ফিল্মে কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকারীর নামও উল্লেখ করা হয়েছে চরিত্রটাকে আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রমাণ করার জন্য ! এই ফিল্মের কারণে দর্শকদের কাছেও হাংরি আন্দোলন হয়ে উঠেছিল খিল্লি করার ব্যাপার । পরাবাস্তব আন্দোলন, ডাডা আন্দোলন, বিট আন্দোলন, র‌্যাঁবো-ভেরলেন নিয়ে যেসমস্ত ফিল্ম তৈরি হয়েছে তাতে তাঁদের খিল্লি করা হয়নি।
    পাঁচ
    একইভাবে, ৬ জুন ২০১৫ তারিখের আনন্দবাজার পত্রিকায়, শৈলেন সরকার,পুরো বই না পড়েই,  কী লিখবেন ভেবে নিয়ে লিখেছেন, “মলয় রায়চৌধুরী তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ সংক্রান্ত মামলায় সুভাষ ঘোষ ও শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকা দেওয়া বা বিভিন্ন সঙ্গীর এই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক অস্বীকারের সঙ্গে সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের সমাপ্তির ঘণ্টা বেজে গেছে বলে তাঁর মনে হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই তাঁর সঙ্গীরা আদালতে সমস্যার হাত থেকে রেহাই পেতে সুবিধাবাদের প্রশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু তিনিও কি নেননি? তিনি জানতেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ কবিতাটিকে পছন্দ করেননি এবং সব জেনেও কেন মলয়বাবু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মিথ্যে করে তাঁর খারাপ লাগা কবিতাটিকে বিচারকের সামনে ভাল বলে শংসাদানে অনুরোধ করেছিলেন? যে অনুরোধ সুনীল রেখেওছিলেন। নিজে বাঁচার জন্য বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে অন্যকে  মিথ্যে সাক্ষী দিতে বলাটা কি কম সুবিধাবাদ? আর একটা কথা, ‘হাংরি প্রতিসন্দর্ভ’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইওরোপীয় অধিবিদ্যাগত মনন বিশ্বের ফসল।’ তাঁর মনে পড়েছে মঙ্গলকাব্যগুলির কথা, তিনি লক্ষ্য করতে বলেছেন, ‘প্রাক ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই মাইক্রোপরিসরগুলি ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তাঁর রচয়িতারা নন।’ ওই একই লেখায় হাংরি আন্দোলনের শুরুর দিকে ফালি কাগজে প্রকাশিত রচনা প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, ‘রচনাগুলি দিলদরাজে বিলি করে দেয়া হত, যে প্রক্রিয়াটি হাংরি আন্দোলনকে দিয়েছিল প্রাক-ঔপনিবেশিক সনাতন ভারতীয় নশ্বরতা বোধের গর্ব।’ কিন্তু প্রথম লিফলেটে হাংরি আন্দোলনের ‘ক্রিয়েটর’ হিসাবে নিজের নাম ‘মলয় রায়চৌধুরী’ ছাপিয়ে মলয়বাবু নিজে কি ভারতীয় নশ্বরতাবোধের উদাহরণ রাখতে পেরেছিলেন?” 
    কবিতাটার শিরোনাম যে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, শৈলেন সরকার খিল্লি করে তা পালটে দিয়েছেন । দ্বিতীয়ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সাক্ষ্য দেবার আগে কবিতাটি পড়েননি । প্রথম পড়েন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে । সাক্ষ্য দেবার দুই বছর আগে কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমার কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’ প্রকাশ করেছিলেন । তৃতীয়ত, লিফলেটে ‘ক্রিয়েটর’ লেখা মানেই তা অশোকের শিলালিপি নয়, তা, পুলিশ কমিশনার যেমন বলেছিলেন, দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপন আর লোকে হাতে পেয়ে মুচড়ে বা ছিঁড়ে ফেলে দেবে । হাংরি আন্দোলনের শতাধিক লিফলেট প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু মাত্র কয়েকটিই পাওয়া যায়, কেননা তা ক্রিয়েটরের শিলালিপি ছিল না । আন্দোলনের সমাপ্তির কথা প্রদীপ চৌধুরীও ঘোষণা করেছিলেন, লাল কালিতে পুস্তিকা ছাপিয়ে, কিন্তু তা শৈলেন সরকারের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল । প্রদীপ তাঁর ব্যাখ্যায় জানিয়েছিলেন যে হাংরি আন্দোলন হয়ে উঠছিল একটি প্রতিষ্ঠান এবং তার মৃত্যু ঘোষণা জরুরি ছিল । প্রসঙ্গত, প্রদীপ চৌধুরী হাংরি আন্দোলনকে ত্রিপুরার কবি অরুণ বণিক, রসরাজ নাথ, রত্নময় দে, সেলিম মুস্তফা, অরূপ দত্ত প্রমুখকে নিয়ে আগরতলায় আরম্ভ করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রাজনৈতিক কারণে অরুণ বণিক খুন হয়ে যাবার পর তা থেমে যায় । অরুণ বণিকের কবিতা আলোচিত হয় না । পরাবাস্তববাদীদের সমস্তকিছু কিন্তু সংরক্ষণ করা হয়েছে, করেছেন পরবর্তী প্রজন্ম।
    অর্ক দেব হাংরি লেখক-কবিদের বইপত্র না পড়েই খিল্লি করেছেন, “হাংরি ধারণাটা লেখাজীবীর প্রেরণা। প্রেরণাই হতে পারে বড়জোর। আন্দোলন না বাল।”
    স্নেহাশীষ রায় কোনও বইপত্রের প্রসঙ্গ ও আলোচনা ছাড়াই খিল্লি করেছেন, “মলয় রায়চৌধুরীর আত্মপ্রচারসর্বস্বতা, চালাকি, মিথ্যাচার ও ভন্ডামীর কারণে কিছুটা হলে হাংরি জেনারেশন তথা বাংলা কবিতার অন্যতম মেরুদন্ড শৈলেশ্বর ঘোষ তুলনামূলক অনেকটাই কম পঠিত ও পরিচিত৷যদিও এর কারণ কবির আত্মপ্রচারবিমুখতা, খ্যাতি, পুরস্কারকে সন্দেহ ও ঘৃণা করাও কিছুটা হতে পারে৷মহৎ কবির বৈশিষ্ট্য আর কী৷বাংলা কবিতার ভাষাবিমোচনকারী মৌলিক স্বরের এই কবি প্রতিষ্ঠান বা 'ক্ষমতার ভাষা'কে পরিহার করে নিজনির্মিত স্বতন্ত্র ভাষায় আজীবন কবিতা,গদ্য,নাটক রচনা করে গেছেন৷তাঁর রচনা প্রতি মুহূর্তে আমাদের বিবেকের সামনে দাঁড় করায়,আমাদের সামাজিক মুখোসগুলো খসে পড়ে তাঁর কবিতার মুখোমুখি হলে৷আজীবন যে কবিকে মার্জিনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয় ক্রমশ,যখন তাঁর বেশকিছু পাঠক হয়,তাঁকে আর কিছুতেই অস্বীকার করা যায়না,তখন সেই প্রতিষ্ঠানই আবার তাঁকে নিয়ে ব্যবসা করে৷মুনাফালোভী নগ্নতার এই তো চরিত্র !আজ এই অস্থির সমাজে, বন্ধা সময়কালে শৈলেশ্বরের রচনা অনিবার্য হয়ে উঠেছে৷” 
    শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে মলয় রায়চৌধুরীকে উল্লেখ করতে হল কেন ? খিল্লি করার সদ্ব্যবহার করার জন্য । শৈলেশ্বর ঘোষের অনুগামীরা যে সুভাষ ঘোষকে মারধর করেছিল, তা স্নেহাশীষ রায় উল্লেখ করলেন না। করলে কোনও ক্ষতি হতো না, কেননা মারধরের ব্যাপার পরাবাস্তববাদীদের মধ্যেও হতো ।
    ছয়
    হাংরি আন্দোলনকারীদের লেখা বইপত্র না পড়েই অনেক আলোচককে এই “মৃত্যুঘণ্টা” শব্দটা ব্যবহার করতে দেখা গেছে -- একথা আমাকে জানিয়েছেন বিষ্ণুচন্দ্র দে, যিনি আমার লেখালিখি নিয়ে পিএইচডি করেছেন। মৃত্যু হলে গির্জার ঘণ্টা বাজায় খ্রিস্টানরা, হিন্দু-মুসলমানরা নয় । উদয়শংকর বর্মা হাংরি আন্দোলন নিয়ে পিএইচডি করেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে । গৌতম চক্রবর্তী বহু বিদেশি নাম বাদ দিয়ে দিয়েছেন ; সম্ভবত তিনিও লেখার আগেই হাংরি আন্দোলনকারীদের খিল্লি করবেন বলে ঠিক করে ফেলেছিলেন । হাংরি আন্দোলনকারীরা জানতো যে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স  মর্গে যেতে ভালোবাসতেন; সেখানে দিনের একটা সময় কাটাতেন।  মর্গে যাওয়া ছাড়াও চার্লস ডিকেন্সের ছিল আফিমে আসক্তি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতন।  আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ছিল মদের প্রতি আসক্তি, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদারের মতন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ফরাসি ও স্কচ খেতে পছন্দ করতেন । নীলাঞ্জন হাজরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন যে উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় প্রচুর মদ খেতেন, কেউ-কেউ বাংলা মদ ; একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায় মহুয়ার মদ খেয়ে তাঁর বুকে বসে গলা টিপে ধরেন । হাংরি আন্দোলনকারীদের নেশা করাকে যেভাবে খিল্লি করা হয়, এনাদের ও বিদেশিদের নেশা করাকে এড়িয়ে যাওয়া হয় ।
    মদের ভালোবাসা থেকে হেমিংওয়ে লিখেছেন- যখন আপনি মাতাল, তখন আপনি অনেক বেশি ভদ্র । এটা আপনার মুখ বন্ধ রাখতে সাহায্য করবে। আমেরিকান রোমান্টিক মুভমেন্টের প্রধান ব্যক্তি, এডগার অ্যালান পো ছিলেন মাদকাসক্ত। হেমিংওয়ের মতো তিনিও দুঃখ থেকে মুক্ত থাকার জন্য মদ খাওয়া আরম্ভ করেন । কলকাতার খালাসিটোলায় আর বারদুয়ারিতে বহু মাতালকে দুঃখে কাঁদতে দেখা গেছে - সুতরাং মদ খাওয়াকে বা নেশা করাকে খিল্লি করে উড়িয়ে দেয়া যায় না । ব্রিটিশ কবি, রোমান্টিক মুভমেন্টের অন্যতম প্রবক্তা, ‘কুবলা খান’ও ‘দ্য রাইম অব দ্য এনসিয়েন্ট মেরিনার’ এর কবি স্যমুয়েল টেইলর কোলরিজ আফিমে আসক্ত ছিলেন। সেই সময় তিনি আফিমখোর হিসেবে ব্রিটেনে পরিচিত ছিলেন এবং এটা নিয়ে তিনি গর্বও বোধ করতেন। তিনি বলেছেন, কুবলা খান লিখতে গিয়ে আফিমের ঘোর তাঁকে সাহায্য করেছিল। ট্রেজার আইল্যান্ড, দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইড-এর স্রষ্টা  স্কটিশ সাহিত্যিক রবার্ট লুই স্টিভেনসন ছিলেন কোকেনে আসক্ত। তার স্ত্রীর ভাষ্যমতে, তিনি কোকেন নিয়ে  মাত্র ছয় দিনে  ঘোরগ্রস্ত অবস্থায় ৬০ হাজার শব্দ লিখেছিলেন। এর মধ্যে দ্য স্ট্রেঞ্জ কেস অব ডা. জ্যাকেল অ্যান্ড মি. হাইডও লিখেছেন।
    শার্ল  বোদলেয়ার হ্যাশিসের নেশা করতেন এবং তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘নকল স্বর্গ : আফিম ও চরস’ রচনায় তা লিখে গেছেন । মমার্ততে পিকাসোর স্টুডিওতে ১৯০৪ থেকে ১৯০৮ পর্যন্ত আফিমের সান্ধ্য আড্ডা বসতো ; নেশা করে মাদুরে শুয়ে থাকতেন তাঁরা, একটিমাত্র কুপি জ্বালিয়ে, যাতে অন্ধকারে নেশার মৌতাত নেয়া যায় । বিশ শতকের ফরাসি আভাঁ গার্দের অনেকে সেখানে একত্রিত হতেন, যেমন আমেদেও মদিগলিয়ানি, হুয়ান গ্রিস, পাবলো গারগালো, আঁদ্রে সালমঁ, গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার, ম্যাক্স জেকব প্রমুখ । গেয়র্গে ব্রাকের প্রেমিকা পলেতে ফিলিপির আফিম চাটা আর ফোঁকার দোকান ছিল মুলাঁ রুজের পেছনে । আরেকটি ছিল ডক্টর পল আলেকজান্দ্রের, যিনি বিশ্বাস করতেন যে কল্পনার বিস্তার ঘটাতে আফিম আর চরসের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না ; আফিম আর চরসের নেশা মানুষকে সময়ের পরিসর থেকে বিচ্যূত করে । পিকাসোকে নেশা ধরিয়েছিলেন গেয়র্গে পিগা, আর এই নেশা থেকেই পিকাসোর নীল পর্বের আরম্ভ । তিনি তাঁর পেইনটিঙের পরিসরের মাত্রায় সময়কে আনতে চাইছিলেন, যে শৈলীকে আলোচকরা নাম দেন ‘কিউবিজম’। পিকাসো বলেছেন যে চাকা আবিষ্কারের পর মানুষের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার হল আফিম । জাঁ ককতোকে তিনি বলেছিলেন যে আফিম মানুষকে বদান্য করে তোলে, তাকে লোভ থেকে মুক্তি দেয় ।
    পিকাসো ১৯০৮ সালে আফিমের আড্ডা ভেঙে দেবার পর পরাবাস্তববাদী চিত্রকর আঁদ্রে ম্যাসনের স্টুডিওতে সবাই জড়ো হতেন । স্বতঃউৎসারিত বা অটোম্যাটিক লেখা ও আঁকার পরাবাস্তববাদী পরীক্ষা-নিরীক্ষা হতো আঁদ্রে ম্যাসনের স্টুডিওতে, এবং তা আফিমের নেশা করে ম্যানদারিন কিউরাকাও পান করার পর । অতিথিদের মধ্যে নিয়মিত আসতেন হেমিংওয়ে, গারট্রুড স্টিন, ম্যাক্স আর্নেস্ট, মান রে এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ । ১৯২৪ সালে ২৪ বছর বয়শে অত্যধিক আফিম নেবার ফলে তাঁর বন্ধু জাক ভাশের মৃত্যুর পর আঁদ্রে ব্রেতঁ মাদকবিরোধী হয়ে ওঠেন এবং যে পরাবাস্তববাদীরা মাদক নিতেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে । তাছাড়া পরাবাস্তব আন্দোলন আরম্ভ করার আগে ব্রেতঁ, লুই আরাগঁ ডাকতারি পড়েছিলেন । মাদকনির্ভর স্বয়ংক্রিয় লেখা ও আঁকার বিরোধী ছিলেন এনারা এবং বিশ্বাস করতেন ফ্রয়েডিয় তত্বে । ব্রেতঁর এই ভাবনায় বিশ্বাস করতেন না বেশ কয়েকজন পরাবাস্তববাদী, যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অঁতনা আর্তো, যিনি ছিলেন আফিম ও চরস সেবন করে ইন্দ্রিয়কে বিপর্যস্ত করার ভাবনায় বিশ্বাসী । মাদক নিয়ে ইন্দ্রিয়কে বিপর্যস্ত করার আরেক সমর্থক ছিলেন কবি, ফিল্মনির্মাতা ও চিত্রকর জাঁ ককতো, যিনি বলতেন যে আফিমের আহ্লাদ হল স্বাস্হ্যের চেয়ে উন্নত, এবং অত্যধিক সেবনের কারণে  প্রায়ই তাঁকে স্যানাটোরিয়ায় ভর্তি করা হতো আর সেরে ওঠার পর আবার নেয়া আরম্ভ করতেন । 
    সাত
    হ্যাঁ, হাংরি আন্দোলনকারীরা অভিজ্ঞতার জন্য মাদকের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন । ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাতে যেতে না হয় তাই মার্কিন যুবক-যুবতীরা হিপি হয়ে যাচ্ছিলেন এবং বিদেশে পাড়ি মারছিলেন, বিশেষ করে ভারতে ও নেপালে। হিপিরা বিটনিক নন । তাঁদের এই পলায়নের জীবনযাপনের খরচ যোগাতেন তাঁদের বাবা-মা, আমেরিকান এক্সপ্রেসের মাধ্যমে তাঁদের টাকা পাঠিয়ে । আমেরিকার চাপে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, ভারতেও, মাদকবিরোধী আইন পাশ হয় আশির দশকে । ষাটের দশকে সরকারী দোকানে গাঁজা, আফিম, চরস পাওয়া যেতো, এখনকার মতন লুকোছাপার দরকার হতো না । খালাসিটোলার পাশেই ছিল একটা সরকারি দোকান, বেনারসেও বহু দোকান ছিল । নেপালে সর্বত্র পাওয়া যেতো। বেনারসে আর কাঠমাণ্ডুতে হিপি কলোনি গড়ে উঠেছিল । হাংরি আন্দোলনের চিত্রকর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাই-এর নাম হিপিদের কাছে লোকমুখে পৌঁছে গিয়েছিল আর তারা বেনারসে পৌঁছে, থাকা-খাওয়ার সুবিধার জন্য ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করত । করুণানিধান মুখোপাধ্যায় তো একসময়ে হিপি কলোনির রান্নার ইনচার্য হয়েছিল । আমরা এদের দুজনের সংস্পর্শে আসার পর বিভিন্ন মাদকের এবং হিপি জীবনযাত্রার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হই । আমি এই জীবনযাত্রার কিছুটা তুলে ধরেছি আমার উপন্যাস “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা”তে । করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের এই দুটো চিঠি থেকে কিছুটা ধারণা হবে :-
      কাঠমাণ্ডু
             ১১ এপ্রিল ১৯৬৬
    মলয়, হুররেরেরে
    এই ঠিকানায় চিঠি দাও বা প্রভাতীর চিঠি এলে সেই চিঠিকে রিডাইরেক্ট না করে আর একটা খামের মধ্যে পুরে নতুন ভারতীয় স্ট্যাম্প লাগিয়ে পাঠাও ।
    কী করে আসতে হবে চার্ট পাঠালাম ।
    সমীরকে চিঠি দিয়েছি । অনিলকেও ।
    কাল থেকে বেরিয়ে পড়ব বার্তা নিয়ে ।
    এখানে সেই যে বালিশের নিচে মুড়ি দিয়ে র‌্যাঁবো পড়ে, সেই ঘি ( গাই )-এর সঙ্গে দেখা - ওর ওখানেই উপস্হিত ।
    দারুণ ব্যাপার ।
    তাড়াতাড়ি এসো ।
    লুণ্ড হয়ে থাকা যাক কিছুদিন ।
    অফুরন্ত চরস আর মেয়েছেলে ।
    আন্ডারগ্রাউণ্ড আর ওভারগ্রাউন্ড মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন ছেলে আর মেয়ে — একেবারে গিজগিজ করছে । শিগগির এসো, আমি হাংরি হ্যাপেনিং করার তালে আছি । পরে মোটা খাম পাঠাচ্ছি ।
                                                          করুণানিধান মুখোপাধ্যায়
    প্রিয় মলয়,
    হঠাৎ আফগানি মাল কিছুটা পেয়ে গেলাম বেশ খানিকটা । বিলি করা শুরু করেছি, তোমায় পাঠালাম, চাপ দিলেই গুঁড়ো, সিগারেট পাইপ ছিলিম যাতে খুশি খেতে পারো । মালের প্রাপ্তি সংবাদ দিও ।
    হঠাৎ আমার এক অ্যালসেশিয়ান বন্ধুর সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলাম । সুবিমলের আস্তানায় ছিলাম । সুবিমল, সুভাষ, ফালগুনী, শম্ভু রক্ষিত, ত্রিদিব, আলো আর দেবীও পীড়াপীড়ি করে জুটেছিল খালাসিটোলায় । মাতাল অবস্হায় জেনারেশনের সবাই গড়াগড়ি দিয়েছিল, দেবী ছাড়া ।
    আজকার ভীষণ একটা যা-তা, বিশ্রী, দারুণ গালাগালি দিয়ে নিজের নোংরামিগুলো বমি করতে ইচ্ছে করছে । লেখাটা সেই নিয়ে চলছে । আমি অনিল একটা পত্রিকা বের করার তালে আছি, তোমার কানে পৌঁছে থাকবে । ভালোবাসা—
                                                                  করুণা
                                                              ( তারিখ মনে নেই )
    গাঁজা, আফিম, চরস সরকারি দোকানে পাওয়া গেলেও, এলএসডি পাওয়া যেতো হিপিদের কাছ থেকে। ওরা লাইসারজিক অ্যাসিডে ব্লটিঙপেপার ভিজিয়ে আনতো বা চব্বিশ ঘণ্টা, আটচল্লিশ ঘণ্টা, বাহাত্তর ঘণ্টার ট্রিপের ক্যাপসুল আনতো । কাস্টমসে কোনও নিষেধ ছিল না । জাঁ ককতো আর পিকাসো মাদকের যে আহ্লাদের কথা বলেছেন তা পাওয়া যেতো এইগুলো আলাদা বা একসঙ্গে নিয়ে, পাইপে বা সেই সময়ের চারমিনার সিগারেটে পুরে । ফালগুনী রায় আর শৈলেশ্বর ঘোষ গাঁজা ফুঁকতে ভালোবাসতেন । ফালগুনীর চরসের মেঠাই আর ভাঙের শরবত ভালো লাগতো । বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, অবনী ধর, সুবিমল বসাক, প্রদীপ চৌধুরী ভালোবাসতেন মদ খেতে । অনুকুল ঠাকুরের কাছে দীক্ষা নেবার পর সুবো আচার্য মাদক নেয়া ছেড়ে দেন । নিজে ঋত্বিক হবার পর মাদক আর সমকামের ব্যাপারে তিনি নিয়মিত বক্তৃতাও দেন তাঁর শিষ্যদের । সরকারি অধিকারী হবার পর ত্রিদিব মিত্রও ছেড়ে দেন মাদক নেয়া । কিন্তু হাংরি আন্দোলনকারীদের মাদক নেয়া নিয়ে খিল্লি করা হয় কেন তা বোধগম্য নয়, যখন কিনা বর্তমানে বহু কলেজ ছাত্রীও পাতা ফোঁকেন ।
    আট
    ১৯১৭ সালে গিয়ম অ্যাপলিনেয়ার “সুররিয়ালিজম” অভিধাটি তৈরি করেছিলেন, যার অর্থ ছিল বাস্তবের অতীত। শব্দটি প্রায় লুফে নেন আঁদ্রে ব্রেতঁ, নতুন একটি আন্দোলন আরম্ভ করার পরিকল্পনা নিয়ে, যে আন্দোলনটি হবে পূর্ববর্তী ডাডাবাদী আন্দোলন থেকে ভিন্ন । ত্রিস্তঁ জারা উদ্ভাবিত ডাডা আন্দোলন থেকে তাঁর সরে আসার কারণ হল ব্রেতঁ সহ্য করতে পারতেন না ত্রিস্তঁ জারাকে, কেননা কবি-শিল্পী মহলে প্রতিশিল্পের জনক হিসাবে ত্রিস্তঁ জারা খ্যাতি পাচ্ছিলেন। ইউরোপিয় ধ্রুপদি সাহিত্যের নান্দনিক শুদ্ধাচারের বাঁধন ছিঁড়ে বেরোবার পথ খুঁজছিলেন ব্রেতঁ। একইভাবে ‘হাংরি’ শব্দটি আমি পেয়েছিলুম কবি জিওফ্রে চসার থেকে । এই ‘হাংরি’ শব্দটি নেয়ার জন্য যেভাবে আমার খিল্লি করা হয়, তেমন কিছুই করা হয়নি আঁদ্রে ব্রেতঁ ও ত্রিস্তঁ জারা সম্পর্কে । আমি  হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ঘোষণা করি  ১৯৬১ সালের পয়লা নভেম্বর একটি লিফলেট প্রকাশের মাধ্যমে । পত্রিকার পরিবর্তে লিফলেট প্রকাশ করা নিয়েও খিল্লি হয় ।
    যাঁরা কবি ও লেখকদের পারস্পরিক অবনিবনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাঁরা হাংরিদের লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণের ব্যাপারটা ভেবে দ্যাখেননি, বিশেষ করে কৌম-সমাজটির আর্থসামাজিক পৃষ্ঠপটে ও পূর্বের সাহিত্যিক পঠন-পাঠনের প্রভাবে নির্মিত তাঁদের প্রতিস্ব ।
    প্রথম ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র ও প্রথম ছোটোগল্পকার পূর্ণচন্দ্র থেকে হাল আমলের মফসসলের কথাসাহিত্যিক, প্রান্তিক ও শহুরে গল্পকার কিংবা মেট্রপলিটান ঔপন্যাসিক, তাঁদের লেখক প্রতিস্ব অবিনির্মাণ করলে প্রথম যে উপাদানটি পাওয়া যাবে, তা তাঁদের মাতৃভাষায় এবং অন্যান্য যে ভাষায় তাঁদের দখল আছে, সে ভাষায় পূর্ব প্রজন্মগুলোর সাহত্যিকদের লেখা গল্প-উপন্যাসের পঠন-পাঠনের জমা করা স্মৃতি । ব্যক্তিপ্রতিস্ব নির্মাণে ভাষার অবদান অনস্বীকার্য, কিন্তু লেখক-প্রতিস্ব নির্মাণে ভাষাসাহিত্যের জ্ঞান তথা সাহিত্যের বিশেষ ঝোঁকের প্রতি লেখকের টান, তাঁর লেখনকর্মের আদল আদরা দিশা তাৎপর্য অন্তর্নিহিত-সম্পদ দাপট চৈতন্য অস্তিত্ব আত্ম-উন্মোচন এমনকী তাঁর সাহিত্য চক্রান্তক কলমটির গঠনকারী মূল উপাদান । তাঁদের লেখন-অভিজ্ঞতার মালিকানার বখরা কিন্তু তাঁদের পড়া পূর্বসূরী গল্পকার-ঔপন্যাসিক-দার্শনিকদের প্রাপ্য।
    আমি যে প্রতিস্ব-নির্মাণের কথা বলছি তা বাংলা সাহিত্যের এক বিশেষ বাঁকবদলের সময়কার । উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষে পঞ্চতন্ত্র, হিতোপদেশ, বেতাল পঞ্চবিংশতি, কথাসরিৎসাগর, বৃহৎকথা, কথামঞ্জরী, দশকুমার চরিত, বাদবদত্তা ইত্যাদি গদ্যে রচিত কথাবস্তুর অতিপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে । ইংরেজরা আসার পর, এবং ফলে, বাংলা গদ্যসাহিত্য ও গদ্যে নানা ধরণের সংরূপের উদ্ভব জলবিভাজকের কাজ করেছিল ; আমি সেদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছি । এক নতুন নন্দনক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল সাহিত্যের এলাকায়, যে এলাকায় লেখক নামের নির্মিত-প্রতিস্বের মানুষটির লেখনকর্মকে কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসেবে নৈতিকতা আর বৈধতা আরোপের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল । ফলে লেখনকর্ম বা পাঠবস্তুতে সতত কেন্দ্র দখল করে থাকলেন লেখ-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিমালিকটি ।
    ইংরেজরা আসার পরই, আর বাংলা কথাসাহিত্যের শুরুতেই যে লেখকরা নির্মিত-প্রতিস্ব নিয়ে লেখন-পরিসরে নেমেছিলেন, তা কিন্তু নয়। লেখন পরিসরে ব্যক্তিনামের লালন, ব্যক্তি-আধিপত্যের ছাপ, ব্যক্তিপ্রসূত রচনাগত মৌলিকতা, ব্যক্তিসৃজনশীলতা ইত্যাদি প্রতর্কগুলো হিন্দু বাঙালির জীবনে প্রবেশ করতে পেরেছিল  সেই সময়কার কলকাতায় ইউরোপিয় আলোকপ্রাপ্তির মননবিশ্বটি পাকাপাকি ভাবে থিতু হয়ে বসার পর । ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ থেকে শিক্ষার বাহন হিসেবে ইংরেজি, তারপর ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষিত বাঙালির সমাজে ওই মননবিশ্ব প্রবেশ করতে পেরেছিল। বাংলা ভাষার প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয় ১৮৬৫ সালে, লেখক হিসেবে বঙ্কিমচন্দ্রের মননবিশ্বটি ওই আদরায় নির্মিত হবার পর এবং ফলে, আর একই কারণে বঙ্কিমচন্দ্রের ভাই পূর্ণচন্দ্র দ্বারা রচিত হলো, ১৮৭৩ সালে, প্রথম বাংলা ছোটোগল্প ‘মধুমতী’ । তার আগে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা এবং ১৮৩১ সালে প্রকাশিত ‘নববাবুবিলাস’ আর ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা ‘আলালের ঘরের দুলাল’ পাঠবস্তুগুলোতে ওই মননবিশ্বের ছাপ ছিল না ।
    পূর্ণচন্দ্র তাঁর গল্পটিতে নামস্বাক্ষর করেননি । ‘নববাবুবিলাস’ আর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ছদ্মনামে লেখা । নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর ‘বাংলা ছোটোগল্প — সংক্ষিপ্ত সমালোচনা’ বইতে জানিয়েছেন যে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সময়কালে ( ১২৮০ থেকে ১৩০৬ বঙ্গাব্দ ) বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় একশ ছাব্বিশটি ছোটোগল্প প্রকাশিত হয়েছিল যেগুলোয় লেখকরা নামস্বাক্ষর করেননি, এমনকী ছদ্মনামও নয় । রচনার সঙ্গে লেখকের নাম দেওয়ার প্রথাটি প্রবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবশালী প্রতিনিধি । সেসময়ে ব্রা্‌হ্মধর্ম হয়ে উঠেছিল ওই মননবিশ্বের ধারক ও বাহক । নামস্বাক্ষর না-করার প্রক্রিয়াটি থেকে স্পষ্ট যে কথাবস্তুর রচয়িতারা জানতেন না যে লেখকসত্তা বলে কোনো ব্যাপার হয়, এবং লেখকের নামটি সত্তাটিকে বহন করে । কোনও কথাবস্তু যে মেধাস্বত্ত, সে ধারণাটির প্রতিষ্ঠা হতে সময় লেগেছিল । তার কারণ অস্তিত্বের কেন্দ্রে ব্যক্তিমানুষকে স্হাপনের কর্মকাণ্ডটির প্রভাব, যাকে উনিশ শতকের রেনেসঁস বলা হয়, সেই চিন্তাচেতনাকে ছড়িয়ে দেবার জন্য অজস্র নির্মিত-প্রতিস্বের প্রয়োজন ছিল । ইউরোপীয় চিন্তনতন্ত্রটির বাইরে যে নন্দনক্ষেত্রটি রয়ে গেল, জলবিভাজিকার অন্য দিকে, তাকে বটতলা নামে এইজন্য দোষারোপ করা হল যে সেই এলাকায় ব্যক্তিএককগুলো অনির্মিত। জেমস লঙ বললেন বটতলার বইগুলো অশ্লীল ও অশোভন, যার দরুন বাংলার সংস্কৃতি থেকে লোপাট হয়ে গেল বইগুলো । একইভাবে, জেমস লঙের বাঙালি বংশধররা হাংরি আন্দোলনের কাজগুলোকে বলেন অশ্লীল ও অশোভন ।
    ইউরোপ থেকে আনা সাহিত্য-সংরূপগুলোর সংজ্ঞার স্বামীত্ব, তাদের ব্যাখ্যা করার অধিকার, দেশীয়করণের বৈধতা, সেসব বিধিবিধান তত্বায়নের মালিকানা, কথাবস্তুটির উদ্দেশ্যমূলক স্বীকৃতি, চিন্তনতন্ত্রটির অন্তর্গত সংশ্লেষে স্বতঃঅনুমিত ছিল যে, অনির্মিত লেখকপ্রতিস্বের পক্ষে তা অসম্ভব, নিষিদ্ধ, অপ্রবেশ্য, অনধিকার চর্চা । ব্যাপারটা স্বাভাবিক, কেননা যাঁরা সংজ্ঞাগুলো সরবরাহ করছেন, তাঁরাই তো জানবেন যে সেসব সংজ্ঞার মধ্যে কী মালমশলা আছে, আর তলে-তলে কীইবা তাদের ধান্দা । ফলে, কোনও কথাবস্তু যে সংরূপহীন হতে পারে, লেখক-এককটি চিন্তনতন্ত্রে অনির্মিত হতে পারে, রচনাকার তাঁর পাঠবস্তুকে স্হানাংকমুক্ত সমাজপ্রক্রিয়া মনে করতে পারেন, বা নিজেকে বাংলা সাহিত্যের কালরেখার বাইরে মনে করতে পারেন, এই ধরণের ধারণাকে একেবারেই প্রশ্রয় দেয়নি ওই চিন্তনতন্ত্রটি । এই কারণেই হাংরি আন্দোলনকে বুঝতে পারেন না অনেকে, হাংরিদের কবিতা ও গদ্যকে পূর্বের কবি ও লেখকদের কাজের পাশে রেখে তুলনা করতে চান । বর্তমান কালখণ্ডে, আমরা জানি, একজন লোক লেখেন তার কারণ তিনি ‘লেখক হতে চান’ । অথচ লেখক হতে চান না এরকম লোকও তো লেখালিখি করতে পারেন । তাঁরা সাহিত্যসেবক অর্থে লেখক নন, আবার সাহিত্যচর্চাকারী বিশেষ স্হানাংক নির্ণয়-প্রয়াসী না-লেখকও নন । তাঁদের মনে লেখক হওয়া-হওয়ি বলে কোনও সাহিত্য-প্রক্রিয়া থাকে না । হাংরি আন্দোলনকারীদের, ডাডাবাদীদের মতনই, এই প্রেক্ষিতে গ্রহণ করতে হবে ।
    বহুকাল যাবৎ বিভিন্ন আলোচককে মন্তব্য করতে দেখা গেছে যে, উপন্যাস আর্ট ফর্মটির বঙ্গীয়করণ করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, ছোটোগল্প আর্টফর্মটিকে সম্পূর্ণ দেশজ করে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সনেট-তের্জারিমা-ভিলানেলকে এতদ্দেশীয় করেছিলেন প্রমথ চৌধুরী, ইত্যাদি ।  এই যে একটি ভিন্ন ভাষসাহিত্যের সংরূপকে আরেকটি ভাষাসাহিত্যে এনে সংস্হাপন, এর জন্য দ্বিভাষী দক্ষতা এবং সংরূপটি সম্পর্কে গভীর জ্ঞানই যথেষ্ট নয় । যিনি এই কাজটিতে লিপ্ত, তাঁর গ্রাহীক্ষমতা, বহনক্ষমতা ও প্রতিস্হাপন ক্ষমতা থাকা দরকার। অমন ক্ষমতা গড়ে ওঠে জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে । আর এই জ্ঞান আহরণ তখনই সম্ভব যখন আ্হরণকারীর লেখক-প্রতিস্বের নির্মাণ ঘটে জ্ঞানটির পরিমণ্ডলে । সার্থকতা নামের মানদন্ডটি ওই চিন্তনতন্ত্রের ফসল । বর্তমান কালখণ্ডে ওই চিন্তনতন্ত্র বাতিল হয়ে গেছে, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ ।
    নয়
    আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিজম তত্বটির একমাত্র ব্যাখ্যাকারী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে আরম্ভ করেন। আঁদ্রে ব্রেতঁ তাঁর বন্ধু পল এলুয়ার, বেনিয়ামিন পেরে, মান রে, জাক বারোঁ, রেনে ক্রেভালl, রোবের দেসনস, গিয়র্গে লিমবোর, রোজের ভিত্রাক, জোসেফ দেলতিল, লুই আরাগঁ ও ফিলিপে সুপোকে নিয়ে ১৯১৯ সালে পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন । কিছুকাল পরে, রাজনৈতিক ভাবাদর্শের কারণে তাঁর সঙ্গে লুই আরাগঁর ঝগড়া বেধে গিয়েছিল । মার্সেল দ্যুশঁ,  ত্রিস্তঁ জারা এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ, উভয়ের সঙ্গেই ছিলেন, এবং দুটি দলই তাঁকে গুরুত্ব দিতেন, দ্যুশঁ’র অবাস্তব ও অচিন্ত্যনীয় ভাবনার দরুন। এই দলবাজিকে কিন্তু মৃত্যুঘণ্টা নামে কেউ খিল্লি করেননি ।
    পরাবাস্তব আন্দোলনের আগে জুরিখে ডাডাবাদী আন্দোলন আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল এবং আঁদ্রে ব্রেতঁ পরাবাস্তববাদের অনুপ্রেরণা পান ডাডা আন্দোলনের পুরোধা ত্রিস্তঁ জারার কাছ থেকে, কিন্তু ব্রেতঁ চিরকাল তা অস্বীকার করে্ছেন । ডাডা ছিল শিল্পবিরোধী আভাঁ গার্দ আন্দোলন ; অবশ্য প্রতিশিল্পও তো নির্মাণ । ডাডাবাদের রমরমার কারণে ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ব্রেতঁর সম্পর্ক দূষিত হয়ে যায় ; একজন অন্যজনের নেতৃত্ব স্বীকার করতে চাইতেন না । ডাডা (/ˈdɑːdɑː/) বা ডাডাবাদ (দাদাবাদ নামেও পরিচিত) ছিল ২০ শতকের ইউরোপীয় ভিন্নচিন্তকদের একটি সাহিত্য-শিল্প আন্দোলন, যার প্রাথমিক কেন্দ্র ছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ক্যাবারে ভলতেয়ার ( ১৯১৬ নাগাদ ) এবং নিউ ইয়র্কে (প্রায় ১৯১৫ নাগাদ)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় ডাডা আন্দোলন গড়ে ওঠে সেইসব শিল্পীদের নিয়ে, যাঁরা পুঁজিবাদী সমাজের যুক্তি, কারণ বা সৌন্দর্যের ধারণা মানতেন না, বরং তাঁদের কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন আপাত-অর্থহীন, উদ্ভট, অযৌক্তিক এবং বুর্জোয়া-বিরোধী প্রতিবাদী বক্তব্য । আন্দোলনটির কাজ প্রসারিত হয়েছিল দৃশ্যমান, সাহিত্য ও শব্দ মাধ্যমে, যেমন   কোলাজ, শব্দসঙ্গীত, কাট-আপ লেখা, এবং ভাস্কর্যতে। ডাডাবাদীরা হানাহানি, যুদ্ধ এবং জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতেন এবং গোঁড়া বামপন্থীদের সাথে তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগ ছিল। ব্রেতঁ মনে করতেন ডাডাবাদীরা নৈরাজ্যবাদী বা অ্যানার্কিস্ট, যখন কিনা তিনি একজন কমিউনিস্ট । 
    পরাবাস্তববাদ আন্দোলনে যাঁরা ব্রেতঁর সঙ্গে একে-একে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম হলেন ফিলিপে সুপো, লুই আরাগঁ, পল এলুয়ার, রেনে ক্রেভাল, মিশেল লেইরিস, বেনিয়ামিন পেরে, অন্তনাঁ আতো,জাক রিগো, রবের দেসনস, ম্যাক্স আর্নস্ত প্রমুখ । এঁদের অনেকে ডাডাবাদী আন্দোলন ত্যাগ করে পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে যোগ দেন। তখনকার আলোচকরা বলেননি যে ডাডাবাদের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গেল । পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে ১৯২৩ সালে যোগ দেন চিত্রকর আঁদ্রে মাসোঁ ও ইভস তাঙ্গুই । ১৯২১ সালে ভিয়েনায় গিয়ে ফ্রয়েডের সঙ্গে দেখা করেন ব্রেতঁ । ফ্রয়েডের ধারণাকে তিনি সাহিত্য ও ছবি আঁকায় নিয়ে আসতে চান । ফ্রয়েডের প্রভাবে ব্রেতঁ বললেন, সুররিয়ালিজমের মূলকথা হল অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। ডাডাবাদীরা  চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে। পরাবাস্তববাদীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে ব্যক্তি-অস্তিত্বের গভীর থেকে তুলে আনা। 
    পরাবাস্তববাদের প্রথম ইশতেহার প্রকাশ করেন ইয়ান গল। এ ইশতাহারটি ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর প্রকাশিত হয়। নেতৃত্ব হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে অনুমান করে, এর কিছুদিন পরেই ১৫ অক্টোবর আঁদ্রে ব্রেতঁ  দ্বিতীয় ইশতাহারটি প্রকাশ করেন এবং ১৯৩০ সালে এ ধারার তৃতীয় ইশতাহারটিও প্রকাশ করেন। ইয়ান গল ও আঁদ্রে ব্রেতঁ—দুজনে দু দল পরাবাস্তববাদীর  নেতৃত্ব দিতেন। ইয়ান গলের দলে ছিলেন ফ্রান্সিস পিকাবিয়া, ত্রিস্তঁ জারা, মার্সেল আর্লেন্ড, জোসেফ ডেলটিল, পিয়েরে অ্যালবার্ট বিরোট প্রমুখ। আন্দ্রে ব্রেতঁর দলে ছিলেন লুই আরাগঁ, পল এলুয়ায়, রোবের ডেসনোস, জ্যাক বারোঁ, জর্জ ম্যালকিন প্রমুখ। এ দুটি দলেই ডাডা আন্দোলনের কয়েকজন সদস্য ছিলেন।  ইয়ান গল আর আঁদ্রে ব্রেতঁ  আন্দোলনের নেতৃত্ব নিয়ে প্রকাশ্য তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন। তখন থেকেই পরাবাস্তববাদীরা ছোটো-ছোটো গোষ্ঠীতে বিভাজিত হতে থাকেন, যদিও তাঁদের ভাবনাচিন্তা ও সাহিত্যধারা ছিল একই । তা সত্বেও আলোচকরা আন্দোলনের মৃত্যুঘণ্টা বাজার কথা বলেননি । পরে আন্দোলনে যোগ দেন জোয়ান মিরো, রেমণ্ড কোয়েনু, ম্যাক্স মোরিজ, পিয়ের নাভিল, জাক আঁদ্রে বোইফার, গেয়র্গে মালকাইন প্রমুখ । 
    পরাবাস্তববাদকে ‘নির্দিষ্ট’ ছকে ফেলা কঠিন। হাংরি আন্দোলনকেও নির্দিষ্ট ছকে ফেলা যায় না । হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রতিস্ব তো একক, নিটোল, একশিলা, একমুখি নয় । পরাবাস্তববাদীরা একই আন্দোলনের সদস্য হয়ে ছবি আঁকলেও এবং কবিতা লিখলেও, তাঁদের দৃষ্টি ও উপলব্ধির মধ্যে ব্যক্তিগত পার্থক্য ছিল ।  মতবাদটি সম্পর্কে প্রত্যেকে নিজস্ব ভাবনা ভেবেছেন, যে কথা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোয্য । ১৯২৯ সালে সালভাদর দালি এই আন্দোলনে যোগ দেন, যদিও তাঁর সঙ্গেও ব্রেতঁর বনিবনা হতো না । সালভাদর দালি মনে করতেন, ‘সুররিয়ালিজম একটি ধ্বংসাত্মক দর্শন এবং এটি কেবল তা-ই ধ্বংস করে যা দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ রাখে।’ অন্যদিকে জন লেলন বলেছেন, ‘সুররিয়ালিজম আমার কাছে বিশেষ প্রভাব নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল। কেননা, আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার কল্পনা উন্মাদনা নয়। বরং সুররিয়ালিজমই আমার বাস্তবতা।’
    তাঁদের রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং অন্যান্য কারণে প্রেভের, বারোঁ, দেসনস, লেইরিস, লিমবোর, মাসোঁ, কোয়েন্যু, মোরিস, বোইফার সম্পর্কচ্ছদ করেন ব্রেতঁর সঙ্গে,  এবং গেয়র্গে বাতাইয়ের নেতৃত্বে পৃথক গোষ্ঠী তৈরি করেন । তবুও তাকে আন্দোলনের মৃত্যুঘণ্টা বলে খিল্লি করা হয়নি । এই সময়েই, ১৯২৯ নাগাদ, ব্রেতঁর গোষ্ঠীতে যোগ দেন সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, আলবের্তো জিয়াকোমেত্তি, রেনে শার এবং লি মিলার । ত্রিস্তঁ জারার সঙ্গে ঝগড়া মিটমাট করে নেন ব্রেতঁ । দ্বিতীয় সুররিয়ালিস্ট ইশতাহার প্রকাশের সময়ে তাতে সই করেছিলেন আরাগঁ, আর্নস্ট, বুনুয়েল, শার, ক্রেভাল, দালি, এলুয়ার, পেরে, টাঙ্গুই, জারা, ম্যাক্সিম আলেকজান্দ্রে, জো বনসকোয়েত, কামিলে গোয়েমানস, পল নুগ, ফ্রান্সিস পোঙ্গে, মার্কো রিসটিচ, জর্জ শাদুল, আঁদ্রে তিরিয়ঁ এবং আলবেয়ার ভালেনতিন । ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকার বন্ধু ছিলেন সালভাদর দালি এবং লুই বুনুয়েল, আলোচনায় অংশ নিতেন, কিন্তু পরাবাস্তব গোষ্ঠিতে যোগ দেননি । ১৯২৯ সালে লোরকার মনে হয়েছিল যে দালি আর বুনুয়েলের ফিল্ম “একটি আন্দালুসিয় কুকুর” তাঁকে আক্রমণ করেছে ; সেই থেকে আরাগঁ ও জর্জ শাদুল ব্রেতঁ’র গোষ্ঠী ত্যাগ করেছিলেন , যদিও ব্রেতঁ বলতেন যে তিনিই ওনাদের তাড়িয়েছেন ।
    ১৯৩০ সালে কয়েকজন পরাবাস্তববাদী আঁদ্রে ব্রেতঁ’র একচেটিয়া নেতৃত্বে বিরক্ত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি প্যামফ্লেট ছাপিয়েছিলেন । পরাবাস্তববাদ আন্দোলন আবার আরেক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে যায় । ১৯৩৫ সালে ব্রেতঁ এবং সোভিয়েত লেখক ও সাংবাদিক ইলিয়া এরেনবার্গের মাঝে ঝগড়া এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছোয় যে প্যারিসের রাস্তায় তাঁদের দুজনের মারামারি আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । এরেনবার্গ একটি পুস্তিকা ছাপিয়ে বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীরা পায়ুকামী । সালভাদর দালি বলেছিলেন যে পরাবাস্তববাদীদের মধ্যে প্রকৃত সাম্যবাদী হলেন একমাত্র রেনে ক্রেভাল । চটে গিয়ে ক্রেভালকে পরাবাস্তববাদী আন্দোলন থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ । অঁতনা অতো, ভিত্রাক এবং সুপোকে পরাবাস্তববাদী দল থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ, মূলত সাম্যবাদের প্রতি ব্রেতঁর আত্মসমর্পণের কারণে এই তিনজন বিরক্ত বোধ করতেন । স্তালিনপন্হী আরাগঁ ও ট্রটস্কিপন্হী ব্রেতঁর কখনও মিটমাট হয়নি । কাট-আপ কবিতার জনক ব্রায়ন জিসিনকেও গোষ্ঠী থেকে বের করে দ্যান ব্রেতঁ ; ব্রায়ান জিসিনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ । বিট আন্দোলনের প্রায় সকলেই পরাবাস্তববাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । বিটদের যৌন স্বাধীনতার ভাবনা-চিন্তায় সুররিয়ালিস্টদের অবদান আছে । হাংরি আন্দোলনকারীরা কেউই কিন্তু কাউকে বের করে দিতেন না, কেননা অমন ক্ষমতা কারোরই ছিল না ।
    দশ
     পরাবাস্তববাদী আন্দোলনে বহু মহিলা সদস্য ছিলেন । কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে উল্লেখ্য ফ্রিদা কাহলো, আসে বার্গ, লিজে দেহামে, আইরিন হামোয়ের, জয়েস মানসোর, ওলগা ওরোজকো, আলেহান্দ্রা পিৎসারনিক, ভ্যালেনটিন পেনরোজ, জিসেল প্রাসিনস, ব্লাঙ্কা ভারেলা, ইউনিকা জুর্ন প্রমুখ । নারী চিত্রকররা সংখ্যায় ছিলেন বেশি । তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য গেরট্রুড আবেরকমবি, মারিয়ন আদনামস, আইলিন ফরেসটার আগার, রাশেল বায়েস, ফ্যানি ব্রেনান, এমি ব্রিজওয়াটার, লেনোরা ক্যারিংটন, ইথেল কলকুহুন, লেনোর ফিনি, জেন গ্রাভেরোল, ভ্যালেনটিন য়োগো, ফ্রিদা খাহলো, রিটা কার্ন-লারসেন, গ্রেটা নুটসন ( ত্রিস্তঁ জারার স্ত্রী ), জাকেলিন লামবা ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র স্ত্রী), মারুহা মালো, মার্গারেট মডলিন, গ্রেস পেইলথর্প, অ্যালিস রাহোন, এডিথ রিমিঙটন, পেনিলোপি রোজমন্ট, কে সেজ ( ইভস তাঙ্গুইর স্ত্রী ), ইভা স্বাঙ্কমাজেরোভা, ডরোথি ট্যানিঙ ( ম্যাক্স আর্নস্টের স্ত্রী ), রেমেদিওস ভারো ( বেনিয়ামিন পেরের স্ত্রী ) প্রমুখ । ভাস্করদের মধ্যে উল্লেখ্য এলিজা ব্রেতঁ ( আঁদ্রে ব্রেতঁ’র তৃতীয় স্ত্রী ), মেরে ওপেনহাইম ( মান রে’র মডেল ছিলেন ) এবং মিমি পারেন্ট । ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ক্লদ কাহুন, নুশ এলুয়ার, হেনরিয়েতা গ্রিনদাত, আইডা কার, দোরা মার ( পাবলো পিকাসোর সঙ্গে নয় বছর লিভ টুগেদার করেছিলেন ), এমিলা মেদকোভা, লি মিলার, কাতি হোরনা প্রমুখ । পুরুষ পরাবাস্তববাদীদের বহু ফোটো এই নারী ফোটোগ্রাফারদের কারণেই ইতিহাসে জায়গা পেয়েছে ।
    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হতে ১৯৩৯ সালে অধিকাংশ পরাবাস্তববাদী বিদেশে পালিয়ে যান এবং তাঁদের মধ্যে আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বক্তব্য নিয়ে তর্কাতর্কি বেধে যায় । অলোচকরা মনে করেন যে গোষ্ঠী হিসাবে ১৯৪৭ সালে পরাবাস্তববাদের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু ভাবনা হিসেবে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে , প্যারিসে “লে সুররিয়ালিজমে” প্রদর্শনীর পর । যুদ্ধের শেষে, প্যারিসে ব্রেতঁ ও মার্সেল দ্যুশঁ’র ফিরে আসার পর প্রদর্শনীর কর্তারা সম্বর্ধনা দিতে চাইছিলেন কিন্তু পুরোনো পরাবাস্তববাদীরা জানতে পারলেন যে একদল যুবক পরাবাস্তববাদীর আবির্ভাব হয়েছে, যাঁরা বেশ ভিন্ন পথ ধরে এগোতে চাইছেন । যুবকদের মধ্যে উল্লেখ্য ছিলেন ফ্রাঁসিস বেকঁ, আলান দাভি, এদুয়ার্দো পোলোৎসি, রিচার্ড হ্যামিলটন প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে মৃত্যুর আগে, ব্রেতঁ লিখেছিলেন, “ডাডা আন্দোলনের পর আমরা মৌলিক কিছু করিনি” । এই দুটি আন্দোলন অংশগ্রহণকারীদের  ওপর এমন চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং কয়েকজন আত্মহত্যা করেছিলেন, যেমন জাক রিগো, রেনে ক্রেভেল, আরশাইল গোর্কি, অসকার দোমিংগেজ প্রমুখ । অত্যধিক মাদক সেবনে মৃত্যু হয় গিলবার্ত লেকঁতে ও অঁতনা আতোর ।
    ‘আয়নানগর’ পত্রিকার অক্টোবর ২০১৬ সংখ্যায় নন্দিনী ধর লিখেছেন: “বহু ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি পেয়েছি একটি নারী নাম— আলো মিত্র। হাংরি দলিল-দস্তাবেজে তিনি ত্রিদিব মিত্রের স্ত্রী বলে চিহ্নিত। এই বিপুল পিতৃতান্ত্রিক নির্ভরতার সূচক ছাড়া, তাঁর অন্য‌ কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না। পাওয়া যায় না অন্য‌ কোনো লেখা। কোনো পাঠক যদি অন্য‌ কোনো ইতিহাসের হদিশ দিতে পারেন আমায়, দিতে পারেন অন্য‌ কোনো তথ্য‌, বাধিত হব। বদলে নেব নিজের ভাবনাচিন্তার গতিপথও। পরবর্তী সময়ে সুনীতা ঘোষ নামে এক কবির কবিতা পাওয়া যায় দু-একটি সংকলনে।” ষাটের দশকে দুজন মহিলা যে হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার দাপট দেখিয়েছিলেন, সেটাই তো যথেষ্ট, নয় কি ? এখন ওনারা নন্দিনী ধরের ঠাকুমা-দিদিমার চেয়েও বয়সে বড়ো । খিল্লি করার আগে নন্দিনী ধর তাঁর ঠাকুমা-দিদিমার বয়সী কবিদের জিগ্যেস করলেই পারতেন যে হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার মতন সৎসাহস কারোর ছিল কিনা ! আলো মিত্র ছিলেন আন্দোলনের দুটি পত্রিকার সম্পাদক :’উন্মার্গ’ ও The Waste Paper ; আর দুটি চিঠি সংকলনের সম্পাদক । নন্দিনী ধর যে কী ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন তা তিনিই জানেন । একবার সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে গেলেই পারতেন কিংবা ইতালিয় হাংরি-গবেষক দানিয়েলা লিমোনেলার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতেন।
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪৬512516
  • আমাদের প্রভাত :মলয় রায়চৌধুরী
    আমি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেশি মাইনের চাকরি ছেড়ে নতুন একটা চাকরি নিয়েছিলুম, শুধু ভারতবর্ষের গ্রামগুলোর মানুষের জীবনযাত্রা দেখার আর তাদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের লোভে । সেসময়ে আমি লেখালিখি বন্ধ করে নানা বিষয়ে বই পড়ায় মন দিই ।  পাটনায় তো থাকতুম ইমলিতলা নামে একটা বস্তিতে । পরে বাবা দরিয়াপুরে বাড়ি করলে সেখানে উঠে যাই । চাকরির জন্য ভারতের মানুষের, খেতখামারের, জীবজগতের, জলসেচের, চাষবাসের বৈচিত্র সম্পর্কে বই পড়া জরুরি হয়ে গিয়েছিল। 
    ওই বৈচিত্র্যের সূত্রেই অনুন্নত দেশগুলো সম্পর্কে পড়া আরম্ভ করি আর জানতে পারি আধুনিকতাবাদ থেকে ভাবুকেরা কতোটা সরে গেছেন এবং অন্য এক ভাবকল্প খুঁজছেন নতুন অবস্হাটাকে সংজ্ঞায়ন করার জন্য । তখনই ফেদেরিকো দ্য ওনিস কথিত ‘পোস্টমডার্ন’ ভাবকল্পের সন্ধান পাই যা ইউরোপ-আমেরিকার পোস্টমডার্ন ভাবনা থেকে একেবারে আলাদা । দাদার অনুরোধে প্রবাল দাশগুপ্ত একটা প্রবন্ধে ব্যাপারটা খোলোশা করে আধুনিকতার পরের অবস্হানকে বলেন ‘অধুনান্তিক’ ।
    দাদা কলকাতায় ফিরে ‘হাওয়া৪৯’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশের তোড়জোড় আরম্ভ করে বলেন যে ‘তুই কলকাতায় চলে আয়’ । বহুকাল কলকাতার বাইরে ছিলুম বলে কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে নতুন করে পরিচয়ের প্রয়োজন অনুভব করলুম । কলকাতায় এসে বেশ কিছুদিন দাদার বাড়িতে ছিলুম, কেননা আমার নাকতলার ফ্ল্যাট চুনকাম করে রেডি করতে সময় লাগছিল ; মুম্বাই থেকে আসবাবপত্রও পৌঁছোয়নি । 
    দাদার বাড়িতে অনেকে আসতেন, যাঁদের সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না । জহর সেনমজুমদার, কলিম খান, মুর্শিদ, নাসের হোসেন, শান্তি লাহিড়ী, রুদ্র কিংশুক,  প্রভাত চৌধুরী প্রমুখ । প্রভাত আর পবিত্রদের ধ্বংসকালীন আন্দোলন তখন ষাটের অন্যান্য আন্দোলনের মতন ফুরিয়ে গেছে । অধুনান্তিকতা নিয়ে আলোচনা হতো এবং ‘হাওয়া৪৯’-এর প্রতিটি সংখ্যায় বিষয়টির কোনো না কোনো দিক নিয়ে লিখতে বলা হতো আগ্রহীদের ।
    দাদার বাড়ি থেকে আলোচনাচক্র প্রভাত চৌধুরীর বাড়িতে আরম্ভ হলে ছুটিছাটায় যেতুম সন্ধ্যাবেলা । প্রভাত চৌধুরী ‘কবিতা পাক্ষিক’ নামে কবিতার একটা পত্রিকা আরম্ভ করেছিল । কানাইলাল জানার আলিপুর জেলের কোয়ার্টারের ছাদে কবিতা পাঠের আয়োজন করত আর সেখানে গোষ্ঠী-নির্বিশেষে প্রায় সবাই আসতো । দেখলুম যে প্রভাত চৌধুরীর সম্পাদকীয় আগ্রহ তার আগের কবিতা পত্রিকা, যেমন বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’, সুশীল রায়ের ‘ধ্রুপদি’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কৃত্তিবাস’ থেকে একেবারে আলাদা । আগের সম্পাদকরা ছিলেন ছাঁটাই করার সম্পাদক, কাদের কবিতা ছাপা হবে না, তার নির্ণায়ক । প্রভাত চৌধুরী সবাইকে ‘কবিতা পাক্ষিক’-এর আশ্রয়ে আনার অবিরাম প্রয়াস করে গেছে, তা একজন যেমনই লিখুক, প্রভাত চৌধুরী গাইড করেছে, কিন্তু  প্রভাত নিজের ফর্মে তাদের লিখতে বলেনি। অর্থাৎ অধুনান্তিক কবিতার এলাকাকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্ণিত করেছে । 
    আমার কবিতার বই, গিন্সবার্গ আর ককতোর অনুবাদ, প্রবন্ধের বই নিজের আগ্রহে প্রকাশ করেছে প্রভাত ; দরকার হলে নতুন মুদ্রণ করেছে। আমার যখন হার্ট অ্যাটাক হলো, তখন চিকিৎসার জন্য প্রভাত গিয়ে ডেকে এনেছে ভূমেন্দ্র গুহকে । 
    বয়স হয়ে গেলেও প্রভাত কাঁধে ঝোলা নিয়ে পৌঁছে গেছে পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন কবিদের জমায়েতে, কবিতা পাঠে, এমনকী কবিদের বাড়িতে । আমি অবাক হয়ে যেতুম, কেননা আমার শরীরে কুলোতো না বলে আমি কোথাও যেতে পারতুম না । প্রভাত আমাকে সম্বর্ধনা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি নিজেকে এসবের অযোগ্য মনে করি বলে অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছিলুম ।
    প্রভাত চৌধুরী ছিল ছত্রপতি । নিজের ছাতার তলায় যেকোনো আগ্রহীকে স্হান দিতো । প্রতিষ্ঠানকে পরোয়া করেনি । প্রভাতের জায়গা নেবার মতন কেউ আর রইলো না । 

     
  • মলয় রায়চৌধুরী | 182.68.89.207 | ০৩ অক্টোবর ২০২২ ১৯:৪৮512517
  • অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর গদ্য বুঝে ওঠার চেষ্টা
    মলয় রায়চৌধুরী
              পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন অর্ঘ্য, দাঁড়ান গুনে বলছি কতোগুলো গদ্য আছে বইটায়, হ্যাঁ, সাতটা, তবে মাসখানেকের বেশি নানা সময়ে পড়েছি বলে জানি না, একআধটা হারিয়ে ফেললুম কি না । 
              পাণ্ডুলিপি হাতে পেয়ে প্রথম যে ভাবনাটা মাথায় এলো, তাহলো এই যে কতো বছর বয়সে লেখকীয় ইপিফ্যানিতে আক্রান্ত হয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বক্সী ?
              কোনো কিছু পড়ায় আমার বদভ্যাস হল যে অবান্তর চিন্তায় হারিয়ে যাই, ফলে আবার ফিরে আসতে হয় যেখান থেকে শুরু করেছিলুম সেখানে ; এই করে অর্ঘ্যর গদ্যগুলো পড়ে উঠতে বেশ সময় লেগে গেল । সাতাত্তর বছর বয়সে ডাইগ্রেশন স্বাভাবিক, নয়কি ?
             এই বয়সে সাহিত্য আলোচনা করতে আমি বড়োই অনাগ্রহী ।
              লরেন্স স্টার্ন অবশ্য বলে গেছেন যে ‘পড়তে বসে হারিয়ে যাওয়া হলো সূর্যের আলো, জীবন, বই পড়ার আত্মা’। সকালে ডাইনিং টেবিলে বসে যে গদ্যটা পড়ছিলুম, দুপুরে অন্য একটা গদ্যে আটকে যাই ; পরের দিন আবার আরেকটা অন্য গদ্য।
              পাণ্ডুলিপি পড়ে বইয়ের সামনে দিকে দুচারপাতা লিখতে বলেছেন অর্ঘ্য আর ওনার বন্ধু মৃগাঙ্কশেখর । 
              প্রস্তাবটা পেয়ে ভাবছিলুম যে আমার মতন একজন কমব্যাট্যান্টকে কেন ! আমাকে যা ক্রুদ্ধ করে, প্যাশনেট করে তোলে, অসংযত করে তোলে, বিরক্ত করে, মানুষের যা অপছন্দ করি, তা কি অর্ঘ্য দত্ত বক্সীর ক্ষেত্রেও একই ? তিনিও কি আমার মতন সমাজের হাতে বিধ্বস্তদের পক্ষে ভাবতে বসে ডিসটার্বড ? মানে খুঁজে বেড়ান যা কিছু অতর্কিত, তাইতে ? পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতন অর্থহীন শব্দবন্ধের বদলে ইনোভেটিভ শব্দটা ব্যবহার করতে চান ?
              প্রথম পাঠে মনে হলো, অর্ঘ্য সম্ভবত স্বীকার করেন যে লেখকীয় কাজ যদি সত্য হতে হয়, তাহলে তাকে মানব-মনের গভীর, অন্ধকার, অসুস্হ, হেজে-যাওয়া, বিরক্তিকর  কোনগুলোতে জোর-জবরদস্তি ঢুকে পড়তে হবে, কেবল ইনোভেশান দিয়ে সামলানো যাবে না। তারপর তো পাঠকের দায়িত্ব সেই কাজে  অজস্র রাস্তা খুঁজে পাওয়া ।
              কিন্তু আমি অনেক বইকে কেবল ফিকশান বলে মনে করি, যেমন সিগমুণ্ড ফ্রয়েডের বই, এতো ভালো উপন্যাস কম লেখকই লিখেছেন । আমি রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ ইত্যাদি সবই ফিকশান বলে মনে করি, ইতিহাস বলে মনে করি না ; যেমন মঙ্গলকাব্যের কাহিনিগুলো । তাই কোন চরিত্র কেন অমন আচরণ করলো, তার দায়-দায়িত্ব পাঠকের বলে মনে করি, লেখকের নয় । 
              পুতুল নাচের ইতিকথায় শশির এরেকটাইল ডিসফাংশান ছিল কিনা তা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে যাননি, তার কারণ ওটা একটা ফিকশান । যে যেমন চায় ব্যাখ্যা করবে ।
              একটি সাহিত্যকর্মকে তার নিজের গুণে দাঁড়াতে হয়, যেমন রামায়ণ মহাভারত দাঁড়িয়ে আছে , কৃতিত্বটা বাল্মীকির ও ব্যাসদেব নামের লেখকদের । বাবরি মসজিদ ভাঙার আগে আমি ভেতরে ঢুকে দেখে এসেছি, অযোধ্যায় বহুবার গেছি চাকুরিসূত্রে । আমার কখনও বিশ্বাস হয়নি যে রামায়ণ কাহিনির রামের ওটা জন্মস্হান আর জন্মশহর । কুরুক্ষেত্র আর হস্তিনাপুর গেছি । সবই গল্প । বরং কোমরে হাত রেখে দাঁড়িয়ে-থাকা মহেঞ্জোদারোর কিশোরীটি আসল, এখনও কিশোরীরা অমন ভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে ।
              রামায়ণ মহাভারত সম্পর্কে অর্ঘ্যর আগ্রহ এবং মহাকাব্যগুলির চরিত্রদের নিয়ে তিনি খেলেছেন নিজের মতন করে, সেঁদিয়ে গেছেন ভেতরে ভেতরে । 
               আমি ভাবি যে রামায়ণ-এর গল্পটা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল, আশেপাশে কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়ল, আর ছড়িয়ে পড়ার সময়ে মূল রামায়ণ থেকে সরে গিয়ে যে-যার নিজের মতো করে গল্পটা তৈরি করে ফেলল, চরিত্রদের ওলোট-পালোট করে ফেলল । এই একই ব্যাপার মহাভারতের ক্ষেত্রে ঘটেনি কেন ? ব্যাসদেবরা মহাভারতে যেমন যে-যার নিজেদের লেখা ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন, তা কেন সম্ভব হয়নি রামায়ণের বেলায় ? শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধাকেই বা কারা জুড়ে দিয়েছিল, মহাভারতে তো নেই ! 
              বাঙালিদের বাড়িতেও দেখি গোপাল, নাড়ুগোপাল, দোলগোবিন্দ, রাধাগোবিন্দ, রাধাকেষ্ট ইত্যাদি । তা বাঙালিরা রাধাকে কবে আর কোথা থেকে পেলো ? বঙ্গদেশে আমদানি-করা উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণরা এনেছিল কি নিজেদের পুঁটলিতে বেঁধে ? ব্রাহ্মণরা বঙ্গদেশে আসার আগে এখানকার দেবী-দেবতা এবং মিথগুলো কেন হারিয়ে গেল ! বৌদ্ধধর্মের দেবী-দেবতারাই বা চিরকালের জন্য কেন লোপাট হয়ে গেল !
              ন্যারেটিভে সোমরস প্রসঙ্গ এলে বেশ হতো, কেননা ওটা যে ঠিক কী জিনিস আমি আজও জেনে উঠতে পারিনি ।
              সরি, আবার ডাইগ্রেশন ঘটিয়ে ফেলছি ।
              সে যাক, পুতুল নাচের ইতিকথা নিজের গুণে দাঁড়িয়ে আছে ।
              একজন লেখক স্রেফ তার সৃজনকর্মের গাদ । রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ লেখকদের মতন তাঁদের আড়ালে চলে যাওয়া উচিত ।
              এর আগে কয়েকটা বইয়ের মুখবন্ধ বা ইনট্রো, ইংরেজি ও বাংলা বইয়ের, যা-ই বলুন, লিখেছি বটে, কিন্তু ন্যারেটিভ নিয়ে এরকম নিজের সঙ্গে নিজে বার্তা-বিনিময়ের একাধিক কন্ঠস্বরের নিরীক্ষা, মেইনস্ট্রিমের বাইরে বেরিয়ে, ফাঁকা জায়গায় শ্বাস নেবার ইনোভেশানের লেখা নিয়ে লিখিনি । 
              বলা যেতে পারে, অর্ঘ্য আমাকে বিপাকে ফেলে দিয়েছেন । 
              পড়তে গিয়ে আমি কোন গদ্যের পর কোন গদ্য, তাও বিছানায় শুয়ে, আরামচেয়ারে হেলান দিয়ে সামনের টেবিলে ঠ্যাঙ তুলে,  আর ডাইনিং টেবিলে বসে পড়ার সময়ে গোলমাল করে ফেলেছি । অবশ্য জানি, অর্ঘ্যর তাতে খুব-একটা কিছু আসে যায় না । ছাপাতে দেবার আগে সাজিয়ে নেবেন ।
              অর্ঘ্য তাঁর প্রোটোফিকশানগুলোকে বলেছেন প্রগল্প । মনে হয় প্রথানুগত গল্প বলার কায়দাকে তিনি কনটেম্পচুয়াস মনে করেন । স্বাভাবিক । বালজাক বলেছিলেন যে, ফিকশান লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো পরিবর্তনরত মূল্যবোধের ভয়াবহ প্রকোপ ফাঁস করে দেয়া । বালজাকের সময় থেকেই নয়, মানব সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ নিষ্ঠুরতা আবিষ্কার করেছে, সভ্যতার প্রসারে তা কাজে লাগিয়েছে । তা সত্ত্বেও ভাবুক ও সাহিত্যিকরা আশা করেন যে মানুষ মানবতাবাদী হবে, সাম্যবাদী হবে, কল্যাণকামী হবে, যুক্তিতে বিশ্বাস করবে, ইত্যাদি । এদিকে দেখতে দেখতে রাজনীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থব্যবস্হার রক্ষিতা বা জিগোলো ।
              অর্ঘ্য ইচ্ছানুযায়ী ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেছেন, চিন্তার স্রোত বজায় রাখার কারণে, আমিও লিখতে বসে মগজে ইংরেজি শব্দ এসে গেলে তা-ই করবো ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যে বিদেশি লেখদের কথা মনে এলো, তাঁরা উলিয়াম বারোজ, ইশমায়েল রিড, টেরি সাদার্ন, কার্ট ভনেগাট, রিচার্ড ব্রটিগান, টমাস পিনচন নয়, কেননা এঁরা একরৈখিকতা থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে যেতে পারেননি, এঁরা নির্ভর করেছেন প্রচলিত ন্যারেটিভের ডিভাইসের ওপর ; ফিকশান ও গদ্যের প্রথাকে ভেঙে ছাপিয়ে যাবার প্রয়াসের বদলে ফিকশানের ফিকশানালিটিকে মান্যতা দিয়েছেন ।
              অর্ঘ্যকে পড়ার সময়ে যাঁদের কথা মাথায় এলো তাঁদের মধ্যে উল্লেখ্য মেরি গেইটস্কিল, কেথি অ্যাকার, গ্যারি ইনডিয়ানা, কারেন ফিনলে, ডেনিস কুপার, ডেভিড ওজনারোইজ প্রমুখ । 
              হয়তো অর্ঘ্যের অবচেতনায় জাঁ জেনে, লুই ফার্দিনান্দ সেলিনে, জর্জ বাতাই, মরিস ব্লাশোঁ প্রমুখের রচনা পাঠের রেশ থেকে গেছে । এঁদের গদ্য ভিশনারি ও কাব্যিক মোডের । অর্ঘ্য নিজেই স্বীকার করেছেন ঋত্বিক ঘটক থেকে পাওয়া তাঁর প্রোটোফিকশানের উপাদান প্রাপ্তির ।
               হাংরি আন্দোলনের গদ্যকার সুভাষ ঘোষ ও সুবিমল বসাকের কথাও উল্লেখ করতে চাইবো, তুলনা নয়। তবে প্রথানুগত ন্যারেটিভ টেকনিকের কারণে বাসুদেব দাশগুপ্তের গদ্যের তুলনা করবো না । একই কারণে উল্লেখ করতে চাই না সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ফিকশান এবং শাস্ত্রবিরোধী গল্পকারদের । শাস্ত্রবিরোধী গল্পকাররা মুক্ত সূচনা দিয়ে আরম্ভ করলেও তাঁরা একরেখিকতা ও বদ্ধ সমাপ্তির বাঁধন থেকে বেরোতে পারেননি, তাঁদের চরিত্ররা কেলাসিত রয়ে গেছে ।
                উল্লেখ করতে চাইবো রবীন্দ্র গুহ, অজিত রায়, শাশ্বত সিকদার, সুব্রত সেন, অনুপম মুখোপাধ্যায়, সৌগত বালী প্রমুখের ইনোভেটিভ  গদ্য । 
                সুবিমল মিশ্রকেও উল্লেখ করতে চাইবো, তাঁর টাইপোগ্রাফিকাল ইমেজখেলা ও অক্ষরকোলাজ বাদ দিয়ে। সুবিমল মিশ্রের একজন  শিষ্য, স্বপনরঞ্জন হালদারের একটা বই আমি আলোচনা করেছিলুম, কিন্তু সেই সময়ের কমিউনিস্টদের রোগ থেকে বেরোতে পারেননি উনি, মুখ ফুটে বলতে পারেননি রক্তচোষার দিগ্বিজয়, উল্টে সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁদের গুরুঘণ্টাল পিঁজরাপোল ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন বলে তাঁর অপমানজনক সমালোচনা করেছিলেন । 
                 ইনোভেটিভ গদ্যের এই এক বিপদ, কে যে কোথা থেকে ঢুকে পড়বে আর জিনিয়াসগিরির দাবি করবে স্পষ্ট করা কঠিন হয়ে পড়ে ।
                যাঁদের নাম উল্লেখ করলুম, তাঁরা সকলেই, অর্ঘ্যের মতন, জানতেন যে সাহিত্যের রিসেপশানের মণ্ডপে ঢোকার মুখে তাঁদের পড়তে হবে বাউন্সারদের পাল্লায় । কারণ এনারা ফিকশানের সংজ্ঞা ও মূল্যবোধের মালিকানা নিজেদের হাতে তুলে নিতে চেয়েছেন ।
                আগের প্রজন্মের ওই লেখকদের লেখনজগতকে সরিয়ে এগোবার রাস্তা বের করতে হয়েছে অর্ঘ্যকে । শব্দ মুচড়ে গড়া ভাষা এবং আইডিয়া ও চিন্তা দিয়ে গড়া ভাষার যে গভীর পার্থক্য আছে তা নিজের গদ্যের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অর্ঘ্য ।
                এক বাসুদেব দাশগুপ্তকে ছাড়া, মেইনস্ট্রিম বাংলা সাহিত্য অন্যান্যদের নিয়ে চিন্তা করেনি, তার কারণ অবিরাম বদলাতে থাকা সংস্কৃতির, ভাষাসংস্কৃতির প্রতি, আলোচকরা খেয়াল নিয়োজিত করেননি। 
                অর্ঘ্যর হাতে পড়ে প্রতিটি অবজেক্ট মর্মার্থে ভরপুর হয়ে উঠেছে, কিন্তু অবজেক্টের মর্মার্থ প্রতিটি পাঠকের কাছে একই বার্তা পৌঁছে দেবে, তা আশা করা যায় না, কেননা অর্ঘ্যের মতামত তাতে কুঁদেকুঁদে ব্যক্তিগত গোপনতাসহ রাখা আছে, সবায়ের অভিজ্ঞতার বনেদ তো একই নয় ।
                অর্ঘ্যর গদ্যগুলোকে কোনো বিশেষ জনারে চিহ্ণিত করা যাচ্ছে না বলে আমি বলেছি প্রোটো-ফিকশান ; গদ্যগুলো পড়ে মনে হয়েছে অর্ঘ্য একজন Neo-gnostic, গোপন জ্ঞানের ভাঁড়াররক্ষক।
                শিরদাঁড়ার শীতল সিরসিরানিকে নিজের গদ্যে চারিয়ে দিতে চেয়েছেন অর্ঘ্য । সম্ভবত যখনই এই সিরসিরানি তাঁর অস্তিত্বে ঘটে তখন তিনি বাক্যগুলোয় যাতে তা থাকে এবং পাঠকের কাছে পৌঁছোয়, তার প্রয়াস করেন । পড়ার সময়ে পাঠক টের পান ঠিক কী ধরণের শীতলতার টর্চার তাঁকে সহ্য করতে হচ্ছে, চরিত্রগুলোকে রাস্তা থেকে, চায়ের ঠেক থেকে, গ্রন্