এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • সন্তান 

    Chayan Samaddar লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০৯১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • ১.

    জিজা শাড়িটায় ভালো করে কাছা দিয়ে নিল। পঞ্চায়েতের সামনে বেশ ভব্যিযুক্ত হয়ে যেতে হবে। এক চিলতে জমি তার। সেখানে সে বাজরা ফলায়। এখন বিঠঠল বলে এই জমি বাপু ওকে বিক্রী করে গিয়েছিল? একটা কবালাও দেখাচ্ছে। বিঠঠল একটা হাড় শয়তান। এমনভাবে তাকায় যেন জিজার পরনে কিছু নেই। প্রচুর পয়সা। জালিয়তি জোচ্চুরি জলভাত ওর কাছে। এদিকে এত মুখমিষ্টি যে সবাই ওর ব্যবহারে মুগ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে বেরোল জিজা। পুরুষের পর পুরুষ এই মলহালা গ্রাম নিজের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। মরহাট্টাদের এটাই বৈশিষ্ট্য। রাজাকে খাজনা পাঠানো ছাড়া তাঁর সঙ্গে আর সম্পর্ক নেই গ্রামের। পঞ্চায়েতই ফয়সালা করে দেওয়ানি আর ফৌজদারি মামলার। গাঁয়ের খাবার গাঁয়েই পাওয়া যায়। কাপড়ও। বাইরে যাওয়ার দরকারই হয় না। ওপর দিকে তাকাল জিজা। শরতের নীল আকাশ। একটা চিল উড়ছে। সামনের পথ চলে গেছে চাওল শহরের দিকে। গাছের নীচে এক সাধুবাবা ধ্যান করছেন।

    পঞ্চায়েতের আদালতে এসে পৌঁছলো জিজা। পঞ্চ পরমেশ্বর বসে আছেন। বাঁদিকে সিদ্ধান্তগ্রাাাহকরা। গ্রামের প্রধান মাসোজি বলতে আরম্ভ করলেন,

    - আমরা বিঠঠলের কবালা দেখেছি। সাক্ষীর দস্তখত হিসেবে ছোরা চিহ্ন আঁকা। দুটো। সাক্ষী কারা ছিল?

    - বিষ্ণো আর বালাজী।

    - মহাদেওজীর নামে শপথ করে বলো, তোমরা দস্তখত করেছিলে এই কাবালায়?

    - আজ্ঞে হ্যাঁ।

    - জিজা, তুমি কিছু বলবে?

    - আমি জানতে চাই, এই বিক্রী বাটা হলো কখন? আমি কিছুই জানতে পারলাম না?

    - বিঠঠল রাও?

    - ধর্মাবতারগণ, জিজার বিয়ের টাকা জোগাড় করতে ওই জমি আমার কাছে বিক্রি করেন ওর বাবা বিনায়ক রাও। তারপরই তিনি হঠাৎ মারা যান। আমার ধারণা ছিল, উনি মেয়েকে সব বলে গেছেন। কিন্তু, দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থাকার পর যখন টাকা পেলাম না, তখন জিজার কাছে চাইতে বাধ্য হলাম। সে অস্বীকার করায় আপনাদের দ্বারস্থ হয়েছি।

    - এজাহারে কোনও অসঙ্গতি পেলে জিজা?

    - বিক্রির কথা মিথ্যে। বাকী সব ঠিক বলছে।

    - নিজের কথার সমর্থনে কোনও প্রমাণ আছে তোমার কাছে?

    চারদিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে মাথা নাড়ল জিজা। তারপর ঘাড় কাত করে বলল,

    - দলিল জাল।

    - প্রমাণ করো।

    - বিঠঠল টাকার জোরে বিচার কিনছে।

    - ব্যস!

    প্রচণ্ড জোরে ধমকে উঠেছেন মাসোজী।

    - প্রথম ভুল বলে ক্ষমা করা হচ্ছে জিজা। আর একবার পবিত্র ধর্মাধিকরণকে অপমান করলে কঠিন শাস্তি পাবে। মাননীয় সিদ্ধধান্তগ্ররাহক মহোদয় গণ আপনারা সব শুনলেন। রায় জানান দয়া করে।

    একটা গুনগুন শুরু হলো। জিজা আর কান্না চাপতে পারছে না। ঠোঁট কামড়ে, এদিক, ওদিক চাওয়াতে, চোখে পড়ল, গাছের নীচে ধ্যানস্থ সাধুবাবা উঠে এসে বিচার দেখছেন। গ্রামের লোক নিজের মনে কথা বলছে।

    মাসোজি হাত তুললেন। সব চুপচাপ।

    - মাননীয় সিদ্ধধান্তগ্রাহকবৃৃৃন্দের সঙ্গে একমত হয়ে, পঞ্চায়েত নদীপাড়ে বিনায়ক রাওয়ের জমির বর্তমান মালিক হিসেবে বিঠঠল রাওকে মেনে নিচ্ছে। রায়ের প্রতিলিপি তৈরী হচ্ছে। গ্রামবাসীরা সবাই তাতে দস্তখত বা টিপসই দেবেন।

    নাগিনীর মতো মাথা ঝাঁকিয়ে বিচারসভা থেকে বেরিয়ে এল জিজা। দু'পা এগোতেই ডাক পেছন থেকে ডাক এল।

    - শোন।

    সেই সন্ন্যাসী। মুগ্ধ চোখে তার পানে তাকিয়ে। না, কোনও খাবো খাবো ভাব নেই। অস্বস্তিও হচ্ছে না। কিন্তু, কোনও রকম প্রশস্তি বা স্তুতি শোনারও ইচ্ছে নেই এখন জিজার। এতই বিরক্ত সে।

    - তোমার  নাম কী?

    - জিজা।

    সন্ন্যাসীর চোখের মুগ্ধতা গাঢ় হলো। জিজার ঠোঁট কুঁচকে উঠল। একটা গদগদ কথা বললে, সাধু বলে মানবে না সে। কিন্তু, সন্ন্যাসী সেরকম কিছু বললেন না। বললেন একেবারে অন্যজাতীয় কথা।

    - বিচার যা হলো সে তো দেখলাম। তুমি রাজসরকারে নালিশ করছ না কেন? রাজগড়ে গিয়ে?

    - রাজার হুকুম মানবে না পঞ্চায়েত। আজ অবধি কোনওদিন রাজারাজড়া আমাদের গাঁ নিয়ে মাথা ঘামাননি।

    - হুঁ।

    সন্ন্যাসী চুপ করে গেলেন।

    ঘরের দিকে পা চালালো জিজা।



    সমুদ্রের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল  বিঘ্নেশজি শঙ্খপাল। ঢেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ছে খাণ্ডেরি দ্বীপের পাথুরে তটে। দ্বীপের ভেতরে গড়ে উঠছে ঘুরাব, মাচোয়া, শিবার। রাজকীয় নৌবহরের হালকা আর ছোট জাহাজ সব। অতি নিপুণ গোলন্দাজ, আর দক্ষ তীরন্দাজ, বিঘ্নেশজির চোখ এসব কিছুই দেখছিল না। তার চোখের সামনে ফুটে উঠছিল, তাদের আঙ্গারিয়া গ্রাম। সেখানে ঝুলাতে শুয়ে হাত পা ছুঁড়ছে তার কলজের টুকরো, ছোট্ট কহ্নোজি শঙ্খপাল। একটা নৌকো এসে ভিড়ল। বিঘ্নেশ দেখল একটা বড় জাহাজ নোঙর করেছে দূরে। এখানে সমুদ্র অগভীর আর সরু। বড় জাহাজ ঢুকতে পারে না। দু'টো লোক এদিকে আসছে। একটা গোরা আরেকটা দিশি। গোরাটা চেঁচিয়ে কী একটা বলল। দিশি লোকটার মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি।

    - হুইচ বাগার রানস দিস প্লেইস? গেট হিম। কল হিম!

    - আমরা বম্বে দ্বীপের ডেপুটি গবর্নর সাহেবের পক্ষ থেকে আসছি। কার সঙ্গে কথা বলব?

    - সেনাপতির উঠতে বিলম্ব আছে। অপেক্ষা করতে হবে।

    দোভাষী কথাটা অনুবাদ করাতে সাহেব চেঁচিয়ে উঠল,

    - হোয়াট চীক্! টেল হিম, আই রিপ্রেসেন্ট দ্য মাইটি ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি।

    অনুবাদ শুনে দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ল বিঘ্নেশ। কালা আদমির এহেন বজ্জাতি কাঁহাতক সওয়া যায়? লেফটেনান্ট ফ্রান্সিস থ্রপ একেবারে হুঙ্কার ছাড়ল।

    - ইমপার্টিনেন্ট ব্ল্যাকি! সান অভ আ বিচ! বেইনশুট!

    বিনা অনুবাদেই শেষ গালিটা দিব্যি বুঝে নিল বিঘ্নেশ। তার বাঁ হাত চেপে ধরল সাহেবের ডান হাত। ডান হাত চেপে ধরল টুঁটি। সাহেবের জিভ বেরিয়ে আসছে। চোখ ঠিকরে বেরোচ্ছে।

    - বিঘ্নেশ ছেড়ে দাও। মরে যাবে।

    নৌবলাধ্যক্ষ দৌলত খান এসে দাঁড়িয়েছেন। বিঘ্নেশ হাত আলগা করলো। সাহেব খাবি খাচ্ছে। দোভাষী বামনদাস আর দেরী না করে ঝটপট ডেপুটি গভর্নরের অনুরোধ পড়ে শোনালো। তিনি রাজকীয় নৌবহরকে এই দ্বীপ ছেড়ে যেতে বলছেন, কারণ এটি বম্বে দ্বীপের সম্পত্তি। দৌলত খান একটু ভাবলেন।

    - রাজগড় থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত আমি কিছুই করতে পারি না।

    - বেশ সেনাপতি। তাই জানাচ্ছি গিয়ে।

    থ্রপ মাটিতে বসে পড়েছিল। বামনদাস তাকে টেনে তুলল। উঠে দাঁড়িয়ে অদ্ভুতভাবে হাসল ফ্রান্সিস।

    - রাউন্ড ওয়ান টু ইউ বাগারস্। বাট মার্ক মাই ওয়র্ড। ভেরি সুন, নট জাস্ট ইউ, বাট দিস ব্লাডি কানট্রি উইল পে ফর দিস।

    মাথার ওপর একটা কাক কা কা করে ডাকছে। কেমন অস্বস্তি হচ্ছে বামনদাসের।

    ওরা দু'জন চলে গেলে জরুরী মন্ত্রণা সভা ডাকলেন দৌলত খান। সভাকক্ষে আছেন তিনি, বিঘ্নেশ, দ্বীপে রাখা অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি মৈনায়ক আর এক ছোট খাটো চেহারার যুবক। সেই প্রথম কথা বলল,

    - এক লাখ হুন নামের টাকা দিয়ে আমাকে চাওলে পাঠিয়েছিলেন রাজা। তারপর, বলেছিলেন আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে। রাজাও কাছে পিঠেই আছেন।  রাজার নিজস্ব বাজ রুস্তমকে চেনানো আছে সে জায়গা। যদি, খুব জরুরী দরকার হয়, তার জন্য  রুস্তম আমার সঙ্গে আছে। আলোচনার সিদ্ধান্ত আমি তার মারফৎ পাঠিয়ে দেব।

    দৌলত খান বললেন,

    - হাতে সময় বেশি নেই। ওরা নৌবহর পাঠাবে।

    - হারবে।

    - ঠিক বলছ বিঘ্নেশ?

    - ওরা আমাদের সমুদ্রকে ভালো করে চেনে না।

    - বেশ, রাজাকে খবর দাও।

    যুবক চলে গেল। তারপর চারদিন কেটে গেল কোনও সংবাদ নেই। চতুর্থ দিন, দিগন্তে সাদা পাল দেখা গেল জাহাজের।  এদিককার নৌবহরও প্রস্তুতই ছিল। চারটে ঘুরাব রওনা হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। প্রথম গোলাটা গিয়ে লাগল ইংরেজ জাহাজের প্রধান মাস্তুলে, দ্বিতীয়টা ডেকের তলায়।

    - স্ট্রাইক কালারস! হোয়াইট ফ্ল্যাগ! কুইক!

    ক্যাপটেন জর্জ কোল আর্তনাদ করে উঠলেন।

    - ইউল থ্রো আস অ্যাট দ্য মার্সি অভ দোজ বাস্টার্ডস্! উইল ইউ?

    - জাস্ট শাট আপ লেফটেনান্ট! অ্যান্ড কল মি ক্যাপটেন।

    - ডেভিল টেক ইউ ক্যাপ্টেন!

    ফ্রান্সিস  থ্রপ মদের নেশায় টলছে।

    - আয়্যাম গোইং টু  কুক দ্য নিগারস্ গুজ অন মাই ঔন, সো হেল্প মি গড! হুজ্ উইথ মি? হু আর দ্য ট্রু সানস অভ ইংলন্ড? আঃ! ব্র্যডবেরি! থ্যাঙ্কিউ ওয়েলশ্! থ্যাঙ্কিউ অল! জেন্টলমেন, আই নিউ ইউ হ্যাড ইট ইন ইউ! টু দ্য শিবার দেন!

    একটা শিবার জাহাজ থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জনা পঞ্চাশেক ইংরেজ সৈনিক নিয়ে। খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে বীভৎস কন্ঠে অকথ্য গালাগালি দিয়ে চলেছে থ্রপ।

    আরেকটু, আরেকটু সামনে। থ্রপের গলা ছাড়া আর কিছু দেখতে  পাচ্ছে না বিঘ্নেশ। পাশের দুই তীরন্দাজও তৈরী। কান পর্যন্ত গুন টেনে তীর ছুঁড়লো বিঘ্নেশ। একটা কুৎসিত গালির মাঝখানে থেমে গেল থ্রপ। গলায় বেঁধা তীরটা দু'হাতে টেনে খুলতে চেষ্টা করল। তারপরই একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজের সঙ্গে এক ভলক রক্ত বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। টলে পড়ে গেল জলের মধ্যে। জন ব্র্যাডবেরি আর হেনরি ওয়েলশ-প্রাণ হারালো তীরের মুখে। ওদিকে, জর্জ কোল আত্মসমর্পণ করলেন।

    যুদ্ধ শেষ হওয়া মাত্র সেই যুবক ছুটতে ছুটতে এল।

    - সেনাপতি,  রুস্তম ফিরেছে। রাজা এখনই আমাকে পঞ্চাশজন অশ্বারোহী নিয়ে যেতে বলেছেন। চিঠিতে জায়গার নাম বলে দিয়েছেন।

    - বেশ বেরিয়ে পড়ো। দেখা হলে রাজাকে এখানকার সংবাদ দিও।



    একদিন আগের কথা। জিজা জল আনতে গিয়েছিল। ফিরতে হয় পায়ে চলা সুঁড়িপথ ধরে। দু'পাশে ঝোপ। আচমকাই কে যেন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঝোপের মধ্যে টেনে নিয়ে যেতে চাইল। একটুক্ষণ হতবুদ্ধি হয়ে গেলেও, নিজেকে চকিতে সামলে নিল জিজা। কলসী মাথাতেই রইল। সবল দুই বাহুতে পেছন থেকে সামনে টেনে আনল দুষ্কৃতীকে। বিঠঠল! একটিও কথা না বলে, হিড়হিড় করে তাকে টেনে নিয়ে চলল জিজা। বিচার সভা যেখানে বসে সেখানে এনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর গলা ফাটিয়ে চ্যাঁচাতে লাগল,

    - কোথায় মাসোজি? কোথায় পঞ্চ? বিচার চাই আমি।

    দেখতে দেখতে লোক জড় হয়ে গেল। পাগড়ি আঁটতে আঁটতে ছুটে এলেন মাসোজি। দেখতে দেখতে বসে গেল জরুরী বিচারসভা।

    - অত্যন্ত নিন্দাজনক কাজ করেছ, বিঠঠল রাও।

    -আমি সংযম হারিয়েছিলাম ধর্মাবতার।

    - কেন?

    - আমি জিজাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসি। আজ ওকে এত সুন্দর লাগছিল যে আমি স্থির থাকতে পারিনি।

    - তবু, অবিবাহিতা কন্যার অঙ্গস্পর্শ করা গুরুতর অপরাধ। আমার চার ভ্রাতা ও জুরিগণ, আমি মনে করি বিঠঠলের উচিত জিজাকে বিবাহ করা। আপনারা কী একমত?

    - একমত।

    সমস্বরে বলা কথাটা শুনেও জিজা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এরকম ঘটনা কী করে ঘটতে পারে? মারহাট্টা দেশে নারীর স্বাধীনতা স্বতঃসিদ্ধ। এসব কী হচ্ছে?

    - তাহলে জিজা...

    - দাঁড়ান।

    সেই সন্ন্যাসী এসে দাঁড়িয়েছেন।

    - এটা বিচার না প্রহসন?  যুগ যুগ ধরে মারহাট্টা গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ থেকেছে। নিজেদের শৃঙ্খলা নিজেরা বজায় রেখেছে। রাজশক্তি হস্তক্ষেপ করেনি। কারণ, কোনও স্বাধীন রাজাই ছিলেন না। এখন অবস্থা বদলেছে। আমরা সাধু সন্ন্যাসীরাও জানি সে কথা। এই গ্রামে বিচার ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘুণ ধরেছে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেদিনের বিচার নিয়ে আমি সন্দিহান ছিলাম, কিন্তু আজকের বিচারের পর আমি নিঃশংসয়। অসহায়া নারীর জমি জালসাজি আর ঘুষখোরি দিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর, আজ যা করা হচ্ছে তা পঞ্চায়েতের এক্তিয়ারের মধ্যেই পড়ে না! মা, আমি বলছি তুমি রাজসরকারে নালিশ করো!

    এতক্ষণে, মাসোজির শিষ্টতার মুখোশ খসে পড়ল। একটা বিকট মুখভঙ্গী করে বলদেন,

    - তাই জানা গে নষ্ট মেয়েছেলে! আর, তুমি কে হ্যা? ডবকা মাগী দেখে মুখ দিয়ে লাল গড়াচ্ছে? মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দেব। গজানন!

    মাসোজির সম্বন্ধী গজানন পালেকর বিশাল পালোয়ান। সে ধীর পায়ে সাধুর দিকে এগোতে লাগল। সন্ন্যাসী গায়ের উত্তরীয় খুলে কোমরে বাঁধলেন। এতক্ষণে জিজা তাঁকে ভালো করে দেখলো। বেশি লম্বা নন। কিন্তু, বিশাল চওড়া বুক আর অসম্ভব লম্বা দুটো হাত। গজানন তাঁর টুঁটি টিপে ধরতে যেতেই দু'হাতে তার দুটো কবজি ধরে সাধু মাটিতে শুয়ে পড়লেন। তারপর দুটো পা পেটে দিয়ে নিমেষের মধ্যে মাথার ওপর দিয়ে ছুঁড়ে দিলেন গজাননকে। ধড়াম করে সেই যে পড়ল গজানন, আর উঠল না। সাধু লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে খুব শান্তস্বরে  বললেন,
     
    - আর কেউ?

    সব লোক পিছু হটছে। মাসোজির চোখ লাল।

    সেদিন রাতে বাইরে একটা শব্দ পেয়ে জিজা উঁকি মেরে দেখল ধুনি জ্বলছে। তার উলটো দিকে বসা সন্ন্যাসীর কোলে একটা ধারালো তলোয়ার। মাথার ওপরে একটা ঝটপট শব্দ। সন্ন্যাসীর মণিবন্ধে এসে বসল এক বিশাল শিকরে বাজ।

    পরদিন বেলা দুপুর পর্যন্ত কিছু ঘটল না। তারপর এটা বিরাট শোরগোল শোনা গেল। চাওল থেকে বাজারি গুণ্ডা নিয়ে এসেছে মাসোজি। ধীর স্থির ভাবে তলোয়ার ধরলেন সন্ন্যাসী। এরপর তাঁর হাতে অসি চলতে লাগলো বিদ্যুতের মতো। কেউ সামনে এগোতে পারছে না। যে আসছে সে মরছে। হঠাৎ, কারও ছুঁড়ে মারা মাথর তাঁর কপালে লাঘলো। রক্ত ঝরছে। রক্ত মুছে, বজ্রকন্ঠে হুংকার ছাড়লেন তিনি,

    - জয় ভবানী।

    অমনি প্রতিধ্বনি উঠল অনেক কন্ঠে,

    - জয় ভবানী।

    পঞ্চাশ জন ঘোড়সওয়ার এসে উপস্থিত হলো রণক্ষেত্রে,

    - হর হর মহাদেও।

    দেখতে দেখতে কচুকাটা হয়ে গেল গুণ্ডার দল। তারপর, দেখা গেল এক ছোটখাটো যুবকের তলোয়ারের খোঁচা খেতে খেতে মাসোজি এদিকেই আসছেন। ঘাড় ধরে মাথাটা সাধুর পায়ের ওপর রেখে যুবক বলল,

    - তোমার, আমার সবার রাজা ছত্রপতি শিবাজি কে প্রণাম করো রাও।

    শিবাজি প্রশ্ন করলেন,

    - খাণ্ডেরির খবর কী শিউ?

    - বম্বের ইংরেজরা আক্রমণ করে রাজা। আমাদের নৌবহরের কাছে হেরেছে। বন্দী হয়েছে বাকীরা।

    শিবাজির চোখে চিন্তা ঘনিয়ে এল,

    - ফরাসী, ডাচ, ইংরেজ সবাই এসেছে। কিন্তু, ইংরেজদের নিয়ে আমার ভারি চিন্তা! ভয় হয় ওরা রয়ে যাবে। অনেকদিন।

    তারপর হেসে বললেন,

    - যাক। সে পরের কথা পরে। আপাতত এই গ্রামটার ব্যবস্থা করে খাণ্ডেরি যাই চল্।

    - এখানে ছিলে কেন রাজা?

    - চাওলেই থাকব ভেবেছিলাম জানিস! কিন্তু, কেমন যেন ছোটবেলার ভূত চাপল মাথায়। ছদ্মবেশে লুঠতরাজ করতাম। গাঁয়ে, খোলা মাঠে, রাত কাটাতাম। হঠাৎ মনে হলো, আসল দেশের কাছে, সাধারণ মানুষের কাছে ক'দিন থেকে যাই।

    বাইরে গ্রামের সব লোক জড় হয়েছে। শিবাজি খুব সংক্ষেপে বললেন,

    - চূড়ান্ত দুর্নীতির অপরাধে পূর্বতন গ্রাম পঞ্চায়েত ভেঙে দেওয়া হলো। প্রধান মাসোজিকে নির্বাসন দেওয়া হলো। নতুন গ্রাম প্রধান নিযুক্ত হলেন জিজাবাই। তিনি মনোমত পঞ্চায়েত গড়বেন। তাঁকে সাহায্য করার জন্য পঞ্চাশ জন যোদ্ধা শীঘ্রই পাঠানো হবে। সবাইকে মনে রাখতে বলব, আমি বর্তমান গ্রাম প্রধানের সন্তান। কারণ, আমার গর্ভধারিনীর নামও জিজাবাই।

    জিজা কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে রইল। তারপর মুখ খুলল। তার সঙ্গে গলা মেলালো সারা গ্রাম।

    - শিবারাজাস্ আঠবাবেঁ।

    শিবাজিকে মনে রেখো।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১০৯১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রণছোড় - Chayan Samaddar
    আরও পড়ুন
    মালিক - Chayan Samaddar
    আরও পড়ুন
    শপথ  - Prolay Adhikary
    আরও পড়ুন
    বকবকস  - Falguni Ghosh
    আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Ranjan Roy | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৬:১৯498199
  • অসাধারণ!
  • Debabrata Bandyopadhyay | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০০:৫৫498232
  • শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সদাশিবের কথা মনে পরিয়ে দিয়েছেন। লিখতে থাকুন। খুশি হলুম।
  • Kausik Ghosh | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:১২498240
  • বেশ ভালো। বিষয় নির্বাচন আলাদা রকমের। 
  • Kausik Ghosh | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:১৪498241
  • জুরি শব্দটাকে পাল্টানো যায় না ?
  • Kausik Ghosh | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৮:১৬498242
  • দস্তখত বা কাবালা যেমন, তেমন কিছু। দ্বিতীয়টা মনে হয় কবালা হলে বেশি ভালো।
  • Chayan Samaddar | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:৪৯498247
  • বদলে দিলাম। 
  • কৌশিক সাহা | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১২:২৭498308
  • @Chayan Samaddar
     
    "I'm going to bust the wops on my own"
     
    Wop শব্দের উৎপত্তি  বিংশ শতাব্দীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ইতালীয় ভাষার guappo বা স্পেনীয় ভাষার guapo শব্দ থেকে।  মূল  শব্দটি বাবুয়ানী চালের পুরুষদের জন্য ব্যবহার করা হয়।  মার্কিনিরা নিন্দার্থে ইতালীয় মূলের মানুষদের জন্য এই শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। অতএব সপ্তদশ সতাব্দীর ইংরেজ জাহাজের captain এর  শব্দভাণ্ডারে  wop শব্দটি ছিলনা।  
     
    Wog শব্দটি এস্থলে উপযুক্ত কিন্তু এই শব্দটির ব্যবহারও 1920 এর পূর্বে ছিলনা এবং এটিও  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রথম ব্যবহৃত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ মূলোদ্ভূত মানুষদের নিন্দার্থে  wog শব্দটি ব্যবহৃত হয়। 
     
    To bust ক্রিয়াপদটি ইংরেজি to burst এই প্রক্ষেপ। এই শব্দটির উৎপত্তিও অষ্টাদশ শতাব্দীতে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সপ্তদশ শতাব্দীর Englandএ এই শব্দের ব্যবহার ছিলনা। 
     
    মধ্যযুগীয়  ইংরেজ জাহাজীদের কথ্য ভাষা সম্পর্কে জানতে হলে  James Clavell এর  Shogun  বা Tai Pan পড়ার পরামর্শ দিচ্ছি।  আপনার উপন্যাসের পরের পর্বগুলিতে তাদের আবির্ভাব বাড়বে। 
  • Kausik Ghosh | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২০:২২498339
  • কৌশিক সাহা তাঁর মন্তব‍্যকে আলাদা একটা লেখার রূপ দিলে খুব ভালো হয়।
  • কৌশিক সাহা | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৭:৫৭498597
  • @Kausik Ghosh
    অত বুদ্ধি  নেই  ভাই| কিন্তু   এই  সামান্য  জ্ঞান   টুকু     আছে   যে  গাভী    বৃক্ষারোহণ  করতে    অক্ষম|
  • Kausik Ghosh | ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৩:৫৬498613
  • @কৌশিক সাহা wop, wog, bust নিয়ে যেভাবে এগিয়েছেন, এই রকম আরো অনেক চেনা অচেনা শব্দ এবং তাদের ইতিহাস নিয়ে সুন্দর একটা রচনা আমাদের উপহার দিলে আমরা উপকৃত হতাম। 
    আপনি পারেন, তা তো আপনার ঐ বিস্তৃত মন্তব‍্যেই প্রমাণিত।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন