এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  লঘুগুরু  কড়চা

  • পারলৌকিক প্রলাপ

    Chayan Samaddar লেখকের গ্রাহক হোন
    লঘুগুরু | কড়চা | ১৫ নভেম্বর ২০২১ | ১৩০৫ বার পঠিত
  • মেয়েটা হাসলো।
     
     - মাই জব ইজ ডান সার! মাই বস উইল টেক ওভার নাউ। 
     
     এসব কী হচ্ছে? আচ্ছা, পরপর ভাবি। আমাদের 'শেষবেলা' বৃদ্ধাশ্রম। রিটায়ারমেন্টের পর থেকে ওখানে। প্রতিদিন নিজের কৃতকর্ম নিয়ে ভাবা। এই একাকীত্ব আমার প্রাপ্য। অপরাধ তো কম করিনি জীবনে। নরক যন্ত্রণা আমার পাওনা। বুকটা সবসময় ভার হয়ে থাকতো। ঘাড়ে ব্যথা। রক্তচাপ খুব বেশি। এসবের জন্যই, সে রাতে যখন বুকের ব্যথাটা খুব বেড়ে গেল , চোখে আঁধার দেখলাম, খুব ভালো লাগছিলো। এইবার মরণ। আচ্ছা তারপর কী? আমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত কি মৃত্যুর পরও করতে হবে? করলে পরে মন্দ হয় না! 
     
    চোখ খুলে দেখি, নার্সিংহোমের কেবিন। হাতে নল, মুখে মুখোশ। দুত্তোর! মরিনি। ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ একটা সুন্দর পারফিউমের গন্ধে চোখ মেললাম। আর দেখলাম মেয়েটাকে। শ্যামলা। জিনস আর টপ পরা। সপ্রতিভ। সবচেয়ে সুন্দর হাসিখানা। 
     
     - হাউ আর উই ফীলিং সার? 
     
     - আই ডোন্ট নো অ্যাবাউট ইউ মাই ডিয়ার। বাট আয়্যাম ফীলিং লাইট হেডেড। 
     
     - ওটা কেটে যাবে। আমার ক্লায়েন্টদের সবারই ওরকম হয় প্রথমটা।
     
     - ক্লায়েন্ট? আমি তো তোমার সার্ভিস চেয়েছি বলে মনে পড়ছে না! 
     
     - ওটা ফ্রী সার। প্যাকেজের মধ্যে ইনক্লুডেড। 
     
     - প্যাকেজ? 
     
     - ও ইয়েস স্যার! কান্না, হাসি, হামাগুড়ি, প্রথম নড়া দাঁত, প্রথম চুমু, প্রথম পাকা চুল, হার্ট বার্ন, হার্ট থ্রব, হার্ট ফেইল। ইউ নো। দ্য ফুল প্যাকেজ। 
     
     এসব কী বলছে? এ কে? মেয়েটা হাসলো।
     
     - মাই জব ইজ ডান সার! মাই বস উইল টেক ওভার নাউ।
     
     দেখি খাটের পাশে এক ভদ্রলোক দাঁড়ানো। জিনস আর লাল কুর্তা। কষ্টি পাথরের মতো রঙ। চোখে কালো সান গ্লাস। কাঁচা পাকা চুল। অসম্ভব স্মার্ট। 
     
     - অর্চন ব্যানার্জী। এজেড সেভেনটি ফাইভ। এখন কেমন লাগছে? আর উই আপ ফর আ জার্নি? 
     
     ধ্যাত্তেরি! এও উই বলে! তোর কথা বলতে পারিস, আমাকে টানিস কেন? 
     
     - ইউ মে বি আপ ইয়াং ম্যান, বাট আয়্যাম ফীলিং রদার ডাউন! মাই হেড ইজ সুইমিং। একটা কথা বলুন তো, আপনারা এমন মেশানো ভাষা বলছেন কেন? তার চেয়েও বড় কথা আপনারা কে? 
     
     - মরলোকে যে ভাষা যখন চলে তখন আমাদের তাই বলতে হয়। বঙ্গদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের যে অংশে এই চিকিৎসাকেন্দ্র বিরাজিত, সেখানে এরকম ভাষাপ্রয়োগই বিধেয় বলে বিবেচনা করেছিলাম।
     
     - দেখুন, একেবারে ইংরিজি বর্জিত বাংলা বলতেও বলিনি। বিরাজিত! বাপ রে! 
     
     ঝকঝকে দাঁতে একটা দারুণ হাসি হাসলেন ভদ্রলোক।
     
     - আমি বা আমরা কিছুই বলি না অর্চন। তোমরা বলাও। তোমাদের কথা আমাদের ওপর বসাও। এই, দেখো না, তোমরা দর্শনের বই আওড়ালে, চালালে আমার নামে। নচিকেতাকে আমার শ্রোতা বানিয়ে! আমাদের কি কোনও অবয়ব আছে রে ভাই? আমরা হলাম গিয়ে অ্যানথ্রোপোমরফিক পারসোনিফিকেশন! যাক গে! ওসব তুমি বুঝবে না। মোদ্দা কথা হলো, আমরা তোমাদের বিশ্বাসের প্রতিমূর্তি। তোমরা মানুষ। তাই আমাদেরও মানবিক রূপ।
     
     ফট করে তুমি বলছে! আর এসব কী বলছে? নচিকেতা? মানে, মানে... আবার সেই হাসি।
     
     - তুমি যদি মৃত্যুর পরের অস্তিত্বে খুব জোর দিয়ে বিশ্বাস না করতে, ভেতরে ভেতরে, তবে আমাদের কায়া নিতে হতো না। অ্যালাও মি টু ইনট্রোডিউস মাই কলীগ মৃত্যু। অ্যান্ড আয়্যাম যম। 
     
     মেয়েটা বললো, 
     
     - হেলো! 
     
     - বুড়ো মানুষের সঙ্গে ইয়ার্কি হচ্ছে? যম আর মৃত্যু এই ভাষায় কথা বলেন?
     
     হো হো আর খিলখিল দুরকম হাসির শব্দ শুনলাম। যম বললেন, 
     
     - অর্চন, তুমি যা শোনোনি, দেখোনি, তা তোমার চেতনায় থাকবে কী করে? তুমি কি তোমার আশপাশে সংস্কৃত শুনেছ? সিনেমায় যমরাজের যে মুস্কো, মোষে চড়া চেহারা দেখেছো, তাকে সিরিয়াসলি নিয়েছো? মৃত্যুকে নারী হিসেবে চেয়েছো - কিন্তু তার কোনো রূপ ভেবেছো? ভাবোনি। তাই তোমার চেতনায় যা স্বাভাবিক, আমরাও তাই। 
     
    দুহাতে মাথা চেপে ধরলাম। আর ঠিক তখনই, খুব ভদ্র একটা কাশির শব্দ শোনা গেলো। মুখ তুলে দেখি, যমের পেছনে তাল ঢ্যাঙা এক সাহেব দাঁড়ানো। অসম্ভব সুপুরুষ। কিন্তু চোখের নীচে পুরু কালি। যেন বহু রাত ঘুমোয়নি। পরনে নিখুঁত স্যুট। যম হাসলেন। 
     
     - তোমাকেও টেনে এনেছে, মেফিস্টোফিলিস? 
     
     খুব ক্লান্ত একটা স্বর বললো, 
     
     - কী করি ধর্মরাজ? এই ইংরিজি পড়া বাঙালিরা ওদেশের লেখা থেকে আমার ধারণা গড়ে। তারপর পাপ বোধে কষ্ট পায়। মরার পর আমাকে চেতনায় নিলে, আমাকে আসতেই হয় যে! 
     
     - হুঁ! টক অফ দ্য ডেভিল! সাহেবরা তোমায় এঁকেছিল খাসা। কিন্তু বাপু শয়তান, তোমার এখানে দরকার নেই। আমি সামলে নেব। তুমি এস। 
     
     - বিশ্বাস করুন, আমি যেতেই চাই। কিন্তু, এরা মনের মধ্যে আমাকে পুষে রাখলে, যাই কী করে? কতদিন আমি ঘুমোই না জানেন?
     
     - বেশ। তোমার ঘুমের ব্যবস্থা করছি। 
     
     যমের হাতে একটা আলোয় গড়া লাঠি। শয়তানের মাথায় আলতো করে ছোঁয়াতেই, তাঁর মুখে একটা ঘুম ঘুম হাসি ফুটে উঠলো। চোখ দুটো বুজে এলো। একটা নড করে মিলিয়ে গেলেন তিনি। যম আবার হাসলেন।
     
     - কালদণ্ড। সময়ের মার। তোমাদের কল্পনায় ব্রহ্মার গড়া হাতিয়ার। কেউ একে আটকাতে পারে না। নাউ অর্চন, লেটস গেট ডাউন টু ব্রাস ট্যাকস। কাজের কথায় আসি। মেফিস্টো যা বললো, সেটা আমিও জানি। পাপবোধ। দেখো, আগের যুগ হলে চিত্রগুপ্তের খাতা থেকে হিসেব বুঝে নিয়ে তোমার পাপের পরিমাণ অনুয়ায়ী নরকভোগ করিয়ে সোজা স্বর্গে পাঠানো যেত। মানে সেটাই তোমরা বিশ্বাস করতে। এখন তোমাদের বিশ্বাস, অবিশ্বাস, কল্পনা এমনভাবে জট খেয়েছে যে থিংস হ্যাভ বিকাম একস্ট্রিমলি কমপ্লিকেটেড। আমাকে ব্রাঞ্চ আউট করতে হয়েছে। একটা নতুন শাখা খুলতে হয়েছে। তাছাড়া, তোমরা, অন্তত এই ভারতভূমিতে, বেঁচে থেকেই এতটা নরকযন্ত্রণা পাও যে, মহারৌরব প্রভৃতি যে ডিভিশনগুলো ছিলো, পাপীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য, সব বন্ধ করে দিতে হয়েছে। তাই তোমাকে কোথায় পাঠাবো, সেটা এখানেই ঠিক করতে হবে। মৃত্যু যা প্রশ্ন করছে তার উত্তর দাও। মিথ্যে বলতে পারবে না। কারণ, তুমিই আমাদের ডেকেছো। নিজের কাছে মিথ্যে বলা যায় না। টু ইউ মৃত্যু। 
     
     মেয়েটির হাতে একটা ক্লিপবোর্ড। একটা ডটপেনও।
     
     - খুন করেছেন? 
     
     - না। 
     
     - রেপ? 
     
     - না। 
     
     - চুরি-ডাকাতি-জালিয়াতি-ঘুষখোরি? 
     
     - না। 
     
     - কী করেছেন তবে? 
     
     - কথা দিয়ে কথা রাখিনি। কষ্ট দিয়েছি অনেককে। নিজের কথা ভেবেছি কেবল। ভালোবাসা বিষ হয়েছে বারবার। সেই বিষে জ্বলতে জ্বলতে জ্বলতে দেখেছি, নিজের ছায়াও সঙ্গে নেই। অভিশাপ কুড়িয়ে দরজা থেকে দরজায় আশ্রয় খুঁজেছি। তোমাকে পেতে চেয়েছি। তুমি আসোনি। আমার পাপের ফলে। 
     
     - বস, ডিভিশন ওয়ানের কেস। 
     
     - ওক্কে। বাঁচা গেল! ডিভিশন ইন চার্জ, কাম ইন প্লিজ! 
     
     ওরেব্বাস। সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরা অন্তত সাত ফুট লম্বা। পাঞ্জাবির হাতা গুটোনো। হাতে একটাও লোম নেই। মাকুন্দ? সারা গায়ে ডুমো ডুমো মাসল।
     
     - নমস্কার স্যার। 
     
     - নমস্কার বৃকোদর। আপনার মক্কেল। 
     
     বৃকোদর? মানে... 
     
    - হ্যাঁ রে! মানে ভীমসেন! এবং পাপ পাপ করে নাকে কাঁদলে একটি রদ্দায় তালগোল পাকিয়ে দেব। ব্যাটা ক্যাডাভ্যারাস কোথাকার! আমাকে দেখ! অবস্থার নিরিখে যা ঠিক মনে হয়েছে, তাই করেছি। দুঃশাসনের রক্তপান করেছি, দুর্যোধনের ঊরু ভেঙেছি; রাগ, কামনা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা কিছুরই ঊর্ধ্বে উঠে মহান হতে যাইনি। আয়্যাম দি আলটিমেট কমন ম্যান! তোদের শাহরুখ বলেছে না, ডোন্ট আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অফ দ্য কমন ম্যান? আমি সেই পাওয়ার। তাই, তোর মতো মক্কেল, যারা সিদ্ধান্ত - ঠিক, ভুল, যাই হোক- নেওয়ার পর, সারাজীবন ছটফট করে; মরার পর কোথায় যাবে বুঝতে পারে না, আমার বসের ডিভিশনে আসে। আমি তার ইনচার্জ। 
     
     এরও বস আছে? আমি এবার পাগল হয়ে যাবো! না, মরে গেছি, পাগল হবো কী করে? তবে, কিছু একটা হয়ে যাবো ঠিকই। দেওয়াল গুলো আবছা হচ্ছে। একটা আলোর রাস্তা। রাস্তার গোড়াতে এক ভদ্রলোক। রাজা-রাজা চেহারা। পাকানো গোঁফ। গিলে করা পাঞ্জাবি। হাতে একটা লাঠি। আরে! ইনি তো মাথা নীচে পা ওপরে করে ঝুলছেন! না, লাঠির ভর দিয়ে সোজা হলেন। কিন্তু নড়বড় করছেন। ভীম বললেন, 
     
     - আপনি নিজে এলেন বস? 
     
     - আসতেই হলো তূবরক। আসতেই হলো। এরা আমার জাতভাই যে! তোমার মতো হিম্মত নিয়ে পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। আমার মতো, ঠিক আমার মতো, স্বর্গ নরকের মাঝখানে, উলটো হয়ে ঝুলে থাকে। 
     
     ভীম আমার শিরদাঁড়ায় এক প্রচণ্ড খোঁচা দিলেন। 
     
     - অ্যাই ছোঁড়া, পেন্নাম কর। এঁর ডিভিশনেই ঠাঁই হবে তোর। তোদের মতো মানুষের আদি প্রতিভূ ইনি। মহারাজ ত্রিশঙ্কু! 
     
     উঠলাম। প্রণাম করলাম। ভদ্রলোক উল্টো ঝুলেই আমায় হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, 
     
    - দেখো, কোথাও স্থিতি পাও কিনা! আমার ডিভিশনে সবাই ওটাই খোঁজে। কেউ পায়, কেউ পায় না। যদি পাও, আমার কাছে আবার এস। আলোচনা করব। মাথা উঁচু রাখার উপায় সম্বন্ধে ধারণা করার চেষ্টা করব। আপাতত ভীমসেনের চার্জে রইলে। 
     
     মিলিয়ে গেলেন। আবার পিঠে মারাত্মক খোঁচা দিলেন ভীম।
     
     - চলে চল্! চলে চল্! অনেকটা পথ যেতে হবে! 
     
     সামনে একটা আলোয় গড়া রাস্তা। বিছানাতে কেউ একটা শুয়ে আছে। আমি দাঁড়িয়ে। লাশটা আমি হতে পারে না। কেননা, তাহলে, এই যে চিন্তা করছে, অনুভব করছে, এ কে? আমিই তো? দুটো আমি হতে পারে না নিশ্চয়ই? আমার আমিত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার আগেই দেখি ভীম আমার হাত ধরে আলোর পথে পা রেখেছেন। কিন্তু, কোন আমি? হাত, টাত দেখে যা বুঝছি, এই আমি বেশ তরুণ! আলোর পথটা অদ্ভুত। এই আছে, এই নেই। ভীমসেনের সঙ্গে চলতে চলতে জানতে চাইলাম, - আমাকে কোথায় যেতে হবে মধ্যম পাণ্ডব? ভীমসেন গুনগুন করে গান গাইছিলেন। থেমে গিয়ে আনমনা ভাবে বললেন,  
     
    -অর্জুনের নাচ গান নিয়ে কত না বাখান! আমিও যে ধ্রুপদ গাইতাম কেউ লিখলোই না! হ্যাঁ, কী বলছিলি? তোকে ইসকুলে যেতে হবে রে! 
     
     - ইসকুল! 
     
     - উপায় কী? খালি পড়েইছিস। বুঝিসনি তো কিছুই! তোর ভেতরের যাবতীয় কাঁকড়াবিছের কামড়ের প্রতিষেধক হলো লেখাপড়া। বাইরের কোনো কিছুই ভেতরে ঢুকবে না। কেন? দেখিসনি? 
     
     ভীমের গলাটা কেমন যেন হয়ে গেল। 
     
     - দেখিসনি, তোদের ইস্কুল, ব্যারাক, জেলের কয়েদীদের থাকার জায়গা অনেকটা এক রকম দেখতে? এল শেপ? তোরা তো এসব বানিয়েইছিস ধরে রাখার জন্য! আমাদের ইসকুল ধরে রাখে না। তবে, তোর মতো মক্কেলদের কিছুদিন ধরে রাখতে হয়! অ্যায়! আ গিয়া! ওরে শালা হিড়ু! অ্যাই শালা! 
     
     ছি! বৃকোদরের মুখে এ কী ভাষা? ভাবতে ভাবতেই দেখি প্রায় ভীমের সমান লম্বা -চওড়া, কালো পাথরে খোদাই এক জোয়ান হাজির। মিষ্টি মুখে একদম শিশুর মতো সরল হাসি। পরনে ঢিলে পাজামা আর পাঞ্জাবি।
     
     - কী রে ভীমে? 
     
     - শোন, এই ছোঁড়ার ভার তোর ওপর। প্রচণ্ড কনফিউজড ক্যারেকটার। ইস্কুলে নিয়ে যা, আর তারপর কী কী করতে হবে তুই সবই জানিস। ইন শর্ট, ইউ আর ইন চার্জ। হি নীডস স্কুলিং। সী টু ইট। 
     
     - লীভ এভরিথিং টু মি। বললেন নবাগত। তারপর, আমার দিকে চেয়ে তাঁর হাসি আরো চওড়া হলো। - হোয়াই সো শকট্? ওহো! ভীমে শালা বলেছে তাই? আরে, গাল দেয়নি রে! আমি হিড়িম্ব। ভীমের আদি শালা! ট্রাইবাল চীফ ছিলাম, জানিসই তো! চল এবার। ওই যে সাদা বাড়ি। 
     
     বাড়ির মধ্যে একটা বিরাট ঘর। যে দরজা দিয়ে ঢুকলাম, তার মুখোমুখি একটা কাঠের টেবিল। তার ওপরে চর্বির দীপ। পালকের কলম হাতে এক ভদ্রলোক বসে আছেন। চওড়া কপাল। টাক আছে। পেছনে লম্বা চুল। বাদামি। হালকা দাড়ি। বাদামি চোখের মণি। আমাকে দেখে অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, 
     
     - বুনের সঙ্গে কী মিলবে?
     
     - শুন? 
     
     - না না, তার মানে তো জুতো! ও চলবে না! 
     
     - সুন? মুন? 
     
     - ককুন! তোমরা তোমাদের মনের চারপাশে যে খোলস গড়ে তোলো! এত লজ্জা কিসের হে? মানুষ তো ভুল করবেই। অন্যায় করবেই। নিষ্কলঙ্ক ভালো বলে কিছু হয় না। এই মহাবিশ্বে ভালো আর মন্দ যুদ্ধ করছে। মানুষের মধ্যেও। হতে পারে, শেষতক শুভবোধ জেতে, কিন্তু ইভিলের ছোঁয়া লেগে থাকে তার মনগহনে। সবার , প্রত্যেকের। আমারও।
     
     - আপনারাও? 
     
     - একশবার। আমার উইলে আমার বউক সেকেন্ড বেস্ট বেড আর আসবাব দিয়েছিলাম খালি? কেন? আঠেরো বছর বয়সে ছাব্বিশ বছরের মেয়েটাকে পোয়াতি করে বিয়ে করেছিলাম। মেয়ে হয়েছিল। দুটো। তারপর আমার ছেলেটা একবছর বয়সে মরে গেল। শহরে এলাম। এবং বুঝলাম বউকে আমি ভালোবাসি না। বহু নারীসঙ্গ করেছি। কিন্তু, এতসব ত্রুটি সত্ত্বেও, এই কলম আমি কারো কাছে বেচিনি। আমার নোঙর এটাই। তোমার বা তোমাদের যা থাকে না। 
     
     বেশ বিরক্ত লাগছিলো। ক্রমাগত খোঁচা খেতে কার ভালো লাগে? চটেমটে বললাম, 
     
     - আপনি কলম বেচেননি? জনগণের মনভোলানো লেখা লিখে টিকিট বিক্রি করেননি? রাজাকে খুশি করার জন্য লেখেননি? জেন্টলম্যান হওয়ার শখ ছিল না আপনার? 
     
     হঠাৎ ভদ্রলোকের চোখ জ্বলে উঠলো। আক্ষরিক অর্থে। তাঁর দু'চোখ দিয়ে তীব্র আলোর রেখা ঠিকরে গেলো। কন্ঠে বজ্রের হুংকার শুনলাম, 
     
     - সব ঠিক। কিন্তু, একটা নাটক লিখে দেখাও, যা সামনে দাঁড়ানো মজুর থেকে ওই উঁচু বক্সে বসা লর্ডের সমান ভালো লাগে, একটা নাটক লেখো যা রাজবন্দনা হলেও আড়ালে অবডালে ধরে রাখে অত্যাচারীর চরমতম পতনের কাহিনি। আমাকে দলে টানা কোনোকালে সহজ ছিল না। ভাষার রাজদণ্ড হাতে, সৃজনবিশ্বে বরাবর মাথা তুলে থেকেছে এই উইল শেক্সপীয়র! 
     
     শেক্সপীয়রের শরীর থেকে অসহ্য একটা তাপ বেরোচ্ছে। ছিটকে ঘরের অন্যদিকে চলে গেলাম। ভারী নরম একটা আলো অন্ধকারের গায়ে স্বচ্ছ ওড়নার মতো লেগে আছে। ছাতিমের গন্ধে বাতাস ভারী। এখানে একটা আরাম কেদারা। দীর্ঘদেহী এক পুরুষ গা এলিয়ে শুয়ে। বেহাগের সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। 
     
     - জাগো মহাভয়। আঁধার মধ্যে এসো 
      ভালবেসো, ওগো ক্ষয়। 
     
     
     আমার মুখের মধ্যেটা শুকিয়ে যাচ্ছিলো। চোখ উপচে জল আসছিলো। ভীষণ রকম ঠকে গেছি মনে হচ্ছিলো। কোনো মতে বললাম, 
     
     - আমাদের ওখানে থাকতে আপনি কখনো এরকম গান করেননি! এখানে এসে...কেন? 
     
     একটা দীর্ঘশ্বাস শুনলাম। 
     
     - গাইনি। গাইলে ভালো হতো। কিন্তু, একেবারে গাইনি কি? সেই তো বসন্ত ফিরে এলো? কিছুই তো হলো না সেইসব? এ পরবাসে রবে কে? ভেতরের আঁধারকে আমিও চিনি। তবে, হ্যাঁ, আমার শরীরটা বিশ্রী রকম ভালো ছিলো, অনেকদিন পর্যন্ত। মনের জোরও তোমাদের থেকে অনেক বেশি। তা না হলে যে অপমান সয়েছি, পাগল হয়ে যেতাম! কিন্তু, কী ভীষণ ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম, নোবেল পাওয়ার পর পরই, রথীকে লেখা চিঠিতে তার হদিশ পাবে। তখন একে মেলানকলিয়া বলতো। ওষুধ খেয়েছিলুম। আত্মহত্যার ইচ্ছে হতো। কিন্তু, সেল্ফ ডিসিপ্লিন যেতে দিইনি। ভিত্তোরিয়া ওকাম্পো কি মনের তারে টান দেয়নি? বা অন্যভাবে বিচলিত হইনি কি? হয়েছি। মনের ভেতর ফুঁসেছে হলাহল সাগর। কিন্তু, তাকে বাঁধ দিয়ে রেখেছিলুম। মুক্তধারার বাঁধের মতো। আমার গানে শোনোনি, দূর করো মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ যাহা ক্ষুদ্র? কার ক্ষুদ্রতা? এই আমার! কিন্তু, অত সাঁটে বললে তো চলছিলো না। তাই রঙ, তুলি ধরলুম। বললুম, ও আমার আঁধার ভালো। এ আঁধারে আলো জ্বলে না। দেখনি, প্রাগৈতিহাসিক জন্তুরা উঠে আসে গভীর, গহন থেকে? দেখনি আমার আত্মপ্রতিকৃতি? চেনা যায়? ভয় করে না? করে! তাহলে মহারুদ্রকেও আমি ডাকি, মহাভয়কেও! হা হা! হা হা হা হা হা! 
     
     প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়ছেন রবীন্দ্রনাথ, ওই কোণায় অগ্নিপিণ্ড হয়ে জ্বলছেন শেক্সপীয়র। আমার চেতনা চলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে মনে আলো ফিরে এল। চোখ চেয়ে দেখি ইসকুল ঘরে আমি একা। মাথার কাছে বসে হিড়িম্ব খুব মন দিয়ে আমাকে দেখছেন। চোখ খুলতে দেখে একটা বড় শ্বাস ফেললেন।
     
     - যাক! মরিসনি তাহলে! 
     
     - আজ্ঞে মরার পর কি আবার মরা যায়?
     
     - তা যায় না বটে! তবে একদিকে রবি জ্বলছে, অন্যদিকে উইলের পাওয়ার! এই দুইয়ের মাঝে পড়ে মড়া বাঁচতেও পারে, আবার মরতেও পারে বলে মনে হয় আমার! মরুক গে! চল হেঁটে আসি একটু।
     
     বাইরে বেরিয়ে দেখি, পথ ঘাট আলো দিয়ে বাঁধানো। পায়ের তলায় শক্ত জমির ছোঁয়া লাগছিল না। কেমন ভেসে ভেসে চলছিলাম। হঠাৎ দেখি, বেজায় লম্বা, প্রায় সাড়ে ছফুটের কাছাকাছি, এক ভদ্রলোক হেঁটে আসছেন। সোজা চুল। চোখে চশমা। গলা বন্ধ কোট। খুব চেনা। হিড়িম্ব চাপা গলায় বললেন, 
     
     - পিকে হ্যায় সালা! 
     
     - আজ্ঞে? পিকে? সে তো আমীর খান! 
     
     আমাকে চমকে দিয়ে হিড়িম্ব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। 
     
     - তোফা! তোফা বলেছিস! একেবারে খানে খানে মিলে গেছে! হো হো হো হো! 
     
     ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন। গুনগুন করছেন। বাগেশ্রীর সুর। 
     
     - ক্যায়সে কাটে রজনী এ সজনি! 
     
     আর চিনতে বাকী থাকে? সোজা পায়ের ওপর ডাইভ দিলাম। কাঁপছি। ভদ্রলোক আমায় টেনে দাঁড় করালেন। 
     
     - খড়ে হো যাও ইয়ার! কেয়া তুম মুঝে পহচাঁনতে হো? 
     
     মাথা নাড়লাম।
     
     - তো ম্যায় হুঁ কওন ইয়ে তো বঁতাও পহেলে! রাজকাপুর ইয়া দিলীপ কুমার? 
     
     হিড়িম্ব তখনো হাসছেন। 
     
     - ব্যাটা তোকে আমীর খান ভেবেচে! হে হে হে! 
     
     ভদ্রলোক ছেলেমানুষের মতো হেসে ফেললেন। 
     
     - ইয়া আল্লা! আদাকারি কোই উনসে শিখে! লেকিন, গাওয়াইয়া ম্যায় থোড়াসা জাদা অচ্ছা হুঁ! 
     
     হিড়িম্ব বললেন, 
     
     - তোর নেইমসেক এখনো আসেনি এখানে। কিন্তু, তুই সুরলোক ছেড়ে এখানে নেমে এলি কী বলে? আর টেনেছিস কোত্থেকে? হ্যাঁ? 
     
     সুরগন্ধর্ব আমীর খান সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। একদম অন্যরকম গলায় বললেন,
     
     - সুর পে নশা, সুর পে খুদা। ম্যায় নশেমে হুঁ কিঁউকি সুর মে হুঁ। আচ্ছা সুনো, তুমহার ভাসাতেই বলি। হামি কলকাত্তার ফুটপাথে শুয়েছি, রাণ্ডীবাড়ি থেকে পাঁইট এনেছি, মস্ত আইয়াশি করেছি...মুঝে শরম নহি আই! সোব লড়কি হমার সহেলি থি! কিসিকো বহেন ইয়া বেটি নহি বোলা! অব বতাও! তুমকো কোই বোলা হ্যাঁয় কে আমীর খান - ইয়ে নামসে ঘিন আতি হ্যায়? নহি বোলেঁ না? পুছো কিঁউ? কিঁউকে সঙ্গীত আমীর খান সে শও গুনা বড়া হ্যায়। অন্দর মে আঁধিয়ারা হ্যায়; মগর উসকা সামনা করনা পড়তা হ্যায়। চাহে যিতনে হি শরাব পী লো : মরনা হ্যায় তো সুর পে মরো। তুমহে পতা হ্যায়? তুমহারা কলকাত্তা মে ম্যায় রিওয়াজ কর রহা থা। অচানক এক গান্ধার নিকলি গলে সে। ম্যায় সমঝ গয়া কি টাইম আ চুকা হ্যায়! ইয়ে সুর লগ জানে কে বাদ আদমি জিন্দা নহি রহতা। উসকে বাদ ইঁহা চলা আয়া। তুম ভি আ চুকে হো। অব জমেগি মহেফিল! আঁধিয়ারা কো জগমগা দেঙ্গে। 
     
     হঠাৎ একটা হুঙ্কার শোনা গেল।
     
     - সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে বসেছি পাথরে বলে - 
     
    মদ দাও শুধোয় সন্ন্যাসী -
     
     তুমি এ ছাড়া যা চাও পাবে মোর কাছে - 
     
     স্বর্গও বিস্তৃতভাবে আছে। 
     
     পা থেকে মাথা অবধি টলমল করছে। কিন্তু তর্জনী উঁচিয়ে শাসন করছেন সৃষ্টিকে। হিড়িম্ব দেখলাম মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। জানতে চাইলাম, 
     
     - এ কেমন ভাব?
     
     - আরে, এ ব্যাটা ভৈরব। স্রষ্টা। সব কিছু লণ্ডভণ্ড করতে চায়। বলে, লুঠ হবে। ঘরের মধ্যে অবনীর খোঁজ আনে। অনন্ত কুয়োর জলে চাঁদ ফেলে রাখে। এর বুকের ভেতর বৃষ্টি নামে।
     
     ভদ্রলোক সামনে এসে পড়েছেন। টাক মাথা, সাদা গোঁফ। চোখে চশমা। বুশ শার্ট আর ট্রাউজার পরা। মুখে খেয়ালি হাসি। 
     
    -আরে ব্যাটা, সমবয়সী বন্ধু তুষার রায় বলেছিলো আমি নিজেকে বেচেছি। কী বলেছিল জানিস? 
     
    এখন খেতেছো ড্রাই মার্টিনি আগে খেতে শুধু তাড়ি 
     নন্দ বাজারে আজ আনন্দে খোঁজো অবনীর বাড়ি। 
     
     আমি কি বেচেছিলাম নিজেকে? হ্যাঁ, কিছুটা তো বটেই। অনেক আপোস। প্রেম। বিষের জ্বালা। 
     
     লখীন্দরের ঘর ভাঙলো কিসে? 
     
    নীলিমা নীল তীব্রতম বিষে। 
     
     ভাঙার চেয়ে গড়া কঠিন অতি 
     
    এসব কথা বুঝেছি সম্প্রতি। 
     
     তুই অন্ধকার নিয়ে ভাবছিস? কত অন্ধকারকে হজম করেছে এই শক্তি চাটুজ্জে যদি জানতিস! মদে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছি। অন্ধকার শুধিয়েছে, কাছা দেয় মদের দোকানি? মদ আর মরণ এক হয়ে গেছে। তাই হিমানীশ গোঁসাই দেখেছিলো, নেশায় চুর হয়ে আমি বলছি, ঘুমিয়ে পড়ো সব ঠিক হয়ে যাবে! ঘুমিয়ে পড়ার পর এখানে এসে দেখি, সব আলো; সব ভালো। আমাদের বহেড়ুর বাড়ির সুসংবাদের গন্ধের মতো।
     
     বলতে বলতেই কবি শিল্পীর পানে চাইলেন। 
     
     - আরে! সেই বুড়োটা না? অ্যাই! গানকা কুছ জানা হ্যায়? বুঝা হ্যায় রবীন্দ্রসঙ্গীত তুমহারা তুম তানা নানা সে আচ্ছা?
     
     বলেই আকাশ কাঁপিয়ে ধরলেন, 
     
     - যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙলো ঝড়ে। 
     
     হিড়িম্ব বিড়বিড় করলেন,
     
     - হয়ে গেল! এখুনি এসে জুটবে! মাতালের মোচ্ছব হচ্ছে আজ!
     
     - আজ্ঞে আপনাদের এখানকার মদ বড় ভালো। বাতাস থেকে টেনে নেওয়া যায়। গলা জ্বলে না। বমি হয় না। হাত কাঁপে না। মাথা পরিষ্কার থাকে। মার্ক্স, ফ্রয়েড, ইয়ুং, অ্যাডলার সব মনে আসে। মোৎসার্ট কনচের্তো, মাইহারে শেখা বাজ সব - সব স্পষ্ট। নেশায় চুর - তবু বুঝি আমি যজ্ঞ করি। আমি ঋত্বিক।
     
     হিড়িম্ব বললেন, 
     
     - শব্দ- ছবির বিয়ে দিস, সেটা বল? ব্যাটা ঘটক! 
     
     দীর্ঘদেহী। তলোয়ারের মতো চাহনি। চোখ দিয়ে আমাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ঈশ্বর বললেন
     
    , - অন্ধকার। ভেতরে বাইরে। তোর বোনকে তুইই কামনা করছিস। মারছিস তাকেই। বাংলা জুড়ে ভূতের নাচনের দায় তোরও। কী করবি? ওই যে, যে গানটা শক্তি গাইছে, তাকে ভাঙবি। তোর প্রিয়ার ছায়া আকাশে মুখ তুলবে , আর - যে রাতে মোর। দুয়ারগুলি। ভাঙলো ঝড়ে। এই তিনটে বীটে শপাং শপাং শপাং করে চাবুক পড়বে।
     
     আমার কেমন অস্থির লাগছে। আর নিতে পারছি না। ঋত্বিক ঘটক হাসছেন। শক্তি চাটুজ্জে হাসছেন। ওদিকে জাগছে নাদব্রহ্ম। 
     
     নাভি থেকে উঠে এল এক পূকার। রাঘ মেঘের ওই ঘনঘটায় গান ধরেছেন আমীর খান।
     
     তাদিম তাদিম তা দেরেনা। 
     
     বৃষ্টি নামলো। 
     
     তারপর থামল একসময়। 
     
    আমাকে ভিজে একশা কাপড়জামায় গাছের নীচে বসে থাকতে দেখে হিড়িম্ব এগিয়ে এলেন। বললেন, 
     
     - চ', নাট্যশালা যাই।
     
     - আজ্ঞে, সেখানে কেন? 
     
     - তোর মনের পাপবোধকে কাটাতে গেলে সেখানে যেতেই হবে রে! শোন, তুই তোর একটা ইমেজ বাইরে প্রোজেক্ট করিস তো? থিং ইজ, ওটা তুই অ্যাসিমিলেট করছিস না। একটা স্পিল্ট আসছে। কী করে অ্যাসিমিলেট করে সেটা শিখতেই তোর ওখানে যাওয়া দরকার। আসলে, তোদের সো কলড সভ্যতা এই সমস্যাটার জন্ম দিয়েছে। আর্য সংস্কৃতায়ন। সংস্কৃত মানে জানিস তো? পলিশড, রেকটিফায়েড। মানে, আমাদের ওয়ে অফ লাইফের চেয়ে ভীমেদের ওয়ে বেটার। আমার বোনকে ভীমে বলেছিলো, তুমি মনে মনে রাক্ষসী নও। এখানে এসে, ব্যাটাকে জিগিয়েছি। হিড়িম্বাকে যদি রাজার ব্যাটার বউ হতে হয়, তবে সভ্য হতে হবে কেন রে? চুপ করেছিলো! অসভ্য কারা? যাদের ভেষজবিদ্যা হিংসে করার মতো; যাদের অসম্ভব রিচ একটা ওরাল ট্র্যাডিশন আছে; যাদের নিজস্ব একটা গণিত-চিত্রশিল্প-সঙ্গীত আছে, আছে সমাজবোধ; যাদের মেয়েরা খোলা বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়; আর যারা শরীরটা খোলা রাখে!! হে হে হে!
     
     হিড়িম্ব দুলে দুলে হাসতে লাগলেন।
     
     - তোরা সভ্য ভারতভূমির উত্তরাধিকারী! তাই এই সমস্যায় পড়েছিস। আমার অসভ্য রীতি তো তোর জন্যে নয়! বললেও তুই সেটা পারবি না অবশ্য! 
     
     - কী সেটা? 
     
     - ল্যাংটো হতে পারবি?
     
     - অ্যাঃ?! 
     
     - হ্যাঁ! দেহে মনে। পারবি?
     
     - না...মানে... 
     
     - পারবি না। কারণ আমাদের অলজ্জ, সরল নগ্নতাকে তোরা নোংরা করে দিস! সাঁওতাল মেয়ের প্রকৃতির বুকে স্নান করার ছবি তুলে, জারোয়া মা-র বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর ছবি তুলে, ফেসবুকে দিস তোরা! ল্যাংটো হয়ে, সূর্যের পানে চেয়ে, নিজের প্রতিটি অনুভূতির দায় অলজ্জভাবে গ্রহণ করার শক্তি আছে তোদের? তোরা ঘেরাটোপে ঘিরিস সব। সততার চেয়ে বড়ো হয় গ্রহণযোগ্যতা। তোদের সম্পর্ক, তোদের পরিবার আদতে প্রথাবদ্ধ গ্রহণযোগ্যতা অর্জনকৌশল। বহুক্ষেত্রেই। তোরা বলবি, এর নাম সুসভ্য শৃঙ্খলা। আমি বলবো এর নাম সুসভ্য শৃঙ্খল!
     
     হিড়িম্ব দম নিলেন। 
     
     - আমার মত তোকে মানতে বলছি না। শুধু বলছি, সমাজশৃঙ্খলার জন্য প্রথা অনুসরণ, আর রিহারস্যাল দিয়ে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করার মধ্যে বিশেষ পার্থক্য আমি অন্তত দেখি না। আর সেখানেও সেই ঘেরাটোপ। নাগরিক আবরু! যাত্রার খোলা মাঠ তোদের জন্য নয়। ইউ আর থিয়েটার পীপল! তাই চল, অভিনয় শিখবি।
     
     একটা বড়ি। চারদিক খোলা। চারটে থামের ওপর ত্রিভুজের মতো ছাদ। আগাগোড়া সাদা মার্বেলে গড়া ভেতরে একটা জমায়েত। পাথরের বেঞ্চিতে ঝুঁপো গোঁফওয়ালা এক বৃদ্ধ বসা। তাঁকে ঘিরে বেশ কয়েকজন বয়স্ক পুরুষ। বৃদ্ধ বলছেন, 
     
    -বোসদের নন্দলালকে বলেছিলুম, তুমি কি হয়ে যেতে পারো? আমার যখন বিড়াল ভাব হয় আমি খাটের তলায় ঢুকতে চাই। স্টেজে আমিই যোগেশ। আমার সাজানো বাগান শুকিয়ে গেলো। 
     
     কথাটা এমনভাবে বললেন যে, আমার মনে হলো শ্মশানের বুকে জড়ো হওয়া মড়ার খুলির ফাঁক দিয়ে শোঁ শোঁ করে হাওয়া বয়ে গেল! গায়ে কাঁটা দিলো। চশমা পরা, টাকমাথা, এক ভদ্রলোক হাসলেন।
     
     - ওটা নিজেকে যোগেশ ভেবে বলেছিলেন? তার মানে হয়ে উঠেছিলেন? তাহলে, প্রচণ্ড মদ খেতেন প্রতি শো-তে? যোগেশের অ্যালকোহলিজম, হাত কাঁপা, একদম ন্যাচারাল হতো তো? - কই না তো! - স্টেজে দর্শকের দিকে পেছন ফিরে দাঁড়াতেন? প্রফুল্ল, রমেশ, সুরেশ এদের গার্ড করতেন? 
     
     - না!
     
     - সে কী বড়বাবু? এত গুলো বাইরের নিয়ম মেনে আপনি যোগেশ হয়ে যেতেন কী করে?
     
     বৃদ্ধ একটু গম্ভীর হলেন। তারপর হাসলেন। 
     
     - আমি বুঝেছি উৎপল। তুমি বলছে স্টেজই একটা আর্টিফ্যাক্ট?
     
     - ঠিক তাই বলছি বড়বাবু। স্টেজের সামনেটাকে ফোর্থ ওয়ল মনে করে কী হবে? ওখানে দেওয়াল থাকলে কেউ আপনাকে দেখতেই পেত না! আসল কথা, আপনি, নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র, দর্শককে বিশ্বাস করাচ্ছেন, আপনি যোগেশ। আর স্টেজ কখনো বাড়ি, কখনো রাস্তা, কখনো আদালত। নিজে থাকছেন চরিত্রের বাইরে। অভিনয় মানে স্রেফ বোকা বানানো। 
     
     - কিন্তু এটা করছি কেন? একটা রীজন তো চাই? 
     
     - আছে তো! মানুষই হোক বা সমাজ, তাদের ভেতরে দুটো অপোজিট ফোর্সের খেলা চলছে। ভাঙছে, গড়ছে, শেষে একটা নতুন কিছু হচ্ছে। যেমন পান। পানপাতা, সুপুরি, খয়ের - আলাদা করে কোনোটাই পান নয়। এমনকি পানের খিলিও পান নয়। মুখে নিলাম, চিবোলাম, মস্তিষ্কে স্বাদের সেন্স এল : এই টোটালিটির নাম পান। তেমনি একটা টোটাল সিনথিসিস দেখানোই আমাদের কাজ। এটাই আসল হয়ে ওঠা। শম্ভুদা কী বলেন?
     
     ব্যাকব্রাশ করা চুল, ভদ্রলোক, একটা বিশেষ সুরে বললেন, 
     
     - নিশ্চয়ই। আমি অবশ্য হয়ে ওঠা বলতে একটা আরবান, ইন্ডিয়ান স্পিরিটের খোঁজ বুঝি। সফোক্লেস, রবীন্দ্রনাথ, ব্রেশট - সবার মাধ্যমে আমি আমার দেশকে ছুঁতে চেয়েছি। 
     
     - আপনার ভারতাত্মা সংগ্রামের কথা বলে? সমাজ বদলের কথা?
     
     - বদলটা তো স্বতঃসিদ্ধ উৎপল। ইনভায়োলেট স্পিরিট বদলকে অ্যাডাপ্ট করে কী করে সেটাই দেখার।
     
     - উঁহু! মিলছে না! তাহলে রক্তকরবীর ওরকম রূপ দিলেন কেন? শেষ সিনে মাদলের বীট? বিশুর ওয়র ক্রাই - আয় রে ভাই! এবার লড়াইয়ে চল? ক্ষমতার ভার ভেতর থেকে যতই তাকে ফোঁপরা করুক, বাইরে থেকে একটা ঠেলা তাকে মারতে হয়, এমনটাই মনে হয় যে, এ নাটক দেখলে? নবান্ন-র প্রথম দৃশ্যের মশালের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে, মনে হয় যে! 
     
     ভদ্রলোক চুপ করে রইলেন। যাঁর নাম উৎপল তিনি আবার হাসলেন। 
     
     - রাজা-র অন্ধকার আত্মবোধনের তমিস্রা। তার মুখোমুখি হয়ে নিজেকে চিনে, ভিন্ন ভিন্ন হয়ে ওঠা পেরিয়ে, অভিনেতা বোঝে, তার শিল্পনাম নী ধাতু থেকে এসেছে। এর মানে নিয়ে চলা। দর্শককে সে নিয়ে চলে একটা স্বপ্নের দিকে। একটা সমাজ বদলের স্বপ্ন। যখন অন্যায় শোষণ, অবদমন, ভণ্ডামি - সবকিছুর পতন - চরমতম পতন হবে! এটাই আমাদের কাজ। এভরিথিং এলস্ ইজ আ ব্লাডি ওয়েস্ট অভ টাইম! 
     
     চোস্ত সাহেবি উচ্চারণ! কিন্তু, এঁরা ঠিক কী বললেন? নিজের আঁধারকে মেনে নিয়ে রোল প্লে করতে হবে বুঝলাম। কিন্তু, এঁরা তো বলছেন, একটা স্বপ্ন বুকে ধরে রাখতে। 
     
     আমার সে স্বপ্ন কই? 
     
     আছে?
     
     কখনো ছিলো? 
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • লঘুগুরু | ১৫ নভেম্বর ২০২১ | ১৩০৫ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রণছোড় - Chayan Samaddar
    আরও পড়ুন
    মালিক - Chayan Samaddar
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন