ইমফল ও কোহিমা - মহত্তম/বিস্মৃত লড়াই
শুরুর আগে
********************
শুরু করতে হবে আই এন এ নিয়ে। মিলিটারী দিক দিয়ে এর ভুমিকা সামান্য হলেও কোহিমা ইমফল অভিযান নেওয়ার সিদ্ধান্তে এর অবস্থান গুরুত্বপুর্ণ ছিলো।
উত্তর আফ্রিকায় এবং পরে ইতালীতে ভারতীয় সেনারা ভালই লড়াই দিয়েছিলো। যদিও কিছু ঐতিহাসিকরা নেহাৎই ফু ফু করে উড়িয়ে দেন। জাপানীদের চোখে কিন্তু ভারতীয় সেনারা একেবারেই পাতে দেবার যোগ্য ছিলো না। কেনো না দক্ষিন পুর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সেনাদের কীর্ত্তি কলাপ খুবই লজ্জার ছিলো।
এখানকার ভারতীয় সেনারা ভালো মতন ট্রেইনড ছিলো না আর তাদের নেতৃত্বে যেসব ব্রিটীশ বড়কর্ত্তা ছিলেন ,তাদের অল্প কয়েকজন বাদ দিয়ে বাকী সবাই ছিলেন নিতান্ত অকর্মণ্যের ঢেঁকি বিশেষ।
ভারতীয় সেনাদের খুবই তাচ্ছিল্য করা হোতো। একই পদে ভারতীয় সেনা পেতেন মাসে ১৮ টাকা, সেই পদেই সাহেব সেনানী পেতো ৭৫ টাকা। আর্মির হায়ার্কি ও মানা হোতো কই? কোনো ব্রিটীশ সেনাই তার অফিসার সে যদি ভারতীয় হোতো,তবে তাকে সেলুট করতো না। ক্লাবে তো বটেই,ট্রেনের কোচেও ইওরোপীয়ানদের সাথে ভারতীয়রা যেতে পারতো না। আর্মির অফিসার হলেও না। মালয়ে এবং সিংগাপুরে, ভারতীয় সেনাদের ভুমিকা ছিলো খুবই লজ্জার। আফ্রিকায় থাকা ইতালিয়ান সেনা বা রাশিয়ার যুদ্ধে জার্মানীর সহযোগী হিসেবে হাংগেরিয়ান বা রুমানিয়ান সেনাদের এরকমই নামডাক ছিলো। বলা হোতো fragile shell একটা টোকা মারলেই ভেঙে পরবে।
এই সেনানীরাই আর বেশ কিছু সিভিলিয়ান ভলান্টিয়ার - এরাই ছিলো আই এন এর মুল শক্তি।
এবং জাপানীরা
*******************************
১৯৪৪ সালের মার্চ এপ্রিল মাস। আমেরিকানেরা ক্রমাগতঃ যুদ্ধে জিতে চলেছে। আর মার্কিন হানায় জাপানে রসদের যোগানদারী ক্রমশঃ কঠিন হয়ে পরছে। সম্রাট হিরোহিতো ছ মাস আগেই জানিয়েছেন "পরিস্থিতি খুবই গম্ভীর"। আমদানী কমে গেছে ৪০%। বেশ একটা ডিফেনসিভ অবস্থা।
সে সময়ে বার্মাতেও জাপানে সংঘাতের কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। জাপানী জেনারেলেরা বার্মাকে বলতেন জিগোকু মানে নরক আর ওখানে পোস্টিং মানে হচ্ছে পানিশমেন্ট পোস্টিং। কেনো যে এই ক্রিটিকাল সময়ে জাপান আরো রণাংগন বাড়াতে চাইলো - তাও ও একেবারে এক ভয়ানক টেরেইনে? এবং মনসুনের ঠিক আগে আগে?
কিছুটা কারন ছিলো জেনারেল মুতাগুচি। অতি উচ্চাকাংখী এই জেনারেলকে ঘোর অপছন্দ করতেন তার সব অফিসারই। তাঁরও সখ ছিলো "একটা কিছু করে দেখাই"।
তার দুত গেলে টোকিও তে , প্রধানমন্ত্রী তোজোর সাক্ষাতে। তোজো তখন স্নান করছেন। বাথরুমে দাঁড়িয়েই কথাবার্ত্তা হোলো। তোজো সামান্য কিছু প্রশ্ন করেই জানালেন "বেশ, ঠিক আছে। কিন্তু মুতাগুচি যেনো বেশী উচ্চাশী না হয়। আমরা খুব একটা হেল্প করতে পারবো না"। এই বলে উলংগ অবস্থাতেই নির্দেশনামাতে সাক্ষর করে দিলেন।
ব্যাস। জাপানের সব থেকে রক্তাক্ষয়ী লড়াইএর একটির ফয়সালা হয়ে গেলো।
মুতাগাচির একটা বিশ্বাস ছিলো যে আই এন এর সেনাদের নিয়ে হামলে করলেই সারা ভারত জুড়ে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। বকলমে লড়াই করে তোফা জিতে যাবে জাপানীরা।আর সেকেন্ডলি, তার দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতায় ভাবতেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি ও নিতান্ত এলেবেলে। খুব সহযেই কেল্লা ফতে হবে।
যুদ্ধের প্রস্তুতি
*******************************
সব্যস্ত হোলো যে দক্ষিনে ইমফল (মনিপুরে)প্রথমে দখল করতে হবে। তবে ইমফলে যাতে যোগান আসতে না পারে সেই মত প্রায় দেড়শো মাইল উত্তরে কোহিমাতেও (নাগাল্যান্ডে) একসাথে আক্রমন করা হবে। জাপানী সেনারা স্কাউট পাঠালেন চুপ চাপ সব খবরাখবর নিতে। তারা কিন্তু ভালই কাজ করলেন। কেনো ইমফল ? কেনো না একটা এয়ারপোর্ট নিয়ে ইমফল বেশ গুরুত্বপুর্ন একটা লজিস্টিক হাব। ওর থেকেও বড়ো হাব হছে ডিমাপুর, কোহিমা থেকে প্রায় ষাঠ মাইল দুরে । ইমফল হয়ে কোহিমার পাশ দিয়েই সেই পাহাড়ী পথ, নাগা হিলসের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে গেছে ডিমাপুর পর্যন্ত্য। কোহিমা দখল করে নিলে ইমফল ও রুদ্ধ হয়ে যাবে। তাই প্রাথমিক লক্ষ্য ইমফল আর দ্বিতীয়তঃ কোহিমা হলেও জাপানীদের মুল টার্গেট ছিলো ডিমাপুর। এই দুটো ঘাঁটি নেহাৎই স্টেপিং স্টোন।
মুতাগুচি জানতেন যে তার নিজের রসদ যোগার করা অসম্ভব। কাছাকাছি গ্রামের থেকেও খাবার যোগার করা সম্ভব নয়। পাহাড়ী জংগুলে যায়গায় চাষ বাস হয়ই বা কই তেমন? বন বাদার থেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে খাবার যোগায় আদিবাসীরা। আর ঐ উঁচু পাহাড়ী যায়গায় ভারী ট্রাক নিয়েও ওঠা যাবে না।
মুতাগুচির অধস্তনেরা কিন্তু এই বেপরোয়া অ্যাডভেঞ্চারিসম একেবারেই পছন্দ করছিলেন না। তাদের সকলেরই সংশয় ছিলো সাপ্লাই নিয়ে। একমাত্র টিঁকে থাকা সম্ভব যদি ঝটপট তারা ব্রিটিশ সাপ্লাই গুদাম দখল করে নিতে পারেন। কিন্তু সে এক অবিশ্বাস্য গ্যামবেল। কিন্তু মুতাগুচি ওদের কথায় কান দিলেন না।
কুছ পরোয়া নেই। তিনি চেংগিস খানের কৌশল নিলেন। "খাবার আমাদের সাথে হেঁটে হেঁটেই যাবে" এই ধরনের অদ্ভুত আইডিয়ায় তিনি পাঁচ হাজার ষাঁড়, বলদ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। খাবার কম পরলেই এই চলমান খাদ্য ভান্ডার রয়েছে। কেটে কেটে খাবেন ! মাস দুয়েক চলে যাবে এই আশা ছিলো জাপানীদের কিন্তু এই বিশাল গো মিছিলের মাত্র হাজার খানেকই বন বাদাড় পেরিয়ে পৌঁছাতে পেরেছিলো ইমফলে।
আরো ভুল করলেন কোনো ভারী আর্টিলারী নিলেন না। ভাবলেন ব্রিটীশদেরই বা সেই সব কোথায় ঐ পাহাড়ী যায়গায়। এমন না যে ট্যাংক নিয়ে যুদ্ধ করবে ব্রিটিশেরা। জাপানীদের ট্যাংক ও ছিলো খুবই খেলো টাইপের। সেই লাইট ট্যাংকও ছিলো সামান্য কটি । সব মিলিয়ে খাবার দাবার ছিলো মেরে কেটে তিন সপ্তাহের। ব্যাস। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে লড়াই শুরু করে মে মাসের আগেই শেষ তো করতেই হবে। এরপরই ঘন ঘোর মনসুন।
সব কটা সিদ্ধান্তই একেবারে ভুলে ভরা ছিলো ।
ইমফলের ফলাফল
*****************************
মুতাগুচি খবর পেয়েছিলেন যে ইমফলে ব্রিটিশেরা প্রতিরক্ষা জোরদার করে তুলেছেন। সেই মত, সীমান্ত ঘেঁষে বার্মার আরাকানে তিনি একটা ডাইভারশনারী এটাক শুরু করলেন ফেব্রুয়ারীর মাঝামাঝি।
দু বছর আগে জাপানীরা, ব্রিটিশদের কাছ থেকে এক ঝটকায় বার্মা ছিনিয়ে নেওয়ার পর থেকেই ব্রিটিশেরা খুব প্ল্যান করে ইমফলকে একটা ঘাঁটি তৈরী করছিলেন। রাস্তা ঘাট তৈরী হচ্ছিলো, এয়ারপোর্ট বানানো হয়েছিলো। তাদের কাছেও খবর ছিলো জাপানীরা ইমফল আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু তারা যথেষ্ট তাড়াহুরো করেন নি। বড্ডো গা জোয়ারী ভাবে চলছিলেন । তাছাড়া তাদের পাওয়া খবরের ভিত্তিতে ব্রিটিশের ধারনা ছিলো মার্চের মাঝামাঝি আক্রমনের দিন। কিন্তু জাপানীরা খুব দ্রুত ইম্ফলের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলো - সেটা মার্চের সাত তারিখেই।
****(এই লেখাটায় ব্রিটীশ সেনা বলতে কিন্তু আমি ব্রিটীশ সরকারের সেনা বলছি। যার মধ্যে খোদ ইংরাজ ও স্কট সেনা ছাড়াও, ভারতীয় আর নেপালী সেনার ছিলো। ইন ফ্যাক্ট সংখ্যায় ভারতীয় সেনারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলো।)******
তিন দিক দিয়ে ঘিড়ে তাদের আক্রমন শুরু হলো। সাংশাক একটা ছোট্টো টিলা, সেখানে ব্রিটিশ সেনারা এক অসম যুদ্ধে জাপানীদের প্রায় দুই দিন ঠেকিয়ে রেখেছিলো - সেটা খুবই জরুরী ছিলো তখন - ঐ দুই দিনের সময় পাওয়া।
সর্বাধিনায়ক স্লিম হুকুম দিয়েছিলেন পিছিয়ে আসা চলবে না। প্রতিরোধ করে যাও। জাপানীদের দেখলেই পালিয়ে যাওয়া চলবে না, যেরকমটা ঘটেছিলো মালয়ে,সিংগাপুরে আর বার্মাতে। তিন সপ্তাহের মধ্যেই জাপানীরা সম্পুর্ন ঘিড়ে ফেললো ইমফলকে। শুরু হোলো অবরোধের লড়াই। ইমফলকে বাঁচিয়ে দিলো আমেরিকান ট্রানস্পোর্ট প্লেন। রুজভেল্টের একটু আপত্তি ছিলো চীন সেক্টর থেকে এই সব প্লেন ইম্ফল কোহিমায় পাঠানোয় কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অনুরোধে তিনি শেষ পর্যন্ত্য নিমরাজী হলেন ।
ইমফলে কোনো অভাব রাখে নি এই বিমানেরা। খাবার, জল,তেল, গোলা বারুদ, ১২ হাজার সেনা মায় পেটি পেটি সিগারেট - একেবারে অঢেল যোগান ছিলো। ফিরতি পথে প্রায় ৪৩ হাজার অসামরিক লোককে আর প্রায় ১৩ হাজার আহত সেনানীদেরও সড়িয়ে আনা হোলো ।
অন্যদিকে জাপানীদের অবস্থা ক্রমেই কাহিল হচ্ছে। রসদের ভাঁড়ার কমতির দিকে । সেনারা প্রায় অর্দ্ধহারে দিন কাটাচ্ছে। ইমফল দখলের পথে দু তিন যায়গায় যা কিছু লুটে এনেছিলো সেই খাবারই সম্বল।
কিন্তু জাপানীদের টেনাসিটি ছিলো প্রায় অলৌকিক। এই অবস্থাতেও তারা কিন্তু ইমফলর চারদিকের ঘেড়াও ক্রমশঃই ছোটো করে আনছিলেন। সব থেকে কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন প্রায় ৪ মাইল দুরে নানশিংগুম টিলায়। ব্যাস। তার পরে আর এগোতে পারে নি জাপানীরা।
আর আই এন এ ?
*******************************************
মুতাগুচির আদৌ ইচ্ছা ছিলো না আই এন এর সেনাদেরকে নিয়ে আসবেন এই লড়াইতে। আরো সাত আট হাজার সেনাকে খাওয়াবেন কি ভাবে?
তার স্ট্র্যাটেজি ছিলো সিম্পল। ইমফলের পতন ঘটলেই এই আই এন এ সেনারা ডিমাপুর হয়ে ভারতের একেবারে ভিতরে গিয়ে লয়াল ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদের দলছুট করবেন। সিংগাপুর পতনের ঠিক আগে এরকম প্রায় দুশো দলছুট সেনা (তখন আই এন এ হয় নি) শহরে অনুপ্রবেশ করে ওখানকার ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাদেরকে দলত্যাগ করতে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিলো। মুতাগুচি ওরকমই একটা খুব গৌন ভুমিকা দিতে চেয়েছিলেন আই এন এ কে। কিন্তু আই এন এ জাপানের এক মিত্র হয়ে সমান মর্য্যাদায় লড়াই করে যুদ্ধ জিততে চেয়েছিলো। ভারতের মাটীতে ব্রিটীশ সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াইতে নিজেরাই সামিল হবেন। প্রক্সি লড়াইতে তাদের সায় ছিলো না।
সেই মতন শাহনওয়াজ খানের নেতৃত্বে চার রেজিমেন্ট (হাজার চারেক) গেরিলা ইমফলের লড়াই শুরু হবার সপ্তাহ দুয়েক পরে যোগদান করলেন। ব্রিটীশ সেনাদের সাথে আই এন এর সেনাদের কয়েকটি ছোটোখাটো মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়েছিলো - খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। তবু ইতিহাসে লেখার মতন ঘটনা যে ইমফল থেকে ৪৫ মাইল দুরে মইরংগ শহরে আই এন এর স্বাধীন ভারতের পতাকা উঠেছিলো রীতিমতন যুদ্ধে জিতেই ।
মুতাগুচি কিন্তু আই এন এ কে তাচ্ছিল্যের চোখেই দেখলেন এবং এরকমই এক ব্যাটালিয়নকে যুদ্ধ থেকে সড়িয়ে স্রেফ রাস্তা সারানোর দায়িত্ব দিলেন আর সে সব খুব ফলাও করে ছাপাও হোলো জাপানী কাগজে। অতি বিরক্ত শাহ নওয়াজ তার গেরিলাদের বল্লেন বেস ক্যাম্পে ফিরে যেতে।
মে মাসের মাঝা মাঝি আর ইমফলে জাপানীদের দম ফুরিয়ে গেছিলো। তাই আই এন এ কে নির্দেশ দেওয়া হোলো কোহিমায় চলে যেতে। কিন্তু তারা যখন কোহিমায় পৌছালেন তখন আর লড়াই নেই। কমান্ডার সাটো তার জাপানী সেনাদের নিয়ে ফিরে আসছেন।
অগত্যা আই এন এর সেনারা ইমফলের কাছে টামু রোডে অবস্থান করলেন। ওখানে দিন পনেরো তাও ও কিছু সংঘর্ষ হয়েছিলো গুর্খা বাহিনীর বিরুদ্ধে। তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য লড়াই নয়। তখন তো পুরো সেক্টর জুড়েই জাপানীদের পিছু হটে আসার পালা। এরপর জুন মাসে ইমফল-কোহিমা পুরোপুরি পরিত্যাগ করলো জাপানীরা। আবার বার্মার পথে, আই এন এর সেনারাও একসাথে ফিরে আসলেন। অনেকেই বন্দীও হয়েছেন সেই সময়ে।
এবং কোহিমা -প্রাচ্যের স্তালিনগ্রাড
**************************************
কোহিমা একটা ছোট্টো টিলা মাত্র। তার পাশ দিয়েই এঁকে বেঁকে গেছে ডিমাপুর পর্যন্ত্য রাস্তা। শহর না বলে গ্রাম বলাই ভালো। সেখানে এক চরম সংঘর্ষ হলো জাপানী ও ব্রিটীশের মধ্যে। প্রথম দিকে ১৫ হাজার জাপানী সেনার বিরুদ্ধে ছিলো মাত্র ১৫০০ ব্রিটীশ সেনা। পরে । পরে ডিমাপুর থেকে আরো সেনারা যোগ দেবে এই লড়াইতে।
প্রায় ৬৪ দিন ধরে কোহিমায় অবরোধ চলে। ছোটো যায়গা তাই অ্যার লিফট করে খুব সুবিধে হয় না। প্যারাড্রপ করা যোগানের অনেকটাই জাপানীদের হাতে এসে পৌছায়।রিলিফ দিতে ডিমাপুর থেকে সেনাদের রীতিমতন লড়াই করে জাপানী ঘেড়াও ভেঙে তবেই ভিতরে ঢুকতে হয়েছিলো।
আর লড়াইটাও ছিলো একেবারে হাতাহাতির লড়াই। সব থেকে রক্তাক্ত ছিলো "টেনিস কোর্টের লড়াই"। নো ম্যানস ল্যান্ড। তার দুই দিকেই দুই যুযুধান সেনা। লড়াই হয় মুলতঃ গ্রেনেড ছুঁড়ে। স্তালিনগ্রাডের মামায়েভ কুরগান টিলার লড়াইও এরকমই ছিলো। এক বৃটীশ সেনার জবানীতে "প্রতি রাতেই জাপানীরা আক্রমন করতো। একদিন সন্ধ্যা সাতটায় তাদের আক্রমন শুরু হয়ে চলেছিলো সারা রাত। ঢেউএর মতন, বারে বারে। একটানা। আরেকজন জানালেন "আমাদের আর নার্ভ বলে কিছু নেই। ট্রেঞ্চে কাদার মধ্যে বসে থেকে জলে ভিজে,ঠান্ডায় আর ক্ষিদেয় কাতর হয়ে শুধু ভাবতাম কবে এর থেকে মুক্তি পাবো?"ডিমাপুর থেকে ব্রিটীশদের হাতে এসেছিলো প্রচুর কামান। মাঝারী ও ভারী কামানও। এক ব্রিটীশ সেনা বলেছেন জাপানীরা কোনো "সারপ্রাইজ অ্যাটাকে" বিশ্বাস করতো না। দুরের ত্থেকে ভয়ানক চেঁচাতে চেঁচাতে তারা আসতেন। সেই আওয়াজ শুনেই রেডিও টেলিফোনে খবর পাঠানো হতো আশ পাশের টিলায় রাখা গোলন্দাজ বাহিনীকে। তারাও নিপুন লক্ষ্যে ছিন্ন ভিন্ন করতো জাপানীদের। পুরো প্যাসিফিকে যেমন ঘটেছিলো এখানেই একই ব্যাপার। জাপানীরা আত্মসমর্পন করতো না। যতোক্ষন পারতেন লড়াই করে মারা যেতেন।
এই সময়ে জাপানীদের একটা খুব ভালো অপশন ছিলো কোহিমাকে বাদ দিয়ে সোজা ডিমাপুরে আক্রমন চালানোর। মুতাগাচি সেই রকম প্ল্যান করে এগিয়েও ছিলেন খানিকটা কিন্তু তার উর্দ্ধতন অফিসার সেটা নাকচ করে দিলেন।
কোহিমার লড়াইতে নেতৃত্ব ছিলো সাটোর হাতে। ব্রিটিশ জেনারেল স্লিম বলতেন "আহা, এরকম মাথামোটা প্রতিপক্ষ থাকলে আমাদের যুদ্ধ হারবার চান্সই নেই"। বিমান বাহিনীকে বলতেন, আর যাই কোরো,সাটোর হেড কোয়ার্টারে বোম ফেলো না। ও যতোদিন টিঁকে ততই আমাদের ভালো।"
সাটোর সেনারা প্রায় অনাহারেই থাকছিলেন। যদিবা একটা সাপ্লাই কনভয় এসে পৌঁছালো তো দেখা গেলো তাতে শুধ গোলা বারুদই আছে,খাবার নেই। সাটো পিছু হটে আসতে চাইলেন। ততোদিনে ব্রিটিশেরাও অনেক জোরদার হয়েছেন। একটা বুলডোজার নিয়ে কোনো রকমে একটা"পথ" তৈরী করে একটা গ্রান্ট ট্যাংক পাঠালেন তারা সেই টেনিস কোর্টের রনাংগনে। উঁচু টিলার থেকে প্রায় আছেড়ে পরলো সেই ট্যাংক, কিন্তু যেটুকু সচল ছিলো তাই সেই ট্যাংক জাপানীদের কচুকাটা করে ফেললো।
মাতাগুচি কিন্তু মানা করেছিলেন।"পিছু হঠা চলবে না"। কিন্তু সাটো বল্লেন হয় রসদ পাঠাও নইলে রইলো তোমার কোহিমা। আমরা ফিরে আসছি পয়লা জুন। একেবারে আল্টিমেটাম। মাতাগুচি জানালেন "নির্দেশ অমান্য করে পিছু হটলে তোমায় কোর্ট মার্শাল করা হবে"। সাটো উত্তরে জানালেন "আপনার যা ইচ্ছে তাই করুন"। এবং ৩১শে মে তিনি সদলবলে কোহিমা ছাড়লেন। কিছু সেনাদের অবশ্য কোহিমায় রেখে গেছিলেন রিয়ারগার্ড অ্যাকশনের জন্য।মুতাগুচি বল্লেন ঠিক আছে, কোহিমা ছেড়ে আসতে চাও তো ইমফলে ফিরে আসো। সেখানেই জোর লড়াই হবে। কিন্তু সাতো সেই নির্দেশও অমন্য করে সোজা বার্মার পথ ধরলেন।
তার সেনাদের অনেকেরই হাঁটবার ক্ষমতাটুকুও ছিলো না। কোহিমার অবরোধ উঠবার পরই ৩ জুলাই ইমফল থেকেও জাপানীর পিছু হঠলেন।
জুলাই মাস নগাদ আর জাপানী সেনা রইলো না ভারতে। অসম্ভব রক্তক্ষয়ী লড়াইতে প্রায় ৫৫হাজার জাপানী সেনা মারা গেলো, বেশীর ভাগটাই অনাহারে আর অসুখে।
Road of bones
******************************
তখন জোরদার মনসুন শুরু হয়ে গেছে। ফিরবার পথেও নেই কোনো খাবার। প্রায় অভুক্ত সেনারা পরাজিত লাঞ্ছনার মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে ফিরছেন। তাদের সংগী ম্যালেরিয়া,ডিসেন্ট্রি আর বেরিবেরি। এক জাপানী সেনা চিঠিতে লিখেছিলেন যে কাদাগোলা পাকদন্ডী পথে বসবারও উপায় নেই। ঐ দাঁড়িয়েই যতোটুকু পারা যায় ঘুমিয়ে নিতে হয়। হাঁটতে গেলেও কাদার মধ্যে পায়ের নীচে পরে থাকে কমরেডদের মৃতদেহ। সে গুলো মাড়িয়েই চলতে হয়। পুরো পথেই বৃটীশ বিমান ঘন ঘন হানা দিয়ে গেছে।
পথের দুই ধারেই মৃতদেহের স্তুপ। কোথাও একটা জীপের ভিতর বসে চারটি কংকাল। অনাহারে অসুখে ঐ গাড়ীতেই বসে প্রানত্যাগ করেছেন তারা। এক প্যাগোডার ভিতরে অজস্র শবদেহ। কোনো রকমে শেষ নিঃশ্বাস নিতে ঐ খানে ঢুকেছিলো জাপানী সেনারা।
জাপানে সাংবাদিক মাসানরি ইতো যখন বার্মায় মুতাগুচির সাক্ষাত পেলেন উনি তখন ভাতের স্যুপ খাচ্ছিলেন। চারিদিকে সম্পুর্ন অভুক্ত জাপানী সেনাদের ভীড়। মুতাগুচি তাকে দেখেই বল্লেন "কি? স্টেটমেন্ট চাই? লিখে নিন। আমার জন্যেই হাজার হাজার সেনা মারা গেছে। আর আমিও এই চিন্দিন নদী পার হবো না"। তবে মুতাগুচি কথা রাখেন নি। তিনি কিন্তু হারাকিরি করেন নি।
হারাকিরি করেন নি সাটো ও। নির্দেশ অমান্য করে কোহিমা ছেড়ে ফিরে এসে তিনি হেড কোয়ার্টারে রিপোর্ট করতে গেলে একজন সান্ত্রী নিঃশব্দে এসে তাকে দিয়ে গেলেন সাদা কাপড়ে মোড়া ধারালো ছোটো তরোয়াল, যেটা হারাকিরির জন্য ব্যবহার হয়। কিন্তু সাটো ও ঐ "সন্মানজনক মৃত্যুর" পথ বেছে নেন নি।
তিন বছর ধরে একটানা হেরে এসে এসে ব্রিটেইন এই প্রথম জয়ের মুখ দেখলো। এর কৃতিত্বের ভাগীদার অনেকটাই জেনারেল স্লিমের। ওনার নেতৃত্ব ছিলো দারুন। ভার্তীয় বা গুর্খা সেনারা ওনার অধীনে লড়াই করতে সদাই প্রস্তুত ছিলেন। সেই সময়ের সবথেকে বড়ো পদক ছিলো ভিক্টোরিয়া ক্রস,আমাদের পরমবীর চক্রের মতন। আঠাশ জন সেনা ঐ সেক্টরে এই পদক পান যাদের বেশীর ভাগটাই ভারতীয় আর গুর্খা।
Road of bones সেই সময়ের উপরে লেখা একটি বইএর শিরোনাম। মানুষ আর পশুর পচা গলাদেহ আর কংকালের স্তুপে ভরা রাস্তা দেখে এই নাম দেওয়া হয়েছিলো
শেষের পরে
**************************************
কেউ বল্লেন পুর্বের স্তালিনগ্রাড তো আরেকজন বল্লেন এটি ভারতের থার্মোপিলী।লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও বলেছিলেন মর্যাদায় এটি নরম্যান্ডি লান্ডিং বা এল এলামিনেরই সমগোত্রের।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গ্রেটেস্ট ব্যাটেল - এই মতও দিয়েছেন অনেকে।
কিন্তু সত্যি তেমন পাত্তা পায় নি এই লড়াই বা এর সুযোগ্য অধিনায়ক স্লিম।
কিন্তু কি লাভ হোলো এই যুদ্ধে? ওকিনাওয়ার শেষ লড়াই বাদ দিলে এটাই জাপানের সব থেকে বড়ো পরাজয়। মুতাগুচির হঠকারিতার সমর্থনে অনেকে বলেন এ ছাড়া উপায়ই বা ছিলো কি? স্লিম যেরকম গুছিয়ে ইম্ফল আর ডিমাপুরে যুদ্ধ প্রস্তুতি চালাচ্ছিলেন তাতে বোঝাই যায় আজ না হোক কাল তিনি বার্মা দখল করতে আসবেনই। একই সাথে উত্তর দিক থেকে হানা দিচ্ছিলো চীনা ও আমেরিকান বাহিনী।এই প্রি এম্পটিভ স্ট্রাইক না করে উপায়ই বা কি ছিলো মুতাগুচির?
জাপান জানতো না কিন্তু সেরকম কোনো পরিকল্পনাই ছিলো না মিত্রশক্তির। ৪৪ সালেই এক গোপন অ্যাংলো আমেরিকান রিপোর্টে বলা হয় "India is at present not suitable to launch large-scale operations"। কারন হিসেবে উল্লেখ হয়েছিলো জটিল রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অবস্থা ও ট্রান্সপোর্টের খারাপ হাল।
জেনারেল স্লিম বা এই সেকটরের অবস্থা নিয়ে ব্রিটেইনের চাঁইদের কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না। যুদ্ধের পরে চীফ অফ স্টাফ লর্ড এলান ব্রুক বা চার্চিলের মেময়ের্সেও সামান্য কয়েক বারে উল্লেখ আছে এই লড়াইএর বা জেনারেল স্লিমের।
আসলে ঘাড়ের উপর সমূহ বিপদ জার্মানীকে সামলাতেই নাস্তানাবুদ ছিলো ব্রিটেইন। জাপানকে সামলানোর দায় দায়িত্ব তাই তারা আমেরিকার ঘাড়ে চাপিয়েই নিশ্চিন্ত ছিলেন। সেই সময়ে লন্ডনে আগত এক আমেরিকান মুখপাত্র প্রকাশ্যেই বলেন "It is our turn to bat in Asia now"।
এই যুদ্ধে আই এন এ মিলিটারিলি খুব কিছু সুনাম অর্জন করেন নি। ডেসার্টেশনের ঘটনাও প্রচুর হয়েছিলো। সব থেকে বড়ো ঘটনা ব্রিটীশ ইন্ডিআন আর্মি কিন্তু আই এন এ কে ভালো চোখে দেখে নি। দুই প্রতিপক্ষ ভারতীয়্রা মুখোমুখী হলে লড়াই হয়েছে জোরদার। দু দিক থেকেই অভিযোগ ছিলো অত্যাচারের আর যুদ্ধ বন্দীদের খুন করার।কোনটা এবং কতটা সত্যি বলা যায় না কিন্তু এটাই আই এন এর রাজনৈতিক পরাজয়।
কিন্তু এর ফল হয়েছিলো সুদুরপ্রসারী। প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলী বলে ছিলেন আই এন এর উথ্থান আর ৪৬'এর নৌ বিদ্রোহই ইংরাজের ভারত ছাড়ার সব থেকে বড়ো কারন। ভারতবর্ষ আর নিরাপদ ছিলো না তাঁদের কাছে।
সুমিত সরকারও তাই বলেন। জাত পাতের উর্দ্ধে উঠে স্বাধীনতার জন্য এরকম সুসংঘবদ্ধ লড়াই ব্রিটেইনের ভিৎ কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। আরো আশ্চর্য্যের যে পেশাদার সৈন্যরা স্বচ্ছন্দে মেনে নিয়েছিলো এক "নন মার্শাল রেসে"র (পড়ুন বাঙালী) এক সিভিলিয়ান নেতাকে। শেষ লড়াইর জিত সেখানেই।
******************************************************** -