এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কর্ণসংহার

    dd লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ মার্চ ২০১৬ | ২৪৭৩ বার পঠিত
  • কর্ণসংহার
    ***************************

    কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ধারাবিবরনী একটা ফরম্যাটেই লেখা হতো। দিনের শেষে সঞ্জয় ,কুরুক্ষেত্রের অনতিদুরে হস্তিনাপুর যেতেন এবং সেখানে হততেজাঃ ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধের খবর জানাতেন। প্রথমে একেবারে হেডলাইন (যেমন "ভীষ্মের নিধন হইয়াছে"),তারপরে আরো ছোটো খাটো দুঃসংবাদ। ধৃতরাষ্ট্রের
    বিলাপ ও সঞ্জয়ের ভরৎসনা তারপর উদগ্রীব মহারাজাকে ডিটেইলসে সব জানানো।

    এদিনেও (পঞ্চদশ দিনের রাত্রে) তার ব্যাতিক্রম ঘটে নি, " মহামতি সঞ্জয় রজনীযোগে উদ্বিগ্নমনে বায়ুবেগগামীশ্বসমুদয় সঞ্চালনপুর্বক সত্বর হস্তিনানগরীতে গমন করিয়া রাজা ধৃতরাষ্ট্রের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। " কুশল প্রশ্নের পরই তার বক্রোক্তি "কেমন,আপনি ত' সুখে আছেন ? আপনি আপনার দোষে ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইয়া ত' বিমোহিত হয়েন নাই ? ভীষ্ম ও দ্রোণপ্রমূখ আপনার সুহৃদগন আপনার হিতানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয় শত্রুহস্তে নিহত হইয়াছেন,ইহা স্মরণ করিয়া আপনার মন ব্যাথিত হইতেছে না ?" এছাড়াও এক লম্বা লিস্ট দিলেন- প্রথম পনেরো দিনের যুদ্ধে দুই পক্ষের কতজন রথী মহারথী নিহত হয়েছেন । কিছু অসংগতি আছে। যেমন সঞ্জয় জানিয়েছিলেন পান্ডবপক্ষে যুধামন্যু আর উত্তোমৌজা নিহত হয়েছেন ইতোমধ্যেই। কিন্তু সেটি সঠিক নয়। এনারা দিব্বি বেঁচে বর্ত্তে ছিলেন এবং পান্ডবশিবিরে ঘুমন্ত অবস্থায় অ্যাসাসিনেটেড হবেন শেষ দিনে । আরো দু একটি অসংগতি আছে, পরে উল্লেখ করবো।

    সেই রাতে, দ্রোণনিধনের পর, দুর্যোধনের শিবিরেই রাত্রি যাপন করলেন মুহ্যমান কর্ণ, দুঃশাসন আর শকুনি। অপরাধবোধের গ্লানিতে বিচলিত তাদের কাছে সেটি ছিলো "শতবৎসরের ন্যায় এক দীর্ঘ রজনী।“

    কর্ণ হলেন কৌরব সেনাপতি, সর্বসম্মতি ক্রমেই; আপত্তি জানাতে পারতেন ঐ এক অশ্ব্ত্থামা, কিন্তু তিনি ও সেনাপতিপদে কর্ণকে নির্দ্বিধায় মেনে নিলেন । কর্ণের বহুদিনের অভীষ্ট লক্ষ্য অবশেষ পুর্ণ হলো। ব্রাহ্মণদের প্রচুর দান করলেন। চারণ ও বন্দিদের দল তার স্তুতি সংগীত করলো। কর্ণ তামার আসনে বসে স্পর্শ করলেন হাতীর দাঁত,গন্ডারের খড়্গ আর মহিষের শিং। নানান সুগন্ধী ভেষজ। মাটী ও সোনার ঘড়া। এইসব মাংগলিক দ্রব্য। তারপর দুর্যোধনকে বল্লেন ,ব্যাস, আর চিন্তা কি আপনার। এই তো আমি সেনপতি বনে গেলাম। "অতএব তুমি প্রশান্তচিত্ত হইয়া পান্ডবগনকে পরাজিত বলিয়া স্থির করো।"

    যুদ্ধের শুরুতেই ব্যুহ রচনা। কর্ন বানালেন মকর ব্যুহ। অর্থাৎ সামনে আর পিছনে স্থুল, মধ্যভাগে ক্ষীন, অনেকটা ডমরুর মতন। এই ব্যুহ সাজানো হয় যখন সামনে থেকে আর পিছন থেকে আক্রমনের সম্ভাবনা হাকে। যদিও মহাভারতের যুদ্ধে একবারের জন্যেও ফ্ল্যাংকিং বা পাশ থেকে যুথবদ্ধ আক্রমনের কথা নেই।

    যুদ্ধরথের শৈশবে অর্থাত্ 1200 বি সির সময়ে কিছু মিশরীয় যুদ্ধের (দ্বিতীয় রামেসিস বনাম হিট্টাইট) বিবরণ আছে। পাঁচ হাজার সেনানী আর কুল্লে বাহান্নোটি রথ। এই রথগুলি অর্ধচন্দ্রাকারে একই সাথে এগিয়ে বা পিছিয়ে যুদ্ধ করতো। রথ গুলি ও ছিলো হাল্কা পুল্কা। দুটি ঘোড়ায় টানতো দুই চাকার রথ। তুলনায় মহভারতের রথ ছিলো ভারী আর চার ঘোড়ার। এবং যুদ্ধ হতো নেহাত্ ই ডুয়েলের মতন। (১)

    এক যোগে ঘোড়সওয়ারেরা পাশ থেকে বা পিছন থেকে আক্রমন করছে এরকম বর্ননাও কোথাও নেই। সেক্ষেত্রে এই ব্যুহ রচনার কি প্রয়োজন ছিলো বোঝা যায় না। আঠারো দিনের যুদ্ধে দুই পক্ষ নানান ব্যুহ বানিয়েছিলেন, সব দিনের ব্যুহের উল্লেখ ও নেই। ছাড়া ছাড়া ভাবে কয়েকটি ব্যুহের কথা আছে। কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও ব্যুহের কথা লেখা আছে, এবং সেই ব্যুহের প্রতিব্যুহের কথা কিন্তু একই রণাংগনে পরিচিত শত্রুর সাথে দীর্ঘ আঠারো দিনের যুদ্ধে কেনো ভিন্ন ভিন্ন ব্যুহ রচনা হবে ?

    প্রত্যুত্তরে পান্ডবেরা সাজালেন অর্দ্ধচন্দ্রাকার ব্যুহ। সেই ব্যুহের বামপার্শ্বে ধৃষ্টদ্যুম্ন,মধ্যে যুধিষ্ঠির ও অর্জুন। যুধিষ্ঠিরের পিছনে নকুল ও সহদেব। আর অর্জুনের "চক্ররক্ষক" অর্থাৎ দুই পাশের প্রহরী যুধামন্যু আর উত্তমৌজা।

    ভীম কই? ডান দিকে কে রইলেন? বড়ো ই অমনোযোগী দেখি সঞ্জয় বা লিপিকারকে। অনেক ভাইটাল তথ্য স্রেফ ভুলে গেছেন। কিছুমাত্র উল্লেখ নেই এই দুই বিষয়ের। আর এই ব্যুহ আর তার প্রতি ব্যুহের ব্যকরণটিও সর্বদা যথাযথ নয়,যেমন ধরুন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ষষ্ঠ দিবসে পান্ডবেরা এই মকরব্যুহই সাজালে তার প্রতি ব্যুহ ভীষ্ম সাজান কিন্তু ক্রৌঞ্চব্যুহ। বা তৃতীয় দিবসে পান্ডবেরা অর্ধচন্দ্রাকার ব্যুহ বানালে ভীষ্ম সাজান গারুঢ়ব্যুহ। অর্থাৎ ব্যুহ ও তার প্রতিব্যুহের কোনো নিদৃষ্ট সমীকরণ নেই।

    যাহোক, যুদ্ধ তো শুরু হোলো। ষোড়শ দিবসের যুদ্ধ। শাঁখ, ঢাক, ডমরু, নাগরা,কাড়া, রণ শিংগা বাজলো। দুই পক্ষ মুখোমুখী।
    এই আঠারোদিনের যুদ্ধের প্যাটারন একটা আছে। যুদ্ধের শুরুতে ,তখন বোধ হয় ওয়ার্ম আপ চলে। দুই পক্ষেই কিছু এলেবেলে লোক মারা যান এবং ইন্দ্রপতন হয় যুদ্ধের শেষ ভাগে। আজও তার ব্যতিক্রম না।

    প্রথম বিবরিত লড়াই ভীম ও ক্ষেমধুর্ত্তির। ভীমর সাথে রয়েছেন দ্রাবিড়,পান্ড্য চোল ও কেরলের সেনরা। ভীম হাতীর পিঠে। ক্ষেমধুর্ত্তি ও তাই। দু জনের হাতেই তোমর (শাবলের মতন, ক্ষেপনীয় অস্ত্র) (২) । দুই রণহস্তী ই বর্মাবৃত। দুজনের দ্বন্দযুদ্ধ চল্লো তোমর ও পরে তীর ধনুক নিয়ে। শেষে দুই যোদ্ধাই মাটীতে নামলেন, ক্ষেমধুর্ত্তি খড়্গধারী আর ভীমের হাতে গদা। ফলাফল ? ভীমের গদাঘাতে ক্ষেমধুর্ত্তির নিধান ও "কৌরব সেনাদের ইতঃস্তত পলায়ন"।

    এর পরের যুদ্ধ কেকয় দেশের রাজা বিন্দ ও তস্য ভ্রাতা অনুবিন্দের সাথে সাত্যকির। এই একই নামের দুই রাজা ছিলেন মালব দেশে, চতুর্দশ দিনের লড়াইতে অর্জুনের হাতে এঁরা নিহত হন। কেকয় দেশের অবস্থান নিয়ে এই সংশয় আছে, বহু পুরোনো গ্রন্থে ও পুরাণে এই দেশের কথা আছে তার ফলে একাধিক নিশানা রয়েছে। এটি পাঞ্জাবের সাহপুর জেলাতে হতে পারে বা ঝিলমের তীরে জালালপুরে। কেকয় দেশের রাজনীতিও ছিলো জটিল, কেননা রাজা বৃহতক্ষত্রের সাথে পাঁচজন রাজপুত্র পান্ডবপক্ষে যোগদান করেন কিন্তু বিন্দ ও অনুবিন্দ, এই দুই রাজপুরুষ ছিলেন কৌরবে পক্ষে ।

    যা হোক, এরাও টেঁকেন নি। সাত্যকির সাথে লড়াইতে প্রথমে অনুবিন্দ ও পরে বিন্দ মারা যান। সাত্যকি তরোয়াল দিয়ে বিন্দকে দ্বিখন্ডিত করেন। বর্ননায় আছে এদের অসি যুদ্ধ স্মরন করিয়ে দিয়েছিলো ' ' দেবাসুরসংগ্রামে খড়্গধারী রম্ভাসুর ও পুরন্দরের" লড়াইকে।

    আসলে এই ষোড়শ দিনের যুদ্ধ ,যাকে বলে একেবারে এলেবেলে গোছের। নেহাৎই দ্বিতীয় স্তরের কিছু যোদ্ধার লড়াইএর বিবরন। কেনো কর্ণ আর অর্জুন মুখোমুখী হলেন না ?
    কিছু লড়াইএর বর্ননা।
    অর্জুনের প্রথম লড়াই হলো অশ্বত্থামার সাথে। দুজনেই সমান বিক্রমে লড়ে যাচ্ছেন। অশ্বত্থামা দশটি নারাচ (৩) নিক্ষেপ করলেন তার পাঁচটি বিদ্ধ করলো অর্জুনকে আর বাকী পাঁচটি কেশবকে। "কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয় সমুদয় নারাচে আহত হইয়া রুধির ক্ষরন পুর্বক নিতান্ত অভিভুত হইলেন'। কৃষ্ণ যেনো বিরক্ত হয়েই অর্জুনকে বল্লেন ,"আর কেনো উপেক্ষা করছো? শীঘ্রই একে খতম করো, নাহলে "প্রতিকারশুন্য ব্যাধির" মতন আরো কষ্ট দেবে।অর্জুনের যেনো এই কথাটা শোনারই অপেক্ষা ছিলেন। অমনি "প্রমাদশুন্য অর্জুন অচ্যুতের বাক্য স্বীকার করিয়া" অশ্বত্থামার বুক,বাহু,মাথা ও "অনুপম উরুদেশ" ক্ষতবিক্ষত করে তার ঘোড়াদের বিদ্ধ করতে লাগলেন। আহত ঘোড়ারা রথ নিয়ে দৌড়ে দুরে চলে গেলো। অশ্বত্থামা ও আর ফিরে এলেন না, ঘোড়াদের সামলে কর্ণের কাছে চলে গেলেন।
    এরপর অর্জুনের লড়াই হবে মগধের রাজা দন্ডভার ও তার ভাই দন্ডের সাথে।এরা হাতীর পিঠে চড়ে যুদ্ধে এসেছিলেন। এদেরকে পরাস্ত করতে অর্জুনের বেশীসময় লাগে নি। কিন্তু ততক্ষনে আবার সংসপ্তকেরা হাজির। অর্জুনো এদের সাথেই যুদ্ধে ব্যাপৃত হলেন।

    এই সময়ে বাসুদেব আবার বললেন "হে সঞ্জয়, তুমি কেনো বৃথা ক্রীড়া করিয়া সময় নষ্ট করিতেছো ? সত্বর এই সংশপ্তকগনকে নিপাতিত করিয়া কর্নবধের চেষ্টা করো।"
    কিন্তু এর পরে আবার অর্জুনের উল্লেখ পাই বাইশতম অধ্যায়ে। ইতোমধ্য আরেকটি সাবপ্লট - পান্ড্যদেশের (তামিলনাডুর মাদুরাই) রাজা প্রবীর, দর্পী বলে তার খুব দুর্নাম ছিলো। পান্ডব্পক্ষের এই রাজার সাথে ল্ড়াই হলো অশ্বত্থামার -ইন্টেরেস্টিং ঘটনা হলো সম্পুর্ণ পর্যুদস্ত করেও অশ্বত্থামা প্রবীরকে তক্ষুনি হত্যা করলেন না।"ঐ সময় দ্রোণতনয় পান্ড্যকে নিহত করিবার সুযোগপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন ,কিন্তু তাহার সহিত সমর করিবার বাসনায় তাহাকে সংহার করিলেন না।"
    এ তো পুরো ক্যাট অ্যান্ড মাউস গেম। খেলিয়ে খেলিয়ে মেরে ফেলা। রথশুন্য প্রবীর এবার এক হাতীর পিঠে চড়ে আসলে অশ্বত্থামা বেশ সময় নিয়ে তাকে তার হাত দুটি কেটে ফেললেন এবং তারপর মাথাটিও।

    এই ঘটনাটি কিন্তু কৃষ্ণের চোখ এড়ায় নি। তিনি অর্জুনকে বললেন - রাজা যুধিষ্ঠিরকেও দেখতে পাচ্ছি না, অন্যান্য পান্ডবদের ও নয়। অর্জুন ও তাই শুনে বল্লেন এখুনি রথের মুখ ঘোরাও। যদি ও পরিষ্কার করে লেখা নেই,তাও মনে হয় অর্জুন প্রতিরক্ষায় মন দিলেন ও যুধিষ্ঠিরের কাছে চলে গেলেন।
    অন্যান্য পান্ডবেরা তখন কর্ণকে ঘিড়ে ধরলেন। "অনন্তর পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ,দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র,যূযূধান এবং যমজ নকুল ও সহদেব ইঁহারা সমবেত হইয়া কর্নের প্রতি গমন করিলেন।"
    ভুল। মারাত্মক ভুল। দ্রুপদ তো দ্রোণের হাতেই মারা গেছেন পঞ্চদশ দিনে।

    অন্ততঃ দ্রুপদ নিধন নিয়ে ভাষ্যকারের এই ভুল হওয়া উচিত্ ছিলো না। যাই হোক, কর্ণের প্রতি এই "মাইনর" পান্ডবেরা ধাবমান হলে দুর্যোধনের আদেশে কৌরব পক্ষের ,বিশেষতঃ পুর্বদেশ যথা অংগ, বংগ,কলিংগ,পুন্ড্র,তাম্রলিপ্তের সেনানীরা গজারোহী হয়ে প্রতিআক্রমন শুরু করলেন।

    সাত্যকির নারাচ বংগাধিপতির হাতিকে নিহত করলে রাজা "ভুতলে অবতীর্ন হইবার উপক্রম করিতেছিলেন, সাত্যকি তাহার বক্ষঃস্থলে নারাচনিক্ষেপপুর্বক তাঁহাকেও ধরাসাৎ করিলেন"। আর নকুলের নারাচে নিহত হলেন অংগাধিপতি। পুর্বদেশগুলির মাহুতেরা তাদের হাতীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরলো নকুলের উপর। সমবেত পান্ডবদের প্রচেষ্টায় তিনি রক্ষা পেলেন কিন্তু আসরে এবার মুখোমুখী কর্ণ,স্বয়ং।
    নকুল তো কর্ণকে দেখে চেঁচিয়ে একশেষ। দ্যাখো আমার ক্ষমতা - "আজ তোমাকে সংহার করিয়া আমি কৃতকার্য্য ও বিগতজ্বর হইবো"।

    কর্ণ কিন্তু পাল্টা গাল দিলেন না, বললেন "হে বীর! তুমি আমাকে প্রহার করো। দেখি তুমি কেমন বীর"। অনুমান করতে পারি ক্রোধের বদলে ঠোঁটে ছিলো অবজ্ঞার হাসি।

    প্রথম দিকে খানিকটা যুঝলেন নকুল, প্রায় সমানে সমানে। কর্ণ এরপর নকুলের পার্শ্বরক্ষক,সারথিকে নিহত করলেন। ধ্বংশ করলেন নকুলের অস্ত্র ও রথ। ছিন্ন করলেন নকুলের ঢাল। নকুল তখন একটি পরিঘ (লোহার কাঁটা ওয়ালা মুষল)নিয়ে কর্ণের দিকে ধেয়ে এলেন। কর্ণ অবহেলে সেই পরিঘকে খন্ড খন্ড করে দিলে নিরস্ত্র নকুল স্রেফ ভোঁ ভাঁ দৌড়। কিন্তু যাবেন কোথায়? কর্ণ দ্রুত রথ চালিয়ে নকুলের গলায় ধনুকার ছিলার ফাঁস লাগিয়ে খুব মিষ্টি করেই বললেন , অনেক তো বড়ো বড়ো কথা বলেছিলে ? আহা থাক, "এক্ষনে তুমি আর কোনো এলেবেলে লোকেদের সাথে লড়াই করো গে' যাও, নাহলে বাড়ী চলে যাও নয়তো কৃষ্ণ আর অর্জুনের কাছেই থাকো ।

    অপমানিত নকুল কী করলেন আর লেখা নেই। মহাভারতকার বলেছেন তখন মধ্যাহ্নকাল। অর্দ্ধেক দিনের যুদ্ধ শেষ।

    সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত্য আর দু একটা সংঘর্ষ হয়ে গেছিলো। নাম উল্লেখ করায় বোঝা যায় সঞ্জয় কিছু কিছু কিছু অংশের খাপছাড়া বিবরণ দিয়েচেন।

    আশ্চর্য্যের বিষয় যে এতো ব্যুহ ট্যুহ করে লাভ কি হলো ? পান্ডব আর কৌরবেরা যথেচ্চ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইন্ডিভিজুয়াল লড়াই করছেন। ধৃতরাষ্ট্রের দাসীপুত্র যুযুৎসু ,শকুনিপুত্র উলুকের হাতে পরাজিত হয়ে অন্য একটি রথে চড়ে পালিয়ে গেলেন। আর সহদেবের প্রহারে পর্যুদস্ত হলেন দুঃশাসন। অচেতন অবস্থায় তাকে সারথি দুরে সড়িয়ে দিলেন। আর একটি অদ্ভুত অধ্যায় হচ্ছে ষড়বিংশতিতম অধ্যায় - সংকুলযুদ্ধ -সুতসোমের অলৌকিক অসিক্রীড়া।

    অদ্ভুত লিখলাম কেনো না সঞ্জয় তাঁর বিবরনীতে ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করে বেশ কয়েকবার বল্লেন "আপনার পুত্র শ্রুতকর্মা"। কে এই শ্রুতকর্মা ? গান্ধারীর শত পুত্রের নাম (যে খানে যে টুকু তথ্য আছে) তাতে তো এই নামের কোনো পুত্র নেই। বরং দ্রৌপদীর ও অর্জুনের পুত্রের নাম শ্রুতকর্মা।

    এই লড়াইতে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের পুত্র প্রতিবিন্ধ্যের উল্লেখ আছে, উল্লেখ আছে নকুল দ্রৌপদীর পুত্র শতানীকের নাম।ঐ বিবরনীতে লড়াইটা শুরু হয়েছিলো শতানীক ও শ্রুতকর্মার মধ্যে। মনে হয় সঞ্জয় পুরোটাই গুলিয়ে ফেলেছিলেন। এরকম নাম নিয়ে গন্ডোগোল প্রায়ই হতো মহাভারতে।

    আর আশ্চর্য্যের বিষয় সুতসোমের কথা। দ্রৌপদীর পাঁচপুত্র সব সময়ে একটি সিংগল ইউনিট হিসাবেই উল্লেখিত হয়েছিলো, যেনো তাঁদের একক স্বত্তা বলে কিছু ছিলো না। তাও দু একবার যেটুকু অনারেবল মেনশন হয়েছে সেটুকু সুতসোমের প্রাপ্য। এই অধ্যায়েও।

    লড়াই হচ্ছিলো শকুনির সাথে সুতসোমের। কিছুক্ষন তীরন্দাজীর পর শকুনির বানে সুতসোমের ধনুক ও তুনীর বিনষ্ট হলে সুতসোম "হস্তিদন্ত নির্মিত মুষ্টিদেশসম্পন্ন" খড়্গ নিয়ে মাটীতে নামলেন। অসি যুদ্ধের চোদ্দ প্রকার মন্ডল দেখিয়ে সুতসোমে এমনই লড়াই করলেন যে শকুনি রথারুড় ও শরাসনধারী হয়েও এঁটে উঠতে পারছিলেন না। অবশেষে শকুনির তীরে সুতসোমের খড়গ দু টুকরো হয়ে গেলে সুতসোম ছয় পা দৌড়ে সেই আধ ভাঙা খড়্গ ছুঁড়েই শকুনির ধনুর্বান ছিন্ন করলেন। (৪)

    এরপর সুতসোম শ্রুতকীর্ত্তির রথে চড়ে রনস্থল ত্যাগ করলেন। সত্যি কথা বলতেই শকুনি ও তেমন মহারথী কিছু নন। সুতসোমের অসিযুদ্ধ ও তেমন ফলপ্রসু হয় নি, বড় জোর এক সন্মানজনক ড্র। অধ্যায়ের নাম করনে "অলৌকিক অসিক্রীড়া" বোধহয় গুড় আন্দাজে একটু বেশী ই মিঠা হয়ে গেছে।

    আরেকটি সংঘর্ষ কৃপাচার্য্য বনম ধৃষ্টদ্যুম্নের। কৃপাচার্য্য যদিও কৌরবদের আদি শিক্ষাগুরু ছিলেন তবুও কুরুক্ষেত্রে তাঁর অবদান সামান্যই। ভগ্নীপতির তুলনায় তো কিছুই নয়।

    যা হোক ,তার সাথে যুদ্ধে ধৃষ্টদ্যুম্নের অবস্থা কাহিল হয়ে গেলো। তাঁর সারথি উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন "হে মহাবীর ! আপনার মংগল তো ? আমি যুদ্ধবানে আপনার এইরুপ বিপদ তো কখনো নিরীক্ষন করি নাই। " আরো বল্লেন ঐ বামুনের সাথে আর লড়াই করবার দরকার নেই। ধৃষ্টদ্যুম্নও সায় দিলেন, বল্লেন আমার সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, ঘাম হছে, সারা শরীর কাঁপছে, তুমি এখনই আমাকে নিয়ে অর্জুনের কাছে চলো। কৃপচার্য্য তাড়া করে ধরে ফেলবার আগেই সারথি ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিরাপদস্থানে নিয়ে গেলেন।

    তখন মধাহ্ন হয়ে গেছে, সন্ধ্যার প্রতীক্ষা। শেষ বেলাকার যুদ্ধও খাপছাড়া ভাবে হচ্ছে।

    আঠাশতম অধ্যায়ে রয়েছে অর্জুনের সংকুল যুদ্ধ। যদিও পিতৃপরিচয় দেওয়া নেই আর একই নামে বিভিন্ন মানুষ থাকতেই পারেন (যেমন গান্ধারীর এক সন্তানের নাম ছিলো কর্ণ আরেকজনের নাম ছিলো ভীম), মনে হয় কর্নের পুত্রদের সাথেই অর্জুনের যুদ্ধ হবে। এই যুদ্ধে নিহত শত্রুঞ্জয় বোধয় কর্ণের নটি ছেলের একজন।
    এই সংকুল যুদ্ধে এতো হতাহত হয়েছিলো এক সময়ে অর্জুনের রথও আর চলতে পারছিলো না, রক্তে কুরুক্ষেত্র কর্দমাক্ত হয়ে গেছিলো। হাতী,ঘোড়া, মানুষের মৃতদেহে রণাংগনে আর দ্রুত রথ চালানো অবকাশ ছিলো না।
    এর পরের অধ্যায়টি এই লড়ইএরই কন্টিনিউড কমেন্টারী, কিন্তু বিভৎস রসের বর্ননায় এটি কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বর্ননার শ্রেষ্ঠ রচনার অন্যতম।

    যদিও যথাঃযথ উল্লেখিত নেই,তবে পঁচিশতম অধ্যায়ে নকুল কর্ণের সংঘাতসময় লেখা আছে সেটি মধ্যাহ্নকাল তাই আরো কয়েকটি সংঘাতের পর এই সংকুল যুদ্ধের বর্ণনা যখন রয়েছে তখন মনে হয় দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসছে।

    সারাদিন অসংলগ্ন ভাবে ইতঃস্তত লড়াইর পর দিনের শেষে যুদ্ধ "জমে উঠলো"।

    শুরু হয়েছিলো দুর্যোধন আর যুধিষ্ঠিরের মুখোমুখী লড়াইতে ,সেনাপতি,দুই পক্ষে, যেই ই থাকুন না কেনো, এঁরা দুই পরষ্পর বিরোধী পক্ষের রাজা । কর্ণ বা ধৃষ্টদ্যুম্নের থেকে অনেক বেশী গুরুত্বপুর্ণ এঁদের অবস্থান। প্রথম রাউন্ডে কিন্তু যুধিষ্ঠিরই এগিয়ে, তার বানে দুর্যোধনের সারথি মস্তকহীন ধ্বজা,শরাসন ও খড়্গ চুর্ণ। দুর্যোধন নিজেও যুদ্ধিষ্ঠিরের নিক্ষিপ্ত পঞ্চবানে নিপিড়ীত ছিলেন । উপায় না দেখে দুর্যোধন তখন রথ থেকে মাটীতে নামলেন - তাকে রক্ষা করতে ছুটে এলেন তাবৎ কৌরব বীরেরা । “তদ্দর্শনে অশ্ব্ত্থামা,কর্ণ ও কৃপাচার্য প্রমূখ বীরগন দুর্যোধনের রক্ষার্থে তাহার নিকট সমুপস্থিত হইলেন। তখন পান্ডুতনেয়রাও যুধিষ্ঠিরের সাহায্যর্থ তাঁহাকে পরিবেশ্টিত করিলেন। অনন্তর উভয় পক্ষে তুমূল সংগ্রাম আরম্ভ হইলো । সহস্র সহস্র তুর্য বাদিত হইতে লাগিল। "

    মহা কোলাহল সমুত্থিত হলো, হাতীর সাথে হাতী,অশ্বের সাথে অশ্ব, পদাতি ও পদাতি, রথী ও রথী, ঘোরতর সংগ্রাম শুরু হলো।সঞ্জয় বল্লেন "এইরূপে ঐ যুদ্ধ মুহুর্ত্তকাল অতি মধুরদর্শন হইলো"। এই ঘোর যুদ্ধের বর্ননায় "মধুরদর্শন" কতোটা উপযুক্ত বিশেষণ সেই তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
    কেমন লড়াই হলো, সেটা সঞ্জয়ের মুখেই শুনুন।"……।কিন্তু অবিলম্বে সকলে একেবারে। উন্মত্ত হওয়াতে উহা নির্ময্যাদ (বিশৃংখল/সমর বিষয়ক নিয়মরহিত) হইল। তখন রথিগন মাতংগদিগকে আক্রমনপুর্বক নিশিতশরনিকরে বিদীর্ণ করিয়া যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। অশ্বারোহিগন চত্তুর্দিক হইতে আগমন ও অশ্বগনকে বেষ্টন করিয়া তলধ্বনি করিতে লাগিল।মহামাতংগগন (মাহুত) বিদ্রাবিত অশ্বগনের প্রতি ধাবমান হইলে অশ্বারোহিগন কুঞ্জরদিগের পৃষ্ঠ ও পার্শ্বদেশে শরাঘাত করিতে প্রবৃত্ত হইল। মদমত্ত দ্বিরদগন অশ্বসকলকে বিদ্রাবিত করিয়া দশন প্রহারে বিনষ্ট ও মর্দ্দিত করিতে লাগিল। কতকগুলি হস্তী রোষভরে দশনদ্বারা অশ্বারোহিগনের সহিত অশ্বদিগকে বিদ্ধ করিয়া মহাবেগে নিক্ষেপ করিতে লাগিল। কোন কোন মাতংগ পদাতিসৈন্যগন কর্ত্তৃক সুযোগক্রমে সমাহত হইয়া ঘোরতর আর্ত্তস্বর পরিত্যাগপুর্বক চতুর্দ্দিকে ধাবমান হইল। …… তখন যোধগন পরস্পর সমাগত হইয়া পরস্পরকে মুষ্টিপ্রহার ও পরস্পরের কেশ ধারনপুর্বক নিক্ষেপ করিয়া পরস্পরকে সংহার করিতে লাগিল। কেহ কেহ ভুজযুগল উন্নত করিয়া প্রতিপক্ষকে ভুতলে নিক্ষেপ ও পাদদ্বারা তাহার বক্ষঃস্থল আক্রোমনপুর্বক শিরশ্ছেদন করিল।…।।কেহবা জীবিত ব্যক্তির দেহে শস্ত্র বিদ্ধ করিতে লাগিল।"

    পুরোটা পড়লে মনে হয় যেনো ন্যাট জিও তে দেখা ডকুমেন্টারীর পিরানহা মাছের ফীডিং ফ্রেন্জী। এক উন্মত্ত রক্ততৃষা।

    ইত্যবসরে এই ঘোর সংগ্রামের মধ্যে যুধিষ্ঠির কিন্তু দুর্যোধনকে পরাজিত করলেন। তার নিক্ষিপ্ত শক্তির (ভারী বল্লম) দুর্যোধন অচৈতন্য হয়ে পরলে হয়তো যুধিষ্ঠির তখনই কুরুপতির প্রাণসংহারও করতে পারতেন, কিন্তু ভীম স্মরণ করিয়ে দেন যে দুর্যোধন তারই বধ্য, তাই যুধিষ্ঠির প্রতিনিবৃত্ত হন।
    এর পরে দেখবো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের অন্তিম দিনে যুধিষ্ঠির আরো রনশালী হয়ে উঠবেন ও হত্যা করবেন কুরু সেনাপতি শল্যকে। যার মৃত্যুর সাথে সাথেই এই মহাসমরের, অন্ততঃ রণাংগনে, পরিসমাপ্তি ঘটবে। যদিও রক্তক্ষয় চলবে আরো কিছু সময়। বোধহয় জয়ের আশায় যুধিষ্ঠির আরো উজ্জিবীত হয়ে উঠছিলেন। দ্বৈরথ সংগ্রামে এই বিজয় তারই লক্ষন।
    দিন তখন শেষ হয়ে আসছে তখন সেদিনের মতন প্রথমবার কর্ণ আর অর্জুন মুখোমুখী। দুজনের মধ্যে কিছুক্ষন বান বিনিময় হলো, এই পর্যন্ত্যই।সুর্য্য অস্তগামী হলে ধুলি ধুসরিত রণাংগনে পরিষ্কার কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। কৌরব সেনারাই যেনো "যথেষ্ট হয়েছে" বলে রণস্থল ত্যাগ করলো। পান্ডব পক্ষ "জয়শ্রী লাভ করিয়া বিবিধ বাদিত্র বাদন ও সিংহনাদ পরিত্যাগপুর্বক শত্রুগনকে উপহাস ও কৃষ্ণ ও অর্জুনের স্তুতিবাদ করিয়া স্বশিবিরে গমন করিতে লাগিলেন।
    কৌরব শিবিরে অন্য চিত্র।"বর্ম্ম ও আয়ুধবিবর্জ্জিত, হত, আহত ও বিদ্ধ্বস্ত বাহনগনে পরিবেষ্টিত মহামানী কৌরবগন এইরূপে অরাতিশরে বর্ম্ম ও অস্ত্রবিবর্জ্জিত,বাহনহীন,হতশৈন্য,একান্ত সমাহত ও নিজ্জিত হইয়া শিবিরে অবস্থানপুর্বক ভগ্নদন্ত বিষবিহীন বিষধরের ন্যায় দীনস্বরে পুনরায় মন্ত্রনা করিতে লাগিলেন।"

    কর্ন বল্লেন, একে তো অর্জুন খুবই বীর এবং "ধৈর্য্যশালী" তায় স্বয়ং বাসুদেব "উহাকে প্রতিরোধিত করিয়া থাকেন"। মনে হয় কর্ণের উদ্দেশ্য ছিলো বলার যে যুদ্ধকালীন ধৈর্য্যশীল মানুষের ও ঠান্ডা মাথায় স্ট্র্যাটেজিক চিন্তা করা সম্ভব নয়, তাই কর্ণ তাঁর অভাবের কথাটি জানলেন। আগামী কাল শল্যকে তাঁর সারথি নিযুক্ত করার এইটি ই বোধহয় কারণ।এ দিনের যুদ্ধের মরাল ভিকট্রি তাহলে পান্ডবদেরই ছিলো।

    কর্ণ আর একদিন মাত্র বাঁচবেন।

    ****************

    সপ্তদশদিনের যুদ্ধের শুরুতেই কর্ণ দুর্যোধনকে আশ্বাস দিলেন, আজ তিনি অর্জুনের সাথে সম্মুখ সমরে ব্যাপৃত হবেন। বল্লেন দিনের শেষে আমাদের মধ্যে একজনই বেঁচে থাকবে।
    এবার যুদ্ধোপকরন নিয়ে কিছু কথা।
    ধরুন রথ। অর্জুনের কাছে ছিলো অগ্নিদত্ত বিজয়রথ। কৃষ্ণের মায়ায় সেটি কখনো ধ্বংশ হয়নি। তার এই রথের প্রসংশা অন্কেই করেছেন। তুলনীয় কর্ণের অমন কোনো দৈবী রথ ছিলো না। বহুবার কর্ণের রথ, সারথি ও ঘোড়া ধ্বংশ হয়েছে। অন্যান্য বীরদের ও হয়েছে। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন অর্জুন।

    সারথি। সারথি শুধু রথচালক ই নয় সে একজন সুপরামর্শদাতা। কৃষ্ণ ছাড়া আর একজন সারথিই স্বনামে পরিচিত ও খ্যাত ছিলেন, তিনি বিশোক। (৫) ভীমের রথ ধ্বংশ হলেও বিশোক নিহত হন নি। অন্য রথ এনে ভীমকে উদ্ধার করেছেন। কর্ণের তেমন সারথি তো কেউ ছিলোই না,পরন্তু শেষদিনে শল্যকে সারথি নিযুক্ত করায় তিনি আরো বিমর্ষ হয়ে পরলেন।
    কুরুক্ষেত্রের রণনীতি হিসাবে সারথি কিন্তু বধ্য। রথী মহারথীরা তাদের প্রতিদ্বন্দী সংগামে সব সময়ই প্রতিপক্ষের সারথিকে অস্ত্রাঘাত করেছেন। গত ষোলোদিনে বহু বহুবার কৃষ্ণ গদা,মুষল ও তীক্ষ্ণ বানে ক্ষত বিক্ষত হয়েছেন। তার সারথ্যের কাজটা সহজ ছিলো না। এই ক্ষেত্রে তো অর্জুনের তুলনামুলক সুবিধা কর্ণের তুলনায় আকাশ ছোঁয়া ছিলো।
    যদি ঘোড়ার কথা(৬) বলেন তো অর্জুন সেখানেও এক কদম এগিয়ে। অর্জুন ব্যতিরেকে অন্যান্য সব যোদ্ধার ঘোড়ারাই যেনো ছিলো কনসিউমেবল কমোডিটি। দিনে একবার কি আটবার ঘোড়ারা মারা যাচ্ছে, আবার নতুন ঘোড়া আসছে। ঘোড়াদের নামকরনও হোতো না, যেমনটি হতো হাতীদের । এখানেও ব্যতিক্রম অর্জুনের চার ঘোড়ার।নাম তাদের বলাহক,মেঘপুষ্প,শৈব্য ও সুগ্রীব। বিবরনী পড়লে মনে হয় এই চার ঘোড়াও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষেও জীবিত ছিলো।
    মহারথীরা পার্শ্বরক্ষক বা চক্ররক্ষক নিয়ে ই লড়াই করতেন। এই পার্শ্বরক্ষকেরা খেয়াল রাখতো মহারথীকে পাশ থেকে বা পিছন থেকে যেনো কেউ আক্রমন না করে। পাঞ্চাল দেশের যুধামন্যু আর উত্তমৌজা, এই দুই পার্শ্বরক্ষক আঠারো দিন ধরেই অর্জুনের ছায়াসংগী ছিলেন। আর কোনো
    মহারথির ক্ষেত্রে এরকম সফল চক্ররক্ষকের উল্লেখ পর্যন্ত্য নেই।
    শেষকথা, ধনুক(৭)। অর্জুনের গান্ডীবধনু তার মতনই বিখ্যাত। কর্ণের ধনুকও সবসেরা। বিশ্বকর্মা এটি বানিয়েছিলেন ইন্দ্রের জন্য। সেটি পরশুরামের হাত ঘুড়ে কর্ণের হাতে পৌছায় কিন্তু গত ষোলো দিনের যুদ্ধে বহুবার দেখা গেছে কর্ণের শরাসন ছিন্ন হয়েছে,তিনি বারবার অন্য ধনুক গ্রহন করেছেন। অথচ এই
    সপ্তদশদিনের যুদ্ধের শুরুতেই কর্ণ এই ধনুকের সুখ্যাতি করে বড়াই করে বললেন অদ্য আমি এই শরাসন দিয়াই অর্জুনের বিনাস করিব। একটা সম্ভাবনা যে এই দিনের জন্যই কর্ণ এই শরাসনটি লুকিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম প্রকাশ করবেন আজকে। যদিও এর কোনো যুক্তি বোধগম্য হয় না।

    কর্ণ সরাসরি দুর্যোধনকে বললেন "আমি ধনঞ্জয় অপেক্ষ যে অংশে হীন, তৎসমুদয় আমার স্বীকার করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অর্জ্জুনের শরাসন,জ্যা দিব্য,তুনীরদ্বয় অক্ষয়,সারথি বাসুদেব,কাঞ্চনভূষণ দিব্যরথ অগ্নিদত্ত ও অছেদ্য, অশ্বসকল মনের তুল্য বেগশালী …… আমার এতাদৃশ কিছুই নাই।"
    তবে ধনুকের কথায় স্বীকার করলেন " আমার কেবল এলমাত্র বিজয়াখ্য দিব্যকার্ম্মুক ধনঞ্জয়ের অর্জিত গান্ডীবশরাসন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।"কর্ণ নিজমুখেই অনুরোধ জানালেন শল্য যেনো তা`র সারথি হন। "অতএব দুঃসহবীর্য্য শল্যই আমার সারথি হউন। শকটসমুদয় আমার নারাচ নিকর বহন এবং উৎকৃষ্ট অশ্বসংযোজিত রথসকল আমার পশ্চাত্ পশ্চাত্ আগমন করুক। হে মহারাজ! এইরূপ হইলে আমি ধনঞ্জয় অপেক্ষা সমধিক হইবো।" দুর্যোধন ও তৎক্ষনাৎ রাজী।

    দুর্যোধন অতঃপর শল্যের কাছে গেলেন এই অনুরোধ নিয়ে। বুঝিয়ে বললন, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপাচার্য্য, কর্ণ,ভোজরাজ,শকুনি,অশত্থামা,আপনি আর আমি, কৌরব পক্ষে এই নয়জনই শত্রুদমনে নয়ভাগে বিভক্ত হয়ে লড়াই চালাচ্ছিলাম। তো ভীষ্ম আর দ্রোণ পান্ডবদের ছলযুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তাই আমাদের ক্ষমতায় একটা ফাঁক থেকে গেছে। আমাদের সেনারাও অধিকাংশই নিহত। তাই কর্ন আর আপনি,এই
    দুই জনের সংঘবদ্ধতা খুবই জরুরী।
    শল্য তো রেগেই একশা। এই"বাক্যশ্রবণে ক্রোধান্ধ হইয়া ললাটে ত্রিশিখ ভ্রূকুটি বিস্তারপুর্বক বারংবার করযুগল বিকম্পিত ও রোষারূণ নেত্রদ্বয় পরিবর্ত্তিত করিয়া " তিনি ঘোরতর আপত্তি জানালেন। বললেন ,আরে আমি হচ্ছি ক্ষত্রিয়। আর কর্ণ নিজেই এক সারথীর ব্যাটা। ওর সারথী হবো আমি ?'
    দুর্যোধন রীতিমতন স্তবস্তুতি শুরু করে দিলেন, বললেন ,আমি মনে করি কর্ণ হচ্ছে অর্জুনের চেয়ে বড়ো যোদ্ধা আর "আপনি বাসুদেব অপেক্ষা সমধিক গুনশালী" বলে আমি মনে করি। আরো বললেন "আপনি বাসুদেব অপেক্ষা দ্বিগুন অশ্ববিদ্যাভিজ্ঞ ও সমধিক বলবীর্য্যসম্পন্ন। আমি এই নিমিত্তই এক্ষনে
    আপনাকে উৎকৃষ্ট অশ্বসমুদয়ের যন্তৃপদে বরণ করিতে অভিলাষ করি।
    শব্দ চয়ন একেবারে নিঁখুত। আদেশ নয়,অভিলাষ, নিযুক্ত নয় বরণ,কর্ণের সারথী নয় অশ্বগনের পরিচালক।

    শল্য রাজী হলেন কিন্তু বললেন শর্ত্ত একটাই ,"আমি স্বেচ্ছানুসারে বাক্যপ্রয়োগ করিব"। কর্ণ আর দুর্যোধন তাতেই রাজী।
    তো কর্ণের আদেশে শল্য সুসজ্জিত রথ কর্ণের কাছে নিয়ে আসলেন। "মহাতেজঃ শল্য কর্ণের আদেশনুসারে সিংহ যেমন পর্ব্বতে অরোহন করে,তদ্রূপ কর্ণের সেই প্রধান রথে সমারুঢ় হইলেন। তখন মহাবীর কর্ণ শল্যকে রথারুঢ় দেখিয়া সত্বর স্যন্দনে আরোহনপুর্বক বিদ্যুতসম্বলিতনীরদমধ্যস্থ দিনকরের ন্যায় শোভা ধারন করিলেন। "
    এই রথের বর্ননায় কর্ণ বললেন শল্যকে "ভগবন রাম আমাকে এই ব্যাঘ্রচর্ম্মাবৃত,শব্দহীন চক্রযুক্ত,…। রথ প্রদান করিয়াছেন।
    বললেন, আর এই দেখুন আমার সোনার আসন, রুপোর ত্রিবেণু, বিচিত্র শরাসন, ভয়ংকর তীর,গদা ও সমুজ্জ্বল অসি। আজ অর্জুন আর আমার মধ্যে হেস্তনেস্ত একটা কিছু হয়েই যাবে। কর্ণ এবার সমবেত পান্ডব সেনা মন্ডলীকে জনে জনে প্রশ্ন করতে লাগলেন, আমাকে একবার জানাও ধনঞ্জয় কোথায় আছেন। সঠিক সংবাদ দিলেই পুরষ্কার দেবো, শকটভর্ত্তি রত্ন,বা কাঁসার দোহনপাত্র সমেত একশো দুধেলা গাই। তাতেও মন না ভরলে খচ্চরে টানা শ্বেতবর্ণ রথ ও যুবতী নারী, আরো চাই ? তো দেবো …।। এই রকম অজস্র প্রতিশ্রুতি। বোঝাই যাচ্ছে এটি নেহাত্ই সাইকলিজিক্যাল ওয়ারফেয়ার।

    কৃষ্ণ আর অর্জুন আদৌ লুকিয়ে থাকতেন না যে পান্ডবপক্ষীয় সেনাদেরকে উৎকোচের লোভ দেখিয়ে তাদের নিশানা জানতে হবে। তবে পুরষ্কারের বহর বেশ কৌতুহলদ্দীপক।
    অর্জুন আর কর্ণের মধ্যে যোদ্ধৃভাবে কিন্তু অনেকটাই ফারাক ছিলো। বিশেষতঃ এই সপ্তদশদিনের যুদ্ধে কর্ণকে বারবারই দেখি যুদ্ধজয়ে ইনি সুনিশ্চিত নন। তিনি বললেন " কর্ম্মসমুদয় দৈবায়ত্ত; তন্নিবন্ধ আমি অনেক অনুসন্ধান করিয়াও এই পৃথিবীর কোন বস্তুরই স্থিরতা দেখিতেছি না যখন আচার্য্য হত হইয়াছেন,তখন অদ্য সূর্য্যোদয়ে আমি জীবীত থাকিব এই কথা নিঃসন্দেহরূপে কে বলিতে পারে?"
    তুলনামূলক মনস্তত্ত্বের আরেকটি উদাহরণ - এটি এই দিনের যুদ্ধের শেষভাগে (অষ্টাশীতম অধ্যায়) দুই রথি ও দুই সারথির কথোপকথন । কর্ণ আর অর্জুন তখন মুখোমুখী, দু জনেই জানেন এই ই তাঁদের শেষ দ্বৈরথ । কর্ণ সহাস্যে শল্যকে প্রশ্ন করলেন ,অর্জুনের হাতে আমি নিহত হলে হে শল্য,আপনি তখন কী করবেন? শল্য বললেন,চিন্তা করার কিছু নেই, আমি একাই কৃষ্ণ আর অর্জুনকে যমালয়ে পাঠিয়ে দেবো । আর এর সাথে তুলনা করুন একই সময়ে বাসুদেবের উত্তর; একই প্রশ্ন ছিলো অর্জুনের, আমি আজ কর্ণের হতে নিহত হলে,হে বাসুদেব, তুমি কী করবে? কৃষ্ণ অল্প হেসে বললেন সুর্য্যও আকাশ থেকে খসে পড়ুক বা আগুনের শীতলভাব হোক, যা কিছু অসম্ভব হোক না কেন, কর্ণ তোমাকে বিনাশে সমর্থ হবে না।
    অন্ততঃ দুটি ঘটনায় কর্ণের শারীরিক সহনশক্তির বিবরণ পাই যে তা ছিলো ক্ষত্রিয়চিত। একটি তো সেই গুরু পরশরামের মাথা নিজের কোলে রেখে বসে ছিলেন আর বজ্রকীট তাঁকে রক্তাক্ত করে তুলছিলো আর অন্যটি ব্রাহ্মণবেশী ইন্দ্রের জন্য নিজের সহজাত কবচ কুন্ডল তরোয়াল দিয়ে স্বহস্তে কেটে দিলেন, তাঁর শরীর বিক্ষত হলো কিন্তু সেই য্ন্ত্রনা তিনি হাসিমুখেই সহ্য করলেন ।

    কিন্তু ভীষ্ম পতনের পর একাদশ দিন থেকে আজকের দিন পর্যন্ত্য অনেক অনেকগুলি সংঘর্ষে দেখি কর্ণ স্রেফ পালিয়ে যাচ্ছেন, বা শত্রু প্রহারে বিচলিত হয়ে পরছেন বা দুর্যোধনকে বলছেন, নেহাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে থাকতে হয় তাই ই আছি,নাহলে আমি নিন্তান্তই আহত । অর্জুনের ক্ষেত্রে এরকম পলায়নবৃত্তি কখনো দেখা যায় নি। মুর্ছিত হয়ে পরেছেন, কিন্তু সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে আবার যুদ্ধ শুরু করেছেন।
    টীকাকার নীলকন্ঠ বলেছেন ক্ষত্রিয় চরিত্রে কর্ণের কতকগুলি খামতি থেকে গেছিলো। জন্মাবধি সূতগৃহে পালিত হয়ে তাঁর মধ্যে ক্ষত্রিয়ধর্মটি পুরোপুরি ফুটে ওঠে নি, তাই যুদ্ধে তাঁর সহনশীলতা ছিলো অর্জুনের তুলনায় কম।

    যুদ্ধ তখনো শুরু হয় নি, তারই মধ্যে শল্য আর কর্ণের তুমুল ঝগড়া লেগে গেলো । কর্ণ অধীর হয়ে শল্য'র দেশ অর্থাৎ মদ্রদেশ (সম্ভবতঃ বর্তমান শিয়ালকোট এবং রাভি আর চেনাব নদীর মধ্যবর্ত্তী অঞ্চল) নিয়ে প্রচুর গালাগালি দিলেন প্রায় একতরফা এরকম গালি গালাজের মুখে শল্য একবারই উল্লেখ করলেন কর্ণের অধীন অংগরাজ্যের (ভাগলপুর) । নিন্দা করলেন সে ও খুব কঠিন ভাষায় নয় , বললেন সব দেশেই খারাপ আর ভালো দু ধরনের লোকই থাকে । দুর্যোধন হাঁ হাঁ করে ছুটে এলে দুজনেই ঝগড়া থামালেন, তো কর্ণ হেসে বললেন ঠিক আছে, এখন তো রথ চালাও।

    কেমন হলো ব্যুহ রচনা সে বিষয়ে মহাভারতকার কিন্তু খুবই অস্পষ্ট। জানাচ্ছেন দুই পক্ষেই সেনা বিন্যাস হলো কিন্তু কোন পক্ষ কোন ব্যুহ রচনা করলেন সেটি অনুল্লেখিতই রয়ে গেলো।
    কৌরবপক্ষের ব্যুহ দেখে যুধিষ্ঠির নিজেই সকলের কর্মবিভাগ করে নির্দেশ দিলেন- অর্জুন কর্ণর সাথে, ভীম দুর্যোধনের সাথে, নকুল বৃষসেনের সাথে, সহদেব শকুনির সাথে, শতানীক দুঃশাসনের সাথে,পান্ড্য অশ্ব্ত্থামার সাথে আর "দ্রৌপদীতনয়েরা শিখন্ডী সহিত অন্যান্য ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগনের সহিত যুদ্ধ করুন"।

    কর্ণের দুই পাশে তার দুই পুত্র, দুই চক্ররক্ষক সুষেণ ও সত্যসেন আর তাঁর পিছনে, পৃষ্ঠরক্ষক মহারথি পুত্র বৃষসেন। আজকের যুদ্ধে কর্ণ এঁদের প্রত্যেকেরই মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে যাবেন ।

    যুদ্ধের গোড়াতেই ভীমের হাতে মারা গেলেন কর্ণপুত্র ভানুসেন । "ভানুসেনের সেই শশধর সদৃশ রমনীয় মস্তক ভীমসেনের ক্ষুরদ্বারা ছিন্ন হইয়া মৃনালভ্রষ্ট কমলের ন্যায় শোভা ধারন করিল"। আর সাত্যকি আক্রমন শুরু করলেন বৃষসেনের উপর। বৃষসেন, সুষেণ আর সত্যসেন এই তিন পুত্রর উপর দায়িত্ব ছিলো পিতা কর্ণ'র পার্শ্ব ও পৃষ্ঠরক্ষনার, বোঝা যাচ্ছে পান্ডবেরা সুপরিকল্পিত কর্ণকে ঘিড়ে ধরবার চেষ্টা করছেন ।

    আর তখন কর্ণের মুখোমুখী দ্বৈরথ সমরে আসরে নামলেন যুধিষ্ঠির স্বয়ং । ফলাফল তো সকলেরই জানা। অচিরেই যুধিষ্ঠিরের রথ চুর্ণ হলে তিনি অন্য রথে চড়ে "সমর পরিত্যাগপুর্বক প্রস্থান করিতে লাগিলেন"। কর্ণ মনে মনে একবার ভাবলেন যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করবার কথা এই অ্যাজেন্ডাটি দ্রোণের ছিলো পুরোমাত্রায়, অনেকবার চেষ্টাও করেছিলেন। শল্য কিন্তু বারন করলেন কর্ণকে, মহামতি যুধিষ্ঠিরকে বন্দী না করতে বল্লেন, "ইঁহাকে গ্রহন করিলেই উনি তোমাকে বিনাশ করিয়া আমাকে ভস্মসাৎ করিবেন"। কী ভাবে,কোন উপায়ে বন্দী হলে যুধিষ্ঠিরের এই রকম ক্ষমতা হবে সেটা বোধগম্য হয় না। বোধহয় এর অন্ত্রনিহিত অর্থ হচ্ছে যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করে সন্ধিস্থাপনা করলে অন্ততঃশল্য আর কর্ণের কোনো মুক্তি নেই।

    গত সতেরো দিনের যুদ্ধে এই রকম অনেকবার হয়েছে, কর্ণ এসে যাচ্ছেতাই রকমের অপমান করে যুধিষ্ঠিরকে ছেড়ে দিলেন। পান্ডবরাজ ও লজ্জিত হয়ে পালিয়ে গেলেন। পাল্টা আক্রমনে ভীম আর কর্ণের ডুয়েল সেইখানে দেখি ভীম নিক্ষিপ্ত শরে "গাঢ়তর বিদ্ধ ও বিমোহিত" হয়ে কর্ণ রথের মধ্যেই বসে পড়লেন। শল্য তাঁকে নিয়ে রণস্থল পরিত্যাগ করলেন । পরের অধ্যায়ে দেখি কর্ণ আবার ফিরে এসেছেন ও ভীমের সাথে দ্বৈরথ যুদ্ধে সামিল হয়েছেন । এই যুদ্ধের বিবরনীতে পড়ি কর্ণ "ভল্লদ্বারা (ভীমের) সারথিকে শমনভবনে প্রেরণ করিলেন"।
    এই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে একজনই পেশাদার সারথির নাম বারবার উল্লেখিত হয়েছে সেটি ভীমের সারথি বিশোক। বাকীরা অনামাই থেকে গেছেন। এই যুদ্ধেও কিন্তু ভীমের সারথির নাম নেই, যদিও এর পরের অধ্যায়গুলিতে দেখবো বিশোক দিব্বি বেঁচে বর্তে আছেন।

    এর পরের অধ্যায়গুলি একে তো রিপেটেটিভ তায় নানান রকমের অসংগতিতে পুর্ণ। প্রধানতঃ যুধিষ্ঠিরের রণাংগনে পুনরাগমন নিয়ে । যুদ্ধের বিবরণীতেও স্পষ্টঃই পরম্পরার অভাব।

    এর মধ্যে যে দু একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য সেটি হচ্ছে অশ্বত্থামার সাথে সংগ্রামে অর্জুনের সাময়িক "পরাজয়" । বাসুদেব অর্জুনের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললেন, খুবই আশ্চর্য্য বোধ করছি যে দ্রোণপুত্র তোমার থেকে আজকে বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠেছে? প্রশ্ন করলেন,তোমার হাতে কি আজ গান্ডীব নেই? আরো বললেন, আরে,গুরুপুত্র বলে অতো হেলাফেলা করো না, "ইহা উপেক্ষার সময় নহে" ।

    এই কটু ভোকাল টনিকে কিন্তু কাজ হলো। অর্জুন স্বত্তর চৌদ্দটি ভল্ল দিয়ে অশ্বত্থামার ধ্বজ, সারথি, রথ, পতাকা,শক্তি,গদা ও শরাশন ছিন্ন করে ফেললেন। এবং অশ্বত্থামার "জক্রুদেশে দৃঢ়রূপে বৎসদন্ত শরনিকর প্রহার করিলেন" ।
    জক্রুদেশ মানে হচ্ছে ঘাড় ও গলার সংযোগস্থান। বর্মাবৃত রথিদের অল্প কিছু শরীরই অনাবৃত থাকতো। মহাভারতে এই জক্রুদেশ খুব প্রচলিত আঘাতস্থান ছিলো। বৎসদন্ত মানে "ছোটো দাঁত" মানে খুব ছোটো ফলার তীর। এর কর্ম ছিলো নিশ্চয়ই বর্মের ফাঁক ফোকোর দিয়ে যোধগনের যেটুকু অরক্ষিত শরীর, সেখানে আঘাত করা।

    আর কৃষ্ণের উৎসাহে বা ভরৎসনায় বা নেহাৎই পরামর্শে অর্জুনের কৃতকার্য হওয়া বার বারই দেখা যায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে। অসহিষ্ণু কৃষ্ণ, অশ্বত্থামা বা কৃতবর্মা, এদের বিপক্ষে যুদ্ধের সময় অর্জুনকে বলেছেন কেনো খামোখা সময় নষ্ট করছো ? এইবার একটু সিরিয়াসলি লড়াই করো। আশ্চর্য্যের বিষয়, প্রতিবারই অর্জুন তৎক্ষনাত সেই লড়াই জিতে যাচ্ছেন ।

    এই অধ্যায়েরই শেষ লাইনে দেখি "তৎকালে রাজা যুধিষ্ঠির সমরবেদনায় নিতান্ত কাতর হইয়া সমরস্থল হইতে একক্রোশ দুরে গমনপুর্ব্বক অবস্থিতি করিতে লাগিলেন"।

    যদিও এই দিনের যুদ্ধে মাঝে মাঝেই যুধিষ্ঠিরের সংগ্রামের কথা লেখা আছে, তবু যুক্তির খাতিরে মানতে হয় যে যুদ্ধের শুরুতেই কর্ণের কাছে অপমানিত ও আহত হয়ে যুধিষ্ঠিরের মেজাজ বিগড়ে যায় । তিনি তখনই রণাংগন থেকে দূরের বিশ্রামশিবিরে চলে যান । তিনি তো সংগ্রামপ্রেমিক বীর কখনই ছিলেন না । তারপর এই টানা সতেরো দিনের রক্তক্ষয়ী স্বজনক্ষয়ী সংঘর্ষে বোধহয় তিনি শারীরিক মানসিক আত্মিক সব দিকে দিয়েই একেবারে টুকরো টুকরো হয়ে পরেছিলেন । তার মানসিক ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে পরে। এর প্রকাশ দেখবো আমরা আজকের লাঞ্চ ব্রেকের সময় ।
    কুরুক্ষেত্র যুদ্ধও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে । অনেক প্রাণহানি হয়ে গেছে। যোধগনের মধ্যে একটা অবসাদ আর ক্লান্তির ছাপ সর্বত্র।

    কৃষ্ণ একবার অর্জুনকে কুরুক্ষেত্রের একটি প্যানারমিক চিত্র দেখালেন, তার ভাষ্য সমেত। রণাংগনের বর্ণনায় ভগ্ন অস্ত্রের কথায় একবার চক্রের উল্লেখও করলেন। পুরো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কোনো বীরকেই এই চক্রাস্ত ব্যবহার করতে শোনা যায় নি । বিবিধ অস্ত্রের বিবরনীতে এটি সব সময়েই অনুপস্থিত ছিলো। কৃষ্ণের ভাষ্যে কুরুক্ষেত্র " সমর সমাহত শয়ান জ্ঞাতিগন জলপ্রার্থনা করাতে অনেকে সলিলনয়নার্থে সত্বর গমন করিতেছে। অনেকে বান্ধবদিগের নিমিত্ত জল আনয়ন করিয়া তাহাদিগকে বিচেতন দেখিয়া জল পরিত্যাগপুর্ব্বক চিৎকার করিয়া ধাবমান হইতেছে। কেহ কেহ জলপান করিয়া ও কেহ কেহ জলপান করিতে করিতেই প্রাণত্যাগ করিতেছে। বান্ধবপ্রিয় বীরগন সেই প্রিয় বান্ধবগনকে পরিত্যাগপূর্ব্বক সংগ্রামার্থ ধাবমান হইতেছে এবং অন্যান্য যোধগন অধোরোষ্ঠ দংশন ও ভ্রুকুটি বন্ধনপুর্ব্বক চতুর্দ্দিক দর্শন করিতেছে। "
    তখনো মধ্যাহ্ন হয় নি, রণাংগনে ভীম আর অর্জুনের সাক্ষাত হলে অর্জুন ভীমকে যুধিষ্ঠিরের খবর জিজ্ঞাসা করলেন। ভীমের কথাবার্ত্তা নিতান্তই রসহীন। বল্লেন ,কর্ণের বানে আহত হয়ে যুধিষ্ঠির তো রণভুমি ছেড়ে চলে গেছেন। কি জানি, এখনো বেঁচে আছেন কি না সন্দেহ। অর্জুন তো হাঁ হাঁ করে উঠলেন ভীমকে বললেন, আপনি এক্ষুনি যান, যুধিষ্ঠিরের খবর নিয়ে আসুন। উদ্বিগ্ব হয়ে বললেন এর আগে দ্রোণাচার্যের বানেও যুধিষ্ঠির খুব আহত হয়েছিলেন, কিন্তু যুদ্ধ করতে করতে সেবারে পালিয়ে গেলেও রণাংগন ছেড়ে একেবরে শিবিরে চলে যান নি। ভীম কিন্তু রনাংগন ছেড়ে যেতে নারাজ, বললেন আমি রণাংগন ছেড়ে চলে গেলে লোকে আমায় ভীতু বলবে। বরং তুমি ই যাও।

    অর্জুন আর কৃষ্ণ তখন কুরুক্ষেত্র রণভুমি ছেড়ে এক ক্রোশ দূরে যুধিষ্ঠিরের শিবিরে প্রবেশ করলেন, সেখানে "ক্ষতবিক্ষতাংগ,রুধিরলিপ্তকলেবর" যুধিষ্ঠির একাকী শুয়ে আছেন। কৃষ্ণ আর অর্জুনকে দেখে তিনি বেজায় খুসী, ভাবলেন কর্ণপতনের সুসংবাদ নিয়ে হাজির এই দুই জনে ।

    বাসুদেব আর অর্জুন কিছু বলবার আগেই যুধিষ্ঠির বলতে শুরু করলেন, "তোমরা অক্ষতশরীরে নিরুপদ্রবে কর্ণকে নিহত করিয়াছ" ইত্যাদি ইত্যাদি। যখন তিনি বুঝতে পারলেন কর্ণ এখনো জীবিত তখন যুধিষ্ঠির রাগে একেবারে ফেটে পরলেন । অর্জুন ধীরে বললেন, আমি ও সংশপ্তকদের সাথে যুদ্ধেই ব্যাস্ত ছিলাম । তারপর অশ্বত্থামা এসে আমার সাথে এমনি যুদ্ধ শুরু করলেন যে আমি আর সময়ই পেলাম না কর্ণের দিকে যাওয়ার। অশ্বত্থামা আট আটটি গোরুর গাড়ী বোঝাই অস্ত্র আমার উপর নিক্ষেপ করলেন। তারপর কোনোক্রমে অশ্ব্ত্থামাকে থামিয়ে আমি যেই বা কর্ণের মুখোমুখী হলাম তখন ই আমার দুশ্চিন্তা হলো আপনাকে না দেখতে পেয়ে। তাই আমি যুদ্ধভুমি ছেড়ে শিবিরে চলে এলাম।

    যাই হোক, আমি আবার ফিরে যাচ্ছি কুরুক্ষেত্রে । সাত্যকি আর ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার পৃষ্ঠরক্ষন আর যুধামন্যু আর উত্তমৌজা আমার পার্শ্বরক্ষণ করুন, আমি কর্ণের সাথে ঘোর যুদ্ধ করবো। অর্জুন বলেন "হে মহারাজ! আপনি ও চলুন, সেই মহাসংগ্রাম নিজের চোখেই দেখবেন।

    কিন্তু যুধিষ্ঠিরের ক্রোধ আর কমেই না ,প্রচুর গালি গালাজ দিলেন অর্জুনকে। বললেন শুধু তোমার উপর নির্ভর করেই আমরা তেরো বৎসর এতো ক্লেশ স্বীকার করলাম, হে নির্বোধ,"এক্ষনে তুমি আমাদিগকে ঘোরতর দুঃখে নিপাতিত করিলে" । বললেন, বরং তুমি কৃষ্ঞের সারথি হতে তবেই ভালো হতো, আর আজ ও যদি কর্ণকে না হারাতে পারো তাহলে তুমি তোমার গান্ডীব কৃষ্ণকে দিয়ে দেও"।

    এরপরের ঘটনা সকলেরই জানা । কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় দুই ভাইএর অভিমান মিটলো। যুধিষ্ঠির বললেন,"এক্ষণে অনুজ্ঞা করিতেছি, তুমি কর্ণকে জয় করো। আমি তোমার প্রতি দুর্বাক্য প্রয়োগ করিয়াছি বলিয়া ক্রুদ্ধ হইয়ো না" ।

    কৃষ্ণ আর অর্জুন আবার ফিরে চললেন রণক্ষেত্রে ।

    কৃষ্ণ দেখলেন অর্জুন তখনো মানসিক হাবে ধ্বস্ত হয়ে আছেন, তার "শরীর হইতে অনবরত স্বেদজল নির্গত" হচ্ছে। কৃষ্ণ দুশ্চিন্তায় পড়লেন, তিনি তখন তার ভোকাল টনিক আবার শুরু করলেন ,
    বললেন ,অর্জুন, মনে পরে কী ভাবে তুমি ভীষ্ম,দ্রোণ,ভগদত্ত,শ্রুতায়ু, অচ্যুতায়ু,কাম্বোজদেশীয় সুদক্ষিণ এবং অবন্তী দেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দকে যুদ্ধে হারিয়েছিলে? আরে মানুষের কথা বাদ দাও, দেবতারাও তোমার সমকক্ষ নয়। উদাহরণ দিলেন, যে দেখো দ্রোণ তোমার হতে নিহত হন নি ঠিকই, কিন্তু তুমি কুরুপক্ষের অন্যান্য বীরদের যদি ব্যতিব্যস্ত না রাখতে তা হলে ধৃষ্টদ্যুম্ন কি আর দ্রোণের মুখোমুখী হতে পারতেন ? কৃষ্ণের এই সমর উৎসাহের অধ্যায়টি দীর্ঘ। বোঝাই যাচ্ছে রণক্লান্ত অর্জুনকে তিনি প্রাণপন উৎসাহিত করবার চেষ্টা করছেন।

    কৃষ্ণের উৎসাহবানীতে উদ্বুদ্ধ হলেন অর্জুন । শপথ নিলেন কর্ণকে বধ করবার। লজ্জাহীন হয়ে বারবার আত্মপ্রসংশা করতে লাগলেন। "হে মাধব! আমি পুনরায় তোমার নিকট আত্মগুন কীর্ত্তন করিতেছি,শ্রবণ কর। এই ভূমন্ডলে ধনুর্বিদ্দ্যাপরায়ণ,পরাক্রমশালী,ক্রোধপরায়ণ বা ক্ষমাগুনসম্পন্ন আর কোনো ব্যক্তি নাই। আমি ধনু ধারন করিলে একাকী একত্রে সমবেত সমুদয় সুর,অসুর ও অন্যান্য প্রাণিগনকে পরাভূত করিতে পারি। ...... মাদৃশ বক্তি যুদ্ধার্থ গমন করিলে কেহই তাহাকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয় না" ।

    কৃষ্ণ আর অর্জুনের সাক্ষাত পেয়ে "পান্ডব সেনাগন নিনাদসহকারে জলধরপটলের ন্যায় গর্জ্জন করিতে আরম্ভ করিল।"
    কর্ণ আর অর্জুনের দ্বৈরথের আগে শুরু হলো দুই প্রতিদ্বন্দীর চক্ররক্ষকের লড়াই, যুধামন্যুর সাথে চিত্রসেনের আর উত্তমৌজার সাথে সুষেণের । উত্তমৌজার শরাঘাতে সুষেণের "ছিন্নমস্তক ভূমন্ডল ও নভোমন্ডল প্রতিধ্বনিত করিয়া সমরাংগনে নিপাতিত হইল" । সুষেণ, কর্ণের তৃতীয় পুত্র, যিনি আজকের যুদ্ধে প্রাণ হারালেন। কর্ণ এই দিন তার আরো পুত্রের মৃত্যুর সাক্ষী থাকবেন।

    এর পরের অধ্যায়টি (সাতাত্তরতম) ভীম আর তার সারথি বিশোকের কথোপকথন। আগেই লিখেছি মহাভারতে একজন পেশাদার সারথি ই ছিলেন খ্যাতনামা, তিনি বিশোক । কৃষ্ণের সারথি দারুক ও নামকরা ছিলেন কিন্তু এই যুদ্ধে তার কোনো ভূমিকা ছিলো না।
    ভীম বললেন "আমি এক্ষণে যুদ্ধে একান্ত আসক্ত হইয়াছি।" কিন্তু এই সংকূল যুদ্ধে শত্রু মিত্র আলাদা করে চেনাই যাচ্ছে না। দেখো যেনো ভীড়ের মধ্যে আমি সেমসাইড না করে বসি। যুধিষ্ঠিরও রণাংগনেই নেই, অর্জুন তো এখনো ফেরেন নি। এই দুজনেই বেঁচেও আছেন কিনা তাও জানি না। যাই হোক, আমি একাই লড়বো আমার অস্ত্র যথেষ্ট মজুত তো?"
    বিশোক বিরাট লিস্ট দিলেন। বললেন আপনার এতো অস্ত্র মজুত আছে যে ছয়টা বলদও সেই অস্ত্র বোঝাই গাড়ী টেনে নিয়ে যেতে পারবে না। "অস্ত্র নিঃশেষিত হইবার কিছুমাত্র আশংকা করিবেন না।"

    এইসব বলতে বলতেই অর্জুনের রথের দেখা পেলেন বিশোক, বললেন ,আমি তো গান্ডীর ধ্বণি আগের থেকেই শুনতে পারছিলাম। ঐ তো দেখা যাচ্ছে অর্জুনের রথ, সামনে বাসুদেব বসে, পাশে তার চক্রাস্ত।(৯) কৃষ্ণ অস্ত্র না ব্যবহারে প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কিন্তু তার চক্রটিকে সাথে নিয়েই রথ চালাতেন। ভীম খুবই খুসী হলেন, বললেন ,বিশোক, এই সুসংবাদের জন্য তোমার পুরষ্কার চৌদ্দটা গ্রাম, একশো দাসী আর কুরিটা রথ।

    নাঃ। মহাভারত ঝট করে অর্জুন আর কর্ণকে মুখোমুখী করলেন না। আরো দু চারটে সংঘর্ষের ব্যাখ্যান দিলেন; যেনো এখনকার সিরিয়ালের মতন। ক্লাইম্যাক্স যতোটা পারা যায় ঠেলে ঠেলে পিছিয়ে দেওয়া যায়, ততঃক্ষণ টি আর পি বাড়তেই থাকুক।

    কর্ণ আর অর্জুন, দুজনেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ পরষ্পরের প্রাণসংহারে। অথচ গত দিনেও একেবারে দিন শেষে একবার দুই জনে মুখোমুখী হলেন, আজ সারা দিনে তারা শুধু অন্যদের সাথে যুদ্ধেই ব্যস্ত থাকলেন। হতেই পারে, দুই পক্ষেই ট্যাকটিক্যাল এবং শর্ট টার্মের লক্ষ্য ছিলো কর্ণ/অর্জুন কে বৃথা যুদ্ধ করিয়ে ক্লান্ত ও বিক্ষত করে দেওয়া, এ ছাড়া,এমন কি যুধিষ্ঠিরের অভিযোগ ছাড়াও, মনে হয় এই দুই যোদ্ধাই যতক্ষন পারছেন তাঁদের দ্বৈরথ সংগ্রামকে যতক্ষন সম্ভব পিছিয়ে দিচ্ছেন।

    কর্ণ আর অর্জুনের দ্বৈরথের আগে আরো কয়েকটি সংঘর্ষ হয়েছিলো, সেই সংগ্রাম বর্ণনা পৌনঃপুনিক ভাবে একই রকমের।

    এইসময়ে দেখি শল্য বেশ উৎসাহব্যাঞ্জক কথা বলছেন কর্ণকে।

    শল্য বললেন, দেখো, অর্জুন একাই আসছেন তোমার কাছে। "কেহই উহার পৃষ্ঠ বা পার্শ্বদেশ রক্ষা করিতেছে না।"বললেন, এই সমরসাগরে কৌরবেরা তোমাকেই দ্বীপের মতন আশ্রয় করেছে। যেমন ভাবে তুমি বৈদেহ,অম্বষ্ঠ,কাম্বোজ,নগ্নজিৎ ও গান্ধারদের পরাজিত করেছো সে ভাবেই তুমি অর্জুনের কাছে যাও। খুব যে একটা "হাত খুলে" প্রশংসা, তা নয় তবুও শল্যের কাছে থেকে ঐ টুকু মরাল সাপোর্ট পেয়েই কর্ণ খুব খুসী। তিনি বললেন "হে মদ্ররাজ! তুমি এক্ষনে প্রকৃতিস্থ ও আমার অভিমত হইয়াছ।" কর্ণ এইবার নির্দেশ দিলেন তার সহযোদ্ধাদের, "হে বীরগন! তোমরা বাসুদেব ও অর্জুনের প্রতি ধাবমান হইয়া তাহাদিগকে অবরুদ্ধ ও পরিশ্রান্ত কর। ঐ বীরদ্বয়কে শরনিকরে সাতিশয় ক্ষতবিক্ষত করিলে আমি অক্লেশে উহাদিগকে সংহার করিতে সমর্থ হইব।" গত দুই দিন ধরে কর্ণ আর অর্জুন, দুই জনেরই পরষ্পরের প্রতি সংগ্রামবিমুখিতার বোধহয় এইটাই কারন। দু জনেই চাইছেন তার প্রতিদ্বন্দী যেনো বৃথা যুদ্ধে আহত ও ক্লান্ত হয়ে থাকে।

    কিন্তু তখনো এই দুই রথি দ্বৈরথ সংগ্রামে সামিল হলেন না। অর্জুনকে দেখি (৮১তম অধ্যায়) দশজন কুরুপুত্র একযোগে অর্জুনকে আক্রমন করলে কৃষ্ণ তাঁদের "বামপার্শ্বে রথসঞ্চালন করিতে লাগিলেন"। শত্রুপক্ষ বামপার্শ্বে থাকলে ডানহাতি তীরন্দাজের সুবিধা, অর্জুনও সেই সুযোগে সেই দশ ধৃতরাষ্ট্রপুত্রের প্রাণসংহার করলেন । অর্থাৎ গান্ধরীর শত পুত্র শুধু ভীমের হাতেই নিহত তাহলে হন নাই।
    এর কিছু পরেই কর্ণের আরেক পুত্র,প্রসেন মারা যাবেন সাত্যকির শরে।
    আর ভীম ? দুঃশাসনের মুখোমুখী হলে তাঁদের লড়াই কিন্তু সমানে সমানেই চলছিলো। মানে যতক্ষন লড়াইটি ছিলো দুই পক্ষের তীরন্দাজির মাধ্যমে। কিন্তু ধনুর্বান ভীমের পছন্দ হয় না। বেশীক্ষন তিনি এই মুক্ত অস্ত্রে সাবলীল হতে পারেন না। দুঃশাসনকে ডেকে বলেলেন ভীম, "তুমি তো আমাকে (বান) বিদ্ধ করলে,এক্ষনে আমি গদা প্রহার করিতেছি,সহ্য কর।" ভীমসেনের গদা ছুঁড়ে মারলে দুঃশাসন কম্পিত কলেবর ও বেদনায় নিতান্ত কাতর হয় মাটীতে লুটিয়ে পরলেন। এরপরে ভীম ভুলুন্ঠিত দুঃশাসনের মাথা খড়্গ দিয়ে ছিন্ন করে বারবার রক্তপান করলেন।

    এই ভয়াবহ ঘটনার ফলেই বোধহয় শেষ মুহুর্ত্তে অশ্বত্থামা আর কৃপাচার্যের সন্ধির প্রস্তাব দুর্যোধন নাকচ করে দেন। ।

    কর্ণ আর আর্জুনের শেষ সংঘাতের অগে কর্ণ পঞ্চম ও শ্রেষ্ঠ বীর সন্তান বৃষসেনের মৃত্যু দেখবেন । এই বৃষসেনই ছিলো কর্ণের সুযোগ্য উত্তরাধিকারী যেমন অভিমন্যু ছিলেন অর্জুনের। ইনি আজকের যুদ্ধে কর্ণের পৃষ্ঠরক্ষক ছিলেন,তার সাথে পান্ডবদের লড়াইর বিবরণ দেখে মনে হয় পান্ডবেরা কর্ণকে পিছন থেকে ঘিড়ে ফেলবার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। বৃষসেন কিন্তু একাই মোকাবেলা করছেন অনেকের সাথে। এই সময়ে মহাবীর বৃষসেন,লৌহময় তিনশরে (নকুল পুত্র) শতানীককে বিদ্ধ করে ভীমকে তিন,অর্জুনকে তিন, নকুলকে সাত আর কৃষ্ণকে দ্বাদশশরে বিদ্ধ করলেন। "ঐ সময়ে কৌরবগন কর্ণপুত্রের লোকাতীত কার্য্য সন্দর্শনে আহ্লাদিত হইয়া তাঁহার ভুয়সী প্রশংসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু যাঁহারা অর্জুনের পরাক্রম সবিশেষ অবগত ছিলেন,তাহারা কর্ণপুত্রকে হুতাশনে আহুত বলিয়া বোধ করিলেন।"

    অভিমন্যু বধে এই বৃষসেনের ও ভুমিকা ছিলো,অর্জুন সেটা ভোলেন নি। তাই কর্ণকে শুনিয়ে তিনি চেঁচিয়ে বললেন, আমি তোমার চোখের সামনেই তোমার পুত্রকে বিনাশ করব, তোমার ক্ষমতা থাকলে আমাকে আটকাও।

    দশটি তীরে বৃষসেনের বুক বিঁধে চার ক্ষুরাস্ত্রে তার ধনুক,দুই হাত আর মাথা ছিন্ন করে ফেললেন। মনে হয় বৃষসেনকে শুধু হত্যাই নয় একেবারে কচুকাটা করেই অর্জুনের প্রতিহিংসাবোধ পুর্ণ হলো।
    কর্ণ আর অর্জুন মুখোমুখী হওয়ার সময়েই অশ্ব্ত্থামা গেলেন দুর্যোধনের কাছে, বললেন "মহারাজ, এইবার ক্ষান্ত হোন। অনেক প্রাণহানি হয়ে গেছে, মৃতদের মধ্যে ভীষ্ম ও আমার বাবা দ্রোণও আছেন। এইবার পান্ডবদের সথে সন্ধিপ্রস্তাব করুন। যুধিষ্ঠির তো চিরকালই শান্তিকামী ও তার আদেশ অন্য চার ভাই মেনে নেবেন। "তুমি প্রসন্ন হইয়া যদি পান্ডবগনের সহিত মিত্রতালাভে কৃতকার্য হও,তাহা হইলে তোমা হইতে জগতের হিতসাধন হইবে" ।

    দুর্যোধন মুহুর্ত্তকাল চিন্তা করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, আপনি সঠিক বলেছেন কিন্তু অল্পক্ষণ আগেই ভীম দুঃশাসনের রক্তপান করে যা করলো তার পর কি আর আমার সন্ধিপ্রস্তাব দেওয়া সাজে? আর এই সময়ে আমি কর্ণকেও সামলাতে পারবো না। দেখুন, অর্জুন খুবই ক্লান্ত,আজ কর্ণই যুদ্ধ জিতবেন। এই বলেই দুর্যোধন কৌরব সেনানীদের তাড়া দিলেন, আরে,তোমরা এরকম নিশ্চিন্ত হয়ে আছো কেন? যাও যাও ,যুদ্ধ করো।

    দুই পক্ষের সেনানীরা চিৎকার করে উৎসাহ দিতে লাগলেন কর্ণ আর অর্জুনকে। দুজনের যুদ্ধ শুরু হলো। ফাইনাল এনকাউন্টার।
    অর্জুন ক্রমাগত নারাচ,নালীক, বরাহকর্ণ,ক্ষুর,আঞ্জলিক ও অর্ধচন্দ্র বাণ নিক্ষেপ করতে লাগলেন। সাঁঝবেলায় বাড়ী ফেরা পাখীর ঝাঁকের মতন অর্জুনের তীরেরা কর্ণের রথের দিকে ধেয়ে গেলো। কর্ণও অজস্র বানে অর্জুনের আক্রমনএর পাল্টা উত্তর দিতে লাগলেন। এই সংঘর্ষেই অশ্বসেনের অতিলৌকিক কাহিনিটির উল্লেখ আছে। সামরিক দিক দিয়ে তাৎপর্য্যপুর্ন এই ই যে কৃষ্ণের চাপে রথ মাটীতে গেঁথে গেলে কৃষ্ণ স্বয়ং রথ থেকে নেমে নিজের দুই হাতে রথের চাকা আকর্ষণ করে রথটিকে আবার সচল করলেন।

    অর্জুন প্রায় প্রথম থেকে জিতে চলেছেন। কর্ণের মুকুট ও কুন্ডল অর্জুনের শরাঘাতে ছিন্ন হলো। কর্ণের কুন্ডলের যে কোন সামরিক তাৎপর্য্য ছিলো জানা নেই, কিন্তু একাধিক বার দেখা গেছে কর্ণের কুন্ডল ছেদন করা হয়েছে। অন্য কোনো রথির ক্ষেত্রে কিন্তু এই কুন্ডলচ্ছেদনের কোনো ঘটনা ঘটে নি, বা লেখা হয় নি। এর পরে দেখি অর্জুনের বাণে কর্ণের বর্মও ছিন্ন হলো। "উত্তম উত্তম শিল্পীরা বহু যত্নসহকারে দীর্ঘকালে কর্ণের যে মহামুল্য ভাস্বর বর্ম প্রস্ত্তুত করিয়াছিলেন, মহাবীর অর্জুন ক্ষণকাল মধ্যে তাহাও বহুধা বিদীর্ণ করিয়া ফেলিলেন"। সহজাত কবচ ও কুন্ডলের ব্যাপারটা পরিষ্কার নয়। হয়তো আভিচারিক কিছু। কেন না কর্ণ তো মনুষের তৈরী বর্ম পরেই যুদ্ধে এসেছেন দেখছি।

    একটি লক্ষ্য করবার মতন ঘটনা হচ্চে কর্ণ, কৃষ্ণ ও অর্জুন, দুজনকেই শরবিদ্ধ করছিলেন কিন্তু অর্জুন যে শল্যকে আঘাত করছিলেন এমন কথা লেখা নেই; সংঘর্ষের শুরুতেই কিন্তু অর্জুন বলেছিলেন কৃষ্ণকে,যে আজ কর্ণকে আমি সারথি শল্য সমেত "শতধা ছিন্নভিন্ন ও বিচুর্ণিত করিব"। অর্জুনের বাণে কর্ন অবশেষে অচেতন হয়ে পরলেন । অর্জুন তখন যুদ্ধ বিরতি দিলে কৃষ্ণ তাকে প্ররোচিত করলেন, বললেন শত্রুনিপাতে আবার কালপ্রতীক্ষা কিসের? অর্জুন তখন কর্ণকে তার ঘোড়া ও রথের সাথে তীরবিদ্ধ করতে লাগলেন।

    এই সময়েই কর্ণের রথের বামচক্রকে "পৃথিবী গ্রাস করিতে লাগিল"।

    আশ্চর্য্যের ব্যাপার - শল্য কোথায়? হঠাৎ করে তাঁর আর উল্লেখই থাকলো না।

    এইরকম অবস্থাতেও কিন্তু যুদ্ধ চলতেই থাকলো। একবার কর্ণের বাণে গান্ডীবের জ্যা ছিন্ন হলো , কিন্তু অর্জুনের কাছে আরো জ্যা থাকায় তিনি তৎক্ষনাত নতুন জ্যা রোপন করলেন।

    শুধু তাই ই নয়, প্রদীপ নিববার আগে যেমন জ্বলে ওঠে, তেমনি কর্ণ ও যেনো একবার, শেষবারের মতন দীপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি অচল রথের থেকেই শরবর্ষণে অর্জুনের অস্ত্র সকল ছেদ করতে লাগলেন। তিনি " অসাধারণ পরাক্রম প্রদর্শন পুর্বক তাঁহা অপেক্ষাও প্রবল হইয়া উঠিলেন।"

    কৃষ্ণ ব্যস্ত হয়ে বললেন, অর্জুন, তুমি প্রধান অস্ত্র নিয়ে কর্ণের কাছে চলে যাও। ততক্ষনে কর্ণের চাকা মাটীতে দৃঢ় ভাবে গেঁথে গেছে। কর্ণ রথ থেকে মাটীতে লাফিয়ে নামলেন, প্রাণপন চেষ্টা করলেন রথ চক্রকে মুক্ত করতে। দুই হাতে রথের চাকা ধরে প্রবল টান দিলেন। কিন্তু রথ অচল রইলো। কর্ণ অর্জুনকে বললেন "হে পার্থ ! তুমি মুহুর্ত্তকাল যুদ্ধে নিবৃত্ত হও। আমি মহীতল হইতে রথচক্র উদ্ধার করিতেছি। দৈববশতঃ আমার দক্ষিণচক্র পৃথিবীতে প্রোথিত হইয়াছে। এ সময়ে তুমি কাপুরুষোচিত দুরভিসন্ধি পরিত্যাগ কর" । একটু আগেই দেখেছিলাম দক্ষিন নয় তার বাম দিকের রথ চক্রই মাটীতে গেঁথে গেছিলো।
    কর্ন আরো বললেন, আমি এখন ভূতলগত ও বিকলাংগ, অতএব ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুসারে অবধ্য। আরো বললেন , ভেবো না,অর্জুন যে আমি তোমাকে বা বাসুদেবকে বিন্দুমাত্র ভয় পাই। "তুমি ক্ষত্রিয়দিগের মহাকূলে সমুৎপন্ন হইয়াছ বলিয়াই তোমাকে কহিতেছি যে তুমি মুহুর্ত্তকাল আমাকে ক্ষমা কর।"

    অর্জুন, হয়তো সেই সময়টুকু দিতেন কর্ণকে। কিন্তু কৃষ্ণ প্রস্তাবটি নাকচ করে দিলেন । কর্ণকে মনে করিয়ে দিলেন তার আগের ব্যবহার। প্রশ্ন করলেন "হে কর্ণ ! তুমি যখন সেই সেই কালে অধর্ম্মানুষ্ঠান করিয়াছ,আর এ সময় ধর্ম ধর্ম করিয়া তালুদেশ শুষ্ক করিলে কি হইবে?" কর্ণ বাস্তবিক ল্জ্জা পেলেন, "অধোবদন হইলেন, "তৎকালে তাহার মুখে বাকস্ফুর্ত্তি হইলো না"। তিনি আবার যুদ্ধ শুরু করলেন। কর্ণ তখনো রথারুঢ় হন নি। কৃষ্ণ বললেন, রথে চড়বার আগেই কর্ণকে বধ কর ।

    অর্জুন প্রথমে ক্ষুরপ্রাস্ত বাণ দিয়ে কর্ণের রথের ধ্বজাচ্ছেদ করলেন। অনেক জ্ঞানবৃদ্ধ শিল্পীরা অনেক পরিশ্রম করে সেই ধ্বজদন্ড নির্মান করেছিলেন, সেই ধ্বজা, যা দেখলে শত্রুপক্ষের ভীতি আর স্বপক্ষের উৎসাহ বৃদ্ধি হ্ত । এই ধ্বজ ছেদের পরই কৌরব পক্ষের মনের মধ্য থেকে যুদ্ধ জয়ের শেষ আশা ও নিবে গেলো।

    এক অন্জলিক বাণ গ্রহন করলেন অর্জুন।"ঐ মর্মভেদী বাণ মাংস ও শোনিত লিপ্ত। " প্রায় মানুষ সমান দীর্ঘ ছিলো ঐ বাণ। "অর্জুন নিক্ষিপ্ত মন্ত্রপূত সায়ক সেই অপরাহ্নকালে দিগ্মন্ডল ও নভোমন্ডল উদ্ভাসিত করিয়া ....... সুতপুত্রের মস্তক ছেদন করিল।

    ভীষ্ম,দ্রোণ ও অবশেষে কর্ণ। এরা তিনজনেই নিহত হলেন কিন্তু সব ক্ষেত্রেই কিছু না কিছু ফাঁক থেকে গেলো। কর্ণের মৃত্যুও অর্জুনকে চিরকালের জন্য অশেষ বীরের সন্মান দিলো না। নেহাৎই ঘটনাচক্রে,দৈব অভিশাপে, এক বিড়ম্বিত মহা নায়ক যেনো অন্যায় যুদ্ধেই মৃত্যু বরণ করলেন। তার মৃত্যু তাঁকে এমনই মহান করে তুললো যে এতাবৎ কালের তার সব পাপ,দোষ,অন্যায় সব যেনো মুছে যায় পাঠকের মন থেকে। বাইরে যেমন ই থাকুন না কেনো, রণাংগনে কর্ণ ছিলেন ধার্মিক মানুষ। সেই উচ্চতায় অর্জুন ও উঠতে পারেন নি।

    জনমদুখিনি সীতার মতন কর্ণএর জীবনও এক নিরবিচ্ছিন্ন বিশ্বাসঘাতকতায় পরিপুর্ণ। এই সময়ের মহাভারতকার, শ্রী নৃসিং প্রাসাদ ভাদুড়ী তার কর্ণ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন সারা বিশ্বের পুরাণে বিবৃত দেবতাদের চরিত্র ও জীবন থেকে তাঁদের জাতবিচার কর যায়। যারা সুর্য্যবংশীয় বা Solar gods ,তাদের অনেকেই শৈশবেই পরিত্যক্ত বা বিপদগ্রস্থ। ভীষ্ম,মোজেস,কর্ণ,কৃষ্ণএরাই উদাহরণ "পুরাণবিদদের মতে - জন্মানর পর পরই সৌরবংশজাতের এই যে বিপদ,এ বিপদ নাকি পাঠকদের মনে এক ধরনের করুণার উদ্রেক করে এবং করুণাই নাকি তাদের জীবনের পরবর্তী শৌর্য-বীর্য,কীর্তিকলাপকে প্রতিতুলনার মাধ্যমে ভাস্বর করে তোলে। কবি-বিধাতা তাঁদের এইভাবেই গড়ে তোলেন,কর্ণকেও এইভাবেই গড়েছেন।"

    কর্ণ নিহত হলে পরে তার ছিন্নমস্তক দেহের চারিদিক ঘিড়ে থাকলো দুই পক্ষেরই সেনানীরা। কোন পক্ষের সেনা, সেই অনুযায়ী কেউ ভীত,কেউ শোকার্ত্ত,কেউ খুসী।

    এতোক্ষনে শল্যের সন্ধান আবার পাওয়া গেলো। কোথায় ছিলেন ইনি যখন কর্ণের রথচক্র মাটীতে প্রথিত হয়েছিলো? কেনো কর্ণকেই রথ থেকে নেমে অরক্ষিত অবস্থায় লড়াই করতে হলো? বাসুদেবকে তো দেখেছি নিজের হাতে টেনে অর্জুনের রথ তুলে আনছেন কিন্তু শল্যের কোনো হদীশই পাওয়া গেলো না।

    যা হোক, দেখি শল্য সেই ছিন্নধ্বজ রথটিকে নিয়েই দুর্যোধনের কাছে পৌছালেন। "বাষ্পগদ্গদবচনে" শোকবার্ত্তা দিলেন।

    কর্ণসংহারের সাথে সাথেই প্রায় এ দিনের যুদ্ধ শেষ হবে।

    কর্ণসংহারের উপসংহার

    সপ্তদশ দিনের যুদ্ধ আর বিশেষ বাকী ছিলো না। ছত্রভংগ কুরুসেনারা পালাচ্ছে, যেনো স্ট্যাম্পীড। ঘোড়া বা রথ বা হাতী, যে যেমন বাহন পেয়েছে তাতে চড়েই রণাংগন ছেড়ে যাচ্ছে অনেকে। সবাই পালাতে শুরু করলে হাতীর ধাক্কায় রথ, রথের আঘাতে ঘোড়া আর ঘোড়ার চাপে পদাতিরা বিনষ্ট হলো। দুর্যোধন শেষ চেষ্টা করছেন, যেনো ওয়াটার্লুতে নেপোলিয়ঁর মতন, পলায়মান সেনানীদের জনে জনের জামার আস্তিন ধরেও শেষ আদেশ বা উপরোধ, থামো, আরেকবার রুখে দাঁড়াও।
    দুর্যোধন কিন্তু হাল ছাড়লেন না, সারথিকে বললেন, তুমি ঐ সেনানীদের মধ্যেই আমার রথ চালাও। অর্জুনকে বধ করে আমি কর্ণের ঋণ মুক্ত হবো। তিনি একাকীই পান্ডবসেনাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলেন। নিজের দলের সেনাদের ডেকে বললেন, আমাদের পালিয়ে যাওয়ার মতন নিরাপদ আশ্রয় কোথাও নেই। যদি পালিয়ে যাই তো পান্ডবেরা আমাদের পিছু নিয়ে আমাদেরকে মেরে ফেলবে আমাদের একমাত্র আশা যে অল্প সংখ্যক পান্ডব এখনো অবশিষ্ট আছে তাদের বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই করে এই যুদ্ধ জিতে নেওয়া, এ ছাড়া আমাদের বাঁচবার আর কোনো উপায় নেই।

    কিন্তু ক্ষতবিক্ষত কুরুসেনারা দুর্যোধনের "বাক্য উপেক্ষা করিয়া নানাদিকে ধাবমান হইলো"। শল্য ও এসে দুর্যোধনকে বোঝালেন, রণাংগন মৃত ও আহত পশু ও মানুষে পুর্ণ হয়েছে, ভাঙা রথ, খন্ডিত অস্ত্রে কুরুক্ষেত্র সংপৃক্ত। "অতএব, হে মহারাজ! এক্ষণে সৈন্যগন স্বেচ্ছানুসারে গমন করুক। তুমি ও প্রতিনিবৃত্ত হইয়া স্বশিবিরে প্রবেশ কর। ঐ দেখ, ভগবান কমলিনীনায়ক অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইয়াছেন।"

    রাত হলে "কৃষ্ণপুচ্ছ মনোবেগগামী শ্বেতাশ্বসমুদয়ে সংযোজিত কনকমন্ডিত রথে" সমরভূমে এলেন যুধিষ্ঠির, নিজের চোখে দেখলেন কেশর পরিবৃত কদম্বকুসুমের মতন মহাবীর কর্ণের মরদেহ অসংখ্য শরে বিদ্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। কৃষ্ণকে বললেন যুধিষ্ঠির, গত তেরো বৎসর একটিও রাত আমরা নিশ্ছিদ্র নিরুপ্রদবে ঘুমাতে পারি নি। "আজ তোমার অনুগ্রহে নিদ্রাসুখ অনুভব করিব।"

    **************************************************************


    সংযোজন

    (১) বংকিমচন্দ্র তার কৃষ্ণচরিত্রে লিখছেন " মহাভারতে যে যুদ্ধের বর্ণনা আছে,তাহা কতকগুলি দ্বৈরথ্য যুদ্ধ মাত্র। রথিগন যুধ করিবার সময় পরষ্পরের অশ্ব ও সারথিকে বিনাশ করিবার চেষ্টা করিতেন। তাহার কারণ, অশ্ব বা সারথি নষ্ট হইলে আর রথ চলিবে না। রথ না চলিলে রথী বিপন্ন হয়েন, সারথিরা যোদ্ধা নহে - বিনাযুদ্ধে,বিনাদোষে নিহত হইত।

    (২) তবে তোমরের আবার রকমফের আছে, দীর্ঘ এবং হ্রস্ব দুটোই হয় এবং তার মধ্যে আবার দৈর্ঘ ভেদে উত্তম,মধ্যম আর অধম হয়। দীর্ঘ তোমর পাঁচ,সাড়ে চার বা চার হাত দীর্ঘ হয়। হ্রস্ব তোমর কে লৌহ শলাকা বলা যায়, মাত্র ছয়,পাঁচ বা সাড়ে চার আঙুল দীর্ঘ। ক্ষেমধুর্ত্তি এক সময়ে ভীমসেনকে একই সাথে সাতটি তোমরে বিদ্ধ করেছিলেন, সে গুলি বোধ হয় শলাকা জাতীয়।

    (৩) নারাচ - লোহার বাণের নাম। ভারী ,তাই বর্মভেদী হতো। এর দশটি কর্ম বা গতি, উন্মুখী, অভিমুখী, তির্য্যক ,মন্দা-ত্বকছেদিনী, গোমুত্রকা-কবচভেদিনী, ধ্রূবা, স্থলিতা,সমকান্তা-লক্ষ্যভেদপুর্বক বহির্গামিনী, কুষ্টতী- নিকটস্থ লক্ষ্যভেদী ও দ্রগতি- মস্তকচ্ছেদন পুর্বক দূরপাতিনী।

    (৪) অগ্নিপুরাণের মতে ধনুর্যুদ্ধ শ্রেষ্ঠ,প্রাস(ক্ষেপনীয় অস্ত্র যেমন শক্তি,তোমর) যুদ্ধ মধ্যম, অসি যুদ্ধ অধম, ও অস্ত্রহীন, যেমন মল্লযুদ্ধ জঘন্য। দ্রোণচার্য্যের কাছে নকুল অসিবিদ্যায় পারদর্শী হন, কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি।

    (৫) সারথি হিসাবে রাজারা একেবারে নগণ্য ছিলেন না। সাত্যকি কখনো অর্জুনের রথ চলিয়েছেন,বিরাট রাজের পুত্র উত্তর দ্ম্ভ ভরে শল্যকে বলেছিলেন বিরাট যুদ্ধে আমি ছিলাম অর্জুনের সারথি। যুধিষ্ঠিরও দ্রোণাচার্যের কাছে রথ চালনা শিক্ষায় বিশেষ পারদর্শী হয়েছিলেন।

    (৬) দ্রোণপর্বের তেইশতম অধ্যায়ে ঘোড়া নিয়ে আখ্যান ছিলো। "ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন," হে সঞ্জয় ! ভীমসেন প্রমুখ যে যে মহাবীর ক্রোধভরে দ্রোণের অভিমূখীন হইয়াছিলেন,তাঁহাদিগের সকলের রথচিহ্নসমুদয় ব্রণনা কর"। এতে প্রায় জনা পঞ্চাশেক রথি ও তাঁদের ঘোড়াদের বর্ণনা আছে। কান্বোজ ও বাহ্লীক দেশের ঘোড়ারা যে বিখ্যাত ছিল সেটি এই অধ্যায়েও উল্লেখিত আছে।

    (৭)ধনুকের নাম থাকত। নকুলের বৈষ্ঞব শরাসন, সহদেবের আশ্বিন,ঘটোৎকচর পৌলস্ত, এবং দ্রৌপদীর পাঁচছেলের রৌদ্র,আগ্নেয়,কৌবের্য্য,ধাম্য ও গিরিশধনু ছিলো। অভিমন্যুর ছিলো বলরামের রৌদ্রধনু।

    (৮) নারাচ ও নালীক অনেক সময়েই একই সাথে উল্লেখিত হত। নালীক ঠিক কি ছিলো সে নিয়ে অনেক মতামত আছে, তবে যেহেতু প্রায়শঃই নারাচের সাথে একযোগে লেখা হতো তাতে মনে হয় নারাচের এক লঘু ভার্শানের নাম নালীক। মানে, পুরোটাই সলিড লোহার বান হচ্ছে নারাচ, আর নলাকৃতি,ফাঁপা ও হাল্কা লোহার বাণের নাম নারাচ।

    (৯)বাশিষ্ঠ ধনুর্বেদে সাত প্রকার যুদ্ধের উল্লেখ আছে; যথা ধনুর্যুদ্ধ,চক্রযুদ্ধ,কুন্তযুদ্ধ,খড়গ যুদ্ধ,ছুরিকাযুদ্ধ,গদাযুদ্ধ ও বাহুযুদ্ধ। এর মধ্যে চক্রযুদ্ধ আছে কিন্তু মহাভারতে চক্রযুদ্ধর কোনো বিবরণ নেই, অবশ্য ছুরিকা যুদ্ধেরও নেই। হতে পারে সেগুলি মুলতঃ সাধারন পদাতিক সেনানীদেরই ব্যবহৃত অস্ত্র ছিলো।

    (১০)অঞ্জলিক বাণের যে বর্ণনা অছে তাতে বোঝা যায় এটি একটি দীর্ঘ,ভারী ও বড় ফলকের বাণ । ফলকের আকৃতি অঞ্জলিবদ্ধ হাতের মতন। তুলনীয় জাপানী যনিণী "ধর্মা" ফলকের বাণ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ মার্চ ২০১৬ | ২৪৭৩ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    চম - dd
    আরও পড়ুন
    ও শানওয়ালা - dd
    আরও পড়ুন
    দ্রোণ পর্ব - dd
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • b | 24.139.196.6 (*) | ১৭ মার্চ ২০১৬ ০৫:৪৪56394
  • কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে, শল্য যখন দুর্য্যোধনের পরিচর্য্যায় ভুলে কুরুপক্ষে যোগ দিলেন, তখন যুধিষ্ঠির (নাকি কৃষ্ণ) শল্যকে বলেছিলেন, মামা, ওদিকে যাচ্ছেন যান, কিন্তু যখন কর্ণের সারথি হিসেবে আপনাকে নিযুক্ত করবে, তখন নানা উল্টোপাল্টা কথা বলে কর্ণকে বিভ্রান্ত করবেন। এই সাবোতাজের দায়িত্বে শল্য সম্মতি দিয়েছিলেন।

    সেই মাতুলকে কেন যে পান্ডবেরা হত্যা করলেন, কে জানে!
  • avi | 113.24.86.249 (*) | ১৭ মার্চ ২০১৬ ০৬:৫৭56395
  • আহহ, তারিয়ে তারিয়ে পড়বো এবার।
  • Atoz | 161.141.85.8 (*) | ১৭ মার্চ ২০১৬ ০৮:৫১56396
  • স্যাবোট্যাজ যারা করে, রাজা রাজড়ারা নিজেদের কাজ মিটে গেলে তাদের ভ্যানিশ করে দেয়, এটা তো ইতিহাসেও দেখা যায়। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা কেস।
  • avi | 113.24.86.249 (*) | ১৭ মার্চ ২০১৬ ০৯:০১56397
  • খাসা লাগলো। একটা ডিডিসমগ্র হাতে পাওয়া সময়ের দাবী হয়ে উঠছে।
    ভালো কথা, শল্য নিয়ে অভিষেক মুখার্জি একটা ব্লগ লিখেছিলেন। আগে। অত্যন্ত সুখপাঠ্য ছিল সেটি।
  • avi | 113.24.86.249 (*) | ১৭ মার্চ ২০১৬ ০৯:৩৮56398
  • শেষে কর্ণের কবচ বা বর্ম নিয়ে, র‍্যাদার তার অভেদ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দেখলাম। কিন্তু কর্ণের দৈব কবচ তো অলরেডি বেহাত, এগুলো হয়তো হেঁজিপেঁজিই ছিল।
  • Rit | 213.110.242.7 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০১:১১56416
  • সব বাণে তো আর ট্র্যাকিং টেকনোলজি ছিল না। একাঘ্নী তে ছিল।
  • dd | 116.51.25.54 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০২:৩৮56399
  • ও হো। একটা "সংযোজন"ও ছিলো। ফুটনোট।

    এইবারে দিয়া দিলাম।

    সংযোজন

    (১) বংকিমচন্দ্র তার কৃষ্ণচরিত্রে লিখছেন " মহাভারতে যে যুদ্ধের বর্ণনা আছে,তাহা কতকগুলি দ্বৈরথ্য যুদ্ধ মাত্র। রথিগন যুধ করিবার সময় পরষ্পরের অশ্ব ও সারথিকে বিনাশ করিবার চেষ্টা করিতেন। তাহার কারণ, অশ্ব বা সারথি নষ্ট হইলে আর রথ চলিবে না। রথ না চলিলে রথী বিপন্ন হয়েন, সারথিরা যোদ্ধা নহে - বিনাযুদ্ধে,বিনাদোষে নিহত হইত।

    (২) তবে তোমরের আবার রকমফের আছে, দীর্ঘ এবং হ্রস্ব দুটোই হয় এবং তার মধ্যে আবার দৈর্ঘ ভেদে উত্তম,মধ্যম আর অধম হয়। দীর্ঘ তোমর পাঁচ,সাড়ে চার বা চার হাত দীর্ঘ হয়। হ্রস্ব তোমর কে লৌহ শলাকা বলা যায়, মাত্র ছয়,পাঁচ বা সাড়ে চার আঙুল দীর্ঘ। ক্ষেমধুর্ত্তি এক সময়ে ভীমসেনকে একই সাথে সাতটি তোমরে বিদ্ধ করেছিলেন, সে গুলি বোধ হয় শলাকা জাতীয়।

    (৩) নারাচ - লোহার বাণের নাম। ভারী ,তাই বর্মভেদী হতো। এর দশটি কর্ম বা গতি, উন্মুখী, অভিমুখী, তির্য্যক ,মন্দা-ত্বকছেদিনী, গোমুত্রকা-কবচভেদিনী, ধ্রূবা, স্থলিতা,সমকান্তা-লক্ষ্যভেদপুর্বক বহির্গামিনী, কুষ্টতী- নিকটস্থ লক্ষ্যভেদী ও দ্রগতি- মস্তকচ্ছেদন পুর্বক দূরপাতিনী।

    (৪) অগ্নিপুরাণের মতে ধনুর্যুদ্ধ শ্রেষ্ঠ,প্রাস(ক্ষেপনীয় অস্ত্র যেমন শক্তি,তোমর) যুদ্ধ মধ্যম, অসি যুদ্ধ অধম, ও অস্ত্রহীন, যেমন মল্লযুদ্ধ জঘন্য। দ্রোণচার্য্যের কাছে নকুল অসিবিদ্যায় পারদর্শী হন, কিন্তু কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে সেরকম কোনো লক্ষণ দেখা যায় নি।

    (৫) সারথি হিসাবে রাজারা একেবারে নগণ্য ছিলেন না। সাত্যকি কখনো অর্জুনের রথ চলিয়েছেন,বিরাট রাজের পুত্র উত্তর দ্ম্ভ ভরে শল্যকে বলেছিলেন বিরাট যুদ্ধে আমি ছিলাম অর্জুনের সারথি। যুধিষ্ঠিরও দ্রোণাচার্যের কাছে রথ চালনা শিক্ষায় বিশেষ পারদর্শী হয়েছিলেন।

    (৬) দ্রোণপর্বের তেইশতম অধ্যায়ে ঘোড়া নিয়ে আখ্যান ছিলো। "ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন," হে সঞ্জয় ! ভীমসেন প্রমুখ যে যে মহাবীর ক্রোধভরে দ্রোণের অভিমূখীন হইয়াছিলেন,তাঁহাদিগের সকলের রথচিহ্নসমুদয় ব্রণনা কর"। এতে প্রায় জনা পঞ্চাশেক রথি ও তাঁদের ঘোড়াদের বর্ণনা আছে। কান্বোজ ও বাহ্লীক দেশের ঘোড়ারা যে বিখ্যাত ছিল সেটি এই অধ্যায়েও উল্লেখিত আছে।

    (৭)ধনুকের নাম থাকত। নকুলের বৈষ্ঞব শরাসন, সহদেবের আশ্বিন,ঘটোৎকচর পৌলস্ত, এবং দ্রৌপদীর পাঁচছেলের রৌদ্র,আগ্নেয়,কৌবের্য্য,ধাম্য ও গিরিশধনু ছিলো। অভিমন্যুর ছিলো বলরামের রৌদ্রধনু।

    (৮) নারাচ ও নালীক অনেক সময়েই একই সাথে উল্লেখিত হত। নালীক ঠিক কি ছিলো সে নিয়ে অনেক মতামত আছে, তবে যেহেতু প্রায়শঃই নারাচের সাথে একযোগে লেখা হতো তাতে মনে হয় নারাচের এক লঘু ভার্শানের নাম নালীক। মানে, পুরোটাই সলিড লোহার বান হচ্ছে নারাচ, আর নলাকৃতি,ফাঁপা ও হাল্কা লোহার বাণের নাম নারাচ।

    (৯)বাশিষ্ঠ ধনুর্বেদে সাত প্রকার যুদ্ধের উল্লেখ আছে; যথা ধনুর্যুদ্ধ,চক্রযুদ্ধ,কুন্তযুদ্ধ,খড়গ যুদ্ধ,ছুরিকাযুদ্ধ,গদাযুদ্ধ ও বাহুযুদ্ধ। এর মধ্যে চক্রযুদ্ধ আছে কিন্তু মহাভারতে চক্রযুদ্ধর কোনো বিবরণ নেই, অবশ্য ছুরিকা যুদ্ধেরও নেই। হতে পারে সেগুলি মুলতঃ সাধারন পদাতিক সেনানীদেরই ব্যবহৃত অস্ত্র ছিলো।

    (১০)অঞ্জলিক বাণের যে বর্ণনা অছে তাতে বোঝা যায় এটি একটি দীর্ঘ,ভারী ও বড় ফলকের বাণ । ফলকের আকৃতি অঞ্জলিবদ্ধ হাতের মতন। তুলনীয় জাপানী যনিণী "ধর্মা" ফলকের বাণ।
  • | 24.97.42.38 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০২:৫০56400
  • এইটে অজ্জিনাল পোস্টে জুড়ে দেন। লগ অন করা থাকলে দেখবেন একটা কুট্টি ড্রপডাউন আসে অ্যাড টু কমেন্ট বলে, ওর নীচের অপশান বোধহয় অ্যাড টু অরিজিনাল পোস্ট। সেইটে সিলেক্ট করে এইবারে এই অংশটা পেস্টিয়ে দ্যান।
  • dd | 116.51.25.54 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৩:১০56401
  • d।দ্যালাম। থেংকু।

    @অভি।

    বর্ম আর কবচ এক জিনিস নয়(আমার ধারনা)। কাঁসার বর্মের উল্লেখ আছে মহাভারতে।

    আর কুমারসম্ভবে কার্ত্তিক আর তারকাসুরের যুদ্ধের বর্ণনায় আছে বর্মের তুলোতে যুদ্ধক্ষেত্র পুর্ণ। এটা মনে হয় মোটা কটনের দু ফালি আস্তরণের মধ্যে তুলো বা ছোবড়া পুরে সাধারন সেনাদের একটা মোটামুটি "বর্ম" হতো। আজতেক সেনানীরাও এরকম ভাবে "কাপুক" তুলোর বর্ম পড়তো যেটা তাদের অস্ত্রের বিরুদ্ধে কাজে দিতো।

    কর্ণের সহজাত কবচ মনে হয় কোনো জন্মদাগ গোছের - লোকে ভাবতো অভেদ্য। এছাড়া বহুবার কবচের কথা আছে - যেগুলি মাদুলি গোছের কিছু। নট বর্ম।
  • PM | 59.14.96.235 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৪:৪৮56402
  • ডিডি বাবুর আরো আগে রিটায়ার করা উচিত ছিলো ঃ) আরো কি কি আসছে ভেবেই রোমন্চিত
  • Rit | 213.110.242.7 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৫:৪৪56403
  • গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। গোটা মহাভারত টাই লেখা যায় না?
    ও ডিডি স্যর।
  • avi | 113.24.86.249 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৬:৪৬56404
  • যে কটা যুদ্ধের টেকনিক্যাল দিক নিয়ে বাংলায় পড়তে চাই ডিডি-স্যরের লেখায়:
    গ্রীক ও পারসিক ঝামেলা, হুণদের ট্যাকটিকস ( রোমান আর গুপ্ত দুই প্রসঙ্গেই), হ্যানিবল এবং ইউরোপে হাতি, হর্ষ-শশাঙ্ক-পুলকেশী বাওয়ালের মিলিটারি দিক, চোল ও নৌযুদ্ধ (যদি আদৌ থেকে থাকে), রিচার্ড-সালাদিন, মোঙ্গল ও স্তেপস রণকৌশল, চীন থেকে ইউরোপ অব্দি বারুদ ও আগ্নেয়াস্ত্রের বিবর্তন, ট্রেঞ্চ ওয়ারফেয়ার।
    যদি এট্টু এট্টু করে হয়, বড্ডো ভালো হয়। :)
  • avi | 113.24.86.141 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৭:০৭56417
  • হুঁ হুঁ বাবা, সেযুগে যদি পাণ্ডবদের কালি-র মত প্রযুক্তি থাকত, ঘটোৎকচকেও মরতে হত না, যুদ্ধও হত না। কৌরবেরাও ঘরে বসে ভয়ে কাঁপত। সাধে কি বিবেকানন্দ লিখেছিলেন, "কালি, দ্য মাদার"!
    কৃষ্ণ কিন্তু ইউ পি থেকে গুজরাট গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে দিল্লীর মসনদের নির্ণায়ক হয়ে উঠেছিলেন। মহাভারতের শিক্ষা বলছে কুরুক্ষেত্রে গুজরাট, রাজস্থান, এম পি, হরিয়ানার শাসকের কাছে দিল্লী, বিহার, বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব, কাশ্মীর হারবেই, এমনকি তাদের আফগানিস্তানের সাপোর্ট থাকলেও।
  • PM | 116.78.89.76 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৭:১০56405
  • ডিডিদা, আপনার উল্লিখিত ভুলগুলো কি কাশীদাসী মরাভারতে নকি মুল ব্যাসের মহাভারতে?
  • PM | 59.14.100.79 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৮:২৮56406
  • আমার একটা কথা মনে হচ্ছে ঠিক কিনা জানি না। আর্জুন-কর্ণ দ্বৈরথের কোনো এক রাউন্ডে কর্ণ অর্জুনকে পর্য্যুদস্ত করেছিলেন এমনভাবে যে কৃষ্ণ নিজেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন হাতে। তাতে কর্ণ অস্ত্রত্যাগ করে কৃষ্ণের হাতে মৃত্যু প্রার্থনা করেছিলো। আর্জুন সে যাত্রা কৃষ্ণকে থামান কোনোক্রমে। এটার উল্ল্যেখ দেখলাম না।

    নাকি ওটা অন্য কারুর সাথে যুদ্ধের ঘটনা? ভীষ্ম?
  • b | 24.139.196.6 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৮:৪০56407
  • ভীষ্ম।
  • de | 24.139.119.174 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৯:১২56408
  • খুবই ভালো লেখা - এই যুদ্ধের লেখাগুলো একত্তর করে একটা বই হোক।

    কর্ণ অর্জুন বাদ্দিয়ে আর কোন পান্ডবকে না মারার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কুন্তিকে - মহাভারতের বড়ো প্রিয় চরিত্র!
  • de | 24.139.119.174 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৯:১৩56409
  • ওটা ভীষ্মের সাথেই -

    কর্ণের ছোঁড়া বাণ থেকে বাঁচতে কৃষ্ণ পায়ের চাপে রথ মাটিতে ঢুকিয়ে নীচু করেছিলেন -
  • sch | 132.160.114.140 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৯:১৬56410
  • ডিডি-দার এই লেখাগুলো একসাথে বের করার ব্যবস্থা হলে ভালো লাগবে। ডিডি দা'র ওপরে আরো শ্রদ্ধা হয় এই কারণে যে মহাভারতের ওপর এত দখল সত্তেও উনি একটা কলি'র বেদব্যাস টাইপের ইমেজ তৈরীর চেষ্টা করেন না। ভালো থাকুন ডিডি দা - সুস্থ থাকুন আর অনেক অনেক এরকম লেখা লিখুন
  • de | 24.139.119.174 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৯:২০56411
  • কর্ণের একটা অর্জুনকে মারার জন্য বাঁচিয়ে রাখা অস্ত্র ঘটোৎকচকে মারতে খরচা হয়ে যায় না? ওটাও বোধহয় পরশুরামের কাছ থেকে পাওয়া ছিলো -
  • sch | 132.160.114.140 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৯:২১56412
  • একাঘ্নী বাণ
  • de | 24.139.119.174 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ০৯:২৪56413
  • হ্যাঁ - নামটা একদম ভুলে গেসলাম - থ্যাংকু, স্চ -
  • PM | 59.14.100.79 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ১০:০৮56414
  • ধন্যবাদ দে
  • b | 135.20.82.164 (*) | ১৮ মার্চ ২০১৬ ১১:৪৭56415
  • পরশুরাম না। ইন্দ্র। ঐ কবচ কুন্ডলের নাকের বদলে নরুণ।
    আর দে যেটা বললেন, সেটা ইন্টারেস্টিং। খান্ডবদাহনের সময় অনেক সর্প মারা যান, তাদের মধ্যে ছিলেন অশ্বসেনের মা। অর্জুনের প্রতি রাগে কর্ণের বাণে প্রবেশ করেছিলেন অশ্বসেন, তার ফলে খুব মারাত্মক হয়ে ওঠে সেই অস্ত্র। কৃষ্ণ টের পেয়ে পায়ের চাপে রথ হেলিয়ে দ্যান, ফলে বাণ লক্ষভ্রষ্ট হয়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। চটপট প্রতিক্রিয়া দিন